০১.
আজকের দিনের আগরপাড়া স্টেশন নয় কিন্তু, ভুল করবেন তা হলে। বাইশ বছর আগেকার সেই ছোট আগরপাড়া স্টেশন। এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন চলেছে—সারাটা পৃথিবী জুড়ে।
পৌষের হাড়-কাঁপানো শীতের এক সকাল। সকালের আলো ফুটেছে বটে তবে কুয়াশার ঘন আবছায়ায় সব ঝাপসা-ঝাপসা।
স্টেশনের অল্প দূরেই স্টেশন মাস্টারের কোয়ার্টার।
খান দুই ঘর। পাকা মেঝে। পাকা দেওয়াল, উপরের কিছু অংশ পাকা—কিছুটা অংশ রাণীগঞ্জের টালি ছাওয়া। সামনে ছোট একটু বাগানের মত-অজস্র বড় বড় গাঁদাফুল, যেন হলুদের একটা বন্যা।
পিছনেও সামান্য একটু খোলা জায়গা পাঁচিল ঘেরা। তার মধ্যে রান্নাঘর-স্নানঘর ইত্যাদি।
স্টেশন মাস্টার রসময় ঘোষাল ব্যাচিলর মানুষ—একাই কোয়ার্টারে থাকে। অনেক দিনের পুরানো চাকর নিতাই-সে-ই সব কাজকর্ম করে দেয় রসময়বাবুর। এক কথায় রান্না থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাজ সব কিছু—অর্থাৎ জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত।
রসময় মানুষটা শান্তশিষ্ট ও একটু আয়েসী। বদখেয়াল বা নেশা বলতে সত্যিকারের কিছুই নেই—তবে ভদ্রলোকের একটা নেশা আছে।
যত রাজ্যের গোয়েন্দা কাহিনী সংগ্রহ করে পড়া।
রসময় যে কেবল গোয়েন্দা কাহিনী পড়েই আনন্দ পান তাই নয়—তার একটা বিচিত্র বিলাস আছে-ঐ সব গোয়েন্দা কাহিনী গোগ্রাসে গেলেন আর নিজেকে ঐ সব গোয়েন্দার চরিত্রে খাড়া করে মনে মনে সব জটিল পরিস্থিতি কল্পনা করে এবং সেই সব পরিস্থিতির জট মনে মনেই খোলে। মনে মনে বিচিত্র সব রহস্য গড়ে তুলে সেই সব রহস্য একটু একটু করে ভেদ করে।
মধ্যে মধ্যে নিতাইকে বলে, বুঝলি নিতাই এই মাস্টারী করা আমার কর্ম নয়।
নিতাই বোকা সরল মানুষ। প্রশ্ন করে, কেন কত্তা?
কেন কি রে—তুই কি মনে করিস এই স্টেশনমাস্টারী করে সারাটা জীবন কাটাব?
কাটাবেন না!
না—আমি তলে তলে চেষ্টা করছি।
কি চেষ্টা করছেন কত্তা?
পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি যদি একটা পেয়ে যাই, বুঝলি না—ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের চাকরি। পেয়ে যেতাম চাকরি একটা, বুঝলি! কিন্তু ঐ বয়সটাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে–
বয়েসটা আবার বাধা কি কত্তা—
পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে যে—এ বয়েসে কি আর চাকরি জোটে!
রসময় ঘোষাল মানুষটি যেমন সাদাসিধে-চেহারাটাও তেমনি সাদাসিধে। গোলগাল নাদুস-নুদুস গড়ন-গোবর গণেশ প্যাটার্নের। মাথায় সামনের দিকে চুল পাতলা হয়ে গিয়ে টাক দেখা দিয়েছে। গোলালো মুখ।
ভোঁতা নাক। ছোট ছোট চোখ—সরল চাউনি।
একটা নতুন গোয়েন্দা কাহিনী হাতে পড়েছিল গত সন্ধ্যায়।
বইটা স্টেশনের পয়েন্টসম্যান রামধনিয়া এনে দিয়েছিল। ওয়েটিং রুমে টেবিলের উপর পড়েছিল। সে পেয়েছে। বোধ হয় কোন যাত্রী পড়তে পড়তে কখন ফেলে চলে গিয়েছে।
বইটার নামটি ভারি লোভনীয় মনে হয়েছিল রসময়ের বইটা হাতে পেয়েই।
বিষের কাঁটা। বেশ মোটা বইটা।
বইটা হাতে পেয়ে রসময়ের গতরাত্রে আর ঘুম হয়নি। আহারাদি কোনমতে শেষ করে বইটা হাতে লেপের তলায় গিয়ে ঢুকেছিল—একেবারে শেষ করে তবে নিশ্চিন্ত।
শেষ যখন হল রাতের অন্ধকার তখন ফিকে হয়ে গিয়েছে।
আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ে নিতাইকে চা করতে আদেশ দেয় রসময়।
মুখ ধুয়ে চা পান করে সোজা চলে আসে স্টেশনে।
ভোর হয়েছে বটে তবে শীতের কুয়াশায় চারিদিক তখনও ঝাপসা-ঝাপসা।
স্টেশনে ঘরে ঢুকতেই রসময়ের নজরে পড়ল ছোটবাবু অর্থাৎ জীবন সমাদ্দার গত দিনের টিকিটগুলো বান্ডিল করে বাঁধছে।
রসময়কে ঘরে ঢুকতে দেখে জীবনবাবু বলে, গুড মর্নিং স্যার—
গুড মর্নিং।
ঢাকা মেল আজ লেট স্যার।
কত?
তা ঘণ্টাখানেক তো হবেই।
টেলিগ্রাফের টক টক একঘেয়ে শব্দ শোনা যায়।
ফার্স্ট নৈহাটি লোকাল পাস করেনি?
হ্যাঁ—এই গেল ছেড়ে, মিনিট দশেক হবে।
টেলিফোনটা বেজে উঠল।
জীবনবাবু ফোনটা তুলে নিল।
আগরপাড়া স্টেশন—ঢাকা মেল ছেড়েছে–ঠিক আছে।
ফোনের রিসিভারটা ঝুলিয়ে রেখে জীবনবাবু চেঁচায়—ওরে ও শুকলাল—সিগন্যাল দে বাবা–ঢাকা মেল—
জীবনবাবু ঢাকা মেল পাস করার জন্য বের হয়ে গেল।
আবার টেলিফোন–
রসময় ফোনটা ধরে, হ্যালো—এস এম আগারপাড়া—কি বললেন, দমদমের আগে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে—ঢাকা মেল লাইন ক্লিয়ার পাবে না…হা-হা ঠিক আছে এখানেই দাঁড় করাচ্ছি।
রসময় ঘর থেকে বের হয়ে হাঁক দেয়, রামধনিয়া–ওরে রামধনিয়া, শুকলালকে। সিগন্যাল দিতে বারণ কর—
বিরাট লৌহদানব স্টেশনের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে গেল।
মেলের গার্ড নেমে এলেন।
কি ব্যাপার, সিগন্যাল দিলেন না কেন—একে তো এক ঘণ্টা প্রায় লেট—
দমদমের আগে একটা ছোট অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, রসময় বললে।
যত সব ঝামেলা—
গার্ড অদূরবর্তী টি-স্টলের দিকে এগিয়ে গেলেন।
রসময় ঘরে ঢুকতে যাবে—মেলের পরিচিত ড্রাইভার আব্দুল এসে সামনে দাঁড়াল।
আব্দুল মিঞা যে, কি খবর?
আব্দুল সে কথার জবাব না দিয়ে বলে, করতা-ডিসট্যান্ট সিগল্যালের কাছে কি উগগা পড়ি আছে দেইলাম–
কি আবার পড়ে আছে? রসময় শুধায়।
মানুষ মত লরে—একবার চাই আস্তক—
কাটা পড়েছে নাকি?
আব্দুল বলে, সেই রকমই মনে হয় তার—কেউ কাটাই পড়েছেএকেবারে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ ঐ সময় আবার ঘরের মধ্যে টেলিফোন বেজে ওঠে। রসময় তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে ফোন ধরে।
সিগন্যাল দেয়ার নির্দেশ এসেছে। রসময় ফোনটা রেখে সিগন্যাল দেবার আদেশ দিয়ে দিল।
সিগন্যাল পেয়ে ট্রেন ছাড়ল। এখন আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ট্রেন নেই। ট্রেন আসবে—রানাঘাট লোকাল সেই সাতটায়।
কিন্তু আব্দুল কি বলে গেল। কাল রাত্রে নিশ্চয়ই হয়তো কেউ কাটা পড়েছে— অ্যাক্সিডেন্ট—একবার দেখা দরকার।
রসময় ঘর থেকে বের হয়ে প্ল্যাটফরম ধরে ডিসট্যান্ট সিগন্যালের দিকে এগিয়ে চলল।
কুয়াশা কেটে গিয়েছে ইতিমধ্যে। সূর্যের আলোয় চারিদিক পরিষ্কার।
লাইনের দুপাশে বুনো ঘাস ও ছোট ছোট আগাছাগুলোর উপরে শিশিরবিন্দুগুলো প্রথম সূর্যের আলোয় যেন মুক্তোর মত মনে হয়। টল টল করছে।
ঠিক ডিসট্যান্ট সিগন্যালের কাছে নয়—তার থেকেও প্রায় একশ গজ দূরে যেখানে রূপশ্রী কটন মিলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একটা গুডস্ ট্রেনের লাইন চলে গিয়েছে সেই লাইন ধরে কয়েক পা এগিয়ে গেলে ডাইনে যে ছোট কালভার্টটা-তারই ধারে কি যেন একটা পড়ে আছে রসময়ের নজরে পড়ে।
কালো মত কি যেন একটা মনে হয়।
রসময় সেই দিকে এগিয়ে যায় অতঃপর এবং বস্তুটার কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ায়-বাঁ দিক দিয়ে হাত দশেক ব্যবধানে মেন লাইন চলে গিয়েছে।
আব্দুল মিথ্যা বলেনি—সে ঠিকই দেখেছে। একটা মানুষের দেহই বটে—তবে তখন আর চিনবার উপায় নেই। মুখটা রক্তাক্ত। ক্ষত-বিক্ষত হাত দুটো ভেঙে দুমড়ে একাকার হয়ে গিয়েছে।
গায়ে একটা কালো গরমের গ্রেট কোট ছিল বোধ হয়—সেটা এখানে-ওখানে ছিঁড়ে গিয়েছে। সব কিছু জড়িয়ে একটা মাংসপিণ্ড বলেই মনে হয়। পায়ের জুতো দুটো বেশ দামী বলেই মনে হয়—পায়ে মোজাও আছে।
লোকটা যে সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের নয় তা বোঝা যায়। কোন সম্রান্ত শ্রেণীরই লোক। প্রথমেই যেটা মনে হয় রসময়ের ঐ মুহূর্তে, লোকটা সুইসাইড করে নি তো!
কিন্তু সাইড লাইনে এসে সুইসাইড করবে?
ঐ লাইনে তো যখন-তখন ট্রেন চলে না।
মিলের মাল নিয়ে মধ্যে মধ্যে গুডস্ ট্রেন যাতায়াত করে।
.
কিন্তু সুইসাইড হোক বা অন্য কিছু যাই হোক এলাকাটা তারই স্টেশনের অন্তর্গত–অতএব অবিলম্বে তাকে একটা পুলিসে খবর দিতে হবে।
রসময়ের মনের মধ্যে তখন নানা চিন্তা মাকড়সার জাল বুনে চলেছে। রসময় অন্যমনস্ক ভাবে নানা কথা ভাবতে ভাবতে স্টেশনে ফিরে এল।
সাড়ে ছয়টা বাজে প্রায়।
থানা খুব বেশি দূর নয়। একটা নোট লিখে তাড়াতাড়ি রসময় স্টেশনের একজন পয়েন্টম্যানের হাতে থানার দারোগা জলধরবাবুর কাছে পাঠিয়ে দিল।
জলধরবাবু রসময়ের পরিচিত। অফ-ডিউটি থাকলে মধ্যে মধ্যে রসময় জলধরের ওখানে গিয়ে আড্ডা জমায়। চুরি, রাহাজানি, খুন-খারাপির গল্প শোনে বসে।
তবে আগরপাড়ার মত ছোট একটা জায়গায় কি-ই বা এমন চমকপ্রদ ঘটনা যখনতখন ঘটতে পারে।
.
০২.
রাণাঘাট লোকালটা পাস করবার পর জলধরবাবু এসে মাস্টারের ঘরে ঢুকলেন।
কি ব্যাপার ঘোষাল-কোথায় অ্যাক্সিডেন্ট ঘটল?
থানার ও. সি. জলধর চাটুজ্যের বয়স হয়েছে—পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। ডিসপেপসিয়ার ক্রনিক রোগীরোগাটে পাকানো চেহারা। মাথার চুল প্রায় পেকে গিয়েছে। ওষ্ঠের উপরে একজোড়া কাঁচাপাকা ভারী গোঁফ।
জলধরের সঙ্গে একজন কনস্টেবলও ছিল, গিরিধারী।
এই যে চাটুয্যে সাহেব আসুন—আমার তো মনে হচ্ছে অ্যাক্সিডেন্ট নয়।
তবে কি?
সুইসাইড।
আত্মহত্যা!
হুঁ–কিংবা এ কেস অফ মার্ডারও হতে পারে—রসময় আস্তে বলে।
সে কি মশাই-রেল লাইনের ধারে মার্ডার!
কেন তা কি কখনও হয়নি?
না, না—তা নয়-লোকটা ভদ্রলোক বলে মনে হল নাকি?
ভদ্রলোক তো বটেই, সম্ভ্রান্ত ঘরের বলে মনে হয়।
কোথায়?
চলুন না কালভার্টটার কাছে।
দুজনে এগিয়ে যায়।
রসময় যেন রীতিমত একটা রোমাঞ্চ বোধ করে। তার মনে হয় সে যেন আর স্টেশন মাস্টার রসময় ঘোষাল নয়—সি. আই. ডি.-র কোন একজন নামকরা অফিসার। একটা হত্যারই ইনভেস্টিগেশনে চলেছে।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে রসময় আঙুল তুলে দেখাল, ঐ দেখুন!
মনে হল জলধর চাটুজ্যেও যেন থমকে দাঁড়ালেন সামনের দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন সামনের দিকে, তারপর সামনে এগিয়ে গেলেন এক পা এক পা করে।
মৃতদেহটা লাইনের এক পাশে পড়ে আছে। একটা বীভৎস লণ্ডভণ্ড ব্যাপার। লাইনের পাশে পাশে একটা মানুষের সরু পায়ে-চলার পথ। লাইনের উপরে বা পাশে ঠিক নয়, সেই সরু পায়ে-চলার পথের উপর পড়ে আছে দেহটা।
গিরিধারী ওদের পশ্চাতেই ছিল।
সে বলে ওঠে, হায় রাম!
কি চাটুজ্যে সাহেব—কি মনে হয়? ব্যাপারটা রীতিমত সাসপেন্স কিনা?
ঊঁ–
বলছিলাম মৃত্যুটা স্বাভাবিক, মানে একটা আচমকা অ্যাক্সিডেন্ট বলে মনে হয় কি?
উঁহু-মনে হচ্ছে না তা-মৃদুকণ্ঠে বলেন জলধর চাটুজ্যে।
সুইসাইডও হতে পারে। কিম্বা—
কি? জলধর তাকালেন রসময়ের মুখের দিকে।
মার্ডারও তো হতে পারে!
জলধর রসময়ের কোন কথার জবাব দিলেন না। আরও একটু এগিয়ে চললেন মৃতদেহটার কাছে।
গায়ের গরম গ্রেট কোটটা দামী ছিল বলে মনে হয়। কোটটা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে যেন। উপুড় হয়ে পড়ে আছে মৃতদেহটা।
মাথাটা ও মুখটা একেবারে থেতলে গেছে। মানুষটাকে চিনবার উপায় নেই। তবে দামী জামা ও পায়ের দামী জুতো দেখে মনে হয় কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিই হবে। বাঁ হাতে একটা দামী রিস্টওয়াচও দেখা গেল। কাচটা ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছে।
মৃতদেহটাকে চিৎ করে ফেললেন জলধর চাটুজ্যে।
জামার পকেটগুলো খুঁজে দেখতে গিয়ে ভিতরের বুকপকেটে একটা দামী পার্স পাওয়া গেল।
পার্সের গায়ে সোনার জলে ইংরাজীতে এমবস্ করা—এম. এন. রায়। ভিতরে প্রায় হাজারখানেক টাকার নোট—একশ টাকা ও দশ টাকার নোটও আছে দেখা গেল।
আর একটা কার্ডও পাওয়া গেল পার্সের মধ্যে। কার্ডে লেখা : এম. এন. রায়-রায় এন্ড কোং, ৯৩ ক্লাইভ রো, থার্ড ফ্লোর।
জলধর চাটুজ্যের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
যাক, তাহলে মৃত ব্যক্তির কিছুটা পরিচয় বা হদিস পাওয়া গেল, কি বলেন?
হুঁ। মৃদুকণ্ঠে জলধর চাটুজ্যে বলেন।
এবং শুধু তাই নয়-মৃত ব্যক্তি যে ধনী, অবস্থাপন্ন তাও জানা গেল তার পার্স থেকে। রসময় বলে।
গিরিধারীকে মৃতদেহের প্রহরায় রেখে জলধর চাটুজ্যে ফিরে এলেন। রসময়ও সঙ্গে সঙ্গে চলল।
কি মনে হচ্ছে চাটুজ্যে সাহেব? রসময় প্রশ্ন করে পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে, সুইসাইড, না মার্ডার?
বলা শক্ত।
তা ঠিক।
স্টেশনে পৌঁছে রসময়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জলধর থানার দিকে হাঁটতে শুরু করেন।
দেখে-শুনে ব্যাপারটা মনে হচ্ছে সুইসাইড কেসই একটা। এবং লোকটা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের নয়। পায়ের জুতো, মোজা ও পরিহিত সুটটা দেখে মনে হয় অবস্থাপন্ন ঘরেরই মানুষ।
অতএব অবিলম্বে লালবাজারে একটা সংবাদ দিতে হবে। মৃতদেহেরও একটা ব্যবস্থা। করতে হবে। তার মানেই নানা ঝামেলা।
থানায় ফিরে লালবাজারে ফোন করতেই স্বয়ং ডেপুটি কমিশনারই ফোন ধরলেন।
অবিনাশ চক্রবর্তী-চক্রবর্তী সব শুনে বললেন, আমি ইন্সপেক্টার মৃণাল সেনকে পাঠাচ্ছি।
অবিনাশ ফোন রেখে তখুনি মৃণাল সেনকে ডেকে পাঠালেন।
একটু পরে মৃণাল এসে ঘরে ঢুকল। অল্প বয়েস। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। পরিশ্রমী ও উৎসাহী।
আমাকে ডেকেছেন স্যার?
হ্যাঁ–তোমাকে এখুনি একবার আগরপাড়া যেতে হবে—সেখানকার থানার ও. সি. জলধর চাটুজ্যে একটু আগে ফোন করেছিল, একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। জলধরবাবুর ধারণা, ব্যাপারটা পিছনে কোন ফাউল প্লে আছে!
আমি এখুনি যাচ্ছি স্যার।
মৃণাল সেন স্যালুট দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
মৃণাল সেন আগরপাড়ায় যখন এসে পৌঁছল বেলা তখন প্রায় সোয়া নয়টা।
জলধরবাবুর মুখ থেকে মৃণাল সমস্ত ব্যাপারটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সর্বপ্রথম জেনে নিল। তারপর সে জলধরবাবুকে নিয়ে অকুস্থানে গেল।
ইতিমধ্যে সংবাদটা আশেপাশে ছড়িয়ে গিয়েছিল।
অনেকেই এসে ভিড় করেছিল আশেপাশে। কিন্তু গিরিধারীর জন্য কিছুটা দূরত্ব রেখে তারা জটলা পাকাচ্ছিল।
জলধরবাবু সকলকে তাড়া দিলেন।
তাড়া খেয়ে সবাই পিছিয়ে গেল বটে কিন্তু স্থানত্যাগ করল না।
মৃণাল সেন মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখল।
মৃতদেহ ও তার পরিধেয় বস্ত্র দেখে মনে হয় মৃত ব্যক্তি হয়ত চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে লাইনের উপরেই এসে পড়ে, তার পর ইঞ্জিনের সামনে লোহার জালে আটকা পড়ে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। এবং শেষটায় হয়ত ধাক্কা খেয়ে পাশে ছিটকে পড়েছে।
কিম্বা হয়ত রেল লাইনের উপরেই সে শুয়েছিল আত্মহত্যা করবার জন্য—শেষটায় ঐ অবস্থা হয়েছে।
আত্মহত্যা করে থাকলে কোন প্রশ্ন নেই। এবং অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে থাকলেও লোকটা হয়ত চিৎকার করেছিল, সে চিৎকার হয়ত কেউ শুনতে পায়নি, এমন কি ইঞ্জিনড্রাইভারও শুনতে পায় নি। তা ছাড়া এ লাইন দিয়ে তো সাধারণত ট্রেন চলাচলও বড় একটা করে না।
কিম্বা হয়ত আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা কোনটাই নয়।কারণ ঠিক ঐখানে ঐভাবে এসে আত্মহত্যা করা বা দুর্ঘটনা ঘটা কোনটাই সম্ভাব্য বলে মনে হচ্ছে না।
হয়ত ব্যাপারটা একটা মার্ডার কেস।
চলুন ফেরা যাক মিঃ চ্যাটার্জী-মৃণাল সেন বলে, মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। আর একটা খোঁজ নেবেন তো
কি বলুন তো!
রূপশ্রী কটন মিলে খোঁজ নেবেন, গতকাল কোন ওয়াগন লোডিং হয়েছে কিনা–
নেবো।
হ্যাঁ—আরও একটা খোঁজ নেবেন।
কি?
এ তল্লাটে এম. এন. রায় বলে কেউ আছেন কিনা—যদি থাকেন তার যথাসম্ভব পরিচয়।
বেশ।
পার্সটা যেটা মৃত ব্যক্তির জামার পকেটে পাওয়া গিয়েছিল সেটা নিয়ে মৃণাল ফিরে এল।
.
পরের দিন—যেটুকু সূত্র হাতের মধ্যে আপাতত পাওয়া গিয়েছিল তার সাহায্যেই মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করে মৃণাল সেন।
ক্লাইভ রো—বেশি দূর নয়, লালবাজারের কাছেই।
প্রথমেই মৃণাল ক্লাইভ রোতে রায় এন্ড কোম্পানির অফিসে গিয়ে হাজির হল! একটা বিরাট পাঁচতলা বিল্ডিং ৯৩ নং ক্লাইভ রোতে।
তিনতলায় রায় এন্ড কোম্পানির অফিস।
বিরাট অফিস-দেখেই বোঝা যায়—বিরাট বিজনেস।
আগেই খোঁজ নিয়ে জেনেছিল মৃণাল সেন-প্রধানত কয়লার খনি, ঐ সঙ্গে নানাজাতীয় কেমিকেলস-এরও ব্যবসা করে রায় এন্ড কোম্পানি।
এনকোয়ারিতে গিয়ে সন্ধান নিয়ে মৃণাল ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করার জন্য স্লিপ দিল বিশেষ জরুরী বলে।
.
০৩.
একটু পরেই অফিস ম্যানেজার মিঃ মুখার্জীর ঘর থেকে মৃণালের ডাক এল।
মৃণাল বেয়ারার সঙ্গে গিয়ে ম্যানেজারের অফিসে প্রবেশ করল।
দেখেই বোঝা যায় ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। মোটাসোটা বেশ ভারিক্কী চেহারা। পরিধানে সাহেবী পোশাক-মুখে পাইপ। চোখে সুদৃশ্য ফ্রেমের চশমা।
বি সিটেড প্লিজ!!
মিঃ মুখার্জী কি একটা ফাইল দেখছিলেন—চোখ তুললেন না—মৃদুকণ্ঠে মৃণালকে বসতে বললেন।
মৃণাল বসল।
ফাইলটা দেখা হল একটু পরে-সেটা একপাশে ঠেলে রেখে মুখ তুলে তাকালেন মিঃ মুখার্জী।
ইয়েস মিঃ সেন, হোয়াট ক্যান ড়ু ফর ইউ।
আমি লালবাজার থেকে আসছি। কথাটা বলে মৃণাল তার পরিচয় দিল।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মুখাজীর দুটো কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। কয়েকটা মুহূর্ত মৃণালের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলেন, লালবাজার থেকে আসছেন—কি ব্যাপার বলুন তো?
মিঃ এম. এন. রায়ের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।
আমাদের ম্যানেজিং ডাইরেক্টারের সঙ্গে?
তিনিই কি ম্যানেজিং ডাইরেক্টার?
হ্যাঁ,–কিন্তু তিনি তো আজ এখনও আফিসে আসেন নি!
আসেন নি?
না।
ও, তা সাধারণত কখন অফিসে আসেন তিনি?
ঠিক দশটায় আসেন—অত্যন্ত পাংচুয়াল তিনি—অথচ আজ এখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেল—এলেন না। তাই ভাবছিলাম
অসুখ-বিসুখ করেনি তো!
না, না, মশাই-ভদ্রলোকের যদিও ষাট বছর বয়স হল—কখনও আজ পর্যন্ত একটা দিনের জন্যও তাকে অসুস্থ হতে দেখিনি। তবে আগরপাড়ায় তার বন্ধুর ওখানে গিয়ে যদি আটকে পড়ে থাকেন কোন কারণে
আগরপাড়ায়—তিনি আগরপাড়ায় কাল গিয়েছেন নাকি? মৃণাল প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
কোন ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপার কি?
না-না, তার এক বন্ধু আগরপাড়ায় থাকে। তার এক জরুরী চিঠি পেয়ে—
জরুরী চিঠি?
হ্যাঁ—এক ভদ্রলোক গতকাল বেলা সাড়ে চারটে নাগাদ চিঠিটা নিয়ে আসে—সেই চিঠি পড়ার পরই তিনি আমাকে বলেন—তিনি অফিসের পর আগরপাড়া যাবেন।
চিঠিটায় কি ছিল কিছু আপনি জানেন?
চিঠিটা তিনি সঙ্গে নিয়ে যাননি—সম্ভবত তার টেবিলের উপরেই এখনও পড়ে আছে।
কি করে আপনি সেকথা জানলেন?
আমি সে সময় তার ঘরে তার পাশেই বসেছিলাম—চিঠিটা তিনি পড়া হলে টেবিলের উপরেই রেখে দিলেন দেখলাম—তারপর বের হয়ে গেলেন।
হুঁ-আচ্ছা দেখুন তো এই পার্সটা-বলতে বলতে মৃণাল সেন জলধর চাটুজ্যের কাছ থেকে পাওয়া পার্সটা পকেট থেকে বের করে মিঃ মুখার্জীকে দেখান।
একি, এ তো মিঃ রায়েরই পার্স! এটা আপনি পেলেন কোথায়?
আর ইউ সিয়োর—ঠিক জানেন?
ঠিক জানি মানে—এ পার্সটা তার ৫৯তম বার্থ-ডেতে আমিই তাকে প্রেজেন্ট করেছিলাম যে—কিন্তু এ পার্সটা আপনি কোথায় পেলেন?
মিঃ মুখার্জীর গলার স্বরে স্পষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ পায় যেন।
তাহলে আপনি নিঃসন্দেহ যে এ পার্সটা আপনাদের ম্যানেজিং মিঃ এম. এন. রায়েরই?
হ্যাঁ—কিন্তু মিঃ সেন, আপনি তোকই বললেন না, মিঃ রায়ের এ পার্সটা আপনি কোথায় পেয়েছেন?
বলছি সব কিছুই, ব্যস্ত হবেন না মিঃ মুখার্জী-তার আগে একবার মিঃ রায়ের অফিসঘরটা আমি দেখতে চাই—আর সেই চিঠিটা যদি পাওয়া যায় একবার সেটাও দেখব।
চলুন।
মিঃ মুখার্জী উঠে দাঁড়ান।
পাশের ঘরটাই ম্যানেজিং ডাইরেক্টারের বসবার ঘর।
বেয়ারা দরজার গোড়ায় টুলের উপরে বসেছিল।
মিঃ মুখার্জীকে দেখে তাড়াতাড়ি সেলাম দিয়ে বলে, বড়া সাক্ তো আভি আয়া নেই সাব!
ঠিক হ্যায়-মুঝে মালুম হ্যায়।
মিঃ মুখার্জী মৃণাল সেনকে নিয়ে ম্যানেজিং ডাইরেক্টারের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
টেবিলের উপরেই চিঠিটা পাওয়া গেল। একটা পেপার-ওয়েট দিয়ে অন্যান্য চিঠিপত্রের সঙ্গে চাপা দেওয়া রয়েছে চিঠিটা।
তুলে নিল হাতে মৃণাল সেন চিঠিটা!
চিঠিটা ইংরাজীতে টাইপ করা। পুরু সাদা লেটার প্যাডের কোণে ইংরাজী এম অক্ষরটি মনোগ্রাম করা।
নিচে নাম সই করা, অ্যাফেকশনেটলি—ইওরস মণি।
চিঠিটার বাংলা তর্জমা করলে এই দাঁড়ায় :
৩০/৩/৪৩
প্রিয় মহেন,
অনেক দিন তোমার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় না। ধন্যবাদ দিয়ে তোমায় ছোট করব না। তবে তোমার সৌজন্যে বর্তমানে আমার আরামেই কাটছে এখানে। সামনের শনিবার যদি একবার আসো তাহলে ভাল হয়—এবং আসবার সময় তোমার সেই চিঠিটা যদি আনো তাহলে আমরা ব্যাপারটা একটু আলোচনা করতে পারি, কারণ আমি গত পরশু ব্যাঙ্ক থেকে আমার চিঠিটা আনিয়েছি।
যদিও আগে তুমি কখনও এখানে আসনি, তাহলেও এখানে আসতে তোমার কোন কষ্ট হবে না। ইচ্ছা করলে গাড়িতেও আসতে পার বা ট্রেনেও আসতে পার—তবে রাতটা কিন্তু ছাড়ছি না। গাড়িতে যদি আসো, তাহলে স্টেশন থেকে উত্তর-মুখো যে পথটা গেছে সেই পথ ধর এগিয়ে এলেই দেশবন্ধু কলোনিতে এসে পৌঁছতে পারবে। আর ট্রেনে যদি আসো তো–একটা রিকশা নিয়ে ঐ পথটা দিয়ে আসতে পার।
স্টেশন থেকে দেশবন্ধু কলোনি প্রায় মাইলখানেক হবে। পথটা ধরে সোজা এগিয়ে এলে একটা রেস্তোরাঁ দেখবে-নামটা তার বিচিত্ৰ-পান্থনিবাস—সেখানে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেও আমার সলিটারি কর্নার তারা দেখিয়ে দেবে।
ভালবাসা নিয়ো—আসবে কিন্তু—আসা চাই-ই। আমি অপেক্ষা করব।
তোমার স্নেহধন্য-মণি।
মৃণাল সেন চিঠিটাই বার-দুই পড়ে ভাঁজ করে নিজের পকেটেই রেখে দিল, চিঠিটা আমি রাখলাম মিঃ মুখার্জী!
বেশ।
মিঃ মুখার্জী-মিঃ রায় গত পরশু নিশ্চয় তার গাড়ি নিয়েই গিয়েছেন?
না।
গাড়ি নিয়ে যাননি?
না–ট্রেনেই গিয়েছিলেন। কেন—ট্রেন কেন?
তার ড্রাইভার রামরূপবয়েস অনেক হয়েছে, রাতে ভাল করে চোখে দেখতে পায় না—তাই তিনি রাত্রে কখনও ওকে নিয়ে বেরুতেন না। কোথায়ও যেতে হলে ট্যাকশিতেই যেতেন।
আশ্চর্য তো।
তাই। লোকটা বুড়ো হয়ে গিয়েছে। ভাল করে চোখে দেখে না। তবু তাকে ছাড়াবেন। আমরা কতবার বলেছি একটা ভাল দেখে ড্রাইবার রাখুন। কিন্তু তিনি কারও কথাই শোনেন নি। বলেন, ও এতকাল আমার কাছে কাজ করল –এখনও চমৎকার গাড়ি চালায়—কেবল রাত্রে একটু কম দেখে—সেই অজুহাতে ওকে আমি তাড়িয়ে দিতে পারি না এই বয়সে। সেটা অন্যায় হবে। তাছাড়া আমি তো রাত্রে বড় একটা বেরই হই না।
লোকটাকে খুব স্নেহ করেন মিঃ রায় মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ—রামরূপেরও স্যারের উপরে অগাধ ভালবাসা ও ভক্তি। তাছাড়া লোকটার আরও একটা গুণ হচ্ছে, অত্যন্ত বিশ্বাসী। অমন বিশ্বাসী লোক আজকাল বড় একটা চোখে পড়ে না।
হুঁ-তাহলে তিনি ট্রেনেই গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। আর একটা কথা—মিঃ গাঙ্গুলী ওঁর বিশেষ বন্ধু বলেই মনে হয়—
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। তিন বন্ধু ছিলেন। এক বন্ধু গত হয়েছেন। এখন দুই বন্ধু আছেন। মিঃ রায় আর আগরপাড়ার ঐ মিঃ গাঙ্গুলী।
অনেক দিনের বন্ধুত্ব বুঝি ওঁদের?
হ্যাঁ–মিঃ রায়ের মুখে শুনেছি ছোটবেলা থেকেই বন্ধু ছিলেন ওঁরা। মহেন্দ্রনাথ রায়, মণীন্দ্র গাঙ্গুলী আর ডাঃ নলিনী চৌধুরী।
নলিনী চৌধুরী নেই?
না।
আচ্ছা মিঃ মুখার্জী-মিঃ গাঙ্গুলী যে চিঠির মধ্যে লিখেছেন কি একটা চিঠির কথা–তিনি ব্যাংক থেকে নিয়ে এসেছেন, সে সম্পর্কে কিছু জানেন?
জানি, সে এক মজার ব্যাপার।
কি রকম?
তাহলে আপনাকে ঐ চিঠির ব্যাপারটা মোটামুটি বলতে হয়। ঐ তিন বন্ধুর মধ্যে মিঃ রায়ের অবস্থাই সব চাইতে ভাল তার ব্যবসার দৌলতে।
এ ব্যবসা কি তারই হাতের?
না।
তবে?
তার বাপেরই তৈরি, বিরাট লাভবান ব্যবসা। অবশ্য তার পরিশ্রমও এতে কম নেই।
মিঃ মুখার্জী বলতে লাগলেন—মণীন্দ্র গাঙ্গুলী সিঙ্গাপুরে ভাল চাকরি করতেন। যুদ্ধ বাধার পর বোমা পড়তে শুরু হলে সেখান থেকে কোনমতে নিঃস্ব কপর্দকহীন অবস্থায় প্রাণটা মাত্র হাতে করে মালয় ও বর্মা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেশে ফিরে আসেন। এসে কিছুদিন আমাদের স্যারের বালীগঞ্জের বাড়িতেই ছিলেন। তারপর স্যারের কাছ থেকেই। কিছু টাকা নিয়ে আগরপাড়ায় দেশবন্ধু কলোনিতে একটা জায়গা কিনে ছোট একটা বাড়ি করে বসবাস করছেন। ডাঃ নলিনী চৌধুরী-তিন বন্ধুর মধ্যে একটু খেয়ালী প্রকৃতির ছিলেন বরাবর। নিজের ছোটখাটো একটা ল্যাবোরেটারি ছিল, সেখানে সর্বক্ষণ বসে বসে রিসার্চ করতেন। মাসকয়েক হল তিনি মারা গেছেন ব্ল্যাড-ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে।
তার ছেলেমেয়ে নেই?
না, মিঃ চৌধুরী ও মিঃ গাঙ্গুলী বিয়েই করেননি। দুজনেই ব্যাচিলার।
চিঠির কথা কি বলছিলেন?
ডাঃ চৌধুরীর এক ভ্রাতা হেমন্ত চৌধুরী ছিলেন বর্মায়। শোনা যায়, যুদ্ধ বাধার সঙ্গেই তিনিও দেশে ফিরে আসেন। এবং আসবার সময় নাকি প্রভূত অর্থ সঙ্গে নিয়ে আসেন। যাহোক, এসে তিনি শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে একটা বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করেন। এবং দেশে ফিরে আসার মাস আষ্টেক পরে হঠাৎ একদিন রাত্রে ঘরের মধ্যে সর্পদংশনে তার মৃত্যু হয়।
সর্পদংশনে মৃত্যু!
সেই রকমই শুনেছি। ডাঃ চৌধুরীর দাদা তার মৃত্যুর দিন দশেক আগে ডাঃ চৌধুরী–তার ছোট ভাইকে শ্রীরামপুরের বাড়িতে ডেকে পাঠান, এবং ঐ সময়ই তিনি তার ছোট ভাইকে প্রথম বলেন যে বর্মা থেকে আসবার সময় তিনি প্রভূত অর্থ নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে। সেই অর্থ তিনি তার ভাইকে দিয়ে যেতে চান—সেই অর্থ দিয়ে যেন ডাঃ চৌধুরী তার আজন্মের বাসনা-মনের মত একটা ল্যাবোরেটারি তৈরি করে তার ইচ্ছামত রিসার্চ চালিয়ে যান।
তারপর?
কিন্তু তাঁর সে বাসনা পূর্ণ হল না। দাদার মৃত্যুর মাস কয়েক আগে থাকতেই ডাঃ চৌধুরীর শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি ক্ষেপ করেন নি। দাদার মৃত্যুর দিন পনেরো-কুড়ি বাদে হঠাৎ ধরা পড়ল তার লিউকিমিয়া, ব্লাড ক্যানসার হয়েছেডাঃ চৌধুরী শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। মিঃ রায় সে সময় ইউরোপে। প্রত্যহই প্রায় তিনি খোঁজ নিতেন মিঃ রায় ফিরেছেন কিনা। মিঃ রায়ের ইউরোপ থেকে ফিরবার আগেই ডাঃ চৌধুরীর মৃত্যু হল। ডাঃ চৌধুরীর মৃত্যুর দিন পনেরো বাদে মিঃ রায় দেশে ফিরে এলেন এবং তার ফিরে আসবার কয়েকদিন পরেই একদিন অফিসে ডাঃ চৌধুরীর লএডভাইসার কালীপদবাবু মিঃ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে দুখানা চিঠি তাঁর হাতে দিলেন। একখানা তার নামে, অন্যটা তাদের বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলীর নামে। এবং চিঠি দুটো দিয়ে তিনি বললেন, তার মৃত ক্লায়েন্টের নির্দেশমতই তিনি ঐ চিঠি দিলেন।
.
০৪.
তারপর।
মিঃ মুখার্জী বলতে লাগলেন–
মিঃ রায়ের মুখেই শোনা আমার কথাগুলো। ডাঃ চৌধুরীর দুখানা চিঠি একখানা স্যারের নামে, অন্যখানা মিঃ গাঙ্গুলীর নামে। চিঠিতে ছিল—বরাবরের যাঁর ইচ্ছা ছিল বিরাট একটা ল্যাবোরেটারি গড়ে তুলবেন কিন্তু অর্থের জন্য পারেন নিশেষটায় সেই অর্থ এল যখন তিনি মৃত্যুশয্যায়—যাই হোক, সেই অর্থের দায়িত্ব তিনি তার দুই বন্ধুর হাতে যৌথভাবে তুলে দিয়ে গেছেন। ব্যাঙ্ক থেকে চিঠি নিয়ে তারা যেন ঐ অর্থ দিয়ে ভাল একটা ল্যাবোরেটারি তৈরি করেন। ভারটা অবিশ্যি তিনি তার ভাগ্নের হাতেও দিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু কেন যে দেন নি তা তিনিই জানেন—যদিও তার নিজস্ব ল্যাবোরেটারিটা তিনি ঐ ভাগ্নেকেই দিয়ে গিয়েছিলেন। ভাগ্নেকে তিনি ভালও বাসতেন যথেষ্ট এবং ঐ ভাগ্নে তার সঙ্গেই বরাবর কাজও করেছে।
তবে দিলেন না কেন?
তা জানি না। হয়ত বন্ধুদের যত বিশ্বাস করতেন ভাগ্নেকে ততটা করতেন না।
আচ্ছা, আপনি বলছেন বিপুল অর্থ নাকি ডাঃ চৌধুরীর ভাই হেমন্ত চৌধুরী বর্মা থেকে সঙ্গে করে এনেছিলেন—সে অর্থ কত?
সে এক মশাই বিচিত্র ব্যাপার।
কি রকম?
ডাঃ চৌধুরীর ভাই হেমন্ত চৌধুরীর বিপুল অর্থের কথাই শুনেছি কিন্তু সে কি নগদ টাকাকড়ি না অন্য কিছু তাও এখন পর্যন্ত জানা যায় নি। এবং সেই অর্থ কোথায় আছে-–আদৌ আছে কিনা—কি ব্যাপার—সেও একটা রহস্যের মত।
কি রকম?
আপনাকে তো আগেই বলেছি, ডাঃ চৌধুরী মানুষটা যেমন খেয়ালী তেমনি রহস্যপ্রিয় ছিলেন। তাঁর চিঠির মধ্যে ছিল ব্যাঙ্ক থেকে নির্দেশ নিতে তার অর্থ সম্পর্কে। ব্যাংকে খোঁজ করতে দেখা গেল
কি?
দু বন্ধুর নামে দুখানা চিঠি আছে আলাদা আলাদা ভাবে—এবং সে চিঠির মধ্যে কতকগুলো অঙ্ক পর পর বসানো কেবল।
অঙ্ক!
হাসে চিঠি আমিও মিঃ রায়ের কাছে দেখেছি। আর একটা জিনিস–
কি?
চিঠির কাগজটা কোনোকুনি ত্রিকোণাকার ভাবে যেন কাঁচি দিয়ে কাটা।
সে আবার কি!
তাই। আর সম্ভবত ঐ চিঠির কথাই লিখেছেন মিঃ গাঙ্গুলী আমাদের স্যারের কাছে এবং চিঠির ব্যাপারটা আলোচনার জন্যই হয়ত ডেকেছেন—কিন্তু মিঃ সেন, এখনও আপনি বললেন না তো-স্যারের ব্যাগটা আপনি কোথায় পেলেন?
মিঃ মুখার্জী, আমি অতীব দুঃখের সঙ্গে আপনাকে জানাচ্ছি, মিঃ রায় বোধ হয় আর বেঁচে নেই।
সে কি! বিস্ময়ে মিঃ মুখার্জী যেন একেবারে থ হয়ে যান।
হ্যাঁ—যতদূর জানা গেছে তাতে মনে হয় ট্রেন-অ্যাক্সিডেন্টে সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
না, না—আই কানট বিলিভ ইট-এ যে কিছুতেই আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না—
মৃণাল সেন অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ডেড বডিটা এখনও মর্গেই আছে—আইডেন্টিফিকেশন-এর জন্য আপনাকে একবার আমার সঙ্গে যেতে হবে। ভাল কথা, তার ছেলেমেয়ে আছে তো—তার স্ত্রী–
অনেক দিন আগেই তার স্ত্রী মৃত্যু হয়েছে।–
স্ত্রী তাহলে নেই?
না।
ছেলেমেয়ে?
দুই ছেলে এক মেয়ে। কিন্তু তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তার বিশেষ কোন সম্পর্ক ছিল না!
সম্পর্ক ছিল না?
না। অল্প বয়সে স্ত্রীর মৃত্যু হয়—তারপর থেকেই তার ছেলেমেয়েরা তাদের মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে-যদিও মোটা একটা মাসোহারা বরাবরই তাদের জন্য গেছে। কোম্পানি থেকে প্রতি মাসে নিয়মিত।
ছেলেমেয়েরা এখনও কি তাদের মামার বাড়িতেই আছে?
না—বড় ছেলে সৌরীন্দ্র ডাক্তার-বর্তমানে সে ইস্টার্ন ফ্রন্টে ইমারজেন্সি কমিশনে আছে-ক্যাপ্টেন। ছোট ভবেন্দ্র-সে বি. কম. পাস করতে না পেরে বছরখানেক হল–সেও বাপের সঙ্গে রাগারাগি করে বাড়ি থেকে চলে গিয়ে যুদ্ধের চাকরি নিয়েছে। বেরিল না কোথায় আছে যেন শুনেছি-সুবেদার মেজর–
আর মেয়ে?
মেয়ে কুন্তলা বছর দেড়েক হল মামীর মৃত্যুর পর বাপের কাছে চলে এসেছে। এম. এ. পড়ে
বাড়িতে তাহলে ঐ এক মেয়ে আর তিনিই ছিলেন?
না—আর একজন ছোট ভাই আছেন মিঃ রায়ের।
ভাই?
হ্যাঁ, সুরেন্দ্রনাথ। লেখাপড়া বিশেষ কিছু করেনি। আর্ট স্কুল থেকে পাশ করে এখন একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। অত্যন্ত বেহিসাবী উদ্ধৃঙ্খল প্রকৃতির মানুষ।
হুঁ–তাহলে তো দেখছি একমাত্র আপনি ছাড়া আর উপায় নেই। চলুন আপনাকে দিয়েই মৃতদেহ আপাতত আইডেন্টিফাই করিয়ে নেওয়া যাক। হ্যাঁ আর একটা কথা–আপাতত অফিসে কাউকে ব্যাপারটা জানাবেন না কিন্তু–
বেশ।
অফিসের গাড়িতেই দুজনে বের হয়।
পথে যেতে যেতে একসময় মৃণাল শুধায়, মিঃ মুখার্জী, মিঃ রায়ের কোন উইল আছে কিনা জানেন?
এ্যা-কিছুদিন আগেই তিনি উইল করেছেন। আমি উইলের একজন সাক্ষী। তাহলে তো উইল সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনি সব কিছু জানেন?
জানি। কিন্তু সে সম্পর্কে আপাতত কিছু আপনাকে আমি বলতে পারছি না বলে দুঃখিত।
বলতে পারছেন না কেন?
সেই রকম নির্দেশই আছে—আর সত্যিই যদি দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়ে থাকে, কালপরশুই তো সব জানতে পারবেন উইলের ব্যাপারে।
মৃণাল সেন আর কোন কথা বলে না। চুপ করে থাকে।
মিঃ মুখার্জীই আবার এক সময় প্রশ্ন করেন, আচ্ছা মিঃ সেন, অ্যাক্সিডেন্টে মিঃ রায়ের মৃত্যু হয়েছে বলছেন—ট্রেনে কাটা পড়ছেন কি?
তা এখনও ঠিক বলা যাচ্ছে না। মৃণাল সেন বলে।
মর্গে গিয়ে মৃতদেহ দেখবার পর মিঃ মুখার্জী কেঁদে ফেললেন। মুখটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেলেও মুখার্জীর চিনতে কষ্ট হয় না মানুষটাকে!
বললেন, মৃতদেহটা তার মনিবেরই বটে। মিঃ মুখার্জীকে বিদায় দিয়ে মৃণাল সেন লালবাজারে ফিরে এল।
.
০৫.
পরের দিন কলকাতার ইংরাজী ও বাংলা সমস্ত দৈনিক কাগজেই লক্ষপতি বিজনেস ম্যাগনেট-রায় এন্ড কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টার মহেন্দ্রনাথ রায়ের আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংবাদটা তার ফটোসহ প্রকাশিত হল।
মহেন্দ্রনাথ যে কেবল লক্ষপতি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন তাই নয়—তার দানধ্যানও যথেষ্ট ছিল এবং একজন দেশকর্মী বলেও তার পরিচয় ছিল।
সকাল তখন নয়টা হবে।
মৃণাল তার অফিস কামরায় ঢুকতে যাচ্ছে, সার্জেন্ট সাহা এসে বললেন, স্যার, আপনাকে ডি. সি. মিঃ চক্রবর্তী দুবার খোঁজ করেছেন।
মৃণাল কোন কথা না বলে ডি. সি.-র ঘরে গিয়ে ঢুকল।
ডি. সি.-র পাশেই একজন মধ্যবয়সী যুবক বসে ছিল-কালো সুশ্রী চেহারা। মৃণাল ঘরে ঢুকতেই বললেন, এই যে মৃণাল, এস পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি সুব্রত রায়।
সুব্রতকে না দেখলেও তার নামের সঙ্গে মৃণালের যথেষ্ট পরিচয় ছিল। সে হাত তুলে সুব্রতকে নমস্কার জানায়।
অতঃপর মিঃ চক্রবর্তী বলেন, কালকের সেই অ্যাক্সিডেন্ট কেসটা—মহেন্দ্র নাথের ব্যাপারটা তোমার কাছ থেকে উনি জানতে চান ডিটেলস-এ।
সুব্রত ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলে, চলুন মিঃ সেন, আপনার অফিস ঘরে যাওয়া যাক।
বেশ তো চলুন।
দুজনে এসে মৃণালের অফিস ঘরে বসে।
আপনি কেসটা সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড় নাকি সুব্রতবাবু? মৃণাল প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
কি ব্যাপার বলুন তো? সংবাদপত্রে news-টা পড়েই কি—
তা ঠিক নয়।
তবে?
আপনি বোধ হয় জানেন, মৃত ঐ মিঃ রায়ের একটি ছোট ভাই আছে!
আপনি সুরেন্দ্রনাথের কথা বলছেন তো?
হ্যাঁ।
তাকে আপনি চেনেন?
হ্যাঁ—তার সঙ্গে আমার অনেক দিন থেকেই পরিচয়। সে-ই আমায় কাল রাত্রে টেলিফোন করে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে সব কথা বলে।
কি বলেছেন তিনি?
তার ধারণা ব্যাপারটা ঠিক একটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়, ওর মধ্যে সুনিশ্চিত একটা কোন ফাউল প্লে আছে।
ফাউল প্লে!
হ্যাঁ—সে বলতে চায় এ আত্মহত্যাও নয়—দুর্ঘটনাও নয়—তাকে অর্থাৎ তার দাদাকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে।
কেন-হঠাৎ তার একথা মনে হল কেন? আপনাকে তিনি বলেছেন কিছু সে সম্পর্কে?
সে বলতে চায়—তার মত মানুষ আত্মহত্যা করতে পারেন না কিছুতেই।
কেন?
তাছাড়া সে বলতে চায় আত্মহত্যা হঠাৎ করবার মতন তার কোন কারণ ছিল না।
কারণ ছিল না তিনি বুঝলেন কি করে?
সুব্রত হেসে বলে, তা তো জানি না। তবে সে বলতে চায়—তার দাদার কোন অর্থের অভাব বা দুশ্চিন্তা ছিল না। বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান। খুব ভাল করে না ভেবে কখনও তিনি কোন কাজ নাকি করতেন না। অবিশ্যি ছেলেদের ব্যাপারে তার মনে একটা অশান্তি ছিল, তবে সে অশান্তি কোনদিনই তাকে তেমন বিচলিত করতে পারেনি।
হুঁ–তা ব্যাপারটা অ্যাক্সিডেন্টও নয় যে, তাই বা তিনি বুঝলেন কি করে?
যে লোক তার মতে অত্যন্ত সাবধানী, হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় কিছু কখনও করেননি, অমন একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাবে আদৌ নাকি বিশ্বাসযোগ্য নয়।
তাহলে তার ধারণাইটস এ কেস অফ মার্ডার—হোমিসাইড।
সুব্রত পুনরায় মৃদু হেসে বলে, কতকটা তাই সে বলতে চায়।
সুব্রতবাবু, কেন এখনও ঠিক বলতে পারছি না—আমারও কিন্তু ঠিক তাই ধারণা।
মানে?
আমারও কেন যেন মনে হচ্ছে ঐ ব্যাপারটার মধ্যে কোন ফাউল প্লে আছে।
আপনারও মনে হয় ব্যাপারটার মধ্যে ফাউল প্লে আছে মিঃ সেন?
হ্যাঁ।
কেন বলুন তো?
মৃণাল সেন সংক্ষেপে তখন গতকালের ব্যাপারটা পুনরাবৃত্তি করে।
সব শোনবার পর সুব্রত বলে, পোস্ট মর্টে তো আজ হবে?
হ্যাঁ—মোটামুটি একটা রিপোর্ট হয়ত আজই পেয়ে যাব।
তারপর একটু থেমে মৃণাল সেন ডাকে, সুব্রতবাবু?
উঁ।
সব তো শুনলেন, আপনার কি মনে হচ্ছে?
ব্যাপারটা সহজ বা স্বাভাবিক নয়, এইটুকু বলতে পারি আপাতত আপনাকে।
অ্যাক্সিডেন্ট বা আত্মহত্যা নয়?
তাই তো মনে হয়।
কেন?
আপনি বলেছেন মৃতের মুখটা এমন ক্ষতবিক্ষত ছিল যে চেনার উপায় ছিলনা।
হ্যাঁ।
ট্রেনের চাকার তলায় আত্মহত্যা করলে বা অ্যাক্সিডেন্ট হলে অমন করে মুখটা মিউটিলেটেড হবে কেন?
এজাক্টলি-আমারও তাই মত। কিন্তু আমি ঠিক এখনও বুঝতে পারছি না সুব্রতবাবু, অনুসন্ধানের ব্যাপারটা কি ভাবে কোথা থেকে শুরু করব–
মোটামুটি একটা পোস্টমর্ট রিপোর্ট তো আজই আপনি পাবেন! হয়ত সেই রিপোর্টেই কিছু পাওয়া যাবে।
আপনি তাই মনে করেন?
দেখুন না, যেতেও পারে। তাহলে এখন আমি উঠি মিঃ সেন, রিপোর্টটা পেলেই কিন্তু আমাকে জানাবেন।
নিশ্চয়ই।
০৬.
সেই রাত্রেই মৃণাল সেন সুব্রতর গৃহে এসে হাজির হল।
কি ব্যাপার? মনে হচ্ছে আপনি যেন একটু উত্তেজিত? সুব্রত বলে।
আপনার কথাই ঠিক সুব্রতবাবু। মৃণাল জবাবে বলে, মৃত ব্যক্তির ব্রেনের মধ্যে রিভলভারের গুলি পাওয়া গিয়েছে একটা।
তাহলে তো আপনার অনুমানই ঠিক হল। অ্যাক্সিডেন্ট বা সুইসাইড নয়। ডেফিনিটলি এ কেস অফ মার্ডার-হোমিসাইড!
সুব্রত ধীরে ধীরে কথাগুলো বললে।
হ্যাঁ। কিন্তু—
চলুন কাল সকালেই একবার আগরপাড়ায় দেশবন্ধু কলোনীতে যাওয়া যাক।
দেশবন্ধু কলোনীতে!
হ্যাঁ–মিঃ গাঙ্গুলীর সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার, মিঃ রায় যখন তার চিঠি পেয়ে সেখানে গিয়েই নিহত হয়েছেন।
বেশ—তাহলে কাল সকালেই আমি আসব।
মৃণাল সে রাত্রের মত বিদায় নেয়।
পরের দিন বেলা প্রায় নটা নাগাদ সুব্রতসহ মৃণাল সেন আগরপাড়া থানায় গিয়ে জলধরবাবুকে সঙ্গে নিয়ে দেশবন্ধু কলোনীর দিকে রওনা হল। অবশ্য সুব্রতর গাড়িতেই।
নতুন কলোনী। সবে গড়ার মুখে। এখানে-ওখানে বিক্ষিপ্ত ভাবে খান পনেরো-ষোল বাড়ি উঠেছে। কাঁচা রাস্তা।
কলোনীর একেবারে শেষপ্রান্তে খোলা মাঠের একধারে ছোট একতলা একটা সাদারঙের বাড়ি, সলিটারি কর্নার। সামনে ছোট একটা বাগান। লোহার গেট। গেটের একপাশে লেখা সলিটারি কর্নার, অন্য পাশে এস গাঙ্গুলী লেখা নেম প্লেট।
লোকটি সাহেবী-ভাবাপন্ন বোঝা যায়।
গেটের পরেই লাল সুরকীর রাস্তা। আর দুপাশে মেহেদীর কেয়ারী। শীতের রৌদ্রে ঘন সবুজ দেখায়।
গেটের বাইরেই গাড়ি রেখে সুব্রত, মৃণান ও জলধর চাটুজ্যে ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করলেন।
সামনেই একটা বারান্দা। কয়েকটি বেতের চেয়ার ও টেবিল পাতা। পর পর ঘরগুলো দেখা যায়। তিনটে দরজা। দুটো বন্ধ, অন্যটায় একটা ঘন নীল রঙের পর্দা ঝুলছে।
ওরা ডাকবে কি ডাকবে না ইতস্তত করছে এমন সময় মধ্যবয়সী একটা ভৃত্য বের হয়ে এল পর্দা তুলে ঘর থেকে।
পরনে তার পরিষ্কার ধুতি ও ফতুয়া।
কাকে চান?
মিঃ গাঙ্গুলী বাড়িতে আছেন?
হ্যাঁ। সাহেব বাড়িতেই আছেন।
জলধর চাটুজ্যেই কথা বললেন, সাহেবকে খবর দাও, বলগে কয়েকজন ভদ্রলোক এসেছেন, দেখা করত চান।
সাহেব তো এসময় কারও সঙ্গে দেখা করেন না।
বল গিয়ে থানা থেকে দারোগাবাবু এসেছেন।
ভৃত্য এবার আর কোন প্রতিবাদ করল না। ওদের বাইরের ঘরে বসিয়ে ভিতরে খবর দিতে গেল।
ছোট ড্রইংরুম কিন্তু পরিপাটি ভাবে সাজানো। গৃহস্বামীর রুচির পরিচয় দেয়।
একটু পরেই একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। পরনের পায়জামা ও ড্রেসিং গাউন। পায়ে চপ্পল। বয়েস ষাটের কাছাকাছি হবে। মাথায় ঘন কোঁকড়ানো চুল কিন্তু বেশির ভাগই পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। মুখখানা রুক্ষ। চোয়ালের হাড় দুটো ব-এর আকারে দুপাশে ঠেলে উঠেছে। চোখ দুটো ছোট ছোট কিন্তু দৃষ্টি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত। লম্বা বলিষ্ঠ দেহের গড়ন। বুকের ও হাতের পেশীগুলো সজাগ। দৈহিক শক্তিরই পরিচয় দেয়।
আপনারা! ভদ্রলোকই প্রশ্ন করলেন।
কথা বললেন জলধর চাটুজ্যে, আপনিই বোধ হয় মিঃ গাঙ্গুলী?
হ্যাঁ। কিন্তু আপনারা–
আমি এখানকার থানার ও. সি. আর ইনি লালবাজার থেকে আসছেন, ইন্সপেক্টার মৃণাল সেন। জলধর চাটুজ্যে বললেন।
মিঃ গাঙ্গুলীর চোখের দৃষ্টি কুঞ্চিত হল যেন।
আমার কাছে কি কোন দরকার ছিল?
হ্যাঁ। নচেৎ আসব কেন বলুন! মৃদু হেসে জলধর চাটুজ্যে বলেন কথাটা।
কি দরকার বলুন তো।
বসুন!
মিঃ গাঙ্গুলী বসলেন একটা সোফায়।
বলুন।
মিঃ গাঙ্গুলী, কলকাতার রায় অ্যান্ড কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেক্টার মিঃ এম. এন রায়কে আপনি তো চেনেন? কথাটা বলে মৃণাল সেনই।
হ্যাঁ—সে আমার বিশেষ বন্ধু। কিন্তু কি ব্যাপার?
আপনার এখানে গত শনিবার তার আসার কথা ছিল, মানে আপনি তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কথা বলে এবারে সুব্রত।
আমি ডেকে পাঠিয়েছিলাম মহেন্দ্রকে?
হ্যাঁ—চিঠি দিয়ে!
হোয়াট ননসেন্স—আমি আবার তাকে কবে চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠালাম।
সে কি? আপনি ডেকে পাঠাননি চিঠি দিয়ে? সুব্রত কথাটা পুনরাবৃত্তি করে।
মোটেই না।
সুব্রত এবার চিঠিটা বের করে দেয়।-দেখুন তো এই চিঠিটা।
চিঠিটা গাঙ্গুলী হাতে করে নিয়ে দেখলেন। পড়লেন, তারপর বললেন, ফানি! এ চিঠি আপনারা কোথায় পেলেন?
এ চিঠি আপনার লেখা তো?
কস্মিনকালেও নয়।
আপনার নয়?
নিশ্চয়ই নয়। প্রথমত আমার বাড়িতে কোন টাইপরাইটিং মেসিন নেই। দ্বিতীয়ত টাইপ করতেই আমি জানি না আর এ যদিও হুবহু প্রায় নকল করার চেষ্টা হয়েছে তবু এটা আমার সই নয়। কিন্তু এ চিঠি কোথা থেকে আপনারা পেলেন?
বলছি—
আচ্ছা মিঃ রায়ের সঙ্গে আপনার শেষ দেখা কবে হয়েছিল?
গত মাসে। মাসের প্রথম দিকে কলকাতায় গিয়েছিলাম একটা কাজে। সেখানে অফিসে গিয়ে দেখা করি।
তারপর আর দেখা হয়নি?
না।
তার কোন খবর জানেন না?
না। কিন্তু কি ব্যাপার? এনিথিং রং!
গতকালের সংবাদপত্র পড়েন নি?
সংবাদপত্র আমি পড়ি না। কিন্তু ব্যাপার কি?
গত শনিবার আপনার বন্ধু মিঃ রায় এখানে এই আগরপাড়ায় কোন অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন!
হোয়াট? কি—কি বললেন? গাঙ্গুলী যেন অস্ফুট কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠেন, মহেন্দ্র খুন হয়েছে? সে নেই? না, না-এ আপনি কি বলছেন!
দুঃখের সঙ্গেই বলছি কথাটা মিথ্যা নয় মিঃ গাঙ্গুলী।
আমার-আমার যেন কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ইন্সপেক্টার। মহেন্দ্র হ্যাজ বিন কিল্ড। আর আমারই বাড়ি থেকে কিছু দূরে তার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে।
আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী! সুব্রত এবার কথা বলে।
কিন্তু মিঃ গাঙ্গুলী কোন সাড়া দিলেন না। আপন মনেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, নলিনী আগেই গেছে। মহেন্দ্রও চলে গেল। বাকি রইলাম আমি। বুঝতে পারছি আমার যাবার সময় হয়েছে। আমার দিনও হয়ত ফুরিয়ে এসেছে।
.
০৭.
মিঃ গাঙ্গুলী। আবার ডাকে সুব্রত।
জানেন ইন্সপেক্টার, দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব আমাদের-নলিনী গেল ক্যানসারে আর মহেন্দ্র গেল পিস্তলের গুলিতে।
আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী, ঐ চিঠিটার মধ্যে যে একটা চিঠির কথা আছে—
হ্যাঁ—ঐ এক বিচিত্র ব্যাপার!
কি রকম?
চিঠিটা আমি ব্যাঙ্ক থেকে দিনসাতেক হল এনেছি। চিঠি ঠিক বলব না। একটা ত্রিকোণাকার কাগজের টুকরোর মধ্যে পর পর কতগুলো অঙ্ক বসানো।
অঙ্ক!
হ্যাঁ।
দেখতে পারি চিঠিটা?
হ্যাঁ, বসুন, আনছি।
মিঃ গাঙ্গুল ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে হাতে একটা সিলমোহর ভাঙা লম্বা লেফাফা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন।
এই দেখুন এর মধ্যেই আছে সে কাগজ।
সুব্রত হাত বাড়িয়ে লেফাফাটা নিল–-উপরে ইংরাজীতে লেখা—মণীন্দ্র গাঙ্গুলী। কোণে লাল কালিতে লেখা পারসোন্যাল।
সুব্রত খাম থেকে কাগজটা বের করল।
মিথ্যে নয়, সত্যিই ত্রিকোণাকার একটা কাগজ এবং তার মধ্যে পর পর কতকগুলো অঙ্ক বসানো। আর নিচের কোণে ইংরাজীতে লেখা অ্যালফাবেট।
মিঃ গাঙ্গুলী বলেন, দেখলেন তো, আমি তো মশাই ওর মাথামুণ্ডু অর্থ কিছুই খুঁজে বের করতে পারিনি। অথচ মজা কি জানেন, নলিনের মত লোক মরার আগে যে আমাদের সঙ্গে একটা ঠাট্টা-তামাসা করে গিয়েছে তাও ভাবতে পারা যায় না।
আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী।
বলুন। মহেন্দ্রবাবুর চিঠিটা আপনি দেখেছেন?
হুঁ, দেখছি বৈকি। সেটাও ঠিক আপনিই একটা ত্রিকোণ কাগজে এমনি কতকগুলো অঙ্ক লেখা।
আপনার মনে আছে চিঠির অঙ্কগুলো?
না মনে নেই, তবে—
তবে?
আমি একটা কাগজে অঙ্কগুলো টুকে এনেছিলাম।
কেন?
কারণ ভেবেছিলাম—মানে তখনও তো আমার চিঠিটা আমি দেখিনি, যদি ঐ অঙ্কগুলোর কোন অর্থ বা সূত্র আমার চিঠি থেকে খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ সে লিখেছিল আমরা যৌথভাবে যেন তার অর্থের দায়িত্ব নিই।
সে কাগজটা আছে—
আছে। দেখবেন?
আনুন তো!
মিঃ গাঙ্গুলী ভিতরে গিয়ে একটা মোটা অমনিবাস ডিটেকটিভ গল্পের বই নিয়ে এলেন। তার মধ্যে কাগজটা ছিল।
কাগজের মধ্যে অমনি কতকগুলো অঙ্ক। এবং সেটাও যদিও ত্রিকোণাকার-হয়ত এমনি হবে।
সুব্রত পাশাপাশি দুটো কাগজ রেখে একবার দুবার তিনবার লেখাগুলো পড়ল, অঙ্কগুলোর কোন অর্থ যদি বের করা যায়। কিন্তু কোন হদিসই যেন পায় না সুব্রত।
পারবেন না মশাই, পারবেন না। মিঃ গাঙ্গুলী বলেন, আমিও অনেক ভেবেছিদু দিন দু রাত, কিন্তু কেন হদিসই করতে পারিনি।
আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী, আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন কি, আপনার বন্ধুর হাতে অনেক টাকা ছিল?
করি—কারণ নলিন ছিল যেমন সত্যবাদী তেমনি সিরিয়াস টাইপের মানুষ এবং মধ্যে মধ্যে তার অসামান্য চরিত্রের মধ্যে যে একটা সহজ কৌতুক প্রকাশ পেত।
কৌতুক!
এটা আর কৌতুক ছাড়া কি বলুন তো?
আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী!
বলুন।
আপনাদের এই চিঠির ব্যাপার আর কেউ জানে?
না। আমরা দুই বন্ধু ছাড়া আর কে জানবে!
আচ্ছা, ডাঃ চৌধুরীর আপনার বলতে তো তার একমাত্র ভাগ্নে ডাঃ নীরেন সান্যাল এবং তিনিই তো ডাঃ চৌধুরীর সব কিছু পেয়েছেন?
হ্যাঁ।
তাঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় নেই?
থাকবে না কেন? ভেরি নাইস বয়-যেমন ভদ্র তেমনি বিনয়ী।
তিনি আপনার বন্ধুর এই চিঠির কথা জানতেন না?
না।
আপনারাও বলেননি?
না, প্রয়োজন মনে করিনি।
কেন প্রয়োজন বোধ করেননি?
কারণ তাকে যদি নলিনীর জানাবার ইচ্ছাই থাকত তবে আমাদের দুই বন্ধুকে বা কেন এত সাবধানতার সঙ্গে ব্যাপারটা জানিয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আমাদের দুজনকে ছাড়া আর কেউ জানুক তার ইচ্ছা ছিল না।
আচ্ছা আপনি কি সত্যিই মনে করেন মিঃ গাঙ্গুলী, চিঠির এই অঙ্কগুলোর মধ্যে থেকে আপনার বন্ধু মিঃ রায়ও কোন কিছু বের করতে পারেননি?
না। আমি বা মহেন্দ্র কেউ ওর কোন মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি।
আচ্ছা একটা কথা মিঃ গাঙ্গুলী, সুব্রত আবার প্রশ্ন করে, আপনি ও মহেন্দ্রবাবু নিশ্চয়ই মিঃ চৌধুরীর ঐ চিঠির ব্যাপারে আলোচনা করেছেন?
তা করেছি।
তাহলে সে-সময়ও তো কেউ আপনাদের আলোচনা শুনে চিঠির ব্যাপারটা জানতে পারে!
সে আর এমন অসম্ভব কি?
আর একটা কথা মিঃ গাঙ্গুলী—
বলুন। আপনি তো মধ্যে মধ্যে বাড়ি থেকে বের হন?
বিশেষ না—তবে–
তবে?
মধ্যে মধ্যে কলোনীতে যে পান্থনিবাস রেস্টুরেন্টটা আছে—সেখানে গিয়ে বসি। পান্থনিবাসের প্রোপ্রাইটার ঋষি লোকটা চমৎকার কফি বানায়—সেই কফির লোভেই মধ্যে মধ্যে সেখানে যাই। তাছাড়া কোথাও বড় একটা আমি যাই না।
সাধারণত কখন রাত্রে শোন?
তা রাত দশটা।
সেদিন—মানে শনিবারও রাত দশটায়ই শুতে গিয়েছিলেন?
না, সেদিন একটু আগেই যাই-রাত সাড়ে নটায়। বেজায় ঠাণ্ডা পড়েছে কদিন। সেদিন আবার ঠাণ্ডাটা একটু বেশিই পড়েছিল।
তাই। আচ্ছা, সেদিন পান্থনিবাসে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
কতক্ষণ ছিলেন?
সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত। দোকানে লোকজন ছিল না তেমন। আমি আর ঋষি বসে বসে গল্প করছিলাম।
ঋষির সঙ্গে আপনার তাহলে বেশ আলাপ আছে?
তা আছে। আঠারো বছর বয়সের সময় লোকটা জাহাজের খালাসী হয়ে বিলেত যায়। সেখানে বছর চল্লিশ ছিল। তারপর বিশ্রী একটা খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়ে ও আর ওর বর্মিনী স্ত্রী
বর্মিনী স্ত্রী নাকি লোকটার?
হ্যাঁ, মালার বাবাও বিলেতে মশলার একটা দোকান করেছিল। সেখানে চাল ডাল সব কিছু পাওয়া যেত। ঋষি ঐ দোকানে চাল ডাল কিনতে যেত, দুজনায় আলাপ হয়–তারপর বিয়ে হয়।
তারপর ঋষির কথা বলুন, কি খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়েছিল বলছিলেন?
হ্যাঁ—অ্যারেস্ট হবার আগেই সে ও তার বর্মিনী স্ত্রী কৌশলে বিলেত থেকে পালায়–তারপর হংকং হয়ে যুদ্ধের ঠিক শুরুতে ইন্ডিয়াতে এসে পৌঁছায়। তারপর এখানে এসে ঘুরতে ঘুরতে আগরপাড়ার এই কলোনীতে একটা জায়গা কিনে ছোট একটা বাড়ি করেছে। সেই বাড়িরই বাইরের অংশে একটা রেস্তোরাঁ খুলেছে। রেস্তোরাঁর প্রধান আকর্ষণই ঐ কফি :
হুঁ , তাহলে আপনি সেদিন ছটার পর ফিরে আসেন—সোজা বাড়িতেই তো আসেন?
, একটু এদিক ওদিক ঘুরেছি। ঠাণ্ডা চিরদিনই আমার ভাল লাগে।
কখন তাহলে ফিরলেন বাড়িতে?
রাত সোয়া আটটা প্রায়।
আচ্ছা আজ তাহলে আমরা উঠব মিঃ গাঙ্গুলী, হয়ত আবারও আপনাকে বিরক্ত করতে আসতে পারি। মৃণাল সেন বলল।
না, না—বিরক্ত কি, আসবেন—নিশ্চয়ই আসবেন, ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম।
.
০৮.
সবাই উঠে পড়েছিল, হঠাৎ সুব্রত বলে, মিঃ গাঙ্গুলী, আপনার এই চিঠিটা আর ঐ কপিটা আমি নিতে পারি? এ দুটো কপি করে দু-এক দিনের মধ্যেই আপনাকে পাঠিয়ে দেব।
বেশ তো-নিয়ে যান!
আচ্ছা তাহলে চলি–নমস্কার।
নমস্কার। সকলে সলিটারি কর্নার থেকে বের হয়ে এল।
গেট দিয়ে বের হয়ে সকলে এসে গাড়িতে উঠে বসল।
গাড়ি চলতে শুরু করে। সুব্রত গাড়ি চালাচ্ছিল-স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে সামনের দিকে চেয়েছিল সে যেন একটু অন্যমনস্ক। মৃণাল সেন পাশেই বসেছিল।
জলধর বললেন, আমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবেন স্যার।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। সুব্রত মৃদুকণ্ঠে বলে।
থানায় জলধর চাটুজ্যেকে নামিয়ে দিয়ে ওরা বি. টি. রোড ধরে। বেলা তখন প্রায় সাড়ে বারোটা হবে।
এ সময়টা বি. টি. রোডে ট্রাফিকের একটু ভিড়ই থাকে। বিশেষ করে যুদ্ধের সময় মিলিটারি ট্রাকের ও জীপের চলাচলটা একটু বেশিই।
অনেকগুলো ইউনিট ও ক্যাম্প ব্যারাকপুরে-মিলিটারিদের যাতায়াতও তাই একটু বেশি বি. টি. রোডে।
ভদ্রলোককে কেমন মনে হল সুব্রতবাবু? মৃণাল সেন প্রশ্ন করে। তদন্তে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেল ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে।
কি?
ভদ্রলোক ঐ টাইপ করা চিঠিটা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। উনি কিছুই জনেন না ও সম্পর্কে।
কিন্তু আমার মনে হয় কথাটা উনি মিথ্যে বলেছেন।
মিঃ সেন, মিঃ গাঙ্গুলী মিথ্যে বলেননি। কারণ সত্যিই ওঁর মহেন্দ্র রায়কে আগরপাড়ায় ডেকে আনবার জন্য কোন চিঠি লেখবার প্রয়োজন ছিল না।
ছিল না বলতে চান!
হ্যাঁ। তা যদি থাকত তো উনি এত সহজে চিঠি দুটো আমাকে দিয়ে দিতেন না। তাছাড়া টাইপ করতে জানলেও এবং টাইপিং মেসিন থাকলেও বন্ধুকে একটা একান্ত। ব্যক্তিগত চিঠি টাইপ করে কেউ সাধারণত দেয় না। এক্ষেত্রে তাই মনে হচ্ছে, হত্যাকারী অত্যন্ত চালাক—সে জানত ঐ এক ঢিলেই হয়ত পাখি কাত হবে।
কি বলছেন?
ব্যাঙ্কের চিঠির ব্যাপার যখন ঐ চিঠির মধ্যে উল্লেখ করা ছিল তখন হত্যাকারী জানত সুনিশ্চিত ভাবেই যে মহেন্দ্রনাথ অমন একটা চিঠি পেয়ে রীতিমত ইন্টারেস্টেড হয়ে উঠবেন এবং যাবেনও বন্ধুর কাছে। তারপর সমস্ত ব্যাপারটা ভেবে দেখুন, কতখানি ভেবে কাজ করেছে হত্যাকারী। প্রথমত, শনিবারটা সে বেছে নিয়েছিল এবং সময়টা সন্ধ্যার দিকে। কারণ সে জানত শনিবারে ডেলি প্যাসেঞ্জারদের তিনটে সাড়ে তিনটের পর আর ভিড় থাকবে না। এই গেল এক নম্বর। দুই নম্বর, হত্যাকারী মহেন্দ্রনাথকে ভাল করেই চিনত এবং এও জানত তিনি সন্ধ্যার পর তার অন্ধপ্রায় ড্রাইভারকে নিয়ে বেরুবেন না—গেলে ট্রেনেই যাবেন। তারপর তৃতীয় নম্বর, মহেন্দ্রনাথ ট্রেনে গেলেও চারটার পর যাবেন। কারণ শনিবারেও তিনি বিকেল সাড়ে চারটা পাঁচটা পর্যন্ত অফিসের কাজ করতেন। অতএব যেতে যেতে যাঁর সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে।
শীতের ছোট বেলা, সাড়ে পাঁচটাতেই অন্ধকার হয়ে যায়। এবং শনিবার চারটের পর যে ট্রেনটা আগরপাড়া হয়ে যায় সেটা পৌনে আটটা নাগাদ আগরপাড়া পৌঁছায়। শনিবার ঐ সময়টা স্টেশনে তেমন ভিড়ও থাকে না। কাজেই–
কি?
কেউ যদি ঐ সময় স্টেশনে এসে মিঃ গাঙ্গুলীকে রিসিভ করে তবে তিনি সঙ্গে যাবেন এবং বড় একটা কারও সেটা নজরে পড়বে না। বুঝতে পারছেন বোধহয় মিঃ সেন, আমি কি বলতে চাইছি। হত্যাকারী মহেন্দ্রনাথকে স্টেশনে কাউকে দিয়ে রিসিভ করায়, তারপর তাকে বলে হয়ত, মিঃ গাঙ্গুলী পাঠিয়ে দিয়েছেন তাকে নিয়ে যেতে। ধরুন লোকটা যদি একটা সাইকেল-রিকশাওয়ালাই হয় মহেন্দ্র নিশ্চয়ই ঐ রিকশাওয়ালার সঙ্গে যাবেন, কারণ ইতিপূর্বে তিনি কখনও আগরপাড়ায় সলিটারি কর্নারে আসেননি, পথ চেনেন না। বরং খুশিই হবেন মিঃ গাঙ্গুলী লোক পাঠিয়েছেন দেখে, তারপর ব্যাপারটা ভেবে নিন—অন্ধকারে পথের মাঝখানে হত্যাকারী ওৎ পেতে ছিল-মহেন্দ্রনাথকে ক্লোজ রেঞ্জ থেকে গুলি করা এমন কিছু একটা শক্ত কাজ নয়।
কিন্তু—
ভাবছেন বোধ হয় গুলির শব্দটা, তাই না? কিন্তু তাও তো চাপা দেওয়া যেতে পারে। ধরুন যদি রিভলবারের সঙ্গে সাইলেন্সর লাগানো থাকে কিংবা রাস্তাটা নির্জন–হয়ত কারও কানে পৌঁছায়নি শব্দটা।
তা যেন হল কিন্তু মৃতের মুখটা অমন করে মিউটিলেট হল কি করে?
আমার অনুমান, সাধারণত শনিবার রাত্রে মিল থেকে যে সব ওয়াগান ভর্তি করে সেগুলো গুডস্ ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। তেমনি কোন ওয়াগনের ট্রাক্সন হুকের সঙ্গে হয়ত হত্যাকারী মৃতদেহটা আটকে দিয়েছিল বা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। ওয়াগন চলার সময় হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে ঐভাবে মুখটা ও পরিধেয় জামা-কাপড় ক্ষতবিক্ষত ও ছিন্নভিন্ন হয়েছে যাতে করে মৃতদেহ দেখলে, পুলিসের মনে হয় ব্যাপারটা স্রেফ একটা আত্মহত্যা-মার্ডার নয় আদৌ।
তাহলে আপনি বলতে চান, হত্যাকারী মহেন্দ্রনাথকে বেশ ভালভাবেই চিনত—তার হ্যাবিটস্ পর্যন্ত জানত?
নিশ্চয়ই। এখন নিশ্চয়ই হত্যাকারীর একটা রূপ আপনি কল্পনা করতে পারছেন মিঃ সেন মনে মনে!
হ্যাঁ, কিছুটা আমার মনে হচ্ছে—
কি? মিঃ গাঙ্গুলীকেও এক্ষেত্রে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে না।
কেন?
মহেন্দ্রনাথের কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছিলেন। ধরুন সেই টাকা যাতে করে শোধ আর না দিতে হয় তাই–
না, যে বন্ধুকে অমন করে টাকা দিতে পারে তার ধারের ব্যাপারে চিন্তার কোন কারণ থাকতে পারে না। ভাল কথা, মহেন্দ্রনাথের বালিগঞ্জের বাড়িতে একবারও কি গিয়েছেন?
না।
সেখানে কিন্তু একবার আপনার যাওয়া উচিত ছিল।
যাব ভাবছি কাল।
হ্যাঁ চলুন, দুজনাই একসঙ্গে যাব—তার দুই পুত্র ও কন্যা সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার।
পরের দিন সকালের দিকে সুব্রত ও মৃণাল সেন বালিগঞ্জে মহেন্দ্রনাথের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হল। মৃণাল সেন ইতিপূর্বে ঐ বাড়িতে আসেনি বটে তবে সুব্রত চিনত।
ধনী ব্যক্তি মহেন্দ্রনাথ।
বালিগঞ্জে লেকের কাছে গড়িয়াহাট অঞ্চল সেই যুদ্ধের সময়ে তেমন ডেভালাপড হয়নি।
অনেক নারকেল বাগান, জঙ্গল ও ধানজমি।
তারই মধ্যে এদিকে-ওদিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে লেককে কেন্দ্র করে কিছু কিছু পয়সাওয়ালা লোক বেশ কিছুটা করে জায়গা নিয়ে বড় বড় বাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করেছেন।
মহেন্দ্রনাথ তাঁদেরই অন্যতম।
বুদ্ধিমান চতুর ব্যবসায়ী তিনি। জানতেন ও বুঝতে পেরেছিলেন ক্রমশ ঐ অঞ্চলটা সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে—লেকের জৌলুসে বিশেষ একটি এলাকায় পরিণত হবে।
সুব্রতরা যখন মহেন্দ্রনাথের বালিগঞ্জের ভবনে এসে পৌঁছাল তখন বেলা আটটা হবে। দরোয়ান মৃণাল সেনের পুলিসের পোশাক দেখে তাকে আটকাল না। গেট খুলে দিল।
গেট দিয়ে ঢুকে সোজা ওরা এসে পোর্টিকোর সামনে গাড়ি থামাল। বাড়িটা অনেকখানি জায়গা নিয়ে। সামনে বেশ খানিকটা বাগান, তাছাড়া টেনিস লনও আছে।
বাড়িটা যেন অত্যন্ত নিস্তব্ধ। কোথাও কোন যেন সাড়াশব্দ নেই।
সুব্রত কলিংবেলটা টিপল।
একটু পরেই উর্দিপরা একজন বেয়ারা বের হয়ে এল।
কাকে চান?
সুরেনবাবু বাড়িতে আছেন? সুব্রতই প্রশ্ন করে।
আছেন।
একবার ডেকে দাও তো।
ভিতরে এসে বসুন।
মনে হল যেন মৃণাল সেনের, পুলিসের ইউনিফর্ম দেখে বেয়ারা একটু অবাকই হয়েছে। সে তাদের এনে ড্রইংরুমে বসাল।
ড্রইংরুমটি সুন্দরভাবে সাজানো।
দামী সোফা-পুরু কার্পেট মেঝেতে। দেওয়ালে দু-চারটি দামী ল্যান্ডস্কেপ।
সুব্রত ও মৃণালকে বেশিক্ষণ বসে থাকতে হল না।
একটু পরেই সুশ্রী, বেশ বলিষ্ঠগড়ন এক যুবক ঘরে এসে ঢুকল।
সুব্রতকেই লক্ষ্য করে যুবক বলে ওঠে, কতক্ষণ এসেছ?
এই আসছি। লেট মি ইনট্রোডিউস, ইনি মৃণাল সেন ইন্সপেক্টার, তোমার দাদার ব্যাপারটা ইনিই তদন্ত করছেন। মিঃ সেন—এই সুরেন, মহেন্দ্রনাথের ছোটভাই, আর্টিস্ট।
মৃণাল সেন দেখছিল। আদৌ আর্টিস্টের মত চেহারা নয় সুরেন্দ্রনাথের। বরং পালোয়ান বা অ্যাথলেটের মত চেহারাটা।
পরনে পায়জামা ও গরম পাঞ্জাবি। পায়ে চপ্পল।
মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা।
কঠিন চোয়াল, খাড়া নাক। হাতের কজি বেশ মোটা—আঙুলগুলো মোটা মোটা।
সুরেন, মিঃ সেন তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান। সুব্রত বলে।
বেশ তো-বলুন না—উনি কি জানতে চান। সুরেন্দ্র মৃদুকণ্ঠে বললে।
আপনি তো এই বাড়িতেই থাকেন?
মৃণাল সেনের প্রশ্নে তার মুখের দিকে তাকিয়ে সুরেন্দ্র মৃদুকণ্ঠে বলে, হ্যাঁ।
আচ্ছা মিঃ রায়, শনিবার দুর্ঘটনার দিন তার সঙ্গে শেষ কখন আপনার দেখা হয়েছিল?
বেলা তখন পৌনে পাঁচটা হবে-বেরুচ্ছিলেন তিনি। পোর্টিকোতে আমার সঙ্গে দেখা।
তাহলে সেদিন তিনি অফিস থেকে বাড়িতে এসে তারপর আগরপাড়া গিয়েছিলেন?
সেই রকমই মনে হয়।
আপনার সঙ্গে আপনার দাদার সে-সময় কোন কথা হয়েছিল?
না।
আচ্ছা মিঃ রায়, সেদিন যাবার সময় আপনার দাদার পরনে কী জামা-কাপড় ছিল মনে আছে নিশ্চয়?
আছে। গরম সুট পরনে ছিল। আর হাতে ছিল গ্রেট কোটটা।
কি রঙের?
কালো রঙের।
হাতে আর কিছু ছিল না?
হ্যাঁ, আর ফোলিও ব্যাগটা ছিল।
পায়ে কি জুতো ছিল?
কালো ডার্বি সু।
আচ্ছা সুরেন–
সুব্রতর ডাকে সুরেন্দ্র এবারে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।
তোমাকে সেদিন একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তোমার দাদার উইলের ব্যাপারটা কিছু জান–মানে উইলে কি ভাবে তিনি তার সম্পত্তি ভাগ করে গেছেন।
না।
ঐ একটি মাত্র শব্দের মধ্যে দিয়ে যেন সুব্রতর মনে হল বেশ একটা বিরক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল।
তুমি জান না কিছু?
না। হি ওয়াজ এ পিকিউলিয়ার সর্ট অফ ম্যান-বিচিত্র স্বভাবের এক লোক ছিলেন। আমাদের কারও পরে—এমন কি নিজের সন্তানদের পরেও তার কোন মায়ামমতা ছিল না। সেক্ষেত্রে যদি শুনি তিনি তার সব কিছু থেকে আমাদের সকলকেই বঞ্চিত করে গিয়েছেন-ওয়েল-ইট ওন্ট বী এ সারপ্রাইজ অ্যাট অল টু এনি অফ আস-আমরা কেউ এতটুকুও বিস্মিত হব না। আর হয়ত তাই কিছু করেছেন।
একথা তো তুমি আমায় বলনি সুরেন। তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদেরও কি তেমন স্নেহের চোখে দেখতেন না?
তাই যদি হত তাহলে কি ছেলেমেয়েরা স্ত্রীর মৃত্যুর পর মামার বাড়িতে চলে যেত এবং কুন্তলা সেখানেই কি মানুষ হত। আসলে মানুষটা ছিল অত্যন্ত সেলফিশ-স্বার্থপর।
তার স্ত্রী কতদিন হল মারা গেছেন?
বৌদি?
হ্যাঁ।
কুন্তলার যখন আট বছর বয়স সেই সময়ে মারা যান বৌদি দীর্ঘদিন পরে আবার সন্তান হতে গিয়ে। সৌরীন-দাদার বড় ছেলের বয়স তখন ষোল ও ছোট ছেলে ভবেনের বয়স ছিল বোধ করি বারো-তেরো।
এমন তো হতে পারে সুরেন, তোমার দাদা তোমাদের বৌদিকে অত্যন্ত ভালবাসতেন, তাই তার মৃত্যুতে সংসার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে?
কে জানে? হয়ত ভালবাসতেন!
হুঁ। তোমার ভাইঝি বাড়িতে আছেন?
কে, কুন্তলা?
হ্যাঁ।
আছে। মিঃ সেন তার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চান।
বেশ তো–তোমরা বোস—আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি তাকে।
সুরেন্দ্র উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মৃণাল সেন সুরেন্দ্রর গমনপথের দিকে চেয়ে থাকে।
.
০৯.
কুন্তলা এল।
প্রায় নিঃশব্দেই এসে যেন কুন্তলা ঘরে প্রবেশ করল।
বাইশ-তেইশ বছর বয়স হবে। রোগা ছিপছিপে গড়ন। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম যাকে বলে। মুখখানি কিন্তু ভারি সুন্দর—বিশেষ করে ছোট কপাল-টানা জ্ব-নাক ও চিবুক। সব কিছুর মধ্যে এমন চমৎকার একটা সামঞ্জস্য আছে যাতে করে সমগ্র
মুখখানিকে অপূর্ব একটি লাবণ্য দিয়েছে।
মাথায় বেশ দীর্ঘ কেশ। তৈলহীন রুক্ষ। পরনে সাধারণ একখানা কালোপাড় শাড়ি। গায়ে সাদা ব্লাউজ। হাতে একগাছি করে সোনার বালা। পায়ে চপ্পল।
সুব্রতই আহ্বান জানায়। বলে বসুন মিস রায়। কু
ন্তলা একটা সোফায় বসল ওদের মুখোমুখি।
সুব্রতই কথা বলে, আপনার এই বিপদের সময় আপনাকে এভাবে বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে আমরা দুঃখিত ও লজ্জিত। কিন্তু বুঝতেই পারছেন—উপায় নেই বলেই
কুন্তলা কোন কথা বলে না। চুপ করে থাকে।
কয়েকটা কথা আমাদের জানবার ছিল মিস্ রায়!
কুন্তলা সুব্রতর দিকে মুখ তুলে তাকাল।
গত শনিবার কোন সময় আপনার বাবা অফিস থেকে ফিরে আসেন?
বোধ হয় সাড়ে চারটে হবে।
কখন আবার বের হয়ে যান?
পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি ছিলেন না। এসেই বের হয়ে যান—চা ও খাননি।
কোথায় যাচ্ছেন কি বৃত্তান্ত এসব সম্পর্কে আপনার সঙ্গে আপনার বাবার কোন কথাবার্তা হয়েছিল?
হ্যাঁ, বলেছিলেন আগরপাড়ায় মণীন্দ্র কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। পরের দিন সকালে ফিরবেন এবং দেরি হলে সোজা অফিসেই চলে যাবেন।
কেন যাচ্ছেন আগরপাড়া সে-সম্পর্কে কিছু বলেননি?
না।
আচ্ছা কুন্তলা দেবী, শুনেছি আপনাদের মা মারা যাবার পর আপনি আপনার মামাদের ওখানে চলে যান।
হ্যাঁ-আমি, দাদা, ছোড়দা—তিনজনেই গিয়ে থাকি।
তাহলে আপনারা দীর্ঘদিন মামার বাড়িতেই কাটিয়েছেন।
হ্যাঁ। বছর দুই হল বি. এ. পাস করবার পর মামীমা মারা গেলেন। তখন বাবা বললেন এখানে চলে আসতে-মামীমার শ্রাদ্ধ চুকে গেলে বাবা গিয়ে সঙ্গে করেই আমাকে নিয়ে আসেন, সেই থেকে বাবার কাছেই আছি।
আর আপনার দাদারা?
দাদা ইন্টারমিডিয়েট পাস করবার পর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। তখন থেকে সে হস্টেলেই ছিল আর ছোটদাও ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত মামার বাড়িতে ছিল। তারপর এই বাড়িতে চলে আসে।
আপনারা যখন মামার বাড়িতে ছিলেন, মিঃ রায় আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন না বা আপনারা এখানে মধ্যে মধ্যে আসতেন না?
বাবাই মধ্যে মধ্যে যেতেন। আমরা কখনও আসিনি। তবে এখানে চলে আসবার বছরখানেক আগে থাকতে বাবা মধ্যে মধ্যে আমাকে গাড়ি পাঠিয়ে এখানে নিয়ে আসতেন। পাঁচ-সাতদিন এখানে আমি থেকে আবার ফিরে যেতাম।
আপনাদের বাবা আপনাদের মধ্যে সবচাইতে কাকে বেশি ভালোবাসতেন বলে মনে হয় আপনার?
বাবা তার সন্তানদের কাউকেই কম ভালবাসতেন না। তবে অত্যন্ত চাপা ও গম্ভীর। প্রকৃতির মানুষ বলে কিছু প্রকাশ পেত না।
হুঁ। আচ্ছা আপনার বাবার বন্ধু ডাঃ নলিনী চৌধুরীকে আপনি চিনতেন?
হ্যাঁ, নলিনী কাকা তো প্রায়ই মামার বাড়িতে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন।
আপনাদের ঐ নলিনী কাকা আপনার বাবা ও মণীন্দ্র কাকার নামে মৃত্যুর পূর্বে ব্যাঙ্কে দুখানা চিঠি রেখে গিয়েছিলেন, আপনি সে-চিঠি সম্পর্কে জানেন কিছু?
শুনেছিলাম—তবে সে চিঠি কিসের—কি তাতে লেখা ছিল জানি না।
চিঠির কথাটা শুনেছিলেন কার কাছে?
বাবার কাছেও শুনেছি, আর—
আর কার কাছে শুনেছেন?
নীরেনের কাছেও শুনেছি।
নীরেন!
ডাঃ নীরেন সান্যাল দাদার বন্ধু। নলিনী কাকার ভাগ্নে।
সুব্রত লক্ষ্য করল নীরেনের কথা বলবার সময় কুন্তলার মুখটা যেন একটু রাঙা হয়ে উঠল। সে চোখ নামাল।
সুব্রত এবার প্রশ্ন করে, ডাঃ নীরেন সান্যালের সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?
দাদার সঙ্গে প্রায়ই মামার বাড়িতে আসত-সেখানেই অনেকদিনের পরিচয়।
আচ্ছা মিস রায়, যাবার সময় আপনার বাবার হাতে কিছু ছিল, আপনার মনে আছে?
হ্যাঁ, তার ফোলিওটা ছিল।
কেমন দেখতে সেটা?
কালো রঙের মরক্কো লেদারের তৈরি। উপরে বাবার নাম মনোগ্রাম করা সোনার জলে।
ভাল কথা, আপনার যে দাদা আর্মিতে কাজ করেন, এখন কোথায় আছেন জানেন?
শুনেছি ইস্টার্ন ফ্রন্টে। তবে কোথায় জানি না।
শেষ কবে ছুটিতে আসেন?
মাস আষ্টেক আগে।
আপনার ছোড়দা?
একটু যেন ইতস্তত করল কুন্তলা, তার পর মৃদুকণ্ঠে বললে, ছোড়দা এখন বেরিলিতে পোস্টেড্।
আর একটা কথা—আপনার বাবার উইল সম্পর্কে কিছু জানেন আপনি?
না। মাত্র গতকালই আমাদের সলিসিটার এসেছিলেন। তার কাছে শুনলাম বাবার উইল আছে। আগামী কাল সেই উইল পড়ে শোনাবেন তিনি বলে গেছে।
আচ্ছা আজ আর আপনাকে বিরক্ত করব না। আপনি যেতে পারেন।
কুন্তলা উঠে দাঁড়াল। নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সেদিনের মত ওরা বিদায় নিল মহেন্দ্র রায়ের বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে।
.
দিন দুই পরে।
মিঃ মুখার্জী-রায় অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজারের বাড়ির বাইরের ঘরে বসে কথা হচ্ছিল।
সুব্রত, মৃণাল সেন ও মিঃ মুখার্জী কথা বলছিল।
গতকাল সন্ধ্যায় উইল পড়া হয়ে গিয়েছে।
মহেন্দ্র রায় তার ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিটের চার লক্ষ টাকার মধ্যে এক লক্ষ টাকা তার মেয়ে কুন্তলাকে—নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা ভাই সুরেন্দ্রকে ও বালিগঞ্জের বাড়িতে যতদিন তারা বেঁচে থাকবে তাদের থাকবার অধিকার দিয়ে গিয়েছেন।
বাকি দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা নানা প্রতিষ্ঠানে দান করে গিয়েছেন। এবং কুন্তলা ও সুরেন্দ্রর অবর্তমানে বাড়িটাও রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করে গিয়েছেন অবলা বিধবাদের একটা আশ্রম করবার জন্য।
আর কোম্পানির স্বত্বের অর্ধেক দিয়ে গিয়েছেন কুন্তলাকে, অর্ধেক মিঃ মুখার্জীকে।
দুই ছেলে কোম্পানি থেকে দেড় হাজার টাকা করে মাসোহারা পাবে মাত্র। তাদের আর কিছু দেননি।
কোম্পানির আয় বাৎসরিক চার লক্ষ টাকার মত।
মিঃ রায়ের সম্পত্তির পরিমাণ শুনে সুব্রত সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিল।
ঐ সঙ্গে আর একটা কথা জানা গিয়েছে। ঐ শেষোক্ত উইলটি মৃত্যুর মাত্র দুমাস আগে করেছিলেন নাকি মহেন্দ্র রায় আগের উইলের বদলে।
আগের উইলে-মেয়েকে অর্ধেক দিয়ে বাদবাকি নগদ টাকা দুই ছেলেকে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন।
বাড়িটার অবিশ্যি আগের উইলের মতই ব্যবস্থা ছিল—আর কোম্পানির অর্ধেক ছিল মিঃ মুখার্জীর ও বাদবাকি অর্ধেক তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করা ছিল।
সে সম্পর্কেই আলোচনা চলছিল মিঃ মুখার্জীর বসবার ঘরে।
আচ্ছা মিঃ মুখার্জী, আপনি যখন উইলের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন, আপনি হয়ত জানেন কেন হঠাৎ তিনি তাঁর উইলটা আবার বদলেছিলেন? সুব্রত প্রশ্ন করে।
ঠিক বলতে পারব না, তবে–
কি?
মনে হয়, হয়ত ছেলেদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি উইলটা বদলেছিলেন।
কেন, বাপ-ছেলেদের মধ্যে কি তেমন সম্প্রীতি ছিল না?
না। কোনদিনই তেমন প্রীতির সম্পর্ক ছিল না বাপ ও ছেলেদের মধ্যে।
কেন—কোন কারণ ছিল কি বাপ ও ছেলেদের মধ্যে সম্প্রীতি না থাকার?
আমার মনে হয় কারণ একটা হয়ত ছিল—
কি?
স্যারের একটা আনম্যারেড শালী ছিল—
ছিল কেন বলছেন?
গত বছর তিনি একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান।
অ্যাক্সিডেন্ট!
হ্যাঁ, বাড়ির বাথরুমের সুইচে ইলেকট্রিক কারেন্টের শক খেয়ে মারা যান। ঐ শালীর সঙ্গে স্যারের ঘনিষ্ঠতা ব্যাপারটা তার স্ত্রীর মৃত্যুর বছরখানেক আগে থাকতেই নাকি গড়ে উঠেছিল। এবং মৃত্যুর পর বেশি হয়।
মিঃ রায়ের ঐ শ্যালিকা কি তার বালিগঞ্জের বাড়িতেই থাকতেন?
না—তিনি থাকতেন শ্যামবাজারে একটা বাড়ি নিয়ে। শ্যামবাজারের একটা স্কুলের তিনি হেডমিস্ট্রেস ছিলেন।
হুঁ। আচ্ছা মিঃ মুখার্জী, মিঃ রায়ের ছেলেদের রিসেন্ট কোন খবর জানেন?
বড় সৌরীন্দ্রর কোন সংবাদ জানি না, তবে ছোট ছেলে ভবেন্দ্ৰ ঐ দুর্ঘটনার দিনসাতেক আগে এক দ্বিপ্রহরে তার বাবার সঙ্গে অফিসে দেখা করতে এসেছিল।
অফিসে?
হ্যাঁ। আমার আর মিঃ রায়ের অফিস কামরা পাশাপাশি। আমি হঠাৎ একটা চেঁচামেচি শুনে ব্যাপারটা কি জানবার জন্য স্যারের অফিসঘরের দিকে যাই। সেই সময় দড়াম করে দরজা খুলে ভবেন্দ্র মিঃ রায়কে শাসাতে শাসাতে রাগতভাবে বের হয়ে গেল দেখলাম।
শাসাতে শাসাতে বের হয়ে গেলেন!
হ্যাঁ, ভবেন্দ্ৰ বলছিল, ওল্ড ভালচার-বুড়ো শকুনি, তোমাকে আমিও দেখে নোব।
তারপর?
আমি স্যারের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। দেখি তিনিও অত্যন্ত উত্তেজিত-বলছেন, রাস্কেল! তারপর আমাকে দেখে বললেন, আর কখনও যেন ও আমার অফিসে না ঢুকতে পারে! দারোয়ানদের স্ট্রিট অর্ডার দিয়ে দেবে মুখার্জী।
অতঃপর সুব্রত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি মিঃ রায়ের অফিসে কতদিন কাজ করছেন—মানে বর্তমান পোস্টে?
প্রায় বছর দশেক হবে।
তার আগে?
তার আগেও তার কোলিয়ারিগুলো দেখাশোনা করতাম আমি।
.
১০.
কিছু মনে করবেন না মিঃ মুখার্জী—উইলে আপনাকে মিঃ রায় অনেক কিছু দিয়েছেন
শুনলাম! সুব্রত বলে।
মিঃ মুখার্জী বললেন, মিঃ রায় মানে মহেন্দ্র রায়ের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আছে।
সম্পর্ক!
হ্যাঁ। আমরা মামাতো-পিসতুতো ভাই। আমার মা অর্থাৎ ওঁর পিসিমার কাছেই মিঃ রায় মানুষ হয়েছিলেন। কারণ ওঁর বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর সেই সময় আমার মামীমা–মহেন্দ্র রায়ের মা মারা যান। উনি তাই বলতেন পিসিমার ঋণ নাকি উনি জীবনে শোধ করতে পারবেন না।
আপনি যে মিঃ রায়ের আত্মীয় কথাটা কিন্তু সেদিন বলেননি। সুব্রত মৃদুকণ্ঠে বলে।
না, বলিনি। দেখুন সুব্রতবাবু, বড়লোকের আত্মীয়তা ঘোষণা করবার মধ্যে গৌরব অনুভব করা একটা থাকতে পারে, কিন্তু মর্যাদা নেই হয়ত।
সুব্রত মিঃ মুখার্জীর কথা শুনে একবার তার মুখের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু সে বলবার আগেই মিঃ মুখার্জী পুনরায় বললেন, আমাদের পরস্পরের মধ্যে বর্তমানের অবস্থার এমন এক আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়ে গিয়েছিল যে, কেউ হয়ত অতীতের সে সম্পর্কের কথাটা কখনও মনে করতাম না পরবর্তীকালে।
সুব্রত ঐ সম্পর্কে আর কোন আলোচনা করল না–সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। বললে, মিঃ মুখার্জী, আপনি সেদিন বলেছিলেন মিঃ গাঙ্গুলী এদেশে ফিরে এসে তার বন্ধু মিঃ রায়ের কাছ থেকেই অর্থসাহায্য নিয়ে আগরপাড়ায় বাড়ি করেছিলেন।
হ্যাঁ!
টাকার পরিমাণটা হয়ত আপনি জানেন–
জানি। হাজার চল্লিশ হবে।
আচ্ছা কি শর্তে মিঃ রায় তার বন্ধুকে টাকাটা দিয়েছিলেন।
বিশেষ কোন শর্তই ছিল না।
মানে? যখন সুবিধা হবে টাকাটা দেবেন এই আর কি!
কিন্তু একজন যিনি জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে পৌঁচেছেন, যাঁর সর্বস্ব গেছে, তার পক্ষে আর এত টাকা শোধ করার সম্ভাবনা কোথায়?
মিঃ মুখার্জী চুপ করে থাকেন।
অবিশ্যি যদি আর কোন কারণ থেকে থাকে—
থাকলেও আমি জানি না। হুঁ। আচ্ছা কোন ডিড হয়নি লেনদেনের? হয়েছিল।
সে ডিডটা একবার দেখতে পারি?
কাল অফিসে আসবেন, দেখাব।
অফিসে আছে বুঝি?
না। মিঃ রায়ের বাড়িতেই আছে। কাল আনিয়ে রাখব সেখান থেকে।
সেদিনকার মত বিদায় নিল ওরা।
দুজনে এসে গাড়িতে উঠে বসল। সুব্রত নিঃশব্দে গাড়ি চালাচ্ছিল।
মৃণাল সেন প্রশ্ন করে, কোন দিকে যাচ্ছেন?
এন্টালিতে।
সেখানে?
একবার ডাঃ নীরেন গাঙ্গুলীর সঙ্গে দেখা করবেন না?
নীরেন গাঙ্গুলী!
হ্যাঁ-ডাঃ নলিনী চৌধুরীর ভাগ্নে। আর আর—
নীরেন গাঙ্গুলীর কথা বলতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন না, কুন্তলা দেবীর মুখের রঙের আভাস!
আপনি তাও নজর করে দেখেছেন? হাসতে হাসতে মৃণাল সেন বলে।
তা দেখতে হয় বৈকি। কিন্তু তার আগে একবার বরাহনগরে যাব মেজর সাহেবের ওখানে।
মেজর সাহেব!
হ্যাঁ, মেজর রণদা সিনহা। এদেশে ফায়ার আর্মসে অতবড় এক্সপার্ট খুব কম পাবেন মিঃ সেন।
অতঃপর সুব্রত মেজর সাহেবের পরিচয় দিল। মেজর রণদা সিনহা গত মহাযুদ্ধে সামান্য সৈনিকের চাকরি নিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে উন্নতি করে মেজর পদে উন্নীত হন।
বছর সাতেক হল চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন।
রিটায়ার করার পর বরাহনগরে অনেকখানি জায়গাসমেত একটা বাগানবাড়ি কিনে বসবাস করছেন। কোন ঝামেলা নেই সংসারে। স্বামী আর স্ত্রী।
একমাত্র ছেলে, সেও আর্মির চাকরিতে বিদেশে।
একবার একটা কেসে আর্মস-সংক্রান্ত ব্যাপারে ওপিনিয়ানের জন্য কিরীটীর সঙ্গে রণদা সিনহার বরাহনগরের আদি নিবাসে গিয়েছিল। সেই সময়ই আলাপ হয় ওদের। ভারি আমুদে ও রসজ্ঞ লোকটি।
মধ্যে মধ্যে তারপরও সুব্রত ওদিকে গেলে মেজর সিনহার আদি নিবাসে গিয়েছে। আড্ডা দিয়ে এসেছে।
বেশ লম্বা-চওড়া এবং রসিক প্রকৃতির মানুষটি।
ওরা যখন আদি নিবাসে গিয়ে পৌঁছল, মেজর সিনহা তৃতীয়বার চা নিয়ে বসেছিলেন।
মাথায় একমাথা পাকা চুল। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।
পরনে পায়জামা ও স্লিপিং গাউন।-মুখে একটা মোটা সিগার।
সুব্রতকে দেখে কলস্বরে অভ্যর্থনা জানান সিনহা, আরে সুব্রতচন্দ্র যে-সু-স্বাগতম।
সুব্রত বসতে বসতে বলে, আড্ডা দিতে আজ নয় কিন্তু—
তবে?
একটা ওপিনিয়ন নিতে এসেছি।
কি ব্যাপার?
সুব্রত পকেট থেকে একটা কাগজে মোড়া বুলেট বের করল।
দেখুন তো মেজর সাহেব এই বুলেটটা!
বুলেটটা হাতে নিয়ে একবার মাত্র চোখ বুলিয়ে সিনহা বললেন, কোথায় পেলেন এটা? এটা তো দেখছি আর্মি রিভলভারের গুলি!
আর কিছু-অন্য বিশেষত্ব আছে বুলেটটার গায়ে?
বিশেষত্ব–দাঁড়ান দেখি। একবার লেন্সটা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হয় তাহলে!
বলতে বলতে মেজর উঠে গেলেন ভিতরে এবং কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে বললেন, হ্যাঁ, বুলেটার গায়ে খুব ফাইন খাজ কেটে গেছে। তাতে মনে হয়
কি?
যে রিভলভার থেকে এটা ফায়ার করা হয়েছিল তার গায়ে ভিতরের ঐ ধরনের কোন খাঁজ আছে, যে জন্য ফায়ারের পর বুলেটের গায়ে খাঁজ কেটে গেছে।
আর কিছু নেই তো?
না। কিন্তু এটা পেলেন কোথায়, ব্যাপারটাই বা কি?
একজন নিহত ভদ্রলোকের মাথার মধ্যে পাওয়া গিয়েছে বস্তুটি।
সত্যি?
হ্যাঁ, সেই ভদ্রলোককে সম্ভবত ঐ গুলিটির সাহায্যেই হত্যা করা হয়েছে।
রিয়েলি! কিন্তু যে ধরনের রিভলভারের সাহায্যে ঐ গুলিটা ছোঁড়া হয়েছিল সেই রিভলভার তো কোন আর্মির লোকের কাছে ছাড়া থাকা সম্ভবপর নয়, বিশেষ করে এই যুদ্ধের সময়!
সেই কারণেই তো আপনার ওপিনিয়নটা নিলাম মেজর। আচ্ছা আজ তাহলে উঠি–অবিশ্যি ব্যালেস্টিক একজামিনেশনের জন্যও পাঠানো হবে বুলেটটা।
উঠবেন?
হ্যাঁ।
বাঃ, তা কি করে হয়? এক কাপ চা অন্তত–
আজ নয় মেজর, অন্য একদিন। আজ একটু তাড়া আছে। সুব্রত বলল উঠতে উঠতে।
কিন্তু এটা ভাল হচ্ছে না রায়সাহেব!
কেন?
কেন কি, রহস্যের দরজার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে রেখে আপনি বিদায় নিচ্ছেন।
সুব্রত মৃদু হেসে বলে, শীঘ্রই আবার একদিন আসব। চলুন মিঃ সেন।
সুব্রত মৃণাল সেনকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
চলন্ত গাড়িতে বসে মৃণাল সেন প্রশ্ন করে, মহেন্দ্রনাথের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে তার ব্রেন ম্যাটারের মধ্যে যে বুলেটটা পাওয়া গিয়েছিল ওটা সেই বুলেটটাই তো?
সুব্রত সামনের দিকে চেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল, মৃদুকণ্ঠে বললে, হ্যাঁ।
সুব্রতবাবু, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে—
কি?
মিঃ গাঙ্গুলী সন্দেহের তালিকায় একেবারে শীর্ষস্থানে!
কেন?
আপনি যাই বলুন প্রথমত সিঙ্গাপুরে ছিলেন—যুদ্ধের সময় কোনমতে পালিয়ে এসেছেন। তার পক্ষে অবশ্যই একটা ৩৮ আর্মি রিভালভার সংগ্রহ করা এমন অসম্ভব কিছু নয়। শুধু তাই নয়, মোটিভ যদি ধরেন তো চল্লিশ হাজার টাকা যেটা তিনি তার বন্ধুর কাছ থেকে ধার করেছিলেন—এক্ষেত্রে ধারই বলব কারণ ডিডে যখন শোধ করবার একটা কথা আছে
তারপর? বলুন, থামলেন কেন?
ঐ ডাঃ চৌধুরীর চিঠিটা। ওটাকে আমি একেবারে কিছু না বলে উড়িয়ে দিতে যেন কিছুতেই পারছি না। আমার কেন যেন ধারণা
কি?
ঐ চিঠির মধ্যে কোন একটা রহস্য আছে, যে রহস্যটা হয়ত ভদ্রলোক আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন বা চিঠিটার কোন সমাধানের ইঙ্গিত খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই বন্ধুকে কৌশলে একটা টাইপ করা চিঠি দিয়ে ডেকে এনে সে-রাত্রে হত্যা করেছেন।
অসম্ভব কিছুই নয়, কিন্তু—
কি?
একটা কথা কিন্তু ভাববার আছে এর মধ্যে। মিঃ গাঙ্গুলী মানুষটা যে বোকা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না। সেক্ষেত্রে তিনি অমনভাবে একটা কাচা কাজ করবেন, ব্যাপারটা যেন ঠিক মেনে নিতে পারছি না।
কাচা কাজ কেন বলছেন সুব্রতবাবু?
নয়ত কি?
একটু পরিষ্কার করে বলুন সুব্রতবাবু, মৃণাল সেন বলে।
ধরুন তার হত্যা করবার ইচ্ছাই যদি থাকত বন্ধুকে কোন কারণে, ঐভাবে তাঁকে তিনি তার এলাকায় ডেকে আনতে যাবেন কেন একটা চিঠি দিয়ে? সেক্ষেত্রে তার উপরেই
যে প্রথম সন্দেহ আসবে সেটা কি তিনি বোঝেননি? না না, ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছেন। ঠিক তত সহজ নয় হয়ত মিঃ সেন!
মৃণাল সেন আর কোন কথা বলে না। চুপ করেই থাকে।
এন্টালীতে একটা গলির মধ্যে বাড়িটা ডাঃ নলিনী চৌধুরীর। দোতলা বাড়ি। লাল রঙের। পাড়াটা অনেক দিনের পুরানো-বাড়িটাও পুরানো। ঐ বাড়িটাই ভাড়া নিয়ে একসময় ডাঃ নলিনী চৌধুরী তার ল্যাবোরেটারি গড়ে তুলেছিলেন দোতলায়।
দোতলায় সর্বসমেত চারখানি ঘর। একটা ছোট ঘরে তিনি থাকতেন ও শুতেন–বাদবাকি তিনটে ঘরে তার ল্যাবোরেটারি। একটা ঘর থেকে অন্য ঘরে যাতায়াত করা যেত মধ্যবর্তী দরজাপথে।
নলিনী চৌধুরী বিয়ে-থা করেন নি। সংসারে আপনারজন বলতে ছিল ঐ একটিমাত্র ভাগ্নে নীরেন সান্যাল। নীরেনের যখন অল্প বয়েস, বছর আট-দশ, সেই সময় থেকেই নীরেনকে বোনের কাছ থেকে চেয়ে এনেছিলেন ডাঃ চৌধুরী।
নীরেনের মা-বাবাও আপত্তি করেননি—কারণ অনেকগুলি সন্তান, দৈন্যের সংসারে সকলকে মানুষ করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। আনন্দেই তাই নীরেনকে ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন কোন একদিন।
নীরেনকে কলকাতায় নিয়ে এসে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন ডাঃ চৌধুরী। তারপর সে ক্রমে পাশ করে এম. এস-সি।
এম. এস-সি. পড়িয়েছিলেন ভাগ্নেকে ডাঃ চৌধুরী ইচ্ছা করেই। তাঁর কেমিস্ট্রিতে একজন সহকারীর প্রয়োজন ছিল।
নীরেনও তার মামাকে হতাশ করেনি। পরে ডক্টরেট পেয়েছিল।
ভাল ভাবেই পাশ করে মামার সঙ্গে তার ল্যাবোরেটারিতে রিসার্চের সাহায্য করতে লাগল। তারপর হঠাৎ একদিন ডাঃ চৌধুরীর হল ক্যানসার এবং তার মৃত্যুর পর
ডাঃ সান্যাল ল্যাবোরেটারি চালাতে লাগলেন।
ডঃ নীরেন সান্যালকে তার ল্যাবোরেটারির মধ্যেই পাওয়া গেল।
বাড়িটা নিচের ঘরগুলোর একটা ড্রইংরুম ও অন্য দুটো স্টোররুম রূপে ব্যবহৃত হয়।
বাকি ঘরটায় ভৃত্য গোপাল থাকে।
ঐ গোপালই নীরেনকে দেখাশোনা করে। রান্না থেকে শুরু করে সব কাজই সে করে।
গোপালকে বলতেই সে বললে, ডাক্তারবাবু ওপরে তার ল্যাবরেটারি ঘরে আছেন। চলে যান।
সুব্রত গোপালের কথাটা শুনে যেন একটু অবাকই হয়।
কারও ল্যাবোরেটারি ঘরে যে অমন সোজা চলে যাবার নির্দেশ মিলতে পারে তার যেন ঠিক ধারণা ছিল না। কিন্তু সে-সম্পর্কে সে কোন কথা বলে না। গোপালের নির্দেশমত মৃণালকে সঙ্গে নিয়ে সুব্রত সোজা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল।
সিঁড়ির মুখেই একটি ব্যস্ত যুবকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দোতলায়।
হাতে তার একটি তরল পদার্থপূর্ণ টেস্টটিউব।
যুবকটিকেই জিজ্ঞাসা করে সুব্রত, ডাঃ সান্যাল আছেন?
হ্যাঁ আছেন—যান, ঐ পাশের ঘরে যান। হাত দিয়ে ইশারা করে ঘরটা দেখিয়ে দিল যুবক।
ঘরের মধ্যে ঢুকে ওরা দাঁড়াল। ঘরভর্তি সব যন্ত্রপাতি। র্যাকে র্যাকে নানা আকারের শিশিতে নানা রঙের সব ওষুধ। বুনসেন বার্নারে একটা কাচের আধারে কি যেন ফুটছিল।
তার সামনে একটা আরামকেদারায় গা ঢেলে আরাম করে সিগারেট টানছিল একটা যুবক।
বাঙালীদের মধ্যে অমন স্বাস্থ্যবান চেহারা সচরাচর বড় একটা চোখে পড়ে না। লম্বায় খুব বেশি হবে না, কিন্তু নিটোল স্বাস্থ্য।
টকটকে ফর্সা গায়ের রং। যেন ইউরোপীয়দের মত। মাথার চুল ব্যাকব্রাস করা। চোখে চশমা। চোখেমুখে একটা প্রখর বুদ্ধির দীপ্তি আছে। পরনে একটা পায়জামা ও তার উপরে একটা অ্যাপ্রন্।
পদশব্দেই মুখ তুলে তাকিয়েছিল যুবক। এবং তাকিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল এবং পুলিসের ইউনিফর্ম পরিহিত মৃণাল সেনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি চাই?
আমরা ডাঃ সান্যালের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। মৃণাল সেন বলে। আমিই ডাঃ সান্যাল।
ওঃ নমস্কার। আমার নাম মৃণাল সেন। আমি একজন ইন্সপেক্টার, লালবাজার থেকে আসছি আমরা।
লালবাজার থেকে! বলুন তো কি ব্যাপার?
একটু দরকার ছিল আপনার সঙ্গে। ওঃ!
তা বেশ চলুন পাশের ঘরে যাওয়া যাক। চলুন।
পাশের ঘরটা একটা লাইব্রেরি। চারদিকের আলমারি ও র্যাকে বই ঠাসা। চেয়ার ও টেবিল সেখানে ছিল। মৃণাল সেন ও সুব্রতকে বসতে বলে নিজে একটা চেয়ার টেনে নেয় নীরেন।
কি দরকার বলুন তো ইন্সপেক্টার?
কথা বললে সুব্রতই, ডাঃ সান্যাল, আপনি নিশ্চয়ই সংবাদপত্রে পড়েছেন রায় অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টার একটা দুর্ঘটনায় গত শনিবার মারা গেছেন?
আমি জানি।
পেপারেই বুঝি সংবাদটা জানতে পারেন প্রথম?
না। তবে? মহেন্দ্রবাবুর মেয়ে কুন্তলা আমাকে ফোন করে জানায়।
কবে?
সংবাদটা পাবার কিছু পরেই।
কুন্তলা দেবীদের সঙ্গে আপনি অনেকদিন পরিচিত, তাই না ডাঃ সান্যাল?
ওর দাদা সৌরীন্দ্র আমার ক্লাসফ্রেন্ড ও বিশেষ বন্ধু।
আচ্ছা ডাঃ সান্যাল, আপনার মামা ডাঃ চৌধুরী মারা যাওয়ার আগে তার দুই বন্ধুর নামে, মানে মিঃ রায় ও মিঃ গাঙ্গুলীর নামে, ব্যাঙ্কে দুখানা চিঠি জমা দিয়ে যান—আপনি সে সম্পর্কে কিছু জানেন?
কুন্তলার মুখে একবার শুনেছিলাম বটে চিঠির কথা!
আর কিছু চিঠি সম্পর্কে জানেন না?
না, জানবার প্রয়োজনও বোধ করিনি।
মিঃ রায় ও মিঃ গাঙ্গুলীর সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই যথেষ্ট পরিচয় ছিল, জানাশোনাও ছিল। তাদের মুখে শোনেননি কিছু ঐ চিঠি সম্পর্কে কখনও?
না।
আচ্ছা ডাঃ চৌধুরী মারা যাওয়ার আগে কি নিয়ে রিসার্চ করছিলেন?
স্নেকৎ ভেনাম নিয়ে।
আচ্ছা আপনার আর এক মামা ছিলেন না বর্মায়?
হ্যাঁ, বড়মামা জীবন চৌধুরী বরাবর বর্মাতে ছিলেন।
শোনা যায় তিনি যুদ্ধ বাধার সঙ্গে সঙ্গেই প্রভৃত অর্থ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
সেই রকম একটা কানাঘুষা শুনেছিলাম বটে।
কার কাছে?
তা ঠিক মনে নেই।
ব্যাপারটা আপনি বিশ্বাস করেননি বুঝি?
না।
কেন?
বড়মামাকে দেখলে ও তার চালচলন দেখলেই বুঝতে পারতেন কেন—তাছাড়া যে লোকটা কোনদিন লেখাপড়া করেনি, অল্প বয়সে জাহাজের খালাসী হয়ে পালিয়ে যায়, তার পক্ষে বড়লোক হওয়া একমাত্র আলাদীনের প্রদীপ হাতে পাওয়ারই সামিল।
কিন্তু আমি শুনেছি-আপনার বড়মামা প্রচুর অর্থ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন এবং সেই অর্থ তিনি তাঁর ছোট ভাইকে অর্থাৎ ডাঃ নলিনী চৌধুরীকেই দিয়ে যান মৃত্যুর পূর্বে।
কার কাছে শুনলেন এ আরব্য উপন্যাসের গল্প?
যার কাছেই শুনে থাকি না কেন, তিনি যে একটা নেহাত গল্প বানিয়ে বলেননি–তাই আমাদের ধারণা।
নীরেন সান্যাল প্রত্যুত্তরে হাসল। কোন জবাব দিল না।
সুব্রত আবার বলে, ডাঃ চৌধুরী যখন হাসপাতালে তখনই খবরটা পান তিনি। কথাটা আপনার না জানার কথা নয় হয়ত।
না, আমি কিছু জানি না।
আপনার ছোটমামা আপনাকে কিছু বলেননি?
না।
আচ্ছা আপনাদের আইন-পরামর্শদাতার নামটা জানতে পারি?
কালীপদ চক্রবর্তী। জোড়াবাগানে থাকেন তিনি-হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন।
আচ্ছা আপনার বড়মামার কোন আইন-পরামর্শদাতা ছিলেন?
তা জানি না।
আচ্ছা ডাঃ সান্যাল, আপনাকে বিরক্ত করলাম, কিছু মনে করবেন না—এবারে আমরা উঠব।
না, না—মনে করব কেন? কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো-এসব কথা কেন জিজ্ঞাসা করছিলেন?
কারণ পুলিসের ধারণা মহেন্দ্রনাথের মৃত্যুর ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়।
বলেন কি!
হ্যাঁ, ব্যাপারটা মার্ডার বলেই মনে হয় আমার। মৃণাল সেন বলে।
ও নো-ইউ ডোক্ট একজ্যাক্টলি মিন ইট!
সুব্রত সে কথার জবাব না দিয়ে বলে, আচ্ছা চলি-নমস্কার।
সুব্রত অতঃপর মৃণাল সেনকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
১১.
ঐ দিনই রাত্রে।
কুন্তলা তার ঘরে একটা রকিং চেয়ারে বসেছিল। ঘরের আলো নিভানো অন্ধকার।
খুব শীত পড়েছে। গায়ে একটা শাল জড়িয়ে বসেছিল কুন্তলা।
ভৃত্য এসে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে ডাকে, দিদিমণি!
কে রে?
আমি। ডাক্তারবাবু এসেছেন।
ডাক্তারবাবু!
আজ্ঞে, নীরেনবাবু।
নীরেনের গলা শোনা গেল, কুন্তলা!
কুন্তলা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দেয়।
নীরেন এসে ঘরে ঢুকল।
আবার মরোজ হয়ে বসে আছ?
কুন্তলা সোজা হয়ে বসে, কোন কথা বলে না।
তুমি এক কাজ করে কুন্তলা—
নীরেনের মুখের দিকে তাকাল কুন্তলা।
তুমি বরং কিছু দিন তোমার মামার বাড়িতে গিয়ে থেকে এস। এই পরিবেশ থেকে তোমার সরে যাওয়া দরকার, অন্তত কিছুদিনের জন্য, আমার মনে হয়।
কুন্তলা কোন জবাব দেয় না।
নীরেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে কুন্তলার মুখোমুখি বসে।
বাবা-মা চিরকাল কারও বেঁচে থাকে না—
তা নয় নীরেন!
তবে কী?
বাবার মৃত্যু হয়েছে একটা দুর্ঘটনায়, কিছুতেই যেন কথাটা ভুলতে পারছি না!
দুর্ঘটনা বলতে তুমি কি বলতে চাও?
কেন—তুমি কি কিছু শোননি?
কি?
পুলিসের ধারণা তাকে কেউ হত্যা করেছে!
ননসেন্স! কে তাকে হত্যা করতে যাবে বল তো! যত সব কক অ্যান্ড বুল স্টোরি, যেমন পুলিস তেমনি তাদের বুদ্ধি। ইফ আই অ্যাম নট রং, তিনি আত্মহত্যা করেছেন ট্রেনের তলায় ঝাপিয়ে পড়ে।
কিন্তু কেন বাবা আত্মহত্যা করতে যাবেন?
শোন কথা, আত্মহত্যা লোকে করে কেন? কোন কারণ হয়ত তার ছিল।
তুমি বাবাকে জান না কিন্তু আমি জানি। তার মত ধীর-স্থির প্রকৃতির লোক আত্মহত্যা করতে পারে আমি বিশ্বাসই করি না।
আমাদের জীবনে বিশ্বাসের বাইরেও অনেক সময় অনেক কিছুই ঘটে কুন্তলা।
তা হয়ত ঘটে—তবু–
বেশ তোমার কথাই না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু যা হয়ে গিয়েছে তা তো আর ফিরবে না—তখন মিথ্যে ভেবে কি হবে!
সত্যি বাবার জন্য ভারি দুঃখ হয়—হি ওয়াজ সোলোনলি!
দেখ কুন্তলা, একটা কথা তোমাকে এতদিন আমি বলিনি—কিন্তু আজ তোমার কথাটা শুনে কেন যেন মনে হচ্ছে
কি?
তোমার বাবার বন্ধু ঐ মণীন্দ্র গাঙ্গুলী লোকটা—
কি?
মনে হয় ওর এই ব্যাপারের মধ্যে হাত আছে!
না না, এসব তুমি কি বলছ নীরেন?
ভুলো না, অনেকগুলো টাকা তোমার বাবার কাছে ধরতো লোকটা।
কিন্তু সে টাকার জন্য তো বাবা কোনদিন তাকে তাগাদা দেননি!
দেননি—তাহলেও একদিন তো তাকে শোধ করতেই হবে, এই কড়ারেই তো সে। টাকা ধার নিয়েছিল! তাছাড়া–
কি?
আজ পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ সেন আমার কাছে আসার পর থেকে কেন যেন আমার একটা কথা মনে হচ্ছে
কি কথা?
আমার বড়মামার চিঠির মধ্যে সত্যিই হয়ত কোন গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত ছিল। যদিও এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না—
কি?
বড়মামা কোন টাকাকড়ি নিয়ে আসতে পারেন বর্মা থেকে-ব্যাপারটা অত্যন্ত অ্যাবসার্ড-অসম্ভব যেন মনে হয় এখনও!
.
ঐদিন রাত্রে—সুব্রতর গৃহে।
আহারাদির পর সুব্রত একটা আরামকেদারায় বসে একটা সায়েন্স ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল। ভৃত্য এসে বললে, আগরপাড়ার স্টেশন মাস্টার রসময়বাবু দেখা করতে এসেছেন।
সংবাদটা শুনে সুব্রতর চোখের তারা দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি বলে, যা তাঁকে এখানে এই ঘরে নিয়ে আয়।
সুব্রত গত পরশু আগরপাড়া গিয়ে রসময়বাবুর সঙ্গে আলাপ করে বেশ একটু। ভদ্রলোক সম্পর্কে ইন্টারেস্টই বোধ করেছিল। কৌতুকও ঐসঙ্গে একটু বোধ করেছিল, ভদ্রলোকের মনে ক্রাইম ডিটেকশনের একটা শখ আছে কথায়বার্তায় বুঝতে পেরে।
আপনার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছি ডিটেকশনের ব্যাপারে আপনি বেশ ইন্টারেস্টেড। তা আপনি পুলিশ লাইনে গেলেন না কেন বলুন তো? সুব্রত বলেছিল একসময় রসময়কে।
হয়ে উঠল না, বুঝলেন না! রসময় বলেছিল লজ্জার হাসি হেসে।
এ কেসটায় আপনার সাহায্য কিন্তু আমি নেবো।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। এ তো আমার গর্বের কথা। বলুন না কি করতে হবে, বলুন?
দুটি কাজ করতে হবে। প্রথমত দেখবেন তো, যেখানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল তার আশেপাশে কালো রঙের মরক্কো লেদারের একটা ফোলিও ব্যাগ পাওয়া যায় কিনা।
দেখব-নিশ্চয়ই খোঁজ করে দেখব।
আর, ঐদিন মানে দুর্ঘটনার রাত্রে কটন মিল থেকে কোন ওয়াগন গুডস্ ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল কিনা—এই খবরটা।
এ আর এমন কি, দিতে পারব খবরটা আপনাকে। গুডস্ ট্রেন সে-রাত্রে গেছে কিনা সে তো আমার ডাইরিতেই আছে। আর কিছু?
হ্যাঁ। ঐ দেশবন্ধু কলোনীতে যে রেস্তোরাঁটা আছে, নাম যার পান্থ-নিবাস, তার অধিকারী ঐ ঋষিবাবুর কাছ থেকে খোঁজ নেবেন সে-রাত্রে সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত কারা কারা সেদিন তার রেস্তোরাঁয় কফি-চা পান করতে গিয়েছিল।
ঋষির সঙ্গে আলাপ আছে। সেও একটি রহস্য-উপন্যাস গল্পের পোকা। মধ্যে মধ্যে সে আমার কাছে বই নিতে আসে, তার কাছেই খবরটা পেয়ে যাব। রসময় তার জবাব দেয়।
সুব্রত বুঝতে পারে, রসময় নিশ্চয়ই কোন খবর সংগ্রহ করে এনেছে, নচেৎ এই শীতের রাত্রে ছুটে আসত না এতদূরে!
রসময় এসে ঢুকল। হাতে একটা ছোট ফোলিও ব্যাগ।
আসুন—আসুন রসময়বাবু, আসুন।
রসময় বসল।
তারপর কি খাবেন বলুন? চা কফি–
না, না। সে-সবের কিছু প্রয়োজন নেই।
বিলক্ষণ, তাই কি হয়! কফিই আনানো যাক।
সুব্রত ভৃত্যকে ডেকে দু কাপ কফির নির্দেশ দিল।
তারপর, এনি নিউজ? কিছু খবর আছে?
আছে।
ফোলিওটা পেয়েছেন নাকি?
নিশ্চয়ই, এই দেখুন।
সুটকেস থেকে একটা কালো মরক্কো লেদারের দামী ফোলিও ব্যাগ রসময় বের করে দিল। ব্যগটা নোংরা হয়ে গিয়েছে।
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল সুব্রত ফোলিও ব্যাগটা।
এম. এন. রায় নামটা সোনার জলে মনোগ্রাম করা আছে ফোলিও ব্যাগের গায়ে।
সুব্রত ব্যাগটা খুলে ফেলল।
ব্যাগের ভিতরে কিছু টাকা পাওয়া গেল। নোট-শপাঁচেকের হবে। একশো টাকা ও দশ টাকা পাঁচ টাকার নোট।
কিছু টাইপ করা কাগজপত্র।
সব কিছু ঘাঁটা—এলোমেলো যেন ভিতরটা।
সুব্রত ব্যাগটা ধীরে ধীরে আবার বন্ধ করে রাখল।
এই ব্যাগটাই খুঁজছিলেন তো স্যার?
হ্যাঁ।
পেলেন?
কি?
যা খুঁজছিলেন? রসময়ের কণ্ঠে আগ্রহ ও উত্তেজনা।
সুব্রত মৃদু হেসে বলে, ব্যাগটাই আমি খুঁজছিলাম রসময়বাবু, অন্য কিছু নয়।
ভৃত্য কফি নিয়ে এল ঐসময়।
কফি পান করবার পর রসময় বলে, সে-রাত্রে এগারোটায় গোয়ালন্দর দিকে একটা গুডস্ ট্রেন গেছে স্যার। এবং সেই ট্রেনে রূপশ্রী কটন মিল থেকে সাতটা ওয়াগন গেছে।
কখন সেগুলো গুডস ট্রেনের সঙ্গে অ্যাটাচড় করা হয়?
রাত আটটার পর। একটা ইঞ্জিন গিয়ে মিল ইয়ার্ড থেকে ওয়াগনগুলো টেনে এনে মেল ট্রেনের সঙ্গে অ্যাটাচ করে দেয়।
হুঁ, তাহলে ঐ সময়ই–। অন্যমনস্ক ও কতকটা যেন আত্মগতভাবে কথাটা বলে সুব্রত।
কি স্যার?
না, কিছু না।
আরও একটা খবর আছে স্যার।
কি বলুন তো?
সে-রাত্রে সন্ধ্যার সময়, মানে ছটা নাগাদ মিঃ গাঙ্গুলী রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। এবং রাত আটটা পর্যন্ত সেখানে ছিলেন।
সত্যি!
হ্যাঁ স্যার, ঋষি বললে। আর একটা জিনিস পেয়েছি স্যার ঐ ব্যাগ খুঁজতে খুঁজতে রেল লাইনের উপরে।
কি?
রসময় এবারে একটা ইংরাজী এস অক্ষরের মত অনেকটা দেখতে লোহার হুক যা সাধারণত ঘরে ফ্যান টাঙাবার জন্য প্রয়োজন হয়, সঙ্গে একখণ্ড দড়ি-বাঁধা— সুটকেস থেকে বের করল।
দেখুন এটা—দেখুন এতে রক্ত শুকিয়ে আছে।
সুব্রত পরীক্ষা করে দেখল রসময়ের কথাটা মিথ্যা নয়। সত্যিই দড়িটার গায়ে রক্তের দাগ। সুব্রতর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
সে বলে, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ রসময়বাবু। এতক্ষণে ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হল, মৃতের চোখ-মুখ-মাথা কেন অমন করে থেতলে গিয়েছে!
.
১২.
পরের দিন সকাল।
মৃণাল সেনকে ফোন করে সুব্রত ডেকে এনেছিল তার বাড়িতে।
দুজনের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। সামনে কফির পেয়ালা।
সুব্রত বলছিল, এখন তো স্পষ্টই বুঝতে পারছেন মিঃ সেন, সে-রাত্রে ব্যাপারটা কি ঘটেছিল। হত্যাকারী কৌশলে ঐ টাইপ করা চিঠির সাহায্যে মিঃ রায়কে অকুস্থলে টেনে নিয়ে যায় বিশেষ কোন কারণে এবং তারপর তার কাজ হাসিল হওয়ার পর সে তাকে হত্যা করে এবং সমস্ত ব্যাপারটাই পূর্বপরিকল্পিত–
আপনার তাই মনে হয়? মৃণাল সেন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় সুব্রতর মুখের দিকে।
হ্যাঁ।
সুব্রত অতঃপর বলতে লাগল, প্রথমত হত্যাকারী জানত মিঃ গাঙ্গুলী তার বন্ধু, তাকে চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠালে তিনি যাবেনই-তাই সে চিঠি পাঠিয়েছে এবং ডাকে।
পাঠিয়ে লোক-মারফত পাঠিয়েছে যাতে করে ব্যাপারটা মিঃ রায় মনে করেন জরুরী।
একটু থেমে বলে আবার, দ্বিতীয়ত সে আরও জানত মিঃ রায় রাত্রে আগরপাড়া গেলে তার গাড়িতে যাবেন না—ট্রেনেই যাবেন। তৃতীয়ত হত্যাকারী এমন একটা দিন বেছে নিয়েছিল যেদিন শনিবার, ডেলি প্যাসেঞ্জারের ভিড় চারটের পর আর থাকবে না–—এবং শীতের সময় ও পরের দিন ছুটি বলে রাস্তায় ঐ সময়টা লোক-চলাচলও বেশি থাকবে না। চতুর্থত সে জানত মিঃ রায়কে রিকশায় করেই দেশবন্ধু কলোনীতে যেতে হবে—হেঁটে অতটা পথ তিনি যাবেন না।
এরপর মনে মনে সমস্ত ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করে দেখুন প্রধান জায়গা থেকে আগরপাড়ার কলোনটা বিচ্ছিন্ন। কাজেই ওদিকটা আরও নির্জন হবে। তারপর শনিবার ও শীতের রাত বলে ঐ জায়গাটায় মানুষের চলাচল একপ্রকার ছিল না বললেই চলে সেদিন ঐসময় এবং সেই কারণেই ঐ সময় হত্যাকারীর তাকে গুলি করে ক্লোজ রেঞ্জ থেকে হত্যা করা খুব একটা ডিফিকাল্ট ব্যাপার কিছু ছিল না।
পঞ্চম : সে ঠিক করেছিল ব্যাপারটাকে একটা আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনায় দাঁড় করাতে পারলে সব দিক দিয়েই তার পক্ষে সুবিধা হবে।
একটু থেমে আবার সুব্রত বলে, তাই সে মিঃ রায়কে হত্যা করবার পর ঐ হুকটার সঙ্গে মিঃ রায়ের গ্রেট কোটটা বিঁধিয়ে ওটা রূপশ্রী কটন মিলের বাইরে যে লোডেড ওয়াগনগুলো ছিল তার একটার সঙ্গে বেঁধে দেয়।
ওয়াগনগুলো তারপর যখন এঞ্জিন টেনে নিয়ে যায়, সেই সময় মৃতদেহ লাইনস্লিপার ও পাথরের ওপর দিয়ে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে যায় এবং ঐভাবে হেঁচড়ে হেঁচড়ে যাওয়ায় হয়ত একসময় দড়িটা ছিঁড়ে লাইনের উপরই পড়ে যায়—যার ফলে মুখটা অমন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়-নচেৎ গুলি লেগে ওভাবে থেতলে যেতে পারে না মুখটা অমন করে মৃতদেহের।
ঐভাবে মৃতদেহের মুখটা বিকৃত করার পিছনে হয়ত আরও একটা অভিসন্ধি হত্যাকারীর ছিল। চট করে মৃতদেহ যাতে কেউ আইডেন্টিফাই না করতে পারে এবং সে কারণেই হয়ত ফোলিও ব্যাগটাও দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু এত করেও হত্যাকারী দুটো ভুল করেছে-যা স্বাভাবিক ক্ষেত্রে সাধারণত হত্যার ব্যাপারে হয়ে থাকেই–
কি রকম?
প্রথমত হত্যাকারী ঐ টাইপ করা চিঠি পাঠিয়ে এবং দ্বিতীয়ত মিঃ রায়ের জামার পকেট থেকে তার পার্সটা নিতে ভুল করে। পার্সটা না পেলে হয়ত এত সহজে আমরা এতখানি এগুতে পারতাম না, এখনও হয়ত অন্ধকারেই আমাদের ঘুরে ঘুরে মরতে
সুব্রত একটু থেমে আবার বলতে লাগল, এবার দেখা যাক খুনী বা হত্যাকারী এক্ষেত্রে কে হতে পারে! যেভাবে মিঃ রায় নিহত হয়েছেন তাতে মনে হয় হত্যাকারী বাইরের কেউ তার অপরিচিত তৃতীয় ব্যক্তি নয়। যারা মিঃ রায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে
পরিচিত ছিল তাদেরই মধ্যে একজন কেউ।
সেকথা বলতে গেলে তো অনেকেই সন্দেহের তালিকায় এসে পড়েন! মৃণাল সেন মৃদুকণ্ঠে বলে।
নিশ্চয়ই। ছোট ভাই সুরেন্দ্র, দুই ছেলে সৌরীন্দ্র ও ভবেন্দ্র, ম্যানেজার মিঃ মুখার্জী, বন্ধু মিঃ মণীন্দ্র গাঙ্গুলী প্রত্যেকেই। কিন্তু
কি? মৃণাল সেন সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে।
হত্যাকারীকে বিচার করতে হবে-মোটিভ প্রোবাবলিটি ও চা সব দিক দিয়েই। প্রথম দেখা যাক—প্রোবাবলিটির দিক থেকে কাকে কাকে ওদের মধ্যে সন্দেহ করা যায় বা যেতে পারে।
একটু থেমে সুব্রত বলতে লাগল, মিঃ রায়ের মৃত্যুতে যাদের নাম করলেন ওরা সকলেই জানত ওদের মধ্যে যে কেউই লাভবান হবে। এখন দেখা যাক কে কোথায় হত্যার সময় ছিল—বড় ছেলে সৌরীন্দ্র অকুস্থান থেকে দুর্ঘটনার সময় অনেক দূরে ছিল–কাজেই তাকে আপাতত বাদ দেওয়া যেতে পারে সন্দেহের তালিকা থেকে, যদিও বাপের সঙ্গে তারও বনিবনা ছিল না, বাপের মৃত্যুতে সে লাভবান হত
দ্বিতীয়ত, ছোট ছেলে ভবেন্দ্ৰ। দুর্ঘটনার মাত্র কয়েকদিন আগে তাকে কলকাতায় দেখা গিয়েছিল। বাপের সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়। বাপকে সে শাসিয়ে যায়—শুধু তাই নয়, সে একজন আর্মির লোক, আর্মির ৩৮ রিভালভারও তার কাছে থাকা সম্ভব। মোটিভ তো তার ছিলই, উপরন্তু চান্সও ছিল প্রচুর।
ছোট ভাই সুরেন্দ্র–
হ্যাঁ, ছোট ভাই সুরেন্দ্র। দুর্ঘটনার রাত্রে সে সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। বাড়িতেই ছিল। তারপর এক বন্ধু এসে তাকে তাসের আড্ডায় টেনে নিয়ে যায়। সেখানে রাত দুটো পর্যন্ত তাস খেলেছে। অতএব তার ক্ষেত্রে প্রোবাবলিটি একেবারে nil। মোটিভ থাকলেও চান্সের কথা তো আসেই না
মিঃ গাঙ্গুলী? মৃণাল প্রশ্ন করে এবারে।
হ্যাঁ, মিঃ গাঙ্গুলীর কথাটা বিশেষ করে জানতে হবে—কারণ তাঁর সময়ের এলিবাইটা এখনও প্রমাণ হয়নি—মোটিভ অবশ্য ছিল—চান্স তো খুবই বেশি ছিল।
বিশেষ করে ঐ টাকার ব্যাপারটা–
হ্যাঁ-সেটা আমি ভাবছি। তারপর ধরুন মিঃ মুখার্জ। তিনি প্রথমত উইলের ব্যাপারটা সব জানতেন এবং দ্বিতীয়ত মিঃ রায়ের মৃত্যুতে তিনি বিশেষ ভাবে লাভবান হবেন। সবচাইতে বড় কথা ঐদিনকার মিঃ মুখার্জীর গতিবিধি সম্পর্কেও আমরা সঠিক কোন প্রমাণ যোগাড় করতে পারিনি আজ পর্যন্ত।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন কিনা জানি না, ঐ বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলীই মিঃ রায়ের হত্যাকারী। মৃণাল সেন বলে।
সুব্রত কোন জবাব দেয় না। মৃদু হাসে।
.
১৩.
ময়না তদন্ত করে জানতে পারা গেল মৃত্যুর কারণ রিভলভারের গুলি-গুলিটা তার ব্রেন ম্যাটারের মধ্যে ইমপ্যাকটেড হয়েছিল-বেস্ অফ দি স্কাল ভেদ করে থ্যালামাসে গিয়ে পৌঁছেছিল এবং মৃত্যু তাতেই হয়েছে।
সেনের ধারণা, মহেন্দ্রনাথ রায়ের মৃত্যুর কারণ অ্যাক্সিডেন্ট বা আত্মহত্যা কোনটাই নয়—তাকে হত্যা করা হয়েছে রিভলভারের গুলির সাহায্যে।
.
দিন দুই পরে।
শীতের ধোঁয়া যেন কলকাতা শহরের পথে একটা শ্বাসরোধকারী পর্দা টেনে দিয়েছে।
সুব্রত এসে তার গাড়ি থেকে নামল মিঃ রায়ের গড়িয়াহাটার বাড়ির পোর্টিকোর সামনে।
বেল বাজাতেই বেয়ারা এসে দরজা খুলে দিল।
কাকে চাই?
মিস রায় আছেন?
হ্যাঁ।
তাকে আমার সেলাম দাও, বল সুব্রতবাবু এসেছেন।
বসুন এসে ভেতরে। আমি খবর দিচ্ছি।
বেয়ারা সুব্রতকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে ভিতরে চলে গেল খবর দিতে।
হঠাৎ জুতোর একটা শব্দ শুনে সুব্রত মুখ তুলে তাকায়—ডাঃ নীরেন সান্যাল।
মিঃ রায়, না? নীরেন সান্যাল বলে।
হ্যাঁ, নমস্কার।
কুন্তলার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন বুঝি? সে আসছে। তারপর আপনাদের ইনভেসটিগেশন কতদূর এগুলো?
একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে—মার্ডার!
বলেন কি?
হ্যাঁ, পোস্টমর্টেমে ব্রেনে বুলেট পাওয়া গিয়েছে। রিয়েলি?
হ্যাঁ।
স্যাড! আচ্ছা মিঃ রায়, চলি। গুডনাইট।
গুডনাইট।
ডাঃ নীরেন সান্যাল চলে গেল।
একটু পরেই কুন্তলা এসে ঘরে ঢুকল। সমস্ত চোখেমুখে একটা ক্লান্তি যেন ব্যাপ্ত হয়ে আছে। চুল বোধ হয় বাঁধেনি আজ কুন্তলা। রুক্ষ তৈলহীন ভ্রমরকৃষ্ণ কেশদাম পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে। পরনে কালো ভেলভেটপাড় একটা শাড়ি ও সাদা ব্লাউজ। পায়ে চপ্পল।
নমস্কার, আপনাকে আজ আবার একটু বিরক্ত করতে এলাম কুন্তলা দেবী!
না না, বিরক্তির কি আছে!
কুন্তলা সামনের একটা সোফায় উপবেশন করল।
পুলিস বলছে, মানে তাদের মতে এটা একটা হত্যা—মানে মার্ডার কেস। সুব্রত বলে।
না না, এ আপনি কি বলছেন সুব্রতবাবু?
হ্যাঁ, ব্রেন ম্যাটারে গুলি পাওয়া গিয়েছে-রিভলভারের গুলি।
এ-এ যে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না! বাবাকে হত্যা করবে কে, আর—আর কেনই বা হত্যা করবে?
আচ্ছা মিস্ রায়-রিসেন্টলি আপনার ছোড়দা কি কলকাতায় এসেছিলেন?
না–না তো!
ঠিক জানেন?
হ্যাঁ, তবে—
তবে?
মাসখানেক আগে ছোড়দার একটা চিঠি আমি পেয়েছিলাম।
চিঠি!
হ্যাঁ।
কি লিখেছিলেন তাতে তিনি?
কুন্তলা একটু যেন চুপ করে থাকে, একটু যেন ইতস্তত করে, তারপর মৃদু কণ্ঠে বলে, ছোড়দা কিছু টাকার জন্য আমাকে লিখেছিল।
টাকা।
হ্যাঁ, বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে তাকে যদি পাঠাতে পারি তাই লিখেছিল।
কেন টাকার দরকার সে সম্পর্কে কিছু লিখেছিলেন চিঠিতে আপনাকে?
না—তবে ছোড়দা চিরদিনই একটু বেশি খরচে—একটু বেহিসাবী—হয়ত কিছু ধারদেনা হয়েছিল!
তা আপনি আপনার বাবাকে কথাটা বলেছিলেন?
হ্যাঁ।
কি বললেন তিনি?
গালাগালি করলেন। টাকা দেননি।
আপনি সে-কথা আপনার ছোড়দাকে জানিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
তারপর তার আর কোন চিঠি পাননি?
না। কিন্তু কেন—কেন এত কথা আপনি তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছেন সুব্রতবাবু?
কুন্তলার স্বরে গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ পায়।
কুন্তলা দেবী, আপনি বোধ হয় জানেন না একটা কথা—
কি—কি জানি না?
আপনার ছোড়দা কিছুদিন আগে কলকাতায় এসেছিলেন!
হঠাৎ যেন চমকে ওঠে কুন্তলা। বলে, কে আপনাকে একথা বলল?
মিঃ মুখার্জী।
মুখার্জী কাকা?
হ্যাঁ। এবং তিনি আপনার বাবার সঙ্গে গিয়ে অফিসে দেখাও করেন।
কুন্তলার মুখ যেন রক্তহীন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে তখন।
কুন্তলা দেবী!
সাড়া নেই।
মিস রায়!
অ্যাঁ! কুন্তলা মুখ তুলে তাকাল সুব্রতর দিকে।
আপনার সঙ্গেও তিনি দেখা করেছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ।
তিনি কদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিলেন, কবে কার্যস্থলে ফিরে যান, জানেন কিছু?
দুদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল—
কিন্তু এসেছিলেন কেন? টাকার জন্যে নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ।
টাকাটার খুব প্রয়োজন ছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
কত টাকা?
প্রায় হাজার টাকা।
টাকাটার যোগাড় হয়েছিল কি?
বোধ হয় সবটা নয়।
সবটা নয় মানে?
আমি আমার জমানো টাকা থেকে শ’তিনেক টাকা ছোড়দাকে দিয়েছিলাম।
আর একটা কথা, আপনার ছোড়দা মিলিটারি ইউনিফর্মে এসেছিলেন কি?
হ্যাঁ।
সঙ্গে রিভলভার ছিল?
হ্যাঁ। কিন্তু কি-কি-কি আপনি বলতে চান মিঃ রায়?
কিছু না। আচ্ছা এবারে আমি উঠব মিস রায়!
এবং কুন্তলা কিছু বলবার আগেই ঘর থেকে বের হয়ে এসে সোজা গাড়িতে স্টার্ট দিল সুব্রত।
.
১৪.
সুব্রত গৃহে ফিরে দেখল মৃণাল সেন তার অপেক্ষায় বসে আছে।
মিঃ সেন! কি খবর—কতক্ষণ?
তা প্রায় আধ ঘণ্টাটাক হবে। মৃণাল সেন বলে।
চা দিয়েছে আপনাকে?
দিতে চেয়েছিল আপনার চাকর কিন্তু আমিই না করেছি।
সুব্রত ভৃত্যকে ডাক দিল।
ভৃত্য আসতেই তাকে দু কাপ চায়ের কথা বললে।
তারপর সোফার উপরে গা ঢেলে দিয়ে বসতে বসতে বললে, কাল থেকে আবার শীতটা কেমন জাঁকিয়ে পড়েছে মিঃ সেন! তারপর বলুন, খবর কি? আপনার মত কাজের মানুষ যখন আমার জন্য বসে আছেন, বুঝতে পারছি মিঃ রায়ের হত্যার ব্যাপারে আরও কিছু জানতে পেরেছেন।
আপনি বলছিলেন না—আর্মি হেড কোয়ার্টারে সৌরীন্দ্র ও ভবেন্দ্রর রিসেন্ট মুভমেন্টের পার্টিকুলারস্ সম্পর্কে জানবার জন্য টেলিগ্রাম করতে!
আপনি তো করেছিলেন! খবর এসেছে কিছু?
হ্যাঁ। একটু আগে আই. জির কাছে ১৪তম আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে সংবাদ এসেছে ওদের দুজনেরই সম্পর্কে। সেই সংবাদ জানতে পেরেই আপনাকে বলতে এসেছি।
বলুন!
হেড কোয়ার্টার জানাচ্ছে, ক্যাপ্টেন সৌরীন্দ্র রায় বর্তমান পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সঙ্গে আজ প্রায় দুমাস হল আরাকান ফ্রন্টেই আছেন। ইতিমধ্যে তিনি কোন ছুটিও নেননি বা ঐ ইউনিট থেকে অন্যত্র ট্রান্সফারও হননি।
আর ভবেন্দ্র?
সুবেদার ভবেন্দ্র রায় একজন নন-কমিশন্ড অফিসার-ক্লার্ক। ওর ওখানকার মেসে প্রচুর ধার-দেনা। অত্যধিক মদ্যপান করে। ইতিমধ্যে একদিন নাকি কোন এক ইউনিটের ডিনার খেতে গিয়েছিল কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে, সেখানে তার রিভালভারটি খোয়া যায়।
তারপর?
ব্যাপারটার একটা কোর্ট অফ এনকোয়ারি বসেছে।
বাট হোয়াট অ্যাবাউট হিজ রিসেন্ট মুভমেন্ট?
সেটাই বলছি। গত ১৫ই ডিসেম্বর অর্থাৎ এখানকার দুর্ঘটনার দশদিন আগে সে দশদিনের ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে নাকি কলকাতায় এসেছে। এবং আজ পর্যন্ত সে ফিরে যায়নি।
ফিরে যায়নি? এখনও কাজে জয়েন করেনি?
না।
অতঃপর সুব্রত মনে হল অন্যমনস্ক ভাবে যেন কি ভাবছে।
মৃণাল সেন সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কি ভাবছেন সুব্রতবাবু?
ভাবছি তাহলে ভবেন্দ্র নিশ্চয়ই এখনও কলকাতায়ই আছে, আর—
আর কি?
তার বোন কুন্তলা দেবী নিশ্চয় তার খবর জানে! শুনুন, একটা কাজ অবিলম্বে করতে হবে।
কি, বলুন?
প্লেন ড্রেসে একজন সি. আই. ডি-কে মিঃ রায়ের গড়িয়াহাটার বাড়ির ওয়াচে রাখুন। সে কেবল বাড়িটার প্রতিই নজর রাখবে না, কুন্তলা দেবীর মুভমেন্টসের উপর নজর রাখবে।
বেশ, আমি এখুনিই ফিরে গিয়েই ব্যবস্থা করছি।
আগরপাড়া সলিটারি কর্নারের উপরে নজর রেখেছেন তো?
হ্যাঁ। আজ বিকেল পর্যন্ত খবর হচ্ছে, গত দুদিন বাড়ি থেকে বেরই হননি মিঃ গাঙ্গুলী।
সুব্রত যেন আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। সে যেন কি ভাবছে।
আজ তাহলে আমি উঠি সুব্রতবাবু!
আসুন।
অতঃপর মৃণাল সেন বিদায় নেয়।
সুব্রত উঠে গিয়ে ফোনে ভবেন্দ্রকে ডাকল।
ভৃত্য ফোন ধরেছিল। সে বললে, ভবেন্দ্র বাড়িতে নেই।
দিদিমণি নেই?
আছে—তাকে দেবো?
না, থাক।
ভবেন্দ্ৰ কলকাতাতেই আছে। আর এও ঠিক, কুন্তলা জানে সে কোথায়! কিন্তু কেন, ছুটি শেষ হওয়া সত্ত্বেও ভবেন্দ্ৰ কেন এখনও ফিরে গেল না চাকরি স্থলে?
ডেজার্টার হলে আর্মির লোকের কোর্টমার্শাল হয়, শাস্তি হয়, তা কি সে জানে না?
নিশ্চয়ই জানে। তবে ফিরে যায়নি কেন?
কুন্তলা তার ঐ ছোড়দাকে মনে হয় একটু বেশিই ভালবাসে। ঐ ছোড়দার উপরে তার একটা দুর্বলতাও আছে।
কুন্তলা চেহারাটা সুব্রতর মনের পাতায় যেন ভেসে ওঠে।
বিষণ্ণ মুখ। রুক্ষ কেশভার। কপাল ও চোখ দুটি ভারি সুন্দর; যেন কপালের উপরে কয়েকগাছি চূর্ণ কুন্তল এসে পড়েছে।
কুন্তলা নামটি ভারি মিষ্টি কিন্তু ডাকতেও ভাল লাগে।
সুব্রত হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পায়। বিরক্ত হয়ে ওঠে নিজের উপরেই। এসব কি ভাবছে সে? আবোল-তাবোল কি এসব চিন্তা সে করছে?
ঘড়ির দিকে তাকাল সুব্রত।
রাত সাড়ে দশটা।
সুব্রত উঠে পড়ল। ভৃত্যকে খাবার দিতে বলল।
.
পরের দিন।
রাত্রি তখন প্রায় দশটা হবে। সেরাত্রেও বাইরে প্রচণ্ড শীত। হাড় পর্যন্ত যেন কাপিয়ে তোলে।
টেলিফোন বেজে উঠল।
সুব্রত টেলিফোন ধরে কার সঙ্গে যেন কথা বলল।
ইয়েস স্যার, একটা মিস্টিরিয়াস লোক পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকেছে পিছন দিক দিয়ে—বোধ হয় পাঁচ-সাত মিনিট হবে!
কিপ এ ক্লোজ ওয়াচ-আমি আসছি। হ্যাঁ, মৃণাল সেনকে খবর দিয়েছ? তাকে ফোন করেছ?
হ্যাঁ স্যার, ফোন করেছিলাম কিন্তু তিনি অফিসে নেই।
সুব্রত টেলিফোন রেখে দিল।
পনেরো থেকে ষোল মিনিটের মধ্যেই সুব্রত ঝড়ের বেগে যেন গাড়ি চালিয়ে গড়িয়াহাটায় মিঃ রায়ের বাড়ির সামনে এসে পড়ল।
কমল নামে যে যুবকটি বাড়ির পাহারায় ছিল সে ছুটে আসে।
এনি ফারদার নিউজ, কমল?
না স্যার।
এখনো বাড়িতেই আছে লোকটা তাহলে?
হ্যাঁ স্যার।
ঠিক আছে। আমি ভিতরে যাচ্ছি। যে পথ দিয়ে ও ভিতরে ঢুকছে সেখানেই তুমি দাঁড়িয়ে থাকো। ও নিশ্চয়ই ঐ পথ দিয়েই ফিরে যাবে। ইউ মাস্ট স্টপ হিম। আর কেউ তোমার সঙ্গে নেই?
না স্যার—তবে এখুনি আমার রিলিফ শিবনাথ আসবে।
ঠিক আছে, আমি না ফিরে আসা পর্যন্ত তুমি থেকো।
ঠিক আছে স্যার।
সুব্রত অতঃপর রাস্তায় গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। গেট বন্ধ ছিল।
দারোয়ানকে ডাকতেই সে সাড়া দেয়, কৌন?
দারোয়ানজী, গেট খুলিয়ে!
দারোয়ান এগিয়ে এল। সুব্রতকে সে চিনতে পারে, সাব, আপ!
হ্যাঁ, গেটটা খোল। ছোটবাবু কোঠিমে হ্যায় না?
জী নেহি তো, উননে বাহার গিয়ে।
দারোয়ান গেট খুলে দিল। সুব্রত ভিতরে প্রবেশ করে।
উপরের একটা ঘরে আলো জ্বলছে।
ভবেন্দ্রর এ সময় থাকার কথা নয়, ব্রত ভাল করেই জানে। সে এ সময়টা তাস খেলতে যায়—তাই গিয়েছে। কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢোকা যায় কেমন করে?
ড্রইংরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজা বন্ধ।
একটু ইতস্তত করে সুব্রত। যেন মুহূর্তকাল কি ভাবে। তারপর বেল বাজায় একবার।
ভিতরে ডিং-ডিং মিউজিক শোনা যায়।
সুব্রত রুদ্ধ নিশ্বাসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। এক-একটা সেকেন্ড যেন একএকটা ঘণ্টা বলে মনে হয়।
কলিংবেল আর একবার কিন্তু বাজাতে হল না। বেয়ারা দরজা খুলে দিল।
ছোটবাবু-ভবেন্দ্রবাবু বাড়িতে আছেন?
না তো!
কখন বের হলেন?
প্রায় ঘণ্টা দুই হবে।
আশ্চর্য, আমাকে এ সময় আসতে বলেছিলেন!
আসতে বলেছিলেন!
হ্যাঁ, বোধ হয় এসে যাবেন এখুনি। আমি বরং একটু বসি। সুব্রত বলে।
ভৃত্য কোন কথা বলে না।
দিদিমণি আছে?
হ্যাঁ।
কি করছেন? দিদিমণির শরীরটা সকাল থেকে খারাপ—শুয়ে আছেন।
হুঁ। আচ্ছা তুমি যাও, আমি বসছি।
বেয়ারা আর কথা বলল না। সুব্রত তার অপরিচিত নয়।
দু-চারদিন এখানে এসেছে—একজন পুলিস অফিসারও প্রথমবার সঙ্গে ছিল। সেদিন তো দিদিমণির সঙ্গে অনেকক্ষণ বসে কথাও বলে গেল।
বেয়ারার মনে কোন সন্দেহ জাগে না।
.
১৫.
বেয়ারা চলে গেল।
তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলে সুব্রত উঠে দাঁড়াল।
দোতলায় একটি ঘরেই মাত্র আলো জ্বলতে দেখেছে সুব্রত গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকবার সময়। নিশ্চয়ই ঐ ঘরটাই কুন্তলার। দক্ষিণ দিকের ঘরটা।
পা টিপে টিপে সুব্রত ড্রইংরুম থেকে বেরুল।
একটা হলঘর। এক পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। হলঘরটা অন্ধকার। সিঁড়িতে একটা আলো জ্বলছে স্বল্পশক্তির। চওড়া চওড়া সিঁড়ি ধাপে ধাপে উপরে উঠে গিয়েছে।
সুব্রত সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়!
দোতলার বারান্দা। টানা বারান্দা। টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে বারান্দায়। আলোছায়ার একটা রহস্য যেন।
দক্ষিণদিককার ঘরটায় আলো জ্বলছিল—দেখেছে সুব্রত। সেই দিকেই পা টিপে টিপে এগিয়ে যায়।
কাচের শার্সি দিয়ে ঘরের ভিতরকার আলোর আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু জানালায় পর্দা থাকায় ভিতরের কিছু নজরে পড়ে না।
দরজা-দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সুব্রত। মৃদু ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে তাকাল সুব্রত। কুন্তলা পিছন ফিরে দরজার দিকে দাঁড়িয়ে আছে।
আর একটা টেবিলে প্লেটে খাবার—কে একজন টুলের উপরে বসে গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছে।
লোকটার বয়স বেশি হবে না। সাতাশ-আটাশ বলেই মনে হয়। পরনে একটা পায়জামা ও পাঞ্জাবি, তার উপরে একটা আলোয়ান জড়ানো। একমুখ দাড়ি।
খেতে খেতে একসময় লোকটা বলে, না এমন করে পারছি না কুন্তী।
ইউনিটে তুমি ফিরে যাচ্ছ না কেন?
উপায় নেই। উপায় থাকলে কি যেতাম না!
কিন্তু এভাবে পালিয়ে পালিয়েই বা কতদিন বেড়াবে?
কুন্তলা দেবী!
কে?
চমকে দুজনেই ফিরে তাকায়। যুগপৎ কুন্তলা ও ভবেন্দ্র।
ভবেন্দ্র ততক্ষণে উঠ দাঁড়িয়েছে।
হু-হু ইজ হি? ভবেন্দ্ৰ জিজ্ঞাসা করে বোনকে।
এ কি আপনি-আপনি উপরে এ ঘরে। কুন্তলার স্বরে বিরক্তিটা যেন বেশ স্পষ্টই।
আই অ্যাম ভেরি সরি, অত্যন্ত দুঃখিত মিস রায়। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় ছিল না।
উপায় ছিল না মানে? আপনি না বলে কয়ে—
বললাম তো, অত্যন্ত দুঃখিত-ক্ষমা চাইছি।
ভবেন্দ্র আবার প্রশ্ন করে, বাট হু ইজ দিস জেনটেলম্যান, কুন্তী?
সুব্রত বলে, তাছাড়া আপনি হয়ত জানেন না, ফোনে ওঁর এখানে আসবার সংবাদ পেয়েই আমি এখানে এসেছি!
ফোনে সংবাদ পেয়েছেন?
হ্যাঁ। যারা সর্বক্ষণ এ বাড়ি পাহারা দিচ্ছে তারাই আমাকে ও ইন্সপেক্টার মিঃ সেনকে সংবাদটা দিয়েছে—উনি এখানে এসেছেন।
হঠাৎ কুন্তলার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
মুখের উপরে ক্ষণপূর্বে যে বিরক্তির মেঘটা দেখা দিয়েছিল, তার যেন অবশিষ্ট মাত্রও থাকে না। বরং একটা ভয় একটা উদ্বেগের ছায়া যেন মুখের উপরে ভেসে উঠেছে।
সুব্রত ভবেন্দ্রকে দেখিয়ে বলে, উনি আর এখন পুলিশের অজান্তে এখান থেকে বেরুতে পারবেন না মিস রায়!
কিন্তু কেন—কেন পুলিস ওর গতিবিধির উপরে নজর রেখেছে? একটা চাপা আর্তনাদের মতই যেন প্রশ্নটা কুন্তলার কণ্ঠ থেকে বের হয়ে আসে।
সেটা আপনার ছোড়দাকেই জিজ্ঞাসা করুন না মিস রায়! সুব্রত শান্ত কণ্ঠে বলে।
ভবেন্দ্র একেবারে চুপ।
সে তখনও ঠিক ব্যাপারটা যেন বুঝে উঠতে পারছে না—কে লোকটা। পুলিসের কোন লোক বলে তো মনে হচ্ছে না। সোজা একেবারে বিনা এত্তেলায় অন্দরে চলে এসেছে এবং তার বোনের সঙ্গে যে ভাবে কথা বলছে তাতে করে মনে হচ্ছে পরস্পরের। সঙ্গে ওদের পরিচয়ও আছে।
সুব্রত আবার বলে, তাহলে সেদিন আপনি আমার কাছে সত্যি কথাটা বলেননি মিসেস রায়!
সত্যি কথা বলিনি! কুন্তলা প্রশ্নটা করে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।
তাই নয় কি! আপনি জানতেন আপনার ছোড়দা কলকাতাতেই আছেন!
কুন্তলা একেবারে যেন চুপ এবারে। সুব্রত আবার প্রশ্ন করে, কি, জানতেন না মিস রায়?
কুন্তলা মাথা নিচু করে।
এবার সুব্রত ভবেন্দ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি নিশ্চয় জানেন ভবেন্দ্রবাবু, আপনি আর্মির আইনে একজন ডেজার্টার এবং ডেজার্টারদের মিলিটারি আইনে কোর্টমার্সাল হয়।
ভবেন্দ্ৰ যেন পাথর।
তাছাড়া আপনার মাথায় তো একটা কোর্ট মার্সাল ঝুলছে আপনার রিভলভারটা হারানোর জন্য!
রিভলভার? হঠাৎ কুন্তলা চমকে ওঠে।
হ্যাঁ। জিজ্ঞাসা করুন না আপনার ভাইকে! সুব্রত বলে।
ছোড়দা—
কুন্তলার কথা শেষ হল না—ভবেন্দ্র বললে, হ্যাঁ, হারিয়েছে।
কোথায় হারালো—কি করে হারালো?
কুন্তলা যেন কতকটা চাপা আর্তনাদের সঙ্গে কথাগুলো উচ্চারণ করে।
জানি না—আমি কিছু জানি না। ভবেন্দ্র হঠাৎ বলে ওঠে, তারপর সুব্রতর দিকে তাকায়, চলুন আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন আপনি, চলুন।
ছোড়দা?
কুন্তলা চেঁচিয়ে ডাকে আর্ত গলায়।
ভবেন্দ্র বলে, ফেড আপ-আই অ্যাম ফেড আপ—এভাবে কুকুরের মত পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে আর পারছি না।
সুব্রত হাসল।
না ভবেনবাবু, আপনি একটু ভুল করেছেন—পুলিশ আপনাকে একজন ডেজার্টার হিসেবে খুঁজে বেড়াচ্ছে ঠিকই এবং মিলিটারিও খুজছে, কিন্তু আমি–
সুব্রতকে বাধা দিয়ে ভবেন্দ্র বলে, জানি, জানি—আপনি পুলিসের গোয়েন্দা!
না, তাও আমি নই। পুলিসের বা মিলিটারির লোক আমি নই—আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, আপনাকে আমি সম্পূর্ণ অন্য কারণে কয়েকটা প্রশ্ন করবার জন্যেই এসেছি।
প্রশ্ন?
হ্যাঁ, গত ২৩শে ডিসেম্বর সকাল আটটা থেকে রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন আপনি?
কোথায় ছিলাম? ভবেন্দ্ৰ তাকাল সুব্রতর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, বলুন, কোথায় ছিলেন আপনি?
মানে আমি–
মিঃ রায়, আমি সেই রাত্রের কথাই বলছি যে রাত্রে আগড়পাড়ায় আপনার বাবা রিভলভারের গুলিতে নিহত হন।
হোয়াট? বাবা রিভলবারের গুলিতে নিহত হয়েছেন?
একটা যেন আর্ত চিৎকারের সঙ্গে প্রশ্নটা বের হয়ে আসে ভবেন্দ্রর কণ্ঠ থেকে।
হ্যাঁ, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তাই বলছে-বুলেটও তার ব্রেন ম্যাটারের মধ্যে ইমপ্যাকটেড় হয়ে ছিল-পাওয়া গিয়েছে এবং এক্সপার্টের মত হচ্ছে—গুলিটা ছোড়া হয়েছিল একটা ৩৮ আর্মি রিভলভার থেকে।
নো নো-ইউ মিন–
হ্যাঁ, আপনি একজন মিলিটারির লোক এবং সেই কারণেই ঐ ধরনের একটা রিভলভার আপনার কাছে থাকা সম্ভব বলেই প্রশ্নটা করছি। বলুন-দুর্ঘটনার দিন আপনি সকাল আটটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?
সুব্রতবাবু। কুন্তলা যেন কি বলবার চেষ্টা করে।
তাকে বাধা দিয়ে সুব্রত বলে, ওঁকে বলতে দিন মিস রায়, কোথায় উনি ঐ সময়টা ছিলেন সেদিন!
আমার-আমার এক বন্ধুর বাড়িতে।
বন্ধুর বাড়িতে! কোথায়?
সুব্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ভবেন্দ্রর মুখের দিকে।
দমদম সিঁথিতে—
সকাল আটটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত?
না, বিকেলবেলা শ্যামবাজারে এসেছিলাম সন্ধ্যার শোতে সিনেমা দেখতে একবার।
কেউ এর সাক্ষী আছে?
সাক্ষী? না-সাক্ষী আবার থাকবে কি!
আপনার সেদিনকার সন্ধ্যার শোতে সিনেমা দেখার ব্যাপারে কেউ সাক্ষী থাকলে হয়ত ভাল হত মিঃ রায়! আচ্ছা মিস রায়, আমি চলি—অসময়ে এভাবে আপনাদের এসে বিরক্ত করবার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।
কিন্তু ছোড়দাকুন্তলা তার কথাটা শেষ করতে পারে না।
সুব্রত বলে, উনি যেতে পারেন—আজকের মত ওঁকে কেউ আটকাবে না। তবে ওঁর প্রতি আমার একটা বিশেষ অনুরোধ, উনি যত শীঘ্র পারেন বেরিলিতে ওঁর ইউনিটে ফিরে যান। আচ্ছা চলি-নমস্কার।
সুব্রত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
১৬.
পরেরদিন সকালে।
চায়ের কাপ হাতে করে সুব্রত গতরাত্রের কথাটাই ভাবছিল।
একটা নির্দিষ্ট পথ ধরে সে এ কদিন এগুচ্ছিল, কিন্তু কাল রাত্রে অতর্কিতে ভবেন্দ্রর সঙ্গে নাটকীয়ভাবে সাক্ষাৎ হয়ে যাবার পর সুব্রতর যেন কেন মনে হচ্ছে মহেন্দ্রনাথের হত্যার ব্যাপারটার মীমাংসায় পৌঁছবার জন্য ঘটনাগুলোকে যেভাবে মনে মনে সে এ কদিন ধরে সাজিয়ে নিচ্ছিল হঠাৎ যেন সে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।
মনে হচ্ছে, আবার বুঝি প্রথম থেকে ভাবতে হবে—নতুন করে শুরু করতে হবে।
একটা সিগারেট ধরালো সুব্রত।
কিন্তু কোথা থেকে কি ভাবে শুরু করা যায়?
হঠাৎ মনে পড়ল কিরীটীকে।
কিরীটীর পরামর্শ নিলে কেমন হয়? কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুব্রত উঠে পড়ল। গায়ে জামা দিয়ে বের হয়ে পড়ল।
কিরীটীর ওখানে গিয়ে যখন পৌঁছল, কিরীটী তখন সবে প্রথম কাপ চা শেষ করে দ্বিতীয় কাপটা হাতে তুলেছে।
সামনে বসে কৃষ্ণা।
দিন দুই হল কিরীটীর ইনফ্লুয়েঞ্জা মত হয়েছে, কালও জ্বর ছিল, আর জ্বর নেই।
সুব্রতকে ঘরে ঢুকতে দেখ কিরীটী তার মুখের দিকে তাকাল।
সুব্রত এসে একটা সোফায় বসল নিঃশব্দে।
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করে, চা দেবো?
দাও। মৃদুকণ্ঠে সুব্রত বলে।
কি রে, একটু যেন চিন্তিত মনে হচ্ছে! কিরীটী এইবার প্রশ্ন করে সুব্রতকে।
কৃষ্ণা চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বলে, কদিন আসনি যে?
সে-কথার জবাব না দিয়ে সুব্রত মৃদুকণ্ঠে ডাকে কিরীটী—
উঁ!
একটা মার্ডার কেস নিয়ে গত কদিন ধরে হিমসিম খেয়ে আছি ভাই।
গত দশদিনের মধ্যে কই মনে তো পড়ে না, সংবাদপত্রে একটিমাত্র বিশেষ মৃত্যুর ব্যাপার ছাড়া আর কোন দুর্ঘটনার কথা পড়েছি! কিরীটী বলে।
না না রে, দুর্ঘটনার নয়-রীতিমত একটা মার্ডার কেস—
মার্ডার কেস?
হ্যাঁ।
কবে ঘটল?
গত ২৩ শে ডিসেম্বর শনিবার রাত্রে
তুই কি সেই আগড়পাড়ার রেল স্টেশনের কাছে কে একজন ধনী বিজনেসম্যান–
হ্যাঁ, আমি মহেন্দ্রনাথ রায়ের হত্যার কথাই বলছি।
কিরীটী চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে, আমিও সংবাদপত্রে পড়েছি। পড়ে মনে হচ্ছিল সামথিং মিস্টিরিয়াস-তারপর শুনলাম আই জি-র কাছে ময়নাতদন্তে মৃতের মাথার মধ্যে নাকি বুলেট পাওয়া গিয়েছে!
হ্যাঁ, সমস্ত ব্যাপারটা শুনলে হয়ত তুই বুঝতে পারবি-হাউ ব্রট্যালি হি ওয়াজ মার্ডার্ড। মনে হচ্ছে অর্থের জন্যই লোকটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
সুব্রত একটানা কথাগুলো বলে যায়।
তোর ধারণা তাহলে ভদ্রলোককে সত্যি-সত্যিই নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে?
অন্তত আমার তো তাই ধারণা। ঘটনাটা তোকে খুলে বলি শোন। সব আগাগোড়া শুনলে হয়ত তুই বুঝতে পারবি।
সুব্রত অতঃপর সমস্ত ঘটনাটা গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বলে যায়।
পাইপটায় অগ্নিসংযোগ করে পাইপটা টানতে টানতে কিরীটী আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনাটা শুনে যায়।
সমস্ত কাহিনী শোনার পর কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে যেন কি ভাবে।
তারপর মৃদুকণ্ঠে কেবল একটা শব্দই উচ্চারণ করে, হুঁ।
কিন্তু আরও কিছু যে ঘটনার মধ্যে ঈঙ্গিত দিচ্ছে ভায়া। কিরীটী আবার বলে একটু থেমে।
ইঙ্গিত? আরও কিছুর?
হুঁ।
কীসের ইঙ্গিত?
পঞ্চশরের ব্যাপার!
সে আবার কি?
কিরীটী মৃদু কণ্ঠে এবার বলে, ঐ কুন্তলা দেবী!
কুন্তলা দেবী?
হুঁ, তোর মনে যে ভাবে রেখাপাত করেছেন ভদ্রমহিলা—
রাবিশ! সুব্রত বলে ওঠে।
রাবিশ নয় বন্ধু—নামের দিকে তাকিয়ে দেখ ঐ রাবিশের তলাতেই মনিরত্ন লুকিয়ে আছে—
দেখ, তোর কাছে কোথায় এলাম একটা পরামর্শ নিতে, না তুই ইয়ার্কি শুরু করে দিলি-সুব্রতর কণ্ঠে একটা উষ্মর আভাস ফুটে ওঠে যেন।
কণ্ঠের তোর ঐ উম্মার সুর কিন্তু বন্ধু অন্য রাগ প্রকাশ করছে!
কৃষ্ণা হেসে ওঠে।
হাসছ কি, কিরীটী বলে স্ত্রীর দিকে চেয়ে, বরণডালা সাজাও! না সুব্রত, যাত্রা তোর এবারে সত্যি মাহেন্দ্ৰ ক্ষণেই হয়েছে মহেন্দ্রভবনে বলতেই হবে।
তাহলে তুই ইয়ার্কি কর, আমি চলি।
সুব্রত উঠে দাঁড়ায়।
আরে বোস্—আমিও তোর সঙ্গে একমত।
একমত।
হ্যাঁ, ভদ্রলোককে সত্যিসত্যিই গুলি করে হত্যা করে ব্যাপারটাকে একটা অ্যাক্সিডেন্টের রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।
তুইও তাহলে তাই মনে করিস?
হ্যাঁ, তবে কতকগুলো, জিনিস তুমি এড়িয়ে গিয়েছ বন্ধু।
এড়িয়ে গিয়েছি?
হ্যাঁ।
কি?
প্রথম অর্থাৎ ১নং, ডাঃ নলিনী চৌধুরীর দুই বন্ধুকে লেখা ব্যাঙ্কে ডিপোজিট দেওয়া চিঠি দুটো।
কিন্তু–
ত্রিকোণাকার সেই পৃথক দুখণ্ড কাগজকে একত্রে জোড়া দাও, হয়ত কোন রহস্যের হদিস পাবে। তারপর ২নং–
কি?
একটি টাপরাইটিং –
ইপরাইটিং মেশিন।
হ্যাঁ, এই হত্যার ব্যাপারে বিশেষ ক্লু ঐ মেশিনটি, যেহেতু চিঠিটা টাইপ করা ছিল। তারপর ৩নং রিভালভারটি—সেটারও প্রয়োজন।
সেটা—
পেতে হবে। আর ঐ সঙ্গে ৪নং সুরেন্দ্রনাথের এই কদিনের মুভমেন্ট!
আর কিছু?
হ্যাঁ। ৫নং, ডাঃ চৌধুরীর কোন উইল ছিল কিনা।
আচ্ছা ঐ মিঃ গাঙ্গুলী সম্পর্কে তোর কি মনে হয় কিরীটী?
না, সে ভদ্রলোক খুন করেন নি—নির্দোষ।
আমারও তাই মনে হয়।
তবে—
কি?
গাঙ্গুলী সাহেবের উপর যে কোনও মুহূর্তে অতর্কিতে আঘাত আসাটা খুব একটা কিছু বিচিত্র নয় কিন্তু–
কেন?
তার কারণ ডাঃ চৌধুরীর চিঠির অর্ধেক তার নামে ছিল। ভাল কথা, ডাঃ চৌধুরীর সে চিঠির অংশটা মানে মিঃ গাঙ্গুলীর অংশটা তো তারই কাছে আছে, তাই না? কিরীটী কথাটা বলে সুব্রতর মুখের দিকে তাকায়।
হ্যাঁ। সঙ্গে দুটোর কপিই আছে-এই যে।
মিঃ গাঙ্গুলীর চিঠিটা ও মিঃ রায়ের চিঠির নকল যেটা মিঃ গাঙ্গুলীর কাছে পেয়েছিল সুব্রত দুটোই পকেট থেকে বের করে কিরীটীকে দেয়।
দেখি! কিরীটী কাগজ দুটো হাতে নিল।
দেখতে থাকে। তারপর নিঃশব্দে গম্ভীর মনোযোগের সঙ্গে কাগজ দুটো সামনে টেবিলের উপরে মেলে ধরে।
সুব্রত কিরীটীকে প্রশ্ন করে, কিছু বুঝতে পারছিস?
আপাতত পারছি না বটে, তবে–
তবে? এটা একেবারে অর্থহীন নয়। কিছুর ইঙ্গিতই দিচ্ছে যেন মনে হয়। আমাকে একটা দিন ভাবতে দে সুব্রত, কাল সন্ধ্যায় বরং আসিস একবার।
বেশ, আমি তাহলে এখন উঠি।
আয়। তবে যে পয়েন্টগুলো বললাম মনে রাখিস।
সুব্রত কোন কথা না বলে নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুব্রতর গমনপথের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মৃদুকণ্ঠে কিরীটী আবৃত্তি করে, পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি সন্ন্যাসী–বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে—
.
হঠাৎ সেদিন বিকেলের দিকে অসময়ে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। সেই সঙ্গে ঝড়ো হাওয়ার শনশনানি।
সুব্রত আর কোথাও বের হল না।
তাড়াতাড়ি আহার শেষ করে শয্যায় আশ্রয় নেয়। এবং ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুমটা ভেঙে গেল রাত বারোটা নাগাদ ক্রমাগত টেলিফোনের শব্দে।
ক্রিং ক্রিং—ক্রিং।
আঃ! বিরক্ত হয়ে সুব্রত লেপের তলা থেকে উঠে গিয়ে ফোন ধরে।
হ্যালো—
কে, মিঃ রায়? আমি মৃণাল সেন কথা বলছি।
কি ব্যাপার!
কিছুক্ষণ আগে আগরপাড়া থানা থেকে চ্যাটার্জী ফোন করেছে। মিঃ গাঙ্গুলীর সলিটারি কর্নারের উপরে যাকে ওয়াচ রাখতে বলা হয়েছিল সে খবর দিয়েছে চ্যাটার্জীকে–গাঙ্গুলী নাকি আত্মহত্যা করেছে।
সে কি!
হ্যাঁ। আমি যাব। আপনি যাবেন?
নিশ্চয়ই, আপনি আমায় তুলে নিয়ে যেতে পারবেন?
পারি।
তাহলে আসুন—আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।
তাহলে কিরীটীর গতকালের ভবিষ্যৎবাণী ফলে গেল!
ফোনটা রেখে দিল সুব্রত। বাইর তখনও বৃষ্টি ঝরছে। সুব্রতর মনে পড়ে ঐদিনের আগের দিন সন্ধ্যারাত্রের কিরীটীর কথাগুলো। কিরীটী বলছিল গাঙ্গুলী সাহেবের উপরেও যে কোন মুহূর্তে আঘাত আসাটা কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু! কথাটা যে সুব্রতর একেবারে মনে হয়নি তা নয়।
কিন্তু সেটা এত তাড়াতাড়ি ফলে গেল! তবে কি সত্যিসত্যিই ঐ চিঠির অঙ্কগুলোর মধ্যে কিছু আছে? এবং গাঙ্গুলী আত্মহত্যা করেনি, নিহত হয়েছে?
মিনিট পনেরোর মধ্যেই মৃণাল সেন পুলিস ভ্যান নিয়ে এসে গেল।
বাইরে তখনও সমানে ঝড়বৃষ্টির তাণ্ডব চলেছে। শিগগির কমবার কোন সম্ভাবনাই নেই। ওদের গাড়ি খালি রাস্তা ধরে বৃষ্টির মধ্যেই যথাসম্ভব স্পিডে আগরপাড়ার দিকে ছুটে চলে।
চলন্ত গাড়িতে বসেই একসময় মৃণাল সেনকে সুব্রত প্রশ্ন করে, কি ব্যাপার? চ্যাটার্জী। ফোনে আপনাকে কি বলেছেন?
সুব্রত প্রশ্নটা করে মৃণাল সেনের মুখের দিকে তাকাল।
মৃণাল সেনকে ফোনে যা জানিয়েছিলেন জলধর চাটুজ্যে–সংক্ষেপে সুব্রতকে সব কথা জানায় সে।
.
১৭.
সন্ধ্যা থেকে আগরপাড়াতেও জলঝড় শুরু হয়।
বিকালের দিকে একবার গাঙ্গুলীর পান্থনিবাসে গিয়েছিলেন, বোধ হয় কফি পান। করতে এবং জলঝড়ের সম্ভাবনা দেখে তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন সলিটারিী কর্নারে কিছুক্ষণের মধ্যেই।
তার পরই ঝড়-বৃষ্টি শুরু।
রাজেশ বলে যে ছেলেটি ওয়াচ করছিল বাড়িটা-ঝড়বৃষ্টির জন্য তাড়াতাড়ি গিয়ে পান্থনিবাসে আশ্রয় নেয়। ঘণ্টা দুই পরে ঝড়বৃষ্টি একটু কমে। তখন সে আবার পান্থনিবাস থেকে বের হয়ে সলিটারি কর্নারের দিকে যায়।
বৃষ্টি তখন টিপ টিপ পড়ছে। বাড়ির কাছে গিয়ে দেখে বাড়িটা অন্ধকার।
প্রথমে রাজেশ ভেবেছিল, ঝড়-বৃষ্টির জন্যে বোধ হয় তাড়াতাড়ি মিঃ গাঙ্গুলী খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছেন।
কিন্তু তারপরই হঠাৎ নজরে পড়ে, বাড়ির সদর দরজাটা হা-হা করছে খোলা। হাওয়ায় খুলছে আর শব্দ করে বন্ধ হচ্ছে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক এবং রাজেশকে যেন কেমন সন্দিগ্ধ করে তোলে।
সে এগিয়ে যায় খোলা দরজা দিয়ে, ভিতরে গিয়ে ঢোকে। কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢোকবার পর সেখানেও দেখে অন্ধকার। কারও কোন সাড়া-শব্দ নেই—যেন একটা পরিত্যক্ত হানাবাড়ি।
অবশেষে রাজেশ টর্চের আলোর সাহায্যে মিঃ গাঙ্গুলীর ঘরে গিয়ে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ায়।
ঘরের এক কোণে একটা রাইটিং টেবিল। তার সামনে চেয়ারে বসে গাঙ্গুলী, তাঁর মাথাটা টেবিলের উপরে ন্যস্ত। বাঁ হাতটা টেবিলের উপরে বিস্তৃত এবং ডান হাতটা অসহায়ের মত ঝুলছে। সেই হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা একটা রিভলবার।
টেবিলের কাচের উপরে রক্ত জমাট বেঁধে আছে অনেকটা জায়গা নিয়ে। সোফাতেও কিছু গড়িয়ে পড়েছে। কপালের মাঝামাঝি একটা বেশ বড় রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন।
ঘরের সব জানালাগুলো বন্ধ। পিছনের বাগানের দিককার জানালাটা খোলা। আর ঘরের দরজাটাও খোলা।
সুব্রত জিজ্ঞাসা করে, মিঃ গাঙ্গুলীর চাকরটা কোথায় ছিল ঐ সময়? সে তখন ছিল না।
ছিল না মানে?
বাইরে গিয়েছিল এবং একটু পরেই ফিরে আসে। সে নাকি দুপুরের দিকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় তার এক জ্ঞাতি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
তাহলে বাড়িতে কেউ ছিল না ঐ সময়ে একমাত্র মিঃ গাঙ্গুলী ছাড়া?
না।
তারপরই একটু হেসে মৃণাল সেন বলে, তখন যদি মিঃ গাঙ্গুলীকে আপনি অ্যারেস্ট করতে দিতেন সুব্রতবাবু, তবে হয়ত এভাবে মিঃ গাঙ্গুলী আমাদের ফাকি দিতে পারতেন না। ধরা পড়বার ভয়েই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করলেন হয়ত ভদ্রলোক।
মিঃ সেন—সুব্রত বলে, মহেন্দ্রনাথের হত্যাকারী উনি নন।
এখনও আপনি তাই বলছেন?
হ্যাঁ।
তবে কে?
আর যেই হোক, আপাতত বলতে পারি মিঃ গাঙ্গুলী নন।
মৃণাল সেন অতঃপর চুপ করে থাকে।
.
ওরা যখন আগরপাড়া থানায় এসে পৌঁছল রাত তখন সোয়া একটা।
বৃষ্টি থেমে গিয়েছে।
তবে হাওয়া একেবারে থামেনি। হাওয়া চলেছে।
জলধর চাটুজ্যে ছিলেন না, থানার ছোটবাবু সুশীল সোম ছিলেন।
তিনি বললেন, স্যার, আপনাদের বড়বাবু সোজা সলিটারি কর্নারে চলে যেতে বলেছেন।
ওরা তখনই আবার সলিটারি কর্নারের দিকে গাড়ি ছোটায়।
ওরা যখন সলিটারি কর্নারে গিয়ে পৌঁছল, জলধর চাটুজ্যে নানাভাবে তখনও মিঃ গাঙ্গুলীর ভৃত্যকে ক্রস করছিলেন।
লোকটা জবাব দিচ্ছে আর কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল মুছছে।
মৃণাল সেনকে দেখতে পেয়ে জলধর চাটুজ্যে বলেন, এ নিশ্চয় আমার মনে হয় মিথ্যে বলছে, সেন সাহেব। ও ঝড়জলের আগেই ফিরে এসেছে।
সুব্রত একবার লোকটার দিকে তাকিয়ে যে ঘরে মৃতদেহ ছিল সেই ঘরে গিয়ে ঢুকল।
.
সত্যিই করুণ দৃশ্য।
টেবিলের সামনেই নিচে মেঝেতে একটা বই পড়ে আছে। একটা নামকরা ইংরেজী উপন্যাস। সেই উপন্যাসের মলাটের উপরেও কয়েকটা রক্তের ফোঁটা জমাট বেঁধে আছে।
মৃণাল সেন বলে, মনে হচ্ছে ও ক্লিয়ার কেস অফ সুইসাইড। বোধ হয় পড়তে পড়তে এসময় ডিসিশন নেন, তারপরই রিভলবারটা বের করে নিজের মাথায় গুলি করেছেন।
সুব্রত মৃদুকণ্ঠে বলে, একটু যেন অস্বাভাবিক মনে হয় ব্যাপারটা মিঃ সেন!
কি?
পড়তে পড়তে হঠাৎ সুইসাইড করা। তাছাড়া সে রকম হলে বইটা মাটিতে না পড়ে হয়ত টেবিলের উপরেই থাকত!
তারপই হঠাৎ মেঝের দিকে তাকিয়ে সুব্রত বলে, সারা ঘরময় এত পোড়া কাগজ কেন বলুন তো?
সত্যিই তো ঘরময় পোড়া কাগজ!
সুব্রত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে দেখতে পেল, ঘরের কোণে কি যেন পোড়ানো হয়েছে। তার সুস্পষ্ট চিহ্নও রয়েছে।
এগিয়ে গেল সুব্রত সেদিকে।
কিছু আধপোড়া কাগজও তখনও সেখানে পড়ে আছে।
কৌতূহলভরে সুব্রত আধপোড়া কাগজগুলো তুলে নিল।
বিক্ষিপ্তভাবে চোখে পড়ল কতকগুলো অঙ্ক, সেই পোড়া কাগজের বুকে-১৫, ২১, ২০, ১৩ ইত্যাদি।
হঠাৎ মনে পড়ে সুব্রতর। অঙ্কগুলো তার পরিচিত।
ভাবতে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে সেই চিঠি দুটোর কথা। ডাঃ চৌধুরীর লেখা দুই বন্ধুকে দুখানা চিঠি।
কিরীটী বলেছিল সেদিন একটা কথা, একেবারে অর্থহীন নয়—কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে যেন মনে হয়!
তবে কি মিঃ গাঙ্গুলী মরার আগে ঐ অঙ্কগুলো থেকে কোন কিছুর ইঙ্গিত পেয়েছিলেন?
রহস্য যেন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
আবার মনে হয় সুব্রতর, মৃণাল সেন যা বলেছে তাও তো হতে পারে, হয়ত মিঃ গাঙ্গুলী আত্মহত্যাই করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হয়, আত্মহত্যাই বা হঠাৎ তিনি করতে যাবেন কেন? তিনি তো মিঃ রায়ের হত্যাকারী নন? তবে?
আরও কতকগুলো প্রশ্ন ঐ সঙ্গে মনের মধ্যে জাগে। বইটা মাটিতে কেন? পোড়া কাগজগুলো কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? ঘরের দরজাটা ও সদর দরজাটা খোলা ছিল কেন? ঘরটা অন্ধকার ছিল কেন?
আরও কিছুক্ষণ পরে মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্যে পাঠাবার ব্যবস্থা করে এবং সলিটারি কর্নারে পুলিস প্রহরা রেখে মৃণাল ও সুব্রত ফিরে এল।
মিঃ গাঙ্গুলীর ভৃত্যকে আরেস্ট করা হল।
.
গৃহে ফিরে প্রথমেই সুব্রত কিরীটীকে ফোন করল।
কি খবর? কিরীটী শুধায়।
সলিটারি কর্নারের ব্যাপারটা সুব্রত বললে।
কি মনে হয় তোর কিরীটী, আত্মহত্যা?
না, আত্মহত্যা নয়।
আমারও তাই মনে হয়েছে। আর একটা মার্ডার!
তোর অনুমান মিথ্যা নয় বলেই মনে হয় সুব্রত।
.
পরের দিনই ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়া গেল।
পুলিস সার্জেন ডাঃ মজুমদার রিপোর্ট দিয়েছেন, মৃণাল সেন রিপোর্টটা নিয়ে এসেছেন। মৃত গাঙ্গুলীর ব্রেনের মধ্যে বুলেট পাওয়া গিয়েছে।
বুলেট! সুব্রত বলে।
হ্যাঁ, দেখুন। পকেট থেকে একটা বুলেট বার করে দেয় মৃণাল সেন।
সুব্রত দেখল একই ধরনের বুলেট।
মিঃ সেন! সুব্রত ডাকে।
বলুন?
মৃণাল সেন তাকাল সুব্রতর মুখের দিকে।
মৃতদেহের হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা যে রিভলবারটা পাওয়া গিয়েছিল সেটা কোথায়?
লালবাজারে আছে।
চলুন, সেটা নিয়ে একবার মেজর সিনহার ওখানে যাওয়া যাক।
বেশ তো, চলুন।
দুজনে উঠে পড়ে। সোজা দুজনে লালবাজারে যায়।
সেখান থেকে রিভলবারটা নিয়ে মেজর সিনহার গৃহে যায়।
.
মেজর ওদের দেখে বলেন, কি ব্যাপার? সুব্রতবাবু, উনি—
ইন্সপেক্টার মৃণাল সেন। আপনাকে আবার একটু বিরক্ত করতে এলাম।
কি ব্যাপার!
সেই বুলেটটার কথা আপনার মনে আছে, মেজর?
আছে বৈকি! রিভলবারটা ট্রেস করতে বলেছিলাম, পাওয়া গেল?
হ্যাঁ।
পাওয়া গেছে?
সুব্রত তখন রিভলবার ও দ্বিতীয় বুলেটটা বের করে মেজরের হাতে দিয়ে বলে দেখুন তো মেজর এ দুটো পরীক্ষা করে!
মেজর সিনহা প্রথমে বুলেটটা পরীক্ষা করলেন-তারপর রিভলবারটা।
হুঁ এ তো দেখছি ৩৮ ওয়েবলি রিভলবার। আর এখন বুঝতে পারছি—
কি?
কেন-কেন-হোয়াই–বুলেটটার গায়ে দাগ পড়েছিল!
কেন? রিভলবারের ব্যারেলের ভিতরটা কোন কারণে ড্যামেজড হয়েছে।
ড্যামেজড।
হ্যাঁ, মনে হয় অ্যাসিড বা ঐ জাতীয় কোন কিছুর অ্যাকশনে ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে, তাইতেই এই রিভলবার থেকে নিক্ষিপ্ত বুলেটের গায়ে অমন খাঁজ কেটে গিয়েছে।
তার মানে, মেজর আপনি বলতে চান—দিস ইজ দি রিভলবার
হ্যাঁ, সুব্রতবাবু। আমার স্থির ধারণা, এই রিভলভার থেকেই ঐ দুটো বুলেট ছোড়া হয়েছে।
ধন্যবাদ মেজর। আমি নিশ্চিন্ত হলাম।
সুব্রত বললে। তারপর মৃণাল সেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, চলুন মিঃ সেন, ওঠা যাক। মে
জরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজনে বাইরে এসে গাড়িতে উঠে বসে।
মিঃ সেন! সুব্রত ডাকে।
বলুন।
আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।
কি?
আজই বেরিলিতে ভবেন্দ্র রায়ের ইউনিটে একটা জরুরি তার পাঠান। ঐ রিভলবারের নম্বরটা দিয়ে ৫৬৩৭৭৯ সুবেদার মেজর ভবেন্দ্র রায়ের যে রিভলবারটা হারিয়েছে সেটারও ঐ নম্বর কিনা এবং ভবেন্দ্ৰ ইউনিটে ফিরে গিয়েছে কিনা খবর নিন।
নিশ্চয়ই-আজই পাঠাব।
দুদিনের মধ্যেই তারের জবাব এল।
যে রিভলবারটা ভবেন্দ্রর কাছ থেকে খোয়া গিয়েছে তার নম্বর ঐ একই অর্থাৎ ৫৬৩৭৭৯ এবং ওয়েবলি ৩৮ রিভলবার।
আর জানালেন ভবেন্দ্ৰ ইউনিটে ফিরে গিয়েছে গতকালই। সে এখন ওপন অ্যারেস্ট আছে। কোর্ট অফ এনকোয়ারি শীঘ্রই বসবে।
মিঃ সেন প্রশ্ন করে, তবে কি ঐ ভবেন্দ্ৰই, সুব্রতবাবু–
কি?
তার বাপকে হত্যা করেছে?
না। সুব্রত মৃদু হাসল।
না—তবে কে?
দু-একদিনের মধ্যেই আশা করি জানতে পারবেন।
আমি তাহলে এবারে উঠি।
আসুন।
মৃণাল সেন অতঃপর বিদায় নিল।
.
সুব্রত বলেছিল, হত্যাকারী কে দু-একদিনের মধ্যেই জানা যাবে কিন্তু তার প্রয়োজন হল না।
ঐদিনই রাত্রে ঘটনাটা ঘটল। সুব্রত একাকী তার ঘরের মধ্যে বসে একটা রহস্য উপন্যাস পড়ছিল।
সন্ধ্যার সময় অনেকক্ষণ ধরে কিরীটীর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। অনেক আলোচনা হয়েছে।
সবশেষে কিরীটী বলেছে, অঙ্কগুলোর রহস্য বোধ হয় সভ করতে পেরেছি।
সুব্রত শুধিয়েছিল, কি রহস্য?
কিরীটী জবাব দিয়েছে, আর দুটো দিন ভাবতে চাই। তারপর—
সুব্রতবাবু!
কে? সুব্রত চমকে সামনের দিকে তাকায়।
এ কি, আপনি! এত রাত্রে, কি ব্যাপার। আসুন আসুন, দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে কেন, ভিতরে আসুন।
সুব্রত সাদর আহ্বান জানায়।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কুন্তলা। কখন সে এসে দাঁড়িয়েছে সুব্রত টেরই পায়নি।
গায়ে একটা দামী কাশ্মীরী শাল। শালটা মাথায় ঘোমটার মত করে তুলে দেওয়া। কুন্তলা এসে ঘরে ঢুকল।
বসুন।
কুন্তলা সামনের খালি চেয়ারটার উপরে বসে।
ছোড়দাকে আপনি বাঁচান সুব্রতবাবু—কথাটা বলতে বলতে দুহাতের মধ্যে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে কুন্তলা।
.
১৮.
কুন্তলা কাঁদছে। সুব্রত ঘটনার আকস্মিকতায় নিজেকে যেন অত্যন্ত বিব্রত বোধ করে। কি বলবে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না।
কেবল মৃদুকণ্ঠে কুন্তলাকে অনুরোধ জানায়, কুন্তলা দেবী, আমাকে সব কথা খুলে বলুন।
কুন্তলা কোন জবাব দেয় না, কাঁদতেই থাকে ফুলে ফুলে।
প্লীজ বলুন।
ধীরে ধীরে কুন্তলা এবার মুখ তুলল।
তার চিবুক ও গণ্ড অশ্রুতে প্লাবিত। দুচোখের কোণে তখনও টলমল করে অশ্রু।
সুব্রতবাবু!
বলুন।
ছোড়দা–ছোড়দা সেদিন আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছিল।
আমি তা জানি কুন্তলা দেবী। শান্তকণ্ঠে সুব্রত জবাব দেয়।
জানেন?
জানি বৈকি। আর এও জানি গত ২৩শে ডিসেম্বর আপনার ভাই সমস্ত দিন সিঁথিতে তার যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন সেখানে ছিলেন না—এবং তিনি যে আমাকে বলেছিলেন সে-রাত্রে ঐ সময় সিনেমাতে গিয়েছিলেন তাও মিথ্যা।
মিথ্যা!
হ্যাঁ, মিথ্যা বলেছিলেন তিনি। এবং যতক্ষণ না তিনি বলছেন ২৩শে ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন ততক্ষণ তার উপর থেকে পুলিসের সন্দেহটা কিছুতেই যাবে না। বিশেষ করে যখন জানা গিয়েছে তারই রিভলবারে আপনার বাবা ও মিঃ গাঙ্গুলী উভয়েরই মৃত্যু হয়েছে।
হ্যাঁ, ইন্সপেক্টার আমাদের বাড়িতে সন্ধ্যায় গিয়েছিলেন, তিনিও তা বলে এলেন। কিন্তু আমি আপনাকে বলছি সুব্রতবাবু, ছোড়দার চরিত্রে যত দোষই থাক, সে জুয়া খেলে, বেহিসাবী, অসংযমী—কিন্তু সে বাবাকে হত্যা করেনি। তার মনটা এত সফ্ট, এত কোমল–
কিন্তু পুলিস তো মনের খবর নিয়ে কাজ করে না কুন্তলা দেবী, আর করবেও না। তারা ফ্যাক্ট নিয়ে সব বিচার করে।
সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ছোড়দা কোথায় ছিল জানি না। কিন্তু—
কি বলুন, থামলেন কেন?
বোধ করি তখন সাড়ে এগারোটা হবে, ছোড়দা আমার কাছে এসেছিল সে রাত্রে গড়িয়াহাটার বাড়িতে—সে সময় পরনে ছিল তার মিলিটারি ইউনিফর্ম! মাথার চুল এলোমেলো। চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল। কেমন যেন অস্বাভাবিক চেহারা।
তারপর?
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কোথা থেকে আসছে সে? এত রাত্রে বেরিলি থেকে নাকি?
আচ্ছা, সদর দিয়ে সে-রাত্রে বাড়িতে ঢুকেছিল কি?
না, পিছনের পাঁচিল টপকে।
তারপর?
সে বলল, না, বেরিলি থেকে সে আট-দশদিন হল এসেছে। ছুটি নিয়ে এসেছে।
বলেছিল ছুটি নিয়ে এসেছে?
হ্যাঁ, বলেছিল। আরও বলেছিল চাকরি করতে আর ভাল লাগছে না।
তারপর?
আমি তখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন বাড়িতে ওঠেনি? তাতে বলেছিল—
কি?
বাড়িতে আর সে কোন দিনও আসবে না। বাবা নাকি তাকে বাড়িতে আসতে নিষেধ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেদিন আপনি চলে আসবার পর বললে, সে আমার কাছে মিথ্যে বলেছিল। ছুটি নিয়ে আসেনি। পালিয়ে এসেছে।
আর—আর কিছু আপনার ছোড়দা আপনাকে বলেনি?
না।
কিন্তু আমি জানি—
কি?
কিছু সে আমার কাছে গোপন করেছে। কিন্তু যাই সে গোপন করে থাকুক না কেন, বাবাকে সে হত্যা করেনি আপনি বিশ্বাস করুন সুব্রতবাবু।
সুব্রত চুপ করে কি যেন ভাবে।
কুন্তলা আবার বলে, ছোড়দাকে আপনি বাঁচান সুব্রতবাবু!
আপনি অধীর হবেন না, শান্ত হোন।
কিন্তু আগে আপনি বলুন, ছোড়দাকে আপনি বাঁচাবেন?
ঢং করে রাত্রি সাড়ে বারোটা ঘোষণা করল ঐ সময়।
রাত অনেক হয়েছে—চলুন, উঠুন-বাড়ি যান এবার। সুব্রত বলে।
কুন্তলা উঠে দাঁড়ায়। কীসে এসেছেন? সুব্রত শুধায়।
ট্যাক্শিতে।
ছি ছি, এত রাত্রে এই যুদ্ধের সময় একা একা ট্যাকশিতে এসেছেন! খুব অন্যায় করেছেন—চলুন, আমি আপনার সঙ্গে যাব।
না, না—আমি একাই যেতে পারব। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
কষ্ট নয়—আপনাকে এত রাত্রে একা একা আমি ছেড়ে দিতে পারি না। সুরেনের ভাইঝি আপনি, তাছাড়া এসময় এত রাত্রে ট্যাকশিও আপনি পাবেন না।
সুব্রত অতঃপর জামাটা গায়ে দিয়ে গাড়ির চাবিটা নিয়ে বললে, চলুন—
গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে গাড়ির দরজা খুলে সুব্রত কুন্তলাকে ডাকে, আসুন উঠুন।
কুন্তলা গাড়িতে উঠে বসল।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ হলেও শহরে তখনও বেশ শীত। শীতের আকাশ—কিন্তু কুয়াশার লেশমাত্রও ছিল না, কৃষ্ণা-চতুর্দশীর চাদ আকাশে। ম্লান চাঁদের আলোয় যেন প্রকৃতি মূৰ্ছাতুরা। খাঁ খাঁ করছে রাস্তা।
সুব্রতর গাড়ি হ্যারিসন রোড দিয়ে শিয়ালদহ হয়ে সার্কুলার রোডে পড়ে। পাশেই একেবারে গা ঘেঁষে কুন্তলা। গাড়ির খোলা জানালাপথে হাওয়ায় কুন্তলার চুল উড়ছে। মৃদু একটা ল্যাভেন্ডারের গন্ধ নাকে আসে।
এ পথ যদি না ফুরাত! সুব্রতর মনে হয়, যদি অন্তহীন এ পথ হত! আর এমনি করে কুন্তলা তার পাশে থাকত।
ছি, এসব কি ভাবছে সে! মাথা তার খারাপ হয়ে গেল নাকি!
কুন্তলা দেবী!
বলুন?
আপনি কিন্তু খুব অন্যায় করেছেন।
অন্যায় করেছি! কুন্তলা ফিরে তাকায় পার্শ্বে উপবিষ্ট সুব্রতর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, করেছেন! কতটুকু বা আমার সঙ্গে আপনার পরিচয়, বলুন তো? হুট করে। এত রাত্রে আমার ওখানে চলে এসেছেন–
আমি জানতাম।
কি?
আপনার কাছে যেতে কারোরই কোন ভয়ের কারণ থাকতে পারে না।
জানতেন?
হুঁ।
কি করে জানলেন?
পুরুষকে চিনতে কোন মেয়েরই ভুল হয় না। কিন্তু আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।
অনুরোধ!
হ্যাঁ, কাকামণির বন্ধু আপনি-আমাকে আপনি বলবেন না আর—
কিন্তু—
‘তুমি’ বলবেন।
বেশ। একটু থেমে আবার সুব্রত বলে, একটা কথা বলব?
কি?
সেদিন অমন করে হঠাৎ রাত্রে তোমার ঘরে গিয়ে ঢুকেছিলাম বলে তুমি আমার ওপরে খুব রেগে গিয়েছিলে, না?
হ্যাঁ।
আমার তো ভয়ই হয়েছিল, এখুনি বুঝি দারোয়ান ডেকে বাড়ি থেকে আমাকে বের করে দেবে।
কুন্তলা চুপ করে থাকে।
কিন্তু এখন আর রাগটা নেই তো?
কুন্তলা কোন জবাব দেয় না।
সে রাত্রে কুন্তলাকে তাদের গড়িয়াহাটার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেল সুব্রত।
.
১৯.
অপঘাতে মৃত্যু হলেও নিয়মমাফিক মহেন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধ-শান্তি চুকে গেল।
কুন্তলাই শ্রাদ্ধ করল।
সুব্রত সেদিন গিয়েছিল কুন্তলার নিমন্ত্রণে তাদের গড়িয়াহাটার বাড়িতে।
তারপর আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল। মহেন্দ্রনাথের হত্যার ব্যাপারটা যেন। কেমন চাপা পড়ে গিয়েছিল।
ইতিমধ্যে আরও দুদিন সুব্রত কুন্তলাদের ওখানে গিয়েছিল। কুন্তলার সঙ্গে বসে বসে গল্প করেছে।
বেরিলিতে ভবেন্দ্রর কোর্ট অফ এনকোয়ারি চলছে—শেষ হয়নি।
সেদিন সন্ধ্যায় কুন্তলা তার শোবার ঘরে বসে একটা উলের বুননি নিয়ে আত্মমগ্ন ছিল। হঠাৎ পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখে দাঁড়িয়ে সামনেই তার নীরেন।
কুন্তলা!
তুমি!
হ্যাঁ। নীরেন ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
কুন্তলা, আমি কিন্তু আজ একটা বিশেষ কথা জানাবার জন্যই এসেছি।
কুন্তলা তাকাল নীরেনের মুখের দিকে।
বুঝতে পারছ বোধ হয়, যে ব্যাপারে তোমাকে দুদিন আগে একটা চিঠি দিয়েছি–এবং সে চিঠিটার জবাব তুমি এখনও দাওনি–
কুন্তলা তথাপি চুপ করেই থাকে, হাতের বুননটা নিয়েই যেন সে ব্যস্ত।
চিঠিটা তুমি আমার পেয়েছ নিশ্চয়ই?
পেয়েছি।
জবাব দাওনি!
না। তারপই একটু থেমে কুন্তলা বলে, আমাকে তুমি ক্ষমা করো।
ক্ষমা করব–কীসের জন্যে? কি ব্যাপার বল তো?..
কুন্তলা নীরেনের মুখের দিকে তাকাল, চোখ তুলে বললে, আমার পক্ষে তোমার প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
সম্ভব নয়?
নীরেন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
না। শান্ত গলায় আবার জবাব দেয় কুন্তলা।
তা হঠাৎ এই মতের পরিবর্তন?
নীরেনের গলার স্বরটা যেন বেশ একটু কঠিন মনে হয়।
পরিবর্তন!
আছাড়া আর কি! এতদিন তো মতই ছিল—হঠাৎ সুব্রতবাবুর আবির্ভাবে—
নীরনবাবু!
তুমি মনে কর কুন্তলা দেবী, একমাত্র এ দুনিয়ায় তুমিই চালাক আর আমরা বোকা–ঘাস খাই! সুব্রতবাবুর সঙ্গে যে ঢলাঢলি শুরু হয়েছে ইদানীং–
নীরেনবাবু, ভদ্রভাবে একজন ভদ্রলোকের সম্পর্কে কথা বললেই আমি খুশি হব।
ভদ্রলোক—তাই না! হঠাৎ ফাঁকতালে বাপের সম্পত্তি পেয়ে মাথাটা বিগড়ে গিয়েছে!
নীরেনবাবু!
চোখ রাঙাচ্ছ কাকে কুন্তলা দেবী?
যান-যান এখান থেকে বলছি—
কুন্তলা তখন উঠে দাঁড়িয়েছে, তার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে।
যাচ্ছি। তবে মনে রেখো কুন্তলা দেবী, এত সহজে নীরেন সান্যাল অপমানকে হজম করে নেয় না।
বের হয়ে যান—বের হয়ে যান এ ঘর থেকে! হঠাৎ যেন সব কিছু ভুলে চিৎকার করে উঠে কুন্তলা।
চিয়ারিও মাই হনি বাঞ্চ! আই অ্যাম গোয়িং নাউ, বাট ইউ উইল হিয়ার মি এগেন-হেয়েন আই ওয়ান্ট ইউ। আপাতত বিদায়–
নীরেন সেন কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়-আর ঠিক তার পরমুহূর্তেই সুব্রত এসে ঘরে প্রবেশ করে।
কুন্তলা!
কুন্তলা দুহাতে মুখ ঢেকে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছিল, সুব্রতর ডাকে যেন ভেঙে পড়ে। চেয়ারটার উপরে বসে পড়ে। ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে।
সুব্রত কুন্তলার মাথায় একটা হাত রাখে, কি হয়েছে কুন্তলা?
কুন্তলা জবাব দেয় না, কাঁদতেই থাকে।
.
ঐ দিনই রাত্রে।
কিরীটীর বাড়িতে-সুব্রত আর কিরীটী কথা বলছিল।
আসলে কিরীটীই বলছিল, সুব্রত শুনছিল।
তাহলে তুমি বলছ মিঃ গাঙ্গুলীকেও হত্যা করা হয়েছে।
হ্যাঁ, সুব্রত। তাকেও একই হত্যাকারী, যে মহেন্দ্রনাথকে হত্যা করেছিল, সেই-ই হত্যা করেছে। তারপর যেমন মহেন্দ্রনাথের ব্যাপারটা অ্যাক্সিডেন্ট বা সুইসাইড বলে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছিল, এক্ষেত্রেও মিঃ গাঙ্গুলীর হাতের মুঠোর মধ্যে রিভলবারটা গুজে দিয়ে সেই চেষ্টাই করেছে খুনী।
কিন্তু কেন-গাঙ্গুলীকে হত্যা করল কেন সে? সুব্রত প্রশ্ন করে।
ঠিক একই কারণে। অর্থাৎ যে কারণে মহেন্দ্রনাথকে সে হত্যা করেছে।
কি-কি সে কারণ?
এখনও বুঝতে পারনি!
না।
ডাঃ নলিনী চৌধুরীর ঐ চিঠি।
মানে সেই সাংকেতিক চিঠি!
হ্যাঁ, সেই চিঠিই হল কাল। চিঠিই ডেকে এনেছে নৃশংস মৃত্যু।
কিন্তু কি করে, তবে কি–
তাই-এবং আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো সম্ভবত মহেন্দ্রনাথ চিঠির সাংকেতিক পাঠ প্রথম উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রথম আঘাত হানে হত্যাকারী। তারপর মিঃ গাঙ্গুলী—তিনিও হয়ত শেষ পর্যন্ত তার বন্ধুর ঐ সাংকেতিক চিঠির রহস্য উদ্ঘাটন করতে পেরেছিলেন, আর সে-কথা হত্যাকারী জানতে পারায় সঙ্গে সঙ্গে মহেন্দ্রনাথের মতই পথের কাঁটা হিসাবে পথ থেকে তাকেও সরিয়ে দিতে দেরি করেনি। তাকেও পৃথিবী থেকে যেতে হল।
তাহলে তুই নিশ্চয়ই জানতে পেরেছিস—
হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি হত্যাকারী কে এবং–
কিরীটীর কথা শেষ হল না—ঘরের ফোনটা হঠাৎ ঐ সময় ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল।
কিরীটীই এগিয়ে গিয়ে রিসিভারটা তোলে, কে—আছে হ্যাঁ ধরুন। সুব্রত তোর ফোন–
কে?
তোর হবু খুড়শ্বশুর সুরেন্দ্রনাথ।
সুরেন।
হ্যাঁ, দেখ, বোধ হয় জামাইকে নিমন্ত্রণ জানাতে চায়!
কিরীটীর ঠাট্টায় কান না দিয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরে, কি খবর সুরেন?
কুন্তলা কি তোমার ওখানে গিয়েছে?
কুন্তলা আমার এখানে! কই না তো। কিন্তু কি ব্যাপার বল তো?
সন্ধ্যার মুখে একটা গাড়ি আসে তোমার একটা চিঠি নিয়ে—কুন্তলার নামে।
কুন্তলার নামে চিঠি! কি বলছ তুমি সুরেন?
হ্যাঁ, আর সেই চিঠি পেয়েই তো কুন্তলা চলে গিয়ছে। এত রাত হচ্ছে, ফিরছে না দেখে তোমার বাড়িতে ফোন করে জানলাম তুমি এখানে!
কিরীটী সুব্রতর কথা বলা শুনেই বুঝেছিল কিছু একটা গোলমাল ঘটেছে। তাড়াতাড়ি সে সুব্রতর পাশে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞাসা করে, কি বলছে সুরেন?
বুঝলাম না ঠিক—
মনে হল যেন তোকে কুন্তলার কথা কি জিজ্ঞাসা করছিল?
হ্যাঁ, জিজ্ঞাসা করছিল কুন্তলা আমার এখানে এসেছে কিনা। কে বলে একটা চিঠি নিয়ে–
চিঠি! কীসের চিঠি? কার চিঠি?
সুব্রত সংক্ষেপে তখন সব কথা খুলে বলে কিরীটীকে।
কিরীটী সব শুনে বলে, এইরকম একটা কিছু তোর কথা শুনে আমি অনুমান করেছিলাম। তুই এখুনি মৃণাল সেনকে ফোন কর, কয়েকজন আর্মড পুলিস নিয়ে যেন সে প্রস্তুত থাকে। আমরা এখুনি আসছি।
সুব্রত কিরীটীর নির্দেশমত তখুনি থানায় মৃণাল সেনকে ফোন করে দিল।
কিরীটী আর একটা মুহূর্তও দেরি করে না, তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নেয়।
চল শিগগির—
গাড়ি লালবাজারের দিকে ছুটে চলেছে।
সুব্রতই গাড়ি চালাছিল। কিরীটী পাশে বসে।
কিরীটী বলছিল, খুনী কে-তাকে তুই তো অনেক আগেই ধরতে পারতিস যদি একবার ভাল করে ভেবে দেখতিস, ডাঃ চৌধুরীর যে উইলের কথাটা তোকে বলছিলাম –সেই উইলের কথাটা–
ডাঃ চৌধুরীর উইল।
হ্যাঁ। মনে করে দেখ, সে উইলে কি লেখা আছে এবং উইলের কথা কে কে জানত?
কিন্তু–
ঐখানেই তুই আলো দেখতে পেতিস বর্তমান রহস্যের!
আমি গতকালই সে উইলের কথা জানতে পেরেছি, কারণ তাঁর সেই উকিল বন্ধু, যিনি উইল তৈরি করেছিলেন তার মৃত্যুর মাত্র দুদিন আগে, তিনি কলকাতায় ছিলেন না। তারপরই তো তোকে জানাই।
ঐ উইলই হচ্ছে কাল।
কিন্তু সে উইলে কি আছে?
এখন সে কথা থাক। লালবাজার পৌঁছে গেছি আমরা। সর্বাগ্রে তোর কুন্তলা উদ্ধার, তারপর অন্য কথা।
.
মৃণাল সেন ফোনে নির্দেশ পেয়েই প্রস্তুত হয়ে ছিল।
কিরীটী বলে, মিঃ সেন, আপনি আমাদের গাড়িতে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন, পুলিশ ভ্যান আমাদের ফলো করবে।
মৃণাল সেন সুব্রতর গাড়িতে উঠে পড়ে।
সুব্রত এবার শুধায়, কোথায় যাব?
শ্রীরামপুর।
শ্রীরামপুরে!
সুব্রত কেমন যেন বোকার মতই প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ, খুব জোরে চালা।
সুব্রত গাড়ি ছেড়ে দেয়।
.
ধীরে ধীরে কুন্তলার জ্ঞান ফিরে এল একসময়।
নিঃশঙ্ক চিত্তেই গাড়িতে এসে উঠে বসেছিল কুন্তলা।
সুব্রতর হাতের লেখা সে কখনও দেখেনি ইতিপূর্বে এবং চিনতও না। তাই সুব্রতরই লেখা ভেবে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে সে এসে গাড়িতে উঠে বসেছিল চিঠিটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই।
একবারও তার কথাটা মনে হয়নি, সুব্রতর তো বাড়িতেই ফোন ছিল! সুব্রত তাকে ফোন করে জানাতে পারত কথাটা!
আর তেমন যদি প্রয়োজন হবে তো সুব্রত চিঠি দিয়ে পাঠাবে কেন? সে নিজেও তো আসতে পারত ওর ওখানে?
আর সেটাই তো ছিল স্বাভাবিক।
কিন্তু অতি বড় বিচক্ষণ ব্যক্তিও মাঝে মাঝে এমন হাস্যকর ভুল করে ঘটনাচক্রে। কুন্তলাকেও বোধ হয় তাই তেমন দোষ দেওয়া যায় না।
পরে সুব্রত যখন কুন্তলাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি এত বড় ভুল করেছিলে কি করে কুন্তলা?
কি জানি কেন—বোধ হয়–
কি?
তুমি ডেকেছ তাই কোন কিছুই আর মনে হয়নি সে-সময়।
কিন্তু আমরা যদি আর একটু দেরি করতাম বা কোন কারণে দেরি হত।
কি আর হত!
কিছু হত না বুঝি?
না।
সত্যি-সত্যি বলছ?
কুন্তলা মুখটা ফিরিয়ে নিয়েছিল অতঃপর।
.
২০.
কুন্তলা জ্ঞান ফিরে আসবার পর দেখল একটা ঘরে শয্যার উপর শুয়ে আছে।
কেমন করে কীভাবে সে এখানে এল কিছুই যেন প্রথমটায় মনে পড়ে না।
প্রথমটায় সব অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে—কিছুই চিন্তা করতে পারে না।
তারপর মনে পড়ে, গাড়ির মধ্যে যে দ্বিতীয় ব্যক্তি অন্ধকারে বসেছিল এবং যাকে সে দেখতে পায়নি তাড়াহুড়ায়, সে যেন তাকে গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকারে অকস্মাৎ জাপটে ধরে তার নাকের ও মুখের ওপরে কি একটা চেপে ধরেছিল-সঙ্গে সঙ্গে যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কুন্তলার।
একটা উগ্র মিষ্টি গন্ধে সব যেন সঙ্গে সঙ্গে কেমন গুলিয়ে গিয়েছিল। তলিয়ে গিয়েছিল ও, হারিয়ে গিয়েছিল ও-চেতনা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।
অনেক-অনেক দূর থেকে যেন ঝাপসা অস্পষ্ট কার গলা শোনা যায়।
কে যেন কাকে বলছে, কি হল ঠাকুরমশাই, তাড়াতাড়ি করুন! ভামিনী, এই ভামিনী–
কি?
দেখ জ্ঞান ফিরল কিনা!
দরজা খোলার শব্দ।
চোখ মেলে তাকায় কুন্তলা। ঘরের মধ্যে স্বল্পশক্তির একটা আলো জ্বলছে। আলোটা তবু যেন চোখে লাগে ওর।
কে এসে যেন পাশে দাঁড়াল।
দিদিমণি-অ দিদিমণি?
কর্কশ মেয়েলী গলায় কে যেন ডাকে কুন্তলাকে।
উঁ!
কি গো, ঘুম ভাঙল?
পূর্বের সেই কর্কশ নারী-কণ্ঠস্বর।
আমি কোথায়? ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করে কুন্তলা।
কোনমতে আস্তে আস্তে শয্যার উপরে উঠে বসে কুন্তলা। মাথাটা যেন তখন ঝিমঝিম করছে!
এই যে জ্ঞান ফিরেছে!
কে?
কেন, চিনতে পারছ না?
নীরেনবাবু?
হ্যাঁ। যাক, চিনেছ তাহলে!
আমি কোথায়?
আমার বাড়িতে।
আপনার বাড়ি।
হ্যাঁ।
এর মানে কি নীরেনবাবু?
মানে তো অত্যন্ত সহজ।
নীরেনবাবু।
হ্যাঁ, যখন আমার কথায় সম্মত হলে না বুঝলাম সুব্রত তোমার মাথাটা রীতিমতই বিগড়ে দিয়েছে-সোজা আঙুলে ঘি গলবে না, তাই অন্য উপায়ে তোমাকে এখানে ধরে নিয়ে আসতে বাধ্য হলাম।
তাহলে এসব আপনারই কীর্তি!
উপায় কি?
কিন্তু জানতে পারি কি, এভাবে কৌশলে আমাকে ধরে নিয়ে এসে কি লাভ হবে আপনার?
লাভ? তা আছে বৈকি। নচেৎ এত ঝামেলা পোহাব কেন?
শুনুন নীরেনবাবু, ভাল চান তো আমার যাবার ব্যবস্থা করুন!
যাবে বৈকি। তবে অন্য কোথাও নয়—আমারই সঙ্গে আমারই ঘরে।
আপনার ঘরে!
হ্যাঁ। শোন, আমার একটা প্রস্তাব আছে—
প্রস্তাব?
হ্যাঁ। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
বিয়ে!
হ্যাঁ।
কুন্তলা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
ওদিকে যাচ্ছ কোথায়? নীরেন বলে, দরজা বন্ধ!
দরজা খুলে দিন নীরেনবাবু!
দেখ কুন্তলা, আমি তোমার সঙ্গে কোনরকম খারাপ ব্যবহার করতে চাই না। ধর্মত আইনসঙ্গতভাবে তোমাকে বিয়ে করতেই চাইছি—আর তাতে যদি তুমি না রাজী হও, তাহলে—
তাহলে? কুন্তলা গ্রীবা বেঁকিয়ে তাকাল নীরেনের দিকে।
তাহলে আজ রাত্রে জোর করে তোমাকে—
ইউ স্কাউন্ডেল!
স্কাউন্ড্রেলই বল আর যাই বল সুন্দরী, সুব্রতর আশা ছাড়! যা বলছি এখনও শোন–ট্রাই টু রিজন, রাশন্যাল–
আবার চাপা গর্জন করে ওঠে ঘৃণায় কুন্তলা, ইতর নীচ!
তার সর্বাঙ্গ তখন থরথর করে আক্রোশে উত্তেজনায় কাঁপছে।
শোন, আমার প্রস্তাবে যদি রাজী না হও তো জেনো আমি যা একটু আগে বলেছি তাও করব না। কেবল তোমার নারীত্বের—সতীত্বের দম্ভকে চূর্ণ করে ছেড়া জুতোর মতই রাস্তায় ফেলে দেবো। আই শ্যাল থ্রো ইউ ইন দি ডাস্ট!
নীরেনের কথা শেষ হল না, হঠাৎ কে যেন ঘরের দরজাটায় বার-দুই ধাক্কা দিল।
কে-কে এল দেখ তো ভামিনী! ঠাকুরমশাই বোধ হয়!
ভামিনী এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই হুঁড়মুড় করে প্রথমে কিরীটী, তার পশ্চাতে সুব্রত, মৃণাল সেন ও দুজন কনেস্টবল ঘরে এসে ঢুকে পড়ে।
মৃণাল সেনের হাতে উদ্যত পিস্তল, ডাঃ সান্যাল, হ্যান্ডস আপ! উই আর আন্ডার অ্যারেস্ট!
কে? ও আই সি-ইন্সপেক্টর! শান্ত গলায় নীরেন সান্যাল বলে, কি চান? হোয়াই ইউ হ্যাভ কাম হিয়ার?
তেওয়ারী হাতকড়া লাগাও!
দাঁড়ান, ইনসপেক্টর। আমি জানতে চাই এসবের অর্থ কি?
এখনও অর্থটা তাহলে পরিষ্কার হচ্ছে না। কিন্তু অর্থটা পরিষ্কার করতে হলে আপনার অপরাধের ফিরিস্তি দিতে হয়। সেটাও তো একটা নয়—আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও তা সম্ভব নয়।
কুন্তলা ও ঘটনার আকস্মিকতায় হঠাৎ যেন থমকে গিয়েছিল। হঠাৎ সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সুব্রতকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে অজ্ঞান হয়ে যায়।
সুব্রত তাড়াতাড়ি কুন্তলাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
কিরীটী বলে, ওকে পাশের ঘরে নিয়ে হ্যাঁ, সুব্রত।
মৃণাল কিন্তু ডাঃ সান্যালের দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তখনও তাকিয়ে আছে।
তাহলে শেষ থেকেই শুরু করি—তোমার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ, কুন্তলা দেবীকে কিডন্যাপ–
কিডন্যাপ। কুন্তলাকে? কোন্ দুঃখে? সে নিজেই এসেছে।
ও, উনি নিজেই এসেছেন!
হ্যাঁ,। জিজ্ঞেস করলেই ওকে জানতে পারবেন সত্য-মিথ্যা।
নীরেনবাবু, আই মাস্ট প্রেজ ইওর নার্ভ! কিরীটী এবারে বলে ওঠে, কিন্তু ওতে করে শেষরক্ষা হবে না। জেল নয়—ফাঁসির দড়ি আপনাকে গলায় নিতেই হবে জানবেন।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। দু-দুটো হত্যা ও একটা কিডন্যাপ—
মশায় কি নেশা করেছেন?
নেশাই বটে, তবে মারাত্মক নেশা। মিঃ সেন, অ্যারেস্ট করুন।
মৃণাল সেন বলে, তেওয়ারী!
কিন্তু তেওয়ারী এগোবার আগেই আচমকা নীরেন সান্যাল পকেট থেকে কি একটা বের করে চট করে মুখে পুরে দেয় এবং ব্যাপারটা কেউ কিছু বোঝবার আগেই নীরেনের দেহটা সশব্দে মেঝেতে পড়ে যায়।
বার দুই আক্ষেপ-তারপরই সব স্থির।
ঘটনার আকস্মিকতায় ঘরের মধ্যে সবাই যেন বিমূঢ় হতবাক।
কিরীটী বলে, হ্যাঁ, মিঃ সেন। হি ইজ দি ম্যান—যে মহেন্দ্রনাথ ও মনীন্দ্র গাঙ্গুলীকে হত্যা করেছে!
২১.
কিরীটীর বাড়ি।
কিরীটী বলছিল, আপনারা হয়ত ভাবতেও পারেননি ইন্সপেক্টার যে ডাঃ সান্যালই ঐ দুজনের হত্যাকারী!–
না মৃণাল সেন বলে, নেভার ড্রেমট অফ ইট!
মনে আছে সুব্রত, যেদিন প্রথম তুই আমার কাছে কেসটা সম্পর্কে বলিস, আমি সব শুনে তোকে কয়েকটা কথা বলেছিলাম! এবং তার মধ্যে বলেছিলাম একটা কথা বিশেষ করে যা তা হচ্ছে ডাঃ চৌধুরীর ঐ দুই বন্ধুকে লেখা দুটো কাগজ-যার মধ্যে পর পর কতকগুলো লেখা রয়েছে এবং যে দুটো আমার কাছে রেখে যেতে বলেছিলাম!
হ্যাঁ, সে তো তোর কাছেই আছে। সুব্রত বলে।
হ্যাঁ, সেই কাগজই প্রথম আমাকে হত্যার মোটিভের ইঙ্গিত দেয়। কথাটা বলতে বলতে কিরীটী কাগজের টুকরো দুটো বের করে সামনের টেবিলের উপরে পাশাপাশি রাখল।
এই দেখ!
একটা কাগজের মাথায় লেখা ২৬ ইংলিশে, অন্যটার মাথায় লেখা অ্যালফাবেটসে অর্থাৎ ইংলিশ অ্যালফাবেটস, ইংরাজী বর্ণমালা—যার মধ্যে ২৬টি কথা আছে এ বি সি ডি করে। এখন ঐ অনুযায়ী ইংরাজী বর্ণমালা বসিয়ে দাও। তাহলে দেখ দাঁড়াচ্ছে কি–শ্রীরামপুর পর্ণকুটির গ্রাউন্ড ফ্লোর-সাউথ রুম। অর্থাৎ শ্রীরামপুরের পর্ণকুটিরের একতলার দক্ষিণের ঘর।
আশ্চর্য! মৃণাল সেন বলে, একবারও এসব মনে হয়নি তো আমাদের সুব্রতবাবু।
কিরীটী দুটো কাগজ জোড়া দিল।
মাঝখানে একটা রেকট্যাঙ্গল আঁকা আছে-তার দুমাথায় এস ও ই লেখা অর্থাৎ সাউথ ইস্ট কোণ।
তাহলে? সুব্রত বলে।
হ্যাঁ, সুব্রত, ডাঃ নলিনী চৌধুরীর দাদা যে ধনসম্পদ বর্মা থেকে নিয়ে এসেছিলেন সেটা তিনি তার শ্রীরামপুরের পর্ণকুটিরের নিচের দক্ষিণ দিককার ঘরের মেঝেতে দক্ষিণপূর্ব কোণে নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে রেখেছিলেন। এবং সেটা যে আছে সে সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হই আমি আর কেন জান?
কেন? সুব্রত জিজ্ঞাসা করে।
ডাঃ নলিনী চৌধুরীর দ্বিতীয় উইলের কথা জানবার সঙ্গে সঙ্গে।
ডাঃ নলিনী চৌধুরীর দ্বিতীয় উইল! মৃণাল সেন বলে।
হ্যাঁ, তার সেই দ্বিতীয় উইলের জন্যই তো এত কাণ্ড। এবং উইলের কথা আমি ডাঃ চৌধুরীর আইন-উপদেষ্টা কালীপদ চক্রবর্তীর কাছে জানতে পারি প্রথম।
কিন্তু কালীপদ চক্রবর্তী বা মিঃ গাঙ্গুলী তো সেরকম কোন উইলের কথা আমাকে বলেননি! সুব্রত বলে।
না বলেননি, তার কারণ উইলটা রেজিস্ট্রি করার আগেই ডাঃ চৌধুরীর মৃত্যু হয়। এবং তার মৃত্যুর পর সেই কাচা উইলটা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কেন? উইলটা তার কাছে ছিল না?
না। কারণ যে রাত্রে ডাঃ চৌধুরীর অ্যাটাক হয় সেই রাত্রেই কালীপদ চক্রবর্তীকে ডেকে তিনি উইলটা লিখিয়ে সই করেন। কথা ছিল চক্রবর্তী এসে উইলটা নিয়ে গিয়ে টাইপ করে পাকাপাকি সব ব্যবস্থা করবেন আর তাই উইলটা ডাঃ চৌধুরীর বালিশের তলায় ছিল। কিন্তু সেই রাত্রেই গোটাপাঁচেক নাগাদ ডাঃ চৌধুরীর মৃত্যু হয়। তারপর মিঃ চক্রবর্তী এসে উইলটার খোঁজ করেন, কিন্তু পান না।
তারপর?
কাজে-কাজেই উইলটা না পাওয়া যাওয়ায় ডাঃ চৌধুরীর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায় এবং উইল যখন লেখা হয় তখনই ঐ কাগজটা মাঝামাঝি কেটে দুই বন্ধুর নামে খামে ভরে ব্যাঙ্কে জমা দেবার জন্য আগেই মিঃ চক্রবর্তীর হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন ডাঃ চৌধুরী।
ঐ কাগজটা কি তারই তৈরি?
না, ওটা চৌধুরীর দাদার কীর্তি। ডাঃ চৌধুরী কাঁচি দিয়ে কেটে দুটুকরো করেছিলেন মাত্র জিনিসটা।
তারপর?
যা হোক, উইলের খসড়া চুরি গেলেও ঐ খাম-দুটো চুরি যায়নি। তাই চক্রবর্তী ঐ খাম-দুটো শেষে ডাঃ চৌধুরীর মৃত্যুর পর ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দেন ও তাদের ব্যাপারটা বলেন। কিন্তু চক্রবর্তী বলেননি রায় ও গাঙ্গুলীকে দ্বিতীয় উইলের খসড়ার কথা প্রথমে বা ঐ দ্বিতীয় উইলে কি ছিল! যদিও উইলে অর্থের কথা স্পষ্ট করে বলা ছিল। তবু সে অর্থ সঠিক কোথায় আছে ডাঃ চৌধুরীও না বুঝতে পারায় ঐ অঙ্ক থেকে কিছু বলে যেতে পারেননি স্পষ্ট করে তার উইলে।
কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না কিরীটী! সুব্রত বলে।
কি?
ডাঃ চৌধুরী তার ভাইকে সব কথা খুলে না বলে অমন একটা রহস্যের মধ্যে ব্যাপারটাকে চাপা দিয়ে রেখে গেলেন কেন?
সেটা বলতে পারব না। যা হোক, হঠাৎ তার সর্পদংশনে মৃত্যু হওয়ায় এবং আমার ধারণা সর্পদংশনে মৃত্যুর ব্যাপারটাও তার আসলে হত্যাই এবং সেটা ঐ নীরেনেরই কারসাজি। সে হয়ত কোনক্রমে ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল। যা হোক যা বলছিলাম, ডাক্তার ভাইয়ের কাগজপত্রের মধ্যে ওটা পেয়েছিলেন তার মৃত্যুর পর
তবে যে চিঠি একটা লিখে গিয়েছিলেন তার ছোট ভাইকে শুনেছিলাম। কথাটা ঠিক নয়। মানে চিঠি নয়-মুখে একদিন কথাটা ভাইকে বলেছিলেন মাত্র তিনি। কারণ তখনও তিনি অর্থের লোভটা সামলে উঠতে পারেননি বোধ হয়।
তাহলে উইলটা ডাঃ চৌধুরীর–
সুব্রতর কথায় বাধা দিয়ে কিরীটী বলে, অবশ্যই ডাঃ চৌধুরীর ভাগ্নে সকল রহস্যের মেঘনাদ ডাঃ নীরেন সান্যালই সরিয়েছিল। কিন্তু শুধু উইলে কি হবে! আসল তথ্য তো ছিল দুই বন্ধুর নামে ডাঃ চৌধুরীর ব্যাঙ্কে সেই দুই খণ্ড কাগজে। আর সেই কারণেই পর পর দুটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হল। এখন দেখা যাক, নীরেন ডাক্তারই যে মহেন্দ্র রায়ের হত্যাকারী—আমি তা জানতে পারলাম কি করে বা তাকে সন্দেহ করলাম কেন?
.
২২.
কিরীটী বলতে থাকে, যখন জানা গেল মহেন্দ্রনাথ নিহত হয়েছেন তখন স্বভাবতই তার আত্মীয়স্বজনদের উপরেই সন্দেহ জাগে প্রথমত, যেহেতু তিনি ছিলেন বিত্তবান এবং তার মৃত্যুতে তারা প্রত্যেকেই লাভবান হত।
তাহলেও সন্দেহের ব্যাপারটা মনে মনে বার বার বিশ্লেষণ করলাম। ছোট ভাই সুরেন্দ্র, দুই ছেলে সৌরীন্দ্র ও ভবেন্দ্র এবং মিঃ মুখার্জী ও তার বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলী সকলের উপরই সন্দেহ জাগে।
বড় ছেলে ও ভাই সুরেন্দ্রকে অনায়াসেই বাদ দেওয়া যেতে পারে, কারণ তাদের পক্ষে ব্যাপারটা জানা সম্ভবপর ছিল না।
তারপই প্রথমে ধরা যাক, ছোট ছেলে ভবেন্দ্রর কথা, বিশেষ করে তার ঐ রিভলবারটির জন্য। আসলে কিন্তু রিভলবারটি হারায়নি!
তবে?
রিভলবারটা নীরেন সান্যাল বেরিলিতে গতমাস ভবেন্দ্রর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে নিয়ে আসে। বেশ কিছু টাকা দিয়ে কিছুদিনের জন্য চেয়ে নিয়ে আসে। টাকার। প্রয়োজন ছিল ভবেন্দ্রর, তাই সে দেয়। তাছাড়া সে ভেবেছিল, সেটা তো আবার ফিরে পাবেই!
ফিরে পাবে?
হ্যাঁ। সেইরকমই ভবেন্দ্রকে বুঝিয়েছিল নীরেন সান্যাল।
আপনি এ-কথা জানলেন কি করে? মৃণাল সেন শুধায়।
বেরিলিতে গিয়ে ভবেন্দ্রর সঙ্গে দেখা করে সব জেনেছি, আর সেই জন্যই-মানে রিভলবারটা ফিরে পাবার জন্যই ভবেন্দ্র কলকাতায় এসেছিল কিন্তু রিভলভার ফিরিয়ে দেয়নি নীরেন সান্যাল।
তাহলে–
হয়াঁ সুব্রত, এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল নীরেন ডাক্তার। সে জানত বাপেছেলেতে বিরোধ—আর এও জানত ভবেন্দ্রর অনেক ধার। এই দুটোর সুযোগ নিয়ে সে বেশ কিছু মোটা টাকা দিয়ে ভবেন্দ্রর কাছ থেকে রিভলবারটা বাগিয়ে আনে। মহেন্দ্রনাথ ও মনীন্দ্র গাঙ্গুলীকে হত্যা করবার জন্য এবং সেই হত্যার অপরাধ বেচারি ভবেন্দ্রর ঘাড়ে চাপানোর জন্য। তাতে করে সে ভেবেছিল, কাজও হাসিল হবে আর তাকেও কেউ সন্দেহ করবে না।
কি সাংঘাতিক! সুব্রত বলে।
হ্যাঁ। চমৎকার প্ল্যান করেছিল নীরেন ডাক্তার। কিন্তু মারাত্মক দুটো ভুল করেছিল
সে–
দুটো ভুল! মৃণাল সেন প্রশ্ন করে।
একনম্বর—নিজের টাইপরাইটিং মেসিনে চিঠিটা টাইপ করে, সেই চিঠি মিঃ রায়কে পাঠিয়ে দিয়ে এবং দু নম্বর—তার মামার কাচা উইলটাকে সরিয়ে ফেলে।
কিরীটী একটু থেমে বলতে লাগল, যে মুহূর্তে ব্যাঙ্কের চিঠি দুটোর রহস্য আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় তখনই একটা কথা আমার মনে হয়। ঐ ডাঃ চৌধুরীর ভাইয়ের অর্থই হল হত্যার মূল এবং সে-কথা কে কে জানত! মহেন্দ্রনাথ ও মণীন্দ্র গাঙ্গুলী ছাড়া জানত নিশ্চয়ই ডাক্তার নীরেন। কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার উপরে আমার সন্দেহ হয়।
কিরীটীর কথা শেষ হল।
সকলেই নির্বাক।