প্রাচীন ইরানে মার্ভ নামে একটি শহর ছিল। এখন অবশ্য এই শহরটি তুর্কেমেনিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। তো ইরানের অন্তর্ভুক্ত ছিল যখন সে সময় মার্ভে দুই বন্ধু বাস করতো। তাদের মাঝে সম্পর্ক ছিল খুবই নিবিড়। তাদের শৈশবও কেটেছে একসাথে। ছোটো বেলা থেকেই একসাথে খেলাধুলা করেছে, ঘুরে বেড়িয়েছে, এক কথায় একসাথেই বেড়ে উঠেছে। শৈশবের বন্ধুত্বের একটা বৈশিষ্ট্য হলো দুজনের মাঝে রেষারেষি মারামারি ঝগড়াঝাটি যতো যাই হোক রাত কেটে গেলে সূর্য ওঠার মতো সব আবার ফকফকা হয়ে যায়। কারণ একসাথে না হলে যে চলে না। ফলে বৈরি সম্পর্কটাও শৈশবে বেড়ে ওঠার একটা অনিবার্য সঙ্গী।কিন্তু প্রকৃতি এবং ভবিষ্যৎ এই শৈশবের অভিন্ন সময়ের মাঝে অনেক সময় ছেদ রেখা টেনে দেয়। যেমন দুই বন্ধুর একজনকে হয়তো অনিবার্য কারণে চলে যেতে হয় অন্য কোনো শহরে। কখনো লেখাপড়ার স্বার্থে কখনো বাবা-মায়ের সাথে ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের শেকল আপাতত ছিঁড়ে ফেলতে হয় একান্ত নিরূপায় হয়ে। দুই বন্ধুর একজনকেও ঠিক এভাবেই পড়ালেখা করার জন্যে চলে যেতে হয়েছিল অনেক দূরের শহরে। অন্য বন্ধু থেকে গেল তার নিজ শহর মার্ভেই। মার্ভের বন্ধু আর উচ্চ শিক্ষার জন্যে বিদেশ যাত্রা না করে এলাকাতেই ব্যবসা বাণিজ্যে মনোযোগ দিল।
ব্যবসা সে ভালোই আয়ত্ত করেছে। প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে গেছে সে। মানুষজনও তাকে খুব সমীহ করতে শুরু করল এবং সেও জনগণের বিশ্বাস এবং আস্থা অর্জন করল। হঠাৎ একদিন ঐ মার্ভের গভর্নর মারা গেলো। খলিফা তখন এই ব্যবসায়ীকেই গভর্নর নিযুক্ত করল। একদিকে ব্যবসা অপরদিকে শহরের গভর্নরের দায়িত্ব দুটোই একসাথে পালন করল এবং আরো বেশি সম্পদের মালিক হলো। নিজের জন্যে একটা বড় এবং সুন্দর বাড়িও বানাল। সেই বাড়িটাতে বসবাস করার পাশাপাশি তার দফতরও বানাল। গভর্নরের চারপাশে এখন বহু লোকজনের সমাগম। কেউ কাজে কেউ অকাজে অর্থাৎ তোষামোদি করে স্বার্থ উদ্ধারের কাজে ঘুরে বেড়ায়।
অফিস যতো বড় হলো গভর্নরের সাথে মানুষের দেখা সাক্ষাৎ করা ততোই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। দারোয়ান সহজে কাউকে ভেতরে যেতে দেয় না। তার দাপটে সবাই এখন তটস্থ। এরিমাঝে গভর্নরের শৈশবের বন্ধু পড়ালেখা শেষ করে অনেক বড় জ্ঞানী গুণী হয়ে ফিরে এলো। সবকিছুর আগে সোজা চলে গেল বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্যে তার বাসায়। সেখানে গিয়ে প্রতিবেশীদের কাছে জানল, তার বন্ধু এই বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে শহরে অনেক বড় বাড়ি বানিয়েছে, সেখানেই থাকে এবং এখন সে শহরের গভর্নর। একথা শুনে বিদ্বান বন্ধু খুব খুশি হলো এবং সোজা চলে গেল তার বাসায়। কিন্তু দারোয়ান তাকে ঢুকতে দিল না। বললোঃ তুমি কে? কী কাজে এসেছো?
বিদ্বান বললোঃ আমি বাইরের কেউ নই। গভর্নরের পুরোণো বন্ধু। বহু বছর তাকে দেখি নি তো, তাই দেখা করতে এসেছি।
দারোয়ান বললোঃ হবে না, তুমি বরং ওই গাছের নীচে বসো। গভর্নর বেরিয়ে এসে তোমাকে দেখে যদি কথা বলতে চায়, বলবে।
গভর্নরের বাসার সামনে বড় একটা চেনর গাছ ছিল। ঐ গাছের নীচে বিদ্বান বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। দুপুর থেকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এলো। গভর্নর বাইরে এলেন। তার পেছনে দুই পাশে বহু মানুষের ভীড়। তাদের সাথে কথা বলতে বলতে গভর্নর তার ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে বসলো এবং চলে গেল। চেনর গাছের নীচে অপেক্ষমান পুরোণো বন্ধুর দিকে তাকানোরও সুযোগ হলো না। বিদ্বানের মনটা কিছুটা খারাপ হয়ে গেল ঠিকই, আবার ভাবলো ‘এটাই তো স্বাভাবিক এখন। এতো লোকের সাথে কথা বললে আমার দিকে তাকাবে কখোন। আর তাকালেই কি চিনে ফেলবে নাকি। এতোদিন পরের ব্যাপার’।
পরের দিন আবারো একই ঘটনা ঘটলো, দেখা হলো না। এভাবে পর পর কয়েকদিন একইভাবে গেল। বিদ্বান ভাবলো, শৈশবের দিনগুলোর সাথে তার বন্ধুর বর্তমানের দিনগুলোর অনেক পার্থক্য। সাক্ষাতের আশা বুকে নিয়েই বিদ্বান গেল তার নিজের কাজে, শিক্ষকতার পেশায়। কিছুদিন পর শোনা গেলো গভর্নরকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং নতুন গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর কয়েকদিন বিদ্বান গেল পুরোণো বন্ধুর বাসায় দেখা করতে। এখন আর দারোয়ানের ঝামেলা নেই। বাসায় ঢুকতেই দুই বন্ধু পরস্পরকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। সাবেক গভর্নর বলল: ‘জানতাম ভুলো নি কিন্তু এতো দেরি করবে আসতে, ভাবিনি। খুব ভালো হতো যদি গভর্নর থাকাকালীন আসতে’।
বিদ্বান বলল: এসেছিলাম তো! বহুবার এসেছিলাম। তোমার দারোয়ান ঢুকতে দেয় নি। কতোদিন আমি তোমার বাসার সামনের চেনর গাছের নীচে বসে ছিলাম…! কিন্তু তোমার তো তখন এদিক ওদিক তাকানোর সময়ই হয় নি।
গভর্নর খুব দুঃখ প্রকাশ করে বলল; ঠিকই বলেছো..। অহংকারীও হয়ে পড়েছিলাম। আশপাশের তোষামোদকারীদের ছাড়া কারো দিকে তাকানোরও প্রয়োজন মনে করিনি। এতোটাই অহংকারী হয়ে পড়েছিলাম যে এতো বড় চেনর গাছটাও নজরে পড়তো না। গাছের নীচের লোক তো দূরের কথা।
বিদ্বান তখন বলল: যা হবার তো হয়েই গেছে, এখন থেকে সতর্ক থেকো অহংকার যেন তোমার দুই চোখকে আর অন্ধ করে ফেলতে না পারে।
এই ঘটনার পর থেকে যে কেউই সম্পদশালী আর ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং সেইসাথে ফেলে আসা অতীত আর পুরোণো বন্ধুদের কথা ভুলে যায়, তখনই মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে শুরু করেছে: ‘মার্ভের খানের মতো হয়ে গেছে, ঘরের সামনের চেনরটিও চোখে দেখে না’।