অবগুণ্ঠিতা – ০৫. সুবিমল চৌধুরী

অবগুণ্ঠিতা – ০৫. সুবিমল চৌধুরী

০৫. সুবিমল চৌধুরী

লম্বায় প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি হবে। রোগা ঢ্যাঙ্গা পাতলা চেহারা। চোখ দুটি টানা টানা। দৃষ্টি যেন দুখানা ধারাল ছুরির ফলার মতই বুদ্ধিপ্রাচুর্যে ঝকঝকে।

টানা উদ্ধত ভ্রূ। নাকটা একটু বোঁচা। সামনের দুটি দাঁত একটু উঁচু। বাঁ গালের ওপরে একটি দুইঞ্চি পরিমাণ ক্ষতচিহ্ন। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা। বেশভূষা অত্যন্ত পরিপাটী। দামী মারের গরম স্যুট পরিধানে। পায়ে দামী পালিশ করা চকচকে পয়েনটেড টো শু। মুখে বর্মা চুরুট।

সুবিমল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললে, আমি জানতাম, আমাকে আপনার প্রয়োজন হবে। তাই নিজেই চলে এলাম আপনাকে কষ্ট না দিয়ে। সত্যি আমি খুব খুশি হয়েছি মিঃ রায় যে, আপনি নিজেই কেসটা হাতে নিয়েছেন। কেননা আমার ধারণা, এ মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। মিঃ সরকারকে খুন করা হয়েছে!

মিঃ সরকার যে খুনই হয়েছেন, স্বাভাবিক মৃত্যু তার হয়নি বা হতে পারে না এ ধারণা হল কেন আপনার, মিঃ চৌধুরী?

সেই কথা বলতেই আমি এসেছি সুব্রতবাবু। আমার কথা সব শুনলেই হয়তো বুঝতে পারবেন, কেন আমার এ ধারণা হল!

বলুন।

সৌরীন্দ্রর সামনে আমি কোন কথা বলতে রাজী নই। ওকে এ ঘর থেকে আগে যেতে বলুন মিঃ রায়।

কিন্তু আমারও যা বলবার তা বলা এখনও শেষ হয়নি। তাছাড়া যা তুমি বলতে চাও, আমার সামনেই অনায়াসে বলতে পার। সৌরীন্দ্রবাবু বাধা দিলেন।

বলতে যে আমি পারব না তা নয় সৌরীন। কিন্তু তবু আমার ইচ্ছা নয় যে তুমি এখন এ ঘরে থাক। আমার মনে হয় এ সময় তোমার এ ঘরে না থাকাই ভাল। সুবিমলবাবু জবাব দিলেন।

সুব্রত এতক্ষণে কথা বললে, সৌরীনবাবু, আপনি না হয় পাশের ঘরে যান! প্রয়োজন হলে তখন আপনাকে আবার ডেকে পাঠাব!

বেশ যাচ্ছি। একটু রাগত ভাবেই কথাটা উচ্চারণ করে সৌরীন্দ্রবাবু সে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

সুব্রত সুবিমলবাবুর দিকে তাকিয়ে বললে, এবারে বলুন, মিঃ চৌধুরী! আপনি কি বলতে চান?

সুবিমলবাবু তখন বলতে লাগলো, জানি না আপনি জানেন কিনা মিঃ রায়, মিঃ গজেন্দ্র সরকার দূর সম্পর্কে আমার মামাত ভাই ছিলেন। এঁদের বাড়িতে আমার যথেষ্ট যাতায়াত এবং পরিচয়ও সেই সূত্রেই। এ বাড়ির সবকিছুই আমার একপ্রকার নখদর্পণে বলতে পারেন। মিঃ সরকার, মানে গজেনদা বয়সে আমার চাইতে অনেক বড় ছিলেন। তিনি যে সম্পর্কে। কেবলমাত্র আমার মামাত ভাই-ই ছিলেন তা নয়, সত্যিকারের একজন বন্ধুও ছিলেন। বলতে বলতে সুবিমলবাবুর স্বরটা যেন গাঢ় হয়ে এল, আজ তাকে হারিয়ে আমি সত্যিকারের একজন সহায়সম্বল হারালাম।

আমি জানি, গজেনদার বাবা যখন মারা যান, তখন তাঁর সম্বলের মধ্যে বৌবাজারে একটি ছোট সোনারূপার দোকান মাত্র ছিল। সেই দোকান থেকেই তিনি প্রভূত যত্নে ও অদম্য অধ্যবসায়ে আজকের এই এক বড় ব্যবসা ও ব্যাঙ্ক গড়ে তোলেন। গজেনদার বড় ছেলের বয়স যখন মাত্র একুশ বৎসর সেই সময় বৌদি মারা যান। তিনি আর দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন নি। অত বড় ধনী হলেও মনে তার এতটুকুও শান্তি ছিল না। তিনি নিজে ছিলেন অত্যন্ত ধীর, শান্ত ও গম্ভীর প্রকৃতির লোক। তার মনে কেউ হাজার ব্যথা দিলেও মুখ ফুটে কোনদিন কারও কাছে কিছু বলতেন না। নিজের মনের কষ্ট চিরদিন নিজের মনেই চেপে রাখতেন।

যারা তাকে কোনদিন ভাল করে বুঝবার সুযোগ বা সুবিধা পেয়েছে, কেবলমাত্র তারাই তার মুখের দিকে তাকালে বুঝতে পারত কত বড় একটা দুঃখে তার মনটা ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। মনের কথা তিনি কখনও কাউকেই খুলে বলতেন না। তবে আমার কাছে তিনি মাঝে মাঝে দু-একটা কথা বলতেন। আমি জানি—অনেকখানি আশা করেই তিনি গণেনকে মানুষ করেছিলেন। কিন্তু গণেন ছিল অত্যন্ত উদ্ধত প্রকৃতির। একদিন সামান্য কারণে সে গজেনদার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। তবু তিনি তাঁর পিতার কর্তব্য থেকে বিচলিত হন। নি। টাকাপয়সা দিয়ে তাকে পৃথকভাবে ব্যবসা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। ইদানীং অবিশ্যি আর ছেলের সঙ্গে তার প্রায় কোন সম্পর্কই ছিল না।

তারপর ছোট ছেলে সৌরীন—তাকে তিনি পড়াবার অনেক চেষ্টা করলেন। সৌরীন ছেলেটিও মেধাবী ছিল। হঠাৎ বি. এস-সি পাস করে পড়াশুনা ছেড়ে দিল। গোঁ ধরল আর সে পড়াশুনা করবে না। বছরখানেক সে বাড়িতে চুপচাপ বসে রইল। যত রকমের আড্ডায় ঘুরে ঘুরে বেড়ালো। তারপর সে শুরু করলে রেস খেলা। গজেনদা এ বাড়ির প্রত্যেকের জন্যই মাসিক একটা হাত-খরচ বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন। সৌরীন মাসে দুশো, অশোক মাসে আড়াইশো, বিনয়দা মাসে দুশো করে টাকা পেত। সৌরীনের দুশো টাকায় চলত না। প্রায়ই সে গজেনদার কাছ থেকে আজ দুশো কাল একশো, এই রকম করে মাসিক ধার্য হাতখরচ ছাড়াও শ দুই-তিন করে টাকা বেশী নিত। এই সময়ই লৌরীন ব্যবসা দেখাশুনা করতে শুরু করলে। মাস দুয়েক আগে হঠাৎ একদিন সে দোকানের ক্যাশ থেকে গজেনদাকে কিছু না বলে গজেনদার নামে টাকা তুলে নেয়। দিন দুই বাদে হঠাৎ সেকথা গজেনদা দোকানের ক্যাশিয়ারের মুখে শুনতে পেলেন, বাপে ছেলেতে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়ে গেল। ঐদিন থেকেই বাপে-ছেলেতে মনোমালিন্য শুরু হল। এবং তারপর থেকেই প্রায়ই দুজনার মধ্যে পয়সা নিয়ে খিটিমিটি চলত।

গজেনদার উইলের ব্যাপারটাও আমি জানি। তার সম্পত্তি সমান দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগ, নানা প্রকারের হিতকর প্রতিষ্ঠানে দান করা হবে। দ্বিতীয় ভাগ, সমান অংশে চার ভাগ—একভাগ সৌরীন, একভাগ অশোক, একভাগ বিনয়দা, আর এক ভাগ আমি! উইলের ব্যাপারেও সৌরীনের খুব আপত্তি ছিল। কিন্তু গজেনদা সৌরীনের কোন কথাই শোনেন নি। তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার ইতিমধ্যে ঘটেছিল। কিছুদিন আগে সৌরীন তার এক বন্ধুর কাছ থেকে দুহাজার টাকা ধার নেয়। সেই ব্যাপার নিয়ে আজ কয়েকদিন থেকেই সৌরীন ও গজেনদার মধ্যে রাগারাগি চলছিল। এসব থেকে নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারবেন—মানে আমি কি বলতে চাইছি—

সুব্রত শান্তকণ্ঠে বললে, হুঁ। আচ্ছা সে জন্যই কি আপনি সকালে আজ আমার কাছে চিঠি দিয়েছিলেন মিঃ চৌধুরী?

সুবিমল যেন আকাশ থেকে পড়েছে হঠাৎ। বিস্ময়ে হতবাক। বললে, চিঠি!

হ্যাঁ, আপনিই তো আজ সকালে আমাকে চিঠি দিয়েছেন! এই তো সেই চিঠি, বলতে বলতে সুব্রত পকেট থেকে সেই আকাশ-নীল রংয়ের খামের চিঠিখানা সুবিমলবাবুর হাতে তুলে দিয়ে তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সুবিমলবাবু সুব্রতর হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে তাকাতে তাকাতে বলে, আশ্চর্য! আশ্চর্য!

চিঠিখানা আপনারই লেখা তো সুবিমলবাবু? সুব্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুবিমলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে।

আশ্চর্য, অবিকল আমারই হাতের লেখা। কিন্তু আমি শপথ করে বলতে পারি সুব্রতবাবু, বিশ্বাস করুন, এ চিঠিটা আমার লেখা নয়!

আর চিঠির কালিটা?

আরও আশ্চর্য, ঠিক এই ধরনের কালিই আমার কাছে আছে। এটা একটা special কালি। Chinese violet ink. আমার এক বন্ধু আর্টিস্ট কিছুদিন হল চীন থেকে ফিরেছে। সেই আমাকে মাস সাতেক আগে কালিটা উপহার দিয়েছিল। মাঝে মাঝে আমি কালিটা ব্যবহার করি বটে এবং কালিটা প্রায় ফুরিয়েও এসেছে।

আপনার সেই বন্ধুটির নাম কি জিজ্ঞাসা করতে পারি?

নিশ্চয়ই। বন্ধুটির নাম সুবোধ দত্ত। আমহার্স্ট স্ট্রীটে..নং-এ থাকে। তাকে জিজ্ঞাসা করলেই আপনি সব জানতে পারবেন।

সুব্রত নোটবুক বের করে নাম-ঠিকানা টুকে নিল।

সুবিমলবাবু, আপনাকে আমার আরও কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে!

বলুন।

গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে আজ সকাল পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন?

সুবিমলবাবু সুব্রতর কথায় মৃদু হাসলো, আপনি বোধহয় জানেন না মিঃ রায়, রাজলক্ষ্মী মিলে আমি চাকরি করি। গতকাল সন্ধ্যা সাতটার পর মিল থেকে বাড়ি ফিরেছি। চা খেয়ে Rainbow Club-এ যাই। রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত আমি Rainbow Club-এই ছিলাম। তারপর বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি। ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে সোয়া ছয়টা নাগাদ গজেনদার এখানে আসি।

কেন?

আমার কিছু টাকার প্রয়োজন ছিল।

তারপর?

আমি জানি তিনি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘণ্টাখানেক লাইব্রেরিতে বসে পড়াশুনা করেন। তাই বরাবর তার লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে ঢুকি। এবং ঘরে ঢুকেই তাকে ঐ অবস্থায় দেখতে পাই। তখনই ডাকাডাকি করে সকলকে জাগাই এবং পুলিশে খবর দিতে বলে হোটেলে চলে যাই। হোটলে গিয়ে হঠাৎ মনে হল, পুলিশ এলে হয়তো আমাকে তাদের প্রয়োজন হতে পারে—তাই আবার চলে এলাম।

আপনি তাহলে মধ্যে মধ্যে মিঃ সরকারের কাছে টাকা নিতেন?

হ্যাঁ, নিতাম।

আচ্ছা শেষ কবে আপনার মিঃ সরকারের সঙ্গে দেখা হয়?

দিন পাঁচেক আগে সন্ধ্যার পর এখানে এসেছিলাম, সেই শেষ দেখা। তারপর আর দেখা হয়নি।

সুব্রত এবার বললে, আচ্ছা সুবিমলবাবু, আপনি এখন যেতে পারেন। প্রয়োজন হলে আবার আপনার ওখানেই গিয়ে দেখা করব। কখন আপনাকে আপনার হোটেলে পাওয়া যেতে পারে?

সকালে বেলা এগারোটা পর্যন্ত। আর সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত। আটটার পরে Rainbow Club-এ গেলেও দেখা পাবেন। প্রত্যহই আমি সেখানে যাই।

সুবিমলবাবু এবার উঠে দাঁড়ালেন, আচ্ছা তাহলে আসি। নমস্কার।

সুবিমলবাবু ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত