হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম আমি। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো হুকাররা সাধারণত এত রূপবতী হয়না। আমার মনে হচ্ছে না এই মেয়ে হুকার টাইপ। কাছে গেলেই হয়ত চড় মেরে বসবে। চুপচাপ বসে থাকাটাই শ্রেয়। আরেকটা সিগারেট ধরাতে যাব এমন সময় মেয়েটা নিজেই আমার কাছে এগিয়ে এল।
-এক্সকিউজ মি।
-আমাকে বলছেন?
-দেখুন আমি বিপদে পরেছি। আপনি কি আমাকে একটু হেল্প করবেন?
-তার আগে আমাকে জানতে হবে বিপদটা কি।
-দেখুন আমার নাম সিন্থিয়া। খুলনা থেকে এসেছি। এখানে এসেছি আমার খালার বাড়িতে। বাড়ির ঠিকানা এটা। আমার পৌছাতে পৌছাতে লেট হয়ে গেছে। আমাকে নিতে স্টেশনে আসার কথা কিন্তু এখনো কেউ আসছে না।
আমি ঠিকানা লেখা কাগজটা একবার পড়লাম ঠিকানাটা যাত্রাবাড়ির। আমি হাতঘড়িতে দেখলাম রাত নটা বাজে। এত রাতে যাত্রাবাড়ি। উঁহু একটু বেশী বাড়াবাড়ি। দেখি কি করা যায়।
-আপনার রাতে খাওয়া হয়নি তাইনা? চলুন আগে আপনার খাওয়ার ব্যাবস্থা করি।
গাবতলি স্টেশন থেকে বের হয়ে রিক্সা নিলাম। কাছেই একটা ভাল রেস্টুরেন্ট আছে। রিক্সায় উঠে মেয়েটা আমার নাম জানতে চাইল। আমি বললাম শোভন।
-কি করেন?
-এইতো একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে জব করি। আপনি?
-এইবার এইচএসসি দেব।
-ও আচ্ছা।
এতক্ষণ মনে হচ্ছিল ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। এবার বুঝলাম কুছ নেহি পুরি দালহি কালি হ্যায়। মেয়েটাকে প্রশ্ন করলাম,
-এই প্রথম পালালে না আগেও বাসা থেকে পালিয়েছ?
-কি বলতে চান?
– পালালে কেন?
এবার মেয়েটা কেঁদে ফেলল। আগের সেই ড্যাম কেয়ার ভাবটা এখন আর নেই। আমি মেয়েটাকে শান্ত করে ওকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম। খাবার আসলে খেতে খেতে যা বলল আমাকে তার সারমর্ম অনেকটা এরকম, ওর সাথে একটা ছেলের দুবছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক। ছেলেটা ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে। মেয়েটার পরিবার থেকে মেয়েটাকে বিয়ে দিতে চাইছে। মেয়েটা রাজি না তাই পালিয়ে এসেছে ঢাকা। এসেই বিপদে পরেছে। এখানকার কিছুই চেনেনা মেয়েটা। ছেলের ফোন বন্ধ আর মেয়েটা ফোন না নিয়েই চলে এসেছে। বাসার একটা ঠিকানা আছে। মেয়েটা সেখানেই যেতে চাইছে। আমি সব শুনে বললাম,
-সব বুঝলাম। কিন্তু তুমি এত রাতে যাত্রাবাড়ী যেতে পারবে না। এখান থেকে অনেক দূর। তুমি রাতটা আমার বাসায় থাক। কাল সকালে আমি তোমাকে পৌঁছে দেব।
– আপনার বাসায়?
-চিন্তা কর না। আমার ওয়াইফ আছেন বাসায় তোমার কোন সমস্যা হবে না।
মেয়েটা তারপরও একটু আপত্তি করে রাজি হয়ে গেল। আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে রিকশা নিলাম। রিকশাওয়ালা বয়সে যুবক। ঝড়ের বেগে চালাচ্ছে। আমি হেসে বললাম, “আমার বিয়েটাও অনেকটা এভাবে হয়েছিল। মিতু ঢাকা ভার্সিটিতে ফারমাসির স্টুডেন্ট ছিল। আর আমি আহসানউল্লাহতে আর্কিটেকচার পড়তাম। ইয়ারমেট ছিলাম আমরা। গ্র্যাজুয়েশনের পর ও একটা স্কলারশিপ পায়। ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে চলে যায় পিএইচডি করতে। ও যাবার ছমাসের মাথায় আমিও ওখানে হুট করে চলে যাই ওকে সারপ্রাইজ দিতে। সেখানে আমি ছোট একটা কন্সাল্টিং এজেন্সি খুলি। আর ও পিএইচডি শেষ করে। সে বছরই আমরা বিয়ে করি।“ কথা শেষ করে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
-আপনি ইউএসএতে ছিলেন?
-হ্যাঁ দেশে ফিরেছি গত বছর। মামা ডানের একতলা বাসাটার সামনে রাখ।
বাড়ি দেখে সিন্থিয়া বেশ মুগ্ধ হল। অবশ্য মুগ্ধ হবার মতই বাড়ি।
-রাতে বেশী কিছু দেখা যাচ্ছে না। সকালে ভাল করে দেখো।
-নিশ্চয়ই আপনি ডিজাইন করেছেন?
-হ্যাঁ সে তো বটেই। চল ভেতরে চল।
বাসায় ঢুকে আমি আলো জ্বালালাম। ওকে বসতে বলে বললাম, “মিতু একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। তুমি বস আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসছি”। রান্নাঘর থেকে ওকে একগ্লাস পানি এনে দিলাম।
-পানিটা খাও মিতু আসছে।
সম্ভবত তৃষ্ণার্ত ছিল মেয়েটা। এক চুমুকে গ্লাসটা খালি করে দিল। আমি এবার কথা শুরু করলাম, “সিন্থিয়া আমি তোমাকে বাসায় এনেছি একটা বিশেষ কারণে”।
সিন্থিয়া অবাক “কি কারণ?”
-তার আগে ছোট্ট একটা গল্প বলি। শোনার ধৈর্য আছে?
-হুম বলেন।
-আজ থেকে প্রায় ৬০/৭০ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয় তা তো তুমি জানোই। তখন জার্মানির কিছু নাৎসি বিজ্ঞানী অ্যাজ লাইক অ্যাজ জোসেফ মেঙ্গেল হিটলারের নির্দেশে সুপার সোলজার বানানোর জন্য নানা ধরণের গবেষণা শুরু করেন। এর মধ্যে একটা পরীক্ষা ছিল এমন যে ওরা কল্পকাহিনীর ভ্যাম্পায়ার তৈরি করার একটা চেষ্টা চালিয়েছিল। আজকের বিভিন্ন মুভি আর সিরিয়ালে যেমন দেখায় তেমন ক্ষমতাধর মানুষ। যাদের হত্যা করা সম্ভব নয়। যারা বেঁচে থাকবে শত্রুসেনাদের রক্তপান করে। অনেকটা সফল নাকি হয়েওছিল তারা। সে যাই হোক। যুদ্ধ শেষ হলে এসব তো ধামাচাপা পড়ে যায়। কিন্তু সেই গবেষণার কিছু ফাইল কিভাবে কিভাবে যেন মিতু যে প্রফেসরের আণ্ডারে ডক্টরেট করছিল তার হাতে চলে আসে। ওরা দুজনেই এক্সপেরিমেন্টটা করার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
দুবছর নিরলস পরিশ্রমের পর প্রথম ড্রাগটা তৈরি হয় যেটা হরমোনাল ইম্ব্যালেন্স ঘটিয়ে শারীরিক পরিবর্তন আনতে শুরু করবে। মিতু প্রচণ্ড কৌতূহলী আর অনুসন্ধিৎসু ধরণের মেয়ে ছিল। সে নিজের দেহেই ড্রাগটা প্রয়োগ করে। কিন্তু পরিণাম হয় মারাত্মক। ড্রাগটা এক্সপেরিমেন্টাল স্পেসিমেন ছিল। ত্রুটিপূর্ণ নমুনা ছিল সেটা। মিতুর নানা রকম পরিবর্তন আসতে থাকে। অন্ধকারে পরিস্কার দেখতে পাওয়া, অনেক সূক্ষ্ম শব্দ পরিস্কার শুনতে পাওয়া, গন্ধে মানুষ চিনতে পারা। একই সাথে আসে নেতিবাচক পরিবর্তন যেমন সে আলো মোটেই সহ্য করতে পারত না। বিশেষ করে সূর্যের আলো। সূর্যের আলোতে ও বেরই হতে পারেনা। গায়ের চামড়ার রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে শারীরিক ক্ষমতা মোটেও বাড়ল না। বরং কমে গেল। খুব দুর্বল হয়ে গেল। মানুষ যে সব খাবার খায় সে সব ওর সহ্য হয় না। খাওয়া মাত্রই বমি হয়। শরীর ভেঙ্গে পড়ে। ওর একমাত্র খাবার রক্ত। ব্লাড ব্যাংক থেকে কিনে এনে দিলে কোন লাভ হয় না ওর বডি সেই রক্ত তাৎক্ষণিক ভাবে রিজেক্ট করে। পশুপাখির রক্তেও কোন কাজ হয় না। সরাসরি মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে টাটকাটা দিতে হয়। ওর সিনেমার ভ্যাম্পায়ারদের মত দাঁত নেই। রক্ত গিলেও খেতে পারে না। রক্ত ওর শরীরে আমি ব্লাড ট্রান্সফিউশন সেট দিয়ে ট্র্যান্সফার করি। একজন মানুষের পুরো রক্ত একবার দিলে আরামসে দুতিন সপ্তাহ চলে যায়।
প্রতিমাসে অন্তত একজন মানুষ দরকার হয় ওর। আমি খুবই দুঃখিত কিন্তু তোমাকেও এ কারণেই এনেছি আমি।
এবার শব্দ করে হেসে উঠল সিন্থিয়া, “প্লীজ ভাইয়া মজা করবেন না তো।“
-মজা মনে হচ্ছে? তোমার পানিতে আমি হাই ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পরবে তুমি।
এবার সিন্থিয়া বিপদ টের পেয়েছে। কারণ ইতোমধ্যে ঘুমে ঢুলতে শুরু করেছে ও। কাঁপা গলায় বলল, “প্লীজ ভাইয়া। প্লীজ। আমাকে ছেড়ে দেন। আমি বাঁচতে চাই।“ চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে মেয়েটার।
নিজের ওপর প্রচণ্ড ঘৃণা হল আমার। প্রতিবারই হয় কিন্তু প্রতিবারের মত এবারও বোধটা চাপা দিলাম আমি। ‘আয়াম সরি। কিন্তু আমি মিতুকে প্রচণ্ড ভালবাসি ওকে বাঁচিয়ে রাখতেই আমাকে এটা করতে হবে। প্লীজ মাফ করে দাও আমাকে’।
সিন্থিয়ার শরীর থেকে রক্ত একটু একটু করে ব্যাগটায় জমা হচ্ছে। মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। শেষ ঘুম। শেষ মুহুরতে মা, বাবা আর রাফির নাম বলে বিড়বিড় করছিল। রাফি হয়ত ওর বয়ফ্রেন্ডটা। লাশটা বাসার বেজমেন্টে গুম করে ফেলতে হবে কাজ হয়ে গেলে।
বেজমেন্টে একটা ওয়াটার হাউজ আছে। সেখানে প্রায় দশটা প্রমান সাইজ আফ্রিকান মাগুর পুষি আমি। প্রতিটা ভিক্টিমের লাশ ওই হাউজেই গায়েব করি আমি। খারাপই লাগছে। এবার লোক যোগাড় করতে দেরী হয়ে গেল। আমার নিজেরও শরীর ভাল না। গত দুই সপ্তাহ মিতুকে নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। আমি সাধারণত রাস্তার পাশের হুকারদের শিকার হিসেবে বেছে নেই। গত কয়েকদিন ধরে রাতে বৃষ্টি হওয়ায় কোন হুকারকে পাইনি রাস্তায়। কোন শিকার যোগাড় করতে পারিনি। রক্ত ট্রান্সফার হতে সময় লাগবে। মেয়েটা বেশ স্বাস্থবতি। বাকি মাসটার জন্য নিশ্চিন্ত। আমি আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম।
আমার বাড়ির এই ঘরটা গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা থাকে সবসময়। ঘরে আসবাব বলতে মাত্র একটি খাট আর একটি ইজিচেয়ার। আমি বিছানায় বসলাম। মিতু জেগেই আছে। রাতটাইতো ওর জেগে থাকারই সময়। ওর একটা হাত আমি নিজের হাতে তুলে নিলাম। হাতের উলটো পিঠে ক্যানোলা লাগানো।
-আজও ধরে এনেছ?
আমি কথা বললাম না। মিতু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “এভাবে আর কতদিন শোভন। বাদ দাও।“
-তারপর? তারপর তুমি আমার সামনে মারা যাও আর আমি সেটা চেয়ে চেয়ে দেখি। তাইনা?
-মরতে তো একদিন সবাইকেই হবে।
-আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দাও তো। আমি যতদিন বেঁচে আছি তোমাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
মিতু অনেক কষ্টে নিজের দুর্বল শরীরটা টেনে তুলে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
হ্যাঁ আমি অপরাধী। আমি খুনি। বিবেকের দংশন প্রতিটা সেকেন্ডেই অনুভব করি আমি। অপরাধবোধ আছে আমার মনে। কিন্তু আমি নিরুপায়। ভাববেন না যে আমি মিতুর জন্য এসব করছি। আসলে করছি নিজের জন্য। আমি যা করছি নিজের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য করছি। এই মেয়েটা আমার বেঁচে থাকবার একমাত্র অবলম্বন। ও না থাকলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকবার কোন কারণ আমার কাছে নেই। আমি আমার কর্কশ খুনে হাতদুটো দিয়ে মিতুর দুর্বল শরীরটা জড়িয়ে ধরলাম। ডুবন্ত মানুষতো খড়কুটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। ঘরের আঁধার আরও গাঢ় হয়ে এল। আমাদের জীবনটার মতই।
********************************************* সমাপ্ত **************************************