মরণখেলা: ২.০৩ উত্তর না পশ্চিম

মরণখেলা: ২.০৩ উত্তর না পশ্চিম

২.০৩ উত্তর না পশ্চিম

উত্তর না পশ্চিম?

রুশ আর্কটিক ঘাঁটি, এন.পি.সেভেনটিন। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আপনমনে বিড়বিড় করল কর্নেল পয়মাল বলটুয়েভ। টেবিলে পকেট সংস্করণ দাবার ছক মেলা রয়েছে, পাশে একটা খোলা বই। উনিশশো ছেষট্টি সালে সান্তা মোনিকায় ফিশার স্প্যাসস্কি দাবা খেলার রেকর্ড রয়েছে বইটায়। উর্বর মস্তিষ্ক, তিনটে কাজ একসাথে সারতে পারে বলে প্রায়ই গর্ব করে কর্নেল। এই যেমন এখন নিজের খেলা খেলছে, আরেকজনের খেলা পরীক্ষা করছে, সেই সাথে চলতি অপারেশন সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করছে।

সব কটা হেলিকপ্টার আকাশে, চেয়ারের পিছন থেকে রিপোর্ট করল জুনায়েভ। আই.আই.ফাইভের উত্তর আর পশ্চিম দিকে নজর রাখছে ওগুলো-সব কটা, শুধু ছয়টা বাদে। এই ছয়টাকে আপনি রাখতে বলেছেন।

মার্কিন স্নো-ক্যাট র‍্যাম্পে ধ্বংস হবার পর আই.আই.ফাইভ থেকে দ্বিতীয়বার ঘুরে এসেছে ওরা। দেখে এসেছে বরফ-দ্বীপ পরিত্যক্ত, কেউ নেই সেখানে। বলটুয়েভের জানার কথা নয়, গুন্টার রডেনবার্গ আর জেমস কাজম্যান রয়ে গেছে ওখানে। ইভেনকো রুস্তভ যদি আসে, ভেবে ছোট একটা ডিটাচমেন্ট ওখানে রেখে এসেছে কর্নেল। এন.পি.সেভেনটিনে ফিরে আসার পরপরই লেনিনগ্রাদ রেকর্ডস থেকে একটা মেসেজ পায় সে। মেসেজটা তাকে হতভম্ব করে তোলে।

আমরা যে বারবার রানার দল রানার দল করছি, জানো ওরা কজন? যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল কর্নেল। লেনিনগ্রাদ থেকে খবর এসেছে, নিয়াজ আর বিনয়, মাত্র এই দুজন বিজ্ঞানীকে নিয়ে আর্কটিকে এসেছে মাসুদ রানা।

মাত্র তিনজন? ইভেনকো রুস্তভকে নিতে এসেছে? জুনায়েভের চেহারায় রাজ্যের অবিশ্বাস।

হ্যাঁ, তিনজন খুব কম লোক, বলল কর্নেল। কিন্তু কোন কোন লোক একাই অনেক, এ-কথা জানো তো? ওদের দুজনকে। পঞ্চাশ পঞ্চাশ একশো জন ধরো, আর রানা একাই একশোকত। হলো? সংখ্যায় তিনজন, কিন্তু শক্তিতে দুশো। এবার সুবিধেগুলো হিসেব করো। সংখ্যায় কম, কাজেই কারও চোখে ধরা পড়ার ভয়। কম। ইভেনকো সাথে থাকলে চারজন, চারজন লোককে পোলার। প্যাকে খুঁজে পাওয়া সহজ, না কঠিন, জুনায়েভ? কতটুকু কঠিন?

প্রায় অসম্ভব, কর্নেল কমরেড।

বারবার প্রমাণও হচ্ছে তাই, বলল কর্নেল। দুদিন আগে যে ছবিটা তোলা হয়েছে, মনে আছে? একদল লোক কুয়াশার ভেতর লুকিয়ে পড়ছিল? হঠাৎ করেই মেঝেতে পা ঠুকল সে। সব কটা। কপ্টারকে কোডেড সিগন্যাল পাঠাও-ওরা আসলে ছোট একটা। দলকে খুঁজছে। সম্ভবত একজোড়া স্লেজ-টীম আর চারজন লোক।

যে ছয়টাকে আপনি রাখতে বলেছিলেন…

ওগুলো দক্ষিণে যাবে-আই.আই.ফাইভের দক্ষিণে।

কিন্তু কর্নেল কমরেড, আমেরিকানরা উত্তর আর পশ্চিম দিকে নজর…!

কর্নেল হুঙ্কার ছাড়ল, এখনও তুমি যাওনি?

একা হতেই পায়চারি শুরু করল সে। কিছু উদ্ভট সিদ্ধান্ত কখনোই সে ব্যাখ্যা করে না। জেনারেল দ্য গলের মত নিজের। চারপাশে রহস্যের একটা অদৃশ্য বলয় তৈরি করে রাখতে পছন্দ করে। পরে যদি সিদ্ধান্তগুলো ভুল প্রমাণিত হয়, গা বাঁচানোর পথ খোলা থাকে। কি সে করতে চাইছিল তাই যদি কেউ না জানে, কোথায় ভুল করেছে ধরবে কিভাবে?

তবে কর্নেলের মনে একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে, ধীরে ধীরে বাড়ছে সেটা। মারমানস্ক থেকে বাইসন বম্বারে চড়ে আসার সময় জেনারেল ফচের ডোশিয়ে পড়েছে সে। জেনারেল ফচ ডিসেপশন অপারেশনে স্পেশালিস্ট। এ-ব্যাপারে মাসুদ রানা আরও এক কাঠি বাড়া। আমেরিকানরা আই.আই. ফাইভের উত্তর আর পশ্চিমে প্লেন পাঠিয়েছে, এই বাস্তব ঘটনা অগ্রাহ্য করা যায় না। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা যদি কেঁচে যায়, ওদিকের এলাকাগুলো চেক করা না হলে জবাবদিহি করতে হবে তাকে। কিন্তু আসলে দক্ষিণ দিকটাই তার মনোযোগ কাড়তে শুরু করেছে।

খানিক পর ফিরে এল জুনায়েভ। পাঁচ মিনিটের মধ্যে টেকঅফ করছে ওগুলো।

চমৎকার! এবার হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার নার্ভায় সিগন্যাল পাঠাও, আমেরিকান আইসব্রেকার কিউটের পজিশন জানতে বলো ওদের।

আবার বিস্ময় বোধ করল জুনায়েভ, কিন্তু প্রশ্ন করার সাহস হলো না। ব্যস্ত ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

কেন যেন মনে হলো কর্নেলের, রানার সাথে অচিরেই আবার দেখা হতে যাচ্ছে তার। ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার চেহারা। পায়চারি থামিয়ে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ঘোড়ার চাল দিল আড়াই ঘর।

.

রানা কোন যুক্তি মানছে না। বলা ভাল, যেন পণ করেছে কারও কথাই শুনবে না ও। সহকর্মী আর কুকুরগুলোকে অমানুষিক খাটাচ্ছে, গোয়ারের মত জেদ ধরে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে সামনের দিকে। কড়া নির্দেশ, কোন কারণেই থামা চলবে না। না বিশ্রামের জন্যে, না কিছু মুখে দেয়ার জন্যে। জোড়া স্লেজ-টীম টেন্থ মেরিডিয়ান ধরে বিরতিহীন ছুটে চলেছে দক্ষিণ দিকে, ক্রমশ কাছে। চলে আসছে আইসফিল্ডের কিনারা, আইসবার্গ অ্যালি।

চারদিক থেকে ওদেরকে ঘেরাও করে রেখেছে প্রেশার রিজ, এবড়োখেবড়ো বরফের বিশাল প্রাচীর একেকটা। নালা-পথ ধরে। ছুটছে কুকুরগুলো, চাঁদের আলোয় চিক চিক করছে সাদা প্রকৃতি। নিজের স্লেজ-টীম নিয়ে সামনে রয়েছে রানা, নির্দয়ভাবে মুহূর্মুহু। চাবুক মারছে কুকুরগুলোর পিঠে। প্রাণপণে ছুটছে ওগুলো, শরীরের সবটুকু শক্তি এক করে। বেশ খানিকটা পিছনে রয়েছে। বিনয়ের টীম, তার পাশে থাকার জন্যে ঝড়ের বেগে ছুটতে হচ্ছে। নিয়াজকে।

এর কোন মানে হয়? হাঁপাতে হাঁপাতে বলল নিয়াজ। ওর সাথে আমাদের কথা বলা দরকার।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল বিনয়।

ছোটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে রানার পাশে চলে এল নিয়াজ। রানা, কুকুরগুলোর বিশ্রাম দরকার। এভাবে বেশিক্ষণ ছুটতে পারবে না…

ফার হুডের ফাঁকে যতটুকু দেখা যায়, কঠোর রানার চেহারা। বার কয়েক সপাং সপাং করে উঠল হাতের চাবুক। কুকুরগুলো। আরও একটু বাড়িয়ে দিল ছোটার গতি। সামনে মোড় নিয়েছে নালা, গতি যাতে মন্থর না হয় সেজন্যে বারবার চাবুক মারল রানা। মাত্র একদিকের রানার-এ ভর করে বাঁক নিল স্লেজ, বরফের ছাল তুলে একই গতিতে ছুটল। নিয়াজের কথা যেন শুনতেই পায়নি ও।

আরেকবার ভাবো, অনুরোধের সুরে বলল আবার নিয়াজ। আমাদেরও বিশ্রাম দরকার। কিউট এখনও অনেক দূরে। আজ রাতে ওখানে আমরা পৌঁছুতে পারব না…!

পাল্টা চিৎকার করল রানা, বাঁচতে হলে ছুটতে হবে। তোমরা চাও বিশ্রামের জন্যে থেমে চির বিশ্রামের ঝুঁকি নিই?

রুস্তভ সাহেবের কথা ভেবে দেখেছ? জিজ্ঞেস করল নিয়াজ। উনি আর পারছেন না।

তাড়াতাড়ি পিছন দিকে তাকাল রানা। বিনয় আর তার স্লেজটীমের পিছনে রয়েছে ইভেনকো রুস্তভ। পিছিয়ে পড়েছে বেশ খানিকটা, তবে ছুটছে এখনও। নজর বুলিয়েই বুঝল রানা, ভদ্রলোকের কষ্ট হচ্ছে। একটু হয়তো নিষ্ঠুর, কিন্তু কৌশলটা কাজ দিচ্ছে, ভাবল ও। ওরই নির্দেশে সবার পিছনে থাকতে হয়েছে রুশ বিজ্ঞানীকে। যে-কোন একটা স্লেজে জায়গা দেয়া যেত তাকে, কিন্তু হিতে বিপরীত হত তাতে, গোটা দলটাকে পিছিয়ে দিত লোকটা। এরইমধ্যে রানার জানা হয়ে গেছে, ভদ্রলোকের স্বভাবই হলো প্রত্যেকটি বিষয়ে খুঁত বের করে জেদ ধরা। স্লেজে ঠাই না পাওয়ায় সারাক্ষণ তার মনে একটা ভয় কাজ করছে, তাকে একা ফেলেই না চলে যায় ওরা। তিন ঘণ্টা আগে রানা বলেছিল, ওঁকে। একটা আতঙ্কের মধ্যে রাখতে হবে, তা না হলে প্রতি পদে বাধা দেবেন উনি।

ওঁর বয়স হয়েছে, আবার শুরু করল নিয়াজ।

ব্যাপারটা যে পিকনিক পার্টি হবে না, জেনেই নিজেদের ঘাঁটি ছেড়ে বেরিয়েছেন উনি, বলল রানা। দুচারবার আছাড় না খাওয়া পর্যন্ত ওঁর সাথে কেউ কথা বোলো না। আমার সাথেও নয়,…স্লেজ চালাচ্ছি।

পিছিয়ে পড়ল নিয়াজ। রানার মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে, কারও কথা শুনবে না। ওর সাথে সামনে ছোটা ছাড়া উপায় নেই।

আসলে রানার মেজাজ মোটেও বিগড়ায়নি। নিয়াজকে চুপ করাবার সবচেয়ে সহজ পথটা বেছে নিয়েছে ও। বিশ্রামহীন এই। ছুটে চলা, এ-ও যুক্তিহীন কোন জেদ নয়। ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব করে দেখেছে রানা, তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিন ঘণ্টা হয়ে গেল। কোন রাশিয়ান হেলিকপ্টার দেখেনি ওরা। কারণটা ওর জানা নেই। তবে চাদের আলোয় আকাশ পরিষ্কার থাকায় সুযোগটা হাতছাড়া করা চলে না। যতটা সম্ভব দক্ষিণে সরে যেতে হবে ওদের। তবেই যদি বলটুয়েভের হেলিকপ্টারগুলোকে ফাঁকি দেয়া যায়।

কিউটের সাথে যোগাযোগ না হওয়া পর্যন্ত থামবে না রানা, ভেবে রেখেছে। কাউকে বলেনি, কারণ তর্ক বেধে যাবে। ওর নিজের মনেও সন্দেহ আছে, আজ রাতে কিউটের দেখা না-ও পাওয়া যেতে পারে। তবে আশা ছাড়েনি এখনও। সবাইকে নিয়ে। এভাবেই সামনের দিকে ছুটবে ও, যতক্ষণ না কিউটের সাথে। যোগাযোগ হয়। কিংবা যতক্ষণ না কুকুরগুলো বরফের ওপর লুটিয়ে পড়ে।

এক ঘণ্টা পর দক্ষিণ-পুবে উঁকি দিল আমেরিকান প্লেন।

.

হল্ট!

পিছনের ওদেরকে সাবধান করার জন্যে ঝট করে হাত তুলল রানা, সীসার মত ভারী লাগল হাতটাকে। কুকুরগুলোকে দাঁড় করিয়ে নিয়াজের হাতে চাবুকটা ধরিয়ে দিল, তারপর বাঁ দিকের প্রেশার রিজে ওঠার জন্যে খামচাখামচি শুরু করল। যেখানেই পা রাখে, ভেঙে যায় বরফ। দস্তানা পরা হাত পিছলে নেমে আসে। এতই ক্লান্ত, মনে হলো কয়েক সেকেন্ড নয়, কয়েক বছর ধরে পাহাড়ে ওঠার ব্যর্থ চেষ্টা করছে ও। দূর থেকে ভেসে আসা এঞ্জিনের আওয়াজ জোর তাগাদা দিচ্ছে-তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি! আওয়াজটা অন্য রকম, সোভিয়েত হেলিকপ্টারের ভোঁতা ভট ভট নয়। একরোখা চেষ্টায় অবশেষে পাঁচিলের মাথা নাগালের মধ্যে চলে এল। তারপর খুব সহজেই উঠতে পারল রানা। নাইট-গ্লাস চোয়াল আর বুকের মাঝখানে আটকে গিয়েছিল, ব্যথাটা টের পেলেও গ্রাহ্য করল না। গ্লাস জোড়া চোখে তুলে দূরে তাকাল।

স্থির হয়ে থাকা ঢেউ আকৃতির প্রেশার রিজের প্রায় শেষ সীমানায় চলে এসেছে ওরা, খানিক সামনে থেকে শুরু হয়েছে। জমাট সাগরের সমতল বিস্তার। দুহাজার ফিট ওপরে রয়েছে প্লেনটা, দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে উড়ে যাচ্ছে, একটু পর ওদের আধ মাইল দূর দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাবে। ফোকাসিং মেকানিজম হাতড়াতে শুরু করল রানা-আমেরিকান, না রাশিয়ান? কাঠামোটা ঝাপসা দেখাল, ভাবল ফোকাস অ্যাডজাস্ট হয়নি। তারপর বুঝল, তা না, আসলে ক্লান্ত চোখ অসহযোগিতা করছে। হাত দিয়ে রগড়ে আবার গ্লাসে চোখ রাখল, লেন্সে পরিষ্কার ধরা পড়ল প্লেন, ফিউজিলাজে সাদা তারকা-চিহ্ন আঁকা। মার্কিন!

নিয়াজ! স্মোক ফ্লেয়ার! জলদি! আমেরিকান…

নালায় দাঁড়িয়ে আছে ওরা, আনন্দ আর বিস্ময়ের ধাক্কায় এক সেকেন্ড কেউ নড়তে পারল না। ইতিমধ্যে প্রথম ডগ-টীমের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ইভেনকো রুস্তভ, তার হাতে হ্যান্ডেলবার। আর চাবুক ধরিয়ে দিয়ে স্মোক ফ্লেয়ার খুঁজতে শুরু করল নিয়াজ।

জলদি! তাগাদা দিল রানা।

ফ্লেয়ার নিয়ে পাঁচিলে উঠতে চেষ্টা করল নিয়াজ। অর্ধেকটা উঠল, রানার বাড়ানো হাতে সেটা ধরিয়ে দিতে গিয়ে পা পিছলে নেমে এল নালায়। দাঁতে দাঁত চাপল রানা। ভাগ্য আর প্রকৃতি। নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছে ওদের নিয়ে।

দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় পাঁচিলের মাথায় উঠতে পারল নিয়াজ, আগেই তার কাছ থেকে স্মোক ফ্লেয়ার নিয়ে নিয়েছে রানা। কিন্তু হাত দুটো ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে আছে, বারবার পড়ে গেল ফ্লেয়ারটা। বার কয়েক চেষ্টা করার পরও জ্বলল না। চেঁচিয়ে উঠল রানা, এটা নষ্ট, আরেকটা দাও!

ছুটে রানার স্লেজের কাছে চলে এল বিনয়, নিয়াজও খাড়া ঢাল। বেয়ে নেমে এল নালায়। ওরা যখন ফ্লেয়ার খুঁজছে, প্লেনের ডানায়। লাল আর সবুজ আলো ঘুরতে শুরু করেছে। নতুন কোর্স ধরে দক্ষিণ দিকে, আরও দূরে চলে যাচ্ছে প্লেন। জলদি করো, ফর। গডস সেক! গর্জে উঠল রানা। বিনয়ের হাতে একটা ফ্লেয়ার। দেখল ও। ওখান থেকেই, ওখান থেকেই-তাড়াতাড়ি!

জ্বলে উঠল ফ্লেয়ার, গাঢ় ধোঁয়া ছাড়ল, শান্ত বাতাস ভেদ করে হুস করে উঠে গেল আকাশে। লাল আর নীল আলোকমালা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। প্রতিমুহূর্তে আরও ওপরে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু সেই। সাথে আরও দূরে সরে যাচ্ছে প্লেনটাও। প্রতি মুহূর্তে ছোট হয়ে আসছে সেটা। চাঁদের আলোয় এক সময় খুদে একটা বিন্দুর মত দেখাল ওটাকে। বরফের গায়ে হামাগুড়ি দিয়ে পাচিলের মাথায়, রানার পাশে উঠে এল বিনয় আর নিয়াজ।

এখনও চলে যায়নি… যেন নিজেকে আশ্বাস দিল নিয়াজ। পিছন দিকে তাকাও, ভাই, পাইলটের উদ্দেশে বিড়বিড় করছে সে। চোদ্দপুরুষের দোহাই লাগে, একবার পেছন ফেরো! ওদের দৃষ্টিসীমা থেকে হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে গেল রূপালি বিন্দুটা। শুধু এঞ্জিনের অস্পষ্ট গুঞ্জন শোনা গেল আরও কিছুক্ষণ, তারপর সেটাও মিলিয়ে গেল দূরে।

রুটিন ওয়েদার ফ্লাইট, বলল রানা। আমাদের খোঁজে আসেনি।

অবজারভার লোকটাকে ধরতে পারলে চড় লাগাব, রাগে ফুসে উঠল বিনয়। আমাদের বোধহয় রেডিও ব্যবহার করা উচিত ছিল।

পাগল নাকি! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল রানা। রেঞ্জের মধ্যে কিউট না এলে রেডিও ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না। সামনে সেট নিয়ে অপেক্ষা করছে সোভিয়েত অপারেটর, রেডিও অন করলেই লোকেশন জেনে ফেলবে। গেট রেডি!

নিঃশব্দে রওনা হলো ওরা, মাথার ওপর এখনও জ্বলজ্বল করছে লাল নীল আলোকমালা। সবাই কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে, এমনকি কুকুরগুলোকেও বিষন্ন মনে হচ্ছে। দুর্গম পথ পিছনে ফেলে সমতল জমাট সাগরে নেমে এল স্লেজ, এখন থেকে খুব দ্রুত আর সহজে এগোনো যাবে, তবু মন খারাপ সবার।

আসলে হতাশা আর ক্লান্তিতে রানার বুদ্ধিশুদ্ধি খানিকটা ভোতা হয়ে গেছে। হাড়ের প্রতিটি জয়েন্টে টনটনে ব্যথা, অসাড় পেশী, চোখ জোড়া এমন জ্বালা করছে যেন লংকাগুঁড়ো ঘষে দিয়েছে। কেউ। হ্যান্ডেলবার ধরে আছে, কিন্তু যে-কোন মুহূর্তে মুঠো থেকে। ছুটে যেতে পারে। ইচ্ছাশক্তি দুর্বল হয়ে আসছে প্রতি মুহূর্তে। ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টি। শুধু বেঁচে থাকার প্রবল আগ্রহে ছুটে। চলেছে ও সামনে। শরীরের শেষ শক্তিটুকু থাকতে থামা চলবে না। ওদের। শুধু নিজের কথা নয়, সবার কথাই ভাবতে হবে ওকে।

লুক আউট! গলা ফাটাল নিয়াজ।

কেউ নড়বে না! বিস্ফোরিত হলো রানা।

অকস্মাৎ স্থির হয়ে গেল স্লেজ দুটো। ওদের পিছনে আর্কটিক। রাতের নিস্তব্ধতা এঞ্জিনের ভোতা ভট ভট আওয়াজে ভেঙে খান খান হলো। তারপর ছায়াটা দেখা গেল। স্থূল আকৃতির কালো ছায়া। জোড়া রোটর, একটার ওপর আরেকটা। লেজের দিকে একজোড়া ফিন। ওদের মাথা থেকে মাত্র পঞ্চাশ ফিট ওপর দিয়ে উড়ে গেল যান্ত্রিক ফড়িং। টুইন জেট সাবমেরিন কিলার। রাশিয়ানদের লেটেস্ট হেলিকপ্টার।

খোদার দোহাই, নোড়ো না কেউ! আবার সাবধান করল রানা। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে হেলিকপ্টার, সেই সাথে বাঁক নিতে শুরু করে আরও ওপরে উঠছে। রুশ আরোহীরা ওদেরকে নাও। দেখে থাকতে পারে। আন্দাজ পঞ্চাশ মাইল গতিতে উড়ে গেছে মাথার ওপর দিয়ে, আচমকা প্রেশার রিজের গোলকধাধা থেকে। বেরিয়ে এসেছিল খোলা প্রান্তরে-ওদেরকে দেখতে পাবার জন্যে। রুশ অবজারভারের তীক্ষ্ণ চোখ থাকতে হবে। কয়েক সেকেন্ড পর জানা গেল, তাই আছে। ফিরে আসছে হেলিকপ্টার।

সর্বনাশ ঘটিয়েছে স্মোক ফ্লেয়ার। আমেরিকান পাইলটের চোখে ধরা না পড়লেও, কাছাকাছি কোথাও থেকে রুশ হেলিকপ্টারকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে এসেছে।

ফিরে আসছে। আগের চেয়ে ধীর গতিতে আসছে, অনেক উঁচু দিয়ে। তারমানে শুধু যে স্লেজগুলো দেখেছে তাই নয়, কাঁধে ঝোলানো রাইফেলগুলোও দৃষ্টি এড়ায়নি। তা না হলে পঞ্চাশ ফিট থেকে দুশো ফিটে উঠে যেত না।

কি করবে ওটা? জিজ্ঞেস করল বিনয়।

কতজন লোক আছে তার ওপর নির্ভর করে, বিড়বিড় করল রানা।

দলের দায়িত্ব নিয়াজকে দিয়ে খানিক দূরে সরে দাঁড়াল ও, একা। রাইফেলটা হাতেই থাকল। আজরাইলের মত এগিয়ে এল স্থূলকায় সাবমেরিন কিলার। মাথার ওপর চলে আসার পর মনে হলো, রোটরের আওয়াজে পায়ের নিচে বরফ কাঁপছে। রাইফেল তুলল রানা, মাজুল অনুসরণ করল কিলারকে।

শূন্যে স্থির হতে যাচ্ছিল কিলার, রানার ভাবগতিক সুবিধের নয় বুঝতে পেরে একদিকে কাত হয়ে তাড়াতাড়ি দূরে সরে গেল, পিছনে রেখে গেল সাদাটে ধোঁয়া।

কিন্তু না, এত সহজে বিদায় নিতে ফিরে আসেনি পাইলট। নিরাপদ দূরত্বে থেকে ঘুরতে লাগল কিলার। ওটার ওপর চোখ রাখার জন্যে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে চারদিকে ঘুরতে হলো ওদেরকেও। হঠাৎ আঁতকে উঠল নিয়াজ। সাবধান! ওরা টেলিস্কোপ সাইটে চোখ রেখে দেখছে আমাদের…!

কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে চোখে নাইট-গ্লাস তুলল রানা। রাইফেল নামাও! নিয়াজকে নির্দেশ দিল ও। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘুরতে ঘুরতে দেখল, হেলিকপ্টারের দরজার গায়ে বসানো জানালা খুলে গেছে, চাঁদের আলোয় ভেতরে দেখা যাচ্ছে কালো চকচকে একটা মাজু। সিনে-ক্যামেরা, আবার বলল রানা। আমাদের ছবি তুলছে-ভয় পাবার কিছু নেই। ক্যামেরায় ওটা টেলি-ফটো লেন্স ব্যবহার করছে ওরা।

নিয়মও তো তাই, মন্তব্য করল নিয়াজ, ছবি শুধু হিরো আর ভিলেনদের তোলা হয়!

রুশ সাবমেরিন কিলার কোর্স বদলে যাচ্ছে, উত্তর-পুব দিকে। এঞ্জিনের আওয়াজ দ্রুত মিলিয়ে গেল। স্লেজের কাছে ফিরে এসে। নিয়াজের কাছ থেকে হ্যান্ডেলবার নিল রানা।

আমি জানি কেন ল্যান্ড করেনি, বলল নিয়াজ।

লোকজন কম বলে। দূরে তাকাল রানা, সমতল বরফের পর, বহু দূরে, আবার শুরু হয়েছে প্রেশার রিজ। ফিরে এসে আবার যদি খোলা জায়গায় পায় আমাদের, একজনও বাঁচব না।

ফিরে যে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এবার শুধু। লোকবল নয়, সাথে অস্ত্রবলও থাকবে।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত