১৪. নরওয়ের নর্বার্ট
কুইরেলকে যতটা মনে হয়েছিল আসলে তিনি তারও বেশি সাহসী। পরের সপ্তাহগুলোতে তিনি আরো বিষণ্ণ, আরো শীর্ণ হয়ে পড়লেও ভেঙে পড়েননি। যতবারই তারা চারতলার দরোজায় কান পেতেছে ততবারই তারা ফ্লাফির গর্জন শুনতে পেয়েছে। স্নেইপের মাথা এখন গরম। তার মানে পরশমণি এখনও নিরাপদ।
কুইরেলের সাথে হ্যারির দেখা হলেই তিনি উৎসাহব্যঞ্জক হাসি হাসেন। এতে হ্যারি অনুপ্রাণিত হয়।
পরশমণি ছাড়াও হারমিওনের মনযোগ দেয়ার অনেক বিষয় ছিল। সে তার লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করল এবং হ্যারি ও রনকে এ ব্যাপারে তাগিদ দিতে থাকলো।
পরীক্ষার তো অনেক সময় বাকি। হ্যারি আর রন বলল।
মাত্র দশ সপ্তাই। হারমিওন জবাব দিল। এটা অনেক কম সময়। আর নিকোলাস ফ্লামেলের কাছে এটা তো একটি মুহূর্ত মাত্র।
কিন্তু আমাদের বয়স তো ছশ বছর হয়নি। রন হারমিওনকে মনে করিয়ে দিল। তা যাই হোক–তুমি কী রিভাইজ দিচ্ছ? তোমার তো সবই জানা।
আমি কী রিভাইজ দিচ্ছি? তোমাদের কি মাথা খারাপ? আমার পড়া এখনো বাকি। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার জন্যে পরীক্ষায় পাস করতে হবে। আমার একমাস আগেই পড়া শুরু করা উচিত ছিল। একাধারে হারমিওনের উপদেশ ও ক্ষেদোক্তি।
শিক্ষকরাও যেন মনে হলো হারমিওনের সাথে একমত হয়ে অতিরিক্ত পড়া চাপাতে লাগলেন। অতিরিক্ত চাপ সামলাতে হ্যারি ও রন তাদের অবসর সময়টাও লাইব্রেরিতে কাটাতে লাগলো।
আমার কিছুই মনে থাকছে না। এই বলে বিরক্ত হয়ে একদিন বিকেলে রন বইপত্র ছুঁড়ে ফেলে লাইব্রেরির জানালায় গিয়ে দাঁড়ালো। তার মনে হলো অনেকদিন পর সে একটা সুন্দর দিন প্রত্যক্ষ করলো। মুক্ত অপরাজিতা নীল আকাশ এবং বাতাসে গ্রীষ্মের হাতছানি।
হ্যারি এক হাজার জাদুকরী গাছপালা ও ছত্রাক নামক বইটি নেড়ে চেড়ে দেখছে, তখনি তার কানে গেল রন বলছে হ্যাগ্রিড, আপনি লাইব্রেরিতে কী করছেন?
হ্যাগ্রিডকে দেখে মনে হলো তিনি তার পেছনে কিছু লুকোচ্ছেন। গন্ধমুষিকের চামড়ার ওভার কোটটাতে তাকে বেখাপ্লাই দেখাচ্ছে।
এমনি দেখছি, হ্যাগ্রিডকে বিব্রত মনে হল। তা তোমরা এখানে কী করছ, তোমরা কি এখনও নিকোলাস ফ্লামেলকে খুঁজছো?
না, আমরা বহু আগেই তাকে পেয়েছি। রন নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল। এবং আমরা এটাও জানি কুকুরগুলো কি পাহারা দেয়। সেটা হচ্ছে পরশ…।
শ্শ্! হ্যাগ্রিড চারদিক সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলেন, কেউ শুনছে কিনা। এটা নিয়ে এত চিৎকার করো না।
আমরা আসলে আপনাকে দুএকটা বিষয় জিজ্ঞেস করতে চাই। হ্যারি বললো, ফ্লাফি ছাড়াও ওই পাথরটা পাহারার আর কি ব্যবস্থা আছে, সে সম্পর্কে যদি বলেন।
শ্শ্…? হ্যাগ্রিড ভীত দৃষ্টিতে ফিস ফিস করে বললেন, ছাত্রদের এ বিষয়ে জানানো নিষেধ, এখানে এটা নিয়ে আলোচনা করনা, সাবধান! পরে আমার সাথে দেখা করো। হ্যাগ্রিড বিদায় নিলেন।
তিনি পেছনে কি লুকোচ্ছিলেন? এটা পরশমনির সাথে সম্পর্কিত কিছু নয়তো? চিন্তিত মনে হারমিওন বললো।
হ্যাগ্রিড যেখানে ছিলেন, এই জায়গাটা আমি একটু দেখে আসি। বলে রন এগিয়ে গেল। মিনিট খানেক পরেই ফিরে এল, হাতে একগাদা বই। সবাই বিস্মিত হলো এটা দেখে যে, বইগুলোর সবই ড্রাগন ও এদের লালন–পালন সম্পর্কিত।
হ্যাগ্রিড সব সময়ই একটা ড্রাগন চেয়েছেন, প্রথম সাক্ষাতের দিনই তিনি আমাকে তার ইচ্ছার কথা বলেছেন–হ্যারি বললো।
কিন্তু ১৭০৯ সালের ওয়ারলকস কনভেনশন অনুযায়ী ড্রাগন লালনপালন করাতো বেআইনি–রন বললো।
***
তাহলে হ্যান্ডি জেনেশুনে ড্রাগন চর্চা করছেন কেন? হারমিওনের প্রশ্ন।
ঘণ্টাখানেক পরে ওরা তিনজন যখন হ্যাগ্রিডের বাসায় পৌঁছুলো, অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ঘরের সব জানালায় পর্দা টানা। এই গরম কালেও আলাদাভাবে আগুন জ্বেলে ঘর গরম করা হচ্ছে। হ্যাগ্রিড ওদেরকে চা এবং বেজীর স্যান্ডউইচ খেতে দিতে চাইলেন, কিন্তু তারা তা খেল না।
হ্যাঁ, কি যেন তোমরা জিজ্ঞেস করবে বলছিলে?
কোন রকম ভুমিকা না করে হ্যারি সরাসরি প্রশ্ন করলো–ফ্লাফি ছাড়া আর কে বা কারা পরশমনি পাহারা দেয়–সে সম্পর্কে যদি কিছু বলেন তো আমরা খুশি হব।
হ্যাগ্রিড ভ্রূ কুঁচকে হ্যারির দিকে তাকালেন। আমি এটা বলতে পারব না। প্রথমতঃ আমি নিজেই জানি না। দ্বিতীয়তঃ জানলেও আমি বলতাম না। কারণ, পরশমনিটা এখানে একটা ভাল কাজে রাখা আছে। তাছাড়া তোমরা ফ্লাফি সম্পর্কেই বা কিভাবে জানলে?
হ্যাগ্রিড, আপনি শান্ত হোন। হারমিওন মিষ্টস্বরে হ্যাগ্রিডকে অনেকটা খুশি করার জন্য বললো, আপনি জানেন, এখানে যা কিছু ঘটছে, সবই আপনি জানেন, আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত। আপনি না বলতে চাইলে সেটা আলাদা কথা। হ্যাগ্রিডের দাঁড়ি নড়ে উঠছে, মনে হলো তিনি মুচকি হাসছেন। হারমিওন বলে চললো–আমরা জানি পাহারার আসল কাজটি কে করেন। আমরা এও জানি ডাম্বলঙের সব কাজে কার ওপর বেশি নির্ভরশীল, আপনি ছাড়া আর কে?
শেষ কথাগুলোতে হ্যাগ্রিডের বক্ষ স্ফীত হলো, হ্যারি ও রন হারমিওনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।
হ্যাঁ, তোমাদেরকে বললে আর কি ক্ষতি হবে!
অধ্যাপক ডাম্বলডোর ফ্লাফিকে আমার কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন। এরপর সকল শিক্ষক মিলে ফ্লাফিকে জাদু দিয়ে বশ করে এই পরশপাথর পাহারায় বসান। তাদের মধ্যে অধ্যাপক স্নেইপও ছিলেন। হ্যাগ্রিড ব্যাখ্যা করলেন।
স্নেইপ? হ্যারি অবাক হয়।
হ্যাঁ–হ্যাঁ, তোমরা এই ব্যাপারটা জান না, তাই না? স্নেইপ পরশপাথর রক্ষা করতে চান, তার পক্ষে এটা চুরি করা সম্ভব নয়। হ্যান্ডি বললেন।
ওরা তিনজনই ভাবছে–যদি স্নেইপ পরশমনি রক্ষার পক্ষে থাকেন তাহলে অন্যান্য শিক্ষকগণ কিভাবে এটা রক্ষা করেন তা জানা সহজ হবে। হ্যাগ্রিড সবই জানেন।
অন্ততঃ অধ্যাপক কুইরেলের জাদুশক্তি ও কিভাবে ফ্লাফিকে ফাঁকি দেয়া যাবে–সবই জানা যাবে।
গরমে সিদ্ধ হওয়ার দশা সকলের। একটা জানালা খুলে দিলে হয়, মি. হ্যাগ্রিড! হ্যারি জানালা খুলতে উদ্যত হয়।
খোলা যাবে না, হ্যারি আমি দুঃখিত। বলেই হ্যাগ্রিড আগুনের দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে হ্যারিও আগুনের দিকে দৃষ্টি দিল। নজরে এল আগুনের মধ্যে কেতলির নিচে বিশাল কালো একটা ডিম। হ্যাগ্রিডকে বিচলিত মনে হলো।
কোথায় পেলেন এটা মি. হ্যাগ্রিড? রন আগুনের আরো কাছে গিয়ে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে।
জিতেছি–হ্যাগ্রিড বললেন। গত রাতে পাশের গ্রামে গিয়ে একজনের সাথে তাস খেলায় বাজি ধরে এটা জিতেছি। লোকটা যেন এটা দিতে পেরে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। হ্যাগ্রিডের চোখে মুখে গর্বের হাসি দেখা গেল।
কিন্তু বাচ্চা ফুটে বেরুলে আপনি কি করবেন। হারমিওন জিজ্ঞেস করলো।
এ বিষয়ে কিছুটা পড়াশোনা করছি। হ্যাগ্রিড বালিশের নিচ থেকে একটা বড় বই বের করলেন। বইটার নাম আনন্দ ও লাভের জন্য ড্রাগন প্রজনন। এর মধ্যেই লেখা আছে, কীভাবে আগুনে দিয়ে ডিম ফুটাতে হবে, কীভাবে ড্রাগনের বাচ্চাকে আধঘণ্টা পর পর মুরগির রক্ত মিশিয়ে পাতিল ভর্তি ব্রান্ডি খাওয়াতে হবে। এবং দেখো, আরও লেখা আছে, কীভাবে বিভিন্ন ধরনের ডিম চিনতে হবে। আমার এটা নরওয়েজিয়ান রিজব্যাক। খুবই দুর্লভ এগুলো।
হ্যাগ্রিড খুশি হলেও ওদের দুশ্চিন্তা গেল না। তারা ভেবে পেল না হ্যাগ্রিডের এই কাঠের ঘরে কেউ যদি এই অবৈধ ড্রাগনের বাচ্চা দেখে ফেলে তাহলে হাগ্রিডের কী হবে।
রাতের পর রাত ওরা পড়ায় ব্যস্ত রইলো। হারমিওন হ্যারি ও রনকে রিভাইজ দেয়ার সময়সূচি বানিয়ে দিল। পড়ার চাপে তারা পাগলপ্রায়।
এমনি একদিন নাস্তার সময় হেডউইগ এল হ্যাগ্রিডের ছোট চিরকুট নিয়ে। হ্যাগ্রিড মাত্র দুটো শব্দ লিখেছেন : বাচ্চা ফুটছে।
পড়া রেখে রন হাগ্রিডের বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। হারমিওনের যাওয়ার কোন আগ্রহ নেই।
হারমিওন, সারাজীবনে আমরা কটা দিন ড্রাগনের বাচ্চা ফোঁটা দেখার সুযোগ পাব বলতো? রনের জিজ্ঞাসা।
আমাদের পড়াশোনা আছে। আমরা বিপদে পড়ব, তাছাড়া কেউ যদি হাগ্রিডের ব্যাপারটা জেনে ফেলে, তখন কিছুই করার থাকবে না। হেমিওন জবাব দিল।
চুপ? হ্যারি ফিসফিসিয়ে বললো।
কয়েক গজ দূরে ম্যালফয়কে দেখা গেল সন্তর্পণে ওদের কথা শুনছে। কতটা শুনে ফেলো কে জানে। ম্যালফয়ের চাহনিটা মোটেই ভাল ঠেকল না।
আপত্তি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত হারমিওন ওদের সঙ্গী হতে রাজি হলো এবং কোনাকুনি মাঠের ওপর দিয়ে হ্যাগ্রিডের বাসায় হাজির হলো ওরা। আনন্দে–উত্তেজিত হ্যাগ্রিড ওদের অপেক্ষায় ছিলেন।
প্রায় ফুটে বেরুল বলে। তিনি ওদেরকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিলেন।
ডিমটা টেবিলের ওপর রাখা। ডিমের চারপাশে ফাটল দেখা যাচ্ছে। ভিতরে কি যেন নড়ছে। একটা মজার শব্দ নির্গত হচ্ছে।
সবাই আগ্রহভরে টেবিলের চারপাশে জড় হলো। বন্ধ নিঃশ্বাসে সবার দৃষ্টি একমাত্র ডিমের দিকে।
অকস্মাৎ সশব্দে ডিম ফেঁটে গেল। বাচ্চা ড্রাগন টেবিলের ওপর পড়ল। দেখতে যে খুব সুন্দর তা নয়। হ্যারির মনে হলো যেন একটা কালো ছাতা। ভানা দুটা জেট প্লেনের ডানার সাথে তুলনা করা যায়। উন্নত নাশা, তীক্ষ্ণ শিং যুগল, উজ্জ্বল কমলা রঙের চোখ। মুখ দিয়ে দু দুবার আগুনের রশ্মি বেরিয়ে গেল।
কি সুন্দর তাই না?–হ্যাগ্রিড বিড়বিড় করে বললেন–ওকে আশীর্বাদ কর, দেখ, ও কিন্তু ওর মাকে চেনে।
মি. হ্যাগ্রিড, একটা নরওয়েজিয়ান রিজব্যাক কতদিনে বড় ইয়?–হারমিওন জিজ্ঞেস করলো।
হ্যাগ্রিড জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তার চেহারা মলিন হয়ে গেল। দ্রুত জানালায় গিয়ে উঁকি দিলেন।
একটা বাচ্চামত কেউ পর্দা সরিয়ে আমাদের দেখে গেল। স্কুলের দিকে দৌড় দিয়েছে। হ্যাগ্রিড বললেন। হ্যারি দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখে নিঃসন্দেহ হলো। আর কেউ নয়–ম্যালফয় ড্রাগন দেখে ফেলেছে।
পরের সপ্তাহে ম্যালফয়ের হাসি হাসি মুখ দেখে ওরা তিনজন বেশ উদ্বিগ্নতার সাথে কাটালো।
হারমিওন, রন ও হ্যারি তাদের অবসর সময় হ্যাগ্রিডের অন্ধকার কুটিরেই কাটালো।
এটাকে আটকে রাখবেন না, হ্যারি বলল, এটাকে মুক্ত করে দিন।
একে ছাড়ব না, এ অত্যন্ত ছোট। হ্যাগ্রিড বললেন। আমি এটাকে নর্বার্ট বলে ডাকবো।
কিন্তু প্রধান চিন্তা হলো, হ্যাগ্রিড তো সারাজীবন এটাকে রাখতে পারবেন না। ম্যালফয়ের মাধ্যমে এ কথা প্রচার হবেই।
হ্যারি হঠাৎই রনের দিকে ফিরে বললো পেয়েছি। রন, তোমার ভাই চার্লি রোমানিয়ায় থাকে না? চার্লিই পারবে নৰ্বার্টকে যত্নে রাখতে।
চমৎকার! রন বললো। হ্যাগ্রিড কি বলেন?
অবশেষে হ্যাগ্রিভ রাজি হলেন। সিদ্ধান্ত হলো চার্লিকে পেঁচা পাঠানো হবে তার মত জানার জন্যে।
পরের সপ্তাহ বুধবার পর্যন্ত গড়াল। সবাই যখন শুতে গিয়েছে তখন হারমিওন আর হ্যারি একান্তে কমনরুমে গিয়ে বসল। মধ্যরাত। হঠাৎ করে প্রতিকৃতির গর্তটা খুলে গেল। সেখান থেকে বেরিয়ে এল রন। সে গা থেকে হ্যারির ছদ্ম আবরণটা খুলে ফেলল। সে এতক্ষণ হ্যাগ্রিডের কুঁড়ে ঘরে নর্বার্টকে মরা ইঁদুর খাওয়াচ্ছিল।
ড্রাগনটা আমাকে কামড়ে দিয়েছে। রন তার হাত দেখিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তার হাত একটা রক্তাক্ত রুমাল দিয়ে বাঁধা।
রন বলল–আমার জীবনে আমি এ পর্যন্ত যত প্রাণী দেখেছি তার মধ্যে এই ড্রাগনটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। হ্যাগ্রিড যখন এটার কাছে যান, মনে হয় তিনি যেন তার পোষ খরগোশের কাছে যাচ্ছেন। আমাকে যখন কামড় দিল তখন হ্যাগ্রিড বললেন–ভয়ের কিছু নেই, তোমাকে ভয় দেখাল। আমি যখন চলে আসি তখন শুনতে পেলাম হ্যাগ্রিড দিব্যি গান গাচ্ছেন।
অন্ধকার জানালায় টোকা পড়লো।
এটা হেডউইগ। হ্যারি বলল–ওকে ঢুকতে দাও। ও হয়তো চার্লির জবাব নিয়ে এসেছে।
তিনজন একত্র হয়ে চিঠি পড়তে শুরু করল–
প্রিয় রন,
তুমি কেমন আছ? তোমার চিঠির জন্য ধন্যবাদ। নরওয়ের প্রাণীটি নিজে আনতে পারলে আমি খুশিই হতাম। তবে তাকে এখানে নিয়ে আসার কিছু ঝামেলা আছে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি আমার কয়েকজন বন্ধুর সাথে তাকে পাঠিয়ে দাও। তারা আগামী সপ্তাহে আমার এখানে আসছে। তবে তাকে এমনভাবে আনতে হবে যাতে এটা বাইরে থেকে দেখা না যায়।
তুমি কি শনিবার মধ্যরাতে তাকে নিয়ে সবচেয়ে উঁচু চুড়ায় আসতে পারবে? আমার বন্ধুরা তোমার সাথে সেখানে দেখা করবে। অন্ধকার থাকতেই তাকে সরিয়ে দিও।
যত দ্রুত সম্ভব জবাব দিও। ভালবাসা রইল।
চার্লি
তারা পরস্পরের দিকে তাকাল।
এটা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। হ্যারি বলল–আমাদেরও অদৃশ্য হওয়ার পোশাক আছে। নর্বার্টকে নিয়ে আমরা দুজন অনায়াসে ওই পোশাকের ভেতর ঢুকে পড়তে পারব।
তারা একমত হল যে, গত সপ্তাই তাদের বেশ খারাপ গেছে। তাই তারা যেকোন মূলোই নর্বার্ট ও ম্যালফয়ের কাছ থেকে মুক্তি চায়।
পরদিন সকালে বেশ সমস্যা দেখা দিল। রনের হাত দ্বিগুণ ফুলে গেছে। সে ভাবছিল মাদাম পমফ্রের কাছে যাবে কিনা। তিনি কি বুঝতে পারবেন যে, এটা ড্রাগনের কামড়। নিরুপায় হয়ে বিকেলে তাকে পমফ্রের কাছে যেতেই হল। তার হাতে কামড়ের জায়গাটা অনেকটা সবুজ হয়ে গেছে। তার মনে হল নবার্টের দাঁত খুব বিষাক্ত। দিনশেষে হ্যারি আর হারমিওন হাসপাতালে গিয়ে দেখে রনের অবস্থা খুবই শোচনীয়। সে বিছানায় শুয়ে আছে।
আমার হাতের সমস্যা বড় সমস্যা নয়। রন ফিস ফিস করে বলল এ ব্যথা বেশিক্ষণ থাকবে না। ম্যালফয় মাদাম পমফ্রেকে জানিয়েছে সে আমার কাছে বই ধার চাইতে আসবে। সুতরাং সে আসতে পারে। আমাকে নিয়ে সে কৌতুক করবে। সে বার বার আমাকে চাপ দিচ্ছিল–আমাকে কোন প্রাণী কামড় দিয়েছে তা মাদাম পমফ্রেকে জানাই। আমি মাদাম পমফ্রেকে বলেছি এটা কুকুরের কামড়। আমার মনে হয় তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি। কিডিচ খেলায় ম্যালফয়কে মারা আমার ঠিক হয়নি। এখন সে প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে।
হ্যারি আর হারমিওন রনকে সান্ত্বনা দিল।
শনিবার মাঝরাতের ভেতরই সব ঠিক হয়ে যাবে। হারমিওন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। এতে রনের উদ্বেগ কাটলো না। রন হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল–সর্বনাশ হয়ে গেছে। চার্লির চিঠিটা তো সেই বইয়ের ভেতরই রয়ে গেছে। ম্যালফয় যদি চিঠি পড়ে ফেলে তাহলে তো সে বুঝে ফেলবে যে আমরা নর্বার্টকে সরাবার চেষ্টা করছি। ঠিক সেই মুহূর্তে মাদাম পমফ্রে হাজির হলেন। তিনি বললেন–তোমরা এখন যাও। রনের নিদ্রা প্রয়োজন।
***
হেরমিওনকে হ্যারি বলল-এখন তো পরিকল্পনা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ভাগ্য ভালো ম্যালফয় আমাদের অদৃশ্য হওয়ার পোশাক সম্পর্কে কিছুই জানে না। আমাদেরকে সাবধানে এগোতে হবে। হ্যাগ্রিডকে তারা চার্লির চিঠির কথা বললে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। তার অশ্রুর কারণ হতে পারে নৰ্বার্ট তার পায়ে কামড় দিয়েছে।
ও কিছু না! সে আমার জুতো নিয়ে খেলছিল। নর্বার্ট তো এখনও শিশু। হ্যাগ্রিড বললেন।
ড্রাগনটা তার লেজ দিয়ে দেয়ালে আঘাত করলে দেয়াল এত জোরে কেঁপে ওঠে যে জানালার কাঁচ চুরমার হয়ে। হ্যারি আর হারমিওন দূর্গে ফিরে এল। কিন্তু তাদের বারবার মনে হচ্ছিল–শনিবার হনুজ দূর অস্ত। শনিবার এখনও অনেক দূর।
নর্বার্টকে বিদায় দেবার সময় হ্যাগ্রিডের জন্য তাদের দুঃখ হলো। তারা এতটা উদ্বিগ্ন না হলে হয়ত কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে পারতো। রাতটা ছিল মেঘলা ও গাঢ় অন্ধকার। হাগ্রডের কুঁড়ে ঘরে সবকিছু প্রস্তুত করতে একটু বেশি সময় লাগলো। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, তারাও একটু দেরিতে এসেছে। কারণ পিভস প্রবেশ কক্ষে দেয়াল জুড়ে টেনিস খেলছিল। পিভস সেখান থেকে খেলা শেষ করে চলে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। একটা বড় বাক্সে নৰ্বার্টকে রাখা হলো।
শোকাভিভূত হ্যাগ্রিড বললেন–বেশ কিছু ইঁদুর ও কিছুটা ব্রান্ডি বাক্সে রেখে দিয়েছি। খিদে পেলে খেয়ে নেবে। তাছাড়া ওর টেডি বিয়ারটা দিয়ে দিয়েছি, যাতে সে একজন সঙ্গী পায়, নিঃসঙ্গ অনুভব না করে।
বাক্সের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে। মনে হচ্ছে ড্রাগন বোধহয় টেডি বিয়ারের মুও উড়িয়ে দিচ্ছে।
বাক্স বন্ধ করা হলে হ্যাগ্রিড ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। হ্যারি আর হারমিওন অদৃশ্য হওয়ার পোশাক দিয়ে বাক্সটা ঢেকে দিল এবং তারা দুজনও ওই পোশাকের নিচে ঢুকে গেল! কীভাবে দুর্গের চূড়ায় বাক্সটা ওঠানো হলো তা তারা জানতেও পারলো না।
এখন কেউ তাদের দেখতে পাচ্ছে না। কারণ তারা অদৃশ্য পোশাকে। তবে তারা একটু পরেই প্রায় দশফুট দূরে প্রদীপের আবছা আলোয় দুটা ছায়ামূর্তি দেখল। তারা হলেন অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল এবং ম্যালফয়। ম্যাকগোনাগল ড্রেসিং গাউন পরেছেন। তিনি ম্যালফয়ের কান টেনে চিৎকার করছেন–ডিটেনশান। মাঝরাতে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এত বড় স্পর্ধা। স্লিদারিন হাউজের বিশ পয়েন্ট কাটা গেল।
ম্যালফয় বলল–অধ্যাপক, আপনি বুঝতে পারছেন না। হ্যারি পটার আসছে। তার কাছে একটা ড্রাগন আছে।
বাজে কথা বল না। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন–চল অধ্যাপক স্নেইপের কাছে।
তারা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন।
যখন রাতের শীতল হাওয়া গায়ে কাঁটার মত বিধছে ঠিক তখনি টাওয়ারের চূড়ায় পৌঁছে তারা তাদের অদৃশ্য হওয়ার পোশাক খুলে ফেলল। হারমিওন বলল–ম্যালফয় শাস্তি পেয়েছে। আমার একটা গান গাইতে খুব ইচ্ছে করছে।
হ্যারি তাকে চুপ থাকতে বলল।
ম্যালফয়ের শাস্তির কথা চিন্তা করে তারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। নর্বার্ট বাক্সের ভেতর ছটফট করছে। ঠিক দশ মিনিট পর হঠাৎ চারটা ঝাড়ু তাদের সামনে উপস্থিত হলো। চার্লির বন্ধুরা খুব হাসি খুশি মেজাজের। নর্বার্টকে ওরা ঝুলিয়ে নিয়ে যাবে। হারমিওন ও হ্যারিকে ওরা দেখালো কি ভাবে ওকে ঝোলাবে এবং ওরা সবাই ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
নর্বার্ট চলে গেল। অবশেষে তারা নৰ্বার্ট থেকে অব্যাহতি পেল।
তারা যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছে তখন তারা ফিলচকে দেখল।
সামনে বোধহয় আমাদের বিপদ আছে। তারা টাওয়ারের ওপর ভুল করে তাদের অদৃশ্য হওয়ার পোশাক ফেলে এসেছে।