মরণখেলা – খণ্ড ১
কাজী আনোয়ার হোসেন
০১.
আঠারোই ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার।
বিদ্যুতের আঁকাবাঁকা রেখা চিরে দিল কালো আকাশটাকে, কড়াৎ করে একটা বাজ পড়ল কোথাও। ঘনঘোর দুর্যোগের রাত, ঝড়ো হাওয়ায় নুয়ে নুয়ে পড়ছে বন-বাদাড়ের ঝাকড়া মাথা, একটানা তুমুল বর্ষণে থই থই করছে জলাভূমি আর ধু-ধু প্রান্তর। ওদেশে ফেব্রুয়ারি মানেই তো এই-প্রবল ঝড়, ঘন ঘন বজ্রপাত, আর তুমুল বৃষ্টি।
কুউউ, ঝিকঝিক ঝিকঝিক। ঝড়-বৃষ্টি মানামানি নেই, বত্রিশটা বগি নিয়ে ঘণ্টায় নব্বই মাইল গতিতে ছুটে চলেছে ফ্লোরিডা এক্সপ্রেস। বাঁধনহীন চাকায় গতির উল্লাস, সমস্ত যান্ত্রিক শব্দ এক হয়ে বারবার যেন একই সুরে গাইছে, যাকে পাই তাকে খাই, যাকে পাই তাকে খাই। দুশো মাইলের মধ্যে কোথাও কোন বিরতি। নেই। বন্ধ জানালার বাইরে হিম শীতল প্রকৃতি ফুঁসছে, সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম থাকায় ট্রেনের ভেতরটা গরম। রাত প্রায় বারোটা, স্লিপিং কারের ভেতর কম্বল মুড়ি দিয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে বাংলাদেশী। এক যুবক।
প্রশস্ত স্লিপিং কারটাকে দুভাগ করেছে সরু একটা করিডর।
করিডরের দুপাশে ভারী পর্দা ঘেরা দুটো কেবিন। নরম বিছানায় শুয়ে দোল খাচ্ছে ঘুমন্ত আরোহী, সাউন্ড-প্রাফ দরজা জানালা দিয়ে ঝড় বা ডিজেল ইঞ্জিনের কোন আওয়াজই ভেতরে ঢুকছে না। কান পাতলে শুধু পাশের কেবিন থেকে ভেসে আসা প্রৌঢ় এঞ্জিনিয়ারের নাক ডাকার মৃদু শব্দ শোনা যাবে।
বিশ মাইল সামনে ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে চারজন সশস্ত্র লোক। ধু-ধু প্রান্তরের মাঝখানে এটা একটা পরিত্যক্ত স্টেশন, বিশ-পঁচিশ মাইলের মধ্যে কোন জনবসতি নেই। চারজনই ওরা দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ, দাঁড়িয়ে আছে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। প্রত্যেকের পরনে কালো সুট, সুটের ওপর ওভারকোট, ওভারকোটের ওপর রেনকোট, মাথায় চওড়া কার্নির্সঅলা হ্যাট। প্রত্যেকে শোল্ডার হোলস্টার পরে আছে, দুজন এরই মধ্যে হোলস্টার থেকে বের করে ওভারকোটের পকেটে রেখেছে। রিভলভার। ফ্লোরিডা এক্সপ্রেসের জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা।
সবচেয়ে লম্বা লোকটা ওদের দলপতি, ছয় ফিট দুইঞ্চি। কজি থেকে ওভারকোটের হাতা সরিয়ে হাতঘড়ির লিউমিনাস ডায়ালে চোখ বুলাল সে। বিশ মাইল দূরে রয়েছে ট্রেন, ট্রেনের সামনে ইতিমধ্যে বদলে গেছে সিগন্যাল। হতভম্ব ড্রাইভার বাধ্য হয়ে ব্রেক চাপ দিতে শুরু করেছে। দুঘণ্টার মধ্যে কোথাও থামার কথা না থাকলেও সিগন্যালকে অগ্রাহ্য করবার সাধ্য নেই তার।
ট্রেনে ব্যাটা থাকলে হয়, দলপতির পাশ থেকে সংশয় প্রকাশ করল একজন, দুহাতের ভেতর আড়াল করা দোমড়ানো সিগারেটে কষে একটা টান দিল সে। ঠাণ্ডায় হি হি করছে।
কটমট করে লোকটার চোখের দিকে তাকাল দলপতি,
চেহারায় তীব্র ভৎর্সনা। আছে, শান্ত গলায় আশ্বস্ত করল সে। হেডকোয়ার্টারের ইনফরমেশন ভুল হতে পারে না।
থাকলেও, বলে খানিক ইতস্তত করল ধূমপায়ী, ওর সম্পর্কে যা শুনলাম, ট্রেন থেকে নামানো সহজ হবে বলে মনে হয় না।
এটা দেখে বাপ বাপ করে নেমে আসবে। ওভারকোটের পকেট থেকে পয়েন্ট ফরটিফাইভ কোল্ট রিভলভারটা বের করে। দেখাল দলপতি। সিলিন্ডার চেক করে আবার সেটা পকেটে রেখে দিল সে। মনে আছে তো, আমাদের নাটকের এক-আধজন দর্শক। থাকতে হবে। আর অভিনয়ে কোন খুঁত থাকা চলবে না।
মাসুদ রানা…মাইরি বলছি, নামটার মধ্যে কেমন যেন ইস্পাত ইস্পাত, নিরেট একটা ভাব আছে…
ভয়ের কিছু নেই। সে একা, আমরা চারজন…
কিন্তু খেপে গেলে সে নাকি একাই একশো…
আরে রাখো, অমন বীরপুরুষ কত দেখলাম! তাচ্ছিল্যের। সাথে মন্তব্য করল একজন।
আরেকজন ঝাঁঝের সাথে বলল, আহত করা যাবে না, এ। আবার কি কথা! ও যদি ব্যাপারটা টের পেয়ে যায়, কি অবস্থা হবে ভাবতে পারো? এক একজনকে ধরে আছাড় মারবে, অথচ আমরা তার গায়ে আঁচড়টাও কাটতে পারব না!
নির্দেশ নির্দেশই, দলপতির গম্ভীর তিরস্কার শোনা গেল। সব কথা জানো না, কাজেই চুপ করে থাকো। আর, আহত করা যাবে না মানে আমি বলতে চেয়েছি, লোকটাকে অচল করা যাবে না। বিশেষ করে পা, চোখ, আর হাত যেন অক্ষত থাকে। কেউ গুলি করবে না, কারণ কোথায় লাগতে কোথায় লাগে তার ঠিক নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ওর নাক বা দাঁত ভাঙা যাবে না। অফিসে ওর ওপর টরচার চালানো হবে বলে শুনে এসেছি। শুধু লক্ষ রাখতে হবে, লোকটা যেন অচল হয়ে না পড়ে।
সতেরো মাইল দূরে রয়েছে ফ্লোরিডা এক্সপ্রেস। চেহারায় রাজ্যের উদ্বেগ নিয়ে ঝড়ো রাতের দিকে তাকিয়ে আছে ড্রাইভার। এইমাত্র পেরিয়ে আসা সিগন্যালের নির্দেশ ছিল, গতি কমাতে হবে। অথচ দুঘণ্টার মধ্যে ট্রেনের কোথাও থামার কথা নয়। কি ঘটছে কী?
স্পীড ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছে ড্রাইভার। ইস্পাত-মোড়া ছাদে ঝক ঝক বৃষ্টি পড়ছে, কাঁচমোড়া দরজা আর জানালার বাইরে দাপাদাপি করছে বাতাস। পরবর্তী সিগন্যালকে পাশ কাটিয়ে এল ট্রেন। টকটকে লাল সঙ্কেত-মানে, সামনে বিপদ। ট্রেন থামাবার চূড়ান্ত নির্দেশ। এর মানেটা কি? ব্রেকের ওপর চাপ আরও বাড়াল ড্রাইভার। সেডার ফলসের কাছাকাছি চলে এসেছে ট্রেন। সামনে পরিত্যক্ত স্টেশন। অনির্ধারিত বিরতি।
দুমিনিট পর একটা ঝাঁকি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ফ্লোরিডা এক্সপ্রেস। কড়কড় কড়াৎ করে কাছে পিঠে কোথাও একটা বাজ পড়ল। ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরল মাসুদ রানা, ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ একটু হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল, সারা শরীর শিউরে উঠল গোপন পুলকে। স্বপ্ন দেখছে রানা, মধুর সুখে ওর শরীর-মনভরপুর।
করিডরের দুপাশের পর্দা হ্যাঁচকা টানে ছিড়ে ফেলা হলো। ভেজা রেনকোট পরা তিনজন লোক রানার বিছানার সামনে দাঁড়াল। কেবিনের মেঝেতে পানি জমছে। দলপতির হাতে পাসপোর্ট সাইজের একটা ফটো, রানার চেহারার সাথে ফটোটা। মেলাল সে। হ্যাঁ, এই লোকই, ডিক, শান্ত গলায় বলল সে।
ধীরে ধীরে চোখ মেলল রানা। কোল্ট ফরটিফাইভের কালো। মাজুল লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সরাও ওটা, বিড়বিড় করে বলল ও। গুলি বেরিয়ে যেতে পারে, তোমার হাত ভিজে।
এক নিমেষে বিপদ আঁচ করে নিয়েছে রানা। ট্রেন চলছে না, তিন আগন্তুকের গায়ে ভিজে রেনকোট, প্রৌঢ় আরোহীর বিস্ফারিত চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক। দলপতির দুপাশে দাঁড়ানো লোক দুজন। রিভলভার বের করেনি, তবে রেনকোটের বোতাম খুলে
ওভারকোটের পকেটে হাত ভরে রেখেছে। ওদের একজন রানার। দিকে একটু পাশ ফিরে আছে, লক্ষ রাখছে অপর আরোহীর। দিকে।
কাপড় পরো, কঠিন সুরে নির্দেশ দিল দলপতি। ট্রেন থেকে নামতে হবে তোমাকে।
মামার বাড়ির আবদার? উদ্বেগ গোপন করে ফেঁস করে। উঠল রানা। কে তুমি? রানা এজেন্সির শাখা অফিসগুলোয়। সারপ্রাইজ ভিজিট দিচ্ছে ও, বিরতিহীন এক হপ্তা চরকির মত আমেরিকার এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ক্লান্ত। সম্ভাবনাগুলো সতর্কতার সাথে বিবেচনা করল। অতর্কিতে ঝটকা মেরে দলপতির হাত থেকে রিভলভারটা ফেলে দিতে পারে। একই সাথে তার ডান পাশে দাঁড়ানো লোকটার তলপেটে হাঁটু দিয়ে। গুঁতো মারতে পারে। তৃতীয় লোকটা ওভারকোট থেকে রিভলভার বের করার আগেই…না, ঝুঁকি নেয়া উচিত হবে না। গুলি শুরু হলে বেচারা এঞ্জিনিয়ার মারা যেতে পারে।
রেক্স, এফ.বি.আই., ঘেউ ঘেউ করে উঠল দলপতি। তাড়াতাড়ি করো-ট্রেন তোমার জন্যে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকবে…
নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হয়েছে তোমাদের, গম্ভীর গলায় বলল রানা। আমি একজন বাংলাদেশী…, হুকের সাথে ঝুলন্ত জ্যাকেটের দিকে হাত বাড়াল ও।
ওয়াচ ইট! গর্জে উঠল রেক্স। চোখের পলকে তার দুই সঙ্গীর হাতে রিভলভার বেরিয়ে এল।
আমি নিরস্ত্র, ব্যঙ্গ মেশানো মুচকি একটু হাসি দেখা গেল রানার ঠোঁটে। ওদের হুমকি গ্রাহ্য না করে হুক থেকে জ্যাকেটটা নামাল ও। পাসপোর্ট বের করছি। তিনটে রিভলভারের মাজুল ওর দিকে তাক করা, দেখেও না দেখার ভান করল ও। ভেতরের পকেট থেকে দুআঙুলে ধরে সাবধানে পাসপোর্টটা বের করে দলপতির দিকে বাড়িয়ে দিল।
এক হাত ব্যবহার করেই পাসপোর্টটা খুলল রেক্স, খুঁটিয়ে দেখল, তারপর গম্ভীর গলায় বলল, জাল পাসপোর্ট, ডিক-তাও একেবারে কাঁচা হাতের কাজ। রানার দিকে ফিরল সে, পাসপোর্টটা নিজের পকেটে ভরল। বুঝতেই পারছ, তুমি ধরা পড়ে গেছ। এখন আর কোন কৌশলই কাজে আসবে না। লক্ষ্মী ছেলের মত যাবে, নাকি টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে হবে?
ওটা যদি জাল পাসপোর্ট হয়, তাহলে তোমরাই বলো, আমি কে? জিজ্ঞেস করল রানা। দ্রুত চিন্তা করছে ও। এদের সাথে কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু মুক্তি পেতে হলে ট্রেন থেকে নামতে হবে ওকে। মোক্ষম একটা সুযোগ দরকার, নিরীহ একজন আরোহীর উপস্থিতিতে তা পাওয়া যাবে না।
জবাব না দিয়ে হাতঘড়ি দেখল রেক্স, রানার কথা যেন শুনতেই পায়নি।
আমি জন ফাইবার, করিডরের ওদিক থেকে বলল প্রৌঢ় এঞ্জিনিয়ার। এই ভদ্রলোকের সাথে আমার কথা হয়েছে। বললেন, রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির উনি ডিরেক্টর…
ভদ্রলোক, হুঁহ! ঘড়ি থেকে চোখ তুলে এঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকাল রেক্স। রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি ওকে আমাদের। হাতে তুলে দেয়ার জন্যে গরুখেজা করছে। রানার দিকে ফিরল সে। আল মাসুদ, হাত দুটো এক করে বিছানার ওপর রাখো!
গায়ের কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে নামল রানা। দ্রুত এক পা। পিছিয়ে গেল রেক্স। দেখা গেল টাই, জ্যাকেট আর জুতো ছাড়া কাপড়চোপড় পরেই শুয়েছিল রানা।
আমরা নেমে গেলেই ট্রেন ছাড়বে, রানার টাই আর জুতো পরা শেষ হতে এঞ্জিনিয়ারকে বলল রেক্স। তখন আপনি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে পারবেন। ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিন যে বদমাশটার সাথে। এতক্ষণ থেকেও প্রাণটা খোয়াননি।
জ্যাকেট পরতে পরতে নির্লিপ্ত চোখে দলপতির দিকে তাকাল রানা, প্রতিবাদ করল না।
ওটা তোমার ব্যাগ? জিজ্ঞেস করল রেক্স, উত্তরের অপেক্ষায় থেকে ডান পাশের সহকারীকে ইশারা করল সে। সহকারী টেবিল থেকে রানার ব্যাগটা তুলে নিল। এবার হাত দুটো এক। করে… রেক্সের বাঁ পাশের লোকটার হাতে একটা হ্যান্ডকাফ দেখা গেল…
না, দৃঢ় কণ্ঠে বলল রানা। হয় আমি এভাবেই যাব, না হয়। আমাকে গুলি করতে হবে-কি করবে ঠিক করো।
করিডর ধরে এগোল ওরা। রানার সামনে ব্যাগ হাতে ডিক, পিছনে রিভলভার হাতে রেক্স আর তার অপর সহকারী। দুপাশের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল আরোহীরা, ছোট্ট মিছিলটা দেখে বিস্মিত হলো। খালি পায়ে ওদের পিছু পিছু এল এঞ্জিনিয়ার জন ফাইবার। তাকে বলতে শোনা গেল, ওর সম্পর্কে কিছুই তো বললেন না! আমি হয়তো সাহায্য করতে পারতাম…।
উঁচু গলায় জবাব দিল রেক্স, সবাই যাতে শুনতে পায়, কুখ্যাত খুনী। ফলসাম জেল থেকে পালিয়েছে।
ধীর পায়ে হাঁটছে রানা, ঝুলে পড়েছে কাঁধ দুটো। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে, যেন আড়ষ্ট ভাবটা এখনও কাটেনি। ওর দিকে চেয়ে পিছন থেকে মুচকি হাসল রেক্স। ভাবল, লোকের অভ্যেসই এই, তিলকে তাল করা! এই লোক নাকি একাই একশো! হতে পারে-উলুবনে শেয়াল রাজা!
ট্রেনের বাইরে এ যেন আরেক জগৎ। সিঁড়ি বেয়ে রানা প্ল্যাটফর্মে নামতেই শীত, বৃষ্টি, আর বাতাস একযোগে হামলা চালাল। সেডার ফলস বনভূমির কিনারায় পরিত্যক্ত স্টেশন, বিদ্যুৎ চমকে ওঠায় নির্জন একতলা ভবনটাকে ভূতের আস্তানা বলে মনে হলো।
এঞ্জিন রুম ছেড়ে ড্রাইভার নামেনি, তবে কয়েক ফিট দূরে গার্ড আর ড্রাইভারের সহকারীকে দেখা গেল, এঞ্জিন রুম থেকে বেরিয়ে আসা আলোয় দাঁড়িয়ে ভিজছে। শেডের নিচে পৌঁছুতেই ভিজে গোসল হয়ে গেল রানা। হঠাৎ ওদের সবার গায়ে চোখ ধাঁধানো এক ঝলক আলো পড়ল।
হল্ট! পিছন থেকে নির্দেশ দিল রেক্স। ট্রেন না ছাড়া পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করব আমরা। টিমোথি, ক্যামেরা থেকে ফিল্মটা। খুলে নিয়ে এসো!
এঞ্জিন রুমের দিকে ছুটে গেল টিমোথি, আলোটা ওদিক থেকেই এসেছে। ড্রাইভারের সহকারী আর গার্ডের সাথে চাপা। স্বরে কথা বলল সে। কিছু একটা হাত-বদল হলো। টিমোথি ফিরে আসতে শুরু করল, লোক দুজন উঠে পড়ল ট্রেনে।
এক মুহূর্ত পর সচল হলো ট্রেন।
সুযোগের অপেক্ষায় আছে রানা, রেক্স সেটা ভাল করেই জানে। রানার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে রয়েছে সে, হাতের। রিভলভার বুক বরাবর তাক করা। রানার পিছনে রয়েছে ডিক।
টিমোথি ফিরে আসতে চারজনের দলটা প্ল্যাটফর্মের আরেক দিকে চলে এল। ঠাণ্ডায় হি হি করছে রানা। ওকে কাঁপতে দেখে সকৌতুকে হাসল রেক্স। ট্রেনের শব্দ দূরে মিলিয়ে যেতে সে বলল, দুঃখিত, একটু কষ্ট দিলাম। আমাদের অফিসে তোমার জন্যে গরম কফি আর যাবতীয় আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করা আছে, গেলেই দেখতে পাবে! ডিকের সাথে তার অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময়। রানার নজর এড়াল না।
স্টেশন থেকে নেমে বিশ গজের মত এগোল ওরা, বাঁকের মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকাণ্ড গাড়িটা। হেডলাইট জ্বলছে। ড্রাইভারকে নিয়ে সংখ্যায় প্রতিপক্ষ হলো চারজন।
সামনের দরজা খুলল ডিক, মাথা নিচু করে ড্রাইভারের পাশে উঠে বসতে যাচ্ছে টিমোথি। পিছনের সীটের দরজা খুলে রানাকে পথ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল রেক্স। কোন রকম কৌশল না করে গাড়ির ভেতরে ঢুকল রানা। সামনের সীটে মাত্র বসেছে টিমোথি, ড্রাইভার ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে রানার দিক। রানা গোবেচারা ভঙ্গিতে বসে আছে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে সামনের দিকে তাকাল। ড্রাইভার। পিছন থেকে তার মাথার চুল খামচে ধরল রানা।
বা কাঁধ, বাঁ হাত, আর মাথা দিয়ে সবেগে দরজার গায়ে পড়ল। রানা, ডান হাতে ধরে আছে ড্রাইভারের চুল। ঠিক যেন বিনা শব্দে একটা বোমা বিস্ফোরিত হলো গাড়ির ভেতর। সীটের পিঠ টপকে এল ড্রাইভার, পিছনের সীটের দরজার কাছে মেঝেতে মাথা পড়ল, পা দুটো সামনের সীটের পিঠে আটকে গেছে। দরজার গায়ে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে রানা, দরজার ধাক্কায় রাস্তার পাশে চিৎ হয়ে পড়েছে। রেক্স। ঝুঁকে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল সে, নাকটা চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেছে। গাড়ি থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে তার বুকের ওপর পড়ল রানা, এক ঝটকায় কেড়ে নিল হাতের রিভলভার।
কোল্ট অটোমেটিকটা রেক্সের ঘেঁতলানো, রক্তাক্ত নাকের ফুটোয় চেপে ধরল রানা। গোটা ব্যাপারটা চোখের পলকে ঘটে গেলেও হাতের ব্যাগ ফেলে দিয়ে এরই মধ্যে রানার দিকে রিভলভার ধরেছে ডিক।
গুলি করো, আহ্বান জানাল রানা। তবে রেক্সের আশা ছেড়ে দিয়ে! হেডলাইটের আলো ওদের কারও গায়েই সরাসরি পড়ছে না, তবে আলোর আভায় প্রত্যেককেই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে রানা।
গাড়ির ভেতর গোঙাচ্ছে ড্রাইভার। দরজার ফ্রেমের সাথে মাথা ঠুকে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে সে, সামনের জোড়া সীটের মাঝখানে পা আটকে যাওয়ায় প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। হাঁ করে জানালা। দিয়ে রানার দিকে তাকিয়ে আছে টিমোথি, তার হাতে ধরা রিভলভারের ব্যারেল জানালার ফ্রেমে ঠেকে রয়েছে।
বাঁ হাত দিয়ে কপাল থেকে ভিজে চুল সরাল রানা, হাতটা কপালে রেখে বৃষ্টির ফোঁটা থেকে চোখ দুটোকে আড়াল করল। দুটোই ছুঁড়ে দাও এদিকে, ঝড়ের শোঁ শোঁ আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল ওর গলা।
বৃষ্টির পানিতে প্রতি মুহূর্তে ধুয়ে যাচ্ছে রক্ত, ফ্যাকাসে দেখাল। দলপতি রেক্সকে। ডিক আর টিমোথি ইতস্তত করছে দেখে। খেঁকিয়ে উঠল সে, যা বলছে করো!
রেক্সের বুকের ওপর বসে তার হাত দুটো জুতোর নিচে চেপে রেখেছে রানা। রেক্সের মাথার কাছে প্রায় এক সাথে পড়ল। রিভলভার দুটো, তুলে নিয়ে পকেটে ভরল রানা। এবার ড্রাইভারের রিভলভার। তারপর গাড়ি থেকে বের করো ওকে।
ড্রাইভার নিরস্ত্র… শুরু করল ডিক।
আমি বলছি, কোন চালাকি নয়, ডিক! রানার নিচে থেকে হুঙ্কার ছাড়ল রেক্স।
ড্রাইভারের রিভলভার তার পকেটেই ছিল, সেটা বের করে রানার দিকে ছুঁড়ে দিল টিমোথি। গুলিগুলো বের করে নিয়ে দূর ঝোপের দিকে রিভলভারটা ছুঁড়ে দিল রানা। মাথায় হাত দিয়ে, টলতে টলতে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ড্রাইভার।
প্রত্যেককে আলাদা ভাবে আদেশ করতে হবে নাকি?
রানার ঝাঁঝ লক্ষ করে ভিজে বিড়ালের মত টিমোথিও বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে। ওদের তিনজনকে গাড়ির পাশে, পাঁচ হাত দূরে এক লাইনে দাঁড় করাল রানা। ধীরে ধীরে, অত্যন্ত সাবধানে রেক্সের বুক থেকে উঠল ও। পিছিয়ে এসে গাড়ির পিছনের দরজাটা বন্ধ করল। ওদের ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে সামনের দরজা দিয়ে উঠে বসল গাড়িতে।
রানা, শোনো… আবেদনের সুরে বলল রেক্স, উঠে বসেছে। সে, হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নাকের রক্ত মুছছে।
রানা? আল মাসুদ নই তাহলে? জানালা দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে রানা। কোল্ট অটোমেটিকের ব্যারেল জানালার ফ্রেমে ঠেকে আছে। বুঝতেই পারছ, ইচ্ছে করলে সারারাত এই বৃষ্টির মধ্যে তোমাদেরকে আমি দাঁড় করিয়ে রাখতে পারি। তা যদি না চাও, ঝটপট জবাব দেবে।
রানা, শোনো, প্লীজ, হড়বড় করে বলল রেক্স। আমরা সি. আই. এ-র লোক, পরিচয়-পত্র আছে…। কাছেপিঠে কোথাও একটা গাছ ভেঙে পড়ার মড়মড় শব্দ হলো, শেষ দিকের কথাগুলো চাপা পড়ে গেল।
লেজে পা পড়তেই জাত বদলে ফেললে? বাপের নাম ভুলে যাওনি তো? একটা হাত লম্বা করে দিল রানা। কই, দেখি।
ওভারকোটের বোতাম খুলে শার্টের পকেট থেকে আইডেনটিটি কার্ড বের করল রেক্স। তার চারপাশে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে, কাদায় হাত আর হাঁটু রেখে কোন রকমে উঠে দাঁড়াল সে।
রানার লম্বা করা হাতে কার্ডটা দিয়ে পিছিয়ে গেল রেক্স। গাড়ির ভেতরে আলো জ্বেলে কার্ডে একবার চোখ বুলিয়ে হাসল রানা। জাল-তাও একেবারে কাঁচা হাতের কাজ।
স্বীকার করি, তোমার খেপে যাওয়ার কারণ আছে, নরম সুরে, বিনয়ের অবতার সাজল রেক্স। কিন্তু সব কথা শুনলে তুমিও। বুঝবে, এই অভিনয়টুকুর দরকার ছিল। একটা কাজে তোমাকে আমাদের দরকার, কিন্তু কাউকে সেটা জানতে দেয়া চলবে না, সে জন্যেই ট্রেনে মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে। তাছাড়া, এটা একটা। ইমার্জেন্সী…
অতি বিনয় চোরের লক্ষণ হলেও, রানার মনে হলো রেক্স সবটুকু মিথ্যে বলছে না। যদিও ওদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হবার সহজ কোন উপায় নেই। পরিচয়-পত্র জাল হওয়া খুবই। সম্ভব। তোমাদের অপারেশনাল চীফের নাম বলো।
প্রতিবাদ জানাল রেক্স, এটা একটা সিক্রেট।
আমার পরিচয়টাও তাই, বলল রানা।
এক মুহূর্ত ইতস্তত করে অপারেশনাল চীফের নাম বলল। রেক্স। এরপর রানা একের পর এক অনেকগুলো প্রশ্ন করল। রেক্সের উত্তর শুনে মোটামুটি সন্তুষ্ট হলো ও, এরা সম্ভবত সি.আই.এ-রই লোক, কিংবা সি.আই.এ-র ভেতর এদের ইনফরমার আছে। এবার আমার সম্পর্কে কি জাননা বলো, জিজ্ঞেস করল রানা।
গড়গড় করে বলে গেল রেক্স, তুমি মেজর মাসুদ রানা, বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের একজন এজেন্ট। রানা। ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি তোমার একটা কাভার। এজেন্সির শাখা অফিসগুলো ভিজিট করার জন্যে আমেরিকায় এসেছ তুমি। তোমার বসের নাম মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খান। বলা যায় প্রায় অলৌকিকভাবে আজও তোমরা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলেছ-না কম্যুনিস্ট ব্লকে ভিড়ছ, না পুঁজিবাদী দুনিয়ায়। তোমাদের একটা নীতি আছে, সেই নীতির মূল কথা হলো সুপারপাওয়ারগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা। তাই মাঝে মধ্যে তোমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরক্তি উৎপাদন করো, আবার কখনও সোভিয়েত রাশিয়ার। কিন্তু মজার কথা হলো, প্রায়ই দেখা যায়, তোমাদের সাহায্য ছাড়া কে.জি.বি. বা সি.আই.এ-র চলে না। তাই সবাই পারতপক্ষে তোমাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চায়।
দুঃখিত, অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলাম। এবার তোমার সম্পর্কে বলি। তুমি মেজর মাসুদ রানা বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের…
তেল মাখাবার ভাল ট্রেনিং পেয়েছ, রেক্সকে থামিয়ে দিয়ে বলল রানা। এবার বলো, আমাকে তোমাদের কি দরকার।
সব কথা কি আমাদের বলা হয়? রেক্সকে প্রায় অসহায় দেখাল। ওয়াশিংটনে গেলেই তুমি জানতে পারবে…
ওয়াশিংটন? রানার ভুরু কুঁচকে উঠল। তোমরা কি ওয়াশিংটন থেকে আসছ?
কুক্ষণই বলতে হবে, যাত্রার শুরুতেই বিপত্তি দেখা দেয়, বলল রেক্স। গোটা আমেরিকার ওপর দিয়ে ইলিকট্রিকাল স্টর্ম বয়ে যাচ্ছে। কোন প্লেন ফ্লাই করছে না। অথচ তোমার ট্রেনকে থামাতে হলে প্লেনে করে আসতে হবে আমাদের। নিজেদের প্লেন আর পাইলট ছিল বলে আসতে পারলাম। বুঝতে পারছ তো, তোমাকে নিয়ে যাবার জন্যে কি রকম ঝুঁকি নিয়েছি আমরা?
কিন্তু সবই বৃথা, বলল রানা। তোমাদের সাথে আমি যাচ্ছি না। কারণ, এক, তোমাদের একটা কথাও আমি বিশ্বাস করছি না, দুই, আমার কোন দায় পড়েনি যে সি.আই.এ-কে সাহায্য করব। মাইল ত্রিশেক হাঁটলেই লোকালয়ে পৌঁছে যাবে তোমরা। গুডবাই।
এক মিনিট, দ্রুত বলল রেক্স, অস্থির দেখাল তাকে। ওভারকোটের ভেতরের পকেট থেকে একটা খাম বের করল সে। এই চিঠিটা পড়ে দেখো, প্লীজ। কয়েক পা এগিয়ে খামটা রানার। দিকে বাড়িয়ে ধরল সে।
কার চিঠি?
অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটনের।
জর্জ হ্যামিলটন গোপন একটা ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির চীফ, প্রেসিডেন্ট ছাড়া অল্প দুএকজন এই এজেন্সি সম্পর্কে জানে। রাহাত খানের বন্ধু তিনি, রানাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। সম্ভব হলে। রানার কোন অনুরোধ তিনি ফেলেন না, রানাও আপদে-বিপদে তাঁকে সাহায্য করে। খামটা খুলে চিঠিটা বের করল ও। ছোট্ট চিঠি, টাইপ করা, নিচের সইটা প্রথমে ভাল করে দেখল ও।
অ্যাডমিরাল লিখেছেন, রানা, সি.আই.এ-র অপারেশনাল। চীফের সাথে ওয়াশিংটনে দেখা করো। সম্ভব হলে ওদের কাজটা করে দিয়ো। শুভেচ্ছা, জর্জ হ্যামিলটন।
এতক্ষণ এটা দেখাওনি কেন? জিজ্ঞেস করল রানা।
সইটা তুমি জাল বলবে, তাই, সাথে সাথে জবাব দিল রেক্স।
তুমি বলতে চাইছ জাল নয়?
অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল রেক্স, বাতাসের ধাক্কায় অনবরত টলছে সে। এরপরও যদি তুমি আমাদের কথা বিশ্বাস না করো, কিছু করার নেই। ছেড়ে দাও আমাদের, ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে বলি, আমরা ফেল করেছি।
দ্রুত কাজ করছে রানার মাথা। অ্যাডমিরালের সইটা চিনতে পেরেছে ও, জাল হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু ওকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে চিঠির ভাষা। অ্যাডমিরাল ওকে আদেশ করতে অভ্যস্ত নন, সম্পর্কটা সে রকম নয়, অথচ প্রথম বাক্যটা আদেশের সুরেই লিখেছেন তিনি। যেন ওয়াশিংটনে সি.আই.এ-র অপারেশনাল চীফের সাথে রানার দেখা করাটা একান্ত জরুরী, ওখানে যেন কি একটা খবর অপেক্ষা করছে রানার জন্যে। পরের বাক্যটা অবশ্য অনুরোধের সুরে লেখা, কিন্তু বাহুল্যবর্জিত ঢঙে। প্রতি দুলাইনের মাঝখানে প্রায় সময়ই কিছু অলিখিত বার্তা থাকে, সেটা পড়তে পারছে না বলেই অস্বস্তি বোধ করল রানা। ওর মন বলছে, ওয়াশিংটনে যাওয়া দরকার। অথচ সি.আই.এ-র আচরণে ও বিরক্ত।
ঠিক আছে, যাব আমি, বলল রানা। কিন্তু আমার সাথে মাত্র একজন আসতে পারবে তোমরা তুমি, রেক্স।
প্লীজ, রানা, এটা অমানবিক…, প্রায় হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গি করল রেক্স। এই দুর্যোগের মধ্যে…
ঘুমন্ত মানুষকে ট্রেন থেকে নামানো অমানবিক নয়? কঠোর দেখাল রানাকে। ইয়েস, অর নো?
আচ্ছা শালা, অফিসে পৌঁছে নিই! মনে মনে বলল রেক্স। সঙ্গীদের দিকে ফিরল সে, নিচু স্বরে কথা বলল কিছুক্ষণ। তারপর ঘুরে গাড়ির দিকে এগোল।
এয়ারপোর্ট এখান থেকে কত দূর? জিজ্ঞেস করল রানা। তুমি ড্রাইভ করবে।