মরণখেলা: ২.১২ ফুল স্পীডে ছুটছে কিউট

মরণখেলা: ২.১২ ফুল স্পীডে ছুটছে কিউট

২.১২ ফুল স্পীডে ছুটছে কিউট

ফুল স্পীডে ছুটছে কিউট। অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে দ্রুত বেগে।

ক্রস কারেন্টের মধ্যে পড়ে সব কটা আইসবার্গ সচল হয়ে উঠেছে, চারদিক থেকে এগিয়ে এসে পরস্পরের সাথে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হবে। প্রায় সবগুলো এগিয়ে আসছে কিউটের দিকে। তবে ক্যাপটেন গোল্ডম্যান সমস্ত মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছেন। সামনের দুই দৈত্যের দিকে। পরস্পরের দিকে এগোচ্ছে সে-দুটো, বন্ধ করে দিচ্ছে চ্যানেলের মুখ। জাহাজের পোর্ট আর স্টারবোর্ড সাইডে একের পর এক নতুন নতুন আইসবার্গ বেরিয়ে আসছে। কুয়াশা ছিড়ে, কিন্তু সেদিকে তাকাবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন তিনি। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে যা কিছু হওয়ার হয়ে যাবে। হয় কিউট চ্যানেল থেকে খোলা সাগরে বেরিয়ে যাবে, না হয় দুই আইসবার্গের মাঝখানে পড়ে চিঁড়েচ্যাপ্টা হবে।

ফুল পাওয়ার! বারবার একই নির্দেশ দিচ্ছেন ক্যাপটেন।

ব্রিজে ঢুকল কাফম্যান। পোর্ট আর স্টারবোর্ডের দিকে। তাকিয়ে ছানাবড়া হলো তার চোখ।

সম্মোহিতের মত সামনে তাকিয়ে আছেন গোল্ডম্যান, কাফম্যানের উপস্থিতি টের পেয়েছেন বলে মনে হলো না। হঠাৎ পকেটে হাত ভরে রুমাল বের করলেন তিনি, কপালের ঘাম মুছে। বললেন, সাংঘাতিক গরম! পোর্টের দিকে তাকালেন না, তাকালে দেখতে পেতেন কেউ যদি একটা বোতল ছুঁড়ে মারে, আইসবার্গের গায়ে ভাঙবে সেটা।

সামনের ডেকে চাঁদের আলো নেই। জোড়া আইসবার্গের ছায়া পড়েছে। চোখে রাজ্যের আতঙ্ক নিয়ে ক্যাপটেনের দিকে তাকিয়ে আছে কাফম্যান আর হেলমসম্যান। গোল্ডম্যান জানেন, পোর্ট বা। স্টারবোর্ডের দিকে তাকালে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবেন তিনি। বিপদ ভুলে থাকার জন্য হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করলেন, নাম্বার ওয়ানটার খবর কি?

কিছুই বুঝতে না পেরে হেলমসম্যান আর কাফম্যান দৃষ্টি বিনিময় করল। ক্যাপটেন কি পাগল হয়ে যাচ্ছেন?

কার কথা বলছেন, স্যার? বেসুরো গলায় জিজ্ঞেস করল কাফম্যান।

নাম্বার ওয়ান। গোঁয়ার দি গ্রেট। চতুর নেকড়েটা, আর্কটিক যাকে অচ্ছুৎ মনে করে হেঁয় না। হাতের তালুতে আইসবার্গ নিয়ে খেলে। এখনও বুঝতে পারছ না কার কথা জিজ্ঞেস করছি? কথা বলতে বলতেই আবার সামনের দিকে তাকালেন ক্যাপটেন।

মি. কাফম্যান, হঠাৎ ভারী গলায় বললেন ক্যাপটেন, পিছনের জানালা দিয়ে বাইরে একবার তাকাও! ক্যাপটেনের সম্বোধনই কাফম্যানকে জানিয়ে দিল, অ্যাকটিং মেট থেকে মেট-এ পরিণত হয়েছে সে।

পেরিয়ে এসেছি! উল্লাসে কাফম্যানের গলা কেঁপে গেল। গেট থেকে বেরিয়ে এসেছি!

মেইন্টেইন ইওর প্রেজেন্ট কোর্স।

সামনে, বহুদূর আকাশে, স্লান একটা আলো দেখা গেল। আর্কটিকে ফিরে আসছে সূর্য। ভারী কুয়াশা থাকায় এই আলোর আভা দিনের পর দিন অদৃশ্য ছিল। পিছনের জানালা দিয়ে স্টার্নের দিকে তাকাল কাফম্যান। দুই আইসবার্গের মাঝখানে চ্যানেলের মুখ এত সরু, ছোট একটা লঞ্চও এখন গলবে না।

ক্লিয়ার ওয়াটার অ্যাহেড, মি. কাফম্যান, ক্যাপটেনের ভারী গলা ব্রিজের ভেতর গম গম করে উঠল। আমরা বাড়ি ফিরছি।

ইয়েস, স্যার! বলে স্যালুট ঠুকল মেট কাফম্যান।

কিন্তু তোমাকে আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম, মি. কাফম্যান?

ইয়েস, স্যার। মি. রানা জ্ঞান হারিয়েছেন, তবে ভয়ের কিছু নেই। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেছে, দুদিনের মধ্যে হাঁটাচলা করতে পারবেন তিনি। জখমগুলো সারতে অবশ্য আরও কটা দিন সময় নেবে…

.

সাতই মার্চ, বুধবার, কুইবেকে নোঙর ফেলল কিউট। গ্যাংওয়েতে রানাকে বিদায় জানাল নিয়াজ আর বিনয়। জাহাজে করে আমেরিকান আর্কটিক রিসার্চ সেন্টারে ফিরে যাবে ওরা, নিজেদের কর্মস্থলে। পালা করে দুজনের সাথে হ্যান্ডশেক করল রানা, তারপর বুকে জড়িয়ে ধরল। দুজনই ওরা হাসছে।

জাহাজ থেকে প্রথমে নামল ইভেনকো রুস্তভ। রানার পাশ ঘেঁষে যাবার সময় তার মুখে বিজয়ীর হাসি দেখা গেল। ভাবটা যেন, কেমন ঠক্ দিলাম! দেখেও না দেখার ভান করল রানা।

গোল্ডম্যান, কাফম্যান, আর হিগিনের কাছ থেকে আগেই বিদায় নিয়েছে রানা। জেটি ধরে এগোল ও। জেটির শেষ মাথায় দুটো গাড়ি দেখল। গাড়ির পাশে জেনারেল ফচ, আর সি.আই.এর ডেপুটি ডিরেক্টর উইলিয়াম অবসনকে দেখা গেল। ওদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে ইভেনকো রুস্তভ।

প্রথমে এগিয়ে এলেন জেনারেল ফচ। রানার সাথে হ্যান্ডশেক করলেন তিনি। কর্নেল উইলিয়াম অবসন আলিঙ্গন করল রানাকে। মাথা আর কাঁধে ব্যান্ডেজ, ব্যথা পেয়ে উফ্ করে উঠল রানা।

আপনার জন্যে হিলটনের একটা স্যুইট রিজার্ভ করা হয়েছে, মি. রানা, উফুল্ল কণ্ঠে বললেন জেনারেল ফচ। এয়ারপোর্টে একটা প্লেন রাখা হয়েছে, আপনার যখন খুশি… কুইবেকে আসার। পথে আমেরিকান একটা জাহাজের সাথে মাঝ সমুদ্রে দেখা হয়েছিল কিউটের, ওয়ায়েরলেসে সব খবরই পেয়েছেন তিনি।

ধন্যবাদ, বলল রানা। সরাসরি এয়ারপোর্টেই যাব আমি।

মেরিলিন চার্ট…

আমার কাছে, মি. ফচ, তাড়াতাড়ি বলল ইভেনকো রুস্তম্ভ। পারকার পকেট থেকে টিউবটা বের করল সে। জেনারেল ফচ আর। কর্নেল অবসনের সাথে তার পরিচয়, ইত্যাদি আগেই হয়ে গেছে। হঠাৎ রানার দিকে ফিরল রুস্তভ। আগেই জানিয়েছি, আপনি আমেরিকান নন বলে আপনার ওপর ততটা বিশ্বাস আমি রাখতে পারিনি, মিস্টার রানা। টিউবটা ঝাঁকাতে শুরু করল সে। তালুর ওপর এক টুকরো কোর পড়ল। আবার ঝাঁকাল রুস্তভ। এবার পড়ল মাইক্রোফিল্ম। আপনি জানেন, এটাই আসল মেরিলিন চার্টের মাইক্রোফিল্ম। আপনাকে তাই আমি জানিয়েছিলাম। হাসতে লাগল সে। কিন্তু এটার কথা আপনাকে আমি জানাইনি, বলে টিউবটা আবার আঁকাতে শুরু করল। এবার আরও এক। টুকরো কোর বেরুল টিউব থেকে। তবু টিউবটা ঝাঁকাচ্ছে রুস্তম্ভ। সবশেষে আরেকটা মাইক্রোফিল্মের মোড়ক বেরুল ভেতর থেকে। মি. রানা, এটাই হলো আসল মেরিলিন চার্টের মাইক্রোফিল্ম। প্রথমটা আপনি দেখেছেন, কিন্তু সেটা নকল-কাজেই আপনি দেখে থাকলেও কিছু আসে যায় না। যেন মস্ত এক রসিকতা করেছে, একা একাই হো হো করে হাসতে লাগল রুস্তভ।

রানার ইচ্ছে হলো বলে, বোকচন্দর, জাহাজে থাকতে টিউব টিউব করে জান দিচ্ছিলে বলে আমাদের সন্দেহ হয়, টিউবের ভেতর আরও একটা মাইক্রোফিল্ম আছে, এবং সেটাই আসল মেরিলিন চার্ট। তাই কৌতূহলী হয়ে টিউবটা আমরাও ঝাঁকাতে শুরু করি। বেরিয়ে আসে দ্বিতীয় মাইক্রোফিল্ম। যদি জানতে, সেটা এখন আমার বগলের তলায় টেপ দিয়ে আটকানো রয়েছে! প্রথম মাইক্রোফিল্মের দুটো ফটোকপি তৈরি করি আমরা, সে-দুটো টিউবে ভরে রাখি, তারপর টিউবটা ফিরিয়ে দেয়া হয় তোমাকে। তোমার হাতে যে দুটো মাইক্রোফিল্ম শোভা পাচ্ছে, ব্যাটা হাড়েবজ্জাত, নকল চার্টের কার্বন কপি ওগুলো। কিছুদিন যাক, দুটোই যে নকল, টের পাবে বাছাধন। আমেরিকানরা তখন তোমার পাছায়…। কিন্তু কিছুই তাকে বলল না রানা। চেহারায় নির্লিপ্ত একটা ভাব ফুটিয়ে তুলে জেনারেল ফচকে বলল, এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আমাকে একটা লিফট দেবেন, প্লীজ?

ও, শিওর, গ্ল্যাডলি! জেনারেল ফচ নয়, সি.আই.এ-র ডেপুটি ডিরেক্টর কর্নেল অবসন রানার হাত ধরে একটা গাড়ির দিকে এগোল। গাড়িতে ওঠার আগে, কি মনে করে ঘাড় ফিরিয়ে। একবার পিছন দিকে তাকাল রানা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ইভেনকো রুস্তভকে ভেঙচাল ও।

এয়ারপোর্টে যাবার পথে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল রানা। আরও একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে। আসল মেরিলিন চার্টের। মাইক্রোফিল্মটা রাশিয়ানদের ফিরিয়ে দিতে হবে। কাজটা ঢাকায় পৌঁছেও সারা যায়। সোভিয়েত দূতাবাসে যেতে হবে ওকে।

খুক করে কেশে কর্নেল অবসন বললেন, কি ভাবছেন, মি. রানা?

রানা হাসল। কিছু বলল না।

আপনি শুনে খুশি হবেন, মি. রানা, আবার বলল কর্নেল অবসন, আমাদের প্রেসিডেন্ট এই অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত সব জেনেছেন। তিনি যে খুশি হয়েছেন, ধন্যবাদ দিয়েছেন, এবং শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, সেটা আপনাকে জানাবার দায়িত্ব পড়েছে। আমার ওপর।

কেউ বলতে পারবে না আপনি আপনার দায়িত্ব পালন। করেননি, মৃদু হেসে বলল রানা।

ধন্যবাদ, মি. রানা, অসংখ্য ধন্যবাদ। হঠাৎ প্রসঙ্গ বদল করল কর্নেল অবসন, ভবিষ্যতে যদি কোন দরকার হয়, আশা করি আবার আমরা আপনার সাহায্য পাব…?

ভবিষ্যই সে-কথা বলতে পারে…

না, প্লীজ, এড়িয়ে যাবেন না, আবেদনের সুরে বলল অবসন।

ভুরু কুঁচকে তাকাল রানা। আপনাকে যেন সিরিয়াস মনে হচ্ছে?

সিরিয়াস? হ্যাঁ, অবশ্যই। সত্যি কথা বলতে কি, জটিল একটা অ্যাসাইনমেন্ট রয়েছে আমার হাতে। কিন্তু যোগ্য লোকের অভাবে…

সি.আই.এ-তে যোগ্য লোকের অভাব? হেসে উঠল রানা।

কর্নেল গম্ভীর। বললে বিশ্বাস করবেন না, আমাদের হাতে মাঝে মধ্যে এমন টপ সিক্রেট কাজ থাকে, নিজেদের কোন এজেন্টকে বিশ্বাস করে সে-কাজ দেয়া চলে না। সেই রকম একটা কাজের কথা নিয়ে আপনার সাথে আলোচনা করতে চাই আমি…

হাতজোড় করল রানা। এখন? মাফ করুন!

হেসে ফেলল কর্নেল। ঠিক আছে, পরে একসময়। আমিই যোগাযোগ করব। তার আগে একটু বলে রাখি, কাজটা করে দেয়ার অনুরোধ শুধু আমার তরফ থেকে নয়, প্রেসিডেন্টের তরফ থেকেও পাবেন আপনি। আশা করি প্রত্যাখ্যান করবেন না।

দেখা যাবে।

এরপর রানাকে আর বিরক্ত করল না অবসন।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত