০৫. দ্য হোমপিং উইলো
গ্রীষ্মের ছুটিটা দ্রুতই শেষ হয়ে গেলো। এটাই হ্যারি চায়। হোগার্টস-এ ফিরে যাওয়ার জন্যে সে অস্থির হয়ে পড়েছিল, কিন্তু এটাও ঠিক যে দ্য বারোতে কাটানো এই এক মাসই ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। যখনই সে ডার্সলিদের কথা মনে করে আর এর পরে প্রিভেট ড্রাইভে ফিরে গেলে তার সম্বর্ধনার কথা ভাবে তখনই রনের প্রতি একটু হলেও ইর্ষা বোধ করে।
শেষের সন্ধ্যায় মিসেস উইসলি আয়োজন করলেন ব্যয়বহুল এক ডিনারের, হ্যারির প্রিয় ডিশ সবগুলোই ছিল ওতে, আর শেষে ছিল মুখে জল আসা গুড়ের পুডিং। সন্ধ্যায় ফ্রেড আর জর্জ ফিলিবাস্টার আতশবাজি দেখালো, কিচেনে তাদের তৈরি লাল–নীল তারাগুলো অন্তত আধঘন্টা ধরে দেয়াল আর সিলিং জুড়ে নাচানাচি করল। সবশেষে এক মগ গরম চকলেট খেয়ে বিছানায় গেলো ওরা।
পরদিন সকালে রওয়ানা হতে হতেই অনেক দেরী হয়ে গেলো। সেই মোরগ–ডাকা ভোরে উঠল ওরা, তারপরও যেন গোছানোই শেষ হয় না। মিসেস উইসলির মেজাজ খারাপ, খুঁজছেন অতিরিক্ত জোড়া মোজা এবং বড় পালক। সবাই অতি ব্যস্ত সিঁড়িতে এ ওর সাথে ধাক্কা খাচ্ছে, কারো কাপড় পরা হয়েছে অর্ধেক হাতে টোস্টের একটু টুকরো, জিনির ট্রাংক নিয়ে উঠোন পেরোবার সময় হঠাৎ মুরগীর বাচ্চা সামনে পড়ায় টপকাবার সময় মিস্টার উইসলি তো নিজের ঘাড়টাই মটকাবার ব্যবস্থা করেছিলেন।
হ্যারি ভাবতেই পারছে না কি করে আটজন মানুষ, ছয়টা বড় ট্রাংক, দুটো পেঁচা আর একটা ইঁদুর ছোট্ট একটা ফোর্ড অ্যাংলিয়ার মধ্যে আঁটবে। অবশ্য মিস্টার উইসলি যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য গাড়িতে যোগ করেছেন সেগুলো হিসাবে নিলে অন্য কথা।
মলিকে একটি শব্দও বলা যাবে না, ফিস ফিস করে বললেন তিনি, গাড়ির পেছনের ডালাটা তুললেন, হ্যারি দেখল জাদুবলে ওটা এত বড় হয়েছে যে ট্রাংকগুলো সহজেই ওতে ধরে গেছে।
সবাই গাড়িতে উঠল, মিসেস উইসলি পেছনের সিটের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, ওখানে হ্যারি, রন, ফ্রেড, জর্জ এবং পার্সি পাশাপাশি খুব আরামেই বসেছে, বললেন, আমরা যতটা ভাবি মাগলরা এর চেয়ে বেশি জানে তাই না? তিনি আর জিনি সামনের সিটে ওঠে বসলেন, ওটাও এতই লম্বা হয়ে গেছে যেন পার্কের বেঞ্চ একটা। আমি বলতে চাচ্ছি বাইরে থেকে তুমি ভাবতেও পারো না যে এতে এত জায়গা রয়েছে, পারো?
মিস্টার উইসলি গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলেন, উঠোন থেকে ধীরে ধীরে গড়িয়ে বের হলো গাড়ি, ঘাড় ঘুরিয়ে হ্যারি শেষবারের মতো বাড়িটা দেখে নিল। ফিরে এসে কখন যে আবার বাড়িটাকে দেখতে পাবে ভাববারও সময় পেলো না হ্যারি। জর্জ তার ফিলিবাস্টার আতশবাজির বাক্সটা ছেড়ে এসেছে, থামতে হলো। এর পাঁচ মিনিট পর আবার গাড়ি থামাতে হলো, এবার ব্রেকটা জোরেই কষতে হলো বলে পিছলে গেলো গাড়িটা, ফ্রেড দৌড়ে গিয়ে ওর ঝাড়ুলাঠিটা নিয়ে এলো। বড় সড়কে প্রায় যখন পৌঁছে গেছে ওরা তখন জিনির তীক্ষ্ণ চিৎকার ডায়রি ফেলে এসেছে ও। এরপরে এসে ও যখন গাড়িতে উঠল, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে ওদের এবং মেজাজ সবার চড়তে শুরু করেছে। মিস্টার উইসলি একবার ঘড়ির দিকে তাকালেন একবার স্ত্রীর দিকে।
মলি, ডিয়ার
না, আর্থার।
কেউ দেখতে পাবে না। এই ছোট্ট বোতামটা এখানে আমি লাগিয়েছি এটা একটা অদৃশ্য বুস্টার–ওটা আমাদের শূন্যে তুলে দেবে–এরপর আমরা মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে যাবো। দশ মিনিটে ওখানে পৌঁছে যাবো এবং কেউ এটা ভাবতেও পারবে না।
আর্থার না, প্রকাশ্যে দিনের বেলা না।
পৌনে এগারোটায় ওরা কিংস ক্রসে পৌঁছল। মিস্টার উইসলি ছুটলেন ওদের ট্রাংকগুলোর জন্য ট্রলি আনতে বাকীরা সব দ্রুত স্টেশনে ঢুকল।
গতবছরও হ্যারি হোগার্টস এক্সপ্রেস-এ চড়েছে। ও জানে কৌশলটা। প্লটফর্ম নম্বর পৌনে দশ-এ যেতে হবে এবং মাগলদের চোখে ওটা ধরা পড়ে না। প্লাটফর্ম নয় এবং দশ এর মাঝখানের পাকা দেয়ালের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। ব্যথা পাওয়া যায় না ঠিকই কিন্তু সাবধান হতে হবে যেন মাগলরা অদৃশ্য হতে না দেখে ফেলে।
প্রথমে পার্সি, মাথার ওপরের ঘড়িটার দিকে নার্ভাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন মিসেস উইসলি। মাত্র পাঁচ মিনিট রয়েছে ওদের দেয়ালের মধ্য দিয়ে অদৃশ্য হওয়ার।
পার্সি দ্রুত সামনে হেঁটে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। পরে গেলেন মিস্টার উইসলি, তাকে অনুসরণ করল ফ্রেড এবং জর্জ।
আমি জিনিকে নিয়ে যাচ্ছি, আর তোমরা দুজন ঠিক আমার পেছন পেছন এসো, মিসেস উইসলি হ্যারি এবং রনকে বললেন। জিনির ডান হাত ধরে তিনি চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
রন হ্যারিকে বলল, আমাদের হাতে আর মাত্র এক মিনিট রয়েছে, চলো আমরা একসঙ্গে যাই।
হ্যারি নিশ্চিত হয়ে নিল যে হেডউইগের খাঁচাটা ওর ট্রাংকের ওপর নিরাপদেই রয়েছে তারপর ট্রলিটাকে এগিয়ে নিয়ে দেয়ালের মুখোমুখি হওয়ার উপক্রম হলো। ও মোটামুটি আত্মবিশ্বাসী ছিল, এটা ফ্লু পাউডার ব্যবহারের মতো অস্বস্তিকর ছিল না। ওরা দুজনেই ওদের ট্রলির হ্যান্ডেলের ওপর ঝুঁকে সোজা দেয়াল লক্ষ্য করেই এগিয়ে গেল, গতি বাড়িয়ে দিল। কয়েক ফিট দূরে থাকতে দৌড়াতে শুরু করল ওরা এবং
ক্র্যাশ। বিকট শব্দ।
দুটো ট্রলিই দেয়ালের সঙ্গে প্রাচণ্ড ধাক্কা খেল এবং ফিরে এলো। প্রচণ্ড শব্দে রনের ট্রাংকটা গেল পড়ে, হ্যারি নিজেই পড়ে গেল মাটিতে, হেডউইগের খাঁচাটা উড়ে গিয়ে পড়ল মাটিতে এবং অপমানে তীক্ষ্ণ চিৎকার করতে করতে সে গড়িয়ে গেল। বিস্ময়ে চারদিকের সব লোক ওদের দিকে তাকিয়ে রইল, ওদের কাছে দাঁড়ানো গার্ডটা চিৎকার করে উঠল, দোজখের কসম! এই যে তোমরা দুজন কি করছ?
ট্রলিটা হাত ফস্কে গিয়েছিল,হাঁপাতে হাঁপাতে বলল হ্যারি। উঠতে উঠতে পাঁজরের হাড় চেপে ধরল ব্যথায়। রন দৌড়ে গেলো হেডউইগকে তোলার জন্য, এরই মধ্যে যা সিন ক্রিয়েট করে ফেলছে ওটা, উপস্থিত লোকজন পশু পাখির প্রতি নিষ্ঠুরতা নিয়ে এরই মধ্যে কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে।
আমরা যেতে পারছি না কেন? চাপা স্বরে হ্যারি জিজ্ঞাসা করল রনকে।
আমি জানি না।
রন এদিক ওদিক তাকাল তখনও ডজন খানেক কৌতূহলী ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
আমরা ট্রেনটা মিস করছি, রন ফিস ফিস করে বলল। বুঝতে পারছি না প্রবেশপথটা কেন নিজেকে বন্ধ করে দিয়েছে।
বিশাল ঘড়িটার দিকে তাকাল হ্যারি, ওর পেটে যেন কে সুড়সুড়ি দিল। দশ সেকেন্ড….. নয় সেকেন্ড…
ও এবার ট্রলিটাকে সাবধানে একেবারে দেয়ালের মুখোমুখি নিয়ে দাঁড় কাল, গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিল। ধাতব দেয়ালটা অটল রইল।
তিন সেকেন্ড…দুই সেকেন্ড…এক সেকেন্ড….
চলে গেছে, বলল রন, চলে গেছে, বলল রন পাথরের স্বরে। ট্রেনটী চলে গেছে। মাম আর ড্যাড যদি আমাদের কাছে গেট দিয়ে ফিরে না আসতে পারে তাহলে কি হবে? তোমার কাছে কি কোনো মাগল টাকা রয়েছে?
অর্থহীনভাবে হাসল হ্যারি। বলল, প্রায় ছয় বছর হয়ে গেলো ডার্সলিরা আমাকে কোনো পকেট খরচা দেয়নি।
শীতল নীরব দেয়ালটার গায়ে কান ঠেকাল রন।
কোনকিছুই শুনতে পাচ্ছি না, চাপা উত্তেজনায় বলল ও। আমরা এখন কী করব? জানি না মাম আর ড্যাড-এর ফিরে আসতে কতক্ষণ লাগবে।
চারদিকে তাকাল ওরা। লোকজন তখনও ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, বিশেষ করে হেডউইগের বিরামহীন চিৎকারের জন্য।
আমার মনে হয় আমদের গাড়ির কাছে গিয়েই অপেক্ষা করা উচিত, বলল হ্যারি। এখানে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণের বস্তুতে পরিণত হয়েছি
হ্যারি! বলল রন, ওর চোখ জোড়া চক চক করছে। গাড়িটা!
ওটার আবার কি হলো?
আমরা গাড়িটা উড়িয়ে হোগার্টস-এ যেতে পারি।
কিন্তু আমার মনে পড়ছে—
আমরা এখানে আঁটকে গেছি, ঠিক তো? এবং আমাদের স্কুলে যেতেই হবে, তাই না? আর অপ্রাপ্তবয়স্ক উইজার্ডরাও জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করতে পারে, রেস্ট্রিকশন অফ খিঙ্গি… আইনের উনিশ ধারা বা ওরকমই একটা কিছু..
হ্যারির ভয় হঠাৎ করেই যেন আগ্রহ আর উত্তেজনায় পরিণত হলো।
তুমি ওটা ওড়াতে পারবে?
কোনো সমস্যা নেই, বলল রন, ট্রলিটা ঘোরালো বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে। এসো, চলো যাই, তাড়াতাড়ি করলে আমরা হোগার্টস এক্সপ্রেসকে অনুসরণ করতে পারব।
কৌতূহলী মাগলদের ভীড় ঠেলে ওরা বেরিয়ে গেলো, স্টেশনের বাইরে, গলিটার ওখানে, একেবারে যেখানে পুরনো ফোর্ড অ্যাংলিয়াটা পার্ক করা রয়েছে।
হাতের জাদুদণ্ডটার কয়েকটা টোকায় রন গুহার মতো দেখতে ওটার পেছনের ডালাটা খুলল। ওদের ট্রাংকগুলো ওখানে রাখল, হেডউইগকে রাখল পেছনের সীটে, নিজেরা বসল সামনের সীটে।
লক্ষ্য করো কেউ আমাদের খেয়াল করছে কি না, বলল রন। জাদুদণ্ডের আরেক টোকায় গাড়ি স্টার্ট করল। জানালা দিয়ে মাথা বের করে হ্যারি দেখল সামনের বড় রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া চলছে কিন্তু ওদের গলিটা একেবারে খালি।
ঠিক আছে, বলল সে।
ড্যাশবোর্ডের একটা ছোট্ট রূপালি বোতামে চাপ দিল রন। ওদের গাড়ি আর ওরা অদৃশ্য হয়ে গেলো। হ্যারি অনুভব করছে ওর সীটটা কাঁপছে। ইঞ্জিনের শব্দও শুনতে পেলো। হাঁটুর ওপর নিজের হাত দুটেকে অনুভব করতে পারল ও। নাকের ডগায় চশমাটাও রয়েছে বুঝতে পারল। কিন্তু যা দেখল তা হচ্ছে ও নিজে এক জোড়া চোখ হয়ে গেছে, ভাসছে মাটি থেকে কয়েক ফিট ওপরে পার্ক করা গাড়ি ভর্তি ছোট্ট একটা নোংরা রাস্তায়।
চলো যাওয়া যাক, ওর ডান দিক থেকে শোনা গেল রনের স্বর।
গাড়িটা উপরে উঠতেই নিচের মাটি আর দুপাশের নোংরা বিল্ডিংগুলো দৃষ্টির বাইরে চলে গেলো, মুহূর্তের মধ্যেই ওদের নিচে গোটা লন্ডন নগরী ধোঁয়াটে আর চিকমিক করছে।
তারপর একটা ফট শব্দ, আবার দৃশ্যমান হলো হ্যারি, রন এবং গাড়িটা। আহ, ওহ, চিৎকার করে উঠল রন, অদৃশ্য হওয়ার বুস্টারটি থাপড় মেরে। এটা খারাপ।
ওরা দুজনেই ওটার উপর উপর্যুপরি ঘুষি মারল। গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেলো। আবার দৃশ্যমান হলো।
দাঁড়াও! রন চিৎকার করল, অ্যাকসেলেটার দাবিয়ে ধরল, সোজা নীচু পেজার মতো মেঘের ভেতর প্রবেশ করল ওরা। সবকিছুই নিষ্প্রভ আর কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে গেলো।
এখন কী? বলল হ্যারি, চারদিকের ঘনিয়ে আসা ঘন মেঘের দিকে তাকিয়ে।
ট্রেনটাকে দেখতে হবে, তাহলে বোঝা যাবে কোনদিকে যেতে হবে, বলল রন।
আবার নিচে নামো দ্রুত
মেঘের নিচে নামল ওরা, সীটের ওপর বাঁকা হয়ে চোখ কুঁচকে নিচে মাটিতে দেখার চেষ্টা করল
আমি ওটাকে দেখতে পাচ্ছি! চিৎকার করে উঠল হ্যারি। একেবারে লোজা–ওইখানে!
ওদের নিচে দৌড়চ্ছে হোগার্টস এক্সপ্রেস টকটকে লাল একটা সাপের মতো।
উত্তর দিকে যাচ্ছে, বলল রন, ড্যাশবোর্ডের কম্পাসটা দেখে নিয়ে। ঠিক আছে, আধ ঘন্টা পর পর এটার গতিপথ চেক করলেই চলবে। দাঁড়াও–ওরা আবার মেঘের উপরে উঠে গেল এবং চোখ ধাঁধানো রোদের বন্যায় গিয়ে পড়ল ওরা।
যেন এক ভিন্ন জগত। গাড়ির চাকা তুলোর মতো মেঘ কাটছে, উজ্জ্বল আকাশ সীমাহীন নীল চোখ ধাঁধানো সাদা সূর্যের নিচে।
আমাদের এখন একটাই দুশ্চিন্তা, অ্যারোপ্লেন, বলল রন।
ওরা পরস্পরের দিকে তাকাল, হাসিতে ফেটে পড়ল; অনেকক্ষণ ওদের হাসি থামল না।
যেন ওরা একটা অবিশ্বাস্য স্বপ্নের মধ্যে রয়েছে। এটাই, ভাবল হ্যারি, হোগার্টস-এ যাওয়ার একমাত্র নিশ্চিত উপায়। তুষার সদৃশ মেঘের ঘূর্ণি পেরিয়ে, উষ্ণ উজ্জ্বল সূর্যালোকে আলোকিত গাড়িতে, হাতমোজা রাখার ঘোপে বড়সড় একটা টফির প্যাকেট। হোগর্টস দুর্গের সামনে ওদের দর্শনীয় অবতরণে ফেড্র আর জর্জের ঈর্ষাপূর্ণ দৃষ্টির সম্ভাবনার কথা কল্পনা করছিল হ্যারি।
আরো আরো উত্তরে উড়ে যেতে যেতে ওরা ট্রেনটাকে নিয়মিত চেক করল, যতবার মেঘের নিচে নেমেছে ততবারই একটা নতুন দৃশ্য দেখেছে। দ্রুতই লন্ডন ওদের চোখের আড়ালে চলে গেল, তার জায়গায় দেখা যেতে লাগল পরিষ্কার সবুজ মাঠ, তারপর প্রশস্ত গোলাপি পতিত জমি, গ্রাম, খেলনার মতো ক্ষুদ্র চার্চ এবং এরপর একটি বড় নগরী, বহুবর্ণের পিঁপড়ার মতো অসংখ্য গাড়ি।
কোনরকম অঘটন ছাড়াই কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর হ্যারিকে মনে মনে স্বীকার করতেই হলো, আনন্দের অনেকখানিই উবে গেছে। টফি খেতে খেতে ওদের যারপরনাই তেষ্টা পেয়েছে, কিন্তু পান করবার কিছুই নেই। সে আর রন গা থেকে ওদের জাম্পার খুলে ফেলেছে, কিন্তু হ্যারির টি-শার্ট সীটের পেছনে লেগে যাচ্ছিল আর চশমাটা বার বার পিছলে তার ঘামে ভেজা নাগের ডগায় চলে আসছিল। এখন আর মেঘের অপূর্ব আকৃতি দেখছে না সে, বরং নিচের ট্রেনটার কথাই ভাবছিল, যেখানে মোটসোটা ডাইনীরা ট্রলিতে করে বরফ-শীতল কদুর জুস বিক্রি করে। কি হয়েছিল? কেন ওরা প্লটফরমে পৌনে দশ-এ ঢুকতে পারল না?
আর খুব বেশি দূরে হবে না, কি বলো? যেন যন্ত্রণায় কাতরে বলল রন, কয়েক ঘন্টা পর, সূর্য যখন মেঘের মধ্যে ডুবতে শুরু করেছে ঘন গোলাপী রঙ্গে রাঙিয়ে। ট্রেনটাকে আরেকবার চেক করবার জন্য প্রস্তুত?
তখনও ওটা ওদের নিচেই রয়েছে, এঁকে-বেঁকে একটি তুষার আবৃত পাহাড় পেরোচ্ছে। মেঘের আচ্ছাদনের নিচে অনেক বেশি অন্ধকার।
একসেলেটারে পা দাবিয়ে রন আবার উপরে উঠে এলো, সঙ্গে সঙ্গে কঁকিয়ে উঠল ইঞ্জিন।
হ্যারি আর রন সন্ত্রস্ত দৃষ্টি বিনিময় করল।
সম্ভবত ক্লান্ত হয়ে গেছে, বলল রন। এর আগে কখনো এতদূরে আসেনি গাড়িটা
গাড়ির আর্তনাদের শব্দ ক্রমেই বাড়ছে, ওরা না শোনার ভান করল। আকাশ ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসছে। একটা দুটো করে তারা ফুটছে। হ্যারি ওর আবার জাম্পার গায়ে চড়ানো। গাড়ির উইন্ডস্ক্রীন ওয়াইপারগুলো ধীরে ধীরে দুর্বলভাবে নড়ছে, যেন প্রতিবাদ করছে। না দেখার ভান করল হ্যারি।
আর খুব বেশি দূর নয়, বলল রন, যতটা না হ্যারিকে তার চেয়েও বেশি গাড়িটাকে শোনাবার জন্যে। এখন আর দূরে নেই, ড্যাশবোর্ডে আস্তে করে চাপড় মারছে রন বিচলিতভাবে।
একটু পরে আবার যখন ওরা মেঘের নিচে নেমে এলো, অন্ধকারের মধ্যে চোখ কুঁচকে ওদেরকে পরিচিত চিহ্নগুলো খুঁজতে হলো।
ওই যে! ওখানে! হ্যারি চিৎকার করে উঠল, লাফিয়ে উঠল রন আর হেডউইগ। সোজা নাক বরাবর।
অন্ধকার দিগন্তের পটভূমিতে আবছা, লেকের ধারে খাড়া পাহাড়টার ওপরে দাঁড়িয়ে হোগার্টস ক্যাসল-এর টাওয়ারগুলো।
কিন্তু গাড়ি ততক্ষণে কাঁপতে শুরু করেছে, গতি কমছে।
এই তো এসে পড়েছি, বলল রন আদর করে, স্টিয়ারিংটাকে ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে, প্রায় পৌঁছে গেছি, অমন করে না–
ইঞ্জিনটা আর্তনাদ করে উঠল। বনেটের নিচ থেকে ধোয়ার সরু কুণ্ডলী বেরুচ্ছে সবেগে। লেকের দিকে উড়ে যাচ্ছ ওরা। হ্যারি খুব জোরে ওর সীটের ধার আঁকড়ে ধরল।
গাড়িটা বিচ্ছিরিভাবে এপাশ-ওপাশ নড়ে উঠল। জানালার বাইরে তাকিয়ে মাইলখানেক নিচে হ্যারি দেখতে পেল মসৃণ, কালো কাঁচের মতো স্বচ্ছ পানি। প্রাণপনে ঠেসে ধরার কারণে স্টিয়ারিং-এর উপর রনের আঙুলের নখ সাদা হয়ে গেছে। গাড়িটা আবার প্রবলভাবে এপাশ-ওপাশ ঝাঁকি খেলো।
এই তো এসে গেছি, বিড় বিড় করে বলল রন।
ওরা এখন লেকের উপর, হোগার্টস ঠিক বরাবর সামনে… রন ওর পা দাবালো একসেলিটারে।
প্রচণ্ড জোরে একটা ধাতব শব্দ হোলো। ফুত ফুত শব্দ করে ইঞ্জিন একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো।
আহ ওহ, নীরবতার মধ্যে বলল রন।
গাড়ির সামনের দিকটা নিচের দিকে খাড়া ডাইভ দিল। ওরা পড়ছে, গতি বাড়ছে, একেবারে হোগার্টস ক্যাসেলের কঠিন দেয়ালের দিকে।
না আ আ আ আ! চেঁচিয়ে উঠল রন, স্টিয়ারিং ঘোরালো; গাড়িটা বিরাট একটা বাঁক নেয়াতে মাত্র কয়েক ইঞ্চির জন্য ওরা পাথরের দেয়ালটা এড়িয়ে যেতে পারল। অন্ধকার গ্রিনহাউজগুলোর উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে সব্জির মাঠগুলো পেরিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা কালো লনগুলোর ওপর। যত এগোচ্ছে তত নিচে নামছে ওরা।
স্টিয়ারিংটা পুরোপুরি হাত থেকে ছেড়ে দিল রন। পেছনের পকেট থেকে জাদুদণ্ডটা বের করল।
থামো! থামো! চীৎকার করে উঠল সে, দণ্ড দিয়ে গাড়ির ড্যাশবোর্ড আর উইন্ডস্ক্রীনে টোকা দিতে দিতে। কিন্তু তখনও ওরা দ্রুত নিচে নামছে, মাটি যেন ওদের দিকে উড়ে আসছে…
সাবধান ওই গাছটা খেয়াল রেখো! এবার হ্যারি চিৎকার করে উঠল, লাফ দিয়ে স্টিয়ারিংটা ধরবার চেষ্টা করল, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে
ক্রাংক।
ধাতু আর কাঠের সংঘর্ষের কান ফাটানো শব্দের মধ্য দিয়ে তারা গাছের গুঁড়িটাতে গিয়ে সজোরে আঘাত করল, মাটিতে যখন পড়ল কেঁপে উঠল গাড়িটা। বেড়ানো বনেটের নিচ থেকে প্রচুর বাষ্প বেরুচ্ছে; ভয়ে কাঁপছে হেডউইগ, উইভীনের সঙ্গে যেখানে হ্যারির মাখার সংঘর্ষ হয়েছে সেখানে গলফ বলের সাইজের একটা আলু দপ দপ করছে, ডান দিকে শোনা গেল রনের নিচু স্বরের হতাশাকাতর যন্ত্রণার আওয়াজ।
তুমি ঠিক আছ তো? বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।
আমার জাদুদণ্ড, বলল রন, ওর স্বর কাঁপছে। আমার জাদুদণ্ডটা খোঁজ।
ওটা ভেঙ্গে গেছে, প্রায় দুই ভাগ, কোনরকমে জোড়া লেগে আলগাভাবে ঝুলছে।
হ্যারি বলতে যাচ্ছিল ওটা নিশ্চয়ই স্কুলে ঠিক করা যাবে, কিন্তু বলতে পারল না। ঠিক সেই মুহূর্তে তার দিকে কে যেন আক্রমণ করল তেড়ে আসা ষাড়ের মতো। ছিটকে পড়ল সে বনের দিকে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একই শক্তিতে গাড়ির ছাদেও হামলা হলো।
কি হচেছ?
ঘন ঘন শ্বাস টানছে রন। উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করছে। আর হ্যারি যেন সময়মতোই মাথা ঘুরিয়েছিল পাইথনের মতো গাছের ডালটাকে উইস্ক্রীন চুরমার করতে দেখার জন্যে। যে গাছটাকে ওরা গাড়ি দিয়ে মেরেছে ওই গাছটাই ওদের আক্রমণ করেছে। ওটার গুঁড়িটা বাঁকা হয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে, ওটার গাঁটযুক্ত শাখাগুলো গাড়ির যেখানে যেখানে নাগাল পাচ্ছে সেখানেই উপর্যপুরি ঘুষি মারছে।
আ আ র ঘ! বলল রন, ওর দিকের দরজাটা দাবিয়ে দিল অরেকটি বাঁকানো শাখা; আঙুলের গাঁটের মতো গাছের ছোট ছোট ডাল ঘুষি মারছে ক্রমাগত আর উইন্ডস্ক্রীনটা কাঁপছে, লোহার মুগুরের মতো মোটা আর একটি শাখ পিটছে গাড়ির ছাদটাকে, ওটা দেবে যাচ্ছে
বাঁচতে হলে দৌড়াও! নিজের দিকের দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার করে উঠল রন, পর মুহূর্তেই আক্রোশে আরেকটি বৃক্ষ শাখা মারল এক আপারকাট উড়ে গিয়ে হ্যারির কোলের উপর আছড়ে পড়ল ও।
আমাদের কাজ সারা! গুঙিয়ে উঠল ও, গাড়ির ছাদটা নিচে ঝুলে পড়েছে, কিন্তু হঠাৎ গাড়ির মেঝেটা কাঁপতে শুরু করল–ইঞ্জিনও আবার স্টার্ট হয়ে গেলো।
পেছন দিকে চেঁচিয়ে উঠল হ্যারি, গাড়িটা তীরের মতো পেছনে ছুটল। গাছটা তখনও ওদের আঘাত করবার চেষ্টা করছে; ওরা শুনতে পেলো ওটার শেকড় মড়মড় করে মাটি থেকে যেন উপড়ে আসছে, গাছটা ওদের ধরার জন্য ধেয়ে আসতে আসতে ওরা নাগালের বাইরে চলে গেলো।
প্রায়, হাঁপাচ্ছে রন, গিয়েছিলাম আর কি! সাবাশ, বাছা গাড়ি।
ক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে গাড়িটা। দুবার ঘটাং ঘটাং করে দরজাগুলো খুলে গেলে হ্যারির মনে হলো ওর সীটটা একদিকে কাত হয়ে গেছে। এরপর সে যা মনে করতে পারল সেটা হচ্ছে সে ভেজা মাটিতে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে। জোরে জোরে ভোতা আওয়াজ শুনে বুঝতে পারল গাড়িটা ওদের বাক্স পেটরা পেছন থেকে ছুঁড়ে বাইরে ফেলছে। বাতাসে উড়তে উড়তে হেডউইগের খাঁচাটা খুলে গেলো; ক্ষিপ্ত পাখিটা বিকট একটা চিক্কার দিয়ে একেবারে সোজা উড়ে চলে গেলো হোগার্টস ক্যাসল-এর দিকে, একবারও পেছন ফিরে তাকাল না। তারপর বেড়ানো, খামচানো গাড়িটা বাষ্প ছাড়তে ছাড়তে অন্ধকারে হারিয়ে গেলো পেছনের বাতিগুলো জুল জুল করছে রাগে।
ফিরে এসো! চিৎকার করে ডাকল রন ওর ভাঙ্গা জাদু দণ্ডটা দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করল। ড্যাড মেরে ফেলবে আমাকে।
কিন্তু গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেলো। চোখের আড়াল হওয়ার আগে অবশ্য একজস্ট পাইপে শেষ বারের মতো একবার ফোঁস করে গেলো।
ভাগ্য আর কাকে বলে? বলল রন, নিচু হয়ে ওর ইঁদুর স্ক্যাবাসকে তুলে নিল। এত গাছ থাকতে কি না আমরা ওই গাছটাকেই মারলাম যেটা পাল্টা মারতে আসে।
কাঁধের ওপর দিয়ে গাছটার দিকে তাকাল ও, ওটা তখনও মারার জন্য ভীতিকরভাবে তড়পাচ্ছে।
চলে এসো, বলল হ্যারি ক্লান্তভাবে, এর চেয়ে আমাদের স্কুলে চলে যাওয়াই উচিত …
ওরা মনে মনে যে ছবি এঁকে রেখেছিল সে রকম বিজয়ীর আগমন তাদের হচ্ছে না। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া ও ক্ষত-বিক্ষত শরীরে ট্রাংকের প্রান্ত টেনে ঢাল বেয়ে হোগার্টস-এর বিশাল ওক কাঠের সম্মুখ দরজার দিকে অগ্রসর হলো।
আমার মনে হচ্ছে এরই মধ্যে ফিস্ট শুরু হয়ে গেছে, বলতে বলতে রন সামনের সিঁড়িতে ওর ট্রাংকটা ফেলে নীরবে এগিয়ে গেলো উজ্জ্বল আলোজ্বলা একটি জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখার জন্য। এই হ্যারি, দেখবে এসো–সর্টিং হচ্ছে।
দ্রুত এগিয়ে হ্যারি রনের সঙ্গে উঁকি মারল গ্রেট হলটার ভেতরে।
চারটে লম্বা ঠাসা টেবিলের উপর বাতাসে অসংখ্য জুলন্ত মোমবাতি ঝুলছে, সোনালি প্লেট আর পানপাত্রগুলো জ্বলজ্বল করছে। মাথার উপর জাদু করা সিলিংটায় সব সময়ই আয়নার মতো আকাশ দেখা যায়, এখন এখানে তারা জ্বল জ্বল করছে।
হোগার্টস-এর সরু হ্যাট-এর ভীড়ের মধ্য দিয়ে ওরা দেখতে পেলো দীর্ঘ একটা ভীত–সন্ত্রস্ত প্রথম বর্ষ লাইন। ওর মধ্যে জিনিও রয়েছে, সহজেই চোখে পড়ছে ওর বিশেষ উইসলি চুলের জন্য। ইতোমধ্যে, প্রফেসর ম্যাকগোনাগল, চশমা পরা এক ডাইনী চুল টানা করে বাধা পেছনে, নবাগতদের সামনে একটা টুলের ওপর হোগার্টস-এর বিখ্যাত সর্টিং হ্যাটটা রাখছেন।
প্রতি বছর এই পুরনো তালি দেয়া, ক্ষয়ে যাওয়া এবং ময়লা হ্যাটটাই নবাগত ছাত্রদের জন্য চারটি হোগার্টস হাউজে (গ্রিফিন্ডর, হাফপাফ, র্যাভেনক্ল এবং স্লিারিন) ওদের স্থান নির্ধারণ করে থাকে। হ্যারির খুব মনে পড়ছে, এক বছর আগে ও নিজেও ওটা পড়েছিল মাথায়, ভয়ে জড়সড় হয়ে অপেক্ষা করছিল, ওর কানে কানে জোরে হার্টটা ওর সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। কয়েক ভয়াবহ মুহূর্তের জন্যে ওর মনে হয়েছিল হ্যাটটা বোধহয় ওকে স্লিারিন হলে পাঠাচ্ছে, যে হাউজ অন্য যে কোনো হাউজের চেয়ে বেশি সংখ্যায় কালোজাদুর জাদুকর এবং ডাইনী তৈরি করেছে–কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যে জুটেছিল রন, হারমিওন এবং অন্যান্য উইসলিদের সঙ্গে গ্রিফিল্ডর হাউজ। গত টার্মে স্রিদারিন হাউজকে গত সাত বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো হারিয়ে গ্রিফিল্ডর হাউজের চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করতে সে আর রন অবদান রেখেছে।
একটি খুব ছোট, ইঁদুর-চুলো ছেলেকে ডাকা হলো মাথায় হ্যাট পড়বার জন্যে। হ্যারির চোখ ওকে পেরিয়ে চলে গেলো যেখানে প্রধান শিক্ষক, প্রফেসর ডাম্বলডোর, স্টাফ টেবিলে বসে সর্টিং দেখছিলেন, ওঁর দীর্ঘ রূপালি শ্মশ্রু আর অর্ধ চন্দ্র চশমা মোমের আলোয় চকচক করছে। কয়েক সীট পর হ্যারি দেখতে পেলো গিল্ডরয় লকহার্টকে, অ্যাকোয়ামেরিন রঙের পোষাক পড়েছেন। সব শেষে বসে আছেন হ্যাগ্রিড, বিশাল এবং লম্বা চুল, গভীর চুমুক দিয়ে পান করছেন।
দাঁড়াও… বিড় বিড় করে হ্যারি বলল রনকে। স্টাফ টেবিলে একটি চেয়ার খালি রয়েছে…স্নেইপ কোথায়?
প্রফেসর সেভেরাস স্নেইপ হচ্ছে হ্যারির সবচেয়ে কম পছন্দের শিক্ষক। হ্যারিও অবশ্য প্রফেসর স্নেইপ-এর সবচেয়ে কম পছন্দের ছাত্র। নিষ্ঠুর, ব্যঙ্গাত্মক এবং সবার অপছন্দের, শুধু তার নিজের হাউজ স্লিথেরিনের ছাত্র ছড়া, স্নেইপ পড়ান পোশন অর্থাৎ বিষ জাতীয় জাদুবিদ্যার উপাচার সম্পর্কে।
সম্ভবত তিনি অসুস্থ! বলল রন।
হয়তো তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বলল হ্যারি। কারণ কালোজাদুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার চাকরিটা আবার তিনি উপভোগ করতে পারেননি।
অথবা তাকে হয়তো চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, উৎসাহের সঙ্গে বলল রন। মানে সবাইতো তাকে ঘৃণা করে–
অথবা হয়তো, ঠিক ওদের পেছন থেকে বলল একটি শীতল কণ্ঠস্বর, তোমরা দুজন কেন স্কুলের ট্রেনে আসোনি এটা শোনার জন্য তিনি হয়তো অপেক্ষা করছেন।
চট করে ঘুরে দাঁড়াল হ্যারি। ওই যে, তার কালো পোষাক ঠাণ্ডা বাতাসে এলোমেলো, দাঁড়িয়ে আছেন সেভেরাস স্নেইপ। চিকন মানুষ, গায়ের চামড়া ফ্যাকাশে, বাঁকা নাক এবং কাঁধ পর্যন্ত লম্বা তেলতেলা চুল। এই মুহূর্তে এমনভাবে হাসছেন যে তার হাসিটাই হ্যারিকে বলছে ও আর রন অনেক গভীর সমস্যায় পড়েছে।
আমার পেছন পেছন আসো, বললেন স্নেইপ।
পরস্পরের দিকে তাকাবার পর্যন্ত সাহস নেই ওদের, হ্যারি আর রন স্নেইপকে অনুসরণ করে সিঁড়ি দিয়ে মশালের আলোয় আলোকিত বিশাল এন্ট্রান্স হলটায় প্রবেশ করল। গ্রেট হল থেকে সুস্বাদু চমৎকার খাবারের গন্ধ আসছে, কিন্তু স্নেইপ আলো আর উষ্ণতা থেকে সরিয়ে ওদেরকে সরু পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ভূগর্ভস্থ অন্ধকার কক্ষে নিয়ে গেলো।
ভেতরে, নিচের ঠাণ্ডা পথের দিকে দরজাটা অর্ধেক খুলে আঙুল তুলে বললেন তিনি।
ওরা স্নেইপ-এর অফিসে ঢুকল, ভয়ে কাঁপছে। আবছা দেয়ালগুলোতে শেলফ ভর্তি কাঁচের জার, ওগুলোর ভেতর ভাসছে এমন সব ঘৃণ্য জিনিস যেগুলোর নাম এই মুহূর্তে হ্যারি জানতেও চায় না। ঘর উষ্ণ রাখার ফায়ারপ্লেসটা অন্ধকার এবং শূন্য। স্নেইপ দরজাটা বন্ধ করে ওদের মুখোমুখি হলেন।
তাহলে, নরম সুরে বললেন তিনি, বিখ্যাত হ্যারি পটার এবং তার বিশ্বস্ত অনুচর উইসলির জন্য ট্রেনটা যথেষ্ট ভাল ছিল না। দর্শনীয়ভাবে আসতে চেয়েছিলে তাই কি?
না, স্যার, মানে কিংস ক্রসের রেলওয়ে স্টেশনের দেয়ালটা, ওটা
চুপ! ঠাণ্ডা গলায় বললেন স্নেইপ। গাড়িটার কি করেছ তোমরা?
রন ঢোক গিলল। স্নেইপ মানুষের মন পড়তে পারেন, এই ধারণাটা হ্যারির এই প্রথম হলো না। কিন্তু মুহূর্ত পর স্নেইপ যখন আজকের ইভিনিং প্রফেটটা মেলে ধরলেন, তখন হ্যারির কাছে সব কিছুই পরিষ্কার হলো।
তোমাদেরকে দেখেছে, হেড লাইনটা ওদের দেখিয়ে হিসহিসিয়ে বললেন স্নেইপ : উড়ন্ত ফোর্ড অ্যাংলিয়া মাগলদেরকে ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে।
জোরে জোরে পড়তে লাগলেন তিনিঃ
লন্ডনের দুজন মাগল নিশ্চিত করেছেন যে, ওরা দেখেছেন পোস্ট অফিস টাওয়ারের উপর দিয়ে ওরা একটি পুরনো গাড়িকে উড়তে দেখেছেন…দুপুরে নরফক-এ, মিসেস হেটি বেলিস, যখন বাইরে তার ধোয়া কাপড় নাড়ছিলেন…পিবলস-এর মিস্টার অ্যাঙ্গাস ফ্লিট পুলিশের কাছে রিপোর্ট করেছেন…ছয় থেকে সাতজন মাগল সব মিলিয়ে।
আমার বিশ্বাস তোমার বাবা মাগল দ্রব্য অপব্যবহার সংক্রান্ত অফিসে কাজ করেন? রনের দিকে তাকিয়ে আরো নোংরাভাবে হেসে বললেন তিনি। আহা আহা… তার নিজের ছেলে…।
হ্যারির মনে হলো পাগল গাছগুলোর একটি সজোরে তার পেটে আঘাত করল। যদি কেউ জানতে পারে মিস্টার উইসলি গাড়িটাকে জাদু করেছে…সে এই সম্ভাবনার কথা একবারও ভাবেনি….
পার্কে তল্লাশি করবার সময় দেখেছি একটি অত্যন্ত মূল্যবান হোমপিং উইলো গাছের প্রচুর ক্ষতি করা হয়েছে, বলে চলেছেন স্নেইপ।
ওই গাড়িটা আমাদের অনেক বেশি ক্ষতি করেছে আমরা– রনের মুখ ফস্কে বের হয়ে গেলো।
চুপ করো! আবার ধমক দিল স্নেইপ। আফসোসের ব্যাপার হলো তোমরা আমার হাউজে নেই, তোমাদের বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি এখন ওদের ধরে নিয়ে আসছি যাদের এই আনন্দের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রয়েছে। তোমরা এখানেই অপেক্ষা করবে।
মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো হ্যারি আর রনের, দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যারির ক্ষিধে গায়েব হয়ে গেছে। খুব অসুস্থ বোধ করছে সে। স্নেইপ যেখানে বসেন তার পেছনে একটা শেলফে সবুজ তরলের মধ্যে বিরাট একটি সরু জিনিস ঝোলানো রয়েছে। হ্যারি চেষ্টা করছে যেন ওটার উপর চোখ না পড়ে। স্নেইপ যদি গ্রিফিল্ডর হাউজের প্রধান প্রফেসর ম্যাকগোনাগলকে আনতে গিয়ে থাকেন, তবে তাদের অবস্থা এর চেয়ে ভাল কিছু হওয়া মুশকিল। তিনি হয়তো স্নেইপ-এর চেয়ে ভাল, কিন্তু তিনি সাংঘাতিক রকমের কড়া।
দশ মিনিট পর স্নেইপ ফিরে এলেন এবং নিশ্চিতভাবেই প্রফেসর ম্যাকগোনাগল রয়েছেন তার সঙ্গে। হ্যারি এর আগেও প্রফেসর ম্যাকগোনাগলকে রাগতে দেখেছে, কিন্তু হয় সে মনে করতে পারছে না রেগে গেলে প্রফেসরের মুখ এত সরু হতে পারে অথবা সে এর আগে তাকে এমন রাগ হতে দেখেনি। ঘরে ঢোকা মাত্র তিনি তার জাদুদণ্ড তুললেন। হ্যারি আর রন দুজনই ভয়ে কুচকে গেল। কিন্তু তিনি এটা শুধু শূন্য ফায়ারপ্লেসটার দিকে নিশানা করলেন, হঠাৎ করেই ওটায় আগুন জ্বলে উঠল।
বসো, বললেন তিনি। দুজনেই আগুনের পাশে চেয়ারে বসল।
ব্যাখ্যা করো, তিনি বললেন, অশুভ লক্ষণের মতো তার চশমা জোড়া চকচক করছে।
রন বলতে শুরু করল, স্টেশনে দেয়ালটা যে তাদের ভেতরে যেতে দেয়নি। সেখান থেকে শুরু করল।
…সে কারণেই আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না প্রফেসর, আমরা ট্রেনে উঠতে পারিনি।
পেঁচাকে দিয়ে আমাদের কাছে চিঠি পাঠালে না কেন? আমার বিশ্বাস তোমার একটা পেঁচা রয়েছে বললেন তিনি হ্যারিকে উদ্দেশ্য করে ঠাণ্ডা স্বরে।
হ্যারি ঢোক গিলল। এখন যে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, মনে হচ্ছে সেটাই করা উচিত ছিল।
আমি–আমি ভাবিনি—
সেটা, বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল,বোঝাই যাচ্ছে।
দরজায় টোকা পড়ল এবং প্রাফেসর স্নেইপ, যাকে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এই মুহূর্তে বেশি খুশি দেখাচ্ছিল, দরজাটা খুললেন। দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রধান শিক্ষক প্রফেসর ডাম্বলডোর।
হ্যারির শরীর যেন বোধশক্তি হারিয়ে ফেলল। ডাম্বলডোরকে অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর দেখাচ্ছে। ডাম্বলডোর তার লম্বা বাঁকা নাক বরাবর তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে। হ্যারির ইচ্ছে হলো এখনও যদি সে আর রন উইলো গাছটার মার খেতো তাহলেই বরং ভাল ছিল।
দীর্ঘ একটা নীরবতা। তারপর ডাম্বলডোর বললেন,প্লিজ, ব্যাখ্যা করো, তোমরা এমন করলে কেন?
ভাল হত তিনি যদি চিৎকার করতেন, বকতেন। কিন্তু তার স্বরে হতাশার সুরটা হ্যারিকে বেশি কষ্ট দিল। কোনো কারণে সে প্রফেসর ডাম্বলডোরের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না, নিজের হাঁটুর দিকে তাকিয়ে কথা বলছে সে। সে ডাম্বলডোরকে সবই বলল, শুধু মিস্টার উইসলি যে গাড়িটার মালিক সে কথাটা বাদ দিয়ে। যে চিত্রটা সে দিল তাতে মনে হতে পারে যেন সে আর রন স্টেশনের বাইরে একটা উড়ন্ত গাড়ি পার্ক করা অবস্থায় পেয়ে গিয়েছিল। সে জানত ডাম্বলডোর ওটা ঠিকই ধরতে পারবেন, কিন্তু তিনি গাড়ির ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করলেন না। হ্যারি তার বক্তব্য শেষ করার পর তিনি শুধু তার চশমার ফাঁক দিয়ে চেয়ে রইলেন।
যাই আমাদের জিনিসগুলো নিয়ে আসি, হতাশার সুরে বলল রন।
কি বলছ তুমি, উইসলি? ধমকে উঠলেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল।
আপনারা তো আমাদের বহিস্কার করছেন, করছেন না? জিজ্ঞাসা করল রন।
হ্যারি দ্রুত প্রফেসর ডাম্বলডোরের দিকে তাকলি।
আজকে নয়, মাস্টার উইসলি, বললেন ডাম্বলডোর। কিন্তু তোমাদের দুজনইে, আজকে তোমরা যা করেছ তার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিতে চাই। তোমাদের গার্ডিয়ানদের আজ রাতে চিঠি লেখা হবে। তোমাদেরও আমি সাবধান করে দিচ্ছি এরপর যদি এ ধরনের কিছু তোমরা করো, তোমাদের বহিস্কার করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকবে না।
সেভেরাসের মনে হলো যেন ক্রিস্টমাস উৎসব বাতিল করা হয়েছে। একটু কেশে তিনি বললেন, প্রফেসর ডাম্বলডোর, এই ছেলে দুটো অপ্রাপ্তবয়স্কদের জাদুপ্রয়োগের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত আইন ভঙ্গ করেছে, একটি প্রাচীন এবং মূল্যবান গাছের ব্যাপক ক্ষতি করেছে…এই ধরনে আচরণ নিশ্চয়ই আ…
এই ছেলেগুলির শাস্তির ব্যাপারে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল স্থির করবেন, সেভেরাস, শান্তভাবে বললেন প্রফেসর ডাম্বলডোর। ওরা তার হাউজের ছাত্র, এবং সে কারণে তার দায়িত্ব। তিনি প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের দিকে ফিরলেন। আমাকে ভোজসভায় ফিরতে হচ্ছে মিনারভা, কয়েকটা নোটিস জারি করতে হবে। আসুন সেভেরাস, সু–স্বাদু এবং দেখতে চমৎকার একটি কাস্টার্ড চাটনি রয়েছে ওটা চেখে দেখতে হবে।
বিষের দৃষ্টিতে হ্যারি আর রনের দিকে তাকালেন স্নেইপ, তারপর নিজের অফিস থেকে বের হয়ে গেলেন। ওরা এখন প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের মুখোমুখি। তখনও তিনি চেয়ে আছেন ওদের দিকে দৃষ্টিটা ক্ষিপ্ত ঈগলের।
তোমার রক্তক্ষরণ হচ্ছে, উইসলি, হাসপাতাল উইং-এ যাওয়াই ভাল।
খুব বেশি না, বলল রন দ্রুত চোখের ওপরে কাটাটা জামার হাত দিয়ে মুছতে মুছতে। প্রফেসর, আমি বরং আমার বোনের হল বাছাইটা চেয়েছিলাম
হল বাছাই অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে, বললেন প্রফেসর ম্যাকগোনাগল। তোমার বোনও গ্রিফিল্ডরেই।
ওহ, খুব ভাল হলো। রন বলল।
আর গ্রিফিল্ডরের কথা বলতে গেলে–তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন প্রফেসর কিন্তু হ্যারি মাঝখানে বাধা দিল, প্রফেসর, আমরা যখন গাড়িটা নিয়েছিলাম তখন স্কুলের টার্ম তখনও শুরু হয়নি, তাহলে এর জন্যে গ্রিফিল্ডরের পয়েন্ট কাটা উচিত হবে না, কাটা উচিত? শেষ করে সে আগ্রহভরে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল-এর দিকে তাকাল।
প্রফেসর তার দিকে একটি অন্তর্ভেদি দৃষ্টি দিলেন, কিন্তু হ্যারি নিশ্চিত যে তিনি প্রায় হাসলেন। তবে ওর মুখটা আর আগের মতো সরু নেই।
গ্রিফিল্ডর থেকে কোনো পয়েন্ট নিতে আমি দেব না, বললেন প্রফেসর, হ্যারির বুকটা একটু হালকা হলো। তবে তোমাদের দুজনকেই আটক থাকার শাস্তি পেতে হবে।
হ্যারি যত ভয় পেয়েছিল ততখানি হয়নি। ডার্সলিদের কাছে ডাম্বলডোর চিঠি লিখলেই বাকি কিছুই হবে না। হ্যারি ভাল করেই জানে ওরা বরং যারপরনাই হতাশ হবে এই ভেবে যে কেনুইলো গাছটা ওকে পিটিয়ে কেন তক্তা বানায়নি।
প্রফেসর ম্যাকগোনাগল আবার তার জাদুদন্ডটা তুললেন ওটাকে স্নেইপ-এর ডেস্কের দিকে তাক করলেন। বিরাট এক প্লেট স্যান্ডউইচ, দুটো রূপালি পানপাত্র আর এক জগ ভর্তি বরফ মেশানো কদুর রস এসে গেলো টেবিলে।
তোমরা এখানেই খাবে, তারপর সোজা হোস্টেলে যাবে, আমাকেও ভোজসভায় ফিরতে হবে।
প্রফেসর ম্যাকগোনাগল-এর পেছনে দরজাটা বন্ধ হতেই রন নিচু স্বরে একটা দীর্ঘ শিষ বাজালো।
একটা স্যান্ডউইচ তুলে নিয়ে ও বলল, আমি মনে করেছিলাম আমাদের এখানেই শেষ হয়ে গেলো।
আমিও তাই ভেবেছিলাম, বলল হ্যারিও একটি স্যান্ডউইচ উঠিয়ে নিতে নিতে।
আমাদের মন্দ ভাগ্যকে কি বিশ্বাস কর? মুখ ভর্তি চিকেন আর হ্যাম এর মধ্যে দিয়ে বলল রন। ফ্রেড আর জর্জ কমপক্ষে ছয় সাত বার গাড়িটা চালিয়েছে কিন্তু কোনো মাগল ওদের দেখতে পায়নি। মুখের খাবারটা পেটে চালান করে দিয়ে আর এক কামড় মুখে পুরল সে। আমরা কেন স্টেশনের বাধা পেরোতে পারলাম না?
কাঁধ ঝাঁকাল হ্যারি। এখন থেকে আমাদেরকে দেখেশুনে সাবধানে চলতে হবে, বলল ও কদুর জুসের একটা চুমুক নিয়ে। যদি আমরা ভোজে যেতে পারতাম…
তিনি চাননি যে আমরা জাহির করি, রন বলল দার্শনিকের মতো। চাননি যে লোকে ভাবুক উড়ন্ত গাড়িতে করে আসাটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ।
পেটপুরে স্যান্ডউইচ খেয়ে প্লে(টটা খালি হলে নিজে নিজেই আবার পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল) ও অফিস ত্যাগ করল, পরিচিত পথ ধরে গ্রিফিল্ডর হাউজের দিকে এগিয়ে গেলো। পুরো মহলটাই চুপচাপ; মনে যেন ভোজ শেষ হয়ে গেছে। ওরা বিড়বিড় করা ছবি, ক্যাচম্যাচ করা ধাতব বর্মের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলল। পাথরের সিঁড়ির সরু ধাপ বেয়ে উঠল। এক সময় গ্রিফিল্ডর হাউজের গোপন পথটা যেখানে গোলাপী সিল্কের পোষাক পরিহিত স্কুল মহিলার অয়েল পেইন্টিং-এর পেছনে লুকিয়ে রয়েছে সেখানে পৌঁছল।
পাসওয়ার্ড, বলল স্থূল মহিলা, ওরা ওখানে পৌঁছতেই।
ইয়ে মানে– বলল হ্যারি।
ওরা নতুন বছরের পাসওয়ার্ড জানে না। কোনো গ্রিফিল্ডর প্রিফেক্ট এর সঙ্গে ওদের তখনও দেখা হয়নি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যও হাজির হলো। ওরা দ্রুত পায়ের শব্দ শুনতে পেলো ওদের পেছনে। ঘুরে দেখল ওদের দিকে দৌড়ে আসছে হারমিওন।
এই যে তোমরা! কোথায় ছিলে? অবিশ্বাস্য সব গুজব-একজন বলল উড়ন্ত একটি গাড়ি আকসিডেন্ট করার জন্য তোমাদেরকে স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।
আমাদেরকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি, হ্যারি ওকে নিশ্চিত করল।
তুমি নিশ্চয়ই বলতে চাচ্ছ না যে তোমরা এখানে উড়ে এসেছ? জিজ্ঞাসা করল হারমিওন, একেবারে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল-এর মতো সিরিয়াস।
বক্তৃতা বাদ দাও এখন আমাদের নতুন পাসওয়ার্ডটা বলো দেখি, বলল রন অধৈর্য হয়ে।
ওয়টলবার্ড, হারমিওনও বলল অধৈর্য হয়ে, কিন্তু সেটা কোনো কথা নয়
ওরা কথাটা কেটে গেল। স্কুল মহিলার অয়েল পেইন্টিংটা সড়াৎ করে সরে গেলো এবং হাততালির একটা ঝড় ওদের কানে এলো। মনে হচ্ছে যেন পুরো গ্রিফিল্ডর হাউজটাই এখনও জেগে আছে, বৃত্তাকার কমন রুমে, ভারসাম্যহীন টেবিলে, গাদাগাদি করে আরাম কেদারায়, অপেক্ষা করছে ওদের আগমনের জন্যে। পেইন্টিং-এর গর্তটার মধ্য দিয়ে হাত বের হয়ে হ্যারি আর রনকে ভেতরে টেনে নিল। হারমিওনকে অবশ্য ওদের পেছনে নিজে নিজেই হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হলো।
ব্রিলিয়ান্ট, চিৎকার করে উঠল লি জর্ডান। দারুণ ব্যাপার! কি একটা আসা! উওমপিং উইলোর একেবারে ওপরে গাড়ি চালিয়ে অবতরণ, মানুষ বহু দিন এ ঘটনা আলোচনা করবে!
তোমার ভালো হোক, বলল পঞ্চম বর্ষের একজন, যার সঙ্গে হ্যারি কোনদিন কথাই বলেনি। কেউ একজন ওর পিঠ চাপড়ে দিল যেন সে এই মুহূর্তে ম্যারাথন জয় করে এসেছে। ফ্রেড আর জর্জ ভিড় ঠেলে একেবারে সামনে এসে একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, এই, তোমরা আমাদের ফোন করনি কেন? লাল টকটকে হয়ে গেলো রনের চেহারা, বিব্ৰত। কিন্তু হ্যারি দেখতে পারছে একজনকে যে মোটেই খুশি নয়। পার্সিকে দেখা যাচ্ছে উত্তেজিত কয়েকজন প্রথম বর্ষীয়র মাথার ওপর দিয়ে, ওদের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে, এখন বলবে ওদের রুমে যেতে। হ্যারি রনের পাঁজরে গুতো মারল, পার্সিকে দেখিয়ে মাথা নাড়ল। ইশারা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল রন।
আমরা ক্লান্ত উপরে যেতে হবে–রুমে, বলল ও, দুজনে রুমের অপর দিকে দরজাটার দিকে অগ্রসর হলো ভিড় ঠেলে। দরজার বাইরে ঘোরানো সিঁড়ি রয়েছে রুমে যাওয়ার জন্য।
শুভ রাত্রি, হ্যারি হারমিওনের উদ্দেশে বলল, পার্সির মতো ওর চোখেও ক্রুদ্ধ চাহনি।
কোনরকমে ওরা কমনরুমের আরেক প্রান্তে যেতে পারল। যেত যেতে পিঠে উৎসাহের চাপড়ও পড়েছে। সিঁড়ির ধাপটাও পেয়ে গেলো। দ্রুত উপরে উঠল ওরা, একেবারে উপরে, অবশেষে পৌঁছল ওদের সেই পুরনো রুমে, এখন ওটার দরজায় দ্বিতীয় বর্ষ। সেই পরিচিত বৃত্তাকার রুমটায় ঢুকল ওরা, পাঁচটি চার স্ট্যান্ড–ওয়ালা খাটে মখমল ঝোলানো, উঁচু সরু জানালা। তাদের ট্রাংকগুলো আগেই নিয়ে আসা হয়েছে এবং বিছানার কিনারায়ই রাখা।
হ্যারির দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল রন, অপরাধীর হাসি।
আমি জানি ওসব বা অন্য কিছু আমার এনজয় করা অনুচিত হয়েছে, কিন্তু
রুমের দরজাটা সজোরে খুলে গেলো এবং ঢুকল আরো তিনজন ড্রিফিল্ডর ছাত্র সিমাস ফিনিগান, ডিন থমাস এবং নেভিল লংবটম।
অবিশ্বাস্য খুশিতে জ্বল জ্বল করছে সিমাস। শান্ত হও, সিমাসের উত্তেজনা দেখে বলল ডিন। বিস্ময়কর, বলল নেভিল অভিভূত হয়ে। হ্যারিও আর নিজেকে চেপে রাখতে পারল না। দাঁত বের করে হাসল।