মরণখেলা: ২.০৬ ঘুসি তুলে পাইলটকে মারতে গেল

মরণখেলা: ২.০৬ ঘুসি তুলে পাইলটকে মারতে গেল

২.০৬ ঘুসি তুলে পাইলটকে মারতে গেল

ঘুসি তুলে পাইলটকে মারতে গেল কর্নেল বলটু। ল্যান্ড করো। বলছি, ল্যান্ড করো! একদিন তো ওটায় নামতে হবে! গলা নয়, যেন বজ্রপাতের আওয়াজ, হেলিকপ্টারের গর্জন সম্পূর্ণ চাপা পড়ে গেল।

ষোলোশো টন রিসার্চ শিপ রিগার ওপর ঝুলে রয়েছে। সাবমেরিন কিলার, ঘুসি খাবার ভয় থাকা সত্ত্বেও ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারল না পাইলট। বেয়াদপ বাতাসের ধাক্কায় একদিকে কাত হয়ে পড়ল কপ্টার, ছিটকে পড়া থেকে নিজেকে রক্ষার জন্যে সীটের পিঠ আঁকড়ে ধরল কর্নেল। ব্লাডি অ্যামেচার, মনে মনে ইংরেজিতে গাল পাড়ল সে। ফ্লাইং স্কুল থেকে পাইলট হয়ে আজকাল যারা বেরোচ্ছে, বিপদের সময় দেশটাকে নির্ঘাত ডোবাবে। তার পিছনে সীটের ওপর কুঁকড়ে বসে রয়েছে জুনায়েভ। এমনিতেই আকাশে উঠলে বমি পায় বেচারির, তার ওপর উচ্ছৃঙ্খল আবহাওয়া ওদের নিয়ে তামাশা করছে।

কপ্টারের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল পাইলট, কর্নেলের দিকে না। তাকিয়ে সবিনয়ে বলল, বসাটাই নিরাপদ, কমরেড কর্নেল…

কাপুরুষ! অযোগ্য! পা ঠুকল কর্নেল, মনে হলো ঝাঁকি। খেলো সাব-কিলার। নিরাপত্তা সম্পর্কে তুমি আমার চেয়ে বেশি জানো? বুদ্ধ কহিকে, এতক্ষণ ধরে কি বলছি? তেড়ে মারতে। গেল আবার। নামো জাহাজে!

কর্নেল কমরেড, গোঁ ধরে বসল পাইলট, ল্যান্ডিং কন্ডিশন অত্যন্ত বিপজ্জনক। আপনাকে বাঁচিয়ে রাখা আমার দায়িত্ব। যথেষ্ট ফুয়েল আছে, যতক্ষণ খুশি আকাশে থাকতে পারব…

অবজারভারের সীটে বসল কর্নেল, পাইলটের কানের কাছে। মুখ নিয়ে গিয়ে একের পর এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটাল, আমি। তোমাকে আদেশ করছি, জাহাজে ল্যান্ড করো। আমার নিরাপত্তার। ব্যাপারে তোমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই, বুঝেছ? নামো!।

অসহায় দেখাল পাইলটকে, ভাবটা-হায়, এ কোন পাগলের। পাল্লায় পড়লাম!

মুখ ফিরিয়ে সাগরের দিকে তাকাল কর্নেল। ভীতিকর দৃশ্য, সন্দেহ নেই। বিশাল রিসার্চ শিপের প্রকাণ্ড রাডার চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল, ব্রিজের সামনে কিম্ভুত আকারের মসজিদ যেন, জাহাজের সাথে মাতালের মত দুলছে। বিরাট আকৃতির ঢেউ, একের পর এক আসছে, প্রতিটির মাথায় চড়ে নাচছে। জাহাজ। যখন কাত হয়ে পড়ে, মনে হয় গম্বুজ আকৃতির রাডার। মাস্ট সাগর ছুঁতে চাইছে। আইসফিল্ডের কাছাকাছি বলে, ঢেউ আর স্রোতের সাথে জাহাজের দুপাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে বরফের চাঁই।

তিনশো ফিট ওপরে রয়েছে কপ্টার। নামতে শুরু করল।

রাডার মেকানিজম লক্ষ্য করে নামছে পাইলট। ওটার ঠিক সামনেই ল্যান্ডিং প্যাড। জাহাজের ডেক যখন কোন দিকে কাত হয়ে নেই, ঠিক সেই সময় প্যাডে ল্যান্ড করতে হবে। তা না হলে প্যাডে নামার সাথে সাথে উল্টে যাবে কপ্টার, ডিগবাজি খেয়ে রেইল ভেঙে পড়বে গিয়ে সাগরে। পানি থেকে হিম বাষ্প উঠছে, ঝাপসা হয়ে গেল উইন্ডস্ক্রীন। গায়ে কর্নেলের দৃষ্টি অনুভব করল সে, গরম আঁচের মত। ইচ্ছার বিরুদ্ধে নামছে সে। উইন্ডস্ক্রীনের সামনে বিশাল পেন্ডুলামের মত কি যেন ঝুলে রয়েছে। মাস্টহেড, ডগায় রাডার উইং সহ। গোটা মাস্তুলের গায়ে গিজগিজ করছে ইলেকট্রনিক গিয়ার। রুশ কর্মকর্তারা রিগাকে রিসার্চ শিপ বললেও, আসলে ওটা সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা জাহাজ।

কপ্টার আরও নিচে নেমে এল। দৃষ্টিপথের প্রায় পুরোটা জুড়ে থাকল রাডার ডোম, জাহাজের সাথে দুলছে। পাইলট তাকিয়ে আছে আরও সামনে, মাস্টহেডের দিকে। মাস্টহেড কাত হয়ে ছিল, ধীরে ধীরে সিধে হচ্ছে। পুরোপুরি সিধে হলে বুঝতে হবে অদৃশ্য ল্যান্ডিং প্যাড কোন দিকে ঢালু হয়ে নেই। অবস্থাটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্যে টিকবে, তারপর মাস্টহেড কাত হতে শুরু করবে আরেক দিকে, সেই সাথে কাত হবে প্যাডও। আন্ডারক্যারিজের নিচে ঝুলে থাকা স্কিডগুলো প্যাড স্পর্শ করল। ছুটে এল অপেক্ষারত টেকনিশিয়ানরা। অ্যাংকর রিঙগুলো ক্ল্যাম্প দিয়ে আটকে দেয়া হলো দ্রুত হাতে। রোটর ঘুরছে, দরজা খুলে ফেলল কর্নেল। কাঁধের ওপর দিয়ে পাইলটের দিকে তাকাল সে। দেখলে তো! চেষ্টা না করলে জানাও যায় না নিজের ক্ষমতা! রোটরের তলায় মাথা নিচু করে দাঁড়াল সে, লাফ দিয়ে পড়ল। জাহাজের ডেকে। জাহাজ আবার কাত হতে শুরু করেছে, রেইল। ধরে হোঁচট খেতে খেতে এগোল। রেইল টপকে থাবা মারল লোনা পানি, দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকল সে। পানি সরে যেতে পারকার। ভাঁজ থেকে বরফের টুকরো ঝাড়ল। মই বেয়ে ব্রিজে ওঠার সময় ঘোঁৎ করে আওয়াজ বেরিয়ে এল গলা থেকে, যেন বিরূপ প্রকৃতির ওপর ঝাল ঝাড়ল। দরজা খুলে গেল, ভেতরে দেখা গেল ক্যাপটেন লিউনিদ ট্রাভকিনকে।

কর্নেল পয়মাল বলটুয়েভ! গা থেকে পানি ঝরছে, ভিজে। পারকা খুলে মেঝেতে ফেলে নিজের পরিচয় দিল কর্নেল। আপনি। ট্রাভকিন? ভাল। নতুন কাপড়, প্লীজ। কচ্ছপের মত একটু একটু। করে উত্তরে যাবার মানে কি?

ক্যাপটেন ট্রাভকিন রোগা-পাতলা, চোখ জোড়া বুদ্ধিদীপ্ত। জাহাজের ওপর দিয়ে কি রকম ধকল যাচ্ছে ভাল করেই জানে। কোন ব্যাপারেই অস্থির হবার লোক নয় সে। নতুন কাপড়-চোপড়। আনার নির্দেশ দিয়ে, কর্নেলকে নিয়ে ব্রিজের পিছনে চার্টরুমে ঢুকল। চার্টের ওপর ঝুঁকে কাজ করছিল এক লোক, তাকে বিদায় করে দিল সে। দরজা বন্ধ করল। তারপর শান্ত গলায় বলল, আমি প্রতিবাদ জানিয়ে বলতে চাই…

প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করা হলো!

কি নিয়ে প্রতিবাদ তাই এখনও বলিনি…! বিস্মিত দেখাল ট্রাভকিনকে।

শুনতে চাই না!

কিন্তু কমরেড কর্নেল, এদিকের সাগর বিপজ্জনক! এই আকারের জাহাজ নিয়ে…!

নতুন কিছু বলার আছে? আবার বাধা দিল কর্নেল। দস্তানা খুলে সাইড টেবিলে রাখল। জ্যাকেটের পকেট থেকে স্টীল-রিম চশমা বের করে পরল, ঝুঁকল চার্ট টেবিলের দিকে। একটা পেন্সিল তুলে নিয়ে আঁক কাটল চার্টে। শেষবার যখন দেখেছি, এখানে ছিল আমেরিকান আইসব্রেকার কিউট। এই মুহূর্তে বরফ ভেঙে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছে ওরা। দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে… চার্টের গায়ে মোটা একটা রেখা আঁকল সে। আমরা উত্তর দিকে যাব। রেখাটা ধরে আবার উঠতে লাগল পেন্সিল। কাজেই নতুন কোর্সে জাহাজ চালান। ফুল স্পীডে।

ক্যাপ খুলে চার্টের ওপর ফেলল ট্রাভকিন, কর্নেল যাতে আর কোন আঁক কাটতে না পারে। হাত দুটো বুকে ভাঁজ করে কর্নেলের দিকে তাকাল সে। এই জাহাজ আমার নির্দেশে চলে, কমরেড কর্নেল। জাহাজে আপনাকে জায়গা দেয়ার নির্দেশ আছে আমার ওপর। নির্দেশ আছে আপনাকে সাহায্য করার। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনার কথা মত জাহাজ চালাতে হবে আমাকে…

অবোধ, অবাধ্য শিশু! কৃত্রিম হতাশায় স্নান দেখাল। কর্নেলকে। ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ল সে, হঁাচকা টান দিয়ে পায়ের বুট খুলল। কার স্বার্থ দেখেন আপনি, ক্যাপটেন? নিশ্চয়ই দেশের?

অবশ্যই!

আমাকে দেখে আপনার কি মনে হয়, নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে আর্কটিকে এসেছি?

কথার মারপ্যাচ আমি বুঝি না, বলল ট্রাভকিন। জাহাজ। নিয়ে উত্তরে যাবার নির্দেশের বিরুদ্ধে আমি আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাচ্ছি। রিগা আমাদের অত্যাধুনিক রিসার্চ শিপ। তৈরি করতে। কয়েক মিলিয়ন রুবল খরচ হয়েছে। জাহাজের নিরাপত্তার জন্যে। আমাকে দায়ী করা হবে। উত্তরে আইসবার্গের ছড়াছড়ি…

কিউট গেল কিভাবে? শেষ দিকে তার রাডার পর্যন্ত ছিল না! তোমার মাস্টহেডের মাথায় ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট রয়েছে, ওগুলো ব্যবহার করো। পায়ে শুধু মোজা, উঠে দাঁড়িয়ে চার্টরুমের। এদিক ওদিক ঘুর ঘুর করতে লাগল। রেডিও-জ্যামিং অফিসারের সাথে কথা বলতে চাই। খানিকক্ষণ জ্যামিং বন্ধ রেখে ক্যারিয়ার নার্ভায় জরুরী একটা সিগন্যাল পাঠাতে হবে-সমস্ত হেলিকপ্টারের এখন একটাই কাজ, কিউটের বর্তমান পজিশন জানা। যে পাইলট প্রথম দেখতে পাবে, রিপোর্ট করার জন্যে সোজা এখানে চলে আসবে সে।

কেন? শান্ত প্রকৃতির ক্যাপটেনকে অশান্ত দেখাল। এধরনের পাগলামির মানে কি? আপনি যখন আমার কথা শুনবেনই না, আমার প্রতিবাদ এখুনি আমি মস্কোয় জানাব…

কর্নেলকে মাথা নাড়তে দেখে থেমে গেল ক্যাপটেন।

ঘাড় ফিরিয়ে ক্যাপটেনের দিকে তাকাল কর্নেল। রেডিও অন। করার সুযোগ কাউকে আমি দিচ্ছি না। জ্যামিং বন্ধ রাখা হবে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্যে, কারণ হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারে আমার সিগন্যাল পাঠানোটা জরুরী। কিউট দক্ষিণে যাচ্ছে, ওখানে গিজগিজ করছে আইসবার্গ। রাডার নেই, অন্ধের মত হাতড়ে এগোতে হবে কিউটকে। বাইরের দুনিয়ার সাথে ওদের কোন যোগাযোগ থাকবে না। রেডিও-জ্যামিং বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে ওদেরকে। আমার জন্যে চা আনতে বলুন, ট্রাভকিন। গোটা ব্যাপারটা আসলে কি নিয়ে শুনবেন তারপর। নাটকীয় ভঙ্গিতে একটু থেমে শেষ কথাটা উচ্চারণ করল সে, কি হবে না হবে সে পরে দেখা যাবে, কিন্তু আমার দায়িত্ব আমি পালন করব। কিউটকে আমরা বাধা দেব। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাবে? আমার তা মনে হয় না। কজন বাংলাদেশীর জন্যে আমেরিকা অত বড় ঝুঁকি নেবে এ আমি বিশ্বাস করি না।

.

নিরেট বরফের সাথে ইস্পাতের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘুম ভেঙে গেল রানার। শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম ভূমিকম্পও বুঝি এরকম ঝুঁকি খাওয়াতে পারবে না, বুঝি বিস্ফোরিত আগ্নেয়গিরিরও সাধ্য নেই এরকম আওয়াজের সাথে পাল্লা দেয়। পোলার প্যাক ভেঙে এগোবার চেষ্টা করছে কিউটের বো। আর একা শুধু রানাই প্রলয়কাণ্ডের সম্পূর্ণ ধাক্কা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ওর কেবিনটা বো-র ঠিক নিচেই। জাহাজের মাঝামাঝি জায়গায় আরেকটা কেবিন খালি ছিল, নিয়াজ আর বিনয় ঠাই নিয়েছে সেখানে। ইভেনকো রুস্তভ অসুস্থ, সিক-বেতে চিকিৎসা চলছে তার।

দুই হাতে চোখ রগড়ে ইস্পাতের দেয়ালের দিকে ভাল করে তাকাল রানা। ধীরে ধীরে ভয়টা কেটে গেল-মোটা পাত ভেঙে বরফের পাহাড় চাপা দেবে ওকে, তা সম্ভব নয়। কিউট আইসব্রেকার, বরফ ভাঙাই তার কাজ। হাতঘড়ি দেখল ও। ভোর চারটে। তারমানে জাহাজে ওঠার পর মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছে।

একসাথে একশো বজ্রপাতের সমান আওয়াজ ছিল সেটা, ঘুমটা তাতেই ভেঙেছে। এই মুহূর্তে অমন জোরাল শব্দ নেই, তবে। বরফের সাথে ইস্পাতের সংঘর্ষ অবিরাম চলছেই। ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি ফিরে আসছে, এই সময় দরজা খুলে টলতে টলতে ভেতরে ঢুকল অ্যাকটিং মেট বেন কাফম্যান। তার হাতে এক মগ। ধূমায়িত কফি।

এই আওয়াজের মধ্যে আপনি ঘুমাচ্ছেন দেখে দুবার আপনার পালস পরীক্ষা করে গেছি, মৃদু হেসে বলল সে। মানুষ। এতটা ক্লান্ত হতে পারে, আপনাকে না দেখলে বিশ্বাস হত না। তাল সামলাবার জন্যে দুপা ফাঁক করে দাঁড়াল সে, খালি হাতটা বাল্কহেডের কিনারা আঁকড়ে ধরে আছে। পরবর্তী ধাক্কা লাগার আগে একটু গিলে ফেলুন।

ধন্যবাদ। মগটা নিয়ে সাবধানে চুমুক দিল রানা, মনে হলো জিভের ছাল তুলে নিয়ে গলা দিয়ে নেমে গেল তরল আগুন। আমার বন্ধুদের খবর কি? কমরেড রুস্তভ কেমন আছেন?

হয় জেগে আছেন নাহয় মারা গেছেন, সকৌতুকে বলল কাফম্যান। ওঁদের পালস পরীক্ষা করার সুযোগ আমার হয়নি। ভেতর থেকে বন্ধ করে রেখেছেন দরজা। রানা অনুমান করল। গোপন একটা কাজে ব্যস্ত রয়েছে নিয়াজ, তাকে সাহায্য করছে। বিনয়। আর ভি.আই.পি. প্যাসেঞ্জার কমরেড রুস্তভের জ্ঞান নেই। রানার চেহারায় উদ্বেগ ফুটে উঠতে দেখে হাসল সে। না, ভয়ের কিছু নেই। উনি প্রলাপ বকছিলেন, ঝামেলা এড়াবার জন্যে ক্যাপটেনের নির্দেশে আমাদের ডাক্তার তাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন।

প্রলাপ বকছিলেন মানে?

আমার টিউব, আমার টিউব করছিলেন, কি ছাই বলতে চান বোঝাতে পারছিলেন না…

আমি বুঝেছি, বিড়বিড় করে বলল রানা, অ্যাকটিং মেট শুনতে পেল না।

কাফম্যান বেশ লম্বা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, বয়স হবে চল্লিশের মত। প্রথম দৃষ্টিতে তাকে কঠোর প্রকৃতির মনে হলেও, ভাল করে তাকালে তার কালো চোখে কৌতুকের ঝিলিক লক্ষ করা যায়। লোকটাকে খুঁটিয়ে দেখার ফাঁকে আরেকবার মগে চুমুক দিল রানা। আমেরিকান কফি, ভারি কড়া।

দরজার কাছে ফিরে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল কাফম্যান, ঘুরল। সাবধান! ধাক্কা আসছে আবার! দরজার ফ্রেম আঁকড়ে ধরল সে। সামনে এগোচ্ছে আইসব্রেকার, এঞ্জিনগুলো প্রচণ্ড শক্তিতে গজরাচ্ছে। কেবিন দেয়ালের সামনেই বো। বো-র ঠিক সামনে কোথাও রয়েছে নিরেট বরফ। কালো পানি কেটে ইস্পাতের বো এগোচ্ছে। শূন্যে, সামনের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে রানা, মগটা অর্ধেক খালি; অপর হাতটা বাঙ্কের কিনারায়।

ধাক্কা দিল জাহাজ।

প্রবল ঝুঁকিতে মনে হলো ভেঙে সহস্র টুকরো হয়ে যাবে কেবিন। দরজার ফ্রেম থেকে হ্যাঁচকা টান খেয়ে কাফম্যানের হাত ছুটে গেল, কেবিনের ভেতর ছিটকে পড়ল সে। দেয়ালে মাথা ঠুকে যাচ্ছিল, কোমর পেঁচিয়ে ধরে তাকে নিজের দিকে টানল রানা। দুজনেই উপলব্ধি করল, নতুন জীবন পেল অ্যাকটিং মেট। রানার মনে হলো, বো ভেঙে যাচ্ছে, বেঁকে যাচ্ছে ইস্পাতের পাত, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ফোরিত দেয়াল দিয়ে হুড়মুড় করে ভেতরে। ঢুকে পড়বে জ্যান্ত বরফের সচল পাহাড়। যদিও মনে মনে জানে, সে-ধরনের কিছু ঘটতে পারে না। জাহাজ থামল, এঞ্জিনগুলো এখনও আক্রোশে গজরাচ্ছে। উল্টোদিকের বাল্কহেডে ছড়িয়ে। পড়েছে কফি, সেদিকে তাকিয়ে জানতে চাইল ও, আমরা কি আদৌ কোথাও যাচ্ছি?

এমন গতিতে, যাওয়া বলা হাস্যকর, দুহাতে বাল্কহেড জড়িয়ে ধরে হাঁপাচ্ছে কাফম্যান। ধন্যবাদ, মি. রানা। অসংখ্য। ধন্যবাদ।

হাত নেড়ে প্রসঙ্গটা চাপা দিল রানা।

প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এই কাণ্ড চলছে, বলল কাফম্যান। ঈশ্বর। জানেন এই অবস্থায় কিভাবে আপনার ঘুম হলো। পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান? নিরেট বরফের মাঝখানে আটকা পড়েছি আমরা। মুশকিল হলো, আমরা যে শুধু রাডার হারিয়েছি তাই নয়, ওটার সাথে অবজারভেশন কেজটাও হারিয়েছে। খাঁচার ভেতর মেট ছিল, সে-ও মারা গেছে-সেজন্যেই তো আমি অ্যাকটিং মেট। কেন্ রাসেল, বেচারা! আসলে অনেক উঁচুতে একজন লোক থাকা। দরকার, ঠিক কোন্ দিক থেকে বরফে ধাক্কা দেয়া উচিত হবে দেখার জন্যে। কিন্তু খাঁচাই নেই, কোথায় লোক পাঠাব!

কাপড় পরছে রানা। বরফ থেকে পিছিয়ে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছে জাহাজ। বুট আর পারকা পরে সিধে হলো ও। আবার কাঁপতে শুরু করল কেবিন। বরফের বজ্ৰ-আঁটুনি থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। টন টন নিরেট বরফ প্রতি মুহূর্তে খুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বো-র সামনে। ব্রিজে গিয়ে দেখি আমার কিছু করার আছে কিনা, বলল রানা। কাফম্যানের দিকে সরাসরি তাকাল ও। ব্যাপারটা কি আমার কল্পনা? নাকি সত্যি আমাদের আসতে দেখে খুশি হয়নি ক্রুরা?

কাফম্যানের চেহারা একটু ম্লান হলো। অস্বস্তি বোধ করল সে। ও-সব আপনি গ্রাহ্য করবেন না, গলার সুরে ইতস্তত ভাব। আসল কথা, ফেব্রুয়ারিতে এত উত্তরে আসতে চাননি ক্যাপটেন হ্যারি গোল্ডম্যান। গুজব, তাকে নাকি ওয়াশিংটন থেকে নির্দেশ দিয়ে বাধ্য করা হয়েছে। হঠাৎ কৌতুকে ঝিলিক দিয়ে উঠল তার চোখ। আপনারা যদি বরফের ওপর মারা যেতেন, আমাদের তাহলে এত ভেতরে ঢুকতে হত না-রাইট?

আপনারা তাহলে সেটাই কামনা করেছিলেন?

সবাই কি আর, দুএকজন করে থাকতে পারে, বলল কাফম্যান। ও কিছু না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

.

কিন্তু সব ঠিক হয়ে গেল না। ব্রিজের দিকে যাবার সময় নিজের চারপাশে বৈরী পরিবেশের আঁচ অনুভব করল রানা। শুধু অন্ধ একজন লোক এই শত্রুতা অনুভব করবে না। যে কজন নাবিককে পাশ কাটিয়ে এল, কেউ ওকে আসতে দেখেছে বলে মনে হলো না। তাগড়া এক যোয়ান, দৈত্যাকৃতি, হাঁটু গেড়ে বসে কম্প্যানিয়নওয়ের মেঝে পরিষ্কার করছে, আচমকা রানার পায়ের সামনে ঠক করে বসিয়ে দিল বালতিটা।

সরাও ওটা, হিগিন! অ্যাকটিং মেট ধমকে উঠল।

মুখ তুলে তাকাল দৈত্য। তোমাকে দেখতে পাইনি, কাফম্যান…, তাড়াতাড়ি বালতিটা সরিয়ে নিল সে। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় রানা ভাবল, আইসবার্গ অ্যালিতে পাঠানো হয়েছে। ওদেরকে, সেটাই ওদের রাগের একমাত্র কারণ হতে পারে না। এর পিছনে আরও কোন কারণ আছে। কাফম্যান তাকে সবকথা। বলেনি। কেন্ রাসেলের মৃত্যুর জন্যে দায়ী করা হচ্ছে ওকে-টীম লীডার মাসুদ রানাকে।

মর্মান্তিক কিছু দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, নিজেকে সাবধান করে। দিল রানা। আইসব্রেকারে যারা চাকরি করতে আসে তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই ক্রাইম রেকর্ড থাকে। হিংস্র, প্রতিশোধপরায়ণ, দুর্দান্ত প্রকৃতির লোক ছাড়া এই পেশায় কেউ আসে না। ক্যাপটেন হ্যারি গোল্ডম্যানের মন্তব্যও উৎসাহব্যঞ্জক নয়।

আপনার জায়গায় আমি হলে, কেবিন থেকে বেরুতাম না, মি. রানা। আপনার বিশ্রাম দরকার।

উঁচু ব্রিজ থেকে সামনের বরফ ভাল দেখা যায়। আরেকটা। ধাক্কা দেয়ার জন্যে চ্যানেল ধরে এগোচ্ছে আইসব্রেকার। চ্যানেলের যেটুকু অংশ বরফ-মুক্ত, তা যথেষ্ট চওড়া ছিল, পোলার প্যাকে আঘাত করার জন্যে জাহাজ ঘোরাতে অসুবিধে হয়নি। বরফ ভেঙে দক্ষিণ দিকে যেতে পারলে তবেই উদ্ধার। চ্যানেলের। শেষ মাথাটা এবড়োখেবড়ো, থেঁতলে আছে বরফ, কিন্তু এখনও অটুট-কিউটের বো আবার আঘাত করতেও সেখানে কোন। ফাটলের সৃষ্টি হলো না।

রেইল থেকে দস্তানা পরা হাত তুলে ক্যাপটেনের দিকে। তাকাল রানা। বছরের এই সময়ে বরফ বাড়তেই থাকবে। তাড়াতাড়ি বেরুতে না পারলে বসন্ত পর্যন্ত আটকা পড়ে থাকব…

আপনি আমাকে জ্ঞানদান করছেন? ক্যাপের নিচে ক্যাপটেনের কাঁচাপাকা ভুরু প্রজাপতির ডানার মত নেচে উঠল। জাহাজ আর ক্রুদের নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়ে শুধু আপনাদের জন্যে এখানে আসতে হয়েছে আমাকে। দয়া করে কোন ব্যাপারে নাক গলাতে আসবেন না।

পাল্টা ঝাঁঝ দেখাতে পারে রানা, বলতে পারে আপনাদেরই একটা উপকার করে দিচ্ছি আমরা, কিন্তু তাতে শুধু সময়েরই অপচয় ঘটবে। সম্পূর্ণ শান্ত থাকল ও, কিন্তু কণ্ঠস্বরে দৃঢ় একটা ভাব ফুটে উঠল, ওপরে কোথাও একজন লোক রাখা দরকার আপনার, ক্যাপটেন। অন্তত আশি ফিট উঁচুতে। সে আপনাকে গাইড করবে, বলে দেবে বরফের কোথায় আপনি আঘাত করবেন। ধাক্কা দেয়ার পর কোথাও যদি সামান্য চিড় ধরে, একমাত্র সে-ই দেখতে পাবে…

আসুন আমার সাথে! রানার কথা শুনে ক্যাপটেনের রাগ যেন আরও এক ডিগ্রী বাড়ল। জাহাজ থামাবার নির্দেশ দিয়ে ব্রিজের পিছনে বেরিয়ে এলেন তিনি। পিচ্ছিল মই, ধাপগুলো থেকে খানিক আগে বরফ পরিষ্কার করা হয়েছে। ডেকে অনেক মানুষ, কোদাল দিয়ে বরফ তুলে জাহাজের বাইরে ফেলছে। রানা দেখল, কিউটের সিকোরস্কি ল্যান্ড করার জন্যে ফিরছে। রুশদের ওপর চোখ বুলিয়ে এল, ক্যাপটেন বললেন। আপনি যেমন পরামর্শ দিয়েছিলেন। আধ ঘণ্টা আগে একটা সাব-কিলার ওদেরকে তুলে নিয়েছে। বিশাল মাস্তুলের গোড়ায় এসে দাঁড়াল ওরা। নজর ফেলে দেখুন, বাঘের মত গরগর করে উঠলেন ক্যাপটেন।

বিশাল কাঠামোটা খাড়াভাবে ওপর দিকে উঠে গেছে, চাঁদের আলোয় সবটুকু দেখা গেল। থামের ডগা এবড়োখেবড়ো আর ভাঙা, কিন্তু ক্রস-ট্রী অক্ষত রয়েছে। এত নিচে থেকেও বোঝা গেল, ক্রস-ট্রীর গায়ে বরফের আবরণ জমেছে। দুজন নাবিক বরফের প্রকাণ্ড একটা চাই ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ সেটা ফেলে দিল। সময় মত সরিয়ে না নিলে রানার ডান পা ছাতু হয়ে। যেত। ফের করো, গর্জে উঠলেন হ্যারি গোল্ডম্যান, তোমাদের আমি কয়েদ করব। যাও, পোর্ট সাইডে নিয়ে গিয়ে ফেলো। ওটাকে। ক্রুরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন, তারপর গম্ভীর সুরে বললেন, রাসেলকে ওরা সবাই ভালবাসত।

আর, তার মৃত্যুর জন্যে আমাকে দায়ী করছে ওরা।

তা আমি বলিনি! এবার, ফর গডস সেক, মাস্তুলটা দেখুন! আপনি তো বলেই খালাস, কোন মানুষকে ওখানে উঠতে বলা যায়?

মাস্তুলের গা ঘেঁষে একটা ধাতব মই ওপর দিকে উঠে গেছে, প্রতিটি ধাপ বরফে মোড়া, চাঁদের আলোয় চকচক করছে। মাস্তুলের গোটা কাঠামো থেকে বরফের ঝুরি নেমে এসেছে, সবচেয়ে লম্বা ঝুরিটা নেমে এসেছে ক্রস-ট্রীর ডগা থেকে। ডেক থেকে মাস্তুলটাকে বরফের তৈরি একটা থামের মত লাগল। এটা। বেয়ে কারও পক্ষে ওপরে ওঠা সম্ভব নয়।

বলেছি ওপরে একজন লোক থাকা দরকার, কাউকে পাঠাতে বলিনি, জবাব দিল রানা। আমি নিজেই ওখানে উঠতে পারি। আমাকে আটকে রাখার জন্যে লেদার স্ট্রাপ দরকার, মাস্তুলকে ঘিরে থাকবে ক্যানভাস প্যাড, আর ব্রিজের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্যে একটা টেলিফোন সেট…

আর আপনার লাশ দেশে পাঠাবার জন্যে একটা কফিন, রানার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কে যেন বলল পিছন থেকে।

ও শেরম্যান, কপ্টারের পাইলট, একটু ভারী গলায় বললেন ক্যাপটেন।

রানা জাহাজে ওঠার পর এই প্রথম একজন লোক সৌজন্য দেখিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল। একহারা চেহারা, শেরম্যানের বয়স হবে রানারই মত। কথার খেই ধরে আবার বলল সে, আপনার তো বরফে থাকতেই মরে যাওয়ার কথা ছিল, মি. রানা। দৈবাৎ যখন বেঁচেই গেছেন, জাহাজ কুইবেকে না পৌঁছুনো পর্যন্ত কেবিনেই বন্দী থাকুনগে। একদিন না একদিন সেখানে আমরা পৌঁছুবোই।

চেহারায় অকারণ আক্রোশ নিয়ে মাস্তুলের দিকে তাকিয়ে আছেন ক্যাপটেন। মানলাম ওখানে একজনের থাকা দরকার, কিন্তু থুথু ফেলা ছাড়া আপনি ওখানে কি কাজে আসবেন?

কিউটের সিসটার শিপ ফ্রাংকেনস্টাইনে এই কাজই করেছিলাম, জবাবে বলল রানা। বাফিন বে-র উত্তরে, বছর তিনেক আগে। স্মিথ সাউন্ডে যাবার চেষ্টা হচ্ছিল, এই একই সমস্যায় পড়ে যায়-সামনে নিরেট বরফ। এলাকাটা আমি চিনি, কাজেই গাইড করে এগিয়ে নিতে আমার অসুবিধে হয়নি।

বিব হাডসনের জাহাজ ওটা। নতুন দৃষ্টিতে রানার দিকে তাকালেন ক্যাপটেন হ্যারি গোল্ডম্যান। মাত্র এক সেকেন্ড, তারপরই চোখ ফিরিয়ে মাস্তুলে চোখ তুললেন। মাস্তুলে আগেই প্যাড জড়ানো হয়েছে, টেলিফোন বক্সও তোলা হয়েছে-আইসফিল্ডে নজর বুলাবার জন্যে কাফম্যান একবার উঠেছিল। কিন্তু প্যাকে ধাক্কা দেয়ার আগে ওকে নামিয়ে আনি।

হ্যাঁ, বব হাডসনই তখন ফ্রাংকেনস্টাইনের ক্যাপটেন ছিলেন, শুকনো গলায় বলল রানা। পরে তিনি আমাকে একটা। সার্টিফিকেট দেন, লোকে যাতে বিশ্বাস করে স্মিথ সাউন্ডে আমার। চেয়ে ভাল গাইড আর কেউ নেই। রেডিও জ্যামিঙের ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে সরে যাওয়া দরকার আমাদের।

কমরেডদের মেজাজ খারাপ থাকলে এই-ই করে। জাহাজ যখন বরফে ধাক্কা দেবে, মাস্তুলের ডগায় কেউ থাকলে কি অবস্থা। হবে তার, আপনি জানেন? জেনেশুনে আপনাকে আমি মরতে। পাঠাব?

ডেকের চারদিকে তাকাল রানা। ক্রুরা শাবল দিয়ে বরফ ভাঙছে, কোদাল দিয়ে সেই বরফ ফেলছে জাহাজের বাইরে। যার। সাথেই চোখাচোখি হলো, ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে নিল সে। থাে করে থুথু ফেলল এক লোক, ক্যাপটেন তার দিকে কটমট করে তাকাতেই নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। মরলে, ক্ষীণ একটু হেসে বলল রানা, অন্তত আপনার লোকেরা কেউ দুঃখ পাবে না।

.

তিন ঘণ্টার ঘুমে ক্লান্তি দূর হয়নি, সারা শরীর ব্যথা করছে রানার। বরফ মোড়া মই বেয়ে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উঠতে শুরু করল ও। উঠে যাচ্ছে মানুষ নয়, যেন কাপড়ের একটা বস্তা, লেদার চেস্ট-স্ট্র্যাপ পেঁচিয়ে রেখেছে শরীরটাকে। দ্বিতীয় স্ন্যাপ-ক্লিপ স্ট্র্যাপ দিয়ে। মাস্তুলকে জড়িয়ে বাঁধা হবে, সেটা ঝুলছে। ফার হুডের নিচে ঠিক। জায়গামত বসিয়ে নেয়া হয়েছে টেলিফোন হেডসেট। ওর নিচে, ডেকে দাঁড়ানো লোকগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। দশ মিনিট আগের শত্রুতার পরিবেশ একটু যেন বদলে গেছে। কাজ থামিয়ে ওপর দিকে তাকিয়ে আছে ওরা, বিপজ্জনক মই বেয়ে উঠে যেতে দেখছে রানাকে। দ্বিতীয়বার ডেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে পরিবর্তনটা লক্ষ করেছিল রানা, অবজ্ঞার সাথে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।-যা খুশি ভাবুক শালারা।

ডেক থেকে বিশ ফুট উঠে থামল ও, বুটের আঘাতে বরফ ভাঙতে গেল। পিছলে গেল পা, দস্তানা পরা হাত একটা ধাপ শক্ত করে ধরে আছে। বুটের প্রচণ্ড লাথি খেয়েও বরফ ভাঙল না। শক্ত বরফের তৈরি মই বেয়ে উঠছে ও। আবার উঠতে শুরু করে অনুভব করল, সাব-জিরো টেমপারেচার দুজোড়া দস্তানা ভেদ করে আঙুলে কামড় বসাচ্ছে। মুখে হিম বাতাসের ঘ্যাঁকা খাওয়া। বন্ধ হয়েছে, ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে গেছে চামড়া আর পেশী। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে, পানি গড়াচ্ছে দুই কোণ থেকে। মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি। গলায় এমন ঠাণ্ডা লাগছে, যেন ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে বাতাস।

যত ওপরে উঠল রানা নির্দয় শীত ততই ওর স্বাভাবিক শক্তি কেড়ে নিতে থাকল। জ্যান্ত, কিন্তু থেমে থাকা এঞ্জিনের একঘেয়ে আওয়াজ কখনও শুনছে কখনও শুনছে না। বো-র ওপর ফিট করা সার্চলাইটের আলো কখনও দেখছে কখনও দেখছে না। দক্ষিণে বরফের বিস্তারকে এই মনে হলো চুনকাম করা দেয়াল, তারপরই মনে হলো গুলি খাওয়া পাখির সাদা পালক।

চল্লিশ ফিট উঠেছে, চেস্ট-স্ট্র্যাপ থেকে ঝুলে পড়া স্ন্যাপ-ক্লিপ একটা ধাপে আটকে গেল। উঠে যাচ্ছে রানা, জানে না কি ঘটছে। নিচের ধাপে এক পা, আরেক পা ওপরের ধাপে উঠছে, আচমকা শূন্যে ঝুঁকি খেলো শরীর। ভারসাম্য ক্ষুন্ন হলো, তাল হারিয়ে ফেলল রানা। ওপরের ধাপে পৌঁছুল না পা, নিচের দিকে হঁাচকা। টান খেলো শরীর। নেমে এল বুট, নিচের একটা ধাপ ছুঁই ছুঁই করল, কিন্তু ছুঁলো না। আরেক ধাপ থেকে হড়কে গেল দ্বিতীয় পা। খসে পড়ল শরীর।

ডেক থেকে চল্লিশ ফিট ওপরে ঝুলে থাকল রানা, শুধু হাত। দিয়ে ধরে আছে বরফ মোড়া মই। পিচ্ছিল, মসৃণ বরফ, দস্তানাপরা হাত স্থির হতে পারল না। পা দুটো শূন্যে এলোপাতাড়ি ঝাঁকি খেলো, চোখে না দেখে ধাপের স্পর্শ পেতে চাইল ও। মুঠো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বরফ। আতঙ্কের হিম শীতল ঢেউ বয়ে গেল। শিরদাঁড়া বেয়ে। মই থেকে একটা হাত খসে গেল। পলকের জন্যে নিচের ডেক দেখতে পেল রানা। খুদে শরীরগুলো পাথর বলে ভুল হয়। দ্বিতীয় হাতটাও খসল, তবে শরীরটা নিচে নামতে শুরু করার আগেই একটা ধাপে ডান পা ঠেকল। দ্বিতীয় হাত আবার আঁকড়ে ধরল মই। ডান পায়ের ওপর শরীরের সমস্ত ভার চাপিয়ে বাঁ পাটাকেও আরেক ধাপে তুলল ও। দম নেয়ার জন্যে থেমে আছে। নিচের দিকে আরেকবার তাকাল। মূর্তিগুলো এক চুল নড়ছে না এখনও। ডেকের প্রতিটি মানুষ মুখ তুলে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হার্টবিট স্বাভাবিক হয়ে আসতেই আবার উঠতে শুরু করল ও।

ডেক থেকে আশি ফিট উঠে আবার থামল রানা। ইস্পাতের মই ক্রস-ট্রীর ঠিক নিচেই শেষ হয়েছে। ক্রস-ট্রী পেরিয়ে যেতে হবে ওকে, পেরিয়ে গিয়ে ওটার দুপাশে পা ঝুলিয়ে বসতে হবে, তারপর আরও ওপরে উঠে যাওয়া মাস্তুলের গায়ে বাধতে হবে চেস্ট-স্ট্র্যাপ। কোন ট্র্যাপ-ডোর নেই, কাজেই ক্রস-ট্রীকে পাশ কাটিয়ে উঠতে হবে ওকে। ঝুঁকিটা নেয়ার আগে হাত উঁচু করল রানা, ক্রস-ট্রীর ওপর দিকটা মুড়ে থাকা ক্যানভাস প্যাড পরীক্ষা করল। হাতের ছোঁয়ায় প্যাড ঘুরে গেল, তারমানে স্থির হয়ে বসার সুযোগ মিলবে না।

ক্রস-ট্রী পেরোতে দশ মিনিট লেগে গেল। দুই উরুর মাঝখানে থাকল মাস্তুল, দ্বিতীয় স্ট্রাপটা মাস্তুলের চারদিকে জড়িয়ে বাঁধা হলো। টেলিফোন বক্স আগেই তোলা হয়েছে, বক্সে টারমিনালগুলো জোড়া লাগানো হলো। হঠাৎ অনুভব করল রানা, কাপড়ের ভেতর ঘামের ধারাগুলো সড় সড় করে নামছে। গালে হাত দিতেই বরফের কুচি ঠেকল আঙুলে, হিম বাতাসে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমাট বেঁধে গেছে। ব্রিজের সাথে যোগাযোগ করার আগে চারদিকে তাকাল রানা।

হুড খানিক তুলে কান দুটো বের করল ও। না, কল্পনা নয়। চারপাশের বরফে ভৌতিক তর্জন-গর্জনের আওয়াজ। যেন রাগে অন্ধ দানবকুল দাঁত কিড়মিড় করছে। তার সাথে শোনা গেল গুরুগম্ভীর ভরাট শব্দ, যেন আগ্নেয়গিরি থেকে উথলে বেরিয়ে আসছে জ্যান্ত লাভা। কিউটের আধ মাইল দূরে ব্যাপক আলোড়ন চোখে পড়ল। এত উঁচু আর দূর থেকে পাঁচিলগুলোকে নিচু দেখাচ্ছে-সচল পাঁচিল, একটার মাথায় চড়ছে আরেকটা, আরও উঁচু হয়ে ঢেউয়ের মত সরে যাচ্ছে কিউটের কাছ থেকে দূরে, দক্ষিণ দিকে। রানা তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কালো ফিতের মত সরু জলরেখা টলটল করে উঠল, চওড়া হয়ে সরে যাচ্ছে দূরে। বরফের তুমুল আলোড়ন মুহূর্তের জন্যে থামছে না। ঠোকাঠুকি, ফাটাফাটি, ধাক্কাধাক্কি, ছুটোছুটি চলছে তো চলছেই। সেইসাথে চওড়া হতে হতে এগিয়ে চলেছে সরু ফাটলটা। মন্থরগতি, কিন্তু থেমে নেই। দূর অন্ধকার একটা রেখা, সাগর বলে চেনার উপায় নেই, সেদিকেই যাচ্ছে ওটা। বরফ ভেঙে ওই ফাটলে পৌঁছুতে হবে কিউটকে।

শরীরটা ঘোরাল রানা, মাস্তুলের সাথে আটকানো চেস্ট-স্ট্র্যাপ। ওকে খসে পড়তে দিল না। জাহাজের পিছন দিকে তাকাল ও। পিছনে আধ মাইল চওড়া খোলা চ্যানেল। চ্যানেলের শেষ মাথায় রুশ হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ দেখা গেল। ওটাতে চড়েই দলবল নিয়ে কিউটে পৌচেছে রানা। ইচ্ছে করেই কিউটের বো-র নিচে ল্যান্ড করেছিল ও, বাকি কাজটা ক্যাপটেন গোল্ডম্যান। সারেন। জাহাজ খানিকটা পিছিয়ে আসে, তারপর ছুটে গিয়ে ধাক্কা দেয় বরফের উঁচু প্ল্যাটফর্মে। কিনারায় ছিল সাব-কিলার, একেবারে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যায় সেটা।

কিন্তু রুশ হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ নয়, রানা তাকিয়ে। আছে আরও দূরে। মাথাটা ঘুরে উঠল ওর।

উত্তরে প্রবাহিত হতে শুরু করা বাতাসে ভর দিয়ে জাহাজের দিকে এগিয়ে আসছে কালো একটা পর্দা। ভাল করে তাকালে বোঝা যায়, গাঢ় বাস্প। আই.আই. ফাইভ যে কুয়াশায় ঢাকা। পড়েছিল, তার সাথে এর কোন মিল নেই। নিচ্ছিদ্র কালো পাঁচিল, কয়েকশো ফিট উঁচু, জাহাজের দিকে এগিয়ে আসছে। আর্কটিকের ভয়াবহ যতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে, এটা তার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক। আর্কটিকে বার কয়েক এলেও, এই বিপদের মধ্যে আগে রানাকে পড়তে হয়নি। এ-ও কুয়াশা, তবে হিমেল আবহাওয়ায় জমাট বেঁধে গেছে। আবহাওয়ার এই বিপজ্জনক রূপ আর্কটিকে কদাচ দেখা যায়, আক্রান্ত মানুষ ফ্রস্ট বাইটের শিকার হতে পারে। মাস্তুলের মাথা থেকে নামার আগেই যদি এসে পড়ে কুয়াশা, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মারা যাবার ভয় আছে। এরই মধ্যে প্রেশার রিজ জোন ঢেকে ফেলতে শুরু করেছে।

ক্যাপটেন! রিভার্স হার! চিবুকের কাছে ঝুলে থাকা মাইকে দ্রুত কথা বলল রানা।

ক্যানভাস প্যাডে মোড়া মাস্তুল আঁকড়ে ধরল ও। এঞ্জিনের শক্তি বাড়তে লাগল। ঝুঁকি খেলো জাহাজ, পিছনের গাঢ় পানি কেটে পিছু হটছে। যা ভয় করেছিল তা ঘটল না-কোন ঝুঁকি না, শুধু মৃদু একটা দোল অনুভব করল ও। দুপাশ থেকে পিছিয়ে গেল আইসফিল্ড, গাঢ় পানি দেখা গেল। তারপর ধীরে ধীরে মন্থর হলো কিউটের গতি, থামল। কি আসছে জানে রানা, তলপেটের পেশী শক্ত হয়ে উঠল। তর তর করে নিচে নামার ঝোকটাকে দমন করে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করল ও। নির্দেশ দিল, হাফ স্পীড! ফরওয়ার্ড!

ও কে, মি. রানা, হিয়ার উই গো। হোল্ড অন টাইট।

মাস্তুলটাকে আপন সন্তানের মত বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করল রানা, মাথাটা একপাশে সরিয়ে রেখেছে, ধাক্কা খাওয়ার জন্যে তৈরি। এঞ্জিনের পাওয়ার বাড়ল, কাঁপুনিটা উঠে এল মাস্তুল বেয়ে। সামনে এগোল কিউট। অনেক নিচে, উল্টোদিকে ছুটল আইসফিল্ড। জলরেখা ক্রমশ সরু হয়ে এল। সেদিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রানা, জানে, জলরেখা মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে নিরেট বরফে ধাক্কা খাবে জাহাজ।

সংঘর্ষের আওয়াজ আর ধাক্কা একসাথে এল। প্রচণ্ড ঝাঁকি খেলো গোটা জাহাজ, শরীরে ঘন ঘন হাতুড়ি বাড়ি খেলো রানা। ক্যানভাস প্যাড ছিল বলে, তা না হলে রানার কাঁধ আর বুকের হাড় পাউডার হয়ে যেত। জাহাজের কাঁপুনির সাথে ধীরে ধীরে। মাস্তুলের কাঁপুনিও কমে এল। ধাক্কা দিয়ে স্থির হয়ে গেল। আইসব্রেকার। বরফে গেঁথে আছে।

পেশী ঢিল করল রানা, সামনে তাকাল। জাহাজের বো-র সামনে একটা ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু লম্বায় মাত্র কয়েক ফিট। ফাটলের দুপাশে তাকাল রানা, আশা, আরও হয়তো কোথাও চিড় ধরেছে।

না।

হঠাৎ খেয়াল হলো, ক্যাপটেন কিছু বলছেন। এক হাতে মাস্তুলটা আরও শক্ত করে ধরল রানা, সামনের দিকে ঝুঁকে আধ। মাইল দূরে তাকাল। আগের সেই ফাটলটা আরও চওড়া হচ্ছে। গলায় উদ্বেগ নিয়ে আবার ওকে ডাকলেন ক্যাপটেন। মি. রানা, শুনতে পাচ্ছেন? আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?

ঠিক আছি আমি। প্রথমবার তেমন কাজ হয়নি। পারলে একই জায়গায় আবার আঘাত করতে হবে।

রিভার্স?

হ্যাঁ।

এঞ্জিনের শক্তি বাড়তে লাগল। মাস্তুলের ডগায় বসে অনুভব। করল রানা, বরফ ছিড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে আইসব্রেকার। প্রচণ্ড ধাক্কায় ফাঁক হয়ে গেছে বরফ, জাহাজের বো-কে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে চারদিক থেকে চেপে বসে আটকে ফেলেছে ওটাকে। সব কটা এঞ্জিনের সমস্ত শক্তি দিয়ে পিছু হটার ব্যর্থ চেষ্টা করল কিউট। ধীরে ধীরে এঞ্জিনের গর্জন কমে এল। একটু পর দ্বিতীয়বার বাড়তে শুরু করল। রানার মনে হলো এবারও ব্যর্থ হয়েছেন ক্যাপটেন, এই সময় বরফের কঠিন থাবা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল জাহাজ। বো-র কাছে নিরেট বরফ বিস্ফোরিত হলো, এঞ্জিনের আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল বিস্ফোরণের শব্দ। পিছু হটছে জাহাজ, পোর্ট সাইডের বরফে গাঢ় রঙ লেগে রয়েছে।

পিছন দিকে তাকাল রানা। গোটা প্রেশার রিজ এলাকা ঢেকে ফেলার কাজ শেষ, সমতল বরফের বিস্তারকে গ্রাস করতে আসছে। কুয়াশা। খুব বেশি দূরে নেই, জাহাজ ঢাকা পড়ে যাবে। কিউট না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করল ও। তারপর নির্দেশ দিল, হাফ স্পীড! ফরওয়ার্ড!

ক্যাপটেন এবার চ্যানেল ধরে আগের চেয়ে বেশি পিছিয়ে এসেছেন, বরফের গায়ে ধাক্কা দেয়ার সময় গতি যাতে বেশি পাওয়া যায়। প্যাড মোড়া মাস্তুলকে আলিঙ্গন করল রানা। আধবোজা হয়ে আছে চোখ, নিচের দিকে দৃষ্টি। ক্রমশ সরু হয়ে আসছে জাহাজের দুপাশে জলরেখা। রানা জানে না, ডেকে বেরিয়ে এসেছে নিয়াজ আর বিনয়, আতঙ্কে বিকৃত চেহারা নিয়ে ওপর দিকে মুখ তুলে রয়েছে দুজনেই।

জলরেখা অদৃশ্য হলো। মাস্তুলের সাথে গাছের পাতার মত কেঁপে উঠল রানা। এবার আগের চেয়ে জোরে বরফের গায়ে হুমড়ি খেয়েছে জাহাজ।

এভাবে একের পর এক আঘাত হানা হলো। জায়গা বদল করল রানা, বরফ ভাঙার জন্যে জাহাজটাকে ব্যক্তিগত হাতুড়ির মত ব্যবহার করল। আধ ঘণ্টা চলল এভাবে। তারপর মনে হলো, কিছু একটা ঘটছে। চিড় ধরতে শুরু করেছে বরফে, আঁকাবাঁকা গাঢ় রেখা ফুটছে গায়ে।

ঘটনা আরও ঘটছে। অনুভূতি ভোতা হয়ে এল রানার। এক। দুই পল ভ্রান্তির ঘোরের মধ্যে থাকছে, ভুলে যাচ্ছে কোথায় সে, কি করছে এখানে। অসহ্য ঠাণ্ডাই আসল কারণ। ক্ষত-বিক্ষত হয়ে। উঠেছে মুখের চামড়া, ক্যানভাস প্যাডে বারবার ঘষা খাওয়ার ফল। ওদিকে, কালো পর্দা দ্রুত এগিয়ে আসছে। এই কুয়াশা ওকে মেরে ফেলার আগে বরফ ভেঙে বেরিয়ে যেতে হবে ওদের। রিভার্স, ক্যাপটেন! কর্কশ গলায় মাইকে চিৎকার করল রানা। এবার একেবারে চ্যানেলের শেষ মাথায় নিয়ে চলুন।

পিছু হটল জাহাজ। খুব বেশি পিছনে চলে এল। কালো কুয়াশার একটা বাহু কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে, যেখানে রুশ। সাব-কিলার চ্যাপ্টা হয়েছিল। বাহুটা ওপর দিকে উঠে এসে। মাস্তুলের মাথা পেঁচাতে শুরু করল। দেখতে পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেল নিয়াজের। রেইল ধরে কাপতে লাগল সে, ভয়ে নয়, রাগে। কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে অভদ্র ভাষায় চিৎকার করে উঠল, ইউ স্টুপিড ইডিয়ট-গেট হার মুভিং! রানা কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে! কোন আরোহী ক্যাপটেনের সাথে এভাবে কথা বলে না।

হঠাৎ করেই রানার চারপাশের জগৎ ছোট হয়ে গেল। অন্ধকারে অদৃশ্য হলো সব। আইসফিল্ড গায়েব হলো, নিখোঁজ হলো নিচের পানি, হারিয়ে গেল ডেক। জাহাজ সামনে এগোল, কিন্তু আগেই এগিয়ে গেছে কুয়াশা, ফলে বেরিয়ে আসা গেল না। পেট আর বুকের সাথে মাস্তুল জড়িয়ে ধরল ও, শ্বাস টানল বড় করে। বাতাসের সাথে ভারী, নোংরা, হিম ঠাণ্ডা কুয়াশা ঢুকল ফুসফুসে। বুকের ভেতর অদ্ভুত একটা কষ্ট অনুভব করল ও, মনে হলো ভেতরটা যেন তরল বরফে ভরাট হয়ে গেছে। বাতাসের জন্যে ছটফট করতে লাগল। মনে হলো, সারা শরীরে ভারী কি যেন চেপে বসছে, মাস্তুলের মাথা থেকে পড়ে যাচ্ছে ও। এগিয়ে চলেছে জাহাজ, হঠাৎ করে কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রানা। নিজের অজান্তে বন্ধ হয়ে যাওয়া চোখ দুটো খুলল ও। পারকার গায়ে রাশ রাশ বরফ কুচি দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। বরফের আবরণ ঢেকে ফেলছে ওকে।

মি. রানা, আপনি কথা বলুন, মি. রানা আপনি…, অস্থির ক্যাপটেন মুহূর্তের জন্যে থামছেন না।

শান্ত হোন। এবারের ধাক্কায় কাজ হবে। দম নেয়ার জন্যে থামল রানা। যে ফাটলটা আমরা তৈরি করেছি তার পঞ্চাশ গজ এদিকে, পোর্ট সাইডের বরফে গুঁতো মারবেন। কি চাইছি বুঝতে পারছেন?

ফাটলের পঞ্চাশ গজ এদিকে! ক্যাপটেনের মনে হলো রানার কথা ভুল শুনেছেন তিনি।

হ্যাঁ। পোর্ট সাইড! পঞ্চাশ গজ! জাহাজকে আমি ধাক্কা খাইয়ে ফিরিয়ে আনতে চাইছি স্টারবোর্ডের একটা ফাটলের মুখে। ফুল পাওয়ার!

ফুল পাওয়ার! আপনাকে আমি খুন করব…

পাল্টা ধমক দিল রানা, প্রলাপ বকবেন না। বজ্জাত জাহাজটাকে রেসের ঘোড়ার মত ছোটান। ফুল পাওয়ার!

ও কে! এ আপনার…সিদ্ধান্ত! শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন ক্যাপটেন, সিদ্ধান্তের জায়গায় মরণ ব্যবহার করতে যাচ্ছিলেন।

রেসের ঘোড়ার মত টগবগিয়ে সামনে ছুটল কিউট। এর আগে এঞ্জিনের এমন দুনিয়া কাঁপানো আওয়াজ শোনা যায়নি। গাঢ় পানি। দুপাশে সরিয়ে দিয়ে, বোর ধাক্কায় পানিতে ঢেউ তুলে, পরবর্তী ধাক্কা মারতে যাচ্ছে ব্যারিয়ারে। অদ্ভুতই বলা যায় রানার প্ল্যান, এ-ধরনের কৌশল সাধারণত কেউ কাজে লাগায় না। দ্রুতগতি জাহাজ সমস্ত ওজন সহ পোর্ট সাইডের নির্দিষ্ট একটা পয়েন্টে আঘাত হানবে, নিরেট বরফে ধাক্কা খেয়ে কিউটের নাক বৃত্ত রচনার ভঙ্গিতে ঘুরতে শুরু করবে। অর্ধবৃত্ত সম্পূর্ণ হবার আগেই স্টারবোর্ড সাইডের নির্দিষ্ট একটা বরফ টুকরোর সাথে সংঘর্ষ হবে। বো-র। এই কৌশল ছাড়া সরাসরি বা অন্য কোনভাবে টুকরোটার নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। এই টুকরোর ওপরই রয়েছে আঁকাবাঁকা রেখা, বহুদূর লম্বা হয়ে মিশেছে গিয়ে ক্রমশ চওড়া হতে থাকা ফাটলে।

মাস্তুলের ডগা থেকে ক্যাপটেনকে গাইড করছে রানা। পোর্ট সাইডের নির্দিষ্ট একটা পয়েন্টে ধাক্কা না লাগলে সব ভেস্তে যাবে, কারণ তা না হলে স্টারবোর্ডের টুকরোটার ঠিক জায়গায় বো-র। গুঁতো লাগবে না। ডেকে ইতিমধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সমস্ত লোককে ডেক থেকে সরে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন। ক্যাপটেন। সর্বশক্তিতে ছুটে গিয়ে আঘাত খাবে আইসব্রেকার, খোলা ডেকে থাকা মানে ছিটকে পানিতে পড়া, নাহয় রেইলের সাথে বাড়ি খেয়ে মাথা ফাটানো।

ব্রিজে উঠে এসেছে নিয়াজ, জানালা দিয়ে মাথা বের করে ওপর দিকে তাকিয়ে আছে। ক্রস-ট্রীর ওপর খুদে মূর্তিটাকে রানা বলে চেনা যায় না। ফুল পাওয়ার!-ক্ষমতা থাকলে ক্যাপটেনের নির্দেশ বাতিল করে দিত সে।

মাস্তুলের ডগা থেকে পোর্টের দিকে তাকিয়ে আছে রানা। বরফের শক্ত স্তর জমেছে ওর কাপড়চোপড়ে, স্তরটা আরও মোটা হচ্ছে। ক্যাপটেনকে শেষ নির্দেশ দিল ও, যদি দেখেন জাহাজ থামছে না, থামাবার দরকার নেই। চিড় ধরা বরফ গুঁড়িয়ে গিয়ে পথ করে দিতে পারে। প্রতি মুহূর্তে জাহাজের গতি বাড়ল। বরফের তর্জন-গর্জন চাপা পড়ে গেল এঞ্জিনের একটানা হুঙ্কারে। অসুস্থ বোধ করল রানা। বারবার শুধু নিজেকে মনে করিয়ে দিল, মাস্তুলটাকে শক্ত করে ধরে রাখতে হবে। ধাক্কাটা এই সময় লাগল।

পোর্ট সাইড ব্যারিয়ারে তির্যকভাবে আঘাত করল কিউট। ব্যারিয়ার যেন পাল্টা ধাক্কা দিয়ে ফিরিয়ে দিল জাহাজকে, প্রচণ্ডবেগে ছুটে এসে স্টারবোর্ড সাইডে বাড়ি খেলো বো। রানার নির্দেশে ক্যাপটেন তার জাহাজটাকে বিশাল একটা বিলিয়ার্ড বল হিসেবে ব্যবহার করেছেন-মেরেছেন যেদিকে, তার ঠিক উল্টোদিকে যেন আঘাত করে বল, চিড়গুলোর কাছাকাছি। এঞ্জিনের শব্দকে ছাপিয়ে অন্য একটা আওয়াজ শোনা গেল, ভাঙচুরের পালা শুরু হয়েছে। পিছনের কয়েক হাজার টন শরীর নিয়ে বরফের ওপর চড়াও হয়েছে বো, সমস্ত বাধা গুঁড়িয়ে দিয়ে হেলেদুলে সামনে ছুটতে চায়।

মাস্তুলের ওপর রানা ওদিকে মরতে বসেছে। চাবুকের মত সপাং সপাং আওয়াজ তুলে এদিক ওদিক দুলছে মাস্তুল, যে-কোন মুহূর্তে গোড়া থেকে মট করে ভেঙে যাবে বলে মনে হলো। মাত্র। কয়েক সেকেন্ড সহ্য করতে পারল রানা, তারপর সমস্ত উঁশ-জ্ঞান লোপ পেল ওর। অবিশ্বাস্য গতিতে নুয়ে নুয়ে পড়ছে মাস্তুল, একবার এদিক, একবার ওদিক। রানার পেশীতে কোন জোর। থাকল না, মনে হলো ঝাঁকি খেয়ে মাথার ভেতর মগজটুকু আকৃতি। বদল করেছে। দাঁতগুলো ফুটো তৈরি করে বেরিয়ে আসতে চাইল মুখের বাইরে। হাত-পা খুলে আসতে চাইল শরীর থেকে।

প্রাণপণ চেষ্টা করার পর চোখ একটু খুলতে পারল রানা। হাত। দুটো এখনও মাস্তুল জড়িয়ে রয়েছে। সব কিছু ঝাপসা দেখল ও। জাহাজ থেমে রয়েছে নাকি চলছে বোঝা গেল না। নিচের দিকে। তাকিয়ে বিশাল একটা ফাটল দেখতে পেল। চোখ আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে আসছে, এই সময় বুকের কাছে ঝুলে থাকা মাইকটা চোখে পড়ল। নিজের অজান্তেই কথা বলে উঠল ও, চালিয়ে যান, ক্যাপটেন, থামবেন না! মুখের ভেতর লোনা স্বাদ-রক্ত। শোল্ডার। ব্লেডের মাঝখানে তীব্র ব্যথা। শিরদাঁড়া ভেঙে গেল নাকি? ফুল স্পীড অ্যাহেড, ক্যাপটেন! ফুল স্পীড…!

বরফের ভেতর জাহাজ ঢুকে যাচ্ছে টের পেয়ে ক্যাপটেন আর নতুন কোন নির্দেশ দেননি, কাজেই যেদিকে খুশি এগিয়ে চলেছে কিউট। বো-র সামনে পড়ে বরফের বিশাল বিশাল চাই ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, কোন কোনটা দুটুকরো হয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। দুপাশে। গায়ের জোরে ক্রমশ ভেতরে ঢুকছে আইসব্রেকার। বোর ধাক্কায় খান খান হয়ে ভেঙে পড়ছে ব্যারিয়ার, নিজের তৈরি পথ। ধরে হেলেদুলে এগোচ্ছে কিউট। ডেকের নিচে চীফ এঞ্জিনিয়ার তার গজের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে, ডেঞ্জার পয়েন্ট ছাড়িয়ে গিয়ে থরথর করে কাঁপছে কাঁটা। ক্যাপটেন সাবধান না হলে বয়লারগুলো যে-কোন মুহূর্তে বিস্ফোরিত হবে।

ব্রিজ থেকে আগের নির্দেশই রিপিট করলেন ক্যাপটেন, ফুল পাওয়ার! তাঁর এই নতুন নির্দেশে জাহাজ যেন এবার সত্যি অদম্য হয়ে উঠল। বো উঠে গেল বরফের ওপর, স্রেফ শক্তি আর ভার চাপিয়ে তছনছ করে দিল নিরেট বাধা। মাস্তুলের মাথা থেকে এতক্ষণে টের পেল রানা কি ঘটছে। সামনে ফাঁক হয়ে গেছে আইসফিল্ড, ফঁাকটা চওড়া ফাটলের দিকে ছুটছে। আর কোন চিন্তা নেই, পরম স্বস্তির সাথে উপলব্ধি করল ও। এভাবেই ফাটল ধরে সাগরে পৌঁছে যাবে জাহাজ। সেই সাথে জ্ঞান হারাল ও।

মাস্তুল থেকে খসে পড়ল হাত। ক্রস-ট্রী থেকে কাত হয়ে পড়ে গেল শরীর। চেস্ট-স্ট্র্যাপের সাথে শূন্যে পেন্ডুলামের মত ঝুলতে লাগল রানা।

.

রানাকে নামাবার জন্যে ওপরে উঠল দৈত্য হিগিন, এই লোকই রানার সামনে বালতি বসিয়ে দিয়েছিল। মাস্তুল বেয়ে কে আগে উঠবে তাই নিয়ে প্রায় ধস্তাধস্তি শুরু করেছে নিয়াজ আর বিনয়, এই সময় ওদের দুজনকেই অনায়াসে ঠেলে সরিয়ে দিল সে। বলল, গরিলা থাকতে তোমরা কেন? সত্যি কথা বলতে কি, গোটা জাহাজে সে-ই বোধহয় এই কাজের জন্যে একমাত্র যোগ্য লোক। রানার চেয়ে ইঞ্চি দুয়েক উঁচু, কিন্তু চওড়ায় দ্বিগুণ। শুধুই পেশী, চর্বির ছিটেফোঁটাও নেই শরীরে। মাস্তুল দুলছে, অথচ প্রায় তরতর করে উঠে গেল হিগিন। জাহাজ থামেনি, আগের মতই বরফ ভেঙে এগিয়ে চলেছে।

রানা কি মারা গেছে? নিয়াজের পাশ থেকে বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করল বিনয়, দুজনেই ওরা মই ধরে স্থির হয়ে আছে। চাঁদের আলোয় আশি ফিট ওপরে দুলছে রানা। দুলছে মাস্তুলের সাথে, শরীরে প্রাণের কোন লক্ষণ নেই—অন্তত আছে কিনা ডেক থেকে বোঝা যাচ্ছে না।

এত সহজে মারা যাবে? ফেঁস করে উঠল নিয়াজ। তার। গলার স্বরে খানিকটা হলেও অভিমান ফুটে উঠল, যেন বলতে চায়। এভাবে ওদেরকে একা ফেলে বিনা নোটিশে মারা যাবার কোন। অধিকার রানার নেই। আমি ভাবছি অন্য কথা, আবার বলল সে। স্ট্রাপটা ওর ভার বেশিক্ষণ সইতে পারবে না।

হিগিনকে এখন ছোট দেখাচ্ছে। এখনও উঠে যাচ্ছে সে। ডেকে অনেক লোকের ভিড়, সবাই ওপর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়ছে। কি হয় বলা কঠিন। মাস্তুল যেভাবে এদিক ওদিক দুলছে, হিগিন পড়ে গেলে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। রুদ্ধশ্বাসে একবার রানার দিকে, একবার হিগিনের দিকে তাকাল নিয়াজ। হঠাৎ চোখ নামিয়ে দুহাতে মুখ ঢাকল বিনয়।

ক্রস-ট্রীর কাছে পৌঁছে গেল হিগিন। ভুলের খেসারত মৃত্যু, অত ওপর থেকে কেউ পড়লে, পড়ার আগেই বলে দেয়া যায় লোকটা মারা গেছে।

ক্রস-ট্রীর নিচে পৌঁছে থামল হিগিন। এই সময় অপ্রত্যাশিতভাবে কিউটের বো অস্বাভাবিক উঁচু হয়ে উঠল। উঁচু হলো ধীরে ধীরে, কিন্তু নামল সবেগে। রেইল থেকে হাত ছুটে। গিয়ে বরফ মোড়া ডেকে আছাড় খেলো নিয়াজ। পিছলে গেল শরীরটা, দূরে একটা বাল্কহেডের গায়ে গিয়ে থামল। দম ফিরে পাবার চেষ্টা করছে, দেখল সাহায্যের জন্যে ছুটে আসছে বিনয়। কি ঘটেছে আন্দাজ করে নিল নিয়াজ। প্রচণ্ড ঝাঁকিতে দুজনেই মাস্তুল থেকে খসে পড়েছে। নিশ্চয়ই জাহাজে পড়েনি।

একটা হাত বাড়াল নিয়াজ। আমাকে তোলো, বিনয়…

বিনয়ের সাহায্য নিয়ে দাঁড়াল সে, একটা রেইল ধরে সিধে হলো। ভয়ে ওপর দিকে তাকাচ্ছে না। হঠাৎ খেয়াল হলো, বিনয় কোন্ সাহসে তাকিয়ে রয়েছে?

চোখ তুলল নিয়াজ। মাস্তুলের ডগায় কেউ নেই। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল, দেখল, ডগা থেকে অনেক নিচে নেমে এসেছে হিগিন, তার চওড়া কাঁধে ঘুমন্ত শিশুর মত নেতিয়ে রয়েছে রানা। মাস্তুল থেকে খুলে চেস্ট-স্ট্র্যাপটা নিজের কাঁধে জড়িয়ে নিয়েছে হিগিন, পিঠ থেকে রানা যাতে পড়ে না যায়। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছানাবড়া হয়ে উঠল নিয়াজের চোখ-লোকটা মানুষ, নাকি আর কিছু? মইটাকে ইস্পাতের বলে চেনার উপায় নেই, প্রতিটি ইঞ্চি বরফের পুরু স্তরে মোড়া। জাহাজের সাথে বিরতিহীন দুলছে আর কাঁপছে। পিঠে ওই ভার নিয়ে লোকটা নামছে কিভাবে?

পিঠে রানা থাকায় ধাপে জোরাল চাপ দিতে পারল হিগিন, বরফের আবরণ ভেঙে বেরিয়ে এল ইস্পাত। ধাপে বরফ থাকা অবস্থায় রানাকে নিয়ে নামতে পারত না সে, পা পিছলে পড়ে যেত।

নিরাপদেই নেমে এল হিগিন। তার চেহারা গম্ভীর, থমথমে। রানা কেমন আছে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও সাহস হারিয়ে ফেলল নিয়াজ। তারপর হঠাৎ দেখল, সে বাদে বাকি সবাই রানা আর হিগিনকে সাহায্য করছে। বলতে গেলে ক্রুদের মধ্যে রীতিমত একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। ফাটলে পড়ল কিউট। বো-তে পানি পেয়ে সাবলীল হলো জাহাজের গতি।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত