১৫. শোন বাবলু
শোন বাবলু, আমি তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করব। যতটা তুমি জান, সব জবাব তুমি আমাকে দেবে, কেমন?
বলুন।
আচ্ছা বাবলু, তোমার মনে পড়ে কতদিন তুমি ওদের সঙ্গে আছ?
কার—অবুর কাছে?
হ্যাঁ।
অনেক দিন। ঠিক কতদিন তা আমার মনে নেই দাদা, তবে অনেক দিন।
আচ্ছা ঐ যে ঢ্যাঙা লম্বা লোকটা, যার গায়ে তুমি রাত্রে চা ফেলে দিয়েছিলে, তার নাম কী জান?
ওকে সবাই সর্দার বলে ডাকে। তবে মাঝে মাঝে সিংহ যখন আসত, ওকে বঙ্কা বলে ডাকতে দুএকবার শুনেছিলাম।
সিংহ! সে আবার কে?
সিংহ—তাকে আপনি চেনেন না? সবাই তাকে খুব ভয় করে। জানেন, সর্দারও তাকে ভয় করে। সিংহ তো কারও সঙ্গে কথা বলে না। যখন সক্কলে বাড়ি থেকে চলে যায়, অনেক রাত্রে সিংহ তখন আসে। তখন কেউ বাড়িতে থাকে না। আমি দুদিন লুকিয়ে লুকিয়ে সিংহকে দেখেছি। আমি নীচে যে ঘরটাতে থাকতাম, রাত্রে সিংহ তার পাশের ছোট ঘরটায় এসে সর্দারের সঙ্গে কি সব কথাবার্তা বলতো।
বাবলুর কথা শুনে সুব্রতর কৌতূহল যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সে গভীর আগ্রহে বাবলুর কথা শুনতে লাগল।
তুমি সিংহকে দেখেছ বাবলু? সে কেমন দেখতে? আবার দেখলে তাকে তুমি চিনতে পারবে?
না, যে দুবার তাকে দেখেছি, তার মুখে একটা কালো রংয়ের মুখোশ ছিল। লোকটা দেখতে কিন্তু জোয়ান আর খুব লম্বা।
তাদের কথাবার্তা কিছু তোমার মনে আছে বাবলু?
সব কথা তো ওদের শুনতে পারিনি। সর্দারকে আমার বড্ড ভয় করে। একদিন শুধু…
হঠাৎ বাবলু যেন সন্ত্রস্তভাবে সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল।
কি, থামলে কেন? বল কি শুনেছিলে—বল!
আপনি কাউকে বলে দেবেন না তো দাদা? সর্দার শুনতে পেলে কিন্তু ঠিক আমাকে মেরে ফেলবে! কেটে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে।
তোমার কোন ভয় নেই ভাই, তুমি বল কাউকে আমি বলবো না। তাছাড়া তোমাকে এমন জায়গায় আমি রেখে আসব, কেউ তোমার সন্ধান পাবে না।
কয়েকদিন আগে আমি আমার ঘরে শুয়ে ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ পাশের ঘরে কথাবার্তার শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি পা টিপেটিপে উঠে দুই ঘরের মাঝখানে যে জানালাটা বন্ধ থাকত, সেখানে গিয়ে কান পেতে দাঁড়ালাম। জানালাটার একটা কপাট ফাটা। সেই ফাটা দিয়ে পাশের ঘরের সব কিছু দেখা যেত। দেখলাম ঘরের মধ্যে তিনজন আছে, সর্দার, সিংহ, আর একজন ভদ্রলোক। ভদ্রলোককে কোনদিনও আমি দেখিনি, তাই চিনতে পারলাম না। তাছাড়া ভদ্রলোক জানালার দিকে পিছন ফিরে বসে ছিল। তাদের দুএকটা কথা শুনে বুঝলাম, তারা আমার কথা নিয়েই আলোচনা করছে। শুনলাম সিংহ ভদ্রলোকটিকে বলছে, তোমার কোন ভয় নেই, কেউ ও মেয়ের সন্ধান পাবে না। কেউ জানবে না যে, এইখানে এ বাড়িতে বষ্কার কাছে লুকানো আছে। কিন্তু টাকা ত্রিশ হাজার চাই। ভদ্রলোক তার উত্তরে বললেন, বেশ, ত্রিশ হাজারই পাবে। মেয়েটার কোন অযত্ন হচ্ছে না তো? সর্দার বললে, আপনি পাগল হয়েছেন! ভদ্রলোক বললেন, উঃ, ঐ মেয়েটাই আমার কাল।
তারপর?
তারপর তারা টাকা সম্পর্কে আরও কী বলাবলি করলে। তারপর সবাই চলে গেল।
ভদ্রলোকের নাম কিছু শোননি?
না।
সুব্রত এতক্ষণে বুঝলে, তার সন্দেহ একেবারে অমূলক নয়। এই হতভাগ্য মেয়েটির জীবনের সঙ্গে একটা জটিল রহস্য জড়িয়ে আছে। এবং খুব সম্ভব সেই রহস্যের সঙ্গে হয়ত মিঃ সরকারের হত্যারও কোন যোগাযোগ আছে।
এমন সময় বন্ধ দরজার গায়ে নক শোনা গেল।
কে?
আমি কামতাপ্রসাদ।
ভিতরে আসুন।
কামতাপ্রসাদ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সুব্রতকে নমস্কার জানাল।
সুব্রত বললে, আপনাকে ডেকেছিলাম ম্যানেজার সাহেব। আমি কাল থেকে আপনার হোটেলের ফ্ল্যাট ছেড়ে দেব। আপনার বিলটা পাঠিয়ে দেবেন।
ম্যানেজার সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, হঠাৎ ফ্ল্যাট ছেড়ে দেবেন কেন মিঃ রায়? কোনরকম অসুবিধা…
না, ধন্যবাদ। এখানে থাকার আর আমার দরকার নেই, তাই ছেড়ে দিচ্ছি।
আচ্ছা আপনি যেতে পারেন। বিলটা পাঠিয়ে দেবেন। নমস্কার।
অগত্যা ম্যানেজারকে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিতে হল।
সুব্রত উঠে দরজাটায় খিল দিয়ে আবার সোফায় এসে বসল।
সুব্রত ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলে, রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটা। এবারে শোওয়া দরকার। কাল সকালে অনেক কাজ। এখন কিছু বিশ্রামের একান্ত প্রয়োজন।
বাবলু, তোমার ঘুম পায়নি?
না, দাদা। আজ কেন যেন আমার একটুও ঘুম পাচ্ছে না। আপনার মত কেউ আগে আমার সঙ্গে এত ভাল করে কথা তো বলেনি। কেউ তো আগে আমাকে এত আদর করেনি, এত ভালবাসেনি।
তুমি যে আমার ছোট বোন। তোমাকে কি আমি ভাল না বেসে থাকতে পারি ভাই।
আমাকে আপনি কখনও বকবেন না, দাদা?
না, তুমি আমার লক্ষ্মী বোন। রাত্রি অনেক হল, এবার আমরা ঘুমাব। এই ঘরে ঐ বিছানায় তুমি শোও। আমি এই সোফাটার ওপরে শোব।
না, না, দাদা আপনি খাটের ওপরে বিছানাটায় শোন। আমি মাটিতেই ঐ পাশের ঘরে শোব।
দূর পাগলী, তা কি হয়! মাটিতে কি কেউ শোয় নাকি! অসুখ করবে ঠাণ্ডা লেগে।
কেন দাদা, আমি তো রোজ মাটিতেই শুতাম। কখনও আমার অসুখ করেনি। কখনও আমি খাটের বিছানায় শুইনি।
তবে আর কি, আজ প্রথম শোও। এবার থেকে তো তুমি খাটেই শোবে। যাও, লক্ষ্মী মেয়ের মত এবার গিয়ে শুয়ে পড়।
তবু যেন বাবলুর সংকোচ যায় না। সে ইতস্তত করে।
কই যাও, শুয়ে পড়! রাত অনেক হয়েছে–যাও।
আমার ময়লা কাপড়জামা। আপনার সুন্দর বিছানা একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে দাদা।
আরে পাগলী, তাতে কী হয়েছে। আবার বোপর বাড়ি দিয়ে কাচিয়ে নিলেই হবে, যাও।
এবারে আর বাক্যব্যয় না করে ধীরে ধীরে বাবলু গিয়ে সুব্রতর শয্যায় শুয়ে পড়ল।
সুব্রত কিন্তু তখনও ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। অসংখ্য চিন্তা। একটার পর একটা কেবলই যেন তার মাথার মধ্যে এসে জট পাকাচ্ছে।
একসময় সুব্রতর ঘরের উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে নীল আলোটা জ্বেলে দিল।
ধীরে ধীরে সুব্রত শয্যার পাশে এসে দাঁড়াল।
নিভাঁজ নিখুঁত পরিষ্কার শয্যার ওপরে বাবলু ঘুমিয়ে পড়েছে। বেচারী একান্ত সংকোচের সঙ্গে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে।
নীল মৃদু আলোয় ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে দুঃখ-তাপক্লিষ্ট অভাগা মেয়েটির মুখখানি। রুক্ষ মলিন চুলগুলি স্তি, এলোমেলো ভাবে উপাধানের ওপরে বিক্ষিপ্ত।
ছিন্ন মলিন শাড়িখানি দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢেকে নিয়েছে।
ধীরে ধীরে গভীর স্নেহে সুব্রত তার হাতখানি বাবলুর কপালের ওপরে রাখল। আহা বেচারী, কার স্নেহের দুলালী—ভাগ্যের স্রোতে বিড়ম্বিতা!
সুব্রতর চোখে জল এসে গেল।