হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য চেম্বার অব সিক্রেটস: গিল্ডরয় লকহার্ট

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য চেম্বার অব সিক্রেটস: গিল্ডরয় লকহার্ট

০৬. গিল্ডরয় লকহার্ট

পরদিন অবশ্য হ্যারি একবারও হাসে নাই। গ্রেট হলে নাস্তার সময় থেকেই কেমন যেন সব গোলমাল পাকাতে শুরু করে। জাদু–করা সিলিংটার (আজ, অবশ্য অনুজ্জ্বল, মেঘ ধুসর) নিচে পাতা চারটে লম্বা হাউজ টেবিল সাজানো, ওতে রয়েছে পরিজ ভর্তি ভাণ্ড, নোনা শুঁটকির প্লেট, টোস্টের পাহাড় এবং ডিম আর বেকন। হ্যারি আর রন যেয়ে বসল গ্রিফিল্ডর টেবিলে হারমিওনের পাশে, ওর ভয়েজেস উইথ ভ্যাম্পায়ার বইটি খোলা অবস্থায় একটা দুধের জগের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা। ও যেমন শুকনো গম্ভীর গলায় ওদের মর্ণিং বলেছে, তাতে মনে হয় ও এখনো ওদের ওইভাবে গাড়িতে উড়ে আসাটা মেনে নিতে পারছে না। অন্যদিকে নেভিল লংবটম ওদের বেশ আনন্দের সঙ্গেই শুভেচ্ছা জানালো। নেভিল হলো গোলমুখো দুর্ঘটনা প্রবণ এবং হ্যারির দেখা সবচেয়ে কম স্মরণ শক্তির ছেলে।

নেভি বলল, যে কোন মুহূর্তে ডাক চলে আসবে মনে হয় যে কয়েকটা জিনিস ভুলে বাড়িতে ফেলে এসেছি সেগুলো দাদী পাঠিয়ে দেবে।

সবেমাত্র হ্যারি তার পরিজটা মুখে দিয়েছে ঠিক সেই সময় মাথার ওপরে দ্রুত কিছু ওড়ার শব্দ শোনা গেল এবং প্রায় একশর মতো পেঁচা সাঁ করে উড়ে এলো এবং ঘরটা চক্কর দিতে দিতে নিচের খোশগল্পরতদের মাঝে চিঠি আর প্যাকেট ফেলতে শুরু করল। একটা বড়সড় প্যাকেট নেভিলের মাথায় পড়ে বাউন্স করল, এক মুহূর্ত পরেই বড় এবং ধূসর একটা কিছু পড়ল হারমিওনের জগের মধ্যে, ওদের গায়ে দুধ আর পাখা ছড়িয়ে সারা।

এরল। বলল রন, পা ধরে নোংরা হয়ে যাওয়া পেঁচাটাকে টেনে তুলল ও। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল এর টেবিলের ওপর। ওর পা আকাশের দিকে, ঠোঁটে একটা ভেজা লাল খাম।

ওহ না দম বন্ধ হয়ে এলো রনের।

সব ঠিক আছে, ও এখনো বেঁচে আছে, আঙুলের মাথা দিয়ে আস্তে করে এরলকে খোঁচা দিয়ে বলল হারমিওন।

ওই কখা না–ওটার কথা বলছি।

রনের আঙুল তাক করে দেখাল লাল খামটার দিকে। হ্যারির কাছে ওটা আর দশটা সাধারণ খামের মতোই লাগছে কিন্তু রন আর নেভিল এমনভাবে তাকিয়ে রয়েছে যেন এক্ষুণি ওটা বিস্ফোরিত হবে বা এমন সাংঘাতিক কিছু।

কি হয়েছে? জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।

আমাকে আমাকে একটা হাউলার পাঠিয়েছে মা, অস্কুটস্বরে বলল রন।

তোমার ওটা খোলাই ভাল, বলল ফিস ফিস করে ভীত নেভিল। তুমি যদি না খোল তবে আরো খারাপ হবে। আমার দাদু একবার আমাকে পাঠিয়েছিলেন, আমি ওটা পাত্তা দিইনি আর তারপর– ঢোক গিলল নেভিল, ভয়াবহ।

ওদের ভীত চেহারা থেকে লাল খামটার দিকে চোখ ফেরাল হ্যারি।

হাউলারটা কি? জানতে চাইল ও।

কিন্তু রনের সমস্ত মনোযোগ চিঠিটার ওপর, ওটার এক কোণ থেকে এরই মধ্যে ধোয়া উঠতে শুরু করেছে।

খোল ওটা, নেভিলের আর্জি। কয়েক মিনিটেই ব্যাপারটা চুকে বুকে যাবে…

কাঁপা হাত বাড়িয়ে রন এরলের ঠোঁট থেকে আস্তে করে খামটা বের করল, এরপর ভয়ে ভয়ে খুলল। নেভিল কানে আঙুল দিল। মুহূর্ত পরই, হ্যারি জানতে পারল কেন। প্রথমে সে ভাল একটা বিস্ফোরণ হয়েছে; একটা বিকট গর্জন। পুরো হল ঘরটা কাঁপিয়ে দিল, সিলিং থেকে ধুলা পর্যন্ত পড়ল।

.. গাড়ি চুরি করা, ওরা যদি তোমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করত আমি অন্তত অবাক হতাম না, দাঁড়াও তোমাকে পেয়েনি, যখন দেখা গেল গাড়িটা নেই তখন তোমার বাবা আর আমার যে কি অবস্থা হয়েছিল নিশ্চয়ই সেটা একবারও ভাবোনি …

মিসেস উইসলির চিৎকার স্বাভাবিকের চেয়ে একশ গুণ বেশি জোরে হচ্ছে, টেবিলের ওপর প্লেট আর চামচ কাঁপছে, দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে। হলের মধ্যে সবাই চেয়ার ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করছে হাউলারটা পেয়েছে কে। আর রন চেয়ারের ভেতর এতটাই সেধিয়ে গেলো যে শুধু ওর কপালের টকটকে লাল চুলই শুধু দেখতে পাওয়া গেল।

… গতরাতে ডাম্বলডোরের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি, মনে হচ্ছিল লজ্জায় তোমার বাবা মারাই যাবেন, এ রকম ব্যবহার পাওয়ার আশায় নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে বড় করিনি, তুমি আর হ্যারি দুজনেই মারাও যেতেও পারতে …

হ্যারি ভাবছিল কখন যে তার নামটা আসে, শেষ পর্যন্ত এলো। সে ভান করল যেন কানের পর্দা ফাটানো শব্দাবলী ও শুনতেই পাচ্ছে না।

.. একেবারেই বিরক্তিকর, অফিসে তোমার বাবাকে ইনকোয়ারির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, পুরোটাই তোমার দোষ, এরপর যদি কখনও বেলাইনে এক পাও দাও তবে নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনব।

স্তব্ধতা নেমে এলো হল ঘরে ৷ রনের হাত থেকে পড়ে লাল খামটায় আগুন ধরে গেলো, দেখতে দেখতে এটা ছাই হয়ে গেলো। পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল হ্যারি আর রন যেন এইমাত্র ওদের ওপর দিয়ে একটা প্রচণ্ড সমুদ্র জোয়ারের ঢেউ ধাক্কা দিয়ে ওদের বিধ্বস্ত করে গেছে। দুএকজন হাসল এবং ক্রমশ আবার শুরু হলো বকবকানি।

হারমিওন ভয়েজেস উইথ ভ্যামপায়ার বন্ধ করে রনের দিকে অবজ্ঞাভরে তাকাল।

বেশ, আমি ঠিক জানি না তুমি ঠিক কি আশা করেছিলে, রন, কিন্তু তুমি এখন বলো না আমার এটা পাওনা ছিল, চট করে বলল রন।

পরিজটা ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল হ্যারি। ভেতরটা তার অপরাধবোধে পুড়ে যাচ্ছে। মিস্টার উইসলির বিরুদ্ধে অফিসে তদন্ত হচ্ছে। গ্রীষ্মে তার জন্যে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস উইসলি কত কিছু না করেছেন…

কিন্তু এটা নিয়ে ভাববার সময় পেলো না সে, প্রফেসর ম্যাকগোনাগল

গ্রিফিল্ডর টেবিল ধরে এগিয়ে আসছেন, রুটিন বিলি করছেন। হ্যারি ওরটা নিল, দেখল ওদের রয়েছে হাফলপাফস প্রথমের সঙ্গে ডাবল হারবলজি।

হ্যারি, রন আর হারমিওন এক সঙ্গে ক্যাসল থেকে বেরিয়ে এলো, শজির ক্ষেত্রটা পেরিয়ে গ্রীন হাউজের দিকে অগ্রসর হলো, যেখানে ম্যাজিক্যাল চারাগুলো রাখা রয়েছে। হাউলারটা অন্তত একটি ভাল কাজ করেছে : হারমিওন মনে হচ্ছে ভাবছে যে তাদের যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে এবং আবার খাঁটি বন্ধুতে পরিণত হয়েছে।

গ্রিন হাউজের কাছে গিয়ে দেখল ক্লাসের অন্যরা সব বাইরে দাঁড়িয়ে, প্রফেসর স্প্রাউট-এর জন্যে অপেক্ষা করছে। হ্যারি, রন আর হারমিওন সবেমাত্র অন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, দেখা গেল উনি আসছেন লটার ওপর দিয়ে হেঁটে সঙ্গে গিল্ডরয় লকহার্ট। প্রফেসর উটের হাত পুরোপুরি ব্যান্ডেজ করা, আরেকটি অপরাধবোধে আহত হলো হ্যারি, উইলো গাছটা দেখতে পেলো একটু দূরে, ওটার কয়েকটা শাখা এখন স্লিং-এ ঝুলছে।

প্রফেসর স্প্রাউট ছোটখাট স্থূলকায়া ডাইনী, উড়ন্ত চুলের ওপর একটা তালি দেয়া টুপি পরনে; ওঁর কাপড়ে প্রচুর কাদা লেগে রয়েছে, এবং ওঁর আঙুলের নখ দেখলে আন্ট পেতুনিয়াকে অজ্ঞান করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। গিল্ডরয় লকহার্ট অবশ্য অনবদ্য ওর ফিরোজার পোষাকে, একবারে মাপমত বসানো সোনা সুবিন্যস্ত ফিরোজার হাটের নিচে ওর সোনালি চুল চকচক করছে।

হ্যালো, এই যে সব, বললেন লকহার্ট সমবেত ছাত্রদের দিকে উৎফুল্লভাবে তাকিয়ে। এই মাত্র প্রফেসর স্প্রাউটকে সঠিকভাবে উওমপিং উইলোর চিকিৎসা করা দেখচ্ছিলাম। কিন্তু আমি চাই না যে তোমরা ভাবো হারবলজিতে আমার জ্ঞান ওঁর চেয়ে ভালো! আমার শুধু ভ্রমণের সময় এরকম কিছু উদ্ভট গাছের সঙ্গে দেখা হয়েছিল…

আজ গ্রিনহাউজ তিন, বললেন প্রফেসর স্প্রাউট, ওঁকে আজ একেবারেই বিরক্ত আর হতাশ দেখাচ্ছিল মোটেই তার স্বাভাবিক আনন্দময়ীর মতো দেখাচ্ছিল না।

মৃদু গুঞ্জন শোনা গেলো। এর আগে ওরা শুধু গ্রিণহাউজ এক এ কাজ করেছে–গ্রিনহাউজ তিনে রয়েছে আরো অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং বিপদজনক গাছ। বেল্ট থেকে একটা বড় চাৰি বের করে প্রফেসর স্প্রাউট দরজা খুললেন। হাওয়ায় ভেসে এলো সোঁদা মাটি আর সারের এক ঝলক গন্ধ, সঙ্গে মেশানো ছাতার মতো দেখতে দৈত্যাকার ফুলের ঘন গন্ধ, ফুলটা ঝুলছে সিলিং থেকে। রন আর হারমিওনকে অনুসরণ করে সেও ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল এমন সময় লকহার্টের হাত ওকে ধরে ফেলল।

হ্যারি। তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল–ওর যদি কয়েক মিনিট দেরি হয় তাহলে আপনি নিশ্চয়ই কিছু মনে করবেন না, প্রফেসর স্প্রাউট, করবেন কি?

প্রফেসরের ভ্রূকুটি দেখে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে অবশ্যই তিনি মনে অনেক কিছু করবেন, কিন্তু লকহার্ট, ওই টিকেট সম্পর্কে বলেই প্রফেসরের মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

হ্যারি, বললেন লকহার্ট, ওর বড় বড় দাঁতগুলো সূর্যালোকে চকচক করল ওর মাথা নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হ্যারি, হ্যারি, হ্যারি।

সম্পূর্ণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হ্যারি কিছুই বলল না।

যখন শুনলাম–মানে, নিশ্চয়ই ওটা আমারই দোষ ছিল। নিজেকে চড় মারা উচিত ছিল।

হ্যারির কোনো ধারণাই নেই কি যে বলছেন লকহার্ট। সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল যখন আবার লকহার্ট বলে উঠলেন, জানি না এর চেয়ে বেশি মর্মাহত আর কখনও হয়েছিলাম কি না। উড়ন্ত গাড়ি চালিয়ে হোগার্টস-এ আসা! আমি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারছিলাম তুমি কেন এটা করেছ। সবার চেয়ে একেবারে এক মাইল এগিয়ে গেছ। হ্যারি, হ্যারি, হ্যারি।

লক্ষ্যণীয় যে যখন কথা বলেন না তখনও তিনি তার অপূর্ব দাঁতগুলো সবাইকে দেখাতে পারেন।

আমি তোমাকে প্রচারের একটা স্বাদ পাইয়ে দিয়েছিলাম, তাই না? বললেন লকহার্ট। পোকাটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম মাথায়। আমার সঙ্গে পত্রিকার প্রথম পাতায় ছবি, আবার ওটার লোভ ছাড়তে পারনি।

ওই না, প্রফেসর, দেখুন—

হ্যারি, হ্যারি, হ্যারি, বললেন লকহার্ট, হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধটা ধরলেন। আমি বুঝতে পারি। প্রথম স্বাদের পর আরো একটু পাওয়াটা স্বাভাবিক এবং আমি নিজেকেই দোষ দিচ্ছি তোমাকে প্রথম স্বাদটা দেওয়ার জন্যে, কারণ ওটা তোমার মাথা বিগড়ে দেবেই–কিন্তু দেখো, ইয়ং ম্যান, নজরে পড়ার জন্যে তুমি উড়ন্ত গাড়ি চালাতে পারো না। শান্ত হও, বুঝতে পারছ? বড় হলে ওসব করার জন্যে অনেক সময় পাবে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি তুমি কি ভাবছ? ওঁর জন্যে এসব কিছু ঠিকই আছে, এরই মধ্যে তিনিতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জাদুকর! কিন্তু যখন আমার বয়স বারো ছিল তখন আমি তোমারই মতো তুচ্ছ ব্যক্তি ছিলাম, এখনকার তোমার মতো। বস্তুত আমার বলা উচিত আরও বেশি তুচ্ছ ছিলাম! আমি বলতে চাচ্ছি কিছু লোক তোমার কথা শুনেছে, শোনেনি? ওই যে যার নাম নেয়া যাবে না সেই তার সাথে সব ঘটনা! হ্যারির কপালের দাগটার ওপর চোখ বোলালেন তিনি। আমি জানি, আমি জানি, পর পর পাঁচবার উইচ উইকলির সবচেয়ে–মনোহর–হাসির পদক জেতার মতো নয়, যেমন আমি জিতেছিলাম–কিন্তু এটাতো শুরু, হ্যারি, এটা শুরু।

তিনি হ্যারির উদ্দেশে একটা উষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে দীর্ঘ পদক্ষেপে স্থান ত্যাগ করলেন। হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকল হ্যারি কয়েক মুহূর্ত, মনে পড়ল তার তো গ্রিনহাউজে থাকা উচিত, দরজাটা খুলে চুপিসারে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

গ্রিনহাউজের মাঝখানে কাঠের পায়ার ওপর তক্তা বসিয়ে বানানো একটা বেঞ্চের ওপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রফেসর স্প্রাউট। বিভিন্ন রঙের প্রায় কুড়ি জোড়া ইয়ারমাফ বেঞ্চের ওপর ছড়ানো। রন এবং হারমিওনের মাঝখানে বসলে, তিনি বললেন, আমরা আজ ম্যান্ড্রেক পুনঃ পটিং করবো, এখন কে আমাকে ম্যান্ড্রেকের গুণাবলী সম্পর্কে বলতে পারে?

হারমিওনের হাত প্রথমেই উঠল, কেউ অবাক হলো না।

ম্যান্ড্রেক অথবা ম্যান্ড্রাগোরা একটি শক্তিশালী সঞ্জিবনী, বলল হারমিওন, এমনভাবে যেন সে বইটাই গিলে খেয়েছে। এটা ব্যবহার করা হয় আত্মিকভাবে পরিবর্তিত বা অভিশপ্ত মানুষকে তাদের আদি অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে।

চমৎকার। গ্রিফিন্ডরের জন্য দশ পয়েন্ট, বললেন প্রফেসর স্প্রাউট। প্রায় সব প্রতিষেধকেরই অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে ম্যান্ড্রেক। এটা আবার বিপদজনকও বটে। কে বলতে পারে কেন?

হারমিওনের হাত আবার দ্রুত ওপরে উঠার সময় অল্পের জন্যে হ্যারির চশমাটায় লাগেনি। অল্পের জন্য বেঁচে গেল ওর চশমাটা।

যে কেউ শুনবে তার জন্যেই ম্যান্ড্রেকের কান্না মৃত্যুর কারণ হবে, দ্রুত বলল সে।

একেবারে সঠিক। আরো দশ পয়েন্ট পেলে। বললেন প্রফেসর স্প্রাউট। এখন, যে ম্যান্ড্রেকগুলো আমরা পেয়েছি সেগুলো এখনো খুব কচি।

এক সারি গভীর ট্রের দিকে দেখালেন তিনি, ভাল করে দেখবার জন্যে সকলেই এগিয়ে এলো। প্রায় একশর মতো গুচ্ছবদ্ধ ছোট ছোট চারা, সবুজাভ রক্তবর্ণ, সারিবদ্ধভাবে জিয়ে উঠছে। হ্যারির কাছে গাছগুলোকে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বলে মনে হলো না, ম্যান্ড্রেকের কান্না বলতে হারমিওন কি বোঝাতে চেয়েছে এ বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

কান বন্ধ করার জন্য প্রত্যেকে এক জোড়া করে ইয়ারমাফ নাও, বললেন প্রফেসর স্প্রাউট।

টানাটানির শব্দ শোনা গেল, প্রত্যেকেই একটা করে জোড়া নেয়ার চেষ্টা করছে, অবশ্য গোলাপী এবং তুলতুলে জোড়াটা বাদ দিয়ে।

যখন বলব তখন ওগুলো কানে লাগাবে এবং কান যেন সম্পূর্ণ ঢাকা থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে, বললেন প্রফেসর স্প্রাউট। যখন ওগুলো কান থেকে সরানো নিরাপদ হবে তখন আমি বুড়ো আঙুল ওপর দিকে করবো, ঠিক আছে–ইয়ারমাফ লাগাও।

হ্যারি ওর কানের ওপর ইয়ারমাফগুলো লাগালো। প্রফেসর স্প্রাউট তার নিজের কানে এক জোড়া গোলাপী তুলতুলে ইয়ারমাফ লাগালেন। জামার হাতা গুটিয়ে নিলেন। একটা গুছো চারা ধরলেন দৃঢ়ভাবে আর টানলেন।

বিস্মিত শ্বাস ছাড়ল একটা হ্যারি, আশ্চর্য কেউই শুনতে পারছে না।

মাটির ভেতর থেকে শেকড়ের পরিবর্তে একটা ছোট্ট, কাদা মাখা খুবই কুৎসিৎ দেখতে শিশু বেরিয়ে এলো। ওটার একেবারে মাথা থেকে পাতা বেরোচ্ছে। ফ্যাকাসে সবুজ, বিচিত্রবর্ণের চামড়া চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে।

প্রফেসর স্প্রাউট টেবিলের নিচে থেকে একটা বড় ফুলের টব নিলেন, ম্যান্ড্রেকটাকে ওটার ভেতরে ছুঁড়ে মারলেন, কালো স্যাঁতস্যাঁতে জৈবসারের নিচে প্রোথিত করে দিলে, শুধু গোছবদ্ধ পাতাগুলি শুধু দৃশ্যমান থাকল। হাত ঝেড়ে নিলেন প্রফেসর, বুড়ো আঙুল ওপরের দিকে ইশারা করলেন এবং তার নিজের ইয়ার–মাফটা কান থেকে সরালেন।

যেহেতু আমাদের ম্যান্ড্রেকগুলো এখনও বাচ্চা, ওদের কান্না তোমাদের মেরে ফেলবে না, বললেন তিনি শান্তভাবে, যেন এই মূহুর্তে বেগোনিয়ার শেকড়ে পানি দেয়ার চেয়ে বেশি কিছু করেননি। অবশ্য কয়েক ঘণ্টার জন্যে তোমাদেরকে অজ্ঞান করে রাখতে পারে ওরা, এবং আমি নিশ্চিত যে প্রথম দিনটাকে তোমরা কেউই মিস করতে চাও না, সে কারণে কাজ করার সময় তোমাদের ইয়ার–মাফ সঠিক জায়গায় থাকে এটা নিশ্চিত করে নিও। শেষ হলে আমিই তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো।

এক ট্রেতে চারজন–ওখানে অনেক টব রয়েছে আর ওইদিকে ছালাতে জৈব সার রয়েছে–আর বিষাক্ত টেন্টকুলার থেকে সাবধান, ওটার দাঁত বেরোচ্ছে।

কথা বলতে বলতে চুপি চুপি কাঁধ বেয়ে উঠে আসা ঘন লাল চাড়াটাকে একটা চড় লাগিয়ে দিলেন প্রফেসর, চাড়াটা ওর লম্বা শুঙ্গগুলো সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে নিল।

হ্যারি, রন আর হারমিওনের সঙ্গে ট্রেতে যোগ দিল কোকড়ানো চুলের একটি হাফলপাফ ছেলে, যার সঙ্গে হ্যারি কোনদিনই কথা বলেনি।

জাস্টিন ফিঞ্চ–ফ্লেচলি, বলল সে সপ্রতিভভাবে হ্যারির হাত ঝাঁকিয়ে। জানি তুমি কে, অবশ্যই বিখ্যাত হ্যারি পটার… আর তুমি হচ্ছ হারমিওন গ্রেঞ্জার–সব কিছুতেই প্রথম… (উজ্জ্বল হাসিতে ভরে গেলো হারমিওনের মুখখানা, যখন তার সাথেও হাল্ডশেক করা হলো) আর রন উইসলি। ওটা তো তোমারই উড়ন্ত গাড়ি ছিল?

রন হাসল না। মায়ের পাঠানো হাউলারটা তখনও ওর মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

উনি লকহার্ট কিছু একটা, তাই না? বলল জাস্টিন আনন্দের সঙ্গে, ওরা তাদের চারাগাছের টবগুলো ড্রাগনের গোবরের সার দিয়ে ভরছে। অসাধারণ সাহসী ব্যক্তি। তোমরা ওর বই পড়েছ? ভয়েই আমি মরে যেতাম যদি আমাকে টেলিফোন বক্সে কোনঠাসা করে রাখত একটা নেকড়ে মানুষ (নেকড়েতে রূপান্ত রিত মানব সন্তান)। কিন্তু উনি ছিলেন একেবারে অকম্পিত–জাপ একেবারেই দারুণ তাই না।

জানো ইটনেও আমার নাম পাঠানো হয়েছিল, ইটনের বদলে এখানে এসে আমি যে কত খুশি তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না। অবশ্য মা সামান্য হতাশ হয়েছিলেন, কিন্তু যখন থেকে তাকে লকহার্টের বই পড়িয়েছি তখন থেকে মা বুঝতে পেরেছে পরিবারে একজন পুরোদস্তুর প্রশিক্ষণ নেয়া জাদুকর থাকা দরকার…

এরপর কথা বলার তাদের আর সুযোগ হয়নি। আবার পড়তে হয়েছে ইয়ার–মাফ আর মনোযোগ দিতে হয়েছে ম্যান্ড্রেকের এর দিকে। প্রফেসর স্প্রাউট ব্যাপারটাকে একেবারে সহজ করে বুঝিয়ে ছিলেন কিন্তু আসলে ততটা সোজা ছিল না। ম্যানড্রেক্সগুলো যেমন মাটি থেকে বেরোতে চাচ্ছিল না তেমনি আবার মাটির ভেতর যেতেও চাচ্ছিল না। ওরা শরীর মোচড়ালো, লাথি মারল, ছোট ছোট মুষ্টিগুলো ছুঁড়ল, দাঁত খিচালো একটা বেশ মোটা ম্যান্ড্রেক্সকে টবে ঢোকাতে হ্যারির পাক্কা দশ মিনিট লাগল।

ক্লাসের শেষ দিকে আর সবার মতো হ্যারিও ঘেমে নেয়ে একাকার, সারা গায়ে ব্যথা আর মাটিতে মাখা। ক্যাসেলে ফিরে গেলো ওরা ক্লান্তু পায়ে শুধু দ্রুত গা ধোয়ার জন্য, তারপর গ্রিফিল্ডররা দৌড় লাগাল ট্রান্সফিগিউরেশনে।

প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের ক্লাসে প্রচুর খাটতে হয়, কিন্তু আজ একেবারেই অনেক বেশি। গত বছর যা কিছু হ্যারি শিখেছিল মনে হচ্ছে গ্রীষ্মে সব যেন বেরিয়ে গেছে মাথার ফুটো দিয়ে। একটা গুবড়ে পৌকাকে বোতাম বানাবার কথা তার, কিন্তু সে শুধু পোকাটাকে ব্যায়ামই করাতে পারল, কারণ ওটা বার বারই ওর জাদুদণ্ডটা এড়িয়ে টেবিলের ওপর দিয়ে দ্রুত এদিক ওদিক সটকে পড়তে লাগল।

রনের সমস্যা আরো খারাপ। সে ওর জাদুদণ্ডটাকে ধার করা টেপ দিয়ে জোড়া লাগিয়েছে ঠিকই কিন্তু মনে হলো ওটা আর সারাবার যোগ্য নেই। বেখাপ্পা মুহূর্তে ওটা পট পট শব্দ আর স্ফুলিঙ্গ ছড়ায় এবং যতবারই রন ওর গুবরেপোকাকে অন্য কিছু বানাতে চেয়েছে ততবারই ওটা ডিম পচা গন্ধে ভরা ঘন ধোয়া ঢেকে দিয়েছে। না দেখে রন একবারতে কনুই দিয়ে ওর গুবরেপোকাটা পিষেই ফেলল। আরেকটি চাইতে হলো তাকে। প্রফেসর ম্যাকগোনাগল খুব খুশি হলেন না।

লাঞ্চের ঘণ্টা বাজল। হ্যারি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। মনে হচ্ছে ওর মাথাটা মুচড়ে দেয়া স্পঞ্জের মতো হয়ে গেছে। সে আর রন ছাড়া আর সকালেই ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। তখনও রন ওর জাদুদণ্ডটা পাগলের মতো ওর ডেস্কের দিকে বার বার তাক করছে।

স্টুপিড,ফালতু জিনিস…

বাড়িতে আরেকটার জন্যে লেখো, হ্যারি বুদ্ধি দিল, জাদুদণ্ডটা আতশবাজির মতো অনেকগুলো বাজি ছুড়ল।

হ্যা ঠিকই বলেছ, চেয়ে পাঠাই আর একটা হাউলার পাই আর কি, বলল রন, হিস হিস করা জাদুদণ্ডটা নিজের ব্যাগে ঠেসে ধরতে ধরতে। ‘তোমার জাদুদণ্ড ভেঙেছে তোমার নিজের দোষে’।

ওরা দুপুরের খাবার খেতে গেল। ওখানে হারমিওনের দেখানো ট্রান্সফিগিউরেশনে ওর তৈরি কোট বোতাম দেখেও রনের মেজাজ ঠিক হলো না।

আজ দুপুরে কি ক্লাস হচ্ছে? বলল হ্যারি দ্রুত বিষয় পরিবর্তন করে। কালো জাদুর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল হারমিওন।

কেন, জানতে চাইল রন, ওর রুটিনটা হাত থেকে সজোরে নিয়ে, তুমি কি লকহার্টের সব পড়া মনে গেঁথে নিয়েছ?

ওর থেকে রুটিনটা আবার ছিনিয়ে নিল হারমিওন। রাগে লাল হয়ে গেছে

দুপুরের খাবার শেষ করে ওরা বাইরে ছায়ায় ঢাকা উঠোনে গেল। হারমিওন একটা পাথরের ধাপে বসল, নাক ডুবিয়ে দিল আবার ওর ভয়েজেস উইথ ভ্যাম্পায়ার-এ। হ্যারি আর রন কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে কিডিচ খেলা সম্পর্কে কথা বলল, এক সময় ওর মনে হলো ওর দিকে কে যেন খুব কাছে থেকে নজর রাখছে। মুখ তুলে ও দেখতে পেলো গতরাতের সর্টিং হ্যাট পরবার সময়কার ইঁদুর–চুলো ছোট্ট ছেলেটা চেয়ে আছে ওর দিকে একেবারে পাথরের মতো। ওর হাতে ধরা মাগল ক্যামেরার মতো দেখতে কি একটা, এবং যেই হ্যারি সরাসরি ওর দিকে তাকাল ছেলেটা একেবারে লাল হয়ে গেলো।

বেশ হ্যারি? আমি–আমি কলিন ক্রিভি, সে বলল একদমে, সামনের দিকে দ্বিধাগ্রস্ত এক পা অগ্রসর হলো। আমিও গ্রিফিল্ডরে। আমি কি তোমার একটা ছবি তুলতে পারি কি বলো–কোনো অসুবিধা হবে না তো? বলল সে ক্যামেরাটা তুলল আশা করে।

একটা ছবি? হ্যারি পুনরাবৃত্তি করল অনিশ্চিতভাবে।

যেন আমি প্রমাণ করতে পারি তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, আগ্রহভরে বলল কলিন ক্রিভি, আরো একটু অগ্রসর হয়ে। তোমার সম্পর্কে আমি সব কিছু জানি। সবাই আমাকে বলেছে। যখন ইউ নো হু তোমাকে মারবার চেষ্টা করেছিল তখন কিভাবে বাঁচলে এবং কিভাবে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল আর সব কিছু এবং কিভাবে তোমার কপালে বিদ্যুতের মতো দাগ হলো ওর চোখ যেন হ্যারির চুল আঁচরে দিল, এবং আমার হোস্টেলের একটি ছেলে বলেছে আমি যদি ফিল্মটা সঠিকভাবে ডেভেলপ করতে পারি তবে ছবিগুলো নড়াচড়া করবে। উত্তেজনায় কলিন একটি গা কাঁপানো শ্বাস নিল, বলল, এ জায়গাটা চমৎকার, তাই না? হোগার্টস থেকে চিঠি না পেলে আমি জানতামই না যে বেখাপ্পা জিনিসগুলো আমি করছি ওগুলো ম্যাজিক। আমার বাবা একজন গোয়ালা, উনি নিজেও সেরকম কিছু বিশ্বাস করেনি। সে কারণে আমি অনেক ছবি তুলছি বাড়িতে ওঁকে পাঠাবার জন্যে। এবং খুব ভাল হবে যদি তোমার একটি ছবি আমি পাঠাতে পারি সে অনুনয়ের ভঙ্গিতে হ্যারির দিকে তাকাল, হয়তো তোমার বন্ধুই ছবিটা তুলতে পারবে আর আমি দাঁড়ব তোমার পাশে? এরপর তুমি ছবিটায় স্বাক্ষর দিতে পারবে?

স্বাক্ষর করা ছবি? তুমি স্বাক্ষর করা ছবি বিলিয়ে বেড়াচ্ছ, পটার?

উচ্চস্বরে এবং কঠোর উপহাসে, ড্র্যাকো মালফয়ের কথা উঠোনজুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। সে থামল একেবারে কলিনের পেছনে, দুই পাশে, যেমন হোগার্টস-এ বরাবর সে চলে তেমনি তার দুই বিশালকায় বদমায়েশের মতো দেখতে অনুগত অনুচর–ক্র্যাব আর গোয়েল।

এই সবাই লাইন ধরে দাঁড়াও! ম্যালফয় ভিড়ের উদ্দেশে চিৎকার করে জানালো। হ্যারি পটার স্বাক্ষর করা ছবি বিলিয়ে বেড়াচ্ছে!

না, আমি বিলি করছি না, হ্যারি রেগে বলল, ওর হাত মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছে। চুপ করো, ম্যালফয়।

তুমি বড় হিংসুটে, চিকন স্বরে বলল কলিন, যার গোটা শরীরটা ক্র্যাব এর গলার সমান মোটা।

হিংসা? বলল ম্যালফয়, ওর আর চিৎকার করবার দরকার নেই, উঠোনের অর্ধেকটা ওর কথা এমনিতেই শুনতে পাচ্ছে। কিসের? আমি আমার কপাল জুড়ে একটা খারাপ দাগ চাই না, ধন্যবাদ। আমি মনে করি না মাথাটা অর্ধেক কাটা গেলে বিশেষ কেউ হওয়া যায়।

ক্র্যাব আর গোয়েল দুজনেই বোকার মতো বিদ্রুপের চাপা হাসি হাসছিল।

পোকা খাও, ম্যালফয়, রনের ক্রুদ্ধ প্রতি উত্তর। হাসি বন্ধ হয়ে গেলো ক্র্যাবের, ও এখন গাছের গাটের মতো ওর গাটগুলোর ওপর ভীতিজনিতভাবে হাত বুলাচ্ছে।

সাবধান উইসলি, দাঁত খিচালো ম্যালফয়। তুমি নিশ্চয়ই এখন কোনো ঝামেলা বাঁধাতে চাও না, বাঁধালেই তোমার মা এসে তোমাকে স্কুল থেকে নিয়ে যাবে। তীক্ষ্ণ কর্ণবিদারী স্বরে আরো যোগ করল। যদি তুমি আর এক পা তোমার গণ্ডির বাইরে দাও

স্লিথারিন পঞ্চম–বর্ষীয়দের একটা দল হেসে উঠল কাছে থেকে।

উইসলি একটা স্বাক্ষর করা ছবি চাচ্ছে পটার, আত্মতৃপ্তির হাসি হাসল ম্যালফয়। ওর পুরো পারিবারিক বাড়িটার চেয়েও ওটার দাম বেশি হবে।

রন ওর সেলোটেপ দিয়ে জোড়া লাগানো জাদুদণ্ডটা একটানে বের করে আনল, কিন্তু হারমিওন চট করে তার ভয়েজেস উইথ ভ্যামপায়ার বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল, কে আসছে দেখো!

কি হচ্ছে, কি হচ্ছে এ সব? গিল্ডরয় লকহার্ট এগিয়ে আসছেন ওদের দিকে দীর্ঘ পদক্ষেপে, ওর ফিরোজা রঙের পোষাকটা উড়ছে ওর পেছনে। কে ছবিতে স্বাক্ষর করছে?

কথা বলতে শুরু করেছিল হ্যারি কিন্তু পারল না, ওর কাঁধের ওপর দিয়ে একটা ঘুরিয়ে এনে হাসিখুশি লকহার্ট বললেন, জিজ্ঞাসা করাই উচিত ছিল না! আবার হ্যারির সঙ্গে আমাদের দেখা হলো!

হ্যারি দেখল লকহার্টের কথায় বিদ্ধ হয়ে অপমানে পুড়তে পুড়তে ম্যালফয় বিদ্রুপের হাসি মুখে নিয়ে অন্যদের দিকে সরে যাচ্ছে।

তাহলে, মিস্টার ক্রিভি ছবি তোলা যাক, বললেন লকহার্ট, কলিনের দিকে উজ্জ্বল হাসি দিয়ে। একটা ডাবল ছবি, এর চেয়ে ভাল কিছু বলা গেল না, আর আমরা দুজনেই ওটা তোমাকে স্বাক্ষর করে দেব।

কলিন আনাড়ির মতো ওর ক্যামেরা হাতড়িয়ে ঠিক–ঠাক করে ছবিটা যখন তুলল তখন ক্লাসের বেল বাজতে শুরু করেছে। দুপুরের পরের ক্লাসগুলি শুরু হবে।

তোমরা এখন যাও, ওখান থেকে সরে যাও, লকহার্ট জটলাটার উদ্দেশে বললেন এবং তিনি নিজেও হ্যারিকে নিয়ে রওয়ানা হলেন, তখনও ও লকহার্টের পাশেই ধরা, আর আশা করছে যদি অদৃশ্য হওয়ার একটা ভাল বিদ্যা জানা থাকত।

জ্ঞানীর উদ্দেশে একটা কথা, হ্যারি, বললেন লকহার্ট পিতৃসুলভ স্বরে পার্শ্ব দরজা দিয়ে বিল্ডিং-এ ঢুকতে ঢুকতে। ওখানে ক্রিভির সামনে আমি তোমাকে আড়াল করলাম বটে–ও যদি আমার দুবিও তোলে, তাহলে তোমার স্কুলের বন্ধুরা ভাববে না যে তুমি নিজেই নিজেকে এত উপরে ওঠাচ্ছো…

হ্যারি তোতলাতে তোতলাতে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কে দেয় কান তার কথায়, একদল ছাত্রের চোখের সামনে দিয়ে করিডোর দিয়ে নিয়ে সিঁডি বেয়ে ওঠালো ওকে লকহার্ট।

আমাকে একটা কথা খোলাখুলি বলতে দাও হ্যারি, তোমার ক্যারিয়ারের এই সময় ছবি স্বাক্ষর করে দেয়ার কোনো মানে হয় না। মানে ইচড়ে পাকা। একটা সময় আসবে, আমার মতো, তুমি যেখানেই যাবে, সেখানেই এক বোঝা স্বাক্ষর করা ছবি তোমাকে বইতে হবে, কিন্তু ছোট করে খল খল হাসলেন তিনি, আমার মনে হয় না তুমি ওখানে পৌঁছে গেছ।

ওরা লকহার্টের ক্লাসের সামনে পৌঁছল। তিনি এবার ওকে মুক্ত করে দিলেন। হ্যারি ওর পোষাক সমান করে ক্লাসের একেবারে পেছনের একটা বেঞ্চের দিকে রওয়ানা হলো। লকহার্টের সাতটা বইই স্তূপ করে নিজের সামনে রাখল হ্যারি, যেন আসল লোকটাকে দেখতে না হয়।

ক্লাসের অনারা ঢুকল বকবক করতে করতে এবং রন আর হারমিওন দুজন হ্যারির দুপাশে বসল।

তোমার মুখের ওপর এখন একটা ডিম ভাজা যাবে, বলল রন। দোয়া কর যেন ক্রিভির সঙ্গে জিনির দেখা না হয়ে যায়, তাহলে ওরা একটা হ্যারি পটার ফ্যান ক্লাব খুলে বসবে।

শাট আপ, ধমকে উঠল হ্যারি। সে যেটা একেবারেই পছন্দ করে না সেটাই হচ্ছে হ্যারি পটার ফ্যান ক্লাব–কথাটা লকহার্টের কানে যাক আর কি।

পুরো ক্লাস আসন গ্রহণ করলে লকহার্ট জোরে গলা খাকারি দিলেন, নিরবতা নেমে এলো ক্লাসে। হাত বাড়িয়ে তিনি নেভিল লংবটমের সামনে থেকে ট্র্যাভেল উইথ ট্রলস বইটা তুলে নিলেন এবং ওর নিজের চোখ পিট পিট করা ছবিটা দেখানোর জন্যে সামনে মেলে ধরলেন।

আমি ওটার দিকে আঙুল তাক করে বললেন তিনি, সঙ্গে সঙ্গে চোখেরও ইশারা করলেন, গিল্ডরয় লকহার্ট, অর্ডার অফ মারলিন, তৃতীয় শ্রেণী, ডার্ক ফোর্স ডিফেন্স লীগের অবৈতনিক সদস্য এবং পাঁচবার উইচ উইকলির সবচেয়ে–মনোহর–হাসি পদক বিজয়ী–কিন্ত্র আমি ও নিয়ে কথা বলি না। কিন্তু হাসি দিয়ে আমি ব্যান্ডন বানশিকে এড়াতে পারিনি?

অপেক্ষা করলেন লকহার্ট ওরা যেন হাসে; দুএকজন দুর্বলভাবে হাসল।

দেখা যাচ্ছে তোমরা সবাই আমার বইয়ের পুরো সেট কিনেছ–ভাল করেছ। একটা ছোট্ট কুইজ দিয়ে আজকের ক্লাস শুরু করব। ঘাবড়াবার কিছু নেই–তোমরা বইগুলো কত ভালোভাবে পড়েছ, কতটা বুঝতে পেরেছ, শুধু সেটাই একটু পরখ করে নেয়া আর কি…

সবার হাতে প্রশ্নপত্র দিয়ে তিনি ক্লাসের সামনে এসে বললে তোমাদের সময় তিরিশ মিনিট, শুরু করো-এখন!

হ্যারি ওর প্রশ্নপত্রটা দেখল :

১। গিল্ডরয় লকহার্টের প্রিয় রং কি?
২। গিরয় লকহার্টের গোপন আকাঙ্ক্ষা কি?
৩। তোমার মতে এ পর্যন্ত গিল্ডরয় লকহার্টের সবচেয়ে বড় অর্জন কি?

প্রশ্নের পর প্রশ্ন, কাগজের তিন দিকে একেবারে শেষ প্রশ্নটা :

৫৪। গিল্ডয় লকহার্টের জন্মদিন কবে এবং তার জন্য উপযুক্ত উপহার কি হবে?

আধ ঘণ্টা পর, লকহার্ট উত্তরপত্রগুলো সংগ্রহ করলেন এবং ক্লাসের সামনেই ওগুলো নিরীক্ষা করলেন।

টাট, টাট–তোমাদের একজনও যে মনে রাখতে পেরেছ আমার প্রিয় রং হচ্ছে লাইলাক (বেগুনি গোলাপী) এ বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এটা আমি লিখেছি ইয়ার উইথ আ ইয়েটি বইয়ে। এবং তোমাদের কয়েকজনের ওয়াল্ডারিংস উইথ ওয়েরউল্ফ বইটা আরো যত্নের সাথে পড়তে হবে–আমি পরিষ্কারভাবে ওখানে লিখেছি যে আমার জন্মদিনের আদর্শ উপহার হবে ম্যাজিক এবং নন–ম্যাজিক মানুষের মধ্যে মিল—যদিও আমি ওগডেন-এর পুরনো ফায়ারহুইস্কির একটা বড় বোতলে না বলবো না!

আবার একটা বদমায়েশি চোখ ঠারলেন তিনি। রন এখন তাকিয়ে আছে লকহার্টের দিকে ওর চোখে অবিশ্বাস; সামনে বসা সিমাস ফিনিপান আর ডিন থমাস নীরব হাসিতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। অন্যদিকে অখন্ড মনোযোগ দিয়ে লকহার্টের প্রতিটি কথা শুনছে হারমিওন, তার নাম কানে যেতেই চমকে উঠল।

… কিন্তু মিস হারমিওন গ্রেঞ্জার জানে যে আমার গোপন আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে দুনিয়া থেকে সব খারাপ দূর করা এবং আমার নিজের মাপের হেয়ার–কেয়ার পোশন (ঐন্দ্রজালিক উপাচারের মাত্রা তৈরি করা ভাল মেয়ে! বস্তুত– ওর উত্তরপত্রের পাতাগুলো ওল্টাচ্ছেন লকহার্ট, পুরো নম্বর! মিস হারমিওন গ্রেঞ্জার কোথায়?

একটা কাঁপা হাত তুলল হারমিওন।

চমৎকার! উজ্জ্বল হাসি লকহার্টের। অতি চমৎকার। গ্রিফিল্ডরের জন্য দশ পয়েন্ট! তাহলে এবার কাজে কথায় আসা যাক…

ডেস্কের পেছনে উবু হয়ে একটা বড় খাঁচা তুললেন, খাঁচাটা আবরণ দিয়ে ঢাকা।

এখন সাবধান হও। আমার কাজ হচ্ছে জাদুর জগতের সবচেয়ে খারাপ জীবের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত করা! তোমরা এ রুমে সবচেয়ে খারাপ ধরনের ভয়ের মুখোমুখি হতে পারো। শুধু এটুকু জেনে রাখো আমি যতক্ষণ রয়েছি ততক্ষণ তোমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। আমি শুধু তোমাদেরকে শান্ত থাকার জন্যে অনুরোধ করব।

হ্যারি আর নিজেকে সামলাতে পারল না, বইয়ের স্তূপের পাশ দিয়ে উঁকি দিল খাঁচাটাকে আরো ভালো করে দেখাবার জন্যে। লকহার্ট খাঁচাটার আগে হাত রাখল। ডিন এবং সিমাসের হাসি ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। নেভিল ওর সামনের সীটে কুঁকড়ে গেছে।

আমি তোমাদের বলব চিৎকার না করার জন্যে, বললেন লকহার্ট নিচু স্বরে। চিৎকার ওদের উস্কে দিতে পারে।

সমস্ত ক্লাস দম বন্ধ করে আছে, লকহার্ট এক ঝটকায় খাঁচার আবরণটা সরিয়ে নিলেন।

হ্যাঁ, নাটকীয়ভাবে বললেন তিনি। সদ্য ধরা কর্ণিশ পিক্সি (ক্ষুদে পরী)।

সিমাস ফিনিগান নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না। একটা নাকি হাসি দিল সে, লকহার্টও ভুলে একে ভয়ের চিৎকার ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারলেন না।

হ্যাঁ? সিমাসের দিকে তাকালেন তিনি।

মানে, ওগুলো–ওগুলো তো আর ততটা–বিপদজনক নয়, তাই না? শ্বাসরুদ্ধ সিমাস বলল।

অত নিশ্চিত হয়ো না। বিরক্ত ভরে সিমাস এর দিকে আঙুল সঞ্চালন করে বললেন লকহার্ট। শয়তানের মতো চালাক সব ক্ষুদে সর্বনাশীও হতে পারে ওগুলো।

পিক্সিগুলো বৈদ্যুতিক নীল, আট ইঞ্চি লম্বা, সরু মুখ থেকে নির্গত শব্দ এত কর্কশ আর গগণবিদারী যে মনে হবে অসংখ্য টিয়া এক সঙ্গে কথা বলছে। খাঁচার আবরণ সরানো হতেই পিক্সিগুলো হড়বড়াতে শুরু করল, এদিক–ওদিক ছুটতে শুরু করল, খাঁচার শিকগুলো ধরে ঝাঁকাতে লাগল আর কাছে যারা বসে আছে ওদের দিকে তাকিয়ে উদ্ভট মুখভঙ্গি করতে লাগল।

ঠিক আছে তাহলে, উচ্চস্বরে বললেন লকহার্ট। দেখা যাক তোমরা ওদের কি করতে পারো! খাঁচাটা খুলে দিলেন লকহার্ট।

এরপর শুধু বিশৃঙ্খলা। রকেটের মতো ছুটছে পিক্সিগুলো এদিক–ওদিক সবদিক। দুজন আবার কান ধরে নেভিলকে একেবারে শূন্যে তুলে ফেলল। কেউ কেউ আবার সোজা জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো, পেছনের সারির বেঞ্চগুলোতে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে। বাদবাকি যে কজন ছিল তারা লেগে গেলো ক্লাস রুমটাকে ভাঙচুর করার কাজে, এমনভাবে যে একটা তেড়ে আসা গণ্ডারও করতে পারবে না। কালির বোতল তুলে পুরো ক্লাসে ছড়িয়ে দিল। বই আর কাগজ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে দিল ক্লাস জুড়ে। দেয়াল থেকে ছবি ছিঁড়ে, বর্জ্য ফেলার পাত্রটাকে উল্টিয়ে, খপ করে বই আর ব্যাগ নিয়ে কাঁচ ভাঙ্গা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ক্লাসের অর্ধেক ডেস্কের নিচে গিয়ে আশ্রয় নিল আর নেভিলকে দেখা গেল ঝুলছে সিলিং থেকে মোমের ঝাড়টায়।

ওগুলোকে ধরো, ধরো, ওগুলো তো শুধু পিক্সি… চিৎকার করে উঠলেন লকহার্ট।

জামার হাতা গুটিয়ে, জাদুদণ্ড নেড়ে তিনি চিৎকার করে আওড়ালেন, পেসকিপিকসি পেস্টেরনমি!

কিন্তু ওতে কিসসুই হলো না; একটা পিক্সি লকহার্টের জাদুদণ্ডটাই ছিনিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। লকহার্ট ঢোক গিলল এক ডাইভ দিল সোজা একেবারে নিজের ডেস্কের নিচে, অল্পের জন্য নেভিলের ওজনে চ্যাপ্টা হওয়া থেকে বেঁচে যান, এক সেকেন্ড পরেই সেখানে নেভিল পড়ে, মোমবাতির ঝাড়টা ছিঁড়ে যাওয়ায়।

ঘণ্টা বাজল। দরজার দিকে পাগলের মতো ছুটল সবাই। রুমে একটু শান্তি ফিরে এলে, লকহার্ট উঠে দাঁড়ালেন, দেখলেন হ্যারি, রন আর হারমিওন দরজা দিয়ে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছে। ওদেরকে বললেন, বাকি পিক্সিগুলোকে খাঁচায় পোরার জন্যে আমি তোমাদের তিনজনকে বলছি। ওদের বেরিয়ে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ করে দিলেন লকহার্ট।

অবিশ্বাস্য! কি বলে গেলেন লকহার্ট? গর্জন করে উঠল রন, একটা পিক্সি ওর কান কামড়ে দিয়েছে, ব্যথা করছে প্রচণ্ড।

উনি আমাদের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ দিয়েছেন, বলতে বলতে হারমিওন চতুর একটা ফ্রিজিং মায়া প্রয়োগ করে দুটো পিক্সিকে নিশ্চল করে খাঁচায় পুরে ফেলল।

হাত লাগাও? বলল হ্যারি, হাতের নাগালের বাইরে জীব বের করা নৃত্যরত একটা পিক্সিংকে ধরবার চেষ্টা করছিল ও। হারমিওন ও কি করছে সে সম্পর্কে ওর কোনো ইঙ্গিত ছিল না।

রাবিশ, বলল হারমিওন। তুমি ওর বই সব পড়েছ–চিন্তাকর উনি যে কত আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটিয়েছেন…

উনি বলেন উনি করেছেন, বিড় বিড় করে বলল রন।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত