মরণখেলা: ২.০৭ মুখোমুখি ধাক্কা লাগলে

মরণখেলা: ২.০৭ মুখোমুখি ধাক্কা লাগলে

২.০৭ মুখোমুখি ধাক্কা লাগলে

মুখোমুখি ধাক্কা লাগলে? কি ঘটবে?

রিসার্চ শিপ রিগার ব্রিজে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে রাডারের দিকে তাকিয়ে আছে ক্যাপটেন ট্রাভকিন। পাশেই দৈত্যাকৃতি কর্নেল। পয়মাল বলটুয়েভ। ব্রিজটা বিশাল, হেলমসম্যানের সামনে ইস্পাতের মত শক্ত অভঙ্গুর কাঁচের প্রকাণ্ড দেয়াল। দেয়াল জুড়ে সাজানো রয়েছে নেভিগেশন সহজ করার জন্যে যাবতীয় জটিল। যন্ত্রপাতি। রুশ রিসার্চ শিপের সাথে তুলনা করলে রাডারহীন সাড়ে ছহাজার টনী কিউটকে মান্ধাতা আমলের বলে স্বীকার করে নিতে হয়।

শক্তিশালী ডিজেল মটরগুলোর ভাইব্রেশন মৃদু গুঞ্জনের মত। শোনায়। ব্রিজের সামনে ফিট করা পাঁচ-সাতটা সার্চলাইট ঘন কুয়াশাকে আলোকিত করে রেখেছে।

আচমকা ব্রিজের মেঝেতে পা ঠুকল কর্নেল বলটুয়েভ। বিস্ফোরণের শব্দে চমকে উঠে ডেকের দিকে তাকাল ট্রাভকিন। না, হাতির পা ইস্পাত মোড়া ব্রিজের মেঝের কোন ক্ষতি করতে পারেনি।

কয়েক হাত দূর থেকে হেলমসম্যান ঘাড় ফিরিয়ে ওদের দিকে। তাকিয়ে আছে, হঠাৎ কর্নেলের চোখ রাঙানি লক্ষ করে নিজের কাজে মন দিল সে। এবার ক্যাপটেনের দিকে ফিরল কর্নেল। আমার কথা আপনি শুনতে পাননি? হুমকির মত শোনাল তার কণ্ঠস্বর।

ক্যাপটেন নিজের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন। ঝগড়ার মধ্যে না গিয়ে মৃদু স্বরে বলল সে, বলুন।

কি ঘটবে? প্রশ্নটা আবার করল বলটুয়েভ, আমরা যদি কুয়াশা থেকে বেরিয়ে কিউটের পেটে একটা রামধাক্কা মারি বো দিয়ে?

বিড়বিড় করে ট্রাভকিন বলল, আপনি একটা বদ্ধ উন্মাদ!

.

সাগরে পৌচেছে কিউট। ডুবে যাচ্ছে।

চারদিকে গাঢ় অন্ধকার, ঘনকালো কুয়াশার পর্দার ওপর কোথাও চাঁদ থাকলেও দেখা যাচ্ছে না। সার্চ-লাইটের আলোয় শুধু সামনের দিকটা খানিকদূর পরিষ্কার, উদ্ভাসিত হয়ে আছে ভীতিকর দৃশ্য।

ব্রিজ, মাস্তুল, রেইল, আর ডেক স্ফটিকের মত বরফের আবরণে ঢাকা পড়ে আছে। গোটা আবহাওয়া জমাট বেঁধে বরফে পরিণত হয়েছে। তাপমাত্রা-৩৯ ডিগ্রী ফারেনহাইট, অর্থাৎ ফ্রিজিং পয়েন্টের চেয়ে একাত্তর ডিগ্রী নিচে। হিম-শীতল সাগরের চেয়ে বাতাস অনেক বেশি ঠাণ্ডা। বাতাস নয়, তরল বরফ কালো মেঘের মত ভেসে রয়েছে জাহাজের ওপর। ডেকে পাঁচশো টনের বেশি বরফ জমেছে, তূপ হয়ে আছে পোর্ট সাইডে। সন্দেহ নেই উল্টে যাবে কিউট। শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। আইসব্রেকার ডুবছে।

ডেকে শুরু হয়েছে মরণপণ যুদ্ধ। আবহাওয়া আর তুষারের সাথে মানুষের লড়াই। একান্ত জরুরী কাজে যারা ব্যস্ত তারা বাদে। বাকি সবাই উঠে এসেছে ওপরে। বাঁচার একটাই উপায়, সময় থাকতে জাহাজ থেকে ফেলতে হবে বরফ। যন্ত্রচালিতের মত কাজ করছে ক্রুরা, বিপদের গুরুত্ব তাদের জানা আছে। প্রতি মুহূর্তে কয়েক মণ বরফ রেইলের ওপর দিয়ে সাগরে ফেলেছে তারা, কিন্তু তারচেয়ে অনেক বেশি নতুন বরফ জমছে ডেকে। অন্ধকার, প্রায় কিছুই দেখছে না তারা। বাল্কহেড ল্যাম্পের আলো ঝাপসা হয়ে আছে, কারণ ল্যাম্পের কাঁচে জমাট বেঁধেছে বরফের স্তর। সিধে। হয়ে দাঁড়াতে পারছে না কেউ, বরফের ভারে পেটের দিকে। বিপজ্জনকভাবে কাত হয়ে রয়েছে জাহাজ। বাতাসের জন্যে ছটফট করছে ফুসফুস, অথচ শ্বাস টানতে পারছে না-টানলেই গলার। ভেতর তরল বরফ হয়ে যাচ্ছে বাতাস।

বরফে তৈরি মানুষ ওরা, প্রত্যেকের কাপড়চোপড় ঢাকা পড়েছে শক্ত আবরণে। অতিরিক্ত বিশ থেকে পঁচিশ সের ওজন। বইতে হচ্ছে। শাবল, কোদাল, আর হাতুড়ি নিয়ে প্রতি মুহূর্তে। আক্রমণ চলছে। বরফ ভাঙো, তোলো, ফেলো। ডেক জুড়ে দলে দলে কাজ করছে লোকজন। অবিরাম, বিরতিহীন। মন্থরগতি। এঞ্জিনের আওয়াজ বরফ ভাঙার শব্দে চাপা পড়ছে। অশান্ত সাগর যেন লগি দিয়ে ঠেলে ওপরে তুলছে কিউটের সামনের দিক, পরমুহূর্তে লগি সরিয়ে নিতেই প্রচণ্ডবেগে আছাড় খাচ্ছে। তখন। আর কাজ করার উপায় থাকছে না ক্রুদের, লাইফ-লাইন ধরে তাল। সামলাতে হয়, তা না হলে রেইল টপকে সাগরে পড়তে হবে।

চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেল, অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই।

ঢেঁকির মত ওঠা-নামা করছে জাহাজের বো, সার্চ-লাইটের আলোয় উথালপাথাল সাগর ফুঁসছে। উঁচু ব্রিজ থেকে তাকিয়ে আছেন ক্যাপটেন হ্যারি গোল্ডম্যান, মাঝ-আকাশ থেকে ডেকে বরফ পড়তে দেখছেন-কালো কুয়াশা স্ফটিক হয়ে নেমে আসছে নিচে। আমরা হারছি, কাফম্যান, গম্ভীর সুরে বললেন তিনি। যতটা বরফ ফেলতে পারছি তারচেয়ে বেশি জমা হচ্ছে।

পোর্ট উইন্ডোর সামনে দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে রয়েছে অ্যাকটিং মেট কাফম্যান। ডেকে প্রায় রেইল সমান উঁচু হয়ে রয়েছে বরফ। আর্মার গ্লাসে মুখ চেপে ভাল করে তাকাতে গেল সে, ঠাণ্ডা হঁাকা খেয়ে তাড়াতাড়ি সরে এল। খুব জোরে বরফে শাবল গাঁথতে গিয়ে বিপদে পড়ল একজন ক্রু। দূর থেকে ঠিক চেনা গেল না, সম্ভবত হিগিন। তার ডান হাতের দস্তানা খুলে গেল, বরফের ভঁজে আটকা পড়ল কজি পর্যন্ত। দ্বিতীয় দস্তানাটা হাতে রয়েছে বটে, তবু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফ্রস্ট বাইটে আক্রান্ত হবে বেচারা। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটল সে, কজিসহ আঙুলগুলো বগলের তলায় চেপে ধরেছে। সবচেয়ে কাছের সিঁড়ি লক্ষ্য করে ছুটছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাফম্যান ভাবল, হয়তো শেষ রক্ষা হবে না-হাতটা বরফে পরিণত হলে কেটে ফেলে দিতে হবে। লোকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারল কিনা দেখা হলো না। একটা ঢেউয়ের মাথা থেকে ছড়িয়ে পড়ল ঝর্নার মত একরাশ পানি, মাঝপথে পরিণত হলো বরফে, ঝমঝম করে শিলাবৃষ্টি হলো কাঁচে। ঝাপসা হয়ে গেল দৃশ্যটা।

শুনলাম মি. মাসুদ রানা ভাল আছেন, বললেন গোল্ডম্যান।

হ্যাঁ, সুস্থ হয়ে উঠছেন, কাফম্যান বলল। ভদ্রলোক এই কঁচের মত, অভঙ্গুর!

নিয়াজের কেবিনে একা বসে রয়েছে রানা। জাহাজের খোলের। সাথে ঘষা খাচ্ছে ভাসমান বরফের চাই, তারই ড্রাম পেটানোর মত। আওয়াজ শুনছে একমনে। কেবিন পোর্ট সাইডে কাত হয়ে আছে। দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে ও। জানে, বরফ সরাবার জন্যে অমানুষিক খাটছে ক্রুরা, কিন্তু সুবিধে করতে পারছে না। জাহাজ উল্টে গেলে কেউ ওরা বাঁচবে না, তবু বিপদটার কথা ভুলে গিয়ে। অন্য কথা ভাবছে রানা।

কর্নেল বলটুয়েভের চেহারাটা চোখের সামনে ভাসল। তিন ঘণ্টা আগে প্রথম যখন জ্ঞান ফিরল, ওকে দেখতে এসেছিলেন ক্যাপটেন গোল্ডম্যান। কিছু কথাবার্তা হয়েছিল।

আমাদের চল্লিশ মাইল দক্ষিণে রয়েছে ওরা, মি. রানা-সোভিয়েত ট্রলার। ক্যাপটেনের আঙুল ছিল ভাঁজ খোলা। চার্টের ওপর। আমাদের পথের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে।

রাডার নেই, জানলেন কিভাবে।

নিজের চোখে দেখে এসেছে শেরম্যান। কুয়াশা তখনও আসেনি, সিকোরস্কি নিয়ে ফুয়েল লিমিটের শেষ মাথা পর্যন্ত চলে গিয়েছিল ও। শুধু যে ট্রলারগুলোকে দেখেছে তাই নয়, ঠিক। এখানটায় আরও বড় কি যেন একটা আছে।

ত্রিশ মাইল দূরে। রিসার্চ শিপ রিগা?

হতে পারে। ভাল করে দেখার সুযোগ পায়নি শেরম্যান, ও তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কালো কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যায় জাহাজটা। তবে গম্বুজ আকৃতির রাডার ডোম মত কিছু একটা দেখেছে। রিগায় এ-ধরনের ইকুইপমেন্ট আছে, আমাদের স্যাটেলাইটগুলোর ওপর নজর রাখার জন্যে ব্যবহার করা হয়। এখন লক্ষ রাখতে হবে ওদের যখন আমরা পাশ কাটাব কোন দুর্ঘটনা যেন না ঘটে…

নড়েচড়ে বাঙ্কে আরও আরাম করে বসল রানা। জ্ঞান ফেরার পর প্রথম কথা হয়েছে জাহাজের ডাক্তারের সাথে। ওর কোন হাড় ভাঙেনি দেখে ডাক্তার নাকি নিজের গায়ে চিমটি কেটে পরীক্ষা করেছিল, স্বপ্ন দেখছে না তো! হাড় না ভাঙার কারণ, পরে ডাক্তার উপলব্ধি করে, রানার পরনের গরম কাপড়চোপড় আর ক্যানভাস প্যাড। মাস্তুলের সাথে ধাক্কা না খেয়ে শূন্যে ঝুলে পড়েছিল শরীরটা, সেটাও একটা কারণ। যাবার সময় ডাক্তার ওকে বলে গেছে, তবু সম্পূর্ণ বিশ্রামের মধ্যে থাকতে হবে আপনাকে, জাহাজ কুইবেকে না পৌঁছুনো পর্যন্ত এই কেবিন থেকে বেরুতে পারবেন না।

আপনমনে হাসল রানা। ডাক্তার জানে না, চার দেয়ালের ভেতর বন্দী থাকার মানুষ নয় সে। সত্যি, সারা শরীর থেঁতলে গেছে ওর; শুধু ব্যথা নয়, সেই সাথে অনুভব করছে ফুলে যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে ধড়টা। তবু এই বিপদের সময় চুপ করে বসে থাকা যায় না। নিয়াজের জন্যে অপেক্ষা করছে ও। জরুরী কথা আছে। তারপর ব্রিজে যাবে…।

উল্টোদিকের দেয়ালে চোখ রেখে কর্নেল বলটুয়েভের কথা ভাবল রানা। আই.আই. ফাইভের একটা ঘরে মিনিট কয়েক লোকটাকে দেখেছে ও। চোখের সামনে বিশাল একটা দেহ ভেসে উঠল, কামানো মাথা, অস্বাভাবিক চওড়া মুখ, চেহারায় মঙ্গোলীয় ছাপ। নিষ্ঠুর, প্রতিশোধপরায়ণ একজন মানুষ।

কিউটের সামনে ছয়টা সোভিয়েত ট্রলার রয়েছে। এটা কোন কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে না। কিউটে ইভেনকো রুস্তম্ভ রয়েছে। আর রয়েছে মেরিলিন চার্ট। এ-সব জানা আছে কর্নেল। বলটুয়েভের। ক্যাপটেন গোল্ডম্যান বললেন, দেখতে হবে যেন। কোন দুর্ঘটনা না ঘটে। কিন্তু রানা ভাবছে সম্পূর্ণ অন্য কথা।

কর্নেল বলটুয়েভের নির্দেশে রিসার্চ শিপ রিগা আর ট্রলারগুলো। কিউটের পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্ন হলো, লোকটা কি। পরিমাণ ঝুঁকি নেবে? মার্কিন পতাকাবাহী একটা জাহাজকে ডুবিয়ে। দেয়ার চেষ্টা করবে কি? কিংবা জাহাজে চড়াও হবার স্পর্ধা। দেখাবে?

লোকটার মানসিক গঠন কি রকম, তার ওপর নির্ভর করছে। ব্যাপারটা। যদি উন্মাদ হয়, সবই সম্ভব। উল্টোদিকের দেয়ালে চোখ রেখে ভবিষ্যৎ দেখতে পাবার চেষ্টা করল রানা।

আরও একটা দুশ্চিন্তার বিষয় মেরিলিন চার্ট। সত্যিই কি আসল চার্টটা নিয়ে এসেছে ইভেনকো রুস্তভ? টিউবের ভেতর থেকে যেটা বেরিয়েছে সেটাকেই আসল চার্ট বলে দাবি করছে সে, তার এই দাবি কতটুকু সত্যি? ওটাই যদি আসল চার্ট হবে, সেটা। নিজের কাছে রাখার জন্যে আরও জেদ ধরেনি কেন?

চার্টটা নয়, টিউবটা পাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল কেন?

শুরুতে রানা ধারণা করেছিল, আসল চার্টটা ইভেনকো নিয়ে। আসবে না, বা নিয়ে আসতে পারবে না। ব্যক্তিগত ভাবে ও চায় না, আসল চার্টটা আমেরিকানদের হাতে পড়ক। তাতে ক্ষমতার। ভারসাম্য নষ্ট হবে। এখন, ইভেনকোর দাবি যদি মিথ্যে না হয়, নতুন একটা দায়িত্ব চাপল ওর কাঁধে। আসল মেরিলিন চার্ট ফিরিয়ে দিতে হবে রাশিয়াকে।

কিন্তু তাহলে আমেরিকানদের বুঝ দেবে কিভাবে?

তারও আগে জানতে হবে, আসল চার্টটা কোথায়।

চিন্তা করতে করতে নিজের অজান্তেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল রানা।

.

বিপদের ঝুঁকি নিয়ে, বা বলা যেতে পারে বিপদের সমস্ত ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে হাফ স্পীডে ছুটছে কিউট। দুই ঢেউয়ের মাঝখানে সরু একটা ঢালে নাক ঢুকিয়ে দিল বো, সবেগে পোর্ট রেইলের ওপর ভেঙে পড়ল মস্ত একটা ঢেউ, সম্পূর্ণ ডুবে গেল রেইল। আবার যখন মাথাচাড়া দিল বো, পানির অর্ধেকই বরফে পরিণত হয়ে রয়ে গেল ডেকে।

দশ মিনিট আগে সিদ্ধান্তে পৌঁছান হ্যারি গোল্ডম্যান। ঝুঁকিটা নিতেই হবে। স্পীড বাড়িয়ে দেখা যাক কুয়াশা থেকে বেরুতে পারি কিনা।

জাহাজ উল্টে…, ক্যাপটেন ঝট করে তাকাতে কথাটা শেষ করতে পারেনি কাফম্যান। ডুবে তো ওরা এমনিতেও যাচ্ছে, কাজেই চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?

বরফ মোড়া রিগিঞ্জের ভেতর দিয়ে শো শো বাতাস বইছে। গতিবেগ বেড়েছে, পঁয়ত্রিশ নট-এর কম নয়। ঢেউয়ের মাথা থেকে ছিনিয়ে এনে ডেকের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে বিপুল জল-ফোঁটা। শূন্যে বরফ হয়ে উঠছে ওগুলো, ক্রুদের কুঁজো শরীরে সীসার তৈরি বুলেটের মত আঘাত করছে। বেঁচে থাকার যুদ্ধে হারছে ওরা, প্রতিটি রণক্ষেত্রে। আগের অবস্থা এখনও বদলায়নি, যত বরফ ফেলছে নতুন করে জমছে তারচেয়ে বেশি। পোর্ট সাইডে রেইল সমান নিরেট হয়ে উঠেছে সাদা স্তুপ।

বাতাসের গতিবেগ বেড়ে যাওয়ায় আরও অশান্ত হয়ে উঠল সাগর। মাঝে মধ্যেই এক আধটা ঢেউ আসছে চল্লিশ ফিট উঁচু। জাহাজের ডেকে আছাড় খেয়ে ভাঙছে সেগুলো, যেন পোটের। দিকে কাত হয়ে পড়া মাস্তুলের ডগা ছুঁতে চায়। ডেকে দাঁড়ানো ক্রুরা লাইফলাইন ধরে ঝুলে পড়ে, পানির ফিরতি তোড়ের সাথে। ভেসে যাবার আতঙ্ক গ্রাস করে সবাইকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অমানুষিক পরিশ্রম করে প্রচুর বরফ ফেলেছে ওরা, ঢেউয়ের পানি নেমে যাবার পর দেখা গেল খালি জায়গাগুলো আবার ভরাট হয়ে। গেছে বরফে।

ঢেউগুলোর সাথে শক্ত বরফও থাকে। কোনটা লম্বা, কংক্রিট পিলারের মত, কোনটা চৌকো বাক্স আকৃতির। লাইফ-লাইন আঁকড়ে ধরা ক্রুরা খোদার নাম জপতে থাকে, কারণ ওগুলোর। একটা ধাক্কা দিলে মৃত্যু অনিবার্য। পানির তোড়ের সাথে উঠে। আসা এই রকম একটা বরফের ধাক্কায় ওদের এক লোক মারাও গেল। লাইফ-লাইন ধরে ঝুলে পড়েছিল সে, পানির তোড় তাকে। ঠেসে ধরল একটা বাল্কহেডের গায়ে। পরমুহূর্তে টর্পেডোর মত ছুটে এসে তার মুখ, মাথা, আর বুক চিড়ে-চ্যাপ্টা করে দিল দেড় মণ ওজনের একটুকরো বরফ।

লাশটা ভেসে গেল সাগরে।

ডেক খালি করা উচিত, স্যার, পনেরো মিনিট পর মুখ খুলল কাফম্যান।

কেন? অ্যাকটিং মেটের পাশে এসে দাঁড়ালেন ক্যাপটেন, পোর্ট উইন্ডো দিয়ে নিচে তাকাতেই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন। পোর্ট রেইল ডুবে গেছে আবার। লোকজন দাঁড়িয়ে আছে বরফের ওপর, কিন্তু বরফ দেখা যাচ্ছে না। পানিতে সবার কোমর পর্যন্ত। ডুবে আছে। রেইল নেই, বরফ নেই, ওপর থেকে মনে হলো ব্রিজ একা নিজ থেকেই ভেসে আছে। পানির ছিটে বরফকণা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল কাঁচে, ঝাপসা হয়ে গেল নিচের দৃশ্য। সরে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার কাঁচে চোখ রাখলেন ক্যাপটেন।

খানিক পর বো-র দিকে চোখ রাখার জন্যে নিজের জায়গায় ফিরে এলেন তিনি। না। ডেকে ওরা যেমন কাজ করছে করুক।

কিন্তু, স্যার কিভাবে কাজ করবে ওরা! কোমর পর্যন্ত পানি…?

এখনও কি তাই? অ্যাকটিং মেটকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন গোল্ডম্যান।

না, তা নয়, কিন্তু পরবর্তী ঢেউ এলেই আবার…

ওরা কাজ করুক, কাফম্যানকে থামিয়ে দিলেন ক্যাপটেন।

মনের গভীরে কাফম্যান জানে, ক্যাপটেন ঠিকই করছেন। প্রতি পাউন্ড বরফ ফেলার সাথে জাহাজের ভেসে থাকার সম্ভাবনা আরেকটু বাড়বে। ভেসে থাকতে পারলে আশা করা যায় এগিয়ে। গিয়ে সামনে কোথাও নিরাপদ পরিবেশ পাওয়া যাবে। এই কালো কুয়াশার ভেতর থেকে বেরুতে না পারলে মৃত্যু অবধারিত।

পরবর্তী ষোলো ঘণ্টা পালা করে কাজ করল ক্রুরা। প্রতিটি টীম কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম পেল, ডেকের নিচে নেমে গিয়ে ভিজে কাপড় বদলে গরম কাপড় পরল তারা, আগুনের ধারে বসে ভাজা ভাজা করে নিল শরীর। দশ মিনিট, তারপরই আবার ফিরে আসতে হলো হিম নরকে। একদল ডেকে উঠল, আরেক দল নামল। যারা উঠল তারা বিদায় চেয়ে নিল, আর হয়তো দেখা নাও হতে পারে।

অসহ্য শীত, তীব্র বাতাস, ঢেউ, ঢেউয়ের সাথে ছুটে আসা বরফের চাঁই, এ-সবের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে লড়ে গেল। লোকগুলো। ক্যাপটেন হ্যারি গোল্ডম্যানের ব্যক্তিত্বই এই। অসম্ভবকে সম্ভব করল। দৃঢ়চেতা ক্যাপটেনের নির্দেশ অমান্য করার সাধ্য কারও নেই। একটা টীমে স্বেচ্ছায় নাম লেখাল নিয়াজ। আর বিনয়। ওদিকে ইভেনকো রুস্তভ, যার জন্যে ওদের সবার। আজ এই অবস্থা, সিক-বেতে শুয়ে শুয়ে ফলের রস আর সুপ খাচ্ছে। ঘুম ভেঙেছে তার, সেই থেকে আমার টিউব, আমার টিউব করে জান দিচ্ছে। অনেক কষ্টে তাকে বিছানায় আটকে রেখেছে জাহাজের ডাক্তার।

কুয়াশার গ্রাস থেকে হঠাৎ করে বেরিয়ে এল ওরা। কি ঘটছে প্রথম টের পেল কাফম্যান। ডেকে নেমে, বরফের একটা চওড়া প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চোখ কুঁচকে তাকাল সে। তারপর ক্রুদের দিকে ফিরল। সবাই বরফ ভাঙছে, অন্য কোন দিকে খেয়াল নেই কারও। হাতের শাবল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মইয়ের দিকে ছুটল। কাফম্যান। ব্রিজে ঢুকল হাঁপাতে হাঁপাতে। অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে! আমরা বেরিয়ে আসছি।

হ্যাঁ, জানি, বললেন ক্যাপটেন। তাঁর চেহারায় স্বস্তি বা সন্তোষের ছায়া পর্যন্ত নেই, রিয়ার উইন্ডো দিয়ে একদৃষ্টে বাইরে। তাকিয়ে আছেন। এখনও পোর্টের দিকে কাত হয়ে রয়েছে জাহাজ,

ডেকে বরফের পাহাড়। তবে আবহাওয়ার মধ্যে আরও একটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। শোঁ শোঁ আওয়াজ একটু যেন কমেছে। বাতাসের। ডেকের ওপর আবছা একটা আলো পড়ল, পরিষ্কার নয়-কুয়াশা সরে যাবার সাথে সাথে উঁকি দিতে শুরু করেছে চাঁদ। কুয়াশার গাঢ় পর্দা এখনও দেখা যাচ্ছে, তবে জাহাজের পিছনে সেটা, দ্রুত সরে যাচ্ছে আরও দূরে।

রাত এগারোটায় সিঁড়ি বেয়ে ফোরডেকে উঠে এল রানা। এত ছুটোছুটি কেন? কি ঘটছে? ধীরে ধীরে হাঁটছে রানা, এখনও ক্লান্ত। আরও দুজন নাবিক ছুটে পাশ কাটিয়ে গেল ওকে, খোলা ডেকে বেরিয়ে বরফের ওপর দিয়ে দৌড় দিল। ভয়ঙ্কর কোন দুঃসংবাদ হলে পিচ্ছিল ডেকের ওপর দিয়ে এভাবে কেউ দৌড়ায় না।

ব্রিজে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। এই আবহাওয়াতেও একটা জানালা খুলে রেখেছেন ক্যাপটেন, নাইট-গ্লাস চোখে নিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরে। হেলমসম্যান, তারপর কাফম্যানের দিকে তাকাল রানা। ওদের চেহারা দেখে বুঝল, এই মুহূর্তে কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভাল। দুজনেই উদ্বেগ আর উত্তেজনায় টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ধীর পায়ে খোলা জানালার দিকে এগোল রানা। জিজ্ঞেস করতে হলো না, বাইরের একটা লুকআউট পয়েন্ট থেকে ভেসে এল এক লোকের রোমহর্ষক চিৎকার, আইসবার্গ অন দি পোর্ট বো! আইসবার্গ অন দি স্টারবোর্ড বো! আইসবার্গ অ্যাহেড!

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত