২.১১ ওদের মাথার ওপর বরফ-প্রাচীর
ওদের মাথার ওপর বরফ-প্রাচীর খাড়াভাবে উঠে গেছে। সহস্র বরফ টুকরোর মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে লঞ্চ। সামনেই আইসশেলফ, ওখানে গোস্ট বার্গের গোড়া আলিঙ্গন করে আছে। সাগর। স্পীড কমিয়ে দিল রানা, ধীরে ধীরে থেমে গেল লঞ্চ। ছোট বড় বরফ টুকরোর মাঝখানে দুলতে লাগল ওরা। ওদের বিশ গজ দক্ষিণে বিশাল গুহাটা, তেরছাভাবে ঢুকে গেছে বার্গের অভ্যন্তরে। কুল কুল শব্দে পানি ঢুকছে ভেতরে। চাদের আলোয় চারপাশটা ভাল করে দেখে নিল রানা। বিপরীতমুখী কোন স্রোত। নেই। দম নিয়ে নির্দেশ দিল, চড়া গলায়, খুলে দাও ফ্লোট!
ছুরি নিয়ে তৈরি ছিল নিয়াজ। এক হাতে রশিটা ধরে, অপর হাতে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে ছুরি চালাল। শক্ত ফাইবার, সহজে কাটতে। চায় না। তার পিছনে রানা আর বিনয় দেরি দেখে ছটফট করছে। রানার হিসেবে, বিস্ফোরণ ঘটতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। তবে হাতে ঘড়ি না থাকায় নিশ্চিত হবার উপায় নেই। হয়তো সাতমিনিট বাকি, কিংবা তিন মিনিট।
শেষ পর্যন্ত রশিটা কাটতে পারল নিয়াজ, কিন্তু কয়েকটা চিকন রোয়া রয়ে গেল, লঞ্চের সাথে আটকে রাখল ভেলাটাকে। অশ্লীল একটা গালি বেরিয়ে এল নিয়াজের মুখ থেকে। ইতিমধ্যে হাত থেকে ফসকে বেরিয়ে গেছে রশি। তার সাহায্যে এগিয়ে এল বিনয়, হাতে নিজের ছুরি। অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকল রানা, হুইল ছেড়ে যেতে পারছে না। গুহামুখের প্রকাণ্ড হাঁ ক্রমশ এগিয়ে আসছে, স্রোতের টানে ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে চলেছে লঞ্চ।
কেঁপে উঠল রানা, কি করছ তোমরা!
অনেক কষ্টে রশিটা আবার ধরতে পারল নিয়াজ। রোয়াগুলোর ওপর ছুরি চালাল বিনয়। বিদায় নিল ফ্লোট। হাতের এক ঝাপটায় থ্রটল খুলে দিল রানা, ঝাঁকি খেয়ে ছুটল লঞ্চ, গোস্ট বার্গকে। পিছনে রেখে দূরে সরে আসছে। চ্যানেল ধরে কোনাকোনি এগোল ওরা, সেই সাথে রিসার্চ শিপ রিগার আওয়াজ আরও জোরে বাজল কানে। কিউটের দিকে যাচ্ছে লঞ্চ, কিন্তু আইসব্রেকারকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না।
স্টার্নে উবু হয়ে বসে পিছনে তাকিয়ে আছে বিনয়। ফ্লোটটা ছোট ছোট ঢেউয়ের তালে দুলছে। স্রোত ওটাকে গুহার ভেতর নয়, গুহার সামনে দিয়ে আরেক দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গুহা-মুখের পাশে, বরফের গায়ে গিয়ে ধাক্কা খেলো ভেলা। মনে হলো ফিরে আসবে। কিন্তু না, ওখানেই থেমে থাকল। গাল-মন্দ করছে বিনয়, ঠোঁট নড়লেও কোন আওয়াজ নেই। তারপর, হঠাৎ করে, গুহার ভেতর থেকে কেউ যেন হ্যাঁচকা টান মারল, চোখের পলকে স্যাঁৎ করে ভেতরে সেঁধিয়ে গেল ফ্লোটটা।
হাঁফ ছাড়ল বিনয়।
লঞ্চ নিয়ে এগোতে গলদঘর্ম হচ্ছে রানা। বড় একটা বরফের চাই দেখে বন বন করে হুইল ঘোরাল, কাত হয়ে পড়ল দ্রুতগতি লঞ্চ, মনে হলো উল্টে যাবে, তারপর আবার সিধে হলো। ছোট। বড় অসংখ্য বরফের টুকরো ভাসছে চ্যানেলে, মাঝখান দিয়ে পথ করে নিয়ে ছুটছে লঞ্চ। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত লঞ্চ চালানো মানে। আত্মহত্যার চেষ্টা করা। অথচ বাঁচার একমাত্র উপায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিস্ফোরকের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া।
ওদের ডান দিক থেকে এখনও মাথার ওপর ঝুঁকে রয়েছে। গোস্ট বার্গ, সেটার বিস্তার ওদের সামনে দক্ষিণ বরাবর যত দূর। দৃষ্টি চলে তত দূর।
হুইলের সাথে যেন কুস্তি লড়ছে রানা।
মনে হলো বহু দূরে একটা নিঃসঙ্গ আলো মিটমিট করছে। কিউটের পিছনে জ্বলছে ওটা। ওই একটাই, বাকি সব আলো কি। মনে করে কে জানে নিভিয়ে দিয়েছেন গোল্ডম্যান। আইসব্রেকারের পিছনে হালকা খয়েরি ফেনা দেখা গেল, ওদের বাঁ দিকে। ঠাণ্ডা হুল-ফোটানো বাতাসে চোখ-মুখ নীল হয়ে গেল। বরফের টুকরোগুলোকে এড়াবার জন্যে এঁকেবেঁকে ছুটছে লঞ্চ। আর পিছু পিছু ধেয়ে আসছে ষোলো হাজার টনী রুশ রিসার্চ শিপ। রিগা-গোস্ট বার্গের প্রায় গা ঘেঁষে।
এবার সত্যি ভয় পেল ওরা। কেউ ভাবতেও পারেনি এমন হুট। করে এত কাছাকাছি চলে আসবে রিগা। রিসার্চ শিপের স্পীড লিমিট সম্পর্কে ভুল ধারণা করেছিল ওরা।
গেট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! হামাগুড়ি দিয়ে রানার পাশে চলে এল নিয়াজ।
দূরে, কিউটের সামনে, দৃশ্যটা বদলে যাচ্ছে। রানার মনে হলো, গোল্ডম্যান অনেক দেরি করে ফেলেছেন। চ্যানেলের মুখে, দুপাশে অটল দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল প্রকাণ্ড দুটো আইসবার্গ-হঠাৎ করে দুটোই বিপরীতমুখী দুই স্রোতের মধ্যে পড়ে যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। সচল হয়ে উঠে পরস্পরের দিকে এগোচ্ছে। কিউট যখন ওখানে পৌঁছুবে, পথটা খোলা থাকবে না। নিয়াজ ভুল বলেনি, সত্যিই গেট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
আঁতকে উঠে দ্রুত হুইল ঘোরাল রানা। আকারে ছোটখাট একটা বাড়ি, ধাক্কা লাগার দরকার হবে না, ঘষা লাগলেই উল্টে যাবে লঞ্চ-এই সাইজের বরফ সামনে আরও দুএকটা দেখা গেল। ঘুর পথে এগোতে হলো ওদেরকে, ফলে আরও পিছিয়ে পড়ছে লঞ্চ। দুএকটা নয়, খানিক পরপর একটা করে, অনেকগুলো বড় বড় চাই সামনে। যে-কোন একটার সাথে ধাক্কা। লাগা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
তবু রানা বেপরোয়া, স্পীড না কমিয়ে আরও বাড়িয়ে দিল। ওর এই দুঃসাহসের ফলও ফলল হাতেনাতে। কিউটের আলো আগের চেয়ে উজ্জ্বল দেখল ওরা। তারমানে মাঝখানের দূরত্ব কমছে। স্টারবোর্ডের দিকে তাকাল রানা। অবাক হয়ে গেল ও। গোস্ট বার্গের শেষ প্রান্ত ছাড়িয়ে সামনে চলে এসেছে লঞ্চ।
.
পাওয়ার! আরও পাওয়ার! ফুঁসে উঠল কর্নেল বলটুয়েভ। ওভারটেক করো!
কোন কথাই বলল না ট্রাভকিন। নিজের জাহাজে তার কোন কর্তৃত্ব নেই। স্টারবোর্ড দিকের জানালা পথে বিশাল আইসবার্গ। আকাশ ছুঁয়ে রয়েছে। এতক্ষণে ট্রাভকিন লক্ষ করল, আইসবার্গটার গোড়ায় একটা ফাঁক রয়েছে। তারমানে কি ফাঁকা ওটা? গোস্ট বার্গ?
.
চোখে ব্যথা, পানি ঝরছে, ডুবে থাকা লম্বা বরফটা দেখতে পেল না। রানা। লম্বায় চল্লিশ ফুট, চওড়ায় পাঁচ ফিটের কম নয়, লঞ্চের। সামনে আড়াআড়িভাবে পড়ল। লঞ্চের বো ধাক্কা খেলো, লাফ দিয়ে উঠল শূন্যে, টুকরোটাকে টপকে যেতে শুরু করল লঞ্চ।
লঞ্চ উঁচু হতে শুরু করতেই একটা হার্টবিট মিস করল রানা। প্রপেলার ধাক্কা খাবে বরফের সাথে, দুমড়েমুচড়ে গিয়ে হয়তো লঞ্চ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। লঞ্চের বো উঠে গেল, তারপর নামতে শুরু করল। খোলের সাথে বরফের ঘষা অনুভব করল ওরা, তারপর কড়াৎ করে আওয়াজ হলো-মাঝখান থেকে ভেঙে গেল টুকরোটা। শূন্যে উঠে পড়ল প্রপেলার, উড়ে পেরিয়ে এল। টুকরোটাকে। ঝপাৎ করে পানিতে পড়ল লঞ্চের পিছনটা। সেই সাথে আকাশ-ছোঁয়া বরফ-পাঁচিলের ভেতর বিস্ফোরিত হলো। ফ্লোটিং মাইন।
প্রথম দিকে একের পর এক ঘটনা যা ঘটল, সব গোস্ট বার্গের। ভেতরে। যে টাওয়ারটা লক্ষ টন ঝুল-বরফের ভার বহন করছিল, প্রথমে ধসে পড়ল সেটা। তারপর সার সার স্তম্ভগুলো কাত হলো। ধীরে ধীরে, বড় বড় টুকরোয় ভাগ ভাগ হয়ে খসল। ঝপাৎ ঝপাৎ। করে পড়তে লাগল বার্গের ভেতর লেকে। তারপর কাত হয়ে থাকা স্তম্ভগুলো আছাড় খেতে শুরু করল। একেকটার ওজন হবে হাজার দুহাজার টন।
স্তম্ভগুলোর মাথায় ছিল অসংখ্য চওড়া সেতু, তিনশো ফিট ওপর থেকে নেমে এল সেগুলো। লেকের কিনারায় বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ তুলে পড়তে লাগল একের পর এক। লেকের ভেতরটায় সচল হিমবাহের মহা আলোড়ন উঠল। টাওয়ার গেল, বিশাল ঝুল বরফ গেল, গোস্ট বার্গের পাঁচিলটাকে ঠেক দিয়ে রেখেছিল অবলম্বনগুলো, সেগুলোও গেল। থাকল শুধু দীর্ঘ পাঁচিল। কিন্তু এবার অবলম্বনহীন পাঁচিলের একটা অংশও কাত হতে শুরু করল। সেই সাথে প্রকৃতির এক ভয়ঙ্করতম দৃশ্য উন্মোচিত হলো ধীরে ধীরে।
পাঁচিল কাত হলো ভেতর দিকে, রিগার উল্টোদিকে। দৃশ্যটা চাক্ষুষ করে স্রেফ পাথর হয়ে গেল রিগার লোকজন। উঁচু পাঁচিল, খানিক আগে যেটা ওদের মাথার ওপর আকাশ ছুঁয়ে ছিল, কাত হয়ে ধসে পড়ল পিছন দিকে। কয়েক মুহূর্ত নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না বলটুয়েভ। ট্রাভকিনের দিকে তাকাল সে, ক্যাপটেনের চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে।
গোস্ট বার্গ…! পতনের একনাগাড় গর্জন প্রতিধ্বনি তুলছে, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল ট্রাভকিন। ভয়েস-পাইপের দিকে ছুটে গেল সে, চিৎকার করে বলল, ভয়ের কিছু নেই…ভয়ের কিছু নেই…
ট্রাভকিন ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। ভুলটা ধরিয়ে দিতে পারত রানা। রাশিয়ানরা যে ভয়ঙ্কর দৃশ্য চাক্ষুষ করছে, যা ঘটবে তার তুলনায় এ কিছুই না। মাত্র প্রস্তুতি নিচ্ছে দানব প্রকৃতি।
শালার গোস্ট বার্গ পিছন দিকে পড়ল! আক্ষেপের সাথে। চিল্কার করে উঠল নিয়াজ। কানা ভূতটা…।
চুপ থাকো! ধমকে উঠল রানা। গাল দিও না বেচারাকে!
বার্গের সামনে পানিতে আলোড়ন উঠল। ফুলে উঠল পানি, বড় বড় ঢেউ তৈরি হলো। কিন্তু এটা রানার উদ্বেগের কারণ নয়। তীব্র স্রোতের সাথে উঁচু পাহাড়ের মত ঢেউ আসবে-আসবেই, জানে ও। সবাই তাকিয়ে আছে পানির ওপরে, বার্গের দিকে। কিন্তু। রানা ভাবছে পানির নিচের কথা।
বাঁচতে হলে দূরে পালাতে হবে। কিউটে না উঠতে পারলে নির্ঘাত মরণ। পিছনে কি ঘটছে ভুলে থাকার চেষ্টা করল রানা, সমস্ত মনোযোগ দিল লঞ্চ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ওপর। লঞ্চে থাকলে ডুবে মরবে সবাই, কোন সন্দেহ নেই তাতে।
রিগা তার কোর্স ধরে আগের মতই ছুটছে, ধসে পড়া গোস্ট বার্গটাকে পাশ কাটিয়ে আসছে। পাঁচিলের একটা মাথা, পিছন। দিকে যেটা আকাশ ছুঁয়ে রয়েছে এখনও, এবার সেটা ধসে পড়ল। বিশেষ কোন দিকে কাত হলো না, সম্ভবত ফাঁপা বলেই তাসের। ঘরের মত ভেঙে পড়ল ফুটবল মাঠ আকৃতির বার্গের মেঝেতে।
লক্ষ টন ধসে পড়া বরফের চাপে গোস্ট বার্গের আরেক প্রান্ত, আধ মাইল লম্বা প্ল্যাটফর্ম বলা যেতে পারে, গম্বুজের আকৃতি নিয়ে ফুলে উঠতে শুরু করল। প্ল্যাটফর্মে পাঁচিলের যে অংশটা এখনও খাড়া হয়ে রয়েছে সেটা মস্ত একটা পাহাড়ের মত দেখতে, কিন্তু পানির তলা থেকে ধীরে ধীরে যেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তার তুলনায় ওটা কিছুই না।
বিশাল এলাকা জুড়ে উথলে উঠল সাগর। সারফেস থেকে উঁচু হয়ে উঠল পানি, যেন ভোজবাজির মত সী-লেভেল দ্রুতবেগে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে। তারপর দেখা গেল ডুবে থাকা নিরেট বরফ-পাঁচিল, সাগরের তলা থেকে যেন জেগে উঠছে একটা মহাদেশ। পাঁচিলের মাথা আর গা থেকে বিপুল জলরাশি জলপ্রপাতের মত নামছে। নায়াগ্রাও বোধহয় হার মানবে এর কাছে।
পাচিলের সাথে মাথাচাড়া দিল অনেকগুলো টাওয়ার, কোনটা কোনটার চেয়ে আগে আকাশ ছুঁতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে। একটা টাওয়ার রিগার ব্রিজ, তারপর মাস্তুল ছাড়িয়ে আরও উঁচুতে উঠে গেল, চওড়া পাঁচিলটা অনুসরণ করল সেটাকে, অন্যান্য টাওয়ারগুলোও পিছিয়ে থাকল না। রিগার ব্রিজ থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে থাকল কর্নেল বলটুয়েভ আর ট্রাভকিন, পরস্পরের অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউ সচেতন নয়।
অসুস্থ বোধ করল কর্নেল। সেই সাথে অসময়োচিত একটা অস্বস্তি। অস্বস্তির কারণটা ঠিক উপলব্ধি করতে পারল না সে। ট্রাউজার ভিজে গেছে, কিন্তু টের যে পাবে, সে-অনুভূতি তার নেই।
জলপ্রপাতের চওড়া একটা বিরতিহীন ধারা প্রচণ্ড গর্জনের সাথে রিগার ওপর পড়তে লাগল। শুধু যে পানি তা নয়, পানির সাথে বরফের চাইও রয়েছে। একেকটা একশো থেকে হাজার টন ওজনের। গুঁড়িয়ে গেল রেইল। তুবড়ে গেল খোল। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা বরফ-পাঁচিল প্ল্যাটফর্মের সাথে ঘুরতে শুরু করল। দশ মিলিয়ন টন, কিংবা তারও বেশি বরফ, বিশাল এলাকা জুড়ে আলোড়িত হতে শুরু করেছে। টাওয়ার, পানি থেকে উঠে আসা পাঁচিল এখনও থামেনি, উঠে যাচ্ছে আরও ওপর দিকে। সেই সাথে প্ল্যাটফর্মের সাথে একশো আশি ডিগ্রী কোণ রচনা করে। ঘুরছে।
ভগবান! দুহাতে মুখ ঢাকল বিনয়। এ আমি কি দেখছি! পাতাল থেকে আরেকটা দুনিয়া উঠে আসছে!
রানা মাত্র একবার, পলকের জন্যে, পিছন ফিরে তাকাল। ওর। একমাত্র প্রার্থনা, খোদা, সময় মত যেন কিউটে উঠতে পারি। এখন থেকে যে-কোন মুহূর্তে স্রোতের মাথায় চড়ে ধেয়ে আসতে। শুরু করবে ঢেউগুলো। ওদের পিছনে গোস্ট বার্গ উল্টে গেল।
বলা যায় গোটা আকাশটাই যেন ভেঙে পড়ল রিগার মাথায়। রিগার ব্রিজ থেকে ওরা দেখল ওদের মাথার ওপর বিশাল একটা ছায়া নেমে আসছে-ঘুরন্ত একটা ছায়া। নিজের অজান্তেই পারকার পকেট থেকে, শেষ মুহূর্তে, দাবা বোর্ডের খুদে সংস্করণটা বের করে দুহাতে ধরে রয়েছে কর্নেল বলটুয়েভ। কোন্ খেলায় কবে। হেরেছিল, চালে কোথায় ভুল করেছিল সেটা বোধহয় জানার ইচ্ছে। হয়ে থাকবে। প্রথম বড় আঘাতটা এল। পাঁচিলের অর্ধেকটা আছাড় খেলো রিগার ওপর, ষোলোশো টন রিসার্চ শিপ তিন চার লক্ষ টন বরফে চাপা পড়ে গেল। রিগার কি ভাঙল বোঝা গেল না, বোঝার দরকারও ফুরাল। রিগা ছিল, ব্যস, অতীত হয়ে গেছে।
জাম্প! হুঙ্কার ছাড়ল রানা।
কিউটের স্টার্ন ছাড়িয়ে এসেছে ওরা, জাহাজের মাঝখানে। থেমেছে। খোলের সাথে ঘন ঘন বাড়ি খেলো লঞ্চ। আগেই ওদেরকে আসতে দেখেছেন গোল্ডম্যান, জাহাজের স্পীড কমিয়ে। দিয়েছেন তিনি। ওপরের রেইল থেকে মই ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। জাম্প! আবার গর্জে উঠল রানা।
একটা মই ধরে ঝুলে পড়ল নিয়াজ, বিনয়ও আরেকটা মই লক্ষ্য করে লাফ দিল। হুইলের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে রানা, সচল খোলের পাশে লঞ্চটাকে ধরে রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। কিউটের পিছনে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে সাগর। ফুলে ওঠা বিপুল জলরাশি ধেয়ে আসছে বিপুল বিক্রমে।
ওপরের রেইল থেকে নতুন আরেকটা রশির মই ছুঁড়ে দিল কাফম্যান। রানার বুকে বাড়ি খেলো সেটা। মইটা ধরে হুইল ছেড়ে দিল ও। মুখ তুলে দেখল, রেইল টপকে জাহাজে উঠছে নিয়াজ আর বিনয়। রানার পায়ের নিচে থেকে সরে গেল লঞ্চ। মই আঁকড়ে ধরে ঝুলে পড়ল ও। রশিতে পা বাধল। মাথার ওপর থেকে আর্তনাদ করে উঠল কাফম্যান, কুইক, মি. রানা! কুইক, কুইক, কুইক!
মই বেয়ে উঠতে শুরু করল রানা, চাপা একটা গর্জন শুনে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল। জাহাজের পিছন দিকে তাকাল ও। কিউটের স্টার্ন লক্ষ্য করে ছুটে আসছে পাহাড় সমান ঢেউ। ঢেউয়ের সাথে পিপে আকৃতির বড় বড় বরফের টুকরো। প্রতিটি ঢেউয়ের মাথায় ভারী টুকরোগুলো নাচছে। ঠিক এই ভয়ই করেছিল রানা। বরফের একটা টুকরো যদি ধাক্কা দেয়, খোলের গায়ে রক্ত মাংস লেপ্টে যাবে।
রেইলের ওপর ঝুঁকে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিল নিয়াজ, বিনয়, আর কাফম্যান। পাগল হয়ে গেল নিয়াজ রানাকে উদ্ধারের জন্যে। আবার মই বেয়ে নামতে চায় সে। তাকে বাধা দেবে কি, বিনয়ও ফুঁপিয়ে উঠে অনুসরণ করল তাকে। কাফম্যানের একার পক্ষে ওদেরকে ধরে রাখা সম্ভব হলো না, অন্যান্য ক্রুরা সাহায্য করল তাকে।
খোলের গায়ে ঝুলছে রানা। স্রোতের সাথে তীরবেগে ছুটে এল ঢেউ। শেষ একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল কাফম্যানের গলা চিরে। আর কোন আশা নেই রানার। ওর জন্যে কারও কিছু করারও নেই। খোলের গায়ে মইয়ের শেষ মাথায় ঝুলে থাকল রানা। যমদূত এসে পড়েছে।
কিন্তু তবু সে মাসুদ রানা। আশা নেই জানে, জানে যতটুকুই ওঠার সুযোগ পাক ও, ঢেউ ওর নাগাল পেয়ে যাবে। কিন্তু হাল ছাড়ল না। এবং আশ্চর্য, ঢেউ এসে পড়ার আগেই অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে এল রানা। এতক্ষণে আবার একবার কিউটের পিছন দিকে তাকাল ও।
মাথায় সাদা ফেনা নিয়ে সবুজ একটা পাঁচিল ছুটে আসছে, এরই মধ্যে ওর মাথা ছাড়িয়ে উঁচু হয়ে উঠেছে সেটা। প্রথম ঢেউয়ের চূড়ায় নিরেট বরফের চাঁইটা দেখতে পেয়ে অন্তরাত্মা। কেঁপে উঠল। একবার ভাবল, কি পাপ করেছে ও যে এই মৃত্যু ছিল কপালে! খোলের গায়ে ছাতু হয়ে যাবে শরীরটা।
ঢেউটা আঘাত করল কিউটের পিছনে। প্রায় এক ঝটকায় উঁচু করে তুলল স্টার্ন, সেই সাথে কিউটের সামনের অংশ, বো, ডুব দিল পানির তলায়। দস্তানা পরা হাত দিয়ে রশির মই কজিতে পেঁচিয়ে নিল রানা, অন্তত লাশটা যেন ভেসে না যায়। কনুই ভাঁজ করে মাথার দুপাশে তুললক্ষীণ আশা মাথাটাকে বাঁচাতে পারলে। বলা যায় না, হয়তো…
লিফটের মত ওপরে উঠে যাচ্ছে স্টার্ন।
ঢেউয়ের ধাক্কা খেলো রানা, ধারাল দাঁতের মত সারা গায়ে কামড় বসাল ঠাণ্ডা পানি। কাঁধের ওপর অসহ্য চাপ অনুভব করল ও। মনে হলো মই থেকে ছিড়ে নিয়ে যাবে ওকে। কানের পাশে একটানা শোঁ-শোঁ গর্জন। ওর পাশে, খোলে বোমা ফাটল যেন, বরফের একটা মস্ত চাই ভেঙে চুরমার হলো। আচমকা রানা উপলব্ধি করল, গুঁড়ো বরফের স্তুপের ভেতর ঢাকা পড়ে গেছে গোটা শরীর। প্রচণ্ড বেগে খোলের গায়ে আছাড় খেয়ে চাইটা গুঁড়ো হয়ে গেছে, অনেকটা জায়গা জুড়ে খোলের গায়ে চুম্বকের মত আটকে গেছে গুঁড়োগুলো, তারই ভেতর জ্যান্ত কবর হয়ে গেছে। ওর।
সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে কিউট, ঢেউয়ের মাথায় শূন্যে উঠে পড়েছে স্টার্ন, কিন্তু রানা জাহাজের খোলের গায়ে একই জায়গায় রয়েছে। জ্যান্ত কবর হওয়াতেই বরং কিছুটা সময় বিপদের হাত থেকে বেঁচে গেল ও। প্রবল স্রোত মই থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেত ওকে, তা সম্ভব হলো না বরফের খোলসের ভেতর থাকায়।
এরপর বো উঠতে শুরু করল পানি থেকে। ধীরে ধীরে সিধে হলো কিউট। দ্বিতীয় ঢেউটা আসছে। কিন্তু তার আগেই রেইলের কাছ থেকে ওরা সবাই মই ধরে টানাটানি শুরু করেছে। বরফের খোলস ভেঙে বেরিয়ে এল রানা। ঠিক তখনই আবার উঁচু হতে শুরু করল স্টার্ন, আবার পানিতে ডুব দিল বো।
তীব্র স্রোত খোলের গায়ে চেপে রাখল রানাকে। ওপর থেকে ওরা বুঝতে পারল না রানা বেঁচে আছে কি না। মই টানছে না কেউ, রেইল ধরে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত সবাই।
রানা বেঁচে আছে, কিন্তু হুঁশ-জ্ঞান ভোঁতা হয়ে গেছে ওর। মনে হলো, বাস্তবে এ-সব কিছুই ঘটছে না, গোটা ব্যাপারটাই দুঃস্বপ্ন। তারপর নিজেকে তিরস্কার করল ও, ব্যাটা উজবুক! টের পাও না মই থেকে ছুটে গেছে হাত, ভেসে যাচ্ছ…
মাথার দুপাশ থেকে ভাঁজ করা কনুই দুটো নিজের অজান্তেই খসে পড়ল। খোলের সাথে ঠক-ঠক, ঠকাঠক বাড়ি খেলো খুলি। তারপর আবার পানি থেকে উঠল বো। চোখের সামনে হঠাৎ আলোর ঝলকানি, তারপর অন্ধকার দেখল রানা। আলোর মধ্যে। কাকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল একবার, নিখুঁতভাবে চোখ টিপে দিল একটা। তাকে চিনতে পেরে একটুও অবাক হলো না। রানা।
সোহানা।
বহু দূর থেকে পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর, শুদ্ধ বাংলায় চিৎকার করে বলল, ধরে থাকো, রানা, ধরে থাকো! আমরা তোমাকে টেনে তুলছি! পরমুহূর্তে, নাকি মিনিট খানেক পর, বলতে পারবে না রানা, শক্ত কিসের সাথে যেন বাড়ি খেলো ও। অক্টোপাস? ওকে জড়িয়ে ধরছে কি ওগুলো?
হাত। মানুষের হাত।
চোখ মেলল রানা। চাঁদের আলো নিয়ে রাতের আকাশ-এ-ও কি স্বপ্ন? তারপর ডগা ভাঙা মাস্তুলটা দেখতে পেল। আগুপিছু দুলছে। কি যেন একটা খসে পড়ল ক্রস-ট্রী থেকে। মনে হলো ওর। মুখের ওপর আছাড় খাবে। কিন্তু পড়ল ডেকের ওপর, ওর পাশে। না, কল্পনা নয়, ক্রস-ট্রী থেকে একজন লোকই পড়েছে। খুলি ফেটে গেছে লোকটার। মারা গেছে বেচারা।
কার মরার কথা কে মরছে!
সারা শরীর রক্তে জবজব করছে। ধরাধরি করে সিঁড়ি দিয়ে নামানো হলো ওকে। আবার চোখ মেলে রানা দেখল, নিয়াজ আর বিনয়ের চোখে পানি। দূর বোকা! এমন ছেলেমানুষি করো তোমরা… জোর করে হাসতে গেল রানা, সেই সাথে জ্ঞান হারাল।