মরণখেলা : ২.০৫ সগর্জনে, খাড়াভাবে ওপরে উঠল

মরণখেলা : ২.০৫ সগর্জনে, খাড়াভাবে ওপরে উঠল

২.০৫ সগর্জনে, খাড়াভাবে ওপরে উঠল

সগর্জনে, খাড়াভাবে ওপরে উঠল সাবমেরিন কিলার। মুহূর্তের জন্যে রানার মনে হলো, মেশিনটা আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে।এত দ্রুত উঠবে ভাবতে পারেনি। অলটিমিটারে একশো মিটার রীডিং দেখে শূন্যে থামাল হেলিকপ্টার। তারপর সামনে খানিকদূর এগিয়ে দিক বদল করল। উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে দূরে তাকাল, আইসব্রেকার কিউটকে বিস্তীর্ণ বরফের মাঝখানে খেলনার মত লাগছে দেখতে। দিক বদল সম্পূর্ণ হবার আগেই সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল সেটা। ছোট্ট একটা লিভার, অচেনা, স্পর্শ করা মাত্র তীব্র ঝাঁকি খেলো হেলিকপ্টার। রানা অনুভব করল, প্যানেলের পিছনে ভয়ঙ্কর শক্তি লুকিয়ে রয়েছে, লিভারটা ছুঁতে যা। দেরি, অমনি তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দেবে।

প্রেশার রিজের অনেক ওপরে রয়েছে রানা, একটা করিডরে দুজন লোককে দেখতে পেল। সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে স্লেজটীমের খোজে আরও সামনে তাকাল ও। নিয়াজকে নির্দেশ দিয়ে এসেছে, পিছিয়ে গিয়ে নিরাপদ একটা জায়গায় গা ঢাকা দিয়ে। থাকবে ওরা। শুধু ওখানেই ল্যান্ড করতে পারবে হেলিকপ্টার। প্রেশার রিজের গোলকধাধার মাঝখানে সমতল বরফের খুদে। একটা প্ল্যাটফর্ম।

আরও কয়েকজন রাশিয়ানকে দেখল রানা। উড়ে এল তাদের মাথার ওপর দিয়ে। মুখ তুলে তাকাল তারা। আরও খানিকদূর এগিয়ে এসে ভুলটা ধরতে পারল ও। প্ল্যাটফর্ম ফেলে এসেছে পিছনে। দিক বদলে আবার ফিরে চলল সাবমেরিন কিলার।

ভয় ভয় করছে। প্ল্যাটফর্মে রাশিয়ানদের চেয়ে আগে পৌঁছুতে হবে ওকে। নাকি এরই মধ্যে রাশিয়ানদের একটা দল পৌঁছে। গেছে সেখানে? ফার মোড়া আরও কয়েকজন লোককে দেখা গেল। ছুটছে তারা, মুখ তুলে ওপরে তাকাল। মনে হলো, নালাগুলোর ভেতর পথ হারিয়ে ফেলেছে লোকগুলো। সবাই একই। দিকে ছুটছে না। ছায়ার ভেতর সাদা বৃত্তটা অবশেষে চোখে পড়ল। প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনটে মূর্তি, একজোড়া স্লেজ-টীম, এক পাল কুকুর। একটা মূর্তি ঘন ঘন হাত নাড়ছে।

প্ল্যাটফর্মের চারদিকে বরফের ঢাল, ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে গেছে। সেই ঢালের মাথায় আচমকা পাঁচজন রাশিয়ানকে দেখা গেল। প্রত্যেকের হাতে রাইফেল, তাকিয়ে আছে। নিচের প্ল্যাটফর্মের দিকে।

মনে মনে প্রমাদ গুনল রানা। অনেক দেরি করে পৌচেছে ও।

নিচে নামছে হেলিকপ্টার। প্রায় খাড়াভাবে। তারপর হঠাৎ রাশিয়ানদের দিকে ছুটল। বিস্ময়ে স্তম্ভিত, নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল লোকগুলো। কি ভাবছে ওরা কে জানে। পাইলটকে দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু হেলমেট আর গগলস পরে থাকায় চেনার উপায় নেই। তবে মেশিনটা নিজেদের। পাইলটের কি মাথা খারাপ হলো? সরাসরি এভাবে ছুটে আসার মানে কি?

আরও নিচে নামল রানা। স্কিডগুলো ঢালের মাথা প্রায় ছুঁয়ে যাবে। একেবারে শেষ মুহূর্তে প্রাণ বাঁচানো ফরজ মনে করল লোকগুলো। রানাও স্বস্তিবোধ করল। প্রয়োজন ছাড়া, একান্ত বাধ্য না হলে কাউকে মেরে ফেলার ইচ্ছে নেই। পাইলটের উদ্দেশ্য ভাল নয় বুঝতে পেরে ঝেড়ে দৌড় দিল লোকগুলো।

আবার ওপরে উঠল রানা, ঘুরল। পাঁচজনের দলটা চওড়া একটা করিডর ধরে ছুটছে। ডাইভ দিল সাবমেরিন কিলার, করিডরের ওপর দিয়ে লম্বালম্বিভাবে ছুটল। হেলিকপ্টার ধাওয়া করছে বুঝতে পেরে দিভ্রান্ত হয়ে পড়ল লোকগুলো, যে যেদিকে পারে বাঁক নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। ওদেরকে পিছনে ফেলে এসে ঘাড় ফেরাল রানা। প্ল্যাটফর্মের উল্টো দিকে ছুটছে সবাই। পালিয়ে বাচছে।

একটা কথা ভেবে মজাই লাগল রানার। গুলি করা তো দূরের কথা, কেউ ওর দিকে রাইফেল পর্যন্ত তোলেনি। নিজেদের সম্পদ, কার না দরদ থাকে। লোকগুলোকে আরও দুবার ধাওয়া করল ও। বরফ মোড়া খোলা প্রান্তরে বেরিয়ে অনেক দূর চলে গেল গোটা। দল। এরপর প্ল্যাটফর্মে নামল হেলিকপ্টার।

তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে বরফে আছাড় খেলো রানা। সময়ের ব্যাপার মাত্র, একজোট হয়ে আবার ফিরে আসবে। রাশিয়ানরা। কুকুরগুলোকে আগে তোলো, ছুটে আসছিল বিনয়, নির্দেশ দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল রানা। সাবধান, রোটরের কথা ভুলে যেয়ো না। কুকুরগুলোর বাঁধন আগেই খুলে দেয়া হয়েছে, ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে ওগুলোকে হেলিকপ্টারে তোলা হলো। একটু দূরে সরে গেছে রানা, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চারদিকের ঢালের মাথায় লক্ষ রাখছে। রাইফেলটা দুহাতে ধরা। স্লেজ দুটো তোলার পর দরজা থেকে হাঁক ছাড়ল নিয়াজ, আমাদের কাজ শেষ। কিন্তু। পাইলট না থাকায় আমরা অচল।

রাইফেলটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে কপ্টারের দিকে ছুটল রানা।

.

সোজা এক হাজার ফিট উঠে এল রানা, রাইফেল রেঞ্জের বাইরে। ট্রান্সপারেন্ট, গম্বুজ আকৃতির কন্ট্রোল কেবিনের কাছাকাছি হাঁটু। গেড়ে বসে রয়েছে নিয়াজ, কুকুরগুলোর মাঝখানে। তার ঠিক পিছনেই রয়েছে বিনয়। ইভেনকো রুস্তভ সবার পিছনে একটা ফোল্ডিং চেয়ারে বসে আছে শিরদাঁড়া খাড়া করে।

এবার আমার জিনিস আমাকে ফিরিয়ে দিন, গম্ভীর সুরে বলল সে। কিউটে ল্যান্ড করতে যাচ্ছি, টিউবটা এখন থেকে আমার কাছে থাকবে।

আপনার জিনিস মানে? রানা নয়, জবাব দিল নিয়াজ। আপনি নিজেও তো এখন আর আপনার নন। আপনি তো বিক্রি হয়ে গেছেন। ভুলে যাবেন না, আমেরিকানদের সাথে আমাদের একটা চুক্তি হয়েছে। মেরিলিন চার্টের মাইক্রোফিল্ম বা আপনি, আমাদের কাছে পণ্য ছাড়া কিছু নয়। এই দুটো জিনিস আমেরিকানদের হাতে তুলে দিতে পারলে ওরা আমাদেরকে এক বিলিয়ন ডলার ফি দেবে। কাজেই মাইক্রোফিল্মটা আমাদের কাছে আছে, থাকবেও।

ইভেনকো রেগেমেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিল রানা, আর মেরিলিন চার্টের যে মাইক্রোফিল্ম আপনি নিয়ে এসেছেন সেটা যদি নকল বা অসম্পূর্ণ হয়, আমেরিকানরা শুধু যে আপনাকে। কান ধরে ওঠবোস করাবে তাই নয়, আমাদের ফি-ও অর্ধেক কমিয়ে দেবে। রানা আর নিয়াজ, দুজনেই বাড়িয়ে বলছে। অভিযান সফল হোক বা না হোক, ওদের ফি ওরা পাবেই।

প্রচণ্ড রাগে বিস্ফোরিত হবার কথা, কিন্তু না-সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে ইভেনকো রুস্তভ ক্ষীণ হাসল। কি বললেন? নকল মাইক্রোফিল্ম নিয়ে এসেছি? হাহ্-হা! তাহলে শুনুন বলি কি ঘটেছিল। লেনিনগ্রাদ থেকে চার্টের দুটো মাইক্রোফিল্ম নিয়ে আসি আমি। একটা রাখি এন.পি. সেভেনটিনে আমার ঘরে, অপরটা থাকে টেপ দিয়ে আমার উরুর সাথে আটকানো। এন.পি. সেভেনটিনে এক লোককে আমি কে.জি.বি-র এজেন্ট বলে সন্দেহ করতাম। জানতাম, আমি না থাকলে মাঝে মধ্যে আমার ঘরে ঢুকে তল্লাশি চালায়। একদিন টের পেলাম, ঘরে রাখা মাইক্রোফিল্মটা কেউ নাড়াচাড়া করেছে। ভাল করে পরীক্ষা করে আমার সন্দেহ হলো, ওটা আমার রাখা জিনিসই নয়। সম্ভবত আমারটার বদলে নকল একটা চার্টের মাইক্রোফিল্ম রেখে গেছে। কে.জি.বি-র এজেন্ট হঠাৎ করে ফিনল্যান্ডে চলে যাওয়ায় আমার সন্দেহ আরও দৃঢ় হলো।

নিয়াজ জিজ্ঞেস করল, চার্টটা আপনার তৈরি, অথচ আসল না নকল চিনতে পারেন না?

কয়েকজন বিজ্ঞানী মিলে নকলগুলো এমনভাবে তৈরি। করেছে, চিনতে পারা সত্যি কঠিন।

তারপর? নকল চার্টের মাইক্রোফিল্মটা কি করলেন? জিজ্ঞেস করল নিয়াজ।

নষ্ট করে ফেললাম, সাথে সাথে জবাব দিল ইভেনকো। কাজেই, যা বলছিলাম, আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন, আসল। মেরিলিন চার্টের মাইক্রোফিল্মই নিয়ে এসেছি আমি।

কিউটের দিকে রওনা হবার আগে রুশ সিকিউরিটি এজেন্টদের মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছে দখল করা সাবমেরিন। কিলার। তবে ইভেনকো রুস্তভের কথা গভীর মনোযোগের সাথে শুনছে রানা। কে.জি.বি. আর স্পেশাল সিকিউরিটির মধ্যে সম্পর্ক ভাল নয়, জানা আছে ওর। ইভেনকোর ওপর নজর রাখার জন্যে। কে.জি.বি. লোক পাঠিয়েছিল, লোকটা ইভেনকোর ঘরে ঢুকে আসল চার্টের জায়গায় নকল চার্ট রেখে ফিরে গেছে ফিনল্যান্ডে, কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। ইভেনকোর কাছে আসল চার্ট আরও একটা ছিল। সেটাই নিয়ে এসেছে সে।

ইভেনকোকে আমেরিকায় নিয়ে আসার জন্যে কে.জি.বি. এজেন্ট জন মিলার রানাকে অনুরোধ করেছিল। কে.জি.বি. ইভেনকোকে নকল চার্ট গছিয়ে দেয়ার চেষ্টাও করেছে। রানা স্বভাবতই ধরে নিয়েছিল, ইভেনকো রওনা হলে রাশিয়ানরা বাধা দেয়ার ভান করবে, সত্যিসত্যি বাধা দেবে না। কিন্তু ঘটছে ঠিক উল্টোটা। কেন? রহস্যটা কোথায়?

তবে কি কে.জি.বি. স্পেশাল সিকিউরিটিকে তাদের প্ল্যানের কথা জানায়নি? বা জানাবার সুযোগ পায়নি? রহস্যের চাবি সম্ভবত ফিনল্যান্ডে রয়েছে। কিংবা জন মিলার বলতে পারবে কেন কিভাবে কি ঘটল।

নতুন একটা দায়িত্ব অনুভব করল রানা। আসল মেরিলিন চার্ট আমেরিকানদের হাতে পড়লে রাশিয়ানদের যে শুধু মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে তাই নয়, দুই পরাশক্তির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যও নষ্ট হবে। এ-ধরনের একটা চার্ট আমেরিকানদেরও আছে, সেটা যদি রাশিয়ানদের হাতে তুলে দেয়ার সুযোগ থাকত তাহলে চিন্তার কিছু ছিল না। কিন্তু সে সুযোগ যখন নেই, মেরিলিন চার্ট আমেরিকানরা পেতে পারে না।

ঠিক আছে, হঠাৎ আবার মুখ খুলল ইভেনকো, মাইক্রোফিল্মটা আপনাদের কাছেই থাকুক। কিন্তু দয়া করে টিউবটা আমাকে ফেরত দিন। ওতে মূল্যবান কোর রয়েছে…।

ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রানা। নিয়াজের সাথে চোখাচোখি হলো। মাইক্রোফিল্ম নয়, টিউবটা ফেরত চাইছে ইভেনকো!

বাক্স থেকে বের করতে হবে, বলল নিয়াজ। কিউটে পৌঁছে নিই, আপনার টিউব আপনি পেয়ে যাবেন।

জবাব শুনে ভারি সন্তুষ্ট দেখাল ইভেনকোকে। নিয়াজের চেহারায় নির্লিপ্ত একটা ভাব ফুটে উঠল, কিন্তু তার আর রানার মনে চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সন্দেহ নেই, কিছু একটা গোপন করছে ইভেনকো।

এক হাজার ফিট ওপর থেকে ভৌতিক জাহাজ বলে মনে হলো কিউটকে। কিংবদন্তীর সেই পরিত্যক্ত জাহাজের মত, কোন নাবিক। ছাড়াই মহাসাগরে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিউট অবশ্য ঘুরে। বেড়াচ্ছে না, নিরেট বরফে আটকা পড়ে আছে। আরও কাছে পৌঁছে রানা দেখল, জাহাজের পিছনে সাগরের গাঢ় খানিকটা পানি টলটল করছে, ওই পথেই পোলার প্যাক ভেঙে ভেতরে ঢুকেছে। কিউট। কিন্তু টলটলে পানির সামনে আবার নিরেট বরফের বিস্তার দেখা গেল। বরফ ভেঙে ভেতরে ঢোকার পর আইসফিল্ড জাহাজের পিছনে আবার জোড়া লেগে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে পিছু হটার পথ।

হঠাৎই কথাটা মনে করিয়ে দিল নিয়াজ, দ্বিতীয় সাবমেরিন। কিলার এখনও জাহাজের ওপর ঝুলছে।

জানি, বলল রানা। ওটাকে ভাগাতে হবে।

স্টিক টানল রানা, জাহাজের দিকে খানিকটা নামল হেলিকপ্টার। জাহাজের ডেক দেখা গেল, আরেকটা রুশ কপ্টারকে আসতে দেখে ক্রুরা ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। দুএকজন নাবিকের হাতে রাইফেলও দেখা গেল। উঁচু ব্রিজের সামনের দিকে, জাহাজের প্রায় পিছনের অংশে, লঞ্চিং প্যাডে বসে। রয়েছে মার্কিন হেলিকপ্টার, একটা সিকোরস্কি। সিকোরস্কির ঠিক মাথার ওপর শূন্যে ঝুলছে রুশ সাবমেরিন কিলার। যতক্ষণ ওখানে থাকবে ওটা, প্যাড থেকে উঠতে পারবে না সিকোরস্কি। উঠতে গেলেই একটার সাথে আরেকটার ধাক্কা লাগবে। কুকুরগুলোর গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বিনয় মন্তব্য করল, দ্বিতীয় সাবকিলারের পাইলট ভাবছে আমরা তার বন্ধু আসছি।

বাঁশ নিয়ে! বলল নিয়াজ।

ওরা কিন্তু আমাদের ক্র্যাশ করাবার চেষ্টা করতে পারে…, ফোল্ডিং চেয়ার থেকে আঁতকে উঠল ইভেনকো। যেন হঠাৎ করে বিপদটার গুরুত্ব উপলব্ধি করে বিচলিত হয়ে পড়েছে। ভাল করে দেখার জন্যে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল সে, আহত গোড়ালির ওপর থেকে চাপ কমাবার জন্যে ভর দিল একটা রেইলে।

আপনি বসুন, ইভেনকো! ধমকের সুরে বলল রানা। বিনয় কি বলল শুনতে পাননি? পাইলট ভাবছে আমরা রাশিয়ান। আপনাকে দেখতে পেলে…

খুব সাবধানে, রানা, সতর্ক করে দিল নিয়াজ। দুজোড়া রোটর কাছাকাছি ঘুরবে। বাতাসের ঘূর্ণি পরস্পরকে কাছে টানতে পারে।

ঝুঁকি না নিয়ে উপায় আছে, বলো? জিজ্ঞেস করল রানা। ল্যান্ড করার আগে ওটাকে ওখান থেকে সরাতে হবে। প্রায় জাহাজের ওপর পৌঁছে গেছে ওরা। ধীরগতিতে এগোচ্ছে। সাবমেরিন কিলার, ডেক থেকে পাঁচশো ফিট ওপরে রয়েছে। চারশো ফিট ওপরে স্থির হয়ে রয়েছে দ্বিতীয়টা।

বরফ মোড়া রেইলের পাশে সার সার দাঁড়িয়ে রয়েছে। নাবিকরা, মুখ তুলে আগন্তুক সাবমেরিন কিলারকে দেখছে। কি না কি ঘটবে ভেবে সবাই উদ্বিগ্ন। কন্ট্রোল কেবিনের কাচ মোড়া ছাদ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সরাসরি নিচে তাকিয়ে আছে নিয়াজ, দ্বিতীয় হেলিকপ্টারের রোটর ঘুরতে দেখছে। হিম বাতাসে তুমুল আলোড়ন তুলে ঘুরছে রোটরের পাতগুলো। রানা, যান্ত্রিক গর্জনকে ছাপিয়ে উঠল তার চিৎকার। আস্তে-ধীরে গাড়লটার পাশে নামতে পারবে?

পারব। কেন?

ভাঁজ করা টুল-কিট পায়ের কাছ থেকে তুলে নিল নিয়াজ, ভেতর থেকে বের করল বড়সড় ইস্পাতের মাঙ্কি রেঞ্চ। এটা। দিয়ে শালার গম্বুজে একটা খোঁচা মারব।

যা করে আল্লা, উৎসাহ দেখাল রানা। চেষ্টা করে দেখতে পারি। কিন্তু জানালা খুলতে হবে। সাবধান, নিউটনের থিওরিটা প্রমাণ করতে যেয়ো না।

আমি রেডি, বলল নিয়াজ। ওটার খুব কাছে নেমো না। একজোড়া কুকুরকে ঠেলে সরিয়ে দিল সে। শক্ত হাতে মাঙ্কি রেঞ্চ। ধরে জানালা খুলে ফেলল। গরম কেবিনের ভেতর ঢুকে পড়ে চোখে মুখে ঘ্যাঁকা দিল ঠাণ্ডা বাতাস, কপ্টার নিয়ে নিচে নামতে শুরু করেছে রানা। হুডটা মাথার পিছনে সরিয়ে দিতেই নিয়াজের কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল বাতাসে উড়তে শুরু করল। জানালার বাইরে ঝুঁকে পড়ল সে। কেবিনের ভেতর কথা নেই কারও মুখে। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষার মুহূর্তগুলো কেটে যাচ্ছে। ফোল্ডিং সীটের কিনারায় ঝুলে রয়েছে ইভেনকো। প্রায় অচেনা একটা মেশিন, নিজেকে বারবার মনে করিয়ে দিল রানা। সমগ্র অস্তিত্ব টান টান হয়ে আছে ওর। বিপজ্জনক একটা ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে ও, এক চুল এদিক ওদিক হয়ে গেলে সবাইকে নিয়ে পটল তুলতে হবে।

নামছে তো নামছেই, এই নামার যেন শেষ নেই। জানালা দিয়ে নিয়াজ দেখতে পেল, কিউটের ডেক উঠে আসছে ওপরে। সার সার কালো মাথা পিছন দিকে কাত হয়ে রয়েছে। ব্রিজের জানালা থেকে বেরিয়ে এল ক্যাপ পরা একটা মাথা, সম্ভবত ক্যাপটেন, মুখ তুলে ওপর দিকে তাকাল। দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল নিয়াজ, আবার তাকাল রোটরের দিকে। দ্বিতীয় সাব-কিলারের রোটরও উঠে আসছে ওর দিকে।

প্রতিটি মুহূর্ত মাপজোকের মধ্যে রয়েছে রানা। দ্বিতীয় সাবকিলারের যতটা সম্ভব কাছে নামতে হবে, অথচ রোটরের সাথে রোটরের ধাক্কা লাগা চলবে না। মাঝখানে ফাঁকটা থাকবে নেহাতই নগণ্য, তা না হলে মাঙ্কি রেঞ্চ নাগাল পাবে না গম্বুজের।

হিম বাতাস নিয়াজের চোখে-মুখে যেন বিষ ঢেলে দিচ্ছে, এরইমধ্যে অসাড় হয়ে গেছে পেশী আর চামড়া। সীসার মত ভারী লাগল চোখের পাতা, আপনাআপনি বন্ধ হয়ে আসছে। জানালার ফ্রেম ধরে আরও একটু বাইরের দিকে ঝুঁকল সে। নিঃশব্দে চিৎকার করছে বিনয়, আর নয়, আর নয়! নিচে গম্বুজ, তার ভেতরে হেলমেট পরা পাইলটের ঝাপসা মূর্তি দেখতে পেল নিয়াজ। গম্বুজের কিনারায় বরফ জমেছে। হেলমেট নড়ে উঠল, ম্লান মুখ তুলে ওপরে তাকাল রুশ পাইলট। লোকটার মনের অবস্থা আন্দাজ করতে পারল নিয়াজ। বন্ধু বেশে শত্রু, এতক্ষণে টের পেয়ে গেছে পাইলট। তা না হলে এভাবে ঠিক গায়ের ওপর নেমে আসছে কেন! জায়গা ছেড়ে সরে যাবার কোন নোটিশ পর্যন্ত দেয়নি। এখন আর নড়াচড়ার সময় নেই।

পরিস্থিতি এখন ঠিক উল্টো। রুশ পাইলট এতক্ষণ অচল করে রেখেছিল আমেরিকান হেলিকপ্টারটাকে, প্যাড থেকে উঠতে দেয়নি। কিন্তু এখন সে নিজেই ফাটা বাঁশে আটকা পড়েছে। না পারছে নিচে নামতে, না পারছে ওপরে উঠতে। ওপর থেকে একটু একটু করে এখনও নামছে বেদখল সাব-কিলার।

রানা ভেবেছিল ধীরে ধীরে ওদেরকে নামতে দেখলে পাইলটের স্নায়ুর ওপর চাপ পড়বে, সময় থাকতে ভয়ে পালিয়ে যাবে সে। মাঝখানের ব্যবধান যখন পঞ্চাশ ফিট ছিল, ইচ্ছে। করলে সরে যেতে পারত লোকটা। কিন্তু এখন আর সে সুযোগ। নেই। অপ্রত্যাশিত বিপদে পড়ে রুশ পাইলটের স্নায়ু ভাঙেনি, অসাড় হয়ে গেছে। কি করলে ভাল হবে বুঝতে না পেরে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকল সে, কিছুই করল না। হেলিকপ্টার নিয়ে নামতে থাকল রানা, দূরত্ব কমতে থাকল। ওর মেশিনের স্কিডগুলো রুশ। পাইলটের মাথার ওপর ঝুলছে। স্কিডগুলো ট্রান্সপারেন্ট গম্বুজ থেকে মাত্র কয়েক ফিট ওপরে।

বাতাসে এখন তুমুল আলোড়ন। মাঝে মাঝে হঁচকা টান। অনুভব করছে নিয়াজ, জানালার ফ্রেম থেকে হাত ফসকালেই ঝপ। করে নিচের রোটরের গায়ে পড়বে। স্রেফ কুচিকুচি হয়ে যাবে। গোটা শরীর। ভয় পেয়ে কেবিনের ভেতর ফিরে এল সে, বন্ধ করে দিল জানালা। বাতাসের ঘূর্ণি এখন আরও একটা সমস্যার সৃষ্টি করল। কপ্টার এদিক ওদিক দোল খাচ্ছে। বাতাসের টানে দুটো। কপ্টার পরস্পরের দিকে এগোলে কিছুই আশ্চর্য হবার নেই।

হঠাৎ করেই কপ্টার দুটোকে পাশাপাশি দেখা গেল। আবার জানালা খুলল নিয়াজ।

শুধু পাইলট নয়, পাশে একজন অবজারভারও রয়েছে। হেডসেট অপারেট করছে লোকটা, ওদের দিকে বার বার তাকাচ্ছে, সেই সাথে অনবরত খই ফুটছে মুখে। কোথাও সিগন্যাল পাঠাচ্ছে সে। ঠিক এই সময় ঝট্‌ করে উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে মুখ বের করতে গেল ইভেনকো রুস্তম্ভ।

বসুন! গর্জে উঠল রানা। রুশ পাইলট আত্মহত্যার ঝুঁকি নেবে কিনা জানা নেই, কিন্তু ইভেনকোকে দেখতে পেলে কি করে বসে বলা কঠিন। হয়তো নির্দেশ দেয়া আছে, ইভেনকোকে। দেখামাত্র প্রাণের ওপর ঝুঁকি নিয়ে হলেও তাকে খুন করতে হবে।

দুটো কপ্টার পাশাপাশি স্থির হয়ে আছে। রানা সামনের দিকে ছুটে যাবার জন্যে তৈরি, ওর সমস্ত মনোযোগ সামনে মাথাচাড়া দিয়ে থাকা মাস্তুলের দিকে। যাই ঘটুক, ওটাকে এড়িয়ে যেতে হবে। গো অ্যাহেড, নিয়াজ, চিল্কার করল ও। কাজটা শেষ করো।

হঠাৎ করেই ওদের নিচে পরিষ্কার হয়ে গেল কিউটের ডেক। আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তিতেই হোক, বা কমান্ডারের নির্দেশেই হোক, হঠাৎ আমেরিকান নাবিকরা দৌড় দিল। চোখের নিমেষে আড়ালে গা ঢাকা দিল তারা। নিয়াজের দিকে তাকিয়ে আছে রানা, হাত রয়েছে লিভারে-ঠেলে দিলেই সামনের দিকে ছুটবে হেলিকপ্টার। কেবিনের ভেতর যান্ত্রিক আওয়াজ অসহ্য হয়ে উঠেছে। শুধু ওদেরটা নয়, পাশের কপ্টারও বিপজ্জনকভাবে ঝাঁকি খাচ্ছে।

আরও ভাল করে দেখার জন্যে চোখ কুঁচকে তাকাল নিয়াজ। পাশের কপ্টারের গম্বুজ মাত্র কয়েক গজ দূরে। রেঞ্চ যাতে নাগাল পায়, জানালার ফ্রেম ধরে আরও খানিকটা বাইরে ঝুলে পড়ল সে। ডান হাতে রয়েছে রেঞ্চ। হাতটা লম্বা করে দিল মাথার ওপর। তারপর বৃত্ত রচনার ভঙ্গিতে গম্বুজ লক্ষ্য করে নামিয়ে আনল প্রাণপণ শক্তিতে।

একেবারে শেষ মুহূর্তে রেঞ্চটা ছুঁড়ে দিল নিয়াজ। মনে হলো। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে, গম্বুজের মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে।

কাঁচ, কিন্তু এ-কাচ ভাঙে না। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি, গম্বুজেই আঘাত করেছে রেঞ্চ, কিন্তু ভাঙল না। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল নিয়াজ। কাজ হয়েছে। প্রচণ্ড আঘাতে শত সহস্র চিড় ধরেছে কাঁচের গায়ে। গম্বুজ এখন আর ট্রান্সপারেন্ট নয়, দুধের মত সাদাটে হয়ে গেছে-সম্পূর্ণ ঝাপসা। পাইলট আর অবজারভারকে এখন অন্ধই বলা চলে, চোখ থাকতেও। গম্বুজের বাইরে কিছুই তারা দেখতে পাচ্ছে না। লিভার ঠেলে দিল রানা, অকস্মাৎ গতি পেয়ে সামনের দিকে ছুটল হেলিকপ্টার। খাড়া পাইপের মত মাস্তুলটাকে পাশ কাটিয়ে এল। নিচে এখন বরফের আদিগন্ত বিস্তার।

.

প্রতিটি হেলিকপ্টারের পিছনে একটা ছোট রোটর থাকে, টেইল রোটর ছাড়া কোন হেলিকপ্টার উড়তে পারে না। রুশ পাইলট তার টেইল রোটরের কথা কয়েক সেকেন্ড ভুলে ছিল, আর সেটাই তার মৃত্যুর কারণ হলো।

রানাও ধারণা করেছিল, রুশ পাইলট ভুল করবে। ভুল করা স্বাভাবিক। চারদিকের সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল, আচমকা ঝাপসা হয়ে গেল সব। দৃশ্যমান জগৎ বলতে কেবিনের ভেতরটা, বাকি সব দৃষ্টিসীমার বাইরে। পাইলট আতঙ্কিত হয়ে। পড়ল।

মাস্তুলকে এড়িয়ে জাহাজের ওপর থেকে সরে যেতে হবে তাকে, ফিরে যেতে হবে বরফের ওপর। লিভার ঠেলল সে, কাঁপা হাতে। দিক হারিয়ে ফেলেছে, মাস্তুলটা ঠিক কোথায় জানে না। তবু আন্দাজের ওপর নির্ভর করে জাহাজের ওপর থেকে সরে যাবার চেষ্টা করল সে। চিড় ধরা গম্বুজের ভেতর থেকে মাস্তুলটাকে দেখতে পেল সে, আবছা, একেবারে শেষ মুহূর্তে। দক্ষ পাইলট, রোটরের সাথে মাস্তুলের ধাক্কা লাগতে লাগতেও লাগল না। মাস্তুলটাকে পাশ কাটিয়ে এসে তীক্ষ্ণ বাঁক নিল সে, ভুলটা হলো সেখানেই। টেইল রোটরের কথা মনে থাকলে এত তীক্ষ্ণ বাঁক নিত না। টেইল রোটর চুমো খেলো মাস্তুলটাকে, সাথে সাথে গোটা মেকানিজম খসে পড়ল হেলিকপ্টার থেকে।

তাল হারিয়ে লাড়ুর মত ঘুরতে লাগল সাবমেরিন কিলার। কেবিনের ভেতর সেই সাথে ঘুরছে পাইলট আর অবজারভার। শুধু ঘুরছে যে তাই নয়, প্রতি মুহূর্তে ঘোরার গতি বাড়তে লাগল। ভাল চক্করে পড়েছে দুজন, স্ট্র্যাপ দিয়ে সীটের সাথে আটকানো শরীরের ওপর কারও কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এই গতিতে ঘোরার মেয়াদ লম্বা হলে যে-কোন মানুষ পাগল হয়ে যাবে। এক অর্থে ওদের ভাগ্য ভালই বলতে হবে, বেশিক্ষণ ঘুরতে হলো না। যে ছন্দে, যে তালে ঘুরছিল সাব-কিলার সেটা অল্পক্ষণ টিকল, তারপরই কাত হয়ে গেল যান্ত্রিক ফড়িং। গোপ্তা দিয়ে নেমে এল বরফে। সংঘর্ষের সময়ও রোটর ঘুরছিল। কিউট থেকে তিনশো গজ দূরে আছাড় খেলো ফিউজিলাজ। ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেল। কাগজের মত ছিড়ে চারদিকে উড়ে গেল রোটরের পাত। বিস্ফোরিত হলো ফুয়েল ট্যাংক। আগুনের শিখা লাল চাদরের মত লকলকিয়ে উঠল। তারপর কালো ধোঁয়া; উত্তুরে বাতাস পেয়ে সাদা বরফের ওপর নাচতে লাগল কোমর দুলিয়ে। রুশ হেলিকপ্টারের বিনাশ আরও একজন চাক্ষুষ করল। দুমাইল দূরে, তিন হাজার ফিট ওপর দিয়ে উড়ছে আরেকটা সাব-কিলার। পাইলটের পাশে বসে রয়েছে কর্নেল পয়মাল বলটুয়েভ। ধীরে ধীরে চোখ থেকে নাইট-গ্লাসটা নামাল সে। নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করছে পাইলট।

কি ঘটল? পিছন থেকে জানতে চাইল জুনায়েভ। ওদিকে আগুন কিসের?

চোপ! বাঘের মত গর্জে উঠল কর্নেল। আমাকে ভাবতে দাও!

শোকে কাতর হয়ে পড়েছে কর্নেল। কি ঘটছে দেখার জন্যে মাত্র এক ঘণ্টা আগে কিউটের দিকে রওনা দিয়েছিল সে। আসার। পথে একটা মেসেজ পায়, তাতে বলা হয়-মাসুদ রানার টীমকে খুঁজে বের করা হয়েছে, সিকিউরিটি ডিটাচমেন্টের লোকেরা ল্যান্ড। করেছে বরফে, মাসুদ রানা যাতে কিউটে পৌঁছুতে না পারে তার। ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেসেজ পেয়ে বিজয়ের উল্লাস অনুভব করেছিল সে।

কিউটের কাছাকাছি পৌঁছে কর্নেল দেখে, জাহাজের ওপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের একটা সাব-কিলার। রেডিওটেলিফোনে পাইলটকে নির্দেশ দেয় সে, নট নড়নচড়ন, গঁাট হয়ে। বসে থাকো ওখানে। তারপরই দ্বিতীয় সাব-কিলার এল। কি ঘটছে কিছুই বুঝল না কর্নেল। রুশ পাইলট রিপোর্ট পাঠাতে শুরু করল। প্রথম দিকে চুপচাপ শুনে গেল সে, বাধা দিল না। ওটা আমাদেরই সাব-কিলার, অথচ হুমকির মত মাথার ওপর নেমে আসছে…ভেতরে কয়েকজন মানুষ…জানালা খুলে রেখেছে…ইভেনকো, ইভেনকো! পরিষ্কার দেখলাম…অনেক কুকুর…তিনজন লোক, চিনি না…। এরপর মেসেজ পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। কারণটা কি জানার জন্যে চোখে নাইট-গ্লাস তুলেছিল কর্নেল। পরিষ্কার না হলেও, হেলিকপ্টারটাকে বিধ্বস্ত হতে দেখেছে সে।

তার পিছন থেকে জুনায়েভ লক্ষ করল, কর্নেলের কাঁধ শক্ত হয়ে গেল। ঝট করে ঘুরল কর্নেল, ভয় পেয়ে একদিকে কাত হয়ে গেল জুনায়েভ। রিসার্চ শিপ রিগায় সিগন্যাল পাঠাও। বলো আমি আসছি। ফুল পাওয়ার দিয়ে রেডিও-জ্যামিং শুরু করতে বলো। সমস্ত জাহাজ তাই করবে। রিগা হবে আমাদের হেডকোয়ার্টার। কিউটই আমাদের কাছে আসবে।

টেকনিকালার…পেলিকান, টেকনিকালার…পেলিকান…

কিউটের ক্যাপটেনের মাধ্যমে মাঝরাতে রানার দুটো মেসেজ পেলেন জেনারেল ফচ। প্রথম মেসেজটা পেয়ে উল্লাসে অধীর হলেন তিনি, মুখের ভেতর রসুনের যে কোয়াটা ছিল আরেকটু হলে গলায় আটকে যাচ্ছিল। ঢোক গিলে সেটাকে পেটে চালান করে দিয়ে টমাসকে বললেন, ইভেনকো এখন আমাদের হাতে, টীম নিয়ে রানা কিউটে পৌঁছে গেছে! অপারেটরকে বললেন, ওয়াশিংটনের সাথে কথা বলব, লাইন লাগাও। আইসক্যাপে রয়েছে রিমোট ডিসট্যান্ট আর্লি ওয়ার্নিং স্টেশন, তার সাহায্যে হট লাইন জ্যান্ত হয়ে উঠল। ওয়াশিংটন, ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের সাথে এক মিনিট কথা বললেন জেনারেল ফচ। তিনি চান, কিউটকে বন্দরে ফিরিয়ে আনার জন্যে একটা শিপের ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট তার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করল। তারা বলল, ইভেনকোকে নিয়ে রানা যখন কিউটে উঠতে পেরেছে, এরপর আর কিছু ঘটতে পারে না। রাশিয়ানদের এত সাহস নেই যে মার্কিন জাহাজের গায়ে টোকা দেবে।

হট লাইন অফ হয়ে যেতে পায়চারি শুরু করলেন জেনারেল ফচ। বারবার মুখ তুলে ওয়াল-ম্যাপের দিকে তাকালেন। আই.আই. ফাইভের আশপাশে যতগুলো জাহাজ রয়েছে সবগুলোর পজিশন লক্ষ করছেন।

নিস্তব্ধতা ভাঙল টমাস। আপনি যে সিগার ধরালেন, স্যার, তারমানে কি রানার মেসেজ পেয়ে সেলিব্রেট করছেন…?

তুমি একটা ইমপসিবল ক্যারেক্টার হয়ে উঠছ, খেকিয়ে উঠলেন জেনারেল।

টমাস ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরও পায়চারি থামালেন না। নিজের অজান্তেই বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ম্যাপের দিকে। অস্বস্তিবোধ করছেন তিনি, জানেন বিছানায় গিয়েও ঘুমাতে পারবেন না। ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের কথা বিশ্বাস করতে পারলে ভাল হত। ওদের ধারণা, আর কিছু ঘটতে পারে না। কিন্তু, আসলে, ঘটনা এই তো মাত্র ঘটতে শুরু করেছে। ওয়াশিংটনকে বোঝাবার সাধ্য তার নেই। প্রেসিডেন্ট চীন সফরে রয়েছেন, তাই নিয়ে সবাই ওরা ব্যস্ত।

দ্বিতীয় মেসেজটা কিউটের ক্যাপটেনের মাধ্যমে নয়, সরাসরি রানার কাছ থেকে এল। আবার জ্যান্ত হয়ে উঠল হট লাইন, এবার। সুইটজারল্যান্ড থেকে সোহানা কথা বলল রানার সাথে। হ্যাঁ, রানা এজেন্সির অ্যাকাউন্টে মার্কিন সরকারের দেয়া এক বিলিয়ন ডলারের চেক জমা হয়েছে। পুরো টাকাটা ইতিমধ্যে ঢাকায় ট্রান্সফারও করেছে সোহানা। রানার কয়েকটা নির্দেশ দ্রুত হাতে লিখে নিল সে। ফিনল্যান্ডে নতুন কে.জি.বি. এজেন্ট গেছে, জন মিলারের কাছ থেকে তার পরিচয় জানতে হবে, ইত্যাদি।

হটলাইনে চুমোর শব্দ হলো, দুই প্রান্ত থেকেই, তারপর ক্লিক শব্দের সাথে কেটে গেল যোগাযোগ।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত