রাত তখন দশটা-এগারোটা হবে। কিন্তু পাড়াগাঁর রাত-সবকিছু চুপচাপ, সুন্সান্। বাড়ির সমস্ত ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝি ডেকে চলেছে একটানা, পাঠশালার দাওয়ার বুড়ো হরিতকি গাছটার প্যাঁচাগুলো হুম্হুম্ করে শব্দ করছে। পথেঘাটে কোনো লোকজন নেই। কোনো কোনো বাড়ির জানলায় কেরোসিন তেলের পিদিম জ্বলছে, কোনো কোনো বাড়ি একেবারে অন্ধকার।
ফুল মিয়ার বাড়িতে তখনো কাজপাট চুকে যায়নি। ফুল মিয়া বাবু সেই কবে মারা গিয়েছেন। কিন্তু ওঁর বাড়ি এখনো ফুল মিয়ার বাড়ি বলেই পরিচিত। ফুল মিয়ার ছেলে রানা জরিপের কাজে বাইরে গেছে-বাড়িতে তখন শুধু ওর বুড়ি মা, স্ত্রী, আর তিন বছরের ছেলে আবির। স্ত্রী মীম ড্রেসিং টেবিলের আয়না পরিষ্কার করেছে তখন-বাইরে থেকে ঠুং ঠাং, ঘ্যাস্ ঘ্যাস্ শব্দ ভেসে আসছে। মীমের শাশুড়ি নীরা বেগম নাতিকে কোলে শুইয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন বাইরের ঘরে বসে, আর বিড় বিড় করে গান গাইছেন ঃ-
রাতের ঘুম, রাতের ঘুম, চাঁদুর গায়ে আয়- লাল-হলুদ জামা আছে এখন চাঁদুর গায়।
আবির যখন প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন নীরা বেগম ঘরের কোণের দিকে তাকিয়ে দেখেন-ওমা একী! কাঁঠাল-কাঠের সিন্দুকটার পেছনে চুপ করে বসে আছে কালু ডাকাতের মতো একটা চোর। চোরকে দেখে নীরা বেগম প্রথমে তো একেবারে ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন। বাড়িতে ছেলে রানা নেই, কোনো পুরুষ মানুষ নেই-শুধু দু’জন মেয়ে, আর একটা ছোট্ট ছেলে। এই অবস্থায় চোরটা তো জোর করেই সব কেড়ে নিয়ে যাবে। তা ছাড়া, চোরটার যা ষন্ডামার্কা চেহারা! একটু পরে, ঘুমন্ত আবিরকে পাটিতে শুইয়ে দিয়ে নীরা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। রান্নাঘরের কাছে গিয়ে ডাকলেন, “বৌমা তোমার কাজ শেষ হয়েছে? একটু শুনে যাও তো!”
“দাঁড়ান, যাচ্ছি।” বলেই মীম দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী!” “না, বলছিলাম,” নীরা বেগম আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন, “বেয়াইয়ের কোনো চিঠি পেয়েছ শিগগিরি?” “কই না তো! কেন?” মীম একটু বিস্মিতভাবে ওর শাশুড়ির দিকে তাকাল। “না, এমনিই বলছিলাম,” নীরা বেগম কথাটা ঘুরিয়ে নিলেন, “যাও তুমি ড্রেসিং টেবিলের আয়না পরিষ্কারের কাজ শেষ করে এস। দাদু ভাই ঘুমিয়ে পড়েছে।” মীম রান্নাঘরে যেতে না যেতেই নীরা বেগম আবার ডাকলেন বৌকে, “বৌমা একটু শুনে যাও তো।”
মীম হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে বলল, “আপনি কি আমাকে কাজ করতে দেবেন না! এত ডাকাডাকি করছেন কেন?” নীরা বেগম একটু চিন্তিত মুখে বললেন, “আচ্ছা বেয়াইয়ের শরীর-টরির ভাল আছে তো!”
মীমের একটু সন্দেহ হল এই কথা শুনে। শাশুড়ি বার-বার ওর বাবার কথা জিগ্যেস করছেন কেন? নিশ্চয়ই একটা কিছু হয়েছে। কাঁদো-কাঁদো গলায় মীম বলল, “কী হয়েছে মা? বাবার শরীরের কথা কেন হঠাত্?” “না, বয়স হয়েছে তো বেয়াইমশাইয়ের,” নীরা বেগম বললেন, “তাই জিগ্যেস করছিলাম।’’
“আপনি কিছু একটা চেপে যাচ্ছেন মা, আমি স্পষ্ট বুঝতে পাচ্ছি সব খুলে বলুন আমাকে।” প্রায় আর্তনাদ করে উঠল মীম। নীরা বেগম চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “তোমাকে আজ জানাব না ভেবেছিলাম, দুপুরের ডাকে একটা চিঠি এসেছে, তাতে-” “বলুন, বলুন,” তাতে কি লেখা আছে আতঙ্কের সুরে বলে উঠল মীম। “বেয়াইমশাই আর নেই, পরশুদিন ভোরে-”
নীরা বেগমের কথা শেষ না হতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল মীম। “বাবা, বাবা, তুমি কোথায় গেলে? ওমা আমার কী হবে গো ; শেষ দেখাটাও দেখতে পারলাম না।” মায়ের কান্না শুনে আবিরও তখন উঠে পড়েছে, আর উঠে পড়েই ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে ফুল মিয়ার-বাড়িতে একটা হৈহৈ ব্যাপার। মীম কাঁদতে কাঁদতে ঘর ছেড়ে সামনের দাওয়ায় লুটিয়ে পড়ল, আর শুয়েই চ্যাঁচাতে লাগল, “আমার কী হবে গো?”
মীমের চিত্কার শুনে আশেপাশের বাড়ির অনেক লোকজন ছুটে এল পাঁচ, ছজন লোক আসতেই নীরা বেগম হাসিমুখে সিন্দুকের দিকটা দেখিয়ে দিলেন। তারপর চোর-বাবাজীর কী অবস্থা হল তা তো তোমরা বুঝতেই পারছ।