মরণখেলা: ১.৬ বরফ-দ্বীপ এন.পি. সেভেনটিন

মরণখেলা: ১.৬ বরফ-দ্বীপ এন.পি. সেভেনটিন

১.৬ বরফ-দ্বীপ এন.পি. সেভেনটিন

বরফ-দ্বীপ এন.পি. সেভেনটিন। সরু এক ফালি এয়ারস্ট্রিপ ছুটে এল বাইসনের দিকে। দুসারি ঝাপসা আলোর মাঝখানে বম্বারের নাক তাক করল পাইলট, থ্রটল পিছিয়ে এনে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে। দিল নিজেকে। ফালিটা বাইসনের জন্যে খুব ছোট।

বরফ উড়ে এল তার দিকে, নিচ দিয়ে তীরবেগে পিছিয়ে। গেল, ঘষা খেলো চাকা। বম্বার ঘন ঘন ঝুঁকি খাচ্ছে, দাঁতে দাঁত চেপে ব্রেক কষল পাইলট। বিস্ফোরিত হলো তুষার মেঘ, সাদা কুয়াশার মত ছলকে উঠে ঢেকে দিল জানালাগুলো। টুকরো বরফ। কামানের গোলার মত আঘাত করল আন্ডারক্যারিজে, আওয়াজ শুনে মনে হলো কয়েক হাজার মেশিনগান থেকে গুলি ছুটছে। প্লেন থামল না, এয়ারস্ট্রিপ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে…

পটকা ফাটার মত চটাস করে একটা আওয়াজ হলো প্লেনের ভেতর। কিছু না, ঊরুর ওপর একটা চাপড় মারল কর্নেল বলটুয়েভ। ঊরুটা আর কারও হলে ইঞ্চিখানেক ফুলে উঠত সন্দেহ। নেই। ভারি একসাইটিং, তাই না, জুনায়েভ? তার চোখ জোড়া পুলকে চকচক করছে।

তার পাশের সীটে ভয়ে সিঁটিয়ে আছে জুনায়েভ। দস্তানা পরা। হাত দিয়ে সীটের হাতল চেপে ধরে আছে সে, চোখ বন্ধ। আপন। মনে হাসল কর্নেল। কে বলবে এই জুনায়েভই সন্ত্রস্ত লোকদের। ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে তথ্য আদায়ে ওস্তাদ?

এয়ারস্ট্রিপের ঠিক কিনারায় পৌঁছে থামল বম্বার, একটুর জন্যে দুর্ঘটনা ঘটল না। প্লেন থামতেই সীট-স্ট্র্যাপ খুলে দরজার কাছে পৌঁছে গেল কর্নেল, তার পিছনের ডেকে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা লোকগুলো নড়ে ওঠার আগেই। গ্রাউন্ড স্টাফরা লোহার সিঁড়ি খাড়া করার আগেই দরজা খুলে ফেলল সে।

সিঁড়িতে পা দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলল কর্নেল। চলে গেছে ওটা? ধুস শালা!

তরতর করে ধাপ বেয়ে নামল সে, সামনের দিকে কাত হয়ে থাকা পাহাড়ের মত দাঁড়াল বেস লীডার ড. নিকোলাই সোরভের সামনে। জুনায়েভের মতই ড. সোরভ মোটাসোটা, তেমন লম্বা নয়। তার চোখের স্নো-গগলসে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। ব্যাপারটা লক্ষ করার সাথে সাথে মেজাজ খিচড়ে গেল কর্নেলের।

কি চলে গেছে, কর্নেল কমরেড?

কি আশ্চর্য! আমি দেখলাম, তুমি কেন দেখোনি? আমরা ল্যান্ড করার সময় একটা প্লেন ছিল আকাশে…

দেখেছি, কর্নেল কমরেড। পশ্চিম দিকে উড়ে গেছে ওটা…

রাডার, রাডার চেক করেছ?

না, কর্নেল কমরেড। এক মিনিট। এক্ষুণি আসছি…

তুমি জানো, জুনায়েভ, অযোগ্য লোকদের নিয়ে কি অসুবিধে? জিজ্ঞেস করল কর্নেল, জুনায়েভ এই মাত্র সিঁড়ি বেয়ে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

জ্বী, মিনমিন করে শুরু করল জুনায়েভ, …

ধমক দেয়া যায় না, প্যান্ট খারাপ করে ফেলবে। সোরভ পোলার বেয়ারের চেয়ে ভয়ঙ্কর-সব ইডিয়টই তাই। পারকার ভেতর হাত ঢুকিয়ে নিজের চারদিকে তাকাল কর্নেল। ঘাঁটির নির্জনতা তার মনে একটা ছাপ ফেলল। সবগুলো দিকেই সিকি। মাইল পর্যন্ত মোটামুটি সমতলই বলা যায়, তারপরই শুরু হয়েছে। জ্যান্ত, ভয়ঙ্কর পোলার প্যাক বিশাল বরফ খণ্ডের নারকীয় তৃপ, মনে হলো যেন লাফ দিয়ে উঠে এসে গোটা দ্বীপটাকে গ্রাস করার জন্যে ছটফট করছে।

দ্বীপের আয়ু শেষ, গলায় ঘড়ঘড়ে আওয়াজ তুলে মন্তব্য করল সে।

আমেরিকান রিসার্চ বেসে ক্যাম্প এরিয়া থেকে এয়ারস্ট্রিপ। যথেষ্ট দূরে থাকে, এখানে তা নয়। এন.পি. সেভেনটিনের সমতল। ছাদঅলা ঘরগুলো থেকে মাত্র ত্রিশ মিটার দূরে রানওয়ে। ছোট্ট কলোনির মাথার ওপর একশো ফিট উঁচু হয়ে আছে রাডার মাস্ট, রাডারের ডানা আকৃতির কান অনবরত ঘুরছে। জুনায়েভকে এক পশলা নির্দেশ দিল কর্নেল, ড. সোরভ এক ছুটে ফিরে আসতে তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।

রাডারে এখন ওটা পিনের মাথা, দেখা যায় কি যায় না, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সোরভ। আমেরিকান পাইলট আপনাদের দেখেই লেজ তুলে গ্রীনল্যান্ডের দিকে ফিরে গেছে আবার। গর্বের সাথে হাসল সে, যেন একটা যুদ্ধ জয় করেছে। কর্নেল বলটুয়েভ হাত লম্বা করে তার গগলসটা কপালের ওপর তুলে দিল।

দিন নয়, ঝড় নয়, এটা পরে সং সেজে আছ কেন? বেস লীডারের দিকে ঝুঁকে পড়ল কর্নেল। হেলিকপ্টারগুলো ইভেনকোর খোঁজ পেয়েছে? তাকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছ? স্নোক্যাটস পাঠিয়েছ? এমন কিছু করেছ যাতে ভাল কিছু আশা করা যায়?

ইভেনকোকে এখনও পাওয়া যায়নি…, নার্ভাস হয়ে পড়ল সোরভ, ঘন ঘন নিচের ঠোঁট মুখের ভেতর পুরে চুষছে। এখনও সার্চ করছে ওরা…

নামো তোমরা! হুঙ্কার ছাড়ল কর্নেল, লম্বা লম্বা পা ফেলে এয়ারস্ট্রিপের ওপর দিয়ে ক্যাম্পের দিকে এগোল। বাইসন থেকে কারা নামছে দেখার জন্যে মার্কিন প্লেনটা কাছেপিঠে নেই, কাজেই পিছন ফিরে তাকাবার গরজও অনুভব করল না।

বাইসনের ল্যান্ড করতে সুবিধে হবে ভেবে ছয়টা হেলিকপ্টারকে এয়ারস্ট্রিপের সামনে সরিয়ে রাখা হয়েছে। ওগুলো এখানে কেন, আকাশে নয় কেন?

কর্নেলের পাশে থাকার জন্যে রীতিমত ছুটতে হচ্ছে ড. সোরভকে। ওগুলো এইমাত্র নার্ভা থেকে এসে পৌচেছে, কর্নেল কমরেড…

ডিমে তা দিতে? আঁ? আবহাওয়ার শেষ খবর কি?

আই.আই. ফাইভের ওপর কুয়াশা থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই কুয়াশার জন্যেই সার্চ করা কঠিন…

ছিটেফোটা ঘিলু যদি বা মাথায় থাকে, সব খেয়ে ফেলছে তোমার ওই চুল-প্রথম সুযোগেই কামিয়ে ন্যাড়া হয়ে যাবে। এটা আমার আদেশ। বুদ্ধ কহিকে, কুয়াশা থাকলে আমেরিকানরা ইভেনকোকে প্লেনে তুলে নিয়ে যেতে পারবে না। ঘরগুলোর কাছাকাছি চলে এল ওরা, ছাদ থেকে বরফের ঝুরি আর থাম নেমে এসেছে, গ্রীষ্মকালের আগে গলবে না ওগুলো। কুয়াশা সরে গেলেই বরফ থেকে ওকে তুলে গ্রীনল্যান্ডে নিয়ে যাবে ওরা। অন্যমনস্ক দেখাল, যা ভাবছে বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে, আই.আই.ফাইভের পশ্চিমে আমাদের লোক পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে। ওদের মাথার ওপর ছাতার মত ঝুলে থাকবে। হেলিকপ্টারগুলো। ইভেনকোকে নিতে আসছে মাসুদ রানা,কেউ যদি তাকে জ্যান্ত ধরে এনে আমার হাতে তুলে দিতে পারে, বিদেশে চাকরির সুযোগ সহ তিনটে প্রমোশন। লাশ এনে দিতে। পারলে শুধু প্রমোশন-তিনটে।

কর্নেল কমরেড, ভয়ে ভয়ে, ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল ড. সোরভ, সেটা কি বিপজ্জনক হয়ে যাবে না? আমেরিকানরা। ব্যাপারটাকে…

কেউ জানবে কেন? চোখ পাকাল কর্নেল। দুর্ঘটনার মত করে সাজাতে হবে।

আর ইভেনকোর ব্যাপারে, কর্নেল কমরেড?

ইভেনকো রুস্তভ একটা উন্মাদ, ঘোষণার সুরে বলল কর্নেল। একজন খুনী। আমাদের একজন বিজ্ঞানী, ওশেনোগ্রাফার পিটার আন্তভকে খুন করেছে সে।

জ্বী, কর্নেল কমরেড? চোখ কপালে তুলল ড. সোরভ। এ আপনি কি বলছেন! আন্তভ তো সিকিউরিটি এজেন্ট…

তুমি এত বড় গবেট, বিশ্বাস করা কঠিন! বরফে পা ঠুকল। কর্নেল। এইমাত্র আন্তভ একজন ওশেনোগ্রাফার হয়েছে। ইভেনকো একজন ক্রিমিনাল, সে তার একজন সহকর্মীকে খুন। করে পালিয়েছে, কাজেই তাকে গ্রেফতার করে বিচারের ব্যবস্থা। করতে হবে। ব্যাপারটা ছিল পলিটিক্যাল কেস, এখন হয়ে গেল পুলিস কেস।

পুলিস কেস? চিন্তিত দেখাল ড. সোরভকে। পরিস্থিতি তাতে পাল্টে যাবে, বলছেন?

যাবে না! পুলিস কেস মানেই হলো এখন আমরা ইভেনকোকে দেখা মাত্র গুলি করতে পারব, তার সাথে যারা থাকবে তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারেও আমাদের কোন দায়-দায়িত্ব। থাকবে না। অজুহাত তৈরি হয়ে গেছে-ইভেনকো রুস্তভ একটা বিপজ্জনক ম্যানিয়াক। অর্থাৎ, সোরভ, আমাদের এই অভিযান মানুষ শিকারের অভিযান!

.

কার্টিস ফিল্ডে রানার সাথে দেখা করার কয়েক মিনিট পরই আবার প্লেনে চড়লেন জেনারেল স্যামুয়েল ফচ। দুই সীটের একটা সেসনা, তরুণ পাইলট লিয়ন চ্যাপেল সারাক্ষণ চুইংগাম চিবাচ্ছে। গ্রীনল্যান্ডকে পিছনে ফেলে পোলার প্যাকের ওপর চলে এল প্লেন। পুব দিকে যাচ্ছে ওরা।

বলছি না আই.আই.ফাইভকে খুঁজে বের করো, পাইলটকে। অভয় দিয়ে বললেন জেনারেল। আমি শুধু পরিস্থিতিটা নিজের চোখে দেখতে চাই।

কথা বলার সুযোগ পেয়ে খুশি হলো লিয়ন চ্যাপেল, স্লেজ নিয়ে বা হেঁটে, বরফের ওপর দিয়ে বেসে পৌঁছুনো সম্ভব বলে আমি মনে করি না, স্যার। কুয়াশা কেটে গেলে প্লেন নিয়েই যেতে হবে মি. রানাকে বরাবর আমরা যেভাবে যাই।

দুহাজার ফিট ওপর দিয়ে উড়ছে সেসনা। নিচে পোলার প্যাক বহুদূর পর্যন্ত সমতল, শুধু প্রেশার রিজগুলো উঁচু বাঁধের মত ঢেউ তুলে আছে। ওপর থেকে ঝাপসা, চিড় ধরা কাচের মত দেখাল বরফের গা। ত্রিশ মিনিট পর সীটের কিনারায় প্রায় ঝুলে থাকতে দেখা গেল জেনারেলকে, ঝুঁকে পড়ে ধূসর রঙের ঘন কুয়াশা দেখছেন। এরকম কুয়াশা আগে কখনও দেখেননি তিনি, ঢেউ খেলানো নিরেট মেঘ যেন, নিচের বরফ সম্পূর্ণ ঢেকে দিয়েছে। কুয়াশার ওপরের কিনারায় খুদে ছারপোকা আকৃতির একটা বিন্দু দেখা গেল, ওঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। দেখতে পাচ্ছ, চ্যাপেল?

হেলিকপ্টার, স্যার। রাশিয়ান।

সাবমেরিন কিলার?

হ্যাঁ।

প্যাকের দক্ষিণে ওদের একটা ক্যারিয়ার আছে, নিশ্চয়ই ওটা থেকে এসেছে। আরও কাছ থেকে দেখতে চাই। ডাইভ!

খসে পড়ার মত দ্রুত নিচের দিকে নামতে শুরু করল সেসনা। রাশিয়ান হেলিকপ্টার মাত্র আধ মাইল দূরে। যত দ্রুত নামছে সেসনা, কুয়াশা তত দ্রুত উঠে আসছে ওদের দিকে। একটা ঝাঁকি খেয়ে প্লেন সিধে হলো, সীট থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়ার কথা জেনারেলের। কিন্তু তৈরি ছিলেন তিনি। হেলিকপ্টার এখন ওঁদের তিনশো ফিট নিচে। তারপরই হারিয়ে গেল ওটা, ঢুকে পড়ল। কুয়াশার ভেতর।

যেন লজ্জাবতী লতা, পালিয়ে বাঁচল! জেনারেলের বলার ভঙ্গিতে খেদ প্রকাশ পেল। এদিকে আগে কখনও দুএকটা চোখে পড়েছে, চ্যাপেল?

এত পশ্চিমে-না, অন্তত এই মডেলের নয়। আই.আই. ফাইভকে ছাড়িয়ে আরও দূরে চলে এসেছি, স্যার। কুয়াশার শেষ। প্রান্তের কিনারা দেখতে পেল ওরা, আরও সামনে চাঁদের আলোয় স্ফটিকের মত চকচক করছে পোলার প্যাক। এন.পি.সেভেনটিন, রাশিয়ান বেসের কাছাকাছি চলে এসেছি।

ওরা কি করছে দেখতে চাই। তোমার ভয় করছে? একটু যেন কৌতুকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন জেনারেল।

তাড়া করবে, স্যার, বলল চ্যাপেল। প্রায় এখানেই একবার ওদের একটার সাথে আমারটার আরেকটু হলে ধাক্কা লাগত। আপন মনে হাসল সে। প্রতিবেশী হিসেবে তেমন সুবিধের নয়, স্যার। আপনি চাইলে আরও কাছে যেতে পারি। ওই দেখুন, স্যার!

বরফের ওপর সবুজাভ ফসফরেসেন্সের আভা দেখে বোঝা গেল নিচে এন.পি. সেভেনটিনের ওপর ওটা এয়ারস্ট্রিপ। ঘরগুলো এখনও দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু অন্য একটা জিনিস ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। চোখের চারপাশ কুঁচকে সামনের দিকে। ঝুঁকলেন জেনারেল। ঠিক সময়ে এসেছি! তোমার মেডেল পাওয়া উচিত, চ্যাপেল, মাই বয়। দূর থেকে ছোট ছায়ার মত দেখাল। জিনিসটাকে, আকাশ থেকে নিচের দিকে নেমে আসছে, পিছনে ছেড়ে আসছে পেন্সিল-সরু বাষ্প। এন.পি. সেভেনটিনে একটা বাইসন বম্বার নামছে।

ফিরে যাব, স্যার?

থামো!

দ্রুত চিন্তা চলছে জেনারেলের মাথায়। বাইসন বম্বার! ভারি ইন্টারেস্টিং তো! রাশিয়ানরা সাধারণত আর্কটিকে বাইসন ব্যবহার করে না, তারমানে মারমানস্ক থেকে জরুরী কিছু বয়ে আনছে। যন্ত্রপাতি, নাকি মানুষ? গ্রাউন্ড লেভেলে নেমে গেল বম্বার, দুসারি আলোর মাঝখানে। এতক্ষণে ঘরগুলো দেখতে পেলেন জেনারেল।

ওদের রাডারে আছি আমরা, সাবধান করে দিয়ে বলল চ্যাপেল। এবার ওরা তাড়া করার জন্যে প্লেন পাঠাবে।

নিচে তাকাও, বোকা!

সাতশো ফিট নিচে তাকিয়ে চ্যাপেল দেখল, এয়ারস্ট্রিপের দুপাশের আলো নিভে গেছে। তারমানে এই মুহূর্তে কোন প্লেন আকাশে উঠবে না। কাছিম আকৃতির ছয়টা স্নো-ক্যাট দেখল সে, সোভিয়েত বরফ-দ্বীপের পশ্চিমে। সরাসরি আই.আই.ফাইভের। দিকে যাচ্ছে ওগুলো। এত উঁচু থেকে মনেই হয় না নড়ছে বলে, কিন্তু পিছনে রেখে যাচ্ছে ক্যাটারপিলার চাকার দাগ।

বাইসন বম্বার আর স্নো-ক্যাট দেখে যা বোঝার বুঝে নিলেন জেনারেল ফচ।

ফেরো, বললেন তিনি। সাথে সাথে প্লেন ঘোরাতে শুরু করল চ্যাপেল, সেই সাথে আরও ওপরে উঠে যাচ্ছে। কার্টিস ফিল্ডের সাথে যোগাযোগ করো…

ব্যাড স্ট্যাটিক, স্যার…।

চেষ্টা করো, গর্জে উঠলেন জেনারেল। একটাই মেসেজ-টেকনিকালার। বারবার, হাজারবার-টেকনিকালার!

এই কোড সিগন্যালের জন্য কার্টিস ফিল্ডে অস্থিরভাবে অপেক্ষা করছে রানা। পেলেই আই. আই. ফাইভের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাবে ও।

.

গ্রীনল্যান্ড উপকূল থেকে একশো মাইল দূরে, পোলার প্যাকের। ওপর খাড়াভাবে নামতে শুরু করল একজোড়া সিকোরস্কি। হেলিকপ্টার, যেন তারের শেষ মাথায় ঝুলছে ওগুলো। বিপজ্জনক একটা মুহূর্ত-অচেনা বরফে যে-কোন ধরনের ল্যান্ডিং বিপজ্জনক। আকাশ থেকে বোঝার উপায় নেই নিচে ওখানে নিরেট বরফ আছে। কিনা। দেখে মনে হতে পারে মুক্ত বরফ, কিন্তু বরফে চাপ পড়লে ফেটে যেতে পারে, বাহনসহ আরোহীরা তলিয়ে যেতে পারে হিম আর্কটিক মহাসাগরে। ওপর থেকে অনেক সময় বরফ সমতল কিনা তাও বোঝা যায় না। সমতল না হলে উল্টে যেতে পারে কপ্টার, ফলে বরফে ধাক্কা খায় প্রথমে ঘুরন্ত রোটর ব্লেড। আরোহীরা হয়তো নামার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, পরমুহূর্তে দেখা যাবে রোটর ব্লেড তাদেরকে কচুকাটা করছে। অবশ্য যদি না ফুয়েল ট্যাংক বিস্ফোরিত হয়; হলে, পুড়ে মরতে হবে সবাইকে।

উদ্বিগ্ন রানা একটা ঝুঁকির জন্যে অপেক্ষা করছে। ঝুঁকিটাই বলে দেবে শক্ত বরফে নামতে পেরেছে হেলিকপ্টার। পাইলটের পাশে অবজারভারের সীটে বসেছে রানা, আগ্রহের সাথে তাকিয়ে আছে কালেকটিভ স্টিক ধরা পাইলটের হাতের দিকে। স্টিকটা ওদের নিচে নামা নিয়ন্ত্রণ করছে। আশার কথা, পাইলটের হাত একটুও কাঁপছে না। তার মুখের দিকে চট করে একবার তাকাল ও-হেলমেট, গগলস, আর হেডসেটের আড়ালে যতটুকু দেখা যায়। শক্ত হয়ে আছে চেহারা, সম্ভবত আঁকিটা অনুভব করার জন্যে দাঁতে দাঁত চেপে রয়েছে।

রানার পিছনের সীটে নয়টা কুকুরকে নিয়ে বসেছে বিনয়, কুকুরগুলো নাকি সুরে গোঙাচ্ছে, কপ্টারের এই খাড়াভাবে খসে পড়া পছন্দ করছে না ওগুলো। আর একদল কুকুর ও স্লেজ নিয়ে নিয়াজ মাহমুদ রয়েছে দ্বিতীয় কপ্টারে।

হাতঘড়ি দেখল রানা। পাইলট রিচার্ড ওয়েন জানিয়েছে ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে পোলার প্যাকে নামবে ওরা। আর বিশ সেকেন্ড।

খানিক আগে রানা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এখানে নামার ঝুঁকি নিতে তুমি?

না! মুখের ওপর স্পষ্ট জবাব দিতে ইতস্তত করল না ওয়েন। কিন্তু আমার ওপর অর্ডার আছে আপনাকে নামাতে হবে, ইফ হিউম্যানলি পসিবল। কাজেই ঝুঁকিটা নিতে হবে, তাই না?

ঈয়ার-প্যাড অ্যাডজাস্ট করল রানা। সবকিছু কাঁপছে-পায়ের। নিচে মেঝে, গম্বুজ আকৃতির সিলিং, পাইলটের সামনে কন্ট্রোল। পাশে বসা একটা কুকুরের মাথায় হাত রাখল রানা, দস্তানা পরা হাতে খুলির কাপন পরিষ্কার অনুভব করতে পারল। ট্রান্সপোর্ট প্লেনে চড়ে অভ্যেস আছে ওগুলোর, হেলিকপ্টার দুচোখের বিষ। পতন থামছে না। স্টিকে ফিট করা টুইস্ট-গ্রিপ থ্রটল অ্যাডজাস্ট করল ওয়েন। দশ সেকেন্ড।

আয়ুও হয়তো তার বেশি নয়।

যথেষ্ট নিচে নেমে এসেছে ওরা, গম্বুজ আকৃতির সিলিঙের বাইরে বরফ দেখতে পেল। চুর চুর কাঁচের সীমাহীন বিস্তার বলে। মনে হলো। দরজা খোলার সাথে সাথে ঝপ করে আশি কি নব্বই। ডিগ্রী নেমে যাবে টেমপারেচার, দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইবে। যদি না তলিয়ে যায় কপ্টার, যদি না উল্টে যায়। সিকোরস্কির নিচে স্কিড আছে-স্কি-কপ্টারকে সিধে রাখতে সাহায্য করবে। যদি না একটা স্কি হড়কায়, আর দ্বিতীয়টা দেবে যায়। পাইলট তাকাতে একটা চোখ টিপল রানা। কৌতুকের পাল্টা কোন সাড়া পাওয়া। গেল না। গগলসের পিছনে ওয়েনের চোখ ভাবলেশহীন। আতঙ্কে সিঁটিয়ে আছে সে। এই সময় বরফে নামল স্কিড।

সিকোরস্কি টলমল করতে লাগল। রানা অনুভব করল, ওর দিকে কাত হয়ে পড়ছে। পোর্টের দিকে নরম বরফ, স্টারবোর্ডের দিকে কঠিন। ওয়েনের হাত যেন স্টিকের সাথে ঝালাই করা। বিপদ টের পেয়ে গেছে কুকুরগুলো, গলার ভেতর থেকে করুণ ফেঁপানির আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। রোটর ব্লেড এখনও ঘুরছে, ডুবে যাবার অনুভূতিতে কোন ছেদ নেই এখনও। কেবিনের ভেতর উত্তেজনা যেন সশরীরে উপস্থিত, আতঙ্কে তিনজনই ঘামছে দরদর করে। হঠাৎ করেই সিধে হলো মেশিন, স্থির হলো। সুইচ অফ করল ওয়েন, গগলস কপালে তুলল। চকচক করছে ভিজে মুখটা।

নাইস ল্যান্ডিং, হেডসেট খুলে বলল রানা, দরজার দিকে হাত বাড়াল। দরজা খুলতেই ছুরি খেলো রানা-ধারাল আর্কটিক ঠাণ্ডা। মুখ ফুলিয়ে গরম বাতাস ছাড়ল রানা, লাফ দিল বরফ লক্ষ্য করে। মাথা নিচু করে খানিকটা দৌড়ে থামল ও, মুখ তুলে তাকাতেই ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক। প্রেশার রিজের ওপর নামছে। নিয়াজের সিকোরস্কি। ধাক্কা খেয়ে নির্ঘাত বিধ্বস্ত হবে।

রানার পিছনে আনন্দ-উল্লাসে ঘেউ ঘেউ করে উঠল কুকুরগুলো, বিনয় ওগুলোকে নামতে সাহায্য করছে। পুব দিকে, সিকি মাইল দূরে, চাঁদের আলোয় ঝুলে থাকতে দেখা গেল ভারী কুয়াশার নিচ্ছিদ্র পর্দা, ধূসর নোংরা মেঘ যেন নিচের বরফে নোঙর ফেলেছে। নিয়াজের সিকোরস্কি একটা প্রেশার রিজের আড়ালে খসে পড়ল, রিজটা মোচড় খাওয়া দশ ফিট উঁচু নিরেট পাঁচিল। বরফে ধাক্কা খেলো স্কিড, রিজের ওপর রোটর ব্লেড ঘুরছে। এযাত্রা বেঁচে গেল নিয়াজ, রানার পিছন থেকে বিকৃত শোনাল বিনয়ের গলা। মুহূর্তের জন্যে মনে হয়েছিল…

বাঁচেনি-হেলিকপ্টার উল্টে যাচ্ছে! বরফের ওপর দিয়ে ছুটল রানা, বুটের তলায় কচকচ করে গুঁড়ো হচ্ছে বরফ কুচি। গোটা এলাকা সম্প্রতি জমাট বেঁধেছে, কোথাও উঁচু-নিচু, কোথাও নরম। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছে ওর—এখনও রিজের মাথায় দেখা। যাচ্ছে রোটর ব্লেড, কিন্তু কাত হয়ে পড়ছে একদিকে। একটা ফাঁক। গলে পাঁচিল পেরোল ও, বিপদের মুহূর্তে বিদ্যুৎগতি নিয়াজ এরই মধ্যে খুলে ফেলেছে সিকোরস্কির দরজা, একের পর এক লাফ দিয়ে নিচে নামছে কুকুরগুলো, ছুটে আসছে ফাঁকটার দিকে।

রোমহর্ষক একটা দৃশ্য। সিকোরস্কির একদিকের স্কিড নরম। বরফে দেবে যাচ্ছে এখনও, স্ট্রাটের খানিকটা এরই মধ্যে ডুবে গেছে, একদিকে অস্বাভাবিক কাত হয়ে পড়া সত্ত্বেও রোটর ঘুরছে। এরচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত হতে পারে না। ছুটে আরও কাছে চলে আসছে রানা, ভাবছে পাইলট ব্যাটা করছে কি! সুইচ অফ করেনি কেন! স্লেজটাকে ঠেলতে ঠেলতে দরজায় উদয় হলো নিয়াজ, ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেবে। ওটা ছাড়ো! রানার চিৎকার যান্ত্রিক। গর্জনে হারিয়ে গেল। লাফ দিল ও, আঁচড়া-আঁচড়ি করে উঠে। পড়ল কেবিনে। কন্ট্রোলের পিছনে বসে আছে পাইলট, তার দিকে না তাকিয়ে হাতের এক ঝাপটায় সুইচ অফ করল ও।

না! প্রতিবাদ জানাল পাইলট। আমি টেক-অফ করতে যাচ্ছি …

ইঞ্জিন চালু করো, আমি তোমার ঘাড় মটকাব! শাসাল রানা। ওই স্লেজের ওপর আমাদের বাঁচা-মরা নির্ভর করছে, হাত লাগিয়ে। নামাও ওটাকে। মেশিন গেলে মেশিন আসবে-আমরা গেলে? নিয়াজকে সাহায্য করার জন্যে ফিরে এল ও। আলগোছে, নিয়াজ। নিচে বরফ স্পঞ্জের মত। সিকোরস্কির পাশে বিনয়কে দেখতে পেল ও। বিনয়, কোথায় নামে লক্ষ রাখো, ডুবে যেতে পারে…

তাড়াতাড়ি-পা দেবে যাচ্ছে…

আস্তে-ধীরে, একটু একটু করে দরজা দিয়ে অর্ধেকটা বের করে দিল ওরা ভারী স্লেজটাকে। লাফ দিয়ে বিনয়ের পাশে নামল রানা, দুজন মিলে ভারটা সামলাবে। শেষ কমুহূর্ত প্রায় স্থির হয়ে থাকল সিকোরস্কি, যদিও কাত হয়ে থাকার ভঙ্গিটা মারাত্মক একটা হুমকির মত, যে-কোন মুহূর্তে উল্টে যেতে পারে। ধীরে ধীরে নিচে নামিয়ে আনা হলো স্লেজ। বরফে চাপ পড়তেই দেবে যেতে শুরু করল। খপ করে হারনেস ধরে ফেলল ওরা, টেনে শক্ত বরফের ওপর নিয়ে আসার চেষ্টা করল। প্রেশার রিজের ফাঁকের কাছে পৌঁছুতে পারলে আর ভয় নেই।

পাইলটের দিকে তাকাল রানা। এখনও কন্ট্রোলের পিছনে। গঁাট হয়ে বসে আছে। জানের মায়া থাকলে লাফ দাও হে, তোমার কফিন ডুবছে।

গোঁ ধরে বসেই থাকল পাইলট, রানার কথায় কান দিল না। চেষ্টা করে দেখব, টেক-অফ করতে পারি কিনা।

নেমে এসে এক নজর দেখো না, নাকি বউকে এতই ভালবাসো ইস্যুরেন্সের টাকাটা এখুনি তাকে পাইয়ে দিতে চাও?

অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিচে নামল পাইলট, পা ডুবে যাচ্ছে টের পেয়ে আঁতকে উঠে ছুটে চলে এল রানার পাশে-বরফ এখানে কঠিন। সিকোরস্কি এখন প্রায় সিধে হয়ে গেছে, কারণ পোর্ট সাইডের মত স্টারবোর্ড সাইডের স্কিডও ডুবে গেছে বরফের তলায়।

এটা এখন একটা আপদ, ঝঝের সাথে বলল রানা। দূর করতে হবে।

প্রায় রুখে উঠল পাইলট লী রয়, তারমানে?

ওখানে ওটার ওভাবে থাকা চলবে না, বলল রানা। হয় তুলতে হবে, নাহয় ডোবাতে হবে। তা না হলে রাশিয়ানরা হেলিকপ্টার থেকে দেখে বুঝে নেবে কোত্থেকে আমরা কুয়াশার ভেতর ঢুকেছি। এক সেকেন্ড চিন্তা করল ও। মটর স্টার্ট দিলে। কাঁপুনিতেই বোধহয় ডুবে যাবে…

তীব্র প্রতিবাদের সুরে লী রয় বলল, ওটা সরকারি সম্পত্তি, মি. মাসুদ রানা। একটা টীম আনতে পারলে টেনে তোলা সম্ভব।

অত সময় নেই, কঠিন সুরে বলল রানা। সরে থাকো, চেষ্টা করে দেখি তোলা যায় কিনা।

রানা, কৌতুকপ্রিয় নিয়াজ মন্তব্য করল, ভেবে দেখো, ওটার সাথে আমাদের লীডারই যদি তলিয়ে যায়…

কিন্তু রানা ততক্ষণে সাবধানে কেবিনে উঠতে শুরু করেছে। ওর ভারেও সিকোরস্কি দুলল না, বা আরও বেশি বরফের নিচে দাবল না। পাইলটের সীটে বসল ও, ভাল করে দেখে নিল সবাই নিরাপদ দূরত্বে সরে গেছে কিনা। সবচেয়ে দূরে সরে গেছে। পাইলট লী রয়, পাঁচিলের ফাঁকটার কাছে। নিয়াজ আর বিনয় অপেক্ষা করছে কাছেই, ঘুরন্ত রোটর ব্লেডের নাগালের ঠিক বাইরে। কাজটায় ঝুঁকি আছে রানা জানে। আর কাউকে এই ঝুঁকি ও নিতে দিত না। কিন্তু সিকোরস্কির একটা ব্যবস্থা না করলেও নয়।

ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার আগে এক মুহূর্ত গুম হয়ে থাকল রানা। বরফ থেকে যদি তোলা সম্ভব হয়, উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে প্রথম হেলিকপ্টারের পাশে ল্যান্ড করাবে। স্কিডগুলো গাঢ় রঙের কাদাটে তরল বরফে ডুবে গেছে। কাঁপুনি শুরু হলে বেশিরভাগ সম্ভাবনা আরও তলিয়ে যাবে ওগুলো, গোটা হেলিকপ্টার হঠাৎ হুস করে অতল তলে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। তৈরি থাকতে হবে ওকে, কপ্টারটা যেন ওকেও সাথে করে নিয়ে না যায়। বিসমিল্লাহ বলে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল রানা।

মুহূর্তের জন্যে মনে হলো, সিকোরস্কি উঠছে। টলমল করল যান্ত্রিক ফড়িং, ইঞ্জিন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোলার চেষ্টা করল ভারী দেহটাকে। তারপরই পোর্ট সাইড নিচু হতে শুরু করল। এত দ্রুত, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রানা। তারপর কি ঘটেছে, পরিষ্কার মনে করতে পারল না রানা। দরজা লক্ষ্য করে ডাইভ দিল ও, বরফের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ল-সিকোরস্কি ওর ওপরই কাত হয়ে পড়ছে।

সাথে সাথে ব্যাপারটা টের পায়নি রানা। আওয়াজ শুনে মুখ তুলল ও, দেখল রোটর ব্লেড ওর বুক লক্ষ্য করে নেমে আসছে। আতঙ্কের হিম একটা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়ায়। স্রেফ দুটুকরো হয়ে যাচ্ছে ও। হামাগুড়ি দিতে শুরু করে উপলব্ধি করল বুট জোড়া নরম বরফের তলায় ঢুকে গেছে, বুটের ভেতর চুইয়ে ঢুকছে তরল বরফ। হাঁটু জোড়া গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে বুকের কাছে তুলতে চেষ্টা করল ও, বুটসহ পা দুটো আগে মুক্ত করতে হবে। রোটরের আওয়াজ কালা করে দিল ওকে। নাগালের মধ্যেই রয়েছে শক্ত বরফ, কিন্তু হাতের নখ দিয়ে আঁচড় কাটাই সার, এক চুল এগোতে পারল না রানা।

মাথা নিচু করে রোটর ব্লেডের নিচে পৌঁছুল নিয়াজ, ওগুলো। আর ছইঞ্চি নেমে এলে ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে তার। আরও নিচু। হলো সে, বরফ থেকে রানার হাত তুলে টানল। একেই কি বলে। যমে মানুষে টানাটানি, রানা? অবিশ্বাস্য হলেও মিথ্যে নয়, দাঁত। বের করে হাসছে নিয়াজ।

শুয়ে পড়ো, নিয়াজের পিছন থেকে বিনয় আর সামনে থেকে রানা প্রায় একযোগে চিৎকার করল।

তাই করল নিয়াজ, তার পা ধরে পিছন থেকে গায়ের জোরে। টানতে লাগল বিনয়। বন বন করে ঘুরছে ব্লেডগুলো, হঠাৎ অনেকটা নেমে এসে ওদের মাথা ছুঁতে গেল।

টান পড়ায় তরল বরফ থেকে বেরিয়ে এসেছে রানার বুট, ক্রল। করে সরে এল ও। দাঁড়াল ওরা, ছুটল। পাঁচিলের গায়ে ফাঁকটার। কাছে পৌঁছে থামল, পিছন ফিরল। খক খক করে উঠে থেমে গেল ইঞ্জিন। তরল বরফে সেঁধিয়ে গেছে ফিউজিলাজ। রোটর এখনও ঘুরছে, তবে গতি কমে আসছে দ্রুত। তারপর হঠাৎ, এক নিমেষে, ডুবে যাওয়ার হুসস্ আওয়াজ তুলে আর্কটিক সাগরে নেমে গেল। সিকোরস্কি। এই ছিল, এই নেই। জায়গাটা উল্টো করা গম্বুজের। মত দেখতে হয়েছে, নিচ থেকে বুদ্বুদ উঠল একরাশ, তারপর। উথলে উঠল তরল বরফ।

সরকারি সম্পত্তি, মুখ হাঁড়ি করে বলল লী রয়, রক্ষা করার আপনারা কোন চেষ্টাই করলেন না। এরজন্যে আপনাদের। জবাবদিহি করতে হবে…

লোকটার পাছায় কষে একটা লাথি মারল নিয়াজ, তার পিছনে দড়াম করে আছাড় খেলো বরফে, কোমরে ব্যথা পাবার ভান করে খানিক কাতরাল, বিনয়ের অবতার সেজে বলল, সত্যি দুঃখিত!

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত