রাতের খাবার সেরে বিস্কুটের টিনটা বগলদাবা করে ড্রয়িংরুমের দিকে এগোয় হৃদয়। শুরুতে বিথি খুব অবাক হতো। একটা মানুষ ভরপেট খেয়েও বিস্কুটের টিন নিয়ে বসে কীভাবে? এখন এটা সয়ে গেছে। ওদের বিয়ের বয়স বছর খানেক। এখনো ওরা ছাড় আর হারের তাল সামলাচ্ছে। হৃদয়ের কিছু অভ্যাস বিথির একদম সয় না। পাল্টানোর অনেক চেষ্টা করে শেষে হার মেনেছে । অার হৃদয়ও যে কিছু বিষয়ে ছাড় দিয়েছে বিথি তা মনে মনে মানে।
সংসার তো এমনই। বিয়ের গিট্টুটা একবার লাগুক না, তারপর শুধু ছাড় আর হারে মানিয়ে নেওয়া। কিন্তু তাই বলে হৃদয়ের এই ভারি বিচ্ছিরি স্বভাবটা কি বদলাবে না? রোজ রাতে খেয়ে-দেয়ে বিস্কুটের টিন নিয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে টিভির সামনে বসে যায়। রিমোট কন্ট্রোলের বাটন টিপবে, আর কুটকুট করে বিস্কুট খাবে। বিস্কুট মানে টোস্ট। এর মধ্যে যে কী মধু, তা সে-ই জানে! বিথি অবশ্য শুরুতে হৃদয়ের সঙ্গে বসে থেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু হৃদয় তখন অন্য মানুষ। শুধু কুটকুট আর কুটকুট। ওর দিকে তাকায়ই না! এখন বিথি ড্রয়িংরুমে উঁকিই দেয় না। খাওয়ার পর গোছগাছ সেরে শুয়ে পড়ে। আর হৃদয় একগাদা টোস্ট ধ্বংস না করে ওঠেই না! আজ হয়েছে কি, হৃদয়ের খুব প্রিয় তিনটা পদ রান্না করেছে বিথি। হৃদয়ের পছন্দমত খুব ঝাল দিয়ে মলা মাছ, অামড়া দিয়ে ইলিশ মাছ আর শুটকি ভর্তা। একটু যত্ন করেই রেঁধেছে বিথি। আর খেতে বসে যা করেছে, বেচারা হৃদয় তো বলেই বসল, ‘এত খাবার তুলে দিচ্ছো, মারতে চাও আমাকে! পেটে একদম জায়গা নেই।’
বিথির তখন ভারি মায়া হলো। চাপাচাপির ইতি টেনে ভাবল, যাক, আজ আর কুটকুট হবে না। ও মা, খাওয়া শেষে দুই ঢোঁক পানি গিলেই বিস্কুটের টিনটা নামাল! গোছগাছ সারার পর বিথির ভীষণ জেদ চেপে যায় আজ হেস্তনেস্ত একটা করেই ছাড়বে! হৃদয়কে গিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, তুমি কেমন মানুষ বলো তো?’ হৃদয় খিলখিল করে হাসে, ‘কেমন মানুষ?’‘এই না বললে পেটে জায়গা নেই, এখন আবার বিস্কুট খাচ্ছ কীভাবে?’ ‘আরে, বিস্কুট খাচ্ছি কোথায়? এটা তো টোস্ট!’ ‘টোস্ট কি বিস্কুট না?’ ‘আরে, টোস্ট তো টোস্টই। সে তুমি বুঝবে না।’ ‘আমার বোঝার দরকার নেই। আমি শুধু বুঝতে চাই, তুমি এটা ছাড়বে কি না, বলো?’ ‘আহা,রাগ করছো কেন? তোমার এত তাড়াতাড়ি রাগ উঠে যায়, স্বামী কিছু খেলে বউরা কত খুশি হয়। আর তুমি দেখছি রেগে আগুন!’ ‘তাই বলে ছাতামাথা খাবে? আর দেখারও তো একটা সৌন্দর্য আছে।’
হৃদয় হো হো করে হাসে। বলে, ‘বুঝতে পেরেছি। টোস্ট খাওয়ার সময় আমাকে ছোট্ট একটা বাবুর মতো লাগে।’ ‘সেটা হলেও নাহয় মেনে নিতাম।’ ‘তাহলে কেমন দেখায়, বলো?’ ‘তোমার এটা খাওয়া না, জাবর কাটা! কোনো মেয়ে তার স্বামীকে ওই বেশে দেখতে চায় না।’ হৃদয় এবার এত জোরে হাসে, যেন ঘরের দেয়াল সব ফাটিয়ে দেবে। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে সে বলে, ‘একটা গো-বেচারাকে তুমি অন্যভাবে দেখতে চাইছ কেন? সে তো জাবর কাটবেই।’ ‘তুমি যত তামাশাই করো না কেন, এই কুটকুট তোমাকে ছাড়তে হবে। তুমি যদি আমাকে সত্যিকারে ভালোবাসো, কাল থেকে আর এই ছাতামাথা খাবে না।’ ভালোবাসার দোহাইয়ে কাজ হলো। পরদিন রাতে খাওয়ার পর সত্যিই হৃদয় টোস্টের ডিব্বা আর নামাল না। সুবোধ বালকের মতো ড্রয়িংরুমে গিয়ে খানিকক্ষণ টিভির দূরনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বোতাম টিপে উঠে এল। দুদিন চলল এভাবে। অফিসেও চায়ের সঙ্গে টোস্ট খায় না হৃদয়।
অফিসের কলিগ তামান্না সেটা খেয়াল করে বলল, ‘আরে, হৃদয়, চায়ের সঙ্গেটোস্ট নেই যে!’হৃদয় বলে, ‘একটা জিনিস যত মজাই লাগুক না কেন,একসময় একঘেয়ে লাগে।’তামান্না মুখ টিপে হেসে বলে, ‘এ্যাঁ, এটা কীবলছেন! অাপনার মিসেসকে শিগগিরই সতর্ক করতে হবে। এক বছরেরই এই দশা!’ অন্যরা এ কথা শুনে হাসতে লাগল। হৃদয় মুখে শুকনো হাসি এঁটে বসে রইল। আরেক জুনিয়র মেনন ছোট ভাইয়ের মতো। সে হৃদয়ের টেবিলে ঢাউশ এক প্যাকেট টোস্ট রেখে বলল, ‘এটা কঠিন জিনিস, বস! ঘিয়ে ময়ান দিয়ে তৈরি!’ এদের ভাবটা এমন যেন রাতে বিথির সঙ্গে টোস্ট নিয়ে খুনসুটির কথা জেনে গেছে। এখন মওকা পেয়ে খোঁচাচ্ছে। খোকাবাবুর মতো গোস্সা করে বসে থাকে হৃদয় । ছুটির পর টেবিলে টোস্টের প্যাকেট ফেলে আসে হৃদয়। কেউ নিলে নিয়ে যাক।
রাস্তায় এসে মনটা কেমন উদাস হয়ে যায় হৃদয়ের। বিয়ের আগে যেমন মাঝে মাঝে একলা ঘুরে বেড়াত, আজ হঠাৎ সেভাবে ঘুরতে ইচ্ছা করে। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে বলে, ‘সিগারেট না, মদ না, অন্য কোনো নেশাও না—শুধু তো ওই টোস্টই।এটা বন্ধ না করলে কি তোমার চলত না, বিথি?’ একটু রাত করেই বাসায় ফেরে হৃদয়। আজ সাত পদের ব্যঞ্জন। কিন্তু মজা নেই। খাওয়া শেষে টিভি দেখতে বসে যায় হৃদয়। অবশ্যই বিস্কুটের টিন ছাড়া। একটু পরই বিথি এসে বসে হৃদয়ের পাশে। হাতে সেই বিস্কুটের টিন।
হৃদয় হেসে বলে, ‘কী, রঙ্গ করতে এসেছ?’ ‘না, তোমার জন্য এক টিন ভালোবাসা নিয়ে এসেছি।’ ‘মানে?’ ‘দুদিন ধরে তুমি কুটকুট করে বিস্কুট খাওনা অামারও ভাল্লাগে না, অাসলে ওই অাওয়াজ শোনার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে!’ হৃদয়ের দিকে করুণ চোখে তাকায় বিথি। বিস্কুটের টিনটা খুলে ধরে। একটা টোস্ট তুলে নিয়ে আগের মতো কুটকুট শুরু করে হৃদয়। বিথি পাশে বসে মুচকি মুচকি হাসে অার ভাবে, কিভাবে যে এই বিস্কুটপাগলার প্রেমে পড়লাম ।