পাহাড়ি ঢালে বাগানসংলগ্ন খুব পুরোনো বাড়ি, মেরামত করার পর আধুনিক সরঞ্জাম আর ফিটিংস যোগ করলে চমৎকার একটা রিসোর্ট তৈরি হয়ে যাবে। আজকাল শুধু সাগর দেখতে নয়, গাঢ় সবুজ জঙ্গলে মোড়া পাহাড় দেখতেও এদিকটায় ভিড় করছে পর্যটকেরা। অনেক আগে হাটহাজারী পর্যন্ত রেলপথ ছিল, সেটাকে আরও লম্বা করার জন্য নতুন লাইন বসানো হয়েছে, আমাদের ভবিষ্যৎ রিসোর্টের কাছাকাছি পাহাড়গুলোর ওপর দিয়ে পথ করে নিয়ে পার্বত্য এলাকার আরও অনেক গভীর প্রদেশে চলে গেছে এই নতুন লাইন।
আমরা দুই বন্ধু নতুন উদ্যোক্তা। বাড়ির বাইরেরটা সাজানো আমার দায়িত্ব, ভেতরটা মেরামত করছে নিলয় হায়দার। আজ সারাটা দিন প্রচুর লোককে খাটানো হয়েছে, তাদের সঙ্গে আমরাও কাজ করেছি, ফলাফল দেখে সবাই সন্তুষ্ট। সন্ধের খানিক আগে, গোধূলিতে, বাগানের এক কোণে এসে লোহার বেঞ্চে বসে আছি আমরা দুজন, সারি সারি পাহাড়ের ওপর চোখ বোলাচ্ছি। আমার ইচ্ছে, কাজ কী রকম এগোচ্ছে, তা নিয়ে আলাপ করা, কিন্তু হায়দারকে দেখে কেমন যেন সতর্ক লাগল, তাই ইতস্তত করছি।
একসময় মোবাইল ফোন অন করে সময় দেখল ও, বলল, ‘আর মিনিট চারেকের মধ্যে তুমি ওটা শুনতে পাবে।’
কী শুনতে পাব?’ ‘মাইল দেড়েক দূরে, ওই পাহাড় দুটোর মাঝখানে, জঙ্গল কেমন ডেবে আছে দেখতে পাচ্ছ?’
হাত তুলে দেখাল নিলয়। ‘ওখানে চোখ রাখো।’ ‘বিস্ফোরণ?
ডিনামাইট ফাটিয়ে পাহাড় ভাঙছে?’ ‘বিস্ফোরণই, তবে তুমি যা ভাবছ তা নয়। স্রেফ তাকিয়ে থাকো।’
চুপচাপ সিগারেট ফুঁকছি দুজন। আমার যখন মনে হচ্ছে আর ধৈর্যধারণ সম্ভব নয়, এই সময় ব্যাপারটা ঘটল। সাধারণ একটা মালবাহী ট্রেন যেতে দেখছি আমরা, তবে ওটার ইঞ্জিন যখন জঙ্গলের ফাঁক হওয়া অংশে পৌঁছাল, হুইসেল থেকে সাদা বাষ্প উঠতে দেখলাম আমরা, পরক্ষণেই আরেক পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে গেল। হুবহু সিনেমার কোনো দৃশ্যের মতো।
এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে সাদা বাষ্প অনূদিত হয়ে চোখের ছবি থেকে কানের শব্দে পরিণত হলো।
ধ্বনি আর প্রতিধ্বনি, দুটো মিলে একটা মিমিক্রি তৈরি করল, শুনতে অনেকটা এ রকম: ভালোবাসি ভালোওবাসি…
দ্বিতীয় শব্দটা একটু প্রলম্বিত সুরে। রবীন্দ্রসংগীত?
নিজের আবিষ্কার নিয়ে উল্লসিত, আমার দিকে ফিরে চোখ মটকাল নিলয়। ‘কী বুঝলে বলো!’ ‘এটা তুমি জানলে কীভাবে?’
‘আমরা প্রথম যেদিন এখানে এলাম, সেদিনই অ্যাক্সিডেন্টালি আমার চোখে পড়ে যায়। রোজ ঠিক এই সময় ব্যাপারটা ঘটে, একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে।’
‘ট্রেনের ড্রাইভার কারও সঙ্গে মজা করছে?’ ‘কিন্তু কেউ কি ঘড়ির কাঁটা ধরে মজা করে? বাঁশিটা ঠিক এই সময় বাজাবে সে। আর সব সময় এই একই ধরন তার।’ আরেকটা ঢিল ছুড়লাম। ‘কোনো কোড?’
‘কী অদ্ভুত কোড! বাংলাদেশ রেলওয়ে এ রকম পোয়েটিক কোড ব্যবহার করছে, ভাবা যায়!’
‘এদিকে পাহাড়ি আর অপাহাড়ি, দুই ধরনের মানুষ বসবাস করে, তার ওপর বিদেশিদেরও খুব আসা-যাওয়া, বিচিত্র অনেক কিছুই ঘটতে পারে।’
‘না, তুমি ঠিকই বলেছ—ওটা কোডই!’ নিজেকে শুধরে নিল হায়দার। ‘তবে আমার সন্দেহ আছে রেলওয়ের কোড কি না।’
‘এক প্রেমিক আর তার দোপাট্টা ওড়ানো প্রেমিকা?’ হেসে উঠলাম আমি। আজ আর কোনো আলোচনা নয়, ক্লান্তিতে শরীর অবশ, বেঞ্চ ছেড়ে বাড়ির পথ ধরলাম।
পরদিন সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের সব লোকজন, বেশির ভাগই লেবার, কৌতূহল জাগানো ওই ট্রেন ইঞ্জিনের কোড সম্পর্কে জেনে ফেলল। নির্দিষ্ট সময়ের খানিক আগেই ট্রেনের বাঁশি শোনার জন্য বাগানে ভিড় করল সবাই। ঘড়ির কাঁটার প্রতি অনুগত মালবাহী ট্রেন যথাসময়ে হাজির হলো, দূর পাহাড়ি জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, এবং ঠিক আগের মতোই দুই প্রস্থ বাষ্প ছাড়ল হুহু করে, আমাদের কানে হুইসেলের আওয়াজ ঢুকল।
সেদিন যেহেতু অনেক লোক শুনল, প্রচুর মতামতও পাওয়া গেল। সবশেষে নিলয় হায়দারের ধারণার পক্ষেই প্রস্তাব পাস করল সংসদ, জানাল, ওটা রেলওয়ের একটা কোড, স্বল্প স্থায়ী এবং প্রলম্বিত সুর কাকতালীয়ভাবে (দুর্ঘটনাবশত) রবিঠাকুরের একটা গানের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, তবে এই মিলটা শোনা ও বোঝার ভুলও হতে পারে, আবার একজন ট্রেন ড্রাইভারের উদ্ভট খেয়ালও হতে পারে।
তা সত্ত্বেও, এর মধ্যে কৌতূহল জাগানোর যথেষ্ট উপাদান থাকায় প্রসঙ্গটা আমরা অনেকেই ভুলে থাকতে পারছি না। খাওয়াদাওয়া সেরে লেবার-সর্দারদের সঙ্গে আগামীকাল কী কী কাজ করা হবে, তা নিয়ে বেশ রাত পর্যন্ত আলোচনা করি আমরা। সেটা শুরু হওয়ার আধঘণ্টা পর দেখা গেল, মালবাহী ট্রেনের ওই বাঁশি নিয়ে কথা বলছে হায়দার, উৎসাহী শ্রোতার সংখ্যা কম নয়।
‘ট্রেনের ওই ড্রাইভার চাইলেও তার বাজানো বাঁশি থেকে সুর বাদ দিতে পারবে না। রাতে বিছানায় শুয়ে প্রায়ই তোমরা ট্রেনের হুইসেল শোনো, না? ড্রাইভার কখন অস্থির কিংবা উদ্বিগ্ন হয়ে আছে, তা তোমরা বুঝতে পারো, বুঝতে পারো কখন তার রওনা হতে দেরি হয়ে গেছে, ওই রাতে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে তাকে। তার বাঁশি তীক্ষ আর অসহিষ্ণু শোনাবে। কিংবা বুঝতে পারো, একজন ড্রাইভার তার পালা শেষ করে এবার বাড়ি ফিরবে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে ড্রাইভারের স্বস্তি আর তৃপ্তি প্রকাশ করে বাঁশি।’
‘হায়দার স্যার, আপনে একজন কবি!’ ‘শোনো, ওই ড্রাইভারের প্রতি আমার একটা বিশ্বাস জন্মেছে,’ বলল হায়দার। ‘এরপর আমি যখন ওদিকের গ্রামে যাব, আমাকে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। কে ওভাবে হুইসেল বাজায়, আর কেনই বা বাজায়।’
গ্রামে সত্যি একদিন গেল হায়দার, আর বাঁশির রহস্যও আমরা জানতে পারলাম। পরিচ্ছন্ন একটা গল্প। কোনো সন্দেহ নেই ওই হুইসেল একটা কোড-ই, গোপন সংকেত।
মালবাহী ট্রেনের ড্রাইভার, নাম সৎ প্রয়াস, সুন্দরী অপরূপা এক মেয়েকে ভালোবাসে, এবং সত্যি সত্যি রবীন্দ্রসংগীতের একটা গানের সুর ওই মেয়ের উদ্দেশে সংকেত হিসেবে বাজায় সে। একসময় উচ্ছন্নে চলে গিয়েছিল, ছিল চরম বেআদব, হাঁড়িয়া খেয়ে মারপিট করত, তারপর হঠাৎ এই মেয়ের প্রেমে পড়ে পুরো বদলে গেছে। পাহাড়ি ঢালে ওই মেয়ের বাড়ি, সেটার সামনে দিয়ে তার ট্রেন ছোটে, আর বাড়িটাকে দেখামাত্র ওই সুরে হুইসেল বাজাতে চেষ্টা করে সে।
‘মনে হয় মেয়েটিকে সংকেত দেয় যে সে ভালো আছে,’ বলল হায়দার।
আমরা অনেকেই অভিযোগ করলাম, এটা তার বানানো গল্প, কিন্তু শেষমেশ তার কথা আমাদের বিশ্বাস হলো। এরপর চার সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ওই বাঁশি শুনলাম আমরা—ওই একই ধরন, ওই একই জায়গায়, একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে। আমাদের কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, আর জোগালিদের মধ্যে একটা আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলাম। ওদের মন আর আচরণ নরম হয়ে গেছে। তারা আগের চেয়ে কম ঝগড়া করছে, প্রত্যেকে এখন বিবেচক হওয়ার চেষ্টা করে, যেচে পড়ে সাহায্য করছে পরস্পরকে। কসম খেয়ে বলতে পারি, ওই গল্প আর বাঁশির প্রভাব থেকে কেউ আমরা মুক্ত থাকতে পারিনি। বাড়িতে একা ফেলে রেখে আসা স্ত্রীর কথা এখন প্রতিদিন পাঁচ-সাতবার ভাবি আমি, আগে হয়তো তিন দিনে একবার মনে পড়ত।
তারপর আরেকটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। হুইসেল থেমে গেল। প্রথম যেদিন বাঁশি বাজল না, নিজেদের কানকে বিশ্বাস করা কর্িঠন হয়ে উঠল। কিন্তু পরদিনও বাজল না। তৃতীয় গোধূলি চলে এল, জঙ্গলের ফাঁকে দেখতে পেলাম ট্রেনটাকে, কিন্তু ইঞ্জিনের মাথা থেকে না কোনো বাষ্প বেরোল, না হুইসেল থেকে কোনো শব্দ।
খাদের উঁচু কিনারা থেকে বাস্তবতার নিরেট মেঝেতে পড়ে গেলাম আমরা। পৃথিবী আবার তার ধূসর চেহারা ফিরে পেয়েছে। যারা সন্দেহ আর হতাশা ফেরি করে, তারা নিজেদের ব্যবসা শুরু করে দিল।
‘স্যার, মনে হইতাছে আপনের ডেরাইবার বন্দু আমগো লাহানই,’ হাসতে হাসতে বলল এক কাঠমিস্ত্রি। ‘ধইরা রাকতে পারল না।’ এক রাজমিস্ত্রি বলল, ‘দেহেন গা, আবর হাঁড়িয়া খাইতাছে।’ ‘ওদের মধ্যে হয়তো সামান্য মনোমালিন্য দেখা দিয়েছে,’ হায়দারের পক্ষ নিয়ে বললাম আমি।
‘খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে আমাকে,’ আলাপে ছেদ টেনে বলল হায়দার। খোঁজ নিতে সত্যি আবার গ্রামে গেল হায়দার। ফিরে এল একমুখ হাসি নিয়ে। ‘ওরা বিয়ে করেছে,’ রিপোর্ট করল সে। ‘হানিমুন করতে কক্সবাজারে গেছে। সপ্তাহ খানেক পর ফিরবে। তখন সংকেতের জন্য অপেক্ষা ক’রো।’
তার কথাই ঠিক। এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার শুরু হলো হুইসেল। তবে এবার অন্য জায়গায়। ‘এটা কী হলো?’ হায়দারকে রীতিমতো ব্যঙ্গ করল এক ঠিকাদার। ‘নতুন বউয়ের মনে হয় হাত চলে, তাই সে হয়তো ভাবছে দূরে সরে থাকাই ভালো।’ হেসে উঠে হায়দার বলল, ‘আরে, না! লাইনের আরও সামনের দিকে নতুন বাড়িতে বউকে তুলেছে সে। জানা কথা, ওখানেই এখন হুইসেল বাজাবে।’
ওই বিশ্বস্ত হুইসেল আরও তিন সপ্তাহ শুনলাম আমরা, প্রতিবার ওই নতুন জায়গায়। আরও একটু অস্পষ্ট, তবে আগের মতোই ঘড়ির কাঁটা ধরে, আওয়াজের ধরনও সেই একই। দেখা গেল, কাজ করার সময় আবার শিস দিচ্ছে বা গুনগুন করছে লেবাররা।
এদিকে আমাদের রিসোর্ট তৈরির কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আর দুই কি তিন সপ্তাহের মধ্যে মিস্ত্রি ও শ্রমিকেরা চলে যাবেন। সে জন্য তাঁদের মন খারাপ। এরপর যেখানেই কাজ করতে যান, জায়গাটা যত সুন্দরই হোক, এই বাঁশি সেখানে বাজবে না।
কিন্তু আবারও একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আবার থেমে গেল হুইসেল। পর পর চার দিন চুপ করে থাকল ওটা। ‘এরই মধ্যে দাম্পত্য কলহ?’ কৌতুক করল সেই ঠিকাদার। ‘বউ বাসন ছুড়ে মেরেছে, সেটা লাগায় শিস দেওয়ার আঙুলটা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে।’ এটা তার সহকারীর কৌতুক।
এক রাজমিস্ত্রি বলল, ‘স্যার, আপনেরে তো একডা খবর নিতে লাগে।’ ‘নিচ্ছি,’ বলল হায়দার। সেদিন সন্ধ্যায় গ্রাম থেকে খবর নিয়ে ফিরল সে, কিন্তু মুখে হাসি নেই। অথচ, তাকে যখন আমরা মেঠো পথ ছেড়ে বাগানে ঢুকতে দেখছি, মাথা হেঁট, হাঁটার গতি মন্থর, আমরা সত্যি সত্যি ট্রেনের হুইসেল শুনতে পেলাম। না, কেউ আমরা ভুল শুনিনি, তবে সুরটা একটু অন্য রকম, এবং মনে হলো, আরও খানিক দূর থেকে ভেসে আসছে।
ট্রেনের বাঁশি বাজছে শুনে থামল হায়দার, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল যতক্ষণ শোনা গেল। তারপর বাকি পথটুকু হেঁটে এসে লোহার বেঞ্চে বসল। আমরা সবাই তার দিকে ঝুঁকে পড়লাম। ‘মেয়েটা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল,’ বলল সে। ‘ওরা ওদিকের এক গোরস্তানে তাকে শুইয়ে রেখে এসেছে। একটা দিনও সুস্থ থাকত না, ছোটবেলা থেকে দুর্বল। আমার মনে হয়, ওই গোরস্তানকে পাশ কাটানোর সময় সংকেত দিচ্ছে ছেলেটা।