ভূমিকা:
সব মানুষই এক ভগবানের সন্তান, অথচ দেশেই মানুষের মধ্যে নানাভাবে নানা রকমের ভেদ-বিভেদ রয়েছে। কিন্তু মানুষের সব-চেয়ে সাংঘাতিক রকমের সামাজিক ভেদ ভারতবর্ষে। আবার সব-চেয়ে সকল মানবের মধ্যে সাম্য ও অভেদের বাণী উচ্চারিত হয়েছেও এই ভারতেই। ভারতের মহাপুরুষেরা সকলেই মানবের মধ্যে নানা ভেদ-বিভেদের অবসান করবার মহামন্ত্রই ঘোষণা করে গিয়েছেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে ভারতে যা আছে এবং যা হওয়া উচিত—অর্থাৎ এখানকার ভূত ও ভব্যের মধ্যে একটা মস্ত অসংগতি বরাবরই চলে আসছে।
ভারতের নানা ভেদবিভেদের মধ্যে যোগস্থাপনার জন্য যুগে যুগে ভগবান একে একে তাঁর আপন যোগ্যতম সব সাধককে পাঠিয়েছেন। এই যোগ আজও সম্পূর্ণ হয়নি। যতদিন এই যোগস্থাপন-চেষ্টার প্রয়োজন থাকবে ততদিন তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ সাধকদের ক্রমাগতই এদেশে পাঠাবেন।
মহাবীর, বুদ্ধ, রাম, কৃষ্ণ, বসব, রামানন্দ, রবিদাস, কবীর, নানক, চৈতন্য, দাদু প্রভৃতি প্রাচীন যুগের সব যোগসাধক মহাপুরুষের দল এই কাজই করে গিয়েছেন, এই যুগেও মহাপুরুষের পর মহাপুরুষ এই কাজই করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন। যুগগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেন, ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারাতে এইটেই হল মর্মকথা।
ভারতে ভগবান বৈচিত্র্যকেই চেয়েছেন বলে এখানে কোনো প্রবল সভ্যতা বা সংস্কৃতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল অন্য সভ্যতা বা সংস্কৃতিকে বিনাশ করেছি। সবাই পাশাপাশি বন্ধুভাবে বাস করেছে। বিভিন্নতা থাকলেই বা বিদ্বেষবুদ্ধি কেন জাগবে। এখানে ভগবান হয়তো চান সকল সাধনার মধ্যে মৈত্রী এবং সকল সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয়ের সাধনা। জগতে আর কোথাও ঠিক এমনতরোটি দেখা যায় না। সেখানে এক ধর্ম বা সংস্কৃতি অন্য সব দুর্বল ধর্ম ও সংস্কৃতিকে মেরে ফেলে সমস্যা সোজা করে দিয়েছে। সে সহজ পথ ভারতের নয়।
ভারতের শাস্ত্রে যা সারতম কথা তাই দিয়েই ভারতীয় সাধনার পরিচয় বা ধর্মের তাই হয়। প্রদীপের পরিচয় তার শিখায়, মানুষের পরিচয় তার প্রাণে। হীরার খনির মধ্যে হীরা অল্প, মাটিই বেশি। কবীর বলেছেন “হীরোকী ওবরী নহী”, খনিতে হীরা স্তূপাকৃতি হয়ে নেই। তবু হীরার নামেই তার পরিচয়।
ইহলোক নিয়ে সাধনা হল সংস্কৃতি, অনন্তলোক নিয়ে সাধনা হল ধর্ম। ভারতের সংস্কৃতি ও ধর্ম দুয়ের মধ্যেই অনেক যুগের অনেক মানব-মণ্ডলীর নানা দান মিলে মিশে আছে। সংস্কৃতি হতেও ধর্মেই প্রবর্তকদের পরিচয় সহজে পাওয়া যায়, তাতেও দেখা যায় ভারতের হিন্দুধর্ম কোনো বিশেষ যুগে কোনো বিশেষ মহাপুরুষের দ্বারা প্রবর্তিত হয়নি। সেইজন্য হিন্দুধর্মকে এক হিসাবে অপৌরুষেয় ধর্ম বলা যেতে পারে। ভারতে যত সংস্কৃতি বা ধর্ম এসেছে সবার সব দান একত্র মিলিত হয়েছে যে ধর্মে, তাকে কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রবর্তিত ধর্ম না বলে তার জন্মভূমির ভৌগলিক নামে তাকে ‘ভারতীয় ধর্ম’ বলাই সংগত। ভারতকে হিন্দ্ বলে। তাই এই দেশের সর্ব সংস্কৃতির সমন্বয়ে হিন্দের অর্থাৎ ভারতের, হিন্দু অর্থাৎ ভারতীয় ধর্ম বলাই ঠিক। ধর্মসাধনায় এই সমন্বয়কেই মহাত্মা কবীর ভারতের তপস্যা বলছেন। তাই তাঁর পন্থকে ‘ভারতপন্থ’ বলা হয়েছে। কবীরের শিষ্য যুগলানন্দ তাঁর সব গ্রন্থ সম্পাদনের সময় নিজেকে ‘ভারতপথিক’ যুগলানন্দ বলেই পরিচয় দিয়েছেন।
মহাত্মা কবীরের সেই ‘ভারতপন্থ’ আজও সম্পূর্ণ সাধিত হয়নি। রামমোহন রামকৃষ্ণ রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি মহাপুরুষেরা সবাই এই ভারতপন্থেরই সেবায় জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। এই গ্রন্থে ভারতের সাধনার ও সংস্কৃতির সেই গতিটি অল্পের মধ্যে সহজ কথায় দেখাবার চেষ্টা করে গিয়েছে। বর্তমান যুগেই নয়, মধ্যযুগেই নয়, ভারতের আদিকাল হতেই ভগবানের নির্দেশে এই সাধনা নিঃশব্দে নিরন্তর চলেছে।
কুমারের বাস জলে, তাই জলেই তার শক্তি-সামর্থ। বাঘের বসতি জঙ্গলে, সেখানেই তার প্রতাপ। দেখা যাচ্ছে জীবের পরিচয় মেলে তার ভৌগলিক বাসস্থানে। কিন্তু মানুষের মধ্যে জীব এবং শিব দুয়েরই সম্মিলন রয়েছে বলে মানুষের সবটা পরিচয় তার ভূগোলে মেলে না।
ঋষি বললেন, জীবদের ভূমিতেই ছেড়ে দেওয়া হল—“জীবান্ বিসসর্জ ভূম্যাম্”(১)। কিন্তু মানুষকে ভূমিতেই ছেড়ে দেওয়া চলেনি। মানুষের মনুষ্যত্বের উদ্ভব হল তার সংস্কৃতিতে। কাজেই মৃন্ময় লোক ছাড়িয়ে চিন্ময় জগতেই মানুষের পূর্ণ পরিচয়। স্থানগত পরিচয় তার আসল কথা নয়। গায়ত্রী মন্ত্রের ব্যাহৃতিতে প্রথমে স্থানবাচক “ভূর্ভুবঃ স্বঃ” বলেই তার পরেই মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে বলতে হল পরমদেবতার সঙ্গে ধীশক্তিগত যোগের চিন্ময় কথা :
“ভার্গো দেবস্য ধীমহি ধীয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ।”(২)
কারণ সেই চিন্ময় জগতেই যথার্থ মানবত্বের উদ্ভব ও সংস্থিতি, শুধু ভূগোলের জগতে নয়। এইজন্যই দেখতে পাওয়া যায় একই ভৌগোলিক পৃথিবীতে বাস করেও সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অন্তহীন বৈচিত্র্যেই মানুষের বৈচিত্র্য।
পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার ইতিহাসে দেখি, যেখানে সে গিয়েছে সেখানে স্থানীয় পুরাতন সভ্যতাকে ধ্বংস ও নির্মূল না করে সে তৃপ্ত হয়নি। এই ধ্বংসের ব্যাপার যে শুধু সংস্কৃতিতে অনগ্রসর অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিলণ্ডে ঘটেছে, তা নয়; আমেরিকার সুসভ্য “মায়া” ও “আজতেগ” সভ্যতারও উচ্ছেদ না করে সে নিবৃত্ত হয়নি। ভারতের সংস্কৃতির ইতিহাস অন্য রকমের। এখানে হয়তো সেরকম করে অন্যদের উচ্ছেদ করা সম্ভবও হয়নি, আর ভারতের ইতিহাস-বিধাতার গূঢ় অভিপ্রায়ও হয়তো অন্যরূপ।
ভারতের ইতিহাসে দেখা যায় আর্যদের আসবার পূর্বে আর্যপুর্ব দ্রাবিড় সভ্যতাকে আর্যেরা নষ্ট করেননি। দ্রাবিড়েরাও তৎপূর্ব সব সভ্যতার উচ্ছেদসাধন করেননি। এই ভাবে বহু সভ্যতা ও সংস্কৃতির পলিমাটি দিয়ে স্তরে স্তরে ধীরে ধীরে ভারতের সংস্কৃতিলোকটি গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি সবাই বসবাস করেছে। কেউ কাউকেও নির্মূল করেনি। বিধাতা বোধ হয় ভারতে বৈচিত্র্যের মধ্যেই একটি যোগসাধনা চেয়েছেন। তাই যখন শান্তিনিকেতনে বসে কবিসাধক রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-সাধনা প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করছেন তখন তার পাশেই সাঁওতালেরা তাদের পাড়ায় ‘বোঙ্গা’পূজায় মত্ত আছেন। পাশ্চাত্ত্য জগতে এমনটি কোথাও দেখতে পাওয়া অসম্ভব।
অতি উন্নত ও অতি অনুন্নত সাধনা এখানে পাশাপাশি রয়েছে বলে ধর্ম ও সাধনার তত্ত্বজিজ্ঞাসুর পক্ষে ভারতের মতো এমন উত্তম বিচারক্ষেত্র আর নেই। এখানে অগ্রসর অনগ্রসর সংস্কৃতির চরম দৃষ্টান্ত একই স্থানে মিলবে। পাশাপাশি নানা সংস্কৃতির যোগাযোগ জীবন্ত থাকাতে এদেশে কত রকম সাধনারই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে এবং সেইজন্যেই এই দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতির সম্পদ নানা বিচিত্র ঐশ্বর্যে ভরপুর।
জ্ঞানালোচনার পক্ষে এরূপ ক্ষেত্রে যতই সুবিধা হোক না কেন, রাষ্ট্রীয় সংহতি ও শক্তির পক্ষে এইরূপ অবস্থা সাংঘাতিক। নৌকাতে খণ্ড খণ্ড করে রাখলে নৌবিদ্যা শেখাবার পক্ষে হয়তো সুবিধা হতে পারে কিন্তু সেই রকম নৌকায় সাগর পার হতে গেলেই বিপদ। শক্তির মূল কথা সংহতি। পশুরাও সেই কথা মানে, তাই অনেক পশু দলবদ্ধ হয়েই শক্তিলাভ করে। মানুষের প্রধান সম্পদ তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতিগত ঐশ্বর্যের জন্য চাই ব্যক্তিত্ব ও বৈচিত্র। পশুরা সংহতির উপরে উঠতে পারেনি, ব্যক্তিত্বটা হল মানুষের সংস্কৃতির গূঢ় কথা।
রাষ্ট্রীয় জীবনে কিন্তু সংহতিই বড়ো কথা, ব্যক্তিত্ব সেখানে অনেক সময় বৃথা বাধা মাত্র। অথচ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্যই সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। রাষ্ট্রীয় শক্তির মূলে তাই কতক পরিমাণে পশুধর্ম রয়ে গিয়েছে।
আমাদের দেশে নানা জাতি নানাশ্রেণী নানা ভেদ-বিভেদ রয়েছে। এগুলি সংস্কৃতির সহায়ক হলেও রাষ্ট্রীয় জীবনের পক্ষে মহাসমস্যা হয়েছে। দেশে বিদেশে য়ুরোপীয়রা পূর্ববর্তী সকলকে উচ্ছেদ করেই সেই সমস্যার চমৎকার সমাধান করেছেন। আর বিচিত্রতাযুক্ত আমাদের দেশ এই সমস্যার জন্যই আজ নানাভাবে বিড়ম্বিত এবং নিগৃহীত। অথচ এর মূলে ছিল অন্য সকলকে লুপ্ত করে না ফেলবার শুভ ও উদার মনোবৃত্তি।
নানা শ্রেণীর সংস্কৃতি পাশাপাশি থাকলেই উন্নতির মাপকাঠিতে উচ্চনীচ ভেদ এসে পড়ে। তাই ভারতেও যুগে যুগে সেই ভেদ এসে পড়েছে। ভারতের ইতিহাসে যে সব মহাপুরুষ সেই ভেদবিভেদের বিচ্ছেদের ও বিদ্বেষের মধ্যে প্রীতির ও মহত্ত্বের যোগ-সেতু রচনা করতে পেরেছেন তাঁরাই আমাদের মহাপুরুষ। রাম, কৃষ্ণ, মহাবীর, বুদ্ধ প্রভৃতি মহাপুরুষেরা এই কাজই করে গেছেন। গুহকমিত্র রামকে আভীরবন্ধু কৃষ্ণকে ভারতবর্ষ নিত্য স্মরণ করে, কিন্তু বড়ো বড়ো রণজয়ীর কথা তার স্মরণে নেই। রবীন্দ্রনাথ ভারতের ইতিহাসের ধারার এই সত্যটি চমৎকার করে দেখিয়েছেন। অন্তহীন ভেদের মধ্যেও একটি অখণ্ড মহান সমন্বয়ের মহাতপস্যা ভারতের জন্য বিধাতা চিরদিন ভিতরে ভিতরে নির্দেশ করে আসছেন।
————–
১. মহানারায়ণ উপনিষৎ ১. ৪
২. ঋগ্বেদ ৩.৬২.১০