একা রাস্তায় হাটছে জর্জ। ভালোই লাগছে। রাতের এই নির্জন পরিবেশে একা হাটার আলাদা রকম মজা আছে। কেউ নেই। শান্ত, কোলাহলমুক্ত পরিবেশ। আর জেমস স্ট্রিটে এই রাত ১১টায় মানুষ থাকেনা বললেই চলে।
অন্যান্য সময় জেমস স্ট্রিট ব্যাস্ত থাকলেও রাত ১০টার পরই নির্জন হয়ে যায়। এখানে মানুষের বসতিও তেমন না। তাই তেমন কোলাহল নেই এখানে। জর্জের কোলাহল তেমন ভালো লাগেনা।
ত্রিশ বছরের এই একাকী জীবনের একাকিত্বকে পূর্ণতা দেয়ার জন্যই জেমস স্ট্রিটে বাসা নেয়া। বাবা-মা,ভাই-বোন কেউই নেই ওর। তাই একা থাকাটাকেই জীবন হিসেবে বেছে নিয়েছে।
আর জেমস স্ট্রিটের পরিবেশটাও খুব ভালো। বাড়িগুলো লাগোয়া না। দূরত্ব আছে। আর এখানকার মানুষগুলো নিজেদের নিয়ে ব্যাস্ত থাকলেও কিছুটা বন্ধুসুলভ আচরণ আছে এদের। তাই ভালোই লাগে। কোলাহলতা না…একটু দেখা,হাসিমুখে হ্যালো বলা এইসবের মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা নেই। এটাই ভালো। একা আবার একাও না।
ল্যাম্পপোস্ট এর হালকা হলুদাভ আলোয় ছেয়ে আছে রাস্তাটা। হাটছে তার মাঝে জর্জ।
হঠাৎ চোখ আটকে গেলো।
রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট মেয়ে বসে। সাদা রঙয়ের একটা ফ্রক পড়ে আছে মেয়েটা।
হাটু ভাজ করে তার উপর মুখ রেখে হাত দুটো সামনের দিকে নিয়ে কি যেন ভাবছে।
কিছুক্ষণ ঘাড় কাত করে মেয়েটার এই খেলা দেখলো জর্জ। আশেপাশে তাকালো বার কয়েক। কেউ নেই।
মেয়েটা কে? তাকে এভাবে একা রেখে ওর বাবা-মা কোথায় গেলো?
মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মনে হয় মেয়েটার চোখ ওর দিকে গেল।
ল্যাম্পপোস্ট এর আলোয় মেয়েটার চেহারা বোঝা যাচ্ছেনা পুরোপুরি। তবুও ওর হাসিটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা জর্জের।
একটা হাসি দিয়ে জর্জও এগিয়ে গেলো মেয়েটার দিকে। মেয়েটার সামনে গিয়ে দাড়ালো।
মেয়েটা আবার ওর হাতের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। এক হাতের পাঁচটা আঙ্গুল আরেক হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে ঢুকিয়ে কিছু একটা বানানোর চেষ্টায় আছে মেয়েটা।
জর্জ মেয়েটার সামনে হাটুতে ভর দিয়ে বসলো। মেয়েটার দিকে তাকালো ভালো করে।
মেয়েটাও ওর দিকে তাকালো। মুখটা হালকা বাঁকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলো।
বিনিময়ে জর্জও হাসলো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো, “হাই!”
মেয়েটা একটু হেসে বললো, “হেই!”
-“নাম কি তোমার?” জর্জ প্রশ্ন করলো।
-“টিনি প্রিন্সেস,” ছোট্ট মেয়েটা নিজের হাতের দিকে তাকিয়েই জবাব দিলো ছোট্ট করে।
-“তোমার মাম্মি-ড্যাডি কোথায়?”
-“ওইদিকে গিয়েছে,” হাত তুলে ডান দিকে ইশারা করলো টিনি।
-“তোমাকে এখানে একা ফেলে গিয়েছে কেন?”
-“ড্যাডি বলেছে মাম্মিকে নিয়ে আসবে। মাম্মি রাগ করেছে,” হালকা গাল ফুলিয়ে জবাব দিলো মেয়েটা।
তাকিয়ে আছে জর্জ মেয়েটার দিকে। ওর বাবা ওকে এখানে একা ফেলে গিয়েছে অথচ মেয়েটার কোনো ভয় নেই। দিব্যি একা বসে খেলছে।
জর্জ জানে মেয়েটার বাবা ফিরবেনা। জর্জের বাবাও জর্জকে একইভাবে রেখে চলে গিয়েছিলো।
-“তোমার মাম্মিকে আনতে যাচ্ছি,” এটাই ছিলো জর্জের বাবার শেষ কথা।
তারপর আর জর্জ তার বাবাকে দেখেনি। ৫বছরের ছোট্ট জর্জ কেঁদেছিলো। কিন্তু তার কান্নায় কেউ সাড়া দেয়নি।
যতোদূর জেনেছিল জর্জ ওর বাবা দেনায় ডুবে ছিলো। মার সাথে বাবার অনেক আগেই ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল। তাই বোঝার বয়স হবার পর মা কি সেটা বুঝতে পারেনি।
আর বাবাও দেনার দায় এড়াতে জর্জকে একা ফেলে চলে গিয়েছিল।
আজও জানেনা জর্জ ওর বাবা কোথায়।
মেয়েটার দিকে তাকালো জর্জ।মায়াবী একটা মুখ। গোলাপি গালের সাথে টুকটুকে লাল ঠোটের মেয়েটা তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। খেলায় ব্যাস্ত।
ঠোটটাকে হালকাভাবে নাড়িয়ে কি যেন বলে যাচ্ছে নিজের মনের মতো করে।
জর্জ ভাবছে মেয়েটার বাবার কথা। যদি মেয়েটার বাবা না আসে তাহলে ওই মেয়েটাকে নিয়ে যাবে নিজের সাথে করে। নিজের মেয়ের মতো করে বড় করবে তাকে।
জর্জের মতো কষ্টে থাকতে দিবে না। নিজের ছোটোবেলা থেকে কষ্টে কাটানো জীবনটা আবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। এই মেয়েটার ক্ষেত্রে তা হতে দিবেনা ও।
-“খাবো!” হঠাৎ এই কথা শুনে বাস্তবে ফিরলো জর্জ। মেয়েটা তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
ল্যাম্পপোস্ট এর হলুদ আলোয় মেয়েটার মায়াবী মুখে দুঃখের ছাপ দেখা যাচ্ছে। এই রে!!
মেয়েটার সাথে এতাক্ষণ ছিলো অথচ মেয়েটা খেয়েছে কি না তাই জিজ্ঞেস করেনি!!!!! মেয়েটা নিশ্চই না খেয়ে আছে অনেক্ষণ ধরে!! কিন্তু মেয়েটার বাবা?
-“তুমি আমার সাথে আমার বাসায় যাবে?” জর্জ মেয়েটাকে প্রশ্ন করলো।
মেয়েটা আবার বললো, “খাবো!”
মেয়েটার দিকে তাকালো জর্জ। ওকে বললো, “আমার সাথে যাবে?”
মেয়েটা তাকালো রাস্তার দিকে। ছোট্ট করে একটা কথাই বললো, “ড্যাডি?”
-“তোমার ড্যাডি আসলে তাকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো। সাথে তোমার আম্মুকেও। ঠিক আছে?”
মেয়েটা আস্তে করে মাথা নাড়লো। মুখে ক্ষিদে ভাবটা ফুটে উঠেছে। খারাপ লাগলো জর্জের। বাসাটা এখান থেকে প্রায় ১০মিনিটের পথ। এই পথটুকু পাড়ি দিতে হবে।
হাত বাড়ালো মেয়েটার দিকে। ছোট্ট মেয়েটা আবার সেই সুন্দর হাসি দিলো। ভালো লাগা কাজ করছে। মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলো জর্জ।
টিনি গলা জড়িয়ে ধরলো জর্জের। গালটা আলতোভাবে টিপে বললো জর্জ টিনিকে,”চল যাই প্রিন্সেস!!!”
জর্জ অবাক হচ্ছে। টিনি কিচ্ছু খাচ্ছেনা। নিজের সাধ্যমতো যা আছে সামনে এনে দিয়েছে টিনির। কিন্তু টিনি খাচ্ছেনা। বারবার বলছে “খাবো।”
কিন্তু খাচ্ছেনা।
সামনে রাখা বিফ স্যান্ডউইচ, চকলেট জ্যাম দিয়ে মাখানো নরম পাউরুটি, আপেলের জুস,ডিম অমলেট, পনির,পাউরুটি টোস্ট,নুডুলস, আর সাথে অরেঞ্জ জুস। তবুও খাচ্ছেনা।
বোধহয় ছোট্ট মেয়েটা এসব খায় না। কিন্তু আর কি আনতে পারে ও? ভাবছে জর্জ।
হঠাৎ মনে হলো ফ্রিজে আইস-ক্রিম আছে। জিজ্ঞেস করলো, “আইস-ক্রিম খাবে প্রিন্সেস?”
কেমন একটা হতাশার চোখে তাকালো টিনি।
ছোট্ট করে মাথা দুলিয়ে বললো, “আচ্ছা”
জর্জ ওকে হাসিমুখে বললো, “একটু বসো! আমি আমার প্রিন্সেসের জন্য খাবার আনছি!!”
ফ্রিজের সামনে গিয়ে ডালাটা খুলে আইস-ক্রিমের বক্সের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে কি যেন মনে পড়ে গেলো ওর।
আচ্ছা!! টিনি ডান দিকের রাস্তা দেখিয়েছিলো না?? জর্জের জানামতে ডান দিকের রাস্তার শেষ হয়েছে জনস স্ট্রিট দিয়ে। ওখানে গত ২০বছর ধরে কেউই থাকেনা। এলাকাটা পরিত্যক্ত।
তাহলে টিনি ওখানকার কথা বললো কেন??
কি জানি!! হয়তো নতুন কেউ ওখানে থাকা শুরু করেছে। তবে টিনির গায়ের পোষাকে বোঝা যাচ্ছে ও গরীব নয়।
ভাবতে ভাবতে ফ্রিজের ডালাটা লাগিয়ে ঘুরতে যাবে এমন সময় চমকে উঠলো জর্জ।
টিনি ঠিক ওর পেছনে দাড়িয়ে।
-“কি হলো প্রিন্সেস?এখানে তুমি?”
টিনি বললো, “খাবো।”
-“আচ্ছা!! এই নাও আইস-ক্রিম,” আইস-ক্রিমের বক্সটা বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে।
হঠাৎ কি যেন ঘটে গেলো। জর্জের হাত ধরে টান দিলো টিনি। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলো জর্জ। ৫বছরের ছোট্ট মেয়ের গায়ে এতো শক্তি এলো কি করে ও বুঝতে পারছেনা।
তবে ওর ভুল ভাঙলো তখনই। টিনির মিষ্টি চেহারা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে মুহুর্তেই।
মায়াবী চোখ দুটোতে এখন আর মায়া নেই। চোখ দুটো সম্পূর্ণ লাল হয়ে গিয়েছে। মুখ অস্বাভাবিক ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। লাল ঠোটের পাশেই দুটো শ্বদন্ত দাঁত দেখা যাচ্ছে।
হাত দুটো বাড়িয়ে শক্ত করে ধরলো টিনি জর্জকে। জর্জ চিৎকার করতে ভুলে গিয়েছে।
টিনির হাত মৃত মানুষের মতো ঠান্ডা।
কিছু বলতে গিয়েও পারলোনা জর্জ। তার আগেই টিনি কামড় বসালো জর্জের ঘাড়ে।
শুষতে লাগলো রক্ত। বুভুক্ষের মতো করে রক্ত পান করতে লাগলো টিনি।
ওর পেটে অনেক দিনের ক্ষিদে। একসময় জর্জ অনেক কষ্টে হাত পা ছুড়ে টিনিকে ছাড়িয়ে ফেললো। মাথা অবশ হয়ে আসছে ওর। ফাঁকা লাগছে।
ফ্রিজের ওপর রাখা ছুরিটা হাতে নিলো খুব কষ্টে। টিনি আবার ঝাপিয়ে পড়লো ওর ওপর।
এবার জর্জ টিনির কানের দিকে আমুলে ছুরিটা বসিয়ে দিলো। টিনি আর্তনাদ করে ছেড়ে দিলো জর্জকে। কান চেপে ধরে বসে পড়েছে টিনি। কালো রক্ত বেয়ে পড়ছে ওর হাত দিয়ে।
জর্জ আর দেখতে পেলোনা কিছু। পড়ে গেলো। ওর চোখ বুজে এসেছে। মৃত্যুকে দেখতে পেলো খুব কাছে থেকে।
রোজি স্যামিনের আজ দেরী হয়ে গিয়েছে অনেক। কাল বাসা শিফট করবে সে। অনেক কাজ বাকি। জিনিসপত্র গুছাতে হবে। বাসায় ঢুকার সময় থেমে গেলো সে। একটা মেয়ে বসে আছে দরজার সামনে। মেয়েটা হাতের আঙুল দিয়ে খেলছে।
মেয়েটাকে দেখে মায়া লাগলো রোজির। মেয়েটার সামনে এসে দাড়ালো রোজি। মেয়েটা খেলছে এক মনে। হাটুর ওপর ভর দিয়ে বসলো রোজি।
মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো,”কি নাম তোমার?”
পাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো, “টিনি প্রিন্সেস ওর নাম,” ঝট করে দাড়িয়ে গেলো রোজি।
-“কে ওখানে?” রাস্তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো রোজি।
-“আমি জর্জ। টিনির বাবা।” অন্ধকার থেকে বাসার গেটের হালকা আলোয় মুখ দেখা গেলো একটা লোকের। রোজি হাসি দিলো একটা।
বিনিময়ে লোকটিও।
তবে খেয়াল করেনি রোজি, হাসার সময় জর্জ নামক লোকটার ঠোটের পাশের শ্বদন্ত দেখা গিয়েছিলো এক পলকের জন্য।।
***************************************** সমাপ্ত **************************************