২.০৯ একশো পাউন্ড জেলিগনাইট
একশো পাউন্ড জেলিগনাইট, সাথে টাইমার মেকানিজম, আর কয়েকশো ফুট কেবল…
কোথায় রাখে ওরা? জিজ্ঞেস করল রানা।
বললে বিশ্বাস করবে নামেইন ডেকের একটা কেবিনে। নিঃশব্দে হাসল বিনয়। সম্পূর্ণ নিয়ম বিরুদ্ধ কাজ, কাফম্যান নিজেই স্বীকার করল। কিন্তু দরকারের সময় অতগুলো সিঁড়ি আর মই বেয়ে ওপরে তোলা ঝামেলার ব্যাপার, তাই…
কাজের লোকদের ভাবনা-চিন্তাই আলদা, কাফম্যানের প্রশংসা করল রানা। দফতরে বসে কর্তারা নিয়ম বেঁধে দেয়। ঠিকই, কিন্তু অভিযানে স্টাফদের সাথে নিয়মগুলো সঙ্গী হয় না।
রানার কেবিনে বসে লাঞ্চ খাচ্ছে তিনজন। অফিসার্স মেসে। ডেকে না পাঠিয়ে লাঞ্চ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, তারমানে সম্ভবত। কষ্টার্জিত জনপ্রিয়তা আবার হারিয়ে ফেলেছে ওরা।
আমাদের বোধহয় একঘরে করা হয়েছে, কফির কাপটা নামিয়ে রেখে বলল নিয়াজ। শেরম্যান মারা যাওয়ায় তোমাকে দায়ী করছে ওরা, রানা।
ক্যাপটেনকে অসন্তুষ্ট মনে হলো, বলল রানা। আসলে দুশ্চিন্তায় মেজাজ বিগড়ে আছে তার। রুশ জাহাজগুলোকে নিয়ে আমাদের চেয়ে উনি কম উদ্বিগ্ন নন।
আমার ভয় রিগাকে, বলল নিয়াজ।
আমারও, সমর্থন করল রানা। ষোলো হাজার টন, তাই না? ট্রলারগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দেয়া সম্ভব। কিন্তু…কি ব্যাপার, বিনয়? তোমার হাতে কি ওটা?
বিনয়ের তালুতে একটা চাবি। এক্সপ্লোসিভ কেবিনের চাবি। খোলা সাগরে রয়েছি, কেউ আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না, ক্যাপটেনের এই ধারণার সাথে একমত নয় কাফম্যান। ওকে সাথে নিয়ে কেবিনটায় ঢুকেছিলাম আমি। একজোড়া শোল্ডার-প্যাকে তোলা হয়েছে জেলিগনাইট, যদি প্রয়োজন হয়…
প্রচণ্ড ঝাঁকি খেলো জাহাজ, মনে হলো বাল্কহেড বিস্ফোরিত হবে। পোর্টের দিকে কাত হয়ে পড়ল কেবিন, পরমুহূর্তে সিধে হলো, তারপরই আবার কাত হলো স্টারবোর্ডের দিকে। প্রতি মুহূর্তে থরথর করে কাঁপছে জাহাজ, সেই সাথে আইসবার্গের ওপর জাহাজের চাপে বিকট শব্দে ভাঙছে বরফ।
আবার জাহাজ সিধে হতে শুরু করল। দরজার দিকে ছুটল নিয়াজ। হ্যাঁচকা টানে কবাট খুলল। বাইরে ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ, চিৎকার। পোর্ট সাইড থেকে বোমা ফাটার মত আওয়াজ এল, বরফ ভাঙছে। হঠাৎ করে স্থির হয়ে গেল আইসব্রেকার। এঞ্জিন নামমাত্র সচল, নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। বালবগুলো ম্লান হয়ে গেল, প্রায় নিভু নিভু-কয়েক সেকেন্ড পর আবার জ্বলে উঠল সবটুকু উজ্জ্বলতা নিয়ে।
বরফে আটকে গেছি, গুঙিয়ে উঠল বিনয়।
দরজার কাছ থেকে নিয়াজ বলল, যদি না তো মেরে থাকে রিগা…
সম্ভবত আইসবার্গে ধাক্কা খেয়েছি, গায়ে পারকা চড়াতে চড়াতে বলল রানা। চলো ব্রিজে যাই।
নির্জন কম্প্যানিয়নওয়ে ধরে ছুটল রানা, পারকার বোতাম লাগাবার জন্যে সিঁড়ির গোড়ায় থামল। ওপরের ডেক থেকে লোকজনের শোরগোল ভেসে এল। আতঙ্কটা কি নিয়ে বোঝা গেল না। ধাপগুলো বেয়ে ওপরে উঠল ও, দরজা খুলতেই ওকে গ্রাস করল সাদাটে কুয়াশা। কুয়াশার ভেতর কালো ছায়ামূর্তি ছুটোছুটি করছে। কি ঘটছে আন্দাজ করা অসম্ভব। পোর্ট রেইলের সামনে। দৃষ্টি চলে। এমনকি পোর্ট রেইলটা পর্যন্ত দেখতে পেল না রানা। হোঁচট খেতে খেতে মইয়ের দিকে এগোল ও। কুয়াশার ভেতর থেকে প্রকাণ্ড একটা ছায়ামূর্তি ছুটে এসে ধাক্কা খেলো গায়ে। হিগিন।
আমরা গেঁথে গেছি! আতঙ্কে কর্কশ শোনাল হিগিনের গলা।
ডুবছি? রানার জ্যাকেটের তলায়, বগলে, টেপ দিয়ে আটকানো রয়েছে একটা খুদে প্যাকেট। প্যাকেটের ভেতর আছে। নিয়াজের দেয়া মাইক্রোফিল্ম। পারকার গায়ে হাত বুলিয়ে প্যাকেটটার অস্তিত্ব আরেকবার অনুভব করল, নিজের অজান্তেই।
গড নোজ…
মই বেয়ে উঠছে রানা, প্রায় মাথায় পৌঁছে গেছে, এই সময় বো-র সামনে কুয়াশায় আলোড়ন উঠল। ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক। হিমালয়ের মত কি যেন একটা, চোখে ধরা দিয়েই মিলিয়ে গেল আবার। মনে হলো মাত্র কয়েক গজ সামনে।
সাবধানে ব্রিজে ঢুকল রানা, পিছু পিছু মই বেয়ে উঠছে নিয়াজ আর বিনয়। ব্রিজের সামনের দিকে, খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন গোল্ডম্যান। এরইমধ্যে হিম হয়ে গেছে ভেতরটা। হেলমসম্যান হুইল ধরে রয়েছে, যদিও জাহাজ কোথাও যাচ্ছে না।
এতক্ষণে খেয়াল হলো রানার, ডানে বা বামে নয়, জাহাজ ঢালু হয়ে রয়েছে পিছন দিকে। আরেকটা জানালা খুলে পোর্টের দিকে তাকিয়ে রয়েছে অ্যাকটিং মেট। সবগুলো এঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঘাড় ফিরিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে রানার দিকে তাকালেন ক্যাপটেন।
এদিকে একবার আসুন, মি. রানা, ডাকলেন তিনি। নরম সুর। এরচেয়ে খারাপ কিছু ঘটতে পারে না-আমরা একটা বার্গের ঢালে উঠে পড়েছি।
অবস্থাটা বুঝতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। কুয়াশার ভেতর দিয়ে খুব ধীর গতিতে এগোচ্ছিল কিউট, সরু একটা ফাঁক গলে বিশাল এক আইসবার্গের পেটের ভেতর, ছোট একটা বে-তে ঢুকে পড়েছে। ফাটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে, বে-র এক মাথা থেকে আরেক মাথায় আসতে মিনিট খানেক লেগেছে জাহাজের। আইসবার্গের ঢাল ক্রমশ নিচু হয়ে বে-র পানির তলায় তলিয়ে গেছে। খোলের সাথে ডুবন্ত ঢালের প্রথম ঘষা লাগার পরপরই ক্যাপটেন সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে জাহাজের সামনের অংশ পানি থেকে উঠে পড়েছে।
কিউটের সামনের অংশ পানির ওপর, পিছনের অংশ পানিতে। এঞ্জিন বন্ধ করেও কোন লাভ হয়নি, পিছলে নেমে আসেনি বো। শুধু বো নয়, খোলের এক তৃতীয়াংশ পানির ওপর জেগে থাকা। ঢালে উঠে পড়েছে। ছোট্ট বে-র চারদিকে কুয়াশা, মাঝে মধ্যে। কুয়াশা আলোড়িত হলে আকাশ-ছোঁয়া আইসবার্গের খাড়া, মসৃণ। পাঁচিল দেখা যায়।
যীসাস! ব্রিজের পিছন থেকে গুঙিয়ে উঠল কাফম্যান। এর। ভেতর আমরা ঢুকলাম কিভাবে!
হুড়োহুড়ি করে পিছনের জানালার সামনে চলে এল সবাই। চোখ পিট পিট করলেন গোল্ডম্যান। আপাতত সামান্য একটু সরে গেছে কুয়াশা, জাহাজের পিছনে ছোট বে-র ফাঁকটা পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এই ফাঁক গলেই আইসবার্গের পেটের ভেতর। সেঁধিয়েছে কিউট। ফাঁকের দুদিকে আইসবার্গের উঁচু, চওড়া। পাঁচিল। তাজ্জব ব্যাপার, এরকম সরু একটা ফাঁক গলে কিভাবে। ভেতরে ঢুকল জাহাজ! এক মুহূর্ত পরই আবার কুয়াশায় ঢাকা। পড়ে গেল ফাঁকটা।
মাপজোকে যদি ভুল না হয়, আর ভাগ্য যদি বেঈমানী না করে, চিন্তিতভাবে বললেন ক্যাপটেন, আবার সাগরে বেরোতে। পারব আমরা। জাহাজের বেশিরভাগ অংশ এখনও পানিতে, প্রপেলার উল্টোদিকে ঘোরালে ঢাল থেকে নেমে আসবে। বড়। করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। এমন উকট বিপদে কেউ কখনও পড়েছে!
বরফ নেই, আপনি জানেন? রানাকে জিজ্ঞেস করল কাফম্যান। ঢালের সাথে খোলের ধাক্কা লাগতেই ঝাঁকি খেয়ে খসে পড়েছে সব। এদিকে আসুন, দেখে যান।
পোর্ট উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকাল রানা। ঢাল থেকে সরে গেছে কুয়াশা। ডেকে ওঠার সময় পোর্ট রেইল দেখতে পায়নি ও, কারণটা এতক্ষণে পরিষ্কার হলো। নেই, দেখবে কোত্থেকে? সংঘর্ষের ধাক্কায় পোর্ট সাইডের রেইল সহ কয়েকশো মণ বরফ ঢালের ওপর ছিটকে পড়েছে। রেইলের ভাঙা টুকরো-টাকরা ঢালের ওপর পড়ে থাকতে দেখা গেল। ঢালে কয়েকজন ফার মোড়া লোককেও দেখল রানা। রশির মই বেয়ে নেমেছে ওরা। কুয়াশার ভেতর ভূতের মত দেখাল ওদেরকে। ক্যাপটেনের নির্দেশে ঘুরেফিরে দেখছে ওরা, আইসবার্গটা কি ধরনের জানতে হবে।
মই বেয়ে একটা ছায়ামূর্তি জাহাজে উঠে এল। চিনতে পারল রানা। নিয়াজ।
ব্রিজে ফিরে এসে নিয়াজ বলল, না, গোস্ট বার্গ নয়…
ঠিক জানো?
অবশ্যই। বিনয় আর আমি যতটা সম্ভব উঁচুতে উঠে দেখেছি-কোথাও একটু ফাঁক-ফোকর নেই, একেবারে নিরেট বরফ…
সামনেটা এখন দেখা যাচ্ছে! ক্যাপটেনের উত্তেজিত গলা শুনে ব্রিজের সামনে ছুটে এল সবাই। বিরতিহীন মোচড় খেয়ে চলেছে কুয়াশা, মাঝে মধ্যে দুএক মুহূর্তের জন্যে ভেসে গিয়ে কোন কোন দিক উন্মোচিত করছে। বো-র সামনে থেকে কুয়াশা সরে যাওয়ায় আইসবার্গের বিশালত্ব ফুটে উঠল ওদের চোখের সামনে। বো-র কাছ থেকে একশো গজ দূরে শেষ হয়েছে ঢাল, তারপর আইসবার্গের পাঁচিল খাড়া উঠে গেছে-কত উঁচু পর্যন্ত কে জানে! ওপর দিকের কুয়াশাও এবার অনেকটা সরে গেল, মনে হলো ওরা যেন বরফ ঢাকা হিমালয় দেখছে। চূড়া কত উঁচুতে। বোঝার উপায় নেই, কারণ ওপরের দিকটা সাদাটে কুয়াশায়। ঝাপসা হয়ে আছে।
নিখাঁদ, নিরেট বরফের প্রকাণ্ড দ্বীপে আটকা পড়েছে ওরা। লম্বায় দ্বীপটা আধ মাইল বা তারও বেশি হতে পারে।
লোকজনদের ডেকে নাও, কাফম্যানকে নির্দেশ দিলেন। ক্যাপটেন। লাউডহেইলার ব্যবহার করো। চেষ্টা করে দেখব সাগরে বেরুনো যায় কিনা।
এখুনি বেরুতে চাইছেন? মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইল রানা।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব…, হঠাৎ থেমে গিয়ে ঝট করে রানার দিকে ফিরলেন গোল্ডম্যান। চমৎকার কোন আইডিয়া, মি. রানা? তার চেহারা ও কণ্ঠস্বরে তীব্র ব্যঙ্গ ফুটে উঠল।
আইসবার্গের পেটে আটকা পড়ায় একদিক থেকে সুবিধেই হয়েছে, বলল রানা। বুঝতে পারছেন না?
আপনি যে অতি বুদ্ধিমান, সে আমি প্রথমেই টের পেয়েছি, গম্ভীর সুরে বললেন ক্যাপটেন। কি বলতে চান পরিষ্কার করে বলুন।
বলছিলাম কি, আরও নরম সুরে বলল রানা, এখানে তো। বেশ নিরাপদেই রয়েছি আমরা। সাগরে না বেরুলেও তো চলে…
এভাবে আটকা পড়ে থাকব? কোথাও যাব না? আপনার বুঝি বাড়ি-ঘর নেই?
কে বলল আমরা যাচ্ছি না? পাল্টা প্রশ্ন কলল রানা। আমরা থেমে নেই, যদিও কোথাও যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে না। গ্রীনল্যান্ড কারেন্ট আইসবার্গটাকে দক্ষিণে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। প্রতিদিন বিশ মাইল গতিতে এগোচ্ছি আমরা…
নটিক্যাল রেকর্ড ভাঙছি কি? ঝাঁঝের সাথে জিজ্ঞেস করলেন গোল্ডম্যান।
তার কি কোন দরকার আছে? ঘণ্টা কয়েক আগে শেরম্যান রিপোর্ট করেছিল, সোভিয়েত ট্রলারগুলো আমাদের চল্লিশ মাইল দক্ষিণে আছে, আর রিগা আছে বিশ মাইল দক্ষিণে। এতক্ষণে আরও কাছে চলে এসেছে ওগুলো। আইসবার্গটা কিউটের জন্যে বিরাট একটা বাহনের কাজ করছে। যদি বার্গের সাথে থাকি, রাতের কোন এক সময় সোভিয়েত জাহাজগুলোকে পাশ কাটাব আমরা।
বার্গের সাথে থাকা মানে আটকা পড়ে থাকা, নড়াচড়া করা যাবে না…
কিছু আসে যায়? ওরা যদি আমাদের দেখতে না পায়? রিগায় আধুনিক রাডার রয়েছে বটে, কিন্তু আমরা কাছাকাছি পৌঁছুলে স্ক্রীনে কী দেখতে পাবে ওরা? স্রেফ আরেকটা আইসবার্গ।
বাহন হিসেবে আইসবার্গ? উত্তেজনায় হাততালি দিয়ে ফেলল কাফম্যান। ওয়ান্ডারফুল…।
ফুল! অ্যাকটিং মেটকে গাল পাড়লেন ক্যাপটেন। এঞ্জিন রুমের সাথে কথা বলার জন্যে ভয়েস-পাইপের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। কথা শেষ করে কাফম্যানের দিকে ফিরলেন। চীফ এঞ্জিনিয়ার বলছে, এঞ্জিন রুমের কোথাও তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। গজগুলোর কাঁচ ভেঙে বা ফেটে গেছে, গরম বাষ্পে ঝলসে গেছে একজনের হাত, ব্যস। ওদের ধারণা এঞ্জিনেরও কোন ক্ষতি হয়নি, তবে চেক করে দেখব আমি। লোকগুলোকে ডেকে নিতে বলেছি, মনে আছে?
এঞ্জিন চালু করবেন? দ্রুত জিজ্ঞেস করল রানা। কাজটা। উচিত হবে না। রিগার হাইড্রোফোনে ভাইব্রেশন ধরা পড়বে।
রানাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কাফম্যানকে ক্যাপটেন জানালেন, আর তারপর, পিছু হটব আমরা, যে-পথ দিয়ে ঢুকেছি সেই পথ দিয়েই বেরিয়ে যাব সাগরে।
.
ঝড়ের বেগে ব্রিজে ঢুকল নিকিতা জুনায়েভ। কিউট খুব কাছে চলে এসেছে, কর্নেল কমরেড! হাইড্রোফোনে এঞ্জিনের আওয়াজ। শোনা গেছে!
ট্রাভকিনকে পাশে নিয়ে ব্রিজে দাঁড়িয়ে রয়েছে কর্নেল বলটুয়েভ, মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে জুনায়েভকে বলল, শান্ত হও, জুনায়েভ। পাঁচ মিনিট পর পর রিপোর্ট করবে আমাকে-যাও!
জুনায়েভ চলে যেতে ধীরে ধীরে কর্নেলের দিকে ফিরল ট্রাভকিন। এখন তাহলে আবার এঞ্জিন চালু করতে পারি। আপনাকে আগেই বলেছি, এদিকের পানিতে পাওয়ার ছাড়া ভেসে থাকা সাংঘাতিক বিপজ্জনক…
আমি মারা গেলে, কোমল সুরে বলল কর্নেল।
তারমানে?
তার আগে এঞ্জিন চালু করা যাবে না। সর্বাধুনিক রাডার রয়েছে আপনার। ব্যবহার করুন! নিঃশব্দে ভেসে যেতে হবে আমাদের, কারণ তাহলেই শুধু হাইড্রোফোন অপারেটররা ওদের এঞ্জিনের আওয়াজ ঠিকমত শুনতে পাবে। কিউটের সঠিক পজিশন জানতেই হবে আমাকে।
পাইপটা মুখে তুলে জানালার সামনে চলে এল কর্নেল। একা তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকল ক্যাপটেন ট্রাভকিন। ক্লিয়ারভিশন প্যানেলে চোখ রেখে কুয়াশা আর সাগরের আলাদা একটা জগৎ দেখতে পেল কর্নেল। ওখানে কোথাও, দৃষ্টিসীমার বাইরে রয়েছে। আইসবার্গ। ঠিক এই মুহূর্তে রাডার অপারেটররা দৈত্যাকৃতি বার্গগুলোর কোর্স জানার চেষ্টা করছে। গ্রীনল্যান্ড কারেন্টের সাথে বিরতিহীন দক্ষিণ দিকে ভেসে চলছে ওগুলো।
.
সবাই এখন জাহাজে। এঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। ব্রিজে যার যেখানে থাকার কথা সবাই উপস্থিত। প্রতিটি লুক-আউট পয়েন্টে লোক পাঠানো হয়েছে। আইসবার্গ থেকে নামার জন্যে সমস্ত প্রস্তুতি শেষ।
পিছনে হাত বেঁধে জানালা দিয়ে কিউটের পিছন দিকে তাকিয়ে আছেন গোল্ডম্যান। উদ্বেগ আর উত্তেজনা চেপে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন তিনি, সমস্ত শরীর টান টান হয়ে আছে। উত্তেজনা বোধ করা স্বাভাবিক, কারণ একই সাথে দুটো বিপজ্জনক কাজ সারতে যাচ্ছেন তিনি। বরফের ঢাল থেকে কিউটকে। নামাবেন, তারপর বে-র দুই বাহুর মাঝখানের সরু ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করবেন সাগরে।
ক্যাপটেন আর কাফম্যানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রানাও জাহাজের পিছন দিকে তাকিয়ে আছে। বে ছাড়িয়ে আরও দূরে চলে গেছে ওর দৃষ্টি, কুয়াশার ভেতর। বার বার আড়চোখে রানার। দিকে তাকাল কাফম্যান। ক্যাফটেন যা করতে যাচ্ছেন তাতে তার সমর্থন নেই, কিন্তু অ্যাকটিং মেট হিসেবে ক্যাপটেনের সাথে তর্ক করাও তার সাজে না।
এঞ্জিনগুলো আরও শক্তি সঞ্চয় করল। একটু পরই নড়ে উঠবে জাহাজ। পিছু হটবে। প্রপেলার যদি পারে, বরফের ঢাল থেকে নামিয়ে আনবে জাহাজকে।
স্টার্নে, লুক-আউট পয়েন্টের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল নিয়াজ। হঠাৎ দমকা বাতাসের মত ব্রিজে ঢুকল সে।
স্টপ ইট, ফর গডস সেক! তারস্বরে চিৎকার করল সে। বন্ধ করুন, এঞ্জিন বন্ধ করুন!
কেন? বোমার মত ফাটলেন যেন ক্যাপটেন।
বাইরে তাকান, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল নিয়াজ। কুয়াশার ভেতর থেকে কি যেন একটা বেরিয়ে আসছে!
কি? চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপটেন।
জানি না, রুদ্ধশ্বাসে বলল নিয়াজ। বিরাট বড় কি যেন একটা…।
আমি জানি কি, ভারী গলায় বলল রানা। মি. গোল্ডম্যান, প্ল্যানটা বাতিল করুন। জাহাজ নড়লে বিপদ বাড়বে…
ঈশ্বর বাঁচাও, বিড়বিড় করে উঠল কাফম্যান। রিগা! রিগা। আসছে আমাদের ধাক্কা…
কিন্তু না। রিগা নয়। রিগা মাত্র ষোলোশো টনী জাহাজ, কিন্তু। কুয়াশার ভেতর থেকে ওটা যেটা এগিয়ে আসছে তার ওজন। কয়েক লক্ষ টন, বাইশতলা একটা বিল্ডিঙের মত উঁচু। সচল একটা বিল্ডিং, ওপরের অংশ যেটুকু দেখা যাচ্ছে, কিউটের মাস্তুলকে ছাড়িয়ে গেছে। ধীর গতিতে কুয়াশা থেকে বেরিয়ে আসছে। ভয়াল-দর্শন এক আইসবার্গ।
স্টার্নের লুক-আউট পয়েন্ট থেকে লোকগুলো আর্তনাদ করে উঠল। জানালার বাইরে তাকালেন গোল্ডম্যান। বাকি সবাই তার গা ঘেঁষে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল।
সচল পাহাড় ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকল ওরা। কুয়াশা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসছে বে-র দিকে। বে থেকে এখনও অনেকটা দূরে ওটা, কিন্তু তবু মনে হলো মূর্তিমান বিভীষিকার চূড়া, যতটুকু দেখা যায়, ঝুঁকে রয়েছে। ওদের মাথার ওপর। বে-র দুই বাহুর মাঝখানে সরু ফাঁকটা বুজে এল।
মাইকে কথা বললেন গোল্ডম্যান। বিপদ টের পেয়ে সমস্ত জড়তা কাটিয়ে উঠেছেন তিনি। হোল্ড অন টাইট! হোল্ড অন টাইট! মেজর কলিশন কামিং!
খপ করে রানার কনুই খামচে ধরল কাফম্যান, ব্যথায় উচ্ করে উঠল রানা। মি. রানা, বে-র ভেতর দিকে তাকান, কি ওটা?
প্রথমে জিনিসটাকে চেনা গেল না। পানির তলা দিয়ে ছুটে আসছে, উঁচু পিঠ জেগে রয়েছে পানির ওপর। হাঙর নয়, তিমি নয়, তবে কি সাবমেরিন?
আন্ডারওয়াটার স্পার! ফিসফিস করে বলল রানা।
দুশো ফিট উঁচু আইসবার্গের প্রসারিত পায়ের পাতা বলা যেতে পারে, পানির তলা দিয়ে ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে বে-তে। পানিতে তুমুল আলোড়ন তুলে এগিয়ে আসছে। আকৃতিটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল রানা, ডায়ামিটারে পঞ্চাশ ফিটের কম হবে না।
পায়ের পাতার পিছু পিছু আসছে শরীরটা। ব্রিজের লোকেরা রেইল আঁকড়ে ধরল। নিচে, ডেকে দাঁড়ানো লোকগুলোও অবশিষ্ট রেইল ধরে তৈরি হলো আত্মরক্ষার জন্যে। রানার মাথা সামান্য একটু নড়ে উঠল, আকাশ থেকে কি যেন একটা পড়তে দেখল ও।
ছোটখাট একটা বাড়ি খসে পড়ল যেন। পড়ল নবাগত আইসবার্গের মাথার দিক থেকে। অথচ এই আইসবার্গের সাথে। বাইশতলা এখনও ধাক্কা খায়নি। বে-র বাইরে, সরু ফাঁকটার কাছাকাছি পড়ল সেটা, মিনার আকৃতি নিয়ে আকাশের দিকে লাফ দিল পানি। খোদা! আঁতকে উঠল নিয়াজ। ওটা গোস্ট বার্গ…।
তারমানে, গোটা পাহাড়টা, কয়েক মিলিয়ন টন বরফ, ধাক্কা লাগার মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে। ঢাকা পড়ে যাবে বে, কবর হয়ে যাবে কিউটের। কাঠের মূর্তির মত অনড় দাঁড়িয়ে ধাক্কা লাগার অপেক্ষায় রয়েছে ওরা। প্রকৃতির খেলা, ওদের কোন ভূমিকা নেই। দুই আইসবার্গ পরস্পরের সাথে ধাক্কা খাবে, ওরা শুধু যতক্ষণ। বেঁচে থাকবে ততক্ষণ নির্বাক দর্শক হয়ে থাকবে।
একেবারে শেষ মুহূর্তে ক্যাপটেন এঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। কুয়াশা সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে এল বাইশতলা, ওটার। বিশালত্ব চাক্ষুষ করার সুযোগ মিলল। মাত্র এক সেকেন্ড, তারপরই দুই আইসবার্গ স্পর্শ করল পরস্পরকে।
সংঘর্ষের আওয়াজ শুনে মনে হলো কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে। শক ওয়েভের ধাক্কায় যে যেখানে ছিল, ছিটকে পড়ল সবাই মেঝেতে। প্রথম ঝুঁকিতে সাড়ে ছয় হাজার টন কিউট লাফ দিয়ে উঠল যেন। জাহাজের প্রতিটি কাঁচ ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেল, ঝন ঝন শব্দে নাচতে শুরু করল পেয়ালা, বাসন, চামচ থেকে শুরু করে শাবল, কোদাল, ইত্যাদি সব। বন বন করে ঘুরতে শুরু করল। কম্পাসের কাঁটা। ডেক থেকে ছিটকে পানিতে পড়ল তিনজন ক্রু, সাথে সাথে মারা গেল তারা। তারপর, হঠাৎ করেই, সব শব্দ থেমে গেল, স্থির হয়ে গেল জাহাজ।
ভৌতিক নিস্তব্ধতা নামল।
সংঘর্ষের আগেই বন্ধ করা হয়েছিল এঞ্জিন। কেউ কোন কথা বলল না। কিছুক্ষণ এক চুল নড়ল না পর্যন্ত। বে থেকে বেরুবার সরু পথের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। ফাঁকটার এখন আর কোন অস্তিত্ব নেই। বাইশতলার নিরেট পাঁচিল বন্ধ করে দিয়েছে সেটা। বে পরিণত হয়েছে খাড়িতে। যেন একটা বোতলের ভেতর আটকা পড়েছে ওরা, চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। ছোট একটা লেকে রয়েছে কিউট, যে লেক থেকে বেরুবার কোন পথ নেই। বিশাল বাহনের ভেতরে বন্দী ওরা, ভেসে চলেছে দিনে বিশ মাইল গতিতে।
সংঘর্ষ ঘটলেও, ধসে পড়েনি গোস্ট বার্গ।
রানাই প্রথম নিস্তব্ধতা ভাঙল। সবাই ওর দিকে এমনভাবে তাকাল যেন মানুষের গলা শুনে ভারি অবাক হয়েছে।
আর কোন উপায় নেই, ক্যাপটেন, বলল রানা। বার্গের সাথেই ভেসে যেতে হবে। কোন বিকল্প নেই।
নেই, মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন ক্যাপটেন গোল্ডম্যান। শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া। অপেক্ষার শেষ হবে শালার আইসবার্গ মাথার ওপর ভেঙে পড়লে, তাই না?
তিক্ত হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে৷ তাই।
ওদের এঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে! আবার দমকা বাতাসের মত ব্রিজে ঢুকল জুনায়েভ। সন্ত্রস্ত, বিমূঢ় চেহারা, হাঁপাচ্ছে।
টু-শব্দ না করে ব্রিজ থেকে বেরিয়ে এল কর্নেল বলটুয়েভ,। হাইড্রোফোন সেকশনে নিজে গিয়ে ব্যাপারটা জানবে।
কর্নেলকে ঢুকতে দেখে ইনস্ট্রমেন্ট থেকে মুখ তুলল অপারেটর।
জুনায়েভ বলল, তুমি নাকি আর কিছু শুনতে পাচ্ছ না? তোমার ইনস্ট্রমেন্ট নষ্ট?
না। ওদের এঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। কোন ইকো-ই আমরা। পাচ্ছি না।
কত দূরে?
এক মাইল, কাছেও হতে পারে…
দশ মিনিট আগেও তো তাই ছিল! জুনায়েভের দিকে কটমট করে তাকাল কর্নেল। ব্যাপারটা কি? দশ মিনিট আগে এক মাইল। দূরে ছিল কিউট। কয়েক সেকেন্ড আগে পর্যন্ত ওদের এঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেছে। অথচ এখনও ওরা এক মাইল দূরে! কিভাবে সম্ভব? আমরা ভেসে আছি, ওরা দক্ষিণ দিকে এগোচ্ছে। মাঝখানের দূরত্ব আরও কমে আসার কথা!
কিন্তু ঘটনা সত্যি…।
হতে পারে না, টেকনিক্যালি ইমপসিবল! মারমুখো হয়ে উঠল কর্নেল।
হ্যাঁ, ব্যাপারটা আমার কাছেও বিদঘুটে লাগছে…
বুকে হাত বেঁধে অগ্নিদৃষ্টি হানল কর্নেল। এমন নয় যে আমরা যেমন কারেন্টের সাথে ভেসে চলেছি, ওরাও তেমনি ভেসে চলেছে। তা যদি হত, দূরত্ব একই রকম থাকত, কমত না বা বাড়ত না। কিন্তু ওরা শুধু স্রোতের টানে চলছে না, আমরা ওদের এঞ্জিনের আওয়াজ শুনেছি!
জ্বী, পরিষ্কার, আমতা আমতা করে বলল অপারেটর। এক মিনিট আগেও…
তাহলে ব্যাখ্যা করো! মেঝেতে পা ঠুকল কর্নেল। ভয়ে এক পা পিছিয়ে গেল অপারেটর।
বুঝতে পারছি না, কি ব্যাখ্যা করব…
সমস্ত রাগ আর উত্তেজনা নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল কর্নেল। অযোগ্য লোকদের কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় জানে সে, কিন্তু কারও বিচার করার সময় এটা নয়। ঠিক আছে, ব্যাপারটা নিয়ে মাথা গরম কোরো না। তোমার যা কাজ করো তুমি, কানে প্লাগ ঢুকিয়ে বসে থাকো। জুনায়েভের দিকে ফিরল সে। চেক করার আরও উপায় আছে। এতই যখন কাছে ওরা, একটা হেলিকপ্টার পাঠালেই তো হয়। জুনায়েভ নির্দেশ পেয়ে চলে যাচ্ছিল, পিছন থেকে হুঙ্কার ছাড়ল কর্নেল, পাইলটকে বলে দেবে কিউটকে দেখতে না পাওয়া পর্যন্ত তার ফেরার দরকার নেই।
.
জোড়া লাগা দুই আইসবার্গের মাঝখানে, বিশাল বাহনের কোলে বসে রয়েছে কিউট। স্রোতের সাথে দক্ষিণ দিকে ভেসে চলেছে ওরা। কতক্ষণ, কত ঘণ্টা ধরে ভেসে চলেছে, কেউ বলতে পারবে না। বরফের খাঁচায় বন্দী লোকগুলোর সময় জানার কোন উপায় নেই।
প্রথমে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। এতই অবিশ্বাস্য, ক্যাপটেন গোল্ডম্যান বাধ্য হয়ে নির্দেশ দিলেন, জাহাজে যত ঘড়ি। আছে সব চেক করে দেখতে হবে। হুকুম তামিল হলো। দেখা গেল, অবিশ্বাস্য হলেও ঘটনা সত্যি। হাতঘড়ি, দেয়াল-ঘড়ি, টেবিল-ঘড়ি-সব বন্ধ হয়ে আছে। কারণটাও আন্দাজ করা গেল। দুই আইসবার্গ ধাক্কা খাওয়ার সময় যে শক ওয়েভ আর কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল, এ তারই ফলশ্রুতি-সব ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে। জাহাজের কোথাও আর খুঁজতে বাকি রাখা হলো না, যদি একটা সচল ঘড়ি পাওয়া যায়। কিন্তু বৃথা চেষ্টা।
কাজেই সময়ের ব্যাপারটা আন্দাজ করে নিয়ে কাজ চালাতে হলো। লগ বুকে লেখা হলো, প্রায় ইনিশশো ঘন্টা… সম্ভবত বাইশশো ঘণ্টা… এই রকম।
সময় জানতে না পারায় স্নায়ুর ওপর চাপ বাড়তে লাগল। ওদিকে মাথার ওপর ঝুঁকে আছে গোস্ট বার্গের চূড়া, লক্ষ-কোটি। টন বরফ নিয়ে। যে-কোন মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে। পারে। যদি পড়ে, বাঁচার চিন্তা করা বাতুলতা। সাড়ে ছহাজার টনী কিউট চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে। লোকজনের কথা না বলাই ভাল।
তার ওপর, কারও কিছু করার নেই। করার নেই, করার সাহসও নেই। প্রতি মুহূর্তের স্বাভাবিক সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ডেকে কিছু বরফ এখনও রয়েছে, কিন্তু ফেলার সাহস হলো না–ভয়, কোদাল বা শাবলের আওয়াজ যদি আকাশ ছোঁয়া গোস্ট বার্গকে স্পর্শ করে, যদি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে গোস্ট বার্গ! রানা আর নিয়াজ প্রতিবেশী আইসবার্গে উঠে এক চক্কর ঘুরে আসার পর পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে মোড় নিল।
লক্ষণ যা দেখছি, গোস্ট বার্গ বলেই মনে হয়, আইসবার্গ থেকে ঘুরে আসার প্রস্তাব দিয়ে ক্যাপটেনকে বলেছিল রানা। চূড়া থেকে বড় একটা টুকরো খসে পড়ল। তবু চেক করে দেখা দরকার…
দেখার পর আর কোন সন্দেহ থাকল না, গোস্ট বার্গই বটে; এত বড় এর আগে দেখেনি রানা। দুশো ফিট উঁচু পাঁচিলের উল্টো পিঠটা, যে পিঠটা সাগরের দিকে মুখ করে রয়েছে, ঠিক যেন আরব্য রজনীর কোন দৃশ্য। ওখানে পৌঁছুবার জন্যে বে-র সরু ফাঁক গলে ঢুকে পড়া আন্ডারওয়াটার স্পার পেরোতে হলো ওদেরকে। পাঁচিলের গোড়ায় এসে সরু একটা কার্নিস পাওয়া গেল, সেটা ধরে সাবধানে উঠল ওরা। তারপর একটা বাঁক নিয়ে থমকে দাঁড়াল, চোখ তুলে যা দেখল তাতে আতঙ্কে কথা সরল না। মুখে। অসংখ্য বিশাল আকারের গুহা আর ফাটল আইসবার্গের গায়ে, অথচ জাহাজ থেকে দেখে মনে হয়েছিল নিরেট বরফের পাহাড়। সারি সারি স্তম্ভ দেখল ওরা, কোনটা পঞ্চাশ ফিট উঁচু, কোনটা একশো বা তারও বেশি; স্তম্ভগুলোর ওপর বসানো রয়েছে। বরফের ভারী ছাদ। আর নিচে, সী লেভেল থেকে অনেক উঁচুতে, যেখানে ওরা দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানে বিশাল একটা কুয়ো। পারে দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকিয়েও কিছু দেখতে পাওয়া গেল না, অন্ধকার। তবে কান খাড়া করে ছলছল আওয়াজ শোনা গেল, বরফের গায়ে গ্রীনল্যান্ড কারেন্ট আছাড় খাচ্ছে। গোস্ট বার্গ, অন্তত আধ মাইল লম্বা, নিরেট তো নয়ই, প্রায় সম্পূর্ণটাই ফাঁপা। ঘামতে শুরু করা জেলিগনাইটের মত, যে-কোন মুহূর্তে ঘটতে পারে বিস্ফোরণ।
ধাক্কা লাগার সময় ধসে পড়েনি কেন! ফিসফিস করে। জিজ্ঞেস করল নিয়াজ।
এটাই তো বৈশিষ্ট্য। প্রচণ্ড ধকল সইতে পারে, আবার হঠাৎ সামান্য একটা শব্দেই হুড়মুড়…
যথেষ্ট দেখেছি, এবার চলো ফেরা যাক…
ইয়াল্লা, ওটা কি নিয়াজ?
বিরাটকায় একটা স্তম্ভের মাথা থেকে কুয়াশা সরে গেছে, টাওয়ারের দুশো ফিট পর্যন্ত দৃষ্টি চলে, আরও ওপর দিকটা কুয়াশায় ঢাকা। টাওয়ারটা চওড়া, ডায়ামিটারে একশো ফিটের। কম না। গায়ে গরাদহীন জানালা, একটার ওপর আরেকটা, অনেকগুলো। জানালা না বলে গর্ত বলাই ভাল, টাওয়ারের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা। সংখ্যায় ওগুলো এত বেশি, টাওয়ারটা এখনও কিভাবে খাড়া রয়েছে সেটাই একটা বিস্ময়। ওপরের অংশ থেকে সরে গেল কুয়াশা, স্তম্ভিত হয়ে ওরা দেখল। টাওয়ারটা বিশাল একটা ঝুল-বরফের প্রসারিত বাহুর ভার বহন। করছে। প্রকাণ্ড বাহু আইসবার্গের মূল পাঁচিলের পিছন দিক থেকে। ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। রানা ঠিক বুঝতে পারল না, টাওয়ারটা কি। শুধু বাহুর ভার বহন করছে, নাকি বাহু সহ গোটা পাঁচিলটার।
এভাবে বেশিক্ষণ টিকবে না, বিড়বিড় করে বলল ও। চলো ফিরি।
কি দেখেছে, মাত্র একজনকে বলল ওরা। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে জাহাজের সবাই জেনে ফেলল ব্যাপারটা। এরপর থেকে উত্তেজনা আর উদ্বেগ অসহ্য হয়ে উঠল। কারও কারও এমন অবস্থা দাঁড়াল, সন্দেহ হলো পাগল হয়ে যাবে। বাল্কহেডের সাথে কারও যদি কনুই ঠুকে যায়, সঙ্গীরা তার দিকে এমনভাবে তাকায়, পারলে যেন খুন করে ফেলে। কারও খিদে পাচ্ছে না। চোখ থেকে ঘুম চলে গেছে। কিছু করার না থাকায় স্নায়ুর ওপর চাপ আরও বাড়তে লাগল। আইসবার্গ প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে চলেছে, সেই সাথে ধীরে ধীরে ঘুরছে স্রোতের টানে, অথচ কেউ কিছু অনুভব করছে না। এভাবে বেশিক্ষণ চলতে থাকলে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবে ওরা।
বিস্ফোরকের ব্যাপারে আমরা এত আগ্রহী কেন? রানার কেবিনে বসে রয়েছে ওরা, নিস্তব্ধতা অসহ্য হয়ে উঠলে জিজ্ঞেস করল নিয়াজ।
আইসবার্গ থেকে যদি বেরুতে পারি, আরেকটা বিপদ দেখা দেবে, বলল রানা। তখন আত্মরক্ষার জন্যে বিস্ফোরক লাগতে পারে। কিভাবে, কোথায়, কখন, আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না। ক্যাপটেন গোল্ডম্যানের মত আশাবাদী নই আমি। ভেসে থাকা মাইন বা ওই ধরনের কিছুর কথা ভাবছি। কাফম্যানের সাথে আমার কথা হয়েছে।
তোমার কি মনে হয়, এই জোড়া লাগা আইসবার্গ থেকে উদ্ধার পাব?
যদি গোস্ট বার্গ ঘুরে আমাদের দক্ষিণে চলে যায়, তাহলে একটা আশা আছে, বলল রানা। স্রোত ওটাকে টানবে, সেই টানে আবার সরে যেতেও পারে।
বিনয় জিজ্ঞেস করল, সত্যিই কি তুমি হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনেছ, রানা? গোস্ট বার্গে গিয়ে? গোল্ডম্যান তো বিশ্বাসই করছেন না।
কারণ নিয়াজ শুনতে পায়নি আওয়াজটা। শুধু শুনিনি, আমার মনে হয় এক পলকের জন্যে দেখেওছি ওটাকে, তারপরই আবার কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যায়।
তারমানে কর্নেল বলটু জানে আমরা কোথায়?
সেটাই সম্ভব।
পঁচিশে ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার রাতে কোন এক সময় গোস্ট বার্গ। বিচ্ছিন্ন হলো। লগে লেখা হলো: আন্দাজ বাইশশো ঘণ্টায়। আইসবার্গের বিদায় পর্বটা দর্শনীয় কিছু হলো না। বজ্রপাতের মত একটা আওয়াজ শোনা গেল! শুনে ছ্যাঁৎ করে উঠল প্রত্যেকের বুক। ব্রিজের পিছনের পোস্ট থেকে কাফম্যান একা ব্যাপারটা ঘটতে দেখল। বে-তে ঢুকে আটকা পড়েছিল আন্ডারওয়াটার স্পার, বিকট শব্দের সাথে ভেঙে গেল সেটা। গোস্ট বার্গ সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় বে-র সামনে থেকে পিছু হটে দূরে সরে গেল ধীরে ধীরে। আন্ডারওয়াটার স্পারের বাকি অংশটা বে-র পানিতে বিপুল আলোড়ন তুলে পিছু নিল।
রানার সাথে ক্যাপটেন যখন ব্রিজে এলেন, পরিচিত দৃশ্যটা বদলে গেছে। জাহাজের পিছনে বে-র মুখ খুলে গেছে আবার। কুয়াশার ভেতর এখনও দেখা যাচ্ছে গোস্ট বার্গের কাঠামো, কিন্তু। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে সেটা। ক্যাপটেনের আচরণে এই প্রথম ভাবাবেগের প্রকাশ ঘটল। যেচে পড়ে রানার সাথে করমর্দন। করলেন তিনি।
কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কারও কোন পরামর্শ না নিয়ে নির্দেশ দিলেন, এঞ্জিন স্টার্ট! সাগরে বেরিয়ে যাব আমরা!