সব ঘোড়াই কথা বলে

সব ঘোড়াই কথা বলে

গাবার জ্যেঠামশাই দুন্দুভি মুখুজ্যে হঠাত্‌ একদিন একটা ঘোড়া কিনে ফেললেন। গ্রামের শেষ প্রান্তে গো-হাটা, সেখানে বেদে বেদেনীরা মাঝে সাঝে ঘোড়া বিকোতে আসে, সেদিনও এসেছিল। দুন্দুভি মুখুজ্যে দেখলেন ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুটের মতো রঙ, চমত্‌কার একটা ঘোড়া। এগিয়ে এসে দরদস্তুর করলেন, দরেও বনে গেল। ব্যাস, আর যায় কোথায়! করকরে টাকা বার করে ঘোড়াটা কিনে ফেললেন।

বেদে বলল, চলুন বাবুজী ঘোড়াটা আপনার মোকামে পৌঁছে দিয়ে আসি।

তারপর তড়াক করে সেই জোয়ান ছোকরা ঘোড়ায় চেপে বসল, পেছনে বসিয়ে নিল মুখুজ্যেকে। আহ্, ঘোড়া তো নয়, পক্ষীরাজের বাচ্চা। সামনে ঘাড়ের কেশর কাশ ফুলের মতো ঢল খাচ্ছে, পেছনে ফুলঝাড়ুর মতো লেজ, চিরিক চিরিক করে লাফিয়ে মুখুজ্যের পিঠে লাগছে, যেন ঘামাচি গেলে দিচ্ছে। আহ্, কি আরাম!

সারা বুক গর্বে ভেসে যাচ্ছিল মুকুজ্যের। ঘোড়া নিয়ে এসে উনি বাড়ির উঠোনে দাঁড়ালেন। অন্দর বাড়ি থেকে মেয়েরা, বউয়েরা, ঝিয়েরা বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এল গাবার ছোটকাকু, বড়কাকু, বাবা।

—  ওমা, ঘোড়া যে!

—  তবে কি ভেবেছিলে, কুকুর? ঘোড়া না হলে এই গ্রামে আমাদের প্রেস্টিজ থাকে! তোমরা শাঁখ বাজাও গো মেয়েরা, ঘোড়াকে বরণ করে ঘরে তোল।

গাবাই সবচেয়ে বেশি খুশী। গা দিয়ে ওর ছিলিক ছিলিক করে খুশী ঝরে পড়তে শুরু করে। একবার এপাশে ছোটে, একবার ওপাশে। ঘোড়ার কান দুটো কেমন মোচার খোলের মতো। কুরকুরি কাটতে ইচ্ছে হয়। গলার নিচটা সাদা। গলা জড়িয়ে ধরে একবার দোল খেতে পারলে বেশ হত। কিন্তু সাহসে কুলোয় না, ঘোড়া রেগে গেলে কামড়ে দেয় কিনা জানা নেই।

হুটোপাটি করতে করতে এক সময় ওর নতুন মাস্টারমশাইয়ের কথা মনে পড়ল। মাস্টারমশাই নিখিলেশবাবু সারাজীবন মাস্টারি করে এখন অবসর জীবন যাপন করছিলেন। গাবা পর পর তিন বছর ক্লাস সিক্সেই ফেল করায় দুন্দুভি মুখুজ্যে ওঁকে চিঠি দিয়ে কলকাতা থেকে আনিয়ে নিয়েছিলেন। মাইনে-পত্র অবশ্য কম, তবে খাওয়া থাকা ফ্রি, আর গাবাকে যদি পাশ করিয়ে দিতে পারেন তাহলে বিঘা চারেক জমি লিখে দেবেন কথা আছে। টিনের সুটকেশ আর বগলদাবা বিছানা নিয়ে ভদ্রলোক মুখুজ্যে বাড়ির বাইরে একটা ঘরে আস্তানা গেড়েছিলেন।

বাড়িতে ঘোড়া আনা হয়েছে, চারপাশে হৈচৈ। নিখিলেশবাবু একবার একটু উঁকি মেরে দেখে এলেন। তেমন উত্‌সাহ পেলেন না। তারপর সময় নষ্ট করা হচ্ছে মনে করে ‘সীতার বনবাস’খানা খুলে বসলেন। এমন সময় গাবাচরণ লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকে নিখিলেশবাবুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “মাস্টারমশাই ঘোড়া এসেছে, ঘোড়া।”

নিখিলেশবাবু বই বন্ধ করলেন।

“কি সুন্দর একটা ঘোড়া এনেছে জ্যেঠামশাই, দেখেছেন?”

“দেখেছি বই কি! খুব সুন্দর।”

গাবা আরো গায়ে গায়ে সেঁটে বসে বলে, “আচ্ছা মাস্টারমশাই?”

“কি বাবা গাবা?” বিরক্তি মিশিয়ে উত্তর দেন নিখিলেশবাবু।

“একটা কথা জিজ্ঞেস করব? রাগ করবেন না তো?”

“ছি, ছি, রাগ করব কেন, বলো?”

“ঘোড়া কথা বলে না?”

“বলে বই কি বাবা, বলাতে জানলেই বলে।”

গাবা চনমন করে উঠে বসে। “আমাদের ঘোড়াও তা হলে কথা বলবে?”

“আলবাত্‌ বলবে।” নিখিলেশবাবু একটা হাই কাটেন। “ঘোড়া তো তবু উচ্চ শ্রেণীর জীব, কত গাধার মুখে আমি কথা ফোটালাম।”

এমন সময় দুন্দুভি মুখুজ্যে দরজার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাত্‌ মাস্টারের মুখে ঘোড়ার কথা শুনে থমকে দাঁড়ালেন। “কি মাস্টারমশাই, কেমন দেখলেন আমাদের ঘোড়া?”

নিখিলেশবাবু ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ান। “আজ্ঞে খাসা, খাস মুলতানী বংশধর।”

“তবেই বলুন। আমার পছন্দ আছে কি না দেখিয়ে দিলাম তো!”

“তা আর বলতে!” নিখিলেশবাবু মাথা ঝাঁকান, “ভারী চমত্‌কার আপনার পছন্দ।”

এমন সময় গাবা বলে, “জানো জেঠু, মাস্টারমশাই না ঘোড়াকেও কথা বলাতে পারেন।”

“বটে বটে!”

মহা বিপাকে পড়ে যান নিখিলেশবাবু, মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলেন, “কথা বলানো মানে, এক কালে ঘোড়ার সাইকোলজি নিয়ে কিছু পড়াশুনা করেছিলাম। তখন ঘোড়াকে যদি বলতাম, ওঠ, অমনি ঘোড়া উঠে দাঁড়াত। যদি বলতাম, বোস, অমনি বসে পড়ত।”

দুন্দুভি মুখুজ্যে খুশীতে আটখানা, “বটে বটে?”

নিখিলেশবাবু সামলাবার চেষ্টা করেন, “তবে এখন কি জানেন, এখন আমি নিজেই একটা বুড়ো ঘোড়া, রাতদিন কেবল জাবর কাটি।”

গাবা সরলভাবে আঙুল চুষছিল, বলল, “তাহলে মাস্টারমশাই আপনি ঘোড়ায় চড়তেও জানেন?”

নিখিলেশবাবুর ইচ্ছে হল ঠাস করে ছেলেটার গালে একটা চড় কষিয়ে দেন, কিন্তু নিজের জ্ঞানগম্যির ওপর বাড়ির লোকের শ্রদ্ধা বাড়াবার জন্য অদ্ভুত চোখে হেসে ওঠা ছাড়া উপায় রইল না। ভাবখানা এরকম, যেন কত পাগলা ঘোড়াকে বশ মানালাম, আর এটুকু পারব না। মাস্টার হওয়া কি মুখের কথা।

দুন্দুভি মুখুজ্যে আরো খুশী। এত দিনে একজন মাস্টারের মতো মাস্টার পাওয়া গেছে। মাস্টারের নামে আধ সের করে দুধ বাড়িয়ে দিলেন তিনি।

পর দিন ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির বাইরে হৈচৈ। কী ব্যাপার? না, ঘোড়া নিয়ে কসরত শুরু হয়ে গেছে। দুন্দুভি মুখুজ্যের হাতে চাবুক, মুখুজ্যেকে ঘিরে জনা চার-পাঁচ লোক। ঘোড়া বেগরবাই শুরু করেছে। ঘোড়ার লাগাম হাতে যেই কেউ উঠতে যায়, অমনি ঘোড়া সামনের পা দুটো তুলে চিঁহিহি চিঁহিহি…সে কি চিত্‌কার।

যাঃবাবা, এরকম তো করার কথা ছিল না। কালও তো দিব্যি বেদেরা ঘোড়ার পিঠে চড়েছে। মুখুজ্যেমশাইকে পিঠে চড়িয়ে বাড়ি অবদি টুকুস টুকুস করে হেঁটে এসেছে। তখন তো ঘোড়া গোলমাল করেনি।

দুন্দুভি মুখুজ্যে এগিয়ে এসে ঘোড়ার পিঠে হাত বোলান, “চটছিস কেন বাবা, এখানে তো জামাই আদরেই থাকবি। যা খেতে চাস, খেতে পাবি। শুধু দয়া করে একটু পিঠে চড়তে দে। দিবি না? এই, এই ঘোড়া?”

গাবা এই সব দৃশ্য ফৃশ্য দেখে হাবা হয়ে গিয়েছিল। ছোট কাকুকে আর একটু হলে চেপটেই দিয়েছিল আর কি! পা দুটো সামনে তুলে ঘোড়াটা যখন লম্বা হয়ে দাঁড়াল, তখন দু হাতে ও চোখ চেপে চিত্‌কার করে উঠেছিল।

দুন্দুভি মুখুজ্যে বুঝতেই পারছিলেন না, গণ্ডগোলটা কোথায়! কাউকেই ও পিঠে তুলে নিতে চাইছে না কেন! আচ্ছা বেয়াদপ তো! এমনি কিন্তু বেশ শান্তশিষ্ট, যেন ভাজা মাছটাও উলটে খেতে জানে না। কিন্তু পিঠে চড়তে গেলেই ধ্যাস্টামি।

অবশেষে হতাশ হয়ে উনি মাস্টারমশাইয়ের তলব করলেন, “মাস্টার কোথায় রে?”

গাবা উত্তর করল, “ঘুমুচ্ছে জ্যেঠামশাই।”

“এই বেলা অবদি ঘুমুচ্ছে। যা, ডেকে নিয়ে আয়। ঘোড়াকে কি করে শায়েস্তা করতে হয় এবার দেখাচ্ছি।”

সবাই কেমন হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে। গাবার বাবা বলেন, “আমরাই যাকে বাগে মানাতে পারছি না, বুড়ো মাস্টারমশাই তাকে কী করবে। নিরীহ গোবেচারা মানুষ।”

গাবা ততক্ষণে সাঁ করে ছুটে গিয়ে মাস্টারমশাইয়ের কাছে হাজির।

“মাস্টারমশাই, ও মাস্টারমশাই!”

“কি রে গাবা, কি হয়েছে?”

“ঘোড়াটা বেয়াদপি করছে মাস্টারমশাই। বাবা আপনাকে ডাকছেন।”

নিখিলেশবাবুর বুক শুকিয়ে গেল, “বেয়াদপি করছে মানে?”

“কি জানি মাস্টারমশাই, কেউ ওর পিঠে উঠতে পারছে না। উঠতে গেলেই ঘোড়া সামনের দু পা তুলে লম্বা হয়ে যাচ্ছে।”

নিখিলেশবাবু পরনে একটা ধুতি, খালি গা। গেঞ্জিটা গায়ে পরে নিতে নিতে বিড়বিড় করে বললেন, “ঘোড়া কথা শুনছে না, তা আমি কি করব?”

গাবা বলল, “আপনি ইচ্ছে করলেই ঘোড়াটাকে ঠিক করে দিতে পারেন। আসুন না মাস্টারমশাই।”

“আমি কি ঘোড়ার মাস্টার নাকি! যত্তোসব।”

কিন্তু গাবা নাছোড়বান্দা। মাস্টারমশাইকে চেপে ধরল, “চলুন না।”

“এই ছাড় ছাড়। আচ্ছা আমি যাচ্ছি, ছাড়।”

নিখিলেশবাবুর কাঁপুনি শুরু হল। সত্যি সত্যি ঘোড়াকে বশ মানাতে হবে নাকি! ঘোড়ার মাথায় কোন গণ্ডগোল নেই তো? কি কুক্ষণেই যে ঘোড়া নিয়ে অত কথা বলতে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত পেটের দায়ে ঘোড়ার মাস্টারি করা, চাকরিটা বুঝি সত্যি সত্যি এবার গেল।

কি আর করেন, নিখিলেশবাবু কাঁপতে কাঁপতে গাবার সঙ্গে বাইরে এসে দাঁড়ালেন।

“এই যে মাস্টারমশাই, দেখুন দেখি, ঘোড়াটা কি ঝামেলা শুরু করেছে সকাল থেকে।”

“কি করেছে?” বুকটাকে সাহসে বাঁধতে চেষ্টা করলেন নিখিলেশবাবু। তারপর সন্দেহজনক চোখে ঘোড়াটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। দিব্যি শান্তশিষ্ট চেহারা। ডাইনে বাঁয়ে একটু আধটু মাঝে মাঝে যা লেজ নাড়াচ্ছে। বললেন, “নাহ, ঘোড়া তো ঠিকই আছে। আপনারাই হয়তো উঠতে গিয়ে গোলমাল করছেন।”

“আপনি একবার উঠে দেখুন না মাস্টারমশাই।”

“আমি!” নিখিলেশবাবুর পেটের মধ্যে কেউ যেন কোঁত্‌ করে একটা ঘুঁষি মারল। “ওসব ঘোড়ায় চড়াফরা অনেককাল আমি ছেড়ে দিয়েছি। আপনারাই কেউ কেউ চড়ুন, আমি দেখি।”

দুন্দুভি মুখুজ্যে এগিয়ে এলেন, “ঠিক আছে, আমিই চড়ছি। তোমরা কেউ ওর গলার কাছটা চেপে ধরে ঝুলে থেকো তো! ও যেন আর দাঁড়াতে না পারে।”

হাতে চাবুক দোলাতে দোলাতে আলতো করে পিঠে একটা ঘা মারলেন মুখুজ্যেমশাই। ঘোড়া নির্বিকার।

“ঠিক আছে, এবার আপনি উঠুন।” নিখিলেশবাবু পেছন থেকে সাহস জোগাবার চেষ্টা করলেন। বেয়াদপি করলে সটাস সটাস করে চাবুক চালাবেন। বলতে বলতে বেশ কয়েক হাত তফাতে সরে এলেন উনি। বলা যায় না, জন্তু তো! দৌড়ে এসে নিখিলেশবাবুকেই যে ঢুঁশ কষিয়ে দেবে না, বিশ্বাস কি!

মুখুজ্যেমশাই ততক্ষণে রেকাবে পা রেখেছেন একটা। অন্য পা লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠে ছুঁড়ে দেবার আগে করুণ চোখে একবার মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকালেন। যেন, মাস্টারমশাই, আপনিই এখন ভরসা। তারপর জয় মা দুর্গা বলে যেই উনি ঘোড়ার পিঠে লাফ দিয়েছেন অমনি সেই আগের দৃশ্য। চিঁহিহি চিঁহিহি… সটান সামনের দু পা আকাশে তুলে একেবারে মানুষের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল ঘোড়া। আর মুখুজ্যেমশাই সেই চোট সামলাতে না পেরে ছিটকে গড়িয়ে এলেন কয়েক হাত দূরে।

“উফ, মাগো, বাবাগো, মলাম গো, গেলাম গো।”

নিখিলেশবাবুর চোখ চড়ক গাছ। একি ঘোড়ারে বাবা, এ যে উঠে দাঁড়ায়। ঘোড়া কখনো এরকম উঠে দাঁড়াতে পারে উনি চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতেন না।

দুন্দুভি মুখুজ্যেকে সবাই এসে তুলে ধরল। ভাগ্যিস তেমন জোরে চোট লাগেনি।

মুখুজ্যে চেঁচাতে চেঁচাতে বললেন, “দেখলেন তো মাস্টারমশাই, কাণ্ডটা দেখলেন। কাল কিন্তু দিব্যি ও ভালো মানুষ ছিল। আজ ঘুম থেকে উঠেই কেমন গণ্ডগোল শুরু করেছে দেখুন।”

“রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি বোধ হয়। মশাটশা কামড়ায় নি তো ওকে?”

“ঘুম না হলেই যদি এমন করে, তা হলে আমাদের চলে কি করে! ঘোড়া কিনেছি, সকাল বিকেল একটু পিঠে চড়ে বেড়াব, তা যদি না হয়”

“তা হলে না হয় আর এক কাজ করুন, বেদেদের কাছে আবার ওকে ফেরত দিয়ে আসুন। এসব দুষ্টু জানোয়ার না রাখাই ভালো।”

দুন্দুভি মুখুজ্যে প্রায় কাঁদো কাঁদো। “আপনি একবার চেষ্টা করে দেখুন না মাস্টারমশাই, এত সাধ করে কিনলাম।”

গাবার বাবা-কাকাও ছেঁকে ধরলেন মাস্টারমশাইকে, “দেখুন না মাস্টারমশাই একটু চেষ্টা করে, আপনাদের মতো জ্ঞানীগুণী লোক যদি না পারেন তাহলে আর বলার কিছু নেই।”

চাকরি আর সম্মান রাখতে হলে এর পর আর না করা চলে না। যা থাকে কপালে! নিখিলেশবাবু ভাবলেন, ঘোড়ার হাতেই ওঁর মৃত্যুযোগ লেখা আছে, বিধির বিধান তো খণ্ডাবার উপায় নেই, কি আর করা যায়।

দুপা এক পা করে এগিয়ে এসে ঘোড়ার পিঠে হাত ছোঁয়ালেন উনি। কে বলবে এই ঘোড়াই চিঁহিহি করে অমনভাবে দাঁড়িয়ে ওঠে। এখন তো দিব্যি শান্ত। চোখে ওর এতটুকু দুষ্টুমি নেই। ঘোড়ার লাগাম ধরে একটু নেড়েচেড়ে দেখলেন। তারপর অসহায় চোখে চারপাশে একবার তাকালেন।

গাবা পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “আপনি উঠে পড়ুন মাস্টারমশাই, উঠে পড়ুন।”

নিখিলেশবাবু ভীষণ চটে গিয়ে ধমকে উঠলেন, “চোপ! এ সময় চেঁচাতে নেই।” ঘোড়া একবার ঘাড় ফিরিয়ে নিখিলেশবাবুকে দেখে নিল।

ফলে আরো বুকের ভিতর গুড়গুড় করে উঠল। কিন্তু উপায় নেই, ধুতিটাকে মালকোচা মেরে গুটিয়ে নিলেন। তারপর ভয়ে ভয়ে রেকাবে একটা পা তুলে দিলেন। বাপরে এত উঁচু, উঠব কি করে!

“দেখবেন মাস্টারমশাই, পেছনের পায়ের দিকে কিন্তু সাবধান। একবার আপনাকে পায়ের রেঞ্জে পেলে ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেবে।”

কিন্তু কোন উপদেশই যেন কানে ঢুকছিল না নিখিলেশবাবুর। চোখ বুজে একবার ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে নিলেন। তারপর অদ্ভুত এক কায়দায় ঘোড়ার পিঠে শুয়ে পড়ে সাঁতরাতে শুরু করলেন। দু হাতের মুঠোর মধ্যে তখন ঘোড়ার লম্বা লম্বা কেশর।

চিঁহিহি…চিঁহা চিঁহা চিঁহা…ঘোড়া সটান লাফিয়ে উঠল সামনে। কিন্তু প্রাণপণে কেশর চেপে রেখেছেন নিখিলেশবাবু। পা দুটো বেসামাল হয়ে জিনের দু পাশে ঝুলছে। ঝুলতে ঝুলতেই ঘোড়ার পেটে দু পাশে দুবার লাথ লেগে গেল।

ঘোড়ার সামনের পা দুটো ধপাস করে মাটিতে আছড়ে পড়ল। এবার লাফিয়ে উঠল পিছনের পা। ঘোড়া যা ইচ্ছা করুক, শক্ত করে ঘোড়ার কেশর আঁকড়ে রইলেন নিখিলেশবাবু। মরতে যদি হয় ঐভাবেই উনি মরবেন।

চারপাশ থেকে সবাই তখন চেঁচাতে শুরু করেছে, “লাগাম চেপে ধরুন মাস্টারমশাই, সাবধান, লাগাম চেপে ধরুন।”

কিন্তু কোন কথাই কানে ঢুকছিল না তখন। ঘোড়ার পেছনের পা দুটোও নেমে এল নীচে। তারপর এলোপাথাড়ি আরো কয়েকটা লাফ। তারপর কি আশ্চর্য, চিঁহা চিঁহা চিঁহা… ঘোড়া মাঠ ছাড়িয়ে ধানবনের দিকে ছুটতে শুরু করল।

নিখিলেশবাবু বুঝতে পারছিলেন না, উনি ঘোড়ার উপরই বসে আছেন, না, ঘোড়াটা ওঁকে আকাশে ছুঁড়ে দিয়েছে! উনি আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছেন! যা থাকে কপালে, একটু একটু করে উনি লাগাম টেনে ধরবার চেষ্টা করলেন। সামনে খানা, খন্দ, জঙ্গল কিছুই মানছে না ঘোড়া, ছুটছে তো ছুটছেই।

আরো কিছুক্ষণ কাটার পর নিখিলেশবাবু বুঝতে পারলেন, ঘোড়ার পেছন পেছন তখন অনেকেই ছুটতে শুরু করেছে। মাঠে যে সব চাষীরা কাজ করছিল তারাও অবস্থা বুঝে দে-ছুট। কোত্থেকে দুটো নেড়ি কুকুর জুটে গেল। ঘোড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওরাও ছুটতে শুরু করেছে। সে এক এলাহী ব্যাপার। কিন্তু ততক্ষণে অবস্থাটা মোটামুটি সামলে নিয়েছেন নিখিলেশবাবু। এতক্ষণ যেন শুয়ে শুয়ে চলছিলেন, এবার একটু একটু করে উঠে বসলেন। লাগামটা এখন হাতের মুঠোয়। ঘোড়ার লাফানির তালে তালে হাত-পাগুলো যেন ওঁর খুলে খুলে যাচ্ছে। যাক্, তবু তো উনি ঘোড়ায় চড়ে ছুটছেন।

ছুটতে ছুটতে হঠাত্‌ একটা ডোবা মতো চোখে পড়ল। ডোবার উপরই ঝাঁপিয়ে পড়বে নাকি! এই সেরেছে। এ যে একেবারে পাঁকে ভর্তি। আবার বুক শুকিয়ে এল নিখিলেশবাবুর। শক্ত করে লাগামটা উনি টেনে ধরতেই ঘোড়া একেবারে ডেট স্টপ। আর এ সময় ওঁর হাতে লাগাম ছাড়া কিছুই নেই। নিখিলেশবাবু বুঝতে পারলেন ঘোড়ার মাথা ডিঙিয়ে উনি সামনের দিকে উড়ে চলেছেন। ঘোড়ার ছুটে চলার গতি ঘোড়া বেশ সামলে নিয়েছে, কিন্তু ওঁর হাতে এখন কেশর ধরা নেই, উনি একটা উড়ন্ত চাকির মতো গাবুত্‌ করে একেবারে ডোবার মাঝখানে।

চারপাশ থেকে লোকজন সব ছুটে আসতে যেটুকু সময়! “কি হল মাস্টারমশাই, কি হল?”

ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁফাচ্ছে।

নিখিলেশবাবু পাঁকের মধ্যে। সর্বাঙ্গে কাদা মেখে অনেক কষ্টে উনি পারে উঠলেন।

“কোথাও চোট লাগে নি তো মাস্টারমশাই?”

নিখিলেশবাবুর ইচ্ছে হচ্ছিল দুন্দুভি মুখুজ্যের টাকে এই কাদা জল এক বালতি ঢেলে দিতে। কিন্তু চাকরি করতে এসে মাথা নিচু করেই থাকতে হয়। হেসে বললেন, “কিচ্ছু না। কিচ্ছু না। ঘোড়া আপনাদের ঠিক হয়ে গেছে, নিয়ে যান। এবার থেকে ও ঠিক কথা শুনবে।”

ঘোড়ার কী খেয়াল হল, ঘোড়া আপন মনে হেসে উঠল, চিঁহা চিঁহা চিঁহা।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত