বাসের পাশের সিটে বসা ঘুমন্ত মেয়েটার হাতের মধ্যে থাকা পার্টসের চেইন খোলা।ভেতরে চকচকে বেশকিছু হাজার টাকার নোট আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।ভালোবেসে ফেলেছি,তাই চোখ সরাতে পারছিনা টাকাগুলোর উপর থেকে।ভালোবাসার জিনিসকে কীভাবে আপন করে নিতে পারব,সেটাই ভাবছি গভীর মনে।
মেয়েটা ঘুমে।সত্যিই ঘুমে??রাত তিনটা বাজে।সকলেই তো ঘুমাচ্ছে।আমারও ঘুম পাচ্ছে।তারমানে মেয়েটার ঘুমে থাকা অস্বাভাবিক নয়।কিন্ত এতগুলো টাকার নিরাপত্তাকে অবহেলা করে কেউ এভাবে ঘুমিয়ে যেতে পারে?সন্দেহ হচ্ছে!যদি ঘুমের ভান করে সে চোর ধরার পরিকল্পনা করে? ২০১১ সালে এভাবেই একজনের টাকা মারতে গিয়ে গণধোলাই খেয়েছিলাম।সেই থেকে অনেকদিন যদিও চুরি করা ছেড়ে দিয়েছি তবুও চুরিবিদ্যা একেবারেই ভুলে যাইনি।মেয়েটা সত্যিই ঘুমে থাকলে তার হাতের টাকাগুলো মারতে পারব,সন্দেহ নেই।কিন্তু যদি সত্যিই অর্ঘুমা থাকে???
মেয়েটার ঘুমের গভীরতা পরখ করার জন্য মশা মারার ছলে নিজের হাতের তালুদুটো মিলিয়ে ঠুসঠাস হাততালির শব্দ করলাম দু/তিনবার।আরে বাহ!!!কেঁচো খুঁড়তে কেউটে!!!হাততালির শব্দ শুনে ঝিমানো মেয়েটার হাত থেকে পার্টসখানা পড়েই গেল নিচে।এইবার আর কে ঠেকায়???দেরি না করে একপলক চতুর্দিকের ঘুমন্ত পরিবেশ অবলোকন করে চট করেই পার্টসখানা নিজের কাঁধব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম।
ঢাকা থেকে আসার সময় ধার-হাওলাত করে আবির,আরমান আর ফাহাদ থেকে মোটামুটি দু’হাজার টাকা এনেছিলাম।আনুমানিক হিসেব করে দেখলাম চুরি করা পার্টসে কমসে কম হাজার ছয়-সাতেক টাকা থাকবেই।আহ!তাহলে ধার শোধ করে আরো মোটামুটি চার/পাঁচ হাজার টাকা পাচ্ছি।গুড।একটা আর একটা/দুইটা পকেট মারতে পারলেই একটা সাইকেল কেনার টাকা হয়ে যাবে।চারপাশের সকলের দিকে আরো একবার তাকিয়ে আর কিছু অবহেলিত পার্টস-মানিব্যাগ আবিষ্কার করতে পারি কিনা দেখলাম।নাহ!সুযোগ নেই।দেশে চোরের উৎপাত যে হারে বাড়ছে তা থেকে সকলেই সচেতন হয়ে যাচ্ছে।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কখন জানি না।ভোরে একটা চিৎকার শুনে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল,”আমার টাকা!আমার টাকা!আমার পার্টস!” থতমত খেয়ে চোখ মুছে বললাম,”কী হয়েছে? কী হয়েছে?চ্যাঁচাচ্ছেন কেন?” “আমার টাকার ব্যাগ চুরি হয়ে গেছে।ভেতরে অনেক টাকা ছিল।আট হাজার টাকা!” চতুর্দিকের হা করে তাকিয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে একটু ভয় পেয়ে গেলাম।এগারো সালের গণধোলাইয়ের কথা ভুলিনি এখনো।তাড়াতাড়ি গলায় জোর দিয়ে বললাম,”কী বলছেন কী!ব্যাগ কোথায় রেখেছিলেন আপনি!” ” ব্যাগ তো আমার হাতেই ছিল,রাতে ঘুমাতে গিয়ে…..!” “এতগুলো টাকাভর্তি ব্যাগ কেউ হাতে রাখে?বোকা নাকি!”
বেশ কিছুক্ষণ হৈহুল্লোড়ের পর পরিবেশ মোটামুটি শান্ত হয়েছে।কিন্তু টাকার আফসোসে মেয়েটা তখনো থেকে থেকে মাথায় হাত দিচ্ছে।নিজেকে যথাসাধ্য সামাল দিয়ে আমিও একটু পরপর তাকে সমবেদনা জানাচ্ছি।একপর্যায়ে কাঁদোকাঁদো মেয়েটা আমাকে বলেই ফেলল,
-ভাইয়া,একটা কথা বলব?
-জ্বী বলুন!
-আমার কাছে আর একটা টাকাও নেই।
-ইস!আপনি কেন যে টাকাটা হাতে রেখেছিলেন!
-ভাইয়া,এখন আমাকে একটু হেল্প করুন না।আপনার প্রেমিকা হলে করতেন না? আর বাহ!সেই তো!মনে মনে লাফিয়ে উঠলাম।দেখি না কিছু হয়ে যেতে পারি কিনা!বললাম,
-জ্বী জ্বী বলুন,সমস্যা নেই।
-ভাইয়া,আসলে যেখানে যাচ্ছি,সেই বাড়িতে কেউ নেই।সবাই ঢাকায়।টাকাচুরির বিষয়টা আম্মু আব্বুকে বললে আমাকে শেষ করে ফেলবে।
সে কী বলতে চাইছে আমি বুঝে ফেললাম।বললাম,
-আসলে আমার কাছে তো খুব একটা বেশি পরিমাণে টাকা নেই।যা আছে,তাও বন্ধুদের থেকে ধার করে নেওয়া।কী যে বলব আপনাকে…..!
-প্লিজ ভাইয়া,মাত্র হাজার দুইয়েক টাকা আমাকে দিন না।আমি আপনাকে কদিনের মধ্যেই দিয়ে দেব।আপনার বিকাশ নম্বরটা দিন,আর আমার নম্বরটাও আপনি রাখুন।বিশ্বাস করুন,টাকাটা আমি দিয়ে দেব আপনাকে।
মেয়েটার করজোড়ে আবেদন।মোবাইল নম্বরও দিতে চায়।আমি মুহূর্তেই মনে মনে হিসেব কষে দেখলাম যদি দু’হাজার টাকা দিই,তাহলে আমার লাভ থাকছে ছয় হাজার টাকা।হাওলাত করা দু’হাজারও যদি আরমান আবিরকে শোধ করি তাও লাভ থেকে যাচ্ছে চার হাজার টাকা।মেয়েটা আবার ফেরতও দেবে বলছে,একান্তই না দিলেও আমার লস নেই।উপর্যুপরি তার মোবাইল নম্বরটাও পাচ্ছি।খারাপ না।
আমি তোতলাতে তোতলাতে একটু চালাকি করে বললাম,”আসলে দেখুন।আমার তো আছেই আড়াই হাজার মতো,তাও ধার করে নেওয়া।টাকাটা দিয়ে দিলে আমার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।”
-বিশ্বাস করুন।আমি আপনাকে ফেরত দিয়ে দেব।বিপদটা তো আপনার সামনেই ঘটেছে।একটু দয়া করুন না ভাইয়া।ধরে নিন আপনার গার্লফ্রেন্ড চেয়েছে,দিতেন না?
পরপর দুবার গার্লফ্রেন্ড শব্দটা উচ্চারণ করাতে টাকাটা না দিয়ে থাকতে পারলাম না।হাসিমুখ করে বললাম,”না না।আমার গার্লফ্রেন্ড নেই।আচ্ছা আপনি যেহেতু বিপদে পড়েছেন,আমি টাকাটা দিতে পারি,তবে যথাসময়ে টাকাটা না পেলে আমার ক্ষতি হয়ে যাবে।”
-আপনি নিশ্চিত থাকুন।টাকাটা আমি কদিনের মধ্যেই দিয়ে দেব আপনাকে।
একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে প্যান্টের ডান পকেট থেকে ধার করা দুহাজার টাকা মেয়েটাকে দিয়ে দিলাম।মেয়েটাও যথেষ্ট বিনয়ী হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে নিজের মোবাইল নম্বরটা আমাকে দিয়ে তাকে মিসকল দিতে বলল,যাতে করে আমার নম্বরটাও সে সেভ করে নিতে পারে।
জার্নি শেষের পথে।মেয়েটার সাথে টুকিটাকি দু/এক কথাও বললাম।জানলাম তার নাম অপরাজিতা।আমার মতো সেও ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে বেড়াতে যাচ্ছে।নিজের পরিচয়ও দিলাম তাকে।
কথা বলতে বলতে একসময় গন্তব্যস্থল এসে গেল।বিদায় সম্ভাষণ শেষ করে যে যার পথে পা বাড়ালাম।খুশি মনে নাচতে নাচতে আর লাভের হিসেব করতে করতে আমার হঠাৎ মনে পড়ল পকেটে ভাংতি টাকা নেই।নোটও যা ছিল,মেয়েটাকে দিয়ে দিয়েছি।কাঁধের ব্যাগ হতে চুরি করা পার্টস হাতিয়ে নিয়ে একহাজার টাকার একটা নোট বের করে নিলাম ভাংতি করব বলে।
মেয়েটা রাতে হয়ত আমাকে কল দেবে,আস্তে আস্তে কথা হবে,প্রেম হবে।আজ তার পার্টস হাতিয়েছি,এরপর তার সব সম্পত্তি নিজের করব তাকে বউ বানিয়ে…লাল-নীল কল্পনা করতে করতে মনের হরষে দোকানে গিয়ে ঢুকলাম টাকা ভাঙাতে। টাকা হাতে নেওয়া মাত্রই দোকানি কী না দেখে ধমক দিল জোরে,আরে মিয়া!জাল টাকা দেন?আপনার সাহস তো কম না!এই ওনারে ধরেন সবাই….কে আছেন!”
চারপাশে মানুষ জড়ো হয়ে গেল মিনিটেই।আকাশ থেকে পরলাম আমি!মুহূর্তেই মাথা গরম হয়ে গেল।কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম,”কী বলছেন আপনি,পাগল নাকি?টাকা মারার ধান্দা করছেন!এক্ষুণি দেখাচ্ছি আপনাকে আমি কে!” রক্ত ওঠা মাথায় পকেট থেকে মোবাইলখানা বের করে চোখ লাল করে আত্মরক্ষার জন্য ভয় দেখিয়ে বললাম,”পুলিশের নম্বরটা যেন কত!”সঙ্গে সঙ্গেই মোবাইলে ম্যাসেজ এলো– “চোরে নিল আট হাজার, লাভ তবু দুই হাজার কেমনে কী,কন তো স্যার???টুকি!!!”
সমাপ্ত