অবস্থাটা এমন দাঁড়ালো নতুন নোট সংগ্রহ করাটা প্রায় আমার নেশাই হয়ে গেল। ব্যাংক থেকে আমি এক বান্ডিল নতুন নোট নেই, তারপর সিরিয়াল অনুযায়ী প্রতিটা নোটে ছোট করে এক লাইন বা ছোট দুই লাইন করে করে একটা ছোট গল্প লিখি।
এরমাঝে প্রয়োজন হলে ওই নোটগুলো দিয়ে কেনাকাটাও করি।
যে কোন একটা গল্প পড়তে হলে আপনাকে অবশ্যই ওই বান্ডিলের সবগুলো নোট সংগ্রহ করতে হবে।
যেটা বাস্তবে কখনোই সম্ভব নয়। আর তাই পুরো গল্পটা কি এবং তার লেখক কে? এটা আপনার অজানা রয়েই যাবে।
তারপরো ভাবলাম, একটা গল্প আপনাদের সাথে বলা যেতেই পারে। সে জন্যেই লিখতে বসা।
হয়ত পেছনে কোন উদ্দেশ্যও আছে।
আমি সিরিয়াসলি শয়তানের উপাসনা শুরু করি, এই কারণে যে, ঈশ্বর আমাদের সাথে সরাসরি কথা বলেন না, যোগাযোগ করেন না, কিন্তু শয়তান করে।
আমি ডাকলে সে আমার ডাকে সাড়া দেয়। এর জন্যে তেমন কিছু করতে হয় না, যেমনটা আপনারা গল্পে পড়েন, তাঁকে ডাকার তেমন কোন নিয়মও নেই। আপনি মনে প্রাণে চাইলেই উনি আপনার সাথে কথা যোগাযোগ করবে।
প্রভু যখন বুঝতে পারলেন আমি উনাকে মনে প্রাণে চাই তখন তিনি খুব সহজ একটা শর্ত দিলেন আমাকে, সবচাইতে বড় পাপ করে দেখাতে হবে।
আমি ভেবে ভেবে বের করলাম সবচাইতে বড় পাপ কি?
মানুষ খুন করা? নিজের স্বামী/ স্ত্রীর সাথে বিশ্বাস ঘাতকথা করা?
আরে নাহ! আত্মহত্যা করা।
এরপর নিজেকে খুন করলাম। বিষ খেয়ে? নাহ!
ট্রেন লাইনে কাটা পড়ে। বুঝলামই না কখন টুকরো টুকরো হয়ে গেলাম।
যখন হুঁশ ফিরে এলো, দেখি আমি বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে মর্গে পড়ে আছি, গভীর রাত। সুযোগ বুঝে উঠে পালিয়ে গেলাম।
ঘরে ফিরে বুক ধক করে উঠলো; আমার চেহারা পাল্টে গিয়েছে।
ওহ! ভুল বললাম! প্রভু অন্যের মৃত দেহে আমাকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
চমৎকার!
একজীবনে শত জীবনের অভিজ্ঞতা।
এরপর থেকে রোজ নিয়মিত আমি ট্রেনে কাটা পড়তে লাগলাম, যখনই মনে হতো এই দেহ আর ভালো লাগছে না। সোজা গিয়ে শুয়ে পড়তাম ট্রেনের নিচে। ব্যাস! অন্য বেওয়ারিস লাশের দেহে ভর করতাম জিন্দা আমি।
একটু খেঁটেখুটে বের করে ফেলতাম বেওয়ারিশ মানুষটার পরিচয়। এরপর তার ঘরে গিয়ে তার মতো করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতাম, সংসার করতাম, বাচ্চা মানুষ করতাম।তারপর বোর হয়ে গেলে, দেহ পালটে ফেলতাম।কখনো কখনো খুব কষ্ট হতো।
এবারো যেমন হয়েছিলো; এই ভদ্রলোক সদ্য বিবাহিত ছিলেন, একটা তিন মাস বয়সী কন্যা সন্তান আছে, কুসুম কুসুম প্রেমের সংসার! ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না।
বৌ টার মাথার সিঁদুর মুছে ফেলার মুহুর্তে আমি এর শরীরে ঢুকি। পতি দেবতার জ্ঞান ফিরতে দেখে মেয়েটা মূর্ছা যায়, আমার বুকের উপর।
প্রতিরাতে মেয়েটাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে তার চুলের ঘ্রানে আমার নেশা নেশা লাগে। সকালে বউ এর স্নিগ্ধ চেহারা দেখে বুকের মাঝে খালি খালি লাগে, বাচ্চাটাকে পালতে গিয়ে সংসারের নেশায় ধরে গেল।
পাখি সবে দৌড়াতে শিখেছে। বাবা বলে ডাকে। ঘরে ফিরলে লাফিয়ে বুকে এসে পড়ে।
এই চরিত্রে আমি লেখক, যদি গত দু বছর কিছুই লিখি নাই, আর প্রতিমা ইউনিভার্সিটির শিক্ষিকা। প্রেমের বিয়ে এত মধুর হয়!?
ওর হাসি শুনলে আমার মাথা ঝিমঝিম করে। একটু ছুঁয়ে দেয়ার আশায়!
একদিন খুব আবেগী মুহুর্তে প্রতিমা একটু অভিমান নিয়েই বলে ফেলেছিলো, খুব তো চেয়েছিলে আমাদেরকে ছেড়ে চলে যেতে।
এরপরই সে সামনে নিলো।
আমিও ঘাটাইনা, তেমন কারো সাথে কথাও বলি না, কোথাও যাই না, লেখক মানুষ হওয়াতে চুপচাপ থেকে সব সামাল দেয়া যায়।
পেছনের ঘটনাতো আমি কিছুই জানি না। দরকারও নেই জানার।
তবে এবার কেন যেন খুব খারাপ লাগছে। এত সুন্দর পরিবার!
প্রায় ৬৬৬ দিন হয়ে গিয়েছে, আর সময় নেই। যদি নিজ থেকে আমি আত্মবলী না দেই তবে, এর ফল হয়ত ভোগ করতে হবে এদেরকে।
আমি না থাকলেও তো করতে হবে তাই না? এই সমাজে বাবা – স্বামী ছাড়া বেঁচে থাকা বড় কষ্টের।
এর চাইতেও বড় সমস্যা হল, নতুন জীবন পাওয়ার পর পুরানো জীবনের কোন কথাই আমার ঠিক মত মনে থাকে না। অনেকটা লুসিড ড্রিমের মতো। একটার সাথে অন্যটা গুলিয়ে যায়।
হয়ত এদের কথা মনে থাকবে, ঠিকানা মনে থাকবে না, ঠিকানা মনে থাকলে এখানে কে কে ছিলো, তার সাথে আমার সম্পর্ক কি ছিলো সেটা মনে থাকবে না। পাখি বড় হয়ে যাবে, বিয়ে হয়ে যাবে, বাবাকে ছাড়া!
আচ্ছা! এদের জন্য আমার এত মায়া কেন?
আমার আসলে এখন এটাও মনে নেই আমি কে ছিলাম?
কি করতাম? কেন আত্মহত্যা করেছিলাম আসলেই? শয়তানকে প্রভু বানানোর জন্যেই কি? কনফিউজড!
অনেক অনেক সময় চিন্তা করে আমি শুধু এতটুকু মনে করতে পেরেছি। কোন এক জীবনে আমি কাগজের নোটে খুব গুরুত্বপুর্ণ কিছু লিখছিলাম, লুকিয়ে লুকিয়ে।
সাংকেতিক কোন অর্থ ছিলো ওই লেখা গুলোর।
আমি কাগজের নোটগুলো খুঁজছি, সেই থেকে, প্রতি জনমে।
গল্পটা খুঁজছি। কেন যেন মনে হচ্ছে, আমার জীবনের সাথে ওই নোটের গল্পের কোন সম্পর্ক আছে।
প্রতিমার মাথা থেকে সিঁদুর মুছে ফেলার দৃশ্য আমি অন্য কোন পাশ থেকে দাঁড়িয়ে কি দেখেছি কখনো?
প্রতিমা কে?
আমি কোথায়?
টাকার নোটগুলো কই?
আমি কেন টাকার নোটে কিছু লিখছিলাম?
এখন কখন?
দেবতার উপাসনা কি আমি সত্যিই করতাম?
সবচাইতে বড় পাপ কি?
দেবতার নির্দেশ মেনে পাপটা কি ঠিক মত করতে পারিনি?
আত্মহত্যা? অন্যকে খুন করা? নাকি নিজের জীবন সঙ্গীর সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করা?
প্রভুর দেখা পাওয়ার জন্য আমি কি আবার চেষ্টা করবো, অন্য কোন পাপ করে?
দেবতার উপাসক কি শুধুই আমি? আমার স্ত্রী প্রতীমা কার উপাসক?
সে কি ধরণের পাপ করে?
পাপ কি?
হাতে টাকার নোট গুলো নিয়ে ভাবছি,
নিস্তব্ধ রাত,
কাছেই কোথাও একটা চায়ের দোকানে রেডিও বাজছে।
ভাবছিলাম, কি লিখতাম আমি নোটগুলোতে?
কোন ভাবেই মনে করতে পারছি না।
একটু লজিক্যালি ভাবি।
আমি লেখক। অন্তত এই জনমে, ঠিক?
হ্যাঁ!
আমি কি ধরণের গল্প বা উপন্যাস লিখি?
ফ্যান্টাসি।
আমার কোন প্রকাশিত বই নেই। প্রচুর পান্ডুলিপি আছে। সারি সারি সাঁজানো। কিছু পোকা খেয়ে ফেলেছে। আমি প্রতিদিন যত্ন করে পান্ডুলিপিগুলো পরিষ্কার করি। বাজার করি, টুকিটাকি সাংসারিক কাজ করি। পাখির সাথে সময় কাটাই।
আমি সুখী?
হুম্মম্মম্মম্মম, সুখ কি?
আমার কিসের অভাব?
হাতের সামনে এক বান্ডিল টাকা। টাকা গুলো কার?
আমার তো না! প্রতীমার?
হ্যাঁ! ওর হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, একমাত্র ও ই চাকরী করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও!
টাকাগুলো যদি প্রতিমার হয়, তাহলে আমি কেন এগুলো লুকিয়ে রেখেছিলাম?
আচ্ছা! প্রতিমাকে নিয়ে চিন্তা করা যাক। আমার জীবনে প্রতিমার অবস্থান কোথায়?
প্রতিমা ওর শিক্ষকতা নিয়ে ব্যস্ত। সকালে বের হয়। সন্ধ্যা করে ঘরে ফেরে। অনেক ক্লান্ত থাকে। আমার সাথে টুকিটাকি কথা বলে। রাতে পাশের ঘরে ঘুমায়। আমি এই ঘরে।
প্রতিমার চশমার আড়ালে খুব শান্ত, স্নিগ্ধ দুটো চোখ আছে। যে কোন পুরুষ ওই চাহনীর প্রেমে পড়বে।
আমি কেন পড়িনা? আমরা কেন আলাদা ঘুমাই?
বড় অস্থির লাগছে! আমি এভাবে ভাবছি কেন? এভাবে ভাবলে আমার প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা শুরু হয়। চোখ মেলে রাখতে পারি না।
কিন্তু আমি প্রতিমার সাথে কেন থাকি না? এক ঘরে থাকার পরেও?
আজ প্রতিমা ঘরে ফিরেছে কখন? আমি কখন থেকে এখানে বসে আছি?
জানি না।
সেদিন কে যেন প্রতিমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল, কে সে?
আমি লোকটাকে চিনি মনে হচ্ছিলো।
আচ্ছা লোকটা বাসায় আসে নি কেন? চোরের মতো গেইটের বাইরে থেকেই চলে গেল। যাওয়ার সময় কি সে প্রতিমার হাত ধরেছিলো একটু করে?
যাহ! যতসব উল্টো পাল্টা চিন্তা।
আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আর ভাবতে পারছি না।
আমি ওকে চিনি! ও আজাদ! শামস আজাদ। প্রতিমার ক্লাসমেট, দু জনই ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলো। একই সাথে পাশ করে, একই বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছে।
আমি কে?
আমি… আমি শ্রী নাথ! শ্রী ভুবন নাথ।
আমিও ওদের সাথেই পড়তাম সাহিত্যে! আমায় কবি বলে ক্ষেপাতো সবাই, শুধু প্রতিমা ছাড়া! আমি থার্ড ইয়ারে এসে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলাম। সাহিত্যে পড়ে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। আমায় আগলে রেখেছিল প্রতীমা! এক প্রকার যুদ্ধ করে আমাকে বিয়ে করেছিলো!
তারপর?
সব ঠিকঠাকই ছিলো।
এতটা সময় একসাথে কাটালে একটু আকটু বন্ধুত্ব হতেই পারে আজাদের সাথে। দোষের কিছু না!
কিন্তু, প্রতিমা বদলে যেতে থাকলো। আজাদের আনা গোনা বেড়েগেল আমাদের ঘরে।
একদিন আমি লেখায় ডুবে ছিলাম। বসার ঘরেই ছিলো ওরা!
প্রতিমার হাসির শব্দ শুনলাম আমি।
তারপর… তারপর?
পা টিপে টিপে বসার ঘরে গেলাম আমি…
ওহ!
এটা তো গল্প?! আমার কোন সহস্র জীবনের, কোন এক জীবনের। আমি এত কস্ট পাচ্ছি কেন?
পাখি কার সন্তান? প্রতিমা কার?
একদিন সন্ধ্যার আড্ডায় প্রতিমা হাসতে হাসতেই আজাদকে বলেছিলো, আমার পান্ডুলিপিগুলোর একটা গতি করতে।
পরদিনই আজাদ প্রতিমার অনুপস্থিতিতে, এক বান্ডিল কচকচে নোটের একটা প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে হেসে হেসে কি যেন বলেছিলো! আমার পাণ্ডুলিপি নিয়ে? নাকি প্রতিমাকে নিয়ে?
প্রতিমা আমার বউ! আমার!
আজাদ কে?
পাখি কার সন্তান?
আমার পাণ্ডুলিপি আমি দরকার হলে সব জ্বালিয়ে দিবো।
আজাদ কে?
প্রতিমা আজাদকে কেন বলবে আমার একটা গতি করে দিতে ?!
আমি ঈশ্বরকে বললাম অনেক। তিনি শুনলেন না।
আমি প্রতীমাকে বললাম, নিষেধ করলাম। প্রতিমা শুনলো না।
আমাকে ছোটলোক বললো। উপদেশ দিলো, লেখকদের মন এত ছোট হতে নেই।
আমি শয়তানের উপাসনা শুরু করলাম। প্রভু আমার কথা শুনলেন।
শর্ত দিলেন পাপ করতে হবে! সবচাইতে বড় পাপ!
আচ্ছা! সবচাইতে বড় পাপ কি?
আত্মহত্যা? অন্যকে খুন করা? নাকি নিজের জীবন সঙ্গীর সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করা?
দেবতার উপাসক কি শুধুই আমি?
তবে, আমার স্ত্রী প্রতীমা কার উপাসক?
সে কি ধরণের পাপ করে?
পাপ কি?
আমি কে?
টাকার নোট গুলোয় কি লিখেছিলাম আমি?
আচ্ছ! এই জীবনটা নিয়ে এত ভাবছি কেন আমি? শেষ করে দিলেই তো হয়।
দিবো?!
এখন কখন?
আমি পাপ করতে পেরেছিলাম?
প্রভু কি আমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছিলেন?