০২. ডব্বির হুঁশিয়ারি
হ্যারি প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল। বিছানার ওপর বসা ছোট্ট জীবটার বাদুরের মতো বিরাট দুটো কান আর কপালের নিচে বেরিয়ে আসা টেনিস বল সাইজের দুটো চোখ। মুহূর্তের মধ্যে হ্যারি বুঝতে পারল এটাই তাকে সকালে বাগানের ঝোপ থেকে লক্ষ্য করছিল।
ওরা পরস্পরের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকল। নিচের হল থেকে ডাডলির গলা শোনা গেল।
আমি কি আপনাদের কোট দুটো নিতে পারি, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস মেসন?
জীবটা বিছানা থেকে নেমে হ্যারির উদ্দেশে এমন ঝুঁকে বো করল যে ওর দীর্ঘ সরু নাকটা মেঝের কার্পেট ছুঁয়ে ফেলল। হ্যারি খেয়াল করল ওটার পরনে বালিশের পুরনো ওয়াড়ের মতো জামা, হাত আর পায়ের জন্যে ফুটো করা।
এই মানে–হ্যালো, বলল হ্যারি সন্ত্রস্ত হয়ে।
হ্যারি পটার, বলল জীবটি, তীক্ষ্ণ উঁচু স্বরে, হ্যারি নিশ্চিত যে আওয়াজটা নিচতলা পর্যন্ত গেছে। এতদিন ধরে ডব্বি অপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে, স্যার … এটা এমন একটি সম্মান …।
ধ–ধন্যবাদ, বলল হ্যারি দেয়ালের কিনারা ঘেমে এগিয়ে গিয়ে ডেস্ক চেয়ারে ডুবে গেল সে, পাশেই হেডউইগ, ওর বিরাট খাঁচায় ঘুমে বিভোর। হ্যারি জিজ্ঞাসা করতে চাইল, তুমি কি করো? কিন্তু ভাবল প্রথমেই এটা জিজ্ঞেস করা খুবই অভদ্রতা হয়ে যাবে, মত পরিবর্তন করে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে?
ডব্বি, স্যার শুধু ডঝি। ডব্বি দি গৃহ-ডাইনী, বলল জীবটি।
ওহ–তাই নাকি? বলল হ্যারি। আমি– মানে অভদ্র বা অমন কিছু হতে চাই না, কিন্তু বেড রুমে গৃহ-ডাইনী থাকার উপযুক্ত সময় আমার জন্যে এটা নয়।
নিচের লিভিং রুম থেকে আন্ট পেতুনিয়ার উচ্চ স্বরের মেকি হাসি শোনা যাচ্ছিল। গৃহ-ডাইনী মাথা নিচু করে বসে রইল।
হ্যারি দ্রুত বলল, তোমাকে দেখে যে আমি খুশি হইনি তা নয়, কিন্তু, মানে, এখানে আসার কি কোনো বিশেষ কারণ আছে?
ওহ, হ্যাঁ, স্যার, আন্তরিকভাবে বলল ডব্বি। ডব্বি আপনাকে বলতে এসেছে, স্যার….বেশ মুশকিল, স্যার….ডব্বি ভাবছে কোথা থেকে শুরু করা যায়…
বিছানাটা দেখিয়ে হ্যারি নম্রভাবে বল, বসো।
গৃহ-ডাইনীটা সশব্দে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, হ্যারি পেল ভয়।
ওর মনে হলো নিচের কণ্ঠস্বরগুলো যেন হোঁচট খেল। ওরা বোধহয় শুনতে পেয়েছে।
আমি দুঃখিত, ও ফিসফিস করে বলল, আমি তোমার মনে কষ্ট দিতে চাইনি।
আমার মনে কষ্ট? গৃহ-ডাইনীর গলা বুজে এলো। ডব্বিকে কখনও কোনো উইজার্ড বসতে বলেনি তাদের সমান মনে করে—
সশশ হ্যারি ওকে থামানোর চেষ্টা করল, সান্ত্বনা দিয়ে বিছানায় নিয়ে বসিয়ে দিল। হেঁচকি দিয়ে তখনও কান্না থামানোর চেষ্টা করছে ও। ওকে দেখতে লাগছে বড়সড় একটা কুৎসিত পুতুলের মতো। অবশেষে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলো সে, ওর বিশাল দুটো চোখ সজল কোমল দৃষ্টিতে হ্যারির দিকে তাকিয়ে রইল।
বোধহয় খুব বেশি ভাল উইজার্ডের সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হয়নি, ওকে চাঙ্গা করার চেষ্টায় বলল হ্যারি।
ডব্বি ওর মাথা নাড়ল। তারপর, হঠাৎ কোনরকম আভাষ না দিয়েই সে লাফিয়ে উঠে জানালায় ওর মাথা ঠুকতে শুরু করল, সঙ্গে চিৎকার, ডব্বি খারাপ! ডব্বি খারাপ!
না–কি করছ তুমি? লাফিয়ে উঠে ওকে আবার বিছানায় টেনে আনতে আনতে চাপা গলায় হিসহিসিয়ে বলল হ্যারি। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে জেগে উঠে হেডউইক পাগলের মতো খাঁচার সঙ্গে ওর ডানা ঝাপটাতে লাগল।
ডব্বির নিজেকে শাস্তি দিতে হবে, সার, ডাইনীটা বলল। ও এখন সামান্য টেরা হয়ে গেছে। ডব্বি তার পরিবার সম্পর্কে প্রায় বদনাম করে ফেলেছিল, স্যার …..।
তোমার পরিবার?
যে উইজার্ড পরিবারে ডব্বি কাজ করে স্যার….. ডব্বি গৃহ-ডাইনী .. চিরকালের জন্য একটি উইজার্ড পরিবারে অবশ্যই তাকে কাজ করতে হবে…
ওরা জানে যে তুমি এখানে? জিজ্ঞাসা করল হ্যারি উৎসুক হয়ে।
ডব্বি শিহরিত হলো।
ওই না, স্যার, না… ডব্বির নিজেকে গুরুতরভাবে শাস্তি দিতে হবে আপনাকে দেখতে আসার জন্যে, স্যার। এর জন্যে ডব্বিকে ওভেনের দরজায় তার কান আটকে রাখতে হবে। যদি ওরা কখনও জানতে পারে, স্যার…
কিন্তু ওভেনের দরজায় কান আটকে রাখলে কি ওরা টের পাবে না?
এ ব্যাপারে ডব্বির সন্দেহ রয়েছে। সব সময়ই কোনো না কোনো কারণে ডব্বির নিজেকে শাস্তি দেয়ার দরকার পড়ে, স্যার। ওরা ডব্বিকে এটা করতে দেয়, স্যার। কখনও কখনও ওরা আমাকে অতিরিক্ত শাস্তি নেয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়…।
তাহলে তুমি ওদেরকে ছেড়ে আসো না কেন? পালাও না কেন?
একজন গৃহ-ডাইনীকে মুক্তি দিতে হয়, স্যার। এবং ওই পরিবার কখনই ডব্বিকে মুক্তি দেবে না… ডব্বি আমৃত্যু ওই পরিবারের কাজ করে যাবে, স্যার…
হ্যারি অপলক তাকিয়ে রইল।
আর আমি ভাবছিলাম এখানে আরো চার সপ্তাহ আমাকে কী না কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে হবে, বলল সে। অবশ্য এখন তোমার কাহিনী শুনে ডার্সলিদের প্রায় মানবিক বলে মনে হবে। তোমাকে কি কেউই সাহায্য করতে পারে না? আমি পারি না?
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হ্যারি ভাবল, যদি সে কথা না বলত। ডব্বি আবার কৃতজ্ঞতার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
প্লিজ, হ্যারি পাগলের মতো ফিসফিস করে বলল, প্লিজ চুপ করো। যদি ডার্সলিরা কিছু শোনে, যদি ওরা জানে তুমি এখানে…
হ্যারি পটার জিজ্ঞাসা করছে সে ডব্বিকে সাহায্য করতে পারে কি না…ডব্বি তোমার মহানুভবতার কথা শুনেছে, স্যার, কিন্তু তোমার সদগুণের কথা কখনো জানত না…।
হ্যারির কান গরম হতে লাগল, বলল, আমার মহানুভবতার কথা যাই শুনে থাকো না কেন সবটাই পাহাড় সমান বাজে। এমনকি আমি হোগার্টস-এ আমার ইয়ারে প্রথম পর্যন্ত হইনি, হয়েছে হারমিওন, সে…
কিন্তু দ্রুত থেমে গেলো সে, কারণ হারমিওনের কথা ভাবা তার জন্যে বেদনাদায়ক।
হ্যারি পটার বিনয়ী এবং ভদ্র, বলল ডব্বি শ্রদ্ধার সঙ্গে, ওর গোলাকার চোখ দুটো যেন জ্বলছে। হ্যারি পটার ওর বিজয়ের কথা বলে না, তার বিজয় তার ওপর যার নাম নিতে হয় না।
ভেলিডেমর্ট? বলল হ্যারি।
বাদুড়ের মতো দুটো কানের ওপর হাত চাপা দিয়ে গুঙ্গিয়ে উঠল ডব্বি, আহ, নাম নেবেন না, স্যার! নাম নেবেন না!
সরি, হ্যারি বলল দ্রুত। আমি জানি অনেক লোক এটা পছন্দ করে না আমার বন্ধু রন…
আবার থামল হ্যারি। ভাবল রনের কথা ভাবাটাও কষ্টকর।
ডব্বি হ্যারির দিকে ঝুঁকল, ওর চোখ জোড়া গাড়ির হেডলাইটের মতো বিশাল।
ডব্বি শুনেছে বলাবলি হচ্ছে, বলল সে ভাঙ্গা গলায়, অন্ধকারের লর্ডের সঙ্গে হ্যারি পটারের দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছে, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে…এবং আবারো হ্যারি পটার রক্ষা পেয়েছে।
হ্যারি সম্মতিতে মাথা নাড়ল এবং হঠাৎ করেই ডব্বির চোখ দুটো জলে চকচক করে উঠল।
আহ, স্যার, ঘন ঘন শ্বাস নিল ডব্বি, পরনের বালিশের খোলটা দিয়ে মুখটা মুছে নিল। হ্যারি পটার সাহসী এবং বীর! ইতোমধ্যেই তিনি অনেকগুলো বিপদ সাহসের সাথে মোকাবিলা করেছেন! কিন্তু ডব্বি এসেছে হ্যারি পটারকে রক্ষা করতে, তাকে সাবধান করতে, যদি তাকে পরে ওভেনের দরজায় কান বন্ধ করে রাখতে হয় তবুও….হ্যারি পটারের কিছুতেই হোগার্টস এ ফিরে যাওয়া উচিত হবে না।
রুমে নীরবতা নেমে এলো। শুধু শোনা যাচ্ছে নিচের তলার ছুরি কাটার শব্দ এবং আঙ্কল ভার্ননের গম গম করা গলার শব্দ।
কি–কি? তোতলাতে শুরু করল হ্যারি পটার। কিন্তু আমাকে তো ফিরে যেতে হবে–সেপ্টেম্বরের এক তারিখে টার্ম শুরু হচ্ছে। এই স্কুলই তো আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তুমি তো জান না ওখানটায় কি-রকম। এটা আমার স্থান নয়। আমার স্থান তোমার দুনিয়ায় হোগার্টস-এ।
না, না, না, যেন যন্ত্রণায় কাতরে উঠল ডব্বি, এতো জোরে জোরে মাথা নাড়ল যে ওর কান দুটো পাখার মতো ঝাপটালো। হ্যারি পটারকে সেখানেই থাকতে হবে যেখানে তিনি নিরাপদ। তিনি খুবই মহৎ, খুবই ভাল, তাকে হারানো যাবে না। হ্যারি পটার যদি হোগার্টস-এ ফিরে যান তবে মরণ, বিপদে পড়বেন তিনি।
কেন? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।
একটা ষড়যন্ত্র আছে, হ্যারি পটার। হোগার্টস স্কুল অফ উইচক্রাফট অ্যান্ড উইজারডি-তে এ বছর খুব ভয়ানক সব ঘটনা ঘটানোর ষড়যন্ত্র হয়েছে। ফিস ফিস করে বলতে বলতে শিউরে উঠল ডব্বি। ডব্বি এটা কয়েক মাস ধরেই জানত, স্যার, হ্যারি পটারের নিজেকে বিপদের মধ্যে ফেলা উচিত হবে না। তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কি ভয়ানক ঘটনা? সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।
ডব্বি একটা অদ্ভুত শব্দ করল যেন ওর গলা বুজে আসছে এবং তারপর পাগলের মতো দেয়ালে মাথা ঠুকতে শুরু করল।
ঠিক আছে, ওর বাহু খামচে ধরে চিৎকার করল হ্যারি। আমি বুঝতে পারছি, তুমি বলতে পারছ না। কিন্তু তুমি আমাকে সাবধান করছ কেন? হঠাৎ ওর মাথায় একটা অপ্রিয় চিন্তা খেলে গেল। দাঁড়াও–ভোল–দুঃখিত–তুমি জান ইউ নো হু-এর সঙ্গে তো এর কোনো সম্পর্ক নেই, আছে? তোমাকে মুখে কিছু বলতে হবে না, শুধু মাথা নাড়লেই চলবে, ডব্বির মাথাটা আবার দেয়ালের দিকে যেতে দেখে তাড়াতাড়ি বলল হ্যারি।
ধীরে ধীরে ডব্বি ওর মাথা নাড়ল।
না–না, যার নাম নেয়া যায় না তিনি নন, স্যার।
কিন্তু ডব্বির চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেলো, মনে হচ্ছে ও হ্যারিকে কোনো ইঙ্গিত করতে চাচ্ছে। অবশ্য হ্যারি তখনও একেবারে অথৈ সাগরে।
ওর তো কোনো ভাই নেই, আছে?
মাথা নাড়ল ডব্বি, ওর চোখ আরো বড় হলো।
বেশ, আমি কিন্তু ভাবতে পারছি না আর কার হোগার্টস-এ ভয়ংকর সব ব্যাপার ঘটানোর সামর্থ্য রয়েছে, বলল হ্যারি। মানে আমি বলতে চাইছি, ডাম্বলডোর রয়েছেন, তাদের মধ্যে একজন। তুমি জান ডাম্বলডোর কে, জান না?
ডব্বি মাথা নোয়াল।
আলবাস ডাম্বলডোর এ যাবৎ হোগার্টস-এর সর্বশ্রেষ্ঠ হেডমাস্টার। ডব্বি জানে স্যার। ডব্বি শুনেছে, চূড়ান্ত পর্যায়ে ডাম্বলডোরের ক্ষমতা যার নাম নেয়া উচিত নয় তার সমকক্ষ। কিন্তু স্যার, ব্যাকুল ফিস ফিস মাত্রায় নেমে এলো ডব্বির গলার স্বর, এমন সব ক্ষমতা রয়েছে যেগুলো ডাম্বলডোরও… ক্ষমতা কোনো ভাল উইজার্ডের…..
এবং হ্যারি তাকে থামানোর আগেই, ডব্বি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল, হ্যারির টেবিল ল্যাম্পটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের মাথায় মারতে লাগল কান ফাটানো তীক্ষ্ণ চীৎকার করতে করতে।
হঠাৎ নীচতলায় সব কিছু নীরব হয়ে গেল। হ্যারির হার্ট বিট বেড়ে গেল, দুসেকেন্ড পর শোনা গেল আঙ্কল ভার্নন হল রুমে এসছেন, বলছেন, নিশ্চয়ই ডাডলি আবার তার টেলিভিশন অন করে রেখেছে, নেড়ি কুত্তার বাচ্চা!
জলদি! ওয়ার্ডরোবে! হিসহিসিয়ে বলল হ্যারি, ডব্বিকে ওটার ভেতর ঠেসে ভরল, দরজা বন্ধ করে নিজেকে বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিল। ঠিক তখনই দরজার হ্যান্ডেলটা ঘুরতে শুরু করল।
একেবারে হ্যারির মুখের কাছে মুখ নিয়ে দাঁত কড়মড় করে আঙ্কল ভার্নন বললেন, বদমাইশি করছিস? তুই আমার গল্পটাই মাটি করে দিলি, যেইমাত্র জাপানী গল্ফ–খেলোয়াড় জোকটার আসল জায়গায় এসেছি ঠিক তক্ষুণি সেটার বারোটা বাজিয়ে ছাড়লি…. আর একটা শব্দ যদি বের করিস তবে জন্মানোর জন্যে তোকে আফসোস করতে হবে!
সশব্দে পা ফেলে রুম ছাড়লেন তিনি।
কাঁপতে কাঁপতে হ্যারি ডব্বিকে ওয়ার্ডরোব থেকে বের করে আনল।
দেখেছ এখানে কি অবস্থা? বলল সে। এবার বুঝেছ কেন আমাকে হোগার্টস-এ ফিরে যেতে হবে? ওই একটাই জায়গা রয়েছে আমার। তাছাড়া, আমার মনে হয় ওখানে আমার বন্ধুও রয়েছে।
বন্ধু, যারা হ্যারি পটারের কাছে চিঠিও লেখে না? চতুরতার সঙ্গে বলল ডব্বি।
আমি আশা করছি ওরা হয়তো–দাঁড়াও, বলল হ্যারি বিরক্ত হয়ে। তুমি কিভাবে জান, আমার বন্ধুরা আমাকে চিঠি লিখছে না?
পা বদল করে দাঁড়াল ডব্বি।
ডব্বির সঙ্গে হ্যারি পটারের রাগ করা উচিত হবে না–ডব্বি এটা ভালর জন্যেই করেছে..
তুমি কি আমার সব চিঠি আটকে রাখছিলে?
ডব্বির কাছেই এগুলো রয়েছে স্যার, বলল ও। দ্রুততার সঙ্গে হ্যারির আওতার বাইরে চলে এলো। পরনের বালিশের ওয়াড়টার ভেতর থেকে সে একটা এনভেলাপের গোছা বের করল। হ্যারি হারমিওনের পরিষ্কার হাতের লেখা দেখতে পেল, রনের অপরিচ্ছন্ন লেখাও বোঝা যাচ্ছে, এমন কি কিছু হিজিবিজিও দেখতে একেবারে হোগার্টস-এর গেমকিপার হ্যাগ্রিডের হাতের রেখার মতো।
ডব্বি আগ্রহের সঙ্গে ম্যারির দিকে তাকালো।
হ্যারি পটারের রাগ করা উচিত হবে না… ডব্বি আশা করেছিল…. যদি হ্যারি পটার ভাবেন যে তার বন্ধুরা তাকে ভুলে গেছে…. তাহলে হ্যারি পটার আর স্কুলে ফিরে যেতে চাইবেন না, স্যার…।
হ্যারি কিছুই শুনছিল না। চিঠিগুলো নেয়ার জন্য হাত বাড়ালো, কিন্তু ডব্বি লাফিয়ে ওর নাগালের বাইরে চলে গেল।
হ্যারি পটার চিঠিগুলো পাবেন, স্যার, যদি তিনি ডব্বিকে কথা দেন যে, তিনি আর হোগার্টস-এ ফিরে যাবেন না। আহ স্যার! আপনার এই বিপদের মুখোমুখি হওয়া ঠিক হবে না! বলুন আপনি ফিরে যাবেন না, স্যার!
না, রেগে বলল হ্যারি, আমাকে আমার বন্ধুদের চিঠিগুলো দাও!
তাহলে হ্যারি পটার কোনো উপায় আর রাখল না, মন খারাপ করে বলল ক্ষুদে ডাইনীটা।
হ্যারি নড়ার আগেই, ডব্বি বেডরুমের দরজার দিকে তীর বেগে ছুটল, দরজা খুলে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল।
হ্যারির মুখ শুকিয়ে গেছে, পেট ভেতরে সেঁধিয়ে গেল, লাফ দিয়ে হ্যারি ওর পেছন পেছন ছুটল, তবে খেয়াল রেখেছে যেন শব্দ না হয়। সিঁড়ির শেষ তিনটা ধাপ এক লাফে পেরিয়ে সে একেবারে হলের কার্পেটের ওপর বেড়ালের মতো পড়েই চারদিকে ডব্বিকে খুঁজল। শুনতে পেল খাবার ঘরে আঙ্কল ভার্নন বলছেন, …পেতুনিয়াকে আমেরিকান জলকল-মিস্ত্রিদের সম্পর্কে সেই মজাদার গল্পটা বলুন মিঃ মেসন, ও না, শোনার জন্য একেবারে অস্থির হয়ে গেছে…
হ্যারি দৌড়ে হলটা পেরিয়ে রান্নঘরে চলে এলো এবং তার মনে হলো দেহের মাঝখান থেকে পেটটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।
আন্ট পেতুনিয়ার তৈরি মাস্টারপিস একটা পুডিং, ক্রিমের পাহাড় এবং চিনি দেয়া ভায়োলেট সব ভাসছে, সিলিং এর কাছে বাতাসে ভাসছে। কোণায় একটা কাবার্ডের ওপর জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে ডব্বি।
না, ককিয়ে উঠল হ্যারি। প্লিজ… ওরা আমাকে মেরে ফেলবে…
হ্যারি পটারকে বলতে হবে সে আর স্কুলে ফিরে যাবে না।
ডব্বি…. প্লিজ…
বলুন স্যার…
আমি বলতে পারি না।
ট্র্যাজিক দৃষ্টিতে ডব্বি চাইল ওর দিকে।
তাহলে ডব্বিকে এটা করতেই হবে স্যার, হ্যারি পটারের ভালর জন্যেই।
পুডিংটা মেঝের ওপর পড়ল কান ফাটানো শব্দে। ক্রিম ছিটকে জানালা আর দেয়াল লেপটালো। ডিশগুলো ভেঙ্গে খান খান হলো। চাবুকের একটা শপাং শব্দের মতোই অদৃশ্য হয়ে গেলো ডব্বি।
খাবার ঘর থেকে চিৎকার শোনা গেলো, আঙ্কল ভার্নন সজোরে ঢুকে হ্যারিকে দেখে শকে জমে কাঠ, মাথা থেকে পা পর্যন্ত আন্ট পেতুনিয়ার পুডিং। প্রথমে মনে হয়েছিল আঙ্কল ভার্নন পুরো ব্যাপারটাই সামলে নেবেন (এই আমাদের ভাগ্নে খুবই বিরক্ত–অচেনা লোক দেখলে ঘাবড়ে যায়, এই জন্যে আমরা ওকে উপরতলায় থাকতে বলেছিলাম…. জাতীয় কথা দিয়ে), বিস্ময়ে পাথর মেসনদেরকে প্রায় ঠেলে আবার ডাইনিং রুমে নিয়ে যাওয়ার সময় হ্যারির হাতে ঘর মোছার একটা কাপড় গুঁজে দিয়ে তিনি বললেন মেসনদের যেতে দাও তারপর গায়ের ছাল তোলা হবে তোমার। আন্ট পেতুনিয়া ফ্রিজার থেকে আরো কিছু আইসক্রীম বের করলেন, হ্যারি তখনও কাঁপছে, রান্নাঘর পরিস্কার করতে শুরু করল।
আঙ্কল ভার্নন তারপরও হয়তো ওর সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে পারতো, যদি এই পেঁচাটা না থাকত।
ডিনার শেষ, যেই না আন্ট পেতুনিয়া মুখশুদ্ধির জন্য মিন্টের বাক্সটা বাড়িয়ে দিয়েছে ওমনি বিরাট একটা গৃহপালিত পেঁচা ডাইনিং রুমের জানালা দিয়ে উড়ে এলো, মিসেস মেসন-এর মাথায় একটা চিঠি ছেড়ে আবার জানালা দিয়েই বেরিয়ে গেলো। অশরীরী প্রেতাত্মার মতো চিৎকার করে উঠলেন মিসেস মেসন এবং উচ্চস্বরে পাগল জাতীয় কথা বলতে বলতে দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। মিস্টার মেসন ততক্ষণই সেই বাড়িতে থাকলেন যতক্ষণ বলতে সময় লাগে শুধু এই কথাটা যে, তার স্ত্রী ছোট-বড় সব মাপের সকল ধরনের পাখি সম্পর্কে একেবারে প্রাণঘাতি ভয়ে ভীত এবং তাই এটা কি তাদের একটা তামাশা ছিল?
হ্যারি দাঁড়িয়ে রইল কিচেনে, হাতে ঘর মোছার কাপড়টা দুহাতে আকড়ে ধরে আছে যেন সাহস যোগাচ্ছে, আঙ্কল ভার্নন এগিয়ে যাচ্ছে ওর দিকে, চোখে দানবীয় চাহনী।
এটা পড়! পেঁচার আনা চিঠিটা ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে দাঁতের ফাঁকে হিসিয়ে উঠলেন তিনি।
নে পড় ওটা!
হ্যারি চিঠিটা নিল। ওর মধ্যে জন্মদিনের কোনো শুভেচ্ছা নেই।
প্রিয় মিস্টার পটার,
গোয়েন্দা সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি আপনি যেখানে থাকেন সেখানে আজ রাত নয়টা বারো মিনিটে হোভার চার্ম মায়া বিদ্যা প্রয়োগ করা হয়েছে।
আপনি জানেন অপ্রাপ্তবয়স্ক জাদুকরদের স্কুলের বাইরে মায়া বিদ্যা প্রয়োগ করবার অনুমতি নেই এবং আপনার দিক থেকে এই বিদ্যার আরো প্রয়োগ হলে আপনাকে স্কুল থেকে বহিষ্কারও করা হতে পারে (অপ্রাপ্তবয়স্কদের মায়াবিদ্যা প্রয়োগের যুক্তিসঙ্গত নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত ডিক্রি, ১৮৭৫, অনুচ্ছেদ সি)
আমরা আপনাকে আরো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, যে কোনো জাদু তৎপরত্তা যা অ-জাদুকর সম্প্রদায় (মাগল)-এর নজরে পড়বার ঝুঁকি রয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অফ ওয়ারলকস স্ট্যাটুট অফ সিক্রেসির ১৩ ধারা অনুযায়ী মারাত্মক অপরাধ।
আপনার ছুটি উপভোগ করন!
আপনারই একান্ত,
মাফাল্ডা পার্ক
ম্যাজিকের অসঙ্গত ব্যবহার সম্পর্কিত দপ্তর
ম্যাজিক মন্ত্রণালয়
চিঠি থেকে মুখ তুলে হ্যারি ঢোক গিলল।
তুমি আমাদের জানাওনি যে স্কুলের বাইরে মায়া প্রয়োগ করা তোমার জন্য নিষেধ, বললেন আঙ্কল ভার্নন চোখে পাগলামির বিচ্ছুরণ স্পষ্ট। বলতে ভুলে গেছ…..তোমার মনে ছিল না ….।
তিনি বুলডগের মতোই হ্যারির সহ্যশক্তির ওপর চেপে বসছেন, সমস্ত দাঁত মুখ খিঁচিয়ে। বেশ, তোমার জন্যে সুসংবাদ আছে…. আমি তোমাকে তালা মেরে রাখব, তুমি আর ওই স্কুলে ফিরে যাচ্ছ না…. কখনোই না…. আর তুমি যদি মায়া বিদ্যার প্রয়োগে নিজেকে মুক্ত করো তাহলে ওরাই তোমাকে স্কুল থেকে বের করে দেবে!
উন্মাদের মতো হাসতে হাসতে তিনি হ্যারিকে টেনে হিঁচড়ে ওপরতলায় নিয়ে চললেন।
আঙ্কল ভার্ননের কথা বলার ধরন যেমন খারাপ তেমনি মানুষটিও খারাপ। পরদিন সকালে হ্যারির জানালায় লোহার শিক লাগানোর জন্যে তিনি লোক ধরে আনলেন। তিন বেলা হ্যারিকে সামান্য কিছু খাবার যেন দেয়া যায় তার জন্যে আঙ্কল ভার্নন নিজেই বেডরুমের দরজায় চৌকো ছিদ্র করে একটা ক্যাট ফ্ল্যাপ লাগিয়ে নিলেন। সকাল-সন্ধ্যায় বাথরুম ব্যবহারের জন্যে হ্যারিকে দুবার বের হতে দেয়া হতো। এ ছাড়া চব্বিশ ঘন্টাই তাকে রুমে আটকে রাখা হতো।
তিনদিন পরও ডার্সলিদের মধ্যে নরম হওয়ার লক্ষণ দেখা গেল না এবং হ্যারিও এই দশা থেকে বের হবার কোনো উপায় দেখতে পেলো না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালার শিকের ওপরে সূর্য অস্ত যেতে দেখে আর ভাবে ওর পরিণতি কি হবে।
ম্যাজিক অর্থাৎ মায়া বিদ্যা প্রয়োগ করে রুম থেকে নিজেকে বের করে কি লাভ, যদি ওটা করার জন্য হোগার্টস তাকে বহিষ্কার করে? প্রিভেট-ড্রাইভে জীবন যেন থেমে গেলো। এখন ডার্সলিরা জানে যে, তাদের সকালে বাদুড় হয়ে জেগে ওঠার আশঙ্কা নেই, এই ভাবে হ্যারি তার একমাত্র অস্ত্রটি হারালো। ডব্বি হয়তো হোগার্টস-এর সম্ভাব্য ভয়ংকর ঘটনাগুলি থেকে বাঁচিয়েছে, কিন্তু যেভাবে চলছে তাতে সে হয়তো না খেতে পেয়েই মরবে।
ক্যাট-ফ্ল্যাপটা আওয়াজ করল। আন্ট পেতুনিয়ার হাত দেখা গেল, রুমের ভেতর এক বোল টিনড–সুপ ঠেলে দিল হাতটা। হ্যারির পেট তখন জ্বলছিল খিদায়, এক লাফে বিছানা থেকে নেমে প্রায় ছিনিয়ে নিল বোলটা। স্যুপটা ঠাণ্ডা বরফ, তবুও এক চুমুকে প্রায় অর্ধেকটা সাবাড় করে দিল হ্যারি। তারপর গেল হেডউইগের খাঁচার কাছে, বোলের নিচের সব্জিগুলো ওর শূন্য ট্রেতে দিয়ে দিল। পাখা আলোড়িত করল হেডউইগ, হ্যারির দিকে তাকাল চরম বিরক্তি নিয়ে।
মুখ ফিরিয়ে লাভ নেই, নির্মমভাবে বলল হ্যারি, ওই যা কিছু জুটেছে ভাগ্যে।
শূন্য বোলটা এবার সে ক্যাট-ফ্ল্যাপের কাছে মেঝেতে রেখে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। কেন জানি স্যুপটা খাওয়ার আগের চেয়ে এখন বেশি খিদে লাগছে।
যদি ধরে নেয়া যায় সে চার সপ্তাহ পরও বেঁচে থাকে, এরপর যদি সে হোগার্টস-এ যেতে না পারে তাহলে কি হবে? ওরা কি কাউকে পাঠাবে তার না যাওয়ার কারণ জানার জন্যে? তারা কি ডার্সলিদের সম্মত করতে পারবে যেন তারা তাকে যেতে দেয়?
ঘরটা অন্ধকার হয়ে আসছে। ক্লান্ত সে শ্রান্ত সে, পেট গুড় গুড় করছে, মনের মধ্যে জবাব না পাওয়া প্রশ্নগুলো বার বার ফিরে আসছে, একটা অস্বস্তি কর ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল হ্যারি।
সে স্বপ্ন দেখল, একটা চিড়িয়াখানার খাঁচার মধ্যে তাকে পুরে দেয়া হয়েছে, একটা বোর্ড ঝুলছে খাঁচাটায় তাতে লেখা ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক জাদুকর’। খাঁচার শিকের ফাঁক দিয়ে বিস্ফোরিত চোখে দর্শকরা ওকে দেখছে, ও শুয়ে আছে খড়ের বিছানার উপর অভূক্ত দুর্বল। সে ভিড়ের মধ্যে ডব্বিকে দেখল, চিৎকার করে সাহায্য চাইল। হ্যারি পটার ওখানেই নিরাপদ, স্যার, বলেই ডব্বি অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর এলো ডার্সলিরা। ওকে দেখে ডাডলি খাঁচার শিক ধরে ঝাঁকালো, বিক্ৰপের হাসি হাসল।
থামো, বিড় বিড় করে বলল হ্যারি। খাঁচা ঝাঁকানোর আওয়াজটা তার মাথায় যেন মুগুড় মারছে। আমাকে একা থাকতে দাও…..বন্ধ কর….আমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছি….
চোখ খুলল হ্যারি। জানালার শিকগুলোর মধ্যে দিয়ে চাঁদের আলো গলে পড়ছে। এবং শিকের ফাঁক দিয়ে কেউ একজন তার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে লাল চুল, লম্বা নাক আর মেচতায় ভরা মুখের কেউ।
হ্যারির জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রন উইসলি।