রক্তমুখী ড্রাগন

রক্তমুখী ড্রাগন

কয়েক মূহুর্ত আগেও বুঝতে পারিনি এত বড় একটা দুঃসংবাদ আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। কিছু বুঝবার ক্ষমতাই ছিল না ঘন্টাখানেক। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সমস্ত ঘটনা যখন শুনলাম তখন রাত অনেক হয়ে গেছে, কৃষ্ণনগর থেকে ফেরার কোনও উপায় তখন আর নেই। ভুলটা আসলে আমিই করেছিলাম। সন্ধের গাড়িতে যখন যাচ্ছি, একটা ফোন করে গেলেই সবচেয়ে ভাল হত। গত সপ্তাহেও তো ফোনে কতক্ষণ কথা হল। বাড়ি আসাটা বরং দারুণ একটা সারপ্রাইজ হবে ভেবে আনন্দে তো লাফাতে লাফাতেই এসেছি সারাটা রাস্তা। সেইজন্যেই বোধহয় এরকম একটা মর্মান্তিক আঘাত আমায় পেতে হল। বনজিতের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়িটা অবশ্য ধরতে গেলে এই

বছরখানেকের কিছু বেশি। এম.এস.সি পাশ করার পর একসঙ্গেই নেট পরীক্ষা দিয়েছিলাম দুজনে। আমার চাকরিটাই দরকার ছিল, সেটাই নিয়ে নিলাম, বনজিত নিল জে.আর.এফ অর্থাৎ গবেষণার কাজ। আমি পড়াতে যাই বেহালা পেরিয়ে সেই ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুর, বনজিত পড়ে থাকে কল্যাণীতে, সোম থেকে শুক্র একই রুটিন। তাই ইচ্ছে থাকলেও দেখা করার উপায় নেই। ঠিক এরকম না হলেও ছাড়াছাড়ি খানিকটা হয়েছিল আমাদের এম.এস.সি পড়ার সময়েই। কারণ বনজিত পড়ত বায়ো সায়েন্স নিয়ে, আর আমি পড়তাম পিওর সায়েন্স নিয়ে। তার আগে স্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়েছি।

বনজিতের বাড়িতে আমি কতবার গিয়েছিলাম তার ঠিক নেই।

আজও সেই বাড়িতেই আছি আমি, বনজিতেরই দোতলার ঘরখানায়, যেখানে দুজনে শুয়ে কয়েকবার কত রাত পর্যন্ত গল্প করেছি। কিন্তু আজ…

ভাবতে পারছিলাম না আমি, মাথার শিরাগুলো দপদপ করছিল। গত মঙ্গলবারেও যার সঙ্গে কথা হয়েছে ফোনে, আজ শনিবার এসে শুনি, সে এই পৃথিবীতেই নেই, বিশ্বাস করতেও সময় লাগে বৈকি। কিন্তু এটাই হয়েছে… অত্যন্ত জ্বর নিয়ে ফিরেছিল বুধবার, বৃহস্পতিবার অবস্থা খারাপ হওয়াতে ভর্তি করা হয়েছিল সদর হাসপাতালে। মাঝরাত পর্যন্ত মৃত্যুর সঙ্গে যুঝেছিল বনজিত, তারপরই হঠাৎ হার্টফেল করে… বাড়ির লোকজন মুহ্যমান তো বটেই, ডাক্তাররা পর্যন্ত হতবাক। জ্বর কমাবার হাজারটা ওষুধ আছে কিন্তু একটা ওষুধেও কাজ হয় নি। সবচেয়ে আক্ষেপ তাঁদের, ঠিক কি জন্য এতটা বাড়াবাড়ি হল তার, সেটাই তাঁরা বুঝে উঠতে পারেন নি, রক্ত পরীক্ষা করে তার রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্তও সময় পাওয়া গেল না। কেউ জানেন না, অসুখটা কি, কিন্তু আমিও কি জানি না সেটা, সত্যিই জানি না কি! কথাটা মনে হতেই সারা শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল।

কিন্তু না, সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেই নিজে একটা ধমক দিলাম। যে জিনিস আমি একফোঁটাও বিশ্বাস করি না, এরকম একটা ব্যাপারের কাছে দুর্বল হয়ে পড়াটা একেবারেই ঠিক নয়। কবে একদিন একটা অশিক্ষিত তিব্বতি বুড়ো কি বলেছিল, সেটাকেই যদি আজ সত্যি বলে ধরে নিই তাহলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে লাভ কি আমার! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আমার ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, জিনিসটা কিন্তু এখনও তোমার ব্যাগের ভেতরেই আছে, বেশ বহাল তবিয়তেই আছে।

হ্যাঁ, আছে, আমি জানি। বনজিতের কথাটা শোনামাত্র মূহুর্তের দুর্বলতায় মনে হয়েছিল এক্ষুনি ব্যাগ থেকে জিনিসটা বের করে ছুটে গিয়ে বাইরে ফেলে আসি। কিন্তু সে সময় পাইনি। রাত অনেকটাই হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য আর একটা কারণেও ফেলিনি, কুসংস্কারের কাছে মাথা নোয়াবো না বলে। জিনিসটা আমার চোখের সামনে ভাসছিল, সেইসঙ্গে এম.এস.সি’র সেমিস্টার পরীক্ষা দিয়ে আমার আর বনজিতের দার্জিলিং বেড়াতে যাবার দিনগুলোও।

ম্যালে ঘুরতে ঘুরতে কি খেয়াল হয়েছিল নীচে বহুদূরে লেবং রেসকোর্সকে একটা বালার মতো লাগছিল..সেটা লক্ষ্য রেখেই অসমতল পাথরের চাঁই বেয়ে নামতে শুরু করেছিলাম আমি আর বনজিত। কেমন যেন ট্রেকিংয়ের স্বাদ পাচ্ছিলাম। জোয়ান বয়সের দুটো ছেলে, ঘন্টাখানেকের মধ্যেই দার্জিলিঙের এই ঠাণ্ডাতেও সমস্ত শরীর ঘামে জবজবে হয়ে উঠেছিল। সোয়েটার খুলে ফেলেছিলাম, জামা খুলে ফেলতে পারলেও ভাল লাগত কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না। একটু বিশ্রাম নেবার জন্য যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটা ছিল তিব্বতি রিফিউজি ক্যাম্প। ছড়ানো ছেটানো কিছু অস্থায়ী আস্তানা। ছেলে-বুড়ো- মেয়ে সবাই আছে। সেখানেই একটু খাবার জল সন্ধান করতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল বুড়োর সঙ্গে।

নাম মনে নেই, কিন্তু চেহারাটা মনে আছে আজও। মাথায় বটের ঝুড়ির মতো চুল, ফাঁকা ফাঁকা গোঁফ দাড়িরও সেই দশা। একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়ায়, তবু মনে হয়, লম্বায় ছয় ফিটের কম হবে না। তামাটে গায়ের রঙ, মুখে অজস্র মানচিত্র আঁকা। গেরুয়া রঙের লম্বা জোব্বা, ওটা নাকি পুরোহিতদের পোশাক। কেমন জল খাচ্ছি, স্বাস্থ্যকর কিনা, এসব ভাবার তখন সময় ছিল না….গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। জল খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে নিতে মনে হচ্ছিল, বড় গরীব এই লোকগুলো, এদের একটু সাহায্য করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু এমনি তো আর টাকা দেওয়া যায় না, কিছু কেনা দরকার। বুড়ো তিব্বতি লোকটা আমাদের কিছু জিনিসপত্র দেখিয়েছিল বিক্রির জন্য, কিন্তু তাতে আমাদের দরকার ছিল না। অবশেষে বেরিয়েছিল জিনিসটি, একটা রক্তমুখী ড্রাগন।

নামটা মনে হতেই আর একবার আমার গা-টা শিরশির করে উঠল। জিনিসটা এখন আমার ব্যাগের মধ্যে আছে, তবু ওটা আরেকবার আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল।

প্রায় গোলাকার ছোটখাটো একটা চাকতি, আট ইঞ্চি মতো ব্যাস হবে। কিন্তু কি বীভৎস দেখতে, চিন্তা করা যায় না। ড্রাগনের মুখ একটি, পেতল, ব্রোঞ্জ অথবা কোনো মিশ্রধাতুতে তৈরি। কুঞ্চিত এবং ভয়ঙ্কর চোখদুটি লাল, আর মুখটিও লাল….মনে হচ্ছে নিশ্বাস দিয়ে আগুনের হলকা বেরোচ্ছে। নামটা শুনে হাসি পেয়েছিল, ‘ফ্রেণ্ডশিপ ড্রাগন’। বন্ধুত্বের ড্রাগন। অথচ বন্ধুত্বের কোনও চিহ্ন তার হাবভাবে কোথাও ছিল না।

তিব্বতী বুড়োও সেই কথাই বলেছিল আমাদের। জিনিসটা নাকি অভিশপ্ত মূর্তি। তিব্বতের কোনও গুম্ফায় নাকি ছিল। নামে ফ্রেন্ডশিপ হলেও এই ড্রাগনের কোপ নাকি পড়ে যার কাছে এই ড্রাগনমূর্তি থাকে, তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর ওপরই। আগে প্রিয় বন্ধুকে শেষ করে,তারপর যার কাছে আছে, তাকে। জানতো বলেই বুড়ো তার এই পারিবারিক সম্পত্তি ফেলেই আসতে চেয়েছিল সেখানে। কিন্তু নিজের নাতনীর অতি প্রিয় বান্ধবী কখন যে সেটিকে তার ঝুলিতে পুরে ফেলেছিল বুঝতেই পারেনি। বুঝতে পারল যখন, তখন অত্যন্ত দেরী হয়ে গেছে। দু ঘন্টার মধ্যে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মরে গিয়েছিল বুড়োর নাতনী। ড্রাগনের চোখ নাকি তখন আগুনের মতো জ্বলছিল, নিশ্বাসে হলকা বেরোচ্ছিল রীতিমতো। পরদিন নাতনীর সেই বান্ধবীকেও শেষ করে তবে সে শান্ত হয়েছে।

বনজিত একটু ভীতু ধরনের ছেলে, বুড়োর কাছে সব শুনে বলল, ” থাক না, কি হবে ওটা নিয়ে?” আমি বলেছিলাম, ” থাকবে তো তোর কাছে! আমার কিছু হলে তখন না হয় ছুঁড়ে ফেলে দিস।” বনজিত বলেছিল, ” রক্ষে কোরো, ওসব বিদঘুটে জিনিস আমি নিজের কাছে রাখতে পারব না।” ” তাহলে আমিই রাখি”, এই বলে ওকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলেছিলাম, ” আজকের দিনের বিজ্ঞান পড়া ছেলে হয়ে তুই বলিস না যে ওই কবেকার একটা পেতলের মূর্তি তোকে খুন করবে।” ” না, সে কথা বলিনি”, দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে বলল বনজিত, ” বলেছিলাম কি লাভ ওসব নিয়েয়ে!” আমি বলেছিলাম, ” ভয় কাটানো হবে। বুকের ভেতর থেকে সংস্কারের বাসা অন্তত উপড়ে ফেলা যাবে।”

যে হাসিটা সেদিন আমার মুখে ছিল, সেটাই আমি দেখতে পেয়েছিলাম বনজিতের মুখে, যেদিন এম.এস.সি’র রেজাল্ট বেরিয়েছিল। খাওয়া দাওয়া হয়েছিল আমাদের বাড়ি। তাক থেকে পেড়ে ধুলো ঝেড়ে মূর্তিটা আমি দেখিয়েছিলাম ওকে আবার, বলেছিলাম, ” তাহলে আমাদের এই ফ্রেন্ডশিপ ড্রাগন কিছুই করতে পারল না আমাদের।” ” তাই তো দেখছি”, বনজিত বলেছিল। আমি ভাবলাম, বনজিতকে এবার বলব, আমার কাছে থেকে এটা তোর তো কোনও ক্ষতি করতে পারল না, এবার ক’দিন তোর কাছেই থাক, দেখ আমার কি ক্ষতি হয়!

তো সে সুযোগ আর পাওয়া গেল না। তার আগেই এইরকম রহস্যময় ভাবে বেচারা বনজিতকে চলে যেতে হল পৃথিবী ছেড়ে।

একটু জল খেলে হত। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ঘুম যে আজ রাতে ভাল হবে না, সেটা জানতাম। সত্যি বলতে কি, আন্টি মানে বনজিতের মা বারণও করেছিলেন আমায় বনজিতের ঘরে শুতে। বলেছিলেন, ” কি দরকার নীচে তো আমরা সবাই আছি..!”

আমি শুনিনি। প্রথমত কথাটার মধ্যে একটা ভয় ভয় ভাব আছে, যেটায় আমি একেবারেই বিশ্বাস করি না। দ্বিতীয় কথা, নীচে তেমন বিছানা টিছানার ব্যবস্থাও নেই।

বনজিতের ঘরে এসে খাটে উঠতে যাচ্ছিলাম, একসঙ্গে দুটো ব্যাপার ঘটে গেল। খাটটা মোটামুটি জোরে একবার নড়ে উঠল। সেটা হতে পারে, আমি যখন নড়ছি, খাট তো নড়বেই। কিন্তু আমি তো সবে একটু পাশ ফিরেছি, তাতে খাটটা এত জোরে নড়বার তো কারণ নেই। দ্বিতীয় ব্যাপারটা আরও অদ্ভুত, ঠিক মনে হল আমার পাশে শুয়ে কেউ ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল…মানে আমি আর বনজিত পাশাপাশি শুলে যে ব্যাপারটা মাঝেমাঝে হয়েছে। মূহুর্তের শঙ্কা। অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলে দিলাম মন থেকে। মশারিটা ফাঁক করে নামলাম মেঝেয়। কিন্তু সামনেই তো টেবিলটা ছিল, মানে যে টেবিলে বনজিতের বোন রীতা জলের বোতলটা রেখে গিয়েছিল, সেই টেবিলটা কোথায় গেল!

দু’বার হাতড়ালাম, কিছুই ঠেকল না হাতে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ঘর। অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি শোবার আগে রীতাকে ঘরের বেডল্যাম্পটা জ্বেলে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলাম। ল্যাম্পটা কি কোনও কারণে ফিউজ হয়ে গেল? হতে পারে।

আন্দাজে আন্দাজে পা বাড়ালাম। সামনে দরজা আছে জানি, পাশেই স্যুইচবোর্ড। বুকটা যে একটু ধড়াস ধড়াস করছিল না তা নয়, অন্ধকার ঘরে রাতদুপুরে এরকম হতেই পারে। তার ওপর বনজিতের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা শুনে মাথাটা ভার হয়ে আছে যেরকম, তাতে আর…

দেওয়াল ঠেকল হাতে। একটু ডান দিকে সরে আসতে স্যুইচবোর্ডও পেয়ে গেলাম। আন্দাজে যে কটা সুইচ টিপলাম, একটাতেও আলো জ্বলল না।

হায় কপাল, তাই বলো! লোডশেডিং! ওই জন্যেই এত অন্ধকার দেখাচ্ছে ঘরটা। একটা জানলা খুলেই শুয়েছিলাম, অথচ একটু আলোর রেখাও কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল টর্চটা তো আমার ব্যাগেই আছে। কিন্তু ব্যাগটা যে এনে কোথায় রেখেছিলাম! ঠিক ঘরের কোণে, মেঝের ওপর। একটা পায়জামা বের করে পড়েছিলাম, ওটা আর তুলে টেবিলে রাখা হয়নি। তারমানে ব্যাগটা পেতে হলে আমায় ডানদিকে দেওয়ালের দিকে একটু এগোতে হবে। টর্চটা জ্বালতেই হবে, ঘরে যদি মোম-টোম কিছু থাকে।
আস্তে আস্তে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ কি যেন একটা গলা ছুঁয়েই বেরিয়ে গেল।
চমকে উঠলাম। কি হতে পারে! ঠাণ্ডা একটা আঙুল মনে হল?
টিকটিকি! নাকি……

কি তা জানি না, তবে এত বরফের মতো ঠাণ্ডা স্পর্শ কিসের হতে পারে, তা আমার মাথায় ঢুকছিল না। সেটা নিয়ে অবশ্য চিন্তা করার অবকাশও পেলাম না বিশেষ, কারণ তার আগেই ঘাড়ের কাছে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল কেউ।

বরফের মতো ঠাণ্ডা নিশ্বাস। এক খাবলা বরফজলই যেন ছুঁড়ে মেরেছে কেউ আমার ঘাড়ে। এবার মাথাটা আমার কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছিল। আমি ছাড়াও এ ঘরে আরেকজন কেউ আছে মনে হচ্ছে। অথচ তার যে একটা সাড়া নেব, তার উপায় ছিল না। গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোচ্ছিল না আমার।

দাঁড়িয়েই পড়েছিলাম বোধহয় কিছুটা স্থির হয়ে। মাথাটা অসম্ভব উদভ্রান্ত লাগছে। কিছুক্ষণ ধরে নিজেকে সামলে স্থির করলাম, টর্চটা আমায় যে করে হোক, বের করতে হবে। টর্চের আলোয় আমি দেখতে পাব, ঘরে আর কেউ আছে কিনা। এভাবে এই অতল অন্ধকারে অজানা আতঙ্ক বুকে নিয়ে বেশীক্ষণ বসে থাকা যাবে না।

পায়ে আর জোর ছিল না আগের মতো। তবু অশক্ত পা টানতে টানতে আন্দাজে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ঘরের কোণের দিকে। বুকের মধ্যে হাপড় চলছিল, কিন্তু আমি থামিনি। আমায় যে করেই হোক ব্যাগের কাছে পৌঁছতেই হবে, টর্চটা আমায় বের করতেই হবে। নইলে এই ভয়ঙ্কর আতঙ্কের হাত থেকে আমার মুক্তি নেই।

পা ঘষে ঘষে ব্যাগের কাছে সবে পৌঁছেছি, ব্যাগের সঙ্গে আমার পায়ের স্পর্শ হতেই আরেকটা ব্যাপার ঘটে গেল। ঠিক কি যে হল, কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি ছিটকে পড়েছিলাম ঘরের মেঝেয়। সমস্ত শরীর আমার অবশ হয়ে গিয়েছিল। মাথার ভেতর শিরাগুলো ছিঁড়ে যাবার মতো যন্ত্রণা। কিছু চিন্তা করার মতো শক্তিও তখন আমার ছিল না। কিন্তু এটুকু পরে বুঝতে পেরেছিলাম, খোলা তারে হাত দিলে যেমন ইলেকট্রিক শক খায়, আমার পা ব্যাগে ঠেকার সঙ্গে সঙ্গে সেইরকম একটা শক খেয়েছিলাম আমি, যাতে আমি ছিটকে পড়েছিলাম ঘরের আরেক কোণে।

এইপ্রথম ভয়ের একটা তীব্র অনুভূতি উঠে আসছিল আমার ভেতর থেকে। এসব নিয়ে কখনওই ভাবি না, কিন্তু মনের মধ্যে যে ভাবনা লুকিয়ে থাকে, তাতেই বোধহয় ভাবছিলাম, বনজিতের অতৃপ্ত আত্মা বোধহয় আমার সঙ্গ চাইছে, আমার পাশে থেকে সে আমার সান্নিধ্য অনুভব করতে চাইছে। কিন্তু এই মূহুর্তে যেটা ঘটে গেল সেটার মানে তো আরও সাঙ্ঘাতিক। এর সঙ্গে বনজিতের তো কোনও সম্পর্কই নেই। যে এই মূহুর্তে আমার সঙ্গে ঘরে আছে, সে বনজিত হতেই পারে না। আমি যে ঠিক চিন্তা করছিলাম এমন নয়, কিন্তু একটা অস্ফুট চিন্তা চারদিক থেকে আমায় যেন জড়িয়ে ধরছিল। আমার হঠাৎই মনে পড়ে যাচ্ছিল রক্তমুখী ড্রাগন কেবল বন্ধুকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলে সন্তুষ্ট হয় না, তারপরেই সে আক্রমণ করে যার কাছে সে আশ্রয় নিয়েছে, তাকে। ড্রাগন এতদিন পর আমার প্রিয়তম বন্ধুকে সরিয়ে দিতে পেরেছে পৃথিবী থেকে, দেরী করে হলেও শেষ পর্যন্ত সে পেরেছে। একবার সে রক্তের স্বাদ পেয়ে গিয়েছে, এবার তার দ্বিতীয় শিকার… নিজেকে বাঁচাবার একটা মরিয়া চেষ্টাই যেন ঠেলে তুলল আমাকে!

বেরিয়ে যেতে হবে এই ঘর থেকে। দরজা কোথায় আছে আমি জানি, একবার ছিটকিনি খুলতে পারলেই বেঁচে যাবো আমি। সিঁড়ি দিয়ে সোজা নীচে, আর তারপরেই ওদের সবাইকে ডেকে তুলে..

টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম। ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম দরজার দিকে। ধাক্কা খেলাম দেওয়ালে। দরজা খুঁজে পাইনি আমি। পড়ে যাচ্ছিলাম, টাল সামলে নিলাম। দ্বিতীয় বারের প্রচেষ্টা শুরু করার আগেই আবার…

ঘাড়ের কাছে সেই হাড় হিম করা নিশ্বাস! রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে আসছিল আমার শরীরে। কোনোরকমে নিজেকে খাড়া রেখে এবার পাগলের মতো ছুটে বেড়াতে গেলাম এদিকে- ওদিকে। ধাক্কা খাচ্ছি, পায়ে লাগছে, মাথা ঠুকে

যাচ্ছে..কিছুই খেয়াল নেই আমার। একটাই মাত্র চিন্তা আমার মাথায়, দরজার কাছে আমায় পৌঁছতেই হবে, ছিটকিনি আমায় খুলতে হবে, বেরিয়ে যেতে হবে ঘর থেকে। শেষ পর্যন্ত বুঝি কোনও অলৌকিক উপায়ে দরজার কাঠের ওপর হাত ঠেকেছে আমার। যে মূহুর্তে ছিটকিনির দিকে হাতটা উঠিয়েছি, ছিটকিনিটা নামিয়েছি নীচে… সাপের মতো একটা হিলহিলে লম্বা জিনিস আছড়ে পড়ল আমার ঘাড়ে,গলায়। পেঁচিয়ে ধরল আমার গলা। আমি দু হাত দিয়ে ঠেলে সরাতে চাইছি সেটাকে, পারছি না। বরফ হিম স্পর্শ বরং আরও এঁটে বসেছে আমার গলায়। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। শরীরের সব জোর ফুরিয়ে আসছে আমার। শেষবারের মতো দেহের সমস্ত জোর দিয়ে সরাবার চেষ্টা করলাম জিনিসটাকে, পারলাম না। থরথর করে কাঁপছিল শরীর। সেখানেই আছড়ে পড়ে গেলাম আমি।

চোখ খুলতে আমার ভয় করছিল। চোখ খুলে বুঝতে পারলাম, আমি মরিনি। শুধু মরিনি যে তা নয়, আমায় ঘিরে রয়েছেন সবাই……বনজিতের মা, বাবা, বোন, সকলে। আমি শুয়ে আছি বনজিতের খাটে, মানে গত রাতে যেখানে শুয়েছিলাম। পিটপিট করে তাকাচ্ছিলাম, বনজিতের বাবা বললেন, ” তুমি ভয় পেয়েছিলে বাবা রাত্তিরে। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক। আমারই উচিত হয় নি তোমায় ওপরে একা শুতে পাঠানোর। হাজার হোক, তোমার প্রাণের বন্ধু। এত বড় শকটা তুমি এত সহজে সহ্য করে নিতে পারো?”

কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলাম, উনিই আবার বললেন, ” লোডশেডিং হয়েছিল রাত্রে। সেইজন্যই বোধহয় তুমি দিক ঠিক করতে পারো নি। তবে ঈশ্বরের অসীম দয়া যে তুমি ছিটকিনিটা খুলতে পেরেছিলে, সেইজন্যেই দড়াম করে তোমার পড়ে যাবার শব্দ শুনে আমরা ছুটে এসেছিলাম।” আমি কোনওরকমে জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ” ঘরে কি আর কেউ, মানে…”। ” না, না, আর কেউ আসবে কোত্থেকে! ওই ছিটকিনির সঙ্গেই মশারির দড়িটা বাঁধা ছিল তো, সেটাই জড়িয়ে গিয়েছিল তোমার গলার সঙ্গে। যাক, তোমার জ্ঞান ফিরেছে, এই আমাদের ভাগ্য। তুমি একটু রেস্ট নাও, আমরা ডাক্তারকে কল করেছি, তিনি এসে তোমায় একবার দেখে যান।” চলে গেলেন ওঁরা সবাই। গলায় একবার হাত দিলাম আমি। ব্যথা হয়ে আছে গলাটা। মশারির দড়ি! কে জানে!

ওঠার চেষ্টা করলাম। মাথাটা ঘুরছে বেশ। শরীরেও জোর নেই তেমন। আস্তে আস্তে আমার ব্যাগের কাছে গেলাম। চেনটা টেনে হাত ভরে দিলাম ভেতরে।

মাথাটা দ্বিতীয়বার শিরশির করে উঠল। জিনিসপত্র টেনে বের করলাম।

না, ঠিকই আন্দাজ করেছি। রক্তমুখী ড্রাগনটা আমার ব্যাগে আর নেই এখন।ওটা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে,আমি ওর অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পেরে স্বস্তি পেলাম।

গল্পের বিষয়:
ফ্যান্টাসি
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত