দেনমহর

দেনমহর

আমার বিয়ে হয়েছে এক মাস তেইশ দিন হলো। এই এক মাস তেইশ দিন জুড়েই দারুণ ভাবে আমাদের বিবাহিত জীবণে ঝগড়া উৎসব চলছে। এমন একটা ঝগড়াটে বর আমার যে কপালে ছিল তা যদি আগে জানতাম তবে এই জীবণে বিবাহ নামক কারবারে আমি থাকতাম না। বিয়ের দিন বাসর রাত থেকেই ঝগড়ার সূচনা। আমি তাকে সালাম করিনী সেই অপরাধেই ঝগড়া নামক যুদ্ধ শুরু হলো।

আমি শাড়ী আর গহণার ভার আর সইতে পারছিলাম না। আমাকে এক জন ভাবী বয়সী মহিলা বাসর ঘরে দিয়ে চলে গেলেন। সেই সুযোগে আমি চেইঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে দেখি আমার বর খাটের নিচে কি যেনো খুঁজছে। আমাকে রুমে ঢুকতে দেখে ভ্যাবাচ্যাবা খেয়ে বললো-“এই আপনি এই রুমে কি করছেন?”

ওর কথা শুনে আমি তো এক রকম হতবাক হয়ে হা করে দাড়িয়ে রইলাম। নিজের বউকে নাকি পাগলেও চেনে আর আমার বর নিজের বউকে চিনতেই পারছে না। শেষমেস একটা মাথা খারাপ ছেলের সাথে বাবা মা আমাকে বিয়ে দিলো? ভালোই হয়েছে, এই বিয়েতে আমার একটুও মত ছিল না এক রকম জোর করেই আমাকে বিয়ে দিয়েছে বাবা মা। এখন বর যদি আমাকে চিনতে না পারে তাহলে বেশ হবে। আমিও মনে মনে বুদ্ধি আটলাম।

আমি-“আসলে আমি আপনার বউয়ের চাচাত বোন” সে-“এই ঘরে কি করছেন? আর সে কই?”

এই ছেলে বিয়ের আগে তো আমাকে দেখতে গেছিল আর দেখতে গিয়ে আমার সাথে কথাও বলে ছিল তাহলে চিনতে পারছে না কেনো? ম্যামোরী লস টস হয়েছে নাকি? আবিরের মানে আমার স্মৃতি ভ্রষ্ট বরের হাতের ইশারায় আমার চেতনা ফিরলো।

সে হা করে আমার দিকে চেয়ে আছে। ধ্যাত্তেরি কি প্রশ্ন করে ছিল সেটাই তো ভুলে গেছি।

আমি-“কি হয়েছে?” সে-“আপনার কাজিন মানে আমার বউ কোথায়?”

ধুর আমার ঘুম ধরেছে এই সব হাগল পাগলের সাথে কথা বলতে মন চাইছে না।

আর এই বাসর ফাসর নিয়ে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নাই।

তাই বললাম- আমি-“সে নাই, পালিয়ে গেছে” সে-“মানে? বাসর রাতে বউ পালালো কোন্ দিক দিয়ে?”

আমি-“জানালা দিয়ে পালিয়েছে বোধ হয়, এখন আমার ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাতে যাচ্ছি গুড নাইট”

সে হা করে দাড়িয়ে থাকলো আর আমি বিছানায় গিয়ে শুতে না শুতেই সে বললো- -“এই আপনি এই রুমে আমার বেডেই ঘুমাবেন নাকি?”

আমি-“এই বেডে এই রুমেই ঘুমাবো আর আপনি ঐ ছোফাতে ঘুমান” সে-“ঠিক আছে তার আগে আপনি আমাকে সালাম করে তারপর ঘুমান” আমি-“মানে?”

সে-“মানে হলো বাসর রাতে স্বামীকে সালাম করে দোয়া নিতে হয়” কি বদ ছেলে রে!তারমানে সে ইচ্ছে করেই না চেনার ভান করে আমাকে মফিজের বউ বানিয়েছে! মনে মনে তো দেখছি ভালোই হারামী।

আমিও বেশ ভাব নিয়ে বললাম- -“আসলে আমি সালাম করতে পারি না গুড নাইট” সে-“পারি না বললেই তো হবে না। সালাম করতেই হবে” আমি-“আপনি কি জোর করেই সালাম কেড়ে নেবেন নাকি?” সে-“সেচ্ছায় না করলে জোর করেই নেবো”

যতোটা সহজ ভেবে ছিলাম ততোটা সহজ নয় দেখছি। এ তো দেখছি আমার চেয়েও দুই ধাপ উপরে। দুই ধাপ বললে ভুল হবে, সে দশ বারো ধাপ উপরে। মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করলাম, আমিও ওকে কিছুতেই সালাম করবো না। দেখি সে কি করে জোর করে নেয়। আমি-“আমি করবো না সালাম” সে-“তাহলে কিন্তু তুলে একটা আছাড় দেবো” আমি-“কি? এত বড় সাহস! এই আসুন আমাকে আছাড় দিন” সে আমার কথা শুনে কাছে এগিয়ে এলো। সেরেছে রে, সত্যিই আছাড় দেবে নাকি? মাথায় ঠিক গন্ডগোল আছে মনে হচ্ছে। সে আমার হাত ধরে টেনে স্বজোরে ওর পায়ের কাছে ফেলে দিলো। হায় আল্লাহ্ এ কেমন বাসর রাত? আর এটা স্বামী নাকি অন্য কিছু?

বাসর রাতেই যদি এমন করে বাকী জীবণটাতে তাহলে কি হবে? সে-“স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত” আমার সাথে লাগছে আসা! তোমাকেও বেহেস্ত দেখাচ্ছি দাড়াও। আমি ওর পায়ের কাছে পড়ে থেকেই ওর হাত টেনে ধরে নিচে ফেলে দিলাম। এখন দু জন সমান সমান। দু’ জন সামনা সামনি পড়ে আছি। আমি-“আমার সাথে যদি লাগছে আসেন না তাহলে কিন্তু এই রকম খারাপই হবে” আমি মুখ ভেংচি দিয়ে ত্যাড়ক দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। তারপর আচমকা আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই সে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে নিচে ফেলে দিলো।

আজব মানুষ তো! মনের দুঃখে মেঝেতেই শুয়ে থাকলাম। বাবা মা আমার সাথে এটা কি করলো? এমন ছেলের সাথে সারা জীবণ কি ভাবে কাটাবো আমি সেটা ভেবেই দম বন্ধ হয়ে এলো। মনের দুঃখে কেঁদেই ফেললাম। সে আবার কি যেনো বুঝে আমাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে এলো। রাগে আমি বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। সে-“তোমার ওয়েট অনেক তাই বার বার আমি তোমাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে আসতে পারবো না। তাই ভালো ভাবে বলছি বিছানায় আসো” আমি-“যাবো না বিছানায়, আপনি সারা রাত আমাকে আছড়ান” সে-“অতো ওয়েটে বার বার আছড়াতে পারবো না। এবার লাঠি পিটা করবো”

আমি-“আমি কাল সকালেই আপনার নামে থানায় মামলা করে আসবো, বউ নির্যাতনের” সে-“বাড়ির বাহিরে যাবার আগেই তোমার ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেবো” আমি আর কথা না বাড়িয়ে মেঝেতেই চুপচাপ শুয়ে রইলাম। ওমা সত্যি সত্যিই সে একটা লাঠি নিয়ে আমার সামনে এসে দাড়ালো। এই লোককে কোনো বিশ্বাস নেই, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সে আমার ঠ্যাংসহ কোমর ভাঙতেই পারে। তাই নিজেই উঠে বিছানায় গেলাম। সে আমার পাশে শুয়ে থেকে বললো- -“বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ফাঁকা বিছানা থাকলে সেখানে শয়তান শুয়ে থাকে।

দশ লাখ টাকা দেনমহর দিয়ে বিয়ে করেছি কি মাঝখানে শয়তানকে শোয়ানোর জন্য?” মনে মনে বললাম আপনি তো নিজেই একটা আস্ত শয়তান। আপনার পাশে আবার কোন্ শয়তান শুবে? শয়তানের ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে? আমি-” শয়তান আপনার ভয়ে এই রুমেই আসবে না, কারণ শয়তান নিশ্চই তার বস এর বিছানাতে শুতে আসবে না!” সে-“বাহানা বানিয়ে লাভ নেই, যেটা বলেছি সেটা যদি না করো তবে আমি কথা বলবো না, লাঠি কথা বলবে” এই লোকের সাথে পেরে উঠা বেশ কঠিণ। এমনিতেই আছাড় খেয়ে আমার কোমর ব্যাথা করছে এর পর আবার লাঠি! ওহ নো! আমি-“ঠিক আছে” পরের দিন সকালে এলার্ম শুনে ঘুম ভাঙলো।

দেখি ছয়টা বাজে ওহ্ আমি নয়টার আগে উঠি না তাই এলার্ম বন্ধ করে শুতে যাবো তখন সে চোখ বন্ধ করেই বললো- -“আর ঘুমাতে হবে না, যাও নাস্তা বানাতে মাকে সাহায্য করো” আমি-“আমি বুঁয়া নাকি?” সে-“আমার মা কি বুয়া? বেশী কথা না বলে যেটা বলেছি সেটাই করো। আজ প্রথম রাত তাই ছাড় দিয়েছি। কাল থেকে ফজরে উঠে নামাজ পড়ে তারপর নাস্তা বানাবে” আমি-“রান্না করতে পারি না” সে-“মা শিখিয়ে দেবে যাও” ধ্যাত্তেরি! অসহ্য একটা মানুষের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। উপায়হীন আমি এই সাত সকালে কিচেনে ঢুকলাম। এই লোক যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততোক্ষণ আমাকে নানান ভাবে জ্বালিয়ে মারে।

এটা খাবো ওটা খাবো বলে বলে আমাকে কিচেনে দৌড় করায়। ব্যাটা বুঝে না নাকি যে আমি রাঁন্দতে পারি না? কেনো বুঝবে না? বুঝে বলেই তো দৌড় করায়, আমাকে হেনোস্তা করাই বোধ হয় এই লোকের জীবণের এক মাত্র লক্ষ্য। মনের মধ্যে তো প্রেম ভালোবাসা নামক পদার্থ খানা একদম নাই, কি আছে কে জানে! বিয়ের পর প্রথম শুক্রবার সে সবার সামনে শ্বাশুমাকে বললো-“মা আজ অবনি সখ করেছে একাই বিরিয়ানী রান্না করবে তাই আজকের দিনটা তুমি ছুটি নাও।” এই অজবুত কয় কি? আমি তো ভাত রাঁন্দতেই পারি না, সেখানে বিরিয়ানী ওহ নো! এদিকে সবার সামনে কি করে বলি যে আমি কিচ্ছু রান্না করতে পারি না! কিন্তু এখন লজ্জা পাবার টাইম নয়, কারণ এখন লজ্জা করে চুপ থাকলে আখেরী বিপদ আমারই হবে।

তাই আমি সরাসরিই সবার সামনেই বললাম- -“আমি রান্না করতে পারি না” অন্য কেউ আমার কথা শুনে অবাক হলো না কিন্তু আবির ঠিক এটা নিয়ে ঝগড়ার আসর বসালো সে-“বয়স তো এক দুই করে কম হয়নী, তাও কিচ্ছু রান্না করতে পারো না, খেতে তো ঠিক ভালোই পারো” সবার সামনে সে আমাকে এ ভাবে অপমান করলো। রাগে আমি রুমে চলে এলাম। তাতেও বাবুর শান্তি নেই, সেও পেছন পেছন রুমে এসে বললো- -“কোনো বাহানা করে রান্না থেকে বাঁচবে সেটি আমি হতে দেবো না” আমি-“এই আপনি আমার স্বামী নাকি শত্রুপক্ষ হ্য? দিন রাত মেয়েদের মত ঝগড়া করেন কেনো? আপনার লজ্জা করে না?” সে-“লজ্জা নারীদের দ্রব্য পুরুষদের নয়। আর এসব বলে তুমি আমাকে কিচ্ছু ভোলাতে পারবে না। আজ তোমাকে বিরিয়ানী রান্না করতেই হবে।”

আমি-“পারবো না, এত খেতে ইচ্ছে করলে রান্না করে খান” সে-“আমি রান্না করে খাবো তাহলে এই হাতি পালতেছি কেনো?” আমি-“কি আমি হাতি?” সে-“ঐ প্রজাতিরই প্রাণী” আমি-“আপনি আস্ত একটা জলহস্তি আর রাক্ষস প্রজাতির প্রাণী” সে-“শোনো দশ লাখ টাকা দেহমহর দিয়ে বিয়ে করেছি এই সব বাক্য শোনার জন্য নয়। আউলে বাউলে সময় খরচ না করে রান্না করতে যাও” আমি-“বললাম তো যে আমি রান্না করতে পারি না” সে-“মেয়ে মানুষ রান্না করতে পারো না আবার জোর গলায় বলছো, পারো না শিখে নিয়ে রান্না করবা। না হলে লাঠি তো আছেই” আল্লাহ্ কোনো শত্রুরও যেনো এমন স্বামী না হয়। দরকার হলে শত্রু চিরকুমারী থাকুক তবুও যেনো এমন জলহস্তীর বউ না হয়।

নেহায়েত আমার বাবা অসুস্থ, ডাক্তার বলেছেন উত্তেজিত করা যাবে না তাই সব অত্যাচার মুখ বুজে সইছি। আমি ওকে কিছু না বলে রান্না ঘরে গেলাম। ইউটিউব দেখে বিরিয়ানী রান্নাটা শিখে নিলাম। দুপুরে খাবার টেবিলে সবাই বেশ খুশি। ননদীনি চিমটি দিয়ে বললো- -” ভাবী শেষ মেস ভাইয়া তোমাকে দিয়ে রান্না করিয়েই ছাড়লো! না জানি কি টেস্ট হইছে বিরিয়ানী সেই ভেবেই আমার খিদে হারিয়ে গেছে।” বলেই সে একটা ফিক করে হাসি দিল। ভাইয়ের মত বোনটাও বজ্জাতের হাড্ডি। আমাকে ইনসাল্ট করা হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে মনে খুব খুশি। এ জীবণে রান্না ঘরে ঢুকতে হবে না। খাবার মুখে দিয়ে সবাই এর ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে।

শ্বাশুমা বললেন- -“অবনি বয়মের সব লবণ ঢেলে দিছো নাকি? কাল রান্না করার জন্য একটু তো রাখতে পারতে!” আমি দৌড়ে গিয়ে কিচেন থেকে লবণের বয়ম এনে বললাম- -” কই নাতো, এই দেখুন আম্মা এখনো অনেক লবণ আছে” সবাই চুপ করে বসে আছে কিন্তু আমার হতচ্ছাড়া বর যে ছেড়ে দেয়ার জন্তু নয় সেটা এই কয় দিনেই আমি ভালো করেই বুঝে গেছি। তাই আমিও প্রস্তুত হয়ে আছি। কিন্তু পাঠক এরপর যা কিছু ঘটলো তাতে আমি বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলেছি। বদমাইশ লোক আমাকে রুমে নিয়ে গিয়ে নিজ হাতে জোর করে ঐ কু-খাদ্য মানে বিরিয়ানী খাইয়ে দিলো। আল্লাহ এত অত্যাচার আর প্রাণে সয় না!

এই বদমাইশ লোক যে দিন আমাকে প্রথম দেখতে গেছিল সেদিনই বুঝে ছিলাম এই লোক বদের হাড্ডি। আমার কপালে টিপ দেখে বলেছিল আর কখনো যেনো কপালে টিপ না পরি। শুনেই আমি মনে মনে ডিসাইড করে ছিলাম যে, এই লোককে আমি কিছুতেই বিয়ে করবো না। আর যখন শুনেছি হবু বরের নাম আবির তখন থেকেই আমার তো মনে মনে জ্বর শুরু হয়ে ছিল কারণ আমার বান্ধবী কণার bf এর নাম আবির। রোজ ওদের ঝগড়া আর ব্রেকআপ হয় তারপর আবার জোড়া লাগে। প্রথম প্রথম এই ঝগড়া নিয়ে কণা বেশ কষ্ট পেতো ডিপ্রেস্ট থাকতো তারপর সময়ের আবর্তে সব অভ্যেস হয়ে গেছে। ওদের এই রোজকার ঝগড়া দেখে আমি বলতাম তোরা প্রেমালাপ করিস কখন? কণা-“প্রেমালাপ আর আমাদের কপালে নেই রে, ঝগড়ার মাঝেই প্রেম খুঁজে নিই” আমার কাছে আবির মানেই ঝগড়াটে একটা নাম আর সেই নামের ছেলেকে বিয়ে করা মানেই চোখ খুলেই আগুনে ঝাপ দেয়া।

মাকে বলে ছিলাম এ বিয়ে আমি করবো না কিন্তু আমাদের বাসায় বাবার ইচ্ছেই হলো চুরান্ত ইচ্ছে তাই বাবার ইচ্ছেতেই বিয়েটা করতে হলো। বাবা এই জীবাণুর কি দেখে যে পাগল হয়ে ছিল তা আল্লাহই জানেন! তবে বিয়ে ঠিক হবার পর বিয়ে ভাঙার জন্য এই বজ্জাত জলহস্তিকে ফোন করে বললাম যে, আমার একজনের সাথে রিলেশন আছে। ভাবলাম এটা শুনে সে নিশ্চই আমাকে আর বিয়ে করতে চাইবে না। কিন্তু সে উল্টা আমাকে বললো, ছেলের নাম কি? তার বাবার নাম কি? ছেলে কি করে? এবং তার ঠিকানা চাইলো। মনে মনে ভাবলাম সম্ভব নয় এ বিয়ে ভাঙা। দিশা না পেয়ে আমি পালিয়ে যাবার প্ল্যানও করে ছিলাম কিন্তু আমার প্রেমিক নেই বলে সেই মহান কাজটি করতে পারিনী।

আমার কয়েকটা ফ্রেন্ডকেও অনুরোধ করে ছিলাম আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে, বিয়ে ভেঙে গেলে আবার ফিরে আসবো কিন্তু ওরা আমার বাবার ভয়ে কিছুতেই রাজী হয়নী। এমনকি হারামী গুলো সেই ভয়ে আমার বিয়েতে পর্যন্ত আসেনী। বাধ্য হয়েই এই বজ্জাত লোককে আমার বিয়ে করতে হলো। আমি আমার রান্না বিরিয়ানী খেয়ে বমি করে অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছি। জলহস্তিটাই আমাকে বমি বন্ধের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে বিকেলে বাহিরে গেলো ফিরলো রাতে। দেখলাম কলা পাতায় কি যেনো মুড়িয়ে টেবিলে রাখা। আমি বাজারে দেখেছি যে, চ্যাপা শুটকী কলা পাতায় মুড়িয়ে বিক্রি করে। এই লোক কি আমাকে এখন এই চ্যাপা শুটকী কাঁচাই জোর করে খাওয়াবে নাকি?

এই অদ্ভুত জলহস্তীকে কোনো বিশ্বাস নেই। ওটাকে যেমন করেই হোক ফেলে দিতেই হবে তাই সে ফ্রেশ হতে ওয়াশ রুমে ঢোকার সাথে সাথেই আমি কলা পাতাটা খুললাম। খুলে তো আমি অবাক, একটা বেলী ফুলের মালা। এই বজ্জাত আমাকে জোর করে ফুল খাওয়াতেই পারে! এবার জোর করে খাওয়াতে এসে দেখ না, আমিও ওকে জোর করে খাওয়াবো। আমি আবার কলাপাতা মুড়িয়ে রেখে অন্য কাজে বিজি হবার ভান করলাম। সে ফ্রেশ হয়ে এসে বললো-“চুল গুলো খোপা করো” আমি-“কেনো?”

সে মালাটা বের করে বললো-” এটা খোপায় পরো” আমি-“এখন তো ঘুমাবো তাই সকালে পরবো” সে-“স্বামী যখন কাজে বাহিরে থাকবে তখন সাজ গোজ করবে মানুষকে দেখানোর জন্য তাই না? দশ লাখ টাকা দেনমহর দিয়ে বিয়ে করেছি কি নিজের বউয়ের সাজগোজ অন্য পুরুষকে দেখানোর জন্য?” আমি-“কথায় কথায় আপনি এই দেনমহরের খোটা দেন কেনো? কে বলে ছিল আপনাকে বিয়ে করতে?” সে-“কেউ বলেনী বিয়ে করতে কিন্তু তোমার বাবা বলে ছিল দশ লাখ টাকা দেনমহর দিতে” আমি-“আমি তো আর বলিনী, যে বলেছে তাকে গিয়ে বলুন” সে-“তোমার বাবার ওয়ারিশ সূত্রে এ গুলো শোনা তোমার প্রাপ্য” আমি-“তাহলে কিছু কথা আমার ভাই বোনদের শুনিয়ে আসেন” সে-“এত বাহানা না করে চুল খোপা বেঁধে আসো, না হলে লাঠি কথা বলবে” আজব মানুষ একটা, মুখ দিয়ে তো একটাও ভালো কথা বেরুয় না সে আবার পীরিত করে ফুল কিনে এনেছে খোপায় বাঁধার জন্য।

আল্লাহই জানে ওর মনে কি আছে! বাধ্য হয়েই দুপুর রাতে চুলে খোপা বাঁধলাম। এর পর যা ঘটলো তা দেখে আমি পুরাই শক খাইলাম। ঐ জলহস্তী প্রজাতির প্রাণীটা নিজ হাতে খোপায় ফুল লাগিয়ে দিলো। হাব ভাব এ তো প্রেম খুঁজে পাই না তাই ফুল লাগানোর মানে বুঝলাম না। এরপর বিছানায় শুয়ে তো রোজ এক হাদিস শুনি, স্বামী স্ত্রীর মাঝে ফাঁকা থাকলে ওর শয়তান পিয়ন নাকি এসে শুয়ে থাকবে। উফফ্ আল্লাহ ভালোবাসা কাকে বলে একটু বুঝিয়ে দেবেন? সেদিন রাতে বাসায় ফিরে বললো ওর মাথা ব্যাথা করছে। তাই মাথা টিপে দিতে বললো। আমি তো এসব পারি না তাই ওষুধ আর এক গ্লাস পানি এনে দিলাম। ওর কথা হলো মাথা টিপে দিতেই হবে সে ওষুধ খাবে না। আমিও সরাসরিই ওকে বললাম- -“আমি এসব পারি না” সে-“এটা পারো না, ওটা পারো না, তো পারোটা কি?”

আমি-“কিছুই পারিনা প্লীজ আমাকে আমার বাবার বাসায় ফেরত দিয়ে আসেন” সে-“দশ লাখ টাকা দেনমহর দিয়ে বিয়ে করেছি কি বউকে বাপের বাড়ি রাখার জন্য নাকি?” আমি-“এই আপনি আপনার দশ লাখ টাকা ফেরত নিয়ে আমাকে মুক্তি দেন, আমি আর পারছি না আপনার এত অত্যাচার সইতে” সে-“আমার থেকে মুক্তি নিয়ে কি ঐ বাউন্ডুলে এক্সপ্রেস এর সাথে পালাবে নাকি?” আমি-“মানে কি?” সে-“অন্য এক জনকে ভালোবাসো বলেই তো স্বামী সংসারে মন নেই তোমার” বিয়ে ভাঙার উদ্দেশ্যে বজ্জাতকে বানিয়ে বলে ছিলাম যে এক জনের সাথে প্রেম ছিল আজ তার খোটা দেয়া হচ্ছে। আমিও কিছুতেই বলবো না যে, আমার ঐ সব প্রেম টেম ছিল না।

আমি-“আর আপনার বুঝি বউয়ের প্রতি খুব মন আছে? ঝগড়াটে একটা” সে-“আমার মন নেই কে বলেছে?” আমি-“কে এসব বলে আপনার ঝগড়ার ফ্যাঁসাদে পড়বে? আমি নিজে থেকেই বুঝেছি” সে-“বাহানা বাদ দিয়ে কপালে বাম লাগিয়ে ম্যাসাজ করো, স্বামী সেবা করলে বেহেস্ত নিশ্চিত” আমি-“বললাম তো পারি না” সে-“এই তুমি মুখে মুখে তর্ক করা ছাড়া পারোটা কি হ্য?” অসহ্য ! সারা দিন ঝগড়া করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। এর সাথে কথায় পারবো না, কখন আবার লাঠি নিয়ে সামনে দাড়ায় তাই বাধ্য হয়েই বাম লাগিয়ে স্বামী সেবা করতে বসলাম। মনে হচ্ছে ঐ বিরিয়ানীর মত জোর করে বজ্জাতটাকে বাম খাইয়ে দিই।

কিন্তু সেটা করতে গেলে উল্টো আমাকেই না জানি আর কি কি খেতে হবে! তিন সপ্তাহের মধ্যে আমি রান্নাসহ ঘরের সব কাজ শিখে নিলাম। না শিখে উপায় আছে? ঐ অদ্ভুত মানুষটার ঝগড়া আর লাঠির ভয়ে শিখতে বাধ্য হয়েছি। পরবর্তীতে আর কখনো তরকারীতে লবণসহ অন্যান্য দ্রব্যাদী বেশী দেয়ার সাহসে কুলোয়নী। সেদিন দেখি টেবিলের উপর কাঁচের দু ড্রজন চুরি রেখে দিয়েছে। বুঝলাম সাহেব আমার জন্য এনেছে। আমি না দেখার ভান করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সে স্বজরে আমার হাত ধরে টেনে নিচে নামিয়ে চুরি পরিয়ে দিল। আল্লাহ এ কেমন ভালোবাসা প্লীজ একটু বুঝিয়ে দেবেন? আজ কাল প্রায়ই সে আমার জন্য এটা ওটা কিনে আনে।

সেদিন রাতে দেখি একটা টুকটুকে লাল শাড়ী টেবিলে রাখা। দেখে খুশি হলাম তারপর সে সব কিছু নিজ হাতে পরায় এটা মনে পড়তেই ধপ করে সব খুশি নিভে গেলো। তাই সে রুমে আসার আগেই আমি শাড়ীটা পরে নিলাম না হলে সে আবার নিজেই শাড়ী পরাতে বসবে। সে রুমে ঢুকে আমাকে নতুন শাড়ীতে দেখে অবাক খুশি কোনোটাই না হয়ে বললো-“এই এটা কি করেছো?” আমি-“কি করেছি?” সে-“এই শাড়ীটা পরেছো কেনো?” ওর কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। সে-“এই শাড়ীটা একটা বন্ধুর বিয়েতে ওর বউয়ের জন্য কিনেছি এটা তুমি কেনো পরেছো?” হায় আল্লাহ্ এত বড় অপমানটাও আমার জন্য অপেক্ষা করছিল?

এর চেয়ে সে যদি নিজে হাতে আমাকে শাড়ী পরিয়ে দিত তবে লজ্জার পরিমাণটা বোধ হয় একটু কম হতো। আমি রাগে দুঃখে ওয়াশ রুমে ঢুকে শাড়ীটা বদলে এলাম। তারপর শাড়ীটা ভাজ করে ঠিকঠাক করে রাখলাম। তারপর গিয়ে শুয়ে পড়লাম। সবে একটু ঘুম ঘুম ভাব এসেছে ঠিক তখনই সে আমাকে ডেকে তুললো। আমি ঘুমালেই কি এই জীবাণুর গায়ে জ্বলনী পুড়নী শুরু হয় নাকি? আমি একটু রাগ করেই বললাম -“কি হয়েছে?” সে-“শাড়ীটা খুলেছো কেনো?” আমি-“অন্যের শাড়ী আমি পরি না”

সে-“তাহলে শুধু শুধু নতুন শাড়ীটাকে পরে পুরোনো কেনো করলে?” আমি-“নিজের ভেবেই পরে ছিলাম, আমার ভুল হয়েছে হাত জোড় করছি আমাকে ক্ষমা করুন” সে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো-“নিচে আসো” আমি-“কেনো?” সে-“শাড়ীটা পরিয়ে দেবো” এই লোকের মাথার নাট বল্টু খুলে পড়ে গেছে নাকি? আমি-“আমি অন্যের শাড়ী পরি না, তখন পরে ছিলাম ভুল করে এখন জেনে শুনে পরতে পারবো না” সে-“শাড়ী পরে ফেলেছো এখন ওটা আর কাউকে দেয়া যাবে না তাই ওটা তুমিই রেখে দাও”

আমি-“যেটা আমার জন্য কেনা হয়নী সেটা আমি নিতে পারবো না” সে-“বেশী কথা বলো না তাহলে কিন্তু দাঁত ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবো” বলেই সে আমাকে শাড়ী পরানো শুরু করলো। শাড়ী পরাতে পরাতে বললো- -“শাড়ীটাও ঠিকঠাক পরতেও পারো না। তখন যে ভাবে শাড়ী পরে ছিলে সে ভাবে কোনো মেয়ে শাড়ী পরে কি না আমার জানা নেই” আল্লাহ এই জীবণে আর কত কিছু দেখাবেন সেটা কি বলবেন প্লীজ? শাড়ী পরানো শেষে সে বললো- -“আসলে শাড়ীটা আমার বউয়ের জন্যই তৈরী হয়েছে।

আর সে কারণেই শাড়ীটা আমি আমার বউয়ের জন্যই কিনেছি” আমি-“তাহলে তখন যে বললেন আপনার বন্ধুর বউয়ের জন্য কিনেছেন?” সে-“আগেই পরে ফেলে ছিলে তাই বলেছি। বউকে শাড়ী পরানোর মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তি আছে। দশ লাখ টাকা দেনমহর দিয়ে বিয়ে করেছি কি এই আত্মতৃপ্তি ত্যাগ করার জন্য?” কি আজব প্রাণী রে বাবাহ! নিজ হাতে আমাকে শাড়ী পরাবে বলে আমাকে অপমান করতে তার একটুও দ্বিধা হলো না! সব কাজ গুলো একটু একটু করে সব শিখে নিয়েছি। কোনো কিছু করতে পারি এর মাঝে যে আনন্দ বসবাস করে সেই আনন্দটা আজকাল অনুভব করতে পারি। সব ঐ জলহস্তীর অবদান।

আজকাল ওকে একটু একটু ভালো লাগতে শুরু করেছে। কিন্তু ওর মনের গহীণ দেশটা দেখতে পাই না। আজব মানুষ একটা! ছোট খাটো ব্যাপারেই ঝগড়া করতে শুরু করে। তবে সেই ঝগড়ার মধ্যে আমি কণার মত প্রেম খুঁজে পাই। যখনই সেই প্রেম ঝগড়ার মধ্যে থেকেই সেঁকে তুলতে চাই ঠিক তখনই জলহস্তীটা এমন কিছু কথা বলে বসে যে মনে হয় সব ফালতু। ভাবলাম সে তো আমাকে ভালোবাসে তাই ওকে তুমি করে বলা উচিত। তাই ওকে তুমি করে বললাম। ওরে বাবাহ্! মনে হলো আমি রাষ্ট্র বিরোধী কোনো পাপ করে ফেলেছি মনে হয়। সে কাছে এসে বললো-“এই তুমি কি বললে?” আমি-“আবার বলবো?” সে-“এই না, খবরদার না” আমি-“কেনো কি হয়েছে?” সে-“এই তুমি আমাকে ‘তুমি’ করে কেনো বলছো?” আমি-“পৃথিবীর সব বউ স্বামীরাই একে অপরকে তুমি করেই বলে তাই আমিও বলেছি যদিও অনেক দিন দেরী হয়ে গেছে” সে-“আজ ‘তুমি’ করে বলবে আর কাল ঝগড়া হলেই ‘তুই’ করে বলবে?

দশ লাখ টাকা দেনমহর দিয়েছি কি বউয়ের মুখে ‘তুই’ শোনার জন্য? এক বার ভুল করে বলেছো তাই মাফ করলাম এর পর আর বলবে না। আর যদি বলেছো তো লাঠি কথা বলবে” আমি টাস্কী খেয়ে দাড়িয়ে থাকলাম। বিগত দশ বছরে বাংলাদেশের কোনো নারীই বোধ হয় তার স্বামী প্রদত্ত এমন উক্তি শুনেনী। আমি কত সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি যে এমন কথা আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে শুনছি আর নির্বাক হজম করছি। এই বজ্জাত লোক আমাকে ছাই ভালোবাসে।

মনের দুঃখে মাঝ রাতে বাথরুমে গিয়ে সাওয়ার ছেড়ে বসে থাকলাম। চোখের জল গুলো পানির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেলো। এমন একটা মানুষের সাথে সংসার করছি যে আমাকে একটুও ভালোবাসে না, এই কথাটা ভাবতেই চোখ ফোয়ারার রূপ ধারণ করলো। চোখ বিরতী নিচ্ছে না তাই বাথরুম থেকে বাহিরেও আসতে পারছি না, সে কারণেই ঘন্টাখানেক ভিজার পর মনে হলো আমার গায়ে ভীষণ জ্বর এসে গেছে। এরপর পর আর কিছু মনে নেই। সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি আমার কপালে জলপটি দেয়া আর রুমে বালতি দেখে বুঝলাম মাথায় পানি ঢালা হয়েছে।

আর বজ্জাত লোকটা দেখছি বসে বসে ঢুলছে। আমি জেগে গেছি দেখে সে বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো-“এখন কেমন লাগছে অবনি?” গত রাতের কথা মনে পড়ে আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। ইচ্ছে করছে না ওর সাথে কথা বলতে। সে-“আমি তোমার নাস্তা আনছি ওষুধ খেতে হবে তো” বলেই সে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো তারপর কিছুক্ষণ পর সে নাস্তার প্লেট হাতে রুমে ঢুকলো। আমাকে সে উঠে বসতে বললো কিন্তু আমি পাশ ফিরে শুলাম। সে আমাকে আর কিছু না বলে শোয়া অবস্থাতেই আমার মুখে পরোটা গুজে দিতে লাগলো। আমি রাগটাকে আর কন্ট্রোল করতে না পেরে খাবারের প্লেটটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বললাম- -“চাই না আমি এসব।

ঐ আলমারীতে আপনার দেয়া গহণা আর দেনমহরের টাকা আছে। ও গুলো বুঝে নিন। আমি আর আপনার সাথে সংসার করতে চাই না। বিয়ে মানে শুধু আইনী আর ধর্মীয় সম্পর্ক নয়। বিয়ে মানে মনেরও সম্পর্ক। বিয়ে মানে শুরু শারীরিক মিলন নয়, বিয়ে মানে মনেরও মিলন। আপনার সাথে আমার না হয়েছে মনের সম্পর্ক না হয়েছে মনের মিলন। আপনার মত মানুষটাকে জাস্ট ভালোবাসা যায় না, তার চেয়ে আপনার ঐ লাঠিটাকে বেশী ভালোবেসে ফেলেছি।” আমার কথা শুনে আবির চুপচুপ দাড়িয়ে আছে।

এই বজ্জাত লোক চুপ থাকার বান্দা নয়, সে নিশ্চই মনে মনে মতলব কোষছে কি করে আমাকে জব্দ করা যায়। মতলব কষে লাভ নেই আজ আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেয়েই ছাড়বো। সে-“আর কি কি অভিযোগ আছে বলো” আমি-“আরো কি শুনে কি করবেন? ঐ লাঠি দিয়ে আমাকে পিটাবেন নাকি? এটা ছাড়া তো বিশেষ কিছুই পারেন না আপনি” আমার কথা শুনে সে আবার চুপ হয়ে গেলো। গায়ে জ্বর না থাকলেও শরীরটা বেশ দূর্বল মনে হচ্ছিল তবুও বিছানা থেকে নেমে রেডী হলাম। কোনো ব্যাগ গোছালাম না।

ওর দেয়া কিচ্ছু নিয়ে যেতে চাই না। কথায় কথায় খোটা দেয়া মানুষের জিনিস নিয়ে আর অপমান হতে চাই না। আমি রেডী হয়ে বের হবো তখন সে বললো- -“এই শরীর নিয়ে তোমাকে একা যেতে হবে না, আমি তোমাকে রেখে আসছি” আমি-“অনেক করেছেন আমার জন্য, দোহাই লাগে আমার জন্য আর কিছু করবেন না। এমনিতেই আমি আপনার কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে গেছি আর ঋণী হতে চাই না।”

সে-“বোরখা আর হিজাব পরে তারপর বাহিরে যাবে। তুমি বেপর্দায় বাহিরে গিয়ে পাপ করে জাহান্নামে যাবে আর টেনে টুনে আমাকেও সাথে নিয়ে যাবে তা আমি হতে দিতে পারি না। এই সময়েও মানুষটার মুখ দিয়ে এ ধরণের কথা বের হচ্ছে দেখেও অবাক হলাম না। কিছু না বলেই বেরিয়ে এলাম। রুম থেকে বেরিয়েই দেখি বাবা মা ড্রয়িং রুমে বসে আছে। হয়ত আমার জ্বরের খবর পেয়েই এসেছে। বাবাকে ভীষণ ভয় পাই তাই ওদের দেখেই গলা শুখিয়ে গেলো। মা আমাকে সাথে নিয়ে আবার আমার রুমে ঢুকলো। আবির মায়ের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে বাহিরে চলে গেলো। আমি মাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলাম যে, আমি আর আবিরের সাথে সংসার করতে চাই না।

মা খুব অবাক হয়ে গেলো আমার কথা শুনে। আর আমি অবাক হলাম এটা ভেবে যে, ঐ বজ্জাত লোকটার উদ্ভট কার্যকলাপের বর্ণনা শুনে মা অবাক না হয়ে আমি সংসার করতে চাই না এটা শুনে মা অবাক হলো। মায়ের অবাক হওয়া দেখে রাগ হলো তাই বললাম- -“শোনো মা, তোমার ঐ আবির নামক জামাই বাবা খুব ভালো ছেলে, এমন ভালো ছেলে পৃথিবীতে দুটো নেই। আর আমি নোবেল পাবার মত খারাপ মেয়ে তাই ঐ ভালো ছেলের সাথে আমাকে একদম মানায় না। সুতরাং আমাদের এক সাথে থাকা চলে না।” মা-“বলিস কি? আবির তো রোজ আমাকে আর তোর বাবাকে ফোন করে বলে তুই খুব ভালো মেয়ে, তুই খুব মন দিয়ে সংসার করছিস। এসব শুনেই তো তোর বাবা অনেকটা সুস্থ বোধ করছে” আমি-“ঐ বজ্জাতের হাড্ডি তোমার কাছে আমার সুনাম করেছে?

এর পেছনেও বড় সড়ো কোনো মতলব আছে নিশ্চয়ই” মা-“সব কিছুতেই ভালোবাসা না খুঁজে মতলব খুঁজিস কেনো? সে যা কিছু করেছে সব তো ভালোবেসেই করেছে!” আমি-“এসবের নাম যদি ভালোবাসা হয় তবে এ ভালোবাসা যাদুঘরে রাখা উচিত। জনগণ একটু দেখুক যে ভালোবাসা কত পদের হয়” মা-“শোন অবনি সব পুরুষের ভালোবাসার প্রকাশের ধরণ এক রকমের হয় না। আবির তোকে দেখে পছন্দ করার পর যখন বিয়ে করবে বলে জানালো তখন আমি তাকে এক দিন তোর অগচরে ওকে ডেকে বলে ছিলাম যে, তুই তোর বাবার মত রগচটা, রাগ হলে ভাংচুর করিস আর তুই ঘরের কোনো কাজ করতে পারিস না। এই সব কিছু জেনে শুনে সে তোকে বিয়ে করবে কি না সেটা তার ব্যাপার। আমার কথা শুনে আবির বলে ছিল-‘আপনার মেয়েকে গড়ে পিটে ঠিক করে নেবো। অবনির বাবা মা বলে এক দিন আপনারা গর্ব বোধ করবেন’ ছেলেটার কথা শুনে সেদিন নিশ্চিন্ত হয়ে ছিলাম। এই যে দেখ তোর বাবা সারা দিন আমার সাথে খিটখিট করে অথচ কোথাও গিয়ে যদি এক রাত থাকি তবে তোর বাবা সারা রাত না ঘুমিয়ে বসে থাকে আর একটু পর পর ফোন করে আমাকে গালি গালাজ করে।

এখন বল তোর বাবা কেনো সারা রাত বসে থাকে আর আমাকে ফোন করে কেনো গালি গালাজ করে?” আমি-“বাবা মশারী টাঙাতে পারে না তাই মশার কামড়ে সারা রাত বসে থাকে আর তোমার জন্য মশা কামড়াচ্ছে বলে রাগে তোমাকে গালি গালাজ করে” মা-“এ জন্মে তোকে বুঝানোর সাধ্য নাই আমার” বিকেলে বাবা মা চলে গেলো আর আমি ঐ বজ্জাত জলহস্তীর বাড়িতেই থেকে গেলাম। সে ও বিকেলে বাহিরে গেলো। গায়ে জ্বর নেই তবুও শুয়ে আছি। আর শুয়ে শুয়ে মায়ের বলে যাওয়া কথা গুলো ভাবছিলাম।

মনে হয় বজ্জাতটা আমাকে ভালোই বাসে কিন্তু ওর মনের নাগাল পাওয়াটা বোধ হয় সম্ভব হবে না। ধুর আমিই বা ওর মনের নাগাল খুঁজছি কেনো? সে রাতে বাসায় ফিরেই আমার কপালে হাত দিয়ে গায়ের তাপমাত্রা দেখে নিলো। তারপর একটা কাশি দিয়ে একটা খাম আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমি খামটা হাতে নিয়ে চেয়ে থাকলাম। এই বদ লোকটা কি আমাকে ডিভোর্স লেটার দিলো নাকি? এই বজ্জাতকে করে কোনো বিশ্বাস নেই। খামটা খুলতেই ভয় লাগছে। বুকের ভেতর কেমন ধুকপুক ধুকপুক করছে। এত জঘন্য মানুষটার ডিভোর্স লেটার পেয়ে তো আমার খুশি হওয়া উচিত কিন্তু আমার ঝড় তুফানের মত কাঁন্না পাচ্ছে। আমার অশ্রু টপ টপ করে খামের উপর পড়তে দেখে সে বললো- -“এই কি করছো? গুরুত্বপূর্ণ কাগজটা এভাবে ভিজিয়ে ফেলছো?”

বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজটা ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো অথচ আমার হৃদয় চিরে যে অশ্রু গড়াচ্ছে এটার কোনো গুরুত্ব নেই তার কাছে? এত পাশান মানুষ হতে পারে? সে-“বাহ্ কাগজ না দেখেই কাঁন্না কাটি শুরু করে দিয়েছো? আমার থেকে আলাদা থাকতে হবে বলে কাঁদছো তাই না? এই তুমি আবার আমাকে ভালো টালো বেসে ফেলোনী তো?” এবার পুরোপুরিই বুঝলাম এটা ডিভোর্স লেটার। মনের দুঃখে না হয় বলেইছি যে সংসার করবো না তাই শুনেই ডিভোর্স দিতে হবে? আমি কিছুতেই ওকে ডিভোর্স দেবো না। সে-“কি হলো কিছু বলছো না যে?” আমি কিছু না বলে কাগজটা ছিড়তে লাগতেই সে আমার হাত থেকে খামটা কেড়ে নিয়ে বললো-“পাগল হয়ে গেছো নাকি? মাত্র দুই সপ্তাহ স্বামীর থেকে দূরে থাকতে পারবে না? এই তুমি এত বর পাগলী কেনো? অথচ সকালে বললে নাকি আর সংসারিই করবে না” আমি-“দুই সপ্তাহ মানে?” সে-“পরশু জয়েন করবো, দুই সপ্তাহ পর বাড়ি আসবো তখন তো আমাকে দেখতে পাবে” আমি-“এটা কিসের কাগজ?”

সে-“আমার ট্রান্সফার লেটার” আমি-“আপনি আমাকে এখানে রেখে দূরে গিয়ে থাকবেন?” সে-“হ্যা থাকবো, এতে তো তোমার সুবিধেই হবে, তোমাকে অত্যাচার করার কেউ থাকবে না।” এক সপ্তাহ হলো সে চলে গেছে। আমি একাই এই রুমটাতে থাকি। সারা দিন কাজের ব্যস্ততায় দিন কেটে গেলেও রাতটা কাটতেই চায় না। বজ্জাতটার অত্যাচার গুলোকে খুব মিস করছি। মিস করছি ওর পরানো চুরি গুলোকে, মিস করছি ওর বেঁধে দেয়া আমার খোপার ফুল গুলোকে। এমনকি ওর লাঠিটাকেও মিস করছি। জীবণটাকে শূন্য শূন্য লাগে, বাড়ি ভরা এত মানুষ আছে অথচ একটা মানুষের শূন্যতা আমাকে যেনো শেষ করে ফেলছে। সারা দিন ঘুরে ফিরে ক্যালেন্ডার দেখি আর দেয়াল ঘড়িটাকে মনে মনে গালিগালাজ করি। আর একটু জোরে চলা যায় না? সে ফোন করে অথচ আমি কিছুই বলতে পারি না।

রাজ্যের নিরবতা আমাকে চেপে ধরে রাখে। মনে হচ্ছে আমি ঐ বজ্জাতের প্রেমে পড়েছি, কি সাংঘাতিক ঘটনা! দুই সপ্তাহ পর সে যখন বাড়ি এলো। মনে হলো আমার জীবণে হারানো কিছু পেয়েছি কিন্তু সে দু দিন পর চলে যাবে এটা শুনেই যেনো শ্বাসরোধ হবার উপক্রম হলো। রাগ করে রাতে কথাই বললাম না। কাল সে চলে যাবে এটা নিয়ে আমার এতটাই মন খারাপ যে আমি কাঁন্না আটকেই রাখতে পারলাম না। সে বাহিরে থেকে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই বললো-” সব কিছু গোছ গাছ করো” আমি-“মানে?” সে-“আগেই তো বলে ছিলাম যে, মাত্র দু সপ্তাহ কষ্ট করো। বাসা ঠিক করেছি, কিছু ফার্নিচার কিনেছি বাকীটা তুমি গিয়ে পছন্দমত কিনে নিও”

আমি-“আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাবে এটা আগে বললে কি হতো?” সে-“দশ লাখ টাকা দেনমহর দিয়ে বিয়ে করেছি কি বউকে দূরে রাখার জন্য নাকি?” আমি-“অদ্ভুত মানুষ!” সে-“এই দু সপ্তাহে শরীরের যে হাল করেছো দেখছি তাতে তো মনে হচ্ছে একটা রাতও ঠিকঠাক ঘুমাওনী। এত বর পাগল হলে চলবে কি করে গো বউ?” আমি-“আপনি তো আর বউ পাগল নন, যা কিছু করেন সবই তো ঐ দশ লাখ টাকা দেনমহরকে ভালোবেসেই করেন” সে-“বউ পাগল না হলে নিজের কাছে কখনোই এই হাতিটাকে নিয়ে যেতাম না। ঐ দেনমহর নিয়েই ঘর সংসার করতাম” আমি-“আবার আমাকে হাতি বলছেন?” সে-“একদম চুপ, খবরদার ঝগড়া করবে না, নাহলে আমি নই লাঠি কথা বলবে আর কাল মনে করে লাঠিটা সাথে নিও” তারপর সে একটা মুচকী হাসি দিয়ে বললো-“এখন তো বুঝেছো যে তোমাকে রান্না বান্না শিখতে কেনো বাধ্য করে ছিলাম? আলাদা বাসায় কে রান্না করে খাওয়াবে এই হাতি আর জলহস্তীটাকে?” ঐ বজ্জাত লোকটা রোজ আমাকে কোনো না কোনো ভাবে মফিজা বানায়। জীবণটা আমার মফিজাময় হয়ে গেছে। সে যে সারাটা জীবণ না।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত