মরণখেলা: ২.০৮ প্রশ্নটা আবার করল কর্নেল বলটুয়েভ

মরণখেলা: ২.০৮ প্রশ্নটা আবার করল কর্নেল বলটুয়েভ

২.০৮ প্রশ্নটা আবার করল কর্নেল বলটুয়েভ

প্রশ্নটা আবার করল কর্নেল বলটুয়েভ।

না! বিস্ফোরিত হলো ট্রাভকিন। আমাকে মাফ করুন। এ নির্দেশ আমি দিতে পারব না। তারচেয়ে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি। চাইব…

কে আপনাকে অব্যাহতি দিচ্ছে? নিরীহ ভঙ্গিতে জানতে। চাইল কর্নেল।

রেডিও-জ্যামিং থামাবার নির্দেশ দেব আমি, ঝঝের সাথে বলল ট্রাভকিন, তারপর মস্কোয় সিগন্যাল পাঠাব…

কি করে? হাসি হাসি মুখ করে তাকাল কর্নেল। কি করে আপনি রেডিও জ্যামিং বন্ধ করার নির্দেশ দেন? আপনার এই। জাহাজে স্পেশাল সিকিউরিটির একটা ডিটাচমেন্ট আছে, ভুলে গেছেন? জ্যামিং সেকশনের নিয়ন্ত্রণ অনেক আগেই নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে তারা।

ব্রিজের পেছনে চার্টরুমে দাঁড়িয়ে দশ মিনিটের বেশি হয়ে গেল তর্ক করছে ওরা। হিটিং সিস্টেম পুরোদমে চালু, রীতিমত ঘামছে। কর্নেল। পারকা আগেই খুলে ফেলেছে, কামানো মাথা থেকে। টুপিটাও নামাল এবার। রিসার্চ শিপ রিগার ক্যাপটেন ট্রাভকিনকে পথে আনতে বেগ পেতে হবে, আগেই ধারণা করেছিল সে। কাজেই চোটপাট না দেখিয়ে কৌশলে এগোচ্ছে।

এটা একটা রিসার্চ শিপ, আমার ওপর নির্দেশ আছে সামুদ্রিক গবেষণা…

আরে রাখুন, মাকে মামা বাড়ির গল্প শোনাবেন না। আপনারা আমেরিকান স্যাটেলাইটের ওপর নজর রাখছিলেন। রিসার্চ, তা ঠিক, কিন্তু মিলিটারি রিসার্চ।

কেন, ওশেনিক রিসার্চ আমরা করছি না? ওয়াটার টেমপারেচার, স্যালিনিটি…

এ-সব গবেষণা বা পরীক্ষার ফলাফল শেষ পর্যন্ত কি কাজে লাগে? নিজের কামানো মাথায় হাত বুলিয়ে ট্রাভকিনের মাথার দিকে আঙুল তুলল কর্নেল। ঘন ঘন নেড়ে সচল কাঁচি বানাল একজোড়া আঙুলকে, বোঝাতে চাইল ক্যাপটেনের উচিত মাথার চুল ফেলে দেয়া। সাবমেরিন চালাবার কাজে, ঠিক? সবাই জানে, আপনাদের যোগাড় করা সমস্ত ডাটা আমাদের ইন্টেলিজেন্স দফতরে চলে যায়…

আপনি যাই বলুন, এ কাজ আমার দ্বারা সম্ভব নয়! উত্তেজিত ট্রাভকিন চড়া গলায় কথা বলছে। আমেরিকান আইসব্রেকার কিউটকে আমি ডোবাতে পারব না। আপনি বদ্ধ একটা উন্মাদ! কিউটকে ডোবালে কেউ আমরা বাঁচব না…।

কেন? বাঁচব না কেন? কে জানবে? কিভাবে? মাথায় আবার হাত বুলিয়ে নিঃশব্দে হাসল কর্নেল বলটুয়েভ। কিউট দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে, তার রাডার নেই। এটা আমরা জেনেছি দুঘণ্টা আগে, আমাদের একটা হেলিকপ্টার ওটাকে দেখে এসেছে। কিউটের অস্তিত্ব সম্পর্কে কারও কোন ধারণা নেই-রেডিও-জ্যামিঙের ফলে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে ওরা, হারিয়ে গেছে। ওটা এখন যদি নিজে থেকে ডুবে যায়?

আপনি ভুলে যাচ্ছেন কিউটে একটা হেলিকপ্টার আছে!

না, ভুলিনি। মুখ ঘুরিয়ে চার্ট টেবিলের দিকে এগোল কর্নেল। চোখে ফুটে ওঠা দ্বিধার ভাবটুকু গোপন রাখতে চাইল। কয়েক ঘণ্টা ধরে চিন্তা করছে সে, কিন্তু কিউটের হেলিকপ্টারটাকে

অকেজো করার উপায় দেখছে না। বজ্জাত ইভেনকো আর। মেরিলিন চার্ট রয়েছে কিউটে। সেজন্যেই দুটোর একটা পথ বেছে। নিতে হবে আমাদের। হয় ওগুলো ফেরত পেতে হবে, নাহয় ধ্বংস। করতে হবে।

কিন্তু আপনি যা করতে বলছেন…

কই? আপনাকে তো আমি কিছু করতে বলিনি! তবে, কে না জানে যে এদিকের পানিতে বিজবিজ করছে আইসবার্গ-দুর্ঘটনা। ঘটতেই পারে। তাছাড়া, আপনাকে তো আপনার পরিবারের। কথাও ভাবতে হবে। শেষ কথাটা বলটুয়েভ নরম সুরে বলল।

আমার পরিবার! এর সাথে আমার পরিবারের সম্পর্ক কি?

বিশেষ করে আপনার স্ত্রীর কথা বলতে চাইছি। অকস্মাৎ। কাঠের মূর্তিতে পরিণত হলো কর্নেল। সে তো ইহুদি…

অসম্ভব! ডাহা মিথ্যে!

কাঠের মূর্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। ঠিক আছে, পুরো নয়, অর্ধেক। যাহা বাহান্ন তাহা তেপান্ন। ভদ্রমহিলার মা ছিলেন ইহুদি। আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন, লেনিনগ্রাদে যারা ইহুদি, তাদের খোঁজ-খবর রাখা আমার অনেক দায়িত্বের একটা?

আমার কাজের মধ্যে আমার স্ত্রীকে টানবেন না…

কমরেড ট্রাভকিন, চুপ করুন! জেনেশুনে নিজের পায়ে কুড়াল। মারতে চান? সোভিয়েত বিরোধী তৎপরতার জন্যে আপনার স্ত্রীকে গ্রেফতার করা হবে, তখন কি করবেন? যে-কোন ইহুদির বিরুদ্ধে। এই অভিযোগ তুলে তাকে আমি ইসরায়েলে পাঠিয়ে দিতে পারি। স্ত্রীকে চিরকালের জন্যে হারাতে চান?

কর্নেল কমরেড, আপনার স্পর্ধা…

তারপর কি ঘটবে? মহিলা আশা করবেন, রাশিয়া থেকে পালিয়ে আপনিও তার কাছে আসবেন। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে যাবে, আপনি পালাতে পারবেন না। তখন আপনার সুন্দরী স্ত্রী নিজের জীবনের কথা ভাববেন। ভাববেন, যাকে আর পাব না তার জন্যে অপেক্ষা করে নিজের জীবন নষ্ট করি কেন! নতুন কোন পুরুষের দিকে চোখ পড়বে…

বদমাশ…

হতেই হয়, শান্ত ভঙ্গিতে বলল কর্নেল। আমার এই পেশায় ওটা একটা যোগ্যতা।

ক্যাপটেন ট্রাভকিন দরদর করে ঘামছে, বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে তাকিয়ে থাকল কর্নেলের দিকে। বুঝে গেছে, কোন উপায় নেই, এই লোকের কথায় নাচতে হবে তাকে। নিশ্চয়ই কোন বিকল্প আছে…

মাথায় এলে জানাবেন আমাকে।

.

আপনার হেলিকপ্টার ফিরে আসছে, মি. রানা, ভারী গলায় বললেন হ্যারি গোল্ডম্যান।

ব্রিজে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা, রানার দুপাশে নিয়াজ আর বিনয়। আপনার হেলিকপ্টার বলার কারণ, প্রস্তাবটা রানার ছিল-হেলিকপ্টার নিয়ে সামনেটায় একবার চোখ বুলিয়ে আসুক শেরম্যান, যদি সে যেতে চায়। বলার সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল শেরম্যান, কুয়াশা সরে যাবার পর থেকে মেশিন নিয়ে আকাশে। ওঠার জন্যে ছটফট করছিল সে।

কালো কুয়াশা সরে গেলেও, হঠাৎ শান্ত হয়ে পড়া সাগরে পানি ছুঁয়ে রয়েছে সী মিস্ট-ভারী সাদাটে কুয়াশা। চারদিক থেকে ওদেরকে ঘিরে রেখেছে আইসবার্গ, অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। দুঘন্টা আগে চল্লিশ ফুট উঁচু ঢেউ ভেঙে এগোতে হয়েছে। কিউটকে, এখন গুটি গুটি সামনে এগোচ্ছে ঠাণ্ডা দুধের মত পানি কেটে। এখনও পোর্টের দিকে কাত হয়ে রয়েছে জাহাজ। ক্রুরা কেউ বসে নেই, তবু এখনও প্রচুর বরফ রয়েছে ডেকে।

বড় একটা আইসবার্গ, একশো ফিট উঁচু, পোর্ট বো থেকে। সিকি মাইল দূরে ভাসছে। বার্গের খাড়া পাঁচিল এবড়োখেবড়ো, গুহা আকৃতির কিছু ফাটল রয়েছে গায়ে। সাদাটে কুয়াশার একটা বেল্ট ওটার কোমর জড়িয়ে রয়েছে, আরেকটা পঁাচ খেয়েছে। গোড়ার দিকে, তবে চাদের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল ছুঁচাল চূড়া ঝুঁকে রয়েছে ওদের দিকে। ছোট আরেকটা বার্গ, শৃঙ্গের কাছাকাছি স্প্যানিশ দুর্গের মত খাজ কাটা, সার সার জানালা, ভাসছে স্টারবোর্ড সাইডে-প্রায় একই দূরত্বে। ব্রিজ থেকে। ওগুলোকে পিঠ-উঁচু দ্বীপের মত লাগল দেখতে-এই দেখা যায়, এই যায় না।

হঠাৎ ঝড়ের বেগে ব্রিজে ঢুকল ইভেনকো রুস্তভ। আমার। টিউব কোথায়? দিন! রানার দিকে ছুটে এল সে।

মি. ইভেনকো রুস্তভ! বিস্মিত হলেন ক্যাপটেন। আপনি অসুস্থ! ডাক্তার আপনাকে ছাড়ল কোন্ আক্কেলে! প্লীজ, আপনি আপনার সিক-বেড়ে ফিরে যান…

দাঁড়ান, আগে সম্পত্তির দখল পাই, তারপর অন্য কথা! ক্যাপটেনকে পাশ কাটিয়ে রানার দিকে মারমুখো হয়ে এগোল রুস্তভ। যখনই ওটা চেয়েছি, ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছেন আমাকে। একা ছিলাম, মুখ বুজে সহ্য করেছি। কিন্তু এখন? ক্যাপটেন একজন আমেরিকান, আমি আমেরিকানদের কাছে আশ্রয় নিতে যাচ্ছি। কাজেই তিনি আমার দলে। ক্যাপটেন…

আমি তো আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না…! গোল্ডম্যান একবার রানা, একবার রুস্তভের দিকে তাকালেন।

উত্তেজিত হবেন না, শান্ত গলায়, ক্ষীণ একটু হেসে রুশ বিজ্ঞানীকে বলল রানা। ব্যাপারটা আমি ব্যাখ্যা করছি, ক্যাপটেন। ইভেনকো রুস্তভ সাথে করে একটা মূল্যবান ডকুমেন্ট নিয়ে এসেছেন—অন্তত উনি তাই বিশ্বাস করেন। নিরাপত্তার কথা ভেবে সেটা নিজেদের কাছে রাখি আমরা।

নিরাপত্তার দোহাই এখন আর কোন কাজে আসবে না! চড়া গলায় বলল ইভেনকো রুস্তভ। আমেরিকান জাহাজে উঠে পড়েছি, কারও বাপের সাধ্যও নেই টিউবটা কেড়ে নিতে আসে। দিন, আমার জিনিস ফিরিয়ে দিন আমাকে!

অবশ্যই, মি. রুস্তভ, বলল রানা, তাকাল নিয়াজের দিকে। নিয়াজ, টিউবটা ভদ্রলোককে ফিরিয়ে দাও।

পারকার পকেট থেকে লম্বা টিউবটা বের করল নিয়াজ। চেহারায় অনিচ্ছার ভাব নিয়ে বাড়িয়ে দিল রুশ বিজ্ঞানীর দিকে। প্রায় ছো দিয়ে সেটা কেড়ে নিল ইভেনকো রুস্তম্ভ।

মাইক্রোফিল্মটা ভেতরে আছে তো? কঠিন সুরে প্রশ্ন করল সে।

আছে।

চোখে দেখে তারপর বিশ্বাস করব, গজগজ করতে করতে টিউবটা উল্টো করে ধরে কয়েকটা ঝাঁকি দিল রুস্তভ। এক টুকরো কোর পড়ল তালুতে, তারপর বেরিয়ে এল থারটি ফাইভ। মিলিমিটার ফিল্মের একটা অংশ।

আশা করি আপনার জিনিস আপনি বুঝে পেয়েছেন, মি.। রুস্তভ? জিজ্ঞেস করল নিয়াজ।

মাইক্রোফিল্মের নিচে আরও কোর ছিল, সব ঠিক আছে তো? এই কোর মহামূল্যবান…

ঝাঁকি দিন, না থাকলে বেরুবে না, নরম সুরে বলল রানা।

রানার দিকে কটমট করে তাকালেন রুশ ওশেনোগ্রাফার। কেউ আপনার পরামর্শ চেয়েছে? ক্যাপটেনের দিকে ফিরলেন তিনি। মি. গোল্ডম্যান, আপনার সাথে একা কথা বলতে চাই। আমি, প্লীজ। আপনাকে একটা জিনিস দেখাব। এই ভদ্রলোকদের। দেখতে দিতে চাই না।

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন ক্যাপটেন। ব্যাপারটা কেমন হলো? মি. রানা আপনাকে এই আর্কটিক নরক থেকে উদ্ধার করে। আনলেন, অথচ তাকেই আপনি অবিশ্বাস করছেন! ব্যাপারটা কি বলুন তো?

ফোড়ন কাটল নিয়াজ, আবার শর্ত দিয়েছিলেন, শুধু যদি মাসুদ রানাকে পাঠানো হয় তবেই তিনি আমেরিকায় পালিয়ে আসবেন। মাসুদ রানা নাকি ওনার হিরো…

হঠাৎ খয়েরি দাঁত বের করে হাসল ইভেনকো রুস্তভ। এখনও আমি বিশ্বাস করি, মি. রানা অসমসাহসী যুবক। শক্ত, প্রায় অসম্ভব কাজ দিয়েও তার ওপর নির্ভর করা যায়। সেজন্যেই শর্ত দিয়েছিলাম, মি. রানাকে পাঠালে আমি আসব, নাহয় আসব না। কিন্তু তারমানে এই নয় যে উনি আমার শ্রদ্ধার পাত্র। কি করে হন! মিগ-একত্রিশ চুরি করে নিয়ে গেলেন উনি, সরাসরি আঘাত করলেন সি.আই.এ. ও জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সকে। ইসরায়েলের একজন শত্রু আমার বন্ধু বা শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারে না! ক্যাপটেন, দয়া করে আপনি ওদেরকে বলুন…

তারচেয়ে আমরাই বরং চার্টরুমে গিয়ে কথা বলি? রুস্তভকে নিয়ে চার্টরুমে চলে গেলেন ক্যাপটেন।

ওরা বেরিয়ে যেতেই নিয়াজের সাথে চোখাচোখি হলো রানার। ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল নিয়াজ।

বিনয়, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ, রানার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। কাফম্যানকে জিজ্ঞেস করতে বলেছিলে জাহাজে বিস্ফোরক আছে। কিনা…

পরে, বিড়বিড় করে বলল রানা। সিকোরস্কি আর তার পাইলট শেরম্যানকে নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে আছে ও। এই শেষ ফ্লাইটে পাঠাবার প্রস্তাবটা ওর ছিল, ফিরে এসে জাহাজে ল্যান্ড না করা পর্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছে। দুমিনিট পর ব্রিজে ফিরে এলেন ক্যাপটেন, আপদটাকে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে দিয়ে এসেছেন। রানার অনুরোধে বো-র কাছে শক্তিশালী একটা সার্চলাইট জ্বালার নির্দেশ দিলেন তিনি। চোখ ধাঁধানো আলোর একটা স্তম্ভ প্রায় খাড়াভাবে উঠে গেল আকাশের দিকে।

সিকোরস্কি এখনও অনেক দূরে, দক্ষিণের অন্ধকার আকাশে খুদে একটা ব্লিপ মাত্র।

জাহাজগুলোকে দেখতে পেয়েছে কিনা কে জানে…

এখনও যদি ওগুলো উত্তরের পথে থাকে, দেখতে না পাবার। কোন কারণ নেই, নিয়াজকে বলল রানা। সাত সাতটা জাহাজ, তাই না?

যেখানে খুশি থাক, আমি গ্রাহ্য করি না, ভারী গলায় বললেন। গোল্ডম্যান। খোলা সাগরে রয়েছি আমরা, ওদের নাকের সামনে। দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাব।

ক্যাপটেনের অগোচরে কাফম্যানের সাথে চোখাচোখি হলো। রানার। দুজনের চেহারাতেই সন্দেহের ছায়া। কাফম্যানও ভাবছে রাশিয়ানরা ঝামেলা করতে পারে।

চাদের আলোয় তেলের মত চকচক করছে সাগরে শান্ত পানি। এঞ্জিনের আওয়াজ ভারী, গমগমে; ধীরগতিতে এগোচ্ছে আইসব্রেকার। কুয়াশা রয়েছে, তবে দূরে দূরে, আইসবার্গগুলোর। চারদিকে। সিকোরস্কির ব্লিপ এক সময় কুয়াশার ভেতর হারিয়ে। গেল। একটু পর শোনা গেল এঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন।

স্টারবোর্ডের দিকে তাকাল রানা। একটা সার্চলাইটের আলো। সবচেয়ে কাছের আইসবার্গের দিকে তাক করা। ভাসমান বরফের পাহাড় বলে মনে হলো না, বিশাল আকৃতি নিয়ে এ যেন একটা দুর্গ। দুর্গের কাঁধের কাছে লম্বা বারান্দা, বারান্দায় সার সার। গরাদহীন জানালা। বারান্দার ওপরে আর নিচে বেশ কিছু সুড়ঙ্গ দেখা গেল, বরফ পাহাড়ের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত লম্বা।

রানার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিয়াজ তাকিয়ে আছে সেদিকে। কি বিশাল, তাই না? গোস্ট বার্গ নয় তো?

প্রার্থনা করো ভাই, তা যেন না হয়, আঁতকে ওঠার ভান করে বলল রানা। গোস্ট বার্গ হলে তোমার একটা ধমকেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে।

অক্ষরে অক্ষরে সত্যি কথাটা, ভাবল নিয়াজ, কিন্তু আর্কটিক সম্পর্কে অজ্ঞ লোকদের বিশ্বাস করানো কঠিন। কয়েক মিলিয়ন টন বরফ, মানুষের গলার আওয়াজে ধসে পড়বে, সত্যি অবিশ্বাস্য। ব্যাপারটা এস্কিমোরা জানে, ভেলা নিয়ে গোস্ট বার্গকে পাশ কাটাবার সময় ঠোঁটে তালা দিয়ে রাখে তারা, জোরে নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলে না। গোস্ট বার্গ যত বিশালই হোক, তার ভিত আর কাঠামো যেমন ভঙ্গুর তেমনি দুর্বল। লক্ষ লক্ষ টন বরফ তূপ হয়ে আছে, ছুঁই ছুঁই করছে আকাশ, কিন্তু ভেতরটা ফাঁপা-দমকা একটা বাতাসের বেমক্কা ধাক্কা খেয়ে মুহূর্তের মধ্যে ধরাশায়ী হতে পারে।

দুর্গের চূড়ায় আলোর খেলা দেখছে রানা। হঠাৎ নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না।

আইসবার্গের চূড়া বিস্ফোরিত হলো।

এই ছিল, এই নেই-কাঁধ থেকে মাথাটা সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেছে। আইসবার্গের ওপরের অংশ সাদাটে বরফ-কণায় ঝাপসা হয়ে গেল। বিস্ফোরণের আওয়াজ চারপাশের আইসবার্গের ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলল। বরফের বড় বড় টুকরো আলোর স্তম্ভ থেকে খসে পড়ল সাগরে। চূড়ার অন্তত বিশ-পঁচিশ ফিট ধসে পড়েছে। গোল্ডম্যান দ্রুত নির্দেশ দিলেন, পোর্টের দিকে কয়েক ডিগ্রী ঘুরে গেল জাহাজ।

গোস্ট মনস্টার যাই হোক, মুণ্ডু বিস্ফোরিত হওয়ায় বার্গ মহাশয় আমাদের দেখতে পাবে না, আশা করি নিরাপদেই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারব।

নিয়াজের কথা শেষ হতেই শেরম্যানের সিকোরস্কিকে দেখা। গেল। চাঁদের আলোয় ঘুরন্ত রোটরের চাকতি আকৃতির ঝিলিক পরিষ্কার ধরা পড়ল চোখে। বোধহয় সিকি মাইলেরও কম দূরে, অনেক উঁচু থেকে দুশো ফিটে নামল, সোজাসুজি কিউটের দিকে এগিয়ে আসছে। পোর্ট সাইডে রয়েছে মুণ্ডুহীন আইসবার্গ, সেটার কাঁধের ওপর দিয়ে উড়ে আসতে হবে শেরম্যানকে।

সিকোরস্কি ল্যান্ড করার সময় এঞ্জিন মন্থর করতে হবে, নির্দেশ দিলেন ক্যাপটেন।

আইসবার্গের কোমর পেঁচিয়ে থাকা কুয়াশা ভেসে গেছে, ভিতের কাছ থেকে কুয়াশা ভেদ করে খাড়াভাবে মাথাচাড়া দিয়ে। রয়েছে বিশাল বরফের পাঁচিল।

ব্রিজে সবাই চুপচাপ, শুধু এঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল।

মাঝখানে একবার নিস্তব্ধতা ভাঙল নিয়াজ, নিশ্চয়ই রিগাকে দেখতে পেয়েছে পাইলট। প্রকাণ্ড আইসবার্গ এক কথায় বোমার মত বিস্ফোরিত হলো। ভেতরের চাপ সইতে না পেরে স্রেফ। বেলুনের মত ফেটে গেল। কিন্তু এবার শুধু মাথার দিকটা নয়, গোটাটাই অদৃশ্য হয়ে গেল। বিস্ফোরণের শব্দে জাহাজের প্রতিটি লোকের কানে তালা লাগল, শক ওয়েভে থরথর করে কেঁপে উঠল ব্রিজ। ওভারহেড কম্পাসের আবরণ ভেঙে গেল, হেলমসম্যানের মাথায় বৃষ্টির মত ঝরে পড়ল কাঁচ। কোর্স ঠিক রাখার জন্যে ছুটে। গিয়ে হুইল আঁকড়ে ধরলেন ক্যাপটেন।

আইসবার্গে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে অনেকক্ষণ ধরে ফিরে আসতে লাগল বিস্ফোরণের আওয়াজ, প্রতিটি প্রতিধ্বনি নাড়া দিয়ে গেল কিউটকে। বার্গটা যেখানে ছিল, সেখান থেকে পাঁচশো ফিট ওপর দিকে শুধু ফেনা, বাষ্প আর বরফ কণা দেখা গেল। সব যখন সী লেভেলে নেমে এল, টগবগে ফুটন্ত পানি ছাড়া দেখার কিছু পাওয়া গেল না। আইসবার্গ অদৃশ্য হয়েছে, সেই সাথে অদৃশ্য হয়েছে। শেরম্যানের সিকোরস্কি।

হেলমসম্যানকে হুইল দিয়ে জানালার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রয়েছেন ক্যাপটেন গোল্ডম্যান। বিষন্ন চোখে বাইরে তাকিয়ে আছেন তিনি। সাগরকে সাগর বলে চেনা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে। ছোট একটা লেক-সবগুলো দিকে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আইসবার্গ। কোনটা দূরে, কোনটা তত দূরে নয়।

বিস্ফোরণের সময় ঠিক মাথার ওপর ছিল শেরম্যান…

রানাকে থামিয়ে দিয়ে গোল্ডম্যান বললেন, জানি। অস্বাভাবিক শান্ত হয়ে গেছেন তিনি। ডিয়ার গড…শেরম্যান! পাশে দাঁড়ানো রানার দিকে তিনি তাকালেন না। চমক্কার! আর কোন ধারণা যদি মাথায় থাকে, মি. রানা, ঢোক গিলে নিচে পাঠিয়ে দিন।

ক্যাপটেনের কথায় রানা যে দুঃখ পেল তা নয়। মনটা শুধু আরেকটু খারাপ হয়ে গেল। নিয়াজ আর বিনয়কে ইশারায় ডাকল ও, নেমে এল ব্রিজ থেকে।

শেরম্যানের আকস্মিক মৃত্যু হতভম্ব করে দিয়েছে রানাকে। কিন্তু তারচেয়ে বেশি ঘাবড়ে গেছে ও সিকোরস্কি ধ্বংস হওয়ায়।

রাডার নেই।

রেডিও থেকেও নেই। রেডিও-জ্যামিঙের ফলে অকেজো হয়ে আছে সেট। কোন সিগন্যাল পাবে না, পাঠাতেও পারবে না।

বাইরের দুনিয়ার সাথে একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ছিল হেলিকপ্টারটা, গেল সেটাও।

দক্ষিণে রয়েছে কর্নেল বলটুয়েভ, তাকে বাদ দিলে বাকি। দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ওরা।

এক ঘণ্টা পর আইসবার্গের সাথে ধাক্কা খেলো কিউট।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত