শী: পরদিন ভোরের আলো ফুটবার সঙ্গে সঙ্গে

শী: পরদিন ভোরের আলো ফুটবার সঙ্গে সঙ্গে

০৬-১০. পরদিন ভোরের আলো ফুটবার সঙ্গে সঙ্গে

পরদিন, ভোরের আলো ফুটবার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লাম আমরা। খেয়াল করলাম, সাগরের দিক থেকে বাতাস বইতে শুরু করেছে আবার। এখন দেরি করা অর্থহীন। বিছানাপত্র গোছগাছ করে নাশতা সেরে নিয়ে পাল তুলে দিলাম। নদীর ওপর দিয়ে এগিয়ে চললাম অজানার দিকে।

কালকের মতো আজও বাতাস পরে গেল সুরের পর। ভাগ্য ভালো, বেশি খোজাখুঁজি ছাড়াই নদীর পাড়ে একটা শুকনো জায়গা পেয়ে গেলাম। নৌকা ভিড়িয়ে তীরে নামলাম আমরা। আগুন জ্বাললাম। দুটো বুনো হাঁস এবং খানিকটা হরিণের মাংস রান্না করে খাওয়া হলো। হরিণের বাকি মাংসটুকু সরু, লম্বা ফালি করে কেটে শুকাতে দিলাম। পরদিন সকাল পর্যন্ত এ জায়গায় কাটালাম আমরা। একমাত্র মশা ছাড়া আর কোর্সেসহংস্র প্রাণী উপদ্ৰব পোহাতে হলো না। একই ভাবে কাটলো পরের দু’তিনটি দিন।

পঞ্চম দিন নাগাদ উপকূল থেকে প্রায় একশো পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ মাইল মতো পশ্চিমে চলে আসতে পারলাম আমরা। এদিন সকাল এগারোটা বাজতে না বাজতেই স্তব্ধ হয়ে গেল বাতাস। দাড় টেনে কিছুদূর এগোনোর পর থামতে বাধ্য হলাম আমরা। নদী এবং প্রায় পঞ্চাশ ফুট চওড়া একটা জলস্রোতের সঙ্গমস্থলে এসে পড়েছি। যতদূর চোখ যায় একই রকম চওড়া হয়ে এগিয়ে গেছে নতুন জলস্রোতটা। পাড়ের ঠিক ওপরেই বেশ কিছু বড় গাছ। আগেও যত গাছ দেখেছি, বেশির ভাগই পাড়ের কাছাকাছি শক্ত জমিতে, এখানেও তাই। গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নদীর শক্ত পার ধরে এগিয়ে গেলাম জায়গাটার অবস্থা দেখার উদ্দেশ্যে। খাওয়ার জন্যে কয়েকটা পাখি শিকার করলাম। পঞ্চাশ গজ যাওয়ার আগেই বুঝে ফেললাম, নদী ধরে আর এগোনোর আশা নেই। যেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছি এর দুশো গজ পর থেকেই শুরু হয়েছে অগভীর কাদার রাজত্ব। পানির পরিমাণ দুইঞ্চিও হবে কিনা সন্দেহ।

এবার অন্য জলস্রোতটার পাড় ধরে এগোলাম আমরা। নানা আলামত দেখে। কিছুক্ষণের ভেতর বুঝতে পারলাম, আসলে এটা প্রাচীন একটা খাল। নিঃসন্দেহে দূর অতীতের কোনো মানবগোষ্ঠী কেটেছিলো এই খাল। অস্বাভাবিক উঁচু পাড়গুলো দেখলে মনে হয় গুণ টানার সুবিধার জন্যে তৈরি করা হয়েছিলো।

খালে পানি যথেষ্ট গভীর, তবে স্রোত প্রায় নেই বললেই চলে। নদী ধরে এগোনোর প্রশ্ন ওঠে না, আমরা যদি আরো এগোতে চাই, এই খাল ধরেই এগোতে হবে। সবাইকে বললাম কথাটা। শেষে যোগ করলাম, আমার মনে হয়, চেষ্টা করা উচিত, কি বলো?

আমি ফিরে যাওয়ার বদলে এগিয়ে যেতে চাইছি শুনে ঠোঁট বেঁকিয়ে একটু হাসলো লিও। অন্য দুজন মৃদু গজ গজ করলো। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাজি হলো ওরাও।

সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার পরও অনুকূল বাতাসের পাত্তা পাওয়া গেল না। এদিকে অপেক্ষা করতেও আর ইচ্ছে করছে না। অতএব রওনা হলাম আমরা। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে প্রথম ঘণ্টাখানেক দাড় টেনে এগোনো গেল। তারপরই জলজ আগাছা এত ঘন হয়ে উঠলো যে, তার ভেতর দিয়ে নৌকা এগিয়ে নেয়া অসম্ভব মনে হলো। অবশেষে নৌকা চালানোর প্রাচীনতম পদ্ধতি–গুণ টানার আশ্রয় নিতে হলো আমাদের। দু’ঘণ্টা একটানা টেনে চললাম আমরা–আমি, জব আর মাহমুদ। লিও রইলো নৌকার আগ গলুইয়ে। মাহমুদের তলোয়ার দিয়ে যথাসম্ভব কেটে দিতে লাগলো আগাছা।

সন্ধ্যার পর কয়েক ঘণ্টার জন্যে বিশ্রাম। তারপর আবার গুণ টেনে চলা। ভোর বেলায় আবার ঘণ্টা তিনেকের বিশ্রাম, তারপর আবার চলা। সকাল দশটার দিকে আচমকা ঝড় উঠলো, সেই সাথে মুষলধারে বৃষ্টি। এবং সত্যি বলতে কি,

পরবর্তী ছয় ঘণ্টা আমরা কাটালাম জলের নিচে।

পরের চারটে দিন কিভাবে কাটলো তার বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। শুধু এটুকু বলতে পারি, জীবনে এত কষ্ট কখনো করিনি। একঘেয়ে কঠোর পরিশ্রম, গরম, মশা, দুর্গন্ধ-সব মিলিয়ে দুর্দশার চূড়ান্ত। খালে ঢোকার তৃতীয় দিনে দূরে একটা গোল মতো পাহাড় দেখতে পেলাম। বিশাল বিস্তৃত জলাভূমির ভেতর থেকে হঠাৎ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে যেন। চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় যখন বিশ্রামের জন্যে থামলাম তখন মনে হলো, এখনও পঁচিশ কি তিরিশ মাইল দূরে রয়েছে পাহাড়টা। ইতিমধ্যে ক্লান্তির শেষসীমায় পৌঁছে গেছি আমরা। নৌকা টানা দূরে থাক, টিন থেকে যে খাবার বের করে খাবো সে শক্তিটাও নেই। ইচ্ছে করছে না। মৃত্যুর জন্যে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে গেছি যেন। বসে বসে ঝিমোতে লাগলাম সব কজন।

আচমকা কেন জানি না–কোনো শব্দ শুনে বা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে, চোখ মেলে তাকালাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে রক্ত হিম হয়ে গেল! বিরাট বিরাট দুটো চোখ জ্বলজ্বল করতে আমার মুখের ওপর। তীব্র এক চিৎকার করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। আমার চিৎকার শুনে লিও, জব, আর মাহমুদও ধড়মড়। করে উঠে দাঁড়ালো। ক্লান্তি এবং আতঙ্কে টলছে ওরা। তারপরই হঠাৎ দেখা গেল। শীতল ইস্পাতের, ঝলকানি। বিরাট একটা বলুমের ফলা এসে ঠেকেছে আমার গলায়। পেছনে আরো অনেকগুলো জ্বলজ্বলে ফলা, যেন ক্রর চোখে তাকিয়ে আছে। আমার দিকে।

শান্ত হও, আরবীতে নির্দেশ দিলো একটা কণ্ঠস্বর। তোমরা কারা? কোত্থেকে এসেছো? বলো, না হলে মরবে। বল্লমের ফলা আর একটু চেপে বসলো আমার গলায়।

আমরা দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছি, ভ্রমণকারী, আরবীতে জবাব দিলাম আমি। পথ ভুলে এখানে এসে পড়েছি।

আমার কথা বোধহয় বুঝতে পারলো লোকটা। ঘাড় ফিরিয়ে পাড়ে দাঁড়ানো কারো কাছে নির্দেশ চাইলো, মেরে ফেলবো, পিতা?

রং কেমন লোকগুলোর? জিজ্ঞেস করলো ভারি একটা গলা।

সাদা।

মেরো না। চার সূর্য আগে নির্দেশ এসেছে—’সে-যাকে-মানতেই-হবে’র কাছ থেকে: সাদা মানুষরা আসবে, যদি আসে, মেরো, না ওদের। সে-যাকে মানতেই-হবে’র কাছে নিয়ে জেতে হবে এদের। মানুষগুলোকে আগে নিয়ে চলো। ওদের সাথে যে সব জির্মির্স আছে পরে সেগুলোও নিতে হবে।

চলো! হাঁক ছাড়লো বল্লমধারী। আমি নড়ার আগেই সে খপ করে আমার হাত ধরে টেনে হিচড়ে নামাতে লাগলো নৌকা থেকে। অন্য কয়েকজন একই আচরণ করলো আমার সঙ্গীদের সাথে।

পাড়ে নেমে দেখলাম জনা পঞ্চাশেক লোক জড়ো হয়েছে। সবকজনই দীর্ঘদেহী। পেশিবহুল শরীর। কোমরের কাছে এক টুকরো করে চিতার চামড়া জড়ানো, এ ছাড়া পুরো শরীর উলঙ্গ। প্রত্যেকেরই হাতে বিশাল বল্লম।

জব এবং লিওকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে আসা হলো আমার পাশে।

ব্যাপার কি? কিছুই তো বুঝতে পারছি না, চোখ ডলতে ডলতে বললো লিও।

কি আশ্চর্য! এ কি কাণ্ড, শুরু করলো জব। এমন সময় একটা হৈ-চৈ শোনা গেল পেছনে। হোঁচট খেতে খেতে আমাদের মাঝে এসে পড়লো মাহমুদ। পেছনে উদ্যত বল্লম হাতে অস্পষ্ট একটা ছায়ামূর্তি।

আল্লাহ! আল্লাহ্! হাউ-মাউ করে উঠলো মাহমুদ। বাঁচাও আমাকে! বাঁচাও আমাকে!

একটা কালো-ও আছে, পিতা, বললো একজন। সে-যাকে-মানতেই হবে কি বলেছেন এর সম্পর্কে?

কিছু না, কিন্তু মেরো না ওকে। তুমি এদিকে এসো।

এগিয়ে গেল লোকটা। দীর্ঘদেহী ছায়ামূর্তি ঝুঁকে কি যেন বললো ফিসফিস করে।

হ্যাঁ-হ্যাঁ, বললো অন্যজন, তারপর হেসে উঠলো রক্ত হিম করা এক স্বরে।

সাদা তিন জন আছে ওখানে? জিজ্ঞেস করলো ছায়ামূর্তি।

হ্যাঁ।

তাহলে যাও, ওদের নেয়ার জন্যে যেগুলো আনা হয়েছে সেগুলো নিয়ে এসো। আর কয়েক জনকে বলল ঐ ভেসে থাকা জিনিসটায় যা-যা আছে সব নিয়ে আসুক।

তার কথা শেষ হতেই কয়েকজন লোক ঘাড়ে করে যে জিনিসগুলো নিয়ে এলো সেগুলোকে পাকি ছাড়া আর কিছু বলার উপায় নেই। প্রতিটার জন্যে চারজন করে বাহক আর অতিরিক্ত দুজন-এইদুজন সম্ভবত বদলি বাহক বা প্রহরী হিসেবে কাজ করবে। যথেষ্ট স্বস্তি বোধ করলাম মনে মনে। যাক হেঁটে যেতে হবে না তাহলে। লিও তো বলেই বসলো—অবশ্য ইংরেজিতে, এতদূর নিজেরা এসেছি, এবার নিয়ে চলো, বাবারা। শত বিপদের মাঝেও বেশ উৎফুল্ল থাকতে পারে ও।

প্রতিবাদ করা অর্থহীন, অতএব একেকজন একেকটা পালকিতে চড়ে বসলাম। তারপর শুরু হলো যাত্রা। ঘাসের আঁশ থেকে তৈরি এক ধরনের কাপড়ে ছাওয়া পালকির ভেতরটা: বেশ আরমদায়ক। সেই সাথে বাহকদের হাঁটার ছন্দে এক লয়ে দুলছে পালকি। কিছুক্ষণের ভেতর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম আমি।

ঘুম যখন ভাঙলো তখন বেশ উপরে উঠে এসেছে সূর্য। ঘণ্টায় প্রায় চার মাইল বেগে ছুটে চলেছে বাহকরা। পালকির মিহি পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। জলাভূমির রাজত্ব শেষ। ঘাসে ছাওয়া সমভূমির ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে বাহকরা। সামনে পেয়ালার মতো দেখতে একটা পাহাড়। ওটার দিকেই নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। খালের পাড় থেকে আমরা যেটা দেখেছিলাম। এটা সেই পাহাড়টাই কি না জানি না। পরে অনেক চেষ্টা করেও এ সম্পর্কে কোনো তথ্য আদায় করতে পারিনি স্থানীয়দের কাছ থেকে।

যাহোক, এবার আমি চোখ ফেরালাম আমার বাহকদের দিকে। চমৎকার স্বাস্থ্য, বোধহয় কারো উচ্চতাই ছফুটের নিচে নয়। হলদেটে গায়ের রং। চেহারা ছৰি যথেষ্ট ভালো। দাঁতগুলো সুন্দর, ঝকঝকে মুক্তার মতো। কিন্তু যে জিনিসটা বিশেষ ভাবে আমার মনে দাগ কাটলো তা ওদের সৌন্দর্য নয়, ওদের মুখে সেঁটে থাকা শীতল নিষ্ঠুর অভিব্যক্তি। আর একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, হাসতে জানে এরা। পাকি বইতে বইতে মাঝে মাঝে একঘেয়ে সুরে গান গাইছে। কিন্তু গান শেষ হওয়া মাত্র সবাই চুপ-রাম গরুড়ের ছানা।

এসব কথা ভাবছি আর চারপাশের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করছি, এই সময় আরেকটা পালকি চলে এলো আমারটার পাশে। তার চারদিকের পর্দা ওঠানো। সাদা চিলা আলখাল্লা পরা এক বৃদ্ধ বসে আছে ওতে। দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে পারলাম, কাল রাতে এই লোককেই পিতা বলে সম্বোধন করা হচ্ছিলো। অদ্ভুত চেহারা বৃদ্ধের। তুষারের মতো সাদা দাড়ি-এত লম্বা যে পালকির পাশ দিয়ে ঝুলে পড়েছে; বাঁকানো নাক, সাপের মত তীক্ষ্ণ্ণ এক জোড়া চোখ, অদ্ভুত। বুদ্ধিদীপ্ত অথচ কৌতুকের দৃষ্টি তাতে।

জেগে আছো নাকি, বিদেশী? ভারি অথচ নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো সে।

নিশ্চয়ই, পিতা, বিনীত ভ্রাবে জবাব দিলাম আমি।

শ্বেত-শুভ্র দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে মৃদু হাসলো বৃদ্ধ। কোন্ দেশ থেকে এসেছো তোমরা? নিশ্চয়ই এমন কোথাও থেকে, যেখানে আমাদের ভাষা একেবারে অজানা নয়। পরের বাক্যটা নিজেকেই যেন শোনালো বৃদ্ধ। স্মরণাতীত কাল থেকে যে দেশে মানুষের পা পড়েনি সে দেশে কিসের আশায়। এসেছো তোমরা? জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গেছে?

অজানাকে জানার জন্যে এসেছি আমরা, দৃঢ় গলায় বললাম আমি। সাগর পাড়ি দিয়ে আমরা এসেছি যদি নতুন কিছু আবিষ্কার করা যায় এই আশায়। একটা কথা আপনাকে বলতে চাই, পিতা, সাহসী জাত আমরা, মৃত্যুকে ভয় পাই না।

হুম! বললো বৃদ্ধ, যুক্তি আছে তোমার কথায়, নয়তো বলতাম তুমি মিথ্যে বলছো। যাহোক, আমার মনে হয় সে-যাকে-মানতেই-হবে মেটাতে পারবেন। তোমার এই নতুনকে জানার তৃষ্ণা।

সে-যাকে-মানতেই-হবে! কে সে?

বাহকদের দিকে চকিতে একবার তাকালো বৃদ্ধ। অপেক্ষা করো, সময় হলেই জানতে পারবে, অবশ্য তিনি যদি সশরীরে দেখা দেন।

সশরীরে? কি বলতে চাইছেন, পিতা?

কোনো জবাব না দিয়ে হাসলো বৃদ্ধ, ভয়ঙ্কর হাসি।

আপনাদের জাতির নাম কি, পিতা? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

আমাহ্যাগার, মানে পাহাড়ের লোক।

বেআদবি নেবেন না, আপনার নাম কি, পিতা?

বিলালি।

কোথায় যাচ্ছি আমরা?

সময় হলেই দেখবে। বাহকদের কি একটা ইশারা করলো বৃদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল ওরা তার পালকি নিয়ে।

এরপর আর তেমন কিছু ঘটলো না। পাকির দুলুনিতে আবার যে কখন ঘুমিয়ে গেলাম টের পেলাম না। যখন ঘুম ভাঙলো, দেখলাম, আগ্নেয়গিরির লাভায় তৈরি সঙ্কীর্ণ একটা পাথুরে গিরিপথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা।

একটু পরেই মোড় নিলো গিরিপথটা। সঙ্গে সঙ্গে অপূর্ব একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো চোখের সামনে। বিশাল একটা সবুজ পেয়ালা যেন পড়ে আছে মাটিতে। চার থেকে ছমাইল হবে বিস্তৃতি। অনেকটা প্রাচীন রোমের অ্যাফিথিয়েটারের মতো দেখতে। ধারগুলো পাহাড়ী। এখানে ওখানে ঝোপঝাড়। সবচেয়ে অপূর্ব এর মাঝখানটা। চমক্কার সবুজ ঘাসে ছাওয়া। ছাগল এবং অন্যান্য গৃহপালিত পশুর পাল চরে বেড়াচ্ছে। তবে কোনো ভেড়া দেখলাম না। অদ্ভুত জায়গাটা কি হতে পারে প্রথমে ভেবে পেলাম না। পরে মনে হলো, প্রাচীন কোনো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ হয়তো। আগ্নেয়গিরিটা মরে যাওয়ার পর এই চেহারা নিয়েছে। যা দেখে সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম তা হলো, পশুর পালগুলো চরিয়ে বেড়াচ্ছে মানুষে, কিন্তু আশপাশে কোনো লোকবসতি নেই। তাহলে ধাকে কোথায় এরা?

বাঁ দিকে একটা মোড় নিয়ে প্রায় আধা মাইল এগোনোর পর থামলো পালকির সারি। বিলালি নেমে পড়লো তার পালকি থেকে। দেখাদেখি আমিও নামলাম। লিও আর জবও। প্রথমেই খেয়াল করলাম, আমাদের আরব সঙ্গী মাহমুদের দুরবস্থা। পুরো পথ বাহকদের সাথে দৌড়ে আসতে হয়েছে তাকে। ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে বেচারা।

বিরাট একটা গুহার মুখে একটা বেদী মতো জায়গায় থেমেছি আমরা। সামনে স্কুপ করে রাখা আমাদের জিনিসপত্র, এমন কি নৌকার পাল এবং দাঁড়গুলো পর্যন্ত।

গুহা মুখটা ঘিরে দাঁড়িয়েছে আমাদের পালকিবাহক লোকগুলো। একই রকম স্বাস্থ্যবান অন্য লোকও দেখলাম সেখানে। কয়েকজন মহিলাও আছে ওদের ভেতর। এই লোকগুলো চিতার চামড়ার বদলে পরেছে লাল হরিণের চামড়া। পুরুষদের মতো মেয়েগুলোও দেখতে খুব সুন্দরী। বড় বড় কালো চোখ, সুন্দর মুখ, মাথা ভর্তি ঘন চুল—নিগ্রোদের মতো কোকড়া নয় মোটেই। দু’এক জন যদিও সংখ্যায় খুব কম—বিলালির মতো হলদেটে এক ধরনের লিনেনের কাপড় পরেছে। পরে জেনেছিলাম এটা আভিজাত্যের প্রতীক। মেয়েগুলোর মুখের ভাব পুরুষদের মতো অমন নিষ্ঠুর নয়।

আমাদের দেখেই কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এলো মেয়েগুলো। সবারই মনোযোগ লিওর দিকে। ওর দীর্ঘ পেটা শরীর আর গ্রীক ধাচের চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছে সবাই। যখন ব্যাট খুলে শ্রভাবে অভিবাদন জানালো, তখন ওর সোনালী চুল দেখে রীতিমতো একটা গুঞ্জন উঠলো মেয়েগুলোর ভেতর। এখানেই শেষ হলো না ব্যাপারটা। ওদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা এগিয়ে এলো আস্তে আস্তে। লিনেনের আলখাল্লা দুলছে তার হাঁটার ছন্দে ছন্দে। দাঁড়িয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখলো সে লিওকে। তারপর গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো ওর ঠোঁটে।

নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল আমার, নিশ্চয়ই এখুনি বল্লম দিয়ে এফোঁড় ওফোড় করে দেয়া হবে লিওকে। কিন্তু না, তেমন কিছু ঘটলো না। লিও অবাক চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে, তারপর সেও মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো।

আবার শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো আমার। এবার কিছু ঘটবেই। কিন্তু আশ্চর্য, কম। বয়েসী মেয়েদের মুখে বিরক্তির ছাপ পড়লো একটু, বয়স্করা মৃদু হাসলো। ব্যস, আর কিছু না। এই মানুষগুলোর রীতি নীতি সম্পর্কে যখন জানলাম তখন বুঝতে পারলাম এর কারণ।

আমাহ্যাগার সম্প্রদায়ের ভেতর নারী এবং পুরুষে কোনো পার্থক্য নেই। বরং নারীরা অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। মায়ের পরিচয়ে সন্তানরা পরিচিত হয়; যদিও গোত্রের প্রধান একজন পুরুষ, এবং তাকে নির্বাচিত করা হয়। গোত্র প্রধানের উপাধি পিতা। যেমন, প্রায় সাত হাজার মানুষের এই গোত্রের পিতা বিলালি। বিয়ের ব্যাপারেও এখানকার মেয়েরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। কোনো পুরুষকে পছন্দ হলে সবার সামনে আলিঙ্গন করে মেয়েটা তার মনের। ইচ্ছা প্রকাশ করে। পুরুষটা যদি পাল্টা আলিঙ্গন করে তাহলে বুঝতে হবে সে তাকে গ্রহণ করলো। ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছে ঐ মেয়েটা—যার নাম উস্তেন–আর লিওর মধ্যে।

.

০৭.

চুমনপর্ব শেষ হওয়ার পর এগিয়ে এলো বৃদ্ধ বিলালি। আমাদের কে তাকিয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে গুহায় ঢোকার ইশারা করলো। এই ফাঁকে বলে রাখি, উপস্থিত যুবতীদের একজনও আমার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায়নি। এমন কি জবের আশপাশেও ঘুর ঘুর করতে দেখলাম একজনকে, কিন্তু আমার দিকে ফিরেও ।তাকালো না কেউ।

উস্তেনের পেছন পেছন ভেতরে ঢুকলাম আমরা। এবং পাঁচ কদম যাওয়ার আগেই, আমার মনে হলো, গুহাটা প্রাকৃতিক নয়, মানুষের তৈরি। লম্বায় হরে প্রায় একশো ফুট, চওড়ায় পঞ্চাশ। অনেক উঁচু। এই মূল গুহার গায়ে প্রতি বারো বা পনেরো ফুট পরপর একেকটা ছোট পথ, সম্ভবত ছোট ছোট প্রকোষ্ঠে গিয়ে ঢুকেছে। গুহামুখ থেকে প্রায় পঞ্চাশ ফুট ভেতরে এটা আগুন জ্বলছে। তার চারপাশে পাতা রয়েছে পশুর ছাল। এখানে থামলো বিলালি। বসতে বললো আমাদের। জানালো, ওর লোকরা খাবার নিয়ে আসবে এক্ষুণি।

আমরা বসলাম। সত্যিই একটু পরে খাবার নিয়ে এলো মেয়েরা। সেদ্ধ ছাগলের মাংস, বড় একটা মাটির পাত্র ভর্তি সদ্য দোয়ানো দুধ এবং এক ধরনের শস্যের সেদ্ধ পিণ্ড। খিদেয় পেট চো-চো করছিলো, মহানন্দে খেলাম আমরা।

খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়ালো বিলালি। ভাষণ দিলো আমাদের উদ্দেশ্যে। সে জানালো, আমাদের এ পর্যন্ত আসাটা অদ্ভুত এক ব্যাপার। পাহাড়ের লোকদের দেশে শ্বেতাঙ্গ আগন্তুক আসবে এমন কথা কেউ কোনো দিন শোনেনি, কল্পনা পর্যন্ত করেনি। মাঝে মাঝে কালো মানুষরা আসে এখানে, তাদের কাছে ওরা শুনেছে, দুনিয়াতে সাদা মানুষ আছে, জাহাজে পাল তুলে দিয়ে তারা সাগরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু তারা যে এখানে এসে পড়বে তা কেউ ভাবেনি। আমরা যখন খালের ভেতর দিয়ে নৌকা টেনে আনছি তখনই ওর লোকরা দেখে আমাদের। খোলাখুলি জানালো বিলালি, সঙ্গে সঙ্গে সে আমাদের ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়ছিলো। কারণ কোনো বিদেশীর এখানে ঢোকা বেআইনী। সে-যাকে মানতেই-হবের কাছ থেকে নির্দেশ আসাতেই শুধু আমাদের না মেরে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।

এ পর্যন্ত শোনার পর বাধা দিলাম আমি। বললাম, ক্ষমা করবেন, পিতা, আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি, আপনাদের এই সে-যাকে-মানতেই-হবে আরো দূরে কোথাও থাকেন। আমরা যে আসছি তা তিনি জানলেন কি করে?

ভালো করে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো বিলালি, নিশ্চিত হয়ে নিলো আমরা ছাড়া আর কেউ নেই গুহায়—সে যখন কথা শুরু করে তখনই উঠে গেছে উস্তেন। তারপর মৃদু হেসে বললো, চোখ ছাড়া দেখতে পায়, কান ছাড়া শুনতে পায় এমন কেউ নেই তোমাদের দেশে? কোনো প্রশ্ন কোরো না; তিনি জানেন।

শুনে একটু কাঁধ ঝাকালাম আমি। বিলালি বলে যেতে লাগলো, আমাদের কি করা হবে না হবে এসম্পর্কে আর কোনো নির্দেশ এখনো আসেনি। তাই সে কিছুক্ষণের ভেতর রওনা হবে আমাহ্যাগারদের রানী সে-যাকে-মানতেই-হবের উদ্দেশ্যে।

কদিন লাগবে ফিরতে? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

অন্তত পাঁচদিন, জবাব দিলো বিলালি। বিস্তৃত জলাভূমি পেরিয়ে যেতে হবে আমাকে। চিন্তা কোরো না, এদিকে সব ব্যবস্থা করে যাচ্ছি, তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। একটু থেমে যোগ করলো, তবে শেষ পর্যন্ত তোমাদের পরিণতি কি হবে তা বলতে পারি না। আশা করার মতো বিশেষ কিছু আমি দেখছি না। আমার নানীর আমল পর্যন্ত জানি, কোনো বিদেশী এলেই নির্মম ভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের বাঁচানোর ব্যাপারে কখনো হস্তক্ষেপ করেননি সে।

কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? বললাম আমি। আপনি নিজেই বৃদ্ধ, আপনার নানীর আমলের মানুষকে মারার বা বাঁচানোর নির্দেশ কি করে দেবেন সে? এর ভেতরে তো একজন মানুষ তিনবার জন্মে তিনবার মরবে।

হাসলো বিলালি—সেই অদ্ভুত হাসি। আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বেরিয়ে গেল গুহা ছেড়ে। পাঁচ দিনের ভেতর আর দেখলাম না তার চেহারা।

বিলালি চলে যাওয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করলাম আমরা। সবদিক বিবেচনা করে আমি একটু শঙ্কিত বোধ না করে পারলাম না। বিশেষ করে এখানকার রহস্যময়ী রানী, সে-যাকে মানতেই হবে সম্পর্কে যা শুনলাম। তা সত্যিই শিউরে ওঠার মতো। যে কোনো আগন্তুককেই নির্দয় ভাবে হত্যা করার। নির্দেশ দেয় সে। লিওকেও দেখলাম বেশ চিন্তিত। তবে একটা কথা ভেবে ও সান্ত্বনা পেতে চাইছে, এই রানী নিঃসন্দেহে ওর বাবার চিঠি এবং সেই পোড়া মাটির ফলকে যার কথা লেখা হয়েছে সেই মহিলা। তার বয়স এবং ক্ষমতা সম্পর্কে বিলালি যা বলেছে তাতে ওর বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে। এদিকে আমার মানসিক অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এই আজগুবি বিষয় নিয়ে লিওর সাথে তর্ক করারও প্রবৃত্তি হলো না। বাইরে গিয়ে স্নান করে আসার পরামর্শ দিলাম আমি।

বিলালি যে কদিন থাকবে না সে কদিন আমাদের দেখাশোনার জন্যে এক লোককে দায়িত্ব দিয়ে গেছে সে। তাকে ডেকে বললাম আমরা গোসল করতে যেতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলো সে। পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল টলটলে একটা ঝরনার কমছে।

স্নান সেরে যখন ফিরে এলাম তখন সূর্য ডুবে গেছে। গুহার ভেতর ঢুকে দেখলাম মানুষে প্রায় ভর্তি। আগুনের চারপাশে বসে সন্ধ্যার খাওয়া সারছে তারা। পোড়া মাটির তৈরি এক ধরনের প্রদীপ জ্বলছে দেয়ালের গায়ে। গুহার মাঝখানেও দেখলাম কয়েকটা প্রদীপ। এগুলো ছোট ছোট। পশুর চর্বি আর গাছের আঁশের সলতে দিয়ে জ্বালানো।

গোসল করে আসায় এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে শরীর। কিছুক্ষণ বসে বসে লোকগুলোর খাওয়া দেখলাম, তারপর আমাদের নতুন তত্ত্বাবধায়ককে ডেকে বললাম, আমরা শুতে যেতে চাই।

বিনাবাক্যব্যয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। বিনয়ের সঙ্গে আমার হাত ধরে নিয়ে চললো, গুহার দেয়ালে কিছুটা পর পর যে ছোট পথগুলো দেখেছিলাম তার একটার দিকে। সরু গলির ভেতর দিয়ে পাঁচ-ছয় পা যাওয়ার পর হঠাৎ চওড়া হয়ে গেল গলিটা। আট ফুট লম্বা, আট ফুট চওড়া বর্গাকার একটা কুঠুরি। এক পাশে কুরির এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত একটা পাথরের চাঙড়, ওপরটা সমান, মাটি থেকে প্রায় তিন ফুট উঁচু। এই পাথরটার ওপরই ঘুমাতে হবে আমাকে। কোনো জানালা নেই কুঠুরিতে, বাতাস ঢোকার কোনো ছিদ্রও না। প্রথম দর্শনেই মনে হলো মড়া রাখার ঘর, পাথরটার ওপর শুইয়ে রাখা হয় মৃতদেহ। কথাটা ভাবতেই সরসর করে খাড়া হয়ে গেল ঘাড়ের চুলগুলো। কিন্তু কিছু করার নেই, এখানেই শুতে হবে। কম্বল নেয়ার জন্যে ফিরে এলাম বড় মূল গুহায় আমাদের নৌকার জিনিসপত্র সব এখন ভেতরে এনে রাখা হয়েছে। লিও আর জবের সঙ্গে দেখা হলো, ওদেরও একই রকম দুটো আলাদা কুরিতে থাকতে দেয়া হয়েছে। কিন্তু জব কিছুতেই একা এক ফুঠরিতে থাকতে রাজি নয়। বলছে ভয়েই মরে। যাবে। আমি যদি দয়া করে অনুমতি দিই তো আমার সঙ্গে কাটাতে পারে রাতটা। সানন্দে অনুমতি দিলাম, কারণ আমার অবস্থাও ওর চেয়ে ভাল নয় মোটেই।

মোটামুটি আরামে কাটলো রাতটা। মোটামুটি বলছি কারণ; ভয়ানক একটা দুঃস্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কোনো অসুবিধা হয়নি। ভোরে শিঙার শব্দে জেগে উঠলাম। সেই ঝরণার কাছে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এলাম। তারপর সকালের নাশতা দেয়া হলো।

সবে খাওয়া শুরু করেছি আমরা, এমন সময় এক মহিলা—মোটেই যুবতী বলা যাবে না তাকে, অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছে বয়সের সে পর্ব—এগিয়ে এলো জবের দিকে। সবার সামনে জড়িয়ে ধরে চুমো খেলো ওকে। গুরু গম্ভীর জবের চেহারাটা যা হলো, সে না দেখলে কল্পনা করা সম্ভব নয়। যতটুকু জানি আমার মতো ও-ও একটু নারী-বিদ্বেষী। তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো ও। ঠেলে সরিয়ে দিলো তিরিশোত্তীর্ণ মহিলাটিকে।

কক্ষনো না! ঢোক গিলে বললো জব। কিন্তু মেয়ে লোকটা ভালো লজ্জা পাচ্ছে ও। এগিয়ে গিয়ে আবার আলিঙ্গন করলো।

ভাগো, ভাগো! বেহায়া মেয়ে মানুষ কোথাকার! চিৎকার করলো জব। হাতের কাঠের চামচটা নাড়তে নাড়তে বললো, আমাকে ক্ষমা করবেন, স্যার, আমি কখনোই পাত্তা দিইনি ওকে। ও, ঈশ্বর! আবার আসছে। ধরুন ওকে, মিস্টার হলি! দয়া করে ধরুন! আমি মরে যাবো, সত্যিই বলছি, দুশ্চরিত্র নই আমি। এ পর্যায়ে এসে রণেভঙ্গ দিলো জব। চামচ, খাবার সব ফেলে উধ্বশ্বাসে ছুটলো গুহার বাইরে। প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে পড়লো উপস্থিত আমাহ্যাগাররা। কিন্তু হতভাগিনী মেয়েটা হাসলো না, অন্যদের হাসি দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো সে। দুপদাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল গুহা থেকে।

একটু পরেই ফিরে এলো জব। মুখ দেখে বুঝতে পারছি, এখনো আতঙ্কিত বোধ করছে ও-এই বুঝি ফিরে এলো মেয়েটা। উপস্থিত আমাহ্যাগারদের আমি ব্যাখ্যা করে বোঝালাম, দেশে বউ আছে জবের, এখন যদি আরেকটা বিয়ে করে তাহলে পারিবারিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে, তাই মেয়েটাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়নি ও। কি বুঝলো ওরা কে জানে, কিছু বললো না।

নাশতার পর বেরোলাম আমাহ্যাগারদের গৃহপালিত পশুর পাল দেখতে। সঙ্গে এলো উস্তেন। স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী ও এখন লিওর বাগদত্তা। ওর কাছে শুনলাম ওদের জীবন, রীতিনীতি আর রানী সম্পর্কে নানা কথা। আমাহ্যাগার জাতির সূচনা বা কোত্থেকে ওরা এলো এখানে সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে পারলো না উস্তেন। তবে জানালো, যেখানে সে অর্থাৎ ওদের রানী থাকেন সেখানে বিশাল বিশাল পাথরের তৈরি থাম আছে। কোনো নগরের ধ্বংসাবশেষ সম্ভবত। জায়গাটার নাম কোর। প্রাচীনকালে এক জাতি বাস করতো সেখানে। সম্ভবত তারাই আমাহ্যাগারদের পূর্বপুরুষ। এখন আর কেউ থাকে না সেখানে। ভয়ে কেউ যায়ও না। বিশাল বিস্তৃত জলাভূমির এখানে ওখানে আরো প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ আছে। এখানকার গুহাগুলোও প্রাচীনকালের কোনো জাতির তৈরি। আমাহ্যাগারদের লিখিত কোনো আইন নেই, যা আছে তা হলো প্রথা—লিখিত আইনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এই প্রথার বাঁধন। প্রথার বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে গোত্র পিতার নির্দেশে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

ওদের রানী সে। কালেভদ্রে তাকে দেখা যায়—দু’বা তিন বছরে খুব বেশি হলে একবার। সে সময় লম্বা আলখাল্লা দিয়ে তার সারা শরীর ঢাকা থাকে, এমনকি মুখটাও। সেজন্যে তার মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি কারো। তার সেবা যত্নের জন্যে যারা আছে তারা বোৰা-কালা। ফলে তাদেরও কেউ কখনো বলতে পারেনি কেমন দেখতে সে। তবে যতটুকু জানা গেছে, সে অসম্ভব সুন্দরী, এমন সুন্দরী পৃথিবীতে কখনো সৃষ্টি হয়নি; ভবিষ্যতেও হবে না। সে অমর এবং পৃথিবীর সবকিছুর ওপর ক্ষমতা আছে তার। তবে এসব কতদূর সত্যি সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে উস্তেনের। ওর ধারণা, রানী মাঝে মাঝে একজন স্বামী বেছে নেয়। যেই মাত্র একটা মেয়ে বাচ্চা জন্ম নেয় অমনি উধাও হয়ে যায় এই স্বামী বেচারা। মেয়ে বাচ্চাটা বড় হয়ে এক সময় পুরানো রানীর জায়গা দখল করে আর পুরানো রানীকে কোনো গুহায় কবর দিয়ে রাখা হয়। রানীর নিয়মিত কোনো সেনাবাহিনী নেই, তবে রক্ষী আছে। এদের মধ্যে কেউ তার অবাধ্য হলে তাকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়।

দেশটা কত বড় এবং কত লোক থাকে এখানে, উস্তেনকে জিজ্ঞেস করলাম। ও বললো, দশটা গোত্র আছে এখানে। সবচেয়ে বড়টা থাকে রানী যেখানে থাকে সেখানে। সবগুলো গোত্রই গুহায় বাস করে। জলাভূমি অতিক্রম করতে গিয়ে প্রায়ই অসুখে পড়ে এখানকার লোকেরা, এবং মারা যায়, ফলে সংখ্যায় খুব একটা বেড়ে উঠতে পারেনি তারা। পশুর পাল দেখতে দেখতে আমাহাগার জাতি সম্পর্কে এ ধরনের আরো নানা তথ্য জেনে নিলাম উস্তেনের কাছ থেকে।

.

চারদিন কেটে গেছে। উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু ঘটেনি এই চারদিনে। সন্ধ্যার পর আগুনের সামনে বসে আছি আমরা—আমি, লিও, জব আর উস্তেন। মাহমুদ সেই যে প্রথম দিন গুহার এক কোনায় গিয়ে বসেছে, আর নড়েনি। খাওয়ার সময় হলে খেয়েছে, ভোরে একবার বাইরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসেছে, তারপর দিনরাত ক্রমাগত ডেকে গেছে আল্লাহ আর নবীকে-যেন তাকে রক্ষা করেন।

রাতের খাওয়া শেষ। একটু পরে শুতে যাবো আমরা। উস্তেন কখন বিদায় নেবে সেই অপেক্ষায় আছি। কিন্তু বিদায় নেয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না তার ভেতর। নীরবে বসে আছে সে মা উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা। লিওর সোনালী। চুলের ওপর হাত রেখে সম্বোধন করলো ওকে। তারপর গাঢ় স্বরে অপূর্ব এক সুরে আবৃত্তি করে চললো অদ্ভুত কিছু কথা। লিওর জন্যে গভীর ভালোবাসা আর উদ্দাম কামনা যেন গলে গলে পড়লো কথাগুলো থেকে।

হঠাৎ থেমে গেল ও। ভয়ের ছায়া পড়লো দুচোখে। লিওর মাথা থেকে হাত উঠিয়ে ইশারা করলো অন্ধকারের দিকে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম আমরা। কিন্তু কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম না।

কি, উস্তেন? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলাম আমি।

না, বললো ও। কিছু না। আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না। খামোকা কেন ভয় পাইয়ে দেবো তোমাদের? তারপর গভীর আবেগে চুমু খেলো লিওর কপালে–যেন মা আদর করছে শিশুকে।

যখন আমি থাকবো না, ও বললো। যখন রাতে হাত বাড়িয়ে আমাকে পাবে না, তখন ভেবে আমার কথা। জানি, আমি তোমার পা ধুইয়ে দেয়ারও যোগ্য নই তবু ভেবো, সত্যিই আমি ভালোবাসতাম তোমাকে। এখন এসো, যে সুযোগ আমরা পেয়েছি তার সদ্ব্যবহার করি। কবরে তো প্রেম নেই, উষ্ণতা নেই, নেই ঠোঁটের ছোঁয়া। কাল কি হবে কে বলতে পারে? আজকের রাতটাই আমাদের, কালকের জন্যে বসে থেকে কেন সেটা আমরা নষ্ট করবো?

.

০৮.

পরদিন সকালে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক এলো সঙ্গে আরো কয়েকজন আমাহাগারকে নিয়ে। জানালো, আজ সন্ধ্যায় আমাদের সম্মানে এক ভোজের আয়োজন করেছে তারা। প্রতিবাদ করলাম আমি। সাধ্য মতো বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমরা এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ লোক নই যে আমাদের সম্মানে ভোজের আয়োজন করতে হবে। চুপচাপ আমার কথাগুলো শুনলো ওরা। বুঝতে পারলাম বিরক্ত হচ্ছে, শেষে ঠিক করলাম চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

সূর্য অস্ত যাওয়ার ঠিক আগে আমাকে জানানো হলো, সব তৈরি। জবকে নিয়ে গুহায় ঢুকলাম। লিও আগেই উপস্থিত হয়েছে সেখানে। উস্তেন যথারীতি আছে ওর সাথে। ওরা দুজন কোথায় যেন বেড়াতে বেরিয়েছিলো, ভোজের কথা জানতো না। উস্তেন যখন শুনলো একথা দেখলাম আতঙ্কের ছায়া পড়লো ওর সুন্দর মুখে। তাড়াতাড়ি এক লোককে ধরে নিচু স্বরে কি যেন জিজ্ঞেস করলো। লোকটার জবাব শুনে স্বস্তির একটু নিঃশ্বাস ছাড়লো। এর পর অন্য এক লোকের কাছে গিয়ে প্রতিবাদের ভঙ্গিতে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো ও! লোকটা একজন কর্তাব্যক্তি। ঝাঁঝের সাথে জবাব দিলো ওর কথার। তার পর হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলো দুজন লোকের মাঝখানে। আর কোনো উচ্চবাচ্য করলো না মেয়েটা।

আজ একটু অস্বাভাবিক বড় করে তৈরি করা হয়েছে আগুন। তার চারপাশে গোল হয়ে বসেছে প্রায় পঁয়ত্রিশ জন পুরুষ আর দুজন স্ত্রীলোক-উস্তেন এবং জবকে প্রেম জানাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলো যে সেই মেয়েটা। নিঃশব্দে বসে আছে সবাই। প্রত্যেকের পেছনে গুহার মেঝেতে ছোট একেকটা গর্ত। তার ভেতর খাড়া করে রাখা তাদের বল্লম। মাত্র এক কি দুজন হলদেটে লিনেনের আলখাল্লা পরে আছে। কোমরে চিতার চামড়া ছাড়া আর কিছু নেই অন্যদের শরীরে।

এবার কি হবে, স্যার? সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলো জব। সেই মেয়েলোকটিও এসেছে! আবার চড়াও হবে না তো আমার ওপর? আরে, মাহমুদকেও খেতে ডেকেছে দেখছি। বেটি ওর সাথেই খাতির জমিয়ে আলাপ করছে। যাক বাবা, আমার কথা ভুলেছে তাহলে!

পুরো ব্যাপারটাতেই কেমন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি আমি। শুধু রহস্য নয়, বিপদেরও। একদিন সব সময়ই অন্ত্যজ ভেবে আলাদা খাবার দেয়া হয়েছে মাহমুদকে। আজ হঠাৎ এমন কি ঘটলো যে, ওকে এক আসনে নিয়ে খেতে বসছে এরা?

ব্যাপার বিশেষ সুবিধার লাগছে না, লিও আর জবের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি। তৈরি থাকা দরকার। রিভলভার আছে তো তোমাদের সাথে?

আমার কাছে আছে, কাপড়ের নিচে কোটায় টোকা দিলো জব। কিন্তু লিওর কাছে শিকারের ছুরি ছাড়া কিছু নেই।

সবাই বসে গেছে। আমরাই কেবল বাকি। এ-সময় লিওর রিভলভার খুঁজতে গিয়ে দেরি করা উচিত হবে না। দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গিয়ে এক সারিতে বসে পড়লাম আমরা। গুহার একটা দেয়াল আমাদের ঠিক পেছনে।

আমরা বসার প্রায় সাথে সাথে লম্বাটে চেহারার একটা মাটির পাত্র এলো। চোলাই করা পানীয় তাতে। একজন মুখ লাগিয়ে খাচ্ছে পানীয় তারপর পাশের জনকে দিচ্ছে। এভাবে হাতে হাতে ঘুরে অবশেষে আমাদের কাছে এলো পাত্রটা। অদ্ভুত চেহারা ওটার। দুই হাতলওয়ালা। অ্যানাহ্যাগারদের এখানে যত পাত্র দেখেছি তার বেশিরভাগই এই চেহারার। প্রাচীন কোনো পদ্ধতিতে তৈরি করে পরে পোড়ানো হয়েছে। দুপাশে দুটো দৃশ্য খোদাই করা। নিপুণ হাতের কাজ। একদিকে প্রচণ্ড বলশালী কিছু লোক বল্লম হাতে আক্রমণ করছে একটা মর্দা হাতিকে। উল্টোদিকে খোলামেলা একটা প্রেমের দৃশ্য, অদ্ভুত সরলতায় আঁকা। প্রশংসার চোখে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম পাত্রটার দিকে। তারপর অন্যদের অনুকরণে গলায় ঢেলে দিলাম খানিকটা পানীয়। আশ্চর্য স্বাদ। অপূর্ব বলবো না, তবে খারাপ যে নয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এক সময় শেষ হলো পান পর্ব। কেউ বাকি নেই। নিয়ে যাওয়া হলো পাত্রটা। তারপর অনেকক্ষণ কিছু ঘটলো না। আর কোনো খাবার বা পানীয় এলো না। সবাই চুপচাপ বসে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিরাট অগ্নিকুণ্ডের দিকে। ওদের নীরবতা দেখে আমরাও চুপ মেরে গেছি। আগুন এবং আমাদের মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গা সেখানে বিরাট একটা কাঠের বারকোশ, চার কোনায় চারটে হাতল লাগানো। বারকোশটার পাশে লম্বা হাতলওয়ালা বিরাট একটা সাঁড়াশি, আগুনের উল্টোদিকে একই রকম আরেকটা।

প্রায় এক ঘণ্টা কেটে গেছে। কেমন ভৌতিক একটা পরিবেশ। সবাই নীরব, নিষ্পন্দ। আগুনের লালচে আভা পড়েছে বসে থাকা আমাহ্যাগারদের মুখে। রীতিমতো সম্মোহিত হওয়ার মতো পরিবেশ। এমন সময় আমাদের সামনে বসে থাকা এক লোক চিৎকার করে উঠলো—

আমাদের খাওয়ার মাংস কোথায়?

গোল হয়ে বসে থাকা প্রতিটা আমাহ্যাগার আগুনের দিকে দুহাত বাড়িয়ে এক সাথে মাপা মাপা গলায় জবাব দিলো–

মাংস আসবে।

কিসের? ছাগলের? একই লোক প্রশ্ন করলো।

ছাগল তবে শিং ছাড়া, এবং ছাগলের চেয়েও ভালো, আমরা তাকে হত্যা করবো, পেছন দিকে একটু ঘুরে বল্লমের হাতল ধরে আবার সম্মিলিত কণ্ঠে জবাব দিলো অন্যরা। তারপর সামনে ফিরলো।

তাহলে ওটা কি ষড়? আবার প্রশ্ন করলো লোকটা।

ষাড়, তবে শিং ছাড়া, আর ষাড়ের চেয়েও ভালো, আমরা তাকে হত্যা করবো, একই ভঙ্গিতে বল্লম ধরে জবাব দিলো অন্যরা।

কিছুক্ষণের জন্যে আবার চুপচাপ। তারপর দেখলাম, জবকে প্রেম নিবেদন করেছিলো যে সেই মহিলা জড়িয়ে ধরেছে মাহমুদকে। গভীর সোহাগের ভঙ্গিতে গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকছে ওর নাম ধরে। গলায় সোহাগ হলেও মহিলার চোখের দৃষ্টিতে আশ্চর্য পাশবিকতা। মাহমুদের সারা শরীরের ওপর ঘুরছে সে দৃষ্টি। কেন জানি না, দৃশ্যটা দেখে আতঙ্কিত বোধ করতে লাগলাম আমি। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। লিও এবং জবের অবস্থাও একই রকম। বেচারা মাহমুদের কালো শরীর ফ্যাকাসে রক্তশূন্য হয়ে গেছে।

মাংস রান্নার জন্যে তৈরি? জিজ্ঞেস করলো সেই লোক।

তৈরি, তৈরি!

পাত্র গরম হয়েছে?

হয়েছে, হয়েছে!

হায়, ঈশ্বর, বিড়বিড় করে বললো লিও। বাবার লেখা সেই কথাটা মনে আছে, আগন্তুকের মাথায় উল্টো করে পাত্র বসিয়ে দেয় যে জাতি–!

লিওর মুখ থেকে সবেমাত্র পড়েছে কথাটা, এমন সময় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো বিশাল দুই আমাহ্যাগার। ছোঁ মেরে সাঁড়াশি দুটো তুলে নিয়ে আগুনের ওপর ধরলো। এদিকে সেই মহিলা মাহমুদকে আদর করা থামিয়ে আচমকা একটা। ফাঁস বের করেছে তার কোমর পেঁচিয়ে থাকা চামড়ার নিচ থেকে। মাহমুদ কিছু টের পাওয়ার আগেই সেটা পরিয়ে দিলো তার গলায়। হ্যাচকা এক টানে এঁটে ফেললো কষে। এই ফাঁকে পাশের লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়ে চেপে ধরলো মাহমুদের। পা-দুটো। এদিকে সেই দুই লোক সাড়াশি দিয়ে নেড়ে একটু ছড়িয়ে দিলো আগুন। তারপর সাঁড়াশি দিয়ে ধরে আগুনের ভেতর থেকে উঠিয়ে আনলো বিরাট একটা মাটির পাত্র গনগনে আগুনের আঁচে সাদা হয়ে গেছে সেটা। এক লাফে মাহমুদের কাছে পৌঁছুলো তারা। গরম পাত্রটা এবার নামিয়ে আনবে বেচারার মাথায়!

হত্যভাগ্য আরব তখন প্রাণপণে যুঝছে নিজেকে মুক্ত করার জন্যে। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারছে না। সেই পিশাচ মেয়েলোকটা গলায় ফাঁস পরিয়ে দেয়ার পরও দুহাতে জড়িয়ে ধরে আছে তাকে। পা-দুটোও চেপে ধরেছে দশাসই এক আমাহাগার।

আর দেরি করা যায় না। প্রচণ্ড এক গর্জন করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। হাতে চলে এসেছে রিভলভার। এক মুহূর্ত দেরি না করে গুলি করলাম সেই পিশাচীর দিকে। পিঠে লাগলো গুলি। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল সে। একই সঙ্গে অমানুষিক প্রচেষ্টায় তীব্র এক লাফ দিলে মাহমুদ। পরমুহূর্তে মেয়েলোকটার মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়লো ওর মৃতদেহও। রিভলভারের গুলি একই সঙ্গে দুজনের শরীর ভেদ করে গেছে। ভেবে মনে মনে শান্তি পেলাম, শ্বেততপ্ত পাত্র মাথায় নিয়ে মরার চেয়ে এভাবে অনেক আরামে মরেছে মাহমুদ।

মুহূর্তের জন্যে নীরবতা নেমে এলো গুহায়। এর আগে কখনো আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন শোনেনি আমাহাগাররা। হতভম্ব হয়ে গেছে তারা। আমাদের কাছেই বসে থাকা এক লোক সংবিৎ ফিরে পেলো প্রথমে। হ্যাঁচকা এক টানে পিঠের কাছ থেকে বল্লমটা নিয়ে ছুটে গেল লিওর দিকে।

পালাও! চিৎকার করেই ছুটলাম আমি গুহার মুখের দিকে। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারলাম না। ইতিমধ্যে নড়েচড়ে উঠেছে সব কজন আমাহ্যাগার। বাইরে থেকেও অনেকে হাজির হয়েছে ইমুখের কাছে। কয়েক পা ছুটেই থেমে পড়লাম আমি। ধীরে ধীরে পিছিয়ে আসতে লাগলাম। লিও আর জব এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। একসাথে পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা। গুহার ভেতরের পয়ত্রিশজন আমাহ্যাগার পা-পা করে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। এদিকে বাইরে থেকেও পিল পিল করে ঢুকতে শুরু করেছে আরো লোক।

পালানোর কোনো উপায় নেই। এদিক ওদিক তাকালাম আমি। একপাশে হার দেয়ালের গায়ে একটা বেদী মতো দেখলাম। রাতে বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয় ওটার ওপর। ফুট তিনেক উঁচু, চওড়ায় আট ফুট মতো। জব আর লিওর উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে বললাম, ওটার দিকে। পরমুহূর্তে আচমকা এক দৌড়ে বেদীটার ওপর গিয়ে উঠলাম আমরা। লিও মাঝখানে, আমি দাঁড়িয়ে আছি ওর ডানে আর জব বাঁয়ে।

পা-পা করে পিছাতে পিছাতে হঠাৎ ছুট দেয়ায় মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল আমাহ্যাগাররা। তারপর আবার এগিয়ে আসতে লাগলো ধীর পায়ে। বল্লম উঁচিয়ে ধরেছে সবাই। মৃত্যু নিশ্চিত। একবার ভাবলাম গুলি করি। কিন্তু লাভ কি? কজনকে মারবো? অনিবার্য নিয়তিকে মেনে নেয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা।

বিদায়, হোরেস কাকা, ফিসফিস করে অনেকটা আপন মনে বললো লিও। কোনো আশা নেই। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মরবো আমরা। আমার জন্যেই আজ তোমাদের এই দুর্গতি–পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো। বিদায়, জব।

সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা, লিও, বললাম আমি। দুঃখ কোরো না।

এই সময় হঠাৎ রিভলভার বের করে গুলি করলো জব। মুখ থুবড়ে পড়লো একজন।

হুড়োহুড়ি পড়ে গেল আমাহ্যাগারদের ভেতর। ছুটে আসতে লাগলো তারা। আমিও গুলি শুরু করলাম এবার। কয়েক সেকেণ্ডের ভেতর খালি করে ফেললাম রিভলভার। পাঁচজন মরলো। নতুন করে গুলি ভরার সময় নেই। ব্যাপারটা যেন টের পেলো লোকগুলো। গুলি বন্ধ হতেই আবার ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে লাগলো তারা।

বিশালদেহী এক আমাহ্যাগার লাফ দিয়ে উঠলো বেদীর ওপর। লিওর ছুরি ধরা হাতের এক আঘাতে ছিটকে নিচে গিয়ে পড়লো লোকটা। আমিও একজনকে কাবু করলাম ছুরি মেরে। কিন্তু জবের আঘাতটা ফস্কে গেল। গাট্টাগোট্টা আমাহ্যাগারটা ধরলো ওকে। কোমর পেঁচিয়ে ধরে নিচে নিয়ে যেতে লাগলো। জব নিজেকে মুক্ত করার জন্যে সমানে হা্ত-পা ছুঁড়ছে। এই সময় ধস্তাধস্তিতে ছুরিটা ছিটকে পড়লো ওর থেকে। পাথরের বেদীর কোনায় যা খেয়ে ছুটে গেল সেটা গাট্টাগোট্টার বুক বরাবর। ভারি ছুরিটা অর্ধেক ঢুকে গেল আমাহ্যাগারটার বুকে। জবকে ছেড়ে দিয়ে লুটিয়ে পড়লো সে।

এদিকে দুজন একসাথে হামলা চালিয়েছে আমার ওপর। ভাগ্য ভালো, তাড়াহুড়োয় দুজনই ফেলে এসেছে তাদের বল্লম। সামনের জনের বুক বরাবর ছুরি চালিয়ে হ্যাচকা টানে সেটা বের করে নিলাম। পরমুহূর্তে বসে পড়ে উঠে দাঁড়ালাম আবার। এখন দ্বিতীয় জনের বুক আমার সামনাসামনি। প্রথম জনের অবস্থা হলো এরও।

লিওর দিকে তাকালাম আমি। শোচনীয় অবস্থা ওর। একসাথে পাঁচ ছজন ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওর ওপর। একজনকে আঘাত করে ঠেলে ফেলতে না ফেলতেই। আরেকজন এগিয়ে যাচ্ছে। রীতিমতো একটা জগাখিচুড়ি জটলা। একসঙ্গে এতজনে আক্রমণ করেছে বলেই বোধহয় এখনো লিওকে ওরা কাবু করতে পারেনি। নিজেরা নিজেরা ঠেলাঠেলি করছে খামোকা।

ইতিমধ্যে আরো দুজন এগিয়ে এসেছে আমার দিকে। বেশিরভাগ আমাহ্যাগারই কেন যে লিওর দিকে ছুটে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। যা হোক, এ দুজনকেও আমি সহজেই কাবু করতে পারলাম। তারপর মাথা তুলতেই আঁতকে উঠলাম। বেদীর ওপর পড়ে গেছে লিও। চার পাঁচজনে ঠেসে ধরেছে ওর হাত পা।

একটা বলুম দাও, চিৎকার করলো একজন। একটা বল্লম, ওর গলা কাটবো, আর একটা পাত্র দাও, রক্ত রাখবো।

মুহূর্তের মধ্যেই দেখলাম, দীর্ঘদেহী এক আমাহাগার ছুটে যাচ্ছে বল্লম হাতে। চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি।

হঠাৎ অন্যরকম একটা কোলাহলের শব্দ কানে এলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও চোখ খুললাম আমি। দেখলাম, উস্তেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে লিওর ওপর। নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে রেখেছে ওর অচেতন দেহ। দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে গলা। দুতিন জন পুরুষ আমাহাগার টানা হ্যাঁচড়া করে সরানোর চেষ্টা করছে। মেয়েটাকে। পারছে না।

অবশেষে ধৈর্য হারিয়ে ফেললো তারা।

দুজনকেই খতম করে দাও, চিৎকার করে উঠলো কেউ একজন।

বল্লম হাতে লোকটা সোজা হলো। এবার সর্বশক্তিতে নামিয়ে আনবে অস্ত্র যেন এক ঘায়েই দুজনকে শেষ করা যায়। আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি।

এমন সময় গভীর গম্ভীর একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো আমার কানে। গুহার দেয়ালে বজ্রের মতো প্রতিধ্বনি উঠলো—

থামো!

পরমুহূর্তে জ্ঞান হারালাম আমি।

.

০৯.

জ্ঞান ফিরতে দেখলাম একটা চামড়ার মাদুরের ওপর শুয়ে আছি। কাছেই জ্বলছে আগুনের কুণ্ড—সেই আগুনের কুণ্ড যার পাশে ভোজ খেতে বসেছিলাম আমরা। একটু দূরে শুয়ে আছে লিও। এখনো জ্ঞান ফেরেনি। উস্তেন ঝুঁকে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছে ওর শরীরের একটা গভীর ক্ষত। উস্তেনের পেছনে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে, জব। আপাতদৃষ্টিতে অক্ষত মনে হলেও থর থর করে কাঁপছে ও, ভয়ে না ক্লান্তিতে, জানি না। আগুনের ওপাশে গায়ে গায়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে আমাদের হাতে নিহত আমাহ্যাগারদের। হতভাগ্য মাহমুদ আর সেই মেয়েলোকটা ছাড়াও বারোটা মৃতদেহ দেখলাম। বাঁ-দিকে কিছুদূরে একদল লোক বেঁচে যাওয়া মানুষখেকোগুলোকে বাঁধছে। প্রথমে প্রত্যেককে পিছমোড়া করে তারপর দুজন দুজন করে একসাথে। বন্ধনপর্ব তদারক করছে বিলালি।

আমাকে উঠতে দেখে এগিয়ে এলো সে। বললো, আশা করি ভালো বোধ করছে এখন।

ভালো কিনা জানি না, তবে সারা শরীরে ব্যথা।

ঝুঁকে লিওর ক্ষতটা পরীক্ষা করলো সে। মারাত্মক ভাবে কেটেছে। ভাগ্য ভালো, আরো গভীরে ঢোকেনি বল্লমের ফলা। চিন্তা কোরো না, ভালো হয়ে যাবে

ঠিক সময়মতো এসেছিলেন, পিতা, আমি বললাম। আর কয়েক সেকেণ্ড দেরি হলেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যেতাম আমরা।

ভয় পেয়ো না, পুত্র। সমুচিত শাস্তি দেয়া হবে ওদের। হাড় মাংস আলাদা করা হবে। সে-যাকে-মানতেই-হবের কাছে পাঠানো হবে ওদের। বলো তো, কি করে ঘটলো ঘটনাটা?

সংক্ষেপে আমি বর্ণনা করলাম।

হুঁ, জবাব দিলো বিলালি। আসলে এখানকার নিয়মই ওরকম। কোনো বিদেশী এলে গরম পাত্র দিয়ে হত্যা করে তাকে খেয়ে ফেলা হয়।

চমৎকার অতিথিপরায়ণতা যা হোক, বললাম আমি। আমাদের দেশে আমরা অতিথিকে আপ্যায়ন করি খাবার দিয়ে আর আপনারা অতিথিকে খেয়ে নিজেরা আপ্যায়িত হন।

কি করবো বলো, কাঁচুমাচু মুখে বললো বিলালি। যেখানকার যা নিয়ম। আমি বুঝি, আমাদের সব নিয়ম ভালো নয়, কিন্তু ইচ্ছে করলেই আমি তা বদলাতে পারি না। সে-যাকে-মানতেই-হবে যখন নির্দেশ পাঠালেন, তোমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে তখন ঐ কালো লোকটা সম্পর্কে কিছু বলেননি। ফলে স্বভাবতই আমার লোকরা ধরে নিয়েছে ওকে বাঁচিয়ে না রাখলেও চলবে। যা হোক, যে ঘৃণ্য কাজ ওরা করেছে তার প্রতিফল তারা পাবে।

তবে একটা কথা ঠিক, বলে চললো বুড়ো, দারুণ সাহসের সাথে লড়েছে তোমরা। আচ্ছা, পুত্র বেবুন, বলো তো, মারার সময় ওদের গায়ে এমন গর্ত করলে কিভাবে?

রিভলভারের রহস্য যথাসম্ভব সরল ভাষায় বুঝিয়ে বললাম বিলালিকে। কি বুঝলো জানি না। তবে হাঁ করে শুনলো সে আমার কথা।

একটু পরে চোখ মেললো লিও। এখনো পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে পায়নি। জবও এতক্ষণে একটু সামলে নিতে পেরেছে—অন্তত হাত-পা কাঁপা কমেছে। উঠে এসে একটু ব্র্যাণ্ডি (আমাদের সাথে এখনো কিছুটা আছে) খাইয়ে দিলো লিওকে। তারপর আমি, জব আর উস্তেন ধরাধরি করে শোয়ার জায়গায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম ওকে। জব রইলো ওর কাছে। আমি গিয়ে শুয়ে পড়লাম আমার কুঠরিতে।

রাতে ভালো ঘুম হলো না। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম বার বার। অবশেষে সকাল হলো। উঠতে গিয়ে টের পেলাম প্রচণ্ড যন্ত্রণা সারা শরীরে। আবার শুয়ে পড়লাম। সাতটার দিকে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে জব এলো। পচা আপেলের রং ধরেছে ওর গোল মুখটায়। জানালো, লিও ভালো মতোই ঘুমিয়েছে। ঘণ্টা দুয়েক পরে এলো বিলালি (জব তার নাম দিয়েছে বিলি ছাগ, সম্ভবত দাড়ির কারণে)। আমি চোখ বুজে ঘুমিয়ে থাকার ভান করলাম।

আহ! বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম ওকে (এরকম প্রায়ই নিজে নিজে বিড়বিড় করে কথা বলে সে) কি কুৎসিত এটা! ঠিক যেন বেবুন-হ্যাঁ বেবুন, একেবারে মানানসই নাম! আর অন্যটা—সিংহের সাথে তুলনা করা যায়, কি চেহারায় কি সাহসে। তাহলে ওটার নাম সিংহ। দুটোকেই আমার খুব ভালো লেগেছে। নিশ্চয়ই সে একে জাদু করবেন না। বেচারা বেবুন! ঘুমিয়ে আছে, ঘুমাক। জাগিয়ে কাজ নেই।

পা টিপে টিপে ঘুরে দাঁড়ালো সে। বুড়োর কুঠুরির মুখে না পৌঁছা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমি। তারপর ডাকলাম, কে, পিতা?

হ্যাঁ, পুত্র, আমি। দেখতে এসেছিলাম, কেমন আছো। সে এখুনি তাঁর কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন তোমারে। কিন্তু তোমরা যেতে পারবে বলে তো মনে হচ্ছে না।

না, পিতা, একটু সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কোথাও নড়তে পারবো না আমরা। একটু থেমে বললাম, আমাকে একটু বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন? এই + জায়গাটা একদম ভালো লাগছে না।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। এখানকার বাতাসে কেমন একটা দুঃখের গন্ধ। ছোট বেলায় আমিও সহ্য করতে পারতাম না এ জায়গা। জানো তো, আমাদের কেউ মারা গেলে তাকে আমরা প্রথমে এখানে এনে রাখি?

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে শিউরে উঠলাম আমি। তাহলে ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম। শরীরের সব যন্ত্রণা ভুলে উঠে বসলাম। বিলালির কাঁধে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গেলাম লিওকে দেখতে। আমার চেয়ে অনেক বেশি বিধ্বস্ত অবস্থা ওর। প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে মানসিকভাবে বেশ উৎফুল্ল দেখলাম ওকে। জব আর উস্তেন বসে আছে ওর পাশে।

আমি টুকটাক কিছু আলাপ করলাম লিওর সাথে। তারপর ওকে সঙ্গে নিয়ে বিলালির পেছন পেছন বেরিয়ে এলাম গুহার বাইরে-দিনের সূর্যের নিচে। গুহা মুখের পাশে ছায়ায় বসলাম আমরা। পরের দুটো দিন এখানেই কাটালাম। তৃতীয় দিন সকালে মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে গেল আমার আর জবের অবস্থা। লিওর অবস্থাও অনেক ভালো। সুতরাং বিলালি প্রস্তাব করতেই রহস্যময়ী সে যাকে-মানতেই হবে যেখানে থাকে সেই কোর-এর পথে বেরিয়ে পড়তে রাজি হয়ে গেলাম আমরা।

.

১০.

এক ঘণ্টার ভেতর পাঁচটা পালকি এনে রাখা হলো গুহার মুখে। প্রতিটার জন্যে চারজন করে বাহক আর দুজন বদলি বাহক। পাহারাদার হিসেবে যাবে পঞ্চাশজন আমাহ্যাগারের একটা দল। তিনটে পালকি আমাদের তিন জনের। জন্যে, একটা বিলালির জন্যে, আর একটায় কে যাবে? উস্তেন?

মেয়েটা কি যাবে আমাদের সাথে? বিলালিকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

কাঁধ ঝাঁকালো বৃদ্ধ। ওর ইচ্ছা! আমাদের দেশে মেয়েরা খুশি মতো সব করতে পারে। ওদের পূজা করি আমরা, এবং ইচ্ছে মতো চলতে দিই, কারণ ওদের ছাড়া পৃথিবী চলতে পারে না; ওরা তো প্রাণের উৎস।

হুঁ, এ-ভাবে কখনো ভেবে দেখিনি আমি।

ওদের পূজা করি আমরা, বলে চললো বৃদ্ধ, তবে ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ ওরা অসহ্য হয়ে ওঠে আমাদের কাছে!

অসহ্য হয়ে ওঠে নাকি?

মোটামুটি প্রতি দ্বিতীয় পুরুষে একবার।

আচ্ছা! তখন কি করেন আপনারা?

আমরা মাথা তুলে দাঁড়াই এবং মেরে ফেলি বুড়িগুলোকে, যাতে কম বয়েসীগুলো শিক্ষা পায়, আমরা পুরুষরাই আসলে শক্তিশালী। আমার স্ত্রীকেও ওভাবে মারা হয়েছে তিন বছর আগে। খুব দুঃখ পেয়েছিলাম, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, পুত্র, জীবনটা আমার অনেক সুখের হয়ে গেছে তারপর থেকে।

সংক্ষেপে, এখন আপনার স্বাধীনতা অনেক বেশি, দায়িত্ব কম।

শুনে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইলো বিলালি। ধীরে ধীরে, অন্তর দিয়ে সে বুঝলো কথাটার মর্ম। হ্যাঁ, বেবুন। ঠিক এভাবে কখনো ভাবিনি আমি। তুমি বলায় এখন মনে হচ্ছে, সত্যি তাই। মেয়েটার কথাই ধরো না-সাহসী, সিংহকে ভালোবাসে, তুমি নিজেই তো দেখেছো, কিভাবে তাকে বাঁচিয়েছে। আমাদের প্রথা অনুযায়ী সিংহের সাথে বিয়েও হয়ে গেছে ওর। এখন সিংহ যেখানে যাবে ইচ্ছে হলে ও-ও সেখানে যেতে পারে যদি না, একটু থেমে যোগ করলো, সে বারণ করেন।

ধরুন, সে বারণ করলেন, মেয়েটা শুনলো না, তখন?

কাঁধ ঝাঁকালো বৃদ্ধ। ধরো প্রচণ্ড ঝড় বাঁকিয়ে ফেলতে চেষ্টা করছে গাছকে, গাছ বাঁকতে রাজি নয়, তখন?

জবাবের অপেক্ষায় না থেকে নিজের পালকিতে গিয়ে উঠলো বৃদ্ধ। দশ মিনিটের মাথায় কোর-এর পথে রওনা হলাম আমরা।

বিশাল পেয়ালা আকৃতির আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখটা পেরোতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। আরো আধ ঘণ্টা লাগলো ওপাশের ঢাল বেয়ে উঠতে। তারপর যে দৃশ্যটা দেখলাম তা জীবনে ভোলার মতো নয়। অপূর্ব সুন্দর সবুজ ঘাসে ছাওয়া বিস্তৃত সমভূমি ঈষৎ ঢালু হয়ে নেমে গেছে। এখানে ওখানে ছোট ছোট গাছ, বেশির ভাগই কাটা জাতীয়। দুপুর নাগাদ প্রায় মাইল দশেক দীর্ঘ সেই ঢালের শেষ মাথায় পৌঁছলাম আমরা। তারপরই শুরু হলো ভয়ানক জলার রাজত্ব। তার মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেছে সরু এক চিলতে একটা আঁকা বাঁকা পথ। ঢালের শেষ আর জলার শুরু যেখানে সে জায়গায় কিছুক্ষণের জন্যে থেমে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম আমরা। খানিকটা করে কুইনাইন নিজে খেতে এবং লিও আর জবকে খাওয়াতে ভুললাম না। তারপর রওনা হলাম।

মাইলের পর মাইল কাদা আর পচা পানি। দলের একেবারে সামনে লম্বা লাঠি হাতে দুজন লোক। একটু পর পরই কাদা পানির ভেতর লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছে মাটি শক্ত কি-না। এই ভর দুপুরেও ব্যাঙের একটানা চিৎকারে কান পাতা দায়। এখানে ওখানে ঝাঁক বেঁধে বসে আছে, উড়ছে, রাজহাঁস, বেলেহাঁস, পান কৌড়ি, কাদাখোঁচা, এবং আরো নানা রকম পাখি। যারা উড়ছে তারা তো উড়ছেই, যারা বসে আছে আমাদের উপস্থিতিতে মোটেই বিরক্ত হলো না তারা যেন পোষা পাখি। জলার ভেতর ছোট এক জাতের কুমীর দেখলাম, সংখ্যায় অজস্র। বড় বড় জলচর সাপও দেখলাম অনেক। ভাগ্য ভালো, পাখিগুলোর মতো ওরাও আমাদের দেখে খুব একটা বিরক্ত হলো না। যেমন ছিলো তেমন পড়ে রইলো। একটা জিনিসই কেবল অসহ্য লাগছে, পচা পানির দুর্গন্ধ। যতক্ষণ না এই জলাভূমি শেষ হচ্ছে ততক্ষণ এই দুর্গন্ধের হাত থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই। কোনোমতে নাক-মুখ কুঁচকে বসে আছি পালকিতে। আর এগিয়ে চলেছে বেহারারা, কোথাও মোটামুটি শুকনো মাটির ওপর দিয়ে, কোথাও হাঁটু সমান কাদা ভেঙে।

সূর্য না ডোবা পর্যন্ত এভাবে এগিয়ে চললাম আমরা। অবশেষে প্রায় দু’একর আয়তনের একটা উঁচু শুকনো জায়গা দেখে আমার নির্দেশ দিলো বিলালি। এখানেই রাত কাটাতে হবে। পালকি থেকে নামলাম আমরা-আমি, জব আর উস্তেন। ধরাধরি করে নামালাম লিওকে। শুকনো ঘাস-পাতা আর সঙ্গে আনা কাঠ দিয়ে ছোট্ট একটা অগ্নিকুণ্ড তৈরি করা হলো। প্রচণ্ড গরম আর দুর্গন্ধ সহ্য করে যতটুকু সম্ভব খেয়ে নিলাম সবাই। তারপর কম্বলের নিচে গিয়ে ঢুকলাম। কিন্তু ব্যাঙের ডাক আর মশার গুনগুনানিতে ঘুমায় কার সাধ্য?, কম্বলের নিচ থেকে মাথা বের করে লিওর দিকে তাকালাম একবার। বসে বসে ঝিমোচ্ছে ও। আগুনের অস্পষ্ট আলোয় উস্তেনকে দেখলাম। লিওর পাশে শুয়ে আছে। একটু পরপর কনুইয়ে ভর দিয়ে উদ্বিগ্নমুখে তাকাচ্ছে লিওর দিকে। শুয়ে পড়লাম আমি। তারাজ্বলা আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। মশার যন্ত্রণায় কম্বল মুড়ি দিলাম আবার। তারপর নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না।

যখন ঘুম ভাঙলো তখন সবেমাত্র ভোর হচ্ছে। প্রহরী আর বাহকরা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। আবার রওনা হওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে। ভোরের ঘন কুয়াশায় ভূতের মতো লাগছে ওদের। আগুন নিবে গেছে কখন জানি! দুহাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে লিও। চোখ দুটো লাল টকটকে।

কেমন লাগছে লিও? কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি।

মনে হচ্ছে মরে যাবো, খেঁকিয়ে উঠলো ও। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, ভীষণ শীত করছে।

ঠোঁট কামড়ালাম আমি। অবশেষে পড়েছে লিও, এত কুইনাইন খাইয়েও ম্যালেরিয়ার হাত থেকে বাঁচানো গেল না। জবের অবস্থাও বিশেষ সুবিধার মনে হচ্ছে না। দুজনকেই পুরো দশ গ্রেন করে কুইনাইন খাইয়ে দিলাম। সাবধানতা হিসেবে আমি নিজেও খেলাম খানিকটা। তারপর গেলাম বিলালির কাছে। আমার সঙ্গীদের অসুস্থতার কথা জানালাম। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে এগিয়ে এলো বৃদ্ধ। প্রথমে। দেখলো লিওকে। তারপর জবকে (এখানে বলে রাখা দরকার, মোটা শরীর, গোল। মুখ আর কুতকুতে চোখ দেখে বিলালি ওর নতুন নামকরণ করেছে শূকরছানা)। ভালোমতো দেখে বুড়ো আমাকে টেনে নিয়ে গেল একটু দূরে।

সেই জ্বর! ফিসফিস করে বললো সে। আমি আগেই ভেবেছিলাম। সিংহের অসুখটা মারাত্মক। তবে ঘাবড়িও না, জোয়ান ছেলে, ঠিক সামলে নেবে। আর শূকরছানার অসুখ সামান্য। আমরা বলি ছোট জ্বর। তেমন কিছু না।

এখন আর এখোনো কি উচিত হবে, পিতা?

অবশ্যই। এখানে থাকলে ওদের মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না। সবকিছু যদি ঠিকমতো চলে, আজ রাতের ভেতর এই জলাভূমি পেরিয়ে যাবো আমরা। তারপর বিশুদ্ধ বাতাস। এসো ওদের পালকিতে তুলে দিই। যত তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া যায় ততই মঙ্গল।

প্রথম ঘণ্টাতিনেক ভালোই এগোলাম আমরা। তারপর আরো দুর্গম হয়ে উঠলো পথ। এখানে ওখানে দেখা যাচ্ছে গভীর জলা। কোনো কোনো জায়গায় আক্ষরিক অর্থেই বেহারাদের হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যেতে লাগলো কাদায়। হাঁটার ছন্দ আর আগের মতো সমান নেই। পালকি দুলছে ভীষণ। কি করে যে এই ভারি : পালকি কাঁধে নিয়ে হাঁটছে ওরা ভেবে অবাক হলাম।

ঘণ্টাখানেক এগোলাম এভাবে। দুলুনির চোটে গায়ে ব্যথা হয়ে গেছে। এমন সময় একটা তীক্ষ্ণ্ণ চিৎকার ভেসে এলো। পরমুহূর্তে ভয়ানক হৈ-চৈয়ের আওয়াজ। থেমে দাঁড়ালো পুরো দলটা!

লাফ দিয়ে পালকি থেকে নেমে সামনে দৌড়ালাম আমি। প্রায় বিশ গজ দূরে দেখতে পাচ্ছি একটা গভীর জলার কিনারা। এই কিনারা ঘেঁষে এগিয়ে গেছে আমাদের কাদামগ্ন পথ। জলার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। বিলালির পাকিটা পানিতে ভাসছে। হতভাগ্য বৃদ্ধকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। ব্যাপার কি জিজ্ঞেস করতে এক বাহক জানালো, বিলালির বাহকদের একজনকে সাপে কেটেছে। আতঙ্কে লাফিয়ে উঠে লোকটা পালকি ছেড়ে দেয়। পরমুহূর্তে আবিষ্কার করে, জলায় পড়ে গেছে সে। তখন প্রাণ বাঁচানোর জন্যে পাকির কিনারা ধরে হাঁচড়-পাঁচড় করতে থাকে সে। এই পরিস্থিতিতে যা ঘটার তা-ই ঘটে—অন্য বাহকরাও ছেড়ে দেয় পালকি। ফলে বিলালি এবং সাপে কাটা লোকটাকে সহ পাকি গড়িয়ে চলে যায় পানিজে

আমি যখন জলার কিনারায় পৌঁছলাম তখন দুজনের একজনকেও জলের ওপর দেখলাম না। হঠাৎ নোংরা পানির এক জায়গায় একটু আলোড়ন উঠলো। তার পরেই ভেসে উঠলো বিলালির শরীর। হাবুডুবু খেতে খেতে গায়ের লিনেনের জট থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে সে।

ঐ তো উনি! চিৎকার করলো একজন। আমাদের পিতা ঐ তো! বললো কিন্তু একচুল নড়লো না লোকটা। অন্যরাও হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রইলো বিলালির দিকে।

সামনে থেকে সরো, গাধার দল! ইংরেজিতে চিৎকার করে উঠলাম আমি। মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে ছুঁড়ে দিলাম এক দিকে, তারপর লাফিয়ে পড়লাম সেই দুর্গন্ধময় সবুজাভ পানিতে। দুবার হাত ছুঁড়েই পৌঁছে গেলাম বিলালির কাছে। কখন কি করতে হয় সে সম্পর্কে টনটনে জ্ঞান বৃদ্ধের-ডুবন্ত মানুষরা সাধারণত যেমন করে তেমন আতঙ্কিত ভঙ্গিতে আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো না। আস্তে তার এক হাত ধরে টেনে নিয়ে এলাম পাড়ের দিকে।

কুত্তার দল! পাড়ে উঠেই খেঁকিয়ে উঠলো বিলালি, চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে তার। তাদের বাপকে মরতে বসিয়েছিলি! এই বিদেশী, আমার ছেলে বেবুন যদি থাকতো আজ নিশ্চয়ই ডুবে মরতাম আমি। আর তোরা কি করতি? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতি!

আরো কিছুক্ষণ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো লোকগুলোর দিকে, তারপর আমার দিকে ফিরলো বিলালি। দুহাতে আমার হাত জড়িয়ে ধরে বললো, পুত্র বেবুন, আজ থেকে আমি তোমার বন্ধু। তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে, যদি কোনো দিন সময় সুযোগ আসে আমি এর প্রতিদান দেবো।

ঐ জঘন্য জায়গায় যতটা সাফ সুতরো হওয়া যায় হয়ে নিয়ে, বিলালির পাকিটা উদ্ধার করে আবার রওনা হলাম আমরা। হতভাগ্য বাহক—যাকে সাপে। কেটেছিলো—পড়ে রইলো জলায়। ওর মৃত্যুতে কিছুমাত্র মর্মাহত হতে দেখলাম না কাউকে। যেন বেমালুম ভুলে গেছে, অমন কেউ ছিলো ওদের সাথে।

আগের পর্ব :

০১-০৫. প্রত্যেকেরই জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে

পরের পর্ব :

১১-১৫. সূর্যাস্তের প্রায় এক ঘণ্টা আগে
১৬-২০. বন্দীদের নিয়ে যাওয়ার পর
২১-২৫. দেখ কোথায় আমি ঘুমিয়েছি
২৬-২৮. আমি, লিও, আর জব

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত