হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন: পৌনে দশ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে যাত্রা

হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন: পৌনে দশ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে যাত্রা

০৬. পৌনে দশ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে যাত্রা

ডার্সিলি পরিবারে হ্যারির শেষ মাসটা খুব আনন্দে কাটেনি। ডাডলি তাকে এমন ভয় পেত যে সে তার সঙ্গে কোন সময়ই এক ঘরে থাকতে চাইত না। অন্যদিকে তাকে কাবার্ডে ভরতে, ধমক দিতে বা জোর করে কিছু করতে ডার্সলিরা সাহসও পেতেন না। প্রকৃতপক্ষে, কেউই হ্যারির সাথে পারতপক্ষে কথা বলতেন না। কিছুটা ভয়, কিছুটা রাগের কারণে হ্যারি সামনে বসে থাকলেও তারা মনে করতেন চেয়ারটা খালি। ওখানে কেউ নেই। এটা অনেক দিক থেকে ভালো হলেও হ্যারির কাছে এই উপেক্ষা বিষাদে পরিণত হয়েছিলো।

সঙ্গী হিসেবে পেঁচাকে হ্যারি তার ঘরে রেখেছে। পেঁচার নাম দিয়েছে সে হেডউইগ। এ নামটি সে পেয়েছে এ হিস্ট্রি অফ ম্যাজিক গ্রন্থে। তার বইগুলো ছিল খুব মজার। সে গভীর রাত পর্যন্ত বইগুলো পড়ত। হেডউইগ জানালা দিয়ে ইচ্ছেমত ঘরের বাইরে যেত আবার আসত। ভাগ্য ভালো যে, আন্ট পেতুনিয়া কখনো হ্যারির ঘরে ঢুকতেন না, কারণ, প্রতিদিনই হেডউইগ ঘরে মরা ইঁদুর নিয়ে আসত। শোবার আগে সে প্রতি রাতেই দেয়ালে পিন দিয়ে আটকানো একটা কাগজে লেখা একটি করে তারিখ কেটে দিত। এভাবেই সে হিসাব রাখতো ১লা সেপ্টেম্বর আসতে আর কদিন বাকি আছে।

আগস্টের শেষ দিন হ্যারি কিভাবে সে কিংসক্রসে যাবে সে বিষয়ে আঙ্কল–আন্টের সঙ্গে একটু কথা বলে নেয়া ভালো। হ্যারি যখন তাদের বসার ঘরে গেল তখন তারা টিভিতে একটি কুইজ দেখছিলেন। হ্যারি গলা দিয়ে কাশির মতো শব্দ করল। তাকে দেখেই ডাডলি চিৎকার করে পালিয়ে গেল।

হ্যারি কাশি দিয়ে নিজের আসার কথা জানান দিল।

ভার্নন আঙ্কল, হ্যারি বলতে শুরু করল।

আঙ্কল কোন কিছু বললেন না, তবে বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি হ্যারির কথা শুনছেন।

হ্যারি বলল–আঙ্কল কাল আমি কিংস ক্রস স্টেশনে যাব। আমাকে হোগার্টস যেতে হবে। আপনার গাড়িতে আমাকে লিফট দিতে পারবেন?

আঙ্কল ভের্নন কথা না বলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

ধন্যবাদ। হ্যারি বলল।

হ্যারি যখন ওপরতলায় ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল তখন তার আঙ্কল কথা বললেন, জাদুকরদের স্কুলে যেতে আবার ট্রেনের প্রয়োজন হয় কেন? ওদের ম্যাজিক কার্পেটগুলো কি ফেঁটে গেছে? তারপর হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলেন–তোমার স্কুল কোথায়?

আমি ঠিক জানি না। হ্যারি জবাব দিল। হ্যারি তখনই উপলব্ধি করলো যে সে বিষয়টি আগে খেয়াল করেনি। সে পকেট থেকে হ্যাগ্রিডের দেয়া টিকিট বের করলো।

কী জানো তাহলে?

হ্যারি জবাব দিল-এতটুকু জানি পৌনে দশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ঠিক এগারোটায় ট্রেনে চড়তে হবে।

কী প্ল্যাটফর্ম বললে? আন্ট ও আঙ্কল তার দিকে বিস্ময়ে তাকালেন।

পৌনে দশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম। হ্যারি বলল।

যত্তসব রাবিশ–

এ নামে তো কোন প্ল্যাটফর্ম নেই। আঙ্কল ভার্নন মন্তব্য করলেন। টিকিটে তো তাই লেখা আছে। হ্যারি মরিয়া হয়ে জবাব দিল।

যত্তসব পাগলের কাণ্ড। আঙ্কল ভার্নন মন্তব্য করলেন–ঠিক আছে। অপেক্ষা করো, তুমি নিজেই দেখতে পাবে। তোমাকে কিংস ক্রস স্টেশনে নামিয়ে দিতে আমার কোন অসুবিধে নেই। কারণ কাল আমরাও লন্ডন যাচ্ছি।

পরিবেশ লঘু করার জন্য হ্যারি প্রশ্ন করল–আপনারা লন্ডন যাচ্ছেন, কেন?

ডাডলিকে হাসপাতালে নিতে হবে। বড় হওয়ার আগেই তার পেছনের ছোট লেজটায় অস্ত্রোপচার করতে হবে। সে-ই লেজটাই, যেটা গজিয়েছিল ঝড়ের রাতে, হ্যাগ্রিডের জাদুমন্ত্রে। সে রাত থেকে হ্যারিকে ডাডলির জ্বালাতন করাতো দূরের কথা, ওর ধারে কাছে যেতে সাহস পায় না।

পরদিন ভোর পাঁচটায় হ্যারি ঘুম থেকে উঠল। ভেতরে টান টান উত্তেজনা। তাই দ্বিতীয়বার আর ঘুমোতে গেল না। সে তার জিনসের কাপড় বের করল, কারণ জাদুকরের পোশাক পরে সে স্টেশনে যেতে চাচ্ছিল না। ট্রেনে উঠে সে পোশাক পালটে নেবে। হোগার্টসের জন্য যা যা জিনিস, তার তালিকা হ্যারি একবার যাচাই করে নিল। কারণ হোগার্টসে গিয়ে দেখা যাবে যে এমন কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনা দরকার ছিল কিন্তু সেগুলো আনা হয়নি।

তারপর হ্যারি অপেক্ষা করতে লাগল–ডার্সলি পরিবারের সদস্যদের কখন ঘুম ভাঙে। দু ঘণ্টা পর হ্যারির ভারী ট্রাংক ডার্সলির গাড়িতে ওঠানো হলো। আন্ট পেতুনিয়া ডাডলিকে বলে দিলেন–গাড়িতে ও যেন হ্যারির পাশে বসে। ভয়ে ভয়ে হলেও ডাডলি হ্যারির পাশে গাড়িতে বসলো, গাড়ি চলতে শুরু করলো।

সাড়ে দশটায় তারা কিংস ক্রস স্টেশনে পৌঁছলেন। আঙ্কল ভার্নন হ্যারির ট্রাংকটা ট্রলিতে উঠিয়ে দিলেন এবং নিজেই ট্রলিটি স্টেশনে ঠেলে নিয়ে গেলেন। হ্যারি আঙ্কলের ওই কাজকে একটা আশ্চর্য সদয় ব্যবহার বলে মনে করল। একটু পরে যখন আঙ্কল ভার্নন প্ল্যাটফর্মে পৌঁছলেন তখন তার মুখে এক অদ্ভুত হাসি।

আঙ্কল ভার্নন বললেন-এই তোমার প্ল্যাটফর্ম প্ল্যাটফর্ম নয়… প্ল্যাটফর্ম দশ। তোমার প্ল্যাটফর্ম এ দুটি সংখ্যার মাঝামাঝি হওয়া উচিত। মনে হচ্ছে–প্ল্যাটফর্ম এখনও তৈরি করেনি। আঙ্কল ভার্নন ঠিকই বলেছেন। প্ল্যাটফর্মের কোন এক জায়গায় প্লাস্টিকে বড় অক্ষরে নয় এবং অন্য এক স্থানে দশ লেখা আছে। এ দুয়ের মাঝামাঝি জায়গায় কোথাও কোন কিছু লেখা ছিল না।

ভালো থেকো। এই বলে তার সে-ই অদ্ভুত ও সংশয়মিশ্রিত হাসি হেসে আঙ্কল ভার্নন আর কোন কথা না বলেই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেলেন। হ্যারি তাকিয়ে দেখল ডার্সলিরা গাড়ি চালিয়ে চলে যাচ্ছেন। তাদের তিনজনই হাসছে। হ্যারির মুখ শুকিয়ে গেল। সে ভাবতে লাগল সে এখন কি করবে? পেঁচা হেডউইকের কারণে লোকজন তার দিকে তাকাচ্ছে। ট্রেনের ব্যাপারে কাউকে জিজ্ঞেস করা উচিত। হ্যারি গার্ডের কাছে গিয়ে হোগার্টসের ট্রেনের কথা জানতে চাইল। প্ল্যাটফর্ম নম্বর পৌনে দশ বলতে হ্যারির সাহস হচ্ছিল না। হোগার্টস কোথায়? জানতে চাইল গার্ড। হ্যারিও তাকে বলতে পারল না হোগার্টস দেশের কোন জায়গায় অবস্থিত। হ্যারি কি বলবে, তার মাথায় কিছু আসছিলো না। এবার প্রশ্ন করল–আচ্ছা এগারোটার সময় কোন ট্রেন আছে কি?

তাতো বলতে পারলাম না। গার্ড জবাব দিল। তখন এগারোটা বাজতে মাত্র দশ মিনিট বাকি। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। ট্রেনের মাত্র দশ মিনিট বাকি। সে স্টেশনের মাঝখানে ভারি ট্রাঙ্ক, পেঁচা ও পকেটভর্তি জাদুকরদের টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ঠিক এই সময়ে পেছনে একদল লোক দেখতে পেল যারা আলাপে মাগল শব্দটি বারবার বলছিল। এক মোটা মহিলা চারজন লাল চুল যুবকের সাথে কথা বলছিলেন। হ্যারি তাদের দিকে এগিয়ে গেল। শুনতে পেল মহিলা বলছেন–

–তোমাদের প্ল্যাটফর্ম নাম্বার কত?

পৌনে দশ। একটি ছোট মেয়ে জবাব দিল। তারও লালচুল। মাম, আমিও কি ওদের সাথে যেতে পারি না।

না, না, গিনি তুমি ছোট এখনো বড় হওনি। এখন চুপ কর। আর পার্সি তুমি আগে আগে যাও।

ছেলেদের মধ্যে যাকে সবচে বেশি বয়সের মনে হলো তাকে প্ল্যাটফর্ম নয় ও দশের দিকে অগ্রসর হতে দেখা গেল। হ্যারি তাকে অপলক দৃষ্টিতে লক্ষ্য রেখে তার পেছনে পেছনে অগ্রসর হলো। ছেলেটা যখন এই দুটো প্লাটফরমের মাঝামাঝি পৌঁছলো, তার সামনে দলে দলে পর্যটক। যখন সর্বশেষ ব্যাগটিও ট্রেন থেকে খালাস করা হলো তখন দেখা গেল যে ছেলেটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। ফ্রেড, তারপর তোমার পালা। ভদ্রমহিলা বললেন।

আমি ফ্রেড নই। আমি জর্জ। ছেলেটি জবাব দিল। তুমি কি আমাকে জর্জ বলে ডাকতে পারো না?

দুঃখিত, জর্জ। ভদ্রমহিলা বললেন।

ঠাট্টা করছিলাম। আমিই ফ্রেড। এই বলে সে চলে গেল।

তারপর তৃতীয় ভাইটি বদ্ধ দেয়ালের দিকে অগ্রসর হলো। তাকে আর দেখা গেল না। মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেল তারও কোন হদিস নেই। হ্যারির পাশে কেউ আর রইল না।

মাফ করবেন। ভদ্রমহিলার কাছে এসে হ্যারি বলল।

হ্যালো! হ্যারিকে সম্বোধন করে ভদ্র মহিলা বললেন–তুমি কি প্রথমবারের জন্য হোগার্টসে যাচ্ছে? রনও প্রথমবারের মতো যাচ্ছে।

তিনি তার ছোট ছেলের প্রতি ইশারা করলেন।

রন লম্বা, পাতলা। হাত পা বড় বড়। চোখা নাক।

হ্যাঁ হ্যারি জবাব দিল। কীভাবে যাব তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি

কেন, তুমি কি প্লাটফর্ম খুঁজে পাচ্ছি না।

না। হ্যারির জবাব।

চিন্তা নেই। তোমাকে শুধু দু প্লাটফর্মের মাঝখানে যেতে হবে। নয় ও দশের মাঝখানে। ওই দেয়ালের দিকে যাও। ঘাবড়াবার কারণ নেই। চেষ্টা কর যাতে রনের আগে পৌঁছতে পারো।

ঠিক আছে। হ্যারি বলল।

হ্যারি তার ট্রলি ধাক্কা দিল এবং সামনের বদ্ধ দেয়ালের দিকে তাকাল। দেয়ালটা একেবারে নিরেট।

হ্যারি হাঁটতে শুরু করল। যাওয়ার পথে লোকজনের সাথে হ্যারির ধাক্কাধাক্কি হলো। হ্যারি আরও দ্রুত হাঁটতে লাগল। টিকিট বাক্সের সাথে হ্যারির ধাক্কা লেগে গিয়েছিল প্রায়। ধাক্কা লাগলে তার জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে যেত। ভাগ্য ভালো। হ্যারিকে দুর্ঘটনায় পড়তে হয়নি।

জনাকীর্ণ প্লাটফর্মের পাশে একটি লাল রঙের বাস্পীয় ইঞ্জিন অপেক্ষা করছিল। ইঞ্জিনের ওপর লেখা ছিল হোগার্টস এক্সপ্রেস।

১১টা। হ্যারি পেছনে তাকাল। তাকিয়ে দেখল। নয় ও দশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে লেখা ভেসে উঠল–প্লাট ফরম পৌনে দশ।

কথাবার্তায় ব্যস্ত লোকজনের মাথার ওপর দিয়ে ইঞ্জিনের ধোঁয়া ভেসে চলেছে। নানা রঙের বিড়াল পায়ের ফাঁক গলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। অনেক পেঁচা এদিক–সেদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। ট্রাংক টানাটানির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

প্রথমদিকের কামরাগুলোতে ছাত্ররা গা ঘেষাঘেষি করে বসে আছে। কেউ কেউ জানালা দিয়ে মুখ গলিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলছে। একটা ছেলে তার ব্যাঙ হারিয়ে ফেলেছে। হ্যারির ভাগ্য ভালো। সে মোটামুটি একটি খালি কামরা পেয়ে গেল।

ফ্রেড নামের ছেলেটা হ্যারিকে জিজ্ঞেস করল–তুমি কি হ্যারি পটার?

হ্যাঁ। হ্যারি জবাব দিল।

হ্যারির দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে লালচুল যমজভাই দুজন ট্রেন থেকে নেমে এল। হ্যারি জানালার পাশে বসেছিল। সেখান থেকে নিজেকে অনেকটা আড়ালে রেখে হ্যারি প্ল্যাটফর্মে লালচুল পরিবারের সবাইকে লক্ষ্য করছিল এবং তারা কি বলছিল তা শুনছিল। মা এইমাত্র তার রুমাল বের করলেন।

রন, তোমার নাকে ওটা কি?

ছোট ছেলেটি তার মার কাছ থেকে সরে যাচ্ছিল। তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে তার নাক মুছে দিলেন।

যমজ ভাইদের একজন বলে উঠল–রনের নাকে কি কিছু আছে?

চুপ কর। রন ধমক দিল।

পার্সি কোথায়? তার মা জানতে চাইলেন।

সে আসছে

বড় ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এল। এরই মধ্যে সে তার পোশাক বদলে হোগার্টসের জাদুর স্কুলের পোশাক পরে নিয়েছে। হ্যারি দেখল ইংরেজি পি বর্ণ দিয়ে তার বুকের ওপর একটি উজ্জ্বল ব্যাজ।

মা, বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। ছেলেটি বলল।

আমি প্রিফেক্টদের কামরা থেকে এলাম। তারা তাদের জন্য দুটি কামরা পৃথক করে রেখেছেন।

পার্সি, তুমি কি একজন প্রিফেক্ট? যমজদের একজন প্রশ্ন করল।

যমজদের একজন আবার প্রশ্ন করল–পার্সি প্রতিদিন নতুন পোশাক পায় কিভাবে?

কারণ সে একজন প্রিফেক্ট। মা জবাব দিলেন। ভালোভাবে থেকো। যখন সুযোগ পাবে তখন আমাকে একটা পেঁচা পাঠাবে।

তিনি পার্সির কপালে চুমু দিলেন। পার্সি চলে গেল! এরপর তিনি যমজ ভাইদের দিকে নজর দিলেন।

হ্যারি লক্ষ্য করল ট্রেন বাঁক নেবার সাথে সাথেই মা ও মেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ট্রেনে চড়তে পারায় হ্যারির অনেক আনন্দ হচ্ছিল। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। হঠাৎ করে সামনের দরোজা খুলে গেল। একজন লালচুলের বালক কামরায় প্রবেশ করে হ্যারির উল্টোদিক দেখিয়ে জানতে চাইল-এখানে কি কেউ আছে? হ্যারি না বলাতে বালকটি ওই আসনে বসে পড়ল।

প্রথমে সে হ্যারিকে লক্ষ্য করল। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে এমনভাবে তাকাল যেন সে হ্যারিকে দেখতেই পায়নি। হ্যারি লক্ষ্য করল এর ভেতরে দু যমজ ভাই ফিরে এসেছে।

যমজ ভাইদের একজন বলল আমাদের কি পরিচয় হয়েছে? আমরা ফ্রেড ও জর্জ। এ হলো আমাদের ভাই রন। আবার দেখা হবে।

বিদায়, হ্যারি ও রন বললো। যমজ দু ভাই অন্য কামরায় গিয়ে দরোজা বন্ধ করে দিল। তুমি কি আসলেই হ্যারি পটার? রন আবার প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ। মাথা নেড়ে হ্যারি বলল। রন আবার বলল–আমি ভেবেছিলাম ফ্রেড বা জর্জের মধ্যে কেউ একজন হবে।

রন হ্যারির কপালের দিকে ইঙ্গিত করে বলল।

হ্যারি, এখানেই কি ইউ-নো-হুর…।

হা হ্যারি জবাব দিল–কিন্তু আমার কিছু মনে নেই।

তোমার কি কিছুই মনে নেই? রন আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল।

তীব্র সবুজ আলোর কথা আমার মনে পড়ে। এর বাইরে কিছুই মনে করতে পারি না। হ্যারি জবাব দিল।

ওহ। এই বলে রন বসে পড়ল ও হ্যারিকে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণের জন্য। তারপর সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।

তোমাদের পরিবারের সবাই কি জাদুকর? হ্যারি রনকে প্রশ্ন করল। রনকে হ্যারির খুব ভাল লেগেছে।

রন জবাব দিল–আমার তাই মনে হয়। মায়ের এক দূরসম্পৰ্কীয় ভাই আছেন যিনি হিসাবরক্ষক। আমরা তাকে নিয়ে খুব একটা আলোচনা করি না।

তাহলে তুমি অনেক জাদু জানো। হ্যারি মন্তব্য করল।

ওয়েসলি পরিবার পুরনো জাদুকর পরিবারের অন্যতম। ডায়াগন এলির সেই ছেলেটি এ ধরনের মন্তব্য করেছিল।

আমি শুনলাম তুমি মাগলদের সাথে থাকতে গিয়েছিলে। তারা কেমন? রন হ্যারিকে প্রশ্ন করল।

খুবই খারাপ। তবে তাদের সবাই নয়। হ্যারি জবাব দিল। মাগল চেনার জন্য আমার চাচা, চাচী ও চাচাতো ভাইই যথেষ্ট। আমার যদি তিনজন জাদুকর ভাই থাকত।

পাঁচ–রন বলল। যেকোন কারণেই হোক রনকে একটু মনমরা দেখাচ্ছিল। রন বলে চলল–আমাদের পরিবারে আমি ষষ্ঠ ব্যক্তি যে হোগার্টসে যাচ্ছি। তুমি হয়তো বলতে পার বিল আর চার্লি যা রেখে গেছে তার অনেক কিছুই আমি পেয়েছি। বিল ছিল হেডবয়, আর চার্লি কিডিচ দলের অধিনায়ক। এখন পার্সি একজন প্রিফেক্ট। ফ্রেড আর জর্জ অনেক হইচই করে বেড়ায়। তবুও তারা ভালো নম্বর পায়। সবাই মনে করে তারা খুব মজার। প্রত্যেকেরই প্রত্যাশা আমিও তাদের মত ভালো করব। আমি যদি ভালো করি তাতেও আমার কোন কৃতিত্ব থাকবে না। কারণ এ রকম ফলাফল ওরা সবাই আগে করে গেছে। যার পাঁচ ভাই আছে সে কখনো নতুন কিছু পায় না। আমি বিলের কাছ থেকে তার পুরনো পোশাক, চার্লির কাছ থেকে জাদুদণ্ড এবং পার্সির কাছ থেকে পুরনো ইঁদুর পেয়েছি।

রন তার জ্যাকেটের ভেতর হাত দিয়ে একটা মোটা ধূসর রঙের ইঁদুর বের করল। ইঁদুরটা তখন ঘুমোচ্ছিল। এর নাম স্ক্যাবাস। এটা কোন কাজের নয়। কখনও ঘুম থেকে ওঠে না। পার্সি প্রিফেক্ট হওয়ার পর আমার বাবার কাছ থেকে এক পেঁচা পেয়েছিল। আর আমি পেলাম এই স্কাবার্সকে। রনের কান গোলাপী বর্ণ ধারণ করল। তার মনে হল সে অনেক বেশি কথা বলছে। তাই সে আবার জানালার বাইরে তাকাল। কারো কাছে যদি একটি পেঁচা না থাকে তাহলে তাকে দুঃখিত হতে হবে এমন কোন কথা নেই–হ্যারির কাছে তাই মনে হলো। একমাস আগেও হ্যারির কাছে কোন টাকা পয়সা ছিল না। হ্যারি রনকে জানাল যে তাকে সব সময় ডাডলির পুরনো কাপড় পরতে হয়েছে এবং জন্মদিনে সে কখনো কোন উপহার পায়নি।

হ্যারির কথা শুনে রন খুশি হয়ে উঠল।

হ্যারি রনকে আরও বলল–হ্যাগ্রিডের সাথে সাক্ষাতের আগে বুঝতে পারিনি যে আমাকে জাদুকর হতে হবে। তার সাথে সাক্ষাতের আগে আমি আমার বাবা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।

রন একটি দীর্ঘশ্বাস নিল।

কি ব্যাপার? হ্যারি প্রশ্ন করল।

তুমি ইউ-নো-হু-এর নাম বললে। আমিও ভেবেছিলাম তোমরা সবাই… রন বলল। তাকে একই সাথে অভিভূত আবার দুঃখিতও মনে হচ্ছিল।

আমি তার নাম উল্লেখ করে বাহাদুরি দেখাতে চাইনি।

হ্যারি বলল আমি মনে করি আমি যে শব্দগুলো উচ্চারণ করেছি সেগুলো তোমার না জানাই ভালো। আমাকে এখনও অনেক কিছু শিখতে হবে। আমার মনে হয় আমি ক্লাশের সবচেয়ে খারাপ ছাত্র হবো?

না, তুমি তা হবে না। রন বলল-এখানে অনেকেই মাগল পরিবার থেকে আসে। তারা অল্প সময়েই সব শিখে ফেলে।

তারা যখন কথা বলছিল ঠিক তখনই ট্রেনটি লন্ডন শহরের বাইরে চলে গেল। তারা জানালা দিয়ে মাঠে গরু–ছাগল–ভেড়া দেখতে লাগল।

ঠিক সাড়ে বারোটার সময় তারা ট্রেনের করিডোর থেকে কথাবার্তা ও হাসির শব্দ শুনতে পেল। তাদের কামরার দরোজা খুলে এক ভদ্রমহিলা এসে হাসি মুখে তার টেনে আনা খাবারের ট্রলির দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–তোমাদের কারো কোন খাবার লাগবে?

হ্যারি সকালে নাশতা করতে পারেনি। তাই সে উঠে দাঁড়ালো। রন বলল তাকে বাইরে যেতে হবে না। তার কাছেই স্যান্ডউইচ আছে।

হ্যারি যখন ডার্সলি পরিবারের সাথে থাকত তখন তার কাছে কোন টাকা–পয়সা থাকত না। অবশ্য এখন তার পকেট গরম। তার পকেট ভর্তি সোনা ও রূপার মুদ্রা। মহিলাটির ট্রলিতে সব আজব ধরনের খাবার, যা সে জীবনে দেখেনি। সে কোনটাই হারাতে চাইলো না, সবকিছুই অল্প অল্প করে কিনলো এবং মহিলাকে এগারটি সিলভার সিকেল ও সাতটি ব্রোঞ্জ নাটস দিল।

হ্যারি অনেক খাবার দাবার এনে খালি আসনে রাখল।

রন জিজ্ঞেস করল–তোমার কি খুব খিদে পেয়েছে? কুমড়োর একটি প্যাস্ট্রি মুখে দিতে দিতে হ্যারি বলল–হ্যাঁ আমার খিদে পেয়েছে।

রন প্যাকেট খুলে চারটি স্যান্ডউইচ বের করল। হ্যারিকে বলল, তুমি এখান থেকে কিছু নেবে? অবশ্য স্যান্ডউইচগুলো শুকনো। বুঝতেই পারছো। আমরা পাঁচ ভাই, মা খুব একটা সময় পায় না।

হ্যারি তার প্যাস্ট্রি রনের সামনে রেখে বলল নাও, এখান থেকে নাও। এ পর্যন্ত ভাগাভাগি করে খাবার সুযোগ হ্যারির হয়নি। রনের সাথে ভাগাভাগি করে খাওয়াতে হ্যারির মনে এক আনন্দময় অনুভূতির সৃষ্টি হলো। রনের সাথে হ্যারি প্যাস্ট্রি ও কেক খেল। স্যান্ডউইচের কথা তারা একেবারেই ভুলে গেল।

চকোলেট ফ্রগের একটি প্যাকেট বের করে হ্যারি রনকে জিজ্ঞেস করল-এটা কী?

হ্যারি বলে চলল-এগুলি নিশ্চয়ই ব্যাঙ নয়।

হ্যারি যেকোন বিস্ময়ের জন্য প্রস্তুত ছিল।

না ব্যাঙ নয়। রন জবাব দিল। দেখো সাথে একটি কার্ড আছে।

কি? হ্যারি প্রশ্ন করল।

তুমি জানো না। রন বল–চকোলেট ফ্রগের ভেতর কার্ড থাকে। এসব কার্ডে বিখ্যাত জাদুকর ও জাদুকরণীদের ছবি থাকে। আমি এ পর্যন্ত পাঁচশ কার্ড সংগ্রহ করেছি, কিন্তু কোনো কার্ডেই এগ্রিপা বা টলেমির ছবি পাইনি।

হ্যারি তার চকোলেট ফ্রগের প্যাকেটটি খুলল। কার্ডে একজন মানুষের ছবি। তার চোখে অর্ধচন্দ্রাকার চশমা। লম্বা বাঁকা নাক। রূপালী চুল, দাঁড়ি ও গোঁফ। ছবির নিচে লেখা

আলবাস ডাম্বলডোর

রন বলল, আমি একটা ফ্রগ চকোলেট নেই, দেখি এগ্রিপা বা টলেমির ছবি পাই কিনা।

হ্যারি পড়তে লাগলো…

আলবাস ডাম্বলডোর হোগার্টস-এর বৰ্তমান অধ্যক্ষ, যাকে বিবেচনা করা হয় এ যুগের শ্রেষ্ঠতম জাদুকর হিসেবে। ১৯৪৫ সালে কালো যাদুকর গ্রিনডে ওয়াল্ডকে পরাজিত করেই ডাম্বলডোর বিখ্যাত হন; ড্রাগন রক্তের ১২টি ব্যবহার উদ্ভব ও সহকর্মী নিকোলাস ফ্লামেলের সাথে আলকেমির উপর কাজ করাও তার অন্যতম কীর্তি। প্রফেসর ডাম্বলডোর উপভোগ করেন চেম্বার মিউজিক ও টেনপিন বোলিং।

হ্যারি এবার কার্ডটি উল্টাল। এবার তাকিয়ে দেখে কার্ডে ডাম্বলডোরের কোন ছবিই নেই।

কই, তিনি তো নেই। হ্যারি অবাক বিস্ময়ে মন্তব্য করল।

তুমি তো আশা করতে পার না তিনি সারাক্ষণ কার্ডের সাথে লেগে থাকবেন। রন বলল–তিনি আবার আসবেন। আমি আবার মর্গানাকে পেয়েছি।… তার ছটা ছবি পেয়েছি।

তুমি কি কার্ড জমাতে চাও?

রনের দৃষ্টি চকোলেট ফ্রগের প্যাকেটগুলোর দিকে।

না–ও না–ও হ্যারি বলল, তুমি তো জান, মাগল জগতে ছবির ভেতর মানুষ স্থায়ীভাবে থাকে।

সত্যিই কি তারা তাই করে? তারা কি একটুও নড়াচড়া করে না। রন আশ্চর্য হয়ে মন্তব্য করল–সত্যিই কী অদ্ভুত!

হ্যারি দেখল যে ডাম্বলডোরের ছবি পুনরায় কার্ডে চলে এসেছে এবং তিনি হ্যারির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। বিখ্যাত জাদুকরদের ছবির চেয়ে রন-এর মনোযোগ ছিল খাবারের দিকে। একটু পর হ্যারি কার্ডে শুধু ডাম্বলডোরই নয়–আরো বিখ্যাত জাদুকরদের ছবি দেখল। এরপর হ্যারি বেরটি বোটস-এর বিচিত্র গন্ধের মটরশুটির প্যাকেট খুললো। এ সব বিষয়ে তোমাকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রন হ্যারিকে সাবধান করে বলল। যখন তারা বলে সকল প্রকার গন্ধ, তার মানে সকল প্রকার গন্ধ–তুমি জান, চকোলেট, পিপারমেন্ট এবং মার্মালেড-এর মত সাধারণ জিনিসে যা পাও, আবার তুমি পালং শাক, কলিজা বা ষাড়ের ভুঁড়ির গন্ধ।

রন একটি সবুজ মটরদানা হাতে নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করল এবং মটরদানায় কামড় বসাল।

তারা বেশ মজা করে খাচ্ছিল। হ্যারি টোস্ট, নারকেল, সেকা মটরশুটি, স্ট্রবেরি, তরকারি, ঘাস, কফি ও সার্দিন খেল। এবং সাহস করে একটি ধূসর রঙের খাবারে এক কামড় দিল যা রন কখনো করবে না, ওটা আসলে ছিল মরিচ।

এবার তারা জানালা দিয়ে দেখল, খেত–খামার নয়, ট্রেনটি বন, আঁকাবাঁকা নদী ও ঘন সবুজ পাহাড় অতিক্রম করছে। তাদের কম্পার্টমেন্টের দরজায় টোকা দেয়ার শব্দ পেল এবং দরজা টেনে গোলমুখ ছেলেটি ভেতরে ঢুকলো, ওকে হ্যারি পৌনে দশ প্লাটফর্মে দেখেছিল। কাঁদো কাঁদো মুখ তার। বলল, তোমরা কি একটি ব্যাঙ দেখেছো? তারা যখন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না। সে কেঁদে ফেলো, আমি ওটা হারিয়ে ফেলেছি। হ্যারি তাকে সান্ত্বনা দিল–পেয়ে যাবে। ঘাবড়িওনা।

যাহোক, যদি দেখতে পাও, আমাকে জানিও বলে ছেলেটি চলে গেল। একটু পর আবার সে ফিরে এল। এবার সাথে একটি মেয়ে। তার গায়ে হোগার্টসের ইউনিফর্ম। তোমরা কি কেউ একটা ব্যাঙ দেখেছো, নেভিল হারিয়েছে। মেয়েটি বলল।

আমরা আগেই ওকে জানিয়েছি–আমরা দেখিনি। রন বলল। রনের হাতে জাদুদণ্ড।

একি, তুমি কি ম্যাজিক দেখাবে? রনের হাতে জাদুকাঠি দেখে মেয়েটি বলল।

দেখি কি ম্যাজিক করছো, বলে মেয়েটি বসে পড়লো।

রন একটু ভয়ই পেয়ে গেল, তারপর বলল, ঠিক আছে। কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে শুরু করলো সানসাইন, ডেইসিস, বাটার মেলো টান দিস স্টুপিড, ফ্যাট র‍্যাট ইয়েলো। বলে সে জাদুকাঠিটি ঘুরালো। কিন্তু কিছুই হলো না। ইঁদুরটা ধুসরই থেকে গেল এবং ওটা তখনও ঘুমাচ্ছিল।

আমি রন ওয়েসলি। রন মৃদুস্বরে বলল।

আমি হ্যারি পটার। হ্যারি বলল।

তুমি কি সত্যিই হ্যারি পটার? অবাক হয়ে হারমিওন প্রশ্ন করল। তারপর হারমিওন বলে চলল–আমি তোমার সবকিছুই জানি। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও আমি কিছু বই পাই। মডার্ন ম্যাজিকাল হিস্ট্রি, দি রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দি ডার্ক আর্টস এবং গ্রেট উইজার্ডিং ইভেন্টস অফ দি টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি বইগুলোতে তোমার নাম উল্লেখ আছে।

সত্যিই? বিস্ময়ের সাথে হ্যারি প্রশ্ন করে।

আশ্চর্য, তুমি কিছুই জান না। হারমিওন বলল–আমি যদি তোমার জায়গায় হতাম তাহলে আমি সবকিছু খুঁজে বের করে ফেলতাম। আচ্ছা, তোমরা কি কেউ জানো তোমরা কোন হাউজে থাকবে? আমি গ্রিফিল্ডর হাউজে থাকতে চাই। আমার মনে হচ্ছে ওটা ভাল হবে। আজ আমি যাচ্ছি। নেভিলের ব্যাঙ খুঁজতে হবে। আর তোমরা জামা–কাপড় পালটে নাও আমরা শিগগিরই পৌঁছে যাব।

যে ছেলেটি ব্যাঙের খোঁজে এসেছিল তাকে নিয়ে হারমিওন বিদায় নিল।

আমি যে হাউজে থাকি না কেন আমি চাই যেন এই মেয়েটি সেখানে না থাকে। একথা বলে রন তার জাদুদণ্ড ট্রাংকে ভরল।

তোমার অন্য ভাইরা কোন হাউজে আছে? হ্যারি জানতে চাইল। গ্রিফিল্ডর হাউজ। রন জবাব দিল। রনের চেহারা একটু বিবর্ণ হলো। তবুও সে বলে চলল–বাবা ও মা এই হাউজে ছিলেন। আমি যদি এই হাউজে থাকতে না পারি তাহলে বাবা–মা কী ভাববেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। হাউজ হিসেবে ব্যাভেনক্লও খারাপ নয়। কিন্তু ভেবে দেখ, তারা যদি আমাকে স্লিদারিন হাউজে রেখে দেয়।

এই হাউজেই… ইউ নো হু ছিল।

হ্যারি ভাবছিল স্কুল ত্যাগ করার পর জাদুকররা কী করে।

রন জানাল–ড্রাগনশাস্ত্রে অধ্যয়নের জন্য চার্লি রোমানিয়া গিয়েছে এবং গ্রিংগটসের প্রস্তুতি নেবার জন্য বিল আফ্রিকায় গেছে। তুমি কি গ্রিংগটসের নাম শুনেছ? ডেইলি প্রফেটে এর ওপর অনেক লেখালেখি হয়েছে। মাগলদের কাছে সে পত্রিকাটা পাবে না। কেউ একবার ভল্ট ভেঙ্গে ডাকাতির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি।

হ্যারি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

সত্যিই? এরপর কি ঘটেছিল?

কিছুই নয়, এই জন্যই তো বড় খবর হয়েছিল সেই ঘটনা। রন বলল–আমার বাবার ধারণা ওটা ছিল কোন কালো জাদুকরের কাজ। কিন্তু ওরা মনে করে না যে, কেউ সেখান থেকে কিছু নিয়ে যেতে পেরেছে। এগুলো খুবই খারাপ জিনিস। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সকলেই শঙ্কিত হয় এবং এর সাথে যদি ইউ নো হু-এর হাত পেছনে থাকে, তা হলে তো কথাই নেই। যদিও সে জেনেছে এসব জাদু জীবনের বিষয়। কিন্তু ভোলডেমর্ট নামটি তেমন তাকে অস্বস্তিতে ফেলে না বা তাকে ভয় পাইয়ে দেয় না।

কিডিচ খেলা সম্পর্কে তোমার কি কোন ধারণা আছে? রন হ্যারিকে প্রশ্ন করে।

এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই নেই। হ্যারি জবাব দিল।

তুমি কি বললে নাম শোননি? বিস্ময়ের সাথে রন প্রশ্ন করে-এটা তো পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলা।

তারপর রন কিডিচ খেলার বিভিন্ন নিয়মকানুন সম্পর্কে হ্যারিকে বলল। তারা যখন গল্প করছিল তখন তাদের কামরার দরোজা খুলে গেল। এবার কামরায় ব্যাঙ হারানো ছেলে নেভিল নয়, হারমিওন গ্রেঞ্জার। তিনটি বালক তাদের কামরায় প্রবেশ করল। হ্যারি মাঝখানে বিষণ্ন মুখের বালকটিকে মুহূর্তেই চিনতে পারল। তাকে মাদাম মালকিনের পোশাকের দোকানে দেখেছিল। ডায়াগন এলির চেয়ে এখন বেশি আগ্রহ নিয়ে সে হ্যারির দিকে তাকিয়ে রইল।

এটা কি সত্য? ছেলেটি বলল–সবাই বলাবলি করছিল এই কামরায় হ্যারি পটার আছে। তাহলে তুমিই সেই হ্যারি পটার?

হ্যাঁ হ্যারি জবাব দিল। হ্যারি অন্য দুই ছেলের দিকে তাকাল। তারা দুজনেই খুব মোটা ও তাদের দুজনকেই সংকীর্ণ মনা মনে হলো। তারা দুজনেই বিষণ্ন মুখের বালকটির দুপাশে এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল, যেন তারা ওর বডিগার্ড।

এরা দুজন হলো ক্ৰেব ও গয়েল। বিষণ্ণ মুখের ছেলেটি বলল আমার নাম ম্যালফয়–ড্রেকো ম্যালফয়।

রন কাশি দিল। ড্রেকো ম্যালফয় তার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমার নামটি কি কৌতুককর মনে হয়। তুমি কে সেটা জিজ্ঞাসা করার কোন প্রয়োজন নেই। আমার বাবা আমাকে বলেছেন ওয়েসলি পরিবারের সদস্যদের মাথার চুল লাল এবং তাদের পরিবারে অনেক বেশি ছেলেমেয়ে।

সে হ্যারির দিকে দৃষ্টি ফেরাল।

পটার, তুমি অল্পদিনেই বুঝতে পারবে যে কিছু জাদুকর পরিবার অন্য পরিবার থেকে ভালো। তুমি খারাপ লোকের সাথে বন্ধুত্ব করবে না। আমি তোমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি।

হ্যারির সাথে করমর্দনের জন্য সে তার হাত বাড়িয়ে দিল, কিন্তু হ্যারি সাড়া দিল না।

ধন্যবাদ, কে ভালো কে মন্দ সেটা আমিই বলতে পারব। শীতলভাবে সে কথাগুলি বলল।

ড্রেকো ম্যালফয়ের চেহারা লাল না হলেও তার চেহারায় একটা গোলাপী আভা দেখা গেল।

আমি যদি তুমি হতাম তাহলে আমি আরো সতর্ক থাকতাম। সে আস্তে আস্তে বলল–তুমি যদি আর একটু নম্র না হও তাহলে তোমাকেও তোমার বাবা–মার পথে যেতে হবে। তারা বুঝতে পারেনি কোন জিনিসটি তাদের জন্য কল্যাণকর ছিল। তুমি যদি ওয়েসলির মত মাস্তান আর হ্যাগ্রিডের সাথে মেলামেশা কর, তাহলে তোমার ভবিষ্যৎ খুব একটা ভালো যাবে না।

হ্যারি এবং রন দুজনেই দাঁড়াল। ওয়েসলির চেহারা তার চুলের মত লাল হয়ে উঠল।

রন বলল–কথাটা আবার বলতো।

তোমরা কি আমাদের সাথে মারামারি করতে চাও? ম্যালফয় ধমকের সুরে বলল।

যদি তোমরা এক্ষুণি এখান থেকে বিদেয় না হও। হ্যারি খুব কড়াভাবে বলল। একটু বেশি কড়াভাবেই। কারণ ওর সাথে অপর দুজন ক্রেবে আর গয়েল ওদের উডয়ের চেয়ে গায়ে–গতরে বড়সড় ছিল।

আমাদের এখান থেকে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমাদের খাবার সব শেষ হয়ে গেছে এবং মনে হচ্ছে তোমাদের কাছে এখনও কিছু খাবার আছে।

রনের কাছে রাখা চকোলেট ফ্রগের দিকে গয়েল এগুল। রন লাফ দিয়ে আগে বাড়ল। গয়েলকে স্পর্শ করার আগেই বিকট শব্দ করে গয়েল আর্তনাদ করে উঠল।

স্ক্যাবার্স, রনের ইঁদুরটি তার আঙুলের ডগায় ঝুলছিল। ইঁদুরটি তার ছোট ধারাল দাঁত গয়েলের আঙুলে বসিয়ে দিয়েছে। ক্রেবে আর ম্যালফয় পেছনে সরে দাঁড়াল। স্কাবার্সের কামড়ে গয়েল হাউ–মাউ করছিল। গয়েল ইঁদুরটাকে ছুঁড়ে ফেলার জন্য হাত মুরাতে লাগলো। এক সময় ইঁদুরটা ছুটে গিয়ে জানালায় আঘাত করলো। এরপর তারা তিনজনই ছুটে পালালো। হতে পারে তারা ভেবেছিল ঘরে বোধহয় আরো অনেক ইঁদুর আছে। পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে ঘটনার এক সেকেন্ড পরই হারমিওন গ্রেঞ্জার কামরায় প্রবেশ করল।

এখানে এতক্ষণ কী ঘটলো? মেঝেতে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মিষ্টি দেখে হারমিওন প্রশ্ন করল। রন লেজ ধরে টেনে স্ক্যাবার্সকে হাতে তুলে নিল।

আমার মনে হচ্ছে সে আঘাত পেয়েছে। রন হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল। সে স্ক্যাবার্সের দিকে তাকাল। তারপর বলল–না, না–আমার বিশ্বাস হয় না… সে বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।

আসলে সে ঘুমিয়েই পড়েছিল।

তোমার সাথে ম্যালফয়ের এর আগে কখনও দেখা হয়েছে?

হ্যারি তাকে বলল, ডায়গন এ্যালিতে তাদের দেখা হওয়ার বিষয়।

আমি এই পরিবারের কথা শুনেছি। রন খুব গুরুগম্ভীর ভাবে বলল। ইউ-নো-হু অদৃশ্য হয়ে যাবার পর যারা আমাদের সাথে প্রথমে এসেছিলেন ওর মধ্যে ওরাও ছিল। ওরা বলেছিল ওদের ওপর জাদু করা হয়েছিল। আমার বাবা অবশ্য এ গল্প বিশ্বাস করেন না। কালো জাদুর দিকে যেতে ম্যালফয়ের বাবার অজুহাত বের করতে কোন রকম অসুবিধে হয় না।

রন হারমিওনের দিকে তাকিয়ে বলল–আমরা কি কোনভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি।

তোমাদের উচিত তাড়াতাড়ি পোশাক পরে নেয়া। আমি ট্রেনের চালককে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন–আমরা গন্তব্যে এসে গেছি প্রায়। তোমরা তো মারামারি করছিলে এখানে, করছিলে কিনা? আমাদের সবার নামার আগে তোমরা যদি সেখানে নাম, তোমাদের বিপদ হতে পারে।

রন জবাব দিল–স্ক্যাবার্স মারামারি করেছে। আমরা করিনি। আমরা এখন পোশাক পরিবর্তন করব। তুমি কি একটু বাইরে যাবে?

হারমিওন বলল–ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। আমি এখানে এসেছি, কারণ ছোট ছেলেমেয়েদের মত এখানকার লোকজন করিডোরে দৌড়াদৌড়ি করছে। আর তুমি কি জানো তোমার নাকে ময়লা লেগেছে।

রন হারমিওনের যাবার দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যারি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরে অন্ধকার হয়ে আসছে। মেঘলা আকাশের নিচে পাহাড় ও বন দেখা যাচ্ছে। মনে হলো ট্রেনের গতি কমে আসছে।

হ্যারি ও রন তাদের জ্যাকেট খুলে হোগার্টসের জন্য কালো পোশাক পরে নিল।

ট্রেন থেকে একটি ঘোষণা এলো–আমরা পাঁচ মিনিটের ভেতর হোগার্টস পৌঁছব। তোমাদের মালামাল ট্রেনেই রেখে দিও! মালামালগুলি পৃথকভাবে হোগার্টস স্কুলে পাঠানো হবে।

ট্রেনের গতি কমল। এক সময় ট্রেন থামল। নামার জন্য সবাই দরোজায় ভিড় করছে। প্ল্যাটফর্মে বেশ ঠাণ্ডা। হ্যারি হঠাৎ একটি পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেল প্রথম বর্ষের ছাত্র যারা তারা ডানদিকে এসো। হ্যারিও এদিকে এসো। এটা ছিল হ্যাগ্রিডের কণ্ঠস্বর।

হ্যাগ্রিড বললেন–যারা প্রথম বর্ষের ছাত্র তারা আমাকে অনুসরণ কর প্রথম বর্ষের আরও কেউ আছে? সাবধানে পা ফেলো। আমাকে অনুসরণ করো।

পা পিছলিয়ে ও হোঁচট খেতে খেতে তারা হ্যাগ্রিডকে অনুসরণ করে খাড়া ও সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে আগে বাড়ল। দুপাশেই এত অন্ধকার ছিল যে হ্যারি ভাবল এখানে সারি সারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। যাবার পথে কেউ তেমন কোন কথা বলল না। হ্যাগ্রিড বললেন–তোমরা সবাই প্রথম বারের মতো হোগার্টস জাদুবিদ্যায় স্কুলে এসেছে।

হঠাৎ জোরে উ–উ–উ–ধ্বনি শোনা গেল।

সংকীর্ণ পথটি যেখানে গিয়ে থামল সেখানে সামনে একটি বড় লেক।

লেকের দুপাশে পাহাড়। আকাশে তারা। কাছাকাছি কয়েকটি দুর্গ আছে বলে মনে হলো।

হ্যাগ্রিড এক সারি নৌকা দেখিয়ে বললেন একটা নৌকায় চারজনের বেশি উঠবে না।

সবাই ঠিকমতো উঠল কিনা হ্যাগ্রিড তা ভাল করে দেখে নিলেন।

অনেকগুলো ছোট ছোট নৌকা এগিয়ে যেতে থাকল। লেকের পানি স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ। সবাই চুপ করে আছে। নৌকাগুলো দুর্গের কাছাকাছি এল।

হ্যাগ্রিড চিৎকার করে বলল–তোমরা সবাই মাথা নিচু কর।

তারপর একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গ। মনে হলো দুর্গের নিচ দিয়ে নৌকা চলছে।

শেষ পর্যন্ত মাটির নিচে বন্দরের মত একটা স্থানে পৌঁছালো। সম্পূর্ণ জায়গাটাতে নুড়ি–পাথর ছড়ানো।

সবাই নৌকা থেকে নামছে কিনা হ্যাগ্রিড দাঁড়িয়ে দেখছিলো। নেভিলকে দেখে হ্যাগ্রিড জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি তোমার ব্যাঙ? নেভিল ব্যাঙটা দেখে আনন্দে বলে উঠলো, ট্রেভর! ট্রেভর তার ব্যাঙটির নাম।

পাথরের সিঁড়ি বেয়ে তারা ওপরে উঠতে থাকলো। পাথুরে সিঁড়ির শেষ প্রান্তে ওক গাছের দরোজা। হ্যাগ্রিড বললেন, সবাই ঠিকমত এসেছে, আর তুমি তোমার ব্যাঙ পেয়েছ। তিনি তার বিশাল মুষ্টি দিয়ে দরজায় তিনবার আঘাত করলেন।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত