হাসনুহানার জামা

হাসনুহানার জামা

বাঁশপুকুরের হাঁসমামা। ছিল তার ছোট্ট ছানা। নাম তার হাস্নুহানা। হাস্নুহানা পুজোয় জামা চেয়েছিল হাঁসমামার কাছে। হাঁসমামা পরিষ্কার বলে দিলে, “পয়সা নেই।” শেষে কোঁক্ কোঁক্ করে কেঁদে ফেলতেই হাঁসমামা বললে, “ঠিক আছে, পুজো গেলেই তোকে জামা কিনে দেব।” পুজো চলে গেল। এদিকে জামা কেনা হচ্ছে না। হাঁসের ছানা হাস্নুহানা তাড়া দিল হাঁসমামাকে, “কই জামা কিনে দিলে না।” “দেব,দেব।” বলেই হাঁসমামা পাঁচ সিকে পয়সা দিয়ে একটা লাল-নীল জামা কিনে দিল। লাল-নীল জামা মানে জামাটার একদিকে লাল, আরেক দিক নীল। সেই জামা পরে হাস্নুহানা ধেই-ধেই করে নাঁচলে কিছুক্ষণ। তারপর হাঁসমামার সঙ্গে হাস্নুহানা বাঁশপুকুরের জলায় সাঁতার কাটতে গেল।

“আমি কি জামা পরে সাঁতার কাটব?” হাস্নুহানা জিজ্ঞেস করে। “উঁহু, জামা ভিজে যাবে।” হাঁসমামা ধমক দিলে, “জামাটা ছেড়ে চট্ করে ঐ ব্যাঙের ছাতার ওপর রেখে, তাড়াতাড়ি জলে নাম দিকি।” হাস্নুহানা তাই করলে। ব্যাঙের ছাতার কাছে ব্যাঙেদের আস্তানা। কে না জানে।

ব্যাঙাচিদের দাদু ব্যাঙবুড়ো সবেমাত্র চাকরি থেকে রিটায়ার্ড হয়ে দেশে ফিরেছে। কিন্তু ফিরে এসে একটু সুস্থির হয়ে বসবে তা নয়, ঘোঙ্ ঘোঙ্ করে বলে উঠল, “গিন্নী, আমি ফুটবল খেলতে চললুম।” শুনে পাড়ার যত ব্যাঙ প্রতিবেশী আছে, সব একসঙ্গে ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙর করে চেঁচিয়ে, “সে কি কথা-তুমি বুড়ো হয়েছ, তোমার হাই প্রেসার, কোমরে বাত হয়েছে…।”

ব্যাঙবুড়ো শুনল না। ব্যাঙের ছাতার ওপর হাস্নুহানার যে জামাটা ছিল সেটা হাতে নিয়ে সকলকে বলল, “ফুটবল খেলার জার্সি যখন পেয়েছি, তখন আমাকে ফুটবল খেলতেই হবে,” বলেই হাস্নুহানার জামাটা গায়ে দিলে। বুট পরলে। তারপর লাফাতে লাফাতে চললে। সবাই দেখলে ব্যাঙবুড়োর জার্সিটা এত ঢলঢল করছে যে পা আটকে মুখ থুবড়ে পড়ে না যায়। ওটা পরে কী করে যে ব্যাঙবুড়ো ফুটবল খেলবে! ফুটবল মাঠে আসা পর্যন্ত ব্যাঙবুড়ো আটাসবার মুখ থুবড়ে পড়ল। তারপর সে দেখলে ফুটবল মাঠে কাদা।

ব্যাঙবুড়ো জামার দিকে বার বার তাকাল। “নাহ্ জামাটা নষ্ট হয়ে যাবে। নতুন জামা,” বলেই হাস্নুহানার জামাটা খুলে চোরকাঁটার ঘন ঝোপের ওপর বিছিয়ে রেখে দিল। তারপর মাঠে নেমে ধুপধাপ লাথি মারতে শুরু করে দিল। ফুটবল মাঠের কাছে কতগুলো ঘাসের ছায়ায় ফড়িংখুড়োর কঁুড়েঘর। কঁুড়েঘরটা নাকি ভীষণ অন্ধকার। আর ফড়িংখুড়োকে নাকি বড্ড মশা কামড়ায়। সে মশা কত বড় মশা কে জানে! তাই ফড়িংখঁুড়ো তার কঁুড়েঘরে টিকতে না পেরে বাইরেই ঘুরে বেড়ায়। ঘুরতে ঘুরতে হাস্নুহানার জামার কাছে থামল। এই তো চমত্‌কার একটা মশারি পাওয়া গেছে।

ফড়িংখঁুড়ো তার পাড়াপড়শীদের ডেকে আনল, বলল, “এই মশারিটা আমার ঘরে নিয়ে যাব। আমাকে একটু সাহায্য কর।” “বেশ তো,” সবাই ধরাধরি করে হাস্নুহানার জামাটা ফড়িংখঁুড়োর কঁুড়েঘরের কাছে নিয়ে এল। কিন্তু ঘরের ভেতর ঢোকানো গেল না। মশারির চেয়ে ঘরটা যে ছোট। “ঘরে ঢুকিয়ে কাজ নেই, ঘর ভেঙে যাবে,” ফড়িংখঁুড়ো বলল, “তার চেয়ে এটা ঘাসের ওপর থাকুক। আমি ততক্ষণে আমার ঘরটাকে বড় করে ফেলি।” বলেই হাস্নুহানার জামাটা ঘাসের ওপর রেখে দিল। তারপর একটা ফিতে বার করে হাস্নুহানার জামাটা মাপতে লাগল, বলল, “মশারিটার তিনগুণ বড় বাড়ি তৈরি করতে হবে।”

হাসনুহানার জামাটা মাপা হয়ে গেলে ফড়িংখঁুড়ো চললে কাঠি আর খড়কুটোর খোঁজে। একটু দূরে একটা পেয়ারা গাছ। পেয়েরা গাছে কাঠ-পিঁপড়েদের মহা ধুমধাম। ঢাক বাজছে। ঢোল বাজছে। সানাই বাজছে। তার উপর লাউড্ স্পিকারও বাজছে। কী ব্যাপার, পুজো তো শেষ হয়ে গেল। কাঠ-পিঁপড়ে শুঁড় উঁচু করে বলল, “পুজো শেষ হলে কী হবে, বছর গেলেই তো আবার পুজো। তাই ধুমধাম হবে না?” আরেকটা কাঁঠ-পিঁপড়ে শুঁড় উঁচু করে বলল, “রঙিন কাপড় পাওয়া গেলে আর তা দিয়ে প্যান্ডেল বাঁধা হয়ে গেলে, এক্ষুণি পুজো হতে দোষ কী?” এমন সময় হৈ-হৈ রৈ-রৈ। কী ব্যাপার? “প্যান্ডেলের রঙিন কাপড় পাওয়া গেছে,” “রঙিন কাপড় পাওয়া গেছে,” বলে ভীষণ সোরগোল। হাজার হাজার ছোকরা কাঠ-পিঁপড়ে হাস্নুহানার জামাটাকে টেনে নিয়ে আসছে। একটা বড়সড় মোটাসোটা কাঠ-পিঁপড়েকে দেখে বলল, “এই যে বারোয়ারি পুজোর সেক্রেটারি, লাল-নীল কাপড় পাওয়া গেছে।” অতএব আবার পুজো। দেখতে-দেখতে আরও ঢাক ঢোল বেজে উঠল। আরও লাউড-স্পিকার।

জামাটা পেয়ারা গাছের ডালে তোলা হল। তারপর সব্বাই চলল বাঁশ আর দড়ি খঁুজতে। হাতিদাদা যাচ্ছিল সেখান দিয়ে। পেয়ারাগাছ দেখে দুটো পেয়ারা খেতে তার ইচ্ছে হল। ডালে শুঁড় তুলে দিতেই, “ওমা এ যে দেখছি একটা চমত্‌কার দস্তানা।” হাস্নুহানার জামাটা পেয়ারা গাছের ডাল থেকে পেড়ে এনে বিড়-বিড় করে বলল, “শীত যা পড়েছে, আমার শুঁড়ের একটা দস্তানা দরকার।” বলেই হাস্নুহানার জামার ভেতর শুঁড়টাকে কোনোমতে ঢুকিয়ে দেখলে ঠিক দস্তানার মত নয়। একেবারে ওপর-নীচ খোলা, “এ যে দেখছি ছেঁড়া। এটাকে একটু সেলাই করতে হবে।” তখন সজারুর মেসোর কাছ থেকে সঁুচ চেয়ে আনলে হাতিদাদা। গাছের গুঁড়িতে গা ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসলে সঁুচে সুতে পরাতে। সঁুচের ফুটো এত ছোট যে হাতিদাদা কিছুই দেখতে পেল না-সুতো আর পরাবে কি! তবু আরও কয়েকবার চেষ্টা করল। শেষে যখন কিছুতেই পারতে পারল না, তখন, “নাহ চশমা না হলে চলছে না” বলেই ঘাসের ওপর হাস্নুহানার জামাটা রেখে ঘরের ভেতর ঢুকল চশমা আনতে।

চশমা পরে ফিরে এসে দেখে কি তার দস্তানাটা নেই, “তাই তো, কোথায় গেল? কে নিল?- আমি তো ঠিক এই ঘাসের ওপর রেখেছিলাম।” চশমা চোখে হাতিদাদা এদিক দেখে সেদিক দেখে। শুঁড় দুলিয়ে হেলতে দুলতে হাঁটে আর এদিক ওদিক ঘাড় ফিরিয়ে দেখে – “নাহ কোথাও নেই।” হাঁটতে হাঁটতে আর খঁুজতে খুঁজতে দেখল চারদিকে কাঠপিঁপড়েরা ছড়িয়ে পড়েছে। “এই যে কাঠপিঁপড়ে, তোমরা কি আমার দস্তানাটা দেখেছো?” “না তো, তুমি কি আমাদের প্যান্ডেল বাঁধার রঙিন কাপড়টা দেখেছ?” “না তো, প্যান্ডেলের রঙিন কাপড় হারিয়ে ফেলেছ বুঝি,” হাতিদাদা বলল, “আমিও আমার দস্তানাটা কোথায় যে হারিয়ে ফেলেছি।” “ঠিক আছে, এসো আমরা এক সঙ্গে দস্তানা আর রঙিন কাপড়টা খঁুজে দেখি-” খোঁজ-খোঁজ-খোঁজ। খঁুজতে খঁুজতে খঁুজতে দেখল শুকনো ঘাসের ডগায় বসে দেখল শুকনো গাছের ডগায় বসে ফড়িংখুড়ো কপাল চাপড়ে কাঁদছে। কেন? কেন? বা-রে, ফড়িংখুড়োর যে মশারি হারিয়ে গেছে।

হাতিদাদা বলল, “আহা কাঁদছ কেন, তোমার মশারি হারিয়ে গেছে,কাঠপিঁপড়েদের প্যান্ডেল বাঁধার কাপড় হারিয়ে গেছে, আমারও দস্তানা হারিয়ে গেছে, এস আমরা সবাই মিলে এক সঙ্গে খঁুজি।” কাঠপিঁপড়ে, ফড়িংখুড়ো, হাতিদাদা সবাই মিলে দস্তানা, মশারি আর আর রঙিন কাপড় খঁুজতে লেগে গেল। খঁুজতে খঁুজতে খঁুজতে দেখল, সেই ব্যাঙখুড়ো, তার পেটে কাদা, পিঠে কাদা, মাথায় কাদা, হাতে কাদা, জোর ফুটবল খেলে, অনেক গোল-টোল খেয়ে, এখন চটে মটে লাল, বলে কী, “আমার জার্সিটা চোরকাঁটার ঝোপে রেখেছিলুম, কোথায় গেল?” “তাহলে তুমিও এস,” কাঠপিঁপড়ে বলল, “আমরা সবাই মিলে সবার সব কিছু খঁুজি।” কাঠপিঁপড়েরা ঘাসপাতাগুলো তন্ন তন্ন করে খঁুজতে শুরু করল। ফড়িংখুড়ো জেট প্লেনের মত এদিক-ওদিক বোঁ করে নেমে পড়ল।

ব্যাঙখুড়োও থপাস থপাস লাফাতে লাগল। আর হাতিদাদা সারা মাঠ জঙ্গল তছনছ করতে লাগল। সবাই যার যার জিনিস খঁুজতে লাগল। অথচ কেউ কারুর জিনিস পাবে না। কী মজা! ওটা তো আসলে হাস্নুহানার জামা। ওটা এখন কার কাছে? ওটা এখন খিটখিটে বিল্লিমাসীর কাছে। বিল্লিমাসী একটা গোলাপফুল মাথায় বেঁধে বেড়াতে বেরিয়েছিল, হাতিদাদার বাড়ির পাশ দিয়েই যাচ্ছিল- ঘাসের ওপর হাস্নুর জামাটা পড়ে আছে দেখে অমনি টুক করে তুলে নিল। তারপর উল্টে পাল্টে নেড়ে চেড়ে দেখল, “বাহ, একদিকের মুখটা সুতো দিয়ে বেঁধে নিলেই হবে দেখছি বাজারের রঙিন থলে-।” তাই বাড়ি ফিরে জামার মুখটা সুতোয় বেঁধে সেই ধুমসো বেড়াল খিটখিটে বিল্লিমাসী ওটাকে বাজারের থলে বানিয়ে ফেলল। তারপর চলল বাজার করতে।

।।২।। এদিকে হাঁসের ছানা হাস্নুহানা চানটান সাঁতার-টাতার সেরে এসে রোদ্দুরে একটু পা শুকিয়ে নিয়ে, তারপর ডামাটা খঁুজতে লাগল। পাতি পাতি করে খঁুজল। প্রত্যেকটা ছোট বড় ব্যাঙের ছাতা বার বার ফিরে ফিরে দেখল। “তাই তো, জামাটা কী হল?” মুখ উঁচু করে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডানদিকটা দেখল। তারপর বাঁ দিকটা দেখল। তারপর সামনের পশ্চিম দিকটা দেখল। তারপর পেছনের পুবদিকটা। “কোথায় রাখলুম আমার নতুন জামা?” “কেন ব্যাঙের ছাতার ওপর,” হাঁসমামা বলল। “নেই তো…” হাসন্ুহানা কেঁদে ফেলল, “হায় হায়, আমার জামা কে নিয়ে গেল?” হাঁসমামাও অনেক খুঁজল। শেষে না পেয়ে হাস্নুহানাকে খুউব বকল, বলল, “নতুন জামা এরই মধ্যে হারিয়ে ফেললি। আর তোকে জামা কিনে দেব না।” হাস্নুহানা তো এমনিতেই জামা হারিয়ে মুখ ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।

শেষে হাঁসমামার বকুনি খেয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল, “কোঁয়ায়াঁয়াঁয়াঁক কোঁয়াঁয়াঁয়াঁয়াঁক…” কান্না শুনে মাছরাঙা, টিপঠুঁটো হাঁস, কানঠুঁটি ফ্লেমিংগো, দুর্গা টুনটুনি, ভোঁদড় বাহাদুর, নেংটি ইঁদুর সবাই ছুটে এল, “কী হয়েছে, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?” তবু হাস্নুহানা কাঁদে “কোঁয়ায়াঁয়াঁয়াঁক কোঁয়াঁয়াঁয়াঁয়াঁক…” “ইস রে বড্ড কাঁদছে” সবাই বলল, “আর কেঁদো না আর কেঁদো না…, হাঁসের ছানা হাস্নুহানা, একটুখানি হাসো সোনা, হাসলে মুড়ির মোয়া পাবে…” এই সব বলে সবাই হাস্নুহানার কান্না যা হোক করে থামাল। তারপর তার সব কথা শুনল। নেংটি ইঁদুর বলল, “আমরা তোমার জামা কিনে দেব। কীরকম দেখতে তোমার জামা বল দেখি।” হাস্নুহানা খুব ছোট্ট তো, তাই ভাল করে বুঝিয়ে বলতে পারল না জামাটা কেমন দেখতে। একবার বলল, “লাল”, আরেকবার বলল, “নীল।” তখন নেংটি ইঁদুর পকেট থেকে লাল-নীল পেনলিস আর একটুকরো কাগজ বার করে বলল, “তোমার জামার ছবিটা ওই কাগজে এঁকে দাও তো।” ওমা, অবাক কাণ্ড, ঐটুকুনি হাঁস হাস্নুহানা, ব্যাঙের ছাতার ওপর কাগজটা রেখে লাল-নীল পেনসিল দিয়ে ঠিক আঁকলে তার লাল-নীল জামাটা। জামাটার একদিকে লাল আর অন্যদিকে নীল। “বাহ জামাটা কী সুন্দর, আমারই পরতে ইচ্ছে করছে।” বলল মাছরাঙা। তারপর নেংটি ইঁদুর হাস্নুহানার জামার ছবি নিয়ে চললে বাজারের দিকে গুটি গুটি।

এমন সময় সেই হাতিদাদার সঙ্গে দেখা। হাতিদাদা অনেক খোঁজাখুঁজি করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরছিল, হঠাত্ নেংটির হাতে ছবিটা দেখে দাঁড়াল। “আরে এই তো।” “কী?” “এ-যে দেখছি আমার দস্তানার ছবি।” হাতিদাদার কথা শুনে নেংটি ইঁদুর তো অবাক। খানিকটা মাথা চুলকে বলল, “বল কী হাতিদাদা, এই তোমার দস্তানার ছবি?” “হ্যাঁ ভাই, আমার শুঁড়ের দস্তানা, কোথায় যে হারিয়ে ফেললাম…।” নেংটি ইঁদুর চুপ করে থেকে ভাবল, তাই তো, এ কী করে হল? হাস্নুহানার জামা হাতিদাদার দস্তানা একই রকম দেখতে কেন হবে? আচ্ছা দেখা যাক, বলল, “তুমি তোমার দস্তানাটা খুঁজতে থাক, আমি একটু বাজার থেকে ঘুরে আসি।” তারপর নেংটি ইঁদুর একটু এগোতেই ফড়িংখুড়োর সঙ্গে দেখা। “আরে-আরে তোমার হাতে আমার মশারির ছবি।” “তোমার মশারি?” নেংটি ইঁদুর খুউব অবাক হল।

সে কী, হাস্নুর জামা হাতিদাদার দস্তানা, আর ফড়িংখুড়োর মশারি সব একই দেখতে কী করে হল। ফড়িংখুড়ো বলল, “কোথায় যে হারিয় গেল মশারিটা, সেই তখন থেকে খুঁজছি।” “বেশ খোঁজ, আমি ততক্ষণে বাজার থেকে ঘুরে আসি।” আবার একটু এগোতেই কাঠপিঁপড়েদের সঙ্গে দেখা। “এই যে সেই প্যান্ডেল বাঁধার রঙিন কাপড়ের ছবি।” বলল কাঠপিঁপড়েরা। “যা বলেছ, সেই তখন থেকে খুঁজছি…।” “বেশ খুঁজতে থাক…।” বলেই নেংটি দিঁুর হাঁটতে লাগল গুটি গুটি। বেশি দূরে যেতে হল না। ব্যাঙখুড়ো খুব ক্লান্ত তো, তাই থপ্ থপ্ করে লাফাচ্ছে আর থামছে। ছবিটা দেখে বলল, “আমার ফুটবল খেলার জার্সিটা ঠিক ঐরকমই দেখতে, কোথায় যে হারিয়ে গেল…। তুমি কি ওটা খুঁজতে বেরিয়েছ…?” যাই হোক, নেংটি ইঁদুর কিন্তু বাজারে এসে জামার দোকানে ঐ ছবির মত একটিও জামা পেল না। আর দোকান নেই? আছে, সে-গুলোতেও ঐরকম লাল-নীল জামা নেই।

মন খারাপ করে নেংটি ইঁদুর ফিরে আসছিল, এমন সময় দেখে কি, সেই খিটখিটে বিল্লিমাসী অনেকদূরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তার, হাস্নুহানার লাল-নীল জামার মত একটা বাজারের থলে। নেংটি ইঁদুর কিন্তু ঠিক বুঝেছে, হাস্নুহানার জামাটাই এখন বিল্লিমাসীর বাজারের থলে হয়ে গেছে। এখন ওটা ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে আনা যাবে কেমন করে? বিল্লিমাসী যা খিটখিটে। তার ওপর নেংটি ইঁদুরের যম। ওর ধারে কাছে কি নেংটি ইঁদুরের থাকা উচিত? “কিন্তু এইটুকুনি হাস্নুহানা জামা হারিয়ে এমন কাঁদছে…কী যে করি।” তারপর মাথা চুলকে মুলকে “একটা বুদ্ধি ঠাওরান যাক”, বলেই নেংটি ইঁদুর মাথা চুলকোতে লাগল। আচমকা মাথা চুলকানো বন্ধ করে নেংটি ইঁদুর জিরাফদাদার মুদিদোকান থেকে এক ঠোঙা চিনি কিনল।

তারপর তার ছোট্ট বুকে এত্তো বড় সাহস এনে চলে এল বিল্লিমাসীর কাছে, “বিল্লিমাসী, বিল্লিমাসী, কী সুন্দর থলে তোমার!” “ম্যা-ও-ও-ও; যাও-যাও। বাজারের এত লোকজনের মধ্যে তোমার ঘাড় মটকাতে লজ্জা-লজ্জা করছে, তাই কিছু বলছি না…। ইরেব্বাপ্রে বিল্লিমাসী রাগ করো না-তোমার ছোট্ট ছেলে মিনি বেড়াল চিনি খেতে ভালবাসে কিনা-তাই এই চিনিটা ওকে দিয়ে দিও…। ওমনি থাবা দিয়ে চিনির ঠোঙাটা তুলে নিয়ে লাল-নীল থলের মধ্যে রেখে, “থ্যাংক্ কিউ,” বলে বিল্লিমাসী লেজটি বেঁকিয়ে চললে বাড়ি। আহ! নেংটি ইঁদুরের আনন্দ দেখে কে। তুড়ি বাজিয়ে নাচ ধরলে, “চিচিং-চিচিং-চিচিং চিক-, হাস্নুহানার জামা এবার, পাচ্ছি পাচ্ছি ঠিক।” কেমন করে জামাটা পাবে? আচ্ছা দেখাই যাক। একটুপরে দেখা গেল রাস্তা দিয়ে চলে গেছে চিনির লাইন, খিটখিটে বিল্লিমাসীর বাড়ির ভেতর পর্যন্ত। আর সেই চিনির লাইন ধরে কাঠপিঁপড়েরার সারি বেঁধে চলেছে বিল্লিমাসীর বাড়ি। আসলে নেংটি ইঁদুর চিনির ঠোঙায় একটা ফুটো করে দিয়েছিল।

তার উপর হাস্নুহানার জামার মুখটা সুতোয় বাঁধা থাকলেও, দুপাশে হাতাদুটো তো খোলাই ছিল-সেখান দিয়ে চিনি রাস্তায় পড়তে পড়তে গেছে! যাই হোক, বিল্লিমাসী খাটের তলায় ঘুমোচ্ছিল। কাঠপিঁপড়েরার ঢুকেই, “এই-তো, এই-তো, আমাদের পুজো প্যান্ডেলের লাল-নীল কাপড়।” ওরা সব ধরাধরি করে লাল-নীল জামাটা বাইরে মাঠে বের করে আনতেই…নেংটি ইঁদুর, যে কিনা সবই দেখছিল দূরে দাঁড়িয়ে, তাড়াতাড়ি ছুটে গেল ফড়িংখুড়োর বাড়ি “ফড়িংখুড়ো ফড়িংখুড়ো, তোমার মশারি পাওয়া গেছে…।” “অ্যাঁ তাই নাকি,” তক্ষুনি ফড়িংখুড়ো বোঁ-ও-ও করে জেটপ্লেনের মত ছুটল। “এই যে আমার মশারি…” “ইস্ কী বলছে ফড়িংদাদু,” কাঠপিঁপড়েরা চটে গেল, “এটা আমাদের পুজো প্যান্ডেলের লাল-নীল কাপড়।” “বাজে বকিস নি কাঠপিঁপড়ের দল, আকাঠ মুখ্যু…” বাস্, কাঠপিঁপড়ে আর ফড়িংয়ের মধ্যে জোর ঝগড়া বেঁধে গেল। নেংটি ইঁদুর তখন ছুটে গিয়ে ব্যাঙবুড়োকে ডেকে বলল, “ও ব্যাঙবুড়ো, তোমার ফুটবল খেলার জার্সি পাওয়া গেছে। ঐ যে কাঠপিঁপড়ে আর ফড়িংখুড়ো ধরাধরি করে নিয়ে আসছে।” ব্যাঙবুড়ো তক্ষুনি লাফাতে লাফাতে ছুটলে, “আমার জার্সি, আমার জার্সি!” নেংটি তারপর হাতিদাদাকেও খবরটা দিলে।

হাতিদাদা হেলতে দুলতে এগিয়ে চলল, “এ্যাই, আমার দস্তানাটা আমার কাছে নিয়ে এসো।” “ইহ তোমার দস্তানা না আরো কিছু,” ব্যাঙবুড়ো বলল, “ওটা আমার ফুটবল খেলার জার্সি…” “আজ্ঞে না স্যার,” ফড়িংখুড়ো বলল, “ওটা আমার মশারি…” “কেন বাজে বকছেন…এটা আমাদের পুজো প্যান্ডেলের রঙিন কাপড়…” ওহ, এই নিয়ে যা ঝগড়া বেধে গেল ওদের মধ্যে, তুমুল হট্টগোল।

এত হৈচৈ শুনে কেউ কি ঘরের মধ্যে থাকতে পারে? মাছরাঙা, একঠেঙে বক, কানঠুঁটি ফ্লেমিংগো, টিপঠুঁটো হাঁস, ভোঁদড় বাহাদুর, কোয়ালা ভালুক আরো অনেকে; তারপর বাঁশপুকুরের হাঁসমামা আর তার সঙ্গে তার ছোট্টছানা হাস্নুহানা, সবাই বেরিয়ে পড়ল। “এই তো আমার জামা।” “এই তো হাস্নুহানার জামা।” সবাই বলল, “তোমরা মিছিমিছি ঝগড়া করছ, এটা আসলে হাস্নুহানার জামা।” তখন ওদের ঝগড়া থেমে গেল। ভাল করে খুঁটিয়ে দেখল, “হ্যাঁ, এই তো পকেট, এই তো বোতাম, আ-রে এই তো হাতা…।” ব্যাঙবুড়ো বলল, “আমি তো জানতামই ওটা জামা, কিন্তু ওটা যে আসলে বাচ্চাদের জামা, তা বুঝতে পারিনি,” বলেই জিব কাটল, “ছি ছি কী লজ্জা!” তারপর? তারপর হাস্নুহানা সেই জামা পরে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বাড়ি চলল ছড়া কাটতে কাটতেঃ প্যাঁক্-প্যাঁ প্যাঁক্-প্যাঁ প্যাঁক্ প্যাঁক্ পুজোর জামাটা দ্যাখ্ দ্যাখ্।।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত