সেবারে আমরা রামপুরহাট বেড়াতে গিয়েছিলাম। স্টেশন থেকে পাঁচ ছ’মাইল দূরে একটা বড় ইস্কুল আছে। তখন পুজোর ছুটি, অত বড় ইস্কুল বাড়িটা ফাঁকা, হস্টেলেও একটিও ছাত্র নেই।
আমাদের এক বন্ধু জীবনময় ঐ ইস্কুলের ইতিহাসের মাস্টার। সে আমাদের চিঠি লিখেছিল, পুজোর সময় এদিকে বেড়াতে চলে এসো না! জায়গাটা খুব চমত্কার, খুব ভালো পুঁই শাক আর সজনে ডাঁটা পাওয়া যায়। আর রামপুরহাটের বেগুন তো বিখ্যাত। আমাদের ঠাকুর খুব ভালো ঝিঙে পোস্ত রান্না করে। অবশ্য এখানকার মুরগিগুলোও বেশ মোটাসোটা। আর থাকার জায়গারও কোনো অসুবিধে নেই। এক একজন দু’তিন খানা করে ঘরে নিয়ে শুতে পারে।
চিঠি পেয়েই আমি, রতন আর অসীম আর তার বউ জয়া আর ওদের ছেলেমেয়ে ভুটানি আর বাবুয়া রওনা হয়ে পড়লুম। আমরা আগে কেউ রামপুরহাট যাইনি, দেখেই আসা যাক্ জায়গাটা।
স্টেশনে নেমেই আমরা একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। মোটরগাড়ি যখন প্রথম আবিষ্কার হয়েছিল, ট্যাক্সিটা বোধ হয় সেই সময়কার। তার হর্ণ বাজে না। কিন্তু সারা গাড়িতেই এমন ঝকার ঝক্ হুড়ুম হাড়াম শব্দ হয় যে হর্ণের কোনো দরকার নেই। ট্যাক্সিটা দেখলেই রাস্তার লোক দৌড়ে মাঠে নেমে যায় আর অন্য গাড়িগুলো অনেক দূরে থেমে পড়ে। মনে হয়, এখানে ট্যাক্সিটা বেশ বিখ্যাত।
আমাদের অবশ্য বেশ ভালো লাগছিল। ট্যাক্সিতে বসে লাফাতে লাফাতে যাচ্ছি। এক সঙ্গে ট্যাক্সি চড়া আর ঘোড়ায় চড়া হয়ে যাচ্ছে।
তখন বিকেলবেলা। গাড়িটা শহর ছাড়াবার পরেই রাস্তার দু’পাশের দৃশ্য বেশ সুন্দর। অনেক দূর পর্যন্ত ঢেউ খেলানো মাঠ। ঠিক পাহাড় নেই, তবে অনেকটা পাহাড় পাহাড় ভাব। লাল রঙের পাথরের ঢিবি, আর মাঝে মাঝে বিরাট বিরাট গাছ। আর আকাশটাকে বেশ জমকালো করে সূর্য ডুবছে। ঠিক যেন একটা ছবি। অর্থাত্ চুলকাটার সেলুনের ক্যালেন্ডারে যে-রকম ছবি থাকে, ঠিক সেইরকম।
আমরা মুগ্ধ হয়ে সেই ছবি দেখছিলাম, ইতিমধ্যে ট্যাক্সিওয়ালা আমাদের ভুল রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছিল। সে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল তারাপীঠে। এখানে নাকি সবাই তারাপীঠের মন্দির দেখতে আসে। আমরা স্কুল যাবো শুনে সে তো খুব অবাক। ছুটির সময় আবার কেউ ইস্কুলে যায় নাকি?
যাই হোক, কোনো রকমে তো পৌঁছোনো গেল। ইস্কুলের গেটেই দাঁড়িয়েছিল জীবনময়। হাতে একটা বিরাট লম্বা লাউ, ঠিক একটা গদার মতন। আমাদের দেখে এক গাল হেসে বললো, তোরা আসবি বলে এক্ষুনি এই লাউ কিনলুম।
রতন অমনি ধমক দিয়ে বললো, মোটেই আমরা লাউ কিংবা পুঁইশাক কিংবা সজনে ডাঁটা খেতে এখানে আসিনি। নিরামিষ খেলে আমার হেঁচকি ওঠে।
জীবনময় বললো, দু’কেজি বড় বড় চিংড়িমাছও কিনেছি অবশ্য।
অসীম বললো, লাউ-চিংড়ি জিনিসটা অবশ্য মন্দ নয়। কিন্তু মোটা মোটা মুরগিগুলো কোথায়?
জয়া বললো, একি, এসেই তোমরা খাওয়ার কথা শুরু করলে যে!
ভুটানি আর বাবুয়া ডন বৈঠক দিতে শুরু করেছে। ট্যাক্সির ঝাঁকুনিতে ওদের গায়ে ব্যাথা হয়ে গেছে। তারপরই ওরা এক ছুটে চলে গেল বাগানে।
জিনিসপত্র নিয়ে আমরা চলে এলাম হস্টেলে। বারোখানা ঘর। সবগুলোই ফাঁকা। বেশ অনেকদিন বাদে আমাদের একটা ছাত্র ছাত্র ভাব এলো। আমরা ছাত্রদের খাটো শোবো, তাদের চেয়ার-টেবিলে বসবো। শুধু আমাদের পড়াশুনো করার জন্য তাড়া দেবার কেউ নেই।
হস্টেলের পাশেই বিরাট বড় মাঠ। অনেক রকম গাছপালাও রয়েছে। ভুটানি আর বাবুয়া বেশ খানিকক্ষণ সেখানে হুটোপুটি করার পর ঝগড়া করতে করতে ফিরে এলো। ভুটানি আর বাবুয়ার বয়েস তেরো আর এগারো, কিন্তু ওরা মাঝেমাঝেই বড় ঝগড়া করে।
ট্রেনে আসবার সময় বাবুয়া একটা বাঁশের বাঁশী কিনেছিল। এখানে খেলতে খেলতে সেটা একবার একটা গাছতলায় রেখেছিল। আর খুঁজে পাচ্ছে না। সে বলছে, ভুটানি সেটা নিয়েছে।
আর ভুটানি বলছে, মোটেই আমি নিইনি। ঐ পচা একটা বাঁশী নিতে আমার বয়ে গেছে!
সে দু’হাত তুলে দেখালো, কোথায় বাঁশী? আমার কাছে আছে!
বাবুয়া বললো, তুই নিশ্চয়ই লুকিয়ে রেখেছিস কোথাও!
আমরা ওদের ঝগড়া থামালাম। সন্ধে হয়ে গেছে। আমি বললাম, কাল সকালে আমিই খুঁজে দেবো বাঁশীটা। বাগানেই নিশ্চয়ই কোথাও পড়ে আছে।
রাত্তিরে খাওয়া দাওয়া বেশ ভালোই হলো। হস্টেলের ঠাকুরটা ভাগ্যিস ছুটি নেয়নি। রান্না সে ভালোই করে। শুধু ডাল রাঁধতে জানে না। ডালের বাটিতে নেমে অনায়াসে সাঁতার কাটা যায়।
খাওয়ার আগে ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমরা তার মানে বুঝতে পারিনি। সন্ধের পর আমরা চা খাচ্ছিলাম। রতন ওর চায়ের কাপটা নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। আমরা ঘরের মধ্যে। চমত্কার ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। ইউক্যালিপটাস পাতার গন্ধ। রতন গান গাইছিল আপন মনে। একটু বাদে ঘরের মধ্যে ফিরে এলো। চায়ের কাপটা বারান্দাতেই রেখে এসেছে। সেটা মনে পড়তেই বারান্দায় ফিরে গিয়ে দেখলো, কাপটা নেই।
রতন চেঁচিয়ে বললো, আরে, আমার চায়ের কাপ কোথায় গেল?
আমরাও বারান্দায় গিয়ে খুঁজলাম। চায়ের কাপটা পাওয়াই গেল না।
জয়া বললো, নিশ্চয়ই আপনি কাপটা ভুল করে অন্য কোথাও ফেলে এসেছেন।
রতন বললো, না, এই তো রেলিং-এর ওপর রেখেছিলাম।
রেলিং-এর ওপর কেউ কাপ রাখে? নিশ্চয়ই নিচে পড়ে গেছে। আমরা সবাই মিলে বকলাম রতনকে। রতন নিচে গিয়েও দেখে এলো। সেখানে ভাঙা কাঁচের টুকরোও পড়ে নেই। তাহলে চায়ের কাপ কোথায় যাবে? অর্ধেক চা ভর্তি কাপ তো আর হাওয়ায় উড়ে যেতে পারে না। রতনের যা ভুলো মন। নিশ্চয়ই অন্য কোথাও রেখেছে কখন।
জীবনময় তখন শহরে গিয়েছিল কয়েকটা জিনিসপত্র কিনতে। সুতরাং কাপের ব্যাপারটা আমরা একটুবাদে ভুলে গেলাম।
এখানে কলের জল নেই। হস্টেলের বাইরে বেশ বড় একটা কুয়ো আছে। উঁচু করে পার বাঁধানো। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে, মুখ ধোওয়ার জন্য কেউ বাইরে যেতে চায় না। কুয়ো থেকে বালতি ভরে ভরে জল আনা হতে লাগলো ভেতরে। আমিই কুয়ো থেকে জল তুলছিলাম। পরিশ্রম করলে শীত কেটে যায়।
জল তোলা শেষ হলে বলতি টালতি নিয়ে ভেতরে আসবার পর খেয়াল হলো চটিটা ফেলে এসেছি। ফিরে এসে দেখি চটি জোড়া অদৃশ্য হয়ে গেছে।
আমি বুঝে গেলুম, এটা রতনের কাণ্ড। খানিকটা আগে চায়ের কাপের জন্য ওকে বকেছি বলে ও আমার চটি লুকিয়েছে। ফিরে গিয়ে আমি কাউকে কিছু না বলে রতনের চটি নিজের পায়ে পরে নিলাম।
রতন একটুবাদেই বললো, এই, তুই আমার চটি পরেছিস কেন?
আমি বললাম, তুই আমার চটি কোথায় লুকিয়েছিস, দে!
আমি তো তোর চটি নিই নি।
কুয়োর ধার থেকে তুই যে আমার চটি পরে চলে এলি?
না সত্যিই না।
তখন টর্চ নিয়ে আমরা দু’জনে আবার গেলাম কুয়োর ধারে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও চটি পাওয়া গেল না।
রতন তখন চোখ গোলগোল করে বললো, একি ভুতুড়ে ব্যাপার নাকি? আমার কি রকম সন্দেহ হচ্ছে!
চাঁদ ওঠেন, তাই ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারদিক নির্জন। এর মধ্যে ভূতের নাম করা মোটেই উচিত নয়।
আমি তবু সাহস সঞ্চয় করে বললাম, যাঃ ভূতে চটি নিয়ে কি করবে?
তাহলে চটি জোড়া গেল কোথায়? এই মাত্র ছিল এখানে।
কিন্তু ভূতে কখনো জুতো নেয়, তা শুনিনি! ভূতেরা তো জামা কাপড়ই পরে না। জামা কাপড় না পরে শুধু চটি কেউ পায় দেয়?
চটি পরা একটা ভূতের কথা চিন্তা করতেই আমার হাসি পেল। আমি বললাম, নিশ্চয়ই কুকুর-টুকুর এসে
রতন বললো, আমার চায়ের কাপটাও কি কুকুরে নিয়েছে?
এমন সময় একটা হালকা বাঁশীর আওয়াজ শোনা গেল বাগান থেকে। কেউ যেন নতুন বাঁশী শিখছে।
রতন ভয় পেয়ে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললো, শুনতে পাচ্ছিস? বাবুয়ার যে বাঁশীটা হারিয়ে গিয়েছিল
এবার আমারও একটু সন্দেহ হলো। কিন্তু রতনের কাছে সাহস দেখানো দরকার। তাই বললাম, চল্, বাগানটা খুঁজে দেখে আসি।
রতন কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, জীবনময়কে ডাকি তাহলে?
আমি বললাম, ওকে ডাকতে হবে কেন? আমরা দু’জনে তো আছি, সঙ্গে টর্চ রয়েছে।
দু’জনে খুব ঘেঁষাঘেঁষি করে বাগানটা ঘুরে দেখলাম। কোথাও কেউ নেই। বাঁশীর শব্দটাও থেমে গেছে। টর্চের আলোয় এক সময় দেখতে পেলাম, একটা গাছের তলায় বাবুয়ার বাঁশীটা পড়ে আছে। মাঝখান থেকে ফাটা, সেটা থেকে শব্দ বেরুবার কথা নয়।
দু’জনে ছুটতে ছুটতে ফিরে এলাম হস্টেলে। রতন সোজা জীবনময়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, এখানে ভূত আছে, আমাদের বলিস নি কেন?
জীবনময় অবাক হয়ে বললো, ভূত! ভূত আবার কি?
আলবত্ এখানে ভূত আছে।
তোদের মাথা খারাপ। এই হস্টেলে আটচল্লিশজন ছাত্র থাকে। তাদের সামনে ভূত তো দূরের কথা ব্রহ্মদৈত্যও আসতে সাহস করবে না। আজকালকার ছাত্রদের তো চিনিস না!
রতন তবু বললো, তাহলে সুনীলের চটি, আমার চায়ের কাপ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে কি করে?
বাবুয়া আর ভুটানি ভূতের কথা শুনেই চঁ্যাচামেচি শুরু করে দিয়েছে। আর জীবনময় হো-হো করে হাসছে। এরকম সময় হাসি কারুর ভালো লাগে?
এক সময় হাসি থামিয়ে জীবনময় বললো, সত্যি, হুপার কথাটা তোমাদের আগেই বলে দেওয়া উচিত ছিল।
আমরা তিন চারজন মিলে একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, হুপা? হুপা আবার কে?
জীবনময় বললো, সে একটা সাঙ্ঘাতিক চোর। তার জ্বালায় এখানকার সব লোক অস্থির।
চোরের কথা শুনে সকলের ভূতের ভয় কমে গেল। বাবুয়া বললো, চোরটাকে পুলিশে ধরতে পারে না?
জীবনময় বললো, ধরবে কি করে, তাকে দেখতেই পাওয়া যায় না! সে যে কখন আসে আর কখন যায়, কেউ টের পায় না। তবে, সে খুব বড় কিছু কিংবা দামী কোনো জিনিস এখনো চুরি করেনি। তাই সব সময় লোকে পুলিশে খবরও দেয় না!
বলতে বলতেই জীবনময় ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালো। ব্যস্ত হয়ে বললো, কুয়োতলায় বালতি ফেলে আসোনি তো? তাহলে এতক্ষণ গেছে।
সবাই মিলে কুয়োতলা ছুটলাম। অন্য বালতিগুলো ভেতরে আনা হয়েছিল। কিন্তু যে-বালতি দিয়ে জল তোলা হয় সেটা দড়ির সঙ্গে বাঁধাই ছিল। গিয়ে দেখি সেটা হাওয়া হয়ে গেছে!
রাত্তিরে আমরা জানলা দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। সকালে উঠে দেখা গেল আর কিছু চুরি যায়নি।
চা-টা খেয়ে আমরা বেড়াতে বেরুলাম। কাছেই একটা ছোট নদী আছে। বেশ টলটলে জল। একটু দূরে দূরে গ্রামও রয়েছে কয়েকটা। সেরকম একটা গ্রাম পেরুলেই পশ্চিম বাংলা শেষ হয়ে বিহার। বাবুয়া আর ভুটানি ছুটে ছুটে একবার পশ্চিমবাংলা একবার বিহারে আসা যাওয়া করতে লাগলো। তাই দেখে রতন বললো, একেই বলে আন্তঃ রাজ্য দৌড় প্রতিযোগিতা!
ফিরে এসে শুনলাম, আমাদের জন্য যে দুটি মুরগি কিনে রাখা হয়েছিল, সে দুটোই চুরি হয়ে গেছে। রান্না ঘরের বারান্দায় একটুক্ষণের জন্য মুরগি দুটোকে রেখে ঠাকুর ভেতরে গিয়েছিল একটা গামলা আনতে, সেই ফাঁকেই হুপা এসে সে দুটো নিয়ে গেছে।
সেই দুপুরে বাধ্য হয়ে আমাদের নিরামিষ খেতে হলো বলে আমরা হুপার ওপর সত্যিই খুব রেগে গেলাম।
খেয়ে দেয়ে দুপুরে ঘুম দিয়ে বিকেলে জেগে ওঠার পর হুপার আর এক কীর্তি দেখা গেল। জয়া বাইরের দড়িতে ছেলেমেয়েদের জামা প্যান্ট আর নিজের একটা শাড়ী কেচে শুকোতে দিয়েছিল। সে সব তো গেছেই, এমনকি দড়িটা পর্যন্ত নেই!
অসীম এবার রেগে গিয়ে জীবনময়কে বললো, এ কোন জায়গায় নিয়ে এলি আমাদের? চোরের রাজত্ব একটা!
জীবনময় বললো, না ভাই এখানে আর কোনো চোর নেই, শুধু হুপার উত্পাতেই নতুন লোকেরা জব্দ হয়ে যায়।
কেন, হুপা বুঝি পুরোনো লোকদের জিনিস চুরি করে না?
না, তা নয়। আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। আমরা কোনো কিছুই বাইরে রাখি না। হুপার কিন্তু একটা গুণ আছে। সে কক্ষণো ঘরে ঢুকে কিছু চুরি করে না। তুমি ঘরের দরজা খুলে রাখো, ভেতরে যতই দামী জিনিস থাক সে হাত দিতে সাহস করবে না।
রতন ধমক দিয়ে বললো, থাম, চোরের আবার গুণ! এখানকার পুলিশ কি এতই অপদার্থ যে একটা চোরকেও ধরতে পারে না?
জীবনময় বললো, শুনেছি, অনেকদিন আগে ধরে পড়েছে দু’ একবার। কিন্তু ছিচ্কে চুরি তো, দু মাস তিন মাস জেল খেটে বেরিয়ে আসে, আবার চুরি করে। লোকটার দেখা পাওয়াই খুব শক্ত। তুম্বুনি গ্রামে ওর বাড়িও আছে, সেখানে গিয়েও ওকে ধরা যায় না। একবার হস্টেলের ছেলেরা ওকে রাত্তিরবেলা প্রায় ধরে ফেলেছিল। তাও হাত ফসকে পালালো। দৌড়ে গিয়ে একটা পুকুরে লাফিয়ে পড়লো, তারপর আর দেখাই গেল না।
ওকে কিরকম দেখতে?
রোগা, ছোট্টখাট্টো চেহারা, কাঁধে একটা ঝোলা।
এর পরের দু দিনে আমাদের দু’জোড়া চটি, তিনটে গেঞ্জি, ভুটানির চুলের ফিতে, বাবুয়ার ক্রিকেট ব্যাট, জয়ার চিরুনিচুরি হয়ে গেল। কোনো জিনিস ভুল করে একটুও বাইরে ফেলে রাখার উপায় নেই। টুক করে জিনিসটা নিয়েই অদৃশ্য হয়ে যায়।
বাবুয়া আর ভুটানি তো দারুণ ক্ষেপে উঠলো। তারা ঠিক করলো, চোরটাকে ধরবেই! বাবুয়া কখনো চোর দেখেনি, তার হুপাকে দেখার দারুণ উত্সাহ। অনেক সময় ওরা ইচ্ছে করে বাগানে কোনো জিনিস ফেলে এসে আড়ালে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে। তখন কিন্তু হুপা আসে না। সেও কম চালাক নয়।
রাস্তায় ঘাটে কোনো রোগা আর ছোট্টখাট্টো চেহারার লোক দেখলেই আমাদের সন্দেহ হয়। সেরকম কোনো লোককে যখন আমরা সন্দেহ করেছি, তখনই হয়তো হুপা অন্যদিক থেকে এসে আমাদের আর একটা জিনিস চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
দিন সাতেকের মধ্যে হুপা সত্যিই আমাদের জব্দ করে দিল। কিছুতেই আমরা তাকে একবার দেখতেও পেলুম না, অথচ সে সমানে আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে পালাচ্ছে। অন্ধকার হলেই মনে হয়, যে-কোনো গাছের আড়ালেই বোধহয় থলে ঘাড়ে করে হুপা ঘাপটি মেরে বসে আছে। কোনো জিনিসে তার অরুচি নেই। কয়লাভাঙা হাতুড়িটাও সে বাদ দেয় না।
দু’দিন বাদে আমাদের ফিরতে হবে। বাবুয়ার বেশী আফশোস, সে হুপাকে একবার, অন্তত একবার দেখতেও পেলে না। এত কাছে এসেও একটা চোর দেখা গেল না।
সেদিন সকালে আমরা গ্রামের দিকে বেড়াতে গেছি। জীবনময় বললো, এই গ্রামেই হুপার বাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই বললাম, দেখতে যাবো! জীবনময় বললো, তাকে কিছুতেই বাড়িতে পাবে না। আমরা বললাম, তা হোক্।
একটা পুকুর ধারে একটা বাঁশের চ্যাচাড়ির তৈরি বাড়ি। তাও ভাঙাচোরা। বাড়ির পাশের লাউমাচার কাছে খুব ছেঁড়া কাপড় পরা একজন মেয়েলোক দাঁড়িয়ে। জীবনময় বললো, ঐ হুপার বৌ। ধুলোয় বসে দুটো ছেলেমেয়ে বিচ্ছিরি গলায় কাঁদছে। ওরা হুপার ছেলেমেয়ে। তাহলে হুপা নামে সত্যিই একজন কেউ আছে। চোর দেখা হলো না বটে, কিন্তু চোরের বাড়িটা দেখা হয়ে গেল।
বাবুয়া জিজ্ঞেস করলো, ছেলেমেয়ে দুটো কাঁদছে কেন?
আমরা কেউ কোনো উত্তর দিলাম না। বাবুয়া বললো, চোরটা কি পাজী, আমরা খেলনাগুলো চুরি করে এনেছে, তাও নিজের ছেলেমেয়েদের খেলতে দেয়নি। তা হলে চুরি করে কেন ও?
ফেরার সময় দেখলাম, রাস্তা দিয়ে একজন মোটা মতন লোক ঢোল বাজাতে বাজাতে কি যেন বলছে। মন দিয়ে শুনলাম, সেদিন হাটে গভর্নমেন্টের দুটো আলমারি নিলাম হবে, সেই কথা জানাচ্ছে। গ্রামের দিকে নিলামের খবর এইভাবে জানায়।
রতন হঠাত্ বললো, আচ্ছা হুপাকে আমাদের বাড়িতে একবার নেমন্তন্ন করলে হয় না? আমরা ওকে কিছু বলবো না, পুলিশেও ধরাবো না। শুধু দেখবো। চোরটা কিন্তু সত্যিই মজার!
বাবুয়া আর ভুটানি লাফিয়ে উঠলো, হঁ্যা, আমরা দেখবো, আমরা দেখবো।
জীবনময় বললো, কিন্তু তাকে পাওয়া যাবে কোথায়? ওর বাড়িতে কিছু বলে লাভ নেই। দুদিন তিনদিন হয়তো বাড়িই ফেরে না!
রতন বললো, আমি সে ব্যবস্থা করছি। রতন সেই ঢোলওয়ালাকে ডেকে কিছু বলে এলো। টাকাও দিলো দুটো। তারপর থেকে সেই ঢোলওয়ালা চঁ্যাচাতে লাগলো, আজ রাতে ইস্কুল বাড়িতে হুপার নেমন্তন্ন, বাবুয়া তাকে খাওয়াবেন। তার কোনো ভয় নেই। সে পেট ভরে খাবে। গোপনতা রক্ষা করা হবে! বাবুয়া ভাত ডাল মাছ মাংস আর এক খিলি পান খাওয়াবেন।
সেদিন সন্ধের পর থেকেই হুপার নেমন্তন্নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা হতে লাগলো। বাবুয়া আর ভুটানি দুপুর থেকেই কয়েকটা বড় বড় কাগজে লিখেছে, হুপা, আজ তোমার নেমন্তন্ন, তোমাকে মারা হবে না, বকা হবে না, জিনিস ফেরত্ চাওয়া হবে না। এসো কিন্তু! তারপর সেই কাগজগুলো আটকে দিয়েছে কয়েকটা গাছে।
চোর একটু বেশী রাত্রেই আসবে ভেবে আমরা নিজেদের খাওয়া দাওয়া আগে সেরে নিলাম। তারপর থালা-বাটিতে হুপার খাবার সাজিয়ে রেখে দিলাম একতলার বারান্দায়। হুপা ঘরের মধ্যে ঢোকে না বলে বারান্দাতেই তার খাবার রাখতে হলো। আমরা সবাই মিলে বসে রইলাম ঘরের চৌকাঠে।
রাত বাড়তে লাগলো, হুপা আর আসে না। তিনখানা গ্রামে ঢোল পিটিয়ে জানানো হয়েছে, হুপা খবর পেয়েছে নিশ্চয়ই। সে কি আমাদের বিশ্বাস করতে পারবে না?
ভুটানি আর বাবুয়া ছড়া বানিয়ে সুর করে বলতে লাগলো, আয়, আয়, হুপা আয়! ভাত দেবো, মাছ দেবো, পিঁড়ি পেতে বসতে দেবো, গেলাস ভরে জল দেবো, বাটি ভরে মাংস দেবো, মিঠে পাতা পান দেবো, আয় আয় হুপা আয়!
হুপা আর আসে না। দশটা, এগারোটা, এমনকি বারোটা পর্যন্ত বেজে গেল, তবু হুপা এলো না। চোরটা তো আচ্ছা নেমকহারাম! অসীম, জয়া আর জীবনময় রাগ করে শুতে চলে গেল। বাবুয়া আর ভুটানি জেদ করে বসে থাকলেও আর বেশীক্ষণ জাগতে পারলো না। ঘুমিয়ে পড়লো সেখানেই। আমি আর রতন বসে বসে গল্প করতে লাগলাম। একসময় সব গল্পও ফুরিয়ে গেল।
কখন দুজনেই যে ঝিমিয়ে পড়ে ছিলাম তা খেয়াল নেই। হঠাত্ জেগে উঠেই চমকে উঠলাম। থালা বাটিগুলো সব খালি। কাছে গিয়ে দেখলাম সব কিছু চেটে পুটে কে যেন খেয়ে গেছে। মানুষই নিশ্চয়ই, নইলে ঐরকমভাবে থালা বাটি পরিষ্কার হয় না। কতটুকু সময় মাত্র আমরা ঝিমিয়েছিলাম, তারই মধ্যে হুপা এসে খেয়ে গেছে!
থালা বাটি গুলোও যে সে নিয়ে যায়নি, সেটাই অবাক কাণ্ড। তাতেই বুঝলাম, আজ সে চুরি করতে আসেনি, নেমন্তন্ন খেতেই এসেছিল। নেমন্তন্ন খেয়ে কেউ থালাবাটি সঙ্গে নিয়ে যায় না, সেইটুকু জ্ঞান আছে। তবে বোধহয় বড্ড লাজুক, আমাদের চোখের সামনে খেতে চায়নি।
তারপর যে আমরা আর একটা দিন ছিলাম ওখানে, সেদিন আর আমাদের কোনো কিছুই চুরি যায়নি! তখন আমরা সবাই ঠিক করলাম, এরপর কোথাও বেড়াতে গেলে প্রথমেই চোরকে নেমন্তন্ন খাওয়াতে হবে। চোররাও ভদ্রতা জানে!