মরণখেলা: ১.৪ কুণ্ডলী পাকিয়ে তুষারের ওপর

মরণখেলা: ১.৪ কুণ্ডলী পাকিয়ে তুষারের ওপর

১.৪ কুণ্ডলী পাকিয়ে তুষারের ওপর

কুণ্ডলী পাকিয়ে তুষারের ওপর পড়ে আছে রানা। জ্ঞান ফিরে এলেও প্রচণ্ড ব্যথায় মাথা তুলতে পারছে না। ফর্সা, ভরাট একটা হাসিখুশি মুখ ঝুঁকে আছে ওর ওপর। হাতের ফ্লাস্কটা রানার ঠোঁটের কাছে ধরল সে। এক ঢোক খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, রানা।

ধীরে ধীরে চোখ মেলল রানা, কনুইয়ে ভর দিয়ে উঁচু করল মাথা। সব ঝাপসা, কণ্ঠস্বর চিনতে পারলেও লোকটাকে পরিষ্কার দেখতে পেল না। মুখ খুলল, খানিকটা ব্র্যান্ডি চালান করে দিল পেটে। প্রায় সাথে সাথে কেটে গেল ঝাপসা ভাব। লম্বা করে হিম। বাতাস টানল কয়েকবার। ব্র্যান্ডির চেয়ে বেশি কাজ হলো তাতে। সরো, বিনয়… নিজেই উঠে বসল রানা, তারপর দাঁড়াতে চেষ্টা করল।

আরেকটু বিশ্রাম নিয়ে…

তবু দাঁড়াল রানা, দাঁড়িয়ে টলতে লাগল। পড়ে যাচ্ছে, হাত বাড়িয়ে ধরে সিধে হতে সাহায্য করল বিনয়। জনসনের জীপ কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে রানার মনে পড়ল চাবিটা তুষারে ফেলে দিয়েছিল সে। আরও খানিক দূরে আরেকটা জীপ দেখা গেল-উইন্ডস্ক্রীনের কাঁচ ফেটে গেছে, সামনের ডান দিকের টায়ার বসে পড়েছে। কোন দিকে গেল জনসন?

এয়ারফিল্ডের দিকে…ব্যাপারটা কি, রানা? জনসন আমাকে গুলি করছে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম…

সে-ই কাঁকড়া-সিকিউরিটি লিক। এয়ারফিল্ডের দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখল না রানা। কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখানে গেট, গেটের পাশে গার্ড-পোস্ট, খানিক দূরে কমলা রঙের স্নোপ্লাউ, আরও সামনে হ্যাঙ্গার। জনসনের ছায়া পর্যন্ত নেই কোথাও।

বিনয় প্রথমে ভেবেছিল রানা মারা গেছে। কিন্তু ওকে নড়তে দেখে নিজের অজান্তেই হাসতে শুরু করে সে। সিকিউরিটি লিক সম্পর্কে একটা গুজব অবশ্য আমরাও শুনেছি। তোমাকে নিতে আসতে দেরি করে ফেলি আমি, পাইলট বলল জনসন তোমাকে জীপে করে নিয়ে গেছে… হঠাৎ বোকা লাগল নিজেকে, এত কথা কাকে বলছে সে?

বাতাসের গতিতে এয়ারফিল্ডের দিকে ছুটছে রানা। পিছু নিল বিনয়। বলল, তার পালাবার কোন উপায় নেই। তোমার প্লেন ল্যান্ড করার ঠিক আগে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছে টেনিসন। বেস সীল করে দেয়া হয়েছে…

তুমি জানো জনসন কপ্টার চালাতে জানে না? পাল্টা চিৎকার করল রানা। বিনয় ভাবল, মাথায় দগদগে ঘা নিয়ে, সদ্য জ্ঞান ফেরা একজন লোক এত জোরে কিভাবে দৌড়ায়?

মাথার ক্ষতটা দপ দপ করছে, বসে পড়তে ইচ্ছে করছে রানার। প্রচণ্ড রাগ আর জেদের বসে ছুটে চলেছে ও। হতে পারে জনসন রাশিয়ান স্পাই, কিন্তু ওর সাথে তার কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই-তবু ওকে মারল কেন সে? ও যদি মারা যেত?

না, এই লোককে ছাড়া যায় না।

নির্জন গার্ড-পোস্ট। খানিকটা দূরে থাকতে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। হাঁপাতে হাঁপাতে পাশে চলে এল বিনয়।

রিভলভার আছে তোমার কাছে? গুড। রিভলভারটা বিনয়ের হাত থেকে ছোঁ দিয়ে তুলে নিল রানা। পিছনে থাকো!

হাতে উদ্যত কোল্ট পয়েন্ট ফরটিফাইভ নিয়ে সাবধানে গার্ড। পোস্টের দিকে এগোল রানা। ঘরটা কংক্রিটের, সামনে তুষারের। ওপর চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছে মানুষের একটা আকৃতি। আরও কাছে এসে চিনতে পারল রানা। একজন মার্কিন সৈনিক কারবাইনটা এখনও আঁকড়ে ধরে আছে। বুকের কাছে পারকায় এরই মধ্যে জমাট বেঁধে গেছে রক্ত। জানে বেঁচে নেই, তবু পালস দেখে নিশ্চিত হলো রানা।

খুব সহজেই কাজটা সারতে পেরেছে জনসন। জরুরী অবস্থা ঘোষণা করার মানে হলো কেউই এয়ারফিল্ডে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু জনসন ক্যাম্পের সিকিউরিটি চীফ, তাকে আসতে দেখে। কিছুই সন্দেহ করেনি গার্ড। জনসন জানত, সিকিউরিটি চীফ হলেও কথায় চিড়ে ভিজবে না, তাই বাধা দূর করার জন্যে একেবারে কাছে এসে গুলি করেছে সে। এয়ারফিল্ডে পৌঁছে গেছে, বিনয় কাছে আসতে বলল রানা। বেড়ার ওদিকে তাকিয়ে। কিছুই নড়তে দেখল না। হ্যাঙ্গারে কপ্টার কাছে, তারই একটা। নিয়ে পালাবে। এসো!

দুজন গার্ড আছে হ্যাঙ্গারে, দ্রুত বলল বিনয়। গার্ড-পোস্ট থেকে ফোন করতে পারি আমরা…

গার্ড-পোস্টের ভেতরে ঢুকতে হলো না, বাইরে থেকেই দেখা গেল ফোনের তার ভেঁড়া। ছুটে এগোল রানা, তারপর থমকে দাঁড়িয়ে দুধ-সাদা বিস্তারের দিকে তাকিয়ে থাকল। এয়ারফিল্ডের কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। গেল কোথায়! পরমুহূর্তে দৃষ্টি কেড়ে নিল স্নো-প্লাউটা।

এখন ওটা ছোট দেখাচ্ছে, কমলা রঙের ছারপোকার মত গুটি গুটি এগিয়ে যাচ্ছে হ্যাঙ্গারের দিকে। চিৎকার করে লাভ নেই, এতদূর থেকে শুনতে পাবে না গার্ডরা। আবার ছুটতে শুরু করল রানা। বিনয়ের পায়ে বুট থাকলেও, রানা এখনও রাবার-সোল লাগানো জুতো পরে রয়েছে। সমতল বরফ লোহার মত শক্ত, দৌড়াতে কোন অসুবিধে হলো না। কয়েক মিনিট প্রাণপণে দৌড়াবার পর হ্যাঙ্গারের কাছাকাছি এসে পিছলে গেল পা, দড়াম করে আছাড় খেলো রানা। বিনয় কাছে পৌঁছুবার আগেই দাঁড়াতে পারল বটে, কিন্তু হাঁটতে গিয়ে দেখল ব্যথা করছে, রিভলভারটা কোথায় পড়েছে খুঁজে পাচ্ছে না।

আলগা খানিকটা বরফের ভেতর অর্ধেক মুখ লুকিয়ে রয়েছে রিভলভার, দেখতে পেয়ে তোলার জন্যে ঝুঁকল রানা, যান্ত্রিক একটা গুঞ্জন শুনে শিরশির করে উঠল ঘাড়ের পিছনটা। হ্যাঙ্গারের ভেতর হেলিকপ্টারের এঞ্জিন চালু হয়ে গেছে।

হাতে রিভলভার নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটল রানা, হ্যাঙ্গার এখনও দুশো গজ দূরে। পিছনে থাকো!

হ্যাঙ্গারের মুখের কাছাকাছি পার্ক করা রয়েছে প্লাউটা, বিদ্যুৎ চালিত বিশাল দরজাটা এখন খোলা। হ্যাঙ্গারের মুখ প্রকাণ্ড কালো একটা গহ্বর। মুখ থেকে দশ গজ দূরে রানা, এইচ-নাইনটিন সিকোরস্কি গাঢ় ছায়ার ভেতর থেকে চাঁদের আলোয় বেরিয়ে এল। বন বন করে ঘুরছে ব্লেডগুলো। তুষার আর বরফের কুচি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, দ্রুত রানার দিকে ধেয়ে এল যান্ত্রিক ফড়িংটা।

দুপা একটু ফাঁক করে শক্ত হয়ে দাঁড়াল রানা। লক্ষ্য যাতে ব্যর্থ না হয়, দুহাতে রিভলভার ধরেছে ও। দশ সেকেন্ডের মধ্যে ওকে পিষে এগিয়ে যাবে হেলিকপ্টার। ককপিটের দিকে রিভলভার তাক করেছে রানা, হেলমেট পরা পাইলটের কাঁধ আর মাথা ঝাপসা লাগল চোখে। বুক ভরে বাতাস টানল ও, তারপর ট্রিগার টেনে দিল। ক্লিক আওয়াজটা শুনতে পেল না, অনুভব করল-কপ্টারের গর্জন হাতুড়ির বাড়ির মত ঘা মারছে কানে। ফায়ারিং মেকানিজম কাজ করছে না, গুলি বেরুবে না।

লুক আউট! বিনয়ের আর্তনাদ যান্ত্রিক আওয়াজের ভেতর। হারিয়ে গেল।

কপ্টারটাকে সোজা রানার দিকে ছুটিয়ে আনল জনসন। একপাশে ডাইভ দিল রানা, বরফে কাঁধ দিয়ে পড়ল, পড়েই গড়িয়ে দিল শরীরটাকে। অশরীরী গর্জন গ্রাস করল ওকে। খক খক করে উঠল মটর, বদলে গেল আওয়াজটা। শেষ গড়ানটা দিয়ে মুখ তুলে রানা দেখল এরইমধ্যে ছয়-সাত মানুষ উঁচুতে উঠে গেছে। কপ্টার। বসল রানা, হাঁটুর ওপর দাঁড়িয়ে কাপড় থেকে তুষার আর বরফের কুচি ঝাড়ল। পাশে এসে দাঁড়াল বিনয়। রানার দৃষ্টি অনুসরণ করে স্নো-প্লাউটার দিকে তাকাল সে। প্লাউ-এর ব্লেডের। তলায় অর্ধেক বেরিয়ে আছে লোকটা, গার্ডদের একজন। এই। খুনটাও খুব সহজে সারতে পেরেছে জনসন। গ্রীনল্যান্ড এয়ারফিল্ডের স্নো-ব্লাউ কোন অপরিচিত জিনিস নয়, ওটাকে। এগিয়ে আসতে দেখে হ্যাঙ্গার থেকে বেরিয়ে আসে গার্ড। স্নোপ্লাউটা সোজা তার ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয় জনসন।

হ্যাঙ্গারের ভেতর ঢুকে হোঁচট খেলো রানা। আরেকটু হলে। দ্বিতীয় গার্ডের লাশের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ত। ঠিক কি ঘটেছে। কল্পনা করতে পারল ও। এক ছুটে হ্যাঙ্গারের ভেতর ঢুকে চিৎকার জুড়ে দেয় জনসন, ভয়ঙ্কর একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে গেছে! তাকে। পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে ছুটেছিল লোকটা, জনসন ঘ্যাঁচ করে তার পিঠে আমূল ঢুকিয়ে দিয়েছে ছোরা।

টর্চের আলোয় ওরা দেখল, পিঠের ওপর শুধু ছোরার হাতলটা বেরিয়ে আছে। কোল্ট ফেলে দিয়ে নিহত সৈনিকের কারবাইনটা তুলে নিল রানা। তারপর আবার ছুটল।

হ্যাঙ্গারের পিছন দিকে, হুড পরানো ল্যাম্পের নিচে, আরেকটা হেলিকপ্টার রয়েছে। দেয়ালের সুইচবোর্ড থেকে একটা ইলেকট্রিক কেবল নেমে এসে মেশিনের ভেতর ঢুকেছে, কপ্টারের মটরকে গরম রাখার জন্যে। প্লাগ থেকে কেবল খুলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল রানা, দরজা খুলে কেবিনে ঢুকল। পিছু পিছু এল বিনয়।

কোন লাভ আছে? জিজ্ঞেস করল সে।

হেলমেট আর হেডসেট পাইলটের সীটেই থাকে, পারকা খুলে ফেলে সেগুলো পরল রানা। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি। ওর সামনে ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেল-রাডার অলটিমিটার, ফুয়েল গজ, রেভ কাউন্টার, ইত্যাদি। কালেকটিভ স্টিক, কপ্টারের ওপরে ওঠা নিয়ন্ত্রণ করে, ওর বাঁ দিকে। সাইক্লিক কন্ট্রোল স্টিক, ফ্লাইটের দিক বদল নিয়ন্ত্রণ করে, ওর ডান দিকে। টুইস্ট-গ্রিপ থ্রটল, দেখতে অনেকটা মটরসাইকেল থ্রটলের মত, কালেকটিভ স্টিকটাকে আঙটার মত ঘিরে আছে। মটর চালু করল রানা।

গোটা কেবিন কেঁপে উঠল, শব্দের বিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়ল হ্যাঙ্গারের চারদিকে। মাথার ওপর রোটর ব্লেডগুলো থেমে থেমে ঘুরছে-স্টার্ট নেয়, থামে, স্টার্ট নেয়, থামে। তারপরই বাড়তে শুরু করল ইঞ্জিনের শক্তি। কংক্রিটের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে গড়াতে শুরু করল চাকা।

হ্যাঙ্গার থেকে বেরিয়ে এল সিকোরস্কি। সেই সাথে দেখা গেল প্রায় তারার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া রাডার মাস্ট। থ্রটল ব্যবহার। করল রানা। হিম বাতাস কেটে পঞ্চাশ ফিট রোটর বন বন করে ঘুরছে, আওয়াজ শুনে মনে হলো যে-কোন মুহূর্তে কপ্টার থেকে। ছিড়ে বেরিয়ে যাবে ওগুলো। গোটা মেশিন থরথর করে কাঁপছে। কয়েক সেকেন্ড পর বরফ ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়ল সিকোরস্কি।

কাঁটাতারের ওপর দিয়ে উড়ে আসার সময় গার্ড-পোস্টের কাছে একটা গাড়ি দেখল ওরা। হেডলাইটের আলোয় গার্ডের লাশ। দেখছে কয়েকজন লোক। তাদের একজন রাইফেল তুলল আকাশের দিকে।

হেলমেট আর হেডসেট পরে রানার পাশে অবজারভারের। সীটে বসেছে বিনয়, মাউথপীসে কথা বলল সে, ওকি! ওরা গুলি করছে কেন!

এঞ্জিনের শব্দকে ছাপিয়ে উঠল রাইফেলের আওয়াজ। কেন আবার, হেলিকপ্টার নিয়ে দ্রুত আরও ওপরে উঠছে রানা। মরিসনের ধারণা এখানে জনসন আছে।

প্রায় খাড়াভাবে উঠে রাইফেল রেঞ্জের বাইরে চলে এল ওরা। দিগন্তে প্রথম সিকোরস্কির কোন হদিস নেই। পুব দিকে কোর্স।

বদল করল রানা, ওর ধারণা ওদিকেই যাবার কথা জনসনের।

মরিসন কে?

এফ.বি.আই. এজেন্ট, বলল রানা। কাঁকড়াকে গ্রেফতার করতে এখানে আসা তার। কথা ছিল বোয়িং থেকে নেমে কমান্ডার টেনিসনকে নিয়ে সরাসরি ক্যাম্পে যাবে সে, তারপর আমাকে নিয়ে জনসন ক্যাম্পে পৌঁছুলে একটা বৈঠকে বসা হবে। মরিসনের ধারণা ছিল, কয়েকজনকে জেরা করলেই কাঁকড়ার আসল পরিচয়। ফাঁস হয়ে যাবে। পুব দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় গোটা আকাশ ফাঁকা দেখল রানা।

কী ঘটল?

মরিসনকে দেখেই যা বোঝার বুঝে নেয় জনসন, বলল রানা। জরুরী অবস্থা ঘোষণা করায় সন্দেহ তার আগেই হয়েছিল। কাজেই কেটে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।

ওদিকে, রানা! হঠাৎ চিৎকার করে উঠল বিনয়। উত্তরে!

বাঁ দিকে তাকাল রানা। আরও অসংখ্য আইসক্যাপনির্জন, ঠাণ্ডা, ফাঁকা। তারপর চোখে পড়ল। জনসনের কপ্টার, আন্দাজ করল রানা, দশ মাইল দূরে। বরফ থেকে খানিকটা উঁচুতে, আবছা অন্ধকারে দ্রুত ধাবমান আলোর একটা নিবু নিবু কম্পন। স্পীড বাড়িয়ে দিল রানা। কয়েক সেকেন্ড পর বরফের ওপর প্রথম হেলিকপ্টারের ছায়া দেখল ওরা। কোর্স বদল করল রানা। শুরু হলো ধাওয়া।

তোমার মেসেজ পেয়ে আমরা কিন্তু…

হ্যাঁ, মেসেজে সব কথা বলা সম্ভব ছিল না, বিনয়কে থামিয়ে দিয়ে বলল রানা। বলতে পারো, এই অ্যাসাইনমেন্টে আমেরিকাকে, সোজা কথায় সি.আই.এ-কে আমরা পাল্টা আঘাত করতে যাচ্ছি।

হোয়াট!

সব শুনলে বুঝতে পারবে। সংক্ষেপে, কিন্তু কিছু বাদ না দিয়ে যা যা ঘটেছে সব বলে গেল রানা।

রানা থামতে বিনয় বলল, রাশিয়ানরাও চাইছে ইভেনকো রুস্তভকে আমরা নিয়ে আসি, তারমানে ওরা আমাদের বাধা দেবে না…?

বাধা দেবে, তবে সেটা হবে লোক-দেখানো-অন্তত আমি। তাই আশা করছি, অন্যমনস্কভাবে বলল রানা। মনে মনে ভাবল, ওরাও কোন পঁাচ কষছে কিনা সময়েই তা জানা যাবে।

কিন্তু রানা, অবাক হলো বিনয়, রুশদের আমরা সাহায্য করছি, তাই না? তাই যদি হয়, জনসনকে পালিয়ে যেতে দিলেই। তো পারি! ধরার দরকারটা কি!

সাহায্য আমরা কে.জি.বি-কে করছি বিনয়, ভুলটা ধরিয়ে। দিয়ে বলল রানা। জনসন কে.জি.বি. এজেন্ট নয়, স্পেশাল সিকিউরিটি সার্ভিসের লোক। স্পেশাল সিকিউরিটি অতীতে আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে, সুযোগ পেলে ভবিষ্যতেও করবে। তাছাড়া, জনসনের সাথে এটা আমার ব্যক্তিগত বোঝাপড়া।

গম্ভীর এবং চিন্তিত দেখাল বিনয়কে। ব্যাপারটা জটিল। লাগছে, রানা। আমার জানা মতে, কে.জি.বি. আর এস.এস.এস. দুটো প্রতিষ্ঠানই যার যার গোপন ব্যাপারে অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর, কেউ কাউকে কোন তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে চায় না। জন মিলার, যে তোমাকে ইভেনকো রুস্তভকে এন.পি. সেভেনটিন থেকে নিয়ে আসার অনুরোধ করেছে, সে কে.জি.বি-র লোক, কিন্তু আর্কটিকে রুশ ঘাঁটিগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে স্পেশাল সার্ভিস।

আর্কটিকে স্পেশাল সার্ভিস কাজ করছে তা সত্যি, বলল রানা। কিন্তু দেশ-বিদেশের সমস্ত ব্যাপারে নাক গলাবার অধিকার রয়েছে একমাত্র কে.জি.বি-র। কে.জি.বি. নির্দেশ দিলে সেটা স্পেশাল সার্ভিস মানতে বাধ্য।

বিনয় আর কিছু বলল না বটে, কিন্তু কাঁধ কঁকিয়ে অসহায় ভাব প্রকাশ করল। রানার কোল থেকে নাইটগ্লাসটা তুলে নিয়ে চোখে চেপে ধরল সে। এখনও উত্তর দিকেই যাচ্ছে জনসন।

জনসনের হেলিকপ্টার কখনও রানা দেখছে কখনও দেখছে।, তবে বরফের ওপর ছায়াটা একবারও হারায়নি। সম্ভবত হামবোল্ডট গ্লেসিয়ারের দিকে যাচ্ছে ও। কারণটা বুঝছি না। পুবদিকে গেলে উপকূল পেত। কোথাও থেকে ফিরে এসে ল্যান্ড করার সাথে সাথে ট্যাংক ভরে দেয়া হয়, কাজেই ফুয়েল কোন সমস্যা হবার কথা নয়। হামবোল্টট গ্লেসিয়ারে কি আছে!

ওদিকে কোথাও হয়তো একটা ট্রান্সমিটার লুকানো আছে, বলল বিনয়।

সম্ভব, বলল রানা। তা যদি থাকে, লেনিনগ্রাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে ও।

কর্নেল পয়মাল বলটুয়েভের সাথে?

লোকটা আমার সম্পর্কে জানে, তিক্ত একটু হাসি ফুটল। রানার ঠোঁটে। আমিও তার সম্পর্কে জানি। কেউ আমরা কাউকে দেখিনি। অথচ স্পেশাল সিকিউরিটির প্রতিটি এজেন্টের ওপর কর্নেল বলটুয়েভের নির্দেশ আছে, আমাকে দেখা মাত্র খুন করতে হবে। পুরস্কার-একসাথে তিনটে প্রমোশন।

তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বিনয় জিজ্ঞেস করল, কারণ?

রাশিয়া থেকে আমার মিগ-একত্রিশ নিয়ে আসাটাকে সবাই সহজভাবে নেয়নি, বিনয়, বলল রানা। কর্নেল বলটুয়েভের ধারণা, রুশ এয়ারফোর্স, রুশ সামরিক বাহিনী, এক কথায় গোটা রুশ জাতিকে দুনিয়ার চোখে আমি ছোট করেছি।

খানিক গুম হয়ে থাকার পর বিনয় জিজ্ঞেস করল, তাহলে। জনসন তোমাকে সুযোগ পেয়েও খুন করল না কেন?

হেসে উঠল রানা। কে বলল চেষ্টা করেনি?

বাঁট দিয়ে মাথায় না মেরে গুলি করলেই তো পারত!

তোমার রিভলভারের ট্রিগার আমিও তো টানলাম, কিন্তু গুলি কি বেরুল? জিজ্ঞেস করল রানা। ভুলে যেয়ো না, এটা গ্রীনল্যান্ড, বিলো ফরটি ডিগ্রী টেমপারেচার। ট্রিগার টানার পর গুলি নাও। বেরুতে পারে, জানত জনসন-জানত, তারপর আর সুযোগ পাবে না সে, ওকে কাবু করে ফেলব আমি। তাই কোন ঝুঁকি নিতে। চায়নি। প্রথমে আমাকে আহত করাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেছিল।

বুঝেছি! তোমাকে আহত করে বরফে নামিয়ে গুলি করতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি পৌঁছে গেছি দেখে সুযোগটা হারায়।

রানা কিছু বলল না।

বিনয় আবার বলল, তারমানে গোটা অ্যাসাইনমেন্টের চেহারা। বদলে যাচ্ছে। কে.জি.বি-র নির্দেশ যদি পেয়ে থাকে কর্নেল। বলটুয়েভ, ইভেনকো রুস্তভকে আমেরিকায় পালিয়ে আসতে দেবে সে। কিন্তু তোমাকে খুন করার সুযোগ হাতছাড়া করবে না।

রানা বলল, আমারও তাই বিশ্বাস।

.

ওদের হেলিকপ্টার যত কাছাকাছি হলো, ধীরে ধীরে উন্মোচিত হলো বিস্ময়কর হামবোল্টট গ্লেসিয়ার। বহু উঁচু আইসক্যাপ থেকে বিশাল এক নদী বিস্তৃত হয়ে নেমে এসেছে অনেক নিচের খাড়িতে, চকমকে বরফ নিয়ে আধ মাইল চওড়া একটা নদী, চাঁদের আলোয় সহস্র ফাটল ধরা স্ফটিকের বিস্তার যেন। আইসক্যাপ থেকে প্রায় খাড়াভাবে নেমেছে ওটা, তারপর বরফ-প্রাচীরের মাথা থেকে জলপ্রপাতের আকৃতি নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে কয়েকশো ফিট নিচের খাঁড়িতে পড়েছে। আরও কাছে এসে ওরা দেখল, বরফের খাড়া পাঁচিল ঘেরা খাঁড়ির নিচে, নিরেট তীরের কাছাকাছি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেকগুলো আইসবার্গ। এরই মধ্যে জনসনের হেলিকপ্টার ল্যান্ড করেছে, গ্লেসিয়ারের পাশের একটা ছোট বরফ-পাহাড়ের মাথায়। কিন্তু জনসনকে কোথাও দেখল না ওরা। তৃতীয়বারের মত অদৃশ্য হয়েছে সে।

বসে থাকা কপ্টারকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে রানা। কি জ্বালা, বারবার শুধু হারিয়ে যায়।

হয়তো কপ্টারের ভেতরই ঘাপটি মেরে বসে আছে, বলল বিনয়। আমরা ল্যান্ড করলেই টার্গেট প্র্যাকটিস করবে।

দুশো ফিট ওপরে থেকে চক্কর দিচ্ছে রানা। গ্লেসিয়ারের খাড়া কিনারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচ্ছন্ন বোধ করল ও, বারবার ঘুরে উঠতে চায় মাথা। হঠাৎ কপ্টার একদিকে কাত করল ও। দেখেছি ওকে! বিনয়ের এয়ারফোনে বিস্ফোরিত হলো রানার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। গ্লেসিয়ারের আরও নিচে, ছোট একটা ঢিবির মাথায়। ওই দেখো, নড়ছে…

নামো ঢিবিতে।

পিচ্চি-কিনারা থেকে খসে পড়তে পারি, বলল রানা। তারচেয়ে প্রথমটার পাশেই নামি, তাহলে আর বাছাধনকে পালাতে হবে না। ল্যান্ড করার পর তুমি কিন্তু বেরুবে না। আমাকে। যদি ফাঁকি দেয়, তোমার ওপর দায়িত্ব থাকবে। থিউল-এর সাথে। যোগাযোগ হয় কিনা দেখো দেখি।

পাঁচবার চেষ্টা করেও রেডিও যোগাযোগ সম্ভব হলো না। দরকারের সময়ে যদি কোন কাজে আসে! বিরক্তি প্রকাশ করল রানা। ছোট পাহাড়ের ওপর, প্রথম কপ্টারের কাছ থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে, নিরাপদে ল্যান্ড করল ওরা। প্রথম কপ্টারটাকে কেমন। যেন পরিত্যক্ত লাগল, জনসন যেন ওটার কাছে আর ফিরে আসবে না বলেই গেছে।

সুইচ অফ করল রানা। আশা করি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে। আসতে পারব, বিনয়। দ্রুত পারকাটা পরে নিল ও।

মাথা ঝাঁকাল বিনয়, মনে মনে জানে জনসনের কাছে রাইফেল থাকলে এক ঘণ্টার অনেক আগেই মারা যাবে রানা। কিন্তু অযথা। কথা বলা স্বভাব নয় তার। সে জানে, রানা একটা কাজে যাচ্ছে। কাজটা করতে গিয়ে কি ঘটবে না ঘটবে সেটা তর্ক করার বিষয়। নয়।

কেবিনের ভেতরটা খুব গরম, এক হাতে কারবাইন নিয়ে দরজা খোলার সময় নিজেকে শক্ত করল রানা। এক নিমেষে ঝপ করে নেমে এল টেম্পারেচার-প্লাস ফরটি থেকে মাইনাস ফরটিতে। লাফ দিল রানা, নিরেট বরফ হাতুড়ির বাড়ি মারল পায়ের তলায়। অসাড় করা ঠাণ্ডায় দম বন্ধ হয়ে এল। পারকাটা। গলা পর্যন্ত তুলে বাঁধল ও, হুড দিয়ে মাথা ঢাকল। পিছনে তাড়াহুড়ো করে দরজা বন্ধ করে দিল বিনয়। রানার সাথে কাজ। করার সময় এই নিয়মটা মেনে চলে বিনয় আর নিয়াজ, অযথা কথা বলে এনার্জি নষ্ট করে না। রানার মাথার ওপর ব্লেডগুলো এখন আর ঘুরছে না। আর্কটিক রাতের শীতল নিস্তব্ধতা চেপে ধরল ওকে।

খুদে পাহাড়ের কিনারায় বসে রয়েছে জনসনের হেলিকপ্টার, ছোট ছোট নিঃশ্বাস ফেলে সেটাকে পাশ কাটাল রানা। কিনারায় দাঁড়িয়ে ক্রমশ নিচের দিকে নেমে যাওয়া গ্লেসিয়ারের বিশাল ঢালের দিকে তাকাল ও। গ্লেসিয়ারের আরও অনেক নিচে দ্বিতীয় ঢিবিটা চাদের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল, উল্টো করা পেয়ালা আকৃতির পাথর, মাথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পোঁতা রয়েছে কর্কশ কাঠের কয়েকটা ক্রস চিহ্ন। একটা এস্কিমো কবরের ওপর দাঁড়া মত কি যেন রয়েছে, সেটার ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে জনসন। গ্রীনল্যান্ডে এস্কিমোদের কবর অত্যন্ত পবিত্র জায়গা বলে মনে করা হয়, ডেনিশ কর্তৃপক্ষের কঠোর নির্দেশ কোন অবস্থাতেই কবরের পবিত্রতা নষ্ট করা চলবে না। দাঁড়াটা খাড়া করল জনসন, এতক্ষণে রানা দেখল দাড়া নয়, ওটা আসলে একটা এরিয়াল, বাক্স আকৃতির ট্রান্সমিটার থেকে বেরিয়ে রয়েছে।

গ্লেসিয়ারের পাথরের পাশটা বড় বেশি খাড়া, এ-পথে নিচে নামা রানার পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই গ্লেসিয়ারের বরফ ঢাল বেয়ে নামতে হবে ওকে। হাত দুটো দুপাশে মেলে দিল রানা, এক হাতে কারবাইন। ধীরে ধীরে, টলমল করতে করতে শুরু হলো নামা। চাঁদের আলো যথেষ্ট নয়, এত দূর থেকে গুলি করলে লাগানো প্রায় অসম্ভব। ঢালের গায়ে হাজারো ফাঁদ। নিরেট মনে করে পা ফেলছে রানা, হুস করে তুষারে ডুবে যাচ্ছে গোড়ালি। কোথাও বরফের গা এত মসৃণ আর পিচ্ছিল যে ঘুর পথে এগোতে হলো। ঢালটা সোজাসুজি নেমে যায়নি, কাত হয়ে আছে। একদিকে। একবার যদি পিছলাতে শুরু করে, থামার যো থাকবে না, ঢালের কিনারায় পৌঁছে যাবে, প্রপাতের সাথে কিনারা থেকে। নেমে যাবে কয়েকশো ফিট নিচের খাড়িতে।

রানা সাবধান, তবু যত দ্রুত সম্ভব নামতে চেষ্টা করছে। ও চায় না, এস.এস.এস. হেডকোয়ার্টার লেনিনগ্রাদের সাথে যোগাযোগ করুক জনসন।

রানা আরও খানিক নিচে নামার পর ঢিবির আড়ালে হারিয়ে গেল জনসন। যত নিচে নামল রানা, বিপদের আশঙ্কা বাড়ল তত। মাঝে মাঝেই ফাঁক হয়ে গেছে গ্লেসিয়ার, মুখ ব্যাদান করে আছে ছোট বড় অসংখ্য ফাটল, কিনারা থেকে নিচের দিকে গাঢ় ছায়ার। ভেতর হারিয়ে গেছে ফাটলের দেয়াল, কেউ জানে না কোন্। অতলে। আরও সাবধান হয়ে গেল রানা। কারবাইনের ব্যারেল। দিয়ে বরফের গা পরীক্ষা করে নিয়ে এক পা এক পা করে নামছে এখন। এমন অনেক ফাটল আছে যেগুলোর মুখ খোলা নয়, বরফের পাতলা চাদর ঢেকে রেখেছে নিখুঁতভাবে। একবার পা। পড়লে স্যাঁৎ করে তলিয়ে যেতে হবে। তবু একের পর এক। বিপজ্জনক ঝুঁকি নিতেই হলো। সামনে পড়ল তিন হাত চওড়া খাঁদ, ওপারের বরফ পরীক্ষা করা সম্ভব হলো না-লাফ দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করতে হলো।

রানা নামছে, সেই সাথে বেদখল হয়ে যাচ্ছে গোটা শরীর। দস্তানার ভেতর, পারকার ভেতর, জুতোর ভেতর এরই মধ্যে ঢুকে কামড় বসাতে শুরু করেছে ঠাণ্ডা। জায়গায় জায়গায় সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

ঢিবির খুব কাছে চলে এসেছে রানা। বরফ পরীক্ষা বাদ দিয়ে কারবাইনটা কোমরের কাছে ধরে তৈরি হয়ে আছে ও। প্রকৃতির চেয়ে মানুষই এখন তার বড় শত্রু হয়ে উঠতে পারে। সামনে বিশ ফিট উঁচু ঢিবি, হঠাৎ ঢিবির আরেক প্রান্ত থেকে এদিকের মাথায় চলে এল জনসন। রানাকে বোধহয় আগেই দেখেছে সে, হাতটা মাথার ওপর তোলাই ছিল, সজোরে কি যেন ছুঁড়ে দিল রানার দিকে। গ্রেনেড মনে করে ছ্যাঁৎ করে উঠল রানার বুক। এক ঝটকায় কারবাইন তুলল ও। ঢালের গায়ে পড়ল জিনিসটা, একটা পাথর। বিদ্যুৎ চমকের মত উপলব্ধি করল রানা, জনসন নিরস্ত্র।

দারুণ টিপ জনসনের, বরফে ড্রপ খেয়ে তীরবেগে ছুটে এল পাথরটা। সময়মত সরে না গেলে রানার ঠিক বা পায়ে লাগত। লাফ দিয়ে সরে গেল রানা ঠিকই, কিন্তু তাল হারিয়ে ফেলল। বরফে আছাড় খাবার আগেই পিছলে গেল শরীরটা। ভারী বস্তার মত পিচ্ছিল বরফের ঢাল বেয়ে দ্রুত নেমে যাচ্ছে। নিচে কিনারা, কিনারা থেকে নেমে গেছে প্রপাত, কয়েকশো ফিট নিচে।

কারবাইনটা খসে গেছে হাত থেকে। সেটার কথা এই মুহূর্তে মনেও নেই রানার। পতন ঠেকাবার জন্যে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করল ও। কিন্তু সবই বৃথা। হাত নয় যেন বাঘের থাবা, কিন্তু বরফের ছাল তুলতে পারলেও ভেতরে সেঁধোল না। পতনের গতি কমিয়ে আনার জন্যে শরীরটাকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ফেলল রানা, মুখের একটা পাশ আর মাথা ঠুকল বরফের গায়ে, সরু চিড়ের ভেতর বাধাবার চেষ্টা করল পা-কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। নিমেষের মধ্যে গোটা জীবনের ছবি ভেসে উঠল চোখের সামনে। ছেলেবেলা, কৈশোর, প্রথম প্রেম, সামরিক ট্রেনিং, প্রিয়জন, মাতৃভূমি। ঢং ঢং বিদায়ের ঘণ্টা বাজল কানের পাশে, যেন ছুটি। হয়ে গেল স্কুল। জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে।

তবু আর সব সাধারণ মানুষের সাথে ওর পার্থক্য এই যে। দ্বিতীয় বার মরে না ও। মৃত্যু অবধারিত জানার পরও বেঁচে থাকার চেষ্টায় কোন ত্রুটি থাকে না। পতন থামছে না, চোখে-মুখে বাড়ি খাচ্ছে হিমবাতাস, কাত হয়ে থাকা ঢাল বেয়ে সোজা না নেমে একটু তেরছাভাবে নামতে চেষ্টা করছে ও, ইচ্ছে কোন ফাটলের ভেতর পড়া।

সামনে মসৃণ বরফের গা ত্রিশ ডিগ্রী কাত হয়ে আছে। পতনের গতি আরও বেড়ে গেল, তবু গায়ে পারকা থাকায় চামড়া অক্ষত আছে।

না, সমস্ত কৌশল ব্যর্থ হয়ে গেল। থামা তো দূরের কথা, পতনের গতি কমাতে পর্যন্ত পারল না রানা। চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি, দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি বলা যায়। ঢালের কিনারা পরিষ্কার দেখতে পেল ও, কঠিন একটা রেখা, ওপারে কিছুই নেই, ফাঁকা শূন্যতা। কিনারা থেকে ঝপ করে নেমে গেছে গ্লেসিয়ারের গা, কয়েকশো ফিট নিচে খাড়ি।

কিনারার দিকে মুখ আর মাথা, শরীরটা পিছনে। কিনারা থেকে নিচে খসে পড়ার জন্যে মানসিকভাবে তৈরি রানা। হাত দুটো সজোরে মাথার দুপাশে বরফের ওপর নামিয়ে আনল, থাবড়া মারার ভঙ্গিতে। কিনারায় পৌঁছে গেল ও। খসে পড়ছে। সীমাহীন শূন্য বিস্তার, গভীরতা, চোখা একটা কালো কি যেন মুখ ব্যাদান করে আছে ওর নিচে। বাঁ হাতে ঠেকল বোল্ডার, গ্লেসিয়ারে গাঁথা একটা চোখা পাথর।

সচেতন কোন চেষ্টা নয়, নিখাঁদ রিফ্লেক্স-বাঁকা হয়ে গেল আঙুলগুলো, ধরে ফেলল পাথরটাকে। পতনের গতি তাতেও রোধ হলো না। ঘুরে গেল শরীরটা পিছলে কিনারা থেকে নেমে গেল পা সহ কোমর আর বুক। শরীরের নিচের অংশ ঝুলে পড়ায় ঝাঁকি খেলো বাঁ হাত, পাথর থেকে খুলে আসতে চাইল আঙুলগুলো। স্থির হলো শরীর, ঝুলে থাকল, কনুই ভাঁজ করা একটা মাত্র হাতের ওপর।

নিচে চট করে একবার তাকিয়ে কিছুই দেখল না রানা, খাড়া বরফের গা শুধু নিচ থেকে আরও অনেক নিচের দিকে নামতে নামতে হারিয়ে গেছে। সবটুকু শক্তি দিয়ে পাথরটা ধরে আছে ও। কিনারায় ওঠার চেষ্টা করল এবার। বোল্ডারটাকে ডান হাত দিয়ে পেঁচাল। দুই হাতের আঙুল আঁকড়ে ধরল পরস্পরকে। ধীরে ধীরে উঠতে চেষ্টা করল ও। বোল্ডারের ওপর দিয়ে এতক্ষণে তাকাল ঢালের দিকে। ঢাল বেয়ে নেমে আসছে জনসন।

বরফের রাজ্যে জমাট বেঁধে আছে হিম নিস্তব্ধতা, শুধু বুটের চাপ খেয়ে আলগা বরফ মুড়মুড় করে কুচি হচ্ছে। মুখের চেহারা বিকৃত হয়ে উঠল রানার। জনসনের পায়ে ক্যাম্পন বুট, তলায় লোহার কাঁটা লাগানো, বেশ নিরাপদেই নামতে পারছে সে। কিন্তু পেল কোথায়? নিশ্চয়ই আগেই রেখে দিয়েছিল জীপে। তারমানে থিউল থেকে রওনা হবার সময়ই প্ল্যান করেছিল পালাবে। এয়ারপোর্টে পৌঁছে বোয়িং-এর জন্যে অপেক্ষা করার একটাই কারণ, রানাকে খুন করে তিনটে প্রমোশন বাগানো।

রানার কাছে পৌঁছুতে আধ মিনিটও লাগবে না জনসনের। কিনারায় ওঠার চেষ্টা বাদ দিল রানা। হঠাৎ একজন নয়, দুজন লোককে ঢাল বেয়ে নেমে আসতে দেখল ও। বিনয়?

পরমুহূর্তে নিজের ভুল বুঝতে পারল রানা। চোখ পিট পিট করে আরেকবার বোল্ডারের ওপর দিয়ে তাকিয়ে দেখল, একা জনসনই, আর কেউ নেই। অর্থাৎ, দৃষ্টিভ্রম ঘটছে ওর।

জনসনের ডান হাতে একটা ছোরা। একেবারে কাছে চলে। এসেছে সে, এই সময় একদিকে কাত হয়ে পড়ল রানার মাথা, বোল্ডার থেকে খসে পড়ল ডান হাত।

ডান হাতটা অসাড় হয়ে গেল, মরা সাপের মত নেমে এল বোল্ডারের পিছনে। শরীরের ভার বাঁ হাতটা আর ধরে রাখতে। পারছে না, মনে হলো কাঁধ থেকে ছিড়ে যাবে ওটা। পারকার ভেতর দরদর করে ঘামছে রানা। বোল্ডারের কাছ থেকে তিন ফিট। দূরে থামল জনসন। বুঝল এতটা দূর থেকে ছোরা নাগাল পাবে না। সাবধানে আরও দুপা এগোল সে। উবু হয়ে পাথরটার পিছনে বসল। লোহার কাঁটাঅলা বুট তুলল সে, লক্ষ্যস্থির করল রানার দস্তানা পরা বাঁ হাতের ওপর। কাঁটাগুলো আধ ইঞ্চি লম্বা, গায়ে বরফের আবরণ।

লাথি মারল জনসন, বোল্ডারের ওপর দিয়ে উঠল রানার ডান হাত। জনসনের গোড়ালি পেঁচিয়ে ধরেই হ্যাঁচকা টান দিল। নিজের। দিকে নয়, একপাশে টানল ও। ওর হাতে ঘষা খেলো কাঁটা, তাল। হারিয়ে ফেলে পিছলাতে শুরু করল জনসন। বোল্ডারটাকে ঘুরে হড়কে কিনারার দিকে চলে এল সে, হাত দুটো এলোপাতাড়ি বরফের ওপর বাড়ি মারল কিছু একটা ধরতে পারবে এই আশায়। শেষ পর্যন্ত পাথরটা ধরে ফেলল, ভাবল এ-যাত্রা বেঁচে গেছে। ডান। হাত দিয়ে আবার আঘাত করল রানা। এবার নির্ভেজাল বিরাশি সিক্কার ঘুসি, দুমুখো সাপের নাক বরাবর। হাঁ করল জনসন, নিঃশব্দে চিল্কার করল, খসে পড়ল কিনারা থেকে। গভীর খাঁদ থেকে উঠে এল তার আর্তচিৎকার, তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেল। কিনারা থেকে নিজেকে তোলার চেষ্টা করল রানা।

বোল্ডার টপকে এসে নেতিয়ে পড়ল ও। জ্ঞান হারায়নি, তবে নড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। খানিকক্ষণ নিঃসাড় পড়ে থাকার পর বাঁ হাতটা ডলতে শুরু করল। তারপর হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে উঁচু হলো, কিনার থেকে উঁকি দিয়ে তাকাল নিচে।

একেই বলে দর্শনীয় মৃত্যু। কিনারা থেকে তিনশো ফিট খাড়া নেমে গেছে গ্লেসিয়ারের দেয়াল, তারপর আবার শুরু হয়েছে ঢাল। ঢালের গা থেকে কুঁড়ে বেরিয়েছে বরফের থাম, মাথাগুলো ছুরির ডগার মত চোখা। এই রকম একটা চোখা থাম জনসনের পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ ফুটো করে বেরিয়ে গেছে। ঢাল থেকে পনেরো ফিট উঁচুতে, থামের মাথায় শেষ আশ্রয় নিয়েছে কাঁকড়া।

নিয়ে চলো, বিনয়।

ফাটা বেলুনের মত অবজারভারের সীটে নেতিয়ে পড়ল রানা। চেহারা বা চোখে কোন ভাব নেই, রানার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বিনয়। ট্রান্সমিটার ছিল?

হ্যাঁ, বলল রানা। কমান্ডার টেনিসন কাউকে পাঠিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবে।

ট্রান্সমিট করতে পেরেছে?

জানি না, ক্লান্ত স্বরে বলল রানা। করলেও কিছু আসে যায় না। কর্নেল বলটুয়েভ জানবে আমরা যাচ্ছি।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত