২৪. আমহার্স্ট স্ট্রীট থেকে বের হয়ে
আমহার্স্ট স্ট্রীট থেকে বের হয়ে কিরীটী ক্লাইভ স্ট্রীটে মিঃ সরকারের অ্যাটর্নীর অফিসে গিয়ে প্রবেশ করল এবং কিছুক্ষণ ধরে অ্যাটর্নীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে যখন সে অ্যাটর্নী-অফিস থেকে। বের হয়ে এল, বেলা তখন প্রায় দুটো। অ্যাটর্নী কলকাতায় ছিলেন না, তাই এর আগে কিরীটী তার সঙ্গে দেখা করতে পারেনি।
টালিগঞ্জের বাড়িতে ফিরে এসে কিরীটী দেখলে, বাইরের ঘরে একটা সোফার ওপরে হেলান দিয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে সুব্রত।
কিরীটীর পায়ের শব্দে সুব্রত চোখ মেলে তাকাল, এত দেরি হল যে?
সব কাজ সেরে এলাম। তুই কতক্ষণ এসেছিস?
প্রায় ঘন্টাখানেক।
মিঃ বি. সরকারের শয়নঘর ও লাইব্রেরিঘর যা চাবি দেওয়া ছিল—সেটা নিয়ে এসেছিস তো?
হ্যাঁ।
সকলকেই আড়ালে ডেকে আলাদা আলাদা করে বলে এসেছিস তো যে ও-ঘরের মধ্যে যেন কেউ না ঢোকে?
হ্যাঁ। তারপর তোমার কাজ কতদূর এগুলো?
প্রায় কমপ্লিট। শুধু সামান্য একটু একত্সপেরিমেন্ট আজ রাত্রে যা বাকি। ব্যস, তারপরই খুনী ধরা পড়বে। তুই বোস, চট্র করে আমি স্নানটা সেরে আসছি—অনেক আলোচনা করবার আছে।
কিরীটী বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
***
সামনে ধূমায়িত চায়ের দুটো কাপ।
কিরীটী বলছিল, প্রথম দর্শনে কেসটা আমার বেশ জটিল বলেই মনে হয়েছিল। তার অবিশ্যি কারণ ছিল তিনটি ১নং মৃত ব্যক্তি চেয়ারে বসে ছিল কেন? মানে ঐ চেয়ারে বসা অবস্থায় ছিল কেন? ২নং, মিঃ সরকারের হাতঘড়িটা ভাঙল কি করে? আর ৩নং কারণ, সহজ দৃষ্টিতে বিচার করে দেখতে গেলে খুন করবার যে মোটিভ মিঃ সরকারের উইলের দ্বারা লাভবান হওয়া, তা ওবাড়ির প্রত্যেকের পক্ষে সম্ভব ছিল। কেন আমি একথা বলছি, কারণ ও বাড়ির প্রত্যেকের পক্ষে সম্ভব ছিল খুন করা!
কারণ প্রথম দর্শনেই আমি স্থিরনিশ্চিত হয়েছিলাম, মিঃ গজেন্দ্র সরকারকে খুন করেছে ও-বাড়িরই কেউ। বাইরের লোকের দ্বারা ওভাবে মিঃ সরকারের খুন হওয়া একেবারেই সম্ভব ছিল না। সেকথাটা সর্বাগ্রে না বলে নিলে বাকি কথাগুলো তোমার কাছে খোলসা হবে না। সব কিছু বিচার করবার আরল আগে যে কথাটা সকলের মনেই সন্দেহের দোলা জাগাতে পারে, সেটা হচ্ছে মিঃ সরকারের মৃত্যু কী করে ঘটেছিল! ডাক্তারের ময়নাতদন্তের বিবরণ থেকে যা প্রকাশ হয়েছে, তা থেকে আমরা জানি বা জানতে পেরেছি, মিঃ সরকারের মৃত্যু ঘটেছে আনুমানিক মধ্যরাত্রিতে অর্থাৎ বারোটা-একটার মধ্যে। এবং তীক্ষ্ণ হাইড্রোসায়নিক অ্যাসি বিষে তার মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। অ্যানালিসিস করে তাই পাওয়া গেছে।
তার বক্ষের ফিফথ ইনটারকস্টাল স্পেসে যে পাংচার-উন্ড দৃষ্ট হয়, সেটার তাৎপর্য মৃত্যুর কারণের পরে কিছুই নেই। অন্য লোককে বিপথে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওটা স্রেফ একটা ধোঁকা মাত্র এবং হয়েছিলও তাই। তুমি তদন্ত করতে গিয়ে সেই ক্ষতচিহ্নটিকে নিয়েই বেশি মাথা ঘামাতে শুরু করেছিলে। সিরিঞ্জের ইতিহাস ও তার গুঢ় তত্ত্ব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলে। আসলে ঐ সিরিঞ্জটাও খুনীর ইচ্ছাকৃত আর একটা চাল এবং নিজের ঘাড় থেকে অন্য এক নির্দোষীর ঘাড়ে খুনের দায়টা চাপিয়ে দেবার জন্য একটা উৎকৃষ্ট উদ্ভাবিত পন্থা মাত্র।
কিন্তু কেমন করে সেকথাটা আমার মনে পরিষ্কার হয়ে যায়?
খুনী একটা ভুল করেছিল—সেটা বড় মারাত্মক ভুল। খুন করবার পর ঐভাবে সেটাকে সাজাবার জন্য মৃতের বক্ষে ফিফথ ইন্টারকস্টাল স্পেসে পাংচার করা ও সিরিঞ্জটা অশোকের ঘরে রেখে যাওয়া। ঐ কাণ্ড দুটো করে সে নিজের পরিচয় নিজেই দিয়ে গেছে।
ব্যাপারটার মধ্যে যে এতটুকু সত্যি নেই, আগাগোড়াই সাজানো, তা আমি কেমন করে বুঝলাম? প্রথমত, ঐভাবে কোন নিল দিয়ে হার্টকে পাংচার করে কোন মানুষকেই মারা যায় না। দ্বিতীয়ত, ঐভাবে মারাটাও একপ্রকার অসম্ভব। ধরে নিচ্ছি মিঃ সরকারের কোন একান্ত পরিচিত লোকই মিঃ সরকারের হার্টে পাংচার করে কোন বিষ প্রয়োগের দ্বারা মেরেছে। কিন্তু মরবার সময় তিনি নিশ্চয়ই চীৎকার করে উঠতেন। কেউই ওভাবে অন্যের হাতে প্রাণ দিতে। প্রস্তুত নন। আর যদি ঘুমিয়েই থাকতেন, তবে ঐ সময় হার্ট পাংচার করবার সময় নিশ্চয়ই জেগে উঠতেন ও একটা গোলমাল হত। এই দুটো ব্যাপারেই আমার মনে হয়েছিল ফিফথ ইনটারকস্টাল স্পেসের পাংচার-উন্ড ও সিরিঞ্জটা খুনীর একটা চাতুরী মাত্র! অন্যের বিচার-পদ্ধতিকে ভুলপথে নিয়ে যাওয়া! তাহলে মীমাংসিত হল, মিঃ সরকার বিষ প্রয়োগের দ্বারাই খুন হয়েছেন এবং তাই যদি হয়ে থাকেন তবে সে বিষপ্রয়োগে কী ভাবে সম্ভব হল? এইখানেই খুনী চরম বুদ্ধির বিকাশ দেখিয়েছে।
তোমার হয়তো মনে থাকতে পারে সুব্রত, খুনের পরদিন সকালে যখন, তুমি সবার জবানবন্দী নাও, তখন কয়েকটা কথা যা আমার মনে খটকা লাগিয়েছিল। ১নং হচ্ছে, মিঃ সরকারের হাতঘড়িটা ভাঙল কী করে? বলেছিলাম, ভাঙার তো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু কেন ছিল না। তার কারণ তোমাদের মনে স্বতঃই একটা প্রশ্ন উঠেছিল, মিঃ সরকার নিশ্চয়ই চেয়ারে যখন অধ্যয়ন করছিলেন, এমন সময় খুনী এসে তাকে হার্টে সিরিঞ্জের দ্বারা বিষপ্রয়োগ করে খুন করেছে। তোমাদের হাইপথেসিসই যদি সত্যি বলে মানো, তবে হাতঘড়িটা তার ভাঙবে কেন? এমন নিশ্চয়ই হতে পারে না যে, খুনী খুন করবার পর ইচ্ছা করেই মিঃ সরকারের হাতঘড়িটা ভেঙে রেখে গেছে! তবে?
দ্বিতীয় কথা, রাত্রি দেড়টার সময় রামচরণের হঠাৎ একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু সে ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে দেখে, মিঃ সরকার চেয়ারেই বসে আছেন। এখন কথা হচ্ছে, শব্দটা কিসের? শব্দটা আর কিছুই নয়, মিঃ সরকার মৃত্যুযন্ত্রণায় খাটের উপর থেকে পড়ে যাওয়ায় ঐ শব্দ হয়।
সুব্রত বিস্মিত কণ্ঠে বললে, খাটের উপর থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। তার মানে?
হ্যাঁ, খাটের উপর থেকেই তিনি মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলেন। এবং পড়বার সময় তার হাতঘড়িটা ভেঙে যায়। রামচরণের জবানবন্দীর একটা কথা তোমার মনে আছে কিনা জানি না, সে বলেছিল, মিঃ সরকার অনেক রাত্রি পর্যন্ত জেগে পড়াশুনা করতেন লাইব্রেরি ঘরে বসে। যতক্ষণ না শুতে যেতেন, ঘড়িটা তার হাতেই বাঁধা থাকত। অনেক সময় ঘড়ি হাতে বাঁধাই থাকত—শুয়ে পড়তেন। এর থেকেই প্রমাণ হয়, সে রাত্রে ঘড়িটা তার হাতেই বাঁধা ছিল এবং হয়তো মন খারাপ ছিল বলেই রাত্রে যখন শুতে যান ঘড়িটা হাত থেকে খুলে রাখতে ভুলে গিয়েছিলেন। ঐ দুটি কারণ থেকে আমি বুঝেছিলাম, মিঃ সরকার রাত্রে পড়াশুনা সেরে শয্যায় শোবার পর খুনী তাকে বিষপ্রয়োগ করে।
কথা হচ্ছে কী ভাবে খুনী বিষপ্রয়োগ করলে? একটা জিনিস তোমার মনে আছে? মৃত ব্যক্তির বাঁ হাতের কড়েআঙুলে একটা পট্টি জড়ানো ছিল! মৃত্যুর দিন সকালে ভাঙা গেলাসের কাঁচের টুকরো তুলতে গিয়ে আঙুলটা কেটে যায়! আঙুলটার ঐ ক্ষতস্থান দিয়েই খুনী বিষপ্রয়োগ করে। বিষের ক্রিয়া শুরু হতেই মিঃ সরকারের ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু তীক্ষ্ণ বিষ হাইড্রোসায়নিক অ্যাসিডের ক্রিয়া এত দ্রুত যে, কিছু বুঝবার আগে তাঁর মৃত্যু হয় এবং ঘুম ভাঙার সঙ্গেসঙ্গেই হয়তো বিষের যাতনায় তিনি ছটফট করতে গিয়ে খাট থেকে মাটিতে পড়ে যান। খুনীর মানসিক বল অত্যন্ত বেশী। মুহূর্তে সে মৃতদেহ মাটি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। কিন্তু সে পালাতে পারে না, পাশের ঘরেই আত্মগোপন করে। কেননা ঠিক সেই সময় শব্দ শুনে রামচরণ ঘরে এসে ডাক দেয়। এবং রামচরণও মিঃ সরকারকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে কোন কিছু সন্দেহ না করে শব্দটা শোনবার ভুল ভেবে চলে যায়।
রামচরণ চলে যাবার পর খুনী তার প্ল্যান কাজে লাগায়। পাশেই ছিল অশোকের ঘর। সমস্ত প্ল্যান সে আগেই ঠিক করে রেখেছিল। ব্যালকনি দিয়ে অশোকের ঘরে প্রবেশ করে সেখান থেকে সিরিঞ্জটা চুরি করে এনে মৃতের হার্টে পাংচার করে। তারপর ঐ পথেই ফিরে গিয়ে অশোকের ঘরে আবার সিরিঞ্জটা রেখে আসে। অশোক তখন ঘুমচ্ছে।
এই সব কাজ শেষ হবার পর তার উর্বর মস্তিষ্কে আর একটা চাল উদয় হয়। সে সব ঘড়িগুলো দুটো বাজিয়ে বন্ধ করে দেয়! যাতে সকলের মনে হয়, রাত্রি দুটোর সময় মিঃ সরকারকে খুন করা হয়েছে!
কিন্তু কেন, ঘড়িগুলোকে দুটো বাজিয়ে রাখবার কারণ কি?
খুনী ঐ সময়টা একটা alibi তৈরি করে রাখে। সে দেখাতে চায়, ঐ সময় সে অন্য জায়গায় ছিল। মৃতব্যক্তির আশেপাশে কোথাও ছিল না। কিন্তু সেটা পরের কথা। পরে ভেবে দেখলেই হবে।
খুন করবার পর সমস্ত প্ল্যান মত সাজিয়ে রেখে খুনী পালিয়ে গেল কোন পথে? এবার সেই আললাচনাই করব। কিন্তু তারও আগে আমাদের একটা কথা ভেবে দেখতে হবে, খুনী এল কোন্ পথে?
তাহলে তুমি বলতে চাও, খুনী বাইরে থেকে এসেছিল? ঠিক যতটুকু বলেছি তার বেশী কিছুই আমি বলতে চাই না সুব্রত! বাকিটা তোমাকে ভেবে দেখতে হবে। বিচার করে দেখতে হবে কার পক্ষে খুন করা সম্ভব! আগেই তোমাকে একটা কথা বলেছি, যে খুন করেছে সে মিঃ সরকারের পরিচিত এবং সে ঐ বাড়ির সব কিছুর সঙ্গে একান্ত পরিচিত। কিন্তু সেকথা বলবার আগে আমি একটা ছোটখাটো experiment করতে চাই। আজ রাত্রে মিঃ সরকারের ঘরে সেই experiment হবে। বলতে বলতে কিরীটী চক্ষু মুদ্রিত করে সোফায় হেলান দিয়ে নীরব হল।