০৯. নিজের আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাসায়
নিজের আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাসায় ও লালবাজারের অফিসে অনেক সময় নানা অসুবিধা হয় বলে সুব্রত মাস দুদিন হল চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনুতে মমতাজ হোটেলের দোতলায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে।
হোটেলের ফ্ল্যাটটি সুব্রত নিজের নাম ভাড়া নেয়নি। ওখানে তার নাম অমিতাভ রায়। শেয়ার মার্কেটের দালাল বলে পরিচিত সেখানে সে।
মিঃ সরকারের সার্কুলার রোডস্থিত মর্মরাবাস থেকে বের হয়ে সুব্রত গাড়ি চালিয়ে বরাবর আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাসায় ফিরে এল।
ঘণ্টাখানেক বাদে কিছু খেয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা গিয়ে হ্যারিসন রোড অভিমুখে একটা ট্রামে চেপে বসল।
***
সুব্রত যখন মমতাজ হোটেলে তার ফ্ল্যাটে এসে প্রবেশ করল, বেলা তখন প্রায় দেড়টা হবে। শীতের রৌদ্রে নীলাকাশ যেন ঝলসে যাচ্ছে।
হোটেলটা একেবারে বড় রাস্তার উপরে।
সুব্রত পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে নিজের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল।
ছোট ঘোট তিনখানি ঘর পাশাপাশি! একখানা ঘর শয়নকক্ষ। সেই ঘরে একটা ক্যাম্প খাটে ধোপদুরস্ত নিভাঁজ শয্যা বিছানো। দুখানা সোফা।
আর আছে একটি বুক-সেলফ। বুক-সেফের পাশেই একটি উঁচু টেবিল স্ট্যান্ডের ওপরে ছোট একটি দামী রেডিও সেট! এবং একটি আলমারিতে কিছু কাপড়জামা।
পাশের ঘরটি একটু বিচিত্র।
দু পাশের দেয়ালে দুটি দামী প্রমাণসাইজের আয়না টাঙানো। পাশেই একটি র্যা। তাতে নানা প্রকারের সব বেশভূষা ঝুলছে। পাশেই একটি টেবিলে নানা ধরনের ছোটবড় শিশি। নানা প্রকার ক্রীম, পাউডার। তাছাড়া নানা ধরনের পরচুলা, স্পিরিটগাম, ছুরি, কাঁচি প্রভৃতিও টেবিলের ওপরে সাজানো।
অবশ্য সুব্রতর আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়িতেও ঐ ধরনের আর একপ্রস্থ সাজ-সরঞ্জাম মজুত আছে।
এই ঘর থেকে সে মাঝে মাঝে গভীর রাতে কখনও ভিখারির বেশে, কখনও গাড়োয়ান, কখনও ঝকামুটে, কখনও ট্যাশ ফিরিংগি, কখনও অন্ধ, কখনও বা খঞ্জ প্রভৃতি নানা প্রকারের ছদ্মবেশে অভিযানে বের হয়।
মমতাজ হোটেলের ম্যানেজার একজন মাড়োয়ারী ভদ্রলোক। তিনি সুব্রতর আসল পরিচয়টা জানেন।
দালালবেশী সুব্রতর বেশ অন্য ধরনের। মাথার সামনের দিকে একটুখানি টাক।
ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, ছুঁচালো পাকানো গোঁফ। চোখে কালো কাঁচের গগলস্।
এই বেশে সুব্রতকে চেনারও উপায় নেই।
সুব্রত কলিং বেলটা টিপে চেয়ারের ওপরে বসল একটা কাগজ-পেনসিল নিয়ে। আজকের সকালের সমস্ত ঘটনাগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিবেচনা করলে দুটো জিনিস সহজেই চোখে পড়ে।
এক নং, মিঃ সরকারকে এমন কোন ব্যক্তি খুন করেছে যে ও বাড়িতে বিশেষ পরিচিত। ও বাড়ির খুঁটিনাটি সব কিছুই তার নখদর্পণে। বাইরের কোন তৃতীয় ব্যক্তি নয়। দু নং, ও বাড়ির প্রত্যেকেরই সমান, মোটিভ বর্তমান।
দরজায় এসে ভৃত্য নক্ করলে।
ভিতরে এস, সুব্রত বললে।
হোটেলের একজন ভৃত্য ঘরে এসে সেলাম দিয়ে দাঁড়াল।
এক কাপ চা পাঠিয়ে দাও।
ভৃত্য চলে গেল।
সুব্রত কাগজটার উপরে আবার পেনসিল দিয়ে লিখতে শুরু করলে :
প্রত্যেকের নাম | সন্দেহ কোন্ কোন্ ব্যক্তিকে করা যায়১০ নম্বর | খুন করা কার কার পক্ষে সম্ভব ছিল?১০ নম্বর।
| উদ্দেশ্য বা Motive১০ নম্বর | Alibi১০ নম্বর | খুন করা সম্ভব এমন দেখতে কি? | সবসমেত নম্বর |
১। মিঃ সরকারের ছোট ছেলে সৌরীন্দ্র | মৃত ব্যক্তির ঠিক পাশের ঘরেই ছিল। অনায়াসে সে খুন করার সুযোগ পেতে পারে, তাছাড়া তার বাপের সঙ্গে টাকার ও উইলের ব্যাপার নিয়ে সেদিন রাত্রে ঝগড়া হয়ে গিয়েছিল।৮
| রাগের মাথায় খুন করা সম্ভব ছিল। এবং সে তার বাপকে শাসিয়েও ছিল।৮ | টাকা বাপ মারা গেলে সে উইলের টাকা পেত।৮ | কোন কিছুই ছিল না, সারারাত্রি সে পাশের ঘরের ছিল।৯ | তেমন কিছু দেখতে নয়।৬ | ৩৯ |
২। ভাগ্নে অশোক | স্বীকার করেছে সে, সে রাত্রে মৃত ব্যক্তিকে একটা antitetanus injection; কিন্তু প্রথমে সেকথা স্বীকার করেনি কেন? সন্দেহজনক।১০ | খুবই সম্ভব ছিল, কেননা সেই সর্বশেষ মিঃ সর কারকে জীবিত দেখে। তাছাড়া যদি ধরে নেওয়া যায় যে Poison করে মিঃ সরকারকে খুন করা হয়েছে, তাহলে অশোক ডাক্তারি পড়ে, তার পক্ষেই বেশী সম্ভব খুন করা।১০ | তেমন বিশেষ কিছু নয় কেননা সে জানত টাকা সে পাবেই। তাছাড়া মিঃ সরকার তাকে ভালবাসতেনও খুব।০ | কোন কিছুই ছিল না তাছাড়া অনেক রাত্রি জেগে সে পড়াশুনা করত।৯ | দেখতে সেরকমকিছুই নয়। ০ | ২৯ |
৩। গণেন্দ্র সরকার | পিতার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সে তিন বছর আগে পৃথক হয়ে যায়। দুর্ঘটনার দিন রাত্রে এগারোটার সময়ে ঐ বাড়িতে ও এসেছিল। কিন্তু সিনেমা গিয়েছিল বলে মিথ্যা কথা বললে কেন? এবং কেনই বা সে অত রাত্রে বাপের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সন্দেহজনক খুবই।৯ | সম্ভব ছিল। কেননা রাত্রি দেড়টায় ও বাড়ি ফেরে। অথচ সিনেমাতেও যায়নি,কোথায় ছিল রাত্রি দেড়টা পর্যন্ত? ১০ | কিছু নেই।০ | কোন কিছুই নেই।৯ | নানা | ২৮ |
৪। ছোট ভাইবিনয়েন্দ্র | ভাই তাকে যথেষ্টই ভালবাসত। নির্বিরোধী মানুষ। তাছাড়া রাত্রে সে বাড়িই ছিল না।০ | সম্ভব ছিল না কেননা রাত্রে সে বাড়ি ছিল না।০ | টাকা১০ | পুরোপুরি ছিল।০ | না০ | ১০ |
৫। মিঃ সরকারের | অনায়াসেই সন্দেহ করা যেতে পারে। তাছাড়া সে-ই প্রথমে মৃতদেহ আবিষ্কার করে। সুব্রত যে চিঠিখানা পেয়েছিল তার হাতের লেখা অবিকল সুবিমলের হাতের লেখার মতই। তাছাড়া লেখার কালি? সে অস্বীকার করলে কেন যে লেখা তার নয়।৯ | Rainbow club থেকে সে অনায়াসেই ফিরে এসে খুন করতে পারত। তাছাড়া এ বাড়ির সব তার কাছে খুবই পরিচিত ছিল। হঠাৎ কেউ দেখলেও তাকে সন্দেহ করতে পারত না।৯ | তার অর্থের অভাব খুবই ছিল, কেননা সে ছিল অসংযমী, বেহিসাবী। মাঝে মাঝে মিঃ সরকারের কাছে টাকাও চাইত, জুয়া খেলত।৯ | কিছুই বলতে গেলে নেই।৯ | তার দেহের আকৃতি দেখে মনে হয় তার পক্ষে খুন করা এতটুকুও অসম্ভব নয়।৯ | ৪৫ |
৬। ভৃত্য রামচরণ | না০ | সম্ভব ছিল৯ | টাকা৫ | কিছুই নেই১০ | না০ | ২৪ |
ইতিমধ্যে এক সময় ভৃত্য এসে চা দিয়ে গিয়েছিল।
চা পান করতে করতে সুব্রত মোটামুটি একটা খসড়া বানিয়ে ফেললে। এবং পরে মনে মনে আলোচনা করতে লাগল এখন তার প্রধান কর্তব্য কী?
সর্বপ্রথম : মিঃ সরকারের অ্যাটর্নী রামলাল মিত্র মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করে উইল সম্পর্কে সমস্ত অবগত হওয়া।
দ্বিতীয় : গণেন্দ্র সরকারের এই রাত্রে মুভমেন্টস ভাল করে পর্যালোচনা করা। কেন তিনি সব কথা গোপন করলেন?
তৃতীয় : চিঠিটা ও কালিটা সম্পর্কে আর একটু বেশীরকম বিবেচনা করা।
চতুর্থ : কিরীটীর সঙ্গে দেখা করে আগাগোড়া সমগ্র ব্যাপারটার একটা বিশদ আলোচনা করা প্রয়োজন।
পঞ্চম : ময়না তদন্তের রিপোর্টটা জানা।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, ঘটে আর এক।
সেই রাত্রেই ঘটনার স্রোত সুব্রতকে সম্পূর্ণ অন্যদিকে টেনে নিয়ে গেল।
হঠাৎ বিকেলের দিকে লালবাজার থেকে এক ফোন পেয়ে সুব্রতকে অফিসে যেতে হল। সেখানে অফিসের কাজ শেষ হতে রাত্রি প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেল।
রাস্তায় বের হয়ে সুব্রত আমহার্স্ট স্ট্রীটে আর্টিস্ট সুবোধ দত্তর ওখানে গেল।
আমহার্স্ট স্ট্রীট থেকে একটা সরু গলিপথ বের হয়ে গেছে। সেই গলির মধ্যেই ৭ নং বাড়ি আর্টিস্ট সুবোধ দত্তের!
দরজার গায়ে পিতলের প্লেটে লেখা শিল্পী সুবোধ দত্ত।
দরজাটা খোলাই ছিল। সামনেই একটি আলোকিত গলিপথ থেকে ঘরখানা বেশ পরিষ্কার দেখা যায়।
উজ্জ্বল পাওয়ারের বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে ঘরের মধ্যে!
ঘরের দেওয়ালে অসংখ্য ছবি ঝুলছে। কোনটা পেনসিল স্কেচ, কোনটা ওয়াটার কলার, কোনটা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট, কোনটা অয়েল পেনটিং।
ঘরের মধ্যে একজন আধ্যবয়সী সুশ্রী যুবক পরিধানে ঢোলা পায়জামা ও ঢোলাহাতা পাঞ্জাবি। ইজেলের সামনে দাঁড়িয়ে ইজেলের ওপরে রক্ষিত অর্ধসমাপ্ত একটা ছবিতে পেনসিল দিয়ে টাচ দিচ্ছে।
সুব্রত কড়াটা নাড়লে!
কে? ভিতর হতে প্রশ্ন এল।
এটা কি সুবোধবাবুর বাড়ি?
হ্যাঁ, আপনি?
সুব্রত চমকে পিছনের দিকে তাকাল। একটি চব্বিশ পঁচিশ বৎসরের স্ত্রীলোক সুব্রতর পাশে দাঁড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করছেন। অদূরে গলির মধ্যেকার গ্যাস পোস্টের খানিকটা আলো ভদ্রমহিলার মুখের ওপরে এসে পড়ছে। কি সুন্দর মুখখানি!
টানা-টানা দুটি চোখ। উন্নত নাসা। কয়েকগাছি চূর্ণ কুন্তল কপোল ও কপালে এসে পড়ছে।
মাথার ওপরে আধ-ঘোমটা টানা, নিরাভরণা হাত দুটি। কিন্তু সিঁথিতে সিঁদুর রেখা, কপালে গোল একটি সিঁদুরের টিপ।
পরিধানে কালোপাড়ের শাড়ি। নিরাভরণা সামান্য এই বেশভূষাতেও যেন ভদ্রমহিলাকে ভারি চমৎকার দেখাচ্ছিল।
ইতিমধ্যে একটু আগে ঘরের মধ্যে দেখা যুবকটিও দরজার ওপরে এসে দাঁড়িয়েছে, এ কি রাণী? কখন এলি?
এই আসছি দাদা। এই ভদ্রলোক বোধ হয় তোমাকে খুঁজছেন—বলতে বলতে ভদ্রমহিলা ওদের পাশ কাটিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেলেন।
কাকে চান আপনি?
সুবোধবাবু আছেন?
হ্যাঁ, আমারই নাম সুবোধ দত্ত। আপনি?
আমার নাম সুব্রত রায়। আপনার সঙ্গে গোটাকতক কথা ছিল। ভিতরে আসতে পারি কী?
ভদ্রলোক কুঞ্চিত করে কী যেন এক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর বললেন, আসুন।
সুব্রত ভদ্রলোকের পিছনে পিছনে গিয়ে পাশের একটি ছোট ঘরে প্রবেশ করল।
ছোট ঘরটি। খানকতক চেয়ার পাতা, ছোট্ট একটি টীপয়। সুবোধবাবু নিজে একখানি চেয়ারে বসে অন্য একটি চেয়ারে সুব্রতকে নির্দেশ করে বললে, বসুন।
সুব্রত নির্দেশমত চেয়ারে উপবেশন করল।
সুব্রতই প্রথমে কথা শুরু করলে, আমার পরিচয়টা আগেই দেওয়া ভাল মিঃ দত্ত। আমি সি. আই. ডি.-র লোক। ব্যাঙ্কার ও জুয়েলার মিঃ সরকারের খুনের তদন্ত আমি করছি।
সুবোধবাবু নির্বিকারভাবে প্রশ্ন করলেন, কি চাই আপনার আমার কাছে?
কয়েকটি কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই। আশা করি, যথাযথ উত্তর পাব। সুবিমল চৌধুরী নামে কোন ভদ্রলোককে আপনি চেনেন? মহালক্ষ্মী ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। শুনলাম, তিনি আপনার বিশেষ বন্ধু। বহুকালের জানাশোনা আপনাদের।
সুব্রত স্পষ্ট লক্ষ্য করলে, সুবোধবাবুর মুখখানা যেন সহসা একটু গম্ভীর হয়েই তখুনি আবার প্রশান্ত ও নির্লিপ্ত ভাব ধারণ করল, সামান্যই তার সঙ্গে জানাশোনা। তাও কিছুদিন আগে ছিল, এখন আর নেই।
ওঃ। আচ্ছা আপনি তাকে কখনও চায়না থেকে আনা চায়নীজ ভায়োলেট রংয়ের একটি কালির শিশি উপহার দিয়েছিলেন কি?
প্রথম কথা, জীবনে আমি চীনে কোনদিনই যাইনি। দ্বিতীয়, আপনার বর্ণনামত কোন কালির শিশিই তাকে উপহার দিইনি।
দেননি!
না। ভদ্রলোক গম্ভীরভাবে জবাব দিলেন।
কিন্তু তিনি যে সেই রকম কথাই আজ সকালে আমায় বললেন!
তিনি যদি বলেই থাকেন যে আমি তাঁকে কালিটা দিয়েছি, সেটাই সত্য হবে, আর আমার কথাটা মিথ্যে হয়ে যাবে?
না, তা নয়। তবে—
আচ্ছা, তিনি বলছিলেন, আপনারা দুজনে ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন?
না, কস্মিকালেও নয়। ছোট সংক্ষিপ্ত জবাব।
এরপর একপ্রকার বাধ্য হয়েই সুব্রতকে উঠতে হল।
আশ্চর্য! এভাবে সুবিমলবাবুর মিথ্যা কথা বলবার কি প্রয়োজন ছিল?
সেরাত্রে সুব্রত আর বাড়িতে ফিরল না। সোজা মমতাজ হোটেলের দিকেই চলল। সমগ্র ব্যাপারটা যেন আগাগোড়া কেমন জটিল হয়ে উঠছে।
চিঠিটা সত্যি তবে তাকে কে লিখল? সুবিমলবাবুর হাতের লেখার মতই অবিকল হাতের লেখা। অথচ সে কথাটা স্বীকার করল না কেন?
ঠিক ঐ রংয়ের কালিও তার কাছে আছে। অথচ যে জায়গা থেকে সে কালিটা পেয়েছে বললে, সেটা দেখা যাচ্ছে মিথ্যা!
কাকে সে বিশ্বাস করবে? কোন্ সূত্র ধরে কোন্ পথে ও এখন চলবে?
সুব্রত হোটেলে যখন ফিরে এল রাত্রি তখন প্রায় নয়টা।
অসহ্য ক্লান্তিতে সর্বশরীর অবসন্ন।
বিশ্রামের একান্ত প্রয়োজন।
ফ্ল্যাটে ফিরে প্রথমেই সে বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ ধরে ঠাণ্ডাজলে স্নান করলে।
শরীর যেন অনেকটা ঠাণ্ডা হল।
হোটেল থেকে ও ডিনার আনিয়ে খেল।
***
রাত্রি তখন বোধ করি একটা বেজে গেছে।
সুব্রত ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ঠিক কতক্ষণ যে ঘুমিয়েছিল তাও বলতে পারে না।
হঠাৎ তার ঘুমটা ভেঙে গেল।
অন্ধকার ঘর।
ঘরের নিঃশব্দ অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা অস্পষ্ট শব্দ। যেন কে বা কারা ঠিক পাশের ঘরেই নিঃশব্দ পদসঞ্চারে চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে।
নাকের ওপরে একটা যেন নরম তুলোর মত স্পর্শ। অথচ কী ভারি মিষ্টি একটা গন্ধ! যেন শ্বাস নিতে কষ্ট বোধ হচ্ছে।
হঠাৎ সে হাত দিয়ে মুখের উপর থেকে টান মেরে কি একটা মেঝেতে ফেলে দিল।
বুঝতে পারলে কেউ তার মুখের ওপরে একটা ক্লোরোফরম স্পঞ্জ দিয়েছিল।
তাড়াতাড়ি ও উঠে বসল।
নিকষ কালো অন্ধকার ঘরের মধ্যে যেন জমাট বেঁধে উঠল।
প্রথমটায় ও কিছুই দেখতে পেল না।
তারপর একটু একটু করে অন্ধকারটা চোখ থেকে সরে গেল। দুঘরের ভাঁজ করা দরজার ঈষৎ ফাঁকে একটা অস্পষ্ট মৃদু আলোর আভাস। বুঝলে, কেউ ওর ফ্ল্যাটে এসেছে।
সুব্রত বিছানা থেকে নিঃশব্দে উঠে পড়ল।
মাথাটার মধ্যে তখনও কিন্তু ঝিঁঝিম্ করছে। বালিশের তলা থেকে সাইলেন্সার দেওয়া রিভলভারটা নিয়ে ও পায়ে পায়ে নিঃশব্দে দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার ফাকে চোখ রাখতেই ও ভয়ংকর রকম চমকে উঠল। দেখলে, সবুজ ঘেরাটোপ ঢাকা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে।
ঘরের মধ্যে দুজন মুখোশধারী লোক! তারা সুব্রতর সিক্রেট ড্রয়ার হাতড়াচ্ছে। কিন্তু সুব্রতর মাথা থেকে ক্লোরোফরমের আমেজটা তখনও যায়নি। হঠাৎ মাথাটা কেমন একটু ঘুরে উঠতেই ও সামলে নিতে গিয়ে ওর হাতের ধাক্কায় সশব্দে দরজাটা খুলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে লোক দুটো খোলা জানলাপথে পালাবার চেষ্টা করলে। এবং চকিতে ওদের মধ্যে একজন হাত বাড়িয়ে। সুইচ টিপে আলোটা নিভিয়ে দিল।
অন্ধকার। নিচ্ছিদ্র আঁধার।
সুব্রত তবু শব্দ ও দিক লক্ষ্য করে রিভলবারের ট্রিগার টিপল। নিঃশব্দে একটা আগুনের ঝিলিক সাঁ করে অন্ধকারের বুকে ছুটে মিলিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা আর্তনাদ।
সুব্রত ততক্ষণে আবার সামলে উঠে দাঁড়িয়েছে।
সুব্রত তড়িৎপদে অন্ধকার ঘরের মধ্যে শব্দ ও আর্তনাদ লক্ষ্য করে ঢুকে পড়ল।
যে লোকটা আহত হয়েছিল, তারই ঘাড়ের উপর সুব্রত অন্ধকারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
হুমড়ি খেয়ে পড়তেই লোকটা অন্ধকারে সুব্রতকে জাপটে ধরে।
তখন শুরু হল দুজনে ঝটাপটি।
লোকটার গায়ে বেশ শক্তি আছে। তথাপি সুব্রত তখন তাকে প্রায় ঘায়েল করে এনেছে, তখন মাথার ওপরে কে একটা প্রচণ্ড ঘূষি বসিয়ে দিল সুব্রতর। সুব্রতর মাথাটা ঝিমঝিম্ করে এল, হাতের মুঠি শিথিল হয়ে গেল।
চোখের পলকে লোকটা সুব্রতর কবল হতে নিজেকে মুক্ত করে নিল এবং দ্রুতপদে সুব্রতর শয়নঘরের দিকে পালিয়ে গেল।
সুব্রত আবার নিজেকে ভাল করে সামলাবার আগেই লোক দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল।
প্রথমে সুব্রত ঘরে আলোটা জ্বালাল।
কিন্তু ঘর তখন খালি।
অতঃপর সুব্রত শয়নঘরে এসে ঢুকল। শয়নঘরটাও খালি।
দরজাটা হা-হা করছে খোলা। ও বুঝলে সে যখন ঘুমিয়েছিল, তখন এই দরজা খুলেই সুব্রতর ঘরে আততায়ীরা প্রবেশ করেছিল। সুব্রত দরজাটা বন্ধ করে দিল।
আশ্চর্য! কী নিতে ওরা তার ঘরে প্রবেশ করেছিল?
সুব্রত আবার পাশের ঘরে এসে প্রবেশ করল।
ড্রয়ার দুটো তখনও খোলা!
ড্রয়ারের কাছে ও এগিয়ে গেল। অনেক আবশ্যকীয় গোপনীয় কাগজপত্র ওর ড্রয়ারে থাকে।
হঠাৎ আবার ওর নজরে পড়ল একটা ভাঁজকরা কাগজ মেঝেতে পড়ে। একান্ত কৌতূহলবশেই ও সেটা তুলে নিয়ে আলোর সামনে মেলে ধরতেই চমকে ওঠে। একটা চিঠি সেই ডি ভায়োলেট কালিতে সেই হাতে লেখা!
চিঠিটায় লেখা আছে :
মানকে, গোবরা,
আজ রাত্রেই যেমন করে তোক কাজটা শেষ করা চাই। খবর পেয়েছি, সুব্রত হোটেলেই আজ আছে এবং সেটা… ওর ঘরেই অথবা ওর জামার পকেটে নিশ্চয়ই আছে। রক্তক্ষয় বা প্রাণহানির কোন প্রয়োজন নেই। ক্লোরোফরম দিয়েই কাজ সারবে এবং কোন সূত্র রেখে এস না। ঘরে অনায়াসেই ঢুকতে পারবে। …….তোমাদের সাহায্য করবেন।
চাবির ড়ুপলিকেটটা তার কাছে চাইলেই পাবে। আমার নাম করলেই এবং পাস ওয়ার্ডটা বললেই …না নিয়ে কোনমতেই ফিরবে না। উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাবে। কাজ শেষ হয়ে গেলে রাত্রি দুটো থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে চিৎপুরের খালসা কেবিনে আমার সঙ্গে দেখা করো। অপেক্ষায় থাকব।
ইতি