১.৭ যে-কোন সঙ্কটের পর
যে-কোন সঙ্কটের পর মানুষের মধ্যে সাধারণত একটা জড়তা আসে, নিয়াজের লাথি সেটাকে আসন গাড়তে দিল না। তার ওপর রানার ব্যস্ত তাগাদা তো আছেই। প্রথম সিকোরস্কি থেকে স্লেজ নামাতে হবে, কুকুরগুলোকে স্লেজের সাথে হারনেস দিয়ে বাঁধতে হবে, এলাকা ছেড়ে কুয়াশার ভেতর ঢুকে পড়তে হবে রাশিয়ান প্লেন এসে পড়ার আগেই।
রানা বলল, পনেরো মিনিটের মধ্যে কুয়াশার ভেতর হারিয়ে যেতে চাই আমরা।
সকৌতুক হাসি নিয়ে নিয়াজ বোধহয় আরেকবার ক্ষমা প্রার্থনা বা দুঃখ প্রকাশ করতে যাচ্ছিল, তার মুখের ওপর দড়াম করে কপ্টারের দরজা বন্ধ করে দিল লী রয়, ইঞ্জিন স্টার্ট দিল রিচার্ড ওয়েন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুটো স্লেজ টীম জোড়া লাগানো হলো, খোঁচা দিয়ে দাঁড় করানো হলো কুকুরগুলোকে হুকুম পেলেই ছুটবে এবার। সিকোরস্কি আকাশ থেকে ইতিমধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। ওটা চলে যাবার সাথে সাথেই ভারী কোন বস্তুর মত ওদের তিনজনের ওপর নেমে এল অশরীরী নির্জনতা, উত্তর মেরুর অটুট নিস্তব্ধতা বিস্ফোরণের মত বাজল কানে।
গ্রীনল্যান্ড থেকে একশো মাইল দূরে সম্পূর্ণ একা ওরা। জমাট সাগরে তিনজন মানুষ, আঠারোটা কুকুর, দুটো স্লেজ-সব মিলিয়ে বিশাল বরফ-রাজ্যে পিনের মাথার চেয়ে বেশি কিছু নয়। ওদের পায়ের নিচে বরফ সম্ভবত বারো ইঞ্চি পুরু, তবে কোথাও কোথাও। আধ বা সিকি ইঞ্চি পুরুও নয়। গোটা বরফ-রাজ্য, আর্কটিক, পানির ওপর ভাসছে। দেখে মনে হবে সব কিছুই স্থির হয়ে আছে, কিন্তু আসলে প্রতি মুহূর্তে বরফের সাথে ভেসে চলেছে ওরা। শক্তিশালী গ্রীনল্যান্ড কারেন্ট গোটা বরফ-রাজ্যকে টেনে নিয়ে চলেছে দক্ষিণ দিকে, আইসবার্গ অ্যালির দিকে প্রতিদিন দশ মাইল গতিতে। বরফের নিচে দশ হাজার ফিট গভীর সাগর। লিডিং টীমের দায়িত্ব বিনয়ের কাছ থেকে নিজে নিল রানা, বলল, আর দেরি নয়। কুয়াশার ভেতর না ঢোকা পর্যন্ত নিরাপদ নই। আমরা।
আমরা একটু অন্য জাতের মানুষ, সামনে থেকে সহাস্যে বলল নিয়াজ। চেষ্টা করছি কত তাড়াতাড়ি নরকে ঢোকা যায়।
হাসি চেপে রওনা হয়ে গেল রানা। শুরু করাটাই ঝামেলা। চাবুক খেয়েও নড়তে চায় না কুকুর, নির্মম ঠাণ্ডায় উঠতে চায় না নিজেদের পা। নিয়াজ কিছু বাড়িয়ে বলেনি, কালচে কুয়াশা আকাশ থেকে বরফ পর্যন্ত যেভাবে পাঁচিলের মত ঝুলে আছে, দেখে সত্যি। গায়ের রোম খাড়া হয়ে যায়। এ যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্ত, এরপর। কি আছে কেউ জানে না। বাতাস নেই, কিন্তু ঠাণ্ডা যেন অদৃশ্য গরল ঢেলে দিচ্ছে গায়ে। স্থির হয়ে আছে কুয়াশা।
স্থির কুয়াশার ভেতর কি ঘটছে কেউ জানে না। দৃষ্টি চললে দেখা যায় বরফ কোথায় ফাটছে, কোথায় চিড় ধরছে, বা কোথায়। দুপাশের চাপে মাথাচাড়া দিচ্ছে প্রেশার রিজ। কুয়াশার ভেতর। সে-সুযোগ নেই। অথচ ভাসমান বরফ কখন যে কি মূর্তি ধারণ করবে কেউ বলতে পারে না। অনেক সময় দেখা গেছে, কুয়াশার ভেতর গোটা স্লেজ টীম অকস্মাৎ ডুবে গেছে আর্কটিক সাগরে। নিমেষে। হয়তো সরাসরি একটা খাদের মধ্যে পড়েছিল, নয়তো ওখানটায় বরফের আবরণ নামমাত্র ছিল কি ছিল না।
কুকুরগুলোর ওপর নির্দয় না হয়ে উপায় থাকল না। কষে বার কয়েক চাবুক মারার পর হাঁটতে শুরু করল ওগুলো। তারপর ছুটল, তবে তার আগে আরও কিছু চাবুকের বাড়ি জুটল কপালে।
দ্বিতীয় স্লেজ চালাচ্ছে বিনয়, সবার কয়েক ফিট সামনে কম্পাস নিয়ে রয়েছে নিয়াজ। এরইমধ্যে নার্ভাস রোগে পেয়েছে। এটাকে, কম্পাসটা উঁচু করে দেখাল সে। অনেক সমস্যার একটা-দুনিয়ার এই অংশে বেঈমানী করার কুখ্যাতি রয়েছে। কম্পাসের।
স্লেজ চালানোটা বছর দুয়েক আগে বিনয়ের কাছ থেকেই শিখেছে রানা, এ-ব্যাপারে বিনয় তার ওস্তাদ। কিন্তু শিষ্যের সাথে তাল বজায় রেখে ছুটতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেল বিনয়। হয়তো রানাকে ভয় করছে কুকুরগুলো, কিংবা হয়তো ওগুলো তাকে পছন্দ করছে, কারণটা যাই হোক, ঝড়ের বেগে ছুটছে ডগ-টীম। বিনয়ের কুকুরগুলোর নেতার নাম, ওরই দেয়া, তুফান। প্রকাণ্ড, অসুরের শক্তি রাখে গায়ে, ওটাই বাকি কুকুরগুলোকে পথ দেখিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ সে হাঁক ছাড়ল, সমস্যা, রানা?
টীমকে দাঁড় করিয়ে, একদিকে মুখ ঘুরিয়ে রয়েছে রানা। চুপ। কি যেন শুনলাম।
অপেক্ষা করছে সবাই। কুকুরগুলো এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাপারটা কি। কোথাও কিছু নেই, না শব্দ, না নড়াচড়া-শুধু লক্ষ কোটি টন নিস্তব্ধতা চেপে বসছে ওদের ওপর। ফার পারকা আর ফার হুড়ে বিশাল দৈত্যের মত লাগছে রানাকে, চাঁদের আলোয় অটল একটা মূর্তি। মুখটা পুব দিকে ঘোরানো, খাড়া কান যেন রাডারের খুদে ডানা। কুয়াশার পর্দা কাছেই, মাত্র। কয়েকশো গজ সামনে, স্থির ধোঁয়ার মত ঝুলে আছে। আবার শব্দটা শুনতে পেল রানা, অস্পষ্ট রোটরের আওয়াজ বাড়ছে। কাছে চলে আসছে একটা হেলিকপ্টার।
আইলো রে, আইলো! নিয়াজের পা যেন বিদ্যুতের গতি পেল, কুয়াশার দিকে খিচে দৌড় দিল সে। কেউ হাসল না, নিয়াজের নিজের মুখও শুকিয়ে গেছে। কুয়াশার ভেতর…
ওরা দেখে ফেলার আগে…, সপাং করে চাবুক কষে। নিয়াজের কথাটা শেষ করল রানা।
বিপদ টের পেয়ে প্রাণপণে ছুটল কুকুরগুলো, ইঞ্জিনের আওয়াজ দ্রুত আরও কাছে চলে এল। আওয়াজটার দিকেই ছুটছে ওরা, ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে কুয়াশার ওপর দিকের শেষ প্রান্তে। কালো পর্দার মাথা থেকে যেকোন মুহূর্তে বেরিয়ে আসবে। রাশিয়ান হেলিকপ্টার। বিনয়ের লীডার কুকুর তুফান রানার পায়ের গোড়ালি লক্ষ্য করে লাফ দিচ্ছে, কিন্তু একবারও স্পর্শ করতে পারছে না, দুটো স্লেজ একই গতিতে ছুটছে। উঁচু-নিচু বরফ, যেকোন মুহূর্তে আঁকি খেয়ে স্লেজ থেকে পড়ে যেতে পারে রানা। সেরকম কিছু ঘটলে সাহায্য করবে বলে পিছিয়ে এসেছে নিয়াজ, রানার পাশে থেকে ছুটছে সে। দরকার হলে লাফ দিয়ে স্লেজে উঠে হ্যান্ডেলবার ধরবে।
হেলিকপ্টারের আওয়াজ, র্যাট-ট্যাট-ট্যাট, একেবারে কাছে চলে এল। সপাং সপাং চাবুক মারল রানা।
পাতলা বরফ! হুঙ্কার ছাড়ল নিয়াজ। সাথে সাথে তোবড়ানো বরফের দিক থেকে স্লেজ ঘুরিয়ে নিল রানা। ঢালটাকে পাশ কাটাবার সময় স্বচ্ছ বরফের পাতলা আবরণের নিচে কালচে পানি। দেখা গেল। হেলিকপ্টারের আওয়াজ ঘন ঘন ড্রাম পেটানোর মত শোনাল, তারমানে খুব নিচু দিয়ে উড়ে আসছে ওটা। সামনে পোর্ট সাইডে কাত হয়ে আছে বরফের বিস্তৃতি, স্নেজের গায়ে একটা কাঁধ ঠেকিয়ে উল্টে পড়া থেকে বাঁচাল নিয়াজ। বাধাটা না টপকে, ঘুর পথে পেরিয়ে এল বিনয়। কুয়াশার ভেতর ঢোকার মুহূর্তে রানার মনে হলো মাথার ওপর কি যেন দেখল সে। পরমুহূর্তে কালো কুয়াশা গ্রাস করল ওদেরকে। ওদের পিছু পিছু ভেতরে ঢুকল বিনয় আর তার স্লেজ।
ঘন অন্ধকার, আলোহীন রাত। মাত্র কয়েক ফিট দূরের কুকুরগুলোকেও পরিষ্কার দেখা গেল না। হ্যান্ডেলবার টেনে ওগুলোকে থামাল রানা। মুখ তুলে ওপর দিকে তাকাল ও। ইঞ্জিনের আওয়াজ সরাসরি ওপর থেকে আসছে।
নিশ্চয়ই রুশ, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল নিয়াজ। শত্রুবেশে পাকা দোস্ত অতিশয়!
রুটিন পেট্রল হতে পারে, বলল বিনয়। এন.পি. সেভেনটিন খুব বেশি দূরে নয়-কপ্টারের জন্যে। আমেরিকানরা কি করছে না করছে দেখার জন্যে প্রায়ই এদিকে আসে বলে শুনেছি।
আওয়াজটা নড়ছে না, সেই একই জায়গা থেকে আসছে। ওদের মনে হলো, পাইলট বোধহয় দলটাকে দেখতে পাচ্ছে। অথচ তা সম্ভব নয়।
খানিক পর সরে গেল শব্দটা, কিন্তু আবার ফিরে এল। চক্কর দিচ্ছে ওরা, বলল রানা।
তবু রুটিন হতে পারে, বলল বিনয়। অথবা ইভেনকো রুস্তভকে খুঁজতে বেরিয়েছে।
ফিসফিস করে কথা বলছে ওরা, অথচ তার কোন দরকার নেই।
কিংবা আমাকে, শান্ত গলায় বলল রানা।
ওটাকে যদি কর্নেল বলটুয়েভ পাঠিয়ে থাকে, কণ্ঠস্বরে কৃত্রিম। উল্লাসের সুর ফুটিয়ে তুলে বলল বিনয়, তাহলে আমি বাজি ধরে। বলতে পারি, তোমাকেই খুঁজছে ওরা, রানা। সেক্ষেত্রে আমার বা নিয়াজের ভয় পাবার কোন কারণ নেই। কর্নেলের যত রাগ একা। তোমার ওপর।
হাচা কথা কইছ, সোনার চান, ভেংচি কাটল নিয়াজ। পরমুহূর্তে গম্ভীর দেখাল তাকে। রানাকে যদি স্পেশাল সিকিউরিটি খুন করে, নিশ্চয়ই ওরা কোন সাক্ষী রাখবে না।
হেসে উঠল বিনয়। তবু ভাগ্যকে ধন্যবাদ যে, মাত্র দুচার সেকেন্ড হলেও রানার চেয়ে আমাদের আয়ু বেশি।
ওদের কথা শুনছে না রানা। ইঞ্জিনের আওয়াজের দিকে। মনোযোগ। পনেরোটা সাবমেরিন কিলার…
এন.পি. সেভেনটিন। ঘরগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে প্রকাণ্ড ভালুকের মত ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে কর্নেল বলটুয়েভ। চাঁদের আলোয় পথ চিনে শেষ হেলিকপ্টারটা নেমে এল। পেট ফোলা কাকের মত দেখতে একেকটা, সবগুলো এক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সোভিয়েত কপ্টার ক্যারিয়ার নার্ভা থেকে এল ওগুলো। প্রত্যেকটা সাবমেরিন কিলারের ভেতর সোনার ডিভাইস আছে, একজোড়া চাকার ওপর বসানো।
আমি চাই, আবার বলল কর্নেল, আধ ঘণ্টার মধ্যে আবার আকাশে উঠুক ওগুলো। ইভেনকোকে না পাওয়া পর্যন্ত নামা চলবে না। শুধু রিফুয়েলিং দরকার হলে ফিরে আসবে।
কিন্তু, কর্নেল কমরেড, প্রতিটি কপ্টারের জন্যে মাত্র একজন করে পাইলট…, জুনায়েভ মিনমিন করে শুরু করল।
তাকে থামিয়ে দিয়ে বরফে পা ঠুকল কর্নেল। যথেষ্ট।
পাইলটদের কি বলব যে মাসুদ রানা…
হ্যাঁ, দেখামাত্র। তবে কোন সাক্ষী রাখা চলবে না।
ত্রিশ মিনিট পর এক এক করে আকাশে উঠে গেল পনেরোটা সাবমেরিন কিলার। কুয়াশার ভেতর ঢোকার সময় এগুলোরই একটার আওয়াজ শুনেছিল রানা। ও জানে না, কুয়াশা ভেতর ঢোকার আগের মুহূর্তে টেলিফটো লেন্সের সাহায্যে ফটো তোলা হয়েছে ওদের।
.
প্রতি মুহূর্তে জীবন হারাবার ঝুঁকি থাকলেও, কুয়াশার ভেতর প্রথম কয়েক ঘণ্টা কিছুই ঘটল না। কোন দিকে যাচ্ছে ওরা বোঝার উপায় নেই, অন্য কোন পরিস্থিতিতে দলটাকে থামার নির্দেশ দিত রানা, কুয়াশা সরে না যাওয়া পর্যন্ত ক্যাম্প ফেলে অপেক্ষা করত। কিন্তু বাতাস না থাকায় কুয়াশার ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না, তাছাড়া হাতে সময়ও কম। পিছনে দল নিয়ে এগিয়ে চলল রানা, স্লেজের সামনে বেশিরভাগ সময় শুধু সর্দার কুকুরটাকে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। ওটা অদৃশ্য হলে সাবধানে সামনে এগোচ্ছে নিয়াজ, বরফ পরীক্ষা করে সঙ্কেত দিচ্ছে রানাকে।
সিকোরস্কি থেকে নামার পর সেক্সট্যান্টের সাহায্যে তারাগুলোর অবস্থান জেনে নিয়েছিল নিয়াজ, তার হিসেবে যদি। মারাত্মক কোন ভুল না থাকে, সিকোরস্কি থেকে মাত্র কয়েক মাইল পুবে গেলেই আই.আই.ফাইভে ওদের পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু শীতের সময় আর্কটিকে কোন হিসেবই নিখুঁত হতে পারে না। নিয়াজ যাই বলুক, রানার মনে সন্দেহ থেকেই গেছে।
উদ্বেগ আর উত্তেজনা হঠাৎ করেই দেখা দিল। কুয়াশা পাতলা। হতে শুরু করেছে, নতুন করে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শোনা। গেল। আচমকা চাঁদের আলো হেসে উঠল, মাথার ওপর থেকে ভেসে সরে যেতে লাগল কুয়াশা। কপ্টারও সেই সাথে কাছে চলে। এল। হল্ট! স্লেজের হ্যান্ডেলবার কষে টেনে ধরল রানা। চেষ্টা করো কুকুরগুলো যেন নড়াচড়া না করে। নিয়াজ, হ্যান্ডেলবার ধরো। হ্যান্ডেলবারের সাথে আটকানো কেস থেকে নাইটগ্লাস বের করে স্লেজের কাছ থেকে কয়েক গজ হেঁটে এল ও, মাথার ওপর কুয়াশার পর্দায় বড় একটা গর্ত তৈরি হচ্ছে। এই মুহূর্তে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না, তবে চাদের আলো রয়েছে আশপাশে। চোখে নাইটগ্লাস তুলল ও। গর্তের কিনারায় দেখা গেল হেলিকপ্টার, খুব নিচ দিয়ে ঝাপসা একটা ফড়িং আকৃতির ছায়া সরে গেল দ্রুত।
খুব কম সময় পেল রানা, রাশিয়ান কিনা চিনতে পারল না। পরমুহূর্তে আরও একটা কপ্টারের আওয়াজ ভেসে এল। এবার তৈরি ছিল ও, আগেরটার মত একই কোর্সে এগিয়ে গেল দ্বিতীয়টাও, জেড-পড আর পাইলটের হেলমেট আবছাভাবে ধরা পড়ল লেন্সে। সাবমেরিন কিলার, স্নেজের কাছে ফিরে এসে নিয়াজকে বলল ও। দূরে ওদিকে আরও একটা রয়েছে।
অভ্যর্থনা কমিটি আর কি, বলল নিয়াজ। কুয়াশার সবগুলো কিনারায় নজর রাখছে।
লক্ষণটা একদিক থেকে শুভই বলতে হয়, স্লেজের দায়িত্ব। নিয়ে বলল রানা। জেনারেল ফচের ধারণাই ঠিক বোধহয়, ইভেনকো রওনা হয়ে গেছে। একসাথে এতগুলো সোভিয়েত মেশিন এদিকে কখনও আসে বলে শুনিনি।
শুভ বৈকি, কৌতুকপ্রিয় নিয়াজ মন্তব্য করল, যদি আমাদেরকে খুঁজতে বেরিয়ে থাকে।
আবার শুরু হলো এগোনো। প্রায়ই মাথার ওপর কাছাকাছি চলে এল হেলিকপ্টার, তবে কুয়াশার পর্দা আবার জোড়া লেগে যাওয়ায় দেখে ফেলার ভয় থাকল না। কুয়াশা না থাকলে বিপদে পড়ত ওরা, কুয়াশা থাকাতেও বিপদের ঝুঁকি কম নয়। পায়ের নিচে বরফ ভেঙে গেছে, কোথাও ফুলে উঠে খুদে ঢিবির আকার নিয়েছে, কোথাও ফাটল ধরেছে, আবার কোথাও দেবে গেছে। নিচের দিকে। প্রতি মুহূর্তে মনে হলো এই বুঝি উল্টে গেল স্লেজ। অস্থির হ্যান্ডেলবারটাকে ধরে রাখতে গিয়ে ব্যথায় টনটন করতে লাগল রানার হাত। একই ভোগান্তির শিকার হলো বিনয়, তবে নিয়াজকে আরও কঠিন পরীক্ষা দিতে হলো। কুয়াশা যখন অন্ধকার রাতের মত গাঢ়, স্লেজের আগে থাকতে হলো তাকে। প্রতিবার সামনে পা ফেলার আগে ইহলোক থেকে বিদায় নিল মনে মনে, হে ডিক্টেটর, ভুল আর পাপ যা করেছি সব তুমি মাপ করে দিয়ো…। জানে, বরফের আবরণ যেখানে ভেঙে গেছে সেখানে একবার পা পড়লেই দশ হাজার ফিট নিচে গিয়ে থামবে ওর কঙ্কাল।
সত্যিকার বিপদ হত সময়টা যদি হত গরমকাল। তখন ফ্রিজিং পয়েন্টে বা দুএক ডিগ্রী ওপর দিকে থাকত টেমপারেচার। বেশিরভাগ জায়গাতেই বরফের কোন আবরণ থাকত না। তারপর। যদি এরকম কুয়াশা থাকত, স্লেজ নিয়ে বেরুতে হত না-বেরুলে পাইকারী আত্মহত্যা হত সেটা। চলতি ফেব্রুয়ারিতে ফ্রিজিং পয়েন্টের চেয়ে চল্লিশ ডিগ্রী নিচে রয়েছে টেম্পারেচার, এক কথায় পৈশাচিক নির্যাতন ভোগ করছে ওরা। লম্বা উলেন আন্ডারঅয়্যার পরে আছে সবাই, ফার দিয়ে কিনারা মোড়া বুটের ভেতর দুজোড়া। করে মোজা, একজোড়া করে উলেন পুলওভার, কিনারায় ফার লাগানো জ্যাকেট, তার ওপর রয়েছে উলফস্কিন পারকা। তবু জমে বরফ হবার মত অবস্থা সবার। হাত আর পায়ে কোন সাড়া নেই। হুডের বাইরে মুখের সামান্য যেটুকু বেরিয়ে আছে, অসহ্য ব্যথা।
পাঁচ ঘণ্টা পর প্রথম যাত্রাবিরতি। কুকুরগুলো আটচল্লিশ ঘণ্টায় মাত্র একবার খায়, শুধু ওরা তিনজন স্লেজে বসেই শুকনো মাংস খেয়ে নিল। মুখরা রমণী-যত দূরেই যাও তুমি, তার ঘ্যানর। ঘ্যানর ঠিকই শুনতে পাবে, খেতে খেতে মন্তব্য করল নিয়াজ।
রুশ হেলিকপ্টারগুলোর কথা বলছে ও। কখনও কাছে, কখনও দূরে, আওয়াজ আসছেই। ঠিক যেন বেহায়া মাথাব্যথার মত, ছাড়ে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে উঠল বিনয়ের। অনেকক্ষণ থেকে মনে হচ্ছে একটাই রয়েছে এদিকে, বলল সে। ভেঙে পড়ছে না কেন? ফুয়েল শেষ হলেও বাঁচতাম।
উঁহু, মাথা নাড়ল রানা। এন.পি. সেভেনটিন থেকে ফুয়েল নেবে ওরা।
হারে, বিনয়, হঠাৎ প্রায় আঁতকে উঠে বলল নিয়াজ। শেষ পর্যন্ত তুই জাত খোয়ালি, আঁ?
বিষম খাওয়ার অবস্থা হলো বিনয়ের। কেন, কি হয়েছে?
গলায় দড়ি দে, শালা, তীব্র ভৎসনার সুরে বলল নিয়াজ। না, দাঁড়া, গলায় দড়ি দিলেও বিপদ, কাঠ কই যে তোকে পোড়াব? ঠিক আছে দড়ি নয়, তুই বরং গলায় আঙুল দে।
উঠে দাঁড়াল বিনয়, ঘুসি বাগিয়ে এগিয়ে এল। কি হয়েছে বলবি, না…?
লে বাবা, ভাল করতে চাইলে ভূতে কিলায়, আহত সুরে বলল নিয়াজ। জাত বাঁচাতে চাইলে যা বলছি তাড়াতাড়ি কর-গলায় আঙুল দিয়ে বমি কর। তুমি বস গোমাংস ভক্ষণ করিয়াছ!
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে দাঁড়াল বিনয়, তারপর ঝট করে রানার দিকে ফিরল।
রানা গম্ভীর। বলল, ইয়ে, মানে, বমি আসলে নিয়াজেরই করা উচিত।
বিনয় আর নিয়াজ একযোগে জানতে চাইল, কেন, কেন?
গরুর মাংস নয়, ক্যানে ওটা শুয়োরের মাংস ছিল। নির্লিপ্ত দেখাল রানাকে। খুব সম্ভব আমেরিকানরা ইচ্ছে করে শয়তানীটা করেছে। দেখছ না, ক্যানের গায়ে কোন লেবেল নেই, আগেই ছিড়ে ফেলে দিয়েছে।
বিনয়ের মুখে হাসি আর ধরে না। নিয়াজকে বলল, দুঃখিত, দোস্ত। ব্যাপারটা তোর জন্যে বুমেরাং…
নিয়াজ সে-কথায় কান না দিয়ে রানাকে জিজ্ঞেস করল, তারমানে তুমিও হারাম…?
দাঁত দিয়ে জিভ কাটল রানা। তওবা! ছাগল।
মানে? ছাগলের মাংস খেয়েছ, নাকি গাল দিচ্ছ? মুখ বেজার। করে জিজ্ঞেস করল নিয়াজ।
খেয়েছি।
কি করে বুঝলে?
স্বাদে আর গন্ধে, বলল রানা। দেখোনি, আলাদা একটা ক্যান খুলে খেলাম!
একসাথে তিনজনই হেসে উঠল ওরা, কারণ খোলা হয়েছিল। একটাই ক্যান।
চুপ! হঠাৎ ঠোঁটে আঙুল রাখল রানা।
ব্যাপারটা আগে থেকেই ঘটছে, কিন্তু হেলিকপ্টারের আওয়াজে শোনা যায়নি। খাওয়া শেষ করার পরপরই নিয়াজের কাছে থেকে কম্পাসটা চেয়ে নিয়েছিল রানা, রসিকতার ফাঁকে কাঁটাটা সিধে করার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ করেই চক্কর দেয়া বন্ধ করে পুব দিকে চলে গেল কপ্টার। দাঁড়িয়ে পড়ল রানা, হাতে। কম্পাস, তাকিয়ে আছে দূরে। কোথাও কোন শব্দ নেই, জমাট। বেঁধে আছে নিস্তব্ধতা, তবু আর কেউ শুনতে পেল না আওয়াজটা শুধু রানা বাদে। অস্পষ্ট একটা আওয়াজ, শুনতে। পাবার কথা নয়। মৃদু পানির কলকল।
এখুনি ফিরে আসব, শান্ত গলায় বলল রানা। যাই ঘটুক না কেন, কেউ এখান থেকে নড়বে না।
পাঁচ মিনিট পর ফিরে এল রানা। কি ঘটছে বাকি দুজন কিছুই জানে না। নড়তে নিষেধ করায় বিনয় মনে করল, রানা ভয় করছে। কুয়াশায় পথ হারিয়ে ফেলবে ওরা। ফিরে এসে রানা দেখল। স্লেজের পিছনে দাঁড়িয়ে তৈরি হয়ে আছে সে, নির্দেশ পেলেই রওনা হয়ে যাবে। নিয়াজের হাতে কম্পাসটা ধরিয়ে দিল রানা। আপাতত এটা তোমার কোন কাজে আসছে না। আমরা কোথাও যাচ্ছি না। ছোট একটা বরফের টুকরোর ওপর রয়েছি, আইসফিল্ড থেকে দূরে সরে যাচ্ছে টুকরোটা…
তা কি করে হয়! স্তম্ভিত বিস্ময়ে বলল নিয়াজ। বরফ ভাঙলে বোমা ফাটার আওয়াজ হবার কথা!
বোমা ফাটার আওয়াজ হতে হবে তার কোন মানে নেই, বলল রানা। তবে আওয়াজ ঠিকই হয়েছে, কপ্টারগুলো যখন কাছাকাছি ছিল-তাই শোনা যায়নি। হাত নেড়ে চারদিকটা দেখাল ও। যেদিকেই হাঁটো, ত্রিশ গজ এগোলে পানিতে পড়বে। আমরা পোলার প্যাকে নেই আর-সাগরে রয়েছি।
.
সম্ভাব্য বিপদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপটা ঘটে গেছে। বিশাল আইসফিল্ড দুফাঁক হয়ে গেছে, বরফের আবরণ ভেঙে বেরিয়ে এসেছে সাগর, চওড়ায় সেটা কয়েক মাইলও হতে পারে। কখনও বাতাস, আবার কখনও বরফের তলায় বিরতিহীন স্রোত ফাটল ধরিয়ে দেয় আইসফিল্ডে। ওদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, উন্মোচিত খালের দুভাগের কোন এক ভাগে ছিল না ওরা, ছিল মাঝখানের ছোট্ট একটা বরফ টুকরোর ওপর। খালটা যদি সাগরের সাথে মিশে না থাকে, আগে বা পরে এই ফঁাক আবার জোড়া লাগবে। জোড়া যদি না লাগে, ভাসতে ভাসতে মহাসাগরে গিয়ে পড়বে ওা, তখন নিপ্রাণ কঠিন মূর্তিতে পরিণত হওয়াটাকে ভাগ্যের একমাত্র লিখন বলে ধরে নিতে হবে।
দুপাশ থেকে বিশাল আইসফিল্ড জোড়া লাগার জন্যে এগিয়ে আসছে, সেটাই রানার উদ্বেগের কারণ। দুই কিনারা আস্তে-ধীরে। এগিয়ে এসে পরস্পরের সাথে মিলবে, ব্যাপারটা সেভাবে ঘটে না। দ্রুতগামী দুটো ট্রেন মুখোমুখি ধাক্কা খেলে যা হয়, তারচেয়ে শতগুণ ভয়ঙ্কর হবে এই পুনর্মিলন। সংঘর্ষের আওয়াজ বহু মাইল। দূর থেকে শোনা যাবে, যেন একসাথে গর্জে উঠবে এক হাজার। কামান। ফুলে-ফেঁপে উঠবে বরফ, চোখের পলকে তৈরি হবে। গতিশীল প্রেশার রিজ, একেকটা ত্রিশ গজ বা তারও বেশি উঁচু। হয়ে উঠবে, তারপর চূড়া থেকে পাথর-বৃষ্টির মত ঝরে পড়বে আলগা বরফের শত সহস্র ভারী চাই। আইসফিল্ড যখন জোড়া। লাগবে, মাঝখানের টুকরোটার অবস্থা কি হবে? স্রেফ কাগজের। মত চ্যাপ্টা হয়ে যাবে দুপাশের চাপে। সেজন্যেই ওদেরকে প্রতি মুহূর্ত সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে রানা।
এ-ধরনের প্রাকৃতিক বিপদ ঠেকাবার ক্ষমতা মানুষের নেই,। বিপদ এসে পড়লে করারও কারও কিছু থাকে না। তবু দুঃসাহসী। অভিযাত্রীরা কখনোই হতাশায় মুষড়ে পড়ে না, করার কিছু না থাকলেও সতর্ক থেকে বিপদের আকার-আকৃতি চাক্ষুষ করার জন্যে তৈরি হয়। খুদে বরফ টুকরোর দুই কিনারায় পাহারা বসাল। রানা, এক প্রান্তে বিনয়কে, আরেক প্রান্তে নিয়াজকে। একটা স্লেজের সাথে দুই প্রস্থ রশি বাঁধা হলো, রশির শেষ প্রান্ত দুটো থাকল নিয়াজ আর বিনয়ের কাছে। আইসফিল্ড কাছে চলে আসছে। দেখলে কুয়াশার ভেতর দিয়ে পথ চিনে তাড়াতাড়ি স্লেজের কাছে। ফিরে আসতে পারবে ওরা।
দুজনকে পাহারায় পাঠিয়ে দিয়ে কুকুরগুলোকে খাওয়াতে বসল রানা। ক্যান থেকে মাংস বের করে ছুঁড়ে দিল, শান্তভাবে খেতে শুরু করল ওগুলো। সময় হয়নি, তবু সামনে বিপদ টের পেয়ে আগেভাগে পেট ভরে নিতে আপত্তি করল না কেউ।
খুদে দ্বীপ ওদেরকে বুকে নিয়ে মন্থরগতিতে ভেসে চলেছে। খোলা সাগরের দিকে কিনা জানার উপায় নেই। ওরা যে ভাসছে, বা ভাসতে ভাসতে এগোচ্ছে, সেরকম কোন অনুভূতি হলো না। আজ রাতে বাতাস নেই। তবে জানা কথা স্রোতের টানে সমান গতিতে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলেছে টুকরোটা, আই.আই.ফাইভের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে আসছে ওরা।
বরফের কিনারায় বসে সামনেটা দেখার চেষ্টা করছে বিনয়। ঘন কুয়াশা, কি ছাই দেখবে। ছয় ফিট, ব্যস, তার বেশি দৃষ্টি চলে না। চারদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। কুয়াশা ভেদ করে আইসফিল্ড আসবে চলমান প্ল্যাটফর্মের মত, একেবারে হঠাৎ করে। কঠিন, ইস্পাতের মত শক্ত হবে তার কিনারা। হয়তো তার আগে আগে আসবে ছোট ছোট কিছু ঢেউ। পানি লাফিয়ে উঠে বুট ছুঁলেই বুঝতে হবে, এসে গেছে।
কুয়াশার সামনে কালো পানি যেন পানি নয়, ভেসে থাকা তেল। ফ্রিজিং পয়েন্ট থেকে প্রায় পঞ্চাশ ডিগ্রী নিচে টেমপারেচার। প্রতি মুহূর্তে জমে বরফ হয়ে যেতে চাইছে পানি, বরফের নতুন আবরণ সৃষ্টি হতে চাইছে কিন্তু বাধা দিচ্ছে স্রোতের অব্যাহত ধারা। পিছন দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়াল বিনয়, কালচে বাষ্পের মত কুয়াশা ছাড়া দেখল না কিছু। সন্দেহ হলো, রানা, নিয়াজ, স্লেজ, কুকুর-সব আছে তো? নাকি টুকরোটার ওপর একা ভাসছে সে? আশ্চর্য নির্জন লাগল পরিবেশটা, গোটা পৃথিবীতে যেন সে। একা বেঁচে আছে।
গা শিরশির করে উঠল। কিছুই অসম্ভব নয়। ছোট টুকরোটা হয়তো আবার মাঝখান থেকে দুভাগ হয়ে গেছে—এক ভাগে সে। একা, আরেক ভাগে ওরা। ওদের নতুন টুকরোটা হয়তো আকারে। ছোট, স্রোতের টানে দ্রুত এগিয়ে গেছে, পিছিয়ে পড়েছে তারটা। চিৎকার করে রানাকে ডাকতে ইচ্ছে হলো তার। অনেক কষ্টে সামলে রাখল নিজেকে। ও ভয় পেয়েছে জানতে পারলে হেসে কুটি কুটি হবে নিয়াজ। লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। আর রানা? দুঃখ। পাবে সে। বিনয় মুখার্জি অসমসাহসী যুবক, এ-কথা জানে বলেই এই অভিযানে নিয়েছে সে তাকে। নির্বাচনে ভুল হয়েছে বুঝতে। পারলে দুঃখ তো পাবেই।
কাজে মন দিল বিনয়, ভয় তাড়াবার সবচেয়ে ভাল উপায়। কাজ বলতে কান দুটোকে খাড়া করে রাখা। ওদের এই টুকরোটা যদি ভাঙতে শুরু করে, ক্ষীণ একটু হলেও আওয়াজ হবে। টুকরোটা খুব যদি পাতলা হয়, সে-আওয়াজ নাও শোনা যেতে পারে। মুশকিল হলো, কতটা পাতলা ওরা জানে না। বরফের কিনারায় হামাগুড়ি দেয়ার ভঙ্গিতে নিচু হলো সে, যেন তৃষ্ণার্ত। কোন পশু নদীতে মুখ দিয়ে পানি খেতে চাইছে। কুয়াশার ভেতর। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকল সে। বুটের ভেতর পা ব্যথা করছে, অসাড় হয়ে গেছে হাত। শুধু মৃত্যুভয় সজাগ রাখছে ওকে।
আওয়াজটা হঠাৎ করেই এল।
কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়াল বিনয়, উত্তেজনায় ইস্পাত হয়ে গেছে। পেশী। সত্যি একা হয়ে গেছে সে। ভেঙে আলাদা হয়ে গেছে টুকরোটা। চারদিকের যেদিকেই দুপা এগোবে, ঝপ করে পড়তে হবে কালো পানিতে। তিন মিনিটের মধ্যে ভবলীলা সাঙ্গ। আতঙ্কিত হয়ে ঝট করে ঘুরল সে। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করল, বাঁচার কোন না কোন উপায় বেরুবেই। অন্তত নিয়াজ আর রানা তাকে…
টান পড়ল রশিতে। ওটার কথা ভুলেই গিয়েছিল সে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন। জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখছিল সে। বরফের টুকরো ভাঙেনি, এখনও ওরা একসাথেই আছে। ধীরে ধীরে নিচু হলো সে, বরফের ওপর বসল। বুটের চাপ লেগে বরফ ভাঙার শব্দ হলো, ঠিক এই শব্দই খানিক আগে শুনেছিল সে। আতঙ্ক কেটে যাওয়ায় দুর্বল আর বোকা লাগল নিজেকে।
বোধহয় ঘণ্টাখানেক হলো ভেসে চলেছে ওরা। ক্লান্তি লাগছে।
আরও চব্বিশ ঘণ্টা পর জোড়া লাগল আইসফিল্ড।
.
রানার ঘড়িতে রাত সাড়ে দশটা। টলমল করছে বরফের টুকরো, ঘুরছে উল্টোমুখী একটা স্রোতের মধ্যে পড়ে গেছে। পুব দিকে পাতলা হচ্ছে কুয়াশা। ঝটু করে দাঁড়িয়ে পড়ল নিয়াজ। ওদিকটা যেন পরিষ্কার লাগছে, হাত তুলে দেখাল সে। সৌভাগ্য, তুমি আরেকবার আসিয়া, যাও মোরে হাসাইয়া…, রানার দিকে ফিরল সে। রানা, এবার বোধহয় কিছু একটা দেখতে পাব, কি বলো?
এখনই দেখতে পাচ্ছি আমি, গম্ভীর সুরে বলল রানা। তীর বলে মনে হচ্ছে।
শব্দটা নিজের অজান্তেই ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল। ঝাপসা রেখা যেটা দেখতে পাচ্ছে, বরফের কিনারা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। নাকি রেখাটা ওর কল্পনা, দৃষ্টিভ্রম? কুয়াশার দিকে। একটানা অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নানা ধরনের কৌতুক শুরু করে দেয় দৃষ্টি-গাছপালা, পাহাড়, আরও সব অসম্ভব বস্তু দেখিয়ে। তামাশা করে। চোখ বন্ধ করে আবার খুলল রানা। দ্রুত পাতলা। হয়ে আসছে কুয়াশা, ফাঁক পেয়ে চাদের আলো অনেক নিচে নেমে আসার সুযোগ পাচ্ছে। হ্যাঁ, রেখাটা ঝাপসা হলেও আছে এখনও। কিন্তু ওটা কি স্থির কিছু? স্রোতের ধারা বদলে যাওয়ায় ওরা কি ধীরে ধীরে স্থির আইসফিল্ডের দিকে এগোচ্ছে?
নিয়াজের গলা তিক্ত শোনাল, মনে হচ্ছে এদিকেই আসছে। ওটা।
পানির ওদিকে সিকি মাইল বা তারও কম দূরে ওটা, সাদা একটা প্ল্যাটফর্ম–দেখতে মহাদেশের কিনারার মত। কিনারার সামনে ছায়া ছায়া ভজ, সম্ভবত ছোট ছোট ঢেউ। পশ্চিম দিকে, ওদের দিকে আসছে। নিয়াজ, চোখ রাখো। বিনয়কে বলি আমি।
রশি ধরেই এগোল রানা, যদিও তার কোন দরকার নেই আর। কুয়াশা যথেষ্ট পাতলা হয়ে এসেছে। খুদে দ্বীপের অপর প্রান্তে ঝাপসা মূর্তির মত দেখা গেল বিনয়কে। দ্বীপের কিনারা থেকে। কয়েকশো গজ দৃষ্টি চলে, তারপর আবার ঘন কুয়াশার পর্দা। ওদিক থেকে আইসফিল্ড এগিয়ে আসছে, বিনয়।
বিপদ?
বিপদ। কুকুরগুলো অস্থির হয়ে উঠেছে, পারলে যেন এখুনি লাফ দেয়। তুমি বরং এখানেই থাকো। কিছু যদি ঘটে, ডাক। পেলেই ঝেড়ে দৌড় দেবে।
কিছু যদি ঘটে…তারমানে, রানার সন্দেহ, একদিক থেকে নয়, দুদিক থেকে এগিয়ে আসছে আইসফিল্ড। টুকরোটার মতিগতি ভাল ঠেকছে না ওর। ধীরে ধীরে ঘুরছে, তারমানে একাধিক স্রোতের পাল্লায় পড়েছে। কুকুরগুলোর সাথে খানিকক্ষণ কাটিয়ে নিয়াজের কাছে ফিরে এল রানা।
ঢেউগুলো দেখো, বলল নিয়াজ।
কাছে চলে আসায় ছায়া ছায়া ভাঁজগুলোকে এখন পরিষ্কার ঢেউ বলে চেনা যাচ্ছে। এখনও ছোট দেখাচ্ছে ওগুলোকে, তবে ওগুলোর পিছনে যে লক্ষ কোটি টন পোলার প্যাকের ধাক্কা কাজ করছে সেটা পরিষ্কার। আরও পাতলা হয়েছে কুয়াশা, কিন্তু আইসফিল্ডের আরও সামনে দৃষ্টি চলে না। সাদা প্ল্যাটফর্মটাকে গোটা একটা উপকূল মনে হলো, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। বরফের উঁচু পাহাড় আর জমাট প্রেশার রিজ।
রানা…!
বিনয়ের চিৎকারে ঝট করে ঘুরল রানা। একটা, মাত্র একটা ঢেউ ওদের খুদে দ্বীপের কিনারা টপকে উঠে এল। পিছন দিকে, বিনয়ের পায়ের কাছে। আরও সামনে তাকাল রানা-আইসফিল্ডের আরেক চোয়াল এগিয়ে আসছে মৃদুগতিতে। ঠিক এই ভয়ই করেছিল ও। চলে এসো! ওর চিঙ্কার শুনে দৌড় দিল বিনয়। আধ পাক ঘুরে পুব দিকে তাকাল রানা। প্রলয় ঠেকানো সম্ভব নয়, সাথে সাথে উপলব্ধি করল ও। আইসফিল্ডের পশ্চিম চোয়াল প্রথম কামড় বসাবে, তারপরই ওরা পুব চোয়ালের নাগালের মধ্যে পড়ে যাবে।
সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে এক সেকেন্ডও অনেক বেশি সময় এখন। রানা ঠিক করল, পুব দিকের আইসফিল্ডে যেতে পারলে ভাল হয়। কুকুরগুলোকে সামলাও, নিয়াজ! পিছনে একটা শব্দ হলো, ঘাড় ফেরাতেই দেখল ঢেউগুলো দ্বীপের গায়ে ভাঙছে,। কালচে পানিতে ভেসে যাচ্ছে বরফ। বিনয়ের বুট ডুবে গেছে। এরইমধ্যে। কাছে পৌঁছুবার আগেই ওরা দেখল, কুকুরগুলোর পা ডুবে গেছে, ক্যাঙ্গারুর মত লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে ওগুলো, হারনেস টেনে ধরেও শান্ত করা যাচ্ছে না।
পিছনের ফিল্ড ঠেলে নিয়ে যাবে…, চেঁচিয়ে বলল রানা।
নিজের স্নেজের দায়িত্ব নিয়ে কুকুরগুলোকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে বিনয়। দ্বিতীয় স্লেজের হ্যান্ডেলবার ধরেছে রানা এক। হাতে, আরেক হাতে চাবুক। ওদের চারপাশে কলকল করে বয়ে। যাচ্ছে পানির স্রোত। পায়ের নিচে বরফ থাকলেও দেখা যাচ্ছে না, মনে হলো সাগরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। কুকুরগুলো ভাবল ডুবে যাচ্ছে তারা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটতেও হয়তো তাই যাচ্ছে। নির্ভর করে যে বরফে ওরা দাঁড়িয়ে আছে সেটা কতটুকু পুরু, কতটুকু তার সহ্যক্ষমতা। পিছন থেকে যে বিশাল বরফ প্রান্তর এগিয়ে আসছে সেটা যদি টুকরোটার কোন দুর্বল জায়গায় প্রথম ধাক্কাটা মারে, নিমেষে দুটুকরো বা সহস্র টুকরো হয়ে যেতে। পারে। অথবা একপলকে একরাশ পাউডার হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে চারদিকে। পানিতে পড়ে ঠাণ্ডায় জমে বরফ হবার সুযোগও মিলবে না, দুই আইসফিল্ডের চাপে…
পুব চোয়াল এখনও একশো গজ দূরে, ঢেউগুলো ওদের কাছে। এসে পৌঁছায়নি, এই সময় সংঘর্ষ ঘটল-যাকে বলে রাম ধাক্কা, ওদের নিচে কেঁপে উঠল বরফ। বিকট আতঙ্কে স্থির হয়ে গেল কুকুরগুলো। তীব্র স্রোত বয়ে গেল খুদে দ্বীপের ওপর দিয়ে, নিচু আর তোবড়ানো জায়গাগুলোয় পানি রেখে গেল। এতক্ষণে অনুভব করল ওরা, বরফের ভেলা ভেসে চলেছে। এক আইসফিল্ড সেটাকে ঠেলে নিয়ে চলেছে আরেক আইসফিল্ডের দিকে। ঘাড় ফেরাল রানা, পিছনের এগিয়ে আসা আইসফিল্ডের কিনারা ওদের ভেলার চেয়ে ফিটখানেক বেশি হবে উঁচু, প্রকাণ্ড একটা ধাপের মত। ওদিকের কিনারায়! ওর কণ্ঠস্বর বিস্ফোরিত হলো।
নির্দয় হয়ে উঠল বিনয় আর রানা। সপাং সপাং চাবুকের বাড়ি খেয়ে খেপে উঠল কুকুরগুলো। প্রায় উড়ে চলল স্নেজরথ। কিনারায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল কুকুরগুলো। মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করল রানার। উচিত ছিল পিছন থেকে এগিয়ে আসা চোয়ালের দিকে যাওয়া, কিন্তু এখন ভুল সংশোধন করার সময় নেই। পুব দিকের ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে ভেলার ওপর, পা ডুবে যাওয়ায় আবার পাগলা হয়ে গেল কুকুরগুলো। বজ্রকঠিন হাতে হ্যান্ডেলবার ধরে থাকল রানা, আরেক হাতে চাবুক উঁচিয়ে ধরেছে। পায়ের চারপাশ থেকে পানি সরেনি, এই সময় ফঁাকটা জোড়া লাগল। স্লেজ দুটো পাশাপাশি রয়েছে। চিৎকার করতে করতে হুডের ভেতর ফুলে উঠল ওদের মুখ। বিনয় আর রানার হাতে তীক্ষ্ণ শব্দে লকলকিয়ে উঠল চাবুক। সংঘর্ষের ঠিক আগের মুহূর্তে লাফ দিল কুকুরগুলো। পায়ের নিচে সম্পূর্ণ ডুবে গেল ভেলা, হাঁটুর কাছে উঠে এল পানির স্তর।
প্রলয়ংকরী সংঘর্ষ ঘটার আগেই ফাঁকটা পেরিয়ে এল স্লেজ জোড়া। তারপরই শোনা গেল দুনিয়া কাঁপানো বিস্ফোরণের আওয়াজ। আইসফিল্ডের কিনারা থেকে বেশ খানিকদূর সমতল বরফ প্রায় মসৃণ, পিছলে ছুটে চলল স্লেজ। বিস্ফোরণের আওয়াজে কানে তালা লেগে গেছে ওদের, আইস শীটের মুখোমুখি ধাক্কায়। প্রেশার রিজ তৈরি হতে দেখল ওরা, কিন্তু কোন আওয়াজ শুনতে। পেল না। ছোট বাড়ি আকারের বরফের অসংখ্য টুকরো সদ্য তৈরি চওড়া পাঁচিলের মাথায় টলমল করছে। রানার পাশে থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে ছোটার সময় পা পিছলে পড়ল নিয়াজ। তার পিছনে প্রেশার রিজ ধেয়ে এল ছুটন্ত লাভার মত, লাভার সামনে। এক দেড়শো মণ ওজনের বরফের চাই একের পর এক আছড়ে পড়ছে।
রানা…! এক নিঃশ্বাসে বলল নিয়াজ, থেমো না…! ক্ষীণ, কিন্তু পরিষ্কার, করুণ হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে।
তাকে পড়তে দেখল রানা, হ্যান্ডেলবার আর চাবুক ধরল। একহাতে, নিয়াজের বাড়ানো হাতটা ধরে ফেলল খপ করে। হাঁটুর। ওপর ভর দিয়ে খানিকটা উঁচু হয়েছে নিয়াজ, নির্দয়ভাবে তার হাত টানল রানা। স্প্রিঙের মত খাড়া হলো নিয়াজ, হোঁচট খেতে খেতে। স্লেজের সাথে ছুটল আবার। ওদের পিছনে বিশ টন ওজনের বরফের একটা চাই পড়ল, ঠিক যেখানে আছাড় খেয়েছিল নিয়াজ। আরও পিছনে, আইসফিল্ড যেখানে জোড়া লেগেছে, বরফের সহস্র চাই যেন জ্যান্ত হয়ে উঠে পরস্পরের সাথে বাধিয়ে দিয়েছে তৃতীয়। মহাযুদ্ধ।
নরম বরফ চিরে এঁকেবেঁকে ছুটল ফাটল। রানার স্লেজের পাশে ধস নামল, বিকট চড়চড় শব্দের সাথে তৈরি হতে হতে ছুটল গভীর একটা খাঁদ, ভেতরে কালচে পানি পারদের মত টলটল করছে। স্লেজের নাক ঘোরাল রানা, পরমুহূর্তে আরও একটা ফাটলকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে দেখে আবার দিক বদল করতে হলো। চারদিকে ধ্বংস প্রলয় শুরু হয়ে গেছে, একনাগাড় বোমাবর্ষণের মত আওয়াজে চাপা পড়ে গেল ওদের গলা ফাটানো চিৎকার আর চাবুকের সপাং সপাং। হঠাৎ করেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে দুঃখবোধ করল রানা। চাবকাবার কোন দরকারই নেই, প্রাণের মায়ায় সবটুকু শক্তি নিয়ে ছুটছে কুকুরগুলো। আধ মাইল চলে এল ওরা, সামনে কুয়াশার কিনারা, হাত তুলে সবাইকে থামতে নির্দেশ দিল রানা। কুকুরগুলোর অনুকরণে বেদম হাঁপাচ্ছে ওরা। পারকার ভেতর কাপড়চোপড় চটচট করছে ঘামে। পিছন দিকে তাকাল ওরা। এখনও তাণ্ডবলীলায় মেতে আছে আইসফিল্ড। নিপ্রাণ দানবদের লঙ্কাকাণ্ড চলতেই থাকবে এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
.
কারা ওরা!
ফার মোড়া তিনটে আকৃতি, কুয়াশার ভেতর ঝাপসা দেখালেও মানুষ বলে চিনতে ভুল হয় না। মুহূর্তের জন্যে দেখা গেল, তারপরই স্ক্রীনে শুধু ঘন কুয়াশা ছাড়া আর কিছু নেই।
এন.পি.সেভেনটিনের একটা ঘরে বসে আকাশ থেকে টেলিস্কোপিক লেন্স লাগানো মুভি ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখছে ওরা। ঘন ঘন পাইপ টানছে কর্নেল পয়মাল বলটুয়েভ, কিন্তু অনেক আগেই সেটা নিভে যাওয়ায় ধোঁয়া বেরুচ্ছে না।
আশ্চর্য তো! মন্তব্য করল জুনায়েভ।
চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে পা ঠুকল কর্নেল। কিছুই বোঝা গেল না, বলল সে। কুয়াশার কিনারায় তিনজন মানুষ, একজোড়া ডগ-টীম। রানার দল তাহলে কোথায়? আর্কটিকে অভিযানে বেরুলে দলে কম করেও পঞ্চাশ জন লোক, দুডজন স্লেজ থাকবে-কোথায় সে-সব? হঠাৎ হুঙ্কার ছাড়ল সে। মাথামোটা পাইলটরা ঠিক জায়গায় খোঁজ করেনি।
থপ থপ পা ফেলে টেবিলে বিছানো ম্যাপের সামনে দাঁড়াল কর্নেল। আর্কটিকের নিচের দিকে মনোযোগ দিল। এলাকার সমস্ত জলযানের অবস্থান চিহ্নিত করা আছে ম্যাপেট্রলার ফ্লীট এম.সিক্সটি-নাইনের ছটা জাহাজ, কপ্টার ক্যারিয়ার নার্ভা, বিশাল রিসার্চ শিপ রিগা, এবং আমেরিকান আইসব্রেকার কিউট। সবগুলোই সমান গতিতে এগোচ্ছে আইসফিল্ডের দিকে।
ম্যাপের পাশে আই.আই.ফাইভের ব্লো-আপ, আকাশ থেকে। তোলা। চার হপ্তা আগে ধরাবাঁধা কাজের অংশ হিসেবে তোলা। হয়েছিল ছবিটা। আই.আই.ফাইভে আমাদের স্যাবোটাজ টীম ইতিমধ্যে পৌঁছে যাবার কথা, তাই না, জুনায়েভ?
ঘড়ি দেখল জুনায়েভ, রাত সাড়ে দশটা। তার জানার কথা নয়, ঠিক এই সময় পঁচিশ মাইল পশ্চিমে ফাটল ধরা আইসফিল্ড জোড়া লাগার জন্যে পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসছে, মাঝখানে রানা আর তার দল। আমাদের টীম এক ঘণ্টা আগেই ওখানে। পৌঁছে গেছে, বলল সে। কুয়াশা থাকলেও, রাডারের সাহায্যে। আমেরিকান বেস পেয়ে গেছে ওরা।
শুধু কিন্তু র্যাম্প নয়, এয়ারস্ট্রিপও, বলল কর্নেল। ওটাও অকেজো করে দিয়ে আসতে হবে।
সেরকম নির্দেশই দেয়া হয়েছে ওদের, কর্নেলকে আশ্বস্ত করল জুনায়েভ।
মনে আছে তো, কোন রকম ইন্টারন্যাশনাল ইনসিডেন্ট বরদাস্ত করব না আমি! চোখ পাকাল কর্নেল।
যাই ঘটুক, দেখে মনে হবে অ্যাক্সিডেন্ট-অথবা অ্যাক্সিডেন্টের মিছিল। আশা করছি আর ত্রিশ মিনিটের মধ্যে বাইরের দুনিয়ার সাথে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে আই.আই.ফাইভ।
কিন্তু যদি ওদের অয়্যারলেস হাট অক্ষত থাকে?
থাকবে না, কর্নেল কমরেড। ওটাকেও বরফের সাথে মিশিয়ে দিয়ে আসবে ওরা।
কিন্তু জুনায়েভের কথা কর্নেলের কানে ঢুকল না। মাসুদ রানা, আপন মনে বিড়বিড় করছে সে, এসেছ যখন, তোমাকে আমি ঠিকই খুঁজে বের করব। কত ধানে কত চাল বুঝবে তখন। তালুতে তোমার মগজ নিয়ে চটকাতে না পারলে আমার শান্তি নেই।
তুমি বোধহয় ভুল করছ…
পুবদিকে যাব আমরা, এবার নিয়ে কথাটা দুবার নিয়াজকে। বলল রানা। তাহলে পৌঁছুতে পারব আই.আই.ফাইভে। হাত কাপছে, অনেক কষ্টে একটা সিগারেট ধরাল ও। প্রথম টানটাই বিস্বাদ লাগল-সিঁধেল চোরের মত কোথাও ঢুকতে বাকি রাখেনি কুয়াশা, ফুসফুসেও ঢুকেছে। দুমিনিট ধরে তর্ক চলছে ওদের-কোন্ দিকে যাওয়া উচিত তাই নিয়ে।
বরফের ভেলায় চড়ে অনেক দক্ষিণে সরে এসেছি আমরা, নিজের যুক্তিতে এখনও অটল নিয়াজ। নেভিগেটর হিসেবে আমি বলছি…
শুনেছি, কিন্তু তোমার সাথে আমি একমত নই, শান্ত সুরে বলল রানা। সব কিছুই দক্ষিণ দিকে ভেসে চলেছে, খুব দ্রুতই। বলা চলে। আইসফিল্ড, আই.আই.ফাইভ, এন.পি.সেভেনটিন, আমরা যে ভেলায় ছিলাম-স-ব। প্রত্যেকটা একই গতিতে। কাজেই ভেলা কতটুকু ভাসিয়ে এনেছে, সে হিসেব বাদ দিতে। পারো তুমি।
একটা পয়েন্ট পর্যন্ত তোমার কথা ঠিক…
আমার কথা নয়, আমার হিসেব-নির্ভুল। তাছাড়া, নিয়াজ, এখানে কোন পার্লামেন্ট অধিবেশন বসেনি। কাজেই তর্ক বাদ দিতে পারো। এখুনি আমরা রওনা হব, ওই পুব দিকেই।
যুক্তিতে হেরে গিয়েই হোক, বা নেতার প্রতি সম্মান দেখিয়েই হোক, স্যালুট ঠুকে হাসল নিয়াজ। ইয়েস, বস!
ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে আবার শুরু হলো যাত্রা। পায়ের নিচে উঁচু-নিচু বরফ। যখন যে স্লেজ উল্টে পড়ার উপক্রম করে তখুনি সেটার দিকে ছুটে গিয়ে ঠেক দেয়ার চেষ্টা করল নিয়াজ। কয়েক মিনিট পরই স্থির দাঁড়িয়ে থাকা প্রেশার রিজ পথরোধ করল ওদের। যেন চীনের প্রাচীন, ঘুরে যাবার উপায় নেই। শাবল আর। কোদাল হাতে কাজে ঝাপিয়ে পড়ল তিনজন, পাঁচিল ভেঙে পথ। তৈরি হলো। হলো বটে, কিন্তু কাজটা সমস্ত শক্তি যেন চুষে বের করে নিল ওদের। তবে কোমরে টনটনে ব্যথা নিয়েও হাসাবার। কাজটা বিশ্বস্ততার সাথে পালন করল নিয়াজ: দাদা তোর পায়ে পড়ি রে, মেলা থেকে বউ এনে দে…
মেলা? খেঁকিয়ে উঠল বিনয়। শালার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
একদিক থেকেই শুধু ভাগ্যটা ভাল ওদের, এখন পর্যন্ত হেলিকপ্টারের কোন আওয়াজ পায়নি।
মনে হচ্ছে রাশিয়ানরা হাল ছেড়ে দিয়েছে, স্লেজ নিয়ে পাঁচিলের ফাঁক গলার সময় বলল বিনয়। কিংবা ফুয়েল শেষ হয়ে গেছে…
তোরা যে যাই বলিস ভাই, আমার ট্রিপল ফাইভ চাই, দ্বিতীয় স্লেজের পাশাপাশি ছুটছে নিয়াজ, বিনয়ের বুকের কাছে হাত পাতল।
ওদের কথা শুনছে না রানা। ভাবছে বাকি রাতের জন্যে এখানেই ক্যাম্প ফেলবে কিনা। সাড়ে এগারোটা বাজে, সবাই ক্লান্ত। নিয়াজের দিকে তাকাল ও। তার হুডের ওপর গগলস, লেন্সে নিরেট বরফের আবরণ। প্রতিটি নিঃশ্বাস বেরিয়ে এসেই তুষার হয়ে গিয়ে গ্লাসে জমছে।
মুচকি হেসে বলল রানা, শোবার ভাল একটা জায়গা পেলে আমরা থামব।
শুতে পেলে নিয়াজ বউ চাইবে না তো? রীতিমত উদ্বিগ্ন দেখাল বিনয়কে।
নিয়াজ গম্ভীর। রেডিওতে যদি সাড়া পাই, প্রথমেই ওদেরকে। বলব রাঙা টুকটুকে একটা হেলিকপ্টার পাঠিয়ে দিক…
অন্যান্য ইকুইপমেন্টের সাথে স্লেজে একটা রেডিফন জি-আরথ্রী-ফোর-ফাইভ ট্রানসিভার এবং ডিরেকশন-ফাইন্ডার রয়েছে-পোর্টেবল হাই-ফ্রিকোয়েন্সি সেট, পনেরো ওয়াটের। কার্টিস ফিল্ড তো বটেই, ওটা দিয়ে থিউল-এর সাথেও যোগাযোগ করতে পারবে ওরা। সিকোরস্কিগুলো ওদেরকে বরফে নামিয়ে ফিরে যাবার পর তিনবার সেটটা কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছে। ওরা, আশা ছিল আই.আই.ফাইভের ট্রান্সমিশন শুনতে পাবে। কিছুই শুনতে পায়নি, আই.আই.ফাইভের যেন কোন অস্তিত্বই নেই।
যোগাযোগটুকু দরকার শুধু, ডিরেকশন-ফাইন্ডারের সাহায্যে। আই.আই.ফাইভকে খুঁজে নেয়া পানির মত সহজ। কিন্তু আই.আই.ফাইভের কোন সাড়া না পাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। রানা, তবে কাউকে কিছু টের পেতে দিল না। সম্ভবত। স্ট্যাটিক-জানে আমরা কিছু শুনতে পাব না তাই ওরা ট্রান্সমিট। করার চেষ্টাই করছে না। নিয়াজের প্রশ্নের উত্তরে ব্যাখ্যাটা দিল। ও।
ওদের সামনে, বরফের কাছাকাছি, পাতলা হতে শুরু করেছে। কুয়াশা। কিন্তু ওপর দিকে যেমন ঘন ছিল তেমনি আছে। এতক্ষণে আরও সমতল এলাকায় চলে এল ওরা। ক্যাম্প ফেলল এখানেই। পা পিছলে প্রায়ই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কুকুরগুলো, সহ্য ক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে ওগুলো। ফাইভ স্টার হোটেল পাওয়া। বোধহয় দুরাশা, বলল রানা। চিৎ হতে চাইলে এখানেই, কি…,
হঠাৎ থেমে গেল রানা, হাতে এখনও হ্যান্ডেলবার, তাকিয়ে। আছে সামনে। পাতলা হচ্ছে কুয়াশা, তার ভেতর লাল কি যেন লকলকিয়ে উঠল। এই আছে, এই নেই। চোখ পিট পিট করল ও, জানে, ভুল দেখেনি। এমনভাবে সরল কুয়াশা, কেউ যেন গুটিয়ে টেনে নিল পর্দা। সাথে সাথে লাল শিখা বিস্ফোরিত হলো আবার, ওপরের কুয়াশা ঘেঁয় ছোঁয়। ধোঁয়ার একটা গন্ধ, খুবই অস্পষ্ট। কুকুরগুলোই আগে পেল, পেয়েই লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে।
ঘটনাটা কি? হাঁ হয়ে গেছে নিয়াজের মুখ।
জবাব না দিয়ে তার হাত থেকে কম্পাসটা একরকম কেড়ে নিল রানা। বিয়ারিং নেয়ার জন্যে ঝুঁকল ও। আবার যখন মুখ তুলল, বিপজ্জনক চেহারার শিখাটা ম্লান আভা হয়ে উঠেছে।
কি ওটা? আবার প্রশ্ন করল নিয়াজ। রানা তুমি কিছু বলছ না কেন?
আই.আই.ফাইভের কথা ভুলে যাও, গম্ভীর সুরে বলল রানা। থামার উপায় নেই, চলার মধ্যেই থাকতে হবে আমাদের। খুব সম্ভব আই.আই.ফাইভ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে!