২.০৪ বন্ধ ঘরের ভেতর ধোঁয়া
বন্ধ ঘরের ভেতর ধোঁয়া আর তামাকের গন্ধ। প্রজেক্টরের মৃদু গুঞ্জন। অকস্মাৎ চেঁচিয়ে উঠল কর্নেল পয়মাল বলটুয়েভ, ফ্রেমটা ধরে রাখো!
প্রজেক্টর থামাল অপারেটর, পর্দায় স্থির হয়ে গেল ছবি। চারজন লোক, মুখ তুলে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। একজন লোকের হাতে রাইফেল, অপরজনের চোখে নাইট-গ্লাস। পর্দার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল একটা ছায়ামূর্তি-বলটুয়েভ। ছায়ামূর্তির একটা হাত লম্বা হলো, আঙুল দিয়ে পর্দার একজন লোককে দেখাল। লোকটা একটা স্লেজের হ্যান্ডেলবার ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই শালা, আমার পেনশন বাজি রেখে বলতে পারি, নিস্তব্ধ কামরায় গমগম করে উঠল তার ভারী গলা। ইভেনকো রুস্তভ! বেঈমান!
অন্ধকার থেকে মৃদু প্রতিবাদ জানাল নিকিতা জুনায়েভ, কিন্তু কর্নেল কমরেড, ওদের কারও মুখ দেখা যাচ্ছে না…
মুখে পেচ্ছাব করি! মেঝেতে পা ঠুকল কর্নেল। কুত্তাটার প্রতিটি নড়াচড়া আমার মুখস্থ। দেখছ না একপাশে কেমন কাত করে রেখেছে মাথাটা, বানচোতের এই ভঙ্গিটা আমার চেনা আছে। চোখে নাইট-গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার ওপর মোটা একটা আঙুল রাখল সে। আর এ হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত শত্রু। মাতৃভূমির মুখে কলঙ্ক মাখিয়েছে। মিগ একত্রিশ চুরি করে নিয়ে গিয়ে অপমান করেছে গোটা রাশিয়াকে। মাসুদ রানা। বাকি দুজন ওর চেলা, আমেরিকানদের আর্কটিক রিসার্চ বেসে গবেষণা করে-বিনয় মুখার্জি আর নিয়াজ মাহমুদ।
আমরা তাহলে উত্তর আর পশ্চিম থেকে প্লেনগুলোকে ফিরিয়ে আনব, কর্নেল কমরেড? জিজ্ঞেস করল জুনায়েভ।
ব্যাটাচ্ছেলে, আগে তুমি ঘরের আলো জ্বালো, নির্দেশ দিল কর্নেল। আলো জ্বলে উঠতেই চোখে হাতচাপা দিল সে, তারপর পিছনে বসা একজন লোকের দিকে তাকাল। খুস্কায়েভ, আবার তুমি ওদের খুঁজে বের করতে পারবে?
খুস্কায়েভ, আটাশ, মারমানস্ক থেকে নিয়ে আসা ডিটাচমেন্টের নেতৃত্ব দিচ্ছে। চেহারায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাব নিয়ে ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে। কয়েক পা এগিয়ে ওয়াল-ম্যাপের সামনে চলে এল, আঁক কাটা একটা জায়গায় আঙুল রেখে বলল, এখানে, কর্নেল। স্টার-ফিক্স নির্ভুল হলে…
তারমানে পারবে? অধৈর্য হয়ে আবার জানতে চাইল কর্নেল।
একবার যখন পেরেছি…, কর্নেলের চেহারা দেখে চুপ করে গেল খুস্কায়েভ।
সে কৃতিত্ব তোমার নয়, কঠিন সুরে বলল কর্নেল। পাঁচ মাইল দূরে থেকে স্মোক ফ্লেয়ার দেখে ওদিকে গিয়েছিলে। আপন। মনে মাথা নাড়ল সে। কে জানে কেন স্মোক ফ্লেয়ার ছাড়ল ওরা-হয়তো অ্যাক্সিডেন্ট।
হ্যাঁ, কর্নেল কমরেড, আমতা আমতা করে বলল খুস্কায়েভ,। বলা যায় ভাগ্যই আমাদেরকে সাহায্য করেছিল…
ভাগ্যের সাহায্য আবার কিভাবে পেতে পারো, আমার কাছ থেকে জেনে নাও! খুস্কায়েভের হাত থেকে পেন্সিলটা কেড়ে নিয়ে। ম্যাপের দিকে তাকাল কর্নেল। ওরা আমেরিকান আইসব্রেকার কিউটে চড়বে বলে দক্ষিণ দিকে এগোচ্ছে। কিউট রয়েছে এখানে, ম্যাপের গায়ে একটা আঁক কাটল সে। আই.আই. ফাইভ আর কিউটের মাঝখানে একটা সরল রেখা আঁকো, নিজেই আঁকল সে। কি, দেখতে পাচ্ছ? হ্যাঁ, টেন্থ মেরিডিয়ান ধরে এগোচ্ছে। ওরা।
খুস্কায়েভের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাহলে তো পানির মত সহজ হয়ে গেল কাজটা। টেন্থ মেরিডিয়ান ধরে গেলেই…
চোপ! মেঝেতে পা ঠুকে গর্জে উঠল কর্নেল। ফের যখন আমি কোন কাজে ডাকব, আসার আগে মাথাটা কামিয়ে ন্যাড়া হয়ে নেবে। বুদ্ধিশুদ্ধি যাও একটু আছে, তাও শুষে নিচ্ছে। চুলগুলো। আমাদের বোকা বানাবার জন্যে কোর্স বদল করবে ওরা, বুঝলে হাঁদারাম? হয় ওরা দক্ষিণ-দক্ষিণ-পুবে নাহয় দক্ষিণদক্ষিণ-পশ্চিমে সরে যাবে। রানার দলকে যেখানে দেখা গেছে। সেখান থেকে দুটো আলাদা রেখা আঁকল সে। পরে আবার ওরা ফিরে আসবে দক্ষিণে। স্টার-ফিক্সে ভুল থাকবে ধরে নিয়ে, আইসফিল্ড ভেসে চলেছে মনে রেখে, ত্রিভুজ আঁকলাম, এর ভেতরই ওদের তুমি দেখতে পাবে।
জ্বী, কর্নেল কমরেড, খুস্কায়েভ ঢোক গিলে বলল। আপনার কথায় যুক্তি আছে…।
আমার সব কথাতেই যুক্তি থাকে, পিছন ফিরে জুনায়েভের দিকে তাকাল কর্নেল। এবার প্রত্যেক হেলিকপ্টারে সশস্ত্র লোক থাকবে।
কিন্তু সবগুলো হেলিকপ্টারে দেব কিভাবে? অত লোক…
আমি বলেছি সবগুলো হেলিকপ্টার ফিরিয়ে আনতে হবে? মেঝেতে আবার পা ঠুকল কর্নেল। তা করলে জেনালের ফচ বুঝে নেবে তার ডিসেপশন অপারেশন ফেল মেরেছে। আই.আই. ফাইভের উত্তর আর পশ্চিম থেকে কয়েকটা রিফুয়েলের জন্যে ফিরে আসুক। দেরি না করে আবার ওগুলো টেক-অফ করবে, চলে যাবে আমার ত্রিভুজে নজর রাখার জন্যে।
কর্নেল আবার ঘেউ ঘেউ করে ওঠার আগেই তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সবাই। পাইপ কামড়ে ধরে ওয়াল-ম্যাপের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল কর্নেল। তারপর বিড়বিড় করে। বলল, এবার কোথায় যাবে, মি. মাসুদ রানা? ঘুঘু দেখেছ, ঘুঘুর ফঁদ দেখোনি! ঠোঁটে নির্দয় একটুকরো হাসি ফুটে উঠল তার।
.
যেন দুঃস্বপ্নের ভেতর রয়েছে ওরা। সারাক্ষণ রাশিয়ান। হেলিকপ্টারের আওয়াজ আসছে কানে। কখনও একেবারে কাছে, মনে হলো যে-কোন মুহূর্তে মাথার ওপর চলে আসবে। কখনও অনেক দূরে, মৌমাছির গুঞ্জনের মত অস্পষ্ট। ক্লান্ত শরীর নিয়ে। একের পর এক নালা ধরে এগোচ্ছে দলটা, পাশে প্রেশার রিজের আড়াল। এঞ্জিনের আওয়াজ যখন বহুদূরে, স্নায়ুর ওপর তখন যেন বেশি চাপ পড়ে-গভীর মনোযোগের সাথে, কান খাড়া করে শুনতে। হয়। মনে হয়, না জানি কখন বাড়তে শুরু করে শব্দটা। কে জানে। এদিকেই আসছে কিনা।
ওগুলো যখন কাছাকাছি চলে আসে, বিরতিহীন একঘেয়ে হয়ে। ওঠে এঞ্জিনের আওয়াজ, কাঁপতে শুরু করে বরফ-পাঁচিল, নাড়া খায় পায়ের তলায় নালার বরফ। শুধু সময়ের ব্যাপার, জানে রানা, আগে হোক বা পরে রাশিয়ানদের চোখে ধরা ওদেরকে পড়তেই। হবে। বিনয় আর নিয়াজের যুক্তি মেনে নিয়ে দলটাকে যদি দাঁড় করিয়ে রাখে ও, নালার ভেতর রাশিয়ানরা ওদেরকে দেখতে পাবে বলে মনে হয় না। কিন্তু তাতে পিছিয়ে থাকতে হবে, কিউটের সাথে যোগাযোগের আশা ছেড়ে দিতে হবে।
কিউটে পৌঁছুতে পারলে নিরাপদ আশ্রয় মিলবে।
কিন্তু সচল বস্তু আকাশ থেকে সহজে চোখে পড়ে।
পিছিয়ে পড়ার চেয়ে রাশিয়ানদের চোখে ধরা পড়ার ঝুঁকিটাই নিচ্ছে রানা।
কিন্তু ক্লান্তি ওদেরকে ক্ষমা করছে না। সন্ধ্যা দশটার দিকে। চারজনেরই ভেঙে পড়ার মত অবস্থা দাঁড়াল। হাত-পা আর চলে না, চোখ আধবোজা হয়ে আছে, শিরায় শিরায় অচল হয়ে পড়ছে। রক্ত। এরই মধ্যে দুবার কেঁদে ফেলেছে ইভেনকো রুস্তভ, রানার কাছে করুণ আবেদন জানিয়ে বলেছে, আর পারছে না।
কিন্তু রানা নির্মম। পরিষ্কার বলে দিয়েছে, হয় সাথে থাকুন, না হয় পথ হারিয়ে পটল তুলুন।
জবাব শুনে চটে উঠল বিজ্ঞানী। স্লেজের সাথে ছুটতে ছুটতে বলল, কিন্তু আপনাকে তো পাঠানোই হয়েছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে!
মনে মনে বলল রানা, কিন্তু কথা ছিল কে.জি.বি. গোপনে সহযোগিতা করবে। অথচ তাদের টিকিটিরও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। স্পেশাল সিকিউরিটিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশও তারা দেয়নি, দিলে বলটুয়েভ গং এভাবে ওদের প্রাণের শত্রু হয়ে উঠত না। পরিস্থিতি বদলে গেছে, মি. ইভেনকো। প্রশ্ন এখন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার। কাজেই ইচ্ছে হলে আসুন, না হয় থেকে যান-কোনটাতেই আমাদের আপত্তি নেই।
ইভেনকো পিছিয়ে পড়ল, চট করে একবার পিছনে তাকিয়ে তাকে দেখে নিল রানা। বিনয়ের স্লেজের পাশে রয়েছে ইভেনকো, আগের মতই ছুটছে। ওদের পিছনে রয়েছে নিয়াজ, সেক্সট্যান্টের সাহায্যে তারাগুলোর অবস্থান জানার চেষ্টা করছে। ইভেনকোকে ফেলে রেখে যাবার কোন ইচ্ছেই নেই রানার, দ্রলোক অচল হয়ে পড়লে বাধ্য হয়ে তখন স্লেজে তুলে নিতে হবে। তবে আশ্চর্য বটে, বরফে একাকী মরার ভয় দেখানোয় তার সমস্ত ক্লান্তি কোথায় যেন। উবে গেল, স্লেজের সাথে দৌড়াতে আর কোন আপত্তি করল না।
কিন্তু স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড চাপ সত্যিকার বিপদ হয়ে দেখা দিল, কেউ তার মেজাজকে বশে রাখতে পারছে না। মুখ খোলার উপায়। নেই, তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ ওঠে। রাত ঠিক দশটার পরপরই নিয়াজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, এবার তাদের থামতেই হবে। তার স্থির। বিশ্বাস, রানার কথামত চললে নির্ঘাত মরতে হবে সবাইকে। যেভাবে হোক বোঝাতে হবে ওকে, ভাগ্য ওদের সাথে বেঈমানী করেছে, সামনে এগিয়ে আর কোন লাভ নেই। ব্যাগে সেক্সট্যান্ট ভরে বিনয়ের স্লেজ থেকে নামল সে, ছুটে চলে এল রানার স্লেজের পাশে। আরেকটা প্লেন আসছে, রানা, বলল সে। থামো। রিজের মাথায় চড়ে দেখে আসি…
শুধু শুধু এনার্জি নষ্ট, উত্তরে বলল রানা। প্লেনটা অনেক দূরে…
কিন্তু এদিকেই আসছে! আওয়াজ শুনে বুঝতে পারছ না, আগের চেয়ে কাছে চলে এসেছে? মাথার ওপর না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলো নাকি?
হ্যাঁ।
ফর গডস সেক, কেন?
হ্যান্ডেলবারটা আরও শক্ত করে চেপে ধরল রানা, ঝুঁঝের সাথে জবাব দিল, কারণ বলটুর খেলার খুঁটি হতে চাই না। কি ঘটছে বুঝতে পারছ না? এলোপাতাড়ি আসা-যাওয়া করছে ওরা, আন্দাজের ওপর। আমরা কোথায় ওরা জানে না।
এভাবে আসা-যাওয়া করতে করতেই দেখে ফেলবে…
ভাগ্য যদি খুব ভাল হয়। নালার ভেতর রয়েছি আমরা, কোন। প্লেন কাছাকাছি চলে এলে পাঁচিলের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াব। মাথার ওপর দিয়ে উঠে গেলেও দেখতে পাওয়া সহজ হবে না।
আর যদি দেখে ফেলে?
তখন ভাবব কি করা যায়।
ভাবলেও তখন কোন উপায় বেরুবে না।
বোকার মত কথা বলছ, বলল রানা। বিপদ যত গুরুতরই হোক, উদ্ধার পাবার উপায় একটা না একটা থাকেই, তুমি সেটা দেখতে পাবে কিনা সেটাই হলো প্রশ্ন।
রানার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস লক্ষ করে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল নিয়াজ, মনে হলো রানার এই গুণটা তার নিজের ভেতর থাকলে ভাল হত।
গভীর করে শ্বাস টানল রানা, নিয়াজের দিকে তাকাল। মুহূর্তের অন্যমনস্কতার জন্যে কাত হয়ে গেল স্লেজ, দুহাতে হ্যান্ডেলবার টেনে ধরে কোন রকমে শেষরক্ষা করল। সামনের দিকে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলল, আরও অনেক দূর এগোতে হবে আমাদের, কর্নেল বলটু যাতে মনে করে অত দক্ষিণে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তার আগে বিশ্রামের কথা ভুলে যাও। জানি, হেলিকপ্টারগুলো আমাদের খুঁজছে। আমাদের স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করাও ওদের একটা উদ্দেশ্য, এঞ্জিনের আওয়াজ কানে ঢুকলেই আমরা যাতে অস্থির হয়ে উঠি। প্রতিবার শুব্দ শুনলেই আমরা যদি থামি, পিছিয়ে পড়ব না? ওরা চাইছেও ঠিক তাই। আমরা যাতে কিউটে পৌঁছুতে না পারি… হেলিকপ্টারের আওয়াজ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় চুপ করে গেল রানা। পরমুহূর্তে গর্জে উঠল, আড়াল নাও!
কুকুরগুলোকে দাঁড় করানো হলো, লম্বা হয়ে পাশে শুয়ে পড়ে। বিনয় শান্ত করার চেষ্টা করল ওগুলোকে। কয়েক সেকেন্ড পরই মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল একটা হেলিকপ্টার, এঞ্জিনের আওয়াজে কানে তালা লাগার যোগাড় হলো। পুব থেকে পশ্চিমে, নালার দুশো ফিট ওপর দিয়ে কালো ছায়ার মত স্যাঁৎ করে বেরিয়ে গেল। তারপরও স্থির হয়ে শুয়ে থাকল ওরা, জানে না শত্রুর চোখে। ধরা পড়ে গেছে কিনা। ওদের দেখে থাকলে আবার ফিরে আসবে ওটা।
নড়াচড়া নেই, হিম শরীরের ভেতর রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে। আসছে। ক্লান্তিতে অবশ, উঠে দাঁড়াবার শক্তি আছে কিনা সন্দেহ। হেলিকপ্টারের আওয়াজ দূরে সরে যেতে আবার অস্থির হয়ে উঠল কুকুরগুলো। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, হেলিকপ্টার। ফিরে আসল না দেখে, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল ওরা। রানাকে। আরেকবার বোঝাবার চেষ্টা করল নিয়াজ। রানা, ভেবে দেখো। পেটে কিছু না পড়লে…
রানা অন্যমনস্ক, চুপচাপ শুধু এদিক ওদিক মাথা নাড়ল। কোন আওয়াজ পেল না ও। ক্লান্ত পা ফেলে বরফ-পাঁচিলের দিকে। এগোল। পাঁচিলে ওঠার জন্যে বারবার চেষ্টা করল, প্রতিবার পা পিছলে নেমে এল নিচে। আপনমনে কাঁধ ঝুঁকিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এল নিয়াজ। পাঁচিলের মাথায় উঠল রানা। নাইট-গ্লাস পরিষ্কার করে চোখে তুলল। অনেক অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পেল ও। ঝাপসা দিগন্তরেখার ওপর চোখ বুলাল, তারপর একটু নিচু করল গ্লাস। ঝাড়া এক মিনিট পর ঘাড় ফিরিয়ে নালার দিকে। তাকাল। উঠে এসো, নিয়াজ। দেখো।
.
খবর? কর্নেল বলটুয়েভ জানতে চাইল।
নেই। খুস্কায়েভ ঘরের দরজা বন্ধ করল। এইমাত্র ফিরে এলাম-ওদের ছায়া পর্যন্ত দেখতে পাইনি। আশা ছেড়ে দেয়াই ভাল।
আশা ছেড়ে দেব, বলছ? মেঝেতে পা ঠুকে, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল কর্নেল। জুনায়েভ তাকে চেনে, নিজের অজান্তেই এক পা পিছিয়ে গেল সে। তুমি একটা কাপুরুষ, খুস্কায়েভ। একটা ডিটাচমেন্টের লীডার হবার যোগ্যতা তোমার নেই। এই খেলায় যে সবচেয়ে বেশি দূর যেতে পারে সে-ই জেতে। ঝামেলা শেষ হলে তোমার চাকরি নিয়ে মাথা ঘামাব আমি। নিশ্চয়ই খেতে যাচ্ছ? ভুলে যাও, খুস্কায়েভ। পরবর্তী যে হেলিকপ্টার টেক-অফ করছে। ওটায় থাকছ তুমি। খুস্কায়েভ ঘর থেকে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল সে। ওরা কিউটে পৌঁছে গেলে ব্যাপারটা সত্যি জটিল হয়ে উঠবে, জুনায়েভ।
থতমত খেয়ে গেল জুনায়েভ। এই প্রথম কর্নেল কমরেড আশঙ্কা প্রকাশ করল, জাহাজ পর্যন্ত পৌঁছুনো রানার পক্ষে অসম্ভব নয়। জটিল, কমরেড কর্নেল? জিজ্ঞেস করল সে, তারপর বলল, ইভেনকো যদি কোন আমেরিকান জাহাজে একবার চড়তে পারে, তাকে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব।
অসম্ভব? ঠাণ্ডা গলায় বলল কর্নেল, মাথা নাড়ল। আমি তা মনে করি না। ঝামেলা হবে, কিন্তু অসম্ভব নয়।
সরাসরি তর্কে না গিয়ে মিনমিন করে জুনায়েভ বলল, ভাগ্য যদি আমাদের সাহায্য করে…
ভাগ্যের আমি নিকুচি করি! গর্জে উঠল কর্নেল। তুমি জানো, নিজের ভাগ্য নিজে গড়ি আমি? টেবিলে দুম করে একটা ঘুসি মারল সে। কৌশল বদল করছি। এখন থেকে কিউটের উত্তর দিকটায় চোখ রাখব। যে-পথ দিয়ে কিউটের দিকে আসবে ওরা। টার্গেটকে দেখামাত্র কাছাকাছি, নিরাপদ দূরত্বে ল্যান্ড করবে। আমাদের হেলিকপ্টার। নিচে বরফ নরম কি শক্ত জানতে চাই না আমি। যেভাবে পারে ল্যান্ড করতে হবে।
ইভেনকোর সাথে যারা আছে তারা যদি বাধা দেয়?
সেজন্যেই আমার দ্বিতীয় নির্দেশটা এখুনি সবাইকে জানিয়ে দেবে তুমি। সশস্ত্র প্রতিটি দলের লীডারকে ব্যক্তিগতভাবে। জানাবে। খবরদার, পাইলট যেন শুনতে না পায়। ইভেনকোর সাথে যারা আছে তাদের আমরা চাই না। তারা ঝামেলা, কাজেই। হারিয়ে গেলে আমরা খুশি হব। সহজ সমাধান, বরফের নিচে পুঁতে। ফেলা। সবচেয়ে ভাল হয় যদি গভীর কোন ফাটল পাওয়া যায়-লাশগুলো নিচে ফেলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কুকুরগুলোকেও মারতে হবে, বিষ মেশানো খাবার দিয়ে। স্লেজ। দুটোরও কোন অস্তিত্ব রাখা চলবে না। মাঝরাতের মধ্যে, জুনায়েভ! যদি সম্ভব হয় তারও আগে…
.
নিশ্চয়ই মরীচিকা, প্রথমবার দেখে ভাবল রানা। আকৃতিটা ঝাপসা হয়ে উঠল, তারপর আর দেখা গেল না। লেন্স অ্যাডজাস্ট করতে আবার ফিরে এল। না, দৃষ্টিভ্রম নয়। নিয়াজকে পাঁচিলের ওপর উঠতে বলল ও।
রানার শান্ত গলার মধ্যে এমন কিছু ছিল, বরফের পিছলা ঢাল বেয়ে কিভাবে যে মাত্র একবারের চেষ্টায় পাঁচিলের মাথায় উঠে এল, বলতে পারবে না নিয়াজ। চোখে গ্লাস তোলার জন্যে হুড নামাল মুখ থেকে।
ওদিকে! দেখে বলো, ভৌতিক কিছু না তো?
নাইট-গ্লাস ধরা আঙুলগুলো কঁপছে নিয়াজের। সামনে আরও তিন মাইল প্রেশার রিজ ঢেউ খেলে রয়েছে, যেন ঝড়ের ছোবল খেয়ে ফুঁসে ওঠা সাগর আচমকা মাঝপথে জমাট বরফ হয়ে গেছে। আরও সামনে সমতল বরফের বিস্তার, তারই মাঝখানে গেঁথে রয়েছে মরীচিকা-চাঁদের আলোয় এমন একটা দৃশ্য, ফটো তোলা হলে অবাস্তব দেখাবে। গুড গড! স্তম্ভিত নিয়াজ ফিসফিস করে উঠল।
উঁচু মাস্তুল আর উঁচু ব্রিজ নিয়ে একটা জাহাজ বরফ আর তুষারে তৈরি। দেখতে অনেকটা জন্মদিনের কেকের মত, নাইটগ্লাসে নিয়াজ দেখল, জাহাজের বো ওর দিকে তাক করা রয়েছে। গোটা জাহাজ চকচক করছে, যেন সাদা কাচে মোড়া। মাস্তুল থেকে বরফের ঝুরি ডেক পর্যন্ত নেমে এসেছে। বোটা অস্বাভাবিক উঁচু, যেন বিশাল কোন ঢেউয়ের মাথায় চড়ে রয়েছে। কিন্তু জাহাজটা সম্পূর্ণ স্থির, পোলার প্যাকে শক্তভাবে গাঁথা। ওটা যে পরিত্যক্ত নয় তার একমাত্র প্রমাণ, মাস্তুলের ডগায় আলো জ্বলছে। মরীচিকা হতেই পারে না। আমেরিকান আইসব্রেকার কিউট ওটা, সবচেয়ে কাছের সাগর থেকে দশ মাইল দূরে চলে এসেছে, আটকা পড়েছে পোলার প্যাকে।
গুড গড! আবার বিড়বিড় করে উঠল নিয়াজ।
রিপিট করছ কেন, বুড়ো হয়ে যাচ্ছ নাকি?
এক পাক নেচে উল্টোটা প্রমাণ করল নিয়াজ।
সবিনয়ে জানতে চাইছ, নিচে থেকে জিজ্ঞেস করল বিনয়, …
আবে হালা অহনও বুঝবার পারো নাই? হালায় কিউট বরফের মইদ্যে…
কুকুরগুলোর কাছে ইভেনকো রুস্তভকে রেখে পাঁচিলে উঠল। বিনয়। যদি ঠাট্টা হয় রে!
নাইট-গ্লাসটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিয়াজ বলল, নিজের। চোখেই দেখ।
গ্লাস চোখে তুলল বিনয়, এক সেকেন্ড পর সবিস্ময়ে বলল, এত ভেতরে ওটা ঢুকল কিভাবে?
ঢোকেনি, ঢোকানো হয়েছে, বলল রানা। শক্তির নাম সাহস। ক্যাপটেন হ্যারি গোল্ডম্যানের সাথে আমার পরিচয় নেই, তবে শুনেছি তাঁর সাহসের তুলনা হয় না। আমাদের কাছাকাছি আসার জন্যে এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি বরফ ভেঙে ভেতরে ঢুকেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার কি বলো তো? জাহাজের রাডার দেখা যাচ্ছে না।
লোকটা যে বেপরোয়া, তাতে কোন সন্দেহ নেই, বলল। নিয়াজ। কত দূরে, আন্দাজ করতে পারো?
সাত মাইলের কম নয়, বলল রানা। এগোনোর ব্যাপারে। আর কোন আপত্তি আছে?
প্রথম দুমাইল ঝড়ের বেগে এগোল ওরা, গত কয়েক ঘণ্টায় এই গতি একবারও তুলতে পারেনি। সামনে আর এক মাইল দুর্গম পথ, তারপরই খোলা, সমতল বরফের বিস্তার। মাথার ওপর রাশিয়ানদের হেলিকপ্টার নেই, কাজেই রানা সিদ্ধান্ত নিল ইলিয়ট হোমিং বীকন অন করে সিগন্যাল পাঠানো যেতে পারে। সিগন্যাল পেলেই হেলিকপ্টার পাঠাবে কিউট।
পরিশ্রান্ত বলেই কনকনে ঠাণ্ডা অসহ্য হয়ে উঠল। চারদিক এখনও পরিষ্কার, শুধু স্লেজ-টীমের মাথার ওপর ঝুলে আছে হালকা কুয়াশা, ধোঁয়াটে বাষ্পের মত। জনপ্রিয় ধারণা, আর্কটিকে চব্বিশ ঘণ্টা ঝড়-ঝঞা লেগে আছে, এই অক্ষাংশে তা সত্যি নয়। এ শুধু পৃথিবীর শীতলতম জায়গার একটা।
একটা নালার ভেতর থামল ওরা। বিনয় সন্দেহ প্রকাশ করে বলল, এই গোলকধাঁধায় হেলিকপ্টার নামতে পারবে না। তবু নিয়াজকে ট্রান্সমিটার বের করার নির্দেশ দিল রানা। ওরা একজন একজন করে আমাদের তুলে নেবে, বিনয়, ব্যাখ্যা করল ও। তারপর কুকুরগুলোকে খোলা বরফে নিয়ে যাব আমি। ক্যানভাসের ভেতর থেকে ট্রান্সমিটার বের করছে নিয়াজ, নালার ঢাল বেয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে নেমে এল ইভেনকো। ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকল রানা। ইভেনকো হাঁপাচ্ছে। রানার মুখের কাছে হাত নেড়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, আর যখন বিপদের কোন ভয় নেই, এবার আমার সম্পত্তি আমাকে ফিরিয়ে দিন!
মানে? চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকাল রানা, ডান বুটের ডগা দিয়ে বরফে খোঁচা মারছে। তেমন শক্ত মনে হলো না। বোধহয় ওর সন্দেহই ঠিক, নালাটার দুপাশে প্রেশার রিজ খুব। বেশি দিন আগে তৈরি হয়নি। এখানে মস্ত একটা ফাটল ছিল, সেটা বন্ধ করে মাথাচাড়া দিয়েছে বরফ-পাঁচিল।
আমার টিউব! তোমরা আমার টিউব চুরি করেছ! ভয়ানক। উত্তেজিত হয়ে পড়ল ইভেনকো, পারকার পকেট থেকে ভারী একটা টিউব বের করে রানার মুখের সামনে নাড়ল।
আপনার হাতেই তো রয়েছে ওটা, বলল রানা, বুটের ডগা হঠাৎ করে বরফের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে ভুরু কুঁচকে উঠল। গর্ত। থেকে বুট তোলার পর দেখা গেল ডগা থেকে কালচে পানি। ঝরছে। নরম বরফ এখানে। ইভেনকো এতই উত্তেজিত যে। ব্যাপারটা লক্ষই করল না।
এটা সেই টিউব নয়…!
আরেকটার কথা বলছেন, যেটার ভেতরে মেরিলিন চার্ট ছিল? সরাসরি ইভেনকোর দিকে তাকাল রানা। ওটা আমাদের কাছে থাকাই নিরাপদ। শুধু শুধু চেঁচামেচি করবেন না।
তারমানে? আমার জিনিস…
তাকে বাধা দিয়ে রানা বলল, কথা না বাড়িয়ে নিয়াজকে একটু সাহায্য করবেন, প্লীজ?
ট্র্যানসিভার কাঁধে নিয়ে নালা ধরে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে। নিয়াজ, সমতল কোন জায়গার খোঁজে। এরইমধ্যে অনেক দূর। চলে গেছে সে। জিনিসটা ভারী, বয়ে নিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। সাবধানে পা ফেলছে সে, পিছলা ঢালে পা হড়কালে সর্বনাশ ঘটে। যাবে। আরও খানিকদূর এগোবার পর একদিকের পাঁচিলের গায়ে একটা ফাঁক দেখল সে, মেঝেটা সমতল। ধীরে ধীরে ফাঁকের মাঝখানে ট্র্যানসিভার নামাল। রানার সামনে দাঁড়িয়ে তখনও ঘ্যান। ঘ্যান করছে ইভেনকো।
এরকম একটা অন্যায় আমি মেনে নেব কেন? আমার জিনিস আপনারা কেন লুকাবেন? ওটার জন্যেই ওয়াশিংটনে আমার দাম…
রানার মুখের সামনে টিউবটা নাড়ছে ইভেনকো, বিনয়ের সহ্য হলো না। ছো দিয়ে সেটা কেড়ে নিল সে, বলল, দাম? কিউটে না ওঠা পর্যন্ত কারও এক কানাকড়ি দাম নেই। রানার মুখের সামনে। টিউবটা নাড়ছেন, এর মানে কি? স্বাভাবিক ভদ্রতা কাকে বলে তাও ভুলে গেছেন? যান, নিয়াজের সাথে ধরাধরি করে ট্রান্সমিটারটা নিয়ে আসুন।
তোমরা আমেরিকান নও, অথচ…, গজগজ করতে করতে চলে গেল ইভেনকো।
নিচু গলায় রানা বলল, বিনয়, পায়ের নিচে নরম বরফ। সাবধানে থাকতে হবে।
নরমই তো হবার কথা, বলল বিনয়। সাগরের কাছাকাছি চলে এসেছি না!
হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠল ইভেনকো। দুজনেই ওরা ঝট করে সেদিকে তাকাল। আছাড় খেয়ে পড়ে গেল ইভেনকো। প্রায় সাথে সাথে উঠে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু পড়ে গেল আবার। সেরেছে! অসহায় বোধ করল রানা। ভদ্রলোকের গোড়ালি ভেঙে গেছে।
সিগন্যাল পাঠাবার জন্যে তৈরি হয়েছে নিয়াজ, ইভেনকোর চিৎকার শুনে সেট ফেলে ছুটে এল।
হাড় না ভাঙলেও, মারাত্মক চোট পেয়েছে ইভেনকো-গোড়ালিতেই। ব্যথায় নীল হয়ে গেছে চেহারা, ফেঁপাচ্ছে। নিয়াজ তার বগলের নিচে হাত গলিয়ে বসার ভঙ্গিতে খানিকটা তুলল, তারপর টেনে নিয়ে এল পাঁচিলের কাছে। পাঁচিলে হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগল ইভেনকো। একটা গর্তে পা দেবে গিয়েছিল, বুট থেকে কালচে পানি ঝরছে। মুখ তুলে রানা আর। বিনয়ের দিকে তাকাল নিয়াজ। রানা! এদিকে নরম বরফ! মি.। ইডেনকোর গোড়ালি মচকে গেছে, হাঁটতে পারবেন না!
ছুটল বিনয়। ধরাধরি করে একটা স্লেজে তোলা হলো ইভেনকোকে। রানাও পৌঁছুল। চেহারায় ব্যথা আর অভিমানের। ছাপ নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল ইভেনকো, রানার দিকে তাকাবে না।
সিগন্যাল পাঠানোটা জরুরী, মনে করিয়ে দিল রানা।
ঢাল বেয়ে আবার উঠতে শুরু করল নিয়াজ, সাথে বিনয়। দেখেশুনে পা ফেলছে ওরা, বরফের পাতলা আবরণে পা পড়লে চিরকালের জন্যে সাগরের অতলতলে তলিয়ে যেতে পারে। পাঁচিলের ফাঁকটার কাছে পৌঁছে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল নিয়াজ। সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? পরমুহূর্তে গলা থেকে দুর্বোধ্য একটা। হাহাকার ধ্বনি বেরিয়ে এল। পিছিয়ে পড়েছিল বিনয়, ছুটল সে। রেডিফন সেট নরম বরফে ডুবে গেছে। ট্রান্সমিটারের প্রায় সবটুকু অদৃশ্য হয়েছে, ওপরে খাড়া হয়ে রয়েছে শুধু এরিয়াল। বরফে হাঁটু গেড়ে বসল নিয়াজ, পাগলের মত হাত দিয়ে বরফ খুঁড়তে শুরু করল। ট্রান্সমিটার বেরুল না, গাদা গাদা বুদ্বুদের সাথে উঠে এল। কালচে পানি। ভেতরে দস্তানা পরা হাত গলিয়ে দিয়েও ট্রান্সমিটারের স্পর্শ পেল না সে। মরিয়া হয়ে এরিয়াল ধরে টান দিল, মট করে ভেঙে গেল সেটা। চারপাশ থেকে কাদাটে বরফ এসে বন্ধ করে দিল ফাঁকটা।
একমাত্র ট্রান্সমিটারটা গ্রাস করল প্রকৃতি। কিউটের সাথে যোগাযোগ করার আর কোন উপায় থাকল না।
.
মৌচাকের ব্যবস্থা করেছ? ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করল কর্নেল পয়মাল বলটুয়েভ। পোলার প্যাক থেকে হাজার ফিট ওপরে অস্থায়ী হেডকোয়ার্টারে বসে রয়েছে সে। সাবমেরিন কিলার দক্ষিণ দিকে উড়ে চলেছে। খুস্কায়েভের হেলিকপ্টার রয়েছে আরও দক্ষিণে, রেডিও-টেলিফোনে তার সাথে সরাসরি কথা হচ্ছে বলে কিউটের ছদ্মনাম মৌচাক ব্যবহার করছে ওরা।
মৌচাককে স্যান্ডউইচ বানানো হয়েছে, জবাব দিল খুস্কায়েভ।
ঘোঁৎ করে একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল কর্নেলের গলা থেকে, সেট অফ করে দিয়ে নিচে বরফের দিকে তাকাল সে। তার ধারণা, ঘটনা প্রবাহ নাটকীয় মোড় পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে চলেছে দ্রুত, ঠিক সময়টিতে ঠিক জায়গায় উপস্থিত থাকার একটা তাগাদা অনুভব করছে সে। মাঝরাতের মধ্যে আমরা মুঠোয় পাব ওদের, আপনমনে বিড়বিড় করল।
জুনায়েভের স্বভাবই হলো খারাপ দিকগুলো আগে চিন্তা করা। কিন্তু এখনও ওদের দেখতে পাইনি আমরা।
জুনায়েভকে থামাবার জন্যে চোখ গরম করে তাকাল কর্নেল। শব্দজটে কান ঝালাপালা হলো তার। চেহারায় নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে মেসেজটা রিসিভ করল সে। তারপর পাইলটের দিকে তাকাল। আরও জোরে চালাতে পারো না, নাকি বরফে নোঙর ফেলে আছ? ঝট করে জুনায়েভের দিকে ফিরল সে। মাঝরাতের মধ্যে, বলিনি? এইমাত্র টার্গেট দেখতে পেয়েছে ওরা।
.
রানা! শকুনটা ল্যান্ড করতে আসছে!
জানতাম। বরফ-পাঁচিলের ওপর থেকে চোখ কুঁচকে তাকাল রানা, পরিষ্কার দেখল সাবমেরিন কিলার নিচে নামছে। এখান। থেকে আধ মাইল দূরে, সমতল বরফের ওপর ল্যান্ড করতে যাচ্ছে ওটা।
শত্রুর চোখে ধরা পড়ে গেছে ওরা। এর আগে হেলিকপ্টারটা। দুবার উড়ে গেছে মাথার ওপর দিয়ে। নামার জন্যে ভাল জায়গা। বেছে নিয়েছে রুশ পাইলট, কিউট আর ওদের মাঝখানে। চোখ থেকে গ্লাস নামাল রানা। খুঁটি আরও একটা চেলেছে কর্নেল বলটুয়েভ-বরফ মোড়া জাহাজের মাস্তুলের কাছাকাছি ঝুলে রয়েছে। দ্বিতীয় সাবমেরিন কিলার, কিউট থেকে যাতে কোন হেলিকপ্টার টেক-অফ করতে না পারে।
প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলাম, রানার একপাশ থেকে তিক্ত গলায় বলল বিনয়। আর ঘণ্টা দুই সময় পেলেই…
রানার আরেক পাশে হামাগুড়ি দিয়ে রয়েছে নিয়াজ। থমথম করছে তার চেহারা।
দুঃখে কাতর হয়ে কোন লাভ নেই, বলল রানা। কি করতে হবে আমি জানি।
কুকুরগুলো হঠাৎ অস্থির হয়ে ওঠায় তাড়াহুড়ো করে নালায় নেমে গেল বিনয়। প্রথম সাবমেরিন কিলার এখনও নামছে, এঞ্জিন আর রোটরের আওয়াজ প্রেশার রিজে বাড়ি খেয়ে দিগ্বিদিক ছুটোছুটি শুরু করল। ধীরে ধীরে বরফে নামল সেটা, রোটর ঘুরছে। দরজা খুলে গেল, লাফ দিয়ে নিচের বরফে নামল লোকজন, প্রত্যেকের হাতে রাইফেল। পারকা পরা বেঢপ আকৃতি নিয়ে, চাঁদের আলোয় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল তারা, এগিয়ে আসছে। প্রেশার রিজগুলোর দিকে। অপারেশনের দ্রুতগতি আর সুশৃঙ্খল ভাব লক্ষ করে আবার মুগ্ধ হলো রানা।
এত লোক! নিজের অজান্তেই একটা ঢোক গিলে বলল নিয়াজ। আমার ধারণাই ছিল না সাবমেরিন কিলারে এত লোক ধরে।
কি করতে হবে তুমি জানো, নিয়াজকে মনে করিয়ে দিল রানা। ইভেনকোর ওপর কড়া নজর রাখবে। এখন যদি দ্রলোক আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, মাথায় বাড়ি।
রানা, আরেকবার ভেবে দেখো। তুমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছ তো!
ওদের আসার অপেক্ষায় বসে থাকলে সবাইকে মরতে হবে, শান্ত গলায় বলল রানা। ওরা শুধু ইভেনকোকে নিতে এসেছে, আমাদের নাম খরচের খাতায় টুকে রাখবে।
বরফ-পাঁচিল থেকে পিছলে নেমে এল রানা, হাতে রাইফেল নিয়ে নালা ধরে ছুটল। পিছন থেকে সবাই তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বিনয় আর ইভেনকোকে নির্দেশ দিল নিয়াজ। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যে-যার কাজে মন দিল ওরা।
দুপাশে বরফ-পঁচিল উঁচু হয়ে থাকলেও মাথা নিচু আর শিরদাঁড়া বাঁকা করে ছুটছে রানা। সামনে নরম বরফ থাকলে বিপদ হবে, জানে, কিন্তু গ্রাহ্য করছে না। জরুরী অবস্থায় সমস্ত ক্লান্তি কোথায় যেন উবে গেছে, নিজেকে সতেজ আর প্রাণবন্ত লাগছে ওর। ভাবনা-চিন্তায় কোন জড়তা নেই, হাত-পায়ের ওপর রয়েছে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। আত্মহত্যা করতে যাচ্ছ না তো, কথাটা। মিথ্যে বলেনি নিয়াজ-সোজা রাশিয়ানদের দিকে ছুটছে রানা।
ঝুঁকি নিচ্ছে রানা, কিন্তু বোকার মত নয়। এ-ধরনের সঙ্কটে। অনেকের বুদ্ধি খোলে, কিন্তু সাহসের অভাব দেখা দেয়। রানা। সাহসী যুবক, ওর রক্তে রয়েছে ঝুঁকির নেশা। একা নিজের কথা ভাবতে অভ্যস্ত নয়, সেজন্যেই কঠিন যে-কোন অভিযানে ওকেই নেতৃত্ব দেয় মানুষ। ইভেনকো সহ সহকর্মীদের প্রাণ বাঁচাবার দায়িত্ব রয়েছে ওর কাঁধে। কাজেই শত্রুদের বাধা দেয়ার জন্যে। সহজ বুদ্ধিটা কাজে লাগাচ্ছে ও। নালা এদিকে একটা নয়, অসংখ্য। রাশিয়ানরা একটা ধরে আসবেও না। সাবমেরিন কিলার থেকে বিশজনকে নামতে দেখেছে ও, তাদের সবার সামনে একা ওকে দাঁড়াতে হবে না। বিস্ময়ের ধাক্কায় শত্রুপক্ষ ঘাবড়ে যাবে, এই ভরসায় ছুটছে রানা। রাশিয়ানরা জানে সংখ্যায় ওরা মাত্র। চারজন, জানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে ছোট্ট দলটা। এই। পরিস্থিতিতে ওদের একজন তাদের দিকে ছুটে আসবে কল্পনা করা যায় না।
এঁকেবেঁকে, ঢালু হয়ে এগিয়ে গেছে নালা। খানিক পরপরই বাঁক নিতে হলো, কিন্তু ছোটার গতি কমল না। পাঁচিলের মাথা থেকে নালাগুলো দেখে নেয়া আছে, রানা জানে সবগুলোই গিয়ে। মিশেছে বরফের সমতল বিস্তারে। কোথাও কোথাও হিম করিডর গাঢ় ছায়ায় ঢাকা, কোথাও বাঁক নিলেই গায়ে জড়াচ্ছে চাঁদের কোমল আলো। একটু পরই গতি মন্থর করতে হবে ওকে, কারণ এগিয়ে আসা রাশিয়ানদের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে ও। ছুটছে, সেই সাথে হেলিকপ্টার এঞ্জিনের ভোতা আওয়াজ শুনছে। পাইলট কোন ঝুঁকি নিচ্ছে না, আবার চালু নাও হতে পারে ভেবে এঞ্জিন বন্ধই করেনি সে।
থামল রানা, তারপর সাবধানে, এক পা এক পা করে এগোল। রাশিয়ানদের সাথে দেখা হওয়ার সময় হয়ে এসেছে। দেয়াল ঘেঁষে এগোল ও, ফাঁক-ফোকরগুলো ভাল করে দেখে রাখছে—গা ঢাকা দেয়ার দরকার হলে কাজে লাগবে। অবশ্য আগেভাগে যদি পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় তবেই লুকোবার সুযোগ মিলবে। ওরা যে অ্যামেচার, কোন সন্দেহ নেই। সোভিয়েত স্পেশাল সিকিউরিটি ডিটাচমেন্টগুলোকে আর্কটিকে কাজ করার উপযোগী করে গড়ে তোলা হলেও, পোলার প্যাকে পায়ে হেঁটে অভিযানে বেরুবার ট্রেনিং দেয়া হয়নি। দুহাতে রাইফেলটা ধরে আছে রানা, বাঁক নিয়ে সামনে বেরিয়ে এল রুশ সৈনিক।
দুজনেই চমকাল। কিন্তু রাশিয়ান লোকটা হেলিকপ্টারের এত কাছাকাছি কাউকে দেখতে পাবে বলে আশা করেনি। সে তার অটোমেটিক রাইফেল কাঁধে রেখেছে। কাঁধ থেকে সেটা নামাতে যাওয়াই তার ভুল হলো। রানার মাথায় কোন চিন্তা খেলে যাওয়ার আগেই শরীরে খেলে গেল বিদ্যুৎ। রাইফেলটা হাতে ঘুরে গেল, ভারী বাট-প্লেট রুশ সৈনিকের মুখের দিকে তাক করে ধরল ও। চ্যাপ্টা বাটটাকে আসতে দেখল লোকটা, ঠিক মাথা বরাবর। শেষ মুহূর্তে মাথা ঝাঁকিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করল সে, মাথা বাঁচলেও, মুখ বাঁচল না। নাকের পাশে আর চোয়ালে রাইফেলের বাট পড়ল, ধাক্কা খেয়ে বরফের ওপর আছাড় খেলো সে। সামনে বাড়ল রানা।
চিৎ হয়ে পড়েছে লোকটা, বরফে ঠুকে গেছে মাথার পিছনটা। তবে ফার হুডে মাথা ঢাকা থাকায় মোটেও ব্যথা পায়নি। হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকল, হাতের রাইফেল ছিটকে পড়েছে দূরে। রানার। বুট পরা পা তার মুখের সামনে থামতেই দুহাত দিয়ে একটা পা জড়িয়ে ধরল সে। তারপর হ্যাঁচকা একটা টান দিল একপাশে।
রাইফেলের বাঁটটা খাড়াভাবে সজোরে নামাল রানা। শক্ত। কপালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল বাঁট। রানার পা জড়িয়ে ধরা হাত। দুটো নিথর হয়ে গেল। অজ্ঞান লোকটাকে পরীক্ষা করল রানা। মারা যাবার সম্ভাবনা কম। তবে জ্ঞান ফিরে পেতে সময় নেবে। ওর সঙ্গীরা আঘাতগুলো দেখে ধরে নেবে পা পিছলে শক্ত বরফে। আছাড় খেয়েছে। অবশ্য যদি খুঁজে পায়। বুটের ধাক্কায় লোকটাকে উপুড় করল রানা।
এরপর আরও বড় ঝুঁকি নিল ও, আবার ছুটতে শুরু করল সামনের দিকে। শত্রুপক্ষের কৌশলটা আন্দাজ করে নিয়েছে রানা। বিশজন সশস্ত্র লোক ছড়িয়ে পড়েছে খোলা বরফ প্রান্তরে, দশ-বারোটা নালা দিয়ে ভেতরে ঢুকবে তারা। কেউ যদি। ফেরারীদের দেখতে পায়, ফাঁকা গুলি করে বাকি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, সাথে সাথে আওয়াজ লক্ষ্য করে ছুটে এসে ছোট্ট। দলটাকে ঘিরে ফেলবে তারা। সামনে বাঁক দেখেও ছোটার গতি কমালো না রানা, বাঁক নেয়ার সাথে সাথে এক ফালি আলো। দেখতে পেল সামনে। নালা থেকে বেরুবার পথ পেয়ে গেছে ও, সামনে খোলা বরফের বিস্তার।
মাত্র একশো গজ দূরে সাবমেরিন কিলার, জোড়া ফিন রানার। দিকে মুখ করা। পাইলটের কেবিন রয়েছে উল্টোদিকে। রোটরের আওয়াজে কান ঝালাপালা। নালা থেকে উঁকি দিয়ে বাইরেটা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখে নিল রানা। খোলা জায়গায় কোন পাহারাদার নেই। বিশজনের একটা দল চারজনকে ধরতে যাচ্ছে, কল্পনাতেও ঠাই পায়নি চারজনের একজন বিপদ হয়ে এগিয়ে আসতে পারে। সরাসরি হেলিকপ্টারের দিকে হাঁটা ধরল রানা।
রাইফেলটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছে ও, দৃঢ় কিন্তু শান্ত ভঙ্গিতে হাঁটছে। ধীরে ধীরে কাছে চলে আসছে সাবমেরিন কিলারের পিছনটা। কাজটা এক ধরনের পাগলামি হয়ে যাচ্ছে, জানে রানা। পাইলট পিছন দিকে তাকাবে না এটা ধরে নিয়ে জুয়া খেলছে ও। পাইলট যদি তাকায়ও, ওকে হাঁটতে দেখে ততটা সতর্ক হবে না যতটা সতর্ক হবে ওকে ছুটতে দেখলে। শুধু একটা লিভার টানার অপেক্ষা, সাথে সাথে খাড়াভাবে আকাশে উঠে যাবে হেলিকপ্টার। মাত্র পাঁচ সেকেন্ডের ব্যাপার। হাঁটার গতি আরও কমিয়ে দিল রানা।
অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে এসে রানার মনে হলো, ভাগ্য আজ প্রসন্ন। ওর প্ল্যান সফল হতে যাচ্ছে। ফার হুড আর পারকা হুবহু রাশিয়ানদের মত দেখতে না হলেও, মিল আছে। অমিল যে-টুকু আছে, চাঁদের আবছা আলোয় পাইলটের চোখে পড়ার কথা নয়। যত কাছে চলে এল ততই বাড়তে লাগল রোটরের আওয়াজ, ততই দৌড়ের ঝোক চাপল শিরায় শিরায়। আর বিশ গজ বাকি। রানার প্রতিটি পেশী, প্রতিটি লোমকূপ নিঃশব্দে চিৎকার করছে। কিন্তু তবু রানা শান্ত, খানিকটা অলস ভঙ্গিতে হাঁটতেই লাগল। সাবমেরিন কিলারের লেজটা পুরানো ধাঁচের, আগেকার দিনে বাইপ্লেনে যেমন থাকত। কাঁধ থেকে রাইফেল নামিয়ে লেজটাকে পাশ কাটাল রানা। বুকের ভেতর হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। ধাপ বেয়ে উঠল। দম বন্ধ। বিপজ্জনক কিছু ঘটলে এখনই ঘটবে। বরফের পাতলা আবরণে মোড়া রয়েছে কেবিনের জানালা। দস্তানা পরা। হাত মুঠো করে জানালায় আঘাত করল ও।
হেলিকপ্টারের সাথে রানাও কাঁপছে। জানালায় ঘুসি মারায়। কোন লাভ হলো না। দ্বিতীয়বার আঘাত করল রানা। মাথা নিচু। করে আছে ও, জানে ভেতর থেকে কাঁচের ওপর নাক ঠেকিয়ে। ওকে দেখার চেষ্টা করবে পাইলট। নিজেদের লোক নয় বুঝতে পারলে খুন করার জন্যে খেপে উঠবে।
স্যাঁৎ করে একপাশে সরে গেল জানালা, অমনি রাইফেলের নলটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিল রানা। গরম বাতাস লাগল মুখে। হেলমেট পরা একটা ফার মোড়া মূর্তি সীটের ওপর পিছিয়ে গেল। বেরোও! রুশ ভাষায় বলল রানা, রোটরের আওয়াজকে ছাপিয়ে। উঠল ওর চিৎকার। তা না হলে গুলি খেয়ে মরো! জলদি! শুধু মুখে নয়, ইঙ্গিতেও লোকটাকে কন্ট্রোল কেবিন থেকে বেরিয়ে। আসার তাগাদা দিল রানা। জানালার ফ্রেমে হেলান দিল ও, রাইফেলের মাজু ঠেকাল লোকটার পাঁজরে। রুশ পাইলট গগলস পরে আছে, তবু চোখ দেখে তাকে যুবক বলেই মনে হলো। পঁচিশ, তার বেশি বয়স হবে না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে। রানা, এই বয়সেই বীরত্ব দেখাবার ঝোঁক থাকে। একটা লিভারের দিকে হাত বাড়াল পাইলট।
লিভারে টান পড়লেই বরফ ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়বে। সাবমেরিন কিলার। ঝুলে থাকতে হবে রানাকে। কিংবা আঁকি খেয়ে নিচের বরফে পড়ে যাবে, সেই সাথে সাঙ্গ হবে ভবলীলা। ট্রিগারে আঙুলের চাপ বাড়িয়ে গর্জে উঠল ও, গুলি করলাম!
মৃত্যু ভয় বড় ভয়। পাইলটের হাত স্থির হয়ে গেল। কিন্তু পরাজয় স্বীকার করেনি সে। লোকটা কি ভাবছে পরিষ্কার ধরতে পারল রানা। আড়চোখে পাশে তাকাল সে, মাজটা দেখে নিল। ভাবছে, গুলি খেয়েও বাঁচার আশা আছে কিনা। ক্যালিবার দেখে ভয় পেল সে, লিভার থেকে সরিয়ে আনল হাত। দাঁড়াও! বেরোও! হিংস্র হয়ে উঠেছে রানা। নালা থেকে ওদের কেউ বেরিয়ে এলেই পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। হেলিকপ্টারের জানালায় ঝুলে থাকা একজন লোককে গুলি করে মারা ডালে বসে থাকা পাখি শিকারের চেয়েও সহজ।
যেন পরাজয় স্বীকার করে নিয়েই হেডসেট খুলে ধীরে ধীরে সীট ছাড়ল পাইলট। তার শান্ত ভঙ্গি সতর্ক করে দিল রানাকে।
সীট থেকে খানিকটা উঠে লাফ দেয়ার ভঙ্গিতে স্থির হয়ে থাকল পাইলট, গগলসে ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলের আলো পড়ায় চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে না। বেরিয়ে এসো, কর্কশ গলায় বলল রানা। তাড়াতাড়ি করো! পাইলট কাছে সরে এল, সেই সাথে রাইফেলটা একটু একটু করে নিজের দিকে টেনে নিল রানা, বাঁটটা ঢুকে যাচ্ছে বগলের তলায়। এক হাতে রাইফেল, আরেক হাতে দরজার হাতল ধরে আছে ও। ট্রিগার গার্ডে আঙুল। হাতলে ঠেলা দিতেই দরজা একপাশে সরে যেতে শুরু করল। ধীর, অলস ভাবে হাত দুটো দুপাশে মেলে দিল পাইলট, আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে।
আস্তে আস্তে রানা আর দরজার দিকে এগিয়ে এল পাইলট। একটু পাশ ফিরল, যেন রানার ইঙ্গিতে লাফ দিয়ে বরফে নামতে যাচ্ছে। তারপর, ঘুরন্ত রোটরের তলা থেকে লাফ দিল সে। লাফ দিল বরফের দিকে নয়, রানার রাইফেল লক্ষ্য করে।
তৈরি ছিল রানা, কিন্তু শুধু আত্মরক্ষার জন্যে। এরকম একটা ব্যাপার ঘটে যাবে, ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। ঝট করে একপাশে সরে গিয়ে, দরজার হাতল ধরে ঝুলে পড়ল ও। ওকে পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল পাইলট, লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় তাল হারিয়ে ফেলল। দরজা দিয়ে বেরুল সে খাড়া ভাবে, পুরোপুরি সিধে। অবস্থায়। নিজের রোটরে গলা পেতে দিল লোকটা। ইস্পাতের ঘুরন্ত পাত জবাই করল তাকে।
ঝুলন্ত অবস্থায় নিচের দিকে তাকিয়ে বমি পেল রানার। পেট, গলা, আর গালের পেশীগুলোর ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকল না। পরপর কয়েকটা জোরাল ঢোক গিলে বমি ভাবটাকে ঠেকাল বটে, কিন্তু মাথার ভেতরটা ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। ধড়টা নিচে বরফে পড়ে আছে। সাদা বরফে লাল রক্তের স্রোত। রোটরের ধাক্কা খেয়ে। কোথায় ছিটকে পড়েছে মাথাটা আল্লাই মালুম। অবিশ্বাস্য ব্যাপার, নিজের রোটরে মুণ্ডুহীন হলো পাইলট। তবে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘরের ভেতরই ঘটে, পাইলটের ঘর বলতে তো হেলিকপ্টারকেই। বোঝায়। রানা কাঁপছে, ভাইব্রেশনই একমাত্র কারণ নয়। ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ও। পাইলটের সীটে বসে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকাল।
সিকোরস্কির কন্ট্রোল প্যানেলের সাথে অনেক মিল আছে। বেশিরভাগ ডায়াল আর লিভার চিনতে পারল রানা। অলটিচ্যুড রীডিংগুলো মিটারে লেখা রয়েছে। কিন্তু দুটো সুইচ আর একটা লিভার সম্পূর্ণ অপরিচিত লাগল। পাইলট যে লিভারে হাত দিয়েছিল সেটা ধরল রানা। কিছুই ঘটল না। আরও একটা চাপ দিল। সাথে সাথে বরফ থেকে শূন্যে উঠে পড়ল সাবমেরিন কিলার। লিভারটা নিজের দিকে টানল ও। ঝুঁকি খেলো হেলিকপ্টার, আবার নামল বরফে। হুক থেকে স্পেয়ার হেলমেটটা নামিয়ে দ্রুত হাতে পরে নিল। একটু ঢিলে হলো হেলমেট। ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলের আলো মাঝে মধ্যে ধাঁধিয়ে দিচ্ছে চোখ, কেমন যেন ঝাপসা লাগছে সব কিছু। কারণটা বুঝতে অসুবিধে হলো না। অদ্রিা আর ক্লান্তি। বিশ্রাম না পাওয়ায় গোলমাল করছে চোখ দুটো।
কন্ট্রোল প্যানেলে হাত দিল রানা। অলসভঙ্গিতে কয়েকটা সুইচ অন করল, সামনে ঠেলল কয়েকটা লিভার। মুহূর্তের জন্যেও ভোলেনি, যে-কোন মুহূর্তে রাশিয়ানরা ওদের স্লেজ-টীমের কাছে পৌঁছে যাবে। থ্রটল খুলে দিল রানা। জোড়া এঞ্জিন গর্জে উঠল। বড় করে শ্বাস নিল ও, তারপর ঠেলে দিল ওপরে ওঠার লিভারটা।