জাতিভেদ ভারতে ও বাহিরে
অন্য সকলের অপেক্ষা নিজের মান ও গৌরব অধিক হউক এই আকাঙ্খা সকলেরই আছে। বংশগৌরব প্রভৃতি নানাভাবে এই উদ্দেশ্য সাধিত হইতে পারে। বংশগৌরবও একটি প্রধান পথ হওয়ায় সকল দেশেই এই বংশগৌরব লাভ করা ও প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য অশেষবিধ প্রয়াস দেখা যায়। এইভাবেই নানা দেশে নানারকমের বংশগত কৌলীন্য বা জাতিভেদের উৎপত্তি।
মিশর দেশ অতি প্রাচীন সভ্যতার স্থান। এখানে পুরাকালে ভূম্যধিকারী, শ্রমিক ও ক্রীতদাস এই তিন শ্রেণী ছিল। ক্রমে সেখানে যোদ্ধা ও পুরোহিতের উচ্চ স্থান ও অধিপত্য হইল ও তার নিচে হইল শিল্পী ও ক্রীতদাসদের স্থান। যোদ্ধা ও পুরোহিতদিগের মধ্যেই কেহ কেহ লেখক হইলেন।
এই সব দেখিয়া ১৮২০ সালে কেরী সাহেব তাঁহার সংস্কৃত ব্যাকরণের ভূমিকায় অনুমান করিয়াছিলেন যে মিশরীয় সভ্যতা ভারত হইতে আনীত। Bigand taতাঁহার ‘Ancient and Modern History’-teতে এই চারি জাতি দেখিয়াও এই একই কথা বলেন (পৃ. ৬৭)। অন্য দেশে শ্রেণীভেদ থাকিলেও মিশরে ও ভারতে তাহা ধর্মসম্মত (পৃ. ৬৯), তাইএই দুই সভ্যতার মধ্যে সম্বন্ধ আছে(১)। নানা প্রমাণে অনেকে মনে করেন দ্রাবিড়জাতির ও দ্রবিড় সভ্যতার সঙ্গে মিশরের যোগ আছে। অন্তত মিশর আর্য নহে। তাই সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় তবে কি এই জাতিভেদ দ্রাবিড়জাতিরই বিশেষত্ব? অন্তত অন্য কোনো আর্যদেশে এইভাবে তো জাতিভেদ দেখা যায় না।
চীনদেশে, ভদ্রলোক কৃষক শিল্পী ও বণিক এই চারি শ্রেণী দেখা যাইত। বণিকদের স্থান ছিল সবার নিচে। জাপানেও এই চারি শ্রেণী; তাহা ছাড়া Eta ও Hinin-রা ছিল অন্ত্যজদের মত। তবে ইহাদের মধ্যে একেবারে মেলামেশা বা পরিবর্তন কি খাওয়াদাওয়া অথবা ছোঁয়াছুঁই অসম্ভব ছিল না।
সে-সব দেখা যায় পৃথিবীর নানা অসভ্য দেশে। যে-দেশের লোক যত আদিম অবস্থায় আছে ততই তাহাদের ছোঁয়াছুঁইর দারুণ বিচার। স্পর্শের দ্বারা নিজেদের শক্তিবিশেষ হারাইয়া যাইতে পারে, অন্যের কাছে হইতে নানা অমঙ্গল আসিতে পারে এই রকম সব ভাব। ইহাকেই প্রশান্ত মহাসাগরস্থ দ্বীপগুলিতে অসভ্য জাতির লোকেরা Mana বলিত। এখন সব দেশের পণ্ডিতেরা এই Mana (ম্যানা) কথাটিই ব্যবহার করেন(২)। রায় বাহাদুর শরৎচন্দ্র রায় মহাশয় Mana সম্বন্ধে চমৎকার আলোচনা করিয়াছেন। তাহা প্রত্যেকের দেখা উচিত।
‘Encyclopedia of Religion and Ethics’-eeএর ‘Mana’ নামক কথাটির সূচী দেখিলে নানাদেশের এই স্পর্শাস্পর্শবিচারের খবর মেলে। আফ্রিকা, ফিজি, প্রশান্ত মহাসাগরের নানা দ্বীপ, বোর্নিও প্রভৃতি নানা স্থানেই এই বিচার আছে। বোর্নিওতে গুটিতিনেক শ্রেণীও আছে। মেক্সিকো দেশেও তিন জাতি। শুদ্ধ স্পেনীয়রা উত্তম, মিশ্রিতরা মধ্যম, আদিমজাতীয়রা অধম।
সেমেটিকরা যদিও গর্ব করেন তাঁহাদের মধ্যে জাতিভেদ ছিল না তবু ইহুদিদের মধ্যে নানারকমের আভিজাত্য দেখা যায়। তাহাতেই বুঝা যায় তাঁহাদের মধ্যেও শ্রেণীবিভাগ ছিল। আরবদেশের দক্ষিণভাগে শিল্পীরাই অন্ত্যজ। তাহাদের বাস গ্রাম বা নগরের বাহিরে। ফেদারম্যান সাহেব বলেন, তাহাদের অপেক্ষাও হতভাগা অন্ত্যজ সে-দেশে আছে, তাহারা নিষ্ঠাবান মুসলমান হইলেও মসজিদের মধ্যে প্রবেশ করিতে পারে না।
আর্যরা প্রায় সব দেশেই এই সব বিষয়ে একোটু উদারচিত্ত। অর্থাৎ তাঁহারা নিজেদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ কম মানেন। রোমে যদিও অভিজাত ও প্রাকৃত (অনতিজাত) এই দুই শ্রেণী ছিল তবু তাহাদের মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান ছিল না। পরাজিত শত্রুরা অবশ্য দাস ছিল। ইংলণ্ডে অ্যাংলো-স্যাকসন যুগেও ঠিক এই ব্যবস্থাই ছিল। গ্রীসে ও প্রাচীন জার্মানিতে অভিজাতগণের একটি বিশেষ শ্রেণী ছিল।
পারসী আচার্য ধল্লা বলেন ইরানদেশীয়দের মধ্যেও চতুর্বর্ণ ছিল, যদিও এক বর্ণের লোক গুণ ও কর্মের দ্বারা বর্ণান্তরভুক্ত হইতে পারিত। আবার কেহ কেহ বলেন, জেন্দাবস্তাতে তিন রকমের বর্ণ দেখা যায়। এক দল করেন মৃগয়া, আর এক দল করেন পশুপালন, তৃতীয় দল করেন কৃষিকর্ম(৩)। কিন্তু এই কথা অন্যান্য পারসিক আচার্যেরা স্বীকার করেন না। তাঁহারা বলেন পারসিকদের মধ্যে জাতিভেদ কখনই ছিল না। হয়তো ভারতীয় ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া ধল্লা মহাশয় নিজেদের সামান্য সামান্য ভেদকেই বর্ণভেদরূপে কল্পনা করিয়াছেন। পারসীরা যখন স্বদেশে নির্যাতনবশত ভারতে আসেন তখন গুজরাতে নামিবার সময় রানা যদুর নিকট নিজেদের পরিচয় দেন। এই দেশে আশ্রয় পাইবার জন্য এদেশের সঙ্গে তাঁহাদের ধর্মের যতটা সম্ভব মিল তাহা দেখাইবার চেষ্টাই তখন তাঁহারা করিয়াছেন। যদু রানার কাছে তাঁহাদের প্রদত্ত পরিচয়-শ্লোকগুলিই তাহার সাক্ষী। তাহার মধ্যেও জাতিভেদের কথা নাই। চাতুর্বর্ন্য যদি তখন তাঁহাদের মধ্যে থাকিত, তবে এমন একটা সময়ে বর্ণাশ্রমবাদী রাজার রাজ্যে প্রবেশ প্রার্থণার উদ্দেশ্যে তাহা গোপন করিবার হেতু থাকিতে পারে না।
ভারতের জাতিভেদের স্বরূপ একটু বিভিন্ন, ঠিক ভারতীয় ভিন্ন ইহা ঠিক মত বুঝিতে পারে না। এই জাতিভেদ এখন জাতিগত। গুণকর্মবশত বিভাগের কথা শাস্ত্রে শোনা গেলেও এখন তাহা আর নাই। ভারতের বাহিরেও তো বহু আর্যজাতি আছে। কিন্তু ভারতের মত ঠিক এইরকম জাতিভেদ নাই। একমাত্র ভারতবর্ষের আর্যদের মধ্যে এই জাতিভেদটা আসিল কুরূপে?
এই বিষয়েরই আলোচনা এখানে যথাসাধ্য করিবার চেষ্টা করা যাইবে। আমরা সাধারণত প্রাচীন শাস্ত্র অর্থাৎ বেদ পুরাণ স্মৃতি প্রভৃতির উপরই আমাদের আলোচনাকে প্রতিষ্ঠিত রাখিব। দেশপ্রচলিত প্রথা ও আচারের আলোচনাও বাধ্য হইয়া করিতে হইবে। এইরূপ আলোচনায় সব সিদ্ধন্তই যে পরম ও চরম সত্য হইবে তাহা না-ও হইতে পারে। ভুলভ্রান্তিও থাকিতে পারে। তবু এই বিষয়ে যদি কাহারও কাহারও বিচার ও বিতর্ক জাগ্রত হয় তবেই শ্রম সার্থক মনে করিব। ভারতীয় জাতিভেদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ ইতিপূর্বে অনেক অনেক কাজ করিয়াছেন। আমি ঠিক সেই পথে কাজ করি নাই। তবু যখন আমার পূর্ববর্তী কাঁহারও ক্ষেত্রের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি তখন তাঁহাদের নাম করিয়াছি। এইরূপে কেতকর, উইলসন, রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রিজলী, ক্রূক প্রভৃতি সেন্সসরিপোর্ট, ক্যাম্পবেল, ঘুরে প্রভৃতির নাম করিয়াছি। ডাক্তার G. SSS. Ghurye প্রণীত ‘Caste and Race in India’ পুস্তকখানি খুব উপাদেয়। তাহার অন্তভাগে এই বিষয়ে বহু বিশেষজ্ঞের নাম ও তাঁহাদের গ্রন্থের উল্লেখ আছে। তাহা দেখিলে অনেকেই উপকৃত হইবেন।
ভারতের জাতিভেদ
ভারতে জাতিভেদের কথা বলিতে গেলেই প্রথমে জাতি কথাটার একটা সংজ্ঞা দেওয়া উচিত। জাতি জিনিসটা কি তাহা এই দেশে আমরা সবাই বুঝি। তাই বলিয়া ভাষাতে তাহার একটা সংজ্ঞানির্দেশ করা সহজ নহে। যুরোপীয় পণ্ডিতেরা নানা ভাবে এই বিষয়টা বুঝাইতে গিয়া অনেক সময় হার মানিয়াছেন। এদেশে জাতি জন্মগত। জাতির বাহিরে বিবাহ নিষিদ্ধ। মৃত্যুর পরে শবসৎকার এবং জীবিত থাকিতে আহারাদি, স্বজাতির মধ্যেই এতকাল সীমাবদ্ধ ছিল। এমন শহরে বাস, বিদেশ ভ্রমণ, হোটেল-রেস্টরাণ্ট প্রভৃতির ফলে এবং নূতন শিক্ষাদীক্ষার প্রভাবে আহারাদিগত আচারবিচার ক্রমে শিথিল হইয়া আসিতেছে।
এদেশে উচ্চতম জাতি ব্রাহ্মণ। তাঁহাদের মধ্যেও উচ্চনীচ অসংখ্য ভেদ। প্রদেশগত ভেদও গণনার অতীত। তাই ব্রাহ্মণদের মধ্যে কোন শ্রেণী উচ্চতম তাহা বলা অসম্ভব। বহু প্রদেশের বহু শ্রেণীর ব্রাহ্মণই সর্বোচ্চতার দাবি করেন। নিম্নতম জাতি যে কী তাহাও বলা কঠিন। এই উভয় কোটির মধ্যে স্তরের আর অন্ত নাই।
যে-সব জাতির জল ব্রাহ্মণাদি উচ্চ জাতির লোকেরা ব্যবহার করেন তাহারা জল-আচরণীয় অর্থাৎ ভালো জাতি। যাহাদের দেওয়া ঘৃতপক্ক খাদ্য ও মিষ্টান্ন ব্রাহ্মণেরা গ্রহণ করেন তাহারা আরও ভালো জাতি। সাধারণ স্বশ্রেণীর লোকের হাতে ছাড়া কাহারও হাতে ভাত ডাল বা রুটি ব্রাহ্মণেরা খান না।
দক্ষিণ-ভারতে স্পর্শবিচার আরও প্রবল। সেখানে যাহাদের স্পর্শে ব্রাহ্মণেরা অশুচি হন না ও যাহাদের জন ব্রাহ্মণের আচরণীয় তাহারাই ভালো জাতি। যাহাদের জন ব্রাহ্মণীরাও আচরণ করিতে পারেন তাহারা আরও ভালো জাতি। যাহাদের স্পর্শে ও জলে ব্রাহ্মণ বিধবারও অশুচিত্ব ঘটে না তাহারা তদপেক্ষা ভালো জাতি।
নীচ জাতির জল অনাচরণীয়, তাহাদের স্পর্শে অশুচিত্ব ঘটে। যাহাদের স্পর্শে মৃৎপাত্রও অশুচি হয় তাহারা আরও নীচ জাতি। যাহাদের স্পর্শে ধাতুপাত্র পর্যন্ত অশুচি হয় তাহাদের স্থান আরও নীচ। ইহাদের অপেক্ষাও যাহাদের জাতি নীচ তাহারা মন্দিরপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করিলেও মন্দির অশুচি হয়। কোনো কোনো জাতি গ্রাম বা নগরে প্রবেশ করিলে গোটা গ্রাম বা নগরই অশুচি হয়। এই সব বিষয়ের বিচার শ্রীযুক্ত শ্রীধর কেতকর মহাশয় তাঁহার রচিত ‘The History of Caste in India’ নামক পুস্তকে ভালো করিয়া করিয়াছেন (পৃ. ২৪, ২৫)।
এখনকার দিনে এই সব ছোঁয়াছুঁই ব্যাপারে অনেক স্থলে লোকের মতামতের অনেকখানি নড়চড় দেখা দিয়াছে। যাঁহারা ভাগ্যক্রমে উচ্চজাতির মধ্যে জন্মিয়াছেন তাঁহারাও অনেক সময় এতটা বাছবিচার পছন্দ করেন না, আর যাঁহারা দুর্ভাগ্যক্রমে তথাকথিত নীচজাতির মধ্যে জন্মিয়াছেন তাঁহারাও আর নিজেকে একেবারে হীন বা পতিত বলিয়া মানিয়া লইতে রাজি নহেন এবং উচ্চপক্ষীয়দের সমকক্ষতা দাবি করেন। নীচজাতির মধ্যে এখনও কিন্তু অনেক সময়েই নীচতর জাতিকে দাবাইয়া রাখিবার প্রয়াসটি রীতিমতই দেখা যায়।
উচ্চতর জাতীয় লোকেরা অনেকেই এখনো বর্ণাশ্রমব্যবস্থাকে ভালোই বলেন। স্বামী দয়ানন্দ বলেন, “ভারতের এই অসংখ্য জাতিভেদের স্থলে মাত্র চারিটি জাতি থাকুক, সেই চাতুর্বর্ণ্যও নির্ণিত হউক গুণকর্মের দ্বারা। বেদের অধিকার হইতে কোনো বর্ণই বঞ্চিত না হউক।”
মহাত্মা গান্ধী অস্পৃশ্যতার বিরোধী কিন্তু তিনি বর্ণাশ্রমের বিরোধী নহেন। শ্রীযুক্ত লক্ষ্মী নরসু ‘A Study of Caste’ নামক পুস্তকে মহাত্মাজীর কিছু মত উদ্ধৃত করিয়াছেন (P. 131)। তাহাতে দেখা যায় মহাত্মাজী বলেন, “Varnashrama is inherent in human nature, and Hinduism has reduced it to a science. It does attach by birth. A man cannot charge his Varna by choice.” অর্থাৎ, “বর্ণাশ্রম মানুষের স্বভাবনিহিত, হিন্দুধর্ম তাহাকেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। জন্মের দ্বারা বর্ণ নির্ণীত, ইচ্ছা করিলেও ইহার ব্যত্যয় ঘটিতে পারে না।” দেখা গেল এই বর্ণভেদ জন্মগত। ব্রাহ্মণ হইতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় হইতে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য হইতে বৈশ্য, শূদ্র হইতে শূদ্র উৎপন্ন। এখন এই ভেদের মূল কোথায়?
সাধারণত সকলে ঋগ্বেদের পুরুষসূক্তকেই (১০ম মণ্ডল, ৯০ সূক্ত) এই বর্ণভেদের মূল মনে করেন। তাহাতে দেখা যায়,
ব্রাহ্মনোহস্য মুখমাসীদ বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ।
উরূ তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত।। —ঋগ্বেদ, ১০.৯০.১২
অর্থাৎ, “সেই প্রজাপতির মুখ হইল ব্রাহ্মণ, বাহু হইল রাজন্য অর্থাৎ ক্ষত্রিয়, ইঁহার উরু হইল বৈশ্য এবং পদদ্বয় হইতে জন্মিল শূদ্র।” ইহাতে দেখা যায় জাতি লইয়াই মানুষ সৃষ্ট হইল। ঋগ্বেদে ব্রাহ্মণ শব্দ খুবই বিরল, তাহাও জ্ঞানী বা পুরোহিত অর্থে ব্যবহৃত। ক্ষত্রিয় শব্দও বড় একটা দেখা যায় না। বৈশ্য ও শূদ্রের উল্লেখ দেখা যায় মাত্র পুরুষসূক্তের ঐ শ্লোকটিতেই।
এখন পণ্ডিতদের মতে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডল অনেকটা অর্বাচীন অর্থাৎ আধুনিক। তাহাতে দেখা যায় মাত্র চারিটি বর্ণ। তাহার দ্বারা আমাদের দেশের অসংখ্য জাতিবিভাগের মীমাংসা হয় কেমন করিয়া? মুখে আমরা চাতুর্বর্ণ্য বলিলে কি হইবে? সেন্সস দেখিলে দেখা যায় জাতি তো প্রায় চারি হাজার, তাহার মধ্যেও ভেদ-বিভেদের অন্ত নাই।
চারি বর্ণের উৎপত্তি সম্বন্ধে এই যে সংশয় ও মতভেদ ইহা সেই যুগেও ছিল। প্রাচীনকালেও পুরুষসূক্তের এই মত সকলে মানিয়া লইতে পারেন নাই। বিষ্ণুপুরাণ আর এক স্থানে বলেন, “ভার্গ হইতে ভার্গভূমি পুত্র হইলেন। তাঁহা হইতেই চাতুর্বর্ণ্য প্রবর্তিত হইল।”
ভার্গস্য ভার্গভূমিঃ, অতশ্চাতুবর্ণ্যপ্রবৃত্তিঃ।। —বিষ্ণুপুরাণ, ৪র্থ অংশ, ৮, ৯
দক্ষ প্রজাপতি ব্রহ্মার দক্ষিণ অঙ্গুষ্ঠ হইতে জাত।
ব্রহ্মণশ্চ দক্ষিণাঙ্গুষ্ঠজন্মা দক্ষপ্রজাপতিঃ।। —বিষ্ণুপুরাণ, ৪, ১, ৫
মহাভারতে দেখি আদি সৃষ্টির কথা কহিতে গিয়া জনমেজয়কে বৈশম্পায়ন বলিতেছেন, “ব্রহ্মার ছয়টি মানসপুত্র, মরীচি অত্রি অঙ্গিরা পুলস্ত্য পুলহ ক্রতু। মরীচির পুত্র কশ্যপ, কশ্যপ হইতে এই সব প্রজা সৃষ্ট।”
ব্রহ্মণো মানসাঃ পুত্রা বিদিতাঃ ষন্মহর্ষযঃ।
মরীচিরত্র্যঙ্গিরসৌ পুলস্ত্যঃ পুলহঃ ক্রতুঃ।
মরীচেঃ কশ্যপঃ পুত্রঃ কশ্যাপাৎ তু ইমাঃ প্রজাঃ।। –আদিপর্ব, ৬৫, ১০-১১
ব্রহ্মার মানসপুত্রদের কথা সকল পুরাণেই আছে। তাঁহাদের সন্ততিই তো ব্রাহ্মণেরা। ব্রহ্মার বরুণযাগের অগ্নি হইতে ভৃগুর জন্ম, তাহার পর চলিল তাঁহার সন্ততিধারা (আদিপর্ব, ৫, ৭-৮)।
গীতাতে তো দেখি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন, “চাতুর্বণ্য আমি সৃষ্টি করিয়েছে গুণকর্মানুসারে।”
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।।–৪, ১৩
বিষ্ণুপুরাণের মতে গৃৎসমদের পুত্র শৌনকই চাতুর্বর্ণ্য প্রবর্তিত করেন।
গৃৎসমদস্য শৌনকশ্চাতুর্বর্ণ্যপ্রবর্তয়িতাভূত।।–বিষ্ণুপুরাণ, অংশ ৪. ৮, ১০
হরিবংশও বলেন, “শুনক হইলেন গৃৎসমদের পুত্র। শুনক হইতে শৌনক নামে পরিচিত ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র জাতীয় বহু পুত্র জন্মে।”
পুত্রো গৃৎসমদস্যাপি শুনকো যস্য শৌনকাঃ।
ব্রাহ্মণাঃ ক্ষত্রিয়াশ্চৈব বৈশ্যাঃ শূদ্রাস্তথৈব চ।।–২৯ অধ্যায়, ১৫১৯-২০
এই হরিবংশেই আর একটি মতেরও উল্লেখ দেখা যায়। শিবির সন্তান রাজা বলিকে ব্রহ্মা বর দেন, “তুমি বর্ণচতুষ্টয়ের স্থাপয়িতা হইবে।”
চতুরো নিয়তান্ বর্ণান্ ত্বং চ স্থাপয়িতেতি হ।।–ঐ ৩১, ১৬৮৮
হরিবংশে আরও একটি মতের কথা জানা যায়। “অক্ষয় হইতে ব্রাহ্মণেরা, ক্ষর হইতে ক্ষত্রিয়েরা, বিকার হইতে বৈশ্যেরা, ধূমবিকার হইতে শূদ্রেরা উৎপন্ন।
অক্ষরাদ্ ব্রহ্মণাঃ সৌম্যাঃ ক্ষরাৎ ক্ষত্রিয়বান্ধবাঃ।
বৈশ্যা বিকারতশ্চৈব শূদ্রা ধূমবিকারতঃ।।–হরিবংশ, ভবিষ্য পর্ব, ২১০, ১১৮১৬
নানাপুরাণে সৃষ্টিকথা নানাভাবে বর্ণিত। এখানে সকলগুলির উল্লেখ করা সম্ভব নহে। তবু আরও দুই-একটা কথার উল্লেখ করা যাইতেছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখি
ব্রহ্ম বা উদমগ্র আসীদ্ একমেব তদেক্যসন্ ন ব্যভবৎ তচ্ছ্রেয়োরূপম্ অত্যসৃজত ক্ষত্রম্।–১, ৪, ১১
একমাত্র এই ব্রহ্মই অগ্রে ছিলেন, একা বলিয়া তিনি বৈভবহীন ছিলেন, তাই তিনি শ্রেয়োরূপ ক্ষত্রিয়কে সৃষ্টি করিলেন। এখানে প্রথমে ক্ষত্রিয়সৃষ্টির কথাই পাইতেছি।
মহাভারতে শান্তিপর্বে অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন “দেবদেব বরপ্রদ নারায়ণের বাকুসংযমকালে তাঁহার মুখ হইতে ব্রাহ্মণেরা প্রথমে প্রাদুর্ভূত হইলেন। পরে ব্রাহ্মণ হইতে অন্যান্য বর্ণ প্রাদুর্ভূত হইল।”
বাক্যসংযমকালে হি তস্য বরপ্রদস্য দেবদেবস্য ব্রাহ্মণাঃ প্রথমং প্রাদুর্ভুতা ব্রাহ্মণেভ্যশ্চ শেষা বর্ণাং প্রাদুর্ভূতাঃ।।–মহাভারত, শান্তিপর্ব, ৩৪২, ২১
তাহার পরে দেখা যায় যেহেতু ব্রাহ্মণ হইতেই অন্য তিনটি বর্ণ সৃষ্ট তাই তাহারাও ব্রাহ্মণের জ্ঞাতির স্বরূপ।
তস্মাদ্বর্ণা ঋভবো জ্ঞাতিবর্ণাঃ
সাংসৃজ্যন্তে তস্য বিকার এব।।–মহাভারত, শান্তিপর্ব, ৬০, ৪৭
এখানে টীকাকার নীলকণ্ঠ বলিতেছেন, “যেহেতু তিন বর্ণের মধ্যে ব্রাহ্মণই যজ্ঞস্রষ্টা, তাই তাহা হইতে জাত সকল বর্ণই যজ্ঞসংযোগবশতঃ ঋজু অর্থাৎ সাধু।”
যস্মাৎ ত্রিষু বর্ণেষু ব্রাহ্মণো যজ্ঞস্রষ্টা তস্মাত সর্বেহপি বর্ণা ঋজবঃ এব যজ্ঞসংযোগাৎ। (তত্র টীকা)
মহর্ষি জৈমিনিও বলেন, “চতুর্মুখ ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রারম্ভে অগ্রে ব্রাহ্মণগনকেই সৃজন করিয়াছিলেন, পশ্চাৎ পৃথক পৃথক সমস্ত বর্ণ তাঁহাদেরই বংশে উৎপন্ন হইয়াছে।”
সসর্জ ব্রাহ্মণানগ্রে স্ররষ্ট্যাদৌ স চতুমুখঃ।
সর্বে বর্ণাঃ পৃথক পশ্চাৎ তেষাং বংশেষু জজ্ঞিরে।।–পদ্মপুরাণ, উৎকলখণ্ড, ৩৮, ৪৪
এই জন্যই মহাভারত বলিলেন, “পূর্বে জগতে একমাত্র বর্ণ ছিল, তারপর কর্মক্রিয়াবিশেষবশতঃ চতুর্বর্ণ প্রতিষ্ঠিত হইল।”
একবর্ণমিদং পূর্বং বিশ্বমাসীদ যুধিষ্ঠির।
কর্ম-ক্রিয়াবিশেষেণ চতুর্বর্ণং প্রতিষ্ঠিতম্।।
শান্তিপর্বের ১৮৮ অধ্যায়ে দেখা যায় মহর্ষি ভৃগুরও বর্ণের উৎপত্তি সম্বন্ধে এই একই মত। বিষ্ণুপুরাণে চতুর্থাংশে কয়েকটি অধ্যায়ে দেখান হইয়াছে মনুর নানা পুত্র হইতেছে নানা জাতির উৎপত্তি।
বিভিন্ন প্রদেশের পুরাণে আবার জাতিসৃষ্টি সম্বন্ধে বিভিন্ন রকমের কথা পাওয়া যায়। মহিশূর প্রদেশের একটি পুরাণ কথাতে পাই যে বৈশ্যবংশ নিজপাপে ব্রহ্মার শাপে নির্মূল হইয়া যায়। পরে বল্কল ঋষি কুশনির্মিত সহস্য মানুষকে প্রাণ দান করিয়া সহস্র গোত্রের বৈশ্য সৃষ্টি করিলেন।(১) কাজেই মানুষ ও জাতি সৃষ্টি সম্বন্ধে আমাদের শাস্ত্রে অসংখ্য মত রহিয়াছে। ভাগবতেও দেখিতে পাই,
এক এব পুরা বেদঃ প্রণবঃ সর্ববাত্ময়ঃ।
দেবো নারায়ণো নান্য একাগ্নির্বর্ণ এব চ।।–৯, ১৪, ৪৮
শ্রীধর স্বামীর ভাষ্যানুসারে অর্থ পাই যে পূর্বে সর্ববাঙ্ময় প্রণবই একমাত্র ছিল বেদ। একমাত্র দেবতা ছিলেন নারায়ণ, আর কেহ নহেন। একমাত্র লৌকিক অগ্নিই ছিলেন অগ্নি, এবং বর্ণ ছিল যাহার নাম হংস।
কারণ পুরাণেও আছে,
আদৌ কৃতযুগে বর্ণো নৃণাং হংস ইতি স্মৃতম্।
আদিতে সত্যযুগে মানুষের হংস নামেই একমাত্র জাতি ছিল।
সেই সত্যযুগে পাপপুণ্যের সৃষ্টি হয় নাই, তখন বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা হয় নাই, কাজেই তখন বর্ণসঙ্করও ছিল না!
অপ্রবৃত্তিঃ কৃতযুগে কর্মণোঃ শুভপাপয়োঃ।
বর্ণাশ্রমব্যবস্থাশ্চ ন তদাসন্ ন সঙ্করঃ।।–বায়ুপুরাণ, ৮, ৬০