১.৩ লেনিনগ্রাদে বিকেল তিনটে
আঠারোই ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার, বিকেল তিনটে পাঁচে লেলিনগ্রাদের নেভস্কি প্রসপেক্টে একজন লোক মারা গেল।
লেনিনগ্রাদে বিকেল তিনটে মানে ওয়াশিংটনে সবেমাত্র সকাল সাতটা। ফ্লোরিডা এক্সপ্রেসে এখনও চড়েনি রানা, এখন থেকে। সতেরো ঘণ্টা পর সি.আই.এ-র দলটা ট্রেন থেকে নামতে বাধ্য করবে ওকে।
আমেরিকান ট্যুরিস্ট, আলবার্ট ডকিনস, তুষার ঢাকা তিনটে ধাপ টপকে হোটেল লেনিনগ্রাদ থেকে রাস্তায় নেমে এল।দীর্ঘদেহী, চল্লিশ বছর বয়স; পাসপোর্টে তাকে একজন লেখক। বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাস্তায় নেমে এসে বাঁ দিকে বাঁক নিল। ডকিনস। তুষার মাথায় করে নেভস্কি প্রসপেক্টের দিকে হন হন। করে এগোল সে।
আরও জোরেশোরে তুষারপাতের হুমকি দিয়ে ফুলে আছে। আকাশ। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। আর আধঘণ্টার মধ্যে নেমে আসবে অন্ধকার। এরই মধ্যে স্ট্রীটল্যাম্পগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। নেভস্কি প্রসপেক্টে পৌঁছে গেল ডকিনস, চওড়া এভিনিউয়ে দাঁড়িয়ে সতর্কতার সাথে দুদিকে তাকাল সে। ভাব দেখে মনে হবে, সাবধানী লোক, রাস্তা পার হতে ভয় পাচ্ছে। আসলে এভিনিউয়ের একধারে পার্ক করা তিনটে গাড়ি তার মনে খুঁতখুঁতে ভাব এনে দিয়েছে।
কিন্তু না, মাদাম নাতাশা তো দূরের কথা, গাড়িগুলোয় কোন লোকই নেই।
হেলসিঙ্কি থেকে পাঁচ দিন হলো লেনিনগ্রাদে এসেছে ডকিনস, সেই থেকে মাদাম নাতাশা তার গাইড হিসেবে কাজ করছে। হার্মিটেজে যতবার গেছে সে, প্রতিবার সাথে থেকেছে মাদাম নাতাশা। গাড়িগুলোয়, রাস্তায়, দোকানগুলোর সামনে, কোথাও তাকে দেখতে না পেয়ে ডকিনস ভাবল, তারমানে ওর গল্প বিশ্বাস করেছে মেয়েটা। কাল রাতেই তাকে জানিয়ে দিয়েছে ও, আজ আর হার্মিটেজে যাবে না।
ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগল ডকিনস, তারপর একটা ট্রলি-বাসকে ছুটে আসতে দেখে তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পেরোল। তাকে দেখে সহজেই লোকে রাশিয়ান বলে ভুল করতে পারে। ফার কোট, ফার হ্যাট, আর হাঁটু পর্যন্ত লম্বা বুট পরেছে সে।
হাতঘড়ি দেখল ডকিনস, তিনটে বাজতে দুমিনিট বাকি। ফুটপাথে দাড়িয়ে তুমুল ঝগড়ায় মেতে আছে একজোড়া কিশোরকিশোরী, মেয়েটা ঠাস করে একটা চড় কষাল ছেলেটার গালে। মনে মনে হাসল ডকিনস, টিন-এজারদের নিয়ে কোথায় না সমস্যা নেই।
ওদেরকে পাশ কাটিয়ে এল ডকিনস, দূরে দেখা গেল ওর গন্তব্য, সারি সারি গাছপালায় ঘেরা পার্ক। দস্তানা পরা হাত দুটো ফার কোটের পকেটে ভরে হন হন করে হাঁটছে সে, কালও এই রাস্তা ধরে হার্মিটেজ মিউজিয়ামে গেছে। আর্ট ক্যাটালগটা বগলে করে নিয়ে এসেছে ডকিনস, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কোথায় যাওয়া হয়েছিল, উত্তর দিতে অসুবিধে হবে না।
পার্কের ভেতর, রাস্তার কাছাকাছি লেনিনের স্ট্যাচু দেখা গেল। পার্কে ঢুকে সোজা রাস্তাটা ধরে এগোল ডকিনস, রাস্তার শেষ মাথায় উদয় হলো একজন লোক।
এই কি সেই নাবিক? এর সাথেই তার দেখা হওয়ার কথা?
ইউরি রুস্তভকে আগে কখনও দেখেনি ডকিনস। বিজ্ঞানী, ওশেনোগ্রাফার ইভেনকো রুস্তম্ভের ভাই ইউরি রুস্তভ। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ডকিনস, লোকটা কাছে চলে আসার আগেই তিনটে চিহ্ন। দেখতে পেতে হবে তাকে।
একটা এয়ারব্যাগ থাকবে, কিন্তু কাঁধের বদলে বগলে। আছে। গলায় জড়ানো থাকবে লাল একটা স্কার্ফ। আছে। কিন্তু আলো দ্রুত কমে আসছে বলে আরেকটা চিহ্ন চোখে পড়ছে না। কোটের। অন্যান্য বোতাম গাঢ় রঙের হবে, কিন্তু ওপরের বোতামটা হবে। সাদা।
বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল ডকিনসের। সর্বনাশ! নাবিক লোকটার। পিছনে একজন পুলিস উদয় হয়েছে…নাকি সৈনিক? বুকের। ভেতরটা ধড়ফড় করলেও যেমন হাঁটছিল তেমনি হাঁটতে থাকল সে। এ কি স্রেফ মন্দভাগ্য, এই সময় এই রাস্তায় পুলিস লোকটার উপস্থিতি নেহাতই কাকতালীয় ঘটনা? না ইউরি রুস্তভের পিছু নিয়েছে? মনে হয় না। এমন প্রকাশ্যে কেউ কাউকে অনুসরণ করে। না।
তবু ডকিনসের ভয় যায় না। ধরা পড়লে কপালে খারাবি আছে। তার, গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে পাঁচ-সাত বছরের জেল হয়ে যাবে। তারচেয়ে বড় কথা, ইভেনকো রুস্তভ কবে রওনা হবে এন.পি. সেভেনটিন থেকে সেই খবরটা জেনারেল ফচের কাছে পৌঁছুবে না।
প্রতি মুহূর্তে দ্রুত কমে আসছে আলো। কাছাকাছি চলে আসছে নাবিক, তার পিছনে পুলিস লোকটার পরনে গাঢ় নীল গ্রেট কোট, দুজনের মাঝখানে পঞ্চাশ গজের মত ব্যবধান। এ-ও কি কাকতালীয় ঘটনা যে ইউরি রুস্তভের সাথে একই গতিতে হেঁটে আসছে পুলিস লোকটা? মাঝখানের ব্যবধান কমছেও না, বাড়ছেও না!
ও কি সত্যি ইউরি রুস্তভ?
সাদা বোতামটা এখনও দেখতে পাচ্ছে না ডকিনস। ত্রিশবত্রিশ, লোকটার বয়স আন্দাজ করল সে। সোজা তাকিয়ে আছে, তার দিকে নয়, তার পাশ ঘেঁষে সোজা রাস্তা বরাবর। চেহারা লক্ষ করে মনে মনে আঁতকে উঠল ডকিনস। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে, মনে হলো যে-কোন মুহূর্তে হয় হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে, নাহয় জ্ঞান হারাবে। এ থেকে কি প্রমাণ হয় এই লোকই ইউরি…?
এ-ধরনের ঝুঁকি নিয়ে অভ্যস্ত নয় লোকটা।
একেবারে সামনে চলে এল নাবিক, ডকিনস তার সাদা বোতাম দেখতে পেল। তুষারে পা বাধিয়ে নিখুঁত একটা আছাড় খেলো সে, উপস্থিত বুদ্ধিতে এরচেয়ে ভাল কোন উপায় তার মাথায় আসেনি। পুলিস লোকটা এখনও পঞ্চাশ গজ পিছনে। আর্ট ক্যাটালগটা বগল থেকে পড়ে খুলে গেছে, সাদা তুষারে রঙিন ছবিগুলো রক্তের দাগের মত দেখাল। এই ক্যাটালগ দেখেই ডকিনসের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হবে ইউরি রুস্তভ। ডকিনস উঠে বসার চেষ্টা করছে, সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এল ইউরি।
বিশ তারিখে রওনা হবেন তিনি, ডকিনসকে ধরে তুলতে শুরু করল ইউরি। বিশ তারিখে, বিশে ফেব্রুয়ারি…এন.পি.সেভেনটিন থেকে রওনা হয়ে আই.আই. ফাইভে পৌঁছুবেন…বিশ, বিশ…
নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গা থেকে তুষার ঝাড়তে শুরু করল ডকিনস। ইউরি রুস্তভ তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের পথে এগোল। আবার। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না সে।
ডকিনসের সামনে থামল পুলিস লোকটা। রুশ ভাষায় জিজ্ঞেস। করল, হাঁটতে পারবেন বলে মনে করেন? অনেক দূর যেতে। হবে?
রুশ ভাষা জানে ডকিনস, কিন্তু ইউরি ছাড়া আর কেউ তা জানে না। ইংরেজীতে বলল সে, কিছু না, গোড়ালিতে একটু। মোচড় খেয়েছি, ধন্যবাদ। কিছুই না বুঝে ওর দিকে বোকার মত। তাকিয়ে থাকল পুলিস, মুখে সামান্য ব্যথার ভাব নিয়ে একটু হাসল ডকিনস। লেনিনগ্রাদ হোটেল থেকে আসছি আমি, মিউজিয়ামে। যাচ্ছিলাম…তা বোধহয় আর সম্ভব নয়।
ক্যাটালগটা তুষার থেকে তুলে ডকিনসের হাতে ধরিয়ে দিল পুলিস। আরেকবার ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরতি পথে হাঁটা ধরল ডকিনস। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে। ভান নয়, সত্যিই ব্যথা পেয়েছে।
এ এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছে, ভাবল সে। পরশু লেনিনগ্রাদ। ছাড়ার কথা তার, রোববার সকালের ফ্লাইটে। কিন্তু এখন জানা। গেল ওই একই দিনে এন.পি.সেভেনটিন থেকে আই.আই. ফাইভের উদ্দেশে রওনা হবে ইভেনকো রুস্তভ। তারমানে। পরশু নয়, আরও আগে হেলসিঙ্কিতে পৌঁছুতে হবে তাকে। অথচ রুশ কর্তৃপক্ষ জানে, বিশিষ্ট আর্ট ক্রিটিক এবং লেখক আলবার্ট ডকিনস বিশ তারিখের আগে মিউজিয়াম দেখা শেষ করতে পারবেন না। পায়ের ব্যথাটায় কোন ভেজাল নেই, তাড়াহুড়ো করে রাশিয়া ছাড়ার কারণ হিসেবে দেখানো চলবে।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে নেভৃস্কি প্রসপেক্টে ফিরে এল ডকিনস, দেখল লাল-চুলো কিশোরীর মান ভাঙাবার জন্যে গলদঘর্ম হচ্ছে। জ্যাকেট পরা কিশোর। সারা গালে আলতো চুমোর স্পর্শ নিয়েও কিশোরী ঠোঁট ফুলিয়ে আছে। ইতিমধ্যে তুষারপাত আরও বেড়েছে, সেই সাথে কুয়াশা আর সন্ধ্যা দ্রুত ঢেকে ফেলছে। চারদিক। রাস্তা ফাঁকা, কোন গাড়ি আসছে না। পুলিস লোকটা এখনও পিছু পিছু আসছে কিনা দেখার জন্যে একবারও ঘাড় ফেরায়নি ডকিনস। ফুটপাথ থেকে নেমে পড়ল সে।
জ্যাকেট পরা কিশোর শেষ পর্যন্ত জিতল। কিশোরীর হাতে আরও একটা কিল খেলো সে, কিন্তু মিষ্টি আদরের কিল। মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে গাড়িতে উঠল সে। ইগনিশন কী ঘুরিয়ে স্টার্ট দিল। বোমার মত বিস্ফোরিত হলো এগজস্ট। ঝুঁকি খেয়ে লাফ দিয়ে সামনে ছুটল গাড়ি। এতক্ষণে মনে পড়ায় হেডলাইটের সুইচ অন করল সে।
খুঁড়িয়ে হাঁটাটা ডকিনসের যদি ভান হত, লাফ দিয়ে অনায়াসে সরে আসতে পারত সে। গাড়িটা তার গায়ের ওপর এসে পড়ছে,এই সময় চোখ ধাঁধানো আলো জ্বলে উঠল। একেবারে অন্ধ হয়ে গেল ডকিনস। কিশোর দেখল, গোটা উইন্ডস্ক্রীন জুড়ে রয়েছে ফারকোট পরা লোকটা। দ্রুত হুইল ঘোরাল সে, গাড়ির নাকে লোকটাকে আটকে নিয়ে ফুটপাথের সাথে ধাক্কা খেলো। রাস্তা থেকে ফুটপাথ আড়াই ফিট উঁচু, ডকিনসের মাথা আর বুক পড়ল ফুটপাথের ওপর, শরীরের বাকি অংশ থাকল রাস্তায়। মট মট করে পাঁজর ভাঙার আওয়াজ হলো। গাড়ির সামনের দুটো চাকা ডকিনসকে চাপা দিয়ে উঠে পড়ল ফুটপাথের ওপর। বুক থেকেচাকা নামার আগেই মারা গেছে ডকিনস।
রাস্তার ওপর থেকে চিৎকার করে উঠল এক মহিলা। একশো গজ দূরে রাস্তা পার হবার জন্যে থেমেছে ইউরি রুস্তভ, দৃশ্যটা দেখে মাথা ঘুরে গেল তার।
বন্দরে অপেক্ষা করছে ট্রলার বার্জেন, তিন ঘণ্টা পর নোঙর। তুলবে। টলতে টলতে রাস্তা পেরোল ইউরি, চোখে অন্ধকার দেখছে। গোটা ব্যাপারটাই ভণ্ডুল হয়ে গেছে, আমেরিকান লোকটা মারা যাওয়ায় ওয়াশিংটনে মেসেজটা পৌঁছুবার আর কোন উপায়। থাকল না। তার ভাইকে সাবধান করে দেয়াও এখন আর সম্ভব নয়।
ইভেনকো রুস্তভ রোববারে এন.পি. সেভেনটিন থেকে রওনা হয়ে যাবে, অথচ আমেরিকানরা সে-ব্যাপারে জানবে না কিছুই।
নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে বন্দরের দিকে হাঁটছে ইউরি। মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া কিছুই করার নেই তার।
.
শনিবার সকাল আটটা, এস.এস.এস. হেডকোয়ার্টার।
আমেরিকান লোকটা, কি যেন নাম…ডকিনস, নেভস্কি। প্রসপেক্টে মারা গেছে কাল, বলল আর্কটিক মিলিটারি জোনের স্পেশাল সিকিউরিটি সার্ভিস চীফ কর্নেল পয়মাল বলটুয়েভ। কি যেন ঠিক মিলছে না। উদ্ভট কিছু একটা আছে, অথচ আঙুল তুলে দেখাতে পারছি না।
গৌরবর্ণ বিশাল দৈত্য সে। চকচকে কামানো মাথাটা সব সময়। গরম হয়ে থাকে। গোটা রাশিয়ায় তার মত কাজপাগল লোক দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ। যখন সে শান্তভাবে কথা বলে মনে হয় সিংহ গজরাচ্ছে। কংক্রিটের মেঝেতে পা ঠুকলে বুঝতে হবে মাত্র রেগে উঠতে শুরু করেছে সে, তখন চেয়ার-টেবিল কেঁপে উঠলেও ঘরে যারা উপস্থিত থাকে তাদের এক চুল নড়ার শক্তি থাকে না। নিজের যেমন প্রাণশক্তির সীমা-পরিসীমা নেই, তেমনি অধীনস্থ লোকদের চরকির মত ব্যস্ত রাখতেও তার জুড়ি মেলা ভার।
কমপ্লিট একটা রিপোর্ট চাই আমি, জুনায়েভ, আবার বলল কর্নেল। গাইড নাতাশাকে আনো। পুলিস লোকটা দেখেছে, তাকেও। প্রত্যক্ষদর্শী আর যারা আছে তাদের সবাইকে বিকেল তিনটের মধ্যে এই অফিসে এক লাইনে দাঁড় করাও। আমি নিজে ওদের জেরা করব।
ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে নিকিতা জুনায়েভ বলল, কর্নেল কমরেড।
এয়ারপোর্টে খোঁজ নাও। একে-তাকে জিজ্ঞেস করলে অনেক তথ্য পেয়ে যাবে। একা এসেছিল কিনা জানতে চাই আমি। বিকেলের আগে।
কর্নেল কমরেড।
পুলিস হেডকোয়ার্টারে যাও, জুনায়েভ। ডকিনসের ব্যক্তিগত সমস্ত জিনিস-পত্র সাথে করে নিয়ে এসো। ফেব্রুয়ারি মাসে লেনিনগ্রাদে আমেরিকান ট্যুরিস্ট! অসম্ভব! এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন ঘাপলা আছে।
এতক্ষণ কর্নেল একবারও মুখ তুলে তাকায়নি। সহকারী জুনায়েভকে নির্দেশ দিচ্ছে মুখে, মনে মনে ভাবছে মেয়েটার এবার বিয়ে না দিলেই নয়, আর চোখ বুলাচ্ছে খোলা একটা ফাইলে।
নিকিতা জুনায়েভের বয়স পঁয়ত্রিশ, কর্নেলের চেয়ে পনেরো। বছরের ছোট। এস.এস.এস. চীফের সহকারী হবার সমস্ত যোগ্যতা তার আছে, আর আছে কর্তার অহেতুক আস্ফালন এবং ঝম ঝম বৃষ্টির মত নির্দেশগুলোকে শান্তভাবে গ্রহণ করার দুর্লভ গুণ। এই গুণটার জন্যেই আজও কর্নেলের সহকারী হিসেবে টিকে আছে সে। এর আগের লোকটা আত্মহত্যা করেছিল।
কর্নেল কমরেড, শান্ত গলায় বলল জুনায়েভ, লোকটার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই যে…
কি! এখনও তুমি যাওনি!
জুনায়েভ কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। ফাইল বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল কর্নেল বলটুয়েভ, কাঁচ কাঁচ করে উঠল চেয়ারটা। জানালার সামনে এসে বাইরে তাকাল সে। সকাল আটটায়ও। বাইরে অন্ধকার। ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল, তুষার। মাথায় করে কাজে যাচ্ছে লোকজন।
পকেট থেকে খুদে একটা দাবার ছক বের করে আবার ডেস্কে বসল কর্নেল। ঘরের ভেতর হিসহিস শব্দে একটা স্টোভ জ্বলছে। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে টেলিপ্রিন্টারের আওয়াজ। গভীর মনোযোগের সাথে দাবার একটা জটিল সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে। শুরু করল সে। সাদা আর কালো যুঁটির অবস্থান দেখে যে-কারও। মনে হবে, পরিণতি ড্র হতে বাধ্য। অথচ কাসপারভ এই খেলায়। জিতেছে।
সমস্যাটা নিয়ে তিন দিন ধরে মাথা ঘামাচ্ছে কর্নেল। আজ। মাত্র আধ ঘণ্টার চেষ্টায় সমাধান বেরিয়ে এল। আত্মবিশ্বাসের মাত্রা বেড়ে গেল তার, বারবার মনে হতে লাগল ডকিনসকে সন্দেহ করে ভুল করছে না সে।
লেনিনগ্রাদে ইহুদিদের নিয়ে বিরাট সমস্যা রয়েছে। প্রতি বছর বেশ কিছু ইহুদি পালিয়ে চলে যাচ্ছে ইসরায়েলে। কোন সন্দেহ নেই ইহুদিদের আন্ডারগ্রাউন্ড একটা সেল অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেছে। কর্নেল বলটুয়েভের বিশ্বাস, এই আন্ডারগ্রাউন্ড সেল টাকা পাচ্ছে বিদেশ থেকে। ডকিনসের ব্যাপারটা জানার সাথে সাথে তার মনে হয়, ইহুদিদের জন্যে লোকটা টাকা নিয়ে আসেনি তো? সে জন্যেই, লোকটা মারা গেলেও, তার লাশ পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে সে।
শনিবার সকাল আটটায়ও কর্নেল বলটুয়েভ জানে না যে সময়ের সাথে ভয়ানক এক দৌড়-প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে তাকে-রোববারে এন.পি.সেভেনটিন থেকে ইভেনকো রুস্তভ যাত্রা শুরু করার আগে ডকিনস রহস্য ভেদ করতে হবে তার।
ওয়াশিংটনে এখনও মাঝরাত, শুক্রবার। রানা এখনও ফ্লোরিডা এক্সপ্রেসের স্লিপিং কারে ঘুমাচ্ছে। সোভিয়েত ঘাঁটি এন.পি.সেভেনটিনে এখন ভোর চারটে, কিয়েভ থেকে সবেমাত্র এখানে পৌঁচেছে ইভেনকো রুস্তভ।
.
প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলো গুনতে গুনতে প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে ইভেনকো রুস্তভ।
বরফ-দ্বীপ এন.পি.সেভেনটিনের মাঝখানে সরু একটা এয়ারস্ট্রিপ, আরেকবার পরিষ্কার করে প্লেন নামার উপযোগী রাখা হয়েছে। ভোর চারটে, চাঁদের আলো গায়ে মেখে এয়ারস্ট্রিপের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। পশ্চিমে আমেরিকানদের রিসার্চ বেস আই.আই.ফাইভ, মাত্র পঁচিশ মাইল দূরে। কিন্তু ইভেনকো। তাকিয়ে আছে পুবে। বরফ-দ্বীপের বাইরে জ্যান্ত পোলার প্যাক আড়মোড়া ভাঙছে, চাদের আলোয় ভাঙা কাচের সীমাহীন তৃপের। মত দেখতে লাগল। ঘরগুলো তার পিছনে, সমতল ছাদ তুষারে। ঢাকা পড়ে আছে। পায়ের আওয়াজ ওদিক থেকেই এল। শক্ত কাঠ হয়ে গেল ইভেনকো।
এই আওয়াজ তার চেনা। সিকিউরিটি এজেন্ট পিটার আন্তভ তার ওপর কড়া নজর রাখছে। পায়ের আওয়াজ ঠিক পিছনে এসে। থামল। আপনার শরীর খারাপ, কমরেড অ্যাকাডেমিশিয়ান?
এরচেয়ে ভাল কখনও ছিলাম না!
না, রাত শেষ হয়নি বাইরে চলে এসেছেন, তাই জিজ্ঞেস করছি। সুর শুনে মনে হবে না যে জেরা করছে, তবে উত্তরের জন্যে অপেক্ষায় থাকে।
রোজই এ-সময় ঘুম ভাঙে আমার, এতদিনে কথাটা তোমার জানা উচিত ছিল। সে যে রেগে গেছে তা গোপন করার চেষ্টা। করল না ইভেনকো। কাজ হলো, গজগজ করতে করতে ঘরগুলোর। দিকে ফিরে গেল আন্তভ।
কোটের পকেটে ইভেনকোর দস্তানা পরা হাত দুটো কঠিন। মুঠো হয়ে উঠল। আন্তভ একটা সমস্যা হতে যাচ্ছে। ঘর থেকে সে। বেরুলেই তার পিছু নিচ্ছে লোকটা। রেগে ওঠার আরেকটা কারণ, পরিকল্পনার এমন একটা পর্যায়ে পৌচেছে সে যখন সিকিউরিটির কাউকে দেখলেই তার সারা শরীরে যেন আগুন ধরে যায়। পিটার আন্তভ কর্নেল বলটুয়েভের বিশ্বস্ত এজেন্ট, আর কর্নেল বলটুয়েভের স্পেশাল সিকিউরিটি সার্ভিসই ছয় মাস আগে তার প্রাণপ্রিয় সুমাইয়া নাজিনকে খুন করেছে।
সুমাইয়ার কথা মনে পড়তেই চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল ইভেনকোর। তারই মত ইহুদি ছিল সুমাইয়া। দুজনের বয়সের ব্যবধান খুব বেশি হলেও, পরস্পরকে তারা প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। বিয়ে হয়নি বটে, কিন্তু লেনিনগ্রাদে যখনই গেছে সে, দুজন স্বামীস্ত্রীর মত একসাথে থেকেছে। হঠাৎ একদিন এন.পি.সেভেনটিনে খবর এল, সুমাইয়া সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা গেছে।
কিছুদিন পর লেনিনগ্রাদে ছুটিতে এসে পুরো ব্যাপারটা জানতে পারল ইভেনকো। সুমাইয়া আন্ডারগ্রাউন্ড সেলের সাথে জড়িত, জানত সে। গোপনে চাঁদা তুলত সুমাইয়া, প্রতিভাবান ইহুদিদের ইসরায়েলে পালাবার ব্যবস্থা করে দিত। আন্ডারগ্রাউন্ড সেলের আরেকটা কাজ ছিল গোপন সামরিক তথ্য সংগ্রহ করা, সময় মত সে-সব ইসরায়েলে পাচার করা হত। যেভাবেই হোক, কর্নেল বলটুয়েভ সন্দেহ করতে শুরু করে সুমাইয়াকে। এক গভীর রাতে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় স্পেশাল সিকিউরিটির হেডকোয়ার্টারে। সেখানে সুমাইয়ার ওপর কি ধরনের নির্যাতন চালানো হয় তা জানা যায়নি। কর্তৃপক্ষ শুধু তার আত্মীয়দের জানায়, সিঁড়ি থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙে গিয়েছিল সুমাইয়ার, তাতেই মারা যায় সে।
হাতঘড়ি দেখল ইভেনকো। চারটে দশ, স্থানীয় সময়। আরও বিশ ঘণ্টা পর রওনা হবে সে।
সময়ের হিসেবটা ভারি গুরুত্বপূর্ণ, একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলে স্রেফ মারা পড়বে সে। আমেরিকানরা তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, সে তার রওনা হবার দিন-তারিখ নিজেই নির্ধারণ করবে, এবং সেই নির্দিষ্ট তারিখ আর বদল করা চলবে না।
ছোট ভাই ইউরির সাথে কিয়েভে দেখা করেছে সে। ইউরির সাথে নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে আমেরিকান ট্যুরিস্ট ডকিনসের। ডকিনসের মাধ্যমে আমেরিকানরা তার রওনা হবার নির্দিষ্ট তারিখ। জেনে গেছে। এখন শুধু অপেক্ষা, আর বিশ ঘণ্টা পর সবার। চোখকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়া। তারপর যা থাকে কপালে।
.
কর্নেল বলটুয়েভ হুলস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছে। শনিবার সকাল এগারোটার মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জড়ো করা হলো। হেডকোয়ার্টারে, কর্নেল নিজে তাদেরকে জেরা করল। জেরা করার পর প্রত্যেকের সম্পর্কে একটা করে মন্তব্য করল সে। মাদাম। নাতাশা সম্পর্কে বলল, একটা দুগ্ধবতী গাভী, জুনায়েভ। এধরনের মেয়েদেরই যমজ বাচ্চা হওয়া উচিত, দিন-রাত দুধ খেয়েও শেষ করতে পারবে না। ওকে দেখে আমারই ইচ্ছে হচ্ছিল সদ্যজাত খোকা হয়ে যাই। নিশ্চয়ই ডকিনসেরও তাই হয়েছিল।
পুলিস লোকটার সাথেই সবচেয়ে বেশি সময় কাটাল কর্নেল। কর্নেলের ঘর থেকে এক ঘণ্টা পর যখন বেরুল সে, মনে হলো। তার ওপর স্টীম রোলার চালানো হয়েছে। হোটেল লেনিনগ্রাদের বয়-বেয়ারা থেকে শুরু করে ম্যানেজার পর্যন্ত সবাইকে জেরা করা। হলো। তলব পেয়ে আসতে হলো এয়ারপোর্ট অফিশিয়ালদের।
কিন্তু কারও কাছ থেকেই সন্দেহ করার মত কোন তথ্য পাওয়া গেল না।
সবশেষে জুনায়েভ বলল, কর্নেল কমরেড, আমার মনে হয়,। ইহুদিদের সাথে ডকিনসের কোন সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়া বৃথা।
চেয়ার-টেবিল, দেয়াল, আলমারি, সব কাঁপতে লাগল, কারণ কর্নেল বলটুয়েভ থপ থপ পা ফেলে পায়চারি করছে। ওদেরকে যে কেউ টাকা এনে দিচ্ছে, এ আমরা জানি, বলল সে। একে একে পাঁচদিন মিউজিয়ামে গেল ডকিনস, প্রতিবার সাথে ছিল গাভীটা। তারপর, কাল কি ঘটল?
রোড-অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল সে, নিরীহ ভঙ্গিতে বলল জুনায়েভ।
তার আগে! চোখ পাকাল কর্নেল। রুটিন ব্রেক করেছে সে, জুনায়েভ! গাইডকে রাতেই বলে রাখল শরীর খারাপ, কাল সে বাইরে বেরুবে না, অথচ চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ল-একা। কেন, জুনায়েভ, কেন? মেঝেতে সবুট পা ঠুকল সে।
শরীর ভাল ছিল তাই মিউজিয়ামে যাচ্ছিল…
চারটেয়, যখন মিউজিয়াম বন্ধ হবার সময় হয়ে এসেছে?
হয়তো কারও সাথে দেখা করতে যাচ্ছিল…
কর্নেলের চেহারায় বিজয়ের উল্লাস ফুটে উঠল। ঠিক তাই। কিন্তু কার সাথে? দেখা যে হয়নি, এটা পরিষ্কার, কারণ তার আগেই সে মারা যায়। এসো, গোটা ব্যাপারটা আবার স্মরণ করি। ডকিনস হোটেল থেকে বেরুল, পার্কে ঢুকল…
আছাড় খেয়ে পা মচকাল…
মনে হলো আছাড় খেয়ে পা মচকেছে, জুনায়েভ, বাধা দিয়ে। বলল কর্নেল। দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। আছাড় খেলো সে একজন নাবিকের সামনে। কেন? কে এই নাবিক?
যে-কেউ হতে পারে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল জুনায়েভ।
উঁহু, তার পরিচয় জানতে হবে আমাদের। লোকটার বগলে একটা এয়ারব্যাগ ছিল, যাচ্ছিল বন্দরের দিকে। টেবিলের সামনে পায়চারি থামাল সে, দেরাজ থেকে একটা ফাইল বের করল। ডকে কি ঘটছে না ঘটছে তার দৈনন্দিন রিপোর্ট লেখা হয় এই ফাইলে। কাল একটাই মাত্র জাহাজ নোঙর তুলেছে, বার্জেন, একটা ট্রলার। তারমানেই দাঁড়াল, নাবিক লোকটা বার্জেনে ওঠার জন্যে বন্দরে যাচ্ছিল।
ফাইলটা আমি দেখেছি, কর্নেল কমরেড, বলল জুনায়েভ। বার্জেনের ক্রুর সংখ্যা তিরিশ…।
কিন্তু তালিকাটা এখানে নেই-যোগাড় করো! বিকেলের মধ্যে। চাই আমি।
কিন্তু এত অল্প সময়ের ভেতর…
সেটা তোমার সমস্যা! নিজের চেয়ারে বসল কর্নেল। দাবার পকেট সংস্করণ ছকটার ভাঁজ খুলে খেলায় মন দিল সে। জুনায়েভ দরজার কাছে পৌঁছুল। ভাল কথা, এ হপ্তায় আমি মস্কোয় থাকার সময়, ফিরে এসে দেখলাম, আবার তুমি ইভেনকো রুস্তভের। এন.পি. সেভেনটিনে যাবার আবেদনে সই করেছ। আমার ধারণা। ছিল, রুস্তভ তার কাজ শেষ করেছে ওখানে।
প্রায় শেষ করেছে, হ্যাঁ, দরজার কাছ থেকে বলল জুনায়েভ। কর্নেল হঠাৎ প্রসঙ্গ বদল করায় সামান্য অস্বস্তি বোধ করল সে। শেষবারের মত কয়েকটা ডেপথ-সাউন্ডিং এক্সপেরিমেন্ট বাকি ছিল, তাই…তাছাড়া, তার হাবভাবে মনে হলো ব্যাপারটা আপনিও জানেন…
ঠিক আছে, জুনায়েভ, মুখ না তুলেই বলল কর্নেল। ঠিক। আছে। ওখানে তার আর কোন কাজ নেই মনে করেছিলাম, তাই অবাক লাগল।
.
চল্লিশ হাজার ফিট উঁচু আকাশ-পথে ওয়াশিংটন থেকে থিউলে পৌঁছুতে ছয় ঘণ্টা লাগল। শনিবার সকাল এগারোটায় ঘুম ভাঙার পর রানা দেখল ওদের বোয়িং গ্রীনল্যান্ডে নামার জন্যে এয়ারপোর্টকে ঘিরে চক্কর দিতে শুরু করেছে। সকাল, কিন্তু ধবধবে চাদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকাল রানা, এফ.বি.আই. এজেন্ট মরিসনকে বলল, মনে হচ্ছে যেন এই তো পাঁচ মিনিট আগে ওয়াশিংটন থেকে রওনা হয়েছি।
সদ্য ভাঁজ ভাঙা নীল সুট পরে আছে মরিসন, নিখুঁত দাড়ি কামানো মুখে একটা সিগারেট গুঁজে নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসল। তুমি তো দিব্যি ঘুমালে। আমার মনে হচ্ছে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে।
ক্ষীণ একটু হাসল রানা। ভোর পাঁচটায় বোয়িং টেক অফ করার পাঁচ মিনিট আগে এয়ারপোর্টে পৌছায় মরিসন। শেষ মুহূর্তের নির্দেশে প্লেনে চড়তে হয়েছে তাকে, কাঁধে গুরুদায়িত্ব-থিউল-এ একজন রুশ গুপ্তচর আছে, খুঁজে বের করতে হবে তাকে। বেচারার নার্ভাস না হয়ে উপায় কি!
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা। যতদূর দৃষ্টি যায় গ্রীনল্যান্ড আইসক্যাপের সমতল ধু-ধু প্রান্তর। খানিক দূরে আকাশের দিকে উঁচু হয়ে রয়েছে হাজার ফিট লম্বা রাডার মাস্ট, মাথায় লাল সতর্ক-সংকেত জ্বলছে আর নিভছে। চারদিকে তিন হাজার মাইল রেঞ্জ ওটার, ডিসট্যান্ট আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমের প্রধান স্টেশন।
টেনিসনের অফিসে দেখা করব তোমার সাথে, হঠাৎ বলল মরিসন। হয়তো সন্ধের দিকে কোন এক সময়।
মাথা ঝাঁকাল রানা। কথাটার একটা তাৎপর্য আছে। মরিসন বলতে চাইছে সন্ধের মধ্যে কাঁকড়ার পরিচয় বের করে ফেলবে। সে। নাকি এরই মধ্যে পরিচয়টা জেনে ফেলেছে? বেসে পৌঁছেই গ্রেফতার করবে তাকে?
বোয়িং ল্যান্ড করল। রানার জন্যে অপেক্ষা করছে মাইকেল জনসন। রানার পরনে ফার পারকা থাকলেও, স্থির বাতাস প্রচণ্ড ঘুসির মত আঘাত করল চোখে মুখে। জিরো থেকে চল্লিশ ডিগ্রী নিচে রয়েছে টেমপারেচার। সিঁড়ি বেয়ে নেমে মাইকেল জনসনের। বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরল রানা, দুজনেই দস্তানা পরে রয়েছে।
জনসন একটু খাটো, পাঁচ ফিট চার। লম্বাটে মুখে বেমানান গাম্ভীর্য, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, তবে চারপাশ কুঁচকে সরু হয়ে নেই চোখ। করমর্দন করার সময় রানাকে সে বলল, আপনার অভিযানের জন্যে সব রেডি করে রেখেছি, মি. রানা…। সিঁড়ির মাথায় মরিসনকে দেখে থেমে গেল সে। তরতর করে নেমে এল মরিসন,। ওদেরকে পাশ কাটিয়ে কর্নেল টেনিসনের দিকে এগোল। কর্নেল। টেনিসনই ক্যাম্প কমান্ডার। কে ও?
একটা কাঁধ ঝাঁকাল রানা। কি জানি, খানিকটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল ও। বোবা তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্লেনে কোন কথাই বলেনি। আমি অবশ্য ঘুমিয়েই…
মুখ তুলে আবার সিঁড়ির মাথার দিকে তাকাল সিকিউরিটি চীফ, চীফ পাইলট ধাপ বেয়ে নেমে আসছে। এক্সকিউজ মি, পাইলটের পথরোধ করে দাঁড়াল সে। দ্বিতীয় লোকটাকে ও? কথা ছিল এই ফ্লাইটে শুধু মি. মাসুদ রানা আসবেন।
পাইলটের এক হাতে ফ্লাইট হেলমেট দেখা গেল, অপর হাত দিয়ে পারকার হুডটা মাথায় পরল সে। যখনই আসি এখানে, আগের বারের চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা লাগে। চিনি না, একেবারে শেষ মুহূর্তে প্লেনে চড়ল লোকটা। সরকারি গাড়ি করে এল…
আমি এখানকার সিকিউরিটি চীফ, অথচ…, রানাকে ইশারা করে রাগের সাথে ঘুরে দাঁড়াল জনসন, একটা জীপের দিকে নিয়ে চলল রানাকে। ঠিক আছে, ওর ব্যাপারটা পরে চেক করব আমি। রানাকে পাশে নিয়ে জীপে বসল, চাবি ঘোরাল ইগনিশনে। যা বলছিলাম, আপনার অভিযানের জন্যে সব রেডি করা আছে, মি. রানা। ইস্ট গ্রীনল্যান্ড কোস্টে অর্থাৎ কার্টিস ফিল্ডে একজোড়া সিকোরস্কি হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছে। আপনার জন্যে মি. নিয়াজ আর মি. বিনয় অপেক্ষা করছে হেডকোয়ার্টারে। চওড়া রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে জীপ চালাচ্ছে সে। ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছে। ওরা। সামনের জীপে, বেশ খানিকটা দূরে রয়েছে ক্যাম্প কমান্ডার কর্নেল টেনিসন আর এফ.বি.আই. এজেন্ট মরিসন। একজোড়া নরওয়েজিয়ান-টাইপ জে-ও পাঠানো হয়েছে কার্টিস ফিল্ডে…
ওগুলো কোন কাজেরই নয়, বাধা দিল রানা। আমি এস্কিমো স্লেজের কথা বলেছিলাম-ওগুলো অনেক বেশি ভারী, বরফ যতই এবড়োখেবড়ো হোক ভেঙে পড়ে না।
জনসনকে বিস্মিত দেখাল। আমরা নিজেরাও তো নরওয়েজিয়ান-টাইপ স্লেজ ব্যবহার করি। এস্কিমো স্লেজ নেইও। আমাদের…
আছে। শেষবার যখন এসেছিলাম, বড় হেলিকপ্টার হ্যাঙ্গারের পিছনে একজোড়া দেখেছিলাম বলে মনে পড়ছে।
লজ্জা দিলেন, মি. রানা! হাসতে লাগল সিকিউরিটি চীফ। একবার উঁকি দেবেন নাকি? সামনের বাঁকে পৌঁছে সোজা না গিয়ে ডান দিকে গেলেই…
এখনই?
নয় কেন! বলল জনসন। যতদূর বুঝেছি, আপনার খুব তাড়া আছে।
রোলার দিয়ে চ্যাপ্টা করা তুষার-পথ ধরে ছুটল জীপ, তেমাথায় পৌঁছে ডান দিকে ঘুরে গেল। বাঁ দিকে, বেশ খানিকটা দূরে দেখা গেল ক্যাম্প-গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে ঢালু। ছাদ লাগানো অনেকগুলো ঘর। ওদের সামনে, সে-ও অনেকটা। দূরে, বিরাট একটা হ্যাঙ্গার। সিকি মাইল সামনে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা সামরিক বিমানঘাঁটি চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে-গোটা রানওয়ে নিরেট বরফে ঢাকা। বেড়ার সামনে, হ্যাঙ্গারের কাছাকাছি, কমলা রঙের নিশ্চল একটা স্নো-প্লাই দেখা গেল। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে রানার দিকে বাড়িয়ে দিল জনসন। গোটা এলাকার রিপোর্ট। ঠিক কোন এলাকার ওপর আপনি ইন্টারেস্টেড আমি জানি না। এবড়োখেবড়ো বরফ…না কি যেন বললেন?
রাফ আইস।
হুল ফোটানো আর্কটিক বাতাস সহ্য হচ্ছে না রানার। এরইমধ্যে অসাড় হয়ে গেছে মুখ, শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে। প্রধান রাস্তা ধরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে কমান্ডার টেনিসনের জীপ, পিছনের। লাল আলো জোড়া দ্রুত অস্পষ্ট হয়ে এল। হঠাৎ আরেকটা জীপ দেখতে পেল রানা। প্রধান রাস্তা ধরে ক্যাম্পের দিক থেকে আসছে। না, ওদের দিকে নয়, বোয়িং-এর দিকে ছুটে গেল সেটা।
কুয়াশার খবর কি? জিজ্ঞেস করল রানা। ভাঁজ খুলে চোখ রাখল ওয়েদার রিপোর্টে।
থ্যাঙ্ক গড, কোথাও কোন ছিটেফোঁটা কুয়াশাও নেই। এখান থেকে নরওয়ে পর্যন্ত আবহাওয়া একেবারে পরিষ্কার।
কিন্তু এই অবস্থা কতক্ষণ থাকে সেটাই হলো কথা।
কাঁধ ঝাঁকাল জনসন। আর্কটিক ওয়েদার মেয়েদের মনের মত, দেবতারাও হদিস পান না।
জীপের গতি কমিয়ে দিল জনসন, তাকাল রানার দিকে। রানা রিপোর্ট পড়ছে। জীপ থামল। দস্তানা পরা ডান হাতটা মুখের সামনে তুলে আঙুলগুলো বার কয়েক ভাজ করল জনসন। পোকা ঢুকল না মাছি! আপনমনে বিড়বিড় করল সে। ইঞ্জিন সচল, বন্ধ করা হয়নি। দস্তানা খুলে ডান হাতটা পকেটে ভরল সে। বেরিয়ে এল পয়েন্ট থ্রী-এইট স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন নিয়ে। বিদ্যুৎগতিতে রানার কপালের পাশে ব্যারেল দিয়ে আঘাত করল সে। একেবারে শেষ মুহূর্তে মাথাটা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল রানা। কপালের পাশটা ভেতর দিকে দেবে না গিয়ে, চুল সহ খুলির খানিকটা চামড়া হারাল। হেঁ দিয়ে ইগনিশন থেকে চাবিটা বের করেই তুষারের দিকে ছুঁড়ে দিল ও। এবার রানার মাথার মাঝখানটা লক্ষ্য করে রিভলভারের ব্যারেল নামাল জনসন। চোখধাধানো আলোর বিস্ফোরণ ঘটল মাথার ভেতর, পরমুহূর্তে ঘন কালো অন্ধকারে নিজেকে হারিয়ে ফেলল রানা।