মরণখেলা: ১.২ জেনারেল স্যামুয়েল ফচ

মরণখেলা: ১.২ জেনারেল স্যামুয়েল ফচ

১.২ জেনারেল স্যামুয়েল ফচ

উনিশে ফেব্রুয়ারি, শনিবার, রাত তিনটে। ওয়াশিংটন, সি.আই.এর অপারেশনাল হেড অফিস।

নিজের অফিসে পায়চারি করছেন জেনারেল স্যামুয়েল ফচ। ঠাণ্ডাকে তাঁর বড় ভয়, বোধহয় সেজন্যেই আর্কটিক জোনের অপারেশনাল চীফ বানানো হয়েছে তাঁকে। সামনে দাঁড়িয়ে কথা। বলা দায়, ভুর ভুর করে কাঁচা রসুনের গন্ধ বেরোয় মুখ থেকে। মাঝারি আকৃতির শক্ত-সমর্থ মানুষ, শিশুর সারল্য মাখা চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই বুদ্ধির পঁাচ কষতে এই লোকের জুড়ি মেলা ভার। হিটিং সিস্টেম চালু থাকায় অফিসের ভেতর তাপমাত্রা তিরাশি ডিগ্রী ছাড়িয়ে গেছে, ওপরের দুটো বোতাম খোলা শুধুএকটা শার্ট গায়ে ঘামছেন তিনি।

আপনার মাসুদ রানা এইমাত্র এয়ারপোর্টে নামল, জেনারেল ফচের সহকারী টমাস উড ফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখে বলল। গাড়িতে করে নিয়ে আসা হচ্ছে ওকে।

জেনারেল ফচ থামলেন না, বরং আরও দ্রুত হলো পায়চারি, জোড়া ভুরুর মাঝখানটা কুঁচকে আছে।

আপনমনে কাঁধ ঝাঁকাল টমাস উড। এত থাকতে এই বাংলাদেশী মেজরকে কেন যে দরকার হলো আমাদের, আমি বুঝতে অক্ষম! নরম কিন্তু অভিযোগের সুরে বলল সে। সহজ একটা অপারেশন, আমাদের ছেলেরাই করতে পারে। ইভেনকো রুস্তভ কখন আই.আই. ফাইভে আসছে জানার সাথে সাথে আমরা একটা প্লেন পাঠাব, প্লেনটা তাকে নিয়ে ফিরে আসবে…

সহজ নয়, টমাসকে থামিয়ে দিয়ে বললেন জেনারেল ফচ। হাতির তিমি গেলার মত কঠিন। তাছাড়া, গোড়াতেই ভুল করছ তুমি। ইভেনকো রুস্তভ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, শুধু যদি মাসুদ রানাকে পাঠানো হয় তবেই সে আসবে।

মুখ বেজার করে টমাস বলল, রাশিয়ানদের এই মাসুদ রানা প্রীতি, অসহ্য!

রুশ প্রশাসন বা কমুনিস্ট পার্টির হর্তাকর্তারা রানাকে কি চোখে দেখে, আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না, মুচকি হেসে বললেন জেনারেল। তবে রাশিয়া থেকে মিগ-একত্রিশ ছিনিয়ে আনার পর থেকে কিছু রুশ নাগরিক সত্যি ওর ভারি ভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে ইভেনকো রুস্তভ একজন। ছিনিয়ে এনে আবার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে মিগটা, অর্থাৎ নিজের বিশ্বস্ততা এবং যোগ্যতা প্রমাণ করেছে রানা। অভিজ্ঞতাটা আমাদের জন্যে তিক্ত নিঃসন্দেহে, কিন্তু রাশিয়ানদের মধ্যে ব্যাপারটা যারা জানে তারা তো ওর ভক্ত হবেই।

ইভেনকো যাই বলুক, রানাকে সে তো আর চেনে না, বলল টমাস। আমাদের একজন এজেন্টকে রানা বলে চালাতে অসুবিধে কি?

রাশিয়া থেকে এর আগে যারা পালিয়ে এসেছে তাদের চেয়ে ইভেনকো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, স্বীকার করো?

নিরীহ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল টমাস। করি।

কাজেই আমরা কোন ঝুঁকি নিতে পারি না, বললেন জেনারেল ফচ। সোভিয়েত এন.পি.সেভেনটিন থেকে রওনা হবে সে, আমাদের সবেচেয়ে কাছের রিসার্চ বেস আই.আই. ফাইভে। পৌঁছুতে হবে। আই.আই. ফাইভ এই মুহূর্তে সোভিয়েত আইল্যান্ড থেকে পঁচিশ মাইল দূরে। ওখানে তিনজন প্রফেসর রয়েছে। আমাদের, দ্বীপটা ভেঙে যাবে তাই ফেরত আসার জন্যে অপেক্ষা করছে। বুঝতে কোথাও অসুবিধে হচ্ছে, টমাস?

না, স্যার…

ইভেনকো পালিয়ে আসছে, তিন প্রফেসরের কেউই তা জানে।। আমরা বলিনি, কারণ ওদের কারও টপ সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স। নেই।

আমাদের হয়তো উচিত রেডিয়োতে ওদেরকে আভাস দেয়া যে…

মাঝে মধ্যে ভাবি, তোমার সার্টিফিকেটগুলো জাল কিনা! জেনারেল ফচের এটা প্রিয় একটা মন্তব্য, সুযোগ পেলেই ঝেড়ে দেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে টমাস উড এত বেশি অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন অর্জন করেছে, সবগুলোর কথা তার মনেও। থাকে না। রুশ সহ ছয়টা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে টমাস। ক্রিপটোগ্রাফ এবং রেডিও-কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ সে, আমেরিকার ছয়জন সেরা ইন্টারোগেটরের মধ্যে একজন। শুধু। একটা ব্যাপারে তার কোন অভিজ্ঞতা নেই, জীবনে কখনও মেরুপ্রদেশে যায়নি। বরফের রাজ্য সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই।

সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স নেই, আভাসই বা দিই কিভাবে? প্লেন ভর্তি একদল লোক পাঠিয়ে দেব, সে উপায়ও নেই, রাশিয়ানরা তাতে সতর্ক হয়ে যেতে পারে। ওরা যদি ওদের বেস সীল করে দেয়, তখন? ইভেনকো আর বেরুতে পারবে? কাজেই আই.আই. ফাইভের পরিবেশ শান্ত আর স্বাভাবিক রাখতে হবে।

মোট কথা ইভেনকো শর্ত দিয়েছে, কাজেই কাজটা রানাকে দিয়ে না করিয়ে আমাদের উপায় নেই, এই তো?

টমাসের চোখে চোখ রেখে এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন। জেনারেল ফচ। আরও কারণ আছে।

কি কারণ?

কুয়াশা।

কুয়াশা?

ধরো আই. আই. ফাইভ কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেল? ইভেনকোকে আনার জন্যে আমাদের লোক তাহলে এখানে পৌঁছুবে কিভাবে? নিরেট পোলার প্যাকে জাহাজ চলবে না। কুয়াশার ভেতর প্লেন চালানো সম্ভব নয়। কাজেই পায়ে হেঁটে বা স্লেজে চড়ে যেতে হবে। রানাকে দিয়ে কাজটা করাবার পিছনে এটাও একটা কারণ।

কেন, রানা কি?

বরফের রাজ্যে রানাকে গ্যারান্টীড ইস্যুরেন্স বলতে পারো, ভারী গলায় বললেন জেনারেল ফচ। সব মানুষই যে-কোন পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, কিন্তু তার রকম ফের আছে। আর্কটিকে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষ তাদের স্বাভাবিক গুণগুলো হারিয়ে ফেলে। আমার কথাই ধরো, ঠাণ্ডাকে আমার বড় ভয়, আর্কটিকে গেলে জড় পদার্থ বনে যাব, ব্রেন কাজ। করবে না। কিন্তু রানার বৈশিষ্ট্য হলো, আবহাওয়া আর পরিবেশ যত বিরূপ হবে ওর স্বাভাবিক গুণগুলো ততই বেশি করে ফুটবে।

মুখ হাঁড়ি করে টমাস বলল, আপনি এমন করে বলছেন যেন। ও একটা সুপারম্যান…

অথচ তুমি জানো, কারও প্রশংসা করা আমার স্বভাব নয়। পিরিচ থেকে খোসা ছাড়ানো এক কোষ রসুন তুলে মুখে পুরলেন। জেনারেল ফচ। নির্জলা বাস্তব ঘটনা বর্ণনা করছি, কিছু বাড়িয়ে বলছি না। এর আগে একাধিক বার আর্কটিকে গেছে রানা, প্রমাণ। করেছে…

বসের কথা কেড়ে নিয়ে টমাস বলল, প্রমাণ করেছে যে সে সি. আই.এ-র সাথে বেঈমানী করতে ওস্তাদ। তার চেহারা কঠোর হয়ে উঠল। যাই বলুন, স্যার, জেনেশুনে ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিতে যাচ্ছি। আমরা। এর আগেও ঠিক এ-ধরনের কাজের দায়িত্ব রানাকে দেয়া হয়েছিল, সেবার রাশিয়ান বিজ্ঞানীকে আমাদের হাতে তুলে না দিয়ে যুগোস্লাভিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছিল সে। এবারও যে সে…

জেনারেল ফচ মুচকি হাসলেন। বেঈমানী করার সুযোগ। এবার আমরা রানাকে দিচ্ছি না, টমাস। ওর যারা প্রিয় লোকজন, তাদের কয়েকজনকে আমরা জিম্মি রাখছি। এদিকে এসো, কাজটার জন্যে শুধু এক রানাকেই কেন উপযুক্ত বলে মনে করছি, ব্যাখ্যা করে বলি। চেয়ার ছেড়ে আর্কটিক ম্যাপের সামনে গিয়ে। দাঁড়ালেন তিনি। থমথমে চেহারা নিয়ে তার পাশে চলে এল টমাস।

ম্যাপের মাথার দিকে রাশিয়ান উপকূল, ডান দিকে মারমানস্ক আর লেনিনগ্রাদ। মাঝখানে স্পিটবার্জেন আর গ্রীনল্যান্ড সহ নর্থ পোল, নিচে কানাডিয়ান আর আলাস্কান উপকূল। মার্কার চিহ্নিত করছে আই. আই. ফাইভের বর্তমান পজিশন, ম্যাপের খুবই নিচের দিকে সেটা, আইসবার্গ অ্যালি-র ঠিক ওপরে গাঁথা, গ্রীনল্যান্ড আর স্পিটবার্জেনের মাঝখানে জাহাজের চিমনি আকৃতির ভাসমান বিশাল বরফ খণ্ড।

আই. আই. ফাইভ এখন গ্রীনল্যান্ড উপকূলের একশো বিশ মাইল দূর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে, জেনারেল ফচ মৃদু গলায় বললেন। আরও পঁচিশ মাইল পুবে রয়েছে রাশিয়ান বেস, এন.পি.সেভেনটিন, ওখান থেকে যাত্রা শুরু করবে ইভেনকো রুস্তভ। দুটো বেসই বিশাল দুই বরফের টুকরোর ওপর রয়েছে, টুকরো দুটো পোলার প্যাকের সাথে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলেছে আইসবার্গ অ্যালির দিকে। শেষবার নর্থ পোল থেকে ফিরে আসার পর রানা আর্কটিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে যে রিপোর্ট করেছিল তাতে লিখেছে, দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা ওটা। ওর সাথে আমি একমত।

আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন…

গোটা এলাকাটা রানা চেনে, গেছে, এবং বেঁচেবর্তে ফিরে এসেছে, ধমকের সুরে বললেন জেনারেল ফচ। কি বলতে চাইছি এখনও বুঝতে পারছ না?

হুঁ, বলে উদাস চোখে ম্যাপের দিকে তাকিয়ে থাকল টমাস।

জেনারেল ফচ তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, থিউল-এ আমাদের সিকিউরিটি লিক সম্পর্কে কিছু শুনেছ?

ঝট করে বসের দিকে ফিরল টমাস। না! কি ব্যাপার?

এফ.বি.আই-র মরিসন দুঘণ্টা আগে সাবধান করে দিয়েছে আমাকে। রসুনের কোষে কামড় দিয়ে মুখ বাঁকালেন জেনারেল ফচ। জানা গেছে, টপ একজন সোভিয়েত স্পেশ্যাল সিকিউরিটি এজেন্ট দুবছর ধরে ওখান থেকে লেনিনগ্রাদে ইনফরমেশন পাচার করছে। এফ. বি. আই. তার কোড নেম জানতে পেরেছে-কাঁকড়া। ওরা নাকি তার আসল পরিচয় খুব তাড়াতাড়ি জেনে ফেলতে পারবে।

টমাসের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। এর ফলে গোটা অপারেশনটাই কেঁচে যেতে পারে।

আমার তা মনে হয় না, বললেন জেনারেল। রানাকে। সাবধান করে দেব, ও যেন শুধু ওখানকার সিকিউরিটি চীফ। মাইকেল জনসনের সাথে ডিল করে। হাতঘড়ি দেখলেন তিনি। যে-কোন মুহূর্তে পৌঁছে যাবে রানা। প্রজেক্টর অপারেটরকে ফোন করো, সে যেন ফিল্ম নিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। মিলারকেও বলো, সে তার সরঞ্জাম রেডি করুক। আমাদের হাতে সময় খুব কম।

সামান্য একটু বিস্মিত দেখাল টমাসকে। আপনি বলতে চাইছেন ফিল্ম দেখার পরও রানা গোয়ার্তুমি করবে? টরচার না করলে রাজি হবে না?

গম্ভীর কণ্ঠে বললেন জেনারেল ফচ, হ্যাঁ, আমি ঠিক তাই বলতে চাইছি।

.

চাদের হিম আলোয় চকচক করছে বরফের রাজ্য। আকাশে ছড়ানো ঝলমলে গ্রেট বিয়ার নক্ষত্রপুঞ্জ ঝুলে রয়েছে পোলার প্যাকের ওপর। বাঘের মত ভয় ধরানো শীত, দীর্ঘ রজনী, আই.আই. ফাইভ অবরুদ্ধ হয়ে আছে।

গ্রীনল্যান্ড উপকূল থেকে একশো বিশ মাইল পুবে, সোভিয়েত আইস আইল্যান্ড এন.পি.সেভেনটিন থেকে মাত্র পঁচিশ মাইল পশ্চিমে, বিশাল বরফ-রাজ্য পোলার প্যাক অবরুদ্ধ করে রেখেছে। আই. আই. ফাইভকে। অযুত কোটি টন বরফ থেমে নেই, প্রতি মুহূর্তে ভেসে চলেছে। বিস্তীর্ণ বরফ রাজ্যে আই, আই. ফাইভ একটা বরফ দ্বীপ। অনবরত ঘষা, চাপ, আর ধাক্কা দিয়ে দ্বীপটাকে ভাঙার চেষ্টা করছে পোলার প্যাক।

দ্বীপটাকে ভাঙার এই চেষ্টা ত্রিশ বছর ধরে চলছে, সেই উনিশশো বেয়াল্লিশ সাল থেকে, যেদিন কানাডিয়ান আইস শেলফ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নর্থ পোলকে ঘিরে চক্কর দেয়া শুরু করল আই.আই. ফাইভ। কিন্তু চিমনির আকৃতি নিয়ে বিশ ফুট উঁচু বরফ-দ্বীপের তেমন কোন ক্ষতিই করতে পারেনি পোলার প্যাক, কারণ পোলার প্যাক লোনা পানির বরফ-সাগরের পানি থেকে তৈরি। বিশাল বরফ রাজ্য পোলার প্যাকের চেয়ে এই নিরেট দ্বীপ অনেক বেশি শক্ত, যদিও ডায়ামিটার মাত্র এক মাইল।

আই.আই. ফাইভ মিষ্টি পানির তৈরি বরফ। তুলনায় লোনা পানির তৈরি বরফ অনেক নরম আর ভঙ্গুর হয়। তাছাড়া, আই.আই. ফাইভের বংশ-পরিচয়টাও তো দেখতে হবে। শত শত বছর ধরে সরু গিরিখাঁদ থেকে নেমে আসা মন্থরগতি হিমবাহগুলো কানাডিয়ান উপকূলের কিনারায় জমাট সাগরে পড়েছে, তৈরি হয়েছে আইস শেলফ। স্তরের ওপর স্তর পড়ে দুশো ফিট গভীর। হয়েছে শেলফ। আই.আই. ফাইভ এই শেলফেরই একটা টুকরো। মাত্ৰ-এক মাইল চওড়া একটা টুকরো, নিজেকে ছাড়িয়ে আলাদা। করে নিয়ে ত্রিশ বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভাসমান পোলার প্যাকের সাথে।

পোলকে ঘিরে দশ বছর মেয়াদী চতুর্থ টহল শুরু করেছে। আই. আই. ফাইভ, আবার একবার ঘুরে চলে এল কানাডিয়ান। আর্কটিক কোস্টে, আর ঠিক তখনই গ্রীনল্যান্ড কারেন্ট পেয়ে বসল ওটাকে। বরফের প্রকাণ্ড টুকরোটাকে অনেক দক্ষিণে টেনে আনা। হলো, এত দক্ষিণে এর আগে কখনও আসেনি। গ্রীনল্যান্ড আর স্পিটবার্জেনের মাঝখানে, হাজার মাইল বিস্তীর্ণ আই-ফিল্ডের কাছাকাছি পৌঁছে গেল ওটা, এর.পর আর ফেরার পথ থাকল না। পশ্চিমের বদলে পুব দিকে এগোল আই.আই. ফাইভ, আইসবার্গ অ্যালির দিকে।

বহুদূর ওয়াশিংটনে জেনারেল ফচ তখনও রানার জন্যে অপেক্ষা করছেন, হাতে সেক্সট্যান্ট নিয়ে হেডকোয়ার্টারের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন আই. আই. ফাইভের স্টেশন লীডার ড. লিমুয়েল কর্ডন, মাপজোক করে তারাগুলোর অবস্থান আরেকবার জেনে নেবেন। পঞ্চান্ন বছর বয়স কৰ্ডনের, শান্ত স্বভাবের মানুষ। কিন্তু। যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করার সময় এই মুহূর্তে তাকে অস্থির দেখাল। পিছনে দরজা খোলার আওয়াজ হতে তার অস্থিরতা বাড়ল বৈ কমল না।

বত্রিশ বছর বয়স, জেমস কাজম্যান স্টেশনের অয়্যারলেস অপারেটর। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ড. কর্ডনের পাশে এসে দাড়াল সে। ব্যস্ততার কোন আভাস পাচ্ছ নাকি, ডক্টর?

প্রচুর, জোর করে কৌতুক করলেন ড. কর্ডন। গান গাইতে গাইতে বাস ভর্তি একদল লোক গেল, পিকনিক পার্টি।

ঈশ্বর, আকাশে চোখ তুলল জেমস কাজম্যান। যদি সত্যি হত! জানতে চাইছিলাম, রাশিয়ানদের কোন তৎপরতা…

না।

বরফ-দ্বীপ আই. আই. ফাইভের মাঝখানে বারোটা সমতল ছাদঅলা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। এই বারোটা ঘর নিয়েই ওদের রিসার্চ বেস। উঁচু-নিচু বরফ মোড়া সরু একটা রাস্তার দুপাশে দুই সারিতে ছটা করে বারোটা ঘর। রাস্তার শেষ মাথায় আরও একটা ঘর রয়েছে, সেটার ছাদ ফুঁড়ে চাঁদের দিকে কয়েকশো ফিট উঠে গেছে অয়্যারলেস মাস্ট। ওদের চারদিকে রয়েছে ভয়াবহ শত্রু-পোলার প্যাক। যেন বিশাল কোন আহত পশু তীব্র ব্যথায় গোঙাচ্ছে। এই গোঙানির শব্দ ওদেরকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, পোলার প্যাক জ্যান্ত, প্রতি মুহূর্তে দ্বীপের উঁচু পাঁচিলটাকে পিষে গুঁড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। নতুন একটা আওয়াজ পেল ওরা, কড়াৎ করে বাজ পড়ল যেন।

ওটা কি? ফিসফিস করে জানতে চাইল কাজম্যান।

ভেঙে আলাদা হলো বরফের একটা টুকরো, ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন ড. কর্ডন। ভেতরে গিয়ে রডেনবার্গের সাথে থাকো, জেমস। কাজটা আমি শেষ করতে চাই।

পাগলা কুত্তা হয়ে আছে রডেনবার্গ। ভয় হয়, ডক্টর, ও না। আত্মহত্যা করে!

সেজন্যেই তো ওর সাথে থাকতে বলছি তোমাকে, বললেন ড. কর্ডন। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলেও, তার চোয়াল শক্ত হয়ে থাকল। ওদের তিনজনের মধ্যে রডেনবার্গ সবচেয়ে ছোট, মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়েস। বরফের এই নির্জন জগৎ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে তাকে, যে-কোন মুহূর্তে নার্ভাস ব্রেকডাউন ঘটতে পারে। এই দ্বীপে ওদের দিন যতই ফুরিয়ে আসছে ততই বাড়ছে তার রোগের উপসর্গ। আর বারো দিন পর ওদেরকে নিতে আসবে প্লেন, এই অভিশপ্ত দ্বীপ ছেড়ে চলে যাবে ওরা, যেন সেজন্যেই এখন প্রতিটি ঘণ্টাকে, এমনকি প্রতিটি মুহূর্তকে মনে। হচ্ছে এক একটা বছর।

ওদের এই সার্চ বেসকে তিন দিক থেকে ঘিরে আছে মসৃণ তুষার মোড়া মালভূমি, দ্বীপ-পাঁচিলের উঁচু কিনারা পর্যন্ত তার বিস্তার-বাকি একদিকে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে মাথাচাড়া দিয়ে রয়েছে। ছোট একটা পাথুরে পাহাড়, মালভূমি থেকে চল্লিশ ফিট উঁচু তার। চূড়া। এখানে, সবচেয়ে কাছের উপকূল থেকে একশো মাইল দূরে, এই পাহাড়ের গায়ে গিজ গিজ করছে বিশাল আকৃতির বরফ মোড়া বোল্ডার, সত্যিকার নিরেট পাথর, কোন কোনটা আকারে। ছোটখাট বাড়ির মত। বহু যুগ আগে হিমবাহের সাথে কানাডিয়ান। আইস শেলফে নেমে এসেছিল ওগুলো, এবং এক সময় যখন বরফের একটা টুকরো দ্বীপের আকৃতি নিয়ে শেলফ থেকে আলাদা। হয়ে যায়, টুকরোর সাথে বেরিয়ে আসে ওই পাথুরে পাহাড়।

একটা ঘরের দিকে এগোল কাজম্যান, দরজা খুলে বেরিয়ে এল রডেনবার্গ। আওয়াজ পেয়ে ড. কর্ডনের মুখভাব থমথমে হয়ে উঠল। কাজম্যান ঘরে না ঢুকে রডেনবার্গের সাথে ফিরে এল ড. কর্ডন যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেখানে।

রডেনবার্গ যে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বরফের রাজ্যে এ এক ধরনের নির্বাসন, গরম ঘরের ভেতরও একা কেউ থাকতে চায় না। কিন্তু পোলার প্যাক যেমন প্রতি মুহূর্তে দ্বীপের পাঁচিলে কামড় বসাচ্ছে, ওরা তিনজন একসাথে হলেও দাঁত-মুখ খিচিয়ে তেমনি পরস্পরের ওপর ঝাপিয়ে পড়ার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে।

দরজাটা বন্ধ করেছ, গুন্টার? একটা ইন্সট্রুমেন্টে চোখ চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন ড. কর্ডন। তার পিছনে দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ হলো।

রাশিয়ানরা চলে গেছে! হাউমাউ করে উঠল রডেনবার্গ, মনে হলো কেঁদে ফেলবে। ঘটে বুদ্ধি রাখে ওরা, সময় থাকতে নিজেদের বেস ছেড়ে কেটে পড়েছে। অয়্যারলেস করে আমরাকেন আমাদের প্লেনটাকে ডাকছি না? সবই তো প্যাক করা হয়ে গেছে…

থামো, গুন্টার, সেক্সট্যান্ট নামিয়ে দ্রুত আধপাক ঘুরলেন ড. কর্ডন। সব প্যাক করা হয়নি। তাছাড়া, এখনও সব এক্সপেরিমেন্ট শেষ করোনি তুমি…

লাথি মারি এক্সপেরিমেন্টে! কুঁসে উঠল রডেনবার্গ। এই জায়গায় আর একটা দিন থাকতে হলে আমি মারা যাব…

আই.আই. ফাইভে আজ এগারো মাস রয়েছ তুমি, বাধা দিয়ে বললেন ড. কর্ডন। এটা তো সেই একই জায়গা।

এসব ছেলে-ভুলানো কথা শুনতে চাই না, রাগের সাথে বলল। রডেনবার্গ। আইসবার্গ অ্যালির কিনারায় চলে এসেছি আমরা, একই জায়গা হলো কি করে?

ভেতরে গিয়ে খানিকটা কফি বানাও, ধমকের সুরে বললেন ড. কর্ডন। সময়টা আমরাও উপভোগ করছি না, কিন্তু তাই বলে অস্থির হয়ে কোন লাভ নেই। নরম তুষারের ওপর থপ থপ পা ফেলে ঘরে ঢুকল রডেনবার্গ, দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ হলো আবার। ওর সাথে থাকো, জেমস, নরম সুরে। বললেন তিনি। একা কি না কি করে বসে। ও শান্ত হলে আবার। তুমি একবার থিউল-এর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা কোরো। আমাদের নতুন পজিশন ওদেরকে জানানো দরকার।

চেষ্টা করতে আপত্তি নেই, সন্দিহান দেখাল কাজম্যানকে। অত্যন্ত বাজে ধরনের স্ট্যাটিক বিল্ড করছে। আমার ধারণা, বাইরের দুনিয়ার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। হতে পারে আবহাওয়ার বিরাট কোন পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।

কাজটা প্রায় শেষ করে এনেছেন ড. কর্ডন, নিজের অজান্তেই ভুরু জোড়া কুঁচকে আছে তাঁর। রেডিও যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটছে, বা। একেবারেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, এ-ধরনের কথা শোনার পর কারও পক্ষেই স্থির থাকা সম্ভব নয়। কাজ শেষ করে যন্ত্রপাতি। গুছিয়ে নিলেন তিনি, ঘরে ঢোকার আগে পরিচিত জমাট সাগর আর প্রাণহীন নির্জন শীতল বিস্তৃতির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। কোত্থেকে একটা ভয় এসে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল তাঁকে, গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠল। কপালে কি দেশে ফেরা আছে? নাকি এই বরফ-দ্বীপেই লেখা আছে শীতল মৃত্যু?

সি.আই.এ-র অপারেশনাল হেড অফিসে সাদর অভ্যর্থনা জানানো হলো রানাকে। জেনারেল ফচকে কোথাও দেখা গেল না, তাঁর সহকারী টমাস উড পথ দেখিয়ে একটা ছোট ঘরে নিয়ে এল ওকে। অপারেটর আগে থেকেই তৈরি ছিল, ওরা ঘরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিয়ে সব আলো নিভিয়ে দিল সে। ইতিমধ্যে একটা চেয়ারে বসেছে রানা, ওর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে টমাস উড। প্রজেক্টর চালু হলো, সামনের সাদা স্ক্রীনে ফুটে উঠল রঙিন ছবি।

গ্রীনল্যান্ড। আমেরিকান আর্কটিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির দিকে স্থির হয়ে আছে ক্যামেরা। ল্যাবরেটরি ভবনের গেটের সামনে মার্কিন নেভীর ছাপ মারা একটা জীপ দেখা যাচ্ছে। ইউনিফর্ম পরা একজন অফিসার আর একজন নৌ-সেনা জীপের পাশে দাঁড়িয়ে, ক্যামেরার দিকে পিছন ফিরে রয়েছে ওরা। মনে হলো, কেউ বেরিয়ে আসবে সেজন্যে অপেক্ষা করছে।

অশুভ কিছু আশঙ্কা করল রানা। আমেরিকান আর্কটিক রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে বাংলাদেশী দুজন তরুণ বিজ্ঞানী কাজ করে, নিয়াজ মাহমুদ আর বিনয় মুখার্জি। কেউ তদবির করেনি, মার্কিন সরকার উপযাচক হয়ে তিন বছরের স্কলারশিপে এই ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করার সুযোগ দিয়েছে ওদেরকে। ওরা যে রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির পার্টটাইম অপারেটর, কাকপক্ষীরও তা জানার কথা নয়। রুশ বা মার্কিন আর্কটিক রিসার্চ বেসগুলো আসলে এক একটা স্পাইয়ের আখড়া, চোখ-কান খোলা রাখলে গবেষকরা অনেক মূল্যবান তথ্য জানতে পারে। নিয়াজ আর বিনয় দুজনেই হঠাৎ পাওয়া কোন তথ্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে গোপনে। পাঠিয়ে দেয় রানা এজেন্সির হেডকোয়ার্টারে।

নিয়াজ মাহমুদ দক্ষ নেভিগেটর, মেরিন বায়োলজিতে মাস্টার ডিগ্রী আছে তার, প্রথম শ্রেণীর মার্কর্সম্যান। সুদর্শন, প্রাণঞ্চল, কৌতুকপ্রিয় নিয়াজ প্রেমে বিফল হওয়ার পর জীবনে কখনও বিয়ে। করবে না বলে ঘোষণা করে দিয়েছে।

বিনয় মুখার্জি পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চি লম্বা, প্রতিভাবান জিয়োলজিস্ট, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ, ডেপথ-সাউন্ডিং বিষয়ে ভাল কারিগরি জ্ঞান রাখে। নিয়াজ তার একমাত্র বন্ধু, এবং ওরা তিনজন সমবয়েসী হলেও রানা বলতে দুজনেই অজ্ঞান। রানার। সাথে ওদের সম্পর্ক ঠিক গুরু-শিস্যের নয়, আবার বন্ধুত্বেরও নয়। রানাকে ওরা নাম ধরেই ডাকে, তুমি বলে সম্বােধন করে, কিন্তু। ব্যবহারে লুকিয়ে থাকে শ্রদ্ধা আর সমীহের ভাব, সেটা অনেক সময়ই কারও চোখে পড়ে না। বছর চারেক আগে মাত্র একবার রানার সাথে একটা অ্যাসাইনমেন্টে কাজ করেছে ওরা। তবে। গ্রীনল্যান্ডে ওদের সাথে দুএকবার দেখা হয়েছে রানার।

ল্যাবরেটরির খোলা গেট দিয়ে বেরিয়ে এল নিয়াজ আর। বিনয়, ওদের সামনে পিছনে একজন করে ইউনিফর্ম পরা সশস্ত্র। নৌ-সেনা। জুম করে এগোল ক্যামেরা, স্ক্রীনে বড় আকারে ফুটল। ওদের দুজনের চেহারা। কৌতুকপ্রিয় নিয়াজের মুখে হাসি নেই, বিনয়ের চোখ দুটো বিষন্ন। রানা বুঝল, ওর আশঙ্কাই সত্যি হতে যাচ্ছে। সম্ভবত কোন গোপন তথ্য যোগাড় করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে ওরা।

অফিসারের সামনে দাঁড়াল ওরা। অফিসার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে পড়ল, গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে আপনাদের গ্রেফতার করা হলো। একজন নৌ-সেনার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল সে, লোকটা এগিয়ে এসে নিয়াজ আর বিনয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল। জীপে তোলা হলো ওদের, দ্রুত একটা ইউটার্ন নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল গাড়ি।

আলো জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় না থেকে চেয়ার ছাড়তে গেল রানা, পিছন থেকে ওর কাঁধে একটা হাত রাখল টমাস উড। আরও আছে, মি. মাসুদ রানা।

অনেক প্রশ্ন ভিড় করে এল রানার মনে, কিন্তু শক্ত কাঠ হয়ে চুপচাপ বসে থাকল ও। ওদের গ্রেপ্তারের ঘটনা ওকে ডেকে আনিয়ে দেখাবার পিছনে নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে। তার চেয়ে অস্বস্তিকর ব্যাপার হলো, আর কি দেখতে হবে ওকে?

আবার সচল ছবি ফুটল স্ক্রীনে। এবার যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো রাজ্যের দৃশ্য ফুটে উঠল। একটা গাড়ির ওপর রয়েছে ক্যামেরা, গাড়ি ছুটে চলেছে বড় একটা রাস্তা ধরে। বুকটা হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে উঠল রানার। শিরদাড়া খাড়া হয়ে গেল ওর। পিছনে দাঁড়িয়ে মুচকি একটু হাসল টমাস উড। আবছা অন্ধকারেও রানার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেছে সে।

সোহানার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল রানা। পর পর দুটো অ্যাসাইনমেন্টে কাজ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে সোহানা, কলোরাডোর সিটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে তাকে। বিশ্রাম আর উপযুক্ত চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সেরে উঠছে সে। দিন সাতেক। আগে তাকে দেখেও এসেছে রানা।

সি.আই.এ. তবে কি সোহানাকেও…?

চোয়াল দুটো শক্ত, উঁচু হয়ে উঠল রানার।

যা আশঙ্কা করেছিল, সিটি ক্লিনিকের সামনে থামল ক্যামেরা। ক্লিনিকের গেটে কোন গাড়ি দেখা গেল না, তবে পনেরো বিশ গজ। পর পর দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকজন ইউনিফর্ম পরা সশস্ত্র পুলিস। খোলা গেট দিয়ে ক্লিনিকের ভেতর ঢুকল ক্যামেরা। একটা কেবিনের দরজা দেখা গেল, দরজার বাইরে একজন পুলিস। পরমুহূর্তে কেবিনের ভেতরে দৃশ্য ফুটে উঠল। বিছানায় শুয়ে একটা ভোগ ম্যাগাজিন পড়ছে সোহানা। ম্লান চেহারা, চোখে বিষন্ন দৃষ্টি। দেয়াল ঘেঁষে একটা চেয়ারে বসে রয়েছে ইউনিফর্ম পরা। একটা মহিলা পুলিস। সোহানার দিকে তাক করা নয় বটে, কিন্তু। তার কোলের ওপর হাতে ধরা একটা পিস্তল দেখা যাচ্ছে।

সম্ভবত ডাক্তারদের অনুমতি পাওয়া যায়নি বলে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়নি সোহানাকে। আপাতত নজরবন্দী করে রাখা হয়েছে, সুস্থ হয়ে উঠলেই হাজতে নিয়ে ভরা হবে।

ওকে নিশ্চয়ই গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে…দাঁতে দাঁত চাপল। রানা।

খুট শব্দের সাথে যখন আলো জ্বলল, টমাস উড দেখল উঠে। দাঁড়িয়ে ট্রাউজারের বোতাম লাগাচ্ছে রানা। মেঝের দিকে উঠে তাকাল সে, পানির স্রোত দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। মি. রানা, আপনি, মানে…

ভয় পেলে এরকম হয় আমার, বলে টমাসের মুখের ওপর হাসল রানা। পরমুহূর্তে গম্ভীর হলো। তোমার বসের কাছে নিয়ে চলো আমাকে।

কালচে তিলে ভরা টমাসের লাল মুখ আরও লাল হয়ে উঠল রাগে। রানার এ এক ধরনের পাল্টা আক্রমণ, বুঝতে পেরেছে। শুধু রাগ নয়, স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে সে-কোন লোক এত দ্রুত রিয়্যাক্ট করতে পারে তার ধারণা ছিল না।

টমাস চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে তার দিকে এক পা এগোল রানা। আমার কথা শুনতে পাওনি?

প্রায় লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেল টমাস, শোল্ডার হোলস্টার থেকে। চোখের পলকে বেরিয়ে এল একটা ইস্পাত-নীল রিভলভার। সাবধান!

হাঁ করে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে অপারেটর।

হাত দুটো সামনে রেখে চেয়ারে বসুন, মি. রানা, বলল টমাস, তার রিভলভারের কালো মাজুল রানার বুকের দিকে তাক করা। আমার বস্, জেনারেল ফচ, আর্কটিক জোনের অপারেশনাল চীফ, জরুরী কাজে বাইরে আছেন। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব আমার ওপর দেয়া হয়েছে।

বসল না রানা, হাত দুটো বুকে ভাঁজ করে টান টান হয়ে দাঁড়াল। বিপদে পড়েছ, আমার সাহায্য দরকার-আগেই বুঝেছি।

দরজার দিকে সরে গেল টমাস, সুইচবোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে শুরু করল, প্রথম শ্রেণীর একজন রুশ ওশেনোগ্রাফার, ইভেনকো রুস্তভ আমেরিকায় পালিয়ে আসতে চেয়েছেন। আর্কটিকে, একটা সোভিয়েত বেসে রয়েছেন তিনি, শর্ত দিয়েছেন শুধু মাসুদ রানাকে পাঠালে তবেই তিনি আসবেন…

ওদের তোমরা…।

ওদের আমরা ইসুরেন্স হিসেবে আটকে রাখব, বলল টমাস। এর আগেও একজন রুশ বিজ্ঞানীকে নিয়ে আসার দায়িত্ব আপনাকে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তাকে আপনি সোভিয়েত এলাকা। থেকে নিয়ে এলেও, আমাদের হাতে তুলে না দিয়ে যুগোস্লাভিয়ায় পাঠিয়ে দেন। সেজন্যেই এবার আমরা সাবধান হয়ে গেছি। ইভেনকো রুস্তভকে আপনি নিরাপদে আমাদের হাতে তুলে দিলেই। ওরা তিনজন ছাড়া পেয়ে যাবে, অর্থাৎ ওদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হবে।

আমি যদি কাজটা না করি?

কাঁধ ঝাঁকাল টমাস। সেক্ষেত্রে আইন তার নিজস্ব পথে। এগোবে। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ প্রমাণ হলে দুটোর যে-কোন। একটা শাস্তি ওদের কপালে ঝুলছে-হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, নাহয় মৃত্যুদণ্ড। আমি দুঃখিত, মি. রানা-কাজটা করা ছাড়া আপনার। সামনে আর কোন বিকল্প আছে বলে তো আমার মনে হয় না…।

আছে, বলে হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে টমাসের দিকে এগোল রানা। কাঁধ থেকে তোমার মুণ্ডুটা আগে ছিড়ে নামাই…

টমাসের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল, সুইচবোর্ডের একটা বোতাম টিপে দিল সে। সবেগে বিস্ফোরিত হলো দরজা, হুড়মুড়। করে ভেতরে ঢুকল উদ্যত রিভলভার হাতে তিনজন সি.আই.এ.. এজেন্ট।

ভেতরে ঢুকে দ্রুত পজিশন নিল ওরা। দুজন দাঁড়াল টমাসের দুপাশে, আরেকজন চলে গেল রানার পিছনে। রানার চোখে চোখ রেখে ক্ষীণ একটু হাসল টমাস। কোথায় রয়েছেন ভুলে গেলে চলবে কেন! এখানে শুধু আমরাই জোর খাটাতে পারি, বাকি সবাইকে নত হতে হয়। আপনি রাজি হয়ে যান, দেখবেন, আমরা সবাই আপনার বন্ধু হয়ে গেছি।

পিছিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসল রানা। তোমার বাপদের খবর দাও; বলো, আমি রাজি নই। ভাবল, কি মনে করে ওরা, ব্ল্যাকমেইলিঙের কাছে নতি স্বীকার করব?

প্লীজ, মি. রানা, আরেকবার ভেবে দেখুন, বলল টমাস। নিয়াজ আর বিনয়ের এই বিপদের জন্যে আপনিও কোন অংশে কম দায়ী নন। আপনার নির্দেশেই ওরা গোপন তথ্য সংগ্রহ করছিল। তারপর ধরুন মিস সোহানার কথা। আপনার ওপর তার দুর্বলতার কথা কে না জানে। নিশ্চয়ই আপনি চান না এদের জীবন ধ্বংস হয়ে যাক?

ওদের কিভাবে মুক্ত করতে হবে আমার জানা আছে, বলল রানা। জানে, ও যদি রানা এজেন্সির অপারেটরদের নির্দেশ দেয়, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ-সাতজন সি.আই.এ. এজেন্টকে পাল্টা আটক করতে পারবে তারা। বন্দি বিনিময়ের প্রস্তাবটা তোমরাই আগে দেবে।

সি.আই.এ. এজেন্টদের সাবধান করে দেয়া হয়েছে, তাদের কেউ আটক করতে পারবে না। তাছাড়া, নিজের লোককে আপনি নির্দেশ দেবেন কিভাবে? আপনাকে আমরা ছাড়লে তো!

রানা জানে, এরই মধ্যে রানা এজেন্সি এবং বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স নিয়াজ, বিনয়, আর সোহানার গ্রেফতার হওয়ার খবর পেয়ে গেছে। বিশেষ করে এজেন্সির অপারেটররা রানার নির্দেশ পাবার জন্যে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে। ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে রানা যোগাযোগ না করলে কি ঘটেছে বুঝে নেবে ওরা, তার পরই পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে কাজে হাত দেবে। ওরা যদি সি.আই.এ. এজেন্টদের নাগাল না পায়, একমাত্র উপায় হিসেবে সোহানা, নিয়াজ, আর বিনয়কে ছিনিয়ে আনার চেষ্টায় কমান্ডো হামলা চালাবে, এবং মারা পড়বে অকাতরে।

হ্যাঁ, মুচকি হেসে আবার বলল টমাস, আপনি যা ভাবছেন আমিও তাই ভাবছি। প্রচুর রক্তপাত ঘটবে। দুপক্ষেরই। আপনি। কি সেটা চান?

কাঁধ ঝাঁকিয়ে রানা বলল, আমি বন্দি, কাজেই যাই ঘটুক না কেন আমাকে দায়ী করা যাবে না।

কিন্তু আপনাকে রাজি করাতে না পারলে আমাকে দায়ী করা। হবে, গম্ভীর সুরে বলল টমাস। কারণটা কি, কেন আপনি গো। ধরছেন?

নীতির প্রশ্ন, বলল রানা। নিরপেক্ষ থাকতে চাই আমরা। কখনও যদি রাশিয়ার বা আমেরিকার বিরুদ্ধে কিছু করি, শুধু। ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যেই তা করব। তাছাড়া, আত্মসম্মানবোধ আমাদের একটু বেশি, চাপের মুখে মাথা নোয়াই না।

রানার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চেহারা দেখে যা বোঝার বুঝে নিল টমাস। ঘি যখন উঠলই না, আঙুল আমাকে বাঁকা করতেই হয়! তার ইঙ্গিতে তিনজন তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলল রানাকে। আন্ডারগ্রাউন্ড সেলে নিয়ে যাও ওকে। টরচারের ফুল কোর্স শেষ করে তারপর রিপোর্ট করবে আমার কাছে।

চেহারা দেখে বোঝা না গেলেও মনে মনে আঁতকে উঠল রানা। সি.আই.এ-র নির্যাতন কি জিনিস জানা আছে ওর, নাসীরা। থাকলে তারাও লজ্জা পেত। ফুল কোর্স মানে বারো ঘণ্টা মেয়াদে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার, বেশিরভাগ লোক ছঘণ্টার মধ্যেই মারা যায়। বারো ঘণ্টার নির্যাতন সহ্য করে কেউ যদি বেঁচে থাকে, পঙ্গু এবং উন্মাদ অবস্থায় বাকি জীবন কাটে তার।

করিডরে আরও দুজন সশস্ত্র এজেন্ট ওদের সাথে যোগ দিল। সিঁড়ি বেয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড সেলে নামার সময় রানার মাথার ভেতরঝড় বয়ে গেল। জানে বাধা দিয়ে কোন লাভ নেই। অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়ে দুএকজনকে আহত করা সম্ভব, এক-আধজনকে হয়তো মেরেও ফেলা যায়, কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে যাবার কোন উপায় নেই। অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন হয়তো কিছুই জানেন না, তার সই সম্ভবত নকল করেছে ওরা। বাংলাদেশ দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়, সম্ভব নয় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ফোন করা। ভদ্রলোকের সাথে রানার পরিচয় আছে, সি.আই.এ-র এই ভূমিকা সম্পর্কে জানলে নিশ্চয়ই খেপে উঠবেন।

এত কথা ভাবল রানা, কিন্তু একবারও ওদের প্রস্তাব মেনে নেয়ার কথা বিবেচনা করল না। ক্ষীণ একটু স্বস্তি বোধ করছে ও, নর্থ পোলে ওকে পাঠানো যদি খুব জরুরী হয় তাহলে নির্যাতনের একটা সীমা থাকবে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা করবে ওরা, সে রাজি হবে যেতে।

লোহার একটা বেডে শোয়ানো হলো রানাকে, কয়েক জোড়া স্ট্র্যাপ দিয়ে এমনভাবে বাঁধা হলো হাত-পা, এক চুল নড়ার উপায় থাকল না। সেল থেকে বিদায় নিল টমাস, যাবার সময় সম্পূর্ণ হতাশ করে দিয়ে গেল রানাকে। আপনি আমাদের কোন কাজে আসবেন না এটা ধরে নিয়েই টরচার চালানো হবে, মি. রানা, নির্দয় সুরে বলল সে। আপনার নাম-পরিচয় নিয়ে অন্য লোক যাবে নর্থ পোলে।

টেপ দিয়ে রানার চোখের পাপড়িসহ পাতা জোড়া ভুরুর সাথে আটকে দেয়া হলো, ফলে চেষ্টা করলেও চোখ বন্ধ করা সম্ভব নয়। তার টেনে নামানো হলো ওর চোখের সামনে, শেষ প্রান্তে ঝুলছে। দুশো পাওয়ারের নগ্ন একটা বালব। সিলিং থেকে ঝুলছে একটা। সরু পাইপ, পাইপের মুখ থেকে হিম শীতল ঠাণ্ডা পানির ফোঁটা পড়তে শুরু করল রানার কপালের ঠিক মাঝখানে। বালবটা। আগেই জ্বেলে দেয়া হয়েছে।

তিন মিনিট সহ্য করল রানা, তারপর গোটা ব্যাপারটা সহ্যের বাইরে চলে গেল। পানির ফোঁটাগুলো ঠাণ্ডা বোমার মত বিস্ফোরিত হলো কপালে। প্রতি দুসেকেন্ডে একটা করে শীতল ফোঁটা। সময়ের সাথে তাল দিয়ে একই ছন্দে জ্বলতে আর নিভতে লাগল বালবটা। রানার পায়ের কাছে বসে আছে এক লোক, দুপায়ের। তলায় পাখির পালক দিয়ে নিবিষ্ট মনে আলতো সুড়সুড়ি দিয়ে চলেছে সে।

দুসেকেন্ড পর পর আলোর বিস্ফোরণ, কিন্তু আলোর ভেতর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না রানা। লোকে অন্ধ হয়ে গেলে অন্ধকার। দেখে, রানা অন্ধ হয়ে গিয়ে শুধু আলো দেখছে। কারও গায়ে বোমা ফাটলে তার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, রানার গায়ে বোমাও। পড়ছে না, শরীরও ছিন্নভিন্ন হচ্ছে না, কিন্তু অনুভূতিটা হচ্ছে হুবহু সেই রকম-দুসেকেন্ড পরপর একবার করে।

দেখতে না পেলেও রানা টের পেল, ক্ষুরধার কিছু দিয়ে ওর গায়ের কাপড় ছিড়ে ফেলা হলো। নির্যাতনের পর্যায়গুলো জানা আছে ওর। ওর বুকের বোঁটায় এবার ইলেকট্রিক কাকড়া বসানো হবে। কোমর থেকে ট্রাউজারও নামিয়ে ফেলা হলো। এরপর আন্ডারঅয়্যার। পেনিসের ডগায়ও থাকবে একটা কাঁকড়া।

আধ ঘণ্টার বেশি ইলেকট্রিক শক দেয়া হয় না, লোকটাকে যদি তাড়াতাড়ি মেরে ফেলার ইচ্ছে থাকে তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। শক দেয়া শুরু হলে রানার সারা শরীর প্রায় অসাড় হয়ে যাবে, কাজেই পায়ে সুড়সুড়ি দেয়ার আর কোন মানে হয় না। পানির ফোটা আর আলোর বিস্ফোরণ চলতেই থাকবে, তবে সেজন্যে আলাদা কোন লোকের দরকার নেই। সেলে এখন শুধু একজন লোকই রয়েছে, জন মিলার।

মানুষকে কষ্ট দিয়ে যারা পৈশাচিক আনন্দ পায়, মিলার তাদের একজন। তাকে এই মুহূর্তে রানা দেখতে পাচ্ছে না বটে, কিন্তু তার সম্পর্কে গোপন অনেক কথা জানা আছে ওর। এই লোক আজরাইলের চেয়েও ভয়ঙ্কর, নির্দয় অত্যাচার চালিয়ে ধীরে ধীরে জান কবচ করে।

দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে ঝাড়া পাঁচ মিনিট সময় লাগবে রানার। একাধারে বিস্মিত এবং শঙ্কিত হয়ে উঠেছে ও। কপালে শীতল বোমা ফাটছে না, চোখে বিস্ফারিত হচ্ছে না সাদা আলো। ব্যাপারটা কি? কি ঘটতে যাচ্ছে? বুঝতে দুমিনিট সময় লাগল, চোখের পাতা থেকে খুলে নেয়া হয়েছে টেপ। চোখ বন্ধ করতে পারছে ও। কানের কাছে ফিসফিস করে উঠল হিসহিসে একটা কণ্ঠস্বর, আরও তিন মিনিট পর চোখ খুলবেন, মি. রানা।

সারা শরীরে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। মাথা আর চোখে প্রচণ্ড ব্যথা, সারা শরীর ঘামছে দরদর করে। তিন মিনিট পর ধীরে ধীরে চোখ মেলল রানা। প্রথম কিছুই দেখল না, সব ঝাপসা, তারপর একটু একটু করে কেটে গেল অস্পষ্ট কুয়াশা ভাব।

সিলিঙে একটা টিউবলাইট জ্বলছে। ওর মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে একটা মুখ। কোথায় যেন দেখেছে লোকটাকে।

আমি জন মিলার, বলল লোকটা, চেহারায় চাপা উত্তেজনা। আপনি আমার সম্পর্কে জানেন, দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা?

মুহূর্তের জন্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল রানার চেহারা। লোকটাকে চিনতে পেরেছে ও।

রাজি হয়ে যান, নিচু গলায় দ্রুত বলল জন মিলার। করে। দিন কাজটা। আমরাও চাইছি ইভেনকো রুস্তভ এখানে চলে আসুন। আপনি শুধু তাঁকে এখানে পৌঁছে দিন-প্লীজ, মি. রানা।

তারপর আবার যাকে তাই অবস্থা। রানা কোন প্রশ্ন বা প্রতিবাদ করার আগেই জ্যান্ত হয়ে উঠল ইলেকট্রিক কঁকড়া, সেই সাথে বিস্ফোরিত হলো পানির ফোঁটা আর চোখ ধাঁধানো আলো।

জ্ঞান হারাবার আগে ভাবনা চিন্তার জন্যে অল্পই সময় পেল রানা। অনেক দিন থেকেই জানে ও, জন মিলার সোভিয়েত স্পাই, সি. আই. এ-র ভেতর ঠাই করে নিয়েছে। সি.আই. এর ওপর একটা মোক্ষম প্রতিশোধ নেয়ার চমৎকার সুযোগ দেখতে পেল ও। কে.জি.বি.-ও চাইছে ইভেনকো রুস্তভ আমেরিকায় চলে আসুক, তারমানে রহস্যের ভেতর রহস্য আছে। রুস্তভের কাছে হয়তো। অমূল্য কোন ডকুমেন্ট আছে, সেগুলো পাবার আশায় উন্মুখ হয়ে। আছে সি.আই.এ.। আর কে. জি. বি. হয়তো ভাবছে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে পাঠাবে রুস্তভকে। এক সময় ব্যাপারটা হয়তো চাপা। থাকবে না, ফাঁস হয়ে যাবে, কিন্তু ততদিনে আমেরিকায় বসে মার্কিনীদের অমূল্য কিছু ডকুমেন্টে চোখ বুলাবার সুযোগ পেয়ে যাবে রুস্তভ। ভুয়া কাগজ-পত্র গুছিয়ে দিয়ে, শত্রুপক্ষের গোপন কাগজ-পত্র হাত করে, আবার ফিরে যাবে রুস্তভ। মস্ত একটা ঠক। খেয়ে আঙুল চোষা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না সি. আই.এ-র। কিংবা এমনও হতে পারে রুস্তভ হয়তো কে.জি.বি.-র ভূমিকা সম্পর্কে কিছুই জানে না। তার পালিয়ে আসার ইচ্ছে সম্পর্কে কে.জি.বি. জানে, এ-সম্পর্কেও হয়তো তার কোন ধারণা নেই।

এত ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও চলবে। নর্থ পোল থেকে ইভেনকো রুস্তভকে আমেরিকায় নিয়ে আসতে পারলে কে.জি.বি.-র একটা উপকার করা হবে, রানার জন্যে এটুকু জানাই যথেষ্ট।

জ্ঞান ফেরার পর ফিসফাস গলার আওয়াজ পেল রানা। অত্যন্ত মার্জিত একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আপনি শান্ত থাকুন, মি. রানা। আপনার এই অবস্থার জন্যে যে লোক দায়ী তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। আমরা সবাই অনুতপ্ত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। প্লীজ, দশ মিনিট পর চোখ খুলবেন।

এখনও রানা নগ্ন, তবে চাদরে গা ঢাকা রয়েছে। একটা ইঞ্জেকশন দেয়া হলো ওকে, শরীরের সব ব্যথা দূর হয়ে গেল। দশ মিনিট পর চোখ মেলে দেখল, ছোট্ট একটা কেবিনে নরম, সাদা বিছানায় শুয়ে রয়েছে ও। দুজন ডাক্তার আর একজন নার্সকে দেখা গেল, তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সি.আই.এ-র পদস্থ একজন কর্মকর্তা। লোকটাকে চিনতে পারল রানা, ডেপুটি ডিরেক্টর কর্নেল উইলিয়াম অবসন।

খবর পাওয়া মাত্র ল্যাংলি থেকে ছুটে এসেছি আমি, মি. রানা, ডাক্তার আর নার্সকে ঠেলে সামনে এগিয়ে এল ডি. ডি.। তার পিছন থেকে উঁকি দিলেন আর্কটিক জোনের অপারেশনাল। চীফ জেনারেল ফচ। আপনার ওপর যে অন্যায় করা হয়েছে তার। জন্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা চাইছি। টমাস একটা গর্দভ, এর জন্যে তাকে শাস্তিও পেতে হবে। জেনারেল ফচ অফিসে ছিলেন। না, থাকলে এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটত না…

বিছানার ওপর উঠে বসতে গেল রানা, তরুণী নার্স দ্রুত এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। ধীরে, স্যার, ধীরে। রানাকে বসিয়ে ওর পিছনে কয়েকটা বালিশ ঠেসে দিল সে। তার কোমল, উন্নত স্তন চাপ দিল রানার কপালে। এক চুমুকে এটুকু খেয়ে নিন, স্যার, বলে রানার মুখে আধ গ্লাস ব্র্যান্ডি ধরল সে।

গ্লাসটা শেষ করে ডি. ডি. কর্নেল অবসনের দিকে তাকাল রানা। এখন তাহলে আমি এখান থেকে যেতে পারি?

হাত দুটো প্রসারিত করে কর্নেল বলল, কেউ আপনাকে বাধা দেবে না। কিন্তু তার আগে আপনার যত্ন নেয়ার অনুমতিটুকু দয়া করে দিন আমাদের, প্লীজ। বলে ঘুরে দাঁড়াল সে, এবং তার পিছু পিছু কামরা থেকে নার্স বাদে আর সবাই নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।

বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হচ্ছে, চোখ মটকে বলল রানা। নরক থেকে সরাসরি একেবারে স্বর্গে? এ-ও এক ধরনের ট্রিটমেন্ট, তাই না?

গোলাপী ঠোঁটে একটা আঙুল রেখে নার্স বলল, চুপ! কথা বলা নিষেধ। একটানে রানার গা থেকে চাদরটা তুলে নিল সে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত সকৌতুকে দেখল। দুষ্টুমিভরা হাসি দেখা গেল তার সারা মুখে। মাই গড! কিন্তু বিস্ময় প্রকাশের কারণটা বলল না। রানার শরীরের তিন জায়গায় খুদে আকৃতির ক্ষত দেখা গেল, বুকের দুটো বোঁটায় আর পেনিসের মাথায়। ক্ষতগুলো আঙুলের আলতো স্পর্শে পরখ করল সে। মৃদু হেসে বলল, চব্বিশ ঘণ্টা মেয়েদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে, তাহলেই মেরামত হয়ে যাবে চামড়া। গুরু নিতম্বে ঢেউ তুলে পিছন ফিরল সে। কাঁধ ধরে ঝুলে পড়ুন, বাথরুমে নিয়ে যাই।

হেঁটেই বাথরুমে ঢুকল রানা। গরম পানি দিয়ে ওকে গোসল করিয়ে দিল নার্স। হ্যাঙ্গারে নতুন এক প্রস্থ কাপড়চোপড় ঝুলছে, এক এক করে রানাকে পরানো হলো। কেবিনে ফিরে মেয়েটার জেদে এক বাটি গরম মুরগির সুপও খেতে হলো ওকে। ওর মাথা আঁচড়ে দিল মেয়েটা, তারপর রানার দুই গালে আর ঠোঁটের ওপর হালকা চুমো খেয়ে গুডলাক বলল, কোমর দুলিয়ে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। প্রায় সাথে সাথে ভেতরে ঢুকল কর্নেল অবসন আর জেনারেল ফচ।

এটা একটা মানবিক প্রশ্ন, মি. রানা, কোন ভূমিকা না করেই নতুন করে প্রস্তাবটা পাড়ল কর্নেল অবসন। কাজটা আপনি করবেন কি করবেন না, সেটা সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার, কেউ আপনাকে জোর করছে না। তবে, একজন মক্কেল হিসেবে রানা এজেন্সির সার্ভিস আশা করার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে, ঠিক কিনা? কাজটা কি আপনি জানেন, কিন্তু এর পুরস্কার কি তা জানেন না। ওয়ান বিলিয়ন ডলার, মি. রানা।

কত বললেন? রানার মনে হলো ভুল শুনেছে।

এক হাজার মিলিয়ন ডলার, মি. রানা, সি.আই.এ-র ডেপুটি ডিরেক্টর সবিনয়ে হাসল। সমস্ত খরচ আমাদের। সত্যি কথা বলতে কি, ইভেনকো রুস্তভ সাথে করে যা নিয়ে আসবে তার। দামের তুলনায় এক বিলিয়ন ডলার হাতের ময়লা মাত্র। আমার। শুধু একটাই অনুরোধ, মি. রানা, প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দেয়ার আগে। মাথা ঠাণ্ডা করে একটু ভেবে দেখুন…

এমন ভাব করল রানা যেন গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। ঝাড়া এক মিনিট পর মুখ তুলে বলল, আমার তিন সহকর্মীকে মুক্তি না দিলে এমনকি আমি আলোচনা করতেও রাজি নই।

ফোনের রিসিভার তুলে রানার দিকে বাড়িয়ে দিল কর্নেল। অবসন, সেই সাথে রানার সামনে একটা নোটবুক খুলে ধরল। সরাসরি ডায়ালিং পদ্ধতি, মি. রানা। নাম্বার দেখে ফোন করুন। ওদের আমরা এরই মধ্যে ছেড়ে দিয়েছি। এমনকি ওদের ওপর। থেকে সমস্ত অভিযোগও তুলে নেয়া হয়েছে।

নোটবুকে গ্রীনল্যান্ড, আর কলোরাডোর নাম্বার দেখল রানা। প্রথমে কলোরাডোর নাম্বারে ডায়াল করল ও। সাঙ্কেতিক ভাষায় দুমিনিট কথা হলো সোহানার সাথে। নিয়াজ আর বিনয়ের সাথেও। আলোচনা হলো। অবসন মিথ্যে বলেনি।

এবার আমি আমার বসের সাথে কথা বলতে চাই, বলল। রানা। আপনাদের বাইরে যেতে হবে।

বি.সি.আই. হেডকোয়ার্টার ঢাকার নাম্বারে ডায়াল করে মেজর। জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের সাথে মিনিট দশেক কথা। বলল রানা। বস্ ওকে সবুজ সঙ্কেত দিয়ে জানালেন, সি. আই. এ. যদি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, তার বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা আছে তার হাতে।

কেবিনের দরজা খুলে ওদেরকে ডাকল রানা। ব্যাপারটা এবার শোনা যেতে পারে।

.

মোটামুটি ছবিটা পেলাম, বলল রানা। এবার বলুন, এই রুশ ভদ্রলোক, ইভেনকো রুস্তভ, এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

আর্কটিক জোনের অপারেশনাল চীফ জেনারেল ফচের অফিসে বসে কথা বলছে ওরা।

তিনি গুরুত্বপূর্ণ, এটুকুই শুধু আপনাকে বলা যায়, বললেন জেনারেল ফচ। তাঁর সম্পর্কে বাকি সব তথ্য টপ সিক্রেট।

ঠাণ্ডা চোখে জেনারেলের দিকে তাকাল রানা, তারপর সি.আই.এ-র ডেপুটি ডিরেক্টরের দিকে ফিরল। কর্নেল তাড়াতাড়ি শুরু করল, ইভেনকো রুস্তভ সোভিয়েত রাশিয়ার এক নম্বর ওশেনোগ্রাফার। ওদের গোটা জুলিয়েট আর রোমিও সিস্টেম আর্কটিক সী-বেডে বিছানোর কাজটা তিনি নিজে সুপারভাইজ করেছেন। সাথে করে মেরিলিন চার্ট নিয়ে আসছেন তিনি, ওই সিস্টেমের কমপ্লিট ব্লু-প্রিন্ট ওটা। আর্কটিক বরফের তলা দিয়ে আমাদের তীর পর্যন্ত আসতে পারে ওদের সাবমেরিনগুলো, কারণ ওই সিস্টেম গাইড হিসেবে কাজ করে। ব্লু-প্রিন্টের গুরুত্ব কতখানি এবার নিশ্চয়ই বুঝেছেন, মি. রানা?

মাথা ঝাঁকাল রানা। মনে মনে ভাবল, আসল জিনিস তোমাদের কপালে নেই, ওই সিস্টেমের নকল ব্লু-প্রিন্ট পাবে তোমরা।

চার্টগুলো আমাদের হাতে এলে ওদের গোটা অফেনসিভ সিস্টেম ভেঙে চুরমার করে দেব আমরা, পাক্কা দশ বছর পিছিয়ে যাবে ওরা, বলে চলল কর্নেল অবসন। মে মাসে প্রেসিডেন্টের মস্কোয় যাবার কথা রয়েছে, তখন যদি তাঁর পকেটে মেরিলিন চার্ট থাকে, জোর গলায় কথা বলতে পারবেন তিনি। কাজেই একজন। যোগ্য লোককে গ্রীনল্যান্ডে পাঠাতে চাইছি আমরা। আপনি, মি.। রানা…

তাড়াহুড়ো করে ফেলেছেন, বাধা দিয়ে বলল রানা। কোথাও যাব বলে এখনও আমি রাজি হইনি। চেয়ার ছেড়ে ম্যাপের সামনে দাঁড়াল ও। ম্যাপের নিচের দিকে একটা তারকা-চিহ্নের ওপর আঙুল রাখল। এটা কি কিউট-আইসব্রেকার?

হা। আর্কটিকে এক বছর কাটিয়ে মিলওয়াউকিতে ফিরে আসছে।

আমি হয়তো চাইতে পারি ঘুরিয়ে নিয়ে আবার ওটাকে। আইসফিল্ডে ফিরে যেতে বলা হোক…

রানাকে বাধা দিল জেনারেল ফচ, প্ল্যানটা আমরা করছি, মি. রানা, আপনি নন…।

তাহলে আপনারাই যান না কেন ওখানে? জিজ্ঞেস করল রানা। কর্নেলের দিকে ফিরল ও। গোটা ব্যাপারটা এমনিতেই জট পাকিয়ে আছে। থিউল-এর সিকিউরিটি লিক সব ভণ্ডুল করে দিতে পারে। ভাল কথা, আমি যদি কাজটা করি, আমার দুজন সহকারী লাগবে।

বেশ তো, লোকের কোন অভাব নেই আমাদের…

মাথা নাড়ল রানা। ওরা আমার লোক হতে হবে, বলল ও। নিয়াজ আর বিনয়ের কথা ভাবছি আমি।

কিন্তু তা কি করে সম্ভব! ঘোর আপত্তি জানালেন জেনারেল ফচ। সি.আই.এ-র অ্যাসাইনমেন্ট অথচ আমাদের কোন লোক থাকবে না…

এখন আর এটা সি.আই.এ-র অ্যাসাইনমেন্ট নয়, জেনারেল, বলল রানা। আমি যদি ভুল বুঝে না থাকি, কেসটা আপনারা রানা এজেন্সিকে দিচ্ছেন, তাই না?

জেনারেল আমতা আমতা করে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই মুখ খুলল কর্নেল অবসন, ঠিক তাই, মি. রানা।

আমি তাহলে থিউল-এ যাব আগে, নিয়াজ আর বিনয়কে তুলে নেয়ার জন্যে, বলল রানা। ওখান থেকে কার্টিস ফিল্ডে। আই.আই. ফাইভের সবচেয়ে কাছের এয়ারফিল্ডের ওপর আঙুল রাখল ও।

অসন্তুষ্ট হলেও, নিজেকে দ্রুত সামলে নিলেন জেনারেল ফচ। বললেন, এফ.বি.আই. এজেন্ট মরিসন বলছে, কাঁকড়ার আসল পরিচয় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বের করে ফেলতে পারবে সে। আমরা যদি আগেভাগে কোন নির্দেশ পাঠাতে চাই, জনসনকে রেডিও মেসেজ পাঠাতে পারব-সে ওখানকার সিকিউরিটি চীফ।

আমি যদি ভাল মনে করি, তবেই, বলল রানা। জেনারেলের কাছ থেকে আবহাওয়ার রিপোর্টটা চেয়ে নিয়ে চোখ বুলাল ও। কুয়াশা নেই। কিন্তু হওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা। তারমানে, কার্টিস ফিল্ড থেকে আমরা তিনজন কুয়াশার কিনারা পর্যন্ত প্লেনে করে যাব, ওখান থেকে আই.আই. ফাইভে যেতে হবে স্লেজে চড়ে-আদৌ যদি খুঁজে পাই ওটাকে। এরপর ইভেনকো রুস্তভকে সাথে নেব, ধরেই নিচ্ছি ভাঙাচোরা বরফের ওপর দিয়ে পঁচিশ মাইল হেঁটে আই.আই.ফাইভে পৌঁছুতে পারবে সে। এরপর বরফের ওপর দিয়ে একশো বিশ মাইল স্লেজে চড়ে আসতে হবে আমাদের, ধাওয়া করবে রুশ সিকিউরিটি…

কুয়াশার ভেতর থেকে আপনারা বেরিয়ে এলে আর কোন চিন্তা নেই, প্লেনে করে…

প্লেন যদি আমাদের খুঁজে পায়, বাধা দিয়ে বলল রানা। কিন্তু পাবে না। চারজন লোক, আর এক জোড়া স্লেজ টীমকে বছরের এ-সময়টায় খুঁজে পাওয়া কি রকম কঠিন, আপনার কোন ধারণা আছে, জেনারেল? আমার তো মনে হয় না আর্কটিকে আপনি কখনও গেছেন।

মুখ বেজার করে জেনারেল বললেন, কেন, প্লেনে করে মানুষকে উদ্ধার করা হয় না?

হ্যাঁ, হয়, ভারী গলায় বলল রানা। কিন্তু তা স্রেফ কপালগুণে। একটা প্লেন, নিখোঁজ দলটাকে খুঁজছে না, হঠাৎ তাদের দেখতে পেল-এভাবে। এক মুহূর্ত থেমে আবার বলল। রানা, আরেকটা জিনিস আমার ভাল ঠেকছে না। রুস্তভ কখন আসছেন আমরা জানি না। কর্নেলের দিকে তাকাল ও। কিউটকে আর্জেন্ট সিগন্যাল পাঠান, আবার উত্তর দিকে অর্থাৎ আইসফিল্ডের দিকে ফিরে যেতে হবে ওটাকে। ওয়াল-ম্যাপের এক জায়গায় পেন্সিল দিয়ে একটা তারকা-চিহ্ন আঁকল ও। এটা একটা ব্লাদিভো পয়েন্ট হতে পারে।

জেনারেল ফচ চোখ কপালে তুললেন, কিন্তু ওটা তো। আইসফিল্ডের অনেক গভীরে!

তারমানেই বরফ ভেঙে ভেতরে ঢুকতে হবে কিউটকে, বলল রানা। দুঘণ্টার মধ্যে একটা প্লেন চাই, গ্রীনল্যান্ডে নিয়ে যাবে আমাকে। নন-স্টপ ফ্লাইট হতে হবে।

আপনার জন্যে একটা বোয়িং অপেক্ষা করছে।

এবার বলুন, রুস্তভ কখন আসছেন সেটা আপনারা জানছেন। কিভাবে, নিজের চেয়ারে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল রানা।

নড়েচড়ে বসে শান্তভাবে শুরু করলেন জেনারেল ফচ, লেনিনগ্রাদ থেকে এক লোক হেলসিঙ্কিতে ফিরে আসবে, তার জন্যে অপেক্ষা করছি আমরা। লেনিনগ্রাদে ইভেনকোর এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করবে সে, সেই আত্মীয় তাকে জানাবে এন.পি.সেভেনটিন থেকে কোন তারিখে রওনা হবেন ইভেনকো। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে যে-কোন একটা দিন, এটুকু আমরা জানি। আমাদের লোক লেনিনগ্রাদ থেকে বেরিয়ে এলেই নির্দিষ্ট তারিখটা জানতে পারব।

এমন যদি হয়, লেনিনগ্রাদ থেকে সে বেরুতে পারল না? জিজ্ঞেস করল রানা।

কেন বেরুতে পারবে না! রানার কথা হেসে উড়িয়ে দিলেন জেনারেল। এর আগে কখনও রাশিয়ায় যায়নি সে, সেজন্যেই তাকে পাঠানো হয়েছে। অত্যন্ত অভিজ্ঞ লোক। হেলসিঙ্কিতে পৌঁছে সোজা আমাদের দূতাবাসে রিপোর্ট করবে সে। দূতাবাস থেকে সিগন্যাল পাব আমরা।

কোন মন্তব্য না করে আপনমনে শুধু কাঁধ ঝাঁকাল রানা।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত