মরণখেলা: ১.৮ এ স্যাবোটাজ, কোন ম্যানিয়াকের কাজ

মরণখেলা: ১.৮ এ স্যাবোটাজ, কোন ম্যানিয়াকের কাজ

১.৮ এ স্যাবোটাজ, কোন ম্যানিয়াকের কাজ

এ স্যাবোটাজ, কোন ম্যানিয়াকের কাজ! রাগে ফুঁসে উঠল বেস লীডার ড. কর্ডন।

ওদেরকে ছুঁয়ে ভেসে যাচ্ছে কুয়াশা। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া রেডিও-রুমটাকে শক্তিশালী ল্যাম্পের আলোয় ঘুরে ফিরে দেখছে ওরা। আগুন নিভলেও, ছাইয়ের ভেতর থেকে ক্ষীণ ধোঁয়া আর পোড়া পোড়া গন্ধ বেরুচ্ছে-নেভেনি মনের জ্বালা।

স্যাবোটাজ বলছেন কেন? রাইফেলটা কাঁধে অ্যাডজাস্ট করে নিয়ে জিজ্ঞেস করল রানা।

আপনারা পৌঁছেই যার সাথে আলাপ করলেন, জেমস কাজম্যান, বলল বেস লীডার, সে-ই প্রথম আগুন দেখে ছুটে আসে। তার চিৎকার শুনে ছুটে আসি আমি। দেখি, দরজার খানিকটা ছাড়া ঘরের বাকি অংশ দাউ দাউ জ্বলছে। তালার চারপাশের কাঠ ভাঙা দেখলাম…

তাতেই ধরে নিতে হবে স্যাবোটাজ? বিরক্তি প্রকাশ করল রানা। অনেক কারণে ওটাকে ভাঙা বলে মনে হতে পারে। দশ। মিনিট আগে এখানে পৌঁছে আই.আই. ফাইভের তিন বিজ্ঞানীকে বরফের ওপর উত্তেজিতভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও, সেই থেকেই ওদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। স্যাবোটাজ, তাতে। কোন সন্দেহ নেই।

প্রমাণ শুধু এই একটাই নয়, গম্ভীর সুরে বলল ড, কর্ডন। ঘরের ভেতর তিনটে কোলম্যান স্পেস হিটার ছিল-ওই যে, দলা। পাকানো মেটাল। ঘর থেকে জেমস শেষবার বেরুবার সময় খাড়া করা ছিল ওগুলো।

এখন উল্টে রয়েছে কিম্ভুতকিমাকার আকৃতিগুলো। আগুনেরও ধাক্কা আছে, তাতে উল্টে যেতে পারে, বলল রানা।

ফর গডস সেক, মি. মাসুদ রানা, আপনি কি আমাকে পাগল। ঠাউরেছেন? ঝঝের সাথে বলল ড. কর্ডন। আপনিও জানেন কি রকম ভারী ওগুলো, ঝেড়ে লাথি না মারলে নড়ে না।

ঠিক আছে, ঠিক আছে-শান্ত হোন, বলে ধীর পায়ে সরে এল। রানা। আই.আই.ফাইভে বছর দুয়েক আগে একবার এসেছিল ও, কিন্তু কুয়াশায় এখন আর চেনা চেনা লাগছে না। দূর থেকে আগুন। জ্বলতে দেখে র‍্যাম্প না খুঁজে সরাসরি বরফের ওপর দিয়ে বেসে চলে এসেছে ওরা। র‍্যাম্পের বদলে বিশ ফিট উঁচু একটা ঢালের। মাথায় চড়তে হয়েছিল, ঢাল থেকে স্লেজ টীম নিয়ে দ্বীপে নামতে অমানুষিক খাটতে হয়েছে ওদেরকে।

কোণে ওই যে তালগোল পাকানো মেটাল দেখছেন, জ্বী, ওটাই আমাদের ট্রান্সমিটার ছিল, রানার পিছন থেকে বলল ড. কর্ডন। মেইনল্যান্ডের সাথে যোগাযোগ করার আর কোন উপায় নেই আমাদের। প্লেন যদি আসে, তবেই আবার সভ্যতার মুখ দেখতে পাব।

তাও দশ দিন পর আসবে বলে শুনেছি, বলল রানা। সময়টা এত পিছিয়ে ধরা হয়েছে কেন?

কাঁধ ঝাঁকাল ড. কর্ডন। আমারই দোষ। এতটা দক্ষিণে ডেপথ-সাউন্ডিং আর স্যালাইনিটি টেস্টের সুযোগ আগে আমরা পাইনি, ভাবলাম সুযোগটা হাতছাড়া করব না। কে জানত এভাবে হঠাৎ কুয়াশায় সব ঢাকা পড়ে যাবে। এখন আবার দেখুন…

কাকে দায়ী করেন আপনি? জিজ্ঞেস করল রানা। কে আছে এখানে যে…?

আমরা তিনজন, কেউ হতে পারি না। কিন্তু এক মুহূর্ত থেমে আপনমনে কাঁধ ঝাঁকাল ড. কর্ডন। কি জানি! রানার দিকে তাকিয়ে অন্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করল সে, কে একজন রাশিয়ান আসবে, তার কি হলো? কে সে?

রুস্তভ, ইভেনকো রুস্তভ। ড. কর্ডনের সিকিউরিটি ক্লিয়ারান্স নেই, ভোলেনি রানা। ভদ্রলোক সম্পর্কে বিশেষ কিছু আমার জানা নেই। ওয়াশিংটন থেকে ধারণা দেয়া হয়েছে, রুশ রাজনীতির সেট-আপ সম্পর্কে উনি নাকি পরিষ্কার কিছু বলতে পারবেন। কথা আছে এন.পি.সেভেনটিন থেকে এখানে চলে আসবেন তিনি।

সেজন্যেই কি আপনি এখানে?

আমার দায়িত্ব তাঁকে নিয়ে কার্টিস ফিল্ডে ফিরে যাওয়া। সামান্য একটা কাজ।

হাঁ হয়ে গেল ড. কর্ডন। বরফের ওপর দিয়ে? সামান্য একটা। কাজ? আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আমি হলে, শুধু কেউ যদি অমরত্বের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ আর প্রতিশ্রুতি দিত তাহলেই এই ঝুঁকি নিতে রাজি হতাম। কাঁধ ঝাঁকাল সে, দস্তানা পরা হাত দিয়ে ভুরু থেকে বরফের গুঁড়ো ঝাড়ল সে। নিজের মরণ নিজে বেছে নিয়েছেন, নিঃশব্দে হেসে রানাকে পাশ কাটাল। চলুন ওদের কাছে ফেরা যাক।

নিরিবিলিতে আলাপ করতে পারি, শুধু আমি আর আপনি?

রিসার্চ হাট এই তো সামনে। অক্ষত ঘরগুলোর মাঝখান। দিয়ে পথ দেখিয়ে এগোল ড. কর্ডন। তার পিছু নিয়ে আবারও মনে হলো রানার, কুয়াশা পাতলা হচ্ছে। ড. কর্ডন ভুল করেনি, রেডিও-রুমে কেউ ইচ্ছে করে আগুন দিয়েছে। কিন্তু উত্তেজনা বাড়িয়ে লাভ নেই। তাছাড়া মুখ বুজে থাকার আরও কারণ আছে। ইভেনকো রুস্তভ যদি পৌঁছুতে পারে এখানে, তাকে একা নিয়ে রওনা হবে ওরা, বিজ্ঞানীদের থেকে যেতে হবে। ড. কর্ডনের ব্যাপারে ওর মনে কোন সন্দেহ নেই, লোকটাকে বেশ কবছর ধরে। চেনে। কিন্তু জেমস কাজম্যানকে চেনে না। আর ড. রডেনবার্গকে। ওর চেনার কোন দরকারই নেই। গ্র্যাভিটি স্পেশালিস্ট লোকটার। দিকে একবার তাকালেই বোঝা যায়, যে-কোন মুহূর্তে উন্মাদ হয়ে। যেতে পারে। ইভেনকোকে নিয়ে ওরা চলে যাবার পর রাশিয়ানরা পৌঁছে চাপ দিলেও বিজ্ঞানীরা কোন তথ্য দিতে পারবে না-যদি না জানে।

এখানে মাথা গুঁজতে হবে আপনাকে, সারির শেষ ঘরটার তালা খুলে বলল ড. কর্ডন। হিটার আগে থেকেই জ্বালানো আছে।

বেসে পৌঁছেই হেডকোয়ার্টার রুমে ঢুকেছিল রানা, বিশ ফিট লম্বা, পনেরো ফিট চওড়া। এই ঘরটাও তাই। ঘাঁটি ত্যাগ করার প্রস্তুতি শেষ, বোঝা যায় দেয়াল ঘেঁষে থাকা কাঠের বাক্সগুলো দেখে। এক কোণে বড়সড় একটা লোহার তেপায়া দেখা গেল, মাথায় প্রকাণ্ড উইঞ্চ মেকানিজম। তেপায়াটা দেখিয়ে ড. কর্ডন বলল, সী-বেডে নামাবার জন্যে আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা ওটায় বাঁধা হয়। একটাই গর্তের ভেতর ড্রিলিং কোর-ও নামাই আমরা। দেখার শখ আছে?

প্রশ্নই ওঠে না। রানা কি বিজ্ঞানী? কিন্তু দেখাতে যখন চাইছে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। ঝুঁকে পড়ে তেপায়ার নিচ থেকে কাঠের মেঝে খানিকটা সরাল ড. কর্ডন। চার ফুটি একটা চৌকো ট্র্যাপ-ডোর। ছফিট নিচে আরেক প্রস্থ মেঝে দেখা গেল। দেখুন, জায়গাটা আপনার পছন্দ হয় কিনা। ইমার্জেন্সি দেখা দিলে কমরেড মহাশয়কে ওখানে আমরা লুকিয়ে রাখতে পারি। একটু গম্ভীর হলো সে। স্বীকার করি, খুব ঠাণ্ডা লাগবে তাঁর, কিন্তু এর বেশি কিছু করা…

হঠাৎ হেসে ফেলল রানা। আসলে কি বলতে চান? কি ঘটেছে তা যেন আন্দাজ করতে পারছে ও।

ড. কর্ডন কিন্তু গম্ভীর হয়েই থাকল। জেনারেল ফচ চিঠিতে যা লিখেছেন, আপনিও ঠিক তাই বলছেন, কিন্তু আমার নিজেরও তো কিছু বুদ্ধিশুদ্ধি আছে? কুয়াশার ভেতর দিয়ে পথ হাতড়ে এসেছেন আপনারা, প্রাণের ওপর ঝুঁকি নিয়ে। তারমানেই ইভেনকো রুস্তভ বেড়াতে আসছেন না, পালিয়ে আসছেন। তাঁকে রিসিভ করার জন্যে এই আয়োজন দেখেই তো বোঝা যায়, সোনা। বা হীরের চেয়েও দামী কোন খনি হবেন তিনি। অর্থাৎ তাঁর পিছু পিছু নির্ঘাত রুশ সিকিউরিটিও আসবে। ঠিক কিনা?

হ্যাঁ, আপনাকে তো আমি বলেইছি…

কিন্তু এই একই কারণে আমার রেডিও-রুম স্যাবোটাজ করা হয়েছে তা বলেননি! কাজটা ওরা ইচ্ছে করে করেছে, ওরা এসে। পেঁৗছুলে আমরা যাতে কার্টিস ফিল্ডের সাথে যোগাযোগ করতে না। পারি।

দ্বিতীয় মেঝের নিচে কি আছে? জিজ্ঞেস করল রানা। ভাল। কথা, গুন্টার রডেনবার্গ আর জেমস কাজম্যান যেন সব কথা না জানে।

আবার ঝুঁকল ড. কর্ডন, হুকের সাথে আটকানো একটা রশি ধরে টান দিল। নিচের মেঝে থেকেও চৌকো একটা তক্তা, ট্র্যাপডোর, সরে গেল। ভেতরে অন্ধকার। ল্যাম্পের সুইচ অন করে আলো ফেলল সে। দ্বিতীয় ট্র্যাপ-ডোরের অনেক নিচে পর্যন্ত আলো গেল, কিন্তু তবু কিছু দেখা গেল না-শ্যাফটটা আরও অনেক গভীর। কটু একটা গন্ধ পেল রানা। শ্যাফটের দেয়ালে বরফ জমে। রয়েছে।

আরও নিচে বরফ, তারপর আর্কটিক সাগর, বলল ড. কর্ডন। লাশ লুকাবার জন্যে এরচেয়ে ভাল জায়গা আর পাবেন?

আপনার বুঝি ধারণা, দরকার হলে ইভেনকোকে মেরে ফেলব আমরা, তবু রাশিয়ানদের জানতে দেব না তাকে আমরা ভাগিয়ে এনেছি?

হেসে ফেলল ড. কর্ডন। স্রেফ একটা জোক, মি. মাসুদ রানা। তাও টেনশন থেকে রিলিজ পাবার জন্যে। নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, মেজাজ চড়ে আছে আমার? কারণটা বুঝতে পারবেন, যখন দেখবেন পাশের ঘরে বসে চুরুট কুঁকছেন আপনার ইভেনকো রুস্তম্ভ।

.

রুশ ফেরারী, সোভিয়েত ইউনিয়নের চীফ ওশেনোগ্রাফার, মেরিলিন সিস্টেমের ডিজাইনার এবং স্রষ্টা, ইভেনকো রুস্তভ ঘরের দেয়ালে লাগানো বাংকে শুয়ে বিচ্ছিরি শব্দে নাক ডাকছেন। বেরিয়ে আছে শুধু মুখটা, পা থেকে গলা পর্যন্ত কম্বলে মোড়া। ঘরে ধোঁয়া, চুরুটের গন্ধ, চুরুটটা পড়ে রয়েছে মেঝেতে নিভে গেছে। ঘুমের মধ্যে খক খক করে কাশছেন তিনি, ঘুমন্ত চেহারায় অশান্তি আর উদ্বেগের ছাপ।

আপনারা আসার আধ ঘণ্টা আগে পৌচেছেন, ব্যাখ্যা করল ড. কর্ডন। রেডিও-রুম পুড়ছে, পাশে একা দাঁড়িয়ে আছি আমি, টলতে টলতে কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন কমরেড। এই ঘরটাই কাছে, তাড়াতাড়ি নিয়ে চলে এলাম।

এক অর্থে বিপরীতে হিত হয়েছে, ভাবল রানা। রাশিয়ানরা রেডিও-রুমে আগুন ধরিয়েছিল বলেই পথ চিনে আই.আই.ফাইভে আসতে পেরেছেন ইভেনকো। ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন তিনি, তার মুখের কাছে কান নামাল রানা।

সুমাইয়া…। স্বপ্নে বোধহয় প্রেমিকাকে দেখতে পাচ্ছেন ভদ্রলোক।

কেমন বুঝছেন ওঁর অবস্থা? ফিসফিস করে জানতে চাইল রানা। এক সময় তো মেডিসিন নিয়ে চর্চা করেছেন।

ফ্রস্টবাইট ততটা মারাত্মক নয়। ওষুধ দিয়েছি। কিন্তু প্রলাপ থামানো যাচ্ছিল না।

ঠোঁট পুড়ল কিভাবে?

চুরুটটা আমিই ধরিয়ে দিই, কিন্তু উল্টো করে ধরে মুখে। পুরলেন, বিষন্ন দেখাল ড. কর্ডনকে। ভয় পাবার কিছু নেই, ঘুম ভাঙার পর আপনার চেহারা দেখলেই আবার উনি স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন।

ভুরু কুঁচকে তাকাল রানা।

বললাম না, প্রলাপ থামানো যাচ্ছিল না? হাসতে লাগল ড. কর্ডন। পরিষ্কার ইংরেজিতে বারবার একই কথা বলছিলেন-দ্য হিরো, দ্য গ্রেটেস্ট স্পাই অভ দ্য সেঞ্চুরি, হয়্যার ইজ হি? তারপর বললেন, তাকে যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার সামনে হাজির করতে না পারো, আমি ফিরে যাব, সুইসাইড করব। কাজেই বাধ্য হয়ে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিলাম। এমন ভাবে কথা বলছিলেন, তিনি আসবেন আমি যেন জানি।

এলেন কিভাবে?

সম্ভবত স্লেজে চড়ে…

সোজা করে কথা বলুন। সম্ভবত আবার কি?

এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ নয় যে…

নয়? স্লেজটা যদি কুয়াশার ভেতর কোথাও পড়ে থাকে আর রাশিয়ানরা দেখতে পায়, তাহলে…?

হাত তুলে আত্মসমর্পণ করল ড. কর্ডন। দুঃখিত। বললেন, এখানেই কাছাকাছি কোথাও কুকুরগুলোকে হারিয়ে ফেলেন তিনি। অগত্যা নিজেই স্লেজটাকে টেনে নিয়ে আসছিলেন, অসুস্থ হয়ে পড়ার সেটাও একটা কারণ। তারপর আগুন দেখে কম্পাস বের করেন, বেয়ারিং নিয়ে হেঁটে চলে আসেন এখানে-স্লেজটাকে ফেলেই। রানার কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে ধরাল ড. কর্ডন, খস করে দিয়াশলাই জ্বালার আওয়াজে নড়ে উঠলেন ইভেনকো রুস্তুভ। আমার ধারণা, ক্লিফের ওদিকে আধ মাইল দূরে স্লেজ পড়ে আছে। ভয়ের ব্যাপার?

খুব একটা নয়। কি করে বুঝলেন উনিই ইভেনকো রুস্তভ?

উনিই বললেন…

এটা কি ওঁর জ্যাকেট? বলে টেবিল থেকে জ্যাকেটটা তুলে পকেটগুলো হাতড়াতে শুরু করল রানা। যতদূর মনে পড়ে, গতবার এখানে এসে এই ঘরে বাংকটা আমি দেখিনি।

দেখেননি, বলল কর্ডন। বলতে পারেন, আজ আমার ভূমিকায় অভিনয় করছেন ইভেনকো। সবার কাছ থেকে পালিয়ে একা কিছু ভাবতে হলে এখানে চলে আসি আমি। বাংকটা তৈরি করে নিয়েছি, দরকার হলে ঘুমিয়েও নিতে পারি।

আসলে রডেনবার্গের কাছ থেকে পালিয়ে আসার দরকার হয় আপনার, তাই না? মানিব্যাগটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছে রানা। জিনিসগুলো বের করে টেবিলের ওপর রাখছে।

গুণী লোকের বুদ্ধির প্রশংসা করতে নেই, তাতে নাকি তাকে অপমানই করা হয়, হাসতে হাসতে বলল ড. কর্ডন। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন প্রায় উন্মাদই হয়ে গেছে রডেনবার্গ। কাজম্যানও হচ্ছে, একটু একটু করে। আতঙ্ক জিনিসটা সংক্রামক কিনা। ভদ্রলোকের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র এত খুঁটিয়ে দেখার আছে কি? গলার সুরে একটু যেন অসন্তোষ।

আছে। যেমন এই কার্ডটা বলছে উনি ইভেনকো রুস্তম্ভ। মুশকিল হলো, ভদ্রলোকের কোন ছবি আমরা পাইনি আগে। সিকিউরিটি পিছু নিয়েছে, এ-ধরনের কিছু বলেছেন উনি?

মাথা নাড়ল ড. কর্ডন। আমি জানি না উনি আসছেন, এটা। টের পেয়েই বোধহয় আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেন। ইঞ্জেকশন দিতে একটু জোর খাটাতে হয়েছে।

ইভেনকোর ভিজে পারকাটা তুলে নিল রানা। স্পেস হিটারের কাছে ছিল ওটা, বরফ গলে গেছে।

উনি যে এসেছেন আর কেউ তা জানে না, বলল ড. কর্ডন। আমি চাইনি আতঙ্ক আরও বাড়ক। তাছাড়া, রুশ সিকিউরিটি এলে রডেনবার্গ মুখ বুজে থাকবে বলে বিশ্বাস হয় না।

আপনার বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়-থুড়ি!

দুজনেই হাসল, নড়ে উঠলেন ইভেনকো।

রাশিয়ানরা যদি এসেই পড়ে, বলল রানা, আপনার ওই। গর্তেই দ্রলোককে রাখতে হবে।

জ্যান্ত মানুষকে? প্রতিবাদ জানাল ড. কর্ডন। বললাম না, জোক করেছি? ওখানে ওঁকে রাখলে স্রেফ আধ ঘণ্টার মধ্যে মারা যাবেন…

ফার দিয়ে মুড়ে রাখলেও, আর পাশে যদি একটা হিটার ঝুলিয়ে রাখি? কিছুক্ষণের জন্যে, সার্চ করে রাশিয়ানরা চলে গেলে। আবার তুলে আনব।

চাপা গলায় গর্জে উঠল ড. কর্ডন। আমেরিকান বেস সার্চ করবে রুশ সিকিউরিটি?

নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যে প্রস্তাবটা আমরাও দিতে পারি, বলল রানা। ইভেনকোর পারকার পকেট থেকে লম্বা একটা টিউব বের করল ও। বেশ ভারী, লম্বায় এক ফুট। বিপদের গুরুত্বটা শুধু আপনাকেই বলছি। আই.আই.ফাইভে আটকা পড়ে গেছি আমরা। কোন প্লেন আসছে না। রেডিও-ও নেই। আমরা এখানে যারা আছি হঠাৎ এই মুহূর্তে বাতাসে মিলিয়ে গেলে কেউ কোন দিন প্রমাণ করতে পারবে না আসলে কি ঘটেছিল।

ধীরে ধীরে কাঠের একটা চেয়ারে বসল ড. কর্ডন, বোবা দৃষ্টিতে রানার দিকে তাকিয়ে আছে। কে এখন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে? জোর করে হাসল সে। আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন না…ওদের এত বড় সাহস হবে…?

পরিষ্কার জেনে রাখুন, ঠাণ্ডা গলায় বলল রানা, খুব বেশি সাহসের দরকার নেই, দরকার শুধু খানিকটা নিষ্ঠুরতার। ধরুন, আপনাদের একটা স্নো-ক্যাট এখান থেকে খানিক দূরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেল-ফুয়েল শেষ হয়ে গেছে। কুয়াশা সরে যাবার পর কার্টিস ফিল্ড থেকে উড়ে এসে কি দেখবে ওরা? বেস খালি, রেডিও-রুম ছাই, স্নো-ক্যাট পরিত্যক্ত। কি বুঝবে?

কুয়াশা আসছে দেখে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি, রেডিওরুমে আগুন ধরে যাওয়ায় স্নো-ক্যাট নিয়ে বেরিয়ে পড়ি…

ফুয়েল ফুরিয়ে যায়, বলল রানা। কাজেই আপনারা বেসে ফেরার জন্যে হাঁটা ধরেন। এবং…

ফেরার পথে কোন ফাটলে পড়ে…

কিংবা কোন মুভিং প্রেশার রিজ আপনাদের গিলে নেয়।

কিন্তু সেটা হবে পাইকারী হত্যাকাণ্ড! প্রতিবাদ জানাল ড. কর্ডন। রাশিয়ানরা…

যোগফলটা কি হতে পারে তাই শুধু কল্পনায় রাখতে বললাম, বলল রানা। কি ঘটবে সেটা পরের কথা। কারা আসছে সেটা ভুলে যাবেন না। কে.জি.বি. হলে তবু কথা ছিল, কিন্তু এ যে। বলটুর পোষা কুকুর-এস.এস.এস.।

.

আমরা যাচ্ছি কখন?

হেডকোয়ার্টার বিল্ডিঙের উল্টোদিকের একটা ঘরে কুকুরগুলোকে বেঁধে রাখছে নিয়াজ। ঘরের তিন দিকের দেয়াল। ঘেঁষে একটার ওপর একটা কাঠের বাক্স, সবগুলোয় জিনিস-পত্র। ভরে তালা মেরে দেয়া হয়েছে। বেস ত্যাগ করার প্রস্তুতি প্রায় শেষ, বেশিরভাগ ঘর খালি পড়ে আছে। অথচ ওদেরকে নিতে। প্লেন আসবে দশ দিন পর।

ইভেনকো আগে সুস্থ হোন, বলল রানা। ইমার্জেন্সি দেখা দিলে আলাদা কথা।

স্পেস হিটারটা অ্যাডজাস্ট করছে নিয়াজ, মুখ তুলে তাকাল। ইমার্জেন্সি মানে? স্পেশাল সিকিউরিটি?

এরই মধ্যে একবার এসে গেছে ওরা। বোধহয় ফিরেও যায়নি, কাছে পিঠে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে। এক সেকেন্ড ভাবল রানা। এখানের কাজ শেষ করে আমাদের ট্রান্সমিটারটা। বের করো। কার্টিস ফিল্ডে একটা মেসেজ পাঠানো দরকার। ওদের বলো, আই.আই. ফাইভের রেডিও নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। স্যাবোটাজ-শব্দটা কয়েকবার রিপিট করবে। আর কিছু না। সাথে। সাথে প্যাক করে রেখে দেবে ট্রান্সমিটার।

মেসেজ রিসিভ করল কিনা শুনবও না?

মেসেজটা কার্টিস ফিল্ডের জন্যে নয়, বলল রানা। এন.পি.সেভেনটিনের মনিটরিং সেটে রাশিয়ানরা রিসিভ করবে ওটা।

রহস্যময়। জানতে পারি…?

পরে। কাজটা শেষ করে ঘরটা পাহারা দিতে চাও, বিনয়কে। সাথে রাখো। কোন ঘরটা তা উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করল না। বিপদ দেখলে, রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজ করবে। পালা করে পাহারা দেবে তোমরা, একজন ঘুমাবে।

ঘুম শুধু বুঝি আমাদেরই দরকার?

জবাব না দিয়ে ঘর থেকে হিম রাতে বেরিয়ে এল রানা, দরজা বন্ধ করার সময় শক্ত হয়ে উঠল মুখের চেহারা। দুসারি ঘরের মাঝখানে প্রায় সমতল বরফ-পথ, মাত্র ছফিট চওড়া। কুয়াশা আবার ঘন হয়ে গেছে, প্রতি মুহূর্তে গাঢ় হচ্ছে আরও। কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করল ও। কাছাকাছি কোথাও থেকে জেনারেটরের মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছে। দূর থেকে আরও একটা শব্দ আসছে, দ্বীপটাকে ঘিরে পোলার প্যাকের আস্ফালন।

বরফ-রাজ্যের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত যখন দ্বীপটা ভাঙবে, কলমা পড়ার সময়ও পাওয়া যাবে না। পলকের মধ্যে লম্বা লম্বা চিড় ধরবে বরফে, নিমেষে সেগুলো চওড়া ফাটলে পরিণত হবে। অথবা, এমনও হতে পারে, মাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যে গোটা দ্বীপ বিস্ফোরিত হবে, বরফের কণা হয়ে ছড়িয়ে পড়বে আকাশে।

দ্বীপের নিরাপত্তা নয়, এই মুহূর্তে রানার উদ্বেগ: কুয়াশার ভেতর কি নড়াচড়া করছে। পাহাড়টা দেখা যায় না, কিন্তু আছে, সেদিকে তাকাল রানা। চল্লিশ ফিট উঁচু, গায়ে বড় বড় বোল্ডার। সবচেয়ে কাছের উপকূল থেকে একশো মাইল দূরে সাগরে। ভাসছে। ঠাণ্ডায় হি হি করছে রানা, ব্যথা করছে চোখ। নিয়াজ। মিথ্যে বলেনি, ওর-ও ঘুম দরকার। পথটুকু পেরিয়ে হেডকোয়ার্টার। হাটের দরজায় নক করল ও। পারকা পরে বেরিয়ে এল বিনয়।

ইভেনকোর উপস্থিতি সম্পর্কে স্রেফ শুনে গেল বিনয়, কোন মন্তব্য করল না। হাতের রাইফেল কাঁধে ঝোলাবার সময় শুধু বলল, রডেনবার্গ আত্মহত্যা করলে খুশি হতাম। একটা আপদ।

হেডকোয়ার্টারের ভেতর ঢুকেই থমকে দাঁড়াল রানা। ড. কর্ডনের সাথে মারমুখো হয়ে ঝগড়া করছে রডেনবার্গ। রেডিও নেই, প্লেন আসছে না, দ্বীপটা ভাঙছে-অর্থাৎ আমরা মারা যাচ্ছি। কেন তাহলে এখানে অপেক্ষা করব আমরা? প্রাণের ওপর তোমার। মায়া না থাকতে পারে, কিন্তু আমার আছে। কেউ যদি না যায়, আমি একাই বেরিয়ে পড়ব…

নিচের একটা বাংকে শুয়ে রয়েছে জেমস্ কাজম্যান, রডেনবার্গের দিকে তাকিয়ে দিয়াশলাইয়ের কাঠি চিবাচ্ছে। বুকে হাত বেঁধে একটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ড. কর্ডন।

থোঃ করে থুথু ফেলে ধমকে উঠল কাজম্যান, ঈশ্বরের দোহাই, একটু ঘুমাও রডেনবার্গ। রডেনবার্গের পিছন থেকে তার। একটা হাত ধরে বাংকের দিকে টানল অয়্যারলেস অপারেটর। অন্তত এই ভদ্রলোকের সম্মানে ঝগড়া ঝাটি…

ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে প্রায় ছুটে রানার সামনে এসে দাঁড়াল রডেনবার্গ, চিৎকার করে জানতে চাইল, এই যে। ভদ্দরলোক, আপনারা এখানে কি মনে করে এসেছেন, জানতে পারি?

আগেই তো বলেছি, শান্ত সুরে জবাব দিল রানা। আমাদের হেলিকপ্টার ক্র্যাশ করায়…

মিথ্যে কথা! আমি বিশ্বাস করি না!

এক পাশে সরে রাইফেলটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখল রানা। তারপর পারকা খুলে টেবিলের ওপর রেখে বলল, তুমি মদ খেয়েছ, তাই না? গন্ধটা ঘরে ঢুকেই পেয়েছে ও।

ঈশ্বর জানেন কোথায় লুকিয়ে রেখেছে বোতলটা, বলল ড. কর্ডন। কোথাও খুঁজতে বাকি রাখিনি…

কোথায় আবার, যেখানে ও হাত লাগাতে দেবে না, বলল রানা। ওর গায়ে।

হঠাৎ টেবিলের তলা থেকে একটা শাবল তুলে মাথার ওপর উঁচু করল রডেনবার্গ। কেউ আমাকে সার্চ করতে এলে আমি তার…

নামাও ওটা! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আদেশ করল ড. কর্ডন।

শালার ভেতো বাঙালী আমার ওপর মাতব্বরী ফলাতে চায়! হিস হিস করে উঠল রডেনবার্গ। দেখো না কেমন হলুদ মগজ বের করে দিই…

সাবধান করে দিল রানা, জেমস, নড়বে না। ওর যা খুশি করতে দাও। পারকাটা তুলে নিল টেবিল থেকে। আমি কোন গোলমাল চাই না, ড. কর্ডন। অন্য কোন ঘরে থাকব আমি। পারকাটা পরতে শুরু করল ও। ঠিক এই সময় ওর মাথা লক্ষ্য করে শাবলটা নামিয়ে আনল রডেনবার্গ।

একপাশে সরে গিয়ে পারকা দিয়ে রডেনবার্গের মুখ আর মাথা ঢেকে দিল রানা। শাবলটা রানার মাথায় না লাগায় তাল হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল রডেনবার্গ, তাকে ধরে সিধে করল রানা। তারপর ডানহাতে প্রচণ্ড এক ঘুসি মারল তার পেটে। কেঁাঁক করে আওয়াজ হলো, বসে পড়ল রডেনবার্গ। তার মাথা থেকে পারকা খুলে নিল রানা। গ্র্যাভিটি স্পেশালিস্ট শুয়ে পড়ল, জ্ঞান হারিয়েছে।

কেউ কোন কথা বলল না। এগিয়ে এসে রডেনবার্গকে সার্চ করল ড. কর্ডন। সত্যিই পারকার ভেতরের পকেট থেকে মদের একটা প্রায়-খালি বোতল বেরুল। তার পালস পরীক্ষা করল সে। প্রচুর গিলেছে, ঘণ্টা কয়েকের আগে জ্ঞান ফিরবে বলে মনে হয় না।

অন্য কোন ঘরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব?

পাশের ঘরে দুটো বাংক আছে…

ওখানেই তাহলে, বলল রানা।বেঁধে রাখবেন।

চোখে অস্বস্তি নিয়ে তাকাল ড. কর্ডন। বেঁধে?

বেঁধে। শাবলটা মেঝে থেকে তুলল রানা। যে লোক কোন কারণ ছাড়াই এটা দিয়ে মারতে আসে, তাকে না বেঁধে উপায় কি? ঘরটায় বাইরে থেকে তালাও লাগাতে হবে। বাংক থেকে নেমে। এগিয়ে এল কাজম্যান, অচেতন রডেনবার্গকে কাঁধে তুলতে শুরু। করল। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলতে গেল ড. কর্ডন, তাকে বাধা। দিল রানা, তালা লাগাতে বলছি, কারণ আছে। এগিয়ে গিয়ে লম্বা। কাবার্ডের সামনে দাঁড়াল ও। হাত উঁচু করে কাবার্ডের মাথা থেকে মদের আরও একটা বোতল নামাল। আমি আপনার চেয়ে লম্বা, তাই ঘরে ঢুকেই এটা দেখেছিলাম। দুএকটা বোতল আরও কোথাও থাকতে পারে।

রানার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল ড. কর্ডন। আশ্চর্য! এগুলো পেল কোথায়! লেবেলেই লেখা রয়েছে, রাশিয়ান ভদকা। ড. সোরভের কাছ থেকে পেতে পারে না, তিনি হার্মলেস-এনপিসেভেনটিনের চার্জে আছেন ভদ্রলোক। আমরা কেমন আছি দেখার জন্যে মাঝে মধ্যে আসেন এখানে…

আসেন তথ্য সংগ্রহের জন্যে, কঠিন সুরে বলল রানা। ভদকার বিনিময়ে। রডেনবার্গকে সাধু মনে করার কোন কারণ নেই। এবার নিশ্চয়ই ওর ঘরে তালা লাগাতে আপত্তি করবেন না, ড. কর্ডন?

.

মেসেজটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে, জেনারেল ফচ পায়চারি করতে করতে বললেন, সংকট দানা বাঁধছে, টমাস। কাজেই আই.আই. ফাইভে আমি একটা প্লেন পাঠাচ্ছি।

কিন্তু কুয়াশা এখনও সরেনি, প্রতিবাদ জানাল টমাস। পাইলট ল্যান্ড করবে কিভাবে?

পাঁচবার স্যাবোটাজ শব্দটা ব্যবহার করেছে ওরা, কটমট করে সহকারীর দিকে তাকালেন জেনারেল। রেডিও-রুম পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। খোসা ছাড়ানো রসুনের কোয়া না গিলে চিবাতে শুরু করলেন তিনি। প্লেন তৈরি হয়ে আছে, বললেই টেক-অফ করবে। ম্যাট ইসটনকে পাঠাচ্ছি আমি।

কিন্তু ল্যান্ড করবে কিভাবে?

জানি না। শুধু জানি, কেউ যদি ল্যান্ড করতে পারে তো সে ইসটন। আর্কটিকের বিভিন্ন এলাকায় আই.আই.ফাইভে পাঁচবার ল্যান্ড করেছে সে। হাজার মাইলের মধ্যে তার চেয়ে দক্ষ সিভিলিয়ান পাইলট আর নেই। আমার নির্দেশ জানিয়ে দাও তাকে।

আমার একদম পছন্দ হচ্ছে না, বলে ফোনের রিসিভার তুলে নিল টমাস। এয়ারফিল্ড কন্ট্রোলারের সাথে কথা বলবে।

ইসটনেরও হবে না, গম্ভীর সুরে বললেন জেনারেল ফচ।

.

মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি, ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে করতে বলল নিয়াজ। চারদিকে তাকাল সে। কোথায় সবাই?

রডেনবার্গকে শোয়াতে গেছে। কি ঘটেছে সব নিয়াজকে শোনাল রানা। কেউ বোধহয় ধরতে পারেনি, আমাকে যাতে মারতে আসে সেজন্যে ইচ্ছে করেই খোঁচাই ওকে। বিপদের সময় উটকো ঝামেলা চাই না।

তুমি ভাবছ রাশিয়ানরা আসবে? টেবিলের ওপর রানার পারকার ওপর নিজেরটা রাখল নিয়াজ। বাইরে শালার বজ্জাতটা বাপের নাম ভুলিয়ে দেবে মনে হলো। ঠাণ্ডাকে গাল পাড়ল সে। খানিকপরই বিনয়কে রেহাই দিতে যাব।

ভাবছি না, জানি, বলল রানা। প্রশ্ন হলো আমরা চলে যাবার। আগে না পরে আসবে? যদি আগে হয়, সব ফাস করে দেয়ার। জন্যে দুর্বল একটা বোন থাকুক, চাই না। ইঙ্গিতে ভদকার বোতল দুটো দেখাল ও। মদের বিনিময়ে আগে থেকেই তথ্য পাচার করে। আসছে সে। রেডিও-রুমের কথা তার কাছ থেকেই জেনেছে ওরা।

রেডিও-রুমের কথা কারও কাছ থেকে জানতে হবে কেন? আকাশ-ছোঁয়া মাস্ট থাকতে?

ফ্লাস্ক থেকে দুটো কাপে কফি ঢালল রানা। রেডিও-রুমে কেউ শোয় না, এই তথ্য? কোন কোন বেসের রেডিও-রুমে অপারেটরের জন্যে একটা বাংক থাকে, এখানে তার দরকার হয়নি। শুধু ট্রান্সমিটার ব্যবহার করবার দরকার পড়লে ওখানে যেত জেমস। রানার হাত থেকে ধূমায়িত কফির কাপটা নিল নিয়াজ। টেবিলের ওপর পাশাপাশি লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা টিউব জোড়া নিয়াজকে দেখাল রানা। চিনতে পারো?

ওগুলোর একেকটার ভেতর পঁচিশ হাজার বছরের ইতিহাস পোরা আছে। একটা টিউব তুলে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখাল। নিয়াজ। ভাবতে আশ্চর্যই লাগে, ড্রিলের শেষ মাথায় আটকে দিয়ে এগুলোর ফাঁপা একটা দশ হাজার ফিট নিচে সাগরের তলায় নামিয়ে দেয়া হয়, উঠে আসে সী-কোর নমুনা নিয়ে। হাজার হাজার বছর ধরে মহাসাগরের ভীষণ চাপে জিয়োলজিক্যাল স্তর তৈরি হয়েছে। পঁচিশ হাজার বছর ধরে, অথচ তোমার পকেটে ভরে রাখতে পারো।

কৃতিত্বটা ইভেনকো রুস্তভের। দুটোর মধ্যে তফাৎটা কি ধরতে পারো?

দ্বিতীয় টিউবটাও পরীক্ষা করল নিয়াজ। দুটোর গায়েই মরচে ধরেছে। কোনটাই ফাপা নয়, ভেতরে কোর রয়েছে। শুধুই অতল তল থেকে তুলে আনা শাঁস, একটা বাক্সের ওপর ড. কর্ডনের সাজানো টিউবগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বলল সে, ওগুলোয় যা আছে, তাই।

দুটোর মধ্যে একটা ইভেনকোর, নিয়াজের হাত থেকে দ্বিতীয় টিউবটা নিয়ে বলল রানা। টিউবের একটা প্রান্ত পেন-নাইফ দিয়ে খোঁচাতে শুরু করল। তিন ইঞ্চি লম্বা নিরেট একটা কোরের টুকরো পড়ল তালুতে। টিউবটা ঝাঁকাতে শুরু করল ও, অপরপ্রান্তের কোর তাতে পড়ল না, যেমন ছিল তেমনি থাকল। কিছুক্ষণ আঁকাবার পর। হঠাৎ করেই রানার তালুতে চকচকে এবং শক্ত করে গোল পাকানো। কি যেন পড়ল আবার। উদ্ভাসিত হয়ে উঠল রানার মুখ। জিনিসটা। নিয়াজের চোখের সামনে, আলোর কাছাকাছি ধরল ও। থারটিফাইভ মিলিমিটার ফিল্মের একটা অংশ। যদি ভুল না হয়, আমার হাতে মেরিলিন চার্টের মাইক্রোফিল্ম দেখছ তুমি, নিয়াজ।

হরিবল!

আর্কটিকে রাশিয়ানদের গোটা আন্ডারওয়াটার সিস্টেমের। রেকর্ড, নিয়াজ। ফিল্মটা আবার গুটিয়ে নিল রানা। টিউবের ভেতর ঢুকিয়ে রেখে কোর দিয়ে বন্ধ করে দিল মুখ। যদিও, গলা খাদে নামিয়ে বলল ও, এটা নকল বলেই আমার ধারণা। রাশিয়ানরা জানে মেরিলিন চার্ট নিয়ে পালিয়ে আসবে ইভেনকো, নিশ্চয়ই আসলটা নিয়ে আসতে দেয়নি।

কিন্তু আমেরিকান বন্ধুরা এ-সব কথা জানে না, বলল নিয়াজ। এটাকেই তারা আসল বলে ধরে নেবে। কাজেই জিনিসটা আমাদের কাছে লুকানো থাকাই ভাল।

কে.জি.বি-র ওপর খুব একটা আস্থা আমার নেই, অন্যমনস্ক। দেখাল রানাকে। ধরো, ইভেনকো নিজের ইচ্ছায় এসেছেন। সেক্ষেত্রে কে.জি.বি. বা স্পেশাল সিকিউরিটি নকল মেরিলিন চার্ট চুরি করতে দেবে ইভেনকোকে। কিন্তু যদি এমন হয়, সে ব্যবস্থা। কোন কারণে করা হয়নি? যদি এমন হয়, আসল চার্টই আনতে পেরেছেন ইভেনকো?

রানা, তুমি কি ওটা এখুনি নষ্ট করে ফেলতে চাইছ?

দূর বোকা! হাসল রানা। নষ্ট করা মানে নিজেদের বিপদ ডেকে আনা। আমেরিকানদের বুঝ দেব কি দিয়ে? গলা আরও খাদে নামাল রানা, পাহারায় থাকছি আমি। ক্যামেরাটা কোথায়। রেখেছ?

পারকার পকেটে।

তাড়াতাড়ি সারবে, বলে দরজার দিকে এগোল রানা। একটা কপি আমাদের কাছেও থাকুক। কেউ আসছে দেখলে নক করব। কামরা থেকে বেরিয়ে গেল রানা,তার আগেই কাজে হাত দিয়েছে নিয়াজ।

কাজটা মাত্র শেষ করেছে নিয়াজ, বিস্ফোরিত হলো দরজা। ঘরে ঢুকল বিনয়। রাশিয়ানরা পৌঁছে গেছে! ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনেছি আমি!

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত