বিমানবিহারের বাসনা মানুষের সার্বজনীন ও বহুকালের পুরানো এবং তা পূরণও করেছেন কেউ কেউ হাজার হাজার বছর আগেই। প্রাচ্যের ও প্রতীচ্যের ধর্মীয় ও পৌরাণিক পুঁথিপত্তরে তার বহু বিবরণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। তার মধ্যে বহু ক্ষেত্রেই মানুষের উড্ডীন যান ছিলো পাখী। যেমন – লক্ষ্মীদেবীর বাহন পেচক, সরস্বতীর বাহন হংস, বিষ্ণুর বাহন গরুড় এবং বাদশাহ নমরুদ নাকি উড়েছিলেন শকুন পাখীর সাহায্যে। আবার কেউ কেউ রথে গোড়ীতে) চেপে উড়েছেন এবং বাদশাহ সোলায়মান নাকি উড়েছেন তার সিংহাসনে চেপেই। কিন্তু এরা সবাই উড়েছেন পৃথিবীর কাছাকাছি, বায়ুমণ্ডলের মধ্যে, এঁদের কেউই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে মহাকাশে যাননি বা যেতে পারেননি। তবে এঁরা সবাই উড়েছেন আপন আপন প্রচেষ্টায়। এ ছাড়া আর একভাবে মানুষ মহাকাশ (স্বর্গ) ভ্রমণ করেছে। কিন্তু তা তাদের আপন প্রচেষ্টায় নয়। মহাকাশ ভ্রমণ করেছেন তাঁরা ঈশ্বর প্রেরিত স্বগীয় দূতের আহানে স্বগীয় যানে আরোহণ করে। আর সেখানে তারা দেখেছেন অত্যাশ্চর্য ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, সাক্ষাৎ করেছেন ঈশ্বরের সাথে, আবার স্বর্গদূতেরা ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন তাদের নিজ নিজ ঠিকানায়। এহেন মহাকাশ ভ্রমণকে ইসলামিক ভাযায় বলা হয় ‘মে্রাজ বা ‘মেয়ারাজ।
মুসলমানদের মতে ওভাবে মহাকাশ ভ্রমণ বা মেরাজ গমন করেছেন একমাত্র শেষ পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদ (দ)। বস্তুত তা নয়। মহর্ষি এনক ঐভাবে মে’রাজ গমন করেছিলেন খ. পূ, প্রায় ৩০০০ অব্দে এবং মহর্ষি ইজেকিয়েল ও মহর্ষি ইলাইজা মে’রাজ গমন করেছিলেন খু পু প্রায় ৬০০ অব্দে। খ. পূ. প্রায় ২০০০ অব্দে মহাপ্রবর ইব্রাহীম মে’রাজ গমন করেছিলেন বলেও শোনা যায়। তবে তা তৌরিত তথা পবিত্র বাইবেলে লিখিত নেই, তা জানা যায় অন্যান্য সূত্রে। আর শেষ নবী মেরাজ গমন করেন কোন তারিখে, তা তো মুসলমান মাত্রেই জানেন। এ সমস্ত মনীষীগণ প্রত্যেকেই মহাকাশে লক্ষ লক্ষ মাইল পথ ভ্রমণ করে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন অতি অলপ সময়ের মধ্যে। কিন্তু তখনকার সকল লোকে এবং আজও অনেকে তাঁদের সে মহাকাশ ভ্রমণের বিবৃতি বিশ্বাস করতে চায়নি। এমনকি ভ্রমণকারীদের আগনদলীয় কিছুসংখ্যক লোকও ছিলেন বা আছেন যারা ও বিষয়ে সন্দিহান।
উপরোক্তরূপ মহাকাশভ্রমণ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে সাম্প্রতিককালে, তা প্রকাশ করেছেন জর্জ অ্যাডামকি নামে জনৈক আমেরিকাবাসী। তাঁর সে বিবৃতি লিপিবদ্ধ করার আগে সংক্ষেপে তাঁর পরিচয়টা দিয়ে নিই।
জর্জ অ্যাডামকির জন্ম পোল্যাণ্ডে ১৮৯১ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখে। যখন তাঁর বয়স প্রায় দুবছর, তখন তাঁর বাবা-মা আমেরিকা গিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন। তারা থাকতেন নিউইয়র্কের কাছে ডানকার্ক শহরে।
জর্জ স্কুলে বেশিদিন পড়তে পারেন নি। কিন্তু তাই বলে যে লেখাপড়া শেখেননি তা নয়। বরঞ্চ বাড়িতে পড়ে তার বয়সী বালক-বালিকা অপেক্ষা বেশীই শিখেছিলেন। যখন তিনি একটু বড় হলেন, মনে যখন কিশোর, তখন তিনি ভাবতে শুরু করলেন – মানুষ ঝগড়া-বিবাদ না করে মিলে-মিশে থাকতে পারে না কেন? তখন থেকেই তিনি ভাবুক। আকাশের প্রতি আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশী। কিন্তু তিনি ইতিহাস এবং ভূগোল উত্তমরূপে পড়েছিলেন।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান। কিন্তু জানতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার সঙ্গতি তার বাপমায়ের নেই। এজন্যে তাঁর কোনো অভিযোগ ছিলো না। তিনি নিজে কাজ করতেন, রোজগার করতেন ; কিন্তু সংসারে দিয়ে এমন উদ্ধৃত্ত থাকতো না যা দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন।
সারা দেশটাকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ভাবলেন। যেখানে যা বা যার কাছে যা পারলেন তিনি তাই শিখতে লাগলেন ; কোনো ব্যক্তিবিশেষের কাছেই হোক, লাইব্রেরীতেই হোক কিংবা মিউজিয়মেই হোক। শিক্ষা তাঁর সম্পূর্ণ হয়েছিলো।
১৯১৩ সালে জর্জ আমিতে যোগদান করেন। থাটিন্থ ক্যাভালরির সঙ্গে তাঁকে ডিউটিতে পাঠানো হয় মেকসিকো সীমান্তে। ১৯১৯ সালে তিনি আর্মি থেকে ছাড়া পান। তাঁর কাজের প্রশংসা করা হয়েছিলো। ইতিমধ্যে ১৯১৭ সালে বড়দিনের দিন মেরি সিমবারকির সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিলো। আমি থেকে ছাড়া পেয়ে রুজি-রোজগারের চেষ্টায় জর্জ অ্যাডামস্মিক বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। এশহর থেকে ওশহর, ওগ্রাম থেকে এগ্রাম ঘুরে বেড়ান, যেখানে কাজ পান সেখানেই থেকে যান। এতে তাঁর অভিজ্ঞতাও বাড়ে প্রচুর, ভালোও লাগে ঘুরে বেড়াতে।
এভাবে চল্লিশ বছর পর্যন্ত কাটিয়ে দেবার পর অ্যাডামস্কি স্থির করলেন – আর ঘুরে বেড়ানো নয়, এবার থিতু হয়ে বসা যাক। লাগুনা বিচ নামে একটি গ্রাম বেছে নিলেন এবং সেখানে তিনি মাষ্টারী আরম্ভ করে দিলেন।
১৯৪০ সালে অ্যাডামকি লাগুনা বিচ থেকে ভ্যালি সেন্টারে উঠে গেলেন। “ভ্যালি সেন্টার হলো ক্যালিফোর্নিয়ায় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মানমন্দির মাউন্ট প্যালোমার যাবার রাস্তায়। তাঁর বাড়ির নাম ‘প্যালোমার গার্ডেন’।
অ্যারিজোনার মরু অঞ্চলে ডেজার্ট সেন্টার গ্রাম। ১৯৫২ সালের ২০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সেখানে মহাকাশ (ভেনাস গ্রহ) থেকে ফ্লাইং সসারে আগত জনৈক মহাকাশচারীর সাথে অ্যাডামকির সাক্ষাৎ হয়। সে সাক্ষাৎকারের বিবরণ লিখে তিনি প্রকাশ করেন ফ্লাইং সসারস্ হ্যাভ ল্যাণ্ডেড নামে একখানা যুগান্তকারী বই। অতঃপর ১৯৫৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ার ফ্লাইং সসারে চেপে দুজন মহাকাশচারী অ্যাডামস্কিকে তাদের সাথে মহাকাশ ভ্রমণে নিয়ে যায় এবং ভ্রমণান্তে তাঁকে পৃথিবীতে তাঁর নিজালয়ে পৌঁছে দিয়ে যায়। এবারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখে তিনি ইনসাইড দি ফ্লাইং সসার নামে আর একখানা পুস্তক প্রকাশ করেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, উক্ত পুস্তকে জর্জ অ্যাডামকি তাঁর মহাকাশ ভ্রমণের যে বিবৃতি প্রকাশ করেছেন, তার সাথে সেকালের মেরাজের কাহিনীসমূহের মৌলিক পার্থক্য বিশেষ কিছুই নেই।
এখন জর্জ অ্যাডামকির সে ভ্রমণকাহিনীর কিছু অংশ তাঁর নিজের কথায়ই বলছি –
১৯৫৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ার আমি লসএঞ্জেলস শহরে এসে পৌছলুম। আমি বাস করি শান্ত একটি শহরে আর লসএঞ্জেলসে যত মানুষ, তত গাড়ী, তত গোলমাল আর রাত্রিবেলায় চোখ ধাধানে আলো। এই শহর আমার ভালো লাগে না। তবুও আমাকে আসতে হয়েছে, কারণ আমি ডাক পেয়েছি। কিসের ডাক? শীঘ্রই জানা যাবে।
শহরের কেন্দ্রস্থলে একটা হোটেলে আমি উঠেছি। নিজের ঘরে ঢুকে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশে একবার চেয়ে দেখলুম। কেন? জানিনা। কোনো প্রেরণা লাভের উদ্দেশ্যে ? তাও তো বলতে পারছি না।
এখন সবে বিকেল চারটি বেজেছে। নিচে ককটেল বারে কিছু লোক আমাকে চিনে ফেলল। খ্যাতির বিড়ম্বনা। ইতিমধ্যে আমার বই ‘ফ্লাইং সসারস্ হ্যাভ ল্যাণ্ডেড প্রকাশিতও হয়েছে, রেডিও ও টিভিতে বক্তৃতা দিয়েছি। ক্লাবে, কলেজ হলে, বিজ্ঞান সভাতেও বক্তৃতা দিয়েছি, কাগজেও ছবি ছাপা হয়েছে।
আমাকে ওরা এক জায়গায় বসিয়ে নানা প্রশ্ন করতে লাগল। আমার খারাপ লাগছিল না। কোথা দিয়ে তিন ঘটা কেটে গেল। নিজের ঘরে ফিরে গেলুম। পোশাক পাল্টে বাইরে খেয়ে এলুম।
একজন মহিলার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। তাকে টেলিফোন করলুম। তিনি বললেন, আমাকে যেতে হবে না। তিনিই আমার হােটেলে আসছেন। রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটা পর্যন্ত কথা বলে মহিলা চলে গেলেন। আমি তাঁকে স্ট্রটকারে তুলে দিয়ে হােটেলের লবিতে বসে একটা সান্ধ্য সংস্করণ পড়তে লাগলুম।
কাগজ পড়তে ভালো লাগছে না। মন ভীষণ চঞ্চল। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। এমন সময় দুজন যুবক আমার দিকে এগিয়ে এলো। দুজনেই আমার অপরিচিত। কিন্তু তারা যেন আমাকে অনেকদিন থেকে চেনে। এইভাবে তারা আমার দিকে এগিয়ে এসে একজন আমাকে ডাকল, মি. অ্যাডামস্কি।
দুজনকে দেখে মনে হয় উঠতি ব্যবসায়ী। একজন ছফুটের ওপর লম্বা, বয়স আন্দাজ তিরিশ। দেহবর্ণ ইংরেজীতে যাকে বলে রাষ্ট্ৰী। চোখের তারা ঘোর বাদামী, দৃষ্টিতে বেশ কৌতুক মাখা। মাথার কালো চুল ব্যাকাব্রাশ করা।
অপরজন মাথায় খাটাে, বয়স বোধহয় তিরিশ হয়নি, গোল মুখ বালকের মতো। বেশ ফর্সা, চোখের তারা নীলাভ ধূসর। মাথার চুল বাদামী এবং কোকড়ানো। কারও মাথায় টুপি নেই। দুজনে যেনো দুই ভিন্ন দেশের মানুষ।
দ্বিতীয় যুবক মি. অ্যাডামস্কি বলে হ্যাণ্ডশেক করবার জন্যে হাসিমুখে তার হাত বাড়িয়ে দিলো। তখনও আমি জানি না এরা কে ? কিন্তু যেই আমি হ্যাণ্ডশেক করলাম, আমনি আমার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল।
এইতো ১৯৫২ সালের ২০ নভেম্বর তারিখে অ্যারিজোনার মরু প্রান্তরে ভেনাস গ্রহের সেই যুবক আমার সঙ্গে এইভাবে হ্যাণ্ডশেক করেছিল। এতক্ষণ আমার মনে সন্দেহ উকিঝুকি মারছিল, মারছিল, কিন্তু এবার আমি বুঝলাম এরা ভিন্ন গ্রহের মানুষ। কিন্তু দুজনের চেহারার এত পার্থক্য কেন ? পার্থক্য কেন পরে জানতে পেরেছিলুম।
ওদের মধ্যে যার বয়স কম সে আমাকে বলল, আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আপনাকে আমরা এখন একটু বাইরে নিয়ে যেতে চাই। আপনার কি সময় হবে?
নিশ্চয় চলুন। আমি কিছু চিন্তা না করেই রাজি হয়ে গেলুম।
হােটেল থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লুম, আমি মাঝখানে, ওরা দুপাশে দুজন। এক জায়গায় অনেক গাড়ী রাখা ছিল। একটা গাড়ীতে আমাকে ওরা উঠতে ইশারা করে নিজেরাও উঠল। কমবয়সী যুবকটি ড্রাইভারের সিটে বসল। গাড়ীখানা আমেরিকায় তৈরী, কালো রং, বেশ বড়, পন্টিয়াক সিডান।
আমরা বসার সঙ্গে সঙ্গে সে গাড়ী ছেড়ে দিল এবং যে কোন সুদক্ষ ড্রাইভারের মতো গাড়ী চালিয়ে নিয়ে চলল। পথ তার উত্তমরূপে চেনা বলে মনে হলো। আমার খুব অবাক লাগছিল, আমি কোনো কথা বলতে পারছিলুম না, মনে নানা প্রশ্ন।
নীরবতা ভঙ্গ করে অপর যুবকটি যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, আপনার ধৈর্যের প্রশংসা করতে হয়, কারণ এতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমাদের সম্বন্ধে কোনো কৌতুহল প্রকাশ করেননি, জিজ্ঞাসাও করেননি আমরা আপনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি।
আমি মৃদু স্বরে বললুম, আমি জানি তোমরা নিজেরাই বলবে।
মৃদু হেসে যুবক বলল, ঐ ছেলেটা যে গাড়ী চালাচ্ছে ও হলো মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দা, যাকে তোমরা বল মার্স আর আমি আসছি শনি অর্থাৎ স্যাটার্ণ থেকে।
যুবকের বাচনভঙ্গি স্পষ্ট এবং উচ্চ কণ্ঠে কথা বলে। কথা বলার ধরণ এমন চমৎকার যে, অবিশ্বাস করার কোনো কারণ পাওয়া যায় না।
গাড়ী চালাতে চালাতে কনিষ্ঠ যুবক বলল, আমরা হলুম আমাদের গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগকারী ব্যক্তি, যাদের আপনারা বলেন “কস্টাইম্যান (সেকালের ফেরেস্তা?)। আমরা পৃথিবীতে কয়েক বছর হলো আছি, গোড়ার দিকে আমাদের ইংরেজী উচ্চারণে কিছুটা জড়তা ছিল, কিন্তু এখন তা আমরা কাটিয়ে উঠেছি। আমরা এখন আপনাদের সঙ্গে মিশে গেছি। অন্য গ্রহের মানুষ বলে কেউ আমাদের চিনতে পারে না, অবশ্য আমরাও আমাদের পরিচয় কারো কাছে প্রকাশ করি না।
জ্যেষ্ঠ যুবক বলল, সেটা বিপজ্জনক হবে, তবে দেখুন, পৃথিবীর মানুষ তাদের যতটা না চিনতে পারে, আমরা তার চেয়ে বেশী চিনতে পারি।
আমি বললুম, বুঝেছি, তুমি বলতে চাইছ যে, আমি আমাদের আর একজন মানুষকে যতটা না চিনতে পারি, তার চেয়ে তোমরা আমাদের আরও ভালো করে চিনতে পার, এই তো? ঠিক তাই, আচ্ছা একটা কথা, আপনি তো বিশ্বাস করেন যে, অন্য গ্রহে আমাদের মতোই মানুষ আছে এবং এজন্য আপনাকে অনেক বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে, কারণ আপনাদের বিজ্ঞানীরা বলেন যে, অন্য কোনো গ্রহে জীবন অসম্ভব। অতএব আপনি যদি এখন গাড়ী থামিয়ে চিৎকার করে রাস্তার মানুষদের বলেন যে, দেখ এই দুটি মানুষ, এরা পৃথিবীর নয়, একজন মঙ্গল গ্রহের এবং অপরজন শনি গ্রহের – তাহলে অবস্থাটা কি হবে?
তাহলে আমাকে তো পাগল বলবেই এবং তোমাদেরও হেনস্থা কম হবে না। কেউ বিশ্বাসই করবে না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। আমার মনে কিন্তু এক মিনিটের জন্যেও সন্দেহ জাগেনি। আমি ওদের কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছি।
জ্যেষ্ঠ যুবক বলল, আমরা অবশ্য মাঝে মাঝে আমাদের গ্রহে ছুটি কাটিয়ে আসি। হ্যা, বলিনি, আমরা দুজনই এখানে চাকুরী করি এবং আমাদের মতো আরও অন্য গ্রহবাসী আছে।
আমার ইচ্ছে হয়েছিল, একবার জিজ্ঞাসা করি, তোমরা কি বিয়ে করেছ? তোমাদের বৌছেলেমেয়ে কি এখানে থাকে? কিন্তু পরমুহূর্তে মনে হলো, না ওরা একাই থাকে। কে জানে ওদের গ্রহে বিবাহ করার রীতি আছে, না অন্য কোনোরকম রীতি আছে। টেলিপ্যাথির দ্বারা ওরা যদি আমার মনের কথা বুঝতে পারে, তা হলে ওরা নিজেরাই জবাব দেবে।
আমি আবার মনে মনে ভাবতে লাগলুম, পৃথিবীতে তো আরো অনেক লোক আছে এবং অনেক বিজ্ঞানীও আছেন যারা বিশ্বাস করেন অন্য গ্রহে মানুষ থাকতে পারে না। তা ভিন্ন গ্রহের এই বাসিন্দারা তেমন মানুষ বা বিজ্ঞানীর সঙ্গে যোগাযোগ না করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল কেন? অবশ্য বায়ান্ন সালে বিশে জুন তারিখে ভেনাসের সেই মানুষটি আমাকে বলে গিয়েছিল যে, আমার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবে। কিন্তু এদের দুজনের মধ্যে কেউ তো ভেনাসের মানুষ নয়। কারণ যা-ই হোক, মনে মনে আমি কৃতজ্ঞ।
স্যাটারিয়ান অর্থাৎ শনিবাসী আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, তোমার সঙ্গে কিন্তু আমরা প্রথম যোগাযোগ করলুম না, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কেউ আমাদের বিশ্বাস করেনি, কেউ করেছে, সে কথা সে অপরকে বলেছে, তার কথা তো বিশ্বাস করেনি উল্টো প্রচুর লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে, এই ভয়ে বাকী ক’জন যারা আমাদের বিশ্বাস করেছে তারা আর মুখ খোলেনি।
প্রায় দেড় ঘটা গাড়ী চলল। কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছি না, বাইরে অন্ধকার (মে’রাজের ঘটনা সমস্তই ঘটেছে রাতে), এদিকের পথ-ঘাট আমি ভাল চিনিও না। আমিও জিজ্ঞাসা করিনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, ওরাও বলেনি।
সোজা রাস্তা ছেড়ে এবার গাড়ী ডানদিকে একটা কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলতে লাগল।
মঙ্গলবাসী বলল, তোমাকে আমরা অবাক করে দেব, অপেক্ষা কর।
মনে মনে বলি, অবাক তো করেই দিয়েছ।
যাই হোক, গাড়ী যাচ্ছে। রাস্ত নির্জন, কোনো গাড়ী বা মানুষ চলছে না। পনের মিনিট কাটল। কিন্তু দূরে ওটা কি? ঝিকমিক করছে, আবার অনুজ্জ্বল কি যেন একটা দাড়িয়ে আছে মাটির ওপর।
গাড়ী যখন আরও খানিকটা এগিয়ে গেল, তখন চিনতে পারলুম, অ্যারিজোনার ডেজার্ট সেন্টারে তিন মাস আগে দেখা সেই রকম একটা ফ্লাইং সসার। ওরা ওটাকে বলল – স্কাউট (বোরাক?)।
এই সসার বা স্কাউট আমার দেখা সসারের মতো প্রায়, তবে এর কিছু বেশী বোধহয়, কুড়ি ফুট হবে।
গাড়ী থামল। স্কাউটের কাছে গাড়ী থেমেছে। গাড়ীতে বসে দেখতে পেলুম স্কাউটটির সামনে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ কি কাজ করছে। গাড়ী থেকে নেমে আমরা সকলে সেই স্কাউটের কাছে এগিয়ে গেলুম। কাছে আসতে মানুষটি ঘুরে দাঁড়াল, আরে এতো আমার পরিচিত সেই ভেনুশিয়ান।
সে হাসিমুখে আমাকে অভ্যর্থনা করে বলল, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলুম। লক্ষ্য করলুম, সেবার সে কথা বলেনি, আকারে-ইঙ্গিতে ও টেলিপ্যাথির সাহায্যে আমরা ভাববিনিময় করেছিলুম। কিন্তু এবার সে কথা বলল, তবে এদের মতো স্পষ্ট নয়।
সে আরও বলল, স্বকাউটটার একটা যন্ত্রাংশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল, সেটা এই ফঁাকে মেরামত করে নিলুম। কথা বলতে বলতে সে ছোট ধাতব একটা পদাৰ্থ বালির ওপর ফেলে দিলো। আমি সেটা তুলে নিলুম এবং সেটি আমার কাছে এখনো আছে।
রাসায়নিকরা সেই ধাতুখণ্ডটি পরে পরীক্ষা করে রায় দিয়েছিলেন যে, এটি কোনো মৌলিক ধাতু নয়, একাধিক ধাতু মিশ্রিত অ্যালয়, তবে কি কি ধাতু মিশিয়ে অ্যালয় তৈরী হয়েছে তা তারা বলতে পারেননি।
আমি যখন সেই ধাতুখণ্ডটি তুলে নিয়ে পকেটে রাখছিলুম, তখন ভেনুশিয়ান মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করেছিল, ওটা নিয়ে কি করবে? আমি বলেছিলুম, পরে কাজে লাগতে পারে, তোমাদের সংস্পর্শে যে এসেছিলুম তার হয়তো প্রমাণ দিতে পারবো।
মৃদু হেসে ভেনুশিয়ান বলেছিল, তোমরা আর্থম্যানরা সুভেনির সংগ্রহ করতে ভালবাস, তাই না?
আমি প্রতিবাদ করিনি। আমিও মৃদু হেসেছিলুম।
এই ভেনুশিয়ানের সঙ্গে পরে আমার মাঝে মাঝে দেখা হয়েছিল, তবে মঙ্গলবাসী ও শনিবাসীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলুম। ওদের নাম জানিনা, জিজ্ঞাসাও করিনি। কিন্তু তাদের পরিচয়ের সুবিধের জন্য আমি মনে মনে ওদের নাম দিলুম। মঙ্গলবাসীর নাম দিলুম ফিরকন, শনিবাসীর নাম দিলুম রামু আর ভেনুশিয়ানের নাম দিলুম অরথন।
ফিরকন, রামু এবং অরথন এবার থেকে আমার সঙ্গী। পরে আরও সঙ্গী জুটেছিল। অরথন স্বাউটের ভেতর ঢুকবার সময় আমাকেও ভেতরে যেতে ইশারা করল। আমার হৃৎপিণ্ড বুঝি লাফিয়ে উঠলো। আমার আশা পূর্ণ হতে চলেছে। ফ্লাইং সসারের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবো, হয়তো ওরা আমাকে মহাকাশে নিয়েও যাবে।
ফিরকন ও রামু আমাকে অনুসরণ করল। ফিরকন মনে সেই মঙ্গলবাসী বলল, কি তোমাকে বলেছিলুম না অবাক করে দেব?
অ্যাডামস্কি বলছেন, প্রথমেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ছোট একটি ঘরে। ঘর ছোট হলে কি হবে, দরজা কিন্তু বেশ উচু। ঘরে ঢুকবার সময় শনিবাসী লম্বা রামুকেও মাথা নীচু করতে হলো না। ঘরে ঢুকে রামু মেঝের এক জায়গায় পা দিয়ে টিপতেই দরজা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। মেঝের নিচে এবং স্কাউটের মাথায় কোথাও মৃদু একটা আওয়াজ হচ্ছে।
ঘরে ঢুকে আমি অবাক। কোনদিকে চাইব? ছোট ঘর হলেও দেখবার ও লক্ষ্য করবার মতো কত কি রয়েছে! দরজা বন্ধ, জানালাও দেখা যাচ্ছে না, চারিদিক বন্ধ অথচ নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে না। আরও লক্ষ্য করলুম যে, রামু ফিরকন বা অরথন মহাশূন্যে উঠবার জন্য বিশেষ কোনো পোশাক পরছে না বা আমাকেও পরতে দিচ্ছে না। তবে কি এরা আমাকে নিয়ে উপরে উঠবে না? সন্দেহের দোলায় দুলতে লাগলুম।
আমাকে এরা মহাশূন্যে বা অন্য কোনো গ্রহে নিয়ে যাক বা না যাক, আমি ততক্ষণে এই স্কাউটের গঠনপ্রণালী দেখে নিই।
প্রথমেই নজর করলুম, ঘরের মাঝখানে একটি স্তম্ভ, ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। এই স্তম্ভটি নাকি মহাশূন্য থেকে চুম্বকশক্তি আহরণ করে আর সেই শক্তি হল এই স্কাউট চালক। স্তম্ভটি মেঝেতে দাড়িয়ে আছে বেশ বড় ও পরিষ্কার গোলাকার একটি লেন্সের ওপর। আর সেই লেন্স ঘিরে দুইপ্রান্তে দুটি অর্ধবৃত্তাকার বসবার বেঞ্চি রয়েছে।
লেন্সটির ব্যাস বোধহয় ছফুট হবে। লেন্সটির গঠন নিখুঁত। পরিষ্কার কিন্তু স্বচ্ছ নয়, অর্ধস্বচ্ছ।
ফিরকন আমাকে একটি বেঞ্চে বসতে বলল, নিজে আমার পাশে বসে যন্ত্রপাতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতে লাগল। উল্টোদিকের বেঞ্চে বসল রামু আর অরথন গেল কন্ট্রোল রুমে।
এবার বোধহয় স্কাউট ওপরে উঠবে। আমার সেকি পুলক, কি উত্তেজনা। অরথন কন্ট্রোল রুমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ও রামুর সামনে রবারের মতো কোনো জিনিস দিয়ে তৈরী একটা বার ধীর গতিতে পড়ল। ফিরকন আমাকে ওটা ধরতে বলল। স্কাউট ওপরে উঠবার আগে বাকুনি প্রতিরোধ করবার জন্যে এই বার। আমাদের প্লেনের সিটবেল্ট আর কি। আমার কাছে সব অবিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। কিন্তু অবিশ্বাস করি কি করে? সবই তো আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
দেওয়ালে কয়েকটা বড় বড় চার্ট টাঙানো আছে। নানা রং, নানা চিহ্ন, কিছুই বুঝতে পারলাম । না, ওরাও বলল না। আমিও জিজ্ঞাসা করলুম না।
ফিরকন বলল, এই স্কাউট চালাবার জন্যে দুজন লোক দরকার হয়। সাধারণত এগুলিতে দুজন লোকই থাকে। তবে দুজনের বেশী লোক এরা বহন করতে পারে ; এই আমরা এখন যেমন চারজন বসে আছি।
অরথনের কন্ট্রোল রুম দেখতে পাচ্ছি। জটিল কোনো যন্ত্রপাতি চোখে পড়ল না। অধিকাংশ কাজই বোতাম টিপে করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে অরথনের সামনে যেন একটা অরগান রয়েছে, তার চাবি টিপে সে স্কাউট চালাচ্ছে।
নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না তো? বিপদ ঘটলে এরা কি করে? প্যারাগুট থাকলেই বা কি হবে? প্যারাশুট খুলে মহাশূন্যে নামবে কোথায়? তবে কি মৃত্যুবরণ করে? নাকি আত্মহত্যা করে?
পাইলটের সিটের সামনে একটা পেরিস্কোপ রয়েছে। সেই পেরিস্কোপ দিয়েই পাইলট বাইরে দেখতে পায়।
ফিরকন বলল, আমাদের এই স্কাউট ঠিক তোমাদের সাবমেরিনের মতো, নিচে দিয়ে না চলে জলের অনেক ওপর দিয়ে চলছে।
দেওয়ালে যে ম্যাপ ও চার্ট টাঙানো আছে, আমার নজর তখন সেদিকে, যদিও আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ইতিমধ্যে আমাদের স্কাউট ওপরে উঠতে আরম্ভ করেছে, একবার শুধু একটু মৃদু বাকুনি অনুভব করেছিলুম। ম্যাপ ও চার্টের দিকে চেয়েছিলুম, কিন্তু হঠাৎ দেখি কি স্থানবিশেষে আলো জুলে উঠছে, বিভিন্ন রঙের ও বিভিন্ন উজ্জ্বলতার। পাইলট অর্থাৎ অরথন মাঝে মাঝে সেদিকে চেয়ে দেখছে। মনে হলো সেই আলো পাইলটকে নির্দেশ দিচ্ছে।
আমরা যে ঘরে বসে আছি সে ঘরে কিন্তু কোথাও অন্ধকার নেই, এমন কি কোণগুলিও আলোকিত। আলোর রং যে কি, তা আমি বলতে পারব না ; সাদা নয়, নীল নয়, নীলাভ সাদাও নয়, কি রকম তা বলতে পারব না। কিন্তু বেশ মৃদু আলো অথচ ঘরের প্রতিটি সামগ্ৰী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
আমাদের স্কাউট এখন পৃথিবী থেকে অনেক অনেক ওপরে উঠেছে। আমি শারীরিক কোনো অসুবিধা বোধ করছি না, নিশ্বাস নিতেও কোনো কষ্ট হচ্ছে না। স্কাউটের ভেতর নিশ্চয়ই একই বায়ুচাপ রক্ষিত হচ্ছে এবং অনন্তর অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা আছে।
ফিরকন বলল, নিচের দিকে লেন্সটা দেখছ? এই লেন্সের অনেক গুণ। পৃথিবীর যে কোনো জিনিস স্পষ্ট ও বড় আকারে দেখা যায়। এমনকি বিশেষ একটি বস্তু বা ব্যক্তিকেও পৃথকভাবে নজর করা সম্ভব।
ফিরকন আরও বলল, এই রকম একটি লেন্স কাউটের মাথায় আছে। সেটি দূর আকাশ দেখতে সাহায্য করে। মাঝখানে যে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্তত্তটি রয়েছে, ওটিই দূরবীনের কাজ করছে, আবার ওটিই এই স্কাউটের শক্তির উৎস।
দুটি পৃথক পর্দায় নিচের দিক ও ওপরের দিক দেখবার ব্যবস্থা আছে, যেন দুটি টি, ভি স্বকীন। আমি একটিতে আমাদের পৃথিবীর দৃশ্য এবং অপরটিতে নক্ষত্র দেখতে লাগলুম। কয়েকটি চেনা নক্ষত্র দেখলুম। এগুলি আমার নিজের ১৫ ইঞ্চি টেলিস্কোপে দেখার চেয়ে আরও ভালভাবে দেখা গেল।
ফিরকন বলল, নিচের দিকে দেখ, লেন্সের ভেতর চারটে মোটা মোটা কেবল দেখতে পাচ্ছ? ওদের কাজ কি ? বলছি। এই স্কাউটের নিচে তিনটে বল আছে। স্কাউট যখন নিচে নামে তখন বলগুলিও নীচে নামিয়ে দেওয়া হয়, তোমাদের প্লেনের চাকার মতো আর ওপরে ওঠবার সময় বল তিনটিকে গুটিয়ে নেওয়া হয়। বলগুলো ফাপা, ওগুলো বিদ্যুৎ ভাণ্ডার, মানে ওদের দুরকম কাজ। স্কাউটের ম্যাগনেটিক পোল থেকে তিনটে কেবল বিদ্যুৎ সংগ্রহ করে তিনটি বলে প্রবেশ করিয়ে দেয়। আর চতুর্থ কেবল-এর কাজ ভিন্ন, পাইলটের সামনে যে পেরিস্কোপ আছে সেই পেরিস্কোপ আর ম্যাগনেটিক পোল#2503;র সঙ্গে ঐ কেবল যুক্ত। কেবলগুলো সবসময় সক্রিয়। কিন্তু দেওয়ালের চার্টে আলো দেখে এদের কাজ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি আছে স্বকাউটের নিচে।
স্কাউট বা কোনো যন্ত্র বিকল হলে কি কর? আমি প্রশ্ন করি।
স্কাউট ছাড়বার আগে ভাল করে দেখে নেওয়া হয়, সেজন্যে খারাপ হয় না। কিন্তু তবুও যদি খারাপ হয় সেজন্যে প্রতি স্কাউট একটা করে ছোট কারখানা ও উপযুক্ত যন্ত্রপাতি আছে, ফিরকন বলল।
এরা আমাকে অনেক কিছু দেখাচ্ছে, অনেক কিছুর পরিচয় দিচ্ছে, কিন্তু কোন যন্ত্র কিভাবে কাজ করে তা বলছে না, জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর দিচ্ছে না।
অরথনের গলা শুনলাম, তৈরী হও, এবার আমরা বড় মহাকাশযানে প্রবেশ করব।
সে কি? এইতো পৃথিবীতে ছিলুম। কয়েক মিনিটে এত ওপরে উঠে এলুম? অরথন বলল, হ্যা, বেশী নয়, আমরা চল্লিশ হাজার ফুট ওপরে উঠেছি মাত্র, মাদারশিপ অপেক্ষা করছে, প্রথম যেদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেদিনও এই মাদারশিপ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল, তোমরা সেদিন দেখেছিলে বোধহয়।
কথা বলতে বলতে অরথন পোর্টহােল খুলে দিল। পোর্টহােলের ব্যাস দেড় ফুটের মতো হবে। তার ভেতর দিয়ে নিচে এবং কিছু দূরে আমি মাদারশিপটি দেখতে পেলুম। শূন্যে এমন নিশ্চল হয়ে ভাসছে, যেন শক্ত জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিরাট সিগারের আকারের সেই ক্যারিয়ারশিপ। ফিরকন বলল, ঐ ক্যারিয়ারশিপের ব্যাস দেড়শ ফুট এবং লম্বায় দুহাজার ফুট (ঈশ্বরের সিংহাসন?)।
অনতিবিলম্বে আমাদের স্বকাউট সেই ক্যারিয়ারশিপের ওপর এলো, ক্যারিয়ারশিপের পিঠে বিরাট একটা ডানা যেন সরে গেল আর সেই ফাক দিয়ে আমাদের স্বকাউট তার পেটের ভেতর ঢুকে পড়ল। এত আস্তে অবতরণ করল যে, আমি একটুও কঁকুনি অনুভব করলুম না।
স্কাউট থেকে আমরা বেরিয়ে এলুম। বাইরে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতে একটা কেবল, কেবলের প্রান্তে কিছু একটা আটকানো রয়েছে। লোকটি আমাদের অভিবাদন জানিয়ে সেই কেবলটি স্কাউটের একটি অংশের সঙ্গে জুড়ে দিল।
আমি সেদিকে চাইতে রামু বলল, তোমাদের মটর গাড়ী যেমন পেট্রল পাম্পে দাঁড়ালে পাম্প থেকে নজল লাগানো হোসপাইপ দিয়ে পেট্রল ট্যাংকে পেট্রল ভরে দেওয়া হয়, এটাও সেই রকম করা হচ্ছে। তবে পেট্রলের বদলে আমরা অন্য শক্তি বা জ্বালানি ভরে দিচ্ছি। বাইরে যাবার জন্যে স্কাউট সব সময় প্রস্তুত রাখা হয়, কে জানে কার কখন ডাক পড়বে।
ভেতরটা বিরাট, প্রচুর জায়গা। এই ক্যারিয়ারশিপে ছটা স্কাউট থাকে। এর ভেতর যেমন কারখানা ও ল্যাবরেটরি আছে, তেমন সকল রকম আরামের ব্যবস্থাও আছে।
আমি শুধু ভাবছি, এত বড় একটা মহাকাশযান এমন নিশ্চল হয়ে কি করে দাড়িয়ে আছে।
একধারে মহাকাশযানটি চালাবার জন্যে বেশ বড় একটি কন্ট্রোল রুম রয়েছে। দেওয়ালে নানা রকম চর্ট, ম্যাপ, গ্রাফ। এর মধ্যে আবার এক জায়গায় একটি শক্তিশালী টেলিস্কোপ বসানো আছে।
সমস্ত মহাকাশযানটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কোনো গোলমাল নেই, নেই কোনো তাড়াহুড়োর লক্ষণ। একটা রেডিও রুম তো থাকা দরকার, কিন্তু সেরকম কিছু দেখা গেল না।
আমাকে বসতে বলা হলো। বসবার ব্যবস্থাও বেশ ভালো। সোফা, কৌচ, ডিভান এবং অনুচ্চ টেবিল দ্বারা সুসজ্জিত। সোফাগুলিও বেশ আরামপ্রদ। বেশ সুন্দর কোমল আলোয় মহাকাশযানটি আলোকিত। আমি আরাম করে বসলুম। যা কিছু দেখছি সবেতেই অবাক হচ্ছি। কিন্তু এবার যা দেখলুম তাতে আরও অবাক দেখলুম দুটি অপূর্ব সুদরী যুবতী (হুর-গেলমন?) আমার দিকে এগিয়ে আসছে। যুবতী এবং এত সুদরী মহাকাশচারী আমি আশা করিনি বলেই অবাক হলুম।
ওরা এসে প্রথমে তাদের হাত দিয়ে আমার হাত স্পর্শ করল এবং পরে অতি আলতোভাবে ওষ্ঠ দিয়ে আমার গাল স্পর্শ করল মাত্র। ওরা যে সুদরী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু তাদের ত্বক প্রায় স্বচ্ছ ভালো করে তাদের অনাবৃত দেহ দেখলে বোধহয় দেহের অভ্যন্তরের রক্ত চলাচল এবং অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ দেখা যাবে। একজন আমাকে এক গ্লাস পানীয় দিল শেরাবুন তহুর?)। পান করলুম, শুধু জল কিন্তু একটু ঘন। তেষ্টা পেয়েছিল, সব জলটুকু পান করে ফেললুম। জল পান করতে করতে লক্ষ্য করলুম যুবতী দুটির পরনে গোড়ালি পর্যন্ত বুলওয়ালা এবং কবজি পর্যন্ত হাতওয়ালা একরকম হালকা রঙের গাউন। সেই পোষাক কি কাপড়ের তা বলতে পারব না, তবে দেখে মনে হয় সিন্ধ। পায়ে স্যাণ্ডাল।
দুটি মেয়ের গায়ের রঙে সামান্য পার্থক্য। দুজনেই ফর্সা, তবে একজন ওরই মধ্যে সামান্য মলিন শুনলুম সে মঙ্গলবাসিনী। আমি তার নাম দিলুম ইলমুথ আর অপরজন শুনলুম ভেনাসবাসিনী। তার নাম ভেনাস দেওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু আমি তার নাম দিলুম কালনা।
আমরা বসে কথা বলতে আরম্ভ করলুম। জানতে পারলুম যে, ওরা আরও বড় মহাকাশযান এবং দূরপাল্লার মহাকাশযান তৈরী করেছে। প্রতিটি মহাকাশযান স্বয়ংসম্পূর্ণ। ওরা মহাকাশে ঘুরে বেড়ায়। যে গ্রহে জীব আছে এবং তারা মানুষের মতই জীব, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করাই হলো তাদের উদ্দেশ্য। তারাও অনেকে মহাকাশযান তৈরি করেছে এবং তারাও অন্য গ্রহের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করার উদ্দেশ্যে সেইসব গ্রহে যাওয়া-আসা করে। ব্যতিক্রম পৃথিবী। পৃথিবীবাসীরা গ্রহান্তরের জীবদের নাকি সুনজরে দেখে না।
আমি প্রশ্ন করলুম, তোমাদের ক্যারিয়ারশিপগুলোর গতিবেগ প্রতি সেকেণ্ডে কত মাইল ? অরথন উত্তর দিল। সে বলল, মহাশূন্যে যে প্রবাহ বইছে আমরা সেই প্রবাহ অনুসরণ করে প্রবাহ স্রোতে ভেসে যাই। সেই প্রবাহ স্রোতের যে গতি, আমাদের গতিও তাই।
অরথন আর ইলমুখ উঠে পড়ল। অরথন বলল, তাদের সময় হয়ে গেছে। আমি মনে মনে ভাবি, কিসের সময়? অরথন বোধহয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিলো, বলল, দেখতেই পাবে।
একটু পরেই দেখি, ওরা দুজনে এলো পাইলটের পোশাক পরে। আমাদের পৃথিবীর পাইলটের মতো নয়। এদের পোশাক অনেক হাল্কা। দেখে মনে হয় যেন স্কি করতে যাচ্ছে। কিন্তু যারা কি করে তারা পশমের মোটা পোশাক পরে। এদের পোশাকের স্টাইলটা সেই রকম কিন্তু অনেক হান্ধা। ওরা দুজনে এবার বিরাট স্পেস ক্যারিয়ার চালিয়ে নিয়ে যাবে।
কোথায় নিয়ে যাবে? কোনো একটি গ্রহে? মঙ্গল, ভেনাস, শনি? আমিই কি প্রথম মানুষ হবো এই গ্রহ তিনটির একটিতে অবতরণ করতে, নাকি আমার আগে ওরা অন্য মানুষ নিয়ে গেছে?
আমি বসে ফিরকন, রামু এবং কালনার সঙ্গে কথা বলতে লাগলুম। ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এইটুকু বুঝেছিলুম যে, ওরা আমাদের পৃথিবীর সমস্ত খবরই রাখে। মাঝে মাঝে কন্ট্রোল রুম থেকে অরথন বা ইলমুথ এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে। ওরা আমার ওপর বেশ অনেক দিন থেকে নজর রেখেছিল এবং ঠিকই করে রেখেছিল যে, আমাকে ওরা ওদের মহাকাশযানে নিয়ে আসবে এবং ওদের নিজেদের পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানাবে, যাতে আমি নাকি সে সব কথা পৃথিবীতে ফিরে এসে মর্ত্যবাসীদের জানাতে পারি। জানাতে তো পারি এবং জানাচ্ছিও। কিন্তু আমার কথা ক’জন বিশ্বাস করবে? অথচ আমি যা বলছি এর প্রতিটি কথা সত্য — কেউ বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক।
এই তো ১৯৫১ সালে কোরিয়ার পশ্চিমে ইনচন উপসাগরে একটি সিপ্লেন থেকে সমুদ্রের ভেতরে একটি মিসাইল ক্ষেপণ করা হলো। উৎক্ষিপ্ত মিসাইলটি সবেগে সমুদ্রে ডুবে গেল, প্রতিক্রিয়ার ফলে সমুদ্রের জল একশ ফুট পর্যন্ত উচ্চে উঠল এবং একটু পরে দেখা গেল সেই শূন্যে মিলিয়ে গেল। ঠিক অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল স্কটল্যাণ্ড থেকে কিছু দূরে সমুদ্রে। এই ঘটনা শুনে কেউ তা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এ দৃশ্য বহু নরনারী প্রত্যক্ষ করেছে।
কন্ট্রোল রুম থেকে ইলমুথ একবার বেরিয়ে এসে বলল, আমরা এখন তোমাদের পৃথিবী থেকে পঞ্চাশ হাজার মাইল দূরে। ইলমুথ একটা পোর্টহেল খুলে দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল, ঐ তোমাদের পৃথিবী।
আমি দেখলুম – আমাদের পৃথিবীর ওপর সূর্যের আলো পড়েছে পৃথিবী জুলজুল করছে, কিন্তু চাঁদের মতো তার আলো স্নিগ্ধ নয়।
অন্ধকার আকাশে আমি দেখলুম কত নক্ষত্র, কেউ জোনাকির মতো ঝিকঝিক করছে, কারও দীপ্তি প্রখর, কারো স্নান। আমি অভিভূত ও আমাকে সমস্ত ক্যারিয়ার দেখাল। বলল, এটা তো ছোট, এতে মাত্র তিরিশজন মানুষ আছে, কিন্তু আমাদের এমন স্পেসশিপ আছে যা হাজার হাজার মানুষ বহন করতে পারে।
আমি প্রশ্ন করি, সেই বিশাল স্পেসশিপের মালিক কোন গ্ৰহ?
কোনো গ্রহই নয়। যখন যার দরকার সে ব্যবহার করতে পারে। ইলমুখ বলল, তুমি বুঝি কেবল তিনটি গ্রহের কথা ভাবছ? এই মহাশূন্যে অনেক গ্রহ আছে, যেখানে সভ্য ও উন্নত মানুষ বাস করে। তাদের কেউ আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে, আবার অনেকে তোমাদের চেয়েও পিছিয়ে আছে।
আমি জিজ্ঞাসা করি, তুমি যে এখন কন্ট্রোল রুম থেকে চলে এসেছ, তা তোমার ডিউটি কে করছে?
কেন? রোবট আছে। সে এই স্পেসশিপ চালাচ্ছে। তবে কন্ট্রোল রুমে অরথন আছে, আমি ফিরে গেলে অরথন আসবে, তোমার সঙ্গে কথা বলবে।
দেওয়ালে কয়েকখানা ছবি টাঙানো রয়েছে। বেশিরভাগ প্রাকৃতিক দৃশ্য। কিন্তু আমার চোখের সামনে একটা দরজার মাথায় বেশ বড় একখানা ছবি টাঙানো রয়েছে। ছবিখানা দেখে আমার মনে হলো এ ছবি নিশ্চয়ই কোনো দেবতার।
সে দেবতার নাম কি? আমি কালনাকে প্রশ্ন করি — এ ছবি কি কোনো দেবতার? তাঁর নাম কি?
তোমরা যাকে দেবতা বল ইনি তা নন, তবে ইনি হলেন আমাদের মহত্তম পুরুষ। আমি একে দেখিনি, এর কত বয়স আমি জানি না, কোন গ্রহে থাকেন তা-ও জানি না, তবে শুনেছি এরই নির্দেশে আমরা পরিচালিত হই।
তোমাদের ভেতর কেউ দেখেনি? আমি প্রশ্ন করি।
হ্যা দেখেছেন, তাকে তুমিও শীঘ্রই দেখতে পারে, তোমাদের ভাষায় তিনি আমাদের প্রভু (ঈশ্বর)। আমরাও রূচিৎ তাকে দেখতে পাই। এই মহাকাশযানে তিনি আছেন, কিন্তু আজও তার দর্শন পাইনি। তোমাকে কিছু বলবার জন্য তিনি এসেছেন, তোমার সঙ্গে আমরাও তার দর্শন পাব, তার কথা শুনবো, তার দেওয়া উপদেশ পালন করব।
পৃথিবী ছাড়ার পর থেকে আমি বোধহয় মহাশূন্যে একঘন্টাকাল বিচরণ করছি, কিন্তু এর মধ্যে আমার মনের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। বসে বসে এইসব কথাই চিন্তা করছি।
হঠাৎ অনুভব করলুম আমার সামনের চেয়ারে কোনো জ্যোতির্ময় পুরুষ বসে আছেন। মুখ তুলে দেখি ঠিক তাই। তাঁকে দেখে আমার মনে হলো, আমি কি মীশুর সামনে বসে আছি? তাকে দেখছি?
না, ইনি যীশু নন, তবে নিঃসন্দেহে একজন মহাপুরুষ। শুনলুম এর বয়স হাজার বৎসর। সে কি? দেখে তো মনে হচ্ছে শত বৎসর পূর্ণ হতে এখনও অনেক দেরি।
আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে রামু বলল, আমরা যেমন পুরনো জামা ত্যাগ করে নতুন জামা পরি, ইনিও তেমনি পুরনো দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহে প্রবেশ করেন।
তিনি (মহাপ্রভু) কিন্তু আমার সঙ্গে খুব সাধারণভাবে কথা আরম্ভ করলেন। বললেন, তোমাকে আমরা আমাদের ছোট ও বড় আকাশযান দেখিয়েছি, নক্ষত্ৰলোকের সঙ্গে কিছু পরিচয় করিয়ে দিয়েছি, যাতে তুমি পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে তোমার দেশবাসীকে এসব কথা বলতে পারো। পৃথিবী যে পারমাণবিক শক্তি নিয়ে পরীক্ষা করছে এবং মারণাস্ত্র তৈরী করছে, এজন্য তিনি শংকিত। পার্থিব মানুষের ঐখানেই ক্রটি, তারা শান্তিতে বাস করতে পারছে না।
তিনি বললেন, আমাদের বিষয়ে তোমাদের কিছুই জানা নেই, আমরা আমাদের বিষয়ে জানাবার জন্যে দীর্ঘদিন থেকে চেষ্টা করছি, কিন্তু তোমাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছি না। তিনি অনেক কথা বললেন, যার মূল সুর হলো শান্তি।
তাঁর কাছ থেকে জানলুম যে, তাঁরা পৃথিবীতে মাঝে মাঝে সৎ মানুষ পাঠাচ্ছেন, যারা মানুষকে সংশিক্ষা দিয়ে উন্নত স্তরে পৌছে দিতে পারেন। যীশু হলেন এইরকম একজন মানুষ। যীশুকে তারাই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। পৃথিবী থেকে কিছু মানুষ তারা উঠিয়ে (মে’রাজে) এনে, তাদের শিখিয়ে আবার পৃথিবীতে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পৃথিবীর মানুষ তাদের বুঝতে পারেনি, তাদের শিক্ষা গ্রহণ করেনি , তাদের তারা পাগলা গারদে নিক্ষেপ করেছে বা হত্যা করেছে।
বিদায় নেবার আগে তিনি বললেন যে, এখনও সময় আছে। তিনি আশা করেন যে, পৃথিবীর মানুষ সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে শান্তিতে বাস করবে। শেষ কথা বললেন, সেই মহত্তম পুরুষ যাকে আমরা মানবশ্রেষ্ঠ বলে মনে করি, যার ছবি তুমি দেখতে পাচ্ছ, তাঁর আশীৰ্বাদ তোমার ওপর বর্ষিত হােক। পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে তুমি আমাদের কথা বোলো।
তিনি বিদায় নেবার সঙ্গে সঙ্গে রামু ফিরকন, কালনা এবং অরথন এসে আমার সঙ্গে নানা বিষয় আলোচনা করতে লাগল। মাঝে মাঝে ইলমুথ এসে যোগ দেয়।
বেশ আলোচনা চলছিল এমন সময় রামু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল এবার তোমাকে পৌছে দিয়ে আসি, আজ সময় হয়ে গেছে। স্কাউট রেডি করা হয়েছে। ফিরকন আমাদের সঙ্গে যাবে।
সকলের কাছে বিদায় নিয়ে আমি রামু ও ফিরকনের সঙ্গে স্কাউট গিয়ে উঠলুম। রামু কন্ট্রোলের সামনে বসল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
আমি চুপ করে বসে আছি। আমি যেন আমার মধ্যে নেই। মনকে কিছুতেই স্থির করতে পারছি না। কি দেখলুম, কি শুনলুম এবং কি করব, নানারকম চিন্তা, সকল চিন্তাধারাকে কিছুতেই একটি ধারায় আনতে পারছি না।
কতক্ষণ যে এই অবস্থায় ছিলুম জানি না, ফিরকনের কথায় চমক ভাঙল, আমরা এসে গেছি, পৃথিবীতে পৌঁছে গেছি। এবার আমরা পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করছি না, মাত্র ছইঞ্চি ওপরে ভাসছি।
কন্ট্রোল থেকে উঠে এসে রামু আমার হাত স্পর্শ করে বলল, তোমাকে ফিরকন তোমার হোটেলে পৌছে দেবে। আশা করি তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে।
ফিরকন ও আমি স্কাউট থেকে বেরিয়ে এলুম। কিছুদূর হেঁটে গিয়ে গাড়ীতে উঠলুম। সেই পন্টিয়াক গাড়ী সেই নির্জন প্রান্তরে তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। ফিরকন গাড়ী চালিয়ে আমাকে নিয়ে চলল। পথে একটাও কথা হলো না। আমি অভিভূত, কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছি। জানি না আমার মতো এই বিরল অভিজ্ঞতা আর কারও হয়েছে কি না !
হোটেলের সামনে থেকে গাড়ী থামিয়ে ফিরকন আমার হাত স্পর্শ ক্রে বলল, শিগগির আবার দেখা হবে, তোমাকে আমরা জানিয়ে জানিয়ে দেব মানে তুমি নিজেই অনুভব করবে – কবে, কখনও কোথায় আমাদের দেখা হবে (এর পরেও নাকি এ মহাকাশচারীদের সাথে জর্জ অ্যাডামস্কির একাধিকবার যোগাযোগ ঘটেছিল। শেষবারে ঘটেছিলো ১৬ মার্চ, ১৯৬২ সালে – লেখক)।
আমি গাড়ী থেকে বেরিয়ে এসে হাত তুলে ফিরকনকে বিদায় জানালুম। রাস্তা তখন নির্জন, একটিও লোক ছিল না। হোটেলে প্রবেশ করে নিজের ঘরে ঢুকলুম। এই প্রথম আমার ঘড়ির কথা মনে পড়ল, দেখলুম শেষরাত্রি, ৫টা বেজে ১০ মিনিট। এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে মহাশূন্যে আমি অন্তত পঞ্চাশ হাজার মাইল ঘুরে এসেছি।
খাটের প্রান্তে বসে পড়লুম। শুতে ভুলে গেলুম। কিন্তু চিন্তা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙল বেলা আটটার সময়।
ব্রেকফাষ্ট সেরে বাসে চেপে আমি প্যালোমারে ভ্যালি সেন্টারে আমার বাড়িতে ফিরে এলুম।
প্ল্যানেট মিসট্রি, চিরঞ্জীব সেন, ১ম প্রকাশ ১৩৮৬, পৃ. ৫৬–৬৪, ৬৬–৭৭।
দূর অতীতের মানুষের কাছে স্বর্গ তথা আকাশ ভ্রমণ করাটা ছিলো একটি অলৌকিক ব্যাপার। তা বিশ্বাস করা শুধুমাত্র ধমীয় দৃষ্টিতেই সম্ভব ছিলো – ঐশ্বরিক ঘটনা বলে। অলৌকিকে বিশ্বাস রাখে এবং রাখে না, এমন কিছু মানুষ সেকালেও ছিলো এবং একালেও আছে। কিন্তু লৌকিকে বিশ্বাস রাখে না, এমন মানুষ সব যুগেই বিরল। কেননা বাস্তবকে অবিশ্বাস করার মানে নিজেকেই অবিশ্বাস করা।
মহাকাশ তথা স্বর্গ ভ্রমণ এখন আর অলৌকিক নয়, বর্তমানে তা হচ্ছে একান্তই লৌকিক ঘটনা। মানুষ চাঁদে অবতরণ করেছে, তা এখন গুরুবাদীরাও অস্বীকার করতে পারেন না। শুক্র, মঙ্গল ইত্যাদি গ্রহে রকেট পাঠানো হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে হয়তো সেখানেও মানুষ অবতরণ করবে।
সৌরজগতের ভিতরে ও তার বাইরে নক্ষত্র-জগতের কোনো গ্রহে কোনোরূপ বুদ্ধিমান জীব আছে কি-না, তার খোজখবর নেওয়া হচ্ছে এবং তাদের সাথে বেতার যোগাযোগের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাকি ইংগিতও পাওয়া যাচ্ছে দূর আকাশে বুদ্ধিমান কোনোরূপ জীব থাকার।
জর্জ অ্যাডামকির মহাকাশ ভ্রমণের বিবৃতিটি হচ্ছে লৌকিক ঘটনার একটি বাস্তবভিত্তিক বর্ণনা। জানি না আধুনিক সুধীমহল বিশেষত বিজ্ঞানীমহল তা কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবেন। অ্যাডামকির বর্ণনার বাস্তবতা প্রমাণিত হলে — দূরতীতের সকল মহাকাশচারীদের মহাকাশ্চারণও অনুরূপ সত্য, একথা অনুমান করা অসঙ্গত নয়।
ঈশ্বর নিরাকার ও সর্বব্যাপী, ধৰ্মজগতে ইহা সর্বত্র স্বীকৃত। ধর্মজগতের বাইরে নাস্তিকমহলে তথাকথিত ঈশ্বরকে মেনে নেয়া হয় না বটে, তবে তাঁরাও এমন একটি মৌলিক শক্তিকে ‘বিশুনিয়ন্তা বলে মেনে নিয়ে থাকেন যে, সে শক্তিও নিরাকার এবং সর্বব্যাপী। এ ক্ষেত্রে আস্তিক ও নাস্তিক মতবাদে বিশেষ পার্থক্য নেই। কিন্তু নাস্তিকরা – ‘নিরাকার অথচ ‘সাকার, এরূপ দ্বিমুখী ঈশ্বরতত্ত্ব মেনে নিতে রাজী নন। তাই তাঁদের বলা হয় নাস্তিক।
ধৰ্মজগতে সাকার ও নিরাকার – এ দুধরণের মতবাদ প্রচলিত থাকলেও নিরাকারবাদীগণও প্রকারান্তরে সাকারবাদীই বটে। যেহেতু বলা হয় যে, ঈশ্বর দেখেন, শোনেন, কথা বলেন, ক্রুদ্ধ হন, খুশি ও বেজার হন, সময়ে হাটাচলাও করেন এবং তিনি বসে আছেন মহাশূন্যের একটি নির্দিষ্ট স্থানে (সিংহাসনে)। সেখানে বসেই নাকি তিনি দূতের মারফতে পৃথিবীর মানুষকে সদুপদেশ দান করেন, যাবতীয় কার্য পরিদর্শন ও পরিচালনা করেন এবং সময় সময় পৃথিবীতেও আসেন ; যেমন এসেছিলেন হযরত মুসা (আ.)-এর সাথে বাক্যালাপ করার জন্য তুর পর্বতে।
মহাকাশ ভ্রমণকারী মনীষীগণ মহাকাশ ভ্রমণে গিয়ে যে ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন এবং যার কাছে মানব-কল্যাণের জন্য নানাবিধ আদেশ-উপদেশ প্রাপ্ত হয়েছিলেন — তিনি প্রভু, মহাপ্ৰভু যিনিই হােন, তিনি সর্বব্যাপী ও নিরাকার ঈশ্বর নন, নির্দ্ধিতায় তা ‘অনুমান’ করা চলে।