ফুটবলের মরসুমে পপনদের বাড়িটা একটা আগ্নেয়গিরি হয়ে থাকে। পপনের কাকা পাঁচজন। পপনের ঠাকুরদা খাস কলকাতার লোক, কট্টর মোহনবাগান-সমর্থক। পপনের বাবাও তাই। পপনের ঠাকুমা চট্টগ্রামের মেয়ে। যদিও আজন্ম কেটেছে কলকাতায়। পুব-বাংলার ভাষা জানেন না, বোঝেন না, তবুও তিনি মনে করেন ইস্টবেঙ্গলকে সমর্থন করার একটা নৈতিক দায়িত্ব তাঁর আছে। যেহেতু পপনের বাবা মোহনবাগানের সমর্থক, সেহেতু পপনের মেজকাকা ইস্টবেঙ্গলকে সমর্থন করেন। মিঠুকাকা যন্ত্রপাতি এবং গপ্পো বানানো নিয়ে থাকতে ভালবাসেন, তাই তিনি ফুটবলের ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখান না।
পপনের ন-কাকা এবং রাঙাকাকা মোহনবাগান, আর ফুলকাকা ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক। ফুলকাকা ন-কাকার চেয়ে ছোট, রাঙাকাকার চেয়ে বড়, আর গলার জোরে পাড়ায় কারো কাছে ছোট নয়। পপনের ছোট বোন হেরে-যাওয়া দল একদম পছন্দ করে না, তাই যখন যে জেতে, সেই দলে থাকে। তবে একে মেয়ে, তায় নেহাত পুঁচকে, তাই পপন ওর কথা নিয়ে একদম ভাবে না।
পপনের মা ময়মনসিংহের মেয়ে এবং সেজন্য খুব গর্বিত বোধ করেন। পপনের মামারা সবাই কট্টর ইস্টবেঙ্গল, মামাতো ভাইরাও তাই। পপনের মা কিন্তু খেলাধুলো নিয়ে কোনো উৎসাহ দেখান না। তাঁর মতে পপনের বাবা ঠান্ডামাথায় কথা বলতে পারেন না, সুতরাং ওসব আলোচনা না করাই ভাল। তবু পাপন লক্ষ করেছে যে, ইস্টবেঙ্গল জিতলে মা যতটা খুশি থাকেন, হারলে ততটা খুশি হন না। তা যাকগে, পপন নিজে মোহনবাগানের সমর্থক। বাড়ি এমনিতেই সরগরম। ফুটবল-মরসুম শুরু হলে আরও সরগরম হয়ে ওঠে। লম্বা সারি দিয়ে খেতে বসেছেন ঠাকুরদা আর বাবা-কাকারা। মা-ঠাকুমা পরিবেশন করছেন।
তখন পপনের মেজকাকা শুরু করলেন, ‘‘মানুষটাকে (পপনের ন-কাকা) নিয়ে খেলা দেখতে যাওয়া বিপদ। আজ শেষ মুহূর্তে যখন ইস্টবেঙ্গল গোল দিল, ও আমাকে বলছে, দেখলি মেজদা, বলটা পাস দিল একদম সাইডলাইনের বাইরে থেকে। আমি বলি, চুপ চুপ।’’ পপনের ঠাকুরদা বললেন, ‘‘গোলটার আগেই তাহলে থ্রো হয়েছিল?’’
পপনের বাবা মাছ বাছতে-বাছতে বলেন, ‘‘সারা কলকাতা ইস্টবেঙ্গল দখল করে নিয়েছে, ওর যা ইচ্ছে তাই করবে। সম্প্রতি নূতন নিয়ম হবে ঠিক হয়েছে, ইস্টবেঙ্গলের ফরোয়ার্ডরা অন্য টিমের হাফ লাইনের মধ্যে ঢুকলেই গোল হয়েছে বলে গণ্য করতে হবে।’’ এধরনের কথা কেন জানি না ফুলকাকার একদম ভাল লাগল না।
ও বলল, ‘‘তাই বল দাদা, তা না হলে গতবারের শীল্ডে পাঁচ গোল খাবি কেন বল?’’ পপনের বাবা পাঁচ গোলের কথাটা সেই খেলার দিন থেকেই প্রাণপণ ভোলবার চেষ্টা করছেন, তাই বললেন, ‘‘আজকের খেলা নিয়েই কথা হোক না কেন।’’ পপনের মেজকাকা বললেন, ‘‘তাই হোক। তুই আজ গিয়েছিলি খেলার মাঠে যে বলছিস?’’
পপনের বাবা বললেন, ‘‘আমি না যাই, মানু গিয়েছিল। তাছাড়া এ তো আর আজ নতুন হচ্ছে না।’’ মিঠুকাকা বললেন, ‘‘থাক থাক। তার চেয়ে বরং আজ কী কাণ্ড হল শোন।’’ পপনের কান খাড়া হয়ে উঠল। নতুন কোনো গপ্পো শোনা যাবে।
কিন্তু ততক্ষণে ন-কাকা বলেছেন, ‘‘কালকে কাগজেই দেখবি।’’ আর যায় কোথা, ফুলকাকা বললেন, ‘‘খবরের কাগজগুলোর কথা আর বলিস না, সব রিপোর্টারগুলো মোহনবাগানের সাপোর্টার।’’
পপনের ঠাকুরমা ধমক দিয়ে বললেন, ‘‘সব চুপ করো, মন দিয়ে খাও। তোমাদের জন্য রান্না করা হবে কষ্ট করে, আর খেতে বসে খাওয়া মাথায় উঠল, পাড়া কাঁপিয়ে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল।’’
পপনের ঠাকুরদা বললেন, ‘‘খাবার সময় ওসব থাক।’’ সেদিনের মতো মিটল। পরের দিন কাগজের বিবরণে বলটা যে মাঠের বাইরে থেকে পাস করা হয়েছিল সে সম্বন্ধে কোনো উল্লেখ ছিল না। ফুলকাকা ওঠেন খুব ভোরে। কাগজটা নিয়ে সটান ন-কাকার ঘরে চলে গেলেন।
ঘুম থেকে উঠিয়ে বললেন, ‘‘দেখাও, কোথায় লিখেছে বলটা আগেই আউট হয়ে গিয়েছিল।’’ ন-কাকা আধোঘুম-ঘুম অবস্থায় বললেন, ‘‘লিখবে তো না-ই। সব ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার।’’