বিরিয়ানি হাউস

বিরিয়ানি হাউস

দিনমজুর ফজর আলীর ঘরে যে মিন্টুর মতো এমন সুন্দর একটা ছেলে জন্মাবে তা কেউ ভাবতেই পারেনি। গ্রামের সবাই ছেলেটাকে আদর-স্নেহ করতো। কেউ কোনো কাজের ফরমায়েশ দিলে সে খুশি মনে করে দিতো। সবার সাহায্য-সহযোগিতায় সে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ফাইভ পর্যন্ত পড়ে আর এগোয়নি। কারণ, লেখাপড়া নাকি তার ভালো লাগেনা। তাই সে গ্রামের কয়েকজনের সাথে ঢাকায় গিয়ে সে রিকশা চালানো শুরু করে দিতো। রিকশায় যারা উঠতো তারা সবাই তার মায়াবী চেহারার দিকে তাকিয়ে ন্যায্য ভাড়ার পরেও কিছু বকশিস দিতো।

এইভাবে একদিন মিন্টু এক কোরিয়ান যাত্রীর দৃষ্টিতে পড়ে গেলো। লি চ্যাং নামের সেই যাত্রী তাকে তার গুলশানের বাসায় নিয়ে গেলো। বিশাল দোতলা বাড়িতে লোকটি থাকে। বয়স ত্রিশের মতো, বিয়ে করেনি। বাংলাদেশে একটি কোরিয়ান প্রজেক্টের বড় ইঞ্জিনিয়ার তিনি। মিন্টুকে দেখে কোরিয়ান লোকটা মায়ায় পড়ে গেলো। লি চ্যাং কিছু বাংলা শিখেছিল। মিন্টুকে সে বললো, “আমার কাছে তুমি থেকে যাও। আমার বাসায় তুমি সুখে থাকবে, রিকশা চালাতে হবেনা। মজার মজার খাবার খাবে, নতুন জামাকাপড় পড়বে, আরামে থাকবে।”

তারপর থেকে মিন্টু কোরিয়ান ভদ্রলোকের বাসায় থাকতে শুরু করে। তিন-চার মাস পরপর গ্রামের বাড়িতে যেতো। বাবা-মাকে অনেক টাকা, কাপড়চোপড় দিয়ে আসতো। আর বলতো যে, সে ঢাকায় একটি বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। শুনে বাবা-মাও ভীষন খুশি। লি চ্যাং প্রচুর রোজগার করে, টাকা খরচের তেমন জায়গা নেই। তিনটা গাড়ি ছিলো তার। বাসায় চাকর-বাকর, বাবুর্চি-দারোয়ান সবই ছিলো। মিন্টুর কাজ হচ্ছে ভদ্রলোক অফিসে চলে গেলে তার কাপড়চোপড়, বিছানাপত্র ফিটফাট রাখা। লি চ্যাং তাকে খুবই পছন্দ করতো।

একসময় লির বাংলাদেশের প্রজেক্টের কাজ শেষ হলো। সে তার সংে মিন্টুকেও নিয়ে গেল তার দেশ কোরিয়ায়। সেখানে লি চ্যাংদের বিরাট হোটেল ব্যবসা ছিলো, মিন্টুকে সে হোটেলের ওয়েটারের কাজে লাগিয়ে দিলো। প্রায় দশবছর এভাবেই কেটে গেলো। মিন্টু দশ বছরে প্রচুর উপার্জন করে দেশে ফিরে গেলো। মিন্টুকে দেখে বাংলাদেশি বলে চেনাই যায়না। স্বাস্থ্যে, চাল-চলনে বেশভূষায় মিন্টু আর সেই গ্রামের মিন্টু নেই। দস্তুর মতো সাহেব হয়ে গেলো। কোরিয়ান ভাষা তো জানেই, ইংরেজিও ফ্লুয়েন্টলি বলতে পারে।

হোটেলে কাজ করে হোটেল ব্যবসায় তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাছাড়া পুঁজিও ছিলো প্রচুর। তাই সে ঢাকায় এসে মতিঝিলে “বিরিয়ানি হাউস” নামে একটি গর্জিয়াস এয়ারকন্ডিশন্ড হোটেল খুলে বসলো। হোটেলের সামনে কয়েকটা কালো রংের খাসি দড়ি দিয়ে বাধা থাকতো। খাসিগুলো ঘনঘন ভ্যা ভ্যা করে ডাকতো। বিরিয়ানির গন্ধে আশেপাশের চারদিক মৌ মৌ করতো। বিশাল বড় হোটেল তবুও দুপুরে লাঞ্চের সময় লাইন লেগে যেতো। অনেকে বসার জায়গা না পেয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে খেতেন। রাতেও প্রায় একই অবস্থা ছিলো।

ভালোই চলছিল হোটেল ব্যবসা। মিন্টু এখন বিশাল বড়লোক, সমাজের উঁচুস্তরের লোকদের সাথে তার ওঠাবসা। সবসময় সে স্যুট, টাই, গলায় সোনার চেইন, হাতের প্লাটিনামের ব্রেসলেট পড়ে থাকে। বাড়ি-গাড়ি কোনো কিছুরই অভাব ছিলোনা। মিন্টুর বিরিয়ানি হাউসের জন্য ঐ এলাকার অন্য হোটেলগুলো বন্ধ হবার উপক্রম। কারণ, মিন্টুর হোটেলে মাংসের পরিমাণ দেয়া হতো বেশি। মাংসও বেশ মোলায়েম। বিরিয়ানিতে দেয়া হতো নাম্বার ওয়ান গাওয়া ঘি। চাল আনা হতো দিনাজপুর থেকে। বিশেষ করে মাংসটা খেতে ভালো বলেই এই “বিরিয়ানি হাউস”- এর এতো সুনাম।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়। একদিন ঐ হোটেলের ব্যাপারে খবরের কাগজে প্রকাশ পায় যে, মতিঝিল, আরামবাগ, বাসাবো এলাকার রাস্তার নিত্য ঘোরাফেরা করা কুকুরের সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছিল বলে অনেকেই লক্ষ্য করেছেন তাছাড়া, অনেকদিন ধরে সিটি কর্পোরেশনের লোকেরাও কুকুর নিধন করেনি। তাহলে, কুকুরগুলো দিনকে দিন যাচ্ছে কোথায়? কোনো কোনো বাড়ির পোষা মোটাতাজা কুকুরগুলোও লাপাত্তা হতে লাগলো। বাধ্য হয়ে তারা থানায় অভিযোগ করতে শুরু করে। গোয়েন্দারা এ বিষয়ে একসময় যথেষ্ট তৎপর হয়ে উঠলো। অনেক সোর্স লাগিয়ে জানতে পারলো যে, “বিরিয়ানি হাউস” হোটেলের পেছনের ড্রেনটায় কুকুরের চামড়া, মাথা ইত্যাদি স্তূপ হয়ে পড়ে ছিলো।

হোটেলের কয়েকজন কর্মীকে ডেকে নিয়ে আচ্ছামত পিটুনি দেয়ার ফলে তারা হরহর করে প্রকৃত ঘটনা ফাস করে দেয়। খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ঐ হোটেলের বিরিয়ানি খেকোদের ঘেন্নায়, ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত