২.০২ দুনিয়াটা একদিন এরকমই দেখতে ছিল
দুনিয়াটা একদিন এরকমই দেখতে ছিল, ভবিষ্যতেও হয়তো কোন দিন এরকম দেখাবে। প্রাণহীন, বন্ধ্যা, জমাট বরফ-সূর্যের বাঁধন ছিড়ে বেরিয়ে আসা মৃত গ্রহ, অসীম শূন্যে নিঃসঙ্গ পথচারী। চারদিকে তাকিয়ে রানা যেন মানব-জাতির বিলুপ্তি চাক্ষুষ করল।
ক্ষীণ বাতাসের মৃদু নাড়া খেয়ে দক্ষিণ দিকে সরে গেছে কুয়াশা। ক্ষীণ কিন্তু হিমশীতল, সরাসরি উত্তর মেরু থেকে আসছে। কুয়াশা সরে যাওয়ায় জমাট বরফ রাজ্য চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করছে যতদূর দৃষ্টি চলে। কোথাও কিছু নেই, শুধু বরফ, আর বরফ। মরুভূমিতে কিছু না কিছু গজায়, নিঃসঙ্গ মরুদ্যান থাকে, দুএক জায়গায় কাটা-ঝোপ দেখা যায়, কোথাও টলটল করে নীল গরম পানি। এখানে সে-সব কিছু নেই, আছে শুধু ঠাণ্ডা বরফ।
ওদের সামনে প্রেশার রিজ ঝুলে আছে, বালিয়াড়ির মত ঢেউ খেলানো, দশ থেকে বিশ ফিট উঁচু। নিয়াজের কম্পাসের ওপর বিশ্বাস রেখে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে ওরা। স্লেজ দুটোকে প্রাণপণে টেনে নিয়ে চলেছে কুকুরগুলো। গন্তব্য সুদূর গ্রীনল্যান্ড, একশো মাইল দূরে। এখনও নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল নয় রানা, মাঝে মধ্যেই ঝোক চাপছে পশ্চিমের বদলে দক্ষিণে যায়। দক্ষিণে রয়েছে দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা-আইসবার্গ অ্যালি।
ঘণ্টাখানেক হলো পর্দা তুলে নিয়েছে কুয়াশা, এখনও রাশিয়ানদের ছায়া চোখে পড়েনি। হতে পারে কর্নেল বলটুয়েভের লোকজন এখনও হয়তো আই.আই. ফাইভের চৌহদ্দি পাহারা। দিচ্ছে। ইভেনকো রুস্তভ আসবে, এই আশায় অপেক্ষা করছে। স্লেজ চালাবার ফাঁকে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে একবার তাকাল রানা, ছুটে তার পাশে চলে এল নিয়াজ। ভি.আই.পি. প্যাসেঞ্জারের খবর কি, নিয়াজ? জিজ্ঞেস করল ও।
মহাশয়ের পশ্চাদ্দেশে বোধহয় ব্যথা, ফাজলামি করে বলল। নিয়াজ। তুমি জেরা করার পর সেই যে হাউকাউ শুরু করেছেন, থামাথামি নেই। বিনয়ের স্লেজে এমন ভঙ্গিতে বসে আছেন, যেন। চেঙ্গিস খান। তোমার অনুমতি পেলে মনের খানিকটা ঝাল। মেটানো যেত।
পরে। জানো তো না কি উপাদানে তৈরি, ঘাটালে পিছিয়ে দেবে আমাদের। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকাল রানা। উত্তর-পুব থেকে গাঢ় একটা আলোক বিন্দু এগিয়ে আসছে, সোজা ওদের। দিকে। কুৎসিত একটা পাখির মত রাতের আকাশ চিরে আসছে। ওটা, এখনও এত দূরে যে রোটর ডিস্ক দেখা গেল না বা এঞ্জিনের আওয়াজও শোনা গেল না।
হেলিকপ্টার! গেট আন্ডার কাভার…! একই সাথে সপাং করে উঠল রানার হাতের চাবুক। জোরে, আরও জোরে ছুটল কুকুরগুলো, যেন বুঝতে পেরেছে সামনের প্রেশার রিজগুলোর আড়ালে গা ঢাকা দিতে হবে।
বাঘের মত হুঙ্কার ছাড়ল নিয়াজ। ইভেনকো রুস্তভকে স্লেজ থেকে নেমে ছুটতে বলছে সে। ইহুদি ভদ্রলোক চলন্ত স্লেজ থেকে নামতে গিয়ে বরফের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। কেউ তাঁকে সাহায্য করার নেই, সবাই তাঁকে ফেলে এগিয়ে গেছে, নিজের ভাষায় অভিশাপ দিতে দিতে দাঁড়ালেন তিনি, লম্বা পা ফেলে ছুটলেন। দ্রুত এগিয়ে আসছে যান্ত্রিক ফড়িং, প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। এঞ্জিনের আওয়াজ। প্রথম বরফ-পাঁচিলের একটা ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকে গেল রানার স্লেজ, একটা করিডরের ভেতর থামল কুকুরগুলো। পিছু পিছু করিডরে ঢুকল বিনয়ের স্লেজ, রুশ বিজ্ঞানী তখনও উন্মুক্ত বরফ প্রান্তরে, অথচ একেবারে কাছে চলে এসেছে। রাশিয়ান হেলিকপ্টার। দাঁড়িয়ে পড়ল নিয়াজ, জানে, প্রাণের ওপর ঝুঁকি নেয়া হয়ে যাচ্ছে। ইভেনকো রুস্তভের হাত ধরে হঁাচকা একটা টান দিল সে, তাকে নিয়ে ছুটল আবার। বরফ-পাঁচিলের কাছাকাছি এসে পিঠে ধাক্কা খেলেন ওশেনোগ্রাফার। নিরাপদ আড়ালে ছিটকে পড়লেন তিনি।
রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে সবাই, কুকুরগুলো পর্যন্ত মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে-হাঁপাচ্ছে।
খুব নিচে দিয়ে উড়ে আসছে রুশ ফড়িং, পাঁচিলের জন্যে দেখতে পাচ্ছে না কেউ। বেশি হলে বরফ থেকে দুশো ফিট উঁচুতে। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেলে নিশ্চয়ই দেখা যাবে। পনেরো ফিট উঁচু বরফ-পাঁচিলের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা, পাঁচিলের মাথা ওদের দিকে ঝুলে আছে ভাঙতে শুরু করা ঢেউয়ের মত। এঞ্জিনের আওয়াজ এখনও বাড়ছে, নালার ভেতরটা কাপছে। হঠাৎ ঝামেলা শুরু করল বিনয়ের একজোড়া কুকুর। এই আওয়াজের ওপর ওদের ঘৃণা থাকা স্বাভাবিক, কারণ হেলিকপ্টারই ওগুলোকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল কুয়াশার কিনারায়। লাফ-ঝাঁপ দিয়ে সামনে ছুটতে চাইল কুকুর দুটো, রশি ছিড়ে পালিয়ে যেতে চায়। একটার মাথায় প্রচণ্ড এক থাবড়া মারল বিনয়, ঝট করে। বিনয়ের দিকে ঘুরল সেটা, ভীতিকর ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরিয়ে এল। গলার ভেতর থেকে। করিডরের ভেতর কুকুরগুলো ছুটোছুটি করলে ওপর থেকে ওগুলোকে দেখা যাবে। কিছু নড়াচড়া করলে। সেটাই সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে।
উদ্বেগের সাথে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রানা, নিজের টীম ছেড়ে নড়তে পারছে না। পরবর্তী দৃশ্যটা বিস্মিত করল ওকে। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল ইভেনকো রুস্তভ, হাত বাড়িয়ে বিদ্রোহী কুকুরটার গলায় হাত বুলাল, রুশ ভাষায় বিড়বিড় করে কি যেন। বলে অভয় দিল সেটাকে। শান্ত হয়ে গেল কুকুরটা, তার অপর। সঙ্গী আদরটুকুতে ভাগ বসাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল। ঠিক এই সময় করিডরের ওপর দিয়ে ছুটে গেল একটা ছায়া।
এতক্ষণ উদ্বেগ ছিল, এবার বাসা বাঁধল ভয়। নিজেদের অজান্তেই আবার দম বন্ধ করল ওরা। এমনকি কুকুরগুলোও চুপ হয়ে গেছে, সম্পূর্ণ স্থির। হেলিকপ্টার দেখেনি কেউ, দেখেছে তার। ছায়া। মনে হলো পশ্চিম দিকে উড়ে গেল সেটা। আমি না ফেরা। পর্যন্ত নড়বে না কেউ, নির্দেশ দিয়ে দ্রুত পায়ে এগোল রানা। খানিক দূর হেঁটে এসে থামল ও, পাঁচিলের মাথা এখানটায় বেঁকে নেই। বরফের গায়ে হাঁচড়েপাঁচড়ে, ফাটলে পা বাধিয়ে উঠে পড়ল চূড়ায়।
নজর রাখার জন্যে আদর্শ একটা জায়গা। ওর সামনে আরও অনেক প্রেশার রিজ ঢেউ খেলে রয়েছে, নিচুগুলোর ওপর দিয়ে। দৃষ্টি চলে। আধ মাইল পর আবার শুরু হয়েছে সমতল বরফ। স্লেজ চলবে ওখানে চমৎকার, কিন্তু পথে রাশিয়ানরা রয়েছে।
দলগুলো ছোট ছোট, কিন্তু সংখ্যায় বারোটা, একটার কাছ থেকে আরেকটা যথেষ্ট দূরে। বিস্তীর্ণ বরফ প্রান্তরের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পশ্চিম দিকে যাচ্ছে ওরা, বহুদূর গ্রীনল্যান্ডের দিকে। দলগুলোর সামনে, একজোড়া হেলিকপ্টার উড়ছে। রানা তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একটা কপ্টার ল্যান্ড করল সমতল বরফে, একটা স্লেজ টীমের কাছাকাছি। রোটর থামার আগেই হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে এল এক দঙ্গল কুকুর। পিছু পিছু নামল লোকজন আর স্লেজ। ওদের কাজ সারার নৈপুণ্য আর দ্রুতগতি দেখে একরকম মুগ্ধই হলো রানা। দশ সেকেন্ড হয়েছে। উঁকি দিতে শুরু করেছে ও, আবার আকাশে উঠে পড়ল হেলিকপ্টার, কোর্স বদলে ফিরে চলল উত্তর-পুবে। করিডরে নেমে, সবার কাছে ফিরে এল রানা। প্রায় সাথে সাথেই ঝড় শুরু হলো-বিতর্কের!
যাক বাবা, ওরা আমাদের দেখতে পায়নি, হাঁফ ছাড়ল বিনয়। মৃদু হাসল রানা।
ওদের আসল কাজ ছিল আরও স্লেজ টীম নামানো।
রানার দিকে একটা আঙুল তাক করল নিয়াজ। মূর্তিমান দুঃসংবাদ।
আরও স্লেজ! বিনয় হতভম্ব।
হ্যাঁ, বলল রানা। পশ্চিম দিকে, আধ মাইলও হবে না, বারোটা পর্যন্ত সার্চ টীম গুনেছি। মাথার ওপর টহলে রয়েছে। হেলিকপ্টার।
এদিকে আসছে?
মাথা নাড়ল রানা।
বিনয় জোর দিয়ে বলল, তাহলে আমরা ওদের পিছু পিছু, আস্তে-ধীরে যেতে পারি, কি বলো?
আবার মাথা নাড়ল রানা। প্যাকের ওপর দিয়ে উড়ে আসার। সময় খোলা, সমতল মাঠ দেখেছিলাম, মনে আছে? ওই মাঠের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে ওরা। ওটা পেরোতে গেলেই দেখে ফেলবে। তারপর কি হবে ভাবতে পারো?
দড়াম করে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেবে বলটু, মন্তব্য করল নিয়াজ।
অনিদ্রায় ক্লান্ত, প্লেন দুর্ঘটনার দৃশ্য এখনও ভুলতে পারেনি, তিক্তমেজাজ নিয়ে রানার সামনে দাঁড়াল বিনয়। তুমি ভুল করছ, রানা, শান্ত সুরে বলল সে। শুধু পশ্চিম দিকেই নিরাপদ আশ্রয়। পাব আমরা। বাঁচতে হলে গ্রীনল্যান্ড উপকূলে আমাদের পৌঁছুতেই। হবে। একবার পৌঁছুতে পারলে আর কোন ভয় নেই। রাশিয়ানরা তো আর গ্রীনল্যান্ড আক্রমণ করতে পারবে না।
নিখুঁত প্ল্যান, বলল রানা। শুধু…
ভুলে যাওয়া হচ্ছে, রানার কথা কেড়ে নিয়ে বলল নিয়াজ, রাশিয়ানরা পথে বাধা দেবে আমাদের।
বরফের মাঠটা বিশাল, ওদের চোখকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব, যুক্তি দেখাল বিনয়।
হয়তো, বলল রানা। কিন্তু হেলিকপ্টারগুলোকে? জিজ্ঞেস করল রানা।
তাহলে তুমিই বলো কি করব আমরা? ঝাঁঝের সাথে জানতে চাইল বিনয়। উত্তর দিকে গিয়ে ব্লাডি পোলে মারা পড়ব? পুবে গিয়ে আই.আই.ফাইডে কয়েদ হব, বলটু যেখানে অপেক্ষা করছে? দক্ষিণে…
দক্ষিণে, মাথা ঝাঁকাল রানা। হ্যাঁ।
এতক্ষণ গভীর মনোযোগের সাথে ওদের কথাবার্তা শুনছিল ইভেনকো রুস্তভ, হঠাৎ খুব ঘাবড়ে গিয়ে বলল, দক্ষিণে? এ তো স্রেফ পাগলামি…!
আপনার সাথে কেউ আলোচনা করছে না, বিরক্তিভরে হাত ঝাপটা মেরে বলল বিনয়। রানার দিকে ফিরল আবার। দক্ষিণে গেলে সোজা আইসফিল্ডের কিনারায় গিয়ে পৌঁছুব আমরা, সোজা আইসবার্গ-অ্যালিতে। তারপর? স্লেজ পানিতে ভাসে কিনা আমার অন্তত জানা নেই।
মাথা নাড়ল নিয়াজ। মাফ চাই, বাবা, এর উত্তর দেয়ার সাধ্য আমার নেই।
মাথা ঠাণ্ডা করো, বিনয়, বলল রানা। আইসব্রেকার কিউটে চড়ব আমরা। এরই মধ্যে আইসবার্গ অ্যালির দিকে রওনা হয়ে গেছে ওটা। এ-ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে ভেবে জেনারেল ফচের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থাটা আগেই করে রাখা হয়েছে।
বিমূঢ় হয়ে পড়ল বিনয়। তুমি সত্যি বিশ্বাস করো কিউটের দেখা পাব আমরা?
টেন্থ মেরিডিয়ান ধরে আসছে কিউট, নিজেদের পজিশন চেক করার জন্যে বার কয়েক তারাগুলোকে দেখে নিতে হবে। কথা। শেষ করে নিজের টীম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রানা, যেন আর কোন আলোচনা নেই।
দোস্ত বিনয় কি ফিউজ হয়ে গেল? কৌতূহল প্রকাশ করল। নিয়াজ।
না, বিনয়ের কথা এখনও শেষ হয়নি। তুমি এমন সুরে কথা। বলছ, রানা, আমরা যেন ঢাকা থেকে গারো পাহাড়ে চড়তে যাচ্ছি। তুমি ভাল করেই জানো, স্টার-ফিক্স নিখুঁত হয় না। ব্যাপারটা দাঁড়াবে অনেকটা যেন-এক পিনের মাথা আরেক পিনের মাথাকে খুঁজছে, মাঝখানে প্রায় একশো মাইল ফারাক।
আরেকটু হলে হাততালি দিয়ে ফেলেছিল নিয়াজ। তর্কবাগীশ। বিনয়ের জুড়ি মেলা ভার।
হাত তুলে নিজের স্লেজটা দেখাল রানা। বিজ্ঞানের সামান্য। একটু সাহায্য পাব আমরা। ভুলে যাচ্ছ কেন, আমাদের সাথে। ইলিয়ট হোমিং বীকন রয়েছে। কিউট রেঞ্জের মধ্যে এসে গেলে রেডিফন সেট অন করে সিগন্যাল পাঠাব। কিউটে হেলিকপ্টার আছে, সিগন্যাল অনুসরণ করে আমাদের কাছে চলে আসবে ওটা। এবার সন্তুষ্ট?
ব্যাপারটা আমার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না, মুখ ভার করে। বলল বিনয়। নিয়াজের দিকে ফিরল সে। তুমি কি বলো?
সবিনয়ে একটা প্রশ্ন করতে চাই, বলল নিয়াজ। আলোচনা। শুরুর আগে, রানা সবচেয়ে খারাপ কি করবে বলে ভেবেছিলে তুমি?
দক্ষিণ দিকে যেতে চাইবে…
কাজেই বলটুও ঠিক তাই ভাববে, বলল নিয়াজ। অর্থাৎ আমরা দক্ষিণ দিকে যেতে পারি এ-সম্ভাবনা তার মাথাতেই আসবে না।
দস্তানা পরা হাত কচলাচ্ছে ইভেনকো। হঠাৎ রাগে বিস্ফোরিত হলো। আপনার মধ্যে, মি. মাসুদ রানা, এ-ধরনের পাগলামি আমি আশা করি না!
প্রতিভাবানরা একটু পাগলাটেই হয়, ফোড়ন কাটল নিয়াজ। আপনি নিশ্চয়ই সেটা বুঝতে পারেন না?
নিয়াজের কথায় কান না দিয়ে রানাকে আবার বলল ইভেনকো, মিস্টার মাসুদ রানা, আপনার ওপর আমার আস্থা আছে, কিন্তু…
যদি অনুমতি দেন, ভুলটা সংশোধন করতে চাই, আবার নিয়াজই মুখ খুলল। আসলে আপনি আস্থা এনেছেন আমেরিকানদের ওপর…
তা সত্যি, স্বীকার গেল ইভেনকো। মুক্ত দুনিয়া বলতে তো আমেরিকাকেই বোঝায়। কিন্তু মিস্টার মাসুদ রানার ওপরও আমার আস্থা আছে।
আচ্ছা, বলুন তো, বাংলাদেশ কোথায়? সবিনয়ে জিজ্ঞেস করল বিনয়।০
মুখ খুলল ইভেনকো, তারপর আবার বন্ধ করল।
ঠিক আছে, বলুন তো, আপনার হিরো কোথায় মানুষ হয়েছে?
অবশ্যই আমেরিকায়, বেশ জোর দিয়ে বলল ইভেনকো। তা না হলে…
নিয়াজ হাসল। আপনি বিশাল সমুদ্র সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হতে পারেন, কিন্তু ক্ষুদ্র বাংলাদেশ বা রানা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। আপনি জানেন না, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পিছনে আমেরিকার কোন অবদান ছিল না, বরং রাশিয়ার ছিল। যার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না, তার ভক্ত হন কিভাবে? কিভাবে সে আপনার। হিরো হয়? আসলে আমার কথাই ঠিক, আপনি আমেরিকার ভক্ত। রানা আমেরিকানদের পোষ্য ধরে নেয়ায় তারও আপনি ভক্ত হয়ে। পড়েছেন।
ম্লানমুখে ইভেনকো বলল, মি. রানা, আপনার সহকারী। আমাকে সম্ভবত অপমান করছেন…
তার এই অভিযোগের উত্তরে কেউ কিছু বলল না। বিনয় বলল, আমেরিকাকে তো চেনেন না, ওখানে কিছু দিন থাকলে টের পাবেন…
আমেরিকা এতই যদি খারাপ, আপনারা তাহলে তাদের কথামত আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে এসেছেন কেন? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল ইভেনকো।
আমাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে, বলল নিয়াজ। কাজটা। আমরা নিতে চাইনি।
অন্যান্য আরও কারণও আছে, বলল বিনয়, সব আপনাকে। জানানো সম্ভব নয়। এক সেকেন্ড থেমে আবার বলল সে, দক্ষিণে যেতে আপত্তি থাকলে ফিরতি পথ ধরে লেনিনগ্রাদে ফিরে যেতে পারেন আপনি। আপনার জন্যেই একের পর এক বিপদে পড়তে হচ্ছে আমাদের। আমাদের লীডার যা বলেছে তাই হবে। দক্ষিণেই যাব আমরা।
তাড়া লাগিয়ে কুকুরগুলোকে দাঁড় করাল বিনয়, পিঠে চাবুকের বাড়ি খেয়ে রানার স্লেজকে অনুসরণ করল ওগুলো। পাঁচ মিনিট এগোবার পর নব্বই ডিগ্রী বাঁক নিল ওরা। সমতল বরফ প্রান্তর ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগল। একনাগাড়ে দুঘণ্টা ছুটল স্লেজ। নালা আর প্রেশার রিজ পেরোল একের পর এক। তারপর কিছু সময়ের জন্যে বিরতি। আগেই ঠিক করা ওয়েভলেন্থে সিগন্যাল পাঠাল নিয়াজ, এই সিগন্যালের জন্যে কার্টিস ফিল্ডে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন জেনারেল ফচ।
ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট…পেলিকান…ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট…পেলিকান…
কার্টিস ফিল্ড থেকে উত্তর পাবার জন্যে পাঁচ মিনিট ধৈর্য ধরতে হলো। এতটা সময় লাগায় ঝুঁকির পরিমাণ বাড়ল বৈকি, কারণ রুশ ঘাঁটি এন.পি. সেভেনটিনের মনিটর সেট রেডিওর অস্তিত্ব ও অবস্থান জেনে নিতে পারবে—অন্তত পাঁচ মিনিটের মধ্যে জেনে নেয়া উচিত। ঝুঁকিটা না নিয়েও কোন উপায় ছিল না। পেলিকান শব্দটা দিয়ে জেনারেল ফচকে জানিয়ে দেয়া হলো ইভেনকো রুস্তভ এখন রানার হাতে, ওয়াশিংটন সিটি ব্যাংকে রানা এজেন্সির অ্যাকাউন্টে এক বিলিয়ন ডলার জমা দিতে হবে। টাকাটা জমা পড়ল কিনা সে-খবর সময় মত পেয়ে যাবে রানা, সে-ব্যবস্থা করাই আছে। আর ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট শব্দের মানে, ওরা দক্ষিণ দিকে এগোচ্ছে। রেডিফন এরিয়াল নামিয়ে সেটের ভেতর ঢোকাল নিয়াজ, তারপর আকাশের দিকে তাকাল।
দুঘণ্টার ভেতর কোন রাশিয়ান প্লেন দেখিনি, বলল সে। বিনয়ের স্লেজ থেকে কথা বলল ইভেনকো, আমেরিকান প্লেনও।
আমেরিকান পাইলটরা শীতের ছুটিতে দেশে ফিরে গেছে, বলল নিয়াজ। কিউটের ক্যাপটেন না গেলেই বাঁচি।
.
…আর্জেন্ট ইউ পেনিট্রেট আইসফিল্ড ফর পসিবল রন্ডিভো। ম্যাক্সিমাম রিস্ক মাস্ট বি অ্যাকসেপ্টেড। রিপিট। মাস্ট বি অ্যাকসেপ্টেড।
ওয়াশিংটন থেকে তিন দিন আগে পেলেও, এখনও মেসেজটাকে সহজভাবে নিতে পারছেন না ইউ.এস. নেভীর কমান্ডার হ্যারি গোল্ডম্যান। ছহাজার পাঁচশো পনেরো টনী আইসব্রেকার কিউটের ক্যাপটেন তিনি। যতই তিনি ভাবছেন,। মেসেজের শেষ অংশটুকু ততই তাঁকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। চরম ঝুঁকি নিতে হবে কথাটার মানে কি? এদিকের পানিতে আসা মানেই তো চরম ঝুঁকি নেয়া! নাকি ওয়াশিংটনে বসে কর্তা ব্যক্তিরা। ভাবেন বরফে চাপা পড়ে বা আইসবার্গে ধাক্কা খেয়ে জাহাজ না। ডোবা পর্যন্ত প্রমাণ হয় না যে চরম ঝুঁকি নেয়া হয়েছে?
তেতাল্লিশ বছর বয়স ক্যাপটেনের, পাঁচ ফিট আট ইঞ্চি লম্বা, চওড়া কাঁধ, চুল আর ভুরু কুচকুচে কালো। ভাবলেশহীন চেহারা, যদিও গম্ভীর দেখায় না। ক্ষীণ একটু হাসির রেখা দেখা যায় শুধু যখন ভয়ঙ্কর বিপদের সামনে পড়েন। তখন তাঁর গলাও শুকিয়ে যায়, বিয়ারের ক্যান খুলতে হয় দুচারটে।
একটু দেখবেন, স্যার? কেন রাসেল, মেট, রাডারস্কোপ-এর সামনে থেকে এক পা পিছিয়ে এসে কোর্টের কলার তুলে দিল ঘাড়ে। কিউটের উঁচু ব্রিজ গরম রাখার জন্যে হিটিং সিস্টেম আছে, কিন্তু সিস্টেমে বোধহয় কোন গোলযোগ দেখা দিয়েছে। আর্কটিক আবহাওয়াই বোধহয় দায়ী। খোলা ডেকে অমানুষিক পরিশ্রম করছে একদল লোক, কোদালে বরফ তুলে জাহাজের কিনারা দিয়ে নিচে ফেলছে। যত ফেলছে ততই আবার জমছে, যেন ভোজবাজির মত বাতাসই হয়ে উঠছে নিরেট বরফ। সান্ত্বনা এইটুকুই যে সমস্ত বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে আইসব্রেকার। আর্কটিক সাগরের ভাসমান বরফখণ্ড তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
ইচ্ছে করছে না, তবু রাডারস্কোপে চোখ রাখলেন কমান্ডার হ্যারি গোল্ডম্যান। তিন ঘণ্টা আগে শেষবার যখন রাবার হুডের ভেতর মাথা গলিয়ে তাকিয়েছিলেন, স্কোপে ব্লিপ দেখা গিয়েছিল। দূরত্ব আর দিক হিসেব করে বুঝতে অসুবিধে হয়নি, ব্লিপগুলো কোন জাহাজের নয়। উত্তর-পশ্চিম আর উত্তর-পুবে কোন জাহাজ থাকতে পারে না। এবার কোন ব্লিপ দেখা গেল না। নিরেট, নিভাঁজ বরফ-রাজ্যে সব কিছুই যেন স্থির।
ব্যারিয়ার, কোন দরকার ছিল না, তবু বলল কেন্ রাসেল। একেবারে সামনে।
মেসেজের শেষ অংশটার কথা আবার মনে পড়ে গেল কমান্ডারের।
ব্লিপ দেখতে না পাবার এটা একটা কারণ, জানেন তিনি-এই ব্যারিয়ার। আইসফিল্ডের নিরেট একটা পাঁচিল কিউটের পথে মাথাচাড়া দিয়ে রয়েছে। ভাসমান বরফখণ্ডগুলোকে দিয়াশলাইয়ের কাঠির মত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেই পাঁচিলের দিকেই এগোচ্ছে আইসব্রেকার। স্পিটবার্জেন থেকে গ্রীনল্যান্ড পর্যন্ত লম্বা এই পাঁচিল। মুশকিল হলো, যেভাবে হোক আইসফিল্ডে ঢোকার জন্যে। একটা পথ খুঁজে বের করতে হবে তাদের। আইসফিল্ড সী লেভেল থেকে সামান্য একটু উঁচু কি উঁচু নয়, এরকম একটা জায়গা চাই। সামান্য উঁচু হলে কিউটের বো বরফ ভেঙে ঠিকই ঢুকে যাবে ভেতরে। আশার কথা এইটুকু, সামনে কি আছে দেখার জন্যে রাডার রয়েছে তাঁদের। মনে মনে প্রার্থনা করলেন তিনি, ঈশ্বর, কুয়াশা দিয়ো না।
.
দুঘণ্টা পর আইসফিল্ড থেকে ধোঁয়ার মত কুয়াশা উঠতে শুরু করল। ব্রিজের সামনে, ক্লিয়ার-ভিশন প্যানেলে তাকিয়ে আছেন কমান্ডার হ্যারি গোল্ডম্যান, পালা করে ঘন ঘন সামনে আর ডেকের দিকে তাকাচ্ছেন। দুটোর একটা দৃশ্যও তাঁকে উৎসাহিত করল না। ফোর-পীকে দ্রুত বরফ জমছে, নতুন একটা দল হেরে যাওয়া। যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে তবু। বরফ ঢাকা রেইলের ওপর দিয়ে গুঁড়ো। বরফ ফেলছে তারা, যতটুকু ফেলছে তারচেয়ে জমছে বেশি। শূন্য থেকে টেমপারেচার পঞ্চাশ ডিগ্রী নিচে।
পোলার বেয়ার…!
ব্রিজ থেকে স্টারবোর্ড সাইডে বরফ-প্রাচীরের মাথায় তাকিয়ে। আছে মেট কে রাসেল। ব্রিজের মতই উঁচু পাঁচিলটা, মাত্র কয়েক কেবৃন্ দূরে। নিচের ফোর ডেক থেকে মুখ তুলে তাকাল লোকজন, পাঁচিলটাকে মনে হলো কোন দালানের খাড়া গা। চাঁদের আলোয় তিনটে ঝাপসা হলদেটে মূর্তি তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে। আইসফিল্ডের কিনারায় তিনটে পোলার বেয়ার, কূকের সদ্য ফেলা আবর্জনার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে উঠে এসেছে পাঁচিলের মাথায়।
খুব ধীরে চলছে এঞ্জিন, কিন্তু আওয়াজটা জোরাল আর নিয়মিত, বোঝা যায় প্রচণ্ড শক্তির লাগাম টেনে রাখা হয়েছে। এঞ্জিন ঠিক থাকলে যত বিপদই আসুক, তোয়াক্কা করেন না কমান্ডার। কিন্তু সামনের দৃশ্য তাঁর মনে খুঁতখুঁতে একটা ভাব এনে দিয়েছে। রাসেল, খাঁচায় উঠে যাও। ওপর থেকে তাকালে তবে যদি ভেতরে ঢোকার পথ চোখে পড়ে। নির্দেশটা তিনি অনিচ্ছার সাথে দিলেন।
অনিচ্ছা নিয়েই একশো ফিট উঁচু মই বেয়ে খাঁচায় উঠে গেল মেট। মাস্তুলের মাথায় এটা কিউটের অবজারভেশন পোস্ট। কুয়াশা উঠছে, নিচের দিকে তাপমাত্রা পঞ্চাশ ডিগ্রী, এই পরিস্থিতিতে আসমানের ওপর এই ঠাই নরকের চেয়ে কম কিসে। ছোট্ট একটা ঘর, চামড়া-মোড়া টুলে বসল রাসেল। বিয়ের পরদিন জরুরী ডাক পেয়ে কিউটে চড়ে সাগরে ভাসতে হয়েছে তাকে। বন্দরে ফিরে যাচ্ছিল, এই সময় আবার জাহাজের কোর্স বদলাবার আদেশ পায় ওরা। বন্দরে আর ফেরা হলো না। অথচ নতুন বউ বসে আছে ওর পথ চেয়ে। ক্যাপটেনের মতই, মাসুদ রানা নামের অচেনা লোকটাকে বিশেষ পছন্দ করতে পারছে না রাসেল।
ক্লিয়ার-ভিশন প্যানেলে চোখ রেখে দ্রুত একবার সামনেটা দেখে নিল সে। মাথায় হারনেস গলাল, অ্যাডজাস্ট করল মাইক, তারপর কথা বলল ব্রিজের সাথে, পজিশনে, স্যার। সামনে বড় একটা আইসবার্গ।
দেখেছি আমরা, তার বেয়ে কমান্ডারের গলা ভেসে এল। ঢোকার কোন পথ দেখছ?
কোথায়! পাথুরে পাহাড়ের মত নিরেট, স্যার।
দেখতে থাকো।
খাঁচার ভেতর নিরাপদ সে, জানে রাসেল, তবু নানা রকম ভয়। এসে ঝামেলা করতে লাগল। মাস্তুলটা যদি ভেঙে পড়ে? চোখ। বুজল সে, সরাসরি নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরছে। হঠাৎ যদি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে? লোহার মই বেয়ে কোন রকমে একজন লোক উঠতে পারে, সে কি কাঁধে করে নামাতে পারবে অসাড় ভারী। একটা দেহ? জোর করে চোখ মেলল সে, হাত বাড়িয়ে কাঁচের দেয়ালগুলো ছুঁয়ে আশ্বস্ত হতে চাইল। ব্রিজে থাকতে মনে হয়েছিল। হিটিং সিস্টেম ভালমত কাজ করছে না, আর খাঁচায় ওঠার পর মনে হচ্ছে সিস্টেমটা কোন কাজই করছে না।
ডেক থেকে একশো ফিট ওপরে রয়েছে সে, চারদিকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পেল। জাহাজ চলছে বলে মনেই হয় না। ভাসমান বরফ আকারে এক একটা বাড়ি, ওপর থেকে জমাট। চিনির বিরাট স্তূপের মত দেখতে লাগল। কিউটের বো ধাক্কা। দিয়ে স্তূপগুলোকে ভাঙছে, ভাঙা টুকরোগুলো দুপাশে সরে গিয়ে। পথ করে দিচ্ছে আইসব্রেকারকে। আরও সামনে ঝুঁকে আছে। দৈত্যাকার পাঁচিল, মাথার দিকে তাকাতে হলে মুখ তুলতে হচ্ছে। রাসেলকে। আপাত দৃষ্টিতে অচল, যেন সাগরতলে নোঙর ফেলে আছে। কিন্তু আইসবার্গ থেমে নেই, ভেসে চলেছে দক্ষিণ দিকে। উল্টো দিকে, উত্তরে চলেছে কিউট।
প্রথমে ডান দিকে, তারপর বাঁ দিকে ঝুঁকে দুপাশে তাকাল রাসেল। ওর ওপরে, বড়সড় রাডার উইং সমান গতিতে ঘুরে চলেছে, অনবরত ওয়ার্নিং ইকো ট্রান্সমিট করছে ব্রিজের হুড পরানো স্কোপে। স্টারবোর্ডের দিকে ধীরবেগে পিছিয়ে যাচ্ছে বরফ-পাঁচিল। পাঁচিলের মাথা থেকে পোলার বেয়ারগুলো অনেক। আগেই অদৃশ্য হয়েছে। নিচের ডেকে এত বেশি বরফ যে জাহাজ প্রায় ঢাকা পড়ে আছে, সাগর আর জাহাজের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন। সুইচ অন করে মেসেজ পাঠাল সে, ঘন কুয়াশা আসছে, স্যার। সিকি মাইল দূরে, নাক বরাবর।
ত্রিশ মিনিট পর, এক অর্থে, সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গেল রাসেল। ঘন কুয়াশায় কিছুই সে দেখতে পেল না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কামড় খেয়ে হাত আর পায়ে যে অসাড় ভাব দেখা দিয়েছিল, সেটা এখন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। রক্ত চলাচল চালু রাখার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়ল সে, জগিং শুরু করল। কাঁচের দেয়ালগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। বাইরের কিছু দেখার একটাই মাত্র উপায় আছে, ক্লিয়ারভিশন প্যানেল। কিন্তু প্যানেলে তাকিয়ে কুয়াশা ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল তার। নিচে তাকিয়ে ডেক। দেখতে চেষ্টা করল। নেই।
ভয় হতে লাগল, কোথায় রয়েছে সে! সাত আসমানে, নাকি অন্ধকার রাতে কোন প্লেনের কেবিনে?
তুমি বরং নেমে এসো, রাসেল, আদেশ করলেন কমান্ডার হ্যারি গোল্ডম্যান।
কিন্তু যদি কুয়াশা পাতলা হতে শুরু করে…
বেশ। পনেরো মিনিট। তারপর নেমে এসো।
ক্লিয়ার-ভিশন প্যানেলে গাল চেপে ধরে তাকাল রাসেল। মনে হলো বরফে ছ্যাকা খেলো গালের চামড়া। কাচের গা ভিজে গেছে, তার ওপর কুয়াশায় ঝাপসা, কিছুই দেখতে পেল না। জাহাজ প্রায় অচলই বলা চলে, রাডার উইং-এর সাহায্যে ধীর, অতি ধীর গতিতে এগোচ্ছে-টের পাওয়া যায় কি যায় না। সামনে যদি কোন। আইসবার্গ থাকে, রাডারের ধাতব চোখ প্রতিধ্বনি পাঠিয়ে সতর্ক। করে দেবে।
কিন্তু রাডার মেকানিজম এই আবহাওয়ায় নির্ভুলতার কোন রকম গ্যারান্টি দেয় না, ডেপুটি মেট বেন ক্যাফম্যানের সে-কথা ভাল করেই জানা আছে। অভিজ্ঞ রাডার অপারেটর সে, ব্যাকুলদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্কোপে। পিং পিং পিং আওয়াজ শোনার জন্যে কান দুটো সজাগ। ওই আওয়াজ শুনেই শুধু বোঝা। যাবে বড়সড় কিছু একটা রয়েছে বো-র সামনে।
একঘেয়ে শব্দে নামেমাত্র চালু রয়েছে ইঞ্জিন। জাহাজের সবচেয়ে লম্বা আর নিঃসঙ্গ মানুষ, কেন্ রাসেল, ঢেউ খেলানো কুয়াশার দিকে তাকিয়ে থাকল সম্মোহিতের মত।
রাসেল? ব্রিজ থেকে প্রশ্ন করলেন কমান্ডার।
কিছুই রিপোর্ট করার নেই, স্যার। চারদিকের দেয়ালে গাল চেপে ধরে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল রাসেল। মনে হলো সামনের কুয়াশা একটু যেন পাতলা হতে শুরু করেছে। এখনও। কিছু দেখতে পাচ্ছে না, তবে গাঢ় কুয়াশার ভেতর নতুন ধরনের। একটা আলোড়ন পরিবর্তনের আভাস দেয়। ক্ষীণ একটু বাতাস বইছে না তো? লাফানো বন্ধ করে স্থির হয়ে গেল সে। আবার। প্যানেলে মুখ-গাল চেপে ধরল। হ্যাঁ, আর কোন সন্দেহ নেই; কিছু একটা তাড়া করছে কুয়াশাকে।
পিং পিং সতর্ক-সঙ্কেত অনেক দেরিতে এল, এল হঠাৎ করে। স্কোপের কাঁটা এক নিমেষে পুরো এক চক্কর ঘুরে গেল, আচমকা ফুটে উঠল নতুন একটা আকৃতি। ঝট করে মাথা তুলল বেন ক্যাফম্যান। চিৎকার দিল।
কেন্ রাসেল বোধহয় আসতেই দেখেনি ওটাকে। যদি দেখেও থাকে, তারপর আর আধ সেকেন্ডও সময় পায়নি। বরফের থাবা, পাচিলের মাথা থেকে লম্বা হয়ে কিউটের পথ পর্যন্ত বেরিয়ে আসা বাহু ডেক থেকে আশি ফুট উঁচু ছিল। ধীরগতিতে হলেও, সরাসরি সেই থাবার মধ্যে গিয়ে পড়ল আইসব্রেকার। মাস্তুলটা ঘ্যাঁচ করে কেটে গেল, অবজারভেশন পোস্ট আর রাডার উইং সহ মাস্তুলের মাথা নিচের অংশ থেকে চোখের পলকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ব্রিজে দাঁড়িয়ে সংঘর্ষের আওয়াজ পেল ওরা, আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল ক্যাফম্যানের গলা চিরে। খাঁচার ভেতর বন্দী কেন্ রাসেল প্রায় একশো ফিট ওপর থেকে স্টারবোর্ড সাইডে পড়ল। ডেক রেইলের গায়ে ধাক্কা খেলো খাঁচা, ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেল, একটা টুকরো রাসেলকে নিয়ে ঝপ করে পড়ল হিম পানিতে। রাডার সহ মাস্তুলের মাথার ওজন হবে পাঁচ টন, পানিতে পড়ার সাথে সাথে তলিয়ে গেল। সাগরের গভীরতা এখানে নয় থেকে দশ হাজার ফিট।
নিহতদের তালিকায় যোগ হলো আরও একজনের নাম। তাকে নিয়ে এরইমধ্যে মারা গেছে বিশজন। বাকিরা-সিকিউরিটি গার্ড পিটার আন্তভ, মাইকেল জনসন, ট্রান্সপোর্ট প্লেনের ষোলোজন আরোহী, এবং ড. কর্ডন।
কিউট এখন অন্ধ। রাডার নেই। তাকে গ্রাস করেছে কুয়াশা, ঘিরে আছে বরফ। আইসফিল্ডের কিনারায় আটকা পড়েছে। আইসব্রেকার, যে আইসফিল্ডকে ওরা কেউ দেখতে পাচ্ছে না। যে-কোন বিচারে, চরম ঝুঁকি নিয়ে এত দূর চলে এসেছে কিউট, যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করেছে। আর কত? যে যাই বলুক, এরপর আর সামনে এগোনো সম্ভব নয়। কমান্ডার হ্যারি গোল্ডের সামনে একটাই পথ এখন খোলা-বো ঘুরিয়ে নিয়ে বন্দরে ফিরে যাবার চেষ্টা করা।
.
কার্টিস ফিল্ডে উৎসবমুখর হয়ে উঠল পরিবেশ। কোড–সিগন্যাল-ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট…পেলিকান রিসিভ করেছেন জেনারেল ফচ, আনন্দে বগল বাজাচ্ছেন তিনি। ইভেনকো রুস্তভ। আমাদের হাতে! রানা তাকে নিয়ে দক্ষিণে আসছে কিউটে ওঠার জন্যে।
কার্টিস ফিল্ডে ছোট্ট অফিসটা ছেড়ে দেয়া হয়েছে। জেনারেলকে। অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন তিনি। জানালার নিচে। তিনটে হিটার জ্বলছে, ভেতরটা গরম। সিগন্যাল এই একটাই পাননি তিনি।
তাঁর সহকারী টমাস উড দরজার পাশে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে বসের দিকে তাকিয়ে আছে।
পায়চারি করতে করতে জেনারেল আবার বললেন, আই.আই.ফাইভের পশ্চিমে গিজগিজ করছে রাশিয়ান সিকিউরিটি। নিভে যাওয়া চুরুটে ঘন ঘন টান দিলেন, জ্বলজ্বল। করছে মুখের চেহারা। বরফের ওপর হেলিকপ্টার রয়েছে ওদের, প্যাকে রয়েছে স্লেজ-টীম। স্নো-ক্যাটও আছে।
পরিস্থিতি ঘোলাটে, মন্তব্য করল টমাস।
ওয়াশিংটনে বসে বলেছিলে, অপারেশনটা পানির মত সহজ, মনে আছে? খেঁকিয়ে উঠলেন ফচ। ঘরে ঢুকল এয়ারফিল্ড কন্ট্রোলার হাওয়ার্ড ম্যাকলিন। ঠিক সময়েই এসেছ। উপকূল আর আই, আই, ফাইভের মাঝখানে গোটা এলাকায় ইনটেনসিভ এয়ার সার্ভেইল্যান্স চাই আমি। যে মেশিনগুলো তুমি পাঠিয়েছ, তিন ভাগের এক ভাগ নজর রাখবে আই.আই. ফাইভের উত্তরে…, সাথে করে নিয়ে আসা ম্যাপটা দেয়ালে আগেই ঝোলানো হয়েছে, সেটার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
এখানে…আর এখানে।
দক্ষিণে? জিজ্ঞেস করল হাওয়ার্ড ম্যাকলিন।
না! নন-স্টপ সার্ভেইল্যান্স চাই আমি। পাইলটরা যাবে, ফিরবে, ফুয়েল নেবে, আবার যাবে…কোন বিরতি ছাড়া চলতেই থাকবে এভাবে।
কিন্তু পাইলটদেরও একটা সহ্যক্ষমতা আছে…, প্রতিবাদের সুরে শুরু করল হাওয়ার্ড।
সেটা কতটুকু, জানার এমন সুযোগ আর পাবে না, উত্তরে বললেন জেনারেল ফচ। জানার পর সেটা আরও বাড়িয়ে নিতে বলবে।
বুঝলাম না, হাওয়ার্ড বেরিয়ে যেতেই জিজ্ঞেস করল টমাস, রানা দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে, তাহলে উত্তর আর পশ্চিমে প্লেন পাঠাবার মানে কি?
তুমি যখন বোঝোনি, বলটুয়েভও বুঝবে না। পোলার প্যাকে রানাকে খুঁজে পাওয়া আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার, ভাগ্য যদি না সহায় হয়। কাজেই সে-চেষ্টা বাদ দিচ্ছি আমরা। তার বদলে রাশিয়ানদের ভুল বোঝাবার কাজটা জরুরী। জানালার বাইরে দিয়ে একটা হেলিকপ্টার উড়ে গেল, রোটর আর এঞ্জিনের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন জেনারেল। বরফের ওপর বলটুয়েভের হেলিকপ্টার আছে, দুঘণ্টার মধ্যে আমাদের প্লেনের অস্তিত্ব টের পেয়ে যাবে ওদের পাইলটরা।
বেশ। তারপর?
কি ভাববে বলটু? ভাববে, আমেরিকানরা ইভেনকো রুস্তভকে খুঁজছে। ভাববে, কোথায় তাকে খুঁজতে হবে আমেরিকানরা তা। জানে।
ফলে দক্ষিণ থেকে সে তার হেলিকপ্টার ফিরিয়ে আনবে?
ঠিক তাই। রেঞ্জের বাইরে বেরিয়ে আসার চমকার একটা সুযোগ পেয়ে যাবে রানা।
মাথা ঝাঁকাল টমাস। প্ল্যানটা ভাল, তবে…
ভাল নয়, চমৎকার! ধমকে উঠলেন জেনারেল। বলটুকে। আসলে একটা সিগন্যাল পাঠাচ্ছি আমরা-রানা উত্তর বা পশ্চিম দিকে যাচ্ছে!