২.০১ ছোট্ট বরফ দ্বীপ আই. আই. ফাইভ
মরণখেলা – খণ্ড ২
কাজী আনোয়ার হোসেন
০১.
ছোট্ট বরফ দ্বীপ আই. আই. ফাইভের সাতশো ফিট ওপরে চক্কর দিচ্ছে প্লেনটা। কন্ট্রোল সামনে নিয়ে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে। পাইলট ম্যাট ইসটন। নিচে কিছুই দেখা যায় না, ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে ঠাণ্ডা প্রকৃতি। তার পিছনে, কার্গো কমপার্টমেন্টে দুসারিতে বারোটা সীট, পারকা পরা বারোজন লোক বসে আছে।
ওরা সবাই ইউ.এস. কোস্টগার্ড সার্ভিসের লোক, এই কাজের। জন্যে বিশেষভাবে বাছাই করা হয়েছে ওদের। লেনিনগ্রাদ থেকে রাশিয়ানরা আর্কটিকে একটা স্পেশাল সিকিউরিটি ডিটাচমেন্ট। পাঠিয়েছে, কারণ তা না হলে অভিযানের ধরনটা অসামরিক থাকে না। ইচ্ছে করলে তারা সামরিক বাহিনী পাঠাতে পারত, কিন্তু তা পাঠালে আন্তর্জাতিক ঘটনা ঘটে যাওয়ার ঝুঁকি থাকত, কয়েক মাস পর মস্কোয় শীর্ষ বৈঠক বসার কথা রয়েছে বলে সে ঝুঁকি তারা নিতে চায়নি। ওয়াশিংটনও একই সাবধানতা অবলম্বন করেছে। সেই একই কারণে। কোনভাবেই ইন্টারন্যাশনাল ইনসিডেন্টের ঝুঁকি নেয়া যাবে না।
পাইলটের কেবিন ঘেঁষে আরও এক জোড়া সীট দখল করে রয়েছে দুজন আরোহী, একজন ডাক্তার, অপরজন নার্স। ডা. পল ফ্লেমিং, বত্রিশ, একহারা চেহারার সুদর্শন প্রেমিক। সে তার হবু রাশিয়ান রোগী ইভেনকো রুস্তভের জন্যে সাথে করে মেডিকেল কিট আর অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে এসেছে। জানালা দিয়ে প্লেনের বাইরে তাকিয়ে আছে ডা. ফ্লেমিং, মেঘের মত ভেসে যেতে দেখছে গাঢ় কুয়াশা। তার পাশের সীটে বসে আছে নার্স এরিকা ফোলি। দুজন ওরা দুজনের হাত ধরে আছে।
দুজনেই ওরা কোস্টগার্ড সার্ভিসে চাকরি করে, কিন্তু আর্কটিকে পাঠাবার জন্যে জরুরী তলব পেয়েছিল একা ডা. ফ্লেমিং। নার্সদের মধ্যে নির্দিষ্ট কাউকে নির্দেশ দিলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কথা ভেবে না-ও যেতে চাইতে পারে, তাই স্বেচ্ছাসেবিকা চাওয়া হয়। একজনই এগিয়ে আসে এবং তাকেই পাঠানো হয়েছে।
পল ফ্লেমিং আর এরিকার মধ্যে তিন বছর ধরে প্রেম চলছে। আগামী মাসের পনেরো তারিখে ওদের বিয়ে। এরিকা স্বেচ্ছায় যেতে চেয়েছে শুনে দিশেহারা বোধ করে পল। তার আপত্তি শুনে এরিকা জবাব দেয়, ধরা পড়ে গেলে তো! এতক্ষণ বলছিলে কাজটা মোটেও বিপজ্জনক নয়, কিন্তু যে-ই আমি যেতে চাইছি অমনি চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছ। ওসব ধানাইপানাই ছাড়ো, তোমার সাথে যাচ্ছি আমি। নাম প্রত্যাহার করার কথা ফের যদি মুখে আনো, আমি তাহলে বিয়ের তারিখটাও অনির্দিষ্টকালের জন্যে পিছিয়ে দেয়ার কথা তুলব।
দুবছর নয় মাস সতেরো দিন সাধনার পর এরিকাকে রাজি করিয়েছে ফ্লেমিং, কাজেই এরপর চুপচাপ ব্যাপারটা মেনে নেয়া ছাড়া তার আর উপায় ছিল কি?
মিষ্টি চেহারার এরিকা শুধু মিষ্টভাষী নয়, তার হাবভাব এবং অঙ্গভঙ্গিতে এমন একটা মাধুর্য আছে যে কেউ একবার তার দিকে তাকালে চোখ ফেরাতে পারে না। মার্কিন সমাজে কুমারী যুবতী। দুর্লভ, অথচ এরিকা তাই। তাকে সামান্য একটা চুমো খাওয়ার ভাগ্য আজ পর্যন্ত কোন পুরুষের হয়নি।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিজের কথা নয়, এরিকার কথাই ভাবছে পল। এই উদ্ধার অভিযান কতখানি বিপজ্জনক। ব্যাখ্যা করার অপেক্ষা রাখে না, এরিকার যদি কিছু ঘটে…
তোমার কি মনে হয়, ক্যাপটেন ম্যাট ল্যান্ড করতে পারবে? জিজ্ঞেস করল এরিকা, পলকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখতে চাইছে সে।
পলও ঠিক তাই চাইছে। হ্যাঁ, অবশ্যই। ওকে আমি চিনি, হার মানার লোক নয়। যতক্ষণ না এয়ারস্ট্রিপ দেখতে পায় চক্কর দিতেই থাকবে। পাইলট হিসেবে ওর জুড়ি মেলা ভার।
কিন্তু পাইলটের কেবিনে পরিবেশটা থমথমে। ম্যাট ইসটন আশার কোন আলো দেখছে না। কুয়াশার ভেতর কোথাও কোন। ফাঁক নেই, নিচে কোথায় কি আছে দেখবে কিভাবে? অসহায় বোধ করল সে। ওপর দিকে চাঁদের আলোয় সব পরিষ্কার, নিচে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। ফুয়েল গজের দিকে তাকাল সে। প্রচুর রয়েছে। আরও অনেকক্ষণ চক্কর দিতে পারবে প্লেন। যখন দেখবে কার্টিস ফিল্ডে। ফিরে যাবার মত ফুয়েল আছে, তখন ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত…
পাইলটের চিন্তায় বাধা পড়ল। এডওয়ার্ড ড্রেক, কো-পাইলট পাশ থেকে বলল, এখন আমারই সন্দেহ হচ্ছে, সত্যিই কি। ল্যান্ডিং লাইট দেখেছিলাম আমি?
মনে হচ্ছে ফিরে যেতে চাও, ড্রেক? কর্কশ স্বরে জিজ্ঞেস করল পাইলট। আলোটা কি সত্যি দেখোনি?
দেখেছি।
ব্যস। চক্কর আমরা দিতে থাকব।
.
আই.আই.ফাইভের বেস লীডার ড. কর্ডন সুইচ অন করার পর থেকেই একটা ল্যান্ডিং লাইটের পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। মাসুদ রানা। উদ্বেগে কাতর হয়ে আছে ও। কুয়াশার ভেতর ল্যান্ডিং লাইটটাকে সবুজাভ আভার মত লাগছে। এয়ারস্ট্রিপের কিনারায় ড. কর্ডনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও, ঘাঁটির ঘরগুলো থেকে সিকি মাইল দূরে। উদ্বেগে কাতর আরও পাঁচজন লোক অপেক্ষা করছে। ওখানে। হঠাৎ করে আবার শুনতে পাওয়া গেল ইঞ্জিনের অস্পষ্ট আওয়াজ। গুঞ্জনটা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, বিড়বিড় করল ড. কর্ডন। ধরেই নিয়েছিলাম হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেছে।
সত্যিই, মনে মনে রানাও ভাবল। একটু হলেও কুয়াশা যেন পাতলা হয়েছে। প্লেনটা শুধু একবার ল্যান্ড করতে পারলেই যথেষ্ট, তারপর আবার টেক-অফ করতে না পারলে না-ই পারল। কার্টিস ফিল্ডে জেনারেল ফচের সাথে কথা হয়েছে রানার, তখনই ওকে জানানো হয়েছে, একটা কোস্টগার্ড ডিটাচমেন্ট তৈরি হয়ে থাকবে। রানার বিশ্বাস, এই প্লেনের ডিটাচমেন্টের বারোজন সশস্ত্র লোক নিশ্চয়ই আছে। দলে ওই বারোজন যোগ হলে কে আর গ্রাহ্য করে কর্নেল বলটুয়েভকে। তখন দুপক্ষের শক্তি প্রায় সমান সমান দাঁড়াবে।
কি মনে হয় আপনার, এই অবস্থায় ল্যান্ড করতে পারবে পাইলট? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ড. কর্ডন।
যেন কুয়াশায় চারপাশ ঢাকা ভৌতিক পরিবেশে জোরে কথা বলা মানা। বাতাস নেই বললেই চলে, অথচ কোথাও স্থির হয়ে নেই কুয়াশা। কখনও ঢেউ-এর মত এগিয়ে আসছে, কখনও ঢেউ ভেঙে গিয়ে পাহাড়, হাতি, তিমি, টাওয়ার, বিশাল দানব বা টানেলের আকৃতি নিচ্ছে। আর ঠাণ্ডা! গায়ে আগুন ধরার অভিজ্ঞতা আছে যার শুধু বুঝি তাকেই বোঝানো সম্ভব আর্কটিকের এই ঠাণ্ডার কি জ্বালা। বুটের ভেতর অনবরত পায়ের আঙুল নাড়াচাড়া করছে। ওরা, তা না হলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু স্থির হয়ে নেই-হাত, পা, কোমর, ঘাড় সব সময় নাড়াচাড়ার মধ্যে রাখছে। খানিক পরই একেবারে মাথার ওপর চলে এল ইঞ্জিনের আওয়াজ, সেই সাথে মনে হলো কুয়াশা যেন আরও একটু হালকা। হয়েছে। এখনও ল্যান্ড করার কথা ভাবছে না পাইলট, বিড়বিড়। করল রানা। ওপর থেকে কি দেখছে না দেখছে কে জানে…
.
প্লেন নিয়ে আরও নিচে নেমে এসেছে পাইলট, পাঁচশো ফিট ওপর। থেকে নিচটা আগের চেয়ে একটু ভাল দেখাল। দুর্বোধ্য একটা। আওয়াজ করে প্লেনের নাক আরও একটু নিচের দিকে তাক করল সে। শুধু কো-পাইলট ড্রেক পাইলটের এই আওয়াজের অর্থ। জানে। বিপজ্জনক একটা ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে ক্যাপটেন ম্যাট ইসটন। এ-ধরনের কোন ঝুঁকি নেয়ার সময় নিজের অজান্তেই আওয়াজটা বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে।
কুয়াশা হালকা হয়ে যাওয়ায় ল্যান্ডিং লাইট দেখতে পেয়েছে পাইলট। জানে, এই শুভ পরিস্থিতির আয়ু বেশিক্ষণ নয়, যে-কোন মুহূর্তে নিচ্ছিদ্র ঢেউ এসে আবার সব ঢেকে দিতে পারে। ক্ষীণ আলোর সমান্তরাল দুটো রেখা এতই অস্পষ্ট, মনে হলো চোখের ভুল। আর যদি চোখের ভুল না হয়, এয়ারস্ট্রিপটা কোথায় আন্দাজ করতে পারছে সে। যা থাকে কপালে, রেখা জোড়ার মাঝখানে ল্যান্ড করবে সে।
আমরা নামছি, শান্ত গলায় বলল সে। ওদের জানাও।
সীট ছেড়ে কার্গো কমপার্টমেন্টে ঢুকল কো-পাইলট, চোদ্দজন আরোহীকে উদ্দেশ্য করে বলল, সীট-বেল্ট বাঁধুন, আমরা ল্যান্ড করতে যাচ্ছি…
দেখলে তো, বলেছিলাম না? এরিকার হাতে চাপ দিয়ে বলল পল। ক্যাপটেন ঠিকই ল্যান্ড করতে যাচ্ছে। এরিকার দিকে ঝুঁকল সে খানিক, যেন মনে হলো চুমো খেতে যাচ্ছে। আশ্চর্য, সেটা ধরতে না পারলেও, নিজে থেকেই পলের দিকে মুখটা বাড়িয়ে দিল এরিকা।
প্রেমিকার কপালে আলতো করে ছোট্ট একটা চুমো খেলো পল। এরিকা রাঙা হয়ে উঠল, সরে বসল একটু, কিন্তু কেউ কারও চোখ থেকে দৃষ্টি ফেরাল না।
ওদিকে, কন্ট্রোল কেবিনে ঘামতে শুরু করেছে পাইলট ম্যাট ইসটন। প্লেনের ডানা একদিকে কাত করে নিয়ে আই.আই. ফাইভ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সে। এয়ারস্ট্রিপের দিকে সরাসরি ফিরে আসবে, এটা তারই প্রস্তুতি। ল্যান্ডিং লাইট অদৃশ্য হলেও, মনে মনে প্রার্থনা করছে সে, অর্ধ বৃত্ত রচনা শেষ করে ফেরার সময় আবার যেন ওগুলো দেখতে পায়।
নিচে পোলার প্যাক, কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। প্লেন সিধে করে নিল ইসটন। কুয়াশার ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ণ, শ্যেন দৃষ্টিতে তাকাল সে। শালার আলোগুলো আগের চেয়েও অস্পষ্ট, মনে হলো তার। কুয়াশার অনেক নিচে ঝাপসা একটা ভাব, আলো কিনা বলা কঠিন। ডাইভ দিল প্লেন, ঝাপসা ভাবটুকু দ্রুত ছুটে আসছে। কাছে। গিয়ার আর ফ্ল্যাপ নামিয়ে দিয়েছে সে। দুজোড়া প্রপেলার কুয়াশায় আলোড়ন তুলে ঘুরছে। এঞ্জিনের আওয়াজে কোন উত্থান বা পতন নেই। ঠিক এ-ধরনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আরও অনেক বার যেতে হয়েছে ক্যাপটেন ইসটনকে। আর্কটিকের বিভিন্ন। অংশে আই.আই.ফাইভে পাঁচবার ল্যান্ড করেছে সে-প্রতিবারই এই অক্ষাংশ থেকে কয়েকশো মাইল উত্তরে।
সীমানা পেরোনো চলবে না!নিজেকে সাবধান করে দিল ম্যাট ইসটন। ল্যান্ড করার জন্যে যথেষ্ট লম্বা এয়ারস্ট্রিপ, শুধু যদি ঠিক সময়ে টাচ ডাউন করতে পারে প্লেন। ঝাপসা ভাবগুলো হয়ে উঠল আভা-দুসারি। মসৃণ বরফ স্পর্শ করল স্কিড। হুমড়ি খেয়ে পড়তে চাইল প্লেন, মনে হলো ডিগবাজি খেতে যাচ্ছে। তারপর মনে হলো স্কিডগুলো বরফের ওপর পিছলাতে শুরু করেছে। দুসারি আভা দ্রুত বেগে পিছিয়ে যাচ্ছে দুপাশ দিয়ে, কিন্তু কোথায় কোন দিকে চলেছে প্লেন বোঝা যাচ্ছে না। সামনে যখন কোন বাধা নেই, কি আর বিপদ ঘটতে পারে! প্রপেলারের বাতাস। খাবলা মারছে তুষারে, দুপাশে মেঘের মত উড়ছে তুষারকণা, আভাগুলো ঢাকা পড়ে গেল। প্লেনের গতি মন্থর হয়ে এল। ব্রেক। কষে এবার থামার প্রস্তুতি নিল পাইলট।এয়ারস্ট্রিপের কিনারায় দাঁড়িয়ে রানা আর ড. কর্ডন এঞ্জিনের আওয়াজ শুনেই বুঝল, পাইলট ল্যান্ড করতে আসছে। পিছিয়ে আসুন, কথাটা শুনে রানার পিছু পিছু ছুটল ড. কর্ডন। এয়ারস্ট্রিপ থেকে বেশ খানিকটা দূরে সরে এসে আবার যখন ওরা ঘুরল, প্রথমবারের মত প্লেনের আলো দেখতে পাওয়া গেল-ওদের দিকে। ঝুঁকে আছে, স্লো-মোশান ছবির ভঙ্গিতে নেমে আসছে নিচে।
ঈশ্বর! গুঙিয়ে উঠল ড. কর্ডন। স্ট্রিপের মাঝখানে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে, সীমানা পেরিয়ে যাবে!
কি জানি! বিড়বিড় করল রানা। কুয়াশায় দূরত্ব আন্দাজ করা অসম্ভব। নিচে দাঁড়িয়ে বেশিদূর দৃষ্টি চলে, ওপর থেকে নিশ্চয়ই অনেক দূর পর্যন্ত পরিষ্কার, তা না হলে ল্যান্ড করতে আসত না পাইলট। ডানা দুটো দেখতে পেল রানা, প্রতিটিতে একটা করে আলো। দুই খুদে আলোর মাঝখানে গাঢ় একটা আকৃতি, এয়ারস্ট্রিপ ধরে তুমুল গতিতে ছুটে আসছে। নিস্তব্ধ আর্কটিক রাতে এঞ্জিনের আওয়াজ বিরতিহীন বিস্ফোরণের মত শোনাল। কুয়াশার পর্দা ছিড়ে প্রকাণ্ড দৈত্যের মত বেরিয়ে এল প্লেন। ওদের সামনে দিয়ে ছুটে গেল স্ট্রিপের শেষ প্রান্তের দিকে। রানার যেন মনে হলো এঞ্জিনের আওয়াজ ছাপিয়ে স্কিগুলোর হিসহিস শুনতে পেয়েছে ও।
কুয়াশার ভেতর আবার ঝাপসা হতে শুরু করল প্লেন। এঞ্জিনের আওয়াজ বদলে যেতে শুনল ওরা। দুএক মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চল দাঁড়িয়ে পড়বে ওদের বাহন। এঞ্জিন বন্ধ করে দিল পাইলট, প্রপেলারের আওয়াজ স্তিমিত হয়ে এল। এখনও ওরা প্লেনটাকে দেখতে পাচ্ছে, ঝাপসা, ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। কাঠামোটা হঠাৎ করে বদলাল। বুকে হেঁটে এগোচ্ছিল প্লেন, হঠাৎ বরফে নাক দিয়ে খাড়া হয়ে গেল, আকাশ ছুঁতে চাইল লেজ। ভোজবাজির মত ঘটে গেল ঘটনাটা। আকাশ থেকে আছড়ে পড়ল লেজ। সংঘর্ষের আওয়াজ আর ধাক্কায় বুটের তলায় ঝুঁকি খেলো বরফ। বিস্ফোরিত হলো পেট্রল ট্যাংক, তালা লেগে গেল কানে। কুয়াশার গাঢ় পর্দা চিরে বেরিয়ে এল আগুনের লকলকে শিখা, মুহূর্তের জন্যে ধাঁধিয়ে গেল রানার চোখ। তারপর শুধু আগুনের চড়চড় আওয়াজ, আর কালো ধোঁয়া।
বিস্ফোরণের প্রতিধ্বনি থামার পর স্নো-ক্যাটের জানালা খুলে পাইপ থেকে তামাক ফেলল কর্নেল পয়মাল বলটুয়েভ। কি, বলিনি, জুনায়েভ? সহকারীর উদ্দেশে শান্ত, সন্তুষ্ট গলায় বলল সে, প্লেনে করে পালাতে পারবে না ওরা।
.
একজনও বাঁচল না। এতই প্রচণ্ড তাপ, অল্প কিছুক্ষণের জন্যে কুয়াশা সরিয়ে দিয়ে একটা টানেল তৈরি হলো, টানেলের শেষ মাথায় আকাশ আর চাঁদের হাসি। একটু পরই টানেলটা ভরে উঠল কালো ধোঁয়ায়। হিম কার্পেটের ওপর পুড়ে ছাই হচ্ছে প্লেনটা। হঠাৎ করেই নিভে গেল আগুন, থাকল শুধু কালো ধোঁয়ার স্তম্ভ। পেট্রল, ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, আর মাংস পোড়ার গন্ধে। বমি পেল রানার।
ইতিমধ্যে ধোঁয়ার স্তম্ভটাকে ঘিরে একটা চক্কর দিয়ে এসেছে। রানা, ওর পিছু নিয়ে এতক্ষণে কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল। ড. কর্ডন। কেউ নিশ্চয়ই বেঁচে আছে…
কি করে আশা করেন!
মি. রানা, এটা দেখুন…, কাঁপা গলায় বলল ড. কর্ডন, তেল মাখানো কি একটা তোবড়ানো জিনিস রয়েছে তার হাতে। জিনিসটার ভাঁজ খুলতেই চেনা গেল। নার্সরা পরে, একটা ক্যাপ। প্লেনে একজন নার্সও আছে…।
ছিল।
নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে চিৎকার করে উঠল ড. কর্ডন, কেন, কেন? সবই তো ঠিক ছিল-স্ট্রিপে নিরাপদে নামব, স্পীড কমল, থামার ঠিক আগের মুহূর্তে কি এমন ঘটল যে…
এদিকে আসুন। এয়ারস্ট্রিপ ধরে কয়েক পা এগোল রানা, ঝুঁকে বড়সড় একটা জিনিসের গায়ে হাত রাখল। জিনিসটা কি চেনা যাচ্ছে না, বরফে ঢাকা। কাছাকাছি স্কিড-এর দাগ দেখা গেল। প্লেন ক্র্যাশ করার এটাই কারণ। সিধে হয়ে জিনিসটার গায়ে বুটের কয়েকটা লাথি মারল ও, বরফের আবরণ খসে বেরিয়ে এল পাথর। এই বোল্ডারটায় ধাক্কা খেয়ে উল্টে গেছে প্লেন। প্লেনের একটা স্কিড ওই ওদিকে পড়ে আছে, বোল্ডারের সাথে ধাক্কা লাগায় ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল।
কয়েক মুহূর্ত বোবা হয়ে থাকল ড. কর্ডন। তারপর অবিশ্বাস আর বিস্ময় ঝরে পড়ল তার গলা থেকে, স্নো-প্লাই দিয়ে মাত্র দুদিন আগে স্ট্রিপ পরিষ্কার করেছি। আমি নিজে ছিলাম। ওটা ছিল না, থাকতে পারে না!
শুধু এই একটাই নয়, বলে কয়েক পা এগিয়ে আরও একটা বরফ-ঢাকা বোল্ডার দেখাল রানা। হাত তুলে খানিক দূরে ড. কর্ডনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল ও। ওখানে আরেকটা। এয়ারস্ট্রিপের চারদিকে চোখ বুলাতে গিয়ে তিন নম্বর বোল্ডারটাও দেখতে পেল ওরা। এগিয়ে গিয়ে সেটার ওপর ল্যাম্পের আলো ফেলল ড. কর্ডন। লাথি মেরে সেটার গা থেকে বরফ খসাল রানা। খুঁজলে হয়তো আরও পাওয়া যাবে, সবগুলো আপনাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। ড. কর্ডন রাগের সাথে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে আবার বলল রানা, কারণটা আর কিছুই নয়, স্ট্রিপ। পরিষ্কার করার সময় ওগুলো এখানে ছিল না।
তারমানে আপনি বলতে চান…।
হা। ক্যাম্পের পিছনের পাহাড়ে ছিল ওগুলো। পাথর তো আর সিকি মাইল পথ হেঁটে আসতে পারে না, কেউ ওগুলো বয়ে নিয়ে এসেছে। যদি কোন প্লেন ল্যান্ড করতে আসে, এই ভেবে। স্যাবোটাজ, ড. কর্ডন। আবার। আল্লাই জানে কজন ছিল প্লেনে।
বাস্টার্ডর্স!
শান্ত হোন। ক্যাম্পে ফিরে যাই চলুন।
আমেরিকার প্রতিটি খবরের কাগজে খবরটা যাতে ছাপা হয়…
বোকার মত কথা বলবেন না। ড. কর্ডনের একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল রানা। প্রমাণ কই?
কেন, বোল্ডারগুলো প্রমাণ নয়?
রাশিয়ানরা বলবে ওগুলো ওখানে আগে থেকেই। ছিল-বাতাসের ধাক্কায় বরফ সরে যাওয়ায় বেরিয়ে এসেছে। ওরা বরং পাল্টা অভিযোগ করে বলবে, স্ট্রিপটা আপনারা ঠিকমত পরিষ্কার করেননি।
তারমানে আপনি বলতে চান…
সম্পূর্ণ অন্য কথা। এ-ধরনের দুর্ঘটনার আয়োজন আরও করা হয়েছে কিনা দেখা দরকার।
.
ঘড় ঘড় আওয়াজ তুলে ঘুরছে ক্যাটারপিলার ট্র্যাক। বরফে দাঁত বসিয়ে এগিয়ে চলেছে স্নো-ক্যাট। ক্যাবের সামনেটায় আলো ফেলছে একটা হেডলাইট, জানালার বাইরে বসানো দ্বিতীয় হেডলাইটের আলো তির্যকভাবে নিচের দিকটা আলোকিত করে রাখছে। বরফের ওপর তির্যক আলোটা যেখানে পড়ছে, সামনের দিকে ঝুঁকে সেদিকে তাকিয়ে আছে ড. কর্ডন। খানিক পর এই আলোটার ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হবে তাকে। এই আলোই তাকে ঝপ করে বিশ ফিট নেমে যাওয়া খাঁদটা দেখতে পেতে সাহায্য করবে। খাদের নিচ থেকেই শুরু হয়েছে সীমাহীন পোলার প্যাক।
ফার পারকা আর ফার হুড পরে থাকায় এঞ্জিনের আওয়াজ তেমন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না ড. কর্ডন। ঘড়ি দেখল, কাঁটায় কাঁটায় আটটা। সময়ের হিসেবে কোন ভুল হয়নি, নিজের হাতে অন করা এয়ারস্ট্রিপের ল্যান্ডিং লাইটগুলোর একটা দেখতে পাবার সময় হয়ে এসেছে। বড় লিভারটা ঘোরাল সে, ভারী ট্র্যাকের নাক একটু ঘুরে গেল। দিক বদলের সাথে সাথে চেক করল মাইলোমিটার। ড. কর্ডন শান্তিপ্রিয় মানুষ, কিন্তু বিপদের কথা মনে রেখে পাশের সীটে লোড করা একটা রাইফেল রাখতে হয়েছে। তাকে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে কোথায় যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছে না, চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে নীল ক্যাপটা-কে জানে। কেমন দেখতে ছিল নার্স মেয়েটা! চোখ আর ভুরু কুঁচকে তাকাল সে। উইন্ডস্ক্রীন ঝাপসা হয়ে গেছে, পরিষ্কার করার বদলে গ্লাস আরও নোংরা করে তুলছে ওয়াইপার। ক্যাট থামিয়ে ন্যাকড়া হাতে। নেমে পড়ল সে।
ঢেউ খেলানো কুয়াশা ভেসে যাচ্ছে স্নো-ক্যাটের ওপর দিয়ে, বাহনের পিছন দিকটা সম্পূর্ণ আড়ালে ঢাকা পড়ল। গ্লাসে ন্যাকড়া ঘষার সময় সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে চারদিকে চোখ বুলাল ড. কর্ডন। চারদিকে কুয়াশা, কাছেপিঠে গোটা রাশিয়ান আর্মি লুকিয়ে। থাকলেও দেখতে পাবার কথা নয়। তাড়াতাড়ি গ্লাস পরিষ্কার করে। ক্যাবে উঠে দরজা বন্ধ করে দিল। খানিকটা হলেও স্বস্তি আর নিরাপত্তা বোধ ফিরে এল। মাইলোমিটার চেক করে বড় লিভারটা ঘোরাল, ধীরে ধীরে আবার এগোতে শুরু করল স্নো-ক্যাট। কাজটার বিপজ্জনক পর্যায় শুরু হলো এবার।
লিভারের ওপর ঝুঁকে তির্যক আলোর ওপর চোখ রাখল সে। হিসেব যদি ভুল না হয়ে থাকে, খাদের কাছাকাছি চলে এসেছে। ক্যাট। প্ল্যানটা যদিও রানার, কাজটা সারার দায়িত্ব আর কাউকে। না দিয়ে নিজে নিয়েছে ড. কর্ডন। স্নো-ক্যাটকে র্যাম্প পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে, র্যাম্প বেয়ে নামা হবে পোলার প্যাকে, তারপর। বরফ-দ্বীপ আই.আই. ফাইভের পাশ ঘেঁষে প্যাক ধরে খানিকদূর, এই সিকি মাইলটাক, এগোনো। তির্যক আলোর সাহায্যে খাদের। দিকে একটা চোখ রাখবে সে, তাতে সীমাহীন বরফ রাজ্যে। নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয় থাকবে না।
এরপর স্নো-ক্যাট রেখে র্যাম্পের দিকে রওনা হবে ড. কর্ডন, পায়ে হেঁটে পোলার প্যাক থেকে ফিরে আসবে আই.আই. ফাইভে। স্নো-ক্যাট পোলার প্যাকে পড়ে থাকবে উত্তর দিকে মুখ করে, স্টিয়ারিং মেকানিজম অকেজো অবস্থায়। রাশিয়ানরা ওটা দেখে ভাববে, দ্বীপ থেকে কেউ পালিয়েছে। ধরে নেবে প্লেনটা ক্র্যাশ করায় আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল, তাই ভুল করে পশ্চিমের বদলে উত্তর দিকে গেছে ওরা।
এক হাতেই একটা সিগারেট ধরাল ড. কর্ডন, ভয় আর নিঃসঙ্গতা-বোধ একটু যেন দূর হলো। তারপর হঠাৎ করেই দিক বদল করল সে। তির্যক আলোয় খাঁদটা দেখতে পেয়েছে। দ্বীপপ্রাচীরের কিনারা ঘেঁষে এগোল স্নো-ক্যাট। বিপদের ঝুঁকি এড়াবার জন্যে খাদের কিনারা থেকে বারো গজ সরে এল সে। এবার ক্যাবের মাথায় কাঠের থামে বসানো হেডলাইটের আলোয় সামনে, দূরে তাকাল সে। র্যাম্পটা এখান থেকে খুব বেশি দূরে হবার কথা নয়।
.
পুব…পুব…পুবদিকে! র্যাম্প, র্যাম্প!
মাইক্রোফোনের সুইচ অফ করে দিল জুনায়েভ। বরফ-দ্বীপ আই.আই.ফাইভকে ঘিরে থাকা পোলার প্যাকে ওদের লোকজন রয়েছে, সাথে মার্কিন ধাঁচের ওয়াকি-টকি ট্রান্সমিটার। স্নো-ক্যাটটা কোনদিকে যাচ্ছে, এইমাত্র তাদের জানিয়ে দিল জুনায়েভ। এখন তারা কয়েক দিক থেকে স্নো-ক্যাট আর র্যাম্পের দিকে এগোবে।
কুয়াশার ভেতর স্থির হয়ে আছে কর্নেলের স্নো-ক্যাট। কর্নেলের পাশের সীটে রয়েছে জুনায়েভ। তাদের পিছনের কমপার্টমেন্টে, রাডার অপারেটর তার স্ক্যানার-এর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, দ্বীপের ওপর দিয়ে ড. কর্ডনের বাহনটাকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখছে সে। তার মাথার ওপর, ছাদে, ধীরে ধীরে ঘুরছে রাডার উইং। পোলার প্যাকে মৃত্যুপুরীর জমাট নিস্তব্ধতা, দাঁত দিয়ে পাইপ কামড়ে আই.আই. ফাইভের। দিকে নিৰ্ণিমেষ তাকিয়ে আছে কর্নেল বলটুয়েভ।
আপনার কি মনে হয়, কর্নেল কমরেড, ইভেনকো ওদের সাথে যাচ্ছে? জিজ্ঞেস করল জুনায়েভ।
বেকুব!
তা তো বটেই! উত্তেজিত হয়ে উঠল জুনায়েভ। ব্যাটা ধরে। নিয়েছে আমাদের চোখে ধুলো দেয়া খুব সহজ। বেঈমান, নেমকহারাম, ইহুদি জাতটাই…
বাধা দিল কর্নেল, বেকুব আমি তোমাকে বলেছি, জুনায়েভ, ঠাণ্ডা সুরে বলল সে। আড়চোখে লক্ষ করল, হাঁ হয়ে গেল জুনায়েভের মুখ। ইভেনকো কোথায় তাই জানি না, জিজ্ঞেস করছ। ওদের সাথে পালাচ্ছে কিনা!
জুনায়েভ মাথা নিচু করে বসে থাকল।
আবার মুখ খুলল কর্নেল, ওদের সাথে থাকতে পারে সে, নাও। পারে। যদি থাকে, সমস্যার সমাধান করা যাবে। যদি না থাকে, ওদের ছেড়ে যাওয়া ক্যাম্পে গিয়ে উঠব আমরা, অপেক্ষা করব। তার জন্যে। জানালা দিয়ে বাঁ দিকে তাকাল সে। কুয়াশা সরে। যেতেই আরেকটা স্নো-ক্যাট দেখা গেল, চুপচাপ এঞ্জিন বন্ধ করে সেটাও স্থির হয়ে আছে। আরোহীর সংখ্যা আট, চারজনের কাছে। রয়েছে অটোমেটিক উইপন। সময় দেখল কর্নেল। আটটা পাঁচ। আটটা পনেরোর মধ্যে দাবার বোর্ড থেকে আরও একটা খুঁটি তুলে নেয়া হবে, মুচকি হেসে ভাবল সে। র্যাম্পে উঠে এল ড. কর্ডন।
সামনের ট্র্যাক নিচের দিকে ঝুঁকছে টের পেয়েই সাবধান হয়ে গেল সে। তিন বছর আগে পাহাড় থেকে পাথর এনে র্যাম্পটা তৈরি করেছিল তারা, পাথুরে অবলম্বনের ওপর দ্বীপ-প্রাচীরের গা ঘেঁষে ক্রমশ বাঁকা, চওড়া, এবং ঢালু হয়ে নেমে গেছে ওটা। ডান দিকে খাঁদ, আর কিনারা। ভারী বাহনটাকে ধীরে ধীরে বাঁ দিকে ঘোরাল ড. কর্ডন, কাছাকাছি থাকল দ্বীপ-প্রাচীরের।
ব্রেক করল, এঞ্জিন চালু থাকল, বাইরে তাকাল জানালা দিয়ে। তির্যক আলোয় নিচে বা সামনে কোথাও কঠিন বরফের নামনিশানা নেই। ঢালু হয়ে কুয়াশার ভেতর হারিয়ে গেছে র্যাম্প, মনে হলো পাহাড়ের কিনারা থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। দস্তানার ভেতর ঘামে চটচট করছে হাত। মুহূর্তের জন্যে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগল। ঝুঁকিটা না নিলে কেমন হয়? এখানেই যদি ক্যাটকে ফেলে ফিরে যায় ক্যাম্পে?
রাশিয়ানদের বোকা বানানো কঠিন। নাহ্, নিখুঁত হওয়া চাই কাজটা।
ধুস শালা, যা আছে কপালে!
পোলার প্যাকে নিঃসঙ্গ দীর্ঘ সময় কাটিয়ে এই অভ্যেসটা হয়ে গেছে, একা একা কথা বলা। বিপজ্জনক দিকটার সবকিছু আড়াল করে রেখেছে কুয়াশা। অপরদিকে, হেডলাইটের আলোয় ঝাপসা মত সাদাটে দেখা যাচ্ছে দ্বীপ-প্রাচীর। ওটার কাছ ঘেঁষে থাকতে হবে তাকে, খাদের দিকে তাকাবেই না।
ব্রেক ছেড়ে দিয়ে বাঁকা পথ ধরে এগোল ড. কর্ডন। নাজুক পরিস্থিতি, কারণ সামনের ক্যাটারপিলারগুলোকে অনুসরণ করে পিছনের ট্র্যাকগুলোকে ঠিকমত বাঁক নিয়ে নেমে আসতে হবে। ঝাপসা বরফ-পাঁচিলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল সে। স্নোক্যাট সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ায় সীটের কিনারায় ঝুলে মত আছে। স্নো-ক্যাটের ডান দিকের ট্রাক খাদের কিনারা থেকে এক ফুট দূরেও নয়। হামাগুড়ি দিয়ে, ধীরে ধীরে এগোল স্নো-ক্যাট, লিভারটা শক্ত করে চেপে ধরে আছে সে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিড়বিড় করল একবার, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ক্যাটের মতিগতি এখনও ঠিক আছে, সুন্দর নেমে যাচ্ছে র্যাম্প বেয়ে।
ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক। ক্যাট ঠিকভাবেই এগোচ্ছে, খাদের কিনারা থেকে দশ ইঞ্চি দূরে রয়েছে ডান দিকের ট্র্যাক। অথচ যা ঘটছে তাও দুঃস্বপ্ন নয়। ব্যাপারটা কেন ঘটছে, প্রথমে টেরই পেল না ড. কর্ডন। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত কাত হতে শুরু করল ক্যাট, উল্টে যাচ্ছে।
বরফই শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করল। অবলম্বন হিসেবে। যে পাথরগুলো র্যাম্পের নিচে বসানো হয়েছিল, সেগুলোর নিচে। ধসে যেতে শুরু করল বরফ। ক্যাটের অতিরিক্ত ওজন সর্বনাশের। ষোলোকলা পূর্ণ করল। কন্ট্রোল নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ড. কর্ডন, এমনি সময়ে কাত হয়ে গেল ক্যাট, কিনারা থেকে খসে পড়ল ঝুপ করে।
অনেকটা অভ্যাসবশত, কিনারা থেকে পড়ে যাচ্ছে বুঝতে। পেরে, এঞ্জিন অফ করে দিল ড. কর্ডন। পরমুহূর্তে তার মাথা। নিচের দিকে আর পা ওপর দিকে হয়ে গেল। বিশ ফিট নেমে এল ক্যাট, প্যাকের শক্ত বরফে পড়ল ছাদ, ভারী ট্রাক চ্যাপটা করে দিল খুদে ক্যাব। সেই সাথে ভেঙে চুরে, ফেটে, গুঁড়িয়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেল হাড়, মাংস, কাচ, আর ধাতু।
দ্বীপের অপর প্রান্তে, এক মাইল দূরে, ড. কর্ডনের এই করুণ পরিণতির কথা জানা হলো না রানার। নিজের দল নিয়ে দ্বীপ থেকে পোলার প্যাকে নেমে এসেছে ও। সপাং সপাং চাবুক খেয়ে ছুটছে কুকুরগুলো। পশ্চিম দিকে যাচ্ছে ওরা।