১.৫ লেনিনগ্রাদে শনিবার রাত আটটা
লেনিনগ্রাদে শনিবার রাত আটটা। এন.পি.সেভেনটিন থেকে ইভেনকো রুস্তভ আর আট ঘণ্টা পর আই.আই. ফাইভের উদ্দেশে রওনা হবে। কর্নেল পয়মাল বলটুয়েভ এখনও তার অফিসে। স্টোভের আঁচে ঘরের ভেতরটা ঝলসাচ্ছে।
ইভেনকো রুস্তভের ব্যাপারে, কর্নেল কমরেড, মাথা ঘামাবার। আমি তো কোন কারণ…
তোমার ওটাকে তুমি মাথা বলো? মাটিতে পা ঠুকল কর্নেল। বাধা পেয়ে ওটা (মাথাটা) নিচু করল জুনায়েভ। নিজের গম্বুজ আকৃতির কামানো মাথায় হাত বুলাল কর্নেল। ঘটনা ঘটার আগেই এখানে তার ছবি ফুটে ওঠে, সেজন্যেই ওই চেয়ারটায় বসতে দেয়া হয়েছে আমাকে। আরও দ্রুত হলো তার পায়চারি। ক্রুদের তালিকা দেখে আমার চোখ খুলে গেছে, বুঝলে?
বার্জেনের ডেপুটি মেট, ইউরি রুস্তভের কথা বলছেন?
সুমাইয়া নাজিন নামে কোন মেয়ের কথা মনে পড়ে কিনা। দেখো তো। কর্নেল চোখ পাকাল।
সুমাইয়া নাজিন…আমাদের এই হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসা হয়েছিল-হ্যাঁ, মনে পড়ে। সিঁড়ি থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙে গিয়েছিল…
সেই সাথে মন ভেঙেছিল ইভেনকো রুস্তভের, তা জানো?
হ্যাঁ, শান্ত গলায় বলল জুনায়েভ। মেয়েটাকে ভালবাসত ইভেনকো রুস্তম্ভ।
সুমাইয়া ইহুদিদের আন্ডারগ্রাউন্ড সেলের একজন সদস্যা ছিল, বলল কর্নেল। জেরার মুখে স্বীকার করেছিল, আমেরিকা থেকে টাকা পায় তারা। আমার এখন সন্দেহ, আমেরিকানদের। টাকা এখন লেনিনগ্রাদে পৌঁছে দেয় আমাদের এই খ্যাতিমান বিজ্ঞানী, ইভেনকো রুস্তভ।
জুনায়েভ হতভম্ব হয়ে গেল। নাহ, মনে মনে স্বীকার করল সে, কর্নেলকে বুঝতে পারা তার কর্ম নয়। কিন্তু কিভাবে?
তিন বছর ধরে আর্কটিকে রয়েছে সে, গড়গড় করে উত্তরটা আউড়ে গেল কর্নেল। পোলার প্যাকের তলায় মেরিলিন সিস্টেমের কেব্ল আর সোনার বয়া পাতার কাজ করছে। আমেরিকানরা কি করছে না করছে দেখার জন্যে কয়েকবারই আই.আই. ফাইভে গেছে সে। পায়চারি থামিয়ে টেবিলের ওপর দুম করে একটা ঘুসি বসিয়ে দিল, মেঝে থেকে আধ ইঞ্চি লাফিয়ে উঠল টেবিলটা। টাকা কিভাবে হাত-বদল হয়েছে বুঝতে পারছ, জুনায়েভ? ফিরে আসার পর কেউ তাকে সার্চ করেনি।
কিন্তু…
চোপ! হুংকার ছাড়ল কর্নেল। সে তার ভাই ইউরির সাথে কিয়েভে দেখা করেছুটি নিয়ে দুজনেই তারা ওখানে গিয়েছিল। ইউরি এখানে ফিরে আসে নিজের জাহাজে চড়ার জন্যে, এবং পার্কে আমেরিকান ট্যুরিস্ট ডকিনসের সাথে দেখা করে। ডকিনসকে একটা মৌখিক খবর দেয় সে নিশ্চয়ই ইভেনকোর পাঠানো কোন মেসেজ।
কিন্তু, কর্নেল কমরেড, ইভেনকো রুস্তভ ইহুদি হলেও অত্যন্ত নামকরা একজন বিজ্ঞানী…
জানি, হঠাৎ মুচকি হেসে বলল কর্নেল। তাই সরাসরি এখুনি তাকে আমরা ঘটাব না। কিন্তু তার ভাই ইউরি তো আর বিখ্যাত। কেউ নয়? তাকে খোঁচা মেরে দেখতে দোষ কি? বার্জেনের সামান্য একজন নাবিক, কতল করলেও কেউ নাক গলাবে না। বার্জেনের। বর্তমান পজিশন জেনেছ?
তালিন থেকে পাঁচ ঘণ্টার পথ দূরে…
তালিন এয়ারপোর্টে একটা প্লেন পাঠিয়ে দাও, ইউরি ওখানে। পৌঁছুলেই তাকে ধরে আনতে হবে। ট্রলার মাস্টারকে তার পাঠিয়ে নির্দেশ দাও, সোজা তালিনে পৌঁছুতে হবে। বন্দরে পৌঁছুবে পাঁচ। ঘণ্টায়, এয়ারপোর্ট থেকে বন্দরে যেতে-আসতে আধ ঘণ্টা, প্লেন। এখানে ফিরে আসতে আরও এক ঘণ্টা। সাত ঘণ্টার মধ্যে এই অফিসে ইউরিকে চাই আমি, রোববার সকাল তিনটের সময়। জুনায়েভ, এখনও তুমি দাঁড়িয়ে আছ কি মনে করে? সহকারীর দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকল সে।
একা হওয়া মাত্র পকেট সংস্করণ দাবা নিয়ে বসে পড়ল কর্নেল। নতুন একটা সমস্যার সমাধান পেতে হবে তাকে।
.
দযেরঝিনস্কি স্কয়ার, কে.জি.বি. হেডকোয়ার্টার।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বলতে হবে, অতি গোপনীয়তাই হিতে বিপরীত ডেকে আনল। শুধু তাই নয়, নিয়ম ভাঙা যে কোন কোন ক্ষেত্রে অপরাধ, অকস্মাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়ে সেটা। আরেকবার প্রমাণ করে গেলেন জেনারেল পিটার কুরাডিন।
শুরু থেকে সুষ্ঠুভাবেই এগোচ্ছিল কাজটা। স্পেশাল। সিকিউরিটিতে কে.জি.বি.-র লোক আছে, তার কাছ থেকেই জেনারেল কুরাডিন প্রথম আভাস পান ইভেনকো রুস্তভ দেশ ত্যাগ করে আমেরিকায় পালিয়ে যেতে পারে। তার উচিত ছিল, স্পেশাল সিকিউরিটির কর্নেল বলটুয়েভকে ব্যাপারটা জানানো, কিন্তু তা না জানিয়ে গোপনে ইভেনকো রুস্তভের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করেন তিনি।
কর্নেল বলটুয়েভ তখন মস্কোয়, আর্কটিক থেকে ছুটি নিয়ে স্পেশাল সিকিউরিটির হেডকোয়ার্টার লেনিনগ্রাদে আসে ইভেনকো রুস্তভ। মেরিলিন চার্টের একটা কপি আছে ওখানে, সেটা দেখার জন্যে নিয়ে প্রতিটি শীটের ফটো তোলে সে। গোটা মেরিলিন সিস্টেমের প্ল্যান তারই করা, কাজেই চার্টটা দেখতে চাইলে কর্নেল বলটুয়েভের সহকারী জুনায়েভ তাকে বাধা দেয়নি।
মেরিলিন চার্টের মাইক্রোফিল্ম নিয়ে আর্কটিকে, এন.পি.সেভেনটিনে ফিরে যায় ইভেনকো রুস্তভ। ওখানে কে.জি.বি.-র এজেন্ট আছে, জেনারেল কুরাডিনের নির্দেশ পেয়ে মাইক্রোফিল্ম বদলের কাজটা নিখুঁতভাবে সারে সে। ইভেনকো রুস্তভ তখন তার ঘরে ছিল না, ভেতরে ঢুকে আসল মেরিলিন চার্টটা খুঁজে বের করে সে, সেটা পকেটে ভরে তার জায়গায় নকল আরেকটা চার্টের মাইক্রোফিল্ম রেখে আসে।
মেরিলিন চার্ট চুরি বা পাচার হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় আগেই নকল অনেকগুলো চার্ট তৈরি করে রাখা হয়েছিল, সবগুলোই দেখতে প্রায় এক রকম। নকলগুলো তৈরি করেছে তরুণ কিছু বিজ্ঞানী, এবং এগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে ইভেনকো রুস্তভকে কিছুই জানতে দেয়া হয়নি। তরুণ বিজ্ঞানীদের কৃতিত্বই বলতে হবে, দেখার সুযোগ পেলে ইভেনকো রুস্তভেরও ওগুলোকে নকল বলে সন্দেহ করতে প্রচুর সময় লেগে যাবে।
মাইক্রোফিল্ম বদল সম্ভব হয়েছে, এই খবর পেয়ে মস্কোয় বসে খুশিতে বগল বাজাতে শুরু করলেন জেনারেল কুরাডিন। কাজ শেষ করে মস্কোয় ফিরে এল তাঁর এজেন্ট, নতুন দায়িত্ব। দিয়ে ফিনল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়া হলো তাকে।
জেনারেল কুরাডিনের অধীনে অন্তত ছয়জন কে.জি.বি. এজেন্ট শুধু আমেরিকাতেই কাজ করছে। তার মধ্যে জন মিলার একজন। কোডেড মেসেজের সাহায্যে এই ছয়জনের সাথে যোগাযোগ রাখেন জেনারেল। এই কোড তাঁর নিজস্ব আবিষ্কার, তিনি আর তাঁর ছয়জন এজেন্ট ছাড়া আর কারও পক্ষে তা ভাঙা সম্ভব নয়।
ওয়াশিংটন থেকে জন মিলারের প্রথম অয়্যারলেস মেসেজ পেলেন জেনারেল, আমেরিকানরা ইভেনকো রুস্তভকে এন.পি.সেভেনটিন থেকে নিয়ে আসার প্ল্যান করছে। কোড ভেঙে মেসেজটা পড়লেন জেনারেল, তারপর পুড়িয়ে ফেললেন। নিয়ম ভাঙাই তার নিয়ম, কোন মেসেজই কোথাও টুকে রাখেন না। তিনি। অবশ্য ফটোগ্রাফিক মেমোরি-র অধিকারী, একবার যা শোনেন। দেখেন, জীবনে কখনও ভোলেন না।
জন মিলারকে মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়ে দেয়া হলো, কে.জি.বি-ও চাইছে ইভেনকো রুস্তভ পালিয়ে যাক।
এরপর দ্বিতীয় মেসেজে জন মিলার জেনারেল কুরাডিনকে জানাল, ইভেনকো রুস্তভ আমেরিকানদের বরফ-দ্বীপ আই.আই.ফাইভে আসবে, সেখান থেকে তাকে তুলে আনবে। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের অন্যতম এজেন্ট মাসুদ রানা। মিলার আরও জানাল, আমেরিকানরা গায়ের জোরে রানাকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু রানাকে রাজি করাতে পারেনি, রানা শুধু আমেরিকানদের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে তার অনুরোধে রাজি হয়েছে।
এ ঘটনা শনিবার সন্ধ্যার। এর আগের মেসেজগুলোর মত এই শেষ মেসেজটাও ছিড়লেন জেনারেল, তারপর পুড়িয়ে ফেললেন। বুকে চিন চিনে ব্যথা নিয়ে আপনমনে হাসতে লাগলেন তিনি। মঞ্চ সাজানো হয়ে গেছে, এখন যে যার ভূমিকায় সুষ্ঠুভাবে অভিনয় করে গেলেই তার মনের আশা পূরণ হয়। এক ঢিলে কয়েকটা পাখি মারার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। কর্নেল বলটুয়েভ তার চির প্রতিদ্বন্দ্বী, এক হাত নেয়া যাবে তাকে। বেঈমান ইহুদিটা ভাবছে আমেরিকায় একবার পৌঁছুতে পারলেই সবাই তাকে জামাই আদর করবে, কিন্তু সে গুড়ে বালি। মাইক্রোফিল্ম যে নকল, দুদিন আগে বা পরে ঠিকই টের পাবে সে। তখনই শুরু হবে তার উভয় সঙ্কট। মাইক্রোফিল্ম নকল এটা স্বীকার করা তার পক্ষে কঠিন হবে, কারণ তাহলে আর আমেরিকানদের কাছে তার কোন মূল্য থাকবে না। আবার স্বীকার না করলেও বিপদ, কারণ নকল মেরিলিন চার্ট ব্যবহার করে আমেরিকানরা আর্কটিকের তলায় অনন্তকাল অপেক্ষা করলেও সোভিয়েত রাশিয়ার কোন সাবমেরিনের দেখা পাবে না। অনন্তকাল নয়, কিছুদিন পরই ওদের মনে সন্দেহ জাগবে। ধীরে ধীরে টের পাবে তারা, মস্ত একটা ঠক দিয়েছে তাদেরকে কে.জি.বি.।
আনন্দে এতই আত্মহারা হলেন জেনারেল, বুকের ব্যথাটাকে আমলই দিলেন না। সারা শরীরে পুলক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভাবলেন তিনি। সব কিছু এখন নির্ভর করছে ইভেনকো রুস্তভকে আই.আই. ফাইভে যেতে দেয়ার ওপর। কিন্তু। তাকে যদি কোন রকম বাধা দেয়া না হয়, যদি ধাওয়া না করা হয়, আমেরিকানরা সন্দেহ করবে। অর্থাৎ বাধা দেয়ার ভান করতে হবে।
নর্থপোলে কে.জি.বি-র কোন নেটওঅর্ক নেই। কাজটা স্পেশাল সিকিউরিটির। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন জেনারেল। কর্নেল বলটুয়েভের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবেন তার স্পেশাল। সিকিউরিটির ওপর টেক্কা দিয়েছে কে.জি.বি, তারপর সব ঘটনা খুলে বলে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবেন।
সবার অলক্ষ্যে মিটিমিটি হাসছিলেন তিনি। বিধাতার এই স্বভাবটা মানুষের কল্পনা মাত্র হলেও, কেন যেন মনে হয় মানুষ যা। আশা করে তার ঠিক উল্টোটা ঘটিয়ে সত্যি বুঝি মজা পান তিনি।
জেনারেল কুরাডিন ঠিক করলেন, অয়্যারলেস রুমে গিয়ে মেসেজটা নিজে পাঠাবেন। কিন্তু চেয়ার ছাড়তে গিয়ে বুকে তীব্র। ব্যথা অনুভব করলেন, সেই সাথে ঘুরে উঠল মাথা। বন্ধ ঘরের ভেতর, সকলের অগোচরে, তিন মিনিট পর মারা গেলেন তিনি।
জন মিলার জানল না, জেনারেল কুরাডিন মারা গেছেন।
কর্নেল বলটুয়েভ জানল না, ইভেনকো রুস্তভ আমেরিকায় চলে যাবার প্ল্যান করেছে, এবং তাকে যেতে দিতে হবে।
রানা জানল না, ভান নয়, রাশিয়ানরা ওর ওপর সত্যি সত্যি হানবে মরণ-আঘাত।
.
কাঁকড়ার কাছ থেকে এইমাত্র একটা মেসেজ এসেছে। আধঘণ্টা পর কর্নেলের অফিসে ফিরে এসে রিপোর্ট করল জুনায়েভ। কোড ভাঙছে ওরা। লক্ষ করল, টেবিলে বসে গভীর মনোযোগের সাথে ইভেনকো রুস্তভের ফাইলটা পড়ছে কর্নেল।
ফাইল থেকে মুখ না তুলেই কর্নেল জিজ্ঞেস করল, আর কিছু?
না। কাঁকড়া কে, কর্নেল কমরেড?
একজন এজেন্ট, শুধু আমিই তাকে চিনি। ডিকোড করার সাথে সাথে মেসেজটা দেখতে চাই আমি।
ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটু পরই ফিরে এল জুনায়েভ। কর্নেলের হাতে ধরিয়ে দিল সে মেসেজটা।
নটা বাজে। এরই মধ্যে কোর্স বদলে তালিনের দিকে রওনা হয়েছে ট্রলার বার্জেন। জুনায়েভ যে প্লেনটা পাঠিয়েছে আর দশ মিনিট পর তালিন এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে সেটা।
ওয়াশিংটনের ঘড়ির কাঁটা লেনিনগ্রাদের চেয়ে আট ঘণ্টা পিছিয়ে আছে, ডকিনসের মেসেজ আসছে না দেখে নিজের অফিসে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন জেনারেল ফচ। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে টমাস। এখনও তারা জানে না ডকিনস মারা গেছে। রানাকে আসলে মিথ্যে কথা বলা হয়েছে, টমাসকে সাসপেন্ড করা হয়নি। রানা ওয়াশিংটন ত্যাগ করার পরপরই জেনারেলের অফিসে ফিরে এসেছে সে।
গ্রীনল্যান্ডের ঘড়ির কাঁটাও লেনিনগ্রাদের চেয়ে আট ঘণ্টা পিছিয়ে আছে, হামবোল্ডট গ্লেসিয়ার থেকে ফিরে আসছে রানা আর বিনয়।
জনসন ওরফে কাঁকড়ার মেসেজ এইমাত্র কর্নেল বলটুয়েভের হাতে পৌঁছুল।
ডিকোড করতে হিমশিম খেয়ে গেছে ওরা, ব্যাখ্যা করল জুনায়েভ। মেসেজটা কেমন যেন এলোমেলো…
পড়া শেষ করল কর্নেল। মন্তব্য করল, চমকার! কামানো মাথায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে দ্বিতীয়বার পড়ল মেসেজটা। আমেরিকানরা প্রস্তুতি নিচ্ছে…আই.আই. ফাইভ থেকে রওনা হতে যাচ্ছে মাসুদ রানা…কার্টিস ফিল্ডে আমেরিকান প্লেন…রানার সাথে একটা দল রয়েছে…পোলার প্যাকের ওপর দিয়ে যাবে। ওরা…সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে…
উঠে দাঁড়াল কর্নেল, পাশের ঘরের দিকে এগোল। তার পিছু নিল জুনায়েভ। পাশের ঘরে টেলিপ্রিন্টার, অয়্যারলেস, টেলিফোন, ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্তভাবে কাজ করছে কিছু লোক। ভেতরে ঢুকে। সোজা ওয়াল-ম্যাপের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কর্নেল।
জেনারেল ফচ আর কর্নেল বলটুয়েভের ওয়াল-ম্যাপ প্রায় একই রকম দেখতে, এটায় শুধু আর্কটিক এলাকাটাকে অন্যভাবে দেখানো হয়েছে। মেঝের কাছাকাছি রয়েছে রাশিয়ান উপকূল; গ্রীনল্যান্ড, কানাডা, আর আলাস্কা উপকূল সিলিঙের কাছাকাছি। এটা কার্টির্স ফিল্ড, হাতের টোবাকো পাইপ তাক করে। জুনায়েভকে দেখাল কর্নেল। আই.আই. ফাইভের সবচেয়ে কাছের। এয়ারফিল্ড। ডেস্কের পিছনে বসা এক লোককে ডাকল সে। বদোনভ, এলাকায় জাহাজগুলোর পজিশন বলো আমাকে।
ট্রলার ফ্লীট এম. সিক্সটি-নাইন, কর্নেল কমরেড?
ওটা দিয়েই শুরু করো।
যেমন দেখছেন, কর্নেল কমরেড, এই মুহূর্তে আইসল্যান্ডের। অনেক উত্তরে রয়েছে ফ্লীটটা, তবে দক্ষিণ দিকে এগোচ্ছে-উদ্দেশ্য, ন্যাটোর ওয়াটার কিং যে মহড়ার পরিকল্পনা করেছে সেটার ওপর নজর রাখা। আমাদের ফ্লীটে বারোটা জাহাজ রয়েছে, প্রত্যেকটি নরমাল ইলেকট্রনিক গিয়ারে সাজানো…
অয়্যারলেস-জ্যামিং অ্যাপারাটাস সহ?
জ্বী, কর্নেল কমরেড। স্পিট বার্জেনের পশ্চিম থেকে। হেলিকপ্টার-ক্যারিয়ার নার্ভা-ও একই মিশনে দক্ষিণ দিকে ঘুরে গেছে…
আর রিগা? ওটাই তো আইসবার্গ অ্যালি-র সবচেয়ে কাছে।
রিগা এখন কয়েক হপ্তা ওখানেই থাকবে। আমেরিকান উপগ্রহগুলোর ওপর নজর রাখছে…
আরও ওপরের একটা চিহ্নের ওপর পাইপ ঠেকাল কর্নেল। আর এই আমেরিকান জাহাজটা…?
আইসব্রেকার কিউট, কর্নেল কমরেড। এইমাত্র ওটার পজিশন আমাদের ম্যাপে বদলাতে হয়েছে, এক ঘণ্টাও হয়নি। যাচ্ছিল দক্ষিণ দিকে, কোর্স বদলে আবার উত্তরে রওনা হয়েছে। নার্ভার একটা হেলিকপ্টার দেখতে পেয়েছে ওটাকে।
ধন্যবাদ, কমরেড, বলে গট গট করে অফিসে ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসল কর্নেল। বিস্ফোরণন্মুখ মেজাজ সম্পূর্ণ বদলে গেছে, জুনায়েভকে নাটকীয় নির্দেশগুলো দেয়ার সময় শান্ত এবং সুস্থির দেখাল তাকে। গোটা আর্কটিক জোনে জরুরী অবস্থা জারি করে দাও। প্রত্যেকটা কোস্টাল বেস, প্রত্যেকটা এয়ারফিল্ড, প্রত্যেকটা আইস আইল্যান্ড, এমনকি আলাস্কা উপকূলের কাছাকাছি দ্বীপগুলোও জরুরী অবস্থার আওতায় থাকবে। মারমানস্কে রেডিও মেসেজ পাঠাও, রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে আমার জন্যে একটা বাইসন বম্বার রেডি রাখতে হবে, ভরা ট্যাংক নিয়ে। লেনিনগ্রাদ এয়ারপোর্টকে বলে রাখো, মারমানস্কে আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে এক ঘণ্টার নোটিশে একটা প্লেন চাই।
তার আগে আমি কি, কর্নেল কমরেড, মস্কোর সাথে যোগাযোগ করব…
খুস্কায়েভ আর তার স্পেশাল ডিটাচমেন্টকে মারমানস্ক। পাঠিয়ে দাও-ওদের প্লেন যেন আধ ঘণ্টার মধ্যে টেক-অফ করে…
কর্নেল কমরেড, মস্কোর অনুমতি…
ডিটাচমেন্টের সবাই সাদা পোশাক পরে যাবে, পারসোনাল। আর্মস থাকবে সাথে। আই.আই. ফাইভ এরিয়ার আবহাওয়া। রিপোর্ট এনে দাও…
মস্কোকে কিছুই জানাব না, কর্নেল কমরেড? এই স্কেলের। একটা অপারেশন জেনারেল মিঝিরিভস্কির অনুমতি ছাড়া…!
একমনে পাইপে টোবাকো ভরছে কর্নেল বলটুয়েভ। তোমাকে। আমি বারবার বলেছি, জুনায়েভ, মাথাটা কামিয়ে ফেলো। তবে। যদি ঘটে কিছু বুদ্ধি…
কিন্তু কর্নেল কমরেড, কাঁকড়ার মেসেজে পরিষ্কার কিছু নেই!
কাঁকড়াকে চিনলে তুমি বুঝতে পারতে, আছে। আমেরিকানরা তাদের আই. আই. ফাইভের কাছে পিঠে বড় ধরনের কোন অপারেশন করতে যাচ্ছে। রাশিয়ার চরম শত্রু মাসুদ রানার। সাহায্য নিচ্ছে ওরা। এর বেশি আর কিছু জানার দরকার আছে। কি? মাসুদ রানা মানেই তো বিপদের মিছিল। কে.জি.বি-কে সে ধোকা দিতে পারে, ধোকা দিয়ে ক্ষমাও পেতে পারে, কিন্তু স্পেশাল সিকিউরিটিকে ধোকা দেয়া সহজ নয়, আর কর্নেল বলটুয়েভ শত্রুকে ক্ষমা করতে জানে না। হঠাৎ চোখ পাকাল সে। কি, এখনও তুমি দাঁড়িয়ে যে?
দরজার কাছে গিয়ে ফিরল জুনায়েভ। এখনও আপনি চান, কর্নেল কমরেড, ইউরি রুস্তভকে তালিন থেকে এখানে নিয়ে আসা হোক?
অবশ্যই, পাইপে আগুন ধরাল কর্নেল। ওটা আলাদা একটা সমস্যা।
.
রানা একাই যেন একশো, যেন একটা প্রতিষ্ঠান। গত ষোলো ঘণ্টায় ওয়াশিংটন থেকে থিউল-এ উড়ে এসেছে ও, কপ্টার নিয়ে জনসনকে ধাওয়া করে হামবোল্ডট গ্লেসিয়ারে গেছে, ওখান থেকে ফিরে প্লেনে করে গ্রীনল্যান্ডের সবটুকু প্রস্থ পেরিয়ে পৌচেছে কার্টিস ফিল্ডে। শনিবার, ওয়াশিংটন সময় সন্ধে তখন সাতটা। নটার মধ্যেই ওদের যাত্রা শুরুর সমস্ত আয়োজন শেষ হয়ে গেল। এ যেন কোন মানুষ নয়, রানাকে দেখে কাটিস ফিল্ডের লোকজন উপলব্ধি করল: মূর্তিমান ঘূর্ণিঝড়।
প্লেন থেকে নেমেই রানা অর্ডার করল, দুঘণ্টার মধ্যে একজোড়া সিকোরস্কি তৈরি অবস্থায় চাই আমি। পুরোপুরি সার্ভিস করা, ভরা ট্যাংক…
সম্ভব নয়, ঝাঁঝের সাথে বাধা দিল এয়ারফিল্ডের কন্ট্রোলার হাওয়ার্ড ম্যাকলিন।
আরও লোক লাগান! নাকি জেনারেল ফচকে ফোন করব? দায়টা আপনাদের…
দুঘণ্টা পাঁচ মিনিটের মাথায় হেলিকপ্টার দুটো তৈরি হয়ে গেল। আগেই আই.আই. ফাইভের কাছাকাছি এলাকার আবহাওয়া। চেক করার জন্যে একটা প্লেন পাঠানো হয়েছিল, ফিরে এসে পাইলট রিপোর্ট করল ওদিকে কোন কুয়াশা নেই। ক্যাম্প সেঞ্চুরি থেকে একজোড়া এস্কিমো-টাইপ স্লেজ আনিয়ে রাখা হয়েছে। খাবারদাবার, রেডিও ট্রানসিভার, রাইফেল, অ্যামুনিশন, এবং একটা ইলিয়ট হোমিং বীকন প্যাক করে তোলা হলো।
বীকন কেন? জিজ্ঞেস করল ম্যাকলিন।
ইসুরেন্স।
ঝটপট, ছোট্ট করে উত্তর দেয় রানা, কোন তথ্য প্রকাশ পায়।। অস্থিরভাবে হ্যাঙ্গারের ভেতর ঘুর ঘুর করতে লাগল ও। সিকোরস্কির কন্ট্রোল চেক করল, স্লেজে যে প্যাকেটগুলো তোলা হবে সেগুলো বাঁধার কাজে সাহায্য করল, বারবার রেডিও রুমে গিয়ে জানতে চাইল ওয়াশিংটন থেকে কোন মেসেজ এসেছে কিনা। তার প্রাণশক্তির যেন সীমা নেই, নিমেষের মধ্যে এয়ারফিল্ড কর্মীদের মধ্যে তা সংক্রমিতও হয়ে গেল, চার ঘণ্টার কাজ। দুঘণ্টায় তুলে দিল তারা। রানার এই তৎপরতা দেখার সুযোগ ঘটলে কর্নেল বলটুয়েভ নিশ্চয়ই ভারী উদ্বেগ বোধ করত।
ওদিকে, রেডিও রুমে, থিউল-এর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টায় গলদঘর্ম হচ্ছে বিনয় মুখার্জি। শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ হলো। আমি চাই কুকুরগুলো এখুনি পাঠানো হোক। কি, কোন প্লেন নেই? শুধু একটা হারকিউলিস পয়েন্ট ব্যারো-য় যাবার জন্যে টেক-অফ করতে যাচ্ছে? বেশ, চেয়ার থেকে পাছা তুলে ওটাকে থামান, কুইক! ওটা যদি টেক-অফ করে, জেনারেল ফচকে দিয়ে মাঝ-আকাশ থেকে ফিরিয়ে আনাব…
কুকুরগুলোর এক ঘণ্টা আগে আসার কথা ছিল, পিছন থেকে ভারী গলায় বলল রানা।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল বিনয়। তিক্ত হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে। এখুনি চাও, নাকি যখন পৌঁছুবে?
নিঃশব্দে হাসল রানা। বোথ-অ্যান্ড সুনার!
দুঘণ্টা পর ওদের জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকে বিনয় রিপোর্ট করল, কুকুর পৌঁছে গেছে।
রানা বলল, নিয়াজকে বলো চেক করে দেখে নিক…
রানার কথা শেষ হবার আগেই ঘরে ঢুকল নিয়াজ মাহমুদ।
যাও, কুকুরগুলো চেক করো, তাকে বলল বিনয়। পতাকার মত ওটা কি নাড়ছ শুনি?
একগাল হাসল সুদর্শন নিয়াজ। জেনারেল ফচের আর্জেন্ট মেসেজ। এক্ষুণি রওনা হবার জন্যে রেডি হতে বলা হয়েছে।
.
এর কোন নজির নেই, তাই আবহাওয়াবিদরা একেবারে হতচকিত হয়ে পড়ল। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে গ্রীনল্যান্ডে নিম্নচাপ অসম্ভব একটা ব্যাপার।
এই নিম্নচাপই সে বছরের পরের মাসগুলোয় উত্তর আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপে বিপর্যয় ডেকে আনে, গ্রীষ্মকাল হয়ে ওঠে ভয়াবহ শীতকাল, আইসবার্গগুলো ভাসতে ভাসতে দূর দক্ষিণে চলে যায় আগে যেখানে কখনও যায়নি, ফলে ট্রান্স-আটলান্টিক জাহাজগুলোর জলপথ বন্ধ হয়ে যায়, বিশাল লাইনারগুলো বাধ্য হয় কোর্স বদলাতে। আর, এই নিম্নচাপই ডেকে আনে ভীতিকর কুয়াশা।
নোভাইয়া জেমলাইয়ার সোভিয়েত আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা টের। পায়নি কুয়াশা আসছে। পৃথিবীর ছাদের ওপর দিয়ে প্রতিদিন উড়ে যায় ইউ.এস. ওয়েদার প্লেন, তাদেরও চোখ এড়িয়ে গেছে। কিন্তু রানা যখন কার্টিস ফিল্ডের হ্যাঙ্গারে অস্থিরভাবে ঘোরাফেরা করছে, ঠিক সেই সময় আই.আই. ফাইভের উত্তরে নেমে আসছে আধ মাইল উঁচু, বহু মাইল চওড়া ঘন কালো কুয়াশার হিমশীতল আবরণ।
.
ঘরের মাঝখানে গোল স্পট লাইট, আলোর মধ্যে একটা চেয়ারে। বসে আছে ইউরি রুস্তভ। তার পিছনে অন্ধকার, খুক করে কেশে কেউ একজন জানান দিল সে আছে। ইউরির সামনেও অন্ধকার, অন্ধকার থেকে মাঝে মধ্যে ভেসে আসছে চেয়ারের কাঁচ কাঁচ আওয়াজ। কর্নেল বলটুয়েভ নড়াচড়া করছে চেয়ারে বসে।
তালিন থেকে প্লেনে করে নিয়ে আসার সময় ইউরি রুস্তভকে। কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। অজানা আশঙ্কায় এমনিতেই কুঁকড়ে ছিল বেচারা, তারপর এই ঘরের পরিবেশ তাকে একেবারে। দিশেহারা করে তুলেছে।
কর্নেল বলটুয়েভ জানে না, চল্লিশ মিনিটের মধ্যে ইউরিকে মচকাতে হবে তার। আর চল্লিশ মিনিট পর লেনিনগ্রাদে চারটে। বাজবে, এন.পি. সেভেনটিনে বাজবে রাত বারোটা। ঠিক চল্লিশ মিনিট পর পোলার প্যাক ধরে অদৃশ্য হয়ে যাবে ইভেনকো রুস্তম্ভ।
ঘটনাটা আবার শোনা যাক, মোলায়েম কণ্ঠে বলল কর্নেল, তাতেই ইউরির কানের পাশে যেন বোমা ফাটল। তুমি পার্কে ঢুকলে, এখান থেকে শুরু করো।
ইউরির মাথা ঘুরছে। পনেরো বার, নাকি পঁচিশ বার? ঘটনাটা কত বার বর্ণনা করেছে এখন আর মনে করতে পারে না সে। পার্কে ঢুকলাম…
বাধা। কেন?
আমি ডকে যাচ্ছিলাম…
তাহলে নিশ্চয়ই নেভস্কি প্রসপেক্ট ধরে যাও তুমি, ওটাই সহজ রাস্তা।
হ্যাঁ, নেভস্কি প্রসপেক্ট ধরে যাচ্ছিলাম…, একঘেয়ে কণ্ঠস্বর ইউরির, যেন কোন বাচ্চা পড়া মুখস্থ করছে।
না, তা তুমি যাওনি-গেলে পার্কে ঢুকতে না। কেন, পার্কে ঢুকলে কেন?
বিদেশী লোকটা পার্কের রাস্তায় আছাড় খেলো, ঘটনার এই পর্যায়ে এল ওরা। এবার নিয়ে ছাব্বিশ বার একই প্রশ্ন করল কর্নেল, আমরা তার শুধু নামটা জানতে চাই। এরমধ্যে আর কিছু নেই, কমরেড। শুধু নামটা।
আমেরিকান একজন লোকের নাম আমি জানব কিভাবে… হঠাৎ চুপ করল ইউরি। ভুল যা হবার হয়ে গেছে।
ঘেমে গোসল হবার জন্যে ইউরিকে পুরো এক মিনিট সময় দিল কর্নেল। ওরা কেউ ইউরিকে বলেনি ডকিনস একজন আমেরিকান ছিল। ডকিনসের কাপড়চোপড় ছিল রাশিয়ানদের মত। তাছাড়া, ইউরি বারবার বলছে, বিদেশী লোকটার সাথে তার কোন কথা হয়নি। নিচে নিয়ে যাও ওকে, নিজের লোকদের নির্দেশ দিল কর্নেল। ঘর খালি হয়ে যেতে সহকারী জুনায়েভকে আদেশ করল সে, যা জানে সব বের করো, জলদি।
.
একজন নাবিকের কাছে ডুবে মরাটা সবচেয়ে বেশি আতঙ্ককর। তাই ওরা তার ওপর ওয়াটার ট্রিটমেন্ট ব্যবহার করল।
বেসমেন্ট সেলারে একটা কাউচে বসিয়ে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা হলো ইউরি রুস্তভকে, কাউচটা ইচ্ছেমত সামনে পিছনে। হেলানো যায়। অন্ধকার কোথাও ভরা একটা বালতিতে চামচ বা খুন্তি নেড়ে পানির আওয়াজ তোলা হচ্ছে।
আমেরিকান লোকটা কি মেসেজ দিল তোমাকে? জিজ্ঞেস করল নিকিতা জুনায়েভ।
কোন মেসেজ দেয়নি…
একজন লোক ইউরির চোয়াল দুহাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল, দ্বিতীয় আরেকজন তার মুখের ভেতর পুরে দিল রাবারের চোঙ, তৃতীয় লোকটা চোঙের ভেতর পানি ঢালছে। বিষম খাওয়ার অনুভূতি হলো ইউরির, বন্ধ হয়ে এল দম, ডুবে যাবার অনুভূতিটা আরও পরে হবে। ইউরির পাশে একটা টুলে বসে রয়েছে একজন ডাক্তার, ইউরির নগ্ন বুকে চেপে ধরে আছে স্টেথসকোপ।
ইউরির চোখ কাপড়ের পট্টি দিয়ে বাঁধা। হাত-পা ছুঁড়তে চেষ্টা। করছে, কিন্তু এক চুল নাড়তে পারছে না। গলা দিয়ে নামছে পানি, পেট ভরে গেল, ফুসফুস ডুবে গেল। তার মনে হতে লাগল সে ডুবে যাচ্ছে। মনে হলো, তার সারা শরীর ফুলে উঠেছে। এভাবে আরও তিন মিনিট কাটল। এক সময় ঝট করে জুনায়েভের দিকে ফিরল ডাক্তার।
মাথা ঝাঁকাল জুনায়েভ। কাউচ খাড়া করা হলো, বসার ভঙ্গিতে ফিরিয়ে আনা হলো ইউরিকে। বাতাসের জন্যে হাঁসফাঁস করতে লাগল সে। হ্যাঁচকা টানে তার চোখের পট্টি খুলে নিল জুনায়েভ।
বলো, কি কথা হলো তার সাথে?
দুচোখ ভরা নগ্ন ঘৃণা নিয়ে জুনায়েভের দিকে তাকিয়ে থাকল ইউরি। তারপর চট করে হাতঘড়ির দিকে একবার তাকাল সে। লক্ষ করে হাতঘড়িটা কজি থেকে খুলে নিল জুনায়েভ।
ঘড়ি হারিয়ে মাথা খারাপের মত অবস্থা হলো ইউরির। তার ওপর যত নির্যাতনই চালানো হোক, ভাই ইভেনকোকে পালাবার একটা সুযোগ দিতে চায় সে। জানে, শেষ পর্যন্ত মুখ তাকে খুলতেই হবে। কিন্তু ইভেনকো এন.পি. সেভেনটিন থেকে রওনা হয়ে যাবার পর, তার আগে নয়। ঘড়ি না থাকায় এখন সে বুঝবে কিভাবে ইভেনকো রওনা হয়ে গেছে কিনা…?
আবার শুরু হলো ওয়াটার ট্রিটমেন্ট। এক সময় ইউরির মনে হলো, সে মারা যাচ্ছে। মনে হলো, একটানা বিশ মিনিট পানি খাওয়ানো হচ্ছে তাকে। প্রাণে বাঁচতে হলে, অন্তত দিন কয়েক বেঁচে থাকতে হলে, সব কথা স্বীকার করা দরকার এবার।
আসলে বিশ মিনিট নয়, নতুন করে ও্যাটার ট্রিটমেন্ট শুরু হবার পর মাত্র পাঁচ মিনিট পেরিয়েছে।
.
বাইশ ঘণ্টা বিছানার ধারেকাছে যায়নি কর্নেল পয়মাল বলটুয়েভ, অথচ লোকজনকে তাড়া করার বহর দেখে মনে হলো এইমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে সে। জুনায়েভের কাছ থেকে খবর পেয়ে নয়, একটা মেসেজ পেয়ে ঝড় তুলল সে।
ঘরে ঢুকে জুনায়েভ বলল, কর্নেল কমরেড, ইভেনকো রুস্তম্ভ আমেরিকায় পালাচ্ছে…
কথাটা আদায় করতে দুঘণ্টা নিলে তুমি, জুনায়েভ, প্রচ্ছন্ন হুমকির সুরে বলল কর্নেল, চট করে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাড়ে পাঁচটা বাজে। অনেক দেরি করে ফেলেছ। এই মেসেজটা দেখো, এন.পি. সেভেনটিন থেকে এসেছে।
কর্নেলের অফিসে স্টোভ জ্বলছে, এরই মধ্যে ঘামতে শুরু করেছে জুনায়েভ। কাগজটা নিয়ে পড়তে শুরু করল সে,। ইভেনকো রুস্তভ ডগ টীম নিয়ে এন.পি. সেভেনটিন ত্যাগ করেছে। সিকিউরিটি এজেন্ট আন্তভের লাশ পাওয়া গেছে বরফে। সার্চ পার্টি পাঠানো হয়েছে। নির্দেশ পাঠান। ড. নিকোলাই সোরভ।
নিজের হাতে মেসেজের উত্তর লিখল কর্নেল, ইভেনকো যত দূর যেতে পারে তারচেয়ে আরও পশ্চিমে যে-কটা হেলিকপ্টার পাওয়া যায় পাঠাও। তারপর ওগুলো এন.পি.সেভেনটিনের দিকে ফিরে আসতে শুরু করবে। আই.আই. ফাইভের কাছে পিঠে কোন। রকম তৎপরতা দেখামাত্র রিপোর্ট করবে। বলটুয়েভ। মেসেজটা নিয়ে রেডিও রুমের দিকে ছুটল বদোনভ।
একগাদা নির্দেশ পেল জুনায়েভ। মারমানস্কের সাথে। যোগাযোগ করে জানতে হবে বাইসন বম্বার এই মুহূর্তে টেক-অফ করার জন্যে তৈরি আছে কিনা। জানতে হবে লেনিনগ্রাদ। এয়ারপোর্টে প্লেন রেডি করে রাখা হয়েছে কিনা। এম.সিক্সটিনাইন আর রিগাকে সিগন্যাল পাঠিয়ে উত্তর চাইতে হবে এলাকায় আমেরিকানদের কোন তৎপরতা আছে কিনা। হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার নার্ভাকে জিজ্ঞেস করতে হবে মার্কিন আইসব্রেকার কিউটের বর্তমান পজিশন।
অ্যাডমিরাল মিঝিরিভস্কি স্পেশাল সিকিউরিটি সার্ভিসের ডিরেক্টর, সাড়ে পাঁচটায় তার ঘুম ভাঙার কথা নয়। তবু মস্কোয় তার নাম্বারে টেলিফোন করল কর্নেল।
আমিই আপনাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম, বলটুয়েভ! অ্যাডমিরাল প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন। মারমানস্ক থেকে এইমাত্র খবর পেলাম আপনি আর্কটিকে জরুরী অবস্থা ঘোষণার নির্দেশ দিয়েছেন। নিশ্চয়ই ওরা ভুল বুঝেছে, তাই না?
না, অ্যাডমিরাল। ওরা ঠিকই বুঝেছে।
আমার অথরিটি ছাড়া?
এ শুধু সতর্ক থাকার জন্যে…
ফার্স্ট সেক্রেটারি ব্যাপারটা শুনেছেন ক্রেমলিন থেকে এখুনি। ডেকে পাঠানো হয়েছে আমাকে।
ভাল।
কি বললেন? গর্জে উঠলেন অ্যাডমিরাল মিঝিরিভস্কি।
এই সতর্কতার প্রয়োজন আছে, কঠিন সুরে বলল কর্নেল বলটুয়েভ। তুরুপের তাসটা এবার ছাড়ল সে, এন.পি.সেভেনটিন থেকে ইভেনকো রুস্তভ পালিয়েছে, বুঝলেন? ভাববেন না শুধু মগজটা নিয়ে যাচ্ছে। এইমাত্র জানতে পারলাম, গেল হপ্তায় আমি মস্কোয় থাকার সময় ইভেনকো সিকিউরিটি রুমে ঢুকে দুঘণ্টা ছিল। আমার ধারণা, মেরিলিন চার্টের ফটো তুলেছে। আমাদের গোটা আন্ডারওয়াটার সিস্টেমের ব্লু-প্রিন্ট সাথে নিয়ে যাচ্ছে সে।
ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেলেন অ্যাডমিরাল মিঝিরিভস্কি। শান্ত গলায় জানতে চাইলেন ইভেনকোকে ফিরিয়ে আনার জন্যে কর্নেলের কি কি সাহায্য দরকার। কর্নেলের উত্তর শুনে চোখ। কপালে উঠল তাঁর।
ক্যারিয়ার নার্ভা, ট্রলার ফ্লীট এম.সিক্সটি-নাইন, আর রিসার্চশিপ রিগার সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব, বলল কর্নেল। পার্সোনাল কন্ট্রোল।
কি বলছেন! আপনি জানেন এ-ধরনের কোন দৃষ্টান্ত নেই!
এ-ধরনের পরিস্থিতিরও কোন দৃষ্টান্ত নেই, ঝঝের সাথে বলল কর্নেল। ফার্স্ট সেক্রেটারি ইচ্ছে করলে অনুমতি দিতে। পারেন, সেজন্যেই আপনি ক্রেমলিনে যাচ্ছেন বলে আমি খুশি।
প্রথম সুযোগেই আবার যোগাযোগ করব, থমথমে গলায় বললেন অ্যাডমিরাল মিঝিরিভস্কি। ইতিমধ্যে আপনি প্রস্তুতি নিতে থাকুন।
আমার প্রস্তুতি নেয়া শেষ, বলে ঘটাং করে রিসিভার রেখে দিল কর্নেল। ফার্স্ট সেক্রেটারির সাথে বিশেষ খাতির আছে তার, কাজেই চীফকে তেমন গ্রাহ্য করে না সে।
ঘরে ঢুকল জুনায়েভ। খবরের আশায় আগ্রহের সাথে মুখ তুলে তাকাল কর্নেল। বলল, তৈরি হও, জুনায়েভ। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আর্কটিকে পৌঁছব আমরা।
.
নিজের অফিসেই একটা বিছানা পেতে নিয়েছেন জেনারেল ফচ। রোববার রাত একটায় ঘড়ির অ্যালার্ম শুনে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। মাথার আর দোষ কি, চব্বিশ ঘণ্টায় দুঘণ্টা ঘুমালে ব্যথা তো করবেই।
দশ মিনিট পর দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকল টমাস। হেলসিঙ্কি থেকে এখনও কোন খবর নেই, বলল সে। চেহারা থমথম করছে। প্লেন লেট হতে পারে—এখনও আমি আশা করছি ডকিনস বেরিয়ে আসতে পারে।
তারমানে আমরা অপেক্ষা করব?
হ্যাঁ।
সেটা ভুলও হতে পারে, মাথা চুলকালেন জেনারেল। অথচ করারও আমাদের তেমন কিছু নেই। কে জানে, ইভেনকো হয়তো এরইমধ্যে বরফ পাড়ি দিতে শুরু করেছে। আচ্ছা, আই.আই.ফাইভে তো আমরা একটা প্লেন পাঠাতে পারি, পারি না?
কিন্তু…
সহকারীকে থামিয়ে দিয়ে জেনারেল বললেন, জানি। ইভেনকো রওনা না হয়ে থাকলে আই.আই.ফাইভে প্লেন দেখে রাশিয়ানরা সতর্ক হয়ে উঠবে।
যে লোক মারা গেছে তার কাছ থেকে মেসেজ পাবার অপেক্ষায় ছটফট করছে ওরা। ওদিকে কর্নেল বলটুয়েভ দূর-দৃষ্টির পরিচয় দিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া শেষ করেছে। গোটা পরিস্থিতিটা যেন অনেকটা এরকম: খেলা শুরু হবার আগেই জিততে শুরু করেছে সে।
.
রোববার দুপুরে কর্নেল বলটুয়েভের অফিসে পায়ের ধুলো দিলেন সোভিয়েত কমুনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি। সাথে অ্যাডমিরাল মিঝিরিভস্কি।
ফার কোর্ট খোলার পর দেখা গেল গাঢ় রঙের বিজনেস সুট পরে আছেন ফার্স্ট সেক্রেটারি। কোন রকম ভণিতা না করে সরাসরি আলোচনা শুরু করলেন তিনি। বলটুয়েভ, ট্রলার ফ্লীটের। ছটা জাহাজ, হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার নার্ভা, আর রিসার্চ শিপ রিগার সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব তোমার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ওগুলোর তৎপরতা দেখে কোনমতেই যেন মনে না। হয় মিলিটারি অপারেশন শুরু করেছি আমরা। কি বলতে চাইছি, বুঝতে পারছ?
অবশ্যই কোন ইন্টারন্যাশনাল ইনসিডেন্ট ঘটা চলবে না।
ঠিক তাই, কোন ইন্টারন্যাশনাল ইনসিডেন্ট নয়, ভারী গলায় বললেন ফার্স্ট সেক্রেটারি। মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মস্কোয় আসার কথা, আমি চাই তিনি আসুন-কাজেই খুব সাবধান।
কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকসিডেন্ট ঘটতেই পারে, ফিসফিস করে বলল কর্নেল বলটুয়েভ। এলাকাটা আমি চিনি, সব কিছুই ঘটতে পারে ওখানে। খোলা ফাটলে পড়ে যেতে পারে মানুষ, তুষার ঝড়ে পথ হারাতে পারে…
ট্রাফিক পুলিসের মত হাত তুললেন ফার্স্ট সেক্রেটারি। সব। খুলে বলার দরকার নেই, প্লীজ। আমি জানি, ইনসিডেন্ট আর। অ্যাকসিডেন্টের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কিভাবে কি। করবে, তুমি জানো-ওটা তোমার জগৎ। তাঁর ঘন ভুরু কুঁচকে উঠল। কিন্তু আমার কাছে তুমি শুধু একটা ব্যাপারে দায়ী। থাকবে-ইভেনকো। সে বা মেরিলিন চার্ট যেন ওয়াশিংটনে না পৌছায়। গোটা ব্যাপারটার গুরুত্ব কতখানি তোমাকে বোঝাবার জন্যেই লেনিনগ্রাদে আমার আসা।
আমেরিকানদের চেয়ে তিন চাল এগিয়ে আছি আমরা, জবাবে বলল কর্নেল।
এগিয়ে থাকতেও হবে, বললেন ফার্স্ট সেক্রেটারি, অ্যাডমিরাল মিঝিরিভস্কির দিকে তাকালেন তিনি। অ্যাডমিরালের হাতে একটা লেদার ফোল্ডার দেখা গেল। জাহাজগুলোর সাথে যোগাযোগ করার জন্যে কোড আর ওয়েভলেংথ রয়েছে। অ্যাডমিরালের কাছে। এরইমধ্যে ওগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকার দিকে রওনা হতে বলা হয়েছে।
আমিও এখুনি রওনা হতে চাই, অ্যাডমিরালের হাত থেকে ফোল্ডারটা নিয়ে বলল কর্নেল। তা না হলে দেরি হয়ে যাবে…
ফার্স্ট সেক্রেটারি কর্নেলের একটা হাত চেপে ধরলেন, বললেন, পয়মাল, অর্ডার নয়, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, ইভেনকোকে ফিরিয়ে আনো-ভরাডুবি থেকে বাঁচাও রাশিয়াকে।
.
রোববার, বিশে ফেব্রুয়ারি, বিকেল তিনটেয় মারমানস্ক থেকে বাইসন বম্বারে চড়ে রওনা হয়ে গেল কর্নেল বলটুয়েভ। সাথে সহকারী নিকিতা জুনায়েভ ছাড়াও ফার-কোট পরা পঞ্চাশজন লোক থাকল। ওরা খালি ডেকে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছে, প্রত্যেকের সাথে একটা করে রাইফেল। বম্বারে চড়েই একটা ম্যাপ খুলে বসল কর্নেল, আমেরিকান আইসব্রেকার কিউটের অবস্থান চিহ্নিত করা আছে তাতে।
বিকেলের আকাশে মেঘ নেই, চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে প্রকৃতি। ছুটে চলল বম্বার। গন্তব্য: এন.পি.সেভেনটিন। হেলসিঙ্কি থেকে এখনও কোন খবর নেই। পাশের সীটে বসে জেনারেল ফচের হাতে একটা মেসেজ ধরিয়ে দিল টমাস। এইমাত্র এল। আমার মনে হচ্ছে ডকিনসের কিছু একটা। ঘটেছে…
সে তো আমি ঘণ্টা কয়েক আগেই সন্দেহ করেছি। কাগজটার দিকে জেনারেল তাকালেন কি তাকালেন না, বললেন, ডকিনস বা তার মেসেজ কোন দিনই আর পেঁৗছুবে না-বাজি ধরবে?
পরিহাস ছাড়া আর কি বলা যায়, কর্নেল বলটুয়েভই সতর্ক করে দিয়েছে জেনারেল ফচকে। গত চার ঘণ্টা ধরে জাহাজ, ওয়েদার প্লেন, আর উপগ্রহ থেকে একের পর এক রিপোর্ট। আসছে, প্রতিটি রিপোর্ট থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে আর্কটিক এলাকায় বিরাট কিছু একটা করতে যাচ্ছে রাশিয়ানরা।
প্রথমে জেনারেল শুনলেন, সোভিয়েত হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার। নার্ভা কোর্স বদলেছে, এখন সেটা ফুল স্পীডে ছুটছে উত্তরে, আইসফিল্ডের দিকে। এক ঘণ্টা পর খবর এল ট্রলার ফ্লীট এম.সিক্সটি-নাইন-এর ছয়টা জাহাজ, গাদা গাদা ইলেকট্রনিক গিয়ার নিয়ে কোর্স বদলে উত্তর দিকে যাচ্ছে, অথচ আগে পাওয়া। খবর অনুসারে ন্যাটোর ওয়াটার কিং-এর ওপর নজর রাখার কথা ওটার। শেষ খবরটা আরও চাঞ্চল্যকর-বিশাল সোভিয়েত রিসার্চ শিপ রিগাও কোর্স বদলেছে। টমাস তাঁকে জানাল, রিগা। আইসবার্গ অ্যালি-র দিকে যাচ্ছে।
এরপর আর চুপ করে থাকা যায় না, জরুরী একটা ফোন করলেন তিনি। ত্রিশ মিনিট পর চশমা পরা সুবেশী এক লোক ঢুকল তার অফিসে। প্রেসিডেন্টের সহকারী, একান্ত বিশ্বস্তদের একজন, বাধা না দিয়ে ঝাড়া পনেরো মিনিট জেনারেলের কথা চুপচাপ শুনে গেল। সবশেষে জেনারেল বললেন, কলিন, এই হলো পরিস্থিতি। মস্কোয় শীর্ষ বৈঠকে বসার সময় প্রেসিডেন্টের পকেটে যদি মেরিলিন চার্ট থাকে, সব দিক থেকে ফলাফল আমাদের অনুকূলে থাকবে। সঙ্গত যেটুকু কনসেশন আমরা চাইব, রাশিয়া অন্তত গোয়ার্তুমি করে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না…
প্রেসিডেন্টের সাথে তিন মিনিট কথা বলল সহকারী। রিসিভার রেখে দিয়ে জেনারেলকে বলল সে, আপনি যা ভাল বুঝবেন করবেন। সময় না থাকলে ওয়াশিংটন কি সিদ্ধান্ত দেয় তার জন্যে অপেক্ষা করার দরকার নেই। শুধু একটা ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, কোন রকম ইন্টারন্যাশনাল ইনসিডেন্ট যেন না ঘটে। তাহলে শীর্ষ বৈঠক বানচাল হয়ে যেতে পারে।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন জেনারেল, পাশের সীট থেকে টমাস তাকিয়ে আছে লক্ষ করে হাতের মেসেজটার কথা মনে পড়ল তার।
খুক করে কেশে টমাস বলল, হঠাৎ করে কোত্থেকে ঘন কুয়াশা এসে ঢেকে ফেলেছে আই.আই.ফাইভকে। গম্ভীর দেখাল তাকে। রানার জন্যে খুব কঠিন হয়ে গেল কাজটা।
রিপোর্টটা পড়া শেষ করে সীট-স্ট্রাপ বাঁধলেন জেনারেল ফচ। বোয়িং নামছে। গন্তব্য ছিল কার্টিস ফিল্ড। পৌঁছে গেছে বিমান।