কান্তার মরু

কান্তার মরু

বিসিআই হেডকোয়ার্টার, মতিঝিল, ঢাকা। ‘এটা একটা খাপছাড়া ব্লাইণ্ড মিশন, রানা, পুরোপুরি অফিশিয়ালও বলা যায় না।’ চুরুটে অগিড়বসংযোগ করে বললেন রাহাত খান। সুপরিসর কামরায় বিশাল ডেস্কটার পেছনে বসে তিনি। দপদপ করে লাফাচ্ছে কপালের শিরা। ‘খবর পেয়েছি, মোট তেইশটা মিসাইল আর নিউক্লিয়ার ওঅরহেড চুরি গেছে। ইথিওপিয়ায় রয়েছে এখন সেগুলো।’ ‘মিসাইলগুলো কাদের, স্যার?’ ‘এক কথায় বলতে গেলে সবার। আমেরিকা, রাশিয়া, মিশর, ইসরাইল, সিরিয়া এমনকি ইরাকেরও। সবচেয়ে মারাত্মক কথা, এ দেশগুলো একে অন্যকে সন্দেহ করছে। আমেরিকা মনে করছে রাশিয়া কিংবা লিবিয়া তার মিসাইল চুরি করেছে, রাশিয়া মনে করছে আমেরিকা। ইসরাইল মনে করছে মিশর আর মিশর ভাবছে ইসরাইল। ইরাক সন্দেহ করছে আমেরিকাকে। ‘মিশর ছোট থেকে মাঝারি পাল্লার পাঁচটা মিসাইল খুইয়েছে। ইসরাইল থেকে চুরি গেছে এমনি আরও ছ’টা। আমরা জানি, এরা কেউই কারও জিনিস চুরি করেনি, অথচ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে এদের দেরি হবে না। এবং খুব শিগ্গিরিই ঘটবে সেটা।’ ‘স্যার, চুরিটা কারা করল?’ রানা বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল। ‘মালদিনি। রবার্তো মালদিনি। দুর্দান্ত প্রকৃতির এক অর্ধোন্মাদ। বহুদিন ধরে ওর ওপর নজর রাখছি আমরা। মিসাইলগুলো এখন ওর হাতে আছে। তার  সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরেক নিও- ফ্যাসিস্ট – ব্রুনো কন্টি। ম্যাকলিন নামে নিজেকে পরিচয় দেয় সে ইদানীং। দুজনই ড্রাগের সঙ্গেও জড়িত। সরাসরি কিনা জানি না, তবে উৎপাদন করছে ওরা কোথাও, এটা প্রায় নিশ্চিত। অনেক দেশে যোগাযোগ করেছি, কিন্তু সাবধান করার পরও কেউ তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।

অথচ আমি ব্যাপারটাকে মোটেই হালকাভাবে নিতে পারছি না, রানা। মালদিনি সারা দুনিয়ায় যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। তোমাকে ডেকেছি লোচনার জন্যে। কী মনে হয় তোমার? বাজে চিন্তায় সময় নষ্ট করছি?’ ‘জ্বী, স্যার,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল রানা। লক্ষ করল গম্ভীর হয়ে উঠেছে রাহাত খানের মুখের চেহারা। চট্ করে বলল, ‘আপনার যখন সন্দেহ হয়েছে ব্যাপারটা তলিয়ে দেখা দরকার। তাছাড়া, মালদিনির কিছু কিছু খোঁজ-খবর রানা এজেন্সির মাধ্যমেও জানা গেছে। আমরা জানি ওর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।’ ‘এবার তাহলে বলা যায়,’ নড়েচড়ে বসলেন রাহাত খান। আশ্বস্ত দেখাল বুড়োকে। রানা ভাবল বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নরম হয়ে যাচ্ছে নাকি বুড়ো! ‘আগে বুঝতে হবে ওর উদ্দেশ্যটা কি। বুঝতে হলে কাউকে না কাউকে যেতে হবে ব্লাইণ্ড মিশনে। তোমার কথাটাই সবার আগে মনে পড়ল আমার। বেশ কিছুদিন আফ্রিকায় ছুটি কাটিয়েছ তুমি। কাজেই ওখানকার পরিবেশ তোমার ভাল জানা থাকার কথা। যাই হোক,’ চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন বৃদ্ধ। ‘ও যদি জানান না দিয়ে বিভিনড়ব দেশে মিসাইল ছুঁড়তে থাকে কি ঘটবে বুঝতেই পারছ। এক দেশ ঝাঁপিয়ে পড়বে আরেক দেশের ওপর। কাজেই যেভাবে হোক ঠেকাতে হবে ওকে।’ ডেস্ক থেকে ‘টপ সিক্রেট’ লেখা একটা ফোল্ডার তুলে নিলেন বৃদ্ধ। পেপারগুলোয় চোখ বুলিয়ে বলতে ‘শুরু করলেন, ‘সত্তর দশকের শেষভাগে নিও- ফ্যাসিস্ট হিসেবে ইতালিতে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিল রবার্তো মালদিনি। রাজনীতি ও সংগঠন নিয়ে যতদিন ব্যস্ত ছিল তার ব্যাপারে কারও মাথাব্যথা ছিল না।

কিন্তু পরে সে সহিংসতার পথ বেছে নেয়। ইতালিয়ান পুলিস তাকে গ্রেপ্তার করার আগেই লিভর্নো থেকে দেশান্তরী হয় সে। ‘আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করে একেবারে নিখোঁজ হয়ে যায় লোকটা।’ ‘স্যার, চাইনিজরা বা অন্য কোন দেশ, যেমন উত্তর কোরিয়া, ওর সাথে জড়িত নয় তো? ওদের তো মিসাইল খোয়া যায়নি।’ ‘এক কথায় না বলা যাচ্ছে না, কিন্তু আমার অন্তত ধারণা-মালদিনি একাই করছে এসব।’ চুরুটের ধোঁয়ায় বুকটা ভরে নিলেন বৃদ্ধ। ‘ইথিওপিয়ার কোথায় রয়েছে ও?’ ‘ডানাকিলে, জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স খোঁজ বের করতে পেরেছিল ওর। কিন্তু ওই পর্যন্তই। দু’মাস আগে ওদের এজেন্ট স্রেফ উধাও হয়ে যায়।’ ‘ডানাকিল, সে তো মরুভূমি, স্যার।’ ‘ঠিক। সাইনাইয়ের মত ওটাও একটা ওয়েইস্টল্যান্ড, রানা। ইথিওপিয়ানদের ওটার ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আর মালদিনি যে ওখানে ঘাঁটি গেড়েছে একথা ওরা বিশ্বাসই করতে চাইছে না। সে যাকগে, ডানাকিলের বাসিন্দারা অচেনা লোক দেখলে খুন করতে দ্বিধা করে না। ইথিওপিয়ার মানচিত্রে রয়েছে জায়গাটা, কিন্তু আমহারিক উপজাতি, যারা এখন ক্ষমতায়, ওটাকে সভ্য করে তোলার কোন উদ্যোগ আপাতত নিচ্ছে না। বড় বিশ্রী জায়গা, রানা। ‘এখন তুমি কি বল, রানা? ইথিওপিয়ায় যাবে একবার? দেখবে পরিস্থিতি আদতে কতখানি ঘোলাটে?’ ‘যাব, স্যার।’ ‘এক বাঙালী বিজ্ঞানী আছে মালদিনির সাথে; আমার সঙ্গে অনেক দিনের পরিচয়,’ বললেন রাহাত খান। ‘কুদরত চৌধুরী। বর্তমানে ড্রাগ অ্যাডিক্ট। ডানাকিলে যাবার পর তাকে অ্যাডিক্ট হতে বাধ্য করেছে মালদিনি। আমাকে অনেক ইনফর্মেশন যুগিয়েছে সে। তুমি গেলে তার সাহায্য পাবে।’ ফাইলটা সামনের দিকে ঠেলে দিলেন বৃদ্ধ। অর্থাৎ যেতে পারো তুমি এবার। যতটা নরম ভাবছিল ততটা বুড়ো এখনও হয়নি বুড়ো, পরিষ্কার বুঝতে পারল রানা।

পরবর্তী সপ্তাহে ডানাকিল সম্পর্কে পড়াশোনা করে যা জানল তাতে মোটেও আশ্বস্ত হতে পারল না রানা। এমনকি ওর যে পরিচয় খাড়া করা হলো, সেটাও ওর মনে ধরল না। আমেরিকা অভিবাসী এক বাঙালী মুসলমান সে। নাম আলী আকবর। এই পাবলিক ওঅর্কস এঞ্জিনিয়ারটিকে মার্কিন মুল্লুকের প্রতিটি সাবডিভিশন কালো তালিকাভুক্ত করেছে। দোষ কি তার? না, সে বেচারা ওখানে গিয়েও বাঙালীয়ানা ছাড়তে পারেনি। কন্ট্রাকটরদের কাছ থেকে দেদার ঘুষ খাওয়ার বদনাম রয়েছে লোকটার। নরওয়েজিয়ান এক ফ্রেইটারে এখন সীট বুক করেছে সে। গন্তব্য মাসাওয়া। রাস্তা নির্মাণ করতে পারে এমন লোকের দরকার পড়েছে ইথিওপিয়ায়। কাজেই ঠিক হলো ওয়াশিংটন হয়ে মাসাওয়া যাচ্ছে মাসুদ রানা। এয়ারপোর্টে ডাফ্ল্ ব্যাগ ও গোপন কম্পার্টমেন্টসমৃদ্ধ তোবড়ানো সুটকেসটা খুঁজে নিল রানা। গোপন কুঠুরীতে স্থান পেয়েছে প্রচুর গোলা- গুলি ও চমৎকার এক ট্র্যান্সিভার। এবার ট্যাক্সি ডাকল। রানার সস্তাদরের গুডউইল সুটটা এক নজর দেখে নিল ড্রাইভার। ‘বারো ডলার হবে তোমার কাছে?’ ‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘কিন্তু মিটারটা ইউজ করো। নইলে প্রথমে আধমরা করব তারপর অভিযোগ দায়ের করব, বোঝা গেছে?’ রানার দিকে দ্বিতীয়বার দৃষ্টিক্ষেপ করল লোকটা। আলী আকবরের ছদ্মবেশ ছেড়ে বোধহয় বেরিয়ে আসতে চাইছে মাসুদ রানা, তবে তর্কাতর্কি করতে গেল না ড্রাইভার, নৌ-কাস্টমসে নামিয়ে দিল। বিনা বাধায় কাস্টমস্পা র হতে পারল ও। একজন ট্রাক ড্রাইভার ওকে পৌঁছে দিল ‘শেপ মাইয়ার’ জাহাজে।

কোঁকড়া, কালোচুলো স্টুয়ার্ড, ববি মুর, রানাকে দেখে খুব একটা খুশি হয়েছে মনে হলো না। হয়তো একটা কারণ, রাত দুটো বাজে এখন, আর নয়তো ওর বেশভূষা। কেবিনটা দেখিয়ে দেয়ায় লোকটাকে বখশিস দিল ও।‘ওয়ার্ডরূমে সাতটা থেকে নটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট পাবেন,’বলল লোকটা। ‘মই দিয়ে নেমে এক নম্বর ডেকে।’ ‘হেড কোথায়?’ ‘প্যাসেঞ্জার কেবিনগুলোর সামনেই। শাওয়ারও পাবেন। দেখবেন, ভদ্রমহিলাদের ভয় পাইয়ে দেবেন না যেন।’ লোকটা চলে গেলে কোট খুলে সুটকেসে অস্ত্রগুলো চালান করল রানা, তারপর দরজা বন্ধ করে খুদে কেবিনটা পরখ করে নিল। মেইনডেকমুখী এক পোর্টহোলের পাশে সিঙ্গল বাঙ্ক। মেইন ডেকটার অবস্থান পোর্ট সাইডে। ডকটাও ওদিকে। দেখা গেল পাতলা পর্দা উজ্জ্বল আলোর প্রবেশ ঠেকাতে পারছে না। ফরোয়ার্ড বাল্কহেডে রয়েছে সিঙ্ক। সঙ্গে লাগোয়া কম্বিনেশন ক্লজিট ও চেস্ট অভ ড্রয়ার্স। সকালে মালপত্র খুলে সাজাবে সিদ্ধান্ত নিল রানা। বিসিআই জানিয়েছে প্যাসেঞ্জার লিস্ট আপাতদৃষ্টিতে নিরাপদ। তবে সময়াভাবে সেভাবে নাকি খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। সাবধান থাকতে বলা হয়েছে ওকে। সাবধান থাকতে বলা হয়েছে ভাল কথা, ভাবল রানা, কিন্তু কি থেকে কিংবা কার কাছ থেকে? বাতি নিভিয়ে বুকে হেঁটে বাঙ্কে উঠে পড়ল রানা। ঘুমটা মোটেও ভাল হলো না ওর।

যে কোন জাহাজ সাগরে ভাসানো এক ঝকমারি, কিন্তু শেপ মাইয়ার-এর ক্রুরা যেন পণ করেছে হুল্লোড় করেযাত্রীদের জ্বালিয়ে মারবে। হাতঘড়িতে নজর বুলাল রানা। সাতটা। সিদ্ধান্ত নিতে হয় এখন। স্টিলেটো সঙ্গে নেবে? আলী আকবরের কাছে ছুরি থাকলে মানাবে? মনস্থির করতে পারল না। সুটকেসের গোপন
কম্পার্টমেন্টে শেষতক লুগার ও খুদে গ্যাস বোমাটাকে সঙ্গ দিতে রয়ে গেল ওটা। আজ সকালে ঘুমকাতুরে এক স্টুয়ার্ড নয়, অনেক মানুষের কৌতূহলী চোখের সামনে পড়তে হবে ওকে। রানা সামনে গিয়ে, হেড ব্যবহার করে, শাওয়ার নিল। তারপর কেবিনে ফিরে এসে কাপড় বাছাই করল। শেপ মাইয়ারে  ফর্মালিটির কোন প্রয়োজন নেই। ফ্লানেল শার্ট, ওঅর্ক প্যান্ট আর ওয়াটারপ্রূফ জ্যাকেট গায়ে চড়াল রানা। এবার ব্রেকফাস্টের পালা। ছিমছাম এক ওয়ার্ডরূম। দশ জনের মত বসার আয়োজন, তারমানে জাহাজে  যাত্রী বেশি নেই। স্টুয়ার্ড ববি মুর রানাকে জুস, স্ক্র্যাম্বল্ড্ এগ, বীফ ও কফি পরিবেশন করল। ওর খাওয়া প্রায় সারা এসময় বয়স্ক দম্পতিটি ঘরে প্রবেশ করলেন। ইংরেজ এঁরা-জ্যাক ও ডেবি চার্লটন। ভদ্রলোকের একহারা গড়ন ও ফ্যাকাসে গায়ের রং দেখে কেরানী মনে হয়, এবং ছিলেনও নাকি তাই, লটারিতে বাজি মেরে দিয়ে এবং তারপর বুদ্ধি করে টাকাটা খাটিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। ভদ্রমহিলার মোটাসোটা গিনড়বী-বানিড়ব চেহারা। স্বামী- স্ত্রী দু’জনেই পঞ্চাশের কোঠায়, হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়াতে ভ্রমণ পিপাসু হয়ে উঠেছেন। এবং দু’জনেই বাক্যবাগীশ। ‘আপনি নরফোকের লোক, মিস্টার আকবর?’ জ্যাক প্রশ্ন করলেন। ‘না,’ বলল রানা। ‘বাংলাদেশী। ওপি ওয়ানে আমেরিকা এসেছি।’

‘ও, তাই নাকি,’ সুর তুললেন মিসেস চার্লটন। ‘আপনাদের বাংলাদেশ সরকার কিন্তু ট্যুরিজমে মোটেও মনোযোগী নয়। দু’বছর আগে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম আমরা। কক্সবাজার, সুন্দরবন এসব জায়গা খুব ভাল লেগেছে। কিন্তু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার প্রশংসা করতে পারছি না,

দুঃখিত, আর…’ ভদ্রমহিলার বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত হওয়ার জন্যে রানাও খানিকটা দায়ী। আলী আকবর হিসেবে ওকে শুনে যেতে হবে, কিন্তু মাঝেমধ্যে হুঁ, হাঁ করা ছাড়া কথোপকথনে ওর আর কোন অংশগ্রহণ থাকবে না। আলী আকবর প্যাচাল শুনবে তার কারণ বড়লোক সহযাত্রীদের কাছ থেকে ড্রিঙ্ক খসানোর তালে থাকবে সে। এবং সম্ভব হলে ডলারও। অবশেষে, অবশ্যম্ভাবী সেই প্রশ্নটা করলেন মিসেস। ‘এই জাহাজে কেন উঠেছেন, মিস্টার আকবর?’ ‘ইথিওপিয়া যাচ্ছি।’ ‘কেন জানতে পারি?’ ‘কাজে। আমি একজন এঞ্জিনিয়ার। রাস্তা-ঘাট, ড্রেনেজ সিস্টেম এসব তৈরি করি।’ ‘বাহ, খুব ইন্টারেস্টিং কাজ মনে হচ্ছে?’ ‘ডাল-ভাত জুটে যায় আরকি।’ রোডবিল্ডিং সম্বন্ধে বিশেষ জানার কথা নয় কেরানীর কিংবা গৃহবধূর, কাজেই চার্লটনদেরকে নিজ পরিচয় যা দিচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা নেই রানার। ও প্লেনে করে আদ্দিস আবাবা যেতে চেয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ আমেরিকার বোমা চুরির খবর পেয়ে মত পাল্টেছেন জেনারেল। এই জাহাজে উঠতে বলেছেন রানাকে। তাছাড়া রানার কভারের সঙ্গে নাকি চমৎকার খাপ খেয়ে যায় এই সুলভ ভ্রমণ। মিসেস  চার্লটনের জেরা ও একতরফা বকবকানি মার খেয়ে গেল ওয়ার্ডরূমে ফ্রেইটারের আরেক যাত্রী প্রবেশ করতে। দরজা দিয়ে যুবতীটি ঢুকতেই রানার মনের ক্যাবিনেটে ফাইল কার্ড ওল্টানো শুরু হয়ে গেল। লম্বা, কুচকুচে কালো চুল, অপূর্ব সুন্দর দেহবল্লরী, আকর্ষণীয় মুখশ্রী — কোথায় দেখেছে একে রানা? ‘আমি জেন এসেক্স,’ বলল মেয়েটি। পরিচয় দিতেই রানা চিনে ফেলল ওকে। সিআইয়ের এজেন্ট। এ-ই সম্ভবত ব্রিফ করবে ওকে। চার্লটন দম্পতি নিজেদের পরিচয় দিলেন। রানার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। মেয়েটির হাত ঝাঁকিয়ে দিল ও।

মুখের অর্গল খুলে দিলেন আবারও মিসেস চার্লটন। বিনীতভাবে শুনে গেল জেন, কিন্তু রানা নিশ্চিত ওর মত সে-ও এর কিছুই মনে রাখবে না। এবার ভদ্রমহিলার তদন্তের পালা। ‘কি কর তুমি?’ প্র ম প্রশ্ন মিসেস চার্লটনের। ‘আমি ফ্রীল্যান্স জার্নালিস্ট।’ ‘বাহ, উইমেন্স লিবে বিশ্বাস কর বুঝি?’ মিস্টার চার্লটন। ‘করি। তবে সাংবাদিকতা করি নিছক অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে।’ রানার দিকে চাইল যুবতী। ‘আপনাকে চেনা চেনা লাগছে, মিস এসেক্স,’ বলল রানা। ‘আমি যদিও পত্রিকা-টত্রিকা পড়ি না তেমন একটা।’ ‘পুরুষদের ম্যাগাজিন তো পড়েন, তাই না, মিস্টার আকবর?’ বলল মেয়েটি। ‘তা পড়ি।’ ‘তাহলে ওখানেই দেখেছেন। এডিটরদের ধারণা, একা একা কোন্মে য়ে কোথায় কি অ্যাডভেঞ্চার করল খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ে পুরুষরা। পিক্স সহ বেশ কয়েকটা স্টোরি ছাপা হয়েছে আমার। তাই মনে হয় চেনা চেনা লাগছে।’

‘তাই হবে,’ বলল রানা। ‘পিক্স?’ মিসেস চার্লটন শুধালেন। ‘পিকচার, মানে ছবি?’ ‘শিয়োর। এই যেমন ধরুন-প্রতিনিধি রিওতোলন করছে। ব্যাঙ্ককের পাতায়া বীচে নগড়ব হয়ে গায়ে রোদ মাখছে। এইসব আর কি।’ মেয়েটির সম্পূর্ণ ডোশিয়ে মুখস্থ রানার। সিআইএ কখনোই নিশ্চিত হতে পারেনি জেন এসেক্স এজেন্ট হিসেবে কোন্ মানের-ভাল না মন্দ। ওকে সামনাসামনি দেখে বিভ্রান্তির কারণটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে রানা। চার্লটন দম্পতি, বলাবাহুল্য, মনে রাখবেন ওকে, চোখ-মুখ লাল করে এইমাত্র ওয়ার্ডরূম ত্যাগ করলেন তাঁরা। কিন্তু মেয়েটি এ-ও নিশ্চিত করল ওকে আর বিরক্ত করবেন না স্বামী-স্ত্রী। চালটা চেলে চালাকির পরিচয় দিয়ে থাকতে পারে জেন, কিংবা বোকামিরও। রানা বুঝতে পারল না কোন্টা।

‘আপনাকে নিয়ে হয়তো একটা স্টোরি করা যায়, মিস্টার আকবর,’ বলল জেন। ‘আপনি এই ফ্রেইটারে কেন?’ সেই রাস্তা-ঘাট বানানর গপ্পো ফাঁদতে হলো রানাকে।  ‘গেলেই কাজে জয়েন করতে পারবেন?’ ‘হ্যাঁ। মাসাওয়ার জেটিতে লোক থাকবে আমার জন্যে।’ ‘বাজে দেশ, ইথিওপিয়া-দেখবেন চাকরি না খেয়ে দেয়।’ ‘সাবধান থাকব আমি।’ আর যাদের চোখেই দিক না কেন, পরস্পরের চোখে ধুলো দিতে পারেনি ওরা। কিন্তু সবার সামনে মুখ খুলতে আপাতত রাজি নয় কেউ। কাজেই ওয়ার্ডরূম থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজের ছোট্ট লাইব্রেরীটায় গেল রানা। গোটা দুই পেপারব্যাক বাছাই করে ফিরে এল কেবিনে। জ্যাক চার্লটনের সঙ্গে প্র ম দু সন্ধে দাবা খেলে কাটানর চেষ্টা করল রানা। একটা করে নৌকা আর গজ দান করে প্রায় পঁয়ত্রিশ চাল পর্যন্ত খেলাটাকে টেনে নিয়ে গেল, তারপর নির্বোধের মত মাত হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। সুতরাং দাবা ছেড়ে এরপর ব্রিজ ধরতে হলো। চরিত্র বিশে−ষণে আসলে সময়টা কাজে লাগাল রানা। চার্লটন দম্পতি নিপাট ভালমানুষ উপলব্ধি করছে ও, দুনিয়া ঘুরে বেড়াবে তারপর গল্পের ঝাঁপি নিয়ে বসে, প্রতিবেশীদের তাক লাগিয়ে দেবে। ওদিকে ধাঁধা হয়েই রইল জেন। তাস খেলায় রানার জুটি হয় সে, কখনও আমীর রানার আবার কখনও ফকির রানার। যাত্রার তৃতীয় দিন সকালে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উত্তাপের আঁচ পাওয়া গেল। ওয়ার্ডরূমের চার্ট জানাচ্ছে, উইন্ডওয়ার্ড চ্যানেলে রয়েছে ওরা। স্পীড রেকর্ড সেট করেনি শেপ মাইয়ার। এ মুহূর্তে, কিউবার ঘন নীল পানির বুক চিরে, ঈষৎ টলমল করতে করতে এগিয়ে চলেছে জাহাজ। সেদিন সন্ধের দিকে জর্জটাউন পৌঁছানর কথা ওদের। সাতটার আগে বাঙ্ক ছেড়ে নাস্তা সারতে ওয়ার্ডরূমে গেল রানা। রাতে ঘুম ভাল হয়নি ওর। জাহাজের এয়ারকন্ডিশনিং ব্যবস্থা মোটেও জুতসই নয়।

চার্লটনদের কিংবা জেনের দেখা নেই। একটা ডেক চেয়ার টেনে নিয়ে, যাত্রীদের জন্যে নির্দিষ্ট ডেকের ছোট্ট অংশটায় বসল রানা। হঠাৎ খর্-খর্শ ব্দ শুনে চোখ তুলতে জেনকে দেখতে পেল। আরেকটা ডেক চেয়ার টেনে আনছে ইস্পাতের ডেক পে−টের ওপর দিয়ে।

‘আমাদের ইংরেজ বন্ধুরা মনে হয় সকালের রোদ পছন্দ করে না,’ বলল যুবতী। জবাবে মুচকি হাসল কেবল রানা। কাটঅফ জিনস ও ব্যাকলেস হল্টার পরনে জেনের, উন্মুক্ত গায়ের চামড়া রোদে পোড়া তামাটে। ডেক চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসল ও, স্যান্ডেল লাথি মেরে খসিয়ে সিগারেট ধরাল। ‘মাসুদ রানা, এখন অভিনয় ছেড়ে বোধহয় কথাবার্তা বলা যায়।’

‘তথাস্তু। এরজন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।’ ‘বিসিআই তোমাকে অনেক কিছুই জানায়নি।’ ‘অনেক কিছু বলতে?’ ‘রবার্তো মালদিনি সম্পর্কে ইনফর্মেশন। দায়িত্বটা সিআইএ আমার ওপর চাপিয়েছে। লেটেস্ট খবর হচ্ছে জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট মারা পড়ার আগে একটা রিপোর্ট ফাইল করে গেছিল। আমরা সেটা ইন্টারসেপ্ট করি। আমাকে বলা হয়েছে জিওনিস্টদের নতুন একজনের সাথে লিয়াজোঁ করে চলতে। কিন্তু ইথিওপিয়া পৌঁছানর আগে পরস্পরকে চিনব না আমরা।’ সিগারেটটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল জেন। ‘কিন্তু আমি বাজিয়ে দেখে বুঝে ফেলেছি, সেই এজেন্ট হচ্ছে এই জাহাজের স্টুয়ার্ড।’ ‘আগে মালদিনির কথা বলো,’ বলল রানা। ‘ধীরে, আকবর, ধীরে-ইংরেজ বন্ধুদের সম্বন্ধে দেখছি ভুল ধারণা করেছিলাম।’ চার্লটন দম্পতি ডেক চেয়ার হিঁচড়ে আনছেন। রানার সঙ্গে বই রয়েছে, কিন্তু পড়ার ভান করল না। মেরা আউটফিট রাখার খুদে বীচ ব্যাগটার ভেতর হাত ভরে দিল জেন। ৩৫ এমএম-এ টেলিফটো লেন্স পেঁচিয়ে ফেলল ত্রস্ত হাতে, উড়ুক্কু মাছের রঙিন ছবি নেয়ার চেষ্টা করবে বলে ঘোষণা দিল। ক্যামেরা স্থির রাখতে রেইলের ওপর ঝুঁকে পড়ল সে। রানার মাথায় তখন পাক খাচ্ছে নানান চিন্তা। ববি মুর, শেপ মাইয়ারের স্টুয়ার্ড, জিওনিস্টের এজেন্ট! বিসিআই তথ্যটা ওকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছে, নাকি চেয়েছে রানা জেনের কাছ থেকে জানুক? রাহাত খানের ভ্রূ দেখতে পেল রানা মনের চোখে। ইচ্ছে করেই ওকে ব্লাইণ্ড মিশনে পাঠানো হয়েছে? বুকের মাঝে অভিমান উথলে উঠল ওর। পরমুহূর্তে নিজেকে ছিছি করল। জেনে-বুঝে কখনোই ওকে এরকম ফাঁকি দেবেন না বস। বিসিআই তথ্যটা তাঁকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছে, এছাড়া ব্যাপারটার আর কোন ব্যাখ্যা নেই। যাই হোক এই মিশনে রানার পাশাপাশি কাজ করতে পাঠানো হয়েছে সিআইএ এজেন্ট জেন এসেক্সকে। এবং মালদিনি সম্পর্কে আরও জানতে হলে রানাকে নির্ভর করতে হবে মেয়েটির ওপর। তেমনভাবেই সাজানো হয়েছে সেটআপটা। সাজিয়েছে সিআইএ। অগত্যা স্বামী-স্ত্রীর ভ্যাজর ভ্যাজর হজম করে সকালটা পার করতে হলো ওকে। সন্ধে নাগাদ জর্জটাউন পৌঁছল ওরা। কিন্তু রানা মনস্থির করল তীরে নামবে না। আলী আকবরের পকেটে টান পড়েছে এবং ভ্রমণের ক্লান্তিতে বড্ড বিরক্ত বোধ করছে সে। জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের কাছে মাসুদ রানার নামে একটা ফাইল আছে। কি আছে ওতে জানে না রানা, কিন্তু ববি মুর সম্ভবত শনাক্ত করতে পেরেছে ওকে। স্থানীয় ইসরাইলী এজেন্টকে একটা খবর দিলে খুন করে গুম করে ফেলবে রানাকে। আলী আকবর নামে জনৈক আমেরিকান অভিবাসী  যদি হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, কেউ আটকে   রাখবে না শেপ মাইয়ারকে। ‘সাইটসিয়িঙের জন্যে যাবেন না?’ মিসেস চার্লটন প্রশ্ন করলেন। ‘না, মিসেস চার্লটন,’ বলল রানা। ‘সত্যি বলতে কি, ভ্রমণ তেমন একটা ভালবাসি না আমি। তাছাড়া সঙ্গে টাকা-পয়সাও বিশেষ নেই। ইথিওপিয়া যাচ্ছি যদি  একটা হিলে− হয়। প্রমোদভ্রমণে আসলে বেরোইনি আমি। টাকা-পয়সা থাকলে…’ ত্বরিত নিষঙঊান্ত হলেন ভদ্রমহিলা, স্বামীকে পেছনে হিড়হিড় করে টানতে টানতে। এই লোককে খাওয়ার ও ব্রিজ খেলার সময় তিতিবিরক্ত করে মারা যায়, কিন্তু তাই বলে উপকূলে নামতে রাজি করাতে একটির বেশি দুটি শব্দ খরচ করতে বয়েই গেছে তাঁর। হায়রে, সবই আলী আকবরের কভারের দোষ, তেতো মনে ভাবল রানা। শালার অভাবী মানুষকে সবাই ডরায়। জেন তীরে গেছে। কভার বজায় রাখতে হলে যেতেই হবে, রানাকে যেমন বসে থাকতে হবে জাহাজে। মালদিনির ব্যাপারে একান্তে কথা বলার সুযোগ এখনও পায়নি ওরা, কখন পাবে তাই বা কে জানে। ক্যাপ্টেন আর সেকেন্ড মেট বাদে জাহাজের বাদবাকি অফিসাররাও ডিনারের সময় তীরে  নেমে গেছে। অফিসার দু’জনের সঙ্গে সাত-পাঁচ গল্প করে সময় পার করল রানা; যদিও জমাতে পারল না। ডিনার-পরবর্তী কনিয়্যাক পান শেষে, তীরে যাওয়ার জন্যে ক্যাপ্টেনের অনুমতি চাইল ববি মুর। ‘জাহাজে প্যাসেঞ্জার রেখে তুমি…’

‘কোন অসুবিধা নেই আমার,’ বলে উঠল রানা। ‘ব্রেকফাস্টের আগে আমার আর কিছু লাগবে না।’ ‘আপনি যাচ্ছেন না, মিস্টার আকবর?’ জানতে চাইল ববি মুর। ‘না,’ বলল রানা, ‘আসল কথা, ট্যাঁক খালি।’ ‘জর্জটাউন কিন্তু ভারী সুন্দর জায়গা, পরে পস্তাবেন,’ বলল ও। ব্যাটার সাফাই শুনলে খুশির সীমা থাকবে না জর্জটাউন ট্যুরিজমের, কিন্তু রানা আগ্রহ দেখাল না। রানাকে উপকূলে চাইছে ববি মুর, কিন্তু এ ব্যাপারে চাপাচাপি করতে ভয়ও পাচ্ছে। যদি সন্দেহ করে বসে রানা। সে রাতে লুগার আর স্টিলেটোটা হাতের কাছে রাখল রানা। পরদিনও চোখের আড়ালে থাকল ও। সাবধানতাটুকু সম্ভবত বৃথা গেল। ববি মুর তীরে নেমেছিল তেল আবিবকে জানাতে, রানা মাসাওয়া যাচ্ছে। আর সেজন্যে যদি নেমে না থাকে তাহলে  চিনতে পারেনি ওকে। চিনতে পারলেও রানার করার কিছু নেই। ‘জর্জটাউনে আকর্ষণীয় কোন স্টোরি পেলে?’ সে রাতে ডিনারে বসে জেনকে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘নাহ্, কিচ্ছু লাভ হয়নি নেমে।’ ডিনারের পর কেবিনের দরজায় মৃদু একটা আওয়াজ হবে আশা করছে রানা। দশটা বেজে সাত। চার্লটনরা আজ অন্যান্য দিনের চাইতে আগেভাগে কেবিনে আশ্রয় নিয়েছে, স্পষ্টতই ক্লান্ত। গত রাতের সাইটসিয়িঙের ধকল। জেনকে ঢুকতে দিল রানা। সাদা স্ল্যাক্স ও বডিশার্ট পরনে ওর। ‘ববি মুর তোমাকে চিনে ফেলেছে মনে হচ্ছে,’ বলল ও। রানাকে মাথা নাড়তে দেখে বলল, ‘মেইন ডেকের সুপারস্ট্রাকচারের কাছে দেখা করতে বলেছে আমাকে। রাত একটায়।’ ‘তুমি চাইছ তোমাকে কাভার করি আমি?’ ‘সেজন্যেই সাদা কাপড় পরেছি। আমাদের রেকর্ডে বলে, ছুরিতে তোমার নাকি হাত চালু, আকবর।’ ‘অপেক্ষা করব আমি, আমাকে খোঁজার দরকার নেই,’ বলল রানা। সায় দিল জেন। নিঃশব্দে দরজা খুলে নগড়ব পায়ে প্যাসেজওয়েতে মিশে গেল মেয়েটা। স্টিলেটো তুলে নিল রানা। ঘরের বাতি নিভিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর সন্তর্পণে প্যাসেজওয়েতে ঢুকে পথ করে দরজাটার কাছে চলে এল, মেইনডেকের পোর্টসাইডের দিকে খোলে এটা। আশপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বেশিরভাগ কার্গো শিপের মত শেপ মাইয়ারেরও বিশৃক্মখল অবস্থা। সুপারস্ট্রাকচার লাগোয়া ডেকে তেরপলের ছড়াছড়ি। রানা সাবধানে গোটা দুই জড়ো করে কার্গো বুমের বেস ঘিরে স্তূপ করে রাখল। এবার বসে পড়ল ওগুলোর আড়ালে। ববি মুর এগুলোকে কুশন না বানালেই বাঁচি, বলল মনে মনে। ওয়াচ-অ্যাফট বসানোর ধার ধারেনি শেপ মাইয়ার। ক্রুদের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে ব্রিজে এসে মিশেছে ইনবোর্ড প্যাসেজওয়ে, রেডিও শ্যাক, এঞ্জিন রূম আর গ্যালী। রানার ধারণা হলো ব্রিজের লুকআউট ঘুমাচ্ছে, এবং অটোমেটিক পাইলটে চলছে জাহাজ। তবুও, আড়াল ছাড়ল না ও। ঠিক একটায় দেখা দিল ববি। মেস জ্যাকেট পরে রয়েছে এখনও, আবছা সাদাটে দেখাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। বাঁ আস্তিন হাতড়াতে দেখল ওকে রানা, সম্ভবত ছুরি লুকানো আছে। এবার উদয় হলো জেন। রানার ডান হাতে উঠে এল স্টিলেটো। কথোপকথনের টুকরো-টাকরা কেবল বাতাসে ভেসে আসছে ওর কানে। ‘তুমি আমাদের ডাবলμস করেছ,’ বলল লোকটা। জেনের জবাবটা উড়ে গেল বাতাসে। ‘ও জাহাজে ওঠার সময়ই চিনতে পেরেছি,’ বলছে ববি। ‘তেল আবিব থোড়াই পরোয়া করে মাসুদ রানা মাসাওয়া পৌঁছল কি না।’ ‘আমি করি।’ উত্তর শোনা গেল না লোকটার। উত্তপ্ত বাদানুবাদ চলছে বোঝা যায়, এবং সেই সঙ্গে মৃদুতর হচ্ছে ওদের কণ্ঠস্বর। রানার দিকে পিঠ দিয়ে জেনকে মেটাল সুপার স্ট্রাকচারটার উদ্দেশে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ববি, ব্রিজের যে কারও চোখের আড়ালে।

আলগোছে তেরপল তুলে বেরিয়ে এল রানা, প্রায় হামাগুড়ির ভঙ্গিতে। হাতে স্টিলেটো তৈরি ওর, গুড়ি মেরে এগোল ওদের উদ্দেশে। ‘তোমার সাথে কাজ করব না আমি,’ বলল ববি। ‘মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?’ ‘তুমি ডাবলক্রস করেছ আমাকে — আর নয়তো তোমার প্রভুরা। আগে তোমাকে খতম করব, তারপর রানাকে। সাগরে কেমন সাঁতরাতে পারে শালা মুসলমানের বাচ্চা দেখা যাক।’ আস্তিনের কাছে হাত চলে গেল ওর। পা টিপে দৌড়ে এসে পেছন থেকে ছুরি- ধরা বাঁ হাতে ওর গলা পেঁচিয়ে ধরল রানা, রুদ্ধ করে দিল চেঁচানর সুযোগ। তারপর এক ঝটকায় ঘুরিয়ে দিয়ে পরপর দুটো বিরাশি সিক্কার ঘুসি ঝাড়ল লোকটার নাক বরাবর। মাথা ঘুরে টলে উঠতে, মেস জ্যাকেট থাবা মেরে ধরে রেইলের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিল শরীরটা। জোর বাতাসে চাপা পড়ে গেল লোকটার আর্তচিৎকার। ‘ঝপাৎ’ শব্দটা নিশ্চিন্ত করল রানাকে। মাত্র ক’মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল পুরোটা। ব্রিজ থেকে কোন শোরগোল উঠল না। পায়ের নিচে জাহাজের আফ্রিকাগামী এঞ্জিন ধড়ফড় করছে। স্টিলেটো খাপে ঢুকিয়ে জেনের কাছে এল ও। সুপারস্ট্রাকচারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে। ‘থ্যাঙ্কস, রানা…ইয়ে, আকবর।’ ‘পুরোটা শুনতে পাইনি,’ জানাল রানা। ‘ও কি তেল আবীবে রিপোর্ট করেছিল আমার সম্পর্কে?’ ‘কিছু বলেনি আমাকে।’ ‘শুনলাম মাসাওয়া গেলাম কি গেলাম না তাতে নাকি তেল আবিবের কিছু আসে যায় না।’ ‘হ্যাঁ, কিন্তু খুব সম্ভব ও কোন রিপোর্ট তৈরি করেনি।’ একটুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল, ‘রানা… আকবর, ওকে কি মেরে ফেলেছ?’ মৃদু হাসল রানা, মাথা নাড়ল। ‘জানি না। কপাল ভাল থাকলে বেঁচেও যেতে পারে।’ ‘জবর দেখিয়েছ কিন্তু,’ বলল জেন। একটু আগে যে মরতে বসেছিল তার কোন ছাপ দেখা গেল না মেয়েটির আচরণে। যেন এমনি ঘটনা ওর জীবনে হরহামেশাই ঘটছে। ‘তোমার কেবিনে চলো, কথা আছে,’ শেষমেষ রানাকে বলল ও।

এই জাহাজে ঘাপলা আছে,’ কেবিনে ঢুকে মূর্তি হয়ে বসল জেন। ‘স্পীড কম। এয়ারকন্ডিশনিং ঠিক মত কাজ করে না। আর ববি মুর জঘন্য কফি বানাত, এই বলবে তো?’ ‘না।’  ওকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিতে অপেক্ষা করছে রানা। ‘রানা,’ বলল মেয়েটি, ‘শেপ মাইয়ার সম্পর্কে বিসিআই তোমাকে কি কি জানিয়েছে বলবে আমাকে?’ ‘একসময় না একসময় জাহাজটা মাসাওয়া পৌঁছবে। এবং প্যাসেঞ্জার লিস্টে সম্ভবত কোন গন্ডগোল নেই।’ ‘ক্রুদের সম্পর্কে কিছু বলেনি?’ ‘ববি সাহেবের কথা জানা ছিল না,’ বলল রানা। ‘সিআইএ আমাকে বলেছে তোমাকে জানাতে। আর আমা ওপর আরও একটা দায়িত্ব চাপিয়েছে। তিনটে মিনিটমেন মিসাইল ট্র্যাক করতে হবে। খোয়া গেছে ওগুলো।’ ‘কমপি−ট মিসাইল?’ ‘না-অংশবিশেষ। সঙ্গে নিউক্লিয়ার ওঅরহেড রয়েছে।’ ‘কোথায় ওগুলো?’ ‘ব্রিজের পেছনে এক নম্বর ডেকে, দড়ি বাঁধা হয়ে বসে আছে কন্টেইনারগুলোর মধ্যে।’ ‘তুমি ঠিক জানো?’ ‘ফেয়ারলি।’ ‘মালদিনির কাছে চালান করা হচ্ছে?’ ‘হ্যাঁ, ববি মুর বেশি বেশি মাতব্বরী ফলাচ্ছিল। আমার বিশ্বাস মাসুদ রানাকে খতম করার চাইতে ওই মিসাইলগুলো অকেজো করাটাই জিওনিস্টের জন্যে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট ছিল।’ ‘তার মানে আমাদের এখন ইসরাইলী সহযোগিতা ছাড়াই কাজটা করতে হবে,’ বলল রানা। ‘যাকগে, রাতটা থেকে যাও এখানে।’ ‘আর আমার চরিত্র ধ্বংস হোক?’ ‘তখন চার্লটনদের সামনে যা বললে তারপর আর ধ্বংস হতে বাকি আছে কিছু?’ হেসে ফেলল জেন। বলল, ‘তবু আমার কেবিনেই শোবো আমি।’

এখন অবধি অল্প কিছু ক্রুর সঙ্গে দেখা হয়েছে রানার। ওদের কথাই ভাবছে। যাত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করে না তারা। ডিনারে ক্যাপ্টেন জোহানসনের সঙ্গে গল্প করেছে রানা। মিস্টার ম্যাকলিন সেকেন্ড মেট, শুনেছে। ফার্স্ট মেট, মিস্টার জন কেয়ার, মাঝেমধ্যে খোঁত-খাঁত করে অভিবাদন জানিয়েছে এবং পাতে আরও আলু চেয়েছে, কিন্তু বাহ্যত একবারও মনে হয়নি যাত্রীরা বাঁচল না মরল তাতে কিছু এসে যায় তার। পার্সার, মিস্টার বর্গ, রানাদের খাওয়ানোর দায়-দায়িত্ব ববি মুরের ঘাড়ে চাপিয়ে, চুপচাপ দৈনন্দিন পাঁচ হাজার ক্যালোরি হজম করে গেছে। রেডিও অপারেটর, লম্বা, সোনালী চুলের লিকলিকে মেয়েটি সুইডিশ; মেরী এন্ডারসন। ফার্স্ট মেটের মতই চাপা স্বভাবের। এক কথায়, ওয়ার্ডরূমে সামাজিকতার কোন বালাই নেই। রানা কান খাড়া রাখল যদি ববির খোঁজে হৈ- চৈ পড়ে জাহাজে। কোনমতে রাত কাবার করে, সকালে জেনকে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে এল প্যাসেজওয়েতে। আরেকটু হলেই ধাক্কা খেত ওরা মেরী এন্ডারসনের সঙ্গে। ‘ববি মুরকে তোমরা কেউ দেখেছ?’ প্রশ্ন করল ও।

‘ডিনারের সময় দেখেছি,’ বলল রানা। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল জেন, সে-ও তখনই শেষবার দেখেছে। মেরী এন্ডারসন ওদের ওপর সন্দেহের দৃষ্টি বুলিয়ে চলে গেল পাশ দিয়ে। পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিল একবার ওরা। ‘দশ মিনিট পর আমার কেবিনে এসো,’ বলল জেন। ‘একসাথে নাস্তা করব আমরা।’ সানন্দে রাজি হলো রানা।

কেবিনে ফিরে এসে তৈরি হয়ে নিল রানা। অস্ত্র সঙ্গে রাখার বিষয়ে আরেকবার মাথা ঘামাল। এই জাহাজে করে তিনটে মিনিটম্যান আইসিবিএম তৈরির মাল-মশলা চলেছে, জেনের এ থিয়োরি বলছে ঠিকই করেছে রানা। কোডেড মেসেজ পাঠানোর জন্যে রেডিও ব্যবহার না করে বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। ক্রুরা হয়তো জানে না কি বহন করছে তারা, কারণ কার্গো শিপে কন্টেইনার খোলার কোন নিয়ম নেই। কিন্তু যদি জানা থাকে ওদের? তবে কি এখন থেকে অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা আরম্ভ করবে রানা? খানিকটা অনুতাপের সঙ্গে লুগার আর স্টিলেটো সুটকেসের গোপন কুঠুরীতে রেখে দিল রানা, খুদে গ্যাস বোমাটা আর ট্র্যান্সিভারও রয়েছে ওখানে। এ জাহাজ ঠিকঠাকমত ইথিওপিয়া গেলে তো ভালই, নইলে একটামাত্র লুগার নিয়ে এতবড় ঝামেলা এড়ানো যাবে না। জাহাজের এঞ্জিনিয়ারদের কারও দেখা পায়নি ভেবে মনে মনে উদ্বিগড়ব হয়ে উঠছে রানা। ববি মুর জানিয়েছিল মিসেস চার্লটনের প্রশেড়বর জবাবে, তারা নাকি নিচে থাকতে ভালবাসে, যাত্রীদের দেখা দেয় না। ওর ব্যাখ্যা তখন মেনে নিয়েছিল রানা। কিন্তু এখন কেমন যেন খুঁত-খুঁত করছে মনটা। তালা বন্ধ সুটকেসটার দিকে আবারও চাইল রানা। জ্যাকেট পরে ঢাকা দেয়া যায় লুগার। এরচাইতে ছোটখাটো কিছু পরে লুগার গোপন করার চেষ্টা বৃথা। কিন্তু এই পচা গরমে জ্যাকেট পরলে জাহাজের সবচাইতে সরল সাদাসিধে ক্রুটিও সন্দিহান হয়ে উঠবে। এবং জাহাজে সরল মনের ক্রু আদৌ কেউ আছে কিনা ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে ওর। প্যাসেজওয়েতে পা রাখল নিরস্ত্র রানা, দরজা লক করে ক’গজ দূরে জেনের কেবিনের উদ্দেশে এগোল। আলতো টোকা দিল ও। জেন ভেতর থেকে ডাকতে ঢুকে পড়ল। মেয়েলি অগোছাল দৃশ্য চোখে পড়বে ভেবেছিল রানা, কিন্তু তার বদলে দেখতে পেল ছিমছাম এক কেবিন। বাঙ্কের নিচে জেন সযতেড়ব ঢুকিয়ে রেখেছে লাগেজ, ওপেন ক্লজিটে নিরাপদ ওর গ্যাজেট ব্যাগ। রানা ভেবে পেল না ওর ক্যামেরা .২২ সিঙ্গল শট ধারণ করছে কিনা, কোন একটা লেন্সে।

জেন পরে রয়েছে ব্লু হল্টার আর ডেনিম কাটঅফ। পায়ে আজ স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার। একটা ব্যাপার নিশ্চিত, অস্ত্র বহন করছে না যুবতী। ব্রেকফাস্টের জন্যে ওয়ার্ডরূমে গেল ওরা একটু পরে। পুরোটা সময় ধরে ববি মুরের অনুপস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা চলল। মিসেস চার্লটনের ধারণা সাগরে পড়ে গেছে লোকটা। কিন্তু প্রতিবাদ করল রানা, বলল তাহলে কেউ না কেউ শুনতে পেত। কিন্তু ওর কথা কানে তুললেন না ভদ্রমহিলা। পাল্টা বললেন লুকআউট কাজ ফেলে ঘুমালে শুনবে কিভাবে? এবার আপত্তি করে উঠল পার্সার। মিস্টার কেয়ার ও মিস্টার ম্যাকলিন থাকতে দায়িত্ব পালনে গাফিলতির নাকি প্রশ্নই ওঠে না। বিস্বাদ কফি, পোড়া টোস্ট আর সঙঊ্যাম্বল্ড্গ দিয়ে নাস্তা সারল ওরা। আজ ওদের প্রতি কেমন শীতল আচরণ করলেন চার্লটন দম্পতি। ওদের বন্ধুত্ব সম্ভবত সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না ওঁরা। একদিক দিয়ে ভালই হলো রানাদের জন্যে। ববি মুরের জন্যে পর্যাপ্ত হা-হুতাশ করে জেনের কেবিনের দিকে পা বাড়াল ওরা। ‘জার্নালিস্টের ভান যখন ধরেছি তখন ববির সম্পর্কে একটু খোঁজ-খবর নিতে হয়,’ রানাকে বলল জেন। ‘তুমি কি করবে ভাবছ?’ ‘কি আর, পোর্ট ডেকে গিয়ে আরেকটা জেমস হেডলি চেজ ধরব।’ ‘এই,’ আদুরে কণ্ঠে বলল জেন। ‘আমার কিছু ছবি তুলে দাও।’ আঁতকে ওঠার ভান করল রানা। ‘মানে জন্মদিনের পোশাকে?’ ‘তা নয় তো কি?’ ‘কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে?’ বলল রানা। ‘এমনিতেই আমাদের মেলামেশা লোকে ভাল চোখে দেখছে না। তার ওপর আবার যখন তখন কেবিনে ঢোকা, কেমন দেখায় না?’ মেয়েটার মনোভাবের হঠাৎ পরিবর্তনে বিস্মিত হয়েছে ও।

মাথা নেড়ে স্বীকার করল জেন। ওকে সান্ত্বনা দিল রানা, বলল, ‘পরে সুযোগ মত তুলে দেব। এখন চলি।’ জেনকে ওর কেবিনে পৌঁছে দিয়ে চলে এল ও। একটু পরে, ডেক চেয়ারে আয়েশ করে বসে তখন রানা, মুখটা ছায়ায় রাখার ব্যবস্থা করে সবে চোখের সামনে তুলতে যাবে বইটা, পায়ের শব্দ ও তারপর এক পুরুষকণ্ঠ কানে এল  ওর। ‘মিস্টার রানা, নড়বেন না।’ রানা উপেক্ষা করার ভান করল। রানা আবার কে, অন্য কাউকে বলছে হয়তো। ‘মিস্টার আকবর, নড়াচড়া করবেন না।’ এবার আর গায়ে না মেখে উপায় কি? সেকেন্ড মেট ম্যাকলিনের গলা। দু’জন নাবিক, সশস্ত্র, রানার সামনে এসে দাঁড়াল। এবার দেখা দিল ম্যাকলিন। তার হাতেও অস্ত্র। ‘জেনারেল মালদিনি আপনাকে জ্যান্ত চান,’ বলল সে। ‘এই জেনারেল মালদিনিটা কে?’ ‘যাঁকে ইথিওপিয়ান সরকারের হয়ে খুঁজছেন আপনি।’ ‘ম্যাকলিন, জেনারেল মালদিনি না কি, তাকে চাকরি দিতে ঠেকা পড়েনি ইথিওপিয়ান সরকারের।’ ‘অনেক হয়েছে, মিস্টার রানা। ববি মুরকে খুন করেছেন আপনি। গাধা বেচারা-ইসরাইলীরা নিশ্চয়ই খুব সস্তায় কিনেছিল ওকে।’ ‘মানুষকে বেহুদা অপবাদ দেয়া ঠিক নয়,’ বলল রানা। ‘খুঁজে দেখোগে, কোথাও হয়তো মাল টেনে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে।’ কথার পিঠে কথা বলার সুরে জবাব দিল ম্যাকলিন। ‘ভেবে অবাক লাগে, বাচাল বুড়িরাও মাঝেমধ্যে ফস করে কেমন সত্যি কথা বলে বসে। কাল রাতে লুকআউট ঘুমাচ্ছিল। বেশিরভাগ রাতেই ঘুমায়। কিন্তু আমি জেগে ছিলাম। ববির জন্যে জাহাজ ঘুরাতে চাইনি। জিওনিস্ট এজেন্ট পানিতে পড়লে আমার কি?’

‘ইসরাইলের অনেক কিছু।’

‘স্বীকার করছি আপনার নার্ভ খুব শক্ত। কিন্তু আমরা সশস্ত্র, আপনি তা নন। এ জাহাজের সমস্ত ক্রু মহান নেতা মালদিনির লোক-শুধু ববি মুর, যাকে ফেলে দিয়েছেন আপনি জাহাজ থেকে এবং ওই এঞ্জিনিয়ারগুলো ছাড়া, এঞ্জিন রূমে এখন বন্দী হয়ে আছে ওরা। আপনার ছোরাটা কই, মিস্টার রানা?’ ‘ববির শরীরে।’ ‘আমি দেখেছি ওটা ব্যবহার করেননি আপনি।’ ‘তুমি রাতকানা মনে হচ্ছে,’ বলল রানা। ‘কি দেখতে কি দেখেছ।’ ‘যাকগে। ওটা এখন আপনার সাথে নেই। আপনি  অতুলনীয়, মিস্টার রানা। কিন্তু অস্ত্রধারী তিনজনের বিরুদ্ধে অসহায়। কাজেই আস্তে করে উঠে পড়ে সামনে হাঁটা দিন। ঘুরবেন না। কোন ফন্দিফিকির করতে যাবেন না। জেনারেল মালদিনি আপনাকে জ্যান্ত চান যদিও, তবে মারা পড়লেও খুব একটা দুঃখ পাবেন বলে মনে হয় না।’ রানার দায়িত্ব মালদিনির পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবগত হওয়া। এখন সেধে যখন তার কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে, আপত্তি কিসের? তাছাড়া সশস্ত্র তিনজনের বিপক্ষে কিইবা করার আছে ওর। বিশেষ করে রানার দক্ষতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে দ্বিগুণ সতর্ক রয়েছে যখন ওরা। পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে তপ্ত সূর্যটা। সামনে হেঁটে গেল ওরা, পাশ কাটাল দড়িবদ্ধ কন্টেইনারগুলোর। শেষবারের মত মহাসাগরে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল রানা। তারপর একটা দরজা পার হয়ে ফরোয়ার্ড সুপারস্ট্রাকচারে পা রাখল। ‘থামুন!’ আদেশ করল ম্যাকলিন। রেডিও শ্যাকের দশ ফিটের মধ্যে এখন রানা। বেরিয়ে এল মেরী এন্ডারসন, রানার তলপেট বরাবর ধরে রয়েছে একটা কাটা শট-গান। ‘ক্যাপ্টেন বলেছেন, বোসান’স লকারের নিচে স্টোরেজ এরিয়া ব্যবহার করতে,’ বলল মেরী। ‘সে তো একদম নাক বরাবর,’ বলল ম্যাকলিন। ‘তো?’

‘ইংরেজ দম্পতি দেখে ফেলতে পারে আমাদের। হাজার হলেও মিস্টার রানা এখন অসুস্থ রোগী। ভয়ঙ্কর ট্রপিকাল ফিভারে ধরেছে তাঁকে।’ ‘অসুস্থ রোগীদের বয়ে নিয়ে যেতে হয়,’ বলল মেরী। কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে মাথা খাটাতে হলো না রানার। পেছনে পদশব্দ হলো ওর। পরমুহূর্তে সাতটা সূর্য দপ করে জ্বলে উঠল রানার মাথার মধ্যে। এখন ঘনঘোর অন্ধকার।

অসহ্য মাথার যন্ত্রণা নিয়ে জ্ঞান ফিরল মাসুদ রানার। মনে হচ্ছে ওর মাথার ভেতর অমলেন্দু বিশ্বাসের যাত্রাপার্টি শো করছে। নগড়ব বাতিটা সরাসরি মুখের ওপর হামলা করায় চোখ বুজতে বাধ্য হলো। গুঙিয়ে উঠে কোথায় রয়েছে ভাবার চেষ্টা করল ও। ‘রানা?’ নারীকণ্ঠ। খোঁত করে জবাব দিল ও। ‘রানা?’ মহিলা বলল আবার, কণ্ঠে জরুরি তাগিদ।ব্যথা সত্ত্বেও চোখ খুলল রানা। ওয়ায়্যার ডোরটা তৎক্ষণাৎ নজর কাড়ল ওর। ম্যাকলিন। মেরী এন্ডারসন। তার শটগান। বোসান’স লকারের নিচে স্টোরেজ এরিয়ার কথা বলেছিল কে যেন। জেনের পেছনেও লেগেছিল ওরা। বাঁয়ে এক গড়ান দিতে জাহাজের এক পাশে দলামোচা হয়ে ওকে পড়ে থাকতে দেখল। চোখের নিচে কালসিটে পড়ে চেহারার সৌন্দর্যহানি ঘটেছে যুবতীর। ‘কে মেরেছে? কে বকেছে, কে দিয়েছে গাল?’ ‘ম্যাকলিন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ে কাবু করে ফেলেছে। তারপর মুখ বেঁধে স্ট্রেচারে করে নিয়ে এসেছে এখানে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে ক্যামেরাটা ভাঙেনি, আমার গলাতেই ঝুলছিল যদিও।’ ওর কাহিনীর দুটো বর্ণনা ঠিক যেন মিলছে না। ক্যামেরা ভাঙেনি, কথাটা এমন দায়সারাভাবে বলল যেন নিজে থেকেই চাইছে রানার মনে সন্দেহ জাগুক। এবং একজন এজেন্ট হিসেবে, ওর ন্যুনতম কমব্যাট স্কিল থাকা উচিত ছিল। ম্যাকলিনের সঙ্গে যুঝতে পারবে আশা করেনি রানা, কিন্তু খানিক ক্ষতি তো অন্তত করবে। সতর্কতাই বা অবলম্বন করল না কেন? অতিকষ্টে উঠে দাঁড়াল রানা। খুদে কম্পার্টমেন্টটা জাহাজের গতির চাইতে দ্রুত ও বেপরোয়াভাবে দুলছে। বমি পাচ্ছে রানার।

ম্যাকলিন ব্যাটা ড্রাগ দিতে পারল না? একটা নির্দিষ্ট সময় পর প্রভাব কেটে যায় ইঞ্জেকশনের। কিন্তু মাথায় আঘাত পেলে অনেক দিন, সপ্তাহ এমনকি মাস অবধি মাথা ঝিম্ঝিম্ করতে পারে। ‘রানা, তুমি ঠিক আছ তো!’ কোমর জড়িয়ে ধরল জেন রানার। নিচু করে বসিয়ে দিল স্টীল ডেকে, জাহাজের কিনারে বিশ্রাম পাচ্ছে রানার পিঠ। ‘তুমি ঠিক আছ তো?’ বলল ফের। ‘শালার জাহাজটা কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে,’ বলল রানা। ‘ম্যাকলিনের বাচ্চা ভাল বাড়িই মেরেছে।’ ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে চোখ পরীক্ষা করল জেন। পালস পরখ করল। তারপর আলতো করে হাত বোলাতে লাগল মাথার পেছন দিকে। জখমে হাত পড়তে ককিয়ে উঠল রানা। ‘হ্যাং অন,’ বলল জেন। মেনে নিল রানা। মনেপ্রাণে আশা করছে কোন চিড় খুঁজে পাবে না জেন।

উঠে দাঁড়িয়ে এসময় বলল যুবতী, ‘ফার্স্ট এইড খুব একটা বুঝি না আমি, রানা। কিন্তু মনে হচ্ছে না বড় ধরনের কোন আঘাত বা ফ্র্যাকচার হয়েছে। কয়েকটা দিন একটা ভোগাবে।’হাতঘড়ি দেখল রানা। তিনটে দুই। ‘দিনটা তো আজই, তাই না?’ ‘মানে যেদিন ওরা আমাদের বন্দী করল? হ্যাঁ, কেন, কি করবে?’ ‘খুব সাবধানে মুভ করব, যখন করব আর কি, এবং আশা করব ওপরে কোন কিছুই পার্মানেন্টলি রিঅ্যারেঞ্জ করা হবে না।’

‘আমি এখান থেকে বেরনোর কথা ভাবছিলাম,’ বলল জেন। ‘বুদ্ধি বাতলাও।’ ‘আমার ক্যামেরাটা আসলে একটা টুলকিট। অল্প কিছু যন্ত্রপাতি আছে ওর ভেতর।’

‘গুড। ওরা লাঞ্চ এনেছিল আমাদের জন্যে?’ ‘না।’ বিস্মিত দেখাল মেয়েটিকে। ‘মাথা গরম করার আগে অপেক্ষা করে দেখি ওরা আমাদের খাওয়ায় কিনা।’ বলল রানা। দ্বিমত করল না জেন। ধাতব খোলের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আকাশ-পাতাল ভেবে চলল রানা। বার দুয়েক আলাপচারিতার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল জেন। কতক্ষণ এখানে আটকা থাকতে হবে ভাবছে রানা। কারাগারটিতে টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। খাওয়ার পানিরও কোন বন্দোবস্ত দেখা যাচ্ছে না। বাকেট আর পানির জগ যদি না আসে তবে বিপদ হয়ে যাবে। চারটে বাজার একটু পরে, জেনের সঙ্গে খানিক মজা করবে ভেবে প্রশ্ন করল রানা, ‘শেপ মাইয়ারে ইঁদুর আছে মনে হয় তোমার?’ ‘ইঁদুর?’ ঈষৎ ভীতি ওর কণ্ঠে। ‘আমি তো কোন ইঁদুর-টিঁদুর দেখলাম না।’ ‘হয়তো নেইও,’ আশ্বস্ত করল রানা। ‘জাহাজটা যথেষ্ট পরিষ্কার- পরিচ্ছনড়ব। কিন্তু ইঁদুর যদি থাকে তবে এই নিচের দিকেই থাকবে।’ ‘কি করে জানো আমরা নিচের দিকে আছি?’

‘জাহাজের গায়ের বাঁক লক্ষ করো,’ বলল রানা, হাত বুলাল ঠাণ্ডা খোলে। ‘নড়াচড়ার ভঙ্গি আর শব্দ খেয়াল করো।’ ‘অনেকখানি নিচ পর্যন্ত বয়ে এনেছে আমাকে,’ মন্তব্য করল জেন। এরপর দশ মিনিটের নীরবতা। ‘হঠাৎ ইঁদুরের কথা উঠল কেন?’ বলে উঠল জেন।

‘সম্ভাব্য সবরকম বিপদের কথা মাথায় রাখা ভাল,’ বলল রানা। ‘ইঁদুর তাদের একটা। ওরা বেশি মারকুটে হয়ে উঠলে পাহারা দিতে পারি আমরা পালা করে। কামড় খাওয়ার চাইতে তাও বরং ভাল।’ শিউরে উঠল জেন। মনে মনে রানার স−্যাক্স ও সুটের সঙ্গে নিজের শর্টস আর হল্টারের তুলনামূলক বিশে−ষণ করল। লোভনীয় মাংস প্রচুর পরিমাণে প্রদর্শন করছে সে। এবং যে কোন বিচারবুদ্ধি সম্পনড়ব ইঁদুর, রানার রুক্ষ চামড়ার চাইতে, জেনের কোমল মসৃণ ত্বকে কামড় বসাতে বেশি আগ্রহী হবে। ‘রানা,’ কাতর কণ্ঠে বলল জেন। ‘ইঁদুরের কথা আর বোলো না। আমার ভয় করে।’ রানার গা ঘেঁষে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল মেয়েটা। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, রানার ঘড়ি যদি আঘাত সয়ে সঠিক সময় দেয় আরকি, ডিনার এসে পৌঁছল। মিস্টার জন কেয়ার, ফার্স্ট মেট রয়েছে দায়িত্বে। তার তুলনায় রীতিমত সদালাপী বলতে হয় ম্যাকলিনকে। ‘খোলে হেলান দিয়ে দাঁড়াও, যদি বাঁচতে চাও,’ ব্যস, এটুকুই বেরোল ড্যাম কেয়ারের মুখ দিয়ে। চারজন নাবিক সঙ্গে এনেছে সে। একজন সাবমেশিনগান তাক করে রেখেছে বন্দীদের তলপেট লক্ষ্য করে। অন্যরা ব্ল্যাঙ্কেট ও একটা বাকেট ছুঁড়ে দিল, তারপর খাবার ও পানি নামিয়ে রাখল খাঁচাটার ভেতর। ওয়ায়্যার ডোর লাগিয়ে দিল থোড়াই কেয়ার সাহেব, যথাস্থানে আঙটা গলিয়ে, বন্ধ করে দিল তালা। ‘পানি দেয়া হয়েছে সারা রাতের জন্যে,’ বলল সে। ‘সকালে বাকেট খালি করা হবে। মেটাল কভার আছে ওটার।’

বন্দীরা ধন্যবাদ দেবে সে সুযোগ না দিয়েই বিদায় নিল লোকগুলো। ট্রে দুটো তুলে নিয়ে বলল জেন, ‘চামচ-কাঁটাচামচ সব রেখে চলে গেল। ওরা কেয়ারলেস।’ ‘কিংবা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী,’

বলল রানা। ‘ওদেরকে আন্ডার- এস্টিমেট কোরো না। ম্যাকলিন বলেছে, জাহাজের সব ক্রু নাকিমালদিনির চর, কেবল ওই এঞ্জিনিয়ারিং অফিসাররা ছাড়া।’

‘ও, সেজন্যেই ওদেরকে কখনো দেখা যায়নি।’

‘ঘাপলাটা আমার আগেই ধরতে পারা উচিত ছিল,’ বলল রানা। ‘ঘোলাটে ব্যাপার আছে বুঝতে পারছিলাম কিন্তু আইডেন্টিফাই করতে পারিনি।’

‘সে দায়িত্ব আমারও ছিল, রানা, তোমার একার নয়,’ সান্ত্বনা দিল জেন।

খাবারের মান ওয়ার্ডরূমের চাইতে অনেক নেমে গেছে। ঠাণ্ডা গরুর মাংস, টোস্ট আর তেলতেলে আলু। তবু তা দিয়েই কোনমতে খাওয়া সারা হলে, ইস্পাতের ডেকে ব্ল্যাঙ্কেট বিছিয়ে বিছানা পাতল ওরা। তারপর বাকেটটা নিয়ে রাখল ফরোয়ার্ড কর্নারে। ‘চার্লটনরা এখন কি করছে কে জানে,’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল জেন। ‘ওরা কি আমাদের সাহায্য…’ কথা কেড়ে নিল রানা। ‘সে আশা কোরো না। ওরা…একজোড়া সৌভাগ্যবান, বিরক্তিকর মানুষ। যদি টেরও পায় শেপ মাইয়ারে কোন গোলমাল আছে তবু টুঁ-শব্দটা করবে না। জাহাজে তো নয়ই, কেপটাউনে নেমেও না।’ ‘কিন্তু এঞ্জিনিয়ারগুলো?’ ‘ভরসা করা যায় না,’ হতাশ করলরানা। ‘জাহাজে মালদিনির লোক আছে ত্রিশ-চলি−শ জন। কতগুলো নিরীহ এঞ্জিনিয়ার কী করবে? তাছাড়া ওরা কিছু জানেই না হয়তো।’

‘তাহলে আমার ক্যামেরাটা হয়তো…’ ‘আপাতত ভুলে যাও ওটার কথা। এখন প্রধান কাজ হচ্ছে এদের রুটিন আঁচ করা। আরও তিন-চারদিন লেগে যাবে সম্ভবত কেপ টাউন পৌঁছতে।’ মুখটা প্যাঁচার মত দেখাচ্ছে জেনের। রানার অনুমতি নিয়ে ঘরের একমাত্র বাতিটা নিভিয়ে দিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এবার শুয়ে পড়ে ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিল। জাহাজের নিচের অংশ বটে, কিন্তু অত বেশি শীত লাগছে না। কেমন এক গুমোট, স্যাঁতসেঁতে ভাব। বিল্জ্ থেকে আসা গন্ধ চরম অস্বস্তিকর। ‘আঁধারে ইঁদুর আসবে না তো, রানা?’ ‘সেজন্যেই বাতিটা জ্বেলে রেখেছিলাম।’
‘ধুরো, মরুকগে, মুখের ওপর আলো নিয়ে ঘুমানর চাইতে ইঁদুরও ভাল। আচ্ছা, গুডনাইট, রানা।’

‘গুডনাইট।’

কয়েক মিনিট জেগে রইল রানা। দপ্দপ্ করছে মাথার যন্ত্রণাটা। তারপর এমনই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল, টেরই পেল না, কোন্ ফাঁকে সকাল ছটা বেজে গেছে।

সম্ভাব্য পরিকল্পনা আঁটতে তিনটে দিন লেগে গেল রানার। জেনকে সঙ্গে নিয়ে ছকটা এঁকেছে ও। ইতোমধ্যে মাথার জখমটা সেরে এসেছে প্রায়। আরেকবার একই জায়গায় বাড়ি না খেলে ওটা আর ভোগাবে না।
গ্রেপ্তারকারীরা দিনে তিনবার করে আসছে, নিশ্চিত হয়েছে ওরা। একবার উচ্ছিষ্ট তুলে নিয়ে যাচ্ছে, একবার বাকেট পাল্টে দিচ্ছে এবং আরেকবার জগভর্তি পানি আনছে। ছটার আগ দিয়ে ডিনার সার্ভ করে, তারপর বাকি সময়টুকু আর বিরক্ত করে না ওদের।
ওয়ায়্যার ডোরের কব্জাগুলো সম্পর্কে রানা বিশেষ ভাবে আগ্রহী। তিন বল্টু দিয়ে দৃঢ়ভাবে ধাতুদণ্ডে আঁটা ও দুটো, এবং আরও তিনটি বল্টু ধাতব দরজাটায় আটকে রেখেছে ওগুলোকে। বল্টুগুলোকে ঢিল করতে লিভারেজ ব্যবহার করা যাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে রানার।
‘তোমার সঙঊু-ড্রাইভারটা লাগবে, জেন,’ বলল রানা।
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টলে উঠল জেন। দুটো ঢেউয়ের মাঝে পড়ে টালমাটাল এমুহূর্তে শেপ মাইয়ার।
‘কি করবে ওটা দিয়ে?’
‘বিসিআইতে একটা মেসেজ পাঠাতে চাই, তারপর আবার এখানে এসে আটকা পড়ব তোমার সাথে। আমরা কোথায় আছি জানলে, ঢাকা বুঝবে কি করা উচিত, বা ইথিওপিয়ান কর্তৃপক্ষকে কতটা জানানো দরকার।’
একপাশে আবার কাত হয়ে গেল জাহাজ। ‘এমন রাতে বেরোয় কেউ!’ ত্রস্ত কণ্ঠে বলল জেন।
‘এটাই তো সুযোগ। সাপ্লাই নিতে লকারে কারও আসার সম্ভাবনা নেই। আমরা কোন শব্দ-টব্দ করলেও শুনতে পাবে না।’
‘স্রোতে যদি আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়?’
‘ভাসালে আমাদের নয়, আমাকে ভাসাবে। এখন বলো দেখি, এই এরিয়ার হ্যাচ কোনদিকে খোলে। আমাকে তো অজ্ঞান করে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই দেখেছ?’
‘আমরা মেইন ডেকের চার ডেক নিচে আছি,’ জানাল জেন।
‘বো-র কাছে, ডেক যেখানে তৈরি হয়েছে, ওখানে একটা হ্যাচ আছে। বড়সড় এক হ্যাচ আর মই নেমেছে দ্বিতীয় ধাপে। নিচের তিন লেভেলে, স্কাট্লের পাশে লম্বালম্বি মই রয়েছে।’
‘মেইন ডেকের হ্যাচটা কি ব্রিজের দিকে মুখ করে খোলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তারমানে ধরা পড়ার চান্স আরও বাড়ছে।’
ক্যামেরাটা খুলতে লাগল জেন। রীলের মাঝখান থেকে বেরোল পিচ্চি এক সঙঊুড্রাইভার। কাজেই, রানাকে একপাটি জুতো খুলে, কব্জার পিন মুক্ত করতে হীল ব্যবহার করতে হলো। উন্মাদের মত দুলে উঠল জাহাজটা, এতখানি দুলুনি সইতে হচ্ছে ওরা একদম সামনের দিকে রয়েছে বলে। পিনগুলো আলগা হয়ে গেলে, দরজাটাকে যথাস্থানে ধরে রাখল জেন এবং রানা ওগুলোকে তুলে দিল ওপরদিকে। এবার বের করে নিয়ে পিনগুলোকে রেখে দিল ব্ল্যাঙ্কেটের ওপর, এবং দু’জনে মিলে বাইরের দিকে ঠেলা দিতে লাগল তারের জালটাকে। জোর ঘষা খেয়ে ঘর-ঘর শব্দ তুলল কব্জা, তারপর বিচ্ছিনড়ব হয়ে গেল। আলগোছে দরজাটা এক মানুষ বেরনোর মত ফাঁক করল রানা। দু’মুহূর্ত পরে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে জেনের সঙ্গে আলাপটা সেরে নিল ও।
নটা বাজেনি এখনও। ঠিক হলো এগারোটার আগেই রেডিও শ্যাকে পৌঁছবে রানা। জেন তথ্য জোগাল, মেরী এন্ডারসন এসময় ওটা বন্ধ করে ক্যাপ্টেনের কেবিনে যায়। রানা মনেপ্রাণে কামনা করছে ওসময় শিথিল থাকবে পাহারা, ডিউটির অর্ধেক সময় পার করে ক্লান্ত হয়ে পড়বে লুকআউটরা।
স্কাট্ল তিনটে পেছনে বন্ধ করল রানা, খোলা হয়েছে ওগুলো বিশেষ নজর না দিলে বোঝার উপায় নেই। প্রয়োজনের সময়, হুইলে হালকা এক মোচড় দিলেই রানা খুলে ফেলতে পারবে। সেকেন্ড ডেকের চারধারে অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নিল রানা, কিন্তু কোন ফাউল-ওয়েদার গিয়ার খুঁজে পেল না। কাজেই হ্যাচের মধ্যখানের স্কাট্ল বেয়ে উঠে পড়ল ও-মেইন ডেকে গিয়ে মিশেছে এটা-এবং বোসান্স্ লকার তল−াশী করে দেখল। কোন এক নাবিক পুরানো এক মোটা কাপড়ের ডাংগ্যারী আর একটা ফাউল-ওয়েদার জ্যাকেট ফেলে গেছে একটা বিনে। প্যান্ট ও জুতো খসিয়ে আঁটো ডাংগ্যারী আর জ্যাকেটটা গায়ে চড়াল রানা।
শেপ মাইয়ার এ মুহূর্তে হেলেদুলে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ছুটছে।
জাহাজের বো যখনই দেবে যাচ্ছে ঢেউয়ের নিচে ফো’ক্যাসলে আছড়ে পড়ছে পানি। স্টোরেজ এরিয়ায় আরও অনুসন্ধান চালিয়ে বড় এক টুকরো ক্যানভাস ও একটা অয়েলস্কিন হ্যাট খুঁজে পেল রানা। আরও দু’টুকরো ক্যানভাস আবিষ্কার করল ও। তোয়ালে হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। বড় ক্যানভাসটা হ্যাচের পাশে ডেকে রাখবে ঠিক করল। ফাউল-ওয়েদার জ্যাকেট খুলে ফেলল ও, শার্ট খুলে, ট্রাউজার ও জুতোর সঙ্গে রেখে, জ্যাকেটটা পরে নিল আবার।
বাতি নিভিয়ে দিল রানা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, হ্যাচের প্রতিটি শিক খোলার প্রকাণ্ড লিভারটার ওপর হাত রাখল ও, অপেক্ষা করল জাহাজের বো যতক্ষণ না দেবে গিয়ে ফের উঠতে শুরু করল। তারপর হ্যাচ খুলল, ওটা গলে বেরিয়ে, ভেজা ডেকের ওপর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিল। ফরোয়ার্ড সুপারস্ট্রাকচারের উদ্দেশে দৌড়াচ্ছে ও।
পতন ঘটল আবার জাহাজের বো-র। পেছনে উঁচু পানির দেয়াল অনুভব করল রানা। সুপারস্ট্রাকচারের গায়ে শরীর ছুঁড়ে দিয়ে, কোমর সমান উচ্চতার সেফটি রেইল খপ করে থাবা মেরে ধরতে চাইল। জোরাল আঘাত হানল ওর গায়ে ঢেউটা। ধাম করে ধাতব বাড়ি খেতেই হুশ করে বুক থেকে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেল রানার। ওকে ঘিরে পাক খাচ্ছে পানি, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে ফেলতে চাইছে কালিগোলা রুদ্ররূপী আটলান্টিকে। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রইল ও রেলিং, বুক ভরে নিল বাতাসে, দস্তুরমত লড়াই চালাচ্ছে ঝিম্ঝিম্ অনুভূতিটার সঙ্গে। মস্তিষ্কের নির্দেশে সাড়া দিতে চাইছে না পেশি।
পানির স্তর গোড়ালির কাছে নেমে এলে, পোর্টসাইডের দিকে ঘুরে পথ করে নেয়ার চেষ্টা করল রানা। রেইল ধরে রেখে সুপারস্ট্রাকচারের গা ঘেঁষে রইল ও। ব্রিজটা তিন ডেক ওপরে, এবং অফিসার কিংবা লুকআউট কারোরই থাকার কথা নয় এখন ওখানে। হেলমসম্যানের সঙ্গে গাদাগাদি করে পাইলটহাউজে থাকবে ওরা। রানাকে ডেক ধরে ছুটতে যদি দেখে না থাকে, তবে এখন আর দেখবেও না।
পোর্টসাইডের এক মইয়ের কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতে তেড়ে এল পরের ঢেউটা। দু’হাতে এক রাং জড়িয়ে ধরে ঝুলে রইল রানা। পানির ভাসিয়ে নেয়ার শক্তি আগেরবারের চাইতে এবারে কম হলেও, জাহাজের পাশ ঘেঁষে রয়েছে বলে রানার সাগরে ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। ও সুপারস্ট্রাকচারের বাঁক ঘুরতে না ঘুরতেই ডেকের ওপর দিয়ে ধেয়ে এল তিন নম্বর স্রোতটা। অল্প একটুখানি পানি কেবল ভেজাতে পারল ওর গোড়ালি।
সুপারস্ট্রাকচারের আফটার ওয়ালে হেলান দিয়ে দম ফিরে পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করল রানা। নিরক্ষরেখার কাছাকাছি রয়েছে ওরা। ফলে, পানি অতখানি ঠাণ্ডা নয় যে পায়ের পাতা অসাড় করে দেবে। সাগরের বিরুদ্ধে প্র ম বাউটে জিতে গেছে রানা। কিন্তু আরও বিপজ্জনক দ্বিতীয় দফা লড়াই এখনও বাকি রয়ে গেছে-বোসানস লকারে ফিরতি যাত্রা। তার আগে, রেডিওশ্যাকে ঢুকে, মেরী এন্ডারসনকে কাবু করে, মেসেজ পাঠাতে হবে।
দুই সুপারস্ট্রাকচারের মাঝখানের মেইন ডেকটা পরীক্ষা করল রানা। বেশিরভাগ জায়গাই ডুবে আছে অন্ধকারে, যদিও পোর্টহোলগুলো থেকে চুইয়ে আফটার সুপারস্ট্রাকচারে এসে পড়েছে ছোপ ছোপ আলো। জাহাজের মাঝখানটার দিকে সরে এল রানা এবং চট করে খুলেই লাগিয়ে দিল হ্যাচটা। টিপে টিপে পা ফেলে এবার এগিয়ে চলল ও এবং রেডিও শ্যাকের খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কান পাতল।
কিছুই শোনা গেল না। রেডিও অপারেটর কোন ব্যান্ড যদি মনিটর করেও থাকে, হয় ব্রিজে বাজছে সেটা আর নয়তো এয়ারফোন ব্যবহার করছে। ভেতরে উঁকি দিল রানা। একাকী মেয়েটি। দ্রুত পায়ে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল রানা, ভাবখানা এমন যেন শ্যাকে আসার যথার্থ কারণ আছে ওর।
বাঁয়ে কন্ট্রোল প্যানেল সামনে নিয়ে বসে আছে মেরী। কিছু টের পেয়ে মুখ তুলে তাকানোর আগেই ডান হাতের মাঝারি ওজনের এক কোপ পড়ল ওর ঘাড়ের ওপর। মুহূর্তে জ্ঞান হারাল মেয়েটি। তাড়াতাড়ি ওর পড়ন্ত দেহটা ধরে ফেলে, সামনের কী থেকে তুলে নিল। জোরাল গোলমাল হয় হোক, সার্কিট সংযুক্ত নয় ব্রিজে কিংবা ক্যাপ্টেনের কেবিনে। এখানে কিছু ঘটলে এখনই জানবে না ওরা। সাবধানে মেয়েটাকে চেয়ারের সামনে মেঝেতে শুইয়ে দিল রানা। আশা করল জ্ঞান ফিরে পাবার পর কি ঘটেছে স্পষ্ট মনে করতে পারবে না মেয়েটা; মনে করবে ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়ে ব্যথা পেয়েছে ঘাড়ে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে সাবধানে দরজা ভেজিয়ে ছিটকিনি মেরে দিল রানা। মেরীর পালস চেক করে নিশ্চিন্ত হলো, চলছে। অতিকায় ট্র্যান্সমিটারটা স্টারবোর্ড বাল্কহেডের গায়ে ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে। ওটার দিকে চেয়ে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করল রানার। ও যা ভেবেছিল তার চাইতে অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী জিনিসটা।
ফ্রিকোয়েন্সি সেট করে, চাবি তুলে নিয়ে ট্রান্সমিটারের সামনে সরাসরি জুড়ে দিল। কন্ট্রোল বোর্ড কিভাবে কাজ করে অতশত ভাবার সময় নেই। রানা আশা করছে ডায়ালগুলো ওটার তুলনামূলকভাবে নিখুঁত। বিসিআইয়ের ফ্রিকোয়েন্সিতে ডায়াল সেট করল রানা। জাহাজ কোথায় আছে জানে না রানা, তবে বিসিআই হেডকোয়ার্টারের রেঞ্জের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই রয়েছে ও। যে-ই ডিউটিতে থাকুক না কেন, নিশ্চয়ই কাজ ফেলে ঘুমাচ্ছে না।
সাদামাঠা সিচুয়েশন রিপোর্ট পাঠাল রানা। কামনা করছে, যে-ই কপি করবে রাহাত খানের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেবে ওটা।
‘এম আর নাইন ধরা পড়েছে। মিশন নিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমেরিকার টনক নড়ায় এজেন্ট পাঠিয়েছে। এম আর নাইন কাজ করছে তার সঙ্গে। চলেছে নির্ধারিত গন্তব্যে। -এম আর নাইন।’ দু’বার পাঠাল ওটা রানা। তারপর কন্ট্রোলবোর্ডে চাবি রেখে, ট্র্যান্সমিটারে আগের ফ্রিকোয়েন্সি রিসেট করল। সন্তর্পণে এবার চলে এল দরজার কাছে।
প্যাসেজওয়ে থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল এসময়: ‘রেডিও শ্যাক বন্ধ কেন?’
‘বুড়োর কেবিনে আজ আগেভাগেই চলে গেছে হয়তো।’
‘কেন, একমাস পূরণের আগেই নিজের ডোজ শেষ করে ফেলেছে?’
‘বুড়োরটা বুড়ো ওকে দিয়ে দেবে কষ্ট হলেও; বাজি ধরতে পারো।’
‘তুমি বা আমি হলেও দিতাম। বিনিময়ে যা পেতাম সেটাও কম না!’
সশব্দ হাসি। মেইন ডেকের ওপরে যাওয়ার হ্যাচটা বন্ধ হলো দড়াম করে। লোক দুটো ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলছিল। আফটার সুপারস্ট্রাকচারে ওদের পৌঁছতে কমপক্ষে দু’মিনিট লেগে যাবে।
হঠাৎ একটা চিন্তা ঘাই মারল রানার মগজে। কিসের ডোজ? তাহলে কি কোনরকমের ড্রাগ দিয়ে লোকগুলোকে নিজের পক্ষে রেখেছে মালদিনি? ডানাকিলদের বেলায় সেটা সত্যি হতেও পারে, কিন্তু নিও ফ্যাসিস্টদেরও বারোটা বাজাচ্ছে লোকটা? ম্যাকলিন? দেখে তো মনে হয় না। নাকি সে ব্যতিμম? ভিনড়ব খাতে চিন্তাস্রোত ঘুরিয়ে দিল রানা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ওকে ধরিয়ে দেবে না তো? কিন্তু যুক্তিটা অসার ঠেকল নিজের কাছেই। শেপ মাইয়ারের মত জাহাজে এত সূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ থাকতে পারে না।
আলগোছে দরজা দিয়ে বেরিয়ে, হ্যাচের উদ্দেশে তড়িঘড়ি পা চালাল রানা। বিনা বাধায় মেইন ডেকে বেরিয়ে এল। পেছন দিক দিয়ে ঘুরে, পথ করে নিয়ে সুপারস্ট্রাকচারের পাশে চলে এল রানা। এমনভাবে সময় মেপে দৌড়টা দিল, যাতে বো ডিঙিয়ে পানি আসার আগেই মইয়ের নাগাল পায়। টায়ে টায়ে পরীক্ষাটায় পাশ করল। দ্বিতীয় দফা চেষ্টায় সুপারস্ট্রাকচারের সামনের অংশে পৌঁছতে পারল ও। এবং ঢেউয়ের আঘাতে আবারও ছিটকে গিয়ে পড়ল জাহাজের ধাতব দেহে। হ্যান্ডরেইল আঁকড়ে ধরে টিকে থাকতে হলো। সামনে যে এগোবে, শরীরে জোর পাচ্ছে না রানা। কতক্ষণ লড়াই চালাতে পারে একটা মানুষ ফুঁসে ওঠা মহাসাগরের বিরুদ্ধে? আরও দুটো জলোচ্ছ্বাস আসতে দিয়ে সুপারস্ট্রাকচারের বাড়ি হজম করল রানা।
এতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্রী আবহাওয়া সহায়তা করেছে ওকে। কিন্তু এখন, এক ছুটে হ্যাচের কাছে পৌঁছতে না পারলে, ভেসে যেতে হবে জাহাজ থেকে। কাজটা মোটেই সহজ নয়। কার্গো বুম ঘেঁষে ছোটার চেষ্টা করবে ও। আবছা কালো এক আকৃতির রূপে ওটা ধরা দিচ্ছে চোখে। একবারের চেষ্টায় হ্যাচের কাছে যেতে না পারলেও, বুম আঁকড়ে ধরে সাগরের ঝাপ্টা কাটাতে পারবে আশা করছে রানা।
পানির ঢল এল আবারও, আগেরগুলোর মত উঁচু কিংবা জোরদার নয় যদিও। বো উঠে যেতে এবং পানি কমে যেতে শুরু করতেই ছপ ছপ করে সামনে এগোল রানা, কাত হয়ে পড়া পিচ্ছিল ডেকে পতন সামলাতে রীতিমত হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। হাঁটু থেকে নেমে গোড়ালির সমান এখন পানি; ধুপধাপ পা ফেলে যত দ্রুত সম্ভব ছুটছে রানা। কার্গো বুম অতিμম করল। সাঁত করে আচমকা নাক দাবাল জাহাজ-এতই ত্বরিত গতিতে যে দিগ্বিদিক্জ্ঞানশূন্য রানা যথাসময়ে থমকে দাঁড়িয়ে বুম ধরতে ব্যর্থ হলো। বো ঘিরে গল গল, ছপাৎ ছপাৎ নানারকম শব্দ করে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে পানি। মুখ তুলে চাইতে, মাথার ওপরে সাদা ফেনার মুকুট লক্ষ করল রানা। নিচু যে স্ট্রাকচারটার উদ্দেশে এগোচ্ছিল
ঢাকা পড়ে গেছে সেটা।
সামনে ঝাঁপ দিল মাসুদ রানা অন্ধের মত, হ্যাচ কিংবা মেটাল লেজ, কোন একটার নিচে আড়াল নিতে হবে। কামনা করছে সময়ের হেরফের করে প্রিয় মাথাটা ছাতু হতে দেবে না। টনকে টন পানি আছড়ে পড়ছে নিচে টের পাচ্ছে। শরীর এ মুহূর্তে প্রায় আনুভূমিক ওর, খোলার ও বন্ধ করার লিভারটা বাগে পেতে হাতড়াচ্ছে দুহাত। দেহের নিুাংশে আঘাত হানল পানি, ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওকে; ডেকের দিকে টেনে হিঁচড়ে ফিরিয়ে নিতে চাইছে সুপারস্ট্রাকচারের কাছে-ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে জাহাজ থেকে। শেষ মুহূর্তে লিভারের নাগাল পেল রানার আঙুল। বাঁ হাতটা পিছলে গেলেও ডান হাত ওটাকে ছাড়ল না, কব্জি মুচড়ে গিয়ে অসহ্য ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল বাহুমূল পর্যন্ত। কাঁধের পেশি ছিঁড়ে যায় কিনা ভয় পেল রানা।
আঁটো ড্যাংগারির বাঁধনটা খুলে গেল কোমরের কাছ থেকে। ড্যাংগারিটা টেনে খানিক নামিয়ে দিয়েছে প্রবল স্রোত। ওভারহ্যাঙের নিচে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে পানি, রানার চোখে-মুখে লবণ ছিটিয়ে শ্বাস কেড়ে নিতে চাইছে। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মত মাথার জখমটা এসময় দাপাতে আরম্ভ করল। শেপ মাইয়ার এক্ষুণি ঢেউয়ের নিচ থেকে নাক না তুলতে পারলে, ফো’ক্যাসলে ভাসমান ওই আলগা যন্ত্রপাতিগুলোর মত একই দশা হবে রানার।
অবিশ্বাস্য ধীর গতিতে, মনে হলো ওর, জাহাজটার বো শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করল। গাল চাটা ছেড়ে শরীরের কাছ থেকে হড়হড় করে সরে গেল পানি। গোড়ালির কাছে তালগোল পাকিয়ে গেছে ভেজা ড্যাংগারি, কাজেই হ্যাচ লিভারে হাতের চাপ দিয়ে ওপরে টেনে তুলল নিজেকে রানা। মরিয়ার মত লাথি মেরে চুপচুপে জিনিসটা দেহ থেকে খসাল ও। ছপাৎ করে ডেকের ওপর পড়ে ভেসে চলে গেল ওটা বানের পানিতে। জাহাজটা এ মুহূর্তে তরতর করে উঠে যাচ্ছে ওপরদিকে, ঢেউয়ের চূড়ায় ক্ষণিকের জন্যে চড়ে আরেকটা বিশাল ঢেউ ভেদ করার জন্যে ঝাঁপ দিল।
লিভার তোলার চেষ্টা করল রানা অনর্থক। ভুলটা বুঝতে পারল ও। শেষ ঢেউটা সামলানোর সময় রানার দেহের চাপ খেয়ে শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে ফাঁকগুলো। ওয়াটারটাইট বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে এত অটুট দৃঢ়তার দরকার পড়ে না। লিভার কেন নড়ে না এর ওপর বিশেষজ্ঞ হলেই বা লাভ কি? পরবর্তী ঢেউটা তো রানার জ্ঞান-গরিমার জন্যে ছাড় দেবে না। আরেকটা প্রবল আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা কি আছে ওর?
শেপ মাইয়ারের বো-র দ্রুত অবনতি ঘটছে। দেহ সাপের মত গুটিয়ে বাঁ কাঁধ দিয়ে আঘাত করল রানা লিভারে। খুলে ওপরদিকে উঠে গেল ওটা। টান মেরে হ্যাচ খুলল রানা। কিনারা আঁকড়ে ধরে, কাত হয়ে শরীর গলিয়ে দিল, বাঁ হাত বোসান্স্ লকারের ভেতরকার লিভার খুঁজছে। সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তে, ধাতব লিভারটা হাতে পেয়ে গেল। দুম করে পেছনে লেগে গেল হ্যাচ। রানা গর্ত বন্ধ করার চেষ্টা করতে মাথার ওপরে ডেকে, আছড়ে পড়ল পানি। হ্যাচের মাঝখানের খুব কাছে রয়েছে ওর হাত। পেছনে সরে এসে, কসরৎ করে শরীর মোচড়াল রানা, লিভারের ওপর সজোরে পড়ল ডান হাত। কিনারা গলে চুইয়ে ঢুকল পানি, কিন্তু বন্ধ হয়ে গেল ফাঁক। ইস্পাতের হ্যাচে বাড়ি খেল ওর মাথা। আগুন ধরে গেল যেন খুলির ভেতর, গুঙিয়ে উঠল রানা। মাথার ভেতর ঝলসে উঠল একাধিক উজ্জ্বল বাতি। হাঁটু ভেঙে স্টীল ডেকে পেতে রাখা ক্যানভাসের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ও। দুলে উঠল গোটা দুনিয়া-জাহাজের গতির সঙ্গে তাল রেখে নাকি নতুন আঘাতটার কারণে, জানে না রানা। মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে মাথা।
সামুদ্রিক ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে ধুঁকতে ধুঁকতে এগিয়ে চলেছে শেপ মাইয়ার।

দুই, বড়জোর তিন মিনিট বিশ্রাম নিল রানা। সময়টুকু যদিও ঢের লম্বা মনে হলো ওর কাছে। হাতঘড়ি বলছে দশটা পঁয়ত্রিশ। কিন্তু এখন নটা পঁয়ত্রিশ কিংবা এগারোটা পঁয়ত্রিশ হওয়াও বিচিত্র নয়। টাইম জোনের পরিবর্তন শুধুমাত্র আন্দাজের ওপর ধারণা করছে রানা।
সুইচটা খুঁজে পেয়ে জ্বালল ও। খুব সাবধানে, বোসানস লকার ত্যাগের আগে মাথায় এঁটে বসানো হ্যাটটা খুলল। একটুকরো ক্যানভাসে হাত দুটো মুছে নিয়ে চুলে আঙুল বুলাল রানা। কোণার দিকগুলো সামান্য ভিজে হলেও চাঁদিটা শুকনো খটখটে। হ্যাটখানা দুমড়ে মুচড়ে ভেজা জায়গাগুলো ঢাকার চেষ্টা করল ও।
ফাউল-ওয়েদার জ্যাকেট শরীরচ্যুত হলো এরপর। ওটাকে ক্যানভাসে ফেলে দিয়ে গা শুকোতে লাগল রানা। আন্ডারশর্টস ওর ভিজে জবজব করছে। কাজেই খুলে ফেলে নিংড়ে নিতে হলো। শরীর ভেজা নয়, শুকনো; নিশ্চিত হয়ে, ক্যানভাসের ছোট টুকরো দুটো আর জ্যাকেটটা গুটিয়ে গোল করে নিল রানা। এবার ক্যানভাসের বড় খণ্ডটার ভেতর ওগুলো ভরে বান্ডিলটা বয়ে নিয়ে গেল বোসানস লকারের ও মাথায়। আরও কিছু গিয়ার ও ক্যানভাসের পেছনে একটা বিনে গুঁজে দিল ওটা।
ক্যাঁচ করে হঠাৎ একটা শব্দ হলো। হাতের কাছে এক মেটাল পাইপ পেয়ে তুলে নিয়ে পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল রানা। নিচের লেভেলে চলে যাওয়া স্কাট্লটা খুলে যাচ্ছে। লাফ দেয়ার জন্যে ঝুঁকেছে এমনিসময় মেঘবরণ দীঘল চুল ও কালো কুচকুচে একজোড়া চোখ দেখতে পেল।
‘রানা?’ জেন এসেক্সের কণ্ঠস্বর।
‘আরেকটু হলেই মরতে।’
‘ওই গর্তে অপেক্ষা করতে করতে পাগল হওয়ার দশা। মেসেজ পাঠাতে পেরেছ?’
জানাল রানা। ডেকের যেখানটায় পানি ইঞ্চি দুয়েক ছিটকে উঠছে সে জায়গাটা নির্দেশ করল ও। ‘এসো না,’ বলল। ‘নিচে পানির ছাপ না পেলে প্রমাণ হবে জেলখানা থেকে বেরোইনি আমরা। মইয়ের কাছ থেকে এক মিনিট একটু দূরে থাকো।’
তখনও নগড়ব, জুতো-মোজা, খাকি ট্রাউজার, পরিচ্ছনড়ব শার্ট ও ভেজা শর্টস জড় করল রানা। ঝুঁকে পড়ে স্কাট্ল দিয়ে ছেড়ে দিল ওগুলো নিচের ডেকে। তারপর মুখ রাখল নিচে, জেনকে যাতে দেখতে পারে।
‘একটা কাপড় লাগবে পা মোছার জন্যে।’
জেনকে মইয়ে না দেখতে পাওয়া অবধি অপেক্ষা করল রানা, এবার হ্যাচের ওপর বসে সতর্কতার সঙ্গে পা দুলিয়ে নামিয়ে দিল স্কাট্লে। মোটা, রুক্ষ কাপড় দিয়ে জেন পা মুছে দিচ্ছে টের পেল। ‘হয়েছে,’ বলল জেন।
মই বেয়ে ত্বরিত নেমে গেল রানা, স্কাট্লটা টেনে পেছনে বন্ধ করে, হুইল ঘুরিয়ে দিল। ডেকে পৌঁছে জেনের দিকে চাইল ও। রানার পাশে দাঁড়িয়ে যুবতী, হাতে ডেনিম শর্টস। ‘এটা ছাড়া আর কিছু পেলাম না।’
‘চলো,’ আদেশ করল রানা। ‘খাঁচায় ফিরে যাই।’
প্যান্ট পরে নিল ও, কিন্তু মাথা ঘামাল না অন্যান্য কাপড়-চোপড় নিয়ে। ভেজা শর্টস পরেনি জেন। জেলখানায় ফিরে ব্ল্যাঙ্কেটে পোশাকগুলো ছুঁড়ে দিল ওরা। রানা ওয়্যার ডোর চেপে ধরে যথাস্থানে ওটাকে টেনে ফেরানোর চেষ্টা করছে, ওদিকে ব্ল্যাঙ্কেট হাতড়ে কব্জার পিনগুলো কুড়িয়ে নিল জেন। দশ মিনিট লেগে গেল ওগুলোকে জায়গা মত বসাতে।
আফটার বাল্কহেডের গায়ে হাত বুলিয়ে আঙুল নোংরা করল রানা। পিনে আর কব্জায় নোংরা মাখাচ্ছে ও, ইতোমধ্যে ক্যামেরা জুড়ে ফেলল জেন।
ঠিক পঁচিশ মিনিট বাদে এল ওরা। ব্ল্যাঙ্কেটে তখন পাশাপাশি শুয়ে রানা ও জেন। স্কাট্ল খুলে যেতে সশস্ত্র এক নাবিক প্রবেশ করল কারাগারে।
‘আমাকে সামলাতে দাও,’ ফিসফিস করে বলল জেন। দ্বিমত করল না রানা।
‘ওরা এখানেই আছে,’ বলল সেইলর ম্যাকলিনকে। ‘বললাম না তোমাকে…’
‘জাহাজ কি ডুবছে?’ হঠাৎ তীক্ষ্ন চিৎকার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল জেন, আঁকড়ে ধরেছে তারের জাল। ‘রানা, আমরা ডুবে যাচ্ছি!’
‘বাজে কথা ছাড়ো,’ ধমকে উঠল ম্যাকলিন।
তার ধরে টানাটানি লাগিয়ে দিল জেন। ‘আমাকে এখান থেকে বেরোতে দাও!’ বলে উঠল ও। ওর আক্রমণের ফলে রীতিমত কাঁপুনি উঠে গেছে দরজাটার। ‘আমি এভাবে ডুবে মরতে চাই না, বাঁচার একটা সুযোগ চাই।’
‘চোপ!’ কড়া ধাতানি দিল ম্যাকলিন।
‘ওকে ধমকাচ্ছ কেন?’ কঠোর কণ্ঠে জবাব চাইল রানা।
‘তোমার খুব লাগছে বুঝি?’ বিদ্রূপ ঝরল ম্যাকলিনের কণ্ঠে।
‘আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও,’ হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত
চেঁচাচ্ছে জেন, দু’চোখে বান ডেকে এনেছে। ‘তুমি যা বলবে তাই করব। দোহাই লাগে, বাঁচাও আমাকে।’
‘কেন, আজ সন্ধেবেলা বেরোওনি তুমি?’
‘কি বলছ আবোল তাবোল,’ বলল জেন, ফোঁপানির জোর আরও বাড়ল।
‘থামবে তুমি?’ গর্জে উঠল ম্যাকলিন। ‘নাকি পেটে গুলি করতে বলব?’ এবার রানার দিকে চাইল। ‘কতক্ষণ ধরে চলছে এই ন্যাকামি?’
‘সেই সন্ধে থেকে। সাগর যখন থেকে ফুঁসে উঠল। মেস স্টুয়ার্ডকে দিয়ে মিস জেনের জন্যে এক শট হুইস্কি পাঠাও না কেন?’
‘পাগল নাকি? ডেকের অবস্থা জানা আছে তোমার?’
‘কি করে জানব?’
‘তা বটে।’ কম্পার্টমেন্টের চারধারে নজর বুলাল ও। গার্ডের উদ্দেশে বলল, ‘ক্যাপ্টেনকে বললাম এরা এখানে আছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। প্রেমিকা ঘুমের ঘোরে ব্যথা পাওয়ায় মাথা খারাপ হয়ে গেছে বুড়োর।’
রানা বা জেন বেরতে পেরেছিল ম্যাকলিন তা বিশ্বাস করে না। স্বস্তির শ্বাস গোপন করল রানা।
ম্যাকলিন সঙ্গীকে নিয়ে চলে গেলে রানার কাছ ঘেঁষে এল জেন। ওকে হাসতে দেখে ভ্রূ কোঁচকাল রানা। ‘চালিয়ে যাও। ওরা হয়তো কান পেতে আছে।’
আরও মিনিট চারেক অভিনয় পর্ব চলল জেনের। রানা মুগ্ধ হয়ে গেল ওর পারফরমেন্স দেখে।
‘মেরী এন্ডারসনের কথা কি যেন বলল লোকটা?’ যুবতী জিজ্ঞেস করল শেষমেষ।
খোলাসা করে পুরোটা জানাল ওকে মাসুদ রানা।
পরদিন রেড সি-তে আটকা পড়ে গেল ওরা। শেপ মাইয়ারের পাশে এসে ঠেকেছে এক আরবী সমুদ্রগামী জাহাজ। ফরোয়ার্ড কার্গো বুম স্থানীয় জাহাজটিতে চালান করে দিল মিসাইলগুলো। কার্গো নেটে করে ডাউতে তুলে দেয়া হলো রানা ও জেনকে, নরওয়েজিয়ান নাবিকরা কভার করল পেছন থেকে, এবং সামনে থেকে রাইফেল তাক করে ধরল ডাউয়ের আরব আগন্তুকরা। মিস্টার ম্যাকলিন সঙ্গ দিল রানাদের।
কাঠের রেইলে হেলান দিয়ে শেপ মাইয়ারকে সরে যেতে দেখল রানা। প্র মে, শুধুমাত্র ওটার পোর্ট রানিং লাইট দেখতে পেল; তারপর বড় হলো ফাঁকটা, দেখা দিল স্টার্নের সাদা রেঞ্জ লাইট।
পেছন থেকে এসময় আরবী ভাষায় আদেশ জারি হলো। বুঝতে পেরেছে তার লক্ষণ দেখাল না রানা।
‘তোমার প্যাসেজ মানি কাজে লাগল,’ বলল ম্যাকলিন।
‘মালদিনি?’
‘হ্যাঁ। তুমিও যাচ্ছ তাঁর কাছে।’
ম্যাকলিনের আদেশে, নিচের ডেকে নিয়ে গিয়ে কেবিনে বন্দী করা হলো রানা ও জেনকে। শেষ যে জিনিসটা দেখতে পেল রানা সেটা হচ্ছে তেকোণা এক পাল, উঠে যাচ্ছে ওপরদিকে। জাহাজের চলনভঙ্গি নিশ্চিত করল মাটির ঢিবির ফাঁকফোকর দিয়ে ইথিওপিয়ান কোস্টলাইনের উদ্দেশে পথ করে নিয়ে এগোচ্ছে ওটা।
দেয়াল ভেদ করে টুকরো-টাকরা কথোপকথন যা কানে এল, তাতে নিশ্চিত হলো রানা ওর অনুমান নির্ভুল-আসাবের উত্তরে এবং মাসাওয়ার দক্ষিণে কোথাও রয়েছে ওরা। নোঙর ফেলল জাহাজ। এক দঙ্গল লোক উঠে এল জাহাজে, ডেকের ওপর দিয়ে ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাক্স। প্যাকিং কেস খোলার শব্দ বেশ কবার পেল রানা।
‘মিসাইলগুলো কতখানি নিরাপদ?’ ফিসফিস করে জেনকে জিজ্ঞেস করল ও।
‘জানি না। আমাকে বলা হয়েছে মালদিনি ওঅরহেডের জন্যে ডিটোনেটর চুরি করেনি, এবং আমার জানা আছে ফুয়েল নেই ওগুলোর মধ্যে।’
শব্দের সঙ্গে রানার অনুমানের সাযুজ্য থাকলে বলতে হবে, রবার্তো মালদিনি রীতিমত সুদক্ষ এক সংগঠনের কর্ণধার। লোকে মিসাইল বলতে দু’তিন ভাগে বিভক্ত, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সিলিণ্ডারসদৃশ মৃত্যু-এঞ্জিন মনে করলেও, আসলে অসংখ্য খুদে খুদে যন্ত্রাংশ জুড়ে তৈরি করা হয় জিনিসটাকে। সুযোগ্য মিসাইল এক্সপার্টের তত্ত্বাবধানে যে কোন বড়সড় ওঅর্ক-ক্রু এক রাতে কমপক্ষে গোটা তিনেক মিসাইল খুলে আলাদা করতে পারে। আওয়াজ বলছে, মাথার ওপর দলে-বলে যথেষ্ট ভারী এ জাহাজের ক্রুরা।
গুমোট হয়ে উঠছে μমেই কেবিনের ভেতরটা। ইথিওপিয়ার ইরিট্রিয়ান উপকূল দুনিয়ার অন্যতম উত্তপ্ত এলাকা, তাও সূর্য এখনও মাথার ওপর চড়াও হয়নি। একটু পরে কেবিনের দরজা খুলে গেল। এক রাশান মেশিন পিস্তল হাতে ম্যাকলিনকে দেখা গেল দোরগোড়ায়। পেছনে রাইফেলধারী দুই নাবিক। তৃতীয় নাবিক বয়ে এনেছে একগাদা কাপড়-চোপড়।
‘কোথায় যাচ্ছ জানতে তুমি, মিস্টার রানা,’ বলল ম্যাকলিন। ‘তোমার বুট আমার পায়ে লাগলে ওগুলো আর ফেরত পেতে না। মরুভূমিতে হোঁচট খেতে খেতে মরতে।’
‘আমার ডাফ্ল ব্যাগ থেকে পুরো ডেজার্ট কিট বের করেছ বুঝি?’
‘না। শুধু বুটজোড়া আর কিছু ভারী ভারী মোজা। মিস জেনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। এছাড়া বাকি কাপড়গুলো স্থানীয় আরবী পোশাক।’
পোশাক বহনকারীর উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল ও। কাঠের ডেকে ঝপাৎ করে ফেলে দিল লোকটা ওগুলো। ম্যাকলিনের দ্বিতীয় নডে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল সে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল ম্যাকলিন পেছনে হেঁটে, মেশিন পিস্তল অকম্প হাতে তাক করে রাখল বন্দীদের দিকে।
‘কাপড় পাল্টে নাও,’ আদেশ করল চলে যাওয়ার আগে। ‘সিংহ কিংবা হায়েনার পেটে গেলেও বুট আর ঘড়ি দেখে তোমার লাশ চিনতে পারব আশা করছি।’ দুম করে দরজা লাগিয়ে তালা মেরে দিল ও।
খানিক বাদে ফিরে এসে রানা ও জেনকে তীরে নামার আদেশ দিল ম্যাকলিন। ইতোমধ্যে কাপড় পাল্টে ফেলেছে ওরা। ঢলঢলে আরবী আলখাল−ায়, এই গরমের দেশে বরং স্বচ্ছন্দ বোধ করছে রানা। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ যেহেতু মুসলমান, বোরখায় মুখ ঢেকে রাখতে পরামর্শ দিয়েছে ও জেনকে। হ্যাট পরে নিয়ে, জেনকে সঙ্গে করে টপসাইডে চলে এল রানা। ছোট্ট উপসাগরের ঘন নীল পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সূর্য তার সমস্ত তাপ নিয়ে। পশ্চিমে, বিস্তৃত ওয়েইল্যান্ড পড়ে রয়েছে রানাদের সামনে। দড়ির মই বেয়ে ছোট্ট এক বোটে নেমে, ত্বরিত চালান হয়ে গেল ওরা তীরে।
জেন ইতিউতি চেয়ে রিসিভ করতে আসা ট্রাক খুঁজছে। কিন্তু কোথাও নাম-গন্ধ নেই তার।
‘হাঁটছি আমরা,’ ম্যাকলিন ঘোষণা করল।
দু’মাইল হেঁটে ইনল্যান্ডের ভেতর ঢুকে পড়ল ওরা। দু’বার রাস্তা অতিμম করল, বালি ও পাথরের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া ট্র্যাকে ট্রাকের চাকার গভীর দাগ আবিষ্কার করল। রাস্তায় পড়ামাত্র মিছিল থামিয়ে দিচ্ছে ম্যাকলিন, বিনকিউলার নিয়ে লোক চলে যাচ্ছে সামনে গাড়ি-ঘোড়া আসে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে।
বেশিরভাগ অঞ্চলে ধু-ধু বালি, তবে মরুভূমির এখানে সেখানে পাথরে ঘেরাও ছোটখাটো পাহাড় ও অ্যারোয়ো দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় রাস্তাটা ছেড়ে আসার অনেকক্ষণ পরে উত্তরমুখো হলো দলটা। প্রবেশ করল অসংখ্য ছোট ক্যানিয়নের একটিতে। এখানে
এক উট-বহরের সঙ্গে মিলিত হলো ওরা।
পাথরের আড়ালে লুকানো ছিল পঁচাত্তরটার মত উট। চালক রয়েছে মনে হলো প্রত্যেকটার। লোকগুলো জগাখিচুড়ি ভাষায় হৈহট্টে গাল বাধিয়ে দিল। আরবী ভাষাটা শুধু চিনতে পারল রানা। আরবী ঘেঁষা সোমালী আঞ্চলিক ভাষাও বলছে কেউ কেউ। নেতা গোছের লোকগুলোকে খুঁজে নিতে বেগ পেতে হয় না। পোশাক ভিনড়ব, পাথরের ছায়ায় হ্যাট বিহীন তারা। হালকা বাদামী গায়ের রং তাদের, উচ্চতা মাঝারি, উঁচু, পাকানো চুল। ব্রেসলেট ও কানের দুলের প্রতি বিশেষ ঝোঁক দেখা গেল এদের। ঝট করে মনে পড়ে গেল রানার বিসিআইয়ের সাবধানবাণী-ডানাকিল গোত্র, মরুভূমির নামানুসারে যাদের নাম-বড় নিষ্ঠুর, ভয়ঙ্কর জাতি। প্রথম শত্রুনিধনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কান ফুটো করে এরা, ব্রেসলেটগুলো হলো যোদ্ধারা কতজন প্রতিপক্ষ হত্যা করেছে তার সাক্ষ্য।
এক শক্তসমর্থ, ধূসরচুলো ডানাকিল এগিয়ে এল পাথরস্তূপের আড়াল থেকে। ‘এ হচ্ছে সাচ্চি,’ ইতালিয়ানে বলল ম্যাকলিন। ‘নাম আসলে সাচ্চি না, কিন্তু উচ্চারণ করতে দাঁত ভেঙে যায় তাই এ নামে ডাকা।’
ডানাকিল লোকটা ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ম্যাকলিনের মুখের দিকে। বাঁ হাত দুলিয়ে অস্ত্র নামিয়ে রাখতে ইঙ্গিত করল ম্যাকলিনকে। বিশালদেহী নাবিক প্রতিবাদ করতে মুখ খুলে, আবার কি ভেবে চুপ মেরে গেল। ডানাকিল এবার রানাদের উদ্দেশে ঘুরে তাকাল। ‘রানা’, আঙুল-ইশারায় বলল। ‘জেন।’ যুবতীর দিকে চাইল।
সায় জানাল মাসুদ রানা।
ওর ইতালিয়ান সাবলীল নয়। তবে খারাপও নয়। ‘আমি তোমাদের ক্যারাভানের কমান্ডার। তিন ক্যারাভানে যাব। হাঁটতে হবে। প্রশ্ন?’
‘কদ্দূর?’ জানতে চাইল রানা।
‘কয়েক দিন। উটেরা পানি আর মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে জেনারেল মালদিনির জন্যে। নারী-পুরুষ সবাই হাঁটবে। এই মরুভূমিতে আমার লোকজন আর মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু নেই। ডানাকিল ছাড়া কেউ পানি পাবে না। বোঝা গেছে?’
মাথা ঝাঁকাল রানা। এসময় কথা বলে উঠল ম্যাকলিন। ‘সাচ্চি, এ বড় ডেঞ্জারাস লোক। মানুষ খুন করতে হাত কাঁপে না…’
‘তোমার কি ধারণা আমার কাঁপে?’ বাহুর ব্রেসলেটগুলো স্পর্শ করল সাচ্চি। তারপর ঘুরে হাঁটা দিল।
চোদ্দটা ব্রেসলেট, গুণতে ভুল হয়ে না থাকলে, পরে রয়েছে লোকটা। স্থানীয় রেকর্ড কিনা কে জানে, ভাবল রানা।
সকাল গড়ালে পর, দলের তিন ভাগের এক ভাগ একটা ক্যারাভান গঠন করে বিদায় নিল। মনে মনে ওদের সংগঠনের তারিফ করল রানা। ডানাকিল উপজাতি অত্যন্ত সুশৃক্মখল ও কর্মঠ। উট ও চালকদের দ্রুত সারিবদ্ধ করল ওরা, বন্দী ও বাড়তি লোকদের মাঝে রেখে, রওনা দিল। ওদের চোখ আশপাশের গ্রামাঞ্চল ঝাঁট দিয়ে যাচ্ছে, যদিও অ্যারোয়োর ঘেরাওয়ের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে তারা।
উটচালকরা পর্যন্ত সামরিক শৃক্মখলা বজায় রাখছে। নেতারা যেখানেই জায়গা নিক না কেন আপত্তি করছে না ওরা। বন্দীদের প্রতি পাহারাদাররা চেঁচামেচি করছে না কিংবা চাবুক আছড়াচ্ছে না। তার বদলে শান্ত গলায় আদেশ করছে, চট করে পালিত হচ্ছে
সে আদেশ। বন্দীরা রানাকে কৌতূহলী করে তুলল।
এদের কারও কারও কোমরে শিকল, যদিও ভারী লোহা অপসারণ করা হয়েছে। মহিলা আছে বেশ কিছু, বেশিরভাগের গায়ের রংই কালো কুচকুচে।
‘এরা কি ক্রিতদাসী নাকি?’ মৃদু কণ্ঠে শুধাল জেন।
‘হ্যাঁ।’
‘ইস, আমি যদি ওদের মতন হতে পারতাম,’ ছেলেমানুষী কণ্ঠে বলল জেন।
‘পারবে না।’ বলল রানা।
‘কেন?’
‘কারণ তুমি একজন পেশাদার এজেন্ট। আমার মনে হয় না কোন গোত্রপতির উপপতড়বী হওয়ার কপাল নিয়ে জন্মেছ তুমি। মালদিনি জানতে চায় আমরা কতটা জানি। লোকটা সম্ভবত ভয়ানক নিষ্ঠুর। ওকে মজাতে পারবে না তুমি।’
‘ধন্যবাদ,’ বলল জেন। ‘আমাকে ভালই আশ্বস্ত করলে তুমি।’
‘চুপ করবে তোমরা?’ খেঁকিয়ে উঠল হঠাৎ ম্যাকলিন।
‘তুমি উটের খুরের নিচে মাথাটা পাতবে?’ পাল্টা বলল জেন।
মেয়েটির দুঃসাহস দেখে অবাক হয়ে গেল রানা। ওদিকে, তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে ম্যাকলিন। ওর কর্কশ হুঙ্কারে এলাকার প্রতিটা উট আঁতকে উঠল। এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে, বোল্ডারে রানার পাশে বসে থাকা জেনের উদ্দেশে ঘুসি ছুঁড়ল লোকটা। ওর
বাহু খপ করে ধরে ফেলল রানা, দেহের ওজন সামনে ছুঁড়ে দিয়ে, মোচড় মারল কাঁধ ও নিতম্বে-চিতপাত হয়ে ভূতলশায়ী হলো ম্যাকলিন।
ক’জন ডানাকিল দৌড়ে এল এদিকে। ম্যাকলিনকে ধুলোয় গড়াতে দেখে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল কেউ কেউ। কথার তুবড়ি ছুটতে বোঝা গেল, যারা দেখেনি তাদেরকে ঘটনার বয়ান দিচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীরা।
ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়িয়েছে ইতোমধ্যে ম্যাকলিন। ‘তুমি বাঁচবে না, রানা,’ চাপা কণ্ঠে বলল।
ঘিরে থাকা জনতার মাঝে সাচ্চিকে লক্ষ করল রানা। ডানাকিলদের মতলবটা কি অনুমান করার চেষ্টা করল। ওরা কি বাধা দেবে, নাকি উৎসাহ? রানার হাতে ম্যাকলিন মারা পড়লে তখন কি হবে?
ম্যাকলিন লোকটা ইয়া লম্বা, ছ’ফিট তিন নিদেনপক্ষে, বাড়তি চল্লিশ পাউন্ড বহন করছে দেহে। বিদঘুটে ভঙ্গিতে দু’হাত শূন্যে তুলে রানার দিকে এগিয়ে এল । কয়েক পা হেঁটেই হঠাৎ তেড়েফুঁড়ে এল লোকটা। একপাশে সরে গেল রানা, জায়গা পরিবর্তনের সময় ডান পা তুলে কষে লাথি ঝাড়ল। ঢোলা আলখাল্লার কারণে মারটা জুতসই হলো না, নইলে ওই লাথি খেয়ে যে-কারও দু’ভাঁজ হয়ে যাওয়ার কথা। কাপড়ে জড়িয়ে গিয়ে, ম্যাকলিনের সোলার প্লেক্সাসে অপেক্ষাকৃত দুর্বল লাথি হানল রানার পা। ‘হুঁক’ শব্দ করে তাল হারিয়ে সামনে হোঁচট খেল লোকটা।
মাটিতে ডিগবাজি খেয়ে এক গড়ান দিয়ে উঠল রানা, চোখা পাথরের খোঁচায় পিঠে ছুরি বিঁধল যেন। সটান লাফিয়ে উঠে টলমল পায়ে পিছু হটে গেল ও। অনুভব করল পিঠে ধাক্কা দিয়ে বেষ্টনী থেকে লড়াইয়ের ময়দানে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে ওকে।
ক্রুদ্ধ লোকটা ধেয়ে এল আবারও। ওর ডান হাতটা বাম কনুই দিয়ে ঠেকাল রানা, শরীর বাঁকিয়ে পাঞ্চটার আংশিক ফিরিয়ে দিল, তারপর দুম করে বাঁ হাত চালিয়ে দিল প্রতিপক্ষের চোখ লক্ষ্য করে। অস্ফুট আর্তধ্বনি করে মাথা ঝাড়া দিল লোকটা। বাঁ হাত
ঘুরিয়ে রানার পাঁজরে সর্বশক্তিতে আঘাত হানল।
দম বন্ধ করা যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল রানার দেহে।
আক্রমণ করল ফের ক্ষিপ্ত ম্যাকলিন। দু’হাত সমানে চলছে। রানা ওর বাহুর নিচে ডুব মেরে, বুকে মাথা রেখে পিস্টনের মত দ্রুতবেগে হাত চালাতে লাগল পাঁজর ও তলপেট বরাবর। প্রকাণ্ড দুটো মুঠো পিঠে তাল ঠুকছে টের পেল। ক’ইঞ্চি পিছে সরে, ডান কনুই দিয়ে বাঁ হাতের হুক ঠেকাল রানা। নিজের বাঁ হাত ঝেড়ে দিল বিপক্ষের চিবুকে। তড়াক করে সিধে হয়ে গেলেও ধরাশায়ী হতে রাজি হলো না লোকটা। এবার সমস্ত ওজন ব্যবহার করে, ম্যাকলিনের হৃৎপিণ্ডের ঠিক নিচে, ডান হাতের নিরেট এক হুক ঝাড়ল রানা। ছিটকে রুক্ষ মাটিতে চিত হয়ে পড়ে গেল নাবিক।
‘বেশ্যার বাচ্চাটাকে খুন করে ফেলো!’ আরবী ভাষায় পেছন থেকে বলে উঠল কে একজন।
আস্তে আস্তে গড়ান দিয়ে এক হাঁটুতে ভর রেখে বসল ম্যাকলিন। ওর চিবুকের নিচে ভারী ডেজার্ট বুট দাবানর জন্যে এগিয়ে গেল রানা। বেল্টের মেশিন পিস্তলের বাঁটে হাত ফেলল লোকটা। লাথিটা মারার আগেই গুলি করে বসবে, আশঙ্কা করল রানা।
বাদামী পোশাকধারী এক লোক ঝলসে উঠল রানার বাঁ দিক থেকে। রাইফেলের বাঁটের বাড়ি খেয়ে মেশিন পিস্তল খসে পড়ল ম্যাকলিনের হাত থেকে। এবার শূন্যে উঠে গেল রাইফেলটা, তারপর নেমে এল বাঁট, সজোরে ম্যাকলিনের বুকে আঘাত হেনে
ওকে শুইয়ে দিল মাটিতে।
‘থামো!’ হুকুম করল সাচ্চি, রাইফেল ঘুরিয়ে তাক করল ধরাশায়ী ম্যাকলিনের উদ্দেশে।
পেছন থেকে একজোড়া শক্তিশালী হাত চেপে ধরল রানাকে, বজ্র আঁটুনিতে দু’বাহু এক করে দিয়েছে। বাধা দেয়ার চেষ্টা করল না ও।
‘ও…’ বলতে চাইল ম্যাকলিন।
‘আমি দেখেছি,’ বলল সাচ্চি, ‘আমার লোকেরাও দেখেছে।’ রাইফেলের নল দিয়ে খোঁচা দিল লোকটাকে। ‘ওঠো। তুমি পরের ক্যারাভানের সাথে যাবে।’
উঠে দাঁড়াল ম্যাকলিন, তুলে নিল মেশিন পিস্তল। ডানাকিল উপজাতি তখনও ঘিরে আছে ওকে। ওদের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ম্যাকলিন, তারপর রানাকে বিদ্বেষের এক ঝলকে ভস্ম করে দিয়ে হোলস্টারে ভরল অস্ত্রটা। চার ডানাকিল সঙ্গ দিল আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হেঁটে-যাওয়া ম্যাকলিনকে।
মাথা নাড়ল সাচ্চি। মুক্ত করে দেয়া হলো রানার বাহু। রাইফেলের নল দেখিয়ে বোল্ডারটা ইঙ্গিত করল ও। জেন তখনও বসে ওখানে। বিস্ফারিত দু’চোখ। রানা পাশে গিয়ে বসল ওর।
‘ম্যাকলিনকে খুন করলে না কেন?’ জবাব চাইল সাচ্চি।
‘ভাবলাম তোমার পছন্দ হবে না।’
‘রানা, আমি জানি আমার সাথে তুমি লাগতে আসবে না।’
সুনিশ্চিত শোনাল লোকটার কথাগুলো, আপত্তি করল না রানা।
মাঝ বিকেলে রওনা হলো দ্বিতীয় কাফেলা। সে রাতে অ্যারোয়োতে ঘুমাল ওরা। দু’বার ঘুম ভেঙে যেতে রানা দেখতে পেল পাহারা দিচ্ছে উপজাতীয় লোকগুলো।
পরদিন পশ্চিম যাত্রা করল ওরা।

সাচ্চিকে কম্পাস ব্যবহার করতে দেখেনি এপর্যন্ত রানা। রাতে তারা জরিপ করার সময়ও সেক্সট্যান্ট জাতীয় কোন কিছু কাজে লাগায় বলে মনে হয় না। আপাতদৃষ্টে, নক্ষত্রপুঞ্জ এত ভালভাবে চেনে সে, যে প্রতি রাতে ওগুলোকে দেখে নিজেদের অবস্থান বের করে নিতে পারছে। কিংবা হয়তো অতিচেনা কোন ট্রেইল অনুসরণ করছে। তাও যদি হয়, তবু ওকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পনড়ব বলে সার্টিফিকেট দেয়া যায়। পুব ডানাকিলের বেশির ভাগ এলাকাই ধুধু বালির সমুদ্র, জীবন যাপনের জন্যে জায়গাটা অত্যন্ত প্রতিকূল, নদীগুলো পর্যন্ত সল্ট বেসিনে মিশে স্রেফ উবে গেছে।
প্রচণ্ড দাবদাহ আর কখনও সখনও ধূলি-ঝড় সত্ত্বেও যাত্রা মন্দ হলো না খুব একটা। কাপড়ে মুখ ঢেকে, গাদাগাদি করে বসে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে ওরা। চতুর্ দিন, মাইলকে মাইল বালির মরুর ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে পাথর এড়িয়ে পথ চলতে চলতে হঠাৎ ডান পাশের বালির ঢিবিগুলোর চূড়া থেকে উৎকট চেঁচামেচি জুড়ে দিল একদল ডানাকিল, সেই সঙ্গে শুরু হলো রাইফেলের গুলিবর্ষণ।
রানার পেছনের উটচালক চড়া কণ্ঠে গাল দিয়ে তার জানোয়ারটাকে নিচু হতে বাধ্য করল। রানা চট করে আক্রমণকারীদের ও উটটার মাঝখানে চলে এলো। খিট্খিটে
জানোয়ারটার কাছ থেকে এতদিন দূরে দূরে ছিল ও, এরা শুধু যে বিশ্রী দুর্গন্ধ ছড়ায় তাইই নয়, কেউ দোস্তি করতে এলে কামড় দিতেও ছাড়ে না। কিন্তু এখন, চিন্তা করে দেখল রানা, রাইফেলের গুলির চাইতে উটের কামড় কম ক্ষতিকর। চালকরা উটেদের নত করে যার যার রাইফেল হাতে তুলে নিল। বালিতে মুখ গুঁজে উটের পেছন দিয়ে উঁকি দিল রানা, পনেরো থেকে বিশজনের একটা দল হামলা চালিয়েছে অনুমান করল। ওদের দলে রয়েছে পঁচিশজন চালক ও ছ’জন গার্ড, এছাড়াও চারজন মহিলা আর দু’জন পুরুষ বন্দী। রানার মুখের কাছে বুলেট বালি ছিটাতেই পিছনে সরে গেল ও। আড়াল নিল মোটা দেখে একটা উটের পেছনে। লুগারটার কথা বড্ড মনে পড়ছে, জাহাজে রয়ে গেছে ওটা, এখন হাতে পেলে দারুণ কাজে লাগত, হামলাকারীদের অনেকে লুগারের আওতার মধ্যে চলে আসছে।
অন্তত দুজন ডানাকিল গার্ড ভূপাতিত, সঙ্গে আরও কজন চালক। আকস্মিক হামলায় বাড়তি লোকের সুযোগটা হারিয়েছে সাচ্চি, এবং এমুহূর্তে প্রতিপক্ষের বড় ধরনের ক্ষতিসাধন করতে না পারলে ভোগান্তির শেষ থাকবে না। সৌভাগ্যক্রমে, কেবলমাত্র ডানদিকেই আড়াল পাচ্ছে ডানাকিলরা বালিময় রিজটার। দক্ষিণেও যদি থাকত ওরকম একটা, তাহলে ক্রসফায়ারে পড়ে স্রেফ পরপারে চলে যেত রানারা।
কাছেই গুলি খেয়ে আর্তচিৎকার ছাড়ল একটা উট। জানোয়ারটার আছড়ানো খুরে চালক বেচারার খুলি ফেটে চুরমার হয়ে গেল।
রানা নিজের গোপন অবস্থান সম্পর্কে ভাবনায় পড়ে গেল। ওর সামনের উটটা এবার গোঙাতে আরম্ভ করল, হয় ভয় পেয়ে, নয়তো আহত সঙ্গীর প্রতি সমবেদনায়। চালক সিধে উঠে দাঁড়াল। খিস্তি ঝেড়ে, পুরানো এম-ওয়ান রাইফেলটা থেকে একটানা গুলি বর্ষাল। তারপর হঠাৎই দু’পাশে হাত ছুঁড়ে দিয়ে, পেছনে টলতে টলতে পড়ে গেল মাটিতে।
রানা ক্রল করে এগোল ওর দিকে। লোকটার গলার ফুটো থেকে রক্ত বেরোচ্ছে গলগল করে। চার মহিলা বন্দীর তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে মুখ ঘোরাতে, দু’জন লোককে ডান দিকে পড়ে যেতে দেখল ও। লাথি ঝাড়ছে আরেকটা উট। ছ’ইঞ্চির জন্যে রানার হাঁটু মিস করল একটা গুলি।
উট চালকের রাইফেলটা থাবা মেরে ধরে গুড়ি মেরে উটটার পেছনে চলে এল রানা। শায়িত অবস্থান থেকে গুলি চালাল, বালির ঢাল বেয়ে নেমে আসতে থাকা এক ডানাকিল সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
আরেক আক্রমণকারীর উদ্দেশে লক্ষ্যস্থির করল রানা। ক্লিক আওয়াজ করল রাইফেলটা। গুলি শেষ! সাঁ করে ওর কানের পাশ দিয়ে চলে গেল একটা বুলেট।
দ্রুত সরে যাচ্ছে, কাপড়ে ঢুকে যাচ্ছে বালি, মৃত চালকটার কাছে ক্রল করে ফিরে এল রানা। বাদামী আলখাল্লায় তালগোল পাকিয়ে আছে ওর অ্যামুনিশন বেল্ট, লোকটাকে দু’বার উল্টে দিয়ে তারপর মুক্ত করা গেল ওটাকে। এমুহূর্তে কাছাকাছি এল না
আর কোন বুলেট। নতুন ক্লিপ গুঁজে চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল রানা যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দেশে।
ডজন খানেক হামলাকারী তখনও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তবে পাল্টা আক্রমণ শুরু হতে তাদের মাথা গরম করে তেড়ে আসা স্তিমিত হয়েছে। বালির ঢালে হাঁটু গেড়ে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে গুলি করছে ওরা। রানাও হাঁটু গেড়ে বসে একটা টার্গেট স্থির করে গুলি চালাল, লোকটা কুঁকড়ে গেলেও বাহ্যত মনে হলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে, বাঁয়ে এক ইঞ্চির ভগড়বাংশ পরিমাণ সরিয়ে দ্বিতীয়বার ট্রিগার টিপল ও।
নেমে গেছে লোকটার রাইফেল। মুখের অভিব্যক্তি নিখুঁতভাবে পড়ার পক্ষে অনেকটা দূরে রয়েছে রানা, তবে মনে হলো যেন চমক খেয়ে গেছে। সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্যস্থির করে রানা গুলি করল আবারও। বালিতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল আরেকজন, বার কয়েক লাথি ছুঁড়ে স্থির হয়ে গেল।
আক্রমণকারীদের বাঁ সারি থেকে দীর্ঘদেহী এক যোদ্ধা লাফিয়ে উঠে, রানার উদ্দেশে গুলি করতে লাগল। জঘন্য নিশানা তার, রানার এক গজের মধ্যেও এল না কোনটা। হঠাৎ উটটাকে ডাক ছেড়ে কসরৎ করে উঠে দাঁড়াতে দেখা গেল, পিঠে চাপানো মালে গুলি লেগে ভেঙেচুরে গেছে খানিকটা, হামাগুড়ি দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে কাফেলার মুখের উদ্দেশে এগোল রানা, ভীত জানোয়ারটার কাছ থেকে সরে যেতে হবে।
সারবন্দী দ্বিতীয় উটটাকে ঘিরে ছিটকে উঠছে বালি। কাফেলার দু’প্রান্ত থেকে হৈ হল্লা শুনে বোঝা গেল উপজাতীয়রা চেষ্টা করছে উটগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে। সাত-আট জায়গায় এমুহূর্তে দিগ্বিদিক্ ছোটাছুটি করছে, সবলে মাড়িয়ে যাচ্ছে অসহায় প্রতিরোধকারীদের। জেনের কি অবস্থা কে জানে, ভাবল রানা। চালকরা অস্ত্র ফেলে ছুটছে জানোয়ারগুলোর দিকে। দুর্বৃত্তদের গুলি খেয়ে আরও দু’জন ভূমিশয্যা নিল।
কাফেলার সামনের দিকে ছুটে গিয়ে বন্দীদের কাছাকাছি হলো রানা, গুলি চালনার জন্যে ফাঁকা জায়গা পেল এখানে। শত্রুপক্ষ অনেকখানি কাছিয়ে এসেছে। শুয়ে পড়ে রাইফেল তাক করতেই বুঝতে পারল এযুদ্ধে পরাজয় অনিবার্য। দীর্ঘদেহী যোদ্ধাটিকে দলের নেতার মত দেখাচ্ছে। দু’বার গুলি করার পর কায়দা করা গেল তাকে।
বাঁ পাশ থেকে ডানাকিল গার্ডটা চেঁচিয়ে কি যেন বলছে, সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে আগুয়ান প্রতিপক্ষের উদ্দেশে গুলি চালাল। পতন ঘটল আরেক দুর্বৃত্তের। তারপর গার্ডের। আর তিনটা গুলি অবশিষ্ট আছে রানার। সেগুলো ব্যবহার করে আরেকজনকে পেড়ে ফেলল ও।
চারধারে নজর বুলাল রানা, এম-ওয়ানের কার্তুজ কোথায় ফেলেছে মনে নেই ওর, উটগুলোকে এড়িয়ে সরে যাওয়ার সময় পড়েছে কোথাও। ভূপাতিত গার্ডের রাইফেলটা থাবা মেরে তুলে নিল ও। লী এনফিল্ড, পুরানো মাল হলেও কার্যকর। লক্ষ্যভেদ করতে পারবে আশা করে, ধেয়ে আসা শরীরগুলোর উদ্দেশে ওটা তাক করল রানা। কাছ থেকে তলপেটে গুলি খেয়ে আরেকজন ভূতলশায়ী হলো।
রানার বাঁ দিক থেকে এক ঝাঁক গুলি বর্ষিত হলে আরও দু’জন হামলাকারী ঢলে পড়ল। চার-পাঁচজন এমুহূর্তে নিজের পায়ে দাঁড়ানো, কিন্তু খুব দ্রুত ব্যবধান ঘুচিয়ে আনছে তারা। রানার রাইফেল ফাঁকা আওয়াজ করল-গুলি শেষ।
দশ ফিট দূর থেকে এক বাদামী পোশাকধারী ডানাকিল গুলি করল ওর উদ্দেশে। আল্লাই জানে, কেন মিস করল লোকটা। রানা চট করে রাইফেলটা ঘুরিয়ে বাঁট উড়িয়ে ধাঁই করে মেরে দিল প্রতিপক্ষের চোয়ালে। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরে উঠে জ্ঞান হারিয়ে
লুটিয়ে পড়ল লোকটা।
ওর বেল্টে ছোরা লক্ষ করল রানা। লোকটার রাইফেল, তুলে নেয়ার পক্ষে, অনেকখানি দূরে পড়ে রয়েছে। ছোরাটা মুঠোয় ধরে গুটিসুটি মেরে বসে রইল রানা। কাউকে বাগে পেলে পেট ফাঁসিয়ে দেবে। আশপাশে দেখতে পাচ্ছে দু’পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চলছে। গুলি,
পাল্টা গুলির সঙ্গে শুরু হয়েছে হাতাহাতি লড়াই।
রানা মরুযুদ্ধ দেখতে ব্যস্ত, টেরও পেল না কখন ঘেরাও দেয়া হয়েছে ওকে। বাদামী পোশাক পরা একদল লোক ঘিরে রয়েছে। কারা এরা? স্বপক্ষ, না বিপক্ষ?
‘ছুরিটা ফেলে দাও, রানা।’ পরিচিত কণ্ঠস্বর। সাচ্চির। অন্যদের এক পাশে ঠেলে সরিয়ে এগিয়ে এসেছে।
আদেশ পালন করল রানা, ঝুঁকে পড়ে ওটা তুলে নিল সাচ্চি।
‘যুদ্ধে জিতেছি আমরা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ওরা মারা পড়েছে।’ একটা গুলির শব্দ শোনা গেল। ‘আর নয়তো পড়বে। ওদের পানি সংগ্রহ করতে সাহায্য করো।’
জনে জনে গিয়ে প্রত্যেকের ক্যান্টিন জড় করল ওরা। শত্রুদের অনেককে হাসতে হাসতে মাথায় গুলি করে মারল সাচ্চির লোকেরা। এদের ক’জনকে সেবা-শুশ্রূষা করলে বাঁচানো যেত মনে হয়েছিল রানার। কিন্তু গ্রেফতারকারীদের সঙ্গে এনিয়ে বাদানুবাদ করে লাভ হয়নি।
ক্যারাভানে ফিরে এসে, পশুর চামড়ার তৈরি ক্যান্টিনগুলো গাদা করে রাখল ওরা। জনৈক চালক এসময় কি যেন বলে, হাতছানি দিয়ে ডাকল রানাকে। ওকে অনুসরণ করে, অন্যান্য বন্দীরা দল বেঁধে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে এল রানা।
‘মেয়েটাকে দেখো, রানা,’ বলল সাচ্চি। ‘জেনারেল মালদিনিকে বলতে পারবে কিভাবে হলো এটা।’
জেন তার ভারী আলখাল্লার ওপর চিত হয়ে শোয়া। বুকের বাঁ পাশ থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে বেরোচ্ছে।
‘যুদ্ধের শুরুতেই ঘটেছে এটা,’ দু’জন মহিলার মধ্যে একজন আরবীতে বলল।
‘কার বুলেট?’ একই ভাষায় শুধাল রানা।
‘মরুভূমির দিক থেকে।’
জেনের পালস পরীক্ষা করল রানা। নিস্পন্দ। আলতো করে ওর চোখের পাতা বুজে দিল। জেনের ক্যামেরাটা কোথায় চিন্তাটা হঠাৎ উদয় হলো মনে। বেচারী এবারকার ট্র্যাভেল স্টোরিটা লিখে যেতে পারল না, ভাবল বিষণড়ব চিত্তে।
‘তুমি চাইলে ওকে কবর দিতে পারো,’ বলল সাচ্চি। মাথা ঝাঁকাল রানা।
ক্যারাভান সুসংহত করা, জেনকে সহ স্বপক্ষের অন্যান্য মৃতদের সৎকার করা, এবং কোন্ কোন্ উট মালদিনির ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে বাকি দিনটা পার হয়ে গেল। চারটে উট মরুভূমিতে পালিয়ে গেছে। আরও নটা হয় মরেছে আর নয়তো এতটাই গুরুতর জখম, নড়াচড়ার সাধ্য নেই। বাকি থাকল সাকুল্যে বারোটা উট আর দশজন চালক। বেঁচে যাওয়া চার ডানাকিল গার্ডের মধ্যে দু’জনকে উটচালকের দায়িত্ব দেয়া হলো, পাহারাদার হিসেবে কাজ করবে অপরদুজন ও সাচ্চি। হামলাকারীদের উটগুলোর হদিস পাওয়া গেল না।
মোটাসোটা দেখে এক উট বাছাই করে তার ছায়ায় গিয়ে বসল রানা। কিভাবে খুঁজে বের করবে জেনের ক্যামেরাটা ভাবছে। খুঁজে পেলেও সাচ্চি রাখতে দেবে ওটা তার নিশ্চয়তা নেই, আবার আবেগের মূল্য দিলে দিতেও পারে।
ক্যামেরার ভেতরকার যন্ত্রপাতিগুলো কতখানি মূল্যবান? রানার স্থিরবিশ্বাস, কোন এক লেন্সের মধ্যে একটা সিঙ্গল শট, .২২ রেখেছিল জেন। ওর মিশনের ব্যাপারে রানাকে খোলামেলা করে কিছু বলেনি মেয়েটা, এবং রানাও চেপে গেছে নিজেরটা সম্পর্কে। লেন্সটা খুব সম্ভব রয়ে গেছে শেপ মাইয়ার জাহাজে।
চালকদের একজনকে এসময় জেনের ক্যামেরা কাঁধে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল। মরুকগে, ভাবল রানা, ওটা ফেরত চেয়ে সাচ্চির সন্দেহ জাগিয়ে তোলার কোন ঠেকা পড়েনি ওর।
মালপত্র সরাতে ব্যস্ত সবাই, ঘণ্টাখানেক কি তারও কিছু পরে হাতছানি দিয়ে রানাকে ডেকে নিল সাচ্চি। কঠোর পরিশ্রম করল রানা, অন্যদের চেয়ে অন্তত তিনগুণ, এবং এদিক ওদিক চেয়ে যখন দেখল কেউ তাকিয়ে নেই, বুট ব্যবহার করে ছেঁড়া বস্তা
থেকে খসে পড়া খুদে খুদে ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ বালির বুকে কবর দিল। মাল সরানর উছিলায় আরও কিছু বস্তার মুখ খুলে দিল রানা।
এখন আর চাইলেই তিনটে মিনিটম্যান আইসিবিএম তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না রবার্তো মালদিনির পক্ষে।

তিনদিন বাদে, প্রায় কারবালার দশা নিয়ে ভিনড়ব ধরনের এক অঞ্চলে প্রবেশ করল রানাদের কাফেলা। অগুনতি পাথুরে পাহাড় চারধারে। ছোটখাট ঝোপ-ঝাড়েরও ছড়াছড়ি লক্ষ করা গেল। উটচালক ও গার্ডদের মুখের হাসি বলে দিল কাছেই পানির ব্যবস্থা রয়েছে। যাত্রাটা খুব সোজা ছিল না। আরও দুটো উট খোয়াতে হয়েছে। বালির ওপর একবার যে শুয়েছিল, ওরা মাল খালাস করার পরও আর উঠতে রাজি হয়নি।
ছোট্ট ডোবাটার পানিতে গাঁজলা। পাথুরে এক অবতলে, আশপাশে খুদে খুদে ঝোপ-ঝাড় নিয়ে অবস্থান ওটার। পানিতে ক্ষারের স্বাদ। চালকদের মরু-জ্ঞান বলছে এপানি খাওয়া চলে, রানার কাছে যদিও দুনিয়ার সবচাইতে সুস্বাদু-সুপেয় জল মনে হলো একে। অভিযানের প্র মার্ধে বেজায় হিসেব করে পানি দেয়া হয়েছিল ওদের, এবং শেষের তিনদিন পানির অভাবে ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেছে শরীর।
উটগুলো আকণ্ঠ পান করে তাজ্জব করে দিল রানাকে। ডোবার পানির স্তর এতই দ্রুত নামিয়ে দিল যে মনে হলো, কোন পাতালনদী ডোবার পানি শুষে নিচ্ছে বুঝি। আর কোন স্থলচর প্রাণী হলে এত পানি একসঙ্গে পান করে নির্ঘাত মারা পড়ত। কিন্তু এদের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সাধে কি আর মরুর জাহাজ বলে এদেরকে?
‘রাতে এখানে ক্যাম্প করব আমরা,’ রানাকে বলল সাচ্চি। ‘সকালে ডোবা ভর্তি হলে ক্যান্টিন ভরে নেব।’
‘আর কেউ পানি চাইলে তখন?’
হেসে উঠল সাচ্চি। ‘সিংহ?’
‘মানুষও হতে পারে।’
রাইফেলে চাপড় দিল সাচ্চি। ‘বেশি লোক এলে আবারও রাইফেল হাতে পাবে তুমি।’
সে রাতে দুটো অগিড়বকুণ্ড জ্বালা হলো। চালক, গার্ড ও বন্দীদের জন্যে একটা, আর অপরটা সাচ্চি ও তার পেয়ারের লোকেদের জন্যে। রানাকে আমন্ত্রণ জানাল লোকটা।
‘দু’দিনের মধ্যে মালদিনির কাছে পৌঁছচ্ছি আমরা,’ বলল।
‘কে মালদিনি?’
‘জানো না?’
‘গুজব শুনেছি শুধু।’
‘গুজব,’ আগুনে থুথু ফেলল সাচ্চি। ‘জেনারেল মালদিনি সম্পর্কে কাফেলার লোকজন ভুলভাল কথা বলে। অনেক বছর আগে, আমাদের গ্রামে আসে জেনারেল। আমরা মেরে ফেলতে পারতাম তাকে, কিন্তু আমাদের শহরবাসী কিছু গোত্রীয় লোক বন্ধুত্ব করতে বলে তার সাথে। জেনারেল মালদিনি প্রতিশ্রুতি দেয় তাকে সাহায্য করলে আমাদের সম্পদ আর ক্রিতদাস দেবে। কাজেই তাকে সাহায্য করি আমরা।’
‘সম্পদ পেয়েছ?’ জিজ্ঞেস করল রানা। জবাবে মাথা ঝাঁকিয়ে, হাতের দোলায় ক্যারাভান দেখাল সাচ্চি।
নারী কণ্ঠের আর্তনাদ শোনা গেল হঠাৎ অপর অগিড়বকুণ্ডটার কাছ থেকে। ঘনীভূত আঁধার ভেদ করে চোখ কুঁচকে চাইল রানা। তিন ক্রীতদাসীকে বাধ্য করা হচ্ছে কাপড় খুলতে, এবং কয়েকজন পুরুষকে দেখা গেল ওদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে। সাচ্চির দিকে
চাইল রানা। দৃষ্টিক্ষেপ করল না লোকটা।
‘ওরা ক্রীতদাসী,’ বলল সাচ্চি, ‘একাজের জন্যেই কেনা হয়েছে ওদের। জেনারেল মালদিনি বেশ কিছু সাদাচামড়ার মানুষ আমদানী করেছে। তাদের মেয়েমানুষ দরকার হয়। এরা মালদিনির সম্পত্তি।’
‘তোমার নিশ্চয় ভাল লাগে না এসব?’
‘যোদ্ধা ভালবাসে তার মেয়েমানুষ, অস্ত্র আর উট। আমার পূর্বপুরুষরা কবে থেকে এখানে বাস করে কেউ জানে না, আমরা জানি জেনারেল যত লোক নিয়ে এসেছে তাদের জায়গা এখানে হবে না। উত্তরের আমহারিক খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সবসময় লড়ে নিজেদের আবাস ভূমি রক্ষা করতে হয় আমাদের। জেনারেল মালদিনির যে-সব লোকেরা আজব ওই অস্ত্র বানাচ্ছে তাদের সঙ্গে লাগতে চাই না আমরা। যাকগে, ম্যাকলিনের জাহাজে উঠেছিলে কেন তুমি?’
‘জেনারেল মালদিনির পরিচয় জানার জন্যে।’
‘জানবে।’ নীরস হাসি হাসল সাচ্চি। ‘আরও অনেকে জানতে চেয়েছে। কেউ কেউ জেনারেলের দলে যোগ দিয়েছে। বাকিরা মৃতদের দলে। আমি আশা করব তুমি তার সাথে যোগ দেবে।’
জবাব দিল না রানা। ‘কি, দেবে?’ প্রশ্ন করল সাচ্চি।
‘না, সাচ্চি,’ বলল রানা। ‘ওর প্ল্যান সম্পর্কে তোমার আশঙ্কায় ভুল নেই। শত্রুরা এক সময় না একসময় জেনারেলকে খুঁজে বের করে খতম করবেই করবে। সঙ্গে মারা পড়বে তাকে যারা সাহায্য করছে তারাও।’
‘আমার লোকদের কথা বলছ?’ জবাব চাইল সাচ্চি। মাথা নেড়ে সায় জানাল রানা।
আগুনে আরেক দলা থুথু ফেলল সাচ্চি। ‘আমার বাপের আমলে ইতালিয়ানরা এদেশে এসেছিল। পে−ন, বোমা, এসব ছাড়াও নানান আজব অস্ত্র ছিল তাদের কাছে। পাহাড়ে, আমহারিক খ্রিস্টানদের শাসন করেছে তারা। আমাদের দক্ষিণে, গালা শাসন করেছে। কিন্তু অ্যাফার, মানে আমাদের লোকেরা যুদ্ধ করেছে। মরুভূমিতে এসে মরেছে ওরা। এটা ধ্রুব সত্য। বিদেশী লোক যখনই ডানাকিলে অনুপ্রবেশ করেছে, মারা পড়েছে।’
একটু পরে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে রানাকে বিদেয় করল সাচ্চি। অন্যান্য পুরুষ ক্রীতদাসদের কাছে, নিজের জন্যে বরাদ্দ জায়গায় চলে এল ও।
সে রাতে তিনবার ঘুম ভাঙল রানার। একবার ক্রীতদাসী দু’জনের চিৎকারে, আরেকবার এক সিংহের গর্জনে। তৃতীয়বার ভাঙল কোন কারণ ছাড়াই। প্রতিবারই, সজাগ ছিল সাচ্চি।
মালদিনির প্রকাণ্ড তাঁবুতে ক্রীতদাসদের জন্যে চারটে কম্পাউন্ড, ঘেরা তিনটে ও অন্যটা মহিলাদের। কাঁটাতারের বেড়া দেয়া নিচু, পাথুরে পাহাড়ের উপত্যকায় তৈরি করা হয়েছে ওগুলো। নেতাদের অর্থাৎ স্বাধীন মানুষদের জন্যে তাঁবু খাটানো হয়েছে ঝোপগুচ্ছ ও ঝর্নার ধার ঘেঁষে। রাস্তাটা চিনে নেয়ার সুযোগ পেল না রানা। একদল ডানাকিল দৌড়ে এসে ক্যারাভান ঘিরে ফেলল। সাচ্চির সঙ্গে কথাবার্তা বলছে।
ওদের ভাষা রানার অজানা। কিন্তু সাচ্চির দেহভঙ্গি ও রানার উদ্দেশে চকিত চাহনি বলে দিল যুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছে সে। গার্ডদের একটা গ্রুপ রানাকে দ্রুত এক ক্রীতদাস কম্পাউন্ডের দিকে সরিয়ে নিয়ে গেল। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে আদেশ করল।
‘তুমি নিশ্চয়ই সেই আমেরিকান,’ বলে উঠল এক ব্রিটিশ কণ্ঠ, ডান পাশ থেকে।
ঘুরে দাঁড়াল রানা। খোঁড়া এক লোক ক্রাচে ভর দিয়ে এগিয়ে এল। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিচয় পর্ব সারা হলে জানা গেল লোকটার নাম টনি গ্রেগ।
‘তুমি নাকি বিসিআই না কিসের স্পাই শুনলাম। তোমার সাথের মহিলাটি কোথায়?’
রানা কাফেলা আক্রমণের বৃত্তান্ত জানাল।
‘রক্ত পিপাসু, ওই ডানাকিল শালারা,’ বলল লোকটা। ‘পাঁচ বছর আগে ওদের হাতে ধরা পড়ি আমি। ইথিওপিয়ান আর্মি পেট্রলের উপদেষ্টা ছিলাম, ঠোকাঠুকি বাধে মালদিনির ছেলেদের সাথে। পা-টা তখনই খোয়াই। একমাত্র আমিই বেঁচে আছি, আমাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে আর কি, আমাকে দিয়ে ফুট-ফরমাশ খাটিয়ে বোধহয় আমোদ পায় মালদিনি।’
ওর প্রতি সহানুভূতি অনুভব করল রানা। ‘স্পাই, একথা আমি স্বীকার করছি,’ বলল। ‘মালদিনির মতলবটা কি শিয়োর হতে পাঠানো হয়েছে আমাকে।’
‘পুরো দুনিয়াটা দখল করে নেবে,’ সশব্দে হেসে উঠল টনি গ্রেগ। ‘শিগ্গিরই বলবে তোমাকে এসব কথা। তা, ধরা পড়লে কিভাবে?’
জাহাজে কভার ফাঁস হয়ে যাওয়ার কাহিনী শোনাল রানা। জানাল, বিপদটা শুরু হয় জিওনিস্টের এজেন্টটিকে মারধর করে সাগরে ফেলে দেয়ার পর থেকে।
‘ইসরাইল এসবের সাথে জড়িত নয়, মিস্টার রানা,’ বলল টনি। ‘এজায়গাটার কথা জানতে পারলে তোমার দেশের মত ওরাও এটাকে নিশ্চিম করতে দ্বিধা করবে না। ক’সপ্তাহ আগে এক ইসরাইলী স্পাই ছিল এখানে, সে-ই তো খেপিয়ে তুলল জেনারেল
মালদিনিকে।’
টনির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কম্পাউন্ড দেখল রানা। পরিচিত হলো ক’জন আমহারিক ও সবকজন বন্দীর সঙ্গে-দু’জন জার্মান, এক সুইড, আর রাহাত খানের পরিচিত সেই কুদরত চৌধুরী। ভদ্রলোককে চেনে এমন ভাব দেখাল না ও। এরা সবাই ডানাকিলে
এসেছিল মালদিনি ওদের চাকরি দেবে ভেবে, কিন্তু ক্রীতদাস হয়ে পচে মরছে।
‘খুব ভাল লোক মনে হচ্ছে,’ টনিকে বলল রানা।
‘সত্যিই তাই, যদি ষড়যন্ত্র না করে অনুগত থাকতে পারো।’
ডিনারের পর, মালদিনির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেল রানা। পূর্বধারণা ইচ্ছে করেই উপেক্ষা করেছে ও। একমাত্র যে ছবিটা ও দেখেছিল, কয়েক বছর আগে তোলা, তাতে কঠোর চেহারার, কোটরাগত চক্ষু একজন রাজনীতিকের সাক্ষ্য মেলে। রোদে থাকতে থাকতে গায়ের রং তামাটে হয়ে গেছে এখন ওর, এবং চোখজোড়া যেন নিশ্চ্রাণ প্রায়।
দু’জন গার্ড রানাকে নিয়ে এলো তার সামনে।
‘বসুন, মিস্টার রানা,’ আমন্ত্রণ জানাল মালদিনি। নিচু টেবিলটার এপাশে মুখোমুখি বসল রানা। রাইফেলধারী গার্ড দু’জনকে বিদেয় করে দিয়ে একই সঙ্গে কোমর থেকে পিস্তলটা
বের করে হাতের নাগালের মধ্যে রাখল লোকটা।
‘সাচ্চির মুখে জানতে পারলাম, আপনার কারণেই নাকি শেষ কাফেলাটা এসে পৌঁছুতে পেরেছে,’ বলল মালদিনি। ‘সেদিক দিয়ে আমি হয়তো আপনার কাছে ঋণী।’
‘আমি নিজের জীবন বাঁচিয়েছি,’ বলল রানা। ‘ওই ডাকাতগুলো আমাকে মুক্ত করতে আসেনি।’
‘খাঁটি সত্যি কথা। ওয়াইন?’
‘ধন্যবাদ,’ বলল রানা। বাঁ হাতে গেলাসে তরল ঢেলে, মালদিনিকে ওর দিকে সাবধানে ঠেলে দিতে দেখে সতর্কতার মাত্রাটা বুঝল। লাল পানীয় ছলকে পড়ে যাওয়ার দশা, এতটাই গভীর মনোযোগে রানাকে লক্ষ করছিল লোকটা।
‘ম্যাকলিন বলছিল আপনি নাকি খুব ডেঞ্জারাস লোক, যদিও বারে বারে বলেছে, রেডিও অপারেটরকে আপনি মারধর করেননি। মেয়েটাও কিছু বলেনি। হয়তো ঘুমের ঘোরে টলে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। যাকগে, এখানে এলেন কেন?’
‘ইথিওপিয়ান সরকার আমাদের সাহায্য চেয়েছে।’
‘কেজিবির বা জিওনিস্টের সাথে কাজ করছেন?’
‘না, কিন্তু তারাও আপনার প্রতি আগ্রহী শুনেছি।’
‘হ্যাঁ,’ বলল মালদিনি। ‘সিআইএ আর চাইনিজরাও। এত আগ্রহের কারণটা কি, মিস্টার রানা?’
‘তেইশটা মিসাইল।’
‘বাহ্ বেশ আলাপী লোক মনে হচ্ছে আপনি। আপনার ইসরাইলী বন্ধুটি কিন্তু মুখ খোলেনি।’
শব্দ করে হাসল রানা। ‘কার কাছে আছে ওগুলো অজানা নেই কারও। কেন আমাকে পাঠানো হয়েছে তাও বলছি, তার আগে বলুন তো ওগুলো জোগাড় করেছেন কেন? সঙ্গে তিনটে মিনিটম্যান যোগ করেছেন কি জন্যে?’
‘মিনিটম্যানগুলোর কথা বাদ দিন,’ দাবড়ি দিল মালদিনি। এক ঢোকে ওয়াইনটুকু নিঃশেষ করে আরেক গেলাস ঢালল, ‘প্রেস্টার জনের নাম শুনেছেন?’ জিজ্ঞেস করল।
‘কিংবদন্তীর সম্রাট। মধ্যযুগে ইথিওপিয়া শাসন করেছে।’
‘একটু ভুল করলেন। প্রেস্টার জন কিংবদন্তী নয়। সেবার রাণীও তাই। গাল-গল্প ফেঁদে ওরা অভিশপ্ত ইথিওপিয়ানদের বুঝিয়েছিল তারা আফ্রিকার সেরা জাতি। ওরা দেখবেন, বলে আনন্দ পায় আফ্রিকায় একমাত্র ইথিওপিয়াই কখনও ইউরোপীয় কলোনিতে পরিণত হয়নি। উনিশ শতকের শেষ ভাগে অবশ্য ব্রিটেন গণহত্যা চালায় এদের ওপর, এবং উনিশশো ত্রিশের দশকে ইতালিয়ানরা এদেশ শাসন করে, কিন্তু এরা বেমালুম ভুলে যায় ওসব অপ্রীতিকর ঘটনা। আরেকজন প্রেস্টার জনকে মুকুট পরাতে এক পায়ে খাড়া এরা।’
‘আপনাকে?’
‘আমাকে।’
‘বর্তমান ইথিওপিয়ান সরকার বাধা দেবে না?’
‘একান্ত বাধ্য না হলে ঝামেলায় জড়াবে না। তাছাড়া ডানাকিলে টহল দেয়া ওদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই ওরাই হয়তো বিসিআইর মাধ্যমে আপনার সাহায্য চেয়েছে। এবং সেজন্যে এখানে দেখতে পাচ্ছি দুর্ধর্ষ এজেন্ট জনাব মাসুদ রানাকে। কেন জোগাড় করেছি মিসাইলগুলো জানতে চাইছিলেন না? শুনুন তবে, সহজ করেই বলি।’ একটুক্ষণ বিরতি নিল লোকটা। ‘পূর্ব আফ্রিকা শাসন করতে চাই আমি। প্রেস্টার জন কিংবদন্তী সাজতে
পেরেছিল তার কারণ, উত্তর-পুব আফ্রিকায় সে এক সুদক্ষ সৈন্য বাহিনী সমাবেশ করেছিল। এতে করে ইসলামের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়। আমার চারপাশে আছে আধুনিক দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা, অকুতোভয় সৈন্য ডানাকিলরা। ওদের দরকার শুধু একজন যোগ্য নেতা আর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র।’
‘মরুভূমিতে যারা হামলা করল তারাও তো ডানাকিল, ওরা চাইছিল আপনি যাতে মিনিটম্যান মিসাইলগুলো হাতে না পান।’
‘ওরা বিপথগামী,’ ক্রুদ্ধ স্বরে বলল লোকটা। ‘আর জেনে রাখবেন, ওই মিনিটম্যানগুলো কমপি−ট করা হবে। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ক’জন মিসাইল বিশেষজ্ঞ কাজ করছে আমার এখানে। রবার্তো মালদিনির নাম শিগ্গিরিই ছড়িয়ে পড়বে দুনিয়াময়।’ উন্মাদের মত চকচক করছে লোকটার চোখজোড়া। হঠাৎ আঙুল দাবাতে কোথাও বেল বেজে উঠল।
তাঁবুর ঢাকনা সরে যেতে এক আমহারিক যুবতী প্রবেশ করল ভেতরে। প্রায় ছ’ফুট লম্বা মেয়েটি, শরীর প্রদর্শনের জন্যেই পোশাক পরেছে যেন, মুখ থেকে বুক পর্যন্ত ঢাকা এক পাতলা কাপড়ে, এবং তার নিচে লম্বা এক স্কার্ট পরে রয়েছে।
‘এ হচ্ছে জুলেখা,’ বলল মালদিনি। ‘জুলেখা, আমাদের জন্যে আরেকটু ওয়াইন নিয়ে এসো।’
‘জ্বী, জেনারেল মালদিনি,’ চর্চাহীন ইতালিয়ান উচ্চারণে বলল যুবতী।
ও চলে যেতে বলল মালদিনি, ‘ওর বাবা আর চাচা কপটিক চার্চের নেতা। দরবারে প্রভাব আছে। ও যদ্দিন আমার জিম্মায়, ইথিওপিয়ানরা আমার বিরুদ্ধে একপা ফেলবে না।’
জুলেখা ফিরে এসে, রেড ওয়াইনের এক সদ্য মুখখোলা বোতল ধরিয়ে দিল মালদিনির হাতে। ‘ইনি মিস্টার রানা,’ পরিচয় করিয়ে দিল মালদিনি। ‘বলা যায়, গোটা দুনিয়ার তরফ থেকে ইথিওপিয়ায় এসেছেন।’
‘সত্যি?’ ইংরেজিতে শুধাল জুলেখা। মাথা ঝাঁকাল রানা।
‘ইতালিয়ান বলো!’ গর্জে উঠল আধপাগলা। পরমুহূর্তেই শান্ত স্বরে বলল, ‘মিস্টার রানা ক’দিনের জন্যে আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। বেঁচে থাকলে হয়তো আমাদের বিয়েটা দেখে যেতে পারবেন। তোমার বাবা কিংবা চাচা তোমাকে আমার হাতে যখন তুলে দেবে আরকি।’
‘কতবার বলব জান গেলেও একাজ করবে না তারা,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল যুবতী।
‘তোমাকে জ্যান্ত দেখতে চাইলে করবে।’
‘আমি ওদের কাছে অনেক আগেই মৃত।’
‘ওকথা বলে না, লক্ষ্মীটি,’ মিষ্টি করে বলল মালদিনি। ‘আর কিছু দিন পরেই আমি হব ইথিওপিয়ার জামাই, শাসন করব গোটা পূর্ব আফ্রিকা। তখন মেয়ে-জামাইয়ের গর্বে মাটিতে পা পড়বে না তোমার বাপ-চাচাদের।’ হাতের ঝটকায় এবার ওকে দূর করে
দিল মালদিনি। রানার উদ্দেশে বলল, ‘ক’দিন পর আবার কথা হবে আপনার সঙ্গে। আপাতত বন্দী হয়ে থাকুনগে যান।’
হাততালি দিল ও। ক্রীতদাস কম্পাউন্ডে রানাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে গেল দু’জন গার্ড।

মাঝরাতের দিকে ঘুম ভাঙল রানার। গুপ্ত স্থান থেকে ও ছোরাটা বের করতে উঠে বসল আবু হাতেম। আলখাল্লার ভাঁজ থেকে একই রকম আরেকটা ছোরা বের করে কুঁড়েঘরের আবছা আঁধারে একগাল হাসল। এক দিক দিয়ে, আজ রাতটা বাছা ঠিক হয়নি ওদের, কারণ চাঁদমামা ভাগেড়ব-ভাগড়বীদের প্রতি সুবিচার করছে না। আজ জ্যোৎস্না রাত।
আবু হাতেমকে আগে যেতে দিল রানা। পর্দা হিসেবে ব্যবহৃত ডালপালা সাবধানে ফাঁক করল ও। আবু হাতেম ওর হাত ধরে টানতেই সামনে এগোল রানা।
নিঃশব্দে পর্দা গলে বেরিয়ে গেল লোকটা। ওকে অনুসরণ করল রানা। মর্মর শব্দ যাতে না হয় সেজন্যে আলগোছে ডালপালা বসিয়ে দিল জায়গামত। দ্বাররক্ষী দু’জন রানাদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে, মাথা নত। তিনটে মস্ত বড় পাত্র পায়ের কাছে মাটিতে নামানো। ছোরা দিয়ে ওদের দিকে ইঙ্গিত করল রানা।
ওরা সামনে এগোতে বাঁয়ে রানার পাশে খানিকটা সরে এল আবু হাতেম। রানার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিঃশব্দে পা ফেলছে। গার্ডদের আর ওদের মধ্যকার বালির ঢিবিটা পেরিয়ে এল দু’জনে। গার্ডদের কাছে পৌঁছনোর ঠিক আগ মুহূর্তে, রানার পায়ের নিচে শক্ত মাটি গুঁড়ো হয়ে যেতে, ডান পাশের গার্ডটা নড়ে উঠল। এক লাফে সামনে গিয়ে পড়ল রানা, বাঁ হাতে গলা পেঁচিয়ে ধরে রুদ্ধ করে দিল লোকটার চেঁচামেচির সুযোগ। ঘাড়ের নার্ভ সেন্টারে প্রচণ্ড এক চাপ দিল এবার রানা। সামনে বস্তার মত ঢলে পড়ল গার্ড। রানা ঘুরে তাকাতে দেখতে পেল অপর গার্ডের শরীর থেকে ছোরা টেনে বের করছে আবু হাতেম।
‘বন্দুক নিয়ে আসি।’ ফিসফিস করে আওড়াল লোকটা। রানা মুখ খুলতে পারার আগেই মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
পাশের কুঁড়েঘরটা থেকে বেরিয়ে এসে, নিঃশব্দে উটের পাল লক্ষ্য করে ছুটল আলী দাঈ আর জোসেফ ক্রেন। রানা আহত — নিহত পাহারাদারদের অস্ত্র তুলে নিল। একটা ইসরাইলী সাবমেশিন গান, একটা লী এনফিল্ড ও প্রাচীন একটা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন .৩৮ হাতে এসে গেল। গুলি বাছাই করে কুদরত চৌধুরীর দিকে রাইফেলটা বাড়িয়ে দিল রানা।
‘জীবনে কোনদিন গুলি ছুঁড়িনি,’ বললেন মিসাইল বিশেষজ্ঞ।
‘জুলেখা?’ বিড়বিড় করে বলল রানা।
‘রাইফেলটা দাও,’ বলল যুবতী, ‘লোড করতে পারলে শূট করতে অসুবিধা হবে না।’
রানা তখনই শিখিয়ে দিল লী এনফিল্ড লোড করার কায়দা। .৩৮টা বিজ্ঞানীকে দিয়ে বলল, ‘টার্গেটকে কাছে না পেলে বড় একটা কাজে দেবে না এটা। চান্স পেলে তলপেট লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপে দেবেন।’
ছায়ার আড়ালে, রানার বাঁ দিকে নড়ে উঠল কিছু একটা। পাঁই করে ঘুরে সেদিকে রানা সাবমেশিনগান তাক করতেই চাপা কণ্ঠে বলে উঠল জুলেখা, ‘থামো, থামো। আমাদের ডানাকিল কমরেড।’
পরমুহূর্তে ওদের সঙ্গে যোগ দিল আবু হাতেম। হাতে রাইফেল তার, কোমরে পিস্তল বাঁধা। ‘এখন বহুত লোক খুন করতে পারি আমি!’ বড়াই করে বলল।
‘না,’ মাথা নেড়ে বললেন কুদরত চৌধুরী। ‘তোমার গ্রামে নিয়ে চলো আমাদের।’
‘র্যাস হাউজে শুধু একটামাত্র গার্ড আছে,’ বলল ডানাকিল।
‘চলো,’ বলল রানা, পা চালাল উটের খোঁয়াড়ের উদ্দেশে। সাত-পাঁচ ভাবনা চলছে রানার মাথায়। ‘মালদিনিকে খতম করে রেখে যাব নাকি?’ হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বলল। ওর বিশ্বাস মালদিনিকে সাবড়ে দিতে পারলে ওর সংগঠন ধ্বংস হয়ে যাবে।
‘আগে আমাদের পালানোটা বেশি দরকার,’ জরুরী কণ্ঠে বলল জুলেখা। ‘ওর অবস্থান জেনে গেছ, চাইলে যখন ইচ্ছে আবার ফিরে আসতে পারবে কিংবা লোক পাঠাতে পারবে। কিন্তু আমার কথা একটু ভাবো। এতদিন উপযুক্ত মানুষের অভাবে পালাতে পারিনি। তোমাকে দেখে আশায় বুক বেঁধেছি। আমাকে এই জালিমটার হাত থেকে বাঁচাও, দোহাই তোমার।’
‘ও ঠিকই বলেছে, রানা,’ বললেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী। ‘বেচারীকে আসমারা থেকে কিডন্যাপ করে আনে শয়তানটা। ও ছেলেমানুষ, ওর একটা জীবন আছে না? কেন ওই বুড়ো হাবড়াটাকে বিয়ে করতে যাবে ও?’
ওদের অনুরোধ ফেলতে পারল না রানা, কথাগুলোয় যুক্তিও রয়েছে। মালদিনিকে খুন করতে গিয়ে ধরা পড়লে ও তো মরবেই, নিরপরাধ এই মানুষগুলোও বাঁচবে না।
বাংলাদেশী দূতাবাসে পৌঁছনোটা এখন বেশি জরুরী। বিসিআই যখন জানবে মালদিনির বেশিরভাগ মিসাইলই বাতিল মাল, এবং ওর ক্যাম্পের অবস্থান রানার জানা হয়ে গেছে, তখন লোকটার নিউক্লিয়ার ব্ল্যাকমেইল সামাল দেয়ার একটা না একটা উপায় মেজর জেনারেল রাহাত খান ঠিকই বের করে ফেলবেন।
উটের খোঁয়াড়ের সামনে চলে এল ওরা। মৃত এক ডানাকিল গার্ড পড়ে রয়েছে গেটের পাশে। মোটা তার দিয়ে গেটটাকে বেঁধে রাখছে আলী দাঈ, এতটাই শক্ত করে যে বেশ কয়েক মিনিট লেগে যাবে প্যাঁচ খুলতে। কাছেই ছোট্ট এক কুঁড়ের পাশে পাঁচটা উট
অপেক্ষা করছে। ওগুলোকে স্যাডল পরাতে ব্যস্ত জোসেফ ক্রেন।
‘ওকে হেল্প্ করো,’ কুদরত চৌধুরী বললেন আবু হাতেমকে।
‘বেচারী জানোয়ারগুলো,’ আওড়াল ডানাকিল।। ‘সোমালীরা উট চেনে না, ওদের মন বোঝে না।’
কুঁড়ে রেইড করে ক্যান্টিন ও ক্যান্ড্ ফুড যেখানে যা পেল জড় করল রানা, জুলেখা আর কুদরত চৌধুরী।
‘আমরা তৈরি,’ বলল আলী দাঈ। ‘এগুলো মেয়ে উট।’
মেয়ে আর পুরুষ উটে কি পার্থক্য জেনে নিতে হবে, মনে মনে স্থির করল রানা। অবিশ্বাস্য সহ্যক্ষমতা আর বদমেজাজ ছাড়া আজ পর্যন্ত এদের আর কোন বৈশিষ্ট্য চোখে পড়েনি ওর।
গ্রামটা প্রায় ছাড়িয়ে এসেছে এসময় গুলি আরম্ভ করল এক রাইফেলধারী। বাতাসে শিস কেটে গুলিগুলো পার হয়ে যেতে, সাবমেশিনগানটা নামিয়ে নিয়ে উঁচু স্যাডলে ঘুরে গেল রানা। অগিড়বস্ফুলিঙ্গ লক্ষ্য করে, এক ঝাঁক গুলিবর্ষণ করল ও। উটের যা চলনভঙ্গি, লাগাতে পারবে আশা করেনি রানা, কিন্তু বন্ধ হয়ে গেল ও পক্ষের গুলিচালনা।
‘জলদি করো,’ তাগাদা দিলেন কুদরত চৌধুরী।
‘সেটা এই জীবগুলোকে বলুন,’ পাল্টা বলল রানা।
সোমালীদের বুদ্ধিমত্তার প্রতি আবু হাতেমের মনোভাব যা-ই হোক, বলতেই হবে বাছা বাছা উট চুরি করেছে আলী দাঈ। দুনিয়ার দ্রুততম জানোয়ার নয় উট, বলাইবাহুল্য। গ্রামে ঘোড়া থাকলে এতক্ষণে ওদের ধরে ফেলত তাও সত্যি। তবে গতি মন্থর হলেও বিশ্বাস রাখা যায় উটেদের ওপর, শেষমেষ জায়গামত ঠিকই পৌঁছে দেবে।
গ্রাম ত্যাগের দু’ঘণ্টা পর, নিচু পাহাড়সারির মধ্য দিয়ে এবং নদীর আশপাশের বালুময় চিলতে ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে উটচালনা করছিল রানারা। একটু পরে, আবু হাতেম ইশারায় মোড় ঘুরে পানির দিকে যেতে নির্দেশ করল।
‘যত খুশি পানি খাক উটগুলো,’ বলল ও। ‘ক্যান্টিন পানিতে ভরে নাও। আর যতটা পারো নিজেরাও গেলো।’
‘নদী অনুসরণ করলেই পারি আমরা,’ বৃদ্ধ বিজ্ঞানী মন্তব্য করলেন। ‘উজানে যাচ্ছি, এবং যেতেও চাই সেদিকে।’
‘নদী পারের লোকজন ওদের দোস্ত,’ যে গ্রামটা থেকে পালিয়েছে ওরা, আবু হাতেম তর্জনী দেখাল সেদিকে। ‘এরা আমার বন্ধু না। নদীর ধার ধরে খুঁজবে আমাদের। মরুভূমিতে যাব আমরা।’
‘যুক্তি আছে ওর কথায়,’ বিজ্ঞানীকে বলল রানা। ফিরল ডানাকিল গাইডের দিকে। ‘পর্যাপ্ত পানি আর খাবার আছে আমাদের সঙ্গে?’
‘না,’ বলল আবু হাতেম। ‘কিন্তু পেয়ে যাব হয়তো। আর নয়তো যাদের আছে তাদের দেখা পাব।’ রাইফেলে চাপড় দিল। ‘আমি যখন এসেছি, ভেলায় চড়ে এসেছি,’ বললেন কুদরত চৌধুরী। ‘জার্নিটা তখন খুব বেশি লম্বা মনে হয়নি, আর…’
‘মরুভূমি,’ ওঁর কথা কেড়ে নিল রানা। ‘ক্যান্টিন ভরতে শুরু করুন। মালদিনি সবার সামনে দিয়ে আপনাকে নদীপথে নিয়ে এলে বুঝতে হবে, তীরে ভাল প্রভাব আছে ওর।’
‘এটা ভেবে দেখিনি তো,’ বললেন বিজ্ঞানী। ‘মরুভূমি,’ বলল আলী দাঈ, ‘বাস করার জন্যে মরুভূমি দারুণ জায়গা।’
‘তা যা বলেছ,’ টিটকারি মেরে সায় জানাল জোসেফ ক্রেন।
কে কার চেয়ে ভাল উট সামলায়, এবং মরুবিশেষজ্ঞ হিসেবে কে কাকে টেক্কা দেবে, তার প্রতিযোগিতা চলছে আবু হাতেম ও আলী দাঈর মধ্যে। এদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যতক্ষণ লাভবান হচ্ছে চিন্তা নেই, ভাবল রানা, কিন্তু খাবার-পানি কমে এলে ওরাই না আবার রানাদের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকায়। তাছাড়া আবু হাতেমের এলাকায় প্রবেশের পর তার আচরণ কেমন হবে রানা সে ব্যাপারেও চিন্তিত। তখনও কি বন্ধু ভাববে ওদের, নাকি বাগে পেয়ে খুন করে কিছু নতুন বালা বাগাতে চাইবে?
নদী পেরিয়ে রাতের আঁধারে পালাচ্ছে দলটা। রানা লক্ষ করেছে পুব থেকে উত্তরে এগোচ্ছে ওরা, ফলে ঊষার আলো ফুটি ফুটি করতে পশ্চিমের ছায়াময় পাহাড়সারি দূরে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। ক্ষণিকের জন্যে, আবু হাতেমের বিবেচনা বোধ সম্পর্কে রানার মনে প্রশেড়বর উদয় হলো। লোকটা মরুভূমির বিরূপ পরিবেশে অভ্যস্ত, কিন্তু আর সবাই তো তা নয়, তারা ভয়ঙ্কর অসহায় এখানে।
কিন্তু পরে মনে হলো লোকটার প্ল্যানে কোন ফাঁক নেই। মরুভূমির জঘন্যতম অঞ্চলের ওপর দিয়ে নিয়ে চলেছে, গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ উপেক্ষা করছে, এভাবে হয়তো দূর উত্তরে, তিগ্রাই প্রদেশে পৌঁছে মালদিনির প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত হতে পারবে ওরা। যথার্থ কারণ ছিল, আবু হাতেমের পর্যাপ্ত পানি নিতে বলার পেছনে। পশ্চিমমুখো না হওয়া অবধি ধু-ধু, জ্বলন্ত বালির বুকে থাকতে হবে দলটিকে।
অবশেষে মাঝবিকেলে ওদের থামতে নির্দেশ দিল আবু হাতেম। বাতাসের ঝাপ্টায় উড়ছে বালি। উঁচু বালির ঢিবিগুলোর মাঝে একটা অবতলের মত সৃষ্টি হয়েছে। পুবের ছোট্ট এক ফোকর দিয়ে কেবল প্রবেশ করা যায় প্রাকৃতিক বৌলটার মধ্যে। গোটা দশেক উট রাখার মত সুপরিসর জায়গাটা, বিশ্রামের জন্যে আদর্শ।
রানা কৃতজ্ঞচিত্তে নেমে পড়ল। আড়মোড়া ভেঙে, বরাদ্দ থেকে পান করল সামান্য পানি। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আশা করা যায় ছায়া দেবে ঢিবিগুলো।
ছায়া! টনি গ্রেগের সরবরাহ করা ইউরোপীয় পোশাকের পিন্ডি চটকাল রানা মনে মনে। আহা, এমুহূর্তে যদি এগুলো পাল্টে স্থানীয় আলখাল্লা গায়ে চড়াতে পারত। যাত্রার শেষ দিকে, পানি, লোকজন আর জন্তু-জানোয়ার চোখে পড়ছিল রানার-বলাবাহুল্য, কল্পনায়। আরেক ঢোক পানি গিলে এযাত্রা টিকবে কিভাবে ভাবতে লাগল ও।
‘পাহারা বসাতে হবে?’ আবু হাতেমকে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘হ্যাঁ। ওরা পিছু নেবে। লোকলস্কর আর উটের অভাব নেই ওদের। একদিনে আমাদের ট্র্যাক বাতাসে মুছে যাবে না। আমি আর সোমালীটা দিনের বেলা পাহারা দেব। তুমি রোদের মধ্যে ভাল দেখতে পাবে না। ক্রেন আর তোমার ডিউটি রাতে।’
এতটাই ক্লান্ত, খেতে মন চাইছে না, রানা লক্ষ করল আবু হাতেম বুকে হেঁটে সবচাইতে উঁচু ঢিবিটায় গিয়ে উঠল। আত্মগোপন করে এলাকাটা জরিপ করার জন্যে নিজের কবর রচনা করল বালিতে। ওর উটের ছায়ায় শুয়ে চোখ বুজল রানা। একসময় কাঁধ ধরে আলী দাঈ ঝাঁকাতে ঘুম ভাঙল। সূর্য পাটে বসেছে।
‘এখন তোমার পালা,’ বলল আলী দাঈ। ‘কিছু খেয়ে নাও।’
রানা ওকে ঘুমাতে যেতে বলে, বীফের একটা টিন খুঁজে বের করল। ঘুমন্ত কুদরত চৌধুরীকে টপকে টিনটা আনতে হয়েছে ওকে। বৃদ্ধ বিজ্ঞানীর শারীরিক অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়। এরকম আর কটা দিন টিকবেন কে জানে। কোথায় অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরী আর কোথায় ইথিওপিয়ার কান্তার মরু। বেচারা! ইচ্ছে করেই ওঁকে পাহারা দেয়া থেকে বাদ রেখেছে ওরা। বীফের কৌটো খুলে বালির উঁচু ঢিবিটার উদ্দেশে পা বাড়াল।
আবু হাতেম আর আলী দাঈ আবছা এক পায়ে চলা পথ তৈরি করেছে। ওটা অনুসরণ করল রানা, বেগ পাচ্ছে দ্রুত পরিবর্তনশীল ঢালের ওপর দেহ-ভারসাম্য বজায় রাখতে। মাথার ওপর অগুনতি নক্ষত্র রাতের মরুর স্বচ্ছ বাতাস, সারা দিনের অসহ্য গরমের পর, কেমন কাঁপ ধরিয়ে দেয় শরীরে। ঢিবির চূড়ায় বসে খাওয়ায় মন দিল রানা। গরুর মাংস লবণে ভর্তি, বিস্বাদ। কি আর করা, এখন এই-ই খেতে হবে।
আগুন জ্বালেনি ওরা। পশ্চিমের পর্বতমালায় আরেকটা দল রয়েছে, বেঁচে থাকার প্রশেড়ব রানাদের চাইতে অনেক আত্মবিশ্বাসী তারা, পিছু নিয়ে ওদেরকে অতর্কিতে হামলা করবে শত্রুপক্ষ সে ভয় করছে না। ছোট্ট করে আগুন জ্বাললেও, নির্মল বাতাসে আর রাতের অন্ধকারে সেটাকেই উজ্জ্বল আলোক-সঙ্কেতের মত দেখাচ্ছে। মালদিনির লোকদের ভুল পথে নিয়ে যাক ওটা, কামনা করল রানা।
মাথার অনেক ওপর থেকে জেটপে−নের গোঁ-গোঁ শব্দ ভেসে এল। মুখ তুলে চাইল রানা। বাতি পিট পিট করছে, কমপক্ষে আট হাজার ফীট উচ্চতা বজায় রেখেছে ওটা অনুমান করল ও। মালদিনির পে−ন-হেলিকপ্টার নেই। ইথিওপিয়ানরা আকাশ থেকে ওকে স্পট করতে পারল না কেন, প্রশ্নটা আবারও পেঁচিয়ে গেল মগজের মধ্যে। হয়তো ঘাটে ঘাটে পয়সা দিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ লোকজনদের ঠুঁটো করে রেখেছে লোকটা, ব্যাখ্যা দাঁড়
করাল মনে মনে।
নাহ, আর সম্ভব নয়। একটু গড়িয়ে না নিলে আর চলছে না। যাত্রার ধকলে ঢলে পড়তে চাইছে শরীর। নির্দিষ্ট সময় শেষ হতেই ঢিবির ঢাল বেয়ে নেমে এল রানা।
জোসেফ ক্রেন যখন পাহারায়, এমনি সময় হামলাটা করল মালদিনির লোকেরা। ওর হুঁশিয়ারী চিৎকারে মুহূর্তে সজাগ হয়ে গেল রানা। .৩৮ এর ছোট, ভোঁতা গর্জনটা এবার শুনতে পেল। পাল্টা জবাব দিল কমপক্ষে গোটা দুই অটোমেটিক আর কয়েকটা রাইফেল। রানা ছোঁ মেরে ওর সাবমেশিনগান তুলে নিল।
টলমল করতে করতে তিন আক্রমণকারী ঢিবি বেয়ে নেমে আসছে, সঙ্গে চলছে ফায়ারিং। কাঁধে বাট ঠেকিয়ে অ্যাকশনে সামিল হলো রানা। নিচে যখন নামল, দলটার কেউই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নেই।
ওর পাশ থেকে ‘বুম’ ‘বুম’ শব্দ করছে জুলেখার রাইফেল। সাঁ করে মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট। আবু হাতেম, কুদরত চৌধুরী আর আলী দাঈ যুদ্ধে যোগ দিয়েছে, যুগপৎ ওপেন করেছে ফায়ার। ঢিবির ফাঁক-ফোকর দিয়ে মূলত স্রোতের মত ধেয়ে আসছে প্রতিপক্ষ। দলবদ্ধতার কারণে আসলে কপাল পুড়ছে ওদের। সহজেই রানারা টপাটপ ফেলে দিচ্ছে শত্রুদের।
যত দ্রুত শুরু হয়েছিল, ঠিক ততটাই দ্রুত থেমে গেল সব গোলমাল। চারধারে নজর বুলিয়ে আরও টার্গেট খুঁজল রানা। অবতলের মধ্যখানে ওরা চারজন দাঁড়িয়ে। ওদের একটা উট মাটিতে শুয়ে ছটফট করছে। অন্যগুলো ঘাবড়ে গিয়ে ডাকাডাকি করছে আর ছুটে পালানোর পাঁয়তারা করছে।
‘ওগুলোর ব্যবস্থা করো, আলী,’ জরুরী কণ্ঠে বলল রানা।
লোকটা দৌড়ে গেল উটেদের কাছে।
‘আমি ওখানটা পাহারা দিচ্ছি,’ বলল আবু হাতেম, তর্জনী দেখাল মূল আক্রমণটা যেদিক থেকে এসেছিল। ‘তুমি জোসেফের খোঁজ নাও!’
চাঁদের উদ্ভাসিত আলোয় ছড়িয়ে পড়ে থাকা দেহগুলোর উদ্দেশে বেপরোয়ার মত ছুটল ডানাকিল। যে তিনটেকে গুলি করেছিল তাদের দিকে সন্তর্পণে এগোল রানা। ফোকরের দিক থেকে একটা আর্তচিৎকার কানে এল। চকিতে চাইল রানা। কিলবিল করছে একটা দেহ, সেটার দিকে অস্ত্র নির্দেশ করছে আবু হাতেম।
রাইফেলের শব্দ হওয়ার আগেই ঘুরে গেল রানা। তালগোল পাকিয়ে পড়ে থাকা লোক তিনটের জট ছাড়াতে ব্যস্ত হলো। একজনকে মনে হলো মৃত, কিন্তু বাকি দু’জন গুরুতর জখম হলেও শ্বাস নিচ্ছে। ওদের অস্ত্র জব্দ করে, আহতদের নিজেদের ক্যাম্পের দিকে ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে এল রানা। তারপর ঢিবির চড়াই বাইতে আরম্ভ করল।
পেছন থেকে এসময় গুলির শব্দ হলো। পাঁই করে ঘুরল রানা, অস্ত্র উঁচিয়ে ধরেছে। এক লোকের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে জুলেখা। রানা লক্ষ করছে, আরেকজনের কাছে সরে গেল যুবতী, আধমরা লোকটাকে মাথায় গুলি করল মেয়েটা। তারপর ঢিবির ঢালে রানার সঙ্গে এসে যোগ দিল।
‘এদের নিয়ে কি করবে?’ রানাকে প্রশ্ন করল।
‘এখানে রেখে যাব ভাবছি।’
‘আমরা কখন গেছি, কোন্দিকে গেছি মালদিনিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানর জন্যে?’ হেসে উঠল যুবতী। ‘ওরা আমাদের খুন করতে এসেছিল, রানা, বন্দী করে নিয়ে যেতে নয়।’
‘চৌধুরী সাহেব কোথায়?’
‘ওঁকে আড়ালে থাকতে বলেছি,’ জানাল জুলেখা।
জুলেখাকে পেছনে নিয়ে ঢিবিতে উঠে এল রানা। চূড়ার কাছে নিথর শুয়ে জোসেফ ক্রেন। দেহটা উল্টে দিয়ে মুখ থেকে বালি ঝেড়ে দিল রানা। মুখের ভেতর থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে নামল কষা বেয়ে। গোটা বুক ও তলপেট গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে লোকটার। বালিতে লাশটা শুইয়ে রেখে বুকে হেঁটে চূড়ায় উঠে এল রানা। উঁকি দিল আলগোছে।
ঢালের মাঝামাঝি হাত-পা ছড়ানো একটা দেহ নজর কাড়ল প্র মে। যাক, একজনকে অন্তত খতম করে গেছে জোসেফ। পাহারা দিতে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল কিনা ভাবল রানা, নাকি শত্রুপক্ষ আসছে টেরই পায়নি? চন্দ্রালোকিত মরুতে ওদের উট দেখা যেতে পারে, কিন্তু দৃষ্টিসীমার মধ্যে কিছুই দেখতে পেল না ও।
উটে চেপেই এসেছে ওরা। যানবাহন হলে শব্দ পাওয়া যেত। এলাকাটা তনড়ব তনড়ব করে নিরীখ করছে রানা, শরীরটা নুইয়ে রেখেছে যাতে চাঁদের আলোয় সিলুয়েট ওর প্রকাশ হয়ে না পড়ে। বেশিক্ষণ নয়, সামান্য পরেই এক বালির ঢিবির আবছায়ায় উটগুলো নজরে এল ওর। প্রতিপক্ষের দু’জন লোক ওগুলোর কাছে দাঁড়ানো, তাদের উত্তেজিত ভাব-ভঙ্গি বলে দিচ্ছে অবতলের ঘটনা সম্পর্কে তারা স্পষ্টতই স্নায়ুর চাপে ভুগছে। রানাদের ক্যাম্পে আসার রাস্তার মধ্যখানে ওদের অবস্থান। কাজেই আবু হাতেমের হাতে সঙ্গীদের নির্মম মৃত্যু, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ওরা দেখতে পায়নি।
খুব সাবধানে, শূটিং পজিশনে নিয়ে সাবমেশিনগান তাক করতে লাগল রানা। কিন্তু সাবধানতা সত্ত্বেও ধরা পড়েই গেল। একটা লোক চেঁচিয়ে উঠে ওকে লক্ষ্য করে রাইফেল তুলল। চকিতে এক পশলা গুলিবর্ষণ করল রানা, লোকটাকে লাগাতে ব্যর্থ হলেও, তার লক্ষ্য টলিয়ে দিল। ফলে শত্রুর রাইফেলের বুলেট ওর অনেকখানি বাঁয়ে বালি ছিটকে তুলল। ভয় পেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল গোটা কয়েক উট।
দ্বিতীয় লোকটা লাফিয়ে সওয়ার হলো একট উটের পিঠে।
এবার সময় নিয়ে লক্ষ্যস্থির করার সুযোগ পেল রানা। গুলিবিদ্ধ আরোহীকে ফেলে মরুভূমিতে ছুটে পালাল জানোয়ারটা। ফাঁকটার কাছে হঠাৎ এক ছায়ামূর্তি উদয় হলো, পরমুহূর্তে রানার মুখের ক’ইঞ্চি তফাতে বালি ছিটকে উঠল। গোলাগুলির শব্দে আতঙ্কিত উটগুলোর দিগ্বিদিক্ ছোটাছুটির ফলে পাল্টা গুলি চালাতে ব্যর্থ হলো রানা। কিন্তু পরমুহূর্তে নেই হয়ে গেল জানোয়ারগুলো, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে মরুভূমির বুকে-সওয়ারীদের ফেলে। মাটিতে কালো মত একটা পিণ্ড পড়ে আছে, আধো আলো আধো অন্ধকারে। রানা লক্ষ করল, ঝিক করে উঠল একটা ছোরা। আর তারপর কানে এল এক পিলে চমকানো আর্তচিৎকার।
ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াতে দেখা গেল একজনকে। বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে অপরজন। এসময় হাঁচড়ে পাঁচড়ে ঢিবির মাথায় উঠে এল জুলেখা। সাবমেশিনগান রানার হাতে রেডি।
‘ছোরাবাজটা আবু হাতেম,’ বলল জুলেখা।
‘ঠিক জানো?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার নাইট ভিশন তো দারুণ!’
উঠে দাঁড়াল ওরা। ডানাকিল রানাদের উদ্দেশে হাত নেড়ে নেচেকুদে অস্থির।
‘আলী দাঈকে বলো গিয়ে আর গুলি না করতে,’ রানা বলল জুলেখাকে।
‘করবে না। উটেদের সঙ্গে লেগে আছে সে।’
ঢাল বেয়ে হড়কে নেমে আবু হাতেমের সঙ্গে যোগ দিল রানা।
‘ছুরির খেল ভাল দেখিয়েছ,’ প্রশংসার সুরে বলল।
‘আমরা ওদের খতম করেছি,’ বলল লোকটা, বন্ধুসুলভ ভঙ্গিতে রানার কাঁধে হাত রাখল।
‘আলী দাঈর কি খবর? ও ক’জনকে মারল?’
‘ওই সোমালী? ফুহ্, মারবে কি, দেখোগে ভয়ে নিজেই হয়তো মরে পড়ে আছে।’ আঁধারে চারধারে দৃষ্টি বুলাল লোকটা। ‘ওদের কাছে যদি রেডিও থেকে থাকে? হয়তো মারা পড়ার আগে মালদিনিকে খবর দিয়ে গেছে। এক ব্যাটার পিঠে একটা জিনিস দেখেছি। রেডিও মনে হলো।’
‘রেডিও? কই দেখি,’ সাগ্রহে বলল রানা।
রানাকে একটা মৃহদেহের কাছে নিয়ে এল ডানাকিল। লাশের বহন করা খোলা প্যাকের ভেতরটা লক্ষ করল রানা। হ্যাঁ একটা ফিল্ড ট্র্যান্সিভারই বটে। লং রেঞ্জের।
‘এটা রেডিওই,’ বলল ও।
পরমুহূর্তে এক ঝাঁক বুলেট রানার পা ঘেঁষে চুরমার করে দিল ট্র্যান্সিভার। ভেতরটা ছিনড়বভিনড়ব হয়ে উড়ে গেল যন্ত্রাংশের নানা পার্টস। ঘুরে দাঁড়িয়ে আবু হাতেমকে গুলি চালনা বন্ধ করতে বলবে, তার আগেই ম্যাগাজিন খালি। একপাশে রাইফেলটা ছুঁড়ে
ফেলে দিল ডানাকিল।
‘এখন আর আমাদের খুঁজে পাবে না,’ বলল লোকটা। ‘কেউ রেডিও ব্যবহার করে আমাদের খোঁজ পাচ্ছে না।’
‘দুনিয়ার কেউ না,’ সায় জানাল ঈষৎ ক্ষুব্ধ রানা। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মৃতদেহগুলোর মাঝ দিয়ে পথ করে নিয়ে উটগুলোর কাছে ফিরে এল ওরা। মরুভূমির জংলীটার ওপর মেজাজ দেখিয়ে কোন লাভ নেই। ও-ই তো গাধার মত চুপ করে না থেকে, আগে বোঝাতে পারত লোকটাকে, রেডিওটা ব্যবহার করে মুক্তি চেয়ে বার্তা পাঠানো যায়। তাহলে নিশ্চয়ই ওটা ধ্বংস করতে যেত না আবু হাতেম। বাঁচতে চাইলে, বুঝতে পারছে রানা হাড়ে হাড়ে, এদের মত চিন্তা-ভাবনা নিয়ে চলতে হবে মরুভূমিতে।
‘কয়েকটা দুঃসংবাদ আছে, রানা,’ ক্যাম্পে ফিরতে বললেন কুদরত চৌধুরী। ‘আমি জানি না ড্রাগ শেষ হলে আমার অনুচররাও বিপক্ষে চলে যাবে কিনা। আর আসল খারাপ খবরটা হলো, যে উটটার পিঠে বেশিরভাগ খাবার-দাবার ছিল সেটা মারা পড়েছে। ওর মাল-পত্র, আর প্রচুর পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট হয়েছে। এখনও পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। আলী দাঈ যতটা পারে বাঁচানর চেষ্টা করছে।’
‘কি বলছেন?’ আবু হাতেমের জিজ্ঞাসা।
ধীরে ধীরে পুরোটা ইতালিয়ানে বলল ওকে জুলেখা।
‘মালদিনির লোকদের কাছে পানি থাকতে পারে।’
‘ছিল, কিন্তু মাত্র তিনজনের ক্যান্টিনে। এবং সেগুলোও আধখালি। উটের পিঠে পানি ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু এখন ওগুলোকে পাবে কোথায়? বেওয়ারিশ জানোয়ারগুলো কোন্ নরকে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে!’
‘আমাদের এ জায়গা ছাড়তে হবে,’ বলল আবু হাতেম।
‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘হামলা করার আগেই হয়তো রেডিও ব্যবহার করেছিল ওরা।’ আলী দাঈর কাছে গেল ও। ‘কি খবর?’
‘ভাল,’ জবাব এল। ‘উটের অন্তত অভাব হবে না।’
উটে চেপে রাতেই রওনা হয়ে গেল দলটা। আবু হাতেম ও আলী দাঈ দু’জনেই অবিরাম জরিপ করে গেল মরুভূমি। সূর্য উঠতে পেছনে দিগন্ত নিরীখ করল, অনুসরণকারীদের চিম দেখতে পায় যদি। রানাও লক্ষ করল, কিন্তু স্থানীয়দের চোখ এড়াচ্ছে এমন কিছু দেখার আশা নেই, জানে ও। সম্ভবত সবার অলক্ষে পালাতে পেরেছে ওরা।
‘মালদিনির হাত কতদূর লম্বা?’ জুলেখাকে প্রশ্ন করল রানা।
‘আজ-কালের মধ্যে ওর প্রভাববলয় পেরোতে পারব আমরা।
কোন সর্দার যদি অতিরিক্ত ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে, বড়সড় এলাকা নিয়ে শাসন করে, তাকে চিনে যায় আদ্দিস আবাবা। মালদিনি তেমন নয়, মানে আমার ধারণা আরকি। এখনও তো হুমকি দিতে শুরু করেনি সে।’
পানির অপ্রতুলতা ভাবাচ্ছে রানাকে। প্রচণ্ড দাবদাহ ডিহাইড্রেটেড করে দিচ্ছে সবাইকে। পানির রেশনিং এতটাই কঠোরভাবে মেনে চলেছে ওরা, গলায় সার্বক্ষণিক বালির অস্তিত্ব
টের পাচ্ছে রানা। মাথা ঝিম্ ঝিম্ করছে ওর, জ্বরাক্রান্ত অনুভূতি।
সেদিন বিকেলে থামলে পর, আবু হাতেমকে সমস্যাটা নিয়ে প্রশ্ন করল রানা।
‘আরও চারদিনের পানি লাগবে আমাদের,’ বলল সে। ‘কিন্তু দু’দিনের মধ্যে, পাহাড়ের দিকে মোড় নিয়ে পানির খোঁজ বের করে ফেলতে পারব। বন্দুকঅলা লোকজনের দেখাও পেয়ে যেতে পারি।’
‘পানি কোন সমস্যা না,’ সায় দিয়ে বলল আলী দাঈ।
ওকে অগ্রাহ্য করল ডানাকিল।
‘পানি কোথায় পাব জানো তুমি?’ কুদরত চৌধুরীর প্রশ্ন।
‘না। দুধ কোথায় আছে জানি। চেয়ে থাকুন, দেখতে পাবেন।’
নিজের উটের কাছে গিয়ে, শূন্য এক চামড়ার থলে স্যাডল থেকে তুলে নিল ও। পরম সতর্কতায় পরখ করে নিশ্চিত হলো ফুটো-ফাটা নেই ওটায়, এবার পিছু সরে এসে উটগুলোকে নিরীখ করল। একটার দিকে হেঁটে গিয়ে গল্প জুড়ে দিল। জন্তুটা সরে গেল ওর সামনে থেকে।
‘জানোয়ারটা পালালে ব্যাটাকে হাঁটতে হবে,’ ঘোষণা করল আবু হাতেম।
আলী দাঈ বকবক করেই চলেছে। উটটা সমঝদারের মত শুনছে মনে হলো। সামান্য একটু পিছু হটে, ঠায় দাঁড়িয়ে ছোট মানুষটাকে লক্ষ করছে। এবার ঘাড়টা একটুখানি সামনে আনল, থুতু দেবে না কামড় ভেবে পেল না রানা। চুরি করার পর থেকে নিজের উটটার সঙ্গে ব্যক্তিগত লড়াই চলছে ওর, এবং পায়ে চার চারটে বেদনাময় কামড় খেয়ে এ মুহূর্তে হারু পার্টি সে।
মৃদু কণ্ঠে কথা বলে যাচ্ছে আলী দাঈ। উটটা এগিয়ে এল, নাক ঘষল, অপেক্ষা করছে মানুষটা কখন ওকে আদর করবে। ধীরে সুস্থে ওটার গায়ের কাছে সেঁটে আসছে সোমালী, নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিল একটা পাশ। মুখ চলছে, লম্বা জানোয়ারটার নিচে পৌঁছে হাত বাড়াল দুধের বাঁট ধরতে। দাঁড়ানর ভঙ্গি পাল্টে গেল উটটার।
‘আগে কখনও হয়তো এগুলোর দুধ দোয়ানো হয়নি,’ বলল জুলেখা।
‘ওকে খুন করে ফেলবে,’ বলল আবু হাতেম।
‘আল্লার কাছে দোয়া করো যেন না করে,’ বলল রানা। ‘ও মরলে আমরাও কেউ বাঁচব না।’
কুলুপ পড়ল ডানাকিলের মুখে। আলী দাঈকে লক্ষ করছে রানা। অত্যন্ত ধীর-শান্ত গতিতে নড়াচড়া করছে সে, দুধ দোয়ানোর জন্যে মিষ্টি কথায় ভোলাতে চাইছে উটটাকে। বউকেও কেউ বাসর রাতে এত মধুর কথা বলে না। আচমকা বাঁট চেপে ধরে থলেটা নিয়ে এল সে জায়গা মতন। ঝাঁকি দিয়ে সরে গেল জানোয়ারটা। মুহূর্তের জন্যে কেমন থমকে মত গেল আলী দাঈ। স্থাণুর মতন দাঁড়িয়ে এখন। হঠকারী পদক্ষেপ নিলে চোখের
পলকে পগার পার হয়ে যাবে উটটা। এবং এর অর্থ, মরুভূমিতে দলের অন্তত একজন মারা পড়বে। জুলেখা, কুদরত চৌধুরী, আবু হাতেম আর রানা নিস্পন্দ থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। উটটাকে লক্ষ করে রানার ধারণা হলো, গরুর কিংবা ছাগলের দুধ
দোয়ানোর মত সহজ করে প্রকৃতি এদেরকে গড়েনি।
আরেকবার উটটার কাছ ঘেঁষে এল আলী দাঈ। শরীরের এক পাশে ধরে রেখেছে থলেটা। সেই আগের প্রক্রিয়া এবারও খাটাতে চেষ্টা করল ও। এদফায় বাঁট চেপে ধরতে মৃদু গান গেয়ে উঠল যেন উটটা, এবং তারপর নীরব হয়ে গেল। দ্রুত হাতে দুধ দোয়াচ্ছে আলী দাঈ, মাঝে মধ্যে থলেটা সরে গেলে লাথি মেরে বালির খুদে ফোয়ারা তুলছে উট। অবশেষে, সরে এল ও, তার আগে মৃদু আদুরে চাপড় দিল ওটার পশ্চাদ্দেশে। এবার সঙ্গীদের দিকে ঘুরে তাকাল, বেরিয়ে পড়েছে বত্রিশ পাটি দাঁত।
চামড়ার থলে উপচে পড়ছে দুধে। লম্বা এক চুমুক দিয়ে রানার কাছে হেঁটে এল সোমালী। ‘মজা আছে,’ বলল। ‘খেয়ে দেখো।’ থলেটা বৃদ্ধ কুদরত চৌধুরীর দিকে বাড়িয়ে দিল রানা। বিজ্ঞানী চুমুক দিলেন মুখ বিকৃত করে।
‘সোমালীরা উটের দুধ খায়,’ ফস করে বলে বসল আবু হাতেম। ‘ওরা উটের বাচ্চা।’
ক্রুদ্ধ গর্জন ছেড়ে কোমরে গোঁজা ছুরিতে টান দিল আলী দাঈ। ডানাকিল তার নিজের ছুরি ইতোমধ্যে বের করে ফেলেছে। বিদ্যুৎগতিতে লাফিয়ে পড়ে রানা লোক দুটোকে কোনমতে ঠেকাল। দু’জনের মাঝখানে দাঁড়ানোর মত বোকামি করেনি ও। কিন্তু অতর্কিতে চেপে ধরাতে দু’হাতে দু’জনকে মাটিতে নুইয়ে দিতে পারল। সাবমেশিনগান তাক করল এবার ও। ‘যথেষ্ট হয়েছে!’
পরস্পরকে দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দিল ওরা।
‘আমাদের উটের দুধ খাওয়াতে পারবে তুমি?’ আবু হাতেমের কাছে জবাব চাইল রানা।
লোকটা ওর কথার জবাব দিল না।
এবার আলী দাঈর উদ্দেশে ফিরে বলল রানা, ‘তুমি আমাদের গাইড করে মরুভূমি পার করতে পারবে?’
‘ও অপমান করেছে আমাকে,’ বলল সোমালী।
‘আর তোমরা দু’জনেই আমাকে অপমান করেছ!’ গর্জে উঠলেন বিজ্ঞানী। ওদিকে রানা তাক করে ধরে আছে সাবমেশিনগান।
সাবধানে শব্দ বাছাই করে, ধীর-সংযত ইতালিয়ানে বলল রানা, ‘তোমরা একে অন্যকে মারতে চাইলে ঠেকাতে পারব না আমি। এই বন্দুক দিয়ে তোমাদের সর্বক্ষণ পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। আমি জানি তোমরা বংশগতভাবে শত্রু। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো। তোমাদের মধ্যে একজন যদি মরো-কিংবা আমাদের কেউ একজন যদি মরে-সবাই মরব।’
‘কিভাবে?’ আবু হাতেম জিজ্ঞেস করল।
‘শুধু আলী দাঈর পক্ষেই দুধ জোগানো সম্ভব। আর তোমার পক্ষে সম্ভব আমাদের মরুভূমি পার করা।’
‘আর তোমরা দু’জন?’ সোমালীর প্রশ্ন। ‘চৌধুরী সাহেবের কথা বলছি না। উনি আমাদের ওস্তাদ।’
‘আমি মরলে মালদিনি পুরো মরুভূমি তো নেবেই আরও অনেক জমি কব্জা করে নেবে। তোমাদেরকে তনড়ব তনড়ব করে খুঁজবে সে, ওর সঙ্গে বেঈমানী করেছ যেহেতু। এবং একমাত্র জুলেখাই সময় মত তার লোকেদের সতর্ক করতে পারবে, যাতে অস্ত্রশস্ত্র এনে লোকটাকে ওরা খুন করতে পারে।’
ক’মুহূর্তের নীরবতার পর দেহের পেশী শিথিল হলো আবু হাতেমের। ছোরাটা খাপবন্দী করল সে। তারপর দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
‘তুমি যোদ্ধাদের নেতা। তুমি বলছ যখন বিশ্বাস করলাম। সোমালীটাকে আর অপদস্থ করব না কথা দিচ্ছি,’ চেঁচিয়ে বলল।
‘বেশ,’ বলল রানা, চাইল নিচের দিকে। ‘যা হয়েছে ভুলে যাও। ছোরাটা ভরে রাখো।’
খাপে ছোরা ভরে ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল আলী দাঈ। ওর অভিব্যক্তি পছন্দ হলো না রানার। একে চোখে চোখে রাখতে হবে।
‘খেতে ভাল না,’ বলল জুলেখা, থলেটা বাড়িয়ে ধরল রানার দিকে। ‘কিন্তু পুষ্টিকর।’
লম্বা করে শ্বাস টেনে ঠোঁটের কাছে তুলল ওটা রানা। দুর্গন্ধে বমি এল ওর। এর তুলনায় ছাগলের গন্ধযুক্ত দুধ স্বর্গসুধা বলা চলে। প্যাকেটে করে বেচলেও এ জিনিস কারও গলা দিয়ে নামবে কিনা সন্দেহ। খুদে খুদে পিণ্ড ভাসছে দুধে, এবং রানা নিশ্চিত নয়, ওগুলো ক্রিম, চর্বি নাকি থলের নোংরা। দুধটার স্বাদও জঘন্য।
ডানাকিলের হাতে থলেটা গছিয়ে দিয়ে মিষ্টি সুবাতাসে বুক ভরে নিল রানা। ওটা থেকে পান করল লোকটা, মুখখানা বিস্বাদ করে রানা ও জুলেখার দিকে চাইল, তারপর থলে তুলে দিল সোমালীর হাতে। প্রাণ ভরে পান করে খুশির হাসি হাসল আলী দাঈ।
‘উটের দুধ পেলে আর কিছুই খাওয়া লাগে না,’ বলল।
‘উটের দুধ এই প্র ম খেলাম আমি,’ বলল জুলেখা।
‘আমি তো ভেবেছিলাম ইথিওপিয়ায় সবাই এর দুধ খায়।’
‘তোমাদের দেশে গরীব মানুষ নেই, রানা? তারা অখাদ্য-কুখাদ্য খায় না?’ পাল্টা বলল জুলেখা।
আপনা থেকেই মাথা নত হয়ে গেল রানা আর বিজ্ঞানীর।
ইথিওপিয়ার চাইতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক ভাল। কিন্তু তাই বলে কি লোকে সব স্বাস্থ্যকর, সুস্বাদু খাবার খাচ্ছে? মোটেই না। গরীব মানুষদের পুষ্টির অভাব তো রয়েইছে, যারা সচ্ছল তারাও কি বাজার থেকে নির্ভেজাল জিনিস পাচ্ছে?
‘হ্যাঁ, খায়,’ স্বীকার করল রানা।
ফের উটে চেপে বাকি দিনটা পাড়ি দিল ওরা। সূর্যাস্তের ঠিক আগে, সুবিস্তৃত এক প্রান্তরের মাঝামাঝি এসে পৌঁছল। আবু হাতেম উট থেকে নেমে, স্যাডলব্যাগ থেকে দড়ি বের করল। পা বেঁধে রাখবে উটগুলোর।
‘পাহারা দিলে,’ বলল ও, ‘কেউ এখানে অতর্কিতে চমকে দিতে পারবে না আমাদের।

তিন দিন বাদে, পানি, খাবার নিঃশেষ প্রায়, পশ্চিম দিকে তিগ্রাই প্রদেশের নিচু, পাথুরে পাহাড়সারির উদ্দেশে মোড় নিল দলটা। সূর্যাস্তের খানিক আগে, ছোট্ট এক ওয়াটার হোল খুঁজে পেল আবু হাতেম। প্রাণ ভরে পান করে, যতেড়বর সঙ্গে ক্যান্টিন ভরে নিল ওরা। ঝোপ-ঝাড় বিরল প্রায়, সেগুলো গলাধঃকরণের আগে উটেরা তাদের স্বাভাবিক লোভী আচরণ দেখাল।
‘বাজে জায়গা এটা,’ বলল আবু হাতেম। রানার প্রশ্নের জবাবে জানাল, ‘আমার লোকেরা ওখানে বাস করে।’ আঙুল দেখাল বিস্তীর্ণ মরুভূমির দিকে। ‘দু’দিনের মধ্যে এক শহরে পৌঁছব আমরা। তারপর নিরাপদ হব। পানির অভাব নেই এখানে, সেই সঙ্গে বদ লোকেরও।’
উটের দুধ ছাড়া আর কিছু জোটেনি গত ক’দিন। সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ওরা। সেদিন সন্ধেয় প্র ম পাহারা দিল রানা, অন্যরা ঘুমাল। রাত দশটার দিকে উঠে এসে প্রকাণ্ড এক পাথরে, রানার পাশে বসল আবু হাতেম।
‘তুমি ঘুমাতে যাও,’ বলল। ‘ক’ঘণ্টা পরে সোমালীকে ডেকে দেব আমি।’
টলতে টলতে তাঁবুতে গিয়ে ঢুকল রানা। ঘুমন্ত এক উটের পাশে পরম শান্তিতে শুয়ে জুলেখা। তার একটু দূরে বৃদ্ধ বিজ্ঞানী গম্ভীর মুখে বসে আছেন। কাজেই ওঁদেরকে বিরক্ত করল না রানা। ওয়াটার হোলের কাছে এক ফালি ঘাস-জমি খুঁজে নিয়ে শুয়ে পড়ল। দুনিয়াটা মনে হলো ক্ষণিকের জন্যে ঘুরে উঠল, তারপর তলিয়ে গেল রানা ঘুমে।
পা বাঁধা উটগুলোর মাঝে অস্থির নড়াচড়ার শব্দে ঘুমটা ভাঙল ওর, অচেনা এক বদগন্ধ নাকে এল, কিন্তু চিনতে পারল না রানা গন্ধটা কিসের। উটের সঙ্গে দিনের পর দিন বাস করতে হচ্ছে, স্নান করার সুযোগ নেই, ফলে ভোঁতা হয়ে গেছে ওর ঘ্রাণশক্তি। এবার
কাশির ও তারপর ঘোঁত ঘোঁত শব্দ কানে এল।
ডানদিকে মাথা কাত করল রানা। ওর ওপর ঝুঁকে রয়েছে বিশাল এক দেহ। গন্ধটা জোরাল হতে নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটা চিনে ফেলল রানা। সিংহের শ্বাসে ভয়ানক দুর্গন্ধ হয়, জানা আছে ওর। কিন্তু এত কাছ থেকে যে কোনদিন তা পাবে ভাবতেও পারেনি রানা।
সাবমেশিনগানটা বাঁ পাশে পড়ে রয়েছে। শরীর মুচড়ে ওটা তুলে নিয়ে, শরীরের আড়াআড়ি এনে তাক করতে পারে পশুরাজের দিকে। কিংবা সাবমেশিনগানটার ওপর দিয়ে এক গড়ান দিয়ে, লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারে অস্ত্র হাতে, সেফটি অফ করে একই সময়ে লক্ষ্য স্থির করতে পারে। দু’ভাবেই অবশ্য বাড়তি সুবিধা পাবে সিংহটা। রানা সাবমেশিনগান ঠিকভাবে বাগাতে পারার আগেই, ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে পারে ওটা।
‘রানা, জেগে থাকলে মড়ার মত পড়ে থাকো,’ অনুচ্চ স্বরে বলল জুলেখা।
মাথা তুলে কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে চাইল পশুরাজ।
‘ওর পেট গোল দেখতে পাচ্ছি,’ বলল আবু হাতেম।
‘মানে কি?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ও ক্ষুধার্ত না। চিমসে পেটের সিংহ খাবারের জন্যে আক্রমণ করে। এটা এইমাত্র খেয়ে এসেছে।’
রানার অবস্থান ডানাকিলের কথার সত্যতা যাচাইয়ের পক্ষে উপযুক্ত নয়; যদিও এটুকু বোঝা যাচ্ছে, ওর নতুন বন্ধু ঘন কেশরঅলা এক বিশালদেহী পুরুষ। মুখের ভেতর আস্ত এক জেট পে−ন ঢুকিয়ে রাখতে পারবে, চোয়াল এমনি বড় দেখাল রানার চোখে। সিংহ সম্পর্কে যা যা জানে সব মনে করার চেষ্টা করল ও। দেখল, তেমন কিছুই জানে না।
জুলেখা বলেছে নিঃসাড় পড়ে থাকতে। নিস্পন্দ হয়ে রয়েছে সিংহটাও, লেজ নাড়াটা বাদ দিলে। হঠাৎ মাথায় ঝিলিক মারল একটা ভাবনা-সিংহ গলিত শবদেহের মাংস ভালবাসে। শকুন তাড়া খায় এদের কাছে মাংস খেতে এলে। এভাবে মড়া সেজে পড়ে থাকলে, নিজের পছন্দসই জায়গায় জানোয়ারটা ওকে টেনে নিয়ে যায় যদি?
নড়েচড়ে গলা খাঁকারি দিল সিংহটা। দুর্গন্ধে নাড়ী উল্টে আসার জোগাড় রানার। নার্ভ আর ঠিক থাকতে চাইছে না। সাবমেশিনগানটা হাতে পাওয়ার তাগিদ অতিকষ্টে দমন করতে হলো ওকে।
খুব আস্তে আস্তে, শরীর রানার সমান্তরালে ঘুরিয়ে আনল সিংহটা। ওটার পেটটা লক্ষ করল রানা। গোলই বটে। রানার দিকে চাইতে পিঠ ফিরিয়েছে সিংহটা। এবার থপ্ থপ্ শব্দ তুলে চলে গেল ওয়াটার হোলটার উদ্দেশে।
মাথার কাছ দিয়ে জানোয়ারটা চলে যেতে চোখ উল্টে চাইল রানা। তারপর সাবধানে ঘাড় কাত করল। অসম্ভব মন্থর সিংহটার হাঁটার গতি, খাওয়া নাকি পানি পান করা বেশি প্রয়োজন হয়তো
বুঝে উঠতে পারছে না। ওটা ওয়াটার হোলের কাছাকাছি হওয়ামাত্র সাবমেশিনগান তুলে নেবে সিদ্ধান্ত নিল রানা। কিন্তু তা না করে মনের জোর খাটিয়ে আরেকটা মিনিট অপেক্ষা করল ও, পানির ওপর দাঁড়িয়ে ক্যাম্পের দিকে জানোয়ারটা ঘাড় ফিরিয়ে চাইছে। জুলেখার কিংবা হাতেমের তরফ থেকে কোন নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেল না রানা। আর কুদরত চৌধুরী হয়তো কিছু টেরই পাননি, ঘুমিয়ে কাদা।
বিপদের আশঙ্কা নেই নিশ্চিত হয়ে, মাথা নামিয়ে সশব্দে পানি পান করতে লাগল জানোয়ারটা। প্রকাণ্ড জিভটা ওটার ছলকে তুলছে পানি। বাঁ হাত ছড়িয়ে দিল রানা, যতক্ষণ না ঠাণ্ডা ধাতব স্পর্শ পায় ওর আঙুল, হাতড়ে চলল মাটিতে। ওটা খুঁজে পেয়ে তুলে আনল নিজের কাছে। একাজ করতে, চোখ সরাতে হলো সিংহটার ওপর থেকে, তবে পানি পানের শব্দ এখনও কানে আসছে ওর।
গড়ান দিয়ে সাবমেশিনগানটা তাক করল রানা। একটু উল্টোসিধে করেছে কি ফুঁড়ে দেবে জানোয়ারটাকে। ম্যাগাজিন ভর্তি রয়েছে গুলিতে। শরীরের মোক্ষম কোন না কোন জায়গায় লাগবেই লাগবে। জানোয়ারটা মাথা তুলতে, নিশুতি রাতে কানে বাজল জুলেখার অস্ফুট আর্তনাদ।
‘এখন গুলি কোরো না,’ বলল আবু হাতেম।
রানা জবাব দিল না। জানোয়ারটা ঝামেলা না পাকিয়ে পানি পান করে চলে গেলে গুলি ছুঁড়বে না ও। কিন্তু দলের কারও ওপর কিংবা উটগুলোর ওপর হামলা করলে পশুরাজ বলে খাতির করবে না রানা।
আবু হাতেমের গুলি করতে বারণ করার পেছনে অন্তত দুটো জোরাল যুক্তি রয়েছে। এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের বিশ্বাস করে না সে, গুলির শব্দে দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে তাদের। দ্বিতীয় যুক্তিটার কারণ সিংহরাজ স্বয়ং। ওটাকে উত্তেজিত করতে চাইছে না আবু হাতেম। অস্ত্রধারী যতই অব্যর্থলক্ষ্য হোক না কেন, মিস সে করতেই পারে।
আলোর অবস্থা বেগতিক। চাঁদটা, পূর্ণ এমুহূর্তে, ডুবতে বসেছে। পরিপার্শ্বের সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে নিয়েছে জানোয়ারটা। উপুড় হয়ে ভূতলশায়ী রানা সাবমেশিনগান ধরে রেখে, সিংহটাকে ধৈর্যের খেলায় হারিয়ে দিতে চাইছে।
আরও খানিকটা পানি খেল সিংহটা। সন্তুষ্টচিত্তে এবার মাথাটা শূন্যে তুলে, জলদগম্ভীর ডাক ছাড়ল। বিড়বিড় গুঞ্জন তুলল উটগুলো। জানোয়ারটা শ্লথ গতিতে বাঁয়ে মোড় নিল, ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। একটু পরেই রানার দৃষ্টিসীমার
আড়ালে চলে গেল।
‘চলে গেছে,’ দু’মিনিট বাদে বলল আবু হাতেম।
সিধে হয়ে দাঁড়াল রানা। ‘ওটা এখানে এল কিভাবে?’
ক্যাম্প ও আলী দাঈর অবস্থান নেয়া পাথরের মাঝখানে এক ফালি জায়গা। ওর সঙ্গে সেখানে দেখা হলো রানার।
‘আমি যে পাশটায় পাহারা দিইনি সেদিক থেকে এসেছে,’ বলল দাঈ।
‘ঘুমাচ্ছিলে নাকি?’
‘না। দেখতে পাইনি।’
‘যাও, নিচে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নাওগে,’ পরামর্শ দিল রানা। জুতিয়ে লোকটাকে ক্যাম্পে ফেরত পাঠাতে মন চাইছে ওর। অমনোযোগের কারণে দেখতে পায়নি, নাকি দেখেও ইচ্ছে করে ছেড়ে দিয়েছে সিংহটাকে কে জানে।
আবু হাতেমের কাছ থেকে ওকে আলাদা করার পর লোকটার চোখের ভাষা, চেহারার অভিব্যক্তি পরিষ্কার মনে আছে রানার।
পরদিন দুপুরের একটু পরে, সাময়িক বিশ্রামের জন্যে আরেকটা ওয়াটার হোলের পাশে থামল দলটা। প্রচুর পরিমাণে স্বচ্ছ তাজা পানি দেখে বুকটা ভরে গেল রানার। অবশ্য খিদেও পেয়েছে জবর। আহা, আলী দাঈর উটটার একটা ঠ্যাং কেটে রোস্ট করে দিলে, কত মজা করেই না আস্তটা সাবড়াতে পারত! মরু যাত্রার ধকলের ফলে, প্রায় পনেরো পাউন্ড ওজন হারাতে হয়েছে ওকে, যতটা সম্ভব কষে কোমরে বেঁধেছে বেল্টটা; তারপরও অবশ্য যথেষ্ট শক্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। শহরে পৌঁছতে আর একটা দিন লাগবে, অনায়াসে পার করতে পারবে সেটা।
‘ওই শহরে থানা-টানা আছে?’ জুলেখাকে প্রশ্ন করল রানা।
‘থাকবে। আমাকে কথা বলতে দিয়ো। নামগুলো সব জানা আছে আমার, রানা।’
‘গুড। যত জলদি পারি আদ্দিস আবাবা আর নয়তো আসমারায় পৌঁছতে হবে আমাকে।’
ওয়াটার হোল ত্যাগ করে, রওনা হয়ে এক ঢিবির ওপর উঠেছে, আচমকা তিন ডানাকিলের একটি দলের মুখোমুখি পড়ে গেল ওরা। চমকে গেলেও, রানাদের চাইতে দ্রুত প্রতিক্রিয়া হলো ওদের। গুলি চালাতে লাগল ওরা। আর্তনাদ ছেড়ে উঠের পিঠ থেকে উড়ে গেল আলী দাঈ। পরক্ষণে আর্তচিৎকার ছাড়লেন কুদরত চৌধুরী।
সক্রিয় হলো এবার রানার সাবমেশিনগান। আবু হাতেম আর জুলেখাও ফায়ার ওপেন করল। ভূতলশায়ী হলো তিন শত্রু এক মিনিটের মধ্যে। জুলেখার দিকে চাইল রানা। মুচকি হাসল যুবতী। আবু হাতেম এবার স্যাডল থেকে স্লো মোশন ছবির মত গড়িয়ে
পড়ল মাটিতে।
উট থেকে লাফিয়ে নেমে বিজ্ঞানীর কাছে ছুটে গেল রানা। বৃদ্ধের বুকের কাছটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মারাত্মক আহত হয়েছেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী। কেউ একজন মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছে টের পেয়ে অতিকষ্টে চোখ মেললেন তিনি। ফিসফিস করে বললেন, ‘কে, রানা? রানা…ড্রাগস…সবার ভেতর…ঝাঁঝরা করে দিয়েছে লোকটা আমাকে। ডানাকিলদেরও মারবে এভাবে। নিও ফ্যাসিস্ট…রানা…’ শেষদিকে নিস্তেজ হয়ে এলো তাঁর স্বর। ‘ওদের ঠেকিয়ো, রানা, ম্যাকলিন আর রবার্তো মালদিনি; ওরা উন্মাদ। রাজ্য গড়তে চায়…নিও ফ্যাসিস্ট…’
পালস দেখল রানা। নেই। মারা গেছেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী। এবার ছুটল আবু হাতেমের কাছে। কাঁধে গুলি খেয়েছে লোকটা, ভয়ের কিছু নেই। ফুটোটা পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল রানা। ওদিকে, আলী দাঈয়ের পতিত দেহের ওপর ঝুঁকে পড়েছে জুলেখা।
‘মারা গেছে,’ একটু পরে রানার পাশে এসে বলল যুবতী।
‘কুদরত চৌধুরীর কি খবর?’
‘ওই একই,’ জানাল রানা, তখনও ব্যস্ত আবু হাতেমের জখম নিয়ে। বলার মত কথা খুঁজে না পেয়ে বলল, ‘উটের দুধ খাইয়ে আমাদের জান বাঁচিয়েছিল দাঈ।’
‘হ্যাঁ,’ সায় দিল জুলেখা। বলল,‘আলী দাঈ তার প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছে। আরেকটু হলে মেরেই ফেলেছিল আমাদের-তোমাকে বিশেষ করে-সিংহের কথা চেপে গিয়ে।’
‘ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। দুর্জয় সাহসী ছিল, কিন্তু এধরনের জার্নির জন্যে যথেষ্ট এনার্জি ওর ছিল না। আর বিজ্ঞানীর তো নয়ই।’
‘ঘুমাচ্ছিল না ছাই,’ মৃদু শব্দে হেসে উঠল জুলেখা। ‘রানা, আলী দাঈদের কখনও বিশ্বাস কোরো না। ডানাকিলের সাথে লড়তে দাওনি বলে তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল ও।’
‘হতে পারে,’ বলল রানা। ‘এখন আর কি যায়-আসে?’
‘তা ঠিক।’
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল রানা। ‘আচ্ছা, তুমি ড্রাগ অ্যাডিক্ট নও তো?’
‘না, আমাকে বিয়ে করবে বলে সুস্থ রেখেছে বুড়ো শয়তানটা।’
‘আর ম্যাকলিন?’
‘সে অ্যাডিক্ট। মালদিনির চাকর। নিও ফ্যাসিস্ট। মালদিনিকে গুরু মানে। যা বলে তাই করে।’
চোখের পাতা পিটপিট করছে আবু হাতেমের জ্ঞান ফিরে আসতে। লোকটা গুঙিয়ে উঠবে ভাবল রানা, কিন্তু তা না করে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ওর দিকে।
‘কতটা আহত আমি?’
‘কাঁধে গুলি খেয়েছ। ভেতরে তেমন ক্ষতি হয়নি, তবে বুলেটটা রয়ে গেছে।’
‘এখান থেকে আমাদের সরে পড়তে হবে,’ বলেই উঠে বসল লোকটা।
‘আগে একটা স্লিং বানাতে দাও,’ বলল রানা।
বাড়তি উটগুলোর পাশে তিন শত্রু ও আলীর দাঈয়ের লাশ ফেলে রেখে রওনা হলো ওরা। তার আগে রানা নিজ হাতে কবর দিল কুদরত চৌধুরীকে। বুকটা টনটন করছে ওর। অল্প ক’দিনের পরিচয়েই ভালবসে ফেলেছিল ও সরল বৃদ্ধকে। রানা আশা করছে, একদল বুভুক্ষু সিংহ এসে শীঘ্রিই লাশগুলোর সদ্ব্যবহার করবে, এদের উপস্থিতি কারও কৌতূহল জাগানোর আগেই। সন্ধে উতরালে থামতে হলো ওদের। আবু হাতেম, প্রচণ্ড যন্ত্রণা সত্ত্বেও সজাগ, এক অ্যারোয়োতে তাঁবু ফেলতে বলল।
‘খুব সম্ভব আর দু’ঘণ্টা পরেই শহর পাব,’ বলল ও। ‘কাল যাব ওখানে। রাতে আগুন জ্বালছি না আমরা।’
‘নিশ্চিন্তে ঘুমাও তুমি,’ বলল রানা।
‘পাহারা দিয়ো কিন্তু।’
‘দেব। তোমার ভাবতে হবে না।’
গুল্মে ছাওয়া এক ঝাড় ঝোপের সঙ্গে উটগুলোর পা বেঁধে রাখল রানা। খাবারের অসুবিধে হবে না ওদের। এরা সবই খায়, পাথরও চিবিয়ে হজম করে ফেলে কিনা কে জানে। বেচারা ছাগলদের না দুষে বরং বলা উচিত: উটে কিনা খায়। আত্মপ্রসাদ বোধ করছে রানা মনে মনে-আজব এই জানোয়ার সামলাতে রীতিমত দক্ষ হয়ে উঠেছে ও এ-কয়দিনে। মেজর জেনারেলকে বলতে হবে ওর নয়া প্রতিভার কথাটা ডোসিয়েতে যোগ করতে। নিচু এক পাহাড়ের ওপর মনপছন্দ এক জায়গা বেছে নিল রানা। এখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দেবে। জুলেখাকে পাঠিয়েছে ঘুমিয়ে নিতে। মেয়েটি অবশ্য প্র মে যেতে চায়নি, পরে রানা ওকে ডেকে দেবে কথা দেয়ায় রাজি হয়েছে।
সজাগ-সতর্ক থাকতে হবে, নিজেকে শোনাল রানা। দৈবাৎ ঘুমিয়ে পড়লে আর হয়তো সভ্য জগতে ফেরা হবে না কারও।

সূর্যোদয়ের দু’ঘণ্টা পর। দূরে, ছোট্ট এক গ্রামের উদ্দেশে চলে যাওয়া একটা ট্রেইল দেখতে পাওয়া গেল। আবু হাতেম সেদিকে নিয়ে চলল ওদের। লোকটা কাহিল, জ্বরাক্রান্ত, স্যাডলে দোল খাচ্ছে; বেশ ক’বার দেখল রানা। ক্যাম্প ত্যাগের আগে ওর জখমটা পরখ করেছে সে। সংক্রমণ ছড়িয়েছে। বুলেট, হাড়ের ভাঙা টুকরো ও কাপড় শীঘ্রিই সরানো দরকার।
‘স্যাডলে বসে থাকতে পারবে?’ রানা জিজ্ঞেস করল। ‘নাকি আমি ক্যারি করব?’
‘তুমি ইতিমধ্যেই আমার জীবন বাঁচিয়েছ,’ বলল লোকটা।
‘রানা, একটা খায়েশ পূরণ হলো না।’
‘কি সেটা?’
‘ওই নোংরা সোমালীটাকে তুমি নিজের হাতে খুন করতে দিলে না।’
‘আরও অসংখ্য শত্রুকে না মেরে মরছ না তুমি,’ অভয় দিল রানা।
‘সত্যি বলছ, রানা?’
লোকটার প্রশেড়বর জবাবে মৃদু মাথা নাড়ল রানা।
‘কিন্তু এরকম অভিযান জীবনে আর করতে পারব না। লোকের মুখে মুখে ফিরবে তোমার আর আমার কথা। সোমালীটা যোদ্ধার ছাতাও ছিল না। আর বাকি রইল এক নারী-জুলেখা। আমরা কতজনকে খুন করেছি, রানা?’
‘হিসেব নেই আমার,’ বলল রানা। ‘তেরোজন হতে পারে।’
‘অস্ত্রগুলো কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে। শহরে ওসবের দরকার পড়বে না।’
উটেরা ট্রেইলে নিজেদের রাস্তা বেছে নিয়েছে। ডানপাশে বেশ কিছু প্রকাণ্ড পাথর পড়ে আছে, এমনি এক জায়গায় রানা ওর উটটাকে দাঁড় করাল। ‘এই পাথরগুলোর ফাঁক-ফোকরে অস্ত্র লুকানো যায়।’
দ্বিরুক্তি করল না আবু হাতেম।
জুলেখা আর রানা ওকে রাইফেল ও গোলাগুলির ভারমুক্ত করে, কোমর থেকে পিস্তলটাও খসিয়ে নিল। পাথরস্তূপে চড়ে দুই পাথরের মাঝে এক ফাটল আবিষ্কার করল রানা। রাইফেল ও পিস্তল ওটার ফাঁকে ছেড়ে দিয়ে, নিজের সাবমেশিনগানটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। এটা ছাড়া নগড়ব মনে হবে ওর নিজেকে, কিন্তু সশস্ত্র হয়ে শহরে প্রবেশ করাটাও সম্ভব নয়। বন্ধুত্বের খোঁজে যাচ্ছে ওরা, শত্রুতা করতে নয়।
আবু হাতেমকে মাঝে রেখে এগিয়ে চলল ওরা একটু পর। থানায় যেতে রাজি নয় ডানাকিল। লোকটার চোখ-মুখ থেকে অহংকারের দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে।
‘জুলেখা,’ ইংরেজিতে বলল রানা, ‘এ লোকের যতড়ব নিতে পুলিসকে রাজি করাতে পারবে?’
‘জানি না। বাবার নাম বলে যদি কাজ হয় তো ইমিডিয়েটলি ডাক্তার ডাকতে বলব। বড় ধরনের অপরাধের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী-একথা বললে হয়তো টনিকের কাজ দেবে।’
‘আবু হাতেম আমাদের জন্যে যা করেছে, তারপর ওর হাত কাটা গেলে মেনে নিতে পারব না,’ বলল রানা।
‘আমি বুঝি সেটা, রানা,’ বলল জুলেখা। ‘কিন্তু পুলিসকে বিশ্বাস করানো শক্ত হবে আমি কে। ওরা রিপোর্ট করবে। আমাদের নাম জানাবে সুপিরিয়রদের কাছে। কিন্তু একজন
আমহারিক মহিলাকে ইসলামী বেশে দেখলে ওরা তাড়াহুড়ো করতে দ্বিধা করবে।’
গ্রামটা মুসলমানদের, মহিলাদের পোশাক বলে দিল রানাকে।
সোজা পুলিস স্টেশনে গেল ওরা। খাকি পোশাকধারী দু’জন লোক দৌড়ে বেরিয়ে এল, হোলস্টারের বোতাম খোলা রেখে। জুলেখা আমহারিক ভাষায় শুরু করল, এবং রানা তার নাম অনেকবার উচ্চারিত হতে শুনল। আহত আবু হাতেমের প্রতি ওদের সহানুভূতি লক্ষ করে খুশি হলো রানা।
পুলিসদের একজন একটা সেলের সামনে নিয়ে গিয়ে, পিঠে ঠেলা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল রানাকে। তালা লেগে গেল।
‘আপনি বাংলাদেশী?’ কাঁচা ইংরেজিতে শুধাল।
‘হ্যাঁ, আমার নাম মাসুদ রানা।’
‘সাথে কাগজপত্র আছে?’
‘না।’
‘এখানে অপেক্ষা করুন।’
সেলের এক কিনারে একটা তোবড়ানো, ছাল-চামড়া ওঠা আর্মি খাট। ছারপোকা কম থাকলেই বাঁচোয়া, ভাবল রানা। গত ক’দিন ঘুম খুব সামান্যই হয়েছে ওর, ইন্দ্রিয় সজাগ রাখতে হয়েছে ক্ষীণতম বিপদ সঙ্কেতের জন্যে। আপাতত সে চিন্তা যখন নেই, আরামসে ঘুম দেয়া যাবে এখানে। মালদিনির হাত এত দূর উত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত নয়। কাজেই খাটে শুতে না শুতেই ঘুম।
‘মিস্টার রানা, মিস্টার রানা, মিস্টার রানা।’ কার যেন এক নাগাড়ে ডাকাডাকিতে ঘুমটা ভাঙল ওর।
চোখ খুলে হাতঘড়িতে নজর বুলাল ও। দু’ঘণ্টার কিছুটা বেশি ঘুমিয়েছে। শরীরটা ঝরঝরে লাগছে ওর। আস্ত একখানা উটের রোস্ট পেলে পাঁচ মিনিটে সাবড়ে দেবে।
‘মিস্টার রানা, দয়া করে আসুন আমার সাথে,’ জেলে ঢুকিয়েছিল যে পুলিসটি সে বলল।
সটান উঠে দাঁড়াল রানা। একটা করিডর দিয়ে, জেলখানার পেছনদিকে, দেয়াল ঘেরা এক কোর্টইয়ার্ডে নিয়ে এল লোকটা ওকে। গরম পানির মস্ত এক টাবের নিচে আগুন উস্কে দিচ্ছে এক বন্দী। খেঁকিয়ে আদেশ করল পুলিসম্যান। বন্দী বেচারা আরেকটা টাবে গরম পানি ঢেলে তাতে ঠাণ্ডা মেশাল।
‘এই নিন, সাবান,’ বলল পুলিসম্যান। ‘আর আপনার জন্যে কাপড়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
সাবান ঘষে ঘষে মহানন্দে গোসল সারল রানা। এবার পরিষ্কার স্ন্যাক্স, যদিও লম্বায় ইঞ্চিখানেক খাটো, ধবধবে সাদা মোজা আর একখানা পরিষ্কার শার্ট বেঞ্চি থেকে তুলে নিয়ে পরে ফেলল। এরপর শেভিঙের পালা। ছোট একটা আয়না, প্রাচীন এক শেভিং মগ, ভাঙা ব্রাশ সবই কপালে জুটল। বন্দী লোকটা এক গামলা পানি এনে দিয়েছে। জবু ুবু হয়ে বসতে হলো রানাকে আয়নায় মুখ দেখার জন্যে, কিন্তু শেভের পর নিজেকে ভিনড়ব মানুষ বলে মনে হলো ওর।
‘দয়া করে আমার সাথে আসুন, মিস্টার রানা,’ বলল পুলিসম্যান।
সামনের ডিউটি রূমের কাছে, প্রাইভেট এক টুকরো এলাকায় নিয়ে এল সে রানাকে। জুলেখা ও এক অফিসার বসে ওখানে, সামনে ধোঁয়া ওঠা স্টু নিয়ে। স্থানীয় সাদা পোশাক পরনে এখন জুলেখার।
‘মিস্টার রানা, আমি এই জেলের কমান্ড্যান্ট,’ আরবীতে বলল লোকটা, উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝাঁকিয়ে দিল রানার। ‘আপনার খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে আসমারা যাব।’
জুলেখার পাশে এক চেয়ারে রানাকে বসিয়ে দিয়ে, বেঁটে, মোটা মত এক মহিলাকে নানান নির্দেশ দিতে লাগল। শীঘ্রি রুটি আর এক পাত্র স্টু নিয়ে এল মহিলা। কি দিয়ে বানিয়েছে সে সব প্রশেড়ব না গিয়ে গোগ্রাসে গিলতে লাগল মাসুদ রানা। স্টু-টা সম্ভবত ভেড়ার মাংসে তৈরি, রুটি টাটকা আর সুস্বাদু। কড়া চা দিয়ে খাওয়ার পর্ব শেষ করল ওরা।
‘তুমি খুব ইম্পর্ট্যান্ট মানুষ বুঝতে পারছি,’ জুলেখাকে বলল রানা।
‘আমি না, তুমি,’ বলল যুবতী। ‘পুলিস তোমার নাম তার করার সাথে সাথে সমস্ত দৃশ্যপট পাল্টে গেল।’
কমান্ড্যান্টের উদ্দেশে ফিরল রানা। ‘আবু হাতেম কেমন আছে এখন?’
‘লোকাল ক্লিনিকে বিশ্রাম নিচ্ছে। ডাক্তার তাকে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছে। হাতটা বেঁচে যাবে।’
খুশি হলো রানা খবরটা পেয়ে।
গলা খাঁকরাল কমান্ড্যান্ট। ‘মিস্টার রানা, আপনাদের অস্ত্রশস্ত্রগুলো কোথায় রেখে এসেছেন?’
‘অস্ত্রশস্ত্র মানে?’ সাধু সাজল রানা। মুচকি হাসল লোকটা।
‘অস্ত্র ছাড়া কেউ ডানাকিলে পাড়ি জমায় না, মিস্টার রানা। আপনার বন্ধু গুলি খেয়েছে। আমার জুরিসডিকশনের বাইরে নিশ্চয়ই গোলাগুলিটা হয়েছে, এবং আমি জানি আপনি আমার সরকারের অনুমতি নিয়ে এসেছেন। সন্ত্রাসী কোন উপজাতির হাতে যাতে অস্ত্রগুলো না পড়ে সেজন্যেই জানতে চাইছি।’
এক মুহূর্ত ভেবে নিল রানা। ‘জায়গাটার নিখুঁত বর্ণনা দিতে পারব কিনা জানি না। ওখান থেকে শহরে পৌঁছতে প্রায় বিশ মিনিটের মত লেগেছে। উটগুলো অবশ্য খুব ধীরে ধীরে চলছিল। বেশ কিছু পাথর আছে ওখানে…’
‘গুড!’ সহাস্যে বলল লোকটা। ‘গ্রামাঞ্চল লক্ষ করারও চোখ আছে আপনার দেখতে পাচ্ছি। ডানাকিলরা শহরে আসার আগে ওখানে অস্ত্রশস্ত্র রেখে আসে। ওটাই হবে আর কি।’
একটা জীপের কাছে অল্পক্ষণ পরে পৌঁছে দিল কমান্ড্যান্ট রানা ও জুলেখাকে। করমর্দন করল। রানা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল তার সহযোগিতার জন্যে।
‘এ তো আমার ডিউটি,’ বলল সে।
‘ইথিওপিয়ায় আপনার মত ডিউটি সচেতন মানুষ-জন দরকার,’ বলল জুলেখা।
কৃতার্থ হয়ে গেছে, মাথা নুইয়ে বিগলিত হাসল কমান্ড্যান্ট। জুলেখার পারিবারিক অবস্থান পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারল রানা।
দু’জন পুলিসের লোক জীপের দরজা মেলে ধরে পেছনের সীটে ওদের বসতে সহায়তা করল। দু’সারি পাহাড়ের মধ্যকার অবতলের উদ্দেশে এবার রওনা হলো ওরা। দশ মাইলের ভেতর আরেকটা গাড়ির দেখা মিলল, প্রাচীন এক ল্যান্ডরোভার কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে চলেছে। রানাদের চালক খিস্তি ঝেড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল হর্নের ওপর, এবং দুটো গাড়ি এতটাই কাছ ঘেঁষে পার হলো, চাইলেই জুলেখা বাঁ পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে পারত ওদেরকে।
দু’মাইলটাক পরে, রীতিমত কসরৎ করে, সারবন্দী উটের পালের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে পথ করে নিতে হলো রানাদের জীপটাকে। বারো মাইলের পর থেকে রাস্তাটা ট্র্যাক থেকে রূপান্ত রিত হলো জমাটবদ্ধ ধুলোয়। হুইলের সঙ্গে রীতিমত লড়াই করে পরবর্তী ঘন্টায় আরও পাঁচ মাইল অতিμম করল ড্রাইভার, এবং এখন ওরা পাশ কাটাচ্ছে অন্যান্য যানবাহনের। বেশ বড়সড় এক শহরে পৌঁছনোর ঠিক আগে, বাঁয়ে তীক্ষ্ন মোড় নিল জীপটা। লক্কড় মার্কা এক ইতালিয়ান ট্রাকের সম্মুখভাগ আড়াআড়িভাবে এড়াল কোনমতে। গুলির মত গালি-গালাজ বর্ষাল ট্রাকের চালক। ঝাঁকি খেতে খেতে এক মাঠে গিয়ে ঢুকল জীপটা, থেমে দাঁড়াল এক হেলিকপ্টারের পাশে।
পাইলট, জনৈক আর্মি অফিসার, লাফিয়ে নেমে স্যালুট করল রানাকে। ‘মিস্টার রানা?’
তার প্রশেড়বর জবাবে মাথা ঝাঁকাল রানা।
‘আপনাকে এখুনি আসমারা নিয়ে যাওয়ার জন্যে পাঠানো হয়েছে আমাকে,’ বলল লোকটা।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে আকাশে উঠে পড়ল ওরা। যন্ত্রটা এতই শব্দ করছে, কথোপকথনের সুযোগ নেই। রানার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল জুলেখা।
সরকারী এক ময়দানে ল্যান্ড করল কপ্টার। রোটর ঘোরা বন্ধ হওয়ার আগেই পাশে সরকারী লেখা নিয়ে বাদামী রঙের একটা গাড়ি তেড়ে এল রানাদের উদ্দেশে। পেছন থেকে উচ্চপদস্থ এক আর্মি অফিসারকে নামতে দেখা গেল। এবার অন্যপাশ থেকে নামল ধোপদুরস্ত পোশাক পরা দ্বিতীয় আরোহী। উজ্জ্বল সূর্যালোকে চোখ পিটপিট করে চাইল রানা। ভুল হয়ে না থাকলে…
রানা কপ্টারের দরজা দিয়ে লাফ মেরে নামতে ওর দিকে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। রানা জুলেখাকে নামতে সাহায্য করে বসের দিকে ফিরে দাঁড়াল। আলিঙ্গনে রানাকে বাঁধলেন বৃদ্ধ। তাঁর চোখে স্বস্তির আভাস অস্পষ্ট ভাবে দেখতে পেয়েছে বলে সন্দেহ হলো রানার।
‘আসমারায় আপনি, স্যার?’
‘শেপ মাইয়ারের ক্যাপ্টেন রিপোর্ট করেছে তুমি নাকি মারা গেছ,’ বললেন মেজর জেনারেল। ‘দু’রকমের দুটো মেসেজ পেয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল!’
‘ক্যাপ্টেন মালদিনির লোক, স্যার,’ বলল রানা। ‘এঞ্জিনিয়ারিং অফিসাররা বাদে তার সমস্ত ক্রু মালদিনির কেনা গোলাম। জাহাজটা এখনও মাসাওয়ায় নেই নিশ্চয়ই?’
‘না। লোকাল অথরিটির ওটাকে আটকে রাখার কোন কারণ নেই। কুদরতের খবর কি বলো।’
‘বাঁচাতে পারিনি, স্যার।’ রানা সংক্ষেপে সবটা জানাল।
ক’মুহূর্ত থম হয়ে রইলেন রাহাত খান।
‘জেন এসেক্স আর নিক্সন ম্যাকলিন?’
জেনের করুণ পরিণতি অল্প কথায় বসকে জানাল রানা। রাহাত খানের কাছে জানতে পারল, ম্যাকলিনের আসল নাম ব্রুনো কন্টি। সন্ত্রাসবাদী মালদিনির একজন অন্ধ ভক্ত সে। তার জন্যে সবই করতে পারে ইতালিয়ানটা। ‘ম্যাকলিন শয়তানটা আছে মালদিনির ক্যাম্পে। মানে যখন চলে এসেছি তখন পর্যন্ত ছিল। আমার মৃত্যু সম্পর্কে কি গল্প ফাঁদা হয়েছে স্যার?’
‘তুমি মাসাওয়া পৌঁছওনি কেন তার একটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছে,’ বললেন রাহাত খান। ‘ক্যাপ্টেন জানিয়েছে তোমরা তিনজনই নাকি বিউবোনিক পে−গে মারা পড়েছ, এবং নিরাপত্তার খাতিরে তোমাদের সাগরে ভাসিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে সে। ইথিওপিয়ান কর্তৃপক্ষ ওর বক্তব্য খণ্ডাতে পারেনি, ফলে পোর্ট ছাড়তে দিতে বাধ্য হয় শেপ মাইয়ারকে।’
জুলেখা আর ইথিওপিয়ান জেনারেল এসময় এগিয়ে এলেন ওদের দিকে। দু’জনেই চোস্ত আমহারিক বলছে, এবং রানার ধারণা হলো ভদ্রলোক জুলেখার পূর্ব পরিচিত।
‘জেনারেল হাশমী, এ হচ্ছে আমাদের মাসুদ রানা,’ বললেন মেজর জেনারেল।
করমর্দন করল ওরা। সম্ভ্রান্ত বংশের এক আমহারিক, ছ’ফুট চার ইঞ্চির ইথিওপিয়ান জেনারেল বলিষ্ঠ দেহী, কালো চুলে তাঁর পাক ধরেছে সবে।
‘মিস্টার রানা, জুলেখাকে আমি ওর জন্মের পর থেকেই চিনি। ওকে ফিরিয়ে আনার জন্যে আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। ওর বাবা আর পরিবারের পক্ষ থেকেও আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।’
সাবলীল ইংরেজি বলেন ভদ্রলোক, এবং রানা অনুমান করল, সম্ভবত ইংল্যান্ডে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছে তাঁর।
‘জুলেখাকে ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব আমার নয়, জেনারেল হাশমী। আমরা একসাথে ফিরেছি। আমাদের মত ও-ও উট চালিয়েছে, পাহারা দিয়েছে, শিক্ষিত যোদ্ধার মত রাইফেল চালিয়েছে। বেঁচে যে আছি সেজন্য আমরা দু’জনেই আবু হাতেমের কাছে ঋণী।’
‘মালদিনির হাত এড়িয়ে পালিয়েছেন যখন, দৌড় থামাবেন না,’ হাশমী ফিরলেন রাহাত খানের দিকে। ‘জুলেখা সরকারের ভেতরে থাকা মালদিনির বেশ কিছু এজেন্টের নাম ফাঁস করে দিয়েছে। আরও ক’দিন আগে এগুলো জানা গেলে ভাল হত।’
‘কি ব্যাপার, স্যার?’ মেজর জেনারেলকে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘তোমরা পালানোর সাথে সাথে মালদিনি চাল দিয়েছে।’ বললেন রাহাত খান। ‘চারদিন আগে আলটিমেটাম দিয়েছে সে।’
‘তাহলে আমরা পালানোর সঙ্গে সঙ্গে নয়,’ বলল রানা। ‘ওর গুণ্ডারা আমাদের ধরতে ব্যর্থ হওয়ার পর।’
‘কি চাইছে সে জানেন?’ জেনারেল হাশমীর প্রশ্ন।
‘পূর্ব আফ্রিকার অর্ধেকটা,’ বলল রানা। ‘মিসাইল ছুঁড়বে হুমকি দিয়েছে নাকি?’
‘তিনটে মিনিটম্যান সহ,’ বললেন রাহাত খান। ‘শেপ মাইয়ারে ছিল। জেন এসেক্স ট্র্যাক করছিল ওগুলোকে।’
‘কখন ছুঁড়তে শুরু করবে?’ রানা জবাব চাইল।
‘কাল সন্ধে নাগাদ। আমরা কোন ধরনের উস্কানি দিলে আরও আগে।’
‘যত জলদি পারে ছুঁড়ুক ওগুলো, স্যার,’ বসকে বলল রানা।
‘বিশেষ করে ওই মিনিটম্যানগুলো।’
চোয়াল ঝুলে পড়ল জেনারেল হাশমীর। ফ্যালফ্যাল করে রানার দিকে চেয়ে আছেন তিনি। রাহাত খানকেও মুহূর্তের জন্যে বিভ্রান্ত মনে হলো, তারপর ধীরে ধীরে সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
‘বলে ফেলো, রানা।’
‘মালদিনির মিসাইলগুলোর অন্তত অর্ধেক যারা ছুঁড়বে শুধু তারাই মারা পড়বে। বালির নিচ থেকে মিনিটম্যানের গাইডেন্স সিস্টেম এখনও খুঁড়ে বের করতে পেরেছে কিনা সন্দেহ আছে আমার, কিংবা হয়তো জানেই না কি খোয়া গেছে। খুব ভালভাবে লুকিয়ে রেখেছে ও মিসাইলগুলো। কারণ প্রপার লঞ্চিং সুবিধা নেই তার। আপনার বন্ধু বেঁচে থাকলে ফুল টেকনিক্যাল রিপোর্ট দিতে পারতেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য! বেশ কিছু দুর্ধর্ষ ডানাকিল যোদ্ধা রয়েছে মালদিনির পক্ষে। অটোমেটিক অস্ত্র আছে তাদের কাছে। ওর হুমকির দৌড় ওই পর্যন্তই।’
‘আপনি শিয়োর, মিস্টার রানা?’ জেনারেল হাশমী জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ। কুদরত চৌধুরী মিসাইল নিয়ে কাজ করতেন। মালদিনির বদমতলব জানতে পেরে উনি ওঁর সাধ্যমত স্কিমটাকে স্যাবোটাজ করেন। মালদিনি আশা করেছিল ওর লোকেরা
মরুভূমিতে খতম করে দেবে আমাদের, কারণ কুদরত চৌধুরী বা আমি কেউ যদি একটা রিপোর্ট করতে পারি, ওর অবস্থান জেনে যাবে সরকার। তাছাড়া আরও একটা অসুবিধা ছিল তার, ফাঁস হয়ে যেত কারা কারা তার হয়ে সরকারের ভেতর কাজ করছে।’
‘চৌধুরী সাহেব কি গোলমাল করেছেন জানে না ও,’ বলল জুলেখা। ‘ওর ধারণা একটা মিসাইল ছুঁড়লেই কেঁপে উঠবে গোটা পৃথিবীর অন্তরাত্মা ।’
‘ওর বুকটা ফেটে যাবে,’ বললেন হাশমী। রানার দিকে ঘুরে ওর কাঁধে প্রকাণ্ড একটা হাত রাখলেন। ‘কোনও হোটেলে আজ রাতটা কাটিয়ে, কাল মালদিনির হেডকোয়ার্টারে ফিরে গেলে কেমন হয়, মিস্টার রানা?’
‘যাব কিভাবে?’
‘আমার হেলিকপ্টারে। আফ্রিকার সেরা দেড়শো সৈন্যকে লিড করে নিয়ে যেতে পারেন।’
‘আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ওর ঘাঁটি খুঁজে পেলে হয়।’
‘একটা ম্যাপ হবে?’ বলল জুলেখা। ‘আমি চিনিয়ে দেব। পপি খেত ধ্বংস হলে ডানাকিলদের আনুগত্য হারাবে লোকটা।’
জেনারেল হাশমী তাঁর স্টাফ কারের দিকে নিয়ে গেলেন ওদের। মিলিটারী কম্পাউন্ডের উদ্দেশে এগোল ওরা। গাড়িতে এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেম নেই বলে দু’বার দুঃখপ্রকাশ করলেন ভদ্রলোক। নির্মল পাহাড়ী বাতাস কত যে ভাল লাগছে তাঁকে বলে বোঝাতে পারল না রানা।
জুলেখা ও জেনারেল ম্যাপের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লে বসের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করল রানা।
‘বিসিআই আমার মেসেজ পায়নি, স্যার?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু এত সরাসরি না পাঠিয়ে তোমার উচিত ছিল কোডেড মেসেজ পাঠানো।’ একটু অসন্তুষ্ট শোনাল মেজর জেনারেলের কণ্ঠ।
‘হাতে সময় ছিল না, স্যার।’
‘শেপ মাইয়ার মাসাওয়ায় থামার পর তো ভুয়া ডেথ সার্টিফিকেট রেজিস্টার করল। তখনই নিশ্চিন্ত হলাম আমরা, তোমার মেসেজের অর্থ – জাহাজটা মালদিনির। নরওয়ের মতন ফ্রেন্ডলি দেশে ওগুলো রেজিস্টার করা হলেও ডামি হোল্ডিং কর্পোরেশন যাচাই করতেও কয়েকটা দিন লেগে যায়। আরও কথা আছে, আমরা নিশ্চিত ভাবে জানতাম না তুমি কিংবা জেন এসেক্স বেঁচে আছ কিনা। তাছাড়া মেসেজটা পাঠালে কিভাবে তাও বুঝতে পারছিলাম না।’
সাগ্রহে অপেক্ষা করছেন বস। বোসানস লকারের নিচের খাঁচা ভেঙে, মেসেজ পাঠিয়ে, আবার ফিরে এসে নিজেদের তালা মেরে রাখার কথা তাঁকে জানাল রানা।
‘নাইস ওঅর্ক, রানা,’ বললেন রাহাত খান। ‘তোমার মেসেজ আমাদের পর্যাপ্ত সময় দিয়েছে। এমুহূর্তে ইথিওপিয়া আর তাদের আফ্রিকান বন্ধুরা শেপ মাইয়ারের পেছনে লেগেছে।’
‘মিস্টার রানা, একটু আসবেন প্লিজ?’ ডাকলেন জেনারেল হাশমী।
কামরার ওপ্রান্তে গিয়ে ডানাকিলের একটা রিলিফ ম্যাপ পরীক্ষা করল রানা। জুলেখা ইতোমধ্যেই মালদিনির হেডকোয়ার্টার চিমিত করেছে।
‘হেলিকপ্টার হামলা করার উপযোগী ওখানকার ভৌগোলিক অবস্থান?’ জেনারেল হাশমী জিজ্ঞেস করলেন।
‘সেটা কত লোক আর কতটা ফায়ার পাওয়ার হাতে পাচ্ছেন তার ওপর নির্ভর করে।’ উজানে, ভাটিতে ও অনুচ্চ পর্বতমালায় তিনটে পয়েন্ট ইঙ্গিত করে বলল রানা। ‘অটোমেটিক অস্ত্রসহ এই তিন এলাকায় লোকজন ল্যান্ড করান, ডানাকিল গ্রাম নিশ্চিম করে দেয়া যাবে।’
‘দুটো হেলিকপ্টার গানশিপও আছে আমাদের।’
‘মালদিনির হেডকোয়ার্টারের ওপরে অন্তত একটাকে তাক করুন,’ বাতলে দিল রানা। ‘তাতে করে ওর লোকেরা সোজা আপনার লোকেদের হাতে গিয়ে পড়বে। ডানাকিলদের বড়সড় কোন ফাইটিং ফোর্স নেই ওর, ড্রাগ আসক্ত ক্রীতদাসদের ওপরেই ভরসা।’
আলোচনাটা নিছক সৌজন্যমূলক হলো। রিসোর্স কিভাবে ব্যবহার করবেন ইতোমধ্যেই ছকে রেখেছেন জেনারেল। ইথিওপীয় সৈন্যদের রণ-কুশলতা দেখিয়ে, তাক লাগিয়ে দিতে
চান তিনি বাংলাদেশী এজেন্ট টিকে।
মিসাইলগুলোর অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে কেউ টুঁ শব্দটি করছে না, এবং রানা ও রাহাত খান এব্যাপারে একান্তে আলোচনার সুযোগ পেলেন না। কিন্তু নিউক্লিয়ার ওঅরহেডগুলো যাতে বাজে লোকের হাতে না পড়ে, সেজন্যেই আবারও মালদিনির হেডকোয়ার্টারে যেতে রাজি হয়েছে রানা।
‘গত ক’দিন ঘুমাতে পেরেছ, রানা?’ স্নেহ ঝরল বসের কণ্ঠে।
‘আজ সকালে জেলে ঘণ্টা দুয়েক,’ বলল রানা।
‘আজ রাতে খুব একটা ঘুম নেই আপনার কপালে,’ বললেন হাশমী। ‘রাত তিনটের দিকে মুভ করব আমরা। সূর্য ওঠার পরপরই হিট করব মালদিনির ক্যাম্প। আঁধারে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ফ্লাই করা বিপজ্জনক বটে, কিন্তু কেউ ওকে সাবধান করতে পারার আগেই হিট করতে হবে।’
‘তুমি হোটেলে চলে যাও, রানা,’ বললেন রাহাত খান।
‘তোমার ঘুম দরকার। আর হ্যাঁ, লোকাল অথরিটির নির্দেশে শেপ মাইয়ার তোমার সমস্ত জিনিসপত্র নামিয়ে দিয়ে গেছে। তোমার রূমে পাবে।’
‘নিজেকে ভিআইপি মনে হচ্ছে!’ খুশি মনে বলল রানা।
‘মিস্টার রানা, আমার সরকারের তরফ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার ইনফর্মেশনগুলো আমাদের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,’ জেনারেল হাশমী বললেন।
মেজর জেনারেল মগড়ব হয়ে পড়লেন জেনারেল হাশমীর সঙ্গে আলোচনায়। আর সেই সুযোগে রানার কাছ ঘেঁষে এল জুলেখা। ‘আবার দেখা হবে, রানা,’ বলল যুবতী।
‘ইনশাল্লাহ,’ মুচকি হেসে বলল রানা।

ছোট্ট মিলিটারী এয়ারফিল্ডে রানাকে আমন্ত্রণ জানালেন জেনারেল হাশমী তাঁর আক্রমণ পর্যবেক্ষণ করার জন্যে। যুদ্ধের জন্যে তৈরি ও কষ্টসহিষ্ণু মনে হলো ওদের দেখে। আমহারিক গোত্র থেকে এসেছে বেশিরভাগ, এবং রানার ধারণা হলো, ইথিওপিয়ার জাতিগত সমস্যার কথা মাথায় রেখে, এদের বাছাই করতে হয়েছে ভদ্রলোককে। ঝটপট রওনা হয়ে গেল ওরা।
মাখনের মত মসৃণ হলো মিলিটারী অপারেশনটা। জেনারেলের কপ্টার থেকে লক্ষ করল রানা, অ্যাটাক ফোর্সের তিন আর্মস গিলে নিল ডানাকিল গ্রামটাকে। এবার মালদিনির হেডকোয়ার্টারমুখো হলো ওরা, এবং পাক্কা বিয়াল্লিশ মিনিটের মাথায় ক্যাম্পের মাথার ওপর অবস্থান নিল।
রেডিও থেকে আমহারিক ভাষার বিস্ফোরণ শোনা গেল। জেনারেল হাশমী তাঁর মাইক্রোফোন তুলে নিয়ে এক ঝাঁক আদেশ দিলেন।
‘ওরা মিসাইল বের করছে,’ বললেন। ‘আমরা এখন ওদের চমকে দেব।’
তিনটে জেট, রকেট ও নাপাম ওগরাচ্ছে, ঝাঁপিয়ে বেরিয়ে এল সূর্যের আড়াল থেকে। আরও ছটা ফাইটার-বম্বার অনুসরণ করছে ওগুলোকে। মালদিনির দুটো মিসাইলসাইট থেকে ধোঁয়ার তরঙ্গ উঠতে দেখল রানা। একটি উত্তরে, ওর ক্যাম্প আর ডানাকিল গ্রামটার মাঝখানে, এবং অপরটা ক্যাম্পের দক্ষিণ দিকে। মাটিতে মিশে গেল পপি খেত। দু’ জায়গায় চাষ করেছিল ডানাকিলরা। গোটা দুই নাপাম পড়তেই, কপ্টারের উদ্দেশে গুলিবর্ষণরত লোকগুলো যে যেদিকে পারে ছুটে পালাতে লাগল। দক্ষিণে বিকট এক বিস্ফোরণ কমান্ড কপ্টারটাকে বাধ্য করল উন্মাদের মত গতিপথ পরিবর্তন করতে।
‘এই বুদ্ধুগুলো কোন ফেইল-সেফ যন্ত্র হাতাহাতি না করলেই বাঁচি,’ বলল রানা।
‘অ্যাটমিক বিস্ফোরণ হলে মারা পড়ব আমরা,’ সায় জানালেন হাশমী। ‘তাও মধ্যপ্রাচ্যের কোন বড় শহরের চাইতে এখানে থাকা ভাল।’
অ্যাটমিক বিস্ফোরণ ঘটল না। জেনারেল আদেশ করলেন মালদিনির ক্যাম্পের মাঝ বরাবর কপ্টার নামাতে। কাছের এক গিরিখাতে আশ্রয় নিয়েছে বিদ্রোহীদের শেষ দলটা। তাদের দমন করতে গুলিবর্ষণ করতে করতে ছুটে গেল গানশিপ।
‘দলছুটদের দিকে লক্ষ রাখবেন,’ সতর্ক করে দিয়ে, হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করলেন হাশমী।
জ্যাকেট খুলে হাতে নিয়ে এল রানা লুগারটা। ওটার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন জেনারেল। বাহুর খাপে পোরা স্টিলেটোটার উদ্দেশে ইঙ্গিত করলেন। ‘আপনি যুদ্ধসাজে সেজেছেন দেখতে পাচ্ছি।’
যুদ্ধ করতেও হলো। মালদিনির ভস্মীভূত তাঁবুর দিকে পায়ে হেঁটে এগোতেই ওদের লক্ষ্য করে গুলি শুরু হলো। ক্রীতদাসীদের কম্পাউন্ডের আশপাশের পাথরগুলোর মাঝ থেকে গুলি করছে ছোট্ট একটা ডানাকিল গ্রুপ। পাল্টা গুলি বিনিময় করল ওরা। রেডিও অপারেটরের উদ্দেশে হাঁক ছাড়লেন জেনারেল। একটু পরেই, উপত্যকার দক্ষিণপ্রান্ত থেকে অল্প ক’জন সৈন্যের একটা দল এসে, হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে দিতে লাগল। আত্মরক্ষাকারীদের একজনকে রানাদের অবস্থান লক্ষ্য করে ধেয়ে আসতে দেখা গেল। লুগার পেড়ে ফেলল ওকে। এই একটা গুলিরই সুযোগ পেল রানা সারা দিনে। আরেক পশলা গ্রেনেড হামলার পর সৈন্যরা তেড়ে গেল পাথরস্তূপ লক্ষ্য করে। মাত্র কয়েক মুহূর্ত, তারপরই সব খেল্ খতম।
জেনারেল হাশমী উঠে দাঁড়িয়ে ইউনিফর্মের ধুলো ঝাড়লেন। ‘চলুন, মিস্টার রানা, আমাদের স্বঘোষিত জেনারেলটিকে খুঁজে বের করা যাক।’
তাঁবুতে তনড়ব তনড়ব করে তল্লাশী চালাল ওরা। বেশ কিছু ডানাকিল ও ইউরোপীয়র লাশ দেখা গেলেও জেনারেল মালদিনি তাদের মাঝে নেই। হাতে গোনা বন্দী ক’জনের মধ্যেও পাওয়া গেল না তাকে।
‘ডানাকিলগুলোর মুখ খোলাতে বেশ সময় লাগবে,’ বললেন জেনারেল হাশমী।
সরকারী লোকেরা সাধ্য সাধনা করুক, রানা ঘুরে বেড়াতে লাগল এলাকাটার চারধারে। ক্রীতদাসদের মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল, তারপর আবার জড় করে প্রহরাধীন রাখা হয়েছে। রানার তাঁবুতে ছিল যে দুই জার্মান, তাদের দেখে অফিসার ইন চার্জের কাছে কথা বলার অনুমতি চাইল ও। রানাকে স্যালুট করে কথা বলতে দিল অফিসার।
‘মালদিনি কোথায়?’ প্র ম প্রশ্ন ছুঁড়ল রানা।
‘তুমি যাওয়ার ক’দিন পর সে চলে গেছে,’ জানাল একজন।
‘কুদরত চৌধুরী কেমন আছে?’
‘মারা গেছেন। মালদিনি কোথায় গেছে?’
‘জানি না। ও আর সাচ্চি কাফেলা তৈরি করে, ম্যাকলিনকে সাথে নিয়ে চলে গেছে।’
রানার যা জানার জানা হয়ে গেল, কিন্তু জেনারেল হাশমী বাকি দিনটা ডানাকিলদের নির্যাতন করে এর সত্যতা স্বীকার করালেন।
‘মালদিনি এখন সাগরে,’ বললেন জেনারেল। ‘ইথিওপিয়ার মাটিতে আর সে নেই।’
‘তাতে ইথিওপিয়ার সমস্যা কাটছে না,’ রানা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল।
‘আমরা নিরপেক্ষ দেশ। বড় কোন নৌবহর নেই যে সর্বক্ষণ সাগর পাহারা দেব। কি করতে বলেন আমাদের?’
‘কিছুই না,’ বলল রানা। ‘আপনার লোকেরা-আপনাদের এয়ারফোর্স চমৎকার কাজ দেখিয়েছে। এখন আপনার বা আমার একার পক্ষে সাঁতরে গিয়ে মালদিনির জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া সম্ভব না। তাছাড়া আমার বিশ্বাস শেপ মাইয়ার ইথিওপীয় জেটের আওতার বাইরে চলে গেছে। আসমারা ফিরে বসের সঙ্গে আলাপ করে দেখি কি করা যায়।’
বাইরে শান্ত-সংযত ভাব বজায় রাখলেও, বিলম্বের জন্যে মনে মনে হাশমীর অহংবোধকে অভিশাপ দিচ্ছে রানা। যত জলদি রাহাত খানকে মালদিনির অন্তর্ধান সম্পর্কে জানানো যায়, তত তাড়াতাড়ি শেপ মাইয়ারের বিরুদ্ধে পরবর্তী কর্মপন্থা ছকে ফেলা যাবে। কিন্তু খোলামেলা রেডিও সার্কিটে এ নিয়ে আলাপ করতে পারছে না রানা। কোড ব্যবহার করলেও মুশকিল, অপমানিত বোধ করবেন হাশমী। লোকটা এখানে ছড়ি ঘুরিয়ে যদি আত্মতৃপ্তি লাভ করে, করুক না।
‘সাধারণ বুদ্ধিতে বলে,’ আসমারায় ফিরে এলে সন্ধেবেলা রানাকে বললেন বস, ‘মালদিনির নিজস্ব নৌবাহিনী নেই, এবং শেপ মাইয়ারে গিয়ে চড়েছে সে। খোলা আটলান্টিকে আছে লোকটা, সমস্ত ট্রেড রুটের সীমানার বাইরে। মিশরীয় একটা ক্যারিয়ার আর চারটে ডেস্ট্রয়ার ছায়া দিচ্ছে ওটাকে। আর দুটো সিরিয়ান সাবমেরিন কভার করছে আফ্রিকান উপকূল।’
‘আমার অনুমান শেপ মাইয়ার আর্মড,’ বলল রানা। দুটো আলাদা সুপারস্ট্রাকচার এবং লোয়ার ডেকের বিশাল এলাকা সম্পর্কে জানাল সে বসকে।
‘থ্রি-ইঞ্চ গান,’ মাথা ঝাঁকালেন রাহাত খান। ‘বিসিআই তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েই ডাটা সংগ্রহ করতে শুরু করে।’
‘মালদিনি জাহাজে আছে নিশ্চিত হব কিভাবে?’
‘হুঁ।’ চিন্তামগড়ব হলেন মেজর জেনারেল রাহাত খান।

রানা আশা করছিল বস ওকে ঢাকা ফেরত পাঠিয়ে মিশনের ইতি টানবেন। মালদিনির হেডকোয়ার্টার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মাসুদ রানা ইথিওপিয়া এসে কাজের কাজ কি করল? না, না, সে জুলেখাকে উদ্ধার করে এনেছে। এনে অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে খুশি রানা, কিন্তু টের পেল ইথিওপিয়া সরকার এটুকুতে খুশি নয়।
কাজেই বস যখন আসমারায় একটা অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবস্থা করে দিলেন এবং নতুন কাপড়-চোপড় কিনতে বললেন তখন খুব একটা আশ্চর্য হলো না রানা।
‘এখানে কি করতে হবে আমার?’
‘তুমি ঠিক জানো মালদিনি ওই জাহাজে আছে?’
‘না।’
‘আমিও না। মিশনটা এত সোজা, ঠিক যেন মেলে না, রানা। আর ওই মিসাইলগুলোর কথাই ধরো। ইথিওপিয়া নিরপেক্ষ বন্ধু রাষ্ট্র হলেও দেখবে ওগুলো ফেরত নিতে বেগ পেতে হবে। মরুভূমিতে ওগুলো কাছ থেকে দেখার সুযোগ দিল না কেন হাশমী কিছু বুঝতে পারলে?’
‘দুটো কারণ আছে, স্যার। প্র ম, সে বিদেশীদের পছন্দ করে না, এবং তার ধারণা লুকানর মত কিছু আছে ওখানে।’
‘ইথিওপিয়াকে একটা ডেলিকেট সিদ্ধান্ত নিতে হবে,’ বললেন বস। ‘ওই মিসাইলগুলোর কয়েকটার মালিক মিশর। ইসরাইলীও কিছু আছে। আরব বিশ্বের অভ্যন্তরীণ চাপে মিশরের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হবে ইথিওপিয়া। কিন্তু দু’দেশের কারও বাহুবল বৃদ্ধি পাক সেটা এরা চাইবে না। মোট কথা, মিসাইলগুলোর কি হিল্লে করবে এদের জানা নেই। কাজেই আসমারায় থাকছ তুমি। চোখ রাখছ এদের গতিবিধির ওপর।’
রানাকে আসমারায় ফেলে রেখে স্বদেশে ফিরে গেলেন বস। কাজেই বসে বসে আঙুল চুষছে রানা। কিসের জন্যে অপেক্ষা করছে জানে না বলে আরও অসহ্য লাগে। জেনারেল হাশমী
সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলেছেন ওকে; এবং জুলেখা না থাকলে কেমন যে লাগত ভেবে শিউরে ওঠে রানা। কারণ আসমারা মোটেও আকর্ষণীয় কোন শহর নয়।
মাসুদ রানার কন্ট্যাক্ট হচ্ছে বাংলাদেশ দূতাবাসের জনৈক কেরানী। রাহাত খানের বিদায়ের দশ দিন বাদে দেখা মিলল তার। লম্বা-চওড়া এক রিপোর্ট বগলদাবা করে নিয়ে এসেছে। ওটা ডিকোড করতে দু’ঘণ্টা লাগল রানার। শেষ করার পর উপলব্ধি করল, কেউ একজন মস্ত বড় এক ট্যাকটিকাল ভুল করে রেখেছিল।
নেভি শেপ মাইয়ারকে খুঁজে পেয়েছিল আটলান্টিকে, শিপিং লেনের বাইরে, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার মাঝখানে, নিরক্ষরেখার একটু ওপরে। এক ক্যারিয়ার ও চার ডেস্ট্রয়ারের একটা টাস্ক ফোর্স আক্রমণ করে ওটাকে। পাল্টা লড়াই দিয়েছে শেপ মাইয়ার। কিন্তু ওটার তিন-ইঞ্চি গান আত্মরক্ষার জন্যে অপ্রতুল ছিল, এবং সাগরে টুকরো-টুকরো হয়ে যায় জাহাজটা। ভগ্নস্তূপের মধ্যে জীবিত কাউকে খুঁজে পাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। এবং অকুস্থলে প্রচুর হাঙর দেখা গেছে, ফলে নাভাল টাস্ক ফোর্স কোন
মৃতদেহ উদ্ধার করতে পারেনি। তারমানে, কেউ বলতে পারে না মালদিনি জীবিত নাকি মৃত। পরদিন এলেন জেনারেল হাশমী। রিপোর্টের একটা কপি তিনিও পেয়েছেন। রানার ড্রিঙ্কের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে, কাউচে বসে কাজের কথা পাড়লেন ভদ্রলোক। ‘আমাদের অন্তত একজন টার্গেট জাহাজটায় ছিল না।’
‘মালদিনি? রিপোর্ট থেকে কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না।’
‘মালদিনির কথা জানি না, মিস্টার রানা। আপনারা ডানাকিল থেকে শহরে আসার পর কিছু লোকজনের নাম দেয় আমাকে জুলেখা। ওরা নাকি মালদিনির বন্ধু-বান্ধব। ইন্টেলিজেন্স আমার লাইন নয়, অল্প কয়েকজন এজেন্ট ছাড়া অন্যদের ওপর ভরসাও করি না। বিশেষ কয়েকজন রাজনীতিবিদ আর জেনারেলের ওপর গোপনে নজর রাখছে ওরা। ওই অফিসারদের একজনকে নাকি ইদানীং বিশালদেহী এক সাদা চামড়ার লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে।’
‘মালদিনির ক্যাম্পে ওরকম একজন মাত্র লোকই দেখেছি আমি,’ বলল রানা। ‘সে হচ্ছে ম্যাকলিন। সে শেপ মাইয়ারে ছিল না শিয়োর আপনি?’
‘মিশরীয় নেভী ছিনড়বভিনড়ব করে দিয়েছে জাহাজটাকে।’
‘কিইবা করবে, থ্রি ইঞ্চ গান ব্যবহার করলে আপসে ওদের জাহাজে নামা সম্ভব?’
‘কি করবেন এখন ভেবেছেন কিছু, মিস্টার রানা?’
‘সেটা ঠিক করবে আপনার সরকার, জেনারেল। মিসাইলগুলো আপনারা কিভাবে অকেজো করবেন দেখে তারপর আসমারা ছাড়তে বলা হয়েছে আমাকে।’
‘গুলি মারেন আপনার মিসাইলের!’ হঠাৎ বিস্ফোরিত হলেন হাশমী।
বিস্ফোরণের কারণটা ব্যাখ্যা করবেন ভদ্রলোক সেজন্যে অপেক্ষা করছে রানা। ওকে মোটেই সহ্য করতে পারছেন না জেনারেল। জুলেখার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব কি এজন্যে দায়ী? যাকগে, ভাবল রানা, এ লোক ইথিওপিয়ার স্বার্থে কাজ করছে, এবং যতক্ষণ না বিসিআইয়ের সঙ্গে এর মতপার্থক্য হচ্ছে, রানা ঠোকাঠুকি করতে যাবে না।
‘মিস্টার রানা,’ বললেন হাশমী। ‘ইথিওপিয়ার কোন ঠেকা পড়েনি নিউক্লিয়ার পাওয়ার হতে চাইবে। অত হ্যাপা সামলানোর ক্ষমতা আমাদের নেই।’
‘সুযোগ এসে গেছে আপনাদের সামনে, সেটা নেবেন কিনা আপনারা বুঝবেন। আমি অবশ্য মিসাইলগুলো ফেরত চাই। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে।’
‘গত ক’দিন ধরে কানে আসছে আমরা নাকি এরইমধ্যে নিউক্লিয়ার পাওয়ার হয়ে গেছি। মিসাইল হাতে থাকলে তার টার্গেটও লাগে। মধ্যপ্রাচ্য আর ইসরাইলের যেমন টার্গেট আছে। কিন্তু আমাদের শত্রু কোথায়?’
‘কাজেই জাতিসংঘের হাতে ওগুলো তুলে দেয়াই ভাল,’ বলল রানা। ‘তারাই বুঝবে ওগুলো রেখে দেবে নাকি যার যারটা তাকে ফিরিয়ে দেবে।’
‘এ নিয়ে পরে আরও আলাপ করা যাবে,’ বললেন জেনারেল হাশমী। ‘আপনি তো আসমারায় কিছুদিন থাকছেনই।’
জেনারেল চলে গেলে দূতাবাসে গেল রানা। কেব্ল্ পাঠাল একটা মেজর জেনারেলের কাছে। জানতে চাইল ইথিওপিয়ায় মিসাইল বিশেষজ্ঞ পাঠাতে কদ্দিন লাগবে। ওঅরহেডগুলো আর্মড নয় বলেছেন জেনারেল হাশমী, কিন্তু তাঁর কথার সত্যতা যাচাই
করে দেখতে চায় রানা।
দু’রাত পরে, আসমারার এক নাইটক্লাব পার্টিতে যাওয়ার প্রস্তাাব তুলল জুলেখা। ইতোমধ্যেই এক সরকারী অফিসে যোগ দিয়েছে সে-রেকর্ড সংক্রান্ত কাজ-কর্ম তার। জেনারেল হাশমী ব্যবস্থা করে দিয়েছেন কাজটার। নাইটক্লাবে রানা বিপদের আশঙ্কা করছে না, কিন্তু তারপরও লুগার, স্টিলেটো ও খুদে গ্যাস বোমাটা সঙ্গে রাখবে ঠিক করল।
পশ্চিমা সংস্কৃতির জঘন্যতম নিদর্শন হচ্ছে এই ক্লাবটা। বিশ্রী এক রক ব্যান্ড কান ঝালাপালা করে ছেড়েছে। তার ওপর সব কিছুরই এখানে চড়া দাম। ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি গানের জন্যে রীতিমত হাহাকার উঠল মাসুদ রানার বুকের ভেতর। আধ ঘণ্টা পর জুলেখাকে নিয়ে পালাল ও।
আজ সন্ধেয় কেমন এক হিম-হিম ভাব, পাহাড়ী শহরের বৈশিষ্ট্য যেমন হয় আর কি। ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে ট্যাক্সি পাওয়া গেল না। এমনকি দারোয়ান, ফোন করে হয়তো কোন একটাকে ডাকতে পারত, সে-ও উধাও। অবশ্য ঘোড়ায় টানা এক ক্যারিজ, খালিই দেখা গেল, দাঁড়িয়ে আছে নাইট ক্লাবের সামনে। জুলেখাকে নিয়ে ওটায় চড়ে বসে চালককে নিজের অ্যাপার্টমেন্টের অবস্থান জানাল রানা। শূন্য দৃষ্টিতে চালক চেয়ে রইল ওর দিকে।
ইতালিয়ানে বলল এবার রানা।
‘সি, সিনর,’ বলল লোকটা।
জুলেখা রানার বাঁ পাশে বসেছে, চলতে শুরু করল গাড়ি। নাইটক্লাবের শোরগোলের পর অস্বাভাবিক শান্ত লাগছে রাতটাকে। রাস্তার ওপর ঘোড়ার নিয়মিত ছন্দবদ্ধ খুরের শব্দে ঘুম পাবে যে কারও। জুলেখা শরীর ঢিল করে দিয়েছে। রানা আড়ষ্ট। ছোট্ট এক রহস্যের সমাধান করতে চেষ্টা করছে ও।
ইথিওপিয়ার স্কুলগুলোয় ইংরেজি বহুল প্রচলিত দ্বিতীয় ভাষা। আসমারা কসমোপলিটন শহর। হোটেলের বেয়ারা থেকে শুরু করে সমাজের মাথা পর্যন্ত সবাই একাধিক ভাষা রপ্ত করেছে। ক্যারিজ চালক ইংরেজি জানে না ব্যাপারটা সামান্য হলেও, সতর্ক হয়ে গেল রানা। অসাবধানতার কারণে শেপ মাইয়ারে মাথায় বাড়ি পড়েছে ওর। আবারও বেলতলায় যেতে রাজি নয় রানা।
একটু পরেই, দু’নম্বর সন্দেহটা আরও জোরাল প্রমাণিত হলো। আসমারায় বসে থাকতে হচ্ছে বলে, রানা কখনও জুলেখাকে নিয়ে, কখনও একা শহরের আশপাশে ঘোরাফেরা
করেছে। তাই বলে যে এ শহরের নাড়ী-নক্ষত্র চিনে গেছে সে তা নয়। কিন্তু তারপরও সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগল ওর মনে, ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে ওদেরকে চালক। ব্যাপারটা জানাল রানা জুলেখাকে।
স্থানীয় ভাষায় যুবতী কিছু বলল চালককে। লোকটা জবাব দিল, শরীর অর্ধেকখানি ঘুরিয়ে হাত নেড়ে কি যেন বোঝাল। জুলেখা কথা বলল ওর সঙ্গে আবার। লোকটা দ্বিতীয়বার কি এক ব্যাখ্যা দিয়ে তারপর সিধে হয়ে বসল। মন দিয়েছে গাড়ি
চালনায়।
‘ও বলছে এটা নাকি শর্টকাট,’ বলল জুলেখা।
শোল্ডার হোলস্টারে লুগারটা ঢিল করল রানা। ‘আমার বিশ্বাস হয় না,’ বলল।
রানার অবিশ্বাস লোকটার ইংরেজি জ্ঞান ফিরিয়ে দিল কিনা কে জানে। সীটে ঘুরে বসে পকেট হাতড়াচ্ছে চালক। ঠাঁই করে লুগারের বাঁট পড়ল ওর চাঁদিতে। ‘হুঁক’ করে একটা শব্দ করে জ্ঞান হারাল লোকটা, আসন থেকে পড়ে যায় আরকি। হাত থেকে খসে
ঠং করে রাস্তায় পড়েছে পিস্তলটা। ওদিকে, চালকবিহীন ত্রস্ত ঘোড়াটা তখন রীতিমত ঘোড়দৌড় লাগিয়েছে।
‘ঘাবড়িয়ো না!’ জুলেখাকে আশ্বস্ত করতে চাইল রানা।
পিস্তলটা হোলস্টারে গুঁজে দিয়ে, এক লাফে সামনে গিয়ে পড়ল রানা। লাথি মেরে সীট থেকে চালককে খসাল। তারপর লাগাম চেপে ধরে সামলাতে ব্যস্ত হলো উদ্ভ্রান্ত জানোয়ারটাকে।
বিপজ্জনকভাবে এপাশ-ওপাশ দুলছে ওরা। জট পাকিয়ে গেছে লাগাম দুটো। সরু রাস্তাটা দিয়ে তীরবেগে ছোটার ফাঁকে ও দুটোকে সোজা করার চেষ্টা করল রানা। রাস্তার দু’পাশে ছিটকে গেল কয়েকজন পথচারী। রানা প্রার্থনা করছে, কোন গাড়ি-টাড়ি যাতে এমুহূর্তে মুখোমুখি পড়ে না যায়। শহরের এ অংশটা সুনসান মনে হলো, রাস্তার পাশে মাঝেমধ্যে দু’একটা গাড়ি পার্ক করে রাখা। হাড় জিরজিরে ঘোড়াটা যে এমন ভেলকি দেখাবে কে
জানত। এ মুহূর্তে কেনটাকি ডার্বি জেতার ক্ষমতা প্রদর্শন করছে এই বুড়ো ঘোড়া।
রানা শেষমেষ লাগামজোড়ার জট খুলে আরেকটু চাপ বাড়াতে পারল। চাপ যাতে দু’পাশে সমান থাকে, সতর্ক রইল ও। ক্যারিজটার সেন্টার অভ গ্র্যাভিটি অনেক উঁচু। আচমকা যদি বাঁক নেয় ঘোড়াটা, গাড়ি থেকে উড়ে গিয়ে রাস্তায় পড়তে হবে ওদেরকে। ধীরে ধীরে চাপ বাড়িয়ে চলল রানা। শ্লথ হতে শুরু করেছে ঘোড়াটার গতি। অনুচ্চ স্বরে কথা বলে ওটাকে শান্ত করতে চাইছে রানা।
নিয়ন্ত্রণে প্রায় এসে গেছে গাড়ি এসময় চেঁচিয়ে উঠল জুলেখা, ‘রানা! পেছন থেকে খুব জোরে একটা গাড়ি তেড়ে আসছে।’
‘কতটা কাছে?’
‘কয়েক ব্লক দূরে, কিন্তু খুব দ্রুত কাছিয়ে আসছে।’
লাগামে ঝাঁকুনি দিল রানা। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে শরীর তুলে ফেলল ঘোড়াটা। প্রবল এক ঝটকা খেল ক্যারিজ। এবার মাটিতে খুর দাপিয়ে পাগলা ঘোড়ার মত ছুটতে চেষ্টা করল জানোয়ারটা। লাগামে ফের ঝাঁকি দিল রানা, ঘোড়াটাকে থামানোর চেষ্টায় খিল ধরে গেল কাঁধের পেশীতে। আবারও দেহ শূন্যে তুলে দিল ভীত-সন্ত্রস্ত জানোয়ারটা। একপাশে কাত হয়ে গেল ক্যারিজ।
‘লাফ দাও!’ চেঁচাল রানা।
ডান পাশে লাগাম ফেলে সামনের বাঁ দিকের চাকার ওপর দিয়ে লাফ মেরে শান বাঁধানো রাস্তায় পড়ল রানা। কয়েক গড়ান দেয়ায় ছড়ে গেল হাঁটু, ফালা ফালা হলো কোট। উঠে দাঁড়িয়ে টলমল পায়ে সুউচ্চ এক বিল্ডিঙের উদ্দেশে এগোল ও। পেছনে চেয়ে দেখল, জুলেখা দশ ফিট দূরে রাস্তা থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে।
লাগামের চাপমুক্ত ঘোড়াটা পাঁই-পাঁই ছুটছিল আবার। কিন্তু ক্যারিজ উল্টে পতন হলো বেচারার, শরীরটা চাপা পড়েছে গাড়ির নিচে। মরিয়া হয়ে শূন্যে লাথি ছুঁড়ছে, আর ডাক ছাড়ছে অবলা জানোয়ার। ওদিকে, তীব্র গতিতে তখন ছুটে আসছে পেছনের গাড়িটা রানাদের উদ্দেশে, মনে হচ্ছে যেন ভূতে পেয়েছে চালককে।
জুলেখা রানার কাছে দৌড়ে এসে কোনমতে বলল, ‘রানা, ওই যে…’
‘কোন দরজা পাও কিনা দেখো।’
নির্জন রাস্তাটা ধরে ছুটল ওরা, বিল্ডিংগুলোর মাঝে কোন ফাঁকা জায়গা পাওয়া যায় কিনা দেখছে। কিন্তু ওয়্যারহাউজ সদৃশ বাড়িগুলোর মাঝে একজন মানুষ গলার মত ফাঁক নেই। একটা সেলারের প্রবেশপথ এসময় আবিষ্কার করল ওরা। গোঁ-গোঁ শব্দ
স্পষ্টতর হচ্ছে গাড়িটার। জুলেখাকে সিঁড়ি দিয়ে ঠেলে নামিয়ে নিল রানা। রাস্তার লেভেলের নিচে এসে গেল দু’জনেই। গাড়িটার হেডলাইট আলোকিত করে তুলেছে এলাকাটা। কিঁইঁচ্ শব্দে তীক্ষ্ণ ব্রেক চাপা হলো এইমাত্র।
‘শব্দ কোরো না,’ ফিসফিস করে বলল রানা, নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
জুলেখা রানার বাঁ বাহুতে চাপ দিয়ে দূরে সরে গেল খানিকটা।
এবার অস্ত্র ব্যবহারের স্বাধীনতা পেল রানা।
দড়াম করে বন্ধ হলো গাড়ির একটা দরজা। তারপর আরেকটা। এবং আরও একটা। এঞ্জিন চালু আছে যদিও। তিনের কম নয় ওরা, চারজনও হতে পারে।
‘খুঁজে বের করো ওদের,’ একজন চোস্ত ইতালিয়ানে আদেশ করল।
রানার বুঝতে কষ্ট হলো না কে লোকটা। ম্যাকলিন, ওরফে ব্রুনো কন্টি। ক্যারিজ চালক পিস্তল বের করার পর থেকেই ওকে আশা করছিল রানা। চাইছিল দেখা হোক, জেনারেল হাশমী যখন বললেন ও ইথিওপিয়ায় রয়েছে, তারপর থেকেই। এবার, বাছাধন, অস্ত্র আছে আমারও হাতে, মনে মনে বলল ও।
‘ওরা ওয়াগনে নেই,’ স্থানীয় কারও গলা।
‘আশপাশে আছে, থাকতেই হবে,’ বলল ম্যাকলিন। ‘অ্যান্ড্রুকে বলো এঞ্জিন অফ করতে, শব্দ শুনতে পাচ্ছি না।’
রানার হাত ধরে টানল জুলেখা। পেছনের দরজাটা ঠেলতেই খোলা পেয়েছে ও। ওখান দিয়ে পালানোর চিন্তা করেও পরমুহূর্তে সেটা বাতিল করে দিল রানা। লোকগুলোর কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে, তারা মনে করছে রানা ও জুলেখা আহত। কাজেই রানা ঠিক করল ওদেরকে থতমত খাইয়ে দিয়ে পরিস্থিতি অনুকূলে আনার চেষ্টা করবে। আহা, জুলেখার সঙ্গেও যদি এখন একটা পিস্তল থাকত। ডানাকিলে প্রমাণ পেয়েছে, কেমন লড়াকু মেয়ে ও।
শরীর কাত করে প্যান্টের ভেতর হাত ভরল রানা। ঊরু থেকে তুলে আনল পিচ্চি গ্যাস বোমাটা। নতুন ধরনের এক নার্ভ গ্যাস ভরা আছে এটায়। জিনিসটা কয়েক ঘণ্টার জন্যে হতবিহ্বল করে রাখবে একজন মানুষকে। বিসিআই ল্যাবোরেটরী সতর্ক করে দিয়েছে ওকে, খুব শক্তিশালী লোক ছাড়া অন্যদের জন্যে জীবনহানিকরও হতে পারে বোমাটা। উপায়ান্তর নেই যখন, কি আর করা, শরীর প্রায় দু’ভাঁজ করে ধাপ বেয়ে পা টিপে টিপে
উঠতে লাগল মাসুদ রানা।
আরও কণ্ঠস্বর। গাড়ির এঞ্জিনটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। এবার একটা দরজা খোলার ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ। সটান দাঁড়িয়ে, বাঁ হাতে বোমাটা ছুঁড়ে মারল রানা, শেষ মুহূর্তে দূরত্ব মেপে নিয়েছে। ঠিক করেছে সরাসরি আক্রমণ চালাবে। গাড়িটার বাঁদিকে পড়ে বোমাটা
বিস্ফোরণ ঘটালেও, রানার দৃষ্টি ছিল হেডলাইটের আলোয় উদ্ভাসিত এলাকাটার দিকে। ওর লুগার গর্জে উঠতেই একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এবার কে যেন, উল্টানো ক্যারিজটার আড়াল থেকে মেশিন পিস্তলের গুলি বর্ষাতে লাগল। মাথার ওপরে, পাথুরে
দেয়ালে গুলি ঠিকরে দিক বদল করায় নিচু হলো রানা।
‘বিল্ডিঙের ভেতরে যাও,’ জুলেখাকে বলল রানা।
বেজমেন্টে ত্বরিত সেঁধিয়ে পড়ল ওরা পথ খুঁজে। অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটার চারপাশে ডাঁই করে রাখা কার্ডবোর্ড কার্টন। রাস্তা থেকে আরেক পশলা গুলিবর্ষণ হলো, ঝনঝন শব্দে চুরমার হয়ে গেল কাঁচ। মাথার ওপরে, দুপ-দাপ পা ফেলার আওয়াজ।
‘পাহারাদার,’ বিড়বিড় করে জুলেখাকে বলল রানা। ‘লোকটা পুলিসে খবর দিলে হয়।’
‘না দিলেই বরং নিরাপদ আমরা,’ মৃদু স্বরে বলল যুবতী।
‘তৃতীয় বিশ্বে যা হয়। ওরা কাদের সাপোর্ট করবে কে জানে!’
এক সার সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছে পদশব্দ। দু’পাশে গাদা করে রাখা কার্টনগুলোর পেছনে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল রানা আর জুলেখা। বাইরে রাস্তায়, ভারী জুতো পরা পায়ের আওয়াজ উঠল। ম্যাকলিন?
কার্টনের মাঝখানের গলিটাতে দেখা হলো লোক দুটোর। দু’জনেই গুলি চালাচ্ছে। দোরগোড়ার সামান্য ভেতরদিকে দাঁড়িয়ে ম্যাকলিন। নৈশপ্রহরী রানাদের ও ম্যাকলিনের মধ্যখানে অবস্থান নিয়েছে। প্র ম গুলি করার সুযোগ পেলেও লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলো পাহারাদারের। মেশিনপিস্তলের ফায়ার ওপেন করল ম্যাকলিন। রানা দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেল প্রহরীর দেহটা ঝাঁঝরা হয়ে গেল। ফ্ল্যাশলাইট আর পিস্তল খসে পড়ল তার হাত থেকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে।
স্তব্ধ হলো ম্যাকলিনের পিস্তল। এক লাফে আইলে গিয়ে পড়ল রানা, লুগারটাকে তলপেট বরাবর তাক করে ধরে একটা গুলি করল। তারপর ডাইভ দিয়ে পড়ল মেঝেতে। আর্তনাদ ছাড়ল ম্যাকলিন। আরেক ঝাঁক গুলি উগরাল ওর মেশিন পিস্তল, তারপর স্তব্ধ হয়ে গেল। রানার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে বুলেটগুলো। অগিড়বশিখা লক্ষ্য করে আরেকবার গুলি করল রানা। এবার মেঝেতে পতনের শব্দ শুনতে পেল ম্যাকলিনের।
বাঁ হাতে লুগার নিয়ে এসে, ডান হাতে স্টিলেটো বাগিয়ে ধরে, দ্রুত আইলের মাথায় চলে এল রানা। দরজার কাছে পাওয়া গেল ম্যাকলিনকে। শ্বাস চলছে ওর, তবে ক্ষীণ।
‘জুলেখা,’ ডাকল রানা। ‘বেরিয়ে এসো।’
দরজা দিয়ে বেরিয়ে, সিঁড়ির ধাপ ভেঙে উঠে এল ওরা, পৌঁছল রাস্তায়। কৌতূহলী লোকজন দেখা গেল বিপদসীমার বাইরে, ফলে লুগারটা হাতছাড়া করল না রানা।
‘দৌড়াতে পারবে?’ জুলেখাকে শুধাল ও।
‘পারব,’ বলল যুবতী। ‘কোথাও থেকে জেনারেল হাশমীকে ফোন করা দরকার।’
আঁকাবাঁকা গলিপথের মধ্য দিয়ে ছুটছে ওরা। এক ফাঁকে লুগার ও স্টিলেটো গোপন করল রানা। অবশেষে ব্যস্ত একটা রাস্তা পেয়ে গেল ওরা। বেশ কটা বার লক্ষ করল এখানে। থেমে দাঁড়িয়ে কাপড়-চোপড় ঠিকঠাক করে নিল দু’জনে। তারপর ঢুকে পড়ল একটা বারের ভেতর।

ম্যাকলিনের তাড়া খেয়ে যে বারটিতে গিয়ে ঢুকল ওরা, সেটিও বড় সুবিধের জায়গা নয়। পছন্দসই পতিতাদের এখান থেকে বেছে নিয়ে যায় খদ্দেররা। দেখা গেল, সন্ধের ঠাণ্ডা বাতাসের তোয়াক্কা নেই মেয়েগুলোর। দিব্যি পাতলা সামার ড্রেস পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়, আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করছে ওরা নিজেদের। রানারা বারে ঢুকতে কটমট করে জুলেখাকে মাপল ওদের চোখ। এমনকি যাদের সঙ্গে খদ্দের রয়েছে তাদের চাহনিও বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হলো না। দুটো কারণে এদের রাগ হয়ে থাকতে পারে জুলেখার প্রতি। প্রহম, জুলেখা আমহারিক, এই মেয়েগুলো হয়তো ভিনড়ব গোত্রের। এবং দ্বিতীয়ত, ওরা হয়তো ভেবেছে খদ্দের কেড়ে নিতে এসেছে নতুন আপদ। যা হোক, জ্যাকেটের চেন খুলে দিল রানা। শোল্ডার হোলস্টারে লুগারটাকে ঘুমোতে দেখলে সম্ভবত আগুনে পানি
পড়বে ওদের।
পরিস্থিতি বিচার করতে ভুল হয়নি জুলেখারও। ‘রানা,’ অনুচ্চ স্বরে বলল। ‘পিঠের দিকে খেয়াল রেখো। ফাইট করতে হতে পারে।’
‘হুঁ,’ বলল রানা। ‘ফোনটা ইউজ করতে পারি?’ বারে ঠেস দিয়ে বার্টেন্ডারকে জিজ্ঞেস করল।
‘দু’ব−ক পরে ডানদিকে একটা পে ফোন আছে!’
জ্যাকেটটা আরেকটু খোলসা করল রানা। ‘অত হাঁটতে যাবে কে?’ জবাব চাইল।
স্থানীয় ভাষায় কড়া গলায় কি যেন বলল জুলেখা। যাই বলুক না কেন, বারের দুটো টুল পেছনে বসে থাকা লোকটার তা পছন্দ হলো না। প্যান্টের পকেট থেকে সাঁত করে এক সুইসব্লেড বের করে আনল সে। লুগারটা টেনে নিয়ে লোকটার মুখের ওপর ব্যারেল দিয়ে সজোরে টোকা দিল রানা। মেঝেয় ঢলে পড়ে গোঙাতে লাগল লোকটা, ঠোঁট কেটে রক্ত বেরোচ্ছে।
‘ফোন,’ বার্টেন্ডারকে স্মরণ করাল রানা।
‘নেই।’
রানা এক লাফে বার টপকে গিয়ে পড়তে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল লোকটা। ড্রাফট বীয়ার ট্যাপের পেছন থেকে পিস্তলটা যে বের করবে সে ফুরসতও পেল না ও। রানা বাঁ হাতে ওর ডান হাত মুচড়ে ফোনের অবস্থান জেনে নিল। এবার ঘরের পেছনদিকে নিয়ে চলল লোকটাকে।
‘বোকামি কোরো না,’ শাসাল। ‘পিস্তল বের করার চেষ্টা করেছ কি মরেছ।’
বারের পেছনে ছুটে এল জুলেখা। স্কার্ট উঠে যেতে ঝিলিক দিল ওর লম্বা পা দুটো। বার্টেন্ডারের পিস্তলটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে, তাক করে ধরল ও পতিতা আর খদ্দেরদের উদ্দেশে। ওর কঠোর অথচ সংক্ষিপ্ত আঞ্চলিক ভাষার ভাষণটা রানাকে অনুবাদ করে শোনানোর প্রয়োজন পড়ল না। সারমর্ম বুঝে নিল রানা: জায়গা ছেড়ে নোড়ো না, আরামে ড্রিঙ্ক করো, এবং রাতে যা খুশি করতে পারো।
বার্টেন্ডার ফোনের কাছে নিয়ে এল ওদের। রানা কভার করল ওকে এবং জুলেখা জেনারেল হাশমীর সঙ্গে কথা বলল। কি কি ঘটেছে, ওরা এখন কোথায় এসব জানাল। এবার বার্টেন্ডারকে ফোনটা দিল ও। জেনারেল কি বললেন লোকটিকে কে জানে, কিন্তু দেখা গেল, রানা আর জুলেখার বীরত্ব দেখেও যা পায়নি, তারচাইতে বেশি ভয় পেয়ে গেছে বেচারা। ওরা যতক্ষণ অপেক্ষা করল কোন খদ্দের বারের কাছ ঘেঁষল না। পনেরো মিনিট বাদে দুজন ষণ্ডা মার্কা দীর্ঘদেহী সৈনিককে নিয়ে বারে প্রবেশ করলেন জেনারেল। তাঁকে দেখে মেঝেতে মিশে যায় আরকি বার্টেন্ডার।
‘গুড ইভনিং, মিস্টার রানা,’ বললেন জেনারেল। ‘জুলেখা সবই বলেছে। দেখা যাচ্ছে ম্যাকলিনের ব্যাপারে ভুল বলেনি আমার লোক।’
‘আমি আগেই জানতাম,’ বলল রানা। ‘আপনার আন্ডারে সবাই দক্ষ লোক।’
মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল জেনারেলের।
আসমারার উপকণ্ঠে এক আর্মি বেস। জেনারেল হাশমীর প্রাইভেট কোয়ার্টার। রানা ও জুলেখাকে নিয়ে এসে প্রচুর আদর-আপ্যায়ন করেছেন জেনারেল। ফোনে কথা বলেছেন নানা জায়গায়। তারপর রাত তিনটের দিকে আলোচনায় বসলেন ওদের সঙ্গে।
‘আচ্ছা, শেপ মাইয়ারে মালদিনি ছিল বলে এখনও বিশ্বাস করেন আপনি?’ প্রশ্ন করলেন রানাকে।
শ্রাগ করল রানা। ‘জাস্ট আন্দাজ করতে পারি। প্রশ্ন হচ্ছে, ম্যাকলিন কি নিজে থেকেই এসব করল? আমার ধারণা, তা নয়। ও আর মালদিনি ওই জাহাজে ওঠেনি।’
‘তাহলে গেল কোথায় লোকটা?’
‘আছে ইথিওপিয়াতেই কোথাও,’ বলল রানা।
‘ম্যাকলিন জ্ঞান ফিরে পাওয়ার আগেই মারা গেছে অপারেশন রূমে। মালদিনির খোঁজ জানার আরেকটা সুযোগ ফস্কে গেল।’
‘কিন্তু ওই মিসাইলগুলোর ব্যাপারে তো একটা কিছু করতে হবে আপনাকে, জেনারেল,’ বলল রানা। ‘তা নাহলে আপনার দেশ অনেকের কোপানলে পড়বে।’
‘না, মিস্টার রানা, সেই কিছুটা করছেন আপনি। সম্প্রতি কিছু কিছু ব্যাপারে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। আমরা আপনাকে মিসাইলগুলো নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেব। বাংলাদেশ
ইথিওপিয়ার কোস্টে একটা ক্যারিয়ার রাখবে। হেলিকপ্টার টেকনিশিয়ানদের এখানে পৌঁছে দেবে। মিসাইল থাকবে মরুভূমিতে, কিন্তু নিউক্লিয়ার ওঅরহেডগুলো জাতিসংঘের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে বাংলাদেশকে দিয়ে দেয়া হবে। আপনি আমাদের জন্যে এত করলেন, আপনার দেশের মাধ্যমেই ওগুলো জাতিসংঘের হাতে পৌঁছাক আমরাও তাই চাই। মিসাইল বানানো তেমন কষ্টসাধ্য কাজ নয় জানেনই তো, নিউক্লিয়ার ওঅরহেড আসলে ডেঞ্জারাস করে তোলে ওগুলোকে।’
‘যারা ওগুলো পাহারা দিচ্ছে তাদের ওপর কন্ট্রোল আছে আপনার?’
‘হ্যাঁ,’ বললেন জেনারেল। ‘গভীর মরুভূমিতে পাঠানো হয়েছে ওদের। বুদ্ধিটা কেমন, দারুণ না?’
দ্বিমত করতে পারল না রানা।
‘দু’একদিনের মধ্যেই ফাইনাল ডিটেইলস পেয়ে যাবেন। সে কদিন ইথিওপিয়ার আতিথ্য গ্রহণ করুন, মিস্টার রানা।’
জেনারেল হাশমীর ড্রাইভার একটু পরে জীপে তুলে, রানা আর জুলেখাকে যার যার বাসায় পৌঁছে দিল।
পাঁচদিন বাদে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিবরণ হাতে পেল রানা। জেনারেল হাশমী জানিয়েছেন ওকে, সকাল ছটায় স্বয়ং উপস্থিত থেকে আসমারার সীমানা পার করে দেবেন। মাসুদ রানা আর আসমারায় ফিরছে না। ডানাকিল থেকে সোজা গিয়ে বাংলাদেশী ক্যারিয়ারে
উঠবে ঠিক করে দেয়া হয়েছে ঢাকা থেকে। কাজেই জুলেখার কাছ থেকে আবেগঘন বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে রানা। এ ক’দিনে বেশ একটা ভাই-বোনের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল ওদের মধ্যে। ওকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কেঁদেছে মেয়েটি।
‘তোমাকে আমি কোনদিন ভুলতে পারব না, রানা,’ কাঁদতে কাঁদতে বলেছে। ‘তুমি আমার জন্যে যা করেছ মুখে বলে তোমাকে ছোট করতে চাই না। আমাকে মরণের হাত থেকে, অসম্মানের হাত থেকে বাঁচিয়েছ।’
‘ছিঃ, বোকা মেয়ে,’ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছে রানা। ‘আমি কিছুই করিনি। যেটুকু করেছি মানুষ মানুষের জন্যে তারচাইতে অনেক বেশি করে।’ চোখের পানি মুছে দিয়েছে ও জুলেখার।
‘আবার কবে আসবে? কথা দাও, আমাকে ভুলে যাবে না।’
‘তোমাকে কি ভোলা যায়? তাছাড়া, আমি তো সুযোগ পেলেই আবার চলে আসব।’ ওর কপালে চুমু দিয়ে বলেছে রানা। মনে মনে করুণ হেসেছে। আজ এ দেশে তো কাল সে দেশে শত্রুর পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে ও, মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় করে। কবে, কখন সুযোগ হবে আবার এদেশে আসার আল্লাই জানে। হয়তো আদৌ কোনদিন হবেই না।
সুটকেস গোছায়নি রানা। লুগার আর স্টিলেটো ছাড়া অন্য কোন মালামালের প্রয়োজনও নেই ওর। মালদিনির চ্যালারা কেউ ওর ওপর নজর রেখে থাকলে বুঝতে পারবে না দক্ষিণযাত্রা করতে চলেছে রানা। উন্মাদ লোকটাকে শায়েস্তা করে, নিউক্লিয়ার ওঅরহেডগুলো ইথিওপিয়া থেকে সরিয়ে নেয়াই এখন ওর মূল কাজ। ও নিশ্চিত ভাবেই জানে বেঁচে আছে মালদিনি। সুযোগের অপেক্ষায় আছে।
গাড়ি নিয়ে এলেন জেনারেল। ‘সারাদিন লেগে যাবে,’ বললেন। চমৎকার ড্রাইভ করেন ভদ্রলোক, নানা জীব-জন্তু আর মান্ধাতা আমলের গাড়িগুলোকে দক্ষ হাতে পাশ কাটিয়ে
দক্ষিণমুখো চালাচ্ছেন গাড়ি। স্থানীয় রেল রোডের চাইতে ইথিওপিয়ার সড়ক যোগাযোগ ভাল হলেও পে−ন ভ্রমণই রানার কাছে সেরা মনে হলো। ভদ্রলোক কেন গাড়ি ড্রাইভ করা বেছে নিলেন ব্যাখ্যা করলেন না। রানাও এ ব্যাপারে কিছু জানতে চাইল না।
যাত্রার বেশিরভাগটা সময় স্যান্ডহার্স্টে তাঁর ছাত্র জীবন সম্পর্কে বকে গেলেন জেনারেল। তাঁর কণ্ঠে ব্রিটিশদের প্রতি যুগপৎ প্রশংসা ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটল। হুঁ-হা করে তাল
মিলিয়ে গেল রানা তাঁর সঙ্গে।
জেনারেলের এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাতটা কাটাল ওরা। বাড়ির কোন মহিলাকে চোখে পড়ল না রানার। গৃহকর্তার সঙ্গে কেবল সংক্ষিপ্ত আলাপ হলো ওর খাওয়ার সময়।
সূর্যোদয়ের ঘণ্টা খানেক আগে, ছোট্ট এক এয়ারফিল্ডে, গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এলেন জেনারেল রানাকে।
‘পাইলটকে বিশ্বাস করতে পারেন,’ বললেন তিনি। ‘রেডিও ব্যবহার করে আপনার লোকেদের কল করুন।’
হেলিকপ্টারের পেছনে কমিউনিকেশন্স স্টেশনে এল রানা, যোগাযোগ করল ক্যারিয়ারের সঙ্গে। ওদিকে গা গরম করছে কপ্টারের এঞ্জিন।
‘তছনছ করে দেয়া হয়েছে মালদিনির পপি খেত। একটা গ্রীনহাউজও আস্ত নেই। মরুভূমির গভীরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মিসাইলগুলো,’ বললেন জেনারেল হাশমী। ‘কেউ ওগুলো পাহারা দিচ্ছে না। আপনার লোকেরা এসে পড়লেই চলে যাব আমি। ঠিক আছে, মিস্টার রানা?’
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল মাসুদ রানা।
বাংলাদেশী টাস্ক ফোর্স ইতোমধ্যে শূন্যে উড়াল দিয়েছে, পনেরোটা নেভি হেলিকপ্টার প্রবেশ করেছে ইথিওপিয়ার আকাশ সীমায়।
এই দেশে যেরকম গোত্র দ্বন্দ্ব, ভাবল রানা, তাতে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই নিউক্লিয়ার ওয়রহেড নিয়ে ফেরার পথে বাধা পড়বে না। কোন গ্রুপ যদি চায় ওগুলো ইথিওপিয়াতে থাকুক, জাতিসংঘের হাতে না যাক, তাহলে? আর কি, গন্ডগোল, রক্তপাত।
পুবে যাওয়ার পথে তিনটে উটের কাফেলার ওপর দিয়ে উড়ে গেল কপ্টার। ডানাকিল মরুভূমির কষ্টের স্মৃতি মনে পড়ে গেল রানার জানোয়ারগুলোকে দেখে। ইথিওপিয়ানরা কি মালদিনির ডানাকিল সমর্থকদের বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশন নিয়েছে? জেনারেল হাশমীকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও চেপে গেল রানা।
ভদ্রলোক হয়তো ভাবতে পারেন তাঁদের ঘরোয়া রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছে রানা।
উচ্চতা হারাতে শুরু করেছে ওরা। নিচে চাইতে, নিখুঁত সারিতে রাখা মিসাইলগুলোয় সূর্যকিরণ ঝিকাতে দেখল রানা। মালদিনির হেডকোয়ার্টার থেকে এই বেলে অঞ্চলে ওগুলোকে টেনে এনেছে বেশ কয়েকটা বড় বড় ট্রাক্টর। সেগুলো অবশ্য এখন নেই। সম্ভবত এয়ারলিফট করা হয়েছে যন্ত্রগুলোকে, কেননা ট্র্যাক দেখা গেল একমুখী।
‘আপনাদের টাস্ক ফোর্স আসতে কতক্ষণ বাকি, মিস্টার রানা?’ প্রশ্ন করলেন জেনারেল হাশমী।
‘বিশ মিনিট,’ বলল রানা।
পাইলটের উদ্দেশে আদেশ বর্ষালেন তিনি। মিসাইলের ঠিক পশ্চিমে, শূন্যে খানিকক্ষণ ভেসে থেকে, তারপর নামতে শুরু করল কপ্টার।
‘ফুয়েল পোড়ানোর কোন অর্থ নেই,’ বললেন জেনারেল। পুড়িয়ে দেয়া পপি খেতের মাটি স্পর্শ করল কপ্টার। র্যাক থেকে রাইফেল তুলে নিয়ে রানাকেও একটা নিতে ইঙ্গিত করলেন জেনারেল। রানা দেখে নিল তার রাইফেলের ম্যাগাজিন ভর্তি আছে কিনা।
‘আসুন,’ বলে কপ্টারের ডানদিকের দরজা দিয়ে লাফিয়ে নামলেন ভদ্রলোক।
রানা অনুসরণ করতে যাবে এমনিসময় গর্জে উঠল অটোমেটিক অস্ত্র। একাধিক। সাঁত করে রানা মাথা নামিয়ে পিছু হটতে এক ঝাঁক বুলেট কপ্টারের একটা পাশ চালুনি করে দিল। জেনারেল হাশমী টলে উঠে কপ্টারের মেঝের কিনারা খামচে ধরলেন। হাত বাড়িয়ে নিচ থেকে তাঁকে টেনে তুলল রানা খোলা দরজাটা দিয়ে।
রোটর চালু হতে কাঁপুনি উঠল কপ্টারে। আরও এক পশলা বুলেট আঘাত হানল। খোলা দরজা গলে একটা বুলেট কপ্টারে ঢুকতেই মুখে বাতাসের ঝাপটা অনুভব করল রানা।
‘জলদি উঠুন!’ চেঁচাল রানা, ইশারা করল পাইলটের উদ্দেশে।
বৃদ্ধি পেল এঞ্জিনের পাক খাওয়ার গতি, ফলে বাতাসে মাতাল নাচন তুলল কপ্টারটা। এবার রোটর ঘুরতে লাগল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। দ্রুত ওপরে উঠে বুলেটের আওতার বাইরে সরে এলো কপ্টার। জেনারেল হাশমীর পাশে হাঁটু মুড়ে বসল রানা।
‘ওদেরকে ইথিওপিয়া ছাড়া করবেন, আমার অনুরোধ…’ নিস্তেজ কণ্ঠে বললেন জেনারেল।
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন,’ আশ্বাস দিল রানা।
‘ওরা এখানকার লোক নয়, দেশদ্রোহী… ওদেরকে ছাড়বেন না…’
মুখে রক্ত তুলে মারা গেলেন জেনারেল।
রানা সামনে, পাইলটের কাছে গিয়ে মৃত্যুসংবাদটা জানাল।
‘ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাব আমি,’ বলল পাইলট।
‘না। আমাদের এখানে থাকতে হবে।’
‘জেনারেলকে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।’ বেল্টে গোঁজা পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল লোকটা।
পাইলটের চোয়ালের নিচ বরাবর ডান হাতটা ল্যান্ড করল রানার। সীট থেকে পাইলটকে টেনে সরিয়ে কপ্টারের দখল নিল রানা। কপ্টারটা আমেরিকান, অচেনা নয়। কাজেই বাংলাদেশীরা না পৌঁছনো অবধি চক্কর কাটতে বেগ পেতে হলো না ওকে। নিচে এক বিঘা জমিতে শুয়ে আছে বিশাল মিসাইলগুলো।
মিনিট খানেকের জন্যে কন্ট্রোল ছেড়ে পাইলটের .৪৫ বাজেয়াপ্ত করল রানা ওর হোলস্টার থেকে। নিশ্চিত হলো একটা কার্তুজ রয়েছে চেম্বারে এবং সেফটি অফ। এরপর আবার বড় করে পাক দিতে লাগল ও। নিচে থেকে লক্ষ করছে ওকে ডানাকিলরা। পুব দিকে উড়ে যাওয়ার সময় ছোট্ট ফোর্সটাকে স্পষ্ট দেখতে পেল রানা।
পাইলট নড়তে চড়তে আরম্ভ করেছে। চোখ মেলে একদৃষ্টে রানার দিকে চেয়ে। এবার ওঠার চেষ্টা করল।
‘নোড়ো না,’ বলল রানা, .৪৫ দোলাল হুমকির ভঙ্গিতে।
‘তুমি আমাকে আক্রমণ করেছ,’ বলল লোকটা।
‘আমার লোকেরা না আসা পর্যন্ত আকাশেই থাকছি আমরা,’ বলল রানা। ‘আমার কথা মত চক্কর দিলে মারটা খেতে হত না।’ ওর আনুগত্য উস্কে দিতে চাইল রানা। ‘আর জেনারেলের শেষ আদেশ ছিল ওঅরহেডগুলো ইথিওপিয়া থেকে দূর করা…পাহাড়ে
ফিরে গেলে কিভাবে করব কাজটা?’
হঠাৎ বায়ুতরঙ্গে আঘাত করল কপ্টার। নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে দু’হাত ব্যবহার করতে হলো রানাকে। কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে চকিতে চাইতে ও দেখতে পেল উঠে পড়েছে পাইলট। টলমল পায়ে রাইফেলের র্যাকটার উদ্দেশে চলেছে। কপ্টারটা লাফ-ঝা না করলে এতক্ষণে গুলি করে বসত রানাকে। রানা সযত্মে লক্ষ্যস্থির করে ওর হাঁটুর পেছনে গুলি করল।
পড়ে গেল না, টলে উঠল পাইলট। একপাশে আবারও কাত হয়ে গেল কপ্টার। জেনারেল হাশমীর লাশ ডিঙিয়ে, খোলা দরজা দিয়ে বাইরে উড়ে গেল পাইলট। রানা এমনটা আশা করেনি। লোকটার বেঁচে থাকা দরকার ছিল। সুপিরিয়রদের সে তাহলে বলতে পারত মিসাইলের মাঝে লুকানো ডানাকিলদের কথা। ইথিওপীয়রা এখন রানাকে দুষতে পারে জেনারেল হাশমীর মৃত্যুর জন্যে।
মাইক্রোফোন তুলে নিয়ে আগুয়ান বাংলাদেশীদের কল করল রানা। ‘সঙ্গে আর্মড লোকজন আছে তো?’
‘বারো জন,’ প্রত্যুত্তর এল।
‘যথেষ্ট নয়, কিন্তু ওদের দিয়েই কাজটা সারতে হবে,’ মিসাইলের পাহারাদারদের কথা জানাল রানা।
‘বারো জন মেরিন এরা,’ টাস্ক ফোর্সের নেতা বলল। ‘ওদের ক্যারি করা কপ্টারগুলো আগে নামাব আমরা। আর তিন মিনিটের মধ্যে দেখা পাবেন আমাদের।’
‘বেশ,’ বলল রানা। ‘আপনাদের আগেই নেমে যাব আমি।
এত অল্প লোক নিয়ে ডানাকিলদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে কিনা, এ ব্যাপারে চিন্তিত ও।
মেরিন দলটি পৌঁছানোর আগেই কপ্টার নামিয়ে আনল রানা। কৌশলটা ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু মিসাইলের একপাশে ল্যান্ড করে, ডানাকিলদের হতচকিত করে দেবে আশা করছে ও। মিসাইলের কারণে কপ্টারের গায়ে গুলি করতে দ্বিধা করবে লোকগুলো। মালদিনির আদেশ ছাড়া কাজটা করবে না। ও নিশ্চিত জানে মালদিনি আছে কাছেই কোথাও। উন্মুক্ত মরুর বুকে কপ্টার নামিয়ে, হতবিহ্বল স্থানীয় লোকগুলো গুলিচালনা আরম্ভ করতে পারার আগেই, লাফিয়ে কপ্টার থেকে নেমে গেল রানা। শরীর ভাঁজ করে সরে গেল কপ্টারের কাছ থেকে।
উত্তপ্ত বালি আগুন ধরাচ্ছে দেহে। গানফায়ার ওপেন হতে কপ্টারের গায়ে বুলেট আছড়াতে শুনল রানা। এরপর ঘটল বিস্ফোরণ; ফুয়েল ট্যাঙ্কে বুলেট সেঁধোতেই সর্বাঙ্গে ছ্যাঁকা খেল যেন ও। μল করার চিন্তা বাদ দিয়ে, রাইফেল বুকে চেপে ধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল রানা। যতটা পারে নুইয়ে রেখেছে শরীর।
অনুচ্চ এক ঢিবির পেছনে ডাইভ দিয়ে পড়ল ও। প্রায় একই সময়ে চারপাশ থেকে ছিটকে উঠল বালি; বাতাসে শিস কাটল বুলেট। রাইফেলটা স্থির করে, মাটিতে শরীর মিশিয়ে দিল ও। জনা বারো হবে, মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে বিস্ফারিত চোখে রানাকে লক্ষ করছে এক ডানাকিল গ্রুপ। মিসাইলের কাছাকাছি রয়েছে আরও দশ-বারো জনের মত। পাল্টা জবাব দিচ্ছে এখন রানা। রাইফেল খালি হলো দু’জনকে কাবু করে।
রাইফেলটা ব্যস্ত হাতে রিলোড করল রানা। কপ্টার থেকে নামার সময় রাইফেল র্যাক থেকে গুলির বাক্স নিয়ে এসেছে। রাইফেলটা দ্বিতীয়বারের মত অর্ধেকখানি খালি হয়ে এসেছে, আরেকজন ডানাকিল কুপোকাত, এমনি সময় কাছিয়ে আসতে লাগল রানার প্রতিপক্ষ। দেহ ভাঁজ করে খানিকদূর দৌড়ে এসে থামছে, একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় করে কভার দিচ্ছে। ঢিবির আরেকপাশে সরে গেল রানা। আরেক শত্রুকে হত্যা করে আবার
খালি হলো ম্যাগাজিন।
ক্রমেই কাছিয়ে আসছে ওরা, শীঘ্রিই অনিবার্যভাবে কেউ না কেউ হিট করবে রানাকে। অতি প্রিয় জানটা যাচ্ছে এবার, রানা যখন মেনে নিয়েছে, ঠিক তখুনি সকালের রোদ ফুঁড়ে বেরিয়ে এল বাংলাদেশী কপ্টারগুলো। গুলি চালাতে আরম্ভ করেছে মেরিন দল। পাঁচ মিনিটে শেষ হয়ে গেল যুদ্ধ। আর গুলি করার লোক খুঁজে পেল না রানা।
এক মেরিন সার্জেন্ট বালি মাড়িয়ে মন্থর পায়ে এগিয়ে এল, স্যালুট ঠুকে বলল, ‘আপনি নিশ্চয় মাসুদ সাহেব?’
‘আমিই সেই অধম, সার্জেন্ট,’ বলল রানা। ‘একদম কাঁটায় কাঁটায় পৌঁছেছেন। আর একটা মিনিট দেরি হলে আমাকে উদ্ধার করতে হত না।’
‘কারা ওরা?’
‘ডানাকিল। কখনও শুনেছেন ওদের কথা?’
‘জ্বী না, স্যার।’
‘ওরা দুনিয়ার দ্বিতীয় সেরা যোদ্ধা।’
মুখে হাসি ছড়াল সার্জেন্ট। ‘প্রথম কারা, স্যার?’
‘আমরা। বাংলাদেশের বাঙালীরা,’ নির্দ্বিধায় বলল রানা।
ভস্মীভূত কপ্টারটা আঙুল-ইশারায় দেখাল সার্জেন্ট। ‘আপনার সাথে কেউ ছিল নাকি, স্যার?’
‘ছিল একজন। কিন্তু মারা গেছে লোকটা। মিসাইল টেকনিশিয়ানদের কাজে লাগাতে কতক্ষণ লাগবে?’
এক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার বিভিনড়ব দেশের বিশজন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে এসেছেন। অগুনতি প্রশ্ন ছিল তাঁর, কিন্তু রানা সে সুযোগ দিল না তাঁকে।
‘সে লম্বা কাহিনী, কমান্ডার,’ বলল। ‘অত কথায় কাজ নেই। এ জায়গাটা ভাল নয়। বিদেশী লোক পেলেই খুনের নেশা চাপে এখানকার বাসিন্দাদের।’
পরিস্থিতি দ্রুত অনুধাবন করলেন কমান্ডার। মিসাইল থেকে ওঅরহেড খসাতে তখুনি লেগে পড়ল লোকেরা। গোটা পাঁচেক ওঅরহেড খুলে কপ্টারে তুলেছে এসময় পুব দিক থেকে গোলাগুলির শব্দ ভেসে এল। নৌবাহিনী অ্যাকশনে নেমে পড়ল কালবিলম্ব না করে, ওদিকে রানা মিসাইলের ছায়া ছেড়ে, সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে লুগার বের করল। আরও শব্দ হয় কিনা সেজন্যে অপেক্ষা করল ও, কিন্তু হলো না। হঠাৎ এক নৌসেনাকে দৌড়ে
আসতে দেখা গেল।
‘মাসুদ সাহেব,’ বলল। হাঁফাচ্ছে। ‘জলদি আসুন। এক পাগল মিসাইলগুলো ফাটাতে চাইছে।’
রানা শশব্যস্তে ছুটল ওর পিছু পিছু। ছোট এক ঢিবিতে চড়তে দেখা গেল, মোটা মত এক শ্বেতাঙ্গের হাতে একটা বাক্স। সোভিয়েতে তৈরি, মিশরের চুরি যাওয়া এক মিসাইলের পাশে দাঁড়িয়ে লোকটা। নির্ভুল প্রমাণিত হলো মাসুদ রানার অনুমান: রবার্তো মালদিনি ইথিওপিয়ারই কোথাও না কোথাও আছে।
মালদিনির পঞ্চাশ ফিটের মধ্যে দাঁড়িয়ে রানা, সহজেই লুগার ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, গুলি করার ঝুঁকিটা নিতে পারল না ও। মালদিনির হাতের বাক্সটা, এবং ওঅরহেডে জোড়া তারগুলো দেখার পর পারার কথাও নয়। অবিশ্বাস্য রকমের সাধারণ এক অস্ত্র। মালদিনি এখন কেবল একটা বোতাম কিংবা সুইচ টিপলেই হয়, ডানাকিলে ইতিহাসের বৃহত্তম ও ভয়ঙ্করতম আণবিক বিস্ফোরণ ঘটে যাবে।
‘ওটা হাত থেকে ফেলে দাও, রানা!’ চেঁচিয়ে বলল মালদিনি।
বালিতে উড়ে গিয়ে পড়ল রানার লুগার। সেই মুহূর্তে দুটো কাজ করতে চাইল রানা। একটা হচ্ছে মালদিনিকে খুন করা। দ্বিতীয়টা, লেফটেন্যান্ট কমান্ডারকে চিবিয়ে খাওয়া। লোকটা রানার কাছে দূত না পাঠালে, গোপনে মালদিনিকে আক্রমণ করার একটা সুযোগ পেত ও।
মালদিনি আদেশ দিল, ‘নাও, আমার দিকে আস্তে আস্তে হাঁটা ধরো।’
স্টিলেটোর কথা কি জানে না লোকটা? সম্ভবত জানে না, মনে মনে বলল রানা। স্টিলেটোর কার্যকারিতা দেখার সৌভাগ্য তো হয়নি মালদিনির অথবা তার লোকেদের।
একটা মওকা জুটে গেছে যা হোক। কিন্তু ফায়দাটা লুটবে কি করে রানা? মালদিনি ডান তর্জনী রেখেছে একটা টগ্ল্ সুইচের ওপর। রানা এতটাই কাছে, কটা তার আছে গুণতে পারল। দুটো তার ওই কালো বাক্সটা থেকে মিসাইলের মাথায় গেছে, ওটা মালদিনির ডান পাশে পেছন দিকে বিস্তার পেয়েছে-রানার বাঁয়ে-সাইন্স ফিকশন ছবির সরীসৃপের মত রোদ পোহাচ্ছে। কতখানি কাছে এগোতে দেবে ওকে মালদিনি অঙ্ক কষছে রানা।
‘ওখানে দাঁড়াও, রানা,’ বলে উঠল লোকটা।
দশ ফিট। থেমে পড়েছে রানা। দুপুর উতরেছে সবে, ভারী জুতো-মোজা মানছে না তপ্ত বালি, সোল ভেদ করে পুড়িয়ে দিচ্ছে ওর পায়ের পাতা।
‘এবার এই যে, তোমরা…!’ চিৎকার থামিয়ে রানার দিকে কটমট করে চাইল মালদিনি। ‘রানা, ডান দিকে সাবধানে দু’পা সরো।’
আদেশ পালন করল রানা। নৌবাহিনীর সদস্যদের এখন আর দেখতে বাধা নেই মালদিনির। ওদের মধ্যে কারও এখন বীরত্ব চেগিয়ে না উঠলেই বাঁচি, আত্মগতভাবে বলল রানা। মালদিনিকে পেড়ে ফেলতে পারবে ওরা অব্যর্থ লক্ষ্যে, কিন্তু লোকটার আঙুলের ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত ক্ষীণতম টোকায় নেমে আসবে কেয়ামত।
‘যাওয়ার জন্যে তৈরি হও!’ বলল মালদিনি ওদের উদ্দেশে। ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে কপ্টার যেন আকাশে ওড়ে।’
আস্ত পাগল লোকটা, আর কোন সন্দেহ রইল না রানার। ওঅরহেডে সংযুক্ত ডিটোনেটর ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র নেই মালদিনির কাছে। রানাকে আটক করার কোন সুযোগই তার নেই। মিসাইল ফাটিয়েই কেবল রানাকে ও নিজেকে সে খুন করতে পারবে। লোকটা তার ভয়ঙ্কর, রেডিও অ্যাকটিভ আত্মহত্যার সাথী হওয়ার জন্যেই বুঝি ডেকে পাঠিয়েছে রানাকে।
কিন্তু বিকল্প সুযোগের যে কমতি রয়েছে তা কি বুঝতে পারছে পাগলটা? দরদর করে ঘাম গড়াচ্ছে রানার সর্বাঙ্গে। তিন মিনিট, বড়জোর চার মিনিট পাবে রানা উন্মাদ লোকটার মনের মধ্যে প্রবেশ করার জন্যে, তার পরিকল্পনা আবিষ্কার করে, ব্যর্থ করে দিতে। কালান্তক ওই কালো বাক্সটা হাত থেকে ফেলে দেয়ার আগেই কিছু একটা করতে হবে রানাকে। এক্ষুণি।
‘আমাদের জ্বালাতন না করে যুদ্ধের জন্যে অন্য কোন দিন বেছে নাও। সরকারের ভেতর তোমার বন্ধুরা তো রয়েছেই,’ কথার পিঠে কথা বলার সুরে বলল রানা।‘ডানাকিলদের মধ্যে তোমার ভাল প্রভাব আছে একথা সত্যি।’
রানা চাইছে না সহসা বাস্তবে ফিরে আসুক মালদিনি। আজকের যুদ্ধে ডানাকিলরা পরাজিত হবে কল্পনাও করেনি লোকটা। ভেবেছিল জেনারেল হাশমীর কপ্টার অ্যামবুশ করে, তারপর ন্যাভাল টাস্ক ফোর্স ল্যান্ড করতে না করতেই তাদের নিশ্চিম করে দেবে। কিন্তু অত্যুৎসাহী এক ডানাকিল হাশমীকে দেখামাত্র গুলি করে বসে। এখন আর মালদিনির পিছু হটার রাস্তা নেই। ব্যাপারটা বুঝলেই সেরেছে, সুইচ টিপে, ইলেকট্রিক্যাল কারেন্ট তারের মাধ্যমে চালান করে দেবে ওঅরহেডের ওই টার্মিনালগুলোয়।
তার? রানা ত্বরিত পরখ করে নিল ওগুলো। ওর জীবন বাঁচাবে এগুলো, আশা করছে রানা। প্রত্যেকটা তার মিশেছে গিয়ে ছোট ছোট মেটাল ক্লিপে, টার্মিনালের স্ক্রু হেডের নিচ দিয়ে স্লাইড করা হয় যেগুলোকে। হেডের কাছে সব কটাকে জড়িয়ে দিয়েছে মালদিনি। সন্দেহ না জাগিয়ে যতখানি সম্ভব কাছ থেকে নিরীখ করে নিল রানা। একটা, টপ টার্মিনালটার সঙ্গে সংযুক্ত, ক্লিপের মাত্র দুটো পয়েন্টের সঙ্গে কন্ট্যাক্ট পাচ্ছে। একটু জোরে টান দিতে পারলে তার সার্কিট ব্রেক করবে এবং ডিটোনেশন হয়ে পড়বে অসম্ভব। এখন রানার কাজ হচ্ছে, লোকটা সুইচ টিপে দেয়ার আগেই যাতে থাবা মারতে পারে ওটায়, এমনি অবস্থান নেয়া।
এক পা আগে বাড়ল ও।
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও!’ চেঁচাল মালদিনি।
টাস্ক ফোর্স টেক অফের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে, কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে কপ্টারগুলোর এঞ্জিন।
‘দুঃখিত,’ মৃদু স্বরে বলল রানা। ‘পায়ে খিল ধরে গেছে আমার। ওই ইথিওপিয়ান কপ্টারটায় এত বেশি যন্ত্রপাতি ছিল, পা ছড়িয়ে বসার জো ছিল না।’
‘পিছিয়ে যাও।’
বাঁয়ে, পেছনে সরে গেল রানা, চাইলেই এখন ওঅরহেড স্পর্শ করতে পারবে। বিদায়ী প্রতিপক্ষ ও রানাকে একই সঙ্গে লক্ষ করতে হলে মালদিনিকে সরে যেতে হত মিসাইলের কাছ থেকে। কিন্তু সরেনি সে। তারমানে ইলেকট্রিকাল কানেকশন যে ঢিলে, নিজেও জানে। অবশ্য জানলেও কিছু করতে পারবে কিনা সন্দেহ।
এমুহূর্তে কপ্টারের শোরগোল ছাপিয়ে চেঁচিয়ে উঠল রানা। ‘জুলেখার কথা মনে আছে, মালদিনি?’
‘ওকে ফেরত পাব,’ বড়াই করে বলল লোকটা। ‘ওকে ওরা আমার কাছে পাঠাবে আর নয়তো পৃথিবীর ম্যাপ থেকে মুছে দিয়ে যাব এদেশের নাম।’
‘একবার পাখি খাঁচাছাড়া হয়েছে আর কি ফেরত আসবে?’ উস্কে দিল ওকে রানা। ‘তাছাড়া তোমার মত একটা বদ্ধ পাগলের কাছে আসতে যাবেই বা কেন?’
রানার মুখে পাগল শুনে মাথায় রক্ত চড়ে গেল লোকটার। কয়েক পা এগিয়ে এল সে রানার উদ্দেশে, ডান হাতে আলগা হয়ে ঝুলছে কালো ডিটোনেটর বক্সটা, টগ্ল্ সুইচের সিকি ইঞ্চি দূরে ওর আঙুল। আরেকটু কাছে এলে সুবিধে হত, কিন্তু কি আর করা।
সামনে ঝাঁপ দিল রানা।
আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে বাঁ হাত উঠে গেল লোকটার। যখন বুঝল রানার লক্ষ্য সে নয়, তার, তখন আর কিছু করার নেই। তারে উড়ে গিয়ে পড়েছে রানার দেহ। বাতাস হাতড়ানো হাত দুটো ওর খুঁজে পেয়েছে ওগুলো। গড়ান দিয়েই সটান দাঁড়িয়ে গেল রানা। সবচেয়ে ওপরের ওয়্যারটা, রানা যেটাকে দুর্বলতম ধারণা করেছে, এক হ্যাঁচকা টানে উঠে এল ওঅরহেডের টার্মিনাল থেকে।
মালদিনি পেছন থেকে মুখ খারাপ করছে শুনতে পাচ্ছে রানা। ঘুরে দাঁড়াতে, টগ্ল্ সুইচটাকে বৃ া আগু-পিছু করতে দেখল সে লোকটাকে। জুড়ে থাকা একমাত্র তারটা সর্বশক্তিতে টান মারল রানা। ওটাও খুলে এল ওঅরহেড থেকে। মালদিনির হাতের ডিটোনেটরটা এখন আর কিছুর সঙ্গেই না, কেবল ডানাকিল মরুভূমির বালির বুকে সংস্পর্শ পাচ্ছে।
উড়াল দিয়েছে কপ্টারগুলো। রানা আশা করছে অনেকেই ওপর থেকে দেখতে পাবে ওকে, এবং নেমে আসবে কপ্টার। সুইচ অ্যাকটিভেট করার চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়ে হিংস্র চোখে রানার দিকে চেয়ে রয়েছে মালদিনি।
‘শুয়োরের বাচ্চা!’ রাগে ফেটে পড়ল লোকটা। রানা ঈষৎ ঝুঁকে এগিয়ে গেল ওর দিকে। মালদিনি অকেজো ডিটোনেটরটা ছুঁড়ে মারল রানাকে লক্ষ্য করে। মাথা নোয়াল রানা। মালদিনি সেই সুযোগে নরম, অস্থির বালির ওপর দিয়ে ছুটতে শুরু করল। কিন্তু পালিয়ে যাবেটা কোথায়? রানার শরীরটা ডাইভ দিয়ে গিয়ে পড়ল লোকটার পিঠের ওপর।
‘বাপ রে!’ অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল মালদিনি। ঘাড়ে মোক্ষম এক রদ্দা কষে ওকে অজ্ঞান করে দিল রানা।
মাথার ওপর গোঁ-গোঁ করছে হেলিকপ্টার।
কপ্টারে তোলা হচ্ছে ওঅরহেডের যন্ত্রাংশ। অচেতন মালদিনিকেও তোলা হয়েছে। সুপ্রাচীন, ভূপাতিত গাছের মত মরুর কোলে পড়ে রয়েছে মিসাইলগুলো। তাজা থাকবে বহুদিন, কেউ খুঁজে পাক বা না পাক।
‘মাসুদ সাহেব,’ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার খন্দকার বোরহান বললেন, ‘কে এই মালদিনি?’
‘প্রতিভাবান এক উন্মাদ। ও পূর্ব আফ্রিকার সম্রাট হয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধাতে চেয়েছিল। ওই ওঅরহেডগুলো কায়রো, দামেস্ক আর তেল আবিবে টার্গেট করেছিল।

‘উন্মাদ কোন সন্দেহ নেই। আমাদের সবাইকে ছিন্নভিন্ন করে দিতেও বুক কাঁপত না ওর। একটা ওঅরহেডই যথেষ্ট ছিল এজন্যে, কিন্তু চেইন রিয়্যাকশন রেডিও অ্যাকটিভ ফলআউট ঢেকে দিত দুনিয়ার এ অংশটুকু।’
রেড সি-র মাঝামাঝি পৌঁছেছে কপ্টার।

মরুভূমিতে চোখ রাখল রানা, গোধূলীলগেড়ব ধু-ধু বালির প্রান্তর অস্পষ্ট হয়ে এসেছে প্রায়। ডানাকিলদের উটের কাফেলা, মরুর বুকে পথ করে নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে এগিয়ে চলেছে, দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেল রানা। এবার হঠাৎ জুলেখার কথা মনে পড়ল ওর। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মাসুদ রানার বুকের ভিতর থেকে।

 

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত