পিউ কাঁদছে।
চোখ দুটো ফুলে গেছে ওর। কান্নার দমকে পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে।
পাশেই বসে আছে নিশি। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে। ছুটি কাটাতে এসেছে এখানে।
পিউ,নিশি দুই বোন। ওদের মা নেই। বাবা ওষুধের ব্যবসা করেন। রাস্তার মোড়ে একটা ফার্মেসি আছে তার।
ওদের বাবা জিয়াউল হাসান আর বিয়ে করেন নি। হাসিখুশি দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি সুখেই আছেন।সদা হাসিখুশি এই পিউ আজ চুপসে গেছে। ওর জীবনে আজ বীভত্স একটা ঘটনা ঘটেছে। শুনে পাথর হয়ে গেছে নিশি।
ঘটনাটা ঘটেছে আজ বিকালে। হাসিখুশি পিউ আর তার বান্ধবী শিউলি দুজনে প্রাইভেট পড়া শেষ করে বাসায় ফিরছিল। পথে জব্বার মিয়ার দোকানে আইসক্রিম খেতে ঢুকেছিল। জব্বার মিয়া খুব হাসি খুশি মানুষ। একাত্তরে রাজাকারদের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে ডান হাতটা হারিয়েছেন। পিউদের প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান। তার দোকানে আইসক্রিম খেতে যাওয়ার এটাই আসল কারন।
যথারীতি আইসক্রিমের অর্ডার দিয়ে দুই বান্ধবী গল্প শুনছে। এমন সময় দোকানের সামনে একটা মোটরসাইকেল এসে থামল। বাইক থেকে নেমে দোকানে ঢুকল মনজু আর রাসেল। এই দুজনকে চেনে ওরা। বখাটে, ওদের স্কুলের সামনে মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অশ্লীল ছড়া কাটে।
বিদঘুটে একটা গন্ধ আসছে ওদের গা থেকে। নিশ্চয়ই গাঁজার গন্ধ। গাঁজার নেশায় টাল হয়ে আছে দুজন। শিউলির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটটা একবার চেটে নিল মনজু। রাসেল সোজা জব্বার মিয়ার কাছে গিয়ে একটা সিগারেট চাইল। তারপর পিউয়ের পাশে বসে ওর কাঁধে হাত দিল।
এ পর্যন্ত চুপ করে ছিল পিউ। এবার তেতে উঠল। ‘ছাড়ুন আমাকে। চলে যান এখান থেকে।’
“তাই নাকি?” পকেটে একবার হাত বুলিয়ে বলল মনজু। “তাহলে তো হাত দিতেই হয়। এমন অমূল্য সম্পদ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না”। খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল রাসেল।
‘”মনজু আর রাসেল, তোমরা দোকান থেকে ভদ্রভাবে বেরিয়ে গেলে খুশি হব'”, গমগম করে উঠল জব্বার মিয়ার গলা।
“আরে এই বুইড়া দেখি বেশি প্যাচাল পাড়ে। ল এইডার মুখ আগে বন্ধ করি।”
চোখের পলকে রাসেলের হাতে বের হয়ে এল ছুরি।
জব্বার মিয়ার চোখের পাপড়ি এতটুকুও কাঁপল না। একমাত্র হাতটা দিয়ে পেপসির কাঁচের একটা বোতল ধরলেন। কাউন্টারে সেটা পিটিয়ে ভেঙে নিলেন প্রয়োজন মত। তারপর মুখোমুখি হলেন দুই দুর্বৃত্তের।
প্রথম কিছুক্ষণ ভালোই লড়লেন। কিন্তু বুড়ো বয়সে আর কতক্ষণইবা পারবেন। রাসেলের ছুরি তার বাম হাতে বিধঁল। একই সাথে মনজুও আরেকটা বোতল ভাঙল জব্বার মিয়ার মাথায়। কাত হয়ে ঢলে পড়লেন তিনি।
এতকিছু ঘটতে মাত্র পঞ্চাশ সেকেন্ড লাগল।
জব্বার মিয়াকে মেরেই ক্ষান্ত দিল না তারা, অচেতন দেহটাকে ছুঁড়ে দিল রাস্তায়, তারপর ফিরল পিউ আর শিউলির দিকে। দুজনেই তখন ভয়ে কাঁপছে। এবার খপ করে শিউলির চুল মুঠি করে ধরল মনজু। যন্ত্রণায় চিত্কার করে উঠল শিউলি। অন্যদিকে পিউর কামিজ খামচে ধরল রাসেল। আর দেরী করল না পিউ। সর্বশক্তিতে কামড়ে ধরল রাসেলের হাত। যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল রাসেল। এই সুযোগে ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল পিউ। তারপর দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এল।
বাইরে বেরিয়ে চিত্কার করে লোক ডাকতে লাগল পিউ। পেছনে খড়খড় আওয়াজ হতেই চমকে উঠল সে। দেখল দোকানের শাটার ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে ওরা। ভেতর থেকে শিউলির একটানা চিত্কার ভেসে আসছে। শাটারে দমাদম কিল ঘুসি মারতে লাগল পিউ। মজা দেখতে আসা লোকদের ভিড় লেগে গেল দোকানটাকে ঘিরে। আধঘন্টা পর বের হল মনজু আর রাসেল। বেরিয়েই রিভলবার থেকে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ল। উপস্থিত জনতা একটু পিছু হটল। সেই সুযোগে ওরা বাইকে করে কেটে পড়ল।
দুই শয়তান বেরিয়ে যেতেই শিউলির কাছে ছুটে গেল পিউ। রক্তাক্ত শিউলিকে দেখে বুকটা হুহু করে উঠল তার।
এলাকার লোকজন মিলে শিউলি আর জব্বার মিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। জব্বার মিয়া কোমায়। আর শিউলি বেশিক্ষণ টিকল না। সন্ধ্যার আগেই তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল।
বাসায় বসে ভাবছে পিউ। পুলিশ মামলা নেয়নি। নানা অজুহাতে এড়িয়ে গেছে। আসল কারন সবার জানা। শয়তান দুটো স্থানীয় এক গডফাদারের টপ হ্যান্ড। তাই ভয়ে কেউ কিছু বলে না ওদের। কিন্তু পিউ আইনের ভরসায় থাকবে না,নিজের হাতে শাস্তি দেবে ওদের। প্রতিজ্ঞা করল ও। কাল সকালের সূর্য দেখতে দেবে না ঐ দুই শয়তানের।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে দরজা খুলে বের হল পিউ। আজ ভরা পূর্ণিমা। আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে সারাদিক। চাঁদটা মাঝ আকাশে পৌছাতেই শারীরিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করল পিউর। ওর চিকন চিকন দুই বাহুতে গজিয়ে উঠল ইস্পাতের মত পেশী। শরীরটা লম্বা হতে হতে সামনের দিকে একটু বেঁকে গেল।ওর সুন্দর হাতের বদলে দেখা দিল সুতীক্ষ্ন নখর যুক্ত থাবা। ওর অনিন্যসুন্দর মুখে গজিয়ে উঠল নেকড়ের মত ভয়ানক চোয়াল। ধূসর কালচে লোমে ঢাকা পড়ল সারা দেহ। অপার্থিব একটা গর্জন ছেড়ে বাসার পেছনের সুপারিবনে ছুটে গেল পিউ।
রাত একটা।মনজু আর রাসেল ক্লাবঘরে বসে তাস খেলছে। খেলা শেষ হতে দুটো বাজল। আজ বোধহয় বেশি মাল খাওয়া হয়েছে। তাই পা দুটো টলমল করছে দুজনেরই। তাই বাইক চালানোর ঝুঁকি নিল না, হেঁটেই বাসায় ফিরবে ঠিক করল। পিউদের বাসার পিছনের সুপারিবনের মধ্যে শর্টকাট রাস্তা আছে। সেই রাস্তা ধরে দুজনে চলতে লাগল।
আর সহ্য করতে পারল না পিউ। আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল রাসেলের উপরে। এক থাবায় খুলি ডেবে গিয়ে মগজ বেরিয়ে এল, সাথে সাথে মারা গেল সে। মনজু ওদিকে ভয়ে কাঁপছে। রাসেলের ভবলীলা সাঙ্গ করে এবার মনজুর দিকে ফিরল সে। হাতে রিভলবার নিয়ে কাঁপছে সে। পিউ তার দিকে ফিরতেই সে গুলি চালাল। কিন্তু পিউ তো তার চেয়েও ক্ষিপ্র। নিমিষেই সরে গেল। গুলি ছুঁড়েই আর দাঁড়াল না মনজু। নেশা কেটে গেছে। উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে সে।এই দূরত্ব অতিক্রম করা এখন পিউ এর কাছে কিছুই না।দুই লাফে মনজুকে ধরে ফেলল সে।তারপর কামড়ে গলাটা ছিঁড়ে ফেলল তার।
পেট ভরে রক্ত খেল পিউ,নখ দিয়ে ফালি ফালি করল দুই বখাটের দেহ।থেকে থেকে ডেকে উঠছে অপার্থিব গলায়।
সকালে ঘুম ভেঙে গেল পিউর। বাথরুমে গিয়ে পরিস্কার করল গায়ে লেগে থাকা শুকনো রক্ত। তারপর নাশতা খেতে বসল। এমন সময় চেঁচামেচি শুনল প্রতিবেশিদের, “শুনেছেন? মনজু আর রাসেলকে কারা যেন কুপিয়ে মেরেছে….”
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল নিশি। যাক, শয়তান দুটো এমনিতেই শাস্তি পেয়ে গেছে।উঠে গিয়ে বাইরে বেরোল সে।প্রতিবেশিদের কাছ থেকে বিস্তারিত ঘটনা শুনবে।
কেউ লক্ষ্য করল না, পিউয়ের মুখে লেগে আছে রহস্যময় হাসি।